ইতিহাস (ব্রাহ্মণ)
ব্ৰাহ্মণ সাহিত্যই আমাদের নিকট ইতিহাস ও ভূগোলের প্রথম দ্ব্যর্থবিহীন উৎসরূপে পরিগণিত, কেননা সংহিতা খুব কম ক্ষেত্রেই নিঃসংশয় তথ্যের জোগান দিতে পেরেছে। ব্ৰাহ্মণে আমরা লক্ষ্য করি যে, আর্যরা ক্রমশ দক্ষিণ ও পূর্বদিকে অগ্রসর হচ্ছেন। শতপথ ব্ৰাহ্মণের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে (১ : ৪ : ১ : ১০-১৪) কথিত হয়েছে, ‘রাজা বিদেঘ মাধব তার পুরোহিত গৌতম রহুগণকে বৈশ্বানর অগ্নি-সহ অগ্রসর হতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তারা সরস্বতী নদীর পূর্বতীর থেকে ক্ৰমাগত ভ্ৰমণ করে। সদানীরা নদীর উত্তর তীরে উপনীত হয়ে থেমে গিয়েছিলেন । প্রাচীনতর পুরোহিতেরা যেহেতু বৈশ্বােনর অগ্নি-সহ সদানীরা নদী অতিক্রম করেন নি, তারাও সে-চেষ্টা করলেন না।’ এই আখ্যানে প্রকৃতপক্ষে আর্যদের দক্ষিণপূর্ব দিকে বসতি বিস্তারের ইতিহাস প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে; ঐ সময় তারা কর্ষণযোগ্য জমির প্রয়োজনে জলাভূমি ও পতিত অঞ্চল এবং অরণ্যভূমিকে অগ্নিসাৎ করছিলেন। বৈশ্বানর অগ্নি একটি যথার্থ প্রতীক; কৃষিকার্য ও যজ্ঞের প্রয়োজনে বিপুল অঞ্চলকে অগ্নিদগ্ধ করার নিদর্শন। এখানে রয়েছে। প্রাগুক্ত আখ্যানে পুরোহিত রাজাদের নিবাসের জন্য কোশল ও বিদেহের পূর্ব সীমান্তকে নির্দেশ করেছিলেন। এই দুটি স্থাননামের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ অনুধাবনযোগ্য; কোশল মানে হ’ল যে স্থানে প্রচুর ঘাস পাওয়া যায়, অর্থাৎ চমৎকার গোচারণভূমি, যেখানে গোসম্পদের জন্য বিপুল খাদ্যের নিশ্চিত জোগান রয়েছে। আবার, বিদেহ মানে হ’ল পাহাড়ের আড়াল নেই এমন সমভূমি, অর্থাৎ বিহার ও বাংলার গঙ্গাবিধৌত উপত্যকা। শতপথের অন্যত্রও কথিত হয়েছে, দিনানুদিনের ক্রমাগত চেষ্টায় অগ্নিকে দক্ষিণ দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
প্ৰাগাৰ্যদের উপর আর্যদের চূড়ান্ত জয়লাভ থেকে বৌদ্ধধর্মের উত্থান পর্যন্ত ব্যাপ্ত দীর্ঘ সময়ের ইতিবৃত্ত ব্ৰাহ্মণ সাহিত্যে প্রতিফলিত। এই চার বা পাঁচ শতাব্দীর মধ্যে আর্যরা পাঞ্জাব থেকে উত্তর-বঙ্গ পর্যন্ত সমগ্ৰ অঞ্চল অধিকার করে নিয়েছিলেন। এই প্রক্রিয়াটি ছিল শ্রমসাধ্য, দীর্ঘািয়ত ও নানাবিধ বিপদে আকীর্ণ; আর্যদের দুঃসাহসী মানসতার প্রকৃত প্ৰমাণ এতে পাওয়া যাচ্ছে।
ব্ৰাহ্মণ সাহিত্যের নবীনতম গ্রন্থগুলির অন্যতম শতপথ ব্ৰাহ্মণ সেই সময়ে রচিত হয়েছিল, যখন লোহার লাঙলের প্রবর্তন ও অন্যান্য কিছু উপাদানের অস্তিত্বের ফলে নানাদিকে বিপুল পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল। অগ্নি প্ৰজ্বলন করে নিবিড় অরণ্য ধ্বংস করাকে সংক্ষিপ্ত চাষের পক্ষে প্রয়োজনীয় পদ্ধতিরূপে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। এই কৃষিপদ্ধতিতে বিভিন্ন ফসলের মধ্যে সময়ের ব্যবধান সংক্ষিপ্ততার হওয়াই ছিল কাম্য, কিন্তু সেজন্য উপযুক্ত লাঙল, হলবাহী পশু ও বহুব্যাপ্ত কৃষিব্যবস্থার প্রয়োজন অনিবাৰ্য।
ব্ৰাহ্মণসাহিত্যে প্ৰাপ্ত নামগুলি আলোচনা করে এবং ভাষাপ্রয়োগের মধ্যে প্রতিফলিত ভাষাগত বিবর্তন বিশ্লেষণ করে আমরা বুঝতে পারি, কৃষিব্যবস্থা পরিণত পর্যায়ে পৌছানোর প্রক্রিয়া কতটা দীর্ঘায়িত হয়েছিল এবং কোন কোন অঞ্চলে আর্যরা বসতি স্থাপন করেছিলেন। পুরাতত্ত্ববিদদের খননকার্যের ফলে যে সমস্ত নিদর্শন এখনো পর্যন্ত পাওয়া গেছে, তা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, সিন্ধু উপত্যকার সৎ গা বিকশিত হয়েছিল আধুনিক সিন্ধুপ্রদেশ, পাঞ্জাব, গুজরাট ও মহারাষ্ট্রের কিছু কিছু অঞ্চলে। উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্ৰদেশ, রাজস্থান ও বিহারের অনেকাংশেই প্রকৃতপক্ষে সিন্ধুসভ্যতার বলয়বহির্ভুত ছিল। আর্যরা পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশ থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে সোজাসুজি যাত্রা করেছিলেন; তাদের এই যাত্রার নিদর্শন রয়েছে ব্ৰাহ্মণ সাহিত্যে উল্লিখিত স্থাননামগুলিতে। আমরা উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে (কাশ্মীর, কফিরিস্তান, কান্দাহার) গান্ধার, কাম্বোজ, উশীনার ও মদ্র, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ অঞ্চলে কুরু, পাঞ্চাল, চেন্দি, কাশী, বংস (বা বৎস), কোশল, বিদেহ ও বিদৰ্ভ; গুজরাটে শূরসেন, রাজস্থানে সৌরাষ্ট্র, মৎস্য, শম্ব, বৈরাট এবং বিহার-বঙ্গে অঙ্গ ও মগধের উল্লেখ পাচ্ছি। প্রাচীন গ্রিসের নগর-রাষ্ট্রের মতো প্রাথমিক বৈদিক যুগের রাষ্ট্র ছিল ক্ষুদ্রাকৃতি–আধুনিক জেলার ভৌগোলিক পরিধির চেয়ে তা ব্যাপকতর ছিল না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাষ্ট্র ছিল কৌম উৎসজাত ।
সিন্ধু-উপত্যকা সভ্যতার প্রত্যক্ষ প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের বহির্ভূত অঞ্চলগুলিতেও বিভিন্ন কৌম গোষ্ঠীর বসতিতে তাদের নিজস্ব ধরনের প্রশাসন ছিল; সেখানেই আৰ্যদের অভিযান হােক না কেন, এই জনগোষ্ঠীগুলি নিশ্চয়ই প্রতিরোধ তৈরি করেছিল এবং আদিম অধিবাসীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক ও দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে আর্যদের প্রবৃত্ত হতে হয়েছিল। বিন্ধ্য পর্বতমালার সংলগ্ন অঞ্চলে সম্পূর্ণ জনবসতিশূন্য বা অতিসামান্য বসতিযুক্ত যে বিপুল অরণ্যভূমি ছিল, আর্যদের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে (সংহিতা সাহিত্যে যার বিবরণ লক্ষ্য করা যায়) কিংবা যুদ্ধের সময়ে আদিম জনগোষ্ঠীগুলি সেখানে নিরাপত্তা ও আশ্রয়ের জন্য পালিয়ে গিয়েছিল। এদের অনেকেই পরাজয়ের ফলে আর্যদের দাসে (বা ‘দস্যু’তে) পরিণত হ’ল, কেউ কেউ বশ্যতা স্বীকার করে নিল, কেউ বা অন্যত্র চলে গেল। আৰ্যরা অক্লান্তভাবে তাদের জয়লাভের ফলকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য কখনো পূর্বতন অধিবাসীদের পশ্চাদ্ধাবন করে তাড়িয়ে দিল, কখনো পতিত জমি বা অরণ্যভূমি পুড়িয়ে দিল, কখনো বা পরাজিত শক্রকে আর্যীকরণের মাধ্যমে নিজেদের সাংস্কৃতিক বৃত্তের অন্তর্ভুক্ত করে নিল বা মিশ্র বিবাহের মাধ্যমে আরো বহু কৌমকে ক্রমশ আত্মসাৎ করে নিল । ব্ৰাহ্মণসাহিত্যে এই প্রক্রিয়াই লিপিবদ্ধ হয়েছে। এই প্রক্রিয়া থাকার সময়েই যেসমস্ত নুতন সামাজিক বৈশিষ্ট্য প্রকট হ’ল, তাদের মধ্যে রয়েছে : বহু রাজতন্ত্রের উত্থান, স্পষ্টভাবে সীমানির্দিষ্ট (পর্বত, নদী বা অরণ্যের মতো প্ৰাকৃতিক সীমারেখা দ্বারা নিরাপিত) ভূমিভাগ, ক্ষুদ্র রাজ্য ও প্রাচীরবেষ্টিত নগরের পত্তন, ব্যবসায়ীদের সঙ্ঘ ও বহুবিধ বৃক্তিজীবী গোষ্ঠীর আবির্ভাব, নূতন নূতন প্রশাসনিক কাৰ্যপদ্ধতির সূত্রপাত, অন্তত প্ৰথম পর্যায়ের তিন বা চার শতাব্দী-ব্যাপী সুদৃঢ় অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, কৃষিকাৰ্য, পশুপালন আর অন্তর্দেশীয় ও বহির্দেশীয় ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার।
পাণিনি উত্তরাপথ, তক্ষশীলা ও তাম্রলিপ্তের মধ্যে বাণিজ্য-পথ এবং নানা মূল্যমানের ও নানা অভিধাযুক্ত মুদ্রার উল্লেখ করেছেন। এ থেকে প্রমাণিত হচ্ছে যে, সে সময় বিপুল বাণিজ্যের অস্তিত্ব ছিল এবং সমাজে সম্পদের বৃদ্ধি ঘটেছিল। পরবর্তী যুগে অর্থনীতি জটিলতর হয়ে ওঠে, ক্রমবর্ধমান নগরায়ণের প্রবণতা থেকে একদিকে ধনবান বণিক ও ব্যবসায়ী এবং অন্যদিকে দরিদ্র প্রাথমিক উৎপাদকের মধ্যে দেখা দেয়া ব্যাপকতর ব্যবধান। বৃত্তিগুলির মধ্যে সঞ্চরণশীলতা ক্রমাগত অধিকতর সংকুচিত হওয়ার ফলে সমাজের নিম্নস্তরে অতি দরিদ্র শ্রেণীর উদ্ভব হয়, যাদের জীবন নির্বাহের জন্য কোনো পথই উন্মুক্ত ছিল না। অন্যভাবে বলা যায়, নিঃস্ব ও জীবিকাহীন শ্রেণীর শোষিত হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল। এসমস্ত কিছুরই অনিবাৰ্থ পরিণতিরীপে উপসিং-গঠনে বিপুল পরিবর্তন সূচিত হ’ল এবং সামাজিক, রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক উচ্চাকাঙক্ষার অভিব্যক্তিতে, ভাবনার জগতে দেখা গেল নুতন তরঙ্গাভিঘাত।
ব্ৰাহ্মণ সাহিত্য থেকে সংগৃহীত ঐতিহাসিক তথ্য দ্বিবিধ : প্রচ্ছন্ন ও প্রকাশ্য। যুদ্ধে প্ৰাগাৰ্যরা নিশ্চিতভাবে পরাভূত হওয়ার পর সমাজে সাধারণভাবে যে শান্তি ও নিরাপত্তার পরিবেশ তৈরি হল, তা ব্ৰাহ্মণ সাহিত্যের নানা মন্তব্যে পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। কৌষীতকি ব্ৰাহ্মণের দুটি দেবকাহিনীতে (১২ : ১, ২) জলপথ-প্রহরারত অনার্যদের বিরুদ্ধে আৰ্যদের যুদ্ধের পর্যায় এবং নুতন ধরনের লৌহনির্মিত অস্ত্ৰ (বাজ) প্রয়োগের ফলে ব্রোঞ্জ ব্যবহারকারীদের পরাজয় প্রতিফলিত হয়েছে। বহু ব্ৰাহ্মণগ্রন্থে, বিশেষত তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে, আমরা প্রায়ই এমন কিছু অনুষ্ঠান নির্দেশিত হতে দেখি, যেগুলির সাহায্যে কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষী মানুষ নিজের জন্য একটি রাজ্য জয় করে নিতে পারে। বিভিন্ন উপাখ্যান, গল্প, লোকশ্রুতি এবং দীর্ঘ যজ্ঞানুষ্ঠানের সময়ে কথিত ‘পরিপ্লব’ কাহিনীগুলিও ইতিহাসের মূল্যবান উৎস।
‘পরিপ্লব’ শতপথ ব্ৰাহ্মণ [ ১৩ : ৪ : ৩ : ২ ] শব্দটির অর্থ হ’ল পুনরাবৃত্তিময় ও বৃত্তাকারে আবর্তনশীল লোকশ্রুতি; এরূপ অভিধার কারণ, যজ্ঞানুষ্ঠানের বছরে প্রতি দশ দিন, অন্তর প্রাচীন লোকশ্রুতি বৰ্ণনা শুরু করা হত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, শতপথে যে বাক্যে ‘পারিপ্লব’ শব্দটি পাই, তার ঠিক পরবর্তী বাক্যেই ‘পুরাণ’ শব্দের ব্যবহার আমরা লক্ষ্য করি। মানবজাতির প্রত্নপৌরাণিক আদিপিতা মনুর বৃত্তান্ত দিয়ে প্ৰাচীন লোকশ্রুতির বিবরণ শুরু হয়েছে। বৈদিক সাহিত্য সম্পর্কে শিক্ষাগ্ৰহণ করার জন্য যে গৃহস্থ একত্র সম্মিলিত হতেন, তারাই ছিলেন শ্রোতা। খুবই তাৎপৰ্যপূর্ণ যে, প্রকৃতপক্ষে যা বর্ণনা করা হত—তা স্বভাববৈশিষ্ট্যে অবৈদিক লোকশ্রুতি। আদিপিতা মনু থেকে সঞ্জাত ক্ৰমিক প্রজন্মগুলির বিবরণে যে সমস্ত নামের উল্লেখ পাওয়া যায়, তাদের মধ্যে অনেকগুলিই ব্যাবিলন ও মিশরের ঐতিহাসিক নৃপতিরূপে অনুমিত। এতে প্রমাণ হচ্ছে যে, মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে নৌবাণিজ্য ও সাংস্কটিক যোগাযোগ ছিল বলেই এই সব ব্যক্তিদের সঙ্গে এতটা পরিচয় গড়ে উঠেছিল এবং এক-সময়ে তাঁরা আর্যদের পবিত্র লোকশ্রুতির অন্তর্ভুক্ত হন।
বিলম্বে আগত মহাকাব্যিক ও ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের উল্লেখ থেকে (যেমন : জনমেজয়, পরীক্ষিৎ, শৌনক, ভীমসেন, শ্রুতসেন, পুরুকুৎস, মরুত্ত, অবিক্ষিত) শতপথ ব্ৰাহ্মণের নবীনতা প্রমাণিত হয়। লোকশ্রুতির অন্তৰ্গত বিভিন্ন রাজার বীরত্বকাহিনী সম্ভবত কতকটা অতিরঞ্জিতভাবেই উল্লিখিত হয়েছে। মহাকাব্যিক ও মহাকাব্যোপম নামগুলির (দ্বৈতবন, মৎস্য, ভরত, দুষ্যন্তপুত্র, সুদ্যুন্ন, শকুন্তলা, কাশী, শতানীক, সত্ৰাজিৎ, সাত্বত, ধৃতরাষ্ট্র) উল্লেখ থেকে বুঝতে পারি, শতপথ ব্ৰাহ্মণ নবীনতম রচনাসমূহের অন্যতম। পূর্বাঞ্চলকে এখানে (১৩ : ৮ : ২ : ১) অসুরদেশ রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। অন্য এক শ্রেণীর ঐতিহাসিক তথ্য আধুনিক অর্থেই ইতিহাসপদবাচ্য, অর্থাৎ সেখানে প্রকৃত ঐতিহাসিক ব্যক্তি ও ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। অধিকাংশ গবেষক এক মত যে, মহাভারতের যুদ্ধ যদি সত্যই ঘটে থাকে, তবে তা খ্রিস্টপূর্ব ৯০০ অব্দের কাছাকাছি সময়ে হয়েছিল। তখন সংহিতা রচনা শেষ পর্যায়ে। ব্ৰাহ্মণে কথিত হয়েছে যে, দুষ্যন্তপুত্র ভরত গঙ্গা ও যমুনা নদীর তীরে যজ্ঞ করেছিলেন; একই স্তবকে ইলাপুত্র পু্রূরবারও উল্লেখ রয়েছে।
ব্ৰাহ্মণ ও উপনিষদ সাহিত্যে বেশ কিছু বংশতালিকা পাওয়া যায়। শতপথ ও বংশ ব্রাহ্মণের মধ্যে প্রাপ্ত নিদর্শন ছাড়াও অন্যত্র যে সমস্ত তালিকা পাওয়া যায়, সেগুলির সঙ্গে সমসাময়িক বৌদ্ধ নথিপত্রের বিষয়বস্তুর যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে। যেমন, বিখ্যাত বৌদ্ধ গ্ৰন্থ মজবিমনিকায়ে আশ্বলায়নকে বিখ্যাত বেদবিশেষজ্ঞ রূপে উল্লেখ করা হয়েছে, কৌষীতকি উপনিষদে পরিবেশিত তথ্যও এর অনুরূপ। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে পরীক্ষিৎ-পুত্ৰ জনমেজয় (যাঁকে দেব-দানবের মধ্যে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও সর্বভূ বলা হয়েছে) কর্তৃক সমগ্ৰ পৃথিবী জয় ও অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান বিবৃত হয়েছে। শতপথে (৫ : ১ : ১ : ১২-১৩) বিদেহরাজ জনককে যখন সম্রাট বলা হচ্ছে, সেসময়ে কুরুরাজদের নিছক ‘রাজা’ বলেই বর্ণনা করা হয়েছে। [ ঐতরেয় ৮ : ১৪; পঞ্চবিংশ ১৪ : ১ : ১২ ]। সম্ভবত, এতে বিদেহের উত্থান ও কুরুর অবনমন সূচিত, কেননা ব্ৰাহ্মণ সাহিত্যের বিভিন্ন অংশে দেখা যায়, সে-যুগে এ-ধরনের বিশেষণগুলির সুস্পষ্ট ও স্বতন্ত্র তাৎপৰ্য ছিল। ক্রমশ কুরুরাজ্যের সাংস্কৃতিক গৌরবও বিলীন হয়ে যাচ্ছিল, যেহেতু এই যুগের শেষ পর্যায়ে কুরুরাজ্যের পণ্ডিতরা বিদ্যার্থীরূপে বিদেহ রাজসভায় উপস্থিত হচ্ছিলেন, আধ্যাত্মিক জ্ঞানের জন্যই শুধু তারা আকাঙক্ষী নন, অনুষ্ঠান পরিচালন সংক্রান্ত প্রশিক্ষণও তাদের কাম্য। সম্ভবত, এই যুগেই সূচিত হয় পার্থিব জীবনের লাঞ্ছনা, শস্যহানি ও তজনিত দুর্ভিক্ষ [ ছান্দোগ্য উপনিষদ, ১ : ১০ : ১৭ ]। হয়ত বা সেই একদা-সমৃদ্ধ জনতা তখন গোষ্ঠীবদ্ধভাবে পূর্বদিকে অভিপ্রয়াণ করে; পরবর্তী যুগের সাহিত্যে সেই বিপুল ও তাৎপৰ্যপূৰ্ণ আত্মিক আলোড়নের নিদর্শন পাওয়া যায়, যার ফলস্বরূপ নুতন নুতন ভাবধারার উন্মেষ ঘটে। উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে কম্বোজ বৈদিক বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করার ফলে ক্রমশ বৈদিকযুগের অন্তিম পর্বে সম্মুখ-সারিতে উপস্থিত হয়।
বংশ-ব্রাহ্মণ কম্বোজের ঔপমন্যব নামে জনৈক শিক্ষকের কথা উল্লেখ করেছে। কম্বোজ কৌমাবদ্ধ আৰ্য জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত ছিল না; সেখানকার ভাষাও যে ভিন্ন ছিল, তা পরবর্তী বৌদ্ধ ও মহাকাব্যিক সাহিত্যের নিদর্শন থেকে বোঝা যায়। উত্তরকুরু অঞ্চলটি বিশেষ সম্মান ভোগ করত; এটিকে সাধারণ ভুগোলের পরিধির বাইরে রাখা হয়েছে (ঐতরেয় ব্ৰাহ্মণ ৮ : ২৯)। আমরা যে সমস্ত রাজার উল্লেখ পাই, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হ’ল বিদর্ভের ভীম, গান্ধারের নগ্নাজিৎ, সৃঞ্জয়, কৌমের সোমক (যাঁর অন্য নাম সোমক সহদেব সৃঞ্জয়), ইন্দ্রের ব্যবহার্য অনুলেপে অভিষিক্ত দুমূখ পাঞ্চাল, বভ্রূ, দৈবাবৃধ ইত্যাদি। ব্ৰাহ্মণ-সাহিত্যের বিভিন্ন স্তবকে প্রাপ্ত স্থাননামগুলি যেমন বাস্তব রাজ্য, নগর বা রাজধানীর পরিচয় বহন করছে, তেমনি ঐ নামগুলির মধ্যেও ঐতিহাসিক ব্যক্তিবর্গের পরিচয় নিহিত। ব্রাহ্মণ সাহিত্যে প্ৰসঙ্গক্রমে ইতিহাস পরিবেশিত হয়েছে; সুতরাং, পুরাণের মতে তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ইতিহাসকে বিকৃত করেনি–ব্ৰাহ্মণের সাক্ষ্য তাই ইতিহাসের ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য।
সাত্বতরা দক্ষিণাঞ্চলের একটি জনগােষ্ঠীর উল্লেখ করেছে, যাদের সঙ্গে ভোজ নামে পরিচিত ঐতিহাসিক জনগোষ্ঠীর সম্পর্ক ছিল; এই উভয় হ’ল যদুকৌমের দুটি শাখা। ব্রাহ্মণের বিভিন্ন অংশে প্রায়ই বিভিন্ন সামাজিক কৌমের পরিচয় ও তাদের সংঘর্ষ প্ৰতিফলিত হয়েছে : সৃঞ্জয় গোষ্ঠী থেকে জনৈক কুরুরাজার পলায়ণ বা গোষ্ঠীগত বিষয়ে কুরুদের দ্বারা দালভ্যকে ভৎসনা ইত্যাদি। কৌমগুলি ক্রমশ ক্ষুদ্রতর হয়ে আসছিল এবং যখন মধ্যম ও বৃহৎ রাজ্যগুলি সেইসব বিজয়ী গোষ্ঠীপতিদের দ্বারা অধিকৃত হ’ল তখন সমগ্ৰ উত্তর ও মধ্য ভারতের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট দ্রুত পরিবর্তিত হয়ে গেল।