০৩. আঙ্গিক ও ভাষা (বেদাঙ্গসূত্র)

আঙ্গিক ও ভাষা (বেদাঙ্গসূত্র)

সংহিতা-সাহিত্যের অধিকাংশই পদ্যে ও ব্রাহ্মণ গদ্যে রচিত; আবার আরণ্যক ও উপনিষদ সাহিত্যে গদ্য ও পদ্য উভয়ই ব্যবহৃত হয়েছে। তবে সমগ্ৰ সূত্ৰ-সাহিত্য একটি বিচিত্র ধরনের জটিল, সংক্ষিপ্ত ও সারগর্ভ ভাষায় রচিত হয়েছিল। সূত্রের গদ্য সম্পূর্ণত স্বরন্যাস থেকে মুক্ত হলেও এর ব্যাকরণগত কাঠামো ব্ৰাহ্মণ সাহিত্যের অনুরূপ; অবশ্য প্রাচীনতর সূত্রগুলিতে বাকসংযমের প্রবণতা অনেক বেশি। এতে এই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে ছয় বা সাতশ বছরের মধ্যে মৌখিক গদ্যে কোনও মৌলিক পরিবর্তন ঘটেনি। সাধারণভাবে এ ভাষা উপনিষদ ও তৎপরবর্তী যুগের বৈশিষ্ট্যের ইঙ্গিত বহন করে। শব্দভাণ্ডারে মহাকাব্যিক যুগের লক্ষণ পরিস্ফুট হলেও এর বিপুল অংশ ধ্রুপদী সংস্কৃত ভাষায় তখনই অপ্রচলিত হয়ে গিয়েছিল। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যাকরণ প্রাকপাণিনীয়। সূত্রসাহিত্য মহাভারত সম্পর্কে অবহিত ছিল। আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র ‘ভারত’ ও ‘মহাভারতে’র উল্লেখ করায় মনে হয়, মহাকাব্য রচনার তিনটি মুখ্য দুটির স্তরের সঙ্গেই তা পরিচিত ছিল।

শব্দসংক্ষেপের জন্য লেখকের অতিরিক্ত উদ্বেগ ছিল বলে ক্রিয়া, সর্বনাম, সম্পূরক শব্দ এবং সমস্ত ধরনের বর্জনীয় ক্রিয়াবিশেষণ ও বিশেষণ পরিত্যক্ত হয়েছিল। ফলে যে কর্কশ, সংক্ষিপ্ত ও সাংকেতিক ভাষার সৃষ্টি হল, অনেকসময়েই উপযুক্ত ভাষ্য ব্যতীত তার অর্থবােধ প্রায় অসম্ভব। প্রাথমিকভাবে আনুষ্ঠানিক ক্রিয়া সম্পর্কিত নির্দেশ শিক্ষকরা মৌখিকভাবে দিতেন। বস্তুত, সূত্রসাহিত্যের অধিকাংশ রচনা এমন একটি যুগে উদ্ভূত হয়েছিল যখন লেখন-প্ৰণালী আবিষ্কৃত হলেও ধর্মীয় সাহিত্যের প্রয়োজনে তা তখনো ব্যবহৃত হত না। এবং এই সাহিত্য যে-তিনটি উচ্চতর বর্ণের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, তারা মনে করতেন যে এধরনের সাহিত্যের পক্ষে প্রয়োজনীয় নিগূঢ় রহস্যময় চরিত্র লেখন-পদ্ধতি প্রয়োগের ফলে বিপন্ন হবে। সুতরাং নুতন যুগের সাহিত্যও স্মৃতিতে ধারণ করার জন্য প্রস্তুত করা হল। কিন্তু বিষয়বস্তু স্বভাবত শুষ্ক ও বন্ধ্যা হওয়ার ফলে স্মৃতিশক্তির উপর অতিরিক্ত চাপ পড়ল। তাই বাধ্য হয়েই ভাষাকে সমস্তকিছু পরিহারযোগ্য উপাদান বর্জন করে কেবলমাত্র সেই অংশটুকু রক্ষা করতে হল। যা বিবক্ষিত বস্তুর সঙ্গে সাধারণভাবে পরিচিত জনগোষ্ঠীর কাছে অর্থবহ হয়ে উঠবে। এটা যথার্থ যে গদ্যে রচিত ব্ৰাহ্মণগুলিও স্মৃতিতে ধারণ করা হত; কিন্তু তখন যজ্ঞ অনেক বেশি জীবন্ত ছিল বলে তা সজীবমন ও শক্তিশালী স্মৃতিকে আকর্ষণ করতে সমর্থ ছিল। তাছাড়া সাহিত্যগত ভাবেও ব্রাহ্মণগুলি পরিপূর্ণতর ভাষায় রচিত বলে সহজে স্মরণযোগ্য রচনা ছিল। অন্যদিকে সূত্ৰ-সাহিত্যে দেবকাহিনীর কোনও স্থান ছিল না। যা ব্ৰাহ্মণসাহিত্যকে বহু ক্ষেত্রে সজীবতা দান করেছে; এমনকি এতে কোনও আলঙ্কারিক সৌষ্ঠব বা কাব্যগুণও নেই। উপরন্তু এই শুষ্ক ও নির্জীব সাহিত্য মনুষ্যরচিত বলে স্বীকৃত, তাই পূর্ববর্তী যুগের সাহিত্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সন্ত্রম ও শ্রদ্ধা থেকেও তা পুরোপুরি বঞ্চিত ছিল। সূত্রসাহিত্য মৌখিকভাবে সম্প্রচারিত হত বলে অধ্যায়ের সমাপ্তি স্পষ্ট কুরার জন্য একটি বিশেষ রীতি অবলম্বিত হত : শেষ সূত্রটি ব্রাহ্মণ এবং উপনিষদে প্ৰাপ্ত দৃষ্টান্ত অনুযায়ী অধ্যায় বা বিভাগের শেষে একবার পুনরাবৃত্ত হত, এতেই একটি পরিচ্ছেদ বা অধ্যায়ের অবসান সূচিত হত।