০১. আরণ্যক

আরণ্যক

সাধারণত প্রথাগতভাবে বৈদিক সাহিত্যকে দুটি প্রধানভাগে বিভক্ত করা হয়,–কর্মকাণ্ড (সংহিতা ও ব্রাহ্মণ) এবং জ্ঞানকাণ্ড (আরণ্যক ও উপনিষদ)। এই বর্গীকরণের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বেদের অন্য একটি সংজ্ঞাও স্মরণ করতে পারি : ‘মন্ত্রব্রাহ্মণয়োর্বেদনামধেয়ম’, যেখানে বেদের দুটি ভাগ কল্পিত হয়েছে, মন্ত্র (বা সংহিতা) ও ব্রাহ্মণ। এই বিভাজনে আপাতদৃষ্টিতে আরণ্যক ও উপনিষদ উল্লেখিত হয় নি। দুটি দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই প্রচুর সত্য রয়েছে, তবে, দ্বিতীয় বর্গীকরণে বিষয়বস্তু অপেক্ষা আঙ্গিকের উপরেই যেন অধিক গুরুত্ব আরোপিত হয়েছে। কেননা, সংহিতা নিঃসংশয়ে একটি সাহিত্যমাধ্যম; পরবর্তী রচনাগুলির চরিত্রবৈশিষ্ট্যের সঙ্গে কোনো সাদৃশ্যই তার নেই। ব্রাহ্মণ ও আরণ্যক কিংবা আরণ্যক ও উপনিষদ কিংবা ব্ৰাহ্মণ ও উপনিষদের মধ্যে আমরা তেমন কোনো স্পষ্ট রচনাভঙ্গিগত ভেদরেখা কল্পনা করতে পারি না; মাঝে মাঝে এই তিন শ্রেণীর রচনা পরস্পরের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে মিশ্রিত হয়ে পরস্পরের সীমা লঙ্ঘন করেছে। ফলে, মাধ্যমগত বিন্যাস অনুযায়ী আমাদের নিকট দুটি প্রধান ও স্পষ্ট শ্রেণী প্রকট হয়েছে-সংহিতা ও সংহিতাপরবর্তী সাহিত্য, যাতে ব্ৰাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ ইচ্ছামতো সন্নিবেশিত হয়েছে। তবে, শ্রেণীবিন্যাসের দ্বিতীয় রীতি অর্থাৎ সৎহিতা পরবর্তী সাহিত্যিই অধিক গুরুত্বপূর্ণ কারণ এতে দুটি ভিন্ন যুগ, অঞ্চল বা ধর্মীয় দর্শনের মূল প্রতিফলিত হয়েছে। জ্ঞানকাণ্ডের সমগ্ৰ যুগ ধরে যজ্ঞানুষ্ঠানের ক্রমাগত অবমূল্যায়নের ফলে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

যদিও প্রত্যেক সংহিতার এক বা একাধিক পৃথক ব্ৰাহ্মণ রয়েছে, তবু প্ৰত্যেক সংহিতার কিন্তু নিজস্ব আরণ্যক বা উপনিষদ নেই। কয়েকটি গ্রন্থ। ব্রাহ্মণ অংশেই সমাপ্ত, আবার কয়েকটি গ্রন্থের সমাপ্তি ঘটেছে আরণ্যকে। তেমনি কয়েকটি সংহিতার অব্যবহিত পরবর্তী অংশ হ’ল উপনিষদ, আবার কয়েকটিতে কোনো আরণ্যকই নেই। শুধুমাত্র তিনটি ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ-সবই পাওয়া যাচ্ছে: ঋগ্বেদের ঐতরেয় ও কৌষীতকি এবং যজ্ববেদের তৈত্তিরীয়। সুতরাং যে শ্রেণীবিন্যাস অনুযায়ী রচনার প্রধান এবং সর্বতোভাবে পরস্পর-নিরপেক্ষ দুটি মাধ্যম অৰ্থাৎ সংহিতা ও ব্ৰাহ্মণকে নির্দেশ করা হয়েছে, তারই যুক্তিযুক্ততা অবশ্যই স্বীকার করা উচিত। শেষোক্ত সাহিত্যরীতির তরল্যায়িত অবস্থা একটি গ্রন্থের যৌগিক নামকরণে ব্যক্তি হয়েছে : কৌষীতকি ব্ৰাহ্মাণোপণিষদ; লক্ষণীয় এই যে, এতে আরণ্যক উল্লেখিত হয় নি। তেমনি জৈমিনীয় উপনিষদ, ব্ৰাহ্মণেও আরণ্যকের উল্লেখ নেই; তাছাড়া ‘ব্রাহ্মণ’ শব্দটি এখানে উপনিষদের পরে ব্যবহৃত হয়েছে। সমগ্র গ্রন্থটি বিচার করলে দেখা যায় যে, তালবকার শাখার আরণ্যকের বৈশিষ্ট্য এই গ্রন্থে মূর্ত হয়ে উঠেছে। এসব থেকে সেই স্তরের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, যখন লেখকেরা নতুন ধরনের সাহিত্যিক প্রবণতা সম্পর্কে ক্রমশ সচেতন হয়ে উঠছিলেন, কিন্তু পৃথক মাধ্যমরূপে নতুন রচনাগুলি তখনও নির্দেশিত বা বগীকৃত হয় নি। আরণ্যক নামটি সম্ভবত শুধু রচনার স্থানগত তাৎপৰ্যই বহন করছে, অর্থাৎ অরণ্যভূমি যা বহু অনুপুঙ্খাযুক্ত সুদীর্ঘ যজ্ঞানুষ্ঠানের ব্যবস্থাপনার পক্ষে মোটেই উপযুক্ত ছিল না; সেখানে অবসরপ্রাপ্ত গৃহস্ত্যদের উপযুক্ত ন্যূনতম কিছু অনুষ্ঠানের আয়োজন করা সম্ভবত হত, যার মধ্যে সম্ভবত ছিল অগ্নিহোত্র ও কিছু কিছু সরল গাৰ্হস্থ্য অনুষ্ঠান। এখানে যজ্ঞ থেকে উত্তীর্ণ ধর্মচারণ অর্থাৎ তত্ত্বান্বেষণের চর্চাই হত।

বিখ্যাত ভারততত্ত্ববিদ গোল্ডস্টুকের আমাদের এই তথ্যের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন যে, শুধু অরণ্যে বসবাসকারী ব্যক্তি অর্থেই পাণিনি ‘আরণ্যক’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। ‘অরণ্যে রচিত গ্ৰন্থ’ অর্থে ‘আরণ্যক’ শব্দের প্রথম প্রয়োগ করেছিলেন কাত্যায়ন–আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে; সুতরাং বোঝা যাচ্ছে যে, ঐ সময়ের কাছাকাছি আরণ্যক পৃথক প্রকাশ মাধ্যমরূপে স্বীকৃত হয়ে গিয়েছিল। আঙ্গিক ও মূলভাবের বিচারে আরণ্যক ও উপনিষদকে যুগ পরিবর্তনের সাহিত্য বলে গণ্য করা যায়। আরণ্যকের প্রবণতা অরণ্যভূমির অধিবাসীদের জ্ঞান ও সন্ন্যাসের অন্বেষণের প্রতি, কারণ তখনও স্পষ্টভাবে কোনো মতবাদ এরা প্রচার করে নি; অথচ পরবর্তী যুগের উপনিষদে কখনাে নূতন মতবাদ প্রকাশের তাগিদ পরিস্ফুট হয়েছে।