০৮. সমাজ (অথর্ববেদ সংহিতা)

সমাজ (অথর্ববেদ সংহিতা)

সামাজিক জীবন সম্পর্কিত সূক্তগুলির মধ্যে যে সমস্ত বিষয়ে প্রার্থনা রয়েছে, তার মধ্যে নিম্নোক্ত বিষয়গুলি উল্লেখযোগ্য :–সমৃদ্ধি, সন্তানের স্বাস্থ্য, গোধন, যথাকলে বৃষ্টি, ভূমির উর্বরতা, পর্যাপ্ত শস্য, সম্পদবৃদ্ধি, ব্যবসা-বাণিজ্যে সাফল্য, গৃহ ও শস্যক্ষেত্রের নিরাপত্তা, বিদ্যুৎ ও অগ্নিভয়-জনিত শস্যহানির আশঙ্কা থেকে রক্ষা, সৰ্পদংশন, আকস্মিক মৃত্যু, শক্রির আক্রমণ ও ধ্বংসপ্রবণ দানবশক্তির বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা প্রভৃতি। এই সমস্ত বিষয়সূচী থেকে স্পষ্টতই কৃষিজীবী সমাজের চিত্রটিই পরিস্ফুট হয়ে ওঠে, যার অভীষ্ট ছিল সমৃদ্ধি ও পরিপূর্ণ শষ্যভাণ্ডার। সমস্ত কৃষিজীবী সমাজে আতিথেয়তা অবশ্য পালনীয় কর্তব্য বলে বিবেচিত হ’ত অথর্ববেদও এবিষয়ে অত্যন্ত স্পষ্ট অভিমত পোষণ করে। অতিথিসেবা পবিত্ৰ সামাজিক কর্তব্য বলে বিবেচিত হয়েছে। স্পষ্টতই এই প্ৰথা স্থায়ীভাবে বসবাসকারী ও উপনিবেশের প্ৰতিষ্ঠাতা আর্যদের বিশ্ববীক্ষারই নিদর্শন। আর্যরা তখনও যথেষ্ট সঞ্চরণশীল ছিলেন বলে স্থায়ী গৃহস্থদের সমৃদ্ধির ওপর নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে কতকটা নির্ভরশীল ছিলেন। অতিথিদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত দানগুলির তালিকা থেকে মনে হয় যে, অপরিচিত গ্রামবাসীদের মধ্যে স্থায়ীভারে বসবাস করার জন্যে প্রয়োজনীয় সাহায্য নবাগত ব্যক্তিকে দেওয়া হ’ত ।

খাদ্য বা অন্নকে উজ্জ্বল ভাষায় প্রশংসা করা হয়েছে; তাই আমরা উষ্ণ, পীতবর্ণ ও পুষ্টিকর অন্নে পূর্ণ থালার বর্ণনা পাই, যা স্বয়ং সূর্যের প্রতীক হয়ে উঠেছিল, কেননা পরোক্ষভাবে সমস্ত খাদ্যই সূর্য থেকে উৎপন্ন। জীবনীশক্তি, যে রহস্য-গূঢ় সত্ত্বা প্ৰাণ থেকে প্রাণহীনকে পৃথক করে, অন্ন থেকেই তা’ উৎপন্ন হয়। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে নববধূর প্রতি যে ধরণের আশীর্বাদ বর্ষিত হয়েছিল, তা থেকে মনে হয় যে সেই সময়ের সমাজ থেকে অথর্ববেদের সমাজ গুণগতভাবে ভিন্ন। প্রতিষ্ঠাপনসূক্ত এবং অন্যান্য বিচ্ছিন্ন নিদর্শন থেকে বোঝা যায় যে, নারী সেই সমাজে স্বাধীনতা ও মর্যাদা হারিয়ে ফেলেছে। তবে বিধবা-বিবাহের সুস্পষ্ট উল্লেখ। অথর্ববেদে পাওয়া যায় (৫। ১৭। ৮; ৯ । ৫। ২৭); আবার সতীদাহের উল্লেখও এতে আছে (১৮।৩।১,৩)

কৃষিব্যবস্থার বিবিধ দিকসম্পর্কিত সূক্তগুলির প্রয়োগ অথর্ববেদের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। ঋগ্বেদের অধিকাংশই আর্যদের কৃষিজীবী হয়ে ওঠার পূর্বে রচিত; সেইজন্য গোধন, অন্যান্য পশু ও অশ্বের বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার জন্য বহু সূক্ত নিবেদিত হলেও কৃষিকাৰ্য সম্পর্কিত সূক্ত বিরল। অথর্ববেদে প্রায়ই আমরা অনেক নতুন নামের উদ্ভিদ ও নানা ঐন্দ্ৰজালিক প্রক্রিয়ায় সেগুলির ব্যবহার দেখতে পাই। এই পর্যায়ে ‘গোধন’ ‘সম্পদে’র প্রতিশব্দ হয়ে পড়েছে এবং অনেক প্রার্থনায় তাদের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, সংখ্যাবৃদ্ধি, ব্যাধিপ্ৰতিকার ইত্যাদি বিষয়ে সমাজের উদ্বেগ প্রতিফলিত। কৃষিকার্যে প্রয়োজনীয় পশুদের প্রতি মনোযোগ খুবই স্বাভাবিক, কেননা অথর্ববেদ মূলত সেই জনগোষ্ঠীর দ্বারা রচিত যাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি কৃষিব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল। সমৃদ্ধি ও দীর্ঘায়ুর জন্য সাধারণ প্রার্থনা ছাড়াও রক্ষাকবচ, প্রলেপ, মায়াঞ্জনের ব্যবহার, গোদান ও ‘মহাব্রীহি’ প্ৰভৃতি সামাজিক প্রথার অস্তিত্ব, জ্ঞান ও মেধার জন্যে প্রার্থনা এবং সেইসঙ্গে গৃহনির্মাণের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী মঙ্গলবিধানের আকাঙক্ষায় প্রার্থনা বিবিধ প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ে নিরাপত্তার জন্যে প্রার্থনা,–সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের বিভিন্ন দিকের পরিচয় বহন করছে। সভা ও সমিতির উল্লেখ থেকে স্বায়ত্তশাসন, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের অস্তিত্ব এবং দক্ষ প্রশাসন ব্যবস্থার প্রয়োজন সম্পর্কে আমরা অবহিত হই। অথর্ববেদের পুরোহিত রাজার সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন ব’লে এ প্রন্থে প্রশাসনের বিভিন্ন দিকের উল্লেখ থাকা খুবই স্বাভাবিক। যে যুগে সমগ্ৰ উত্তর ভারত অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত ছিল এবং প্রত্যেক রাজাই প্ৰতিবেশীর রাজ্য গ্ৰাস করে নিজের রাজনৈতিক ক্ষমতা, প্রতিপত্তি ও ঐশ্বৰ্য বৃদ্ধির জন্যে উৎসুক ছিলেন, সে যুগে অথর্ববেদের পুরোহিতের ভূমিকা স্বাভাবিকভাবেই অংশত রাজনৈতিক মাত্রা পেয়ে গিয়েছিল। শত্রুকে পরাস্ত করার জন্যে ঐন্দ্ৰজালিক ক্রিয়ার ব্যবস্থা করা ছাড়াও পুরোহিতকে রাজ্যাভিষেক বা সৈন্যাভিযানের সময়ে সর্বাত্মক দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্ৰহণ করতে হত। সামাজিক শ্রেণীরূপে ক্ষত্রিয়দের উত্থান ও প্রাধান্য অথৰ্ববেদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক। সোমযাগগুলি বিশদ ও দীর্ঘায়িত হয়ে ওঠার যুগে রাজন্য। শ্রেণীর প্রাধান্যলাভ খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার, কেননা প্ৰভূত ব্যয়সাধ্য ও অতিরিক্ত মাত্রায় দীর্ঘায়ত যজ্ঞানুষ্ঠানের আর্থিক দায়িত্ব বহন করা অন্য কোনো শ্রেণীর পক্ষে সম্ভব ছিল না। ক্ষত্রিয়দের পৃষ্ঠপোষকরূপে ‘ক্ষত্ৰিভৃৎ অগ্নি’ নামে অগ্নির বিশেষরূপ তখনই পরিকল্পিত হয়েছিল। ব্ৰাহ্মণ ও পুরোহিতসম্প্রদায়ের গুরুত্বও কিছুমাত্র কম ছিল না। সামাজিক শ্রেণীরূপে ব্ৰাহ্মণের পবিত্রতার উপর গুরুত্ব আরোপ থেকে বোঝা যায় যে, অথর্ববেদের কিছু কিছু প্রাসঙ্গিক সূক্ত অনেক পরবর্তীকালে অর্থাৎ বৈদিক যুগের অন্তিম পর্যায়ে রচিত, যখন সমাজে শ্রেণীবিন্যাস স্পষ্ট এবং ব্ৰাহ্মণের অবস্থান সমাজের শীর্ষস্থানে।