১৩. নারী (ব্রাহ্মণ)

নারী (ব্রাহ্মণ)

ব্ৰাহ্মণ সাহিত্যের বহু অংশে নারীকে স্বামীর অর্ধাংশ বা যজ্ঞের পশ্চাৎঅর্ধ রূপে কিংবা সৌন্দর্য ও সমৃদ্ধির প্রতীক হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এধরনের বেশ কিছু প্ৰশংসামূলক মন্তব্য থাকা সত্ত্বেও তা সমগ্র চিত্রের একটি দিক মাত্র। অন্য দিকেই লক্ষ করি পুরুষ-প্রাধান্যের জ্বলন্ত ছবি-সামন্ততান্ত্রিক সমাজের যা অপরিহার্য অঙ্গ। নারীকে সাধারণভাবে পুরুষের তুলনায় হেয় বলে প্ৰতিপন্ন করা হয়েছে। যজ্ঞের সঙ্গে যজমান-পত্নীর সম্বন্ধ প্ৰধান লক্ষ্যস্থল ছিল; কেননা, যজ্ঞে সক্রিয় কোনো ভূমিকা না থাকলেও যজমান পত্নীর উপস্থিতি ছিল অপরিহার্য। সম্ভবত, প্ৰাথমিক স্তরে মাঝে মাঝেই যজমানের পত্নী অনার্য বংশোদ্ভূত হতেন এবং পরবর্তী স্তরে নারীর উপনয়ন নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল; এইজন্যে যজ্ঞে তার কোনো সক্রিয় ভূমিকা থাকত না। সমস্ত কৃষিজীবী সমাজের মতো মাতৃত্ব ছিল নারীর গুরুত্বের অপর কারণ। এটা শতপথ ব্ৰাহ্মণে বিবৃত একটি বিধিতে স্পষ্ট [ ৫ : ২ : ৩, ১৩ ] যেখানে অপুত্ৰক নারীকে (পরিবৃত্তি বা পরিবৃক্তি) ত্যাগের বিধান দেওয়া হয়েছে। নির্ধতি বা ধ্বংসের কুপ্ৰভাবগ্ৰস্ত বলে সন্তানহীনা নারীকে চিহ্নিত করা হয়েছে।

পুরুষের বহুবিবাহ প্ৰথা প্রচলিত ছিল এবং শাস্ত্রে তার বৈধতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা রয়েছে। যেমন : ঐতরেয় ব্রাহ্মণ [ ৩ : ৫ : ৩ : ৪৭ ]। সমাজে নারীর অবস্থানের শতপথের একটি দেবকাহিনীতে [ ৪ : ৪ : ২ : ১৩ ] চমৎকারভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। সেখানে স্পষ্ট ঘোষণা করা হয়েছে : ‘নারীর নিজ শরীরের উপর বা কোনো উত্তরাধিকারে কোনো রকম অধিকার-ই নেই।’ আবার, বরুণপ্রঘাস অনুষ্ঠানে নারীদের প্ৰতি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অবিশ্বাস ও তাচ্ছিল্য অভিব্যক্ত হয়েছে। যেমন : তৈত্তিরীয় ব্ৰাহ্মণ : [ ১ : ৬ : ৫ : ৩৫; শতপথ : ২ : ৫ : ২ : ২০ ] । বিধবা ইতোমধ্যে করুণার পাত্রী হয়ে উঠেছে, তার প্রমাণ পাচ্ছি তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণের একটি প্রার্থনায় ইন্দ্ৰানীর মতো যেন অবিধবা হই । [ ৩ : ৭ : ৫ : ৫১ ]। ঐ গ্রন্থের একটি স্তবকে [ ২ : ২ : ৩২-৩৩ ] প্ৰায় অপ্রত্যাশিতভাবে নর-নারীর প্রেম ও বিবাহ সম্পর্কে সততাপূর্ণ চিন্তা ব্যক্ত হয়েছে, একই সঙ্গে যা কাব্যমূল্যেও অসামান্য। তৈত্রিরীয়ে অন্যত্র [ ২ : ৪ : ৪ : ৪২ ] দাম্পত্য প্ৰণয়ের দেবতা ভগের প্রতি একটি প্রার্থনা পাওয়া যায়। শতপথ ব্ৰাহ্মণে [ ১০ : ৫ : ২ : ১১, ১২ ] লক্ষণীয়ভাবে দাম্পত্য প্ৰেমকে শ্রেষ্ঠ আনন্দ ও স্বৰ্গপ্রদ রূপে বর্ণনা করা হয়েছে।

সামগ্রিকভাবে পুরুষের অনুগতরূপে নারীর ভূমিকা লক্ষণীয় : নারী অপরিহার্য কারণ গাৰ্হস্থ্য জীবনের প্রয়োজন নির্বাহ করা ছাড়াও সে পুত্রসন্তানের জন্ম দেয়,–বংশ ও সম্পদের অবিচ্ছিন্নতার জন্য যার গুরুত্ব সর্বাধিক। প্রথাগতভাবে যজ্ঞে নারীর নির্বাক ও নিষ্ক্রিয় আনুষ্ঠানিক উপস্থিতি প্রয়োজনীয় ছিল। এই বাইরে নারীকে প্রয়োজনীয় সামগ্ৰী অথচ হীনতার প্রাণীরূপে বিবেচনা করা হত, যার অস্তিত্ব সহ্য করতে হলেও একই সঙ্গে কঠিন প্রহরা ও অধীনতার মধ্যে রাখাই ছিল বিধি। ব্ৰাহ্মণগুলির বক্তব্যের সুর ও সার্বিক প্রবণতা থেকে এটা স্পষ্ট। শতপথে [ ১৩ : : : ২ : ৮ ] বলা হয়েছে যে, সমৃদ্ধিশালী পুরুষের চারজন পত্নী, একজন পরিচারিকা ও চারশত দাসী থাকত : সমস্তই ভোগের জন্য। বহু পত্নীর স্বামী হতে পারাকে তখনকার সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রতীক বলেই বিবেচনা করত [ তাদেব ১৩ : ২ : ৬ : ৭]।