০৯-১০. সুটিং-এ সুত্রের সন্ধান

০৯. সুটিং-এ সুত্রের সন্ধান

হালুটিয়ার জমিদারদের বাগান বাড়িতে আমাদের ক্যাম্পিং-এর চতুর্থ দিন শুরু হলো আগের দিনগুলোর মতোই আনন্দ উত্তেজনাময় পরিবেশে। নিকোলাস স্যারের সঙ্গে আমরা কজন রাত জেগে এতসব কাণ্ড করলেও ভাবু-জীবনের রুটিনে কোথাও এতটুকু ফটল ধরেনি। রোজকার মতো আমরা পতাকা উত্তোলন করেছি, নিকোলাস স্যার আর টুপ লিডার তাঁবু পরিদর্শন করে ডিয়ার পেট্রোলকে প্রথম পুরস্কার দিয়েছেন। তারপর পিটি করে ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়েছি ট্রেনিং-এ। সকালে অন্যদের দুঘন্টা ট্রেনিং হলেও আমার আর শিবলীর ট্রেনিং যে সন্ধ্যে পর্যন্ত চলবে আমাদের পেট্রল লিডারদের সেটা জানানো হয়েছে।

ইরফান ভাইদের স্যুটিং-এর জায়গায় যেতে যেতে শিবলী গদ গদ হয়ে বললো, ক্যাম্পিং-এ এসে কী দারুণ এক এ্যাডভেঞ্চারে জড়িয়ে পড়লাম বল তো!

আমি বললাম, ওরা এখনো টের পায়নি, আমরা যে ওদের পেছনে লেগেছি। টের পেলে দেখিস কী হয়!

কেন কী হবে? শিবলী অবাক হলো।

কী হবে মানে! এমনি এমনি ছেড়ে দেবে ভেবেছিস? আমি ভাবছি শেষকালে না একটা খুনোখুনি কাণ্ড হয়ে যায়!

শিবলী কাষ্ঠ হেসে বললো, কী যে বলিস তুই! মিছেমিছি ভয় পাইয়ে দিস!

ইরফান ভাই আমাদের অবজার্ভেশনের কথা শুনে ভারি খুশি হলেন। সেদিন তার স্যুটিং হচ্ছিলো দোতলার একটা বড় শোবার ঘরে। হিরো, হিরোইন, কমেডিয়ান তিনজনই আছে। ব্যস্ত হয়ে দাগুবাবুও ঘুরে বেড়াচ্ছে। ইরফান ভাই ইউনিটের সবাইকে স্কাউটিং সম্পর্কে বেশ খানিকটা জ্ঞান দিয়ে বললেন, জানো তো শিবলী যে আমাদের আফজাল হোসেনের ছোট ভাই!

পুরোনো কালের নর্তকীর পোশাক পরনে, কড়া মেকাপ করা হিরোইন আদুরে গলায় বললো, ও-মা, তাই বুঝি! স্কাউটিং-এর ড্রেসে ওকে দারুণ হ্যান্ডসাম আর স্মার্ট লাগছে। আমি আফজাল ভাইকে বলবো, শিবলীকে একটা ছবিতে কাস্ট করতে।

শুনে আমি মুখ টিপে হাসলাম। শিবলী তো লজ্জায় লাল-টাল হয়ে একাকার। গোলগাল ঢুলুঢুলু চোখ কমেডিয়ান গুলগুল্লা ঘুম জড়ানো গলায় বললো, ম্যাডাম, এই গরীবের একটা ছোট ভাই আছে, পারলে চাকর-টাকরের পার্ট নেয়ার জন্য যদি সুপারিশ করতেন–কেনা গোলাম হয়ে থাকতাম। ওর কথার ভঙ্গিতে সবাই হেসে উঠলো।

ইরফান ভাই হাসি চেপে বললেন, গুলগুল্লা, নিজের জায়গায় যাও। আর্টিস্টস্ গেট রেডি।

পরচুলা পরে নবাব সাজা হিরো ডাকলো, মেকাপ, এদিকে এসো!

বুড়ো মেকাপম্যান এসে হিরোর মুখে একটু পাফ বুলিয়ে আয়নাটা সামনে ধরলো। হিরো পরচুলাটা সাবধানে একটু চেপে বললো, ঠিক আছে।

নায়িকা বুড়োকে বললো, আমাকে একটু গ্লিসারিন।

ইরফান ভাই বললেন, আরেকটা মনিটর হবে, না টেক করবো?

হিরোইন চোখে দু ফোঁটা গ্লিসারিন দিয়ে আদুরে গলায় বললো, আর কত মনিটর করবেন, এবার ফাইনাল টেক করুন।

ওকে। ইরফান ভাই গলা তুলে বললেন, অল কোয়াইট, টেকিং। লাইটস?

সঙ্গে সঙ্গে জ্বলে উঠলো হাজার পাওয়ারের পাঁচ ছটা লাইট।

ইরফান ভাই বললেন–সাউণ্ড?

কানে হেড ফোন লাগানো সাউণ্ড রেকর্ডিন্ট বললো, রেডি।

ইরফান ভাই বললেন, ক্যামেরা?

নায়িকার মুখের ওপর ধরা ক্যামেরার বোতাম টিপে ক্যামেরাম্যান বললো, রোলিং।

একজন এ্যাসিসটেন্ট নায়িকার মুখের ওপর ক্ল্যাপস্টিক ধরে রাজনৰ্তকী, সিকোয়েন্সে ফাইভ, শট নাইন, টেক ফোর।–বলে সরে দাঁড়ালো।

এরপর ইরফান ভাই বললেন, এ্যাকশন।

নায়িকা কান্না জড়ানো গলায় বললো-না, না, জাঁহাপনা, এ কিছুতেই হতে পারে না। আমাকে আপনি এ কাজ করতে বলবেন না। দোহাই আপনার। বলতে বলতে দুহাতে মুখ ঢাকলো নর্তকী।

ক্যামেরা ঘুরে গেলো পাশে দাঁড়ানো নায়কের মুখের ওপর। আবেগ ভরা গলায় নায়ক বললো, তুমি ছাড়া একাজ যে আর কেউ করতে পারবে না জহরত বাঈ। আমার শেষ অনুরোধ তুমি রাখবে না?

কাট ইট, ওকে। চেঁচিয়ে বললেন ইরফান ভাই। ওয়েল ডান সুমিত্রা, স্বপন। এবার পরের সিকোয়েন্স। প্রোডাকশন, চা!

শিবলীর সঙ্গে আগেও কয়েকবার সিনেমার স্যুটিং দেখেছি এফডিসিতে গিয়ে। এভাবেই সব হয়। ইরফান ভাই আমাদের বললেন, চলো বারান্দায় গিয়ে বসি। পরের সিকোয়েন্সের জন্য রেডি হতে এক ঘন্টা লাগবে।

ইরফান ভাইর কথা শেষ না হতেই দাগুবাবু গলা তুলে বললো, পিচ্চি, বারান্দায় কয়েকটা চেয়ার দে তো!

আমরা আর সিনেমার তিন আর্টিস্ট ইরফান ভাইর সঙ্গে বারান্দায় গিয়ে বসলাম। চা বোধহয় তৈরি হচ্ছিলো। মিনিট খানেকের মধ্যেই পিচ্চি একা ট্রেতে করে চা নিয়ে এলো। আমাদের দুজনকে চা দেয়ার সময় সামান্য হাসলো।

জমানো লোক হলো কমেডিয়ান গুলগুল্লা। একটার পর একটা হাসির গল্প বলে সবার পেটে খিল ধরিয়ে দিলো। ইরফান ভাই একবার হাসতে হাসতে বললেন, তোমার বাপ-মা কতটা দূরদর্শী ছিলেন ভেবে দেখেছো গুলগুল্লা?

গুলগুল্লা চোখ কপালে তুলে বললো, ছিলেন নাকি!

ইরফান ভাই হেসে বললেন, তারা কি করে জানবেন তুমি বড় হলে সিনেমায় কমেডিয়ান হবে, যে জন্যে তোমার নাম গুলগুল্লা রাখতে হবে।

তোব তোবা! নিজের দুই গালে আলতোভাবে দুটো চড় মেড়ে গুলগুল্লা বললো, আমার বাপ-মা এ নাম রেখেছেন নাকি! রেখেছেন তো ফিল্ম ডিরেক্টর বখতিয়ার। বাপ রেখেছিলেন মুনশী হেদায়েতুল্লাহ। জানেন না বুঝি, আমরা হলাম মুনশী মেহের উল্লাহর খান্দান। বখতিয়ার সাহেব নাম শুনে নাকচ করেদিলেন। লাহোরে নজর তখন শেরেগুল নামে বেশ নাম করেছে। ডিরেক্টর সাহেব শেরেগুলের সঙ্গে উল্লাহ যোগ করে গুলগুল্লা বানালেন। আমিও দেখলাম, নামটা পাবলিক নেবে। তাই রেখে দিলাম। খালি খারাপ লাগে পাড়ার বখাটেগুলোকে ক্লাবের জন্য চাঁদা না দিলে রোয়াকে বসে যখন চ্যাঁচায়–দো দো পয়সা গুলগুল্লা, বলে। কিছু বলতেও পারি না। একটা গুলগুল্লার দাম ও যে দুপয়সা। আসলে তো ওরা বলে–গুলগুল্লা, পয়সা দাও।

গুলগুল্লার কথা বলার ধরন দেখে হেসে সবাই গড়াগড়ি খেলো। হাসতে হাসতে ইরফান ভাই বললেন, থলে ঝেড়ে সব এখানে উজাড় করে দিও না। কিছু সেটের জন্য রেখো।

গোলগাল ভুড়িতে টোকা মেরে গুলগুল্লা, বিস্তার আছে স্যার। এতবড় স্টক কখনো খালি হবে না।

একজন এ্যাসিসটেন্ট এসে ইরফান ভাইকে সেটে ডেকে নিয়ে গেলো। গুলগুল্লা শিবলীকে বললো, কী ওস্তাদ, নামটা পছন্দ হয়নি?

শিবলী বললো, শুধু নাম কেন, আপনার সবই পছন্দ হয়েছে।

তাই নাকি। গদগদ হয়ে গুলগুল্লা বললো, তাহলে তো আফজাল সাহেবের পরের ছবিতে নির্ঘাত চান্স পাচ্ছি। কী একটু সুপারিশ করবে না? আজকাল হ্যাংলা দত্ত কমেডিয়ানের পার্ট শুরু করায় আমার বাজার পড়ে গেছে।

ইরফান ভাই ভেতরে যাওয়ায় প্রোডাকশন ম্যানেজার দাগুবাবু এসে বসলো আমাদের পাশে। বললো, স্যারের সামনে সিগারেট খাওয়ার জো নেই। নিজে খাবেন না, কাউকে খেতেও দেবেন না। আমরা ওঁর নাম দিয়েছি পেট্রল পাম্প।

কী যে মজা পাও দাদা, বুঝি না। গুলগুল্লা ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো, ছোটবেলায় একবার বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে টেনে দেখেছিলাম। মাথা ঘুরে বমি টমি হয়ে একাকার। তারপর আর ছুঁয়েও দেখিনি।

দাগুবাবু আস্তে করে বললো, দেখে তো মনে হয় না এমন নিপাট ভালো মানুষ। হিরো স্বপন শিবলীকে–কোন স্কুলে, কোন ক্লাসে পড়া হয়, সাবজেক্ট কী, কোনটা পছন্দ–এসব কথা বলছিলো।

হিরোইন বললো, তোমার ভাই নতুন ছবিটায় কেন যে ধুমসি প্রতিমাকে হিরোইনের পার্ট দিলেন বুঝি না। ওর তো এখন খালার পার্ট করার কথা। এই বলে হিরোইন নেইল কাটারের উখো দিয়ে নখের ডগা ঘষতে লাগলো।

হিরো বললো, এ ছবিতে তুমি এত বড় নখ রেখেছো কেন সুমিত্রা? আগেকার দিনে বুঝি নখ লম্বা রাখার ফ্যাশন ছিলো?

বারে আমি কী করবো! ঠোঁট ফুলিয়ে হিরোইন বললো, এগুলো যে আমার ক্যাবারে গার্ল ছবির কন্টিনিউটি। এখান থেকে গিয়েই ক্যাবারে গার্লের সুটিং করতে হবে যে।

দাগুবাবু বললো, আমি স্যারকে বলেছিলাম ম্যাডামের নখের কথা। স্যার বললেন, ছবি পছন্দ হলে পাবলিক ওসব খুঁত ধরবে না। বড় জোর দুএকটা কাগজে সাংবাদিকরা ও নিয়ে খোঁচাতে পারে। ওতে কিছু আসে যায় না।

শিবলী দাগুবাবুকে বললো, আপনারা এই নাচঘরে কোন স্যুটিং করেননি?

দাগুবাবু বললো, করি নি মানে! দুটো লম্বা নাচের সিকোয়েন্স আছে এই ঘরে। একটা কমপ্লিট, আরেকটার অর্ধেক বাকি। ওখানে হেলেনের থাকার কথা।

ঝাড়বাতির চুরি হয়ে যাওয়াতে আপনাদের সুটিং-এ অসুবিধে হবে না?

শিবলীর কথা শুনে একটু অপ্রস্তুত হলো দাগুবাবু–না, মানে–স্যার নিশ্চয় কোনও ভাবে ম্যানেজ করবেন।

আপনার কী ধারণা। ওটা চুরি হলো কিভাবে?

শিবলীর কথায় এবারও নার্ভাস মনে হলো দাগুবাবুকে। কমেডিয়ান গুলগুল্লা–আমি একটু বাথরুম থেকে আসি, বলে উঠে গেলো। দাগুবাবু কাষ্ঠ হেসে বললো, কী করে জানবো বলো! সারাদিন স্যুটিং-এর খাটা-খাটনি–রাতে মড়ার মতো ঘুমিয়েছি। সকালে শুনি এই কাণ্ড।

হিরো স্বপন ভুরু কুঁচকে বললো, আপনি যাই বলেন দাগুবাবু আমার ধারণা এতে ইউনিটের কারো হাত আছে। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ, নাচঘরের বাইরের তালা দেয়া, চাবি রয়েছে আমাদের কাছে আর কেয়ারটেকারের কাছে। তালা না ভেঙে জিনিসটা কে নিতে পারে বলুন!

দাগুবাবু কৈফিয়ৎ দেয়ার সুরে বললো, বছরের পর বছর খালি পড়ে থাকে বাড়িটা। বাড়তি আরেকটা চাবি কারো পক্ষে বানিয়ে রাখা অসম্ভব নয়।

আমার একটুও ভালো লাগে না চুরির গল্প শুনতে। আদুরে গলায় বললো হিরোইন সুমিত্রা–তার চেয়ে দাগুবাবু ভূতের গল্প বলুন। সেদিন কী দারুণ ভুতের গল্প বললেন–বেচারি হেলেন ভয়ে পালালো। বলে খিলখিল করে হাসলো।

দাগুবাবু লাজুক হেসে বললো, ওগুলো গল্প নয় ম্যাডাম, একেবারে সত্যি ঘটনা। অনেকেই ওদের এ বাড়িতে দেখেছে।

পিচ্চি এসে বললো, সেট রেডি, আপনেগো বোলাইতাছে।

হিরো-হিরোইন উঠে সেটে গেলো। দাগুবাবু চাপা গলায় বললো, তোমরা কেয়ার টেকার মুনশীকে দেখেছো? লোকটাকে আমার মোটেই সুবিধের মনে হয় না। দেখো গে আমাদের ওপর দোষ চাপাবার জন্য ও নিজেই চুরি করেছে। নইলে পুলিশে খবর দিতে ওর এতো আপত্তি কেন?

আমি বললাম, ওর শুধু নাম শুনেছি। আমাদের সঙ্গে এখনো পরিচয় হয়নি। তিনি তো সাত দিনে একবার আসেন।

সে তো সবার নাকের ডগা দিয়ে আসা। লুকিয়ে লুকিয়ে রোজ আসতে তাকে বারণ করছে কে?

শিবলী চিন্তিতভাবে মাথা নাড়লো। আমি বললাম, আমরা একটু স্যুটিং দেখবো।

দাগুবাবু ব্যস্ত গলায় বললো, অবশ্যই দেখবে, একশবার দেখবে। চলো তোমাদের বসিয়ে দি।

রাজনৰ্তকী ছবিতে কমেডিয়ান গুলগুল্লার পার্ট ছিলো রাজার বিদুষকের। রাজদরবারের লোক হাসানো তার কাজ। দুপুরের আগে তোলা দুটো সিকোয়েন্সে ছিলো সে। একথা মানতেই হবে নায়ক স্বপনের চেয়েও গুলগুল্লা বড় অভিনেতা। স্যুটিং-এর সময় কী কষ্টে যে হাসি চেপেছি সে আর বলার নয়। কারণ, এতটুকু শব্দ করলেই শট বাতিল হয়ে যাবে। হয়েছেও একবার। রাজার ডাক শুনে হন্তদন্ত হয়ে আসতে গিয়ে বিদুষক ধপাস করে পড়বে–এটা টেক করার সময় যেই না গুলগুল্লা আছাড় খেলো, অমনি নায়িকা সুমিতা খিল খিল করে হেসে উঠলো। ইরফান ভাই কা-ট, বলে চিৎকার করে উঠলেন। সঙ্গে সঙ্গে সুমিত্রা, সরি, বলে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে পাশের ঘরে পালালো।

দুপুরে আমরা ইরফান ভাইদের সঙ্গে খেলাম। খেতে বসে একটা জিনিস খুব খারাপ লাগলো। ইরফান ভাইর সঙ্গে শুধু হিরো-হিরোইন আর আমরা দুজন ছিলাম। দাগুবাবু, ভিলেন, কমেডিয়ান, ক্যামেরাম্যান আর সাউণ্ড রেকর্ডিস্ট বসেছে আলাদা। বাদ বাকিরা আরেক জায়গায়। খাওয়ার মানও তিন রকমের। বেশি খারাপ লাগলো যখন দেখলাম, আমাদের দেয়া হলো মস্তো বড়ো কইমাছ, মুরগির মাংশ এই সব, আর পিচ্চিটা শুধু একটা তরকারি দিয়ে ভাত খেলো।

শিবলী অবশ্য পরে বলেছে সিনেমা কোম্পানিগুলোর স্যুটিং-এ এটাই নাকি নিয়ম। কেউ কোনো প্রতিবাদ করে না। অথচ আমরা স্কাউটরা তাঁবুতে সবাই একই খাবার খাচ্ছি, একই কাজ করছি, একই সঙ্গে ঘুমোচ্ছি। শওকত, রব্বানীরা যে মস্ত বড়লোকের ছেলে–কোন ও দিন কেউ এ নিয়ে একটা কথাও বলেনি। বরং সবাই ক্যাম্পে আসার আহ্লাদে সারাক্ষণ আটখানা হয়ে থাকে।

বিকেলের সুটিং ছিলো শুধু হিরো-হিরোইনের। গুলগুল্লার কোনো কাজ ছিলো না। দুপুরে খাওয়ার পর পর সেই যে নিচে নামলো আর তার পাত্তা নেই। বিকেলে টিব্রেকের সময় দাগুবাবুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম গুলগুল্লার কথা। বিরক্ত হয়ে দাগুবাবু বললো, ওর কথা আমাকে জিজ্ঞেস কোরো না। সারাক্ষণ আছে ধান্দাবাজিতে। কোথাও পীর ফকিরের খোঁজ পেলেই হলো। হত্যে দিয়ে পড়ে থাকবে। হ্যাংলা দত্ত এসে ওর বাজার দর কমিয়ে দিয়েছে–এ নিয়ে সারাক্ষণ কাঁদুনি গাইবে। এখানে এসেও খুঁজে খুঁজে পীরের মাজার একটা পেয়ে গেছে।

তারপর গলাটা একধাপ নামিয়ে দাগুবাবু বললো, এইসব মাজারে ঘুরে ঘুরে যা হবার তাই হয়েছে। আজকাল শুনি নেশা-টেশাও নাকি করে!

শুনে ভারি মায়া হলো গুলগুল্লার জন্য। শিবলী বললো, মেজদাকে আমি বলবো পরের ছবিতে ওকে নিতে।

জমিদার বাড়িতে ইলেকট্রিসিটি আসেনি। ডায়নামো চালিয়ে স্যুটিং-এর কড়া আলোর ব্যবস্থা করতে হয়েছিলো। নায়িকা সুমিত্রা একবার বললো, স্যুটিং দেখতে খারাপ লাগে না কিন্তু করা যে কী ঝকমারি। ঘন্টার পর ঘন্টা মুখের ওপর এসব আলো পড়লে টের পাবে।

একবার একটানা অনেকক্ষণ একা শট দিয়ে ঘেমে-টেমে একাকার হয়ে সুমিত্রা বারান্দায় এসে বসলো। আমরা তখন বারান্দার চারপাশটা দেখছিলাম, কেউ দেয়াল বেয়ে দোতলায় উঠতে পারে কি-না। আলাপ করার জন্য সুমিত্রাই প্রথম ডাকলো আমাদের। শিবলীকে বললো, তোমার ভাইর মাত্র একটা ছবিতে আমি কাজ করেছি।

শিবলী লাজুক হাসলো–জানি। ওটার জন্য আপনি এ্যাওয়ার্ডও পেয়েছিলেন। আপনার অভিনয় খুব সুন্দর হয়েছিলো।

সুমিত্রা হেসে বললো, তার জন্যে প্রশংসা অবশ্য আফজাল ভাই পাবেন। তিনি জানেন কিভাবে কাজ আদায় করে নিতে হয়।

শিবলী কয়েক মুহূর্তে চুপ থেকে কী যেন ভাবলো। তারপর দুম করে প্রশ্ন করলো, আচ্ছা সুমিত্রাদি আপনি কী খেতে ভালোবাসেন?

হাসতে হাসতে সুমিত্রা বললো, কেন বল তো? হঠাৎ সাংবাদিকদের মতো প্রশ্ন করছো?

না, এমনি জানতে ইচ্ছে হলো। ভারি লজ্জা পেলো শিবলী।

চিবুকে আঙুল রেখে একটু ভাবলো সুমিত্রা। তারপর রহস্যভরা গলায় বললো, কাউকে বলবে না, আমার সবচেয়ে ভালো লাগে শুঁটকির ভর্তা দিয়ে পান্তাভাত খেতে।

আপনার মোরগ পোলাও, বিরিয়ানী এসব ভালো লাগে না?

শিবলীর প্রশ্ন শুনে আমি মুখ টিপে হাসলাম। আর সুমিত্রার নাক কুঁচকে গেলা–একেবারে সহ্য করতে পারি না ওসব। একগাদা ঘি জবজব করে, লোকে কি করে যে খায়…..মাগো! বলে শিউরে উঠলো সে।

তার মানে আপনি স্যুটিং-এ এসে কখনো এসব খাবার খান না।

তার চেয়ে বরং আমি উপোস থাকবো, তাও ভালো।

শিবলী হেসে বললো, মেজদার নতুন ছবির হিরোইন স্যুটিং-এ এসে দুবেলা বিরিয়ানী খান।

সেজন্যে দেখ না কি মোটা হয়েছে। আমার মতো দুটোর সমান। আমি তো বলি ওর এখন বড় ভাবী নয় তো খালার পার্ট করা উচিত।

শিবরীর কথায় হিরোইন সুমিত্রা খুশি হলো। শিবলীর কাছে শুনেছি এসব হিরোইনরা নাকি একজন আরেকজনকে দুচোখে দেখতে পারে না।

সেদিন স্যুটিং শেষ হতে হতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। তাঁবুতে গিয়ে দেখি এনামুল ক্যাম্প ফায়ারের অনুষ্ঠানের মহড়া দিচ্ছে। আমাকে দেখে মুখ টিপে হেসে বললো, সারাদিন নিশ্চয়ই অনেক ধকল গেছে। কেতলিতে চা আছে, খেয়ে নাও।

চা নিতে এসে দেখি মুন্না রান্না করছে। বললো, কী মজা তোর, সারাদিন স্যুটিং দেখলি, অবজার্ভেশনও সারলি। একেই বলে এক ঢিলে দুই পাখি মারা। আমাদের জো ভাই নিয়ে গেলো কোন এক পীরের মাজারে। হুজুরটা আমাকে বললো আমি নাকি পরীক্ষায় ফাস্ট হবো। কী বুজরুকি বল তো! যদি বলতো স্কুল ফুটবল টিমে ক্যাপ্টেন হবো, তাহলে না হয় মানতাম।

আমি চা খেতে খেতে মৃদু হেসে বললাম, পীর ফকিরকে এভাবে হেনস্তা করিসনি মুন্না, জিভ-টিব নাকি খসে যায় শুনেছি।

চাপা গলায় মুন্না বললো, ওসব বুজরুকি আমাদের কাছে চলবে না। জো ভাই বলছে ওই হুজুরটা নাকি বিরাট ক্রিমিনাল।

আমি বললাম, এসব কথা বাইরে বলিস না, পিটুনি খাবি।

রাতের ক্যাম্প ফায়ারে এনামুল আমাদের দিয়ে জুলু ড্যান্স করলো। সঙ্গে সেই বিখ্যাত গান–গিং গ্যাং গলি গলি গলি গলি ইয়াশ্যাগিং গ্যাং গো, হেলা হেলা শেলা, হেলা শেলা হোঃ। শেরিবেরি শেরিবেরি শেরিবেরি, হোম্পা হোম্পা–

ক্যাম্প ফায়ার যারা দেখতে এসেছিলো মনে হলো তাদের সবাইকে পালক দিয়ে সুড়সুড়ি দেয়া হচ্ছে–এমনই হুল্লোড় বইয়ে দিলো। দেখলাম সিনেমা কোম্পানির দাগুবাবু, পিচ্চি আর কয়েকজন এসেছে। দুঃখের বিষয় পুরোনো অনুষ্ঠান দেখাবার জন্য আমরা ফাস্ট হতে পারলাম না। সেটা জুটলো টাইগার পেট্রলের ভাগ্যে। ওরা বিপি-র বই থেকে এলসডন মার্ডার কেস নাটকটা করছিলো। তবে দাগুবাবু আগে দেখেনি বলে আমাদের নাচের খুব প্রশংসা করলো। ক্যাম্প ফায়ারের পর তলব পড়লো নিকোলাস স্যারের তাবুতে। আগের রাতের মতো আরিফ, জোসেফ, শিবলী আর আমি। হারিকেনের চারপাশে গোল হয়ে বসলাম আমরা সবাই। প্রথমে আমার আর শিবলীর বিবরণ দেয়ার পালা। সুটিং-এ যা দেখেছি তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো লোকজনের সঙ্গে আমাদের কথাবার্তা। লক্ষ্য করলাম আমার বলার ফাঁকে ফাঁকে নিকোলাস স্যার ডায়েরিতে অনবরত নোট নিচ্ছেন।

আমাদের পর জোসেফের পালা। জোসেফ, মুন্না আর নঈম গিয়েছিলো পীরের মাজারে। পাগলা পীরের মাজারটা একেবারে নদীর ধারে মাজারের কেয়ারটেকার হচ্ছে লম্বা কালো দাড়িওয়ালা মিশমিশে কালো দশাসই শরীরের এক হুজুর। জোসেফদের খুব খাতির করে বসিয়েছে, মাজারের তবারক নকুলদানা খেতে দিয়েছে। মুন্নাকে বলেছে পরীক্ষায় ফাস্ট হবে আর নঈমকে বলেছে অনেক দৌলত হবে ওর।

হুজুরের জনা পাঁচেক এ্যাসিসেটন্ট ছিলো মাজারে। কারো চুলদাড়ি জট পাকিয়ে গেছে, কারো গায়ে শেকল জড়ানো, সর্বক্ষণ জিকির করছে। জোসেফ নিজের ভক্তি প্রমাণের জন্য হুজুরকে সোয়া তিনটাকা নজরানা দিয়েছে। তারপর বিনীতভাবে জানতে চেয়েছে হুজুরদের খরচপত্রের টাকা কোত্থেকে আসে। হুজুর বলেছে উপরওয়ালা দুনিয়ার সবার রিজিকের ব্যবস্থা করে রেখেছেন। মাজারে ভক্তরা আসে, নজর-নেওয়াজ দেয়। তাছাড়া গুদাম একটা আছে, এক হেকিম সাহেব দাওয়াখানার মালপত্র রাখে। তিনি কিছু ভাড়া দেন।

জোসেফরা সেই গুদামে নৌকা থেকে মাল নামিয়ে রাখতেও দেখেছে। কী মাল বলতে পারবে না, বস্তায় ভরা ছিলো। দেখে মনে হয়েছে হেকিমি ওষুধের গাছ গাছালি জাতীয় কিছু।

হুজুরও জোসেফদের খবর-টবর নিয়েছে। স্কাউট কী, ক্যাম্পিং-এ কেন আসে, কী করে–এইসব। জোসেফ হুজুরকে দাওয়াত দিয়েছিলো ক্যাম্প ফায়ারে আসার জন্য। হুজুর বিনয়ের সঙ্গে বলেছে–আমার যে বাবার জায়গা ছেড়ে নড়ার হুকুম নেই। তোমরা বরং শুক্রবারে এসো। প্রত্যেক শুক্রবার হালকায়ে জিকির হয়, গরু জবই করা হয়। এসে তবারক নিয়ে যেও।

মাজারের ভেতরে হুজুরের হুজুরাখানা আছে। সেখানে উঁচু দরের ভক্ত ছাড়া অন্য কারো ঢোকা নিষেধ। জোসেফরা থাকতে দুজন হুজুর টাইপের লোক এসেছিলো। ওদের নিয়ে মাজারের হুজুর কিছুক্ষণের জন্য হুজরাখানায় ঢুকেছিলো। জোসেফরা মাজার পরিদর্শন শেষ করে দুপুরে খাওয়ার আগেই চলে এসেছে।

আরিফের ওপর দায়িত্ব ছিলো ভাঙা মন্দিরের এলাকায় অবজার্ভেশন করা। ঈগল ট্রেলের হারুন আর র‍্যাবিট পেট্রলের বেলালকে নিয়ে আরিফ সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত মন্দিরের ওপর নজর রেখেছে। গাছ পালা আর ভাড়া ইট সুরকির ওপর নোট নিয়েছে বিস্তর তবে নজরে পড়ার মতো কিছুই দেখেনি। আমাদের মতো পাশের ভাঙা ঘরের একটায় তালা, আরেকটায় ঘোড়ার নাদি দেখেছে। আশেপাশের লোকজনকে জিজ্ঞেস করেছে মন্দিরের ধারে কাছেও কেউ এখন যায় না। নাকি এক সময় নিয়মিত নরবলি হতো। ভীষণ জাগ্রত ছিলো মন্দিরের শ্মশানকালী।

সন্ধ্যেবেলা ফেরার পথে ওদের সঙ্গে দাগুবাবু দেখা হয়েছে। মুরগি কিনতে বেরিয়েছে, কাল দুপুরে নাকি বিরিয়ানী হবে। আরিফদের সন্ধ্যের পর বাইরে ঘোরাফেরা করতে বারণ করেছে। রাতে ক্যাম্পে ফায়ার দেখতে আসবে, তাও বলেছে।

নিকোলাস স্যার শুধু দাগুবাবুর প্রসঙ্গটুকু শোনার সময় নোট নিলেন। জোসেফের বলার সময় বেশ কয়েকবার নোট নিয়েছিলেন তিনি। তবে সবচেয়ে বেশি নোট নিয়েছেন আমাদের বলার সময়। সবার কথা শেষ হওয়ার পর তিনি বললেন, আমরা যদি বেশ কিছুদিন এখানে থাকতে পারতাম তাহলে গোটা রহস্যটা আমরাই উদঘাটন করতে পারতাম। কিন্তু আমরা আর মাত্র একদিন আছি। অর্থাৎ কালকের দিনটা শুধু। পরশু ভোরে আমরা এখান থেকে চলে যাবো। সেজন্যে এই পরিস্থিতিতে পুলিশে খবর দেয়া ছাড়া উপায় নেই। কাল সকালে পুলিশ আসবে। যা কিছু করার ওরা করবে। অবশ্য আমাদের এসব অবজার্ভেশন রিপোর্ট ছাড়া তারা কিছু করতে পারতো না। এজন্যে অগ্রিম ধন্যবাদও পেয়ে গেছি।

আমি বললাম, পুলিশকে জানানো কী ঠিক হলো? থানায় যে ওদের লোক আছে?

জানি সেটা। মৃদু হেসে নিকোলাস স্যার বললেন, আজ বিকেলে আমি এসপির সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি আমাদের সময় স্কাউটিং করতেন। পড়তেন তোমাদের স্কুলেই। আমি যদিও পড়াশোনা করেছি বান্দুরাতে, স্কাউটিং-এর সুবাদে ওঁর সঙ্গে পরিচয় ছিলো। শুনে খুব আগ্রহ দেখালেন। একটু থেমে নিকোলাস স্যার বললেন, আজ আমরা শেষবারের মতো জমিদার বাড়িতে ঢুকবো। দেখা যাক এসপিকে দেয়ার মতো আরো কোন তথ্য পাওয়া যায় কি না। ইরফানকে আমি বলে রেখেছি।

কথাগুলো বলার সময় নিকোলাস স্যার বোধহয় ভাবতেও পারেননি সেই রাতে জমিদার বাড়িতে আমাদের জন্য কী ভয়ঙ্কর বিপদ অপেক্ষা করছিলো।

.

১০. বাঘের গুহায় বন্দী

আরিফ আর জোসেফকে আগের রাতের মতো থুজা ঝোঁপের পাশে বসিয়ে রেখে নিকোলাস স্যার, শিবলী আর আমি জমিদার বাড়িতে ঢুকলাম। ইরফান ভাইকে আগে বলা ছিলো কোন দরজা দিয়ে আমরা ঢুকবো। দরজার ছিটকিনি নামানোই ছিলো। নিকোলাস স্যারে কথামতো আমরা ছাদে উঠলাম। ছাদে উঠে ওরা কিছু পাহারা দেয়, না কোনও সংকেত পাঠায় আগে জানা দরকার।

রাত তখন প্রায় এগারোটা। পূবের আকাশে ম্লান এক টুকরো চাঁদ–অন্ধকার খুব বেশি দূর করতে পারেনি। নিকোলাস স্যার বললেন, কাল ছাদে ওরা যেরকম ভূত দেখেছে, মনে হয় না আজ কেউ উঠার সাহস পাবে।

তবু সাবধান হওয়ার জন্য ছাদে পা রাখার আগে চিলেকোঠার দরজার ফাঁক দিয়ে গোটা ছাদটা দেখে নিয়েছিলাম। নিশ্চিন্ত হয়ে দক্ষিণের কার্ণিশের কাছে এলাম। জোসেফ বলাতে খেয়াল হলো নদীর ধারে একটা মাজারের মতো রয়েছে গাছের একটু আড়ালে। মাজারে সম্ভবত হ্যাঁজাক জ্বলছে, বেশ জোরালো মনে হলো আলোটা।

হঠাৎ চাপা গলায় শিবলী বললো, স্যার ও দিকে দেখুন।

ওদিকে মানে পুব দিকে, যেদিকে ভাঙা মন্দির। বেশ উঁচুতে একটা আকাশ বাতি জ্বলছে। তখনই জ্বালিয়ে কেউ উড়িয়ে দিয়েছে। কারণ, ছাদে উঠেই একবার তাকিয়ে ছিলাম ওদিকে। তখন কিছু দেখিনি।

নিকোলাস স্যার বললেন, খেয়াল করে দেখো, কোথাও নিশ্চয়ই আলোর সংকেত দেখতে পাবে।

সংকেত খুঁজতে গিয়ে আমরা তিনজন বিভোর হয়েছিলাম–কখন যে ওরা আমাদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে টেরও পাইনি। যখন টের পেলাম তখন আর কিছুই করার ছিল না, সামান্য ধ্বস্তাধ্বস্তি করা ছাড়া। কারণ, আমাদের তিনজনকে এক সঙ্গে জাপটে ধরেছে। হাতে দুটো পিছমোড়া করে ধরা, ছাড়াবার চেষ্টা করতেই মোড় দিলো। তিনজন আমাদের ধরেছে আর তিনজন আমাদের সামনে–দুজনের হাতে ছুরি আর একজন হারিকেন হাতে দাঁড়িয়ে। সবার পরনে সাদা আলখাল্লা, মুখে কঙ্কালের মুখোশ আঁটা। হারিকেনওয়ালা বললো, টু শব্দ করোছো–পেটটা ফাঁসিয়ে দেবো। ভালো মানুষের মতো চলে এসো।

একজন গামছার মতো কাপড় একটা দিয়ে নিকোলাস স্যারের মুখ বেঁধে ফেললো। আমরা ছোট বলে বাঁধার হাত থেকে রেহাই পেলাম। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় আরেকবার হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করেছিলাম। লোকটা এমন এক মোচড় দিলো-মাথার ভেতর ঝন করে উঠলো। মোলায়েম গলায় একজন বললো, কেন মিছেমিছি কষ্ট পাচ্ছে। এমন চিন্তা ঘুণাক্ষরেও মাথায় এনো না।

নেতা গোছের লোকটা চাপা গলায় বললো, কী হয়েছে?

কিছু না। মোলায়েম গলায় বললো, পাখির বাচ্চা ডানা ঝাপটাতে চায়।

সিঁড়ি দিয়ে আগে নামছিলেন নিকোলাস স্যার, তারপর আমি, সবার শেষে শিবলী। মাথার ভেতর হাজারটা চিন্তা একসঙ্গে ভিড় জমালো। বাইরে যেভাবে হোক খবর পাঠাতে হবে। কিংবা কোথায় যাচ্ছি তার ট্র্যাক রেখে যেতে যেতে হবে।

নামার সময় কাঠের সিঁড়িতে একটু জোরে পা ফেলেছিলাম যদি শব্দ শুনে স্যুটিং কোম্পানির কেউ ওঠে! মোলামেয় গলা আবার হাতে মোচড় দিয়ে বললো, কোনও ফন্দি খাটবে না। ফের যদি শব্দ হয় তাহলে হাত দুটো নিচে নামার আগে ধড় থেকে আলাদা হয়ে যাবে।

আরেকজন বললো, এক আধটু শব্দ শোনার অভ্যেস আছে সিনেমাঅলাদের। ওরা জানে এসব তেনাদের কাজ।

সামনের হারিকেনওয়ালা নিচে নেমে এন্টিকরুমে যাওয়ার করিডোরে ঢুকলো। আমি সেরকমই অনুমান করেছিলাম। অবাক হলাম করিড়োর পা রেখে। কাঠের পাটাতনের করিডোরের মাঝখানে চারকোণা এক গজ বাই এক গজ জায়গা ফাঁকা। ওপাশে হারিকেনওয়ালা দাঁড়িয়ে। ফাঁকা জায়গা দিয়ে কাঠের সিঁড়ি নেমে গেছে নিচে।

নামার আগে সমানে লোকটা দড়ি দিয়ে নিকোলাস স্যারের হাত বেঁধে ফেললো। হারিকেনওয়ালা চাপা গলায় বললো, সাবধান, কোন রকম ফন্দি-ফিকির চলবে না। একজন একজন করে নামো।

দুজনের হাতে চকচকে ছুরি দেখে আমাদের নিরাপত্তার কথা ভেবেই নিকোলাস স্যার বিনাপ্রতিবাদে নেমে গেলেন। ওদের একজন তার সামনে, আরেকজন পেছন পেছন নামলো। এবার আমার পালা। মনে হলো এই কালো সুড়ঙ্গের ভেতর ঢুকলে কোনওদিন আর বেরোতে পারবো না। কেউ কোনওদিন টেরও পাবে না আমরা কোথায় হারিয়ে গেছি। লোকজন বলবে জমিদারবাড়ির অতৃপ্ত আত্মারা বুঝি গায়েব করে দিয়েছে।

পেছনের লোকটা ধাক্কা দিলো নামার জন্য। ভেবে কোনও কুল কিনারা না পেয়ে মরিয়া হয়ে চিৎকার করে ইরফান ভাইকে ডাকতে গেলাম। শুধু ই–বলতে পেরেছি তারপরই ঘাড়ের ওপর প্রচণ্ড জোরে কী যেন পড়লো। ব্যাস আর কিছুই আমার মনে নেই।

শিবলী পরে বলেছে আমার মাথাটা নাকি এমনভাবে ঝুলে পড়েছিলো যে হারিকেন ওয়ালা পর্যন্ত ঘাবড়ে গিয়েছিলো। দুসেকেন্ডের ভেতর সবাই নেমে কাঠের পাটাতন টেনে মুখটা সমানভাবে বন্ধ করে দিয়েছিলো।

জ্ঞান ফেরার পর দেখি মাটির নিচের একটা ঘরে হাত বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছি মেঝের ওপর। পাশে নিকোলাস স্যার আর শিবলী দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে। কেউ বোধহয় মুখে পানি ঢেলেছে। জামাটা ভিজে একাকার। ঘাড়ে প্রচণ্ড ব্যাথা-মনে হলো তুলতে পারবো না। চোখ মেলে তাকাতেই একজন বললো, জ্ঞান ফিরেছে।

প্রথমে চোখ পড়েছিলো নিকোলাস স্যারের ওপর। দুচোখে ভীষণ উদ্বেগ নিয়ে ব্যাকুল হয়ে তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে। শিবলীর চোখ দেখে মনে হলো বুঝি কেঁদে। ফেলবে। মুখোশপরা গুণ্ডাদের একজন আমাকে ধরে দেয়ালের সঙ্গে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিলো। ব্যাথায় অস্থির হয়ে চোখে কেবল তারা দেখছিলাম।

ছটা গুণ্ডা লাইন করে আমাদের দুপাশে দাঁড়িয়ে। সামনে চেয়ারে বসা কুচকুচে মুশকো চেহারার এক ষণ্ডামতো লোক। কফ জড়ানো গলায় বললো, ছেলের তো জ্ঞান ফিরেছে, মাস্টার সাহেব এবার নিশ্চয়ই আমার কথার জবাব দেবেন। আমার প্রত্যেকটা কথার ঠিক জবাব চাই। জবাব না পেলে আপনার ছেলে দুটোকে–দেখবেন, চোখের সামনে জ্যান্ত চামড়া খুলে নেবো। বলুন, এসপির কাছে কেন গিয়েছিলেন?

নিকোলাস স্যার একবার আমার দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, আমাদের গ্র্যান্ড ক্যাম্প ফায়ারের অনুষ্ঠান দেখার জন্য নিমন্ত্রণ করতে।

গ্র্যান্ড ক্যাম্প ফায়ার কী?

ক্যাম্পের শেষ রাতে যে অনুষ্ঠান হয়। তাঁবুর জলসা বলে। রোজ রাতেই হয়, তবে শেষ রাতেরটায় জাঁকজমক বেশি হয়। সবাই তাদের সেরা অনুষ্ঠানগুলো দেখায়।

গুণ্ডাদের একজন বললো, কাল রাতে আমি দেখেছি ওস্তাদ। ঘোড়াগুলো ভারি সুন্দর নাচতে গাইতে পারে।

চোপ! চাপা গলায় মুশকো চেহারা ওকে ধমকে দিয়ে আবার নিকোলাস স্যারকে জিজ্ঞেস করলো, আপনি যে সত্যি কথা বলেছেন তার প্রমাণ কী?

নিকোলাস স্যার নির্বিকার গলায় বললেন, এসপিকে জিজ্ঞেস করলেই হয়।

হু। একটু থেমে কী যেন ভাবলো মুশকো। তারপর বললো, সকালে পাগলা পীরের মাজারে কেন ছেলে পাঠিয়েছিলেন?

ক্যাম্পিং-এ এলে ওদের অবজার্ভেশন টেস্ট দিতে হয়। যেখানে ক্যাম্প হয়–গোটা এলাকায় দর্শনীয় স্থান যা আছে সব কিছুর বিবরণ লিখতে হয় ওদের। ম্যাপ বানাতে হয়।

তারপর ওসব সরকারের গোয়েন্দা পুলিশকে সাপ্লাই দেয়া হয়? . স্কাউটদের সঙ্গে সরকারের গোয়েন্দা পুলিশের কোনো সম্পর্ক নেই। শুধু যুদ্ধের সময় এসব ট্রেনিং দরকার হয়, যখন স্কাউটরা দেশের সৈন্যদের সাহায্য করে।

কাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করনে আপনারা?

আমাদের দেশের ওপর যারা হামলা চালাবে।

কাল রাতে ও আপনারা জমিদার বাড়ির ছাদে উঠেছিলেন?

হ্যাঁ।

কেন উঠেছিলেন?

আমার ছেলেরা এ বাড়িতে অনেক রাতে আলো দেখেছিলো। আমরা ভেবেছিলাম বাড়িতে চোর ঢুকেছে। ইরফান বলেছে এ বাড়ির একটা বড় ঝাড়বাতি, দুটো প্লাস্টারের সিংহ আর ওদের ইউনিটের দুটো ঘোড়া গত কদিনে চুরি হয়েছে।

সে তো তাদের ইউনিটের লোকই চুরি করেছে।

আমি বিশ্বাস করি না।

আপনার বিশ্বাস-অবিশ্বাসে কিছুই আসে যায় না। জমিদার বাড়ির জিনিস চুরি করার মতো ছিঁচকে চোর নই আমরা। আমাদের একটা মান সম্মান আছে।

ইউনিটের কে চুরি করেছে?

কেন কমেডিয়ান গুলগুল্লা! হেরোইনের নেশা করার মতো যথেষ্ট পয়সা সিনেমাঅলারা ওকে দেয় না, তাই ও চুরি করে।

শিবলী বললো, আমরা তো ভেবেছিলাম দাগুবাবু চুরি করে।

শিবলীর কথা শুনে মুশকো একটু হাসলোগুলগুল্লা প্রথমে আমাদের ব্লাফ দিয়েছিলো দাগুর কথা বলে। দাগু জানি না কিভাবে টের পেয়ে গেছে এটা গুলগুল্লার কাজ। ও হাতে-নাতে ধরার জন্য সুযোগ খুঁজছিলো। যে জন্যে গুলগুল্লা আমাদের বলেছে দাগু ওকে বিরক্ত করেছে। থানাকে বলে যেন চুরির জন্য ওকে জেলে দিই।

নিকোলাস স্যার বললেন, থানার সঙ্গেও তোমারদের তাহলে সম্পর্ক আছে!

আমরা যে ব্যবসা করি–থানার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখতেই হয়।

ব্যাবসাটা কিসের? জানতে চাইলেন নিকোলাস স্যার।

ড্রাগসের। হেরোইন, হাসিস–এইসব।

গুদামটা নিশ্চয়ই পীরের মাজারে?

তাই। জানলেন কী করে? মুশকোর মুখে হাসি, চোখে বিস্ময়।

আমার ছেলেদের অবজার্ভেশন রিপোর্টে দেখলাম কোন হেকিম সাহেবের ওষুধের গুদাম। অথচ এ তল্লাটে কোন হেকিমি দাওয়াখানা আছে বলে শুনি নি। তাই খটকা লেগেছিলো।

মন্দিরের পাশে ভাঙা ঘরের একটাতে তালা দেখেও নিশ্চয়ই খটকা লেগেছে?

হ্যাঁ, ছেলেদের অবজার্ভেশন রিপোর্টে দেখেছি।

জমিদার বাড়ির বাগানে মানুষের আনাগোনার চিহ্ন দেখেও নিশ্চয়ই খটকা লেগেছে?

তা লেগেছে–। তোমরা কী করে জানো এসব?

জানা কি খুব কঠিন কাজ! আজ সন্ধ্যার পর সিনেমা কোম্পানির ডিরেক্টরের সঙ্গে যখন কথা বলছিলেন তখন যে পেছনে মুনসী বসেছিলো টের পাননি?

কোন্ মুনশী?

কেন গুলগুল্লা! মুনশী মেহেরুল্লাহর খান্দানের ছেলে মুনশী হেদায়েতুল্লাহ!

গুলগুল্লা কেন তোমাকে এসব কথা বলতে যাবে?

বারে! হাত খালি থাকলেও বাকিতে নেশার জিনিস দিই, এটুকু খবর সে দেবে না?

নিকোলাস স্যার এবার একটু অপ্রস্তুত হলেন–তার মানে তোমরা জানতে আজ রাত আমরা এ বাড়িতে আসবো?

সে জন্যেই তো তৈরি হয়েছিলাম।

নিকোলাস স্যার কোন কথা বললেন না। মুশকো এবার কর্কশ গলায় বললো, মাস্টার সাহেব নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন আপনি যে এতক্ষণ মিথ্যে কথা বলেছেন, সেটা আমার অজানা নয়।

নিকোলাস স্যার কোন কথা বললেন না।

মুশকো এবার ধমক দিয়ে বললো, এসপিকে আপনি আমাদের সম্পর্কে বলতে গিয়েছিলেন। ঠিক কি না বলুন?

নিকোলাস স্যার চুপ করে রইলেন।

মুশকে আবার বললো, কেন আপনি আপনার ছেলেদেরকে আমাদের পেছনে লেলিয়ে দিয়েছেন?

মাথা তুলে শান্ত গলায় নিকোলাস স্যার বললেন, তোমরা ক্রিমিনাল। তোমারা দেশের শত্রু।

তার মানে আপনাদের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ! মুশকোর গলায় উপহাস—আফসোস, কোনো সৈন্যবাহিনী আপনাদের মদদ দিতে আসবে না।

এসপি কাল সকালেই আসবেন পুরো ফোর্স নিয়ে।

তার আগেই আমরা গুদাম খালি করে এখানকার ঘাঁটি গুটিয়ে ফেলবো।

আমাদের কী করবে?

সঙ্গে নিয়ে যাবো জামানত–হিসেবে।

নিতে চাও আমাকে নাও। এই বাচ্চা ছেলে দুটোকে ছেড়ে দাও। রান্টুকে যেভাবে মেরেছে আমার ভয় হচ্ছে ওর নার্ভ ছিঁড়ে গেছে।

বাচ্চা হলেও এরা কেউটের বাচ্চা। নার্ভ ছিডুলে আমার কিছু করার নেই। এর জন্য আপনার ছেলের অবাধ্যতাই দায়ী।

পাশের ঘর থেকে হন্তদন্ত হয়ে একটা লোক এসে মুশকোকে বললো, ওস্তাদ বড় কর্তা আসছেন, আপনাকে যেতে বলেছে।

মুশকো ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালো। লোকটাকে জিজ্ঞেস করলো মাল তোলা শুরু করেছিস?

করেছি। আরো লোক লাগবে। নইলে রাতের ভেতর সব সরানো যাবে না।

মুশকো আমাদের পাশের লোকগুলোকে বললো, তোরা সব তাহলে গুদামে চলে যা। এগুলো এখানে থাকুক পড়ে। বড় কত্তা এসে নিশ্চয়ই দেখতে চাইবেন। ওপরের দরজায় তালা দিয়েছিস তো?

মুখোশ পরা একজন মাথা নেড়ে বললো, দিয়েছি ওস্তাদ।

তাহলে যা, আর দেরি করিস না। এই বলে মুশকো দলবল নিয়ে বেরিয়ে গেলো।

তিনজন একা হতেই পালাবার একটা প্রচণ্ড ইচ্ছা আমাদের পেয়ে বসলো। নিকোলাস স্যার বললেন, শিবলী, তোমার হাতটা আমার হাতের কাছে আনতে পারো কি-না দেখো তো চেষ্টা করে।

শিবলী বললো, আমার পেছনে বাঁধা হাত দুটো সামনে নিয়ে আসতে পারবো।

কথাটা আমারও মনে হলো। শিবলী নিয়মিত যোগ ব্যায়াম করে। আমরা না পারলেও কাজটা ও পারবে ব্যায়াম করার সময় দেখেছি–মাঝে মাঝে মনে হয় ওর শরীরে বুঝি কোন হাড় নেই।

মিনিট দুয়েকের মধ্যেই শিবলী শরীরটাকে গোল করে পেছনে মোড়া হাত দুটোর ভেতর গলিয়ে দিলো। দড়ি বাঁধা হাত দুটো ওর সামনে চলে এলো। দেখতে ও আমার চেয়ে ছোট বলে বাঁধনটা বেশি শক্ত ছিলো না। দাঁত দিয়ে ও আর নিকোলাস স্যার দুজনে মিলে গিট খুলে ফেললো। তারপর দ্রুত হাতে ও আমাদের বাঁধন খুলে দিলো।

ঘরটার দুদিকে দরজা ছিলো। মুশকো যে দরজা দিয়ে বেরিয়েছে আমরা তার উল্টো দরজা দিয়ে বেরুলাম। সামনে দেখি ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। নিকোলাস স্যার বলেন, শিবলী, হারিকেনটা নিয়ে এসো।

হরিকেন আনার পর অন্ধকার কিছুটা দূর হলো। সামনে একটা সুড়ঙ্গের মতো। আমাদের দাঁড়াতে কোনো অসুবিধে হচ্ছিলো না। তবে নিকোলাস স্যার মাথা নুইয়ে হাঁটছিলেন। বললেন, সুড়ঙ্গের শেষ মাথা নিশ্চয়ই বাগানের কোনো জায়গা দিয়ে বেরিয়েছে।

কিছুদূর যেতেই দেখি সুড়ঙ্গটা দুভাগ হয়ে গেছে। পকেট থেকে চক বের করে শিবলী দুটোর মুখে ট্র্যাকিং সাইন আঁকলো। কোনও স্কাউট আমাদের অনুসরণ করলে যাতে বুঝতে পারে আমরা কোনদিকে গেছি। মিনিট দশেক পর আবার ভাগ হয়ে গেলো সুরঙ্গটা। এবার সমানে তিন ভাগ। ঝটপট মার্ক দিয়ে একটা ধরে আমরা হারিকেন হাতে রীতিমতো দৌড়াতে লাগলাম। কান খাড়া রেখেছি সামনে বা পেছনে কোনো শব্দ হয় কি না শোনার জন্য। ভাগ্য ভালো এখনো ওরা টের পায়নি।

হঠাৎ মনে হলো সুড়ঙ্গটা ইংরেজি অক্ষর ইউর মতো একটা বাঁক নিয়েছে। কত বছর যে এখানে কেউ পা দেয়নি পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিলো। বিচ্ছিরি ভ্যাপসা একটা গন্ধ। একটা দুটো ছুঁচো চিক চিক করে ছুটে বেড়াচ্ছিলো। দেয়ালগুলো ঠাণ্ডা ভেজা। কোথাও রীতিমতো ঘাম জমেছে দেয়ালের গায়ে। সামনে যতো এগুচ্ছিলাম মনে হলো সুড়ঙ্গটা ঢালু হয়ে নিচের দিকে নেমে গেছে। আর ভ্যপসা দমবন্ধ করা গন্ধটা আরো ভারি হচ্ছে। একসময় হারিকেনের আলো নিভে যাওয়ার দশা হলো।

নিকোলাস স্যার বললেন, আর সামনে এগুনো যাবে না। কার্বনডাই-অক্সাইড জমেছে। চল অন্য টানেল ধরে এগুই।

মোড়ের কাছে এসে যে গর্তে ঢুকেছিলাম–সংকেত এঁকে সেখানে চিহ্ন পাল্টে দিলাম। অর্থাৎ আমরা দুনম্বর টানেলে ঢুকবো।

এবারের টানেলটা আগের চেয়ে বড়। নিকোলাস স্যার মাথা সোজা করেই হাঁটছিলেন। হারিকেনটা ওঁর হাতে, আমরা দুজন পেছনে। কিছুদূর গিয়ে চাপা গলায় তিনি বললেন, এ টানেলটায় লোকজন চলা ফেরা করে।

অল্প কিছুদূর যেতেই একটা ঘরে এসে ঢুকলাম। ঘরের দুদিকের দরজার জায়গা দিয়ে দুটো টানেল দুদিকের চলে গেছে। সামনে দোয়ালের গায়ে কেরোসিন কাঠের কতগুলো প্যাকিং বাক্স। কাছে গিয়ে দেখলাম বাক্সগুলো খালি, গায়ে কালো ছাপ মারা লেখা-গ্লাস, হ্যাঁণ্ডেল উইথ কেয়ার। নিকোলাস স্যার বললেন, বোধহয় শিশি বোতল জাতীয় কিছু এনেছিলো।  আমি বললাম, এসব বাক্সে করেই হয়তো মাল পাচার করে। বাইরে একটা ছাপ থাকলে সুবিধা।

নতুন টানেলে ঢুকে নিকোলাস স্যার মৃদু হেসে আলতোভাবে আমার পিঠ চাপড়ে দিলেন–ঘাড়ের ব্যাথাটা কি এখনো খুব বেশি?

দম বন্ধ করে সুড়ঙ্গের ভেতর বেরোবার পথ খুঁজতে গিয়ে ব্যাথার কথা কখন ভুলে গেছি। মনে হচ্ছিলো বছরের পর বছর অন্ধকার পথ খুঁজে বেড়াচ্ছি। একবার মনে হলো যদি এখান থেকে আর বেরোতে না পারি। সারা শরীর আতঙ্কে শিউরে উঠলো। শিবলী আমার হাত ধরেছিলো। ফিসফিস করে বললো, কী হলো?

ভয়ের কথা শিবলীকে বলা যাবে না। বলালম শীত করছে।

টানেলটা কিছুদূর গিয়ে আবার দুভাগ হয়ে গেছে। নিকোলাস স্যার থমকে দাঁড়ালেন।.কোন দিকে যাবেন ভাবছেন, এমন সময় একটু দূরে মানুষের গলা শোনা গেলো। লক্ষ্য করে দেখলাম বাঁ দিকের টানেলের মাথায় সামান্য আলোর আভাস। হারিকেনের আলোটা একেবারে কমিয়ে দিলেন নিকোলাস স্যার। আমরা তিনজন নিঃশব্দে বাঁদিকের টানেলে ঢুকলাম।

গজ দশেকের মতো যেতেই দেখি ডান দিকে একটু ভেতরে বড় একটা ঘরের মতো। খোলা দরজা দিয়ে ভেথরে জ্বালানো হ্যাঁজাকের আলোর কিছুটা বাইরে এসেছে। বেশ কয়েকজন মানুষের গলা শুনতে পাচ্ছিলাম। কিন্তু কিছুই বোঝা যাচ্ছিলো না।

পা টিপে আমরা দরজার দিকে আরেকটু এগুলাম। এবার কথা বোঝা গেলো। কফ জড়ানো গলা কি বললো বুঝলাম না। ওর জবাবে অচেনা.কর্তৃত্বসম্পন্ন গলা বললো, না না, সঙ্গে নেয়া যাবে না। ওই তিনটেকে এখানেই নিকেশ করে রেখে যাবি। ফালতু বোঝা বইতে পারবো না।

আমাদের তিনজনের কারো বুঝতে এতটুকু অসুবিধে হলো না ওরা কাদের নিকেষ করার কথা বলছে। শিবলী আমার হাতে মৃদু চাপ দিলো। নিকোলাস স্যার অন্ধকারে কাঁধে হাত রেখে আশ্বস্ত করলেন। এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে একটা লোক হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, সর্বনাশ হয়েছে কত্তা। স্কাউট ছোঁড়াগুলো শুধু বাড়িটা ঘিরে রাখেনি, মাজার আর মন্দিরও ঘিরে ফেলেছে। পাঞ্জা বলছে, নৌকোয় এখন মাল তোলা যাবে না।

চিলের মতো চিৎকার করে কত্তা বললো, পাঞ্জার পিঠের চামড়া দিয়ে আমি ডুগডুগি বানাবো। কটা পুঁচকে ছোঁড়াকেও শায়েস্তা করতে পারছে না? মাজারে কি আমাদের লোক কম পড়ছে? বল, ধরে সব কটাকে সাবড়ে দিতে।

যাই কত্তা। হন্তদন্ত গলা চলে গেলো।

কফ জড়ানো গলা বললো, আমি বলছিলাম, এখন এসব খুনোখুনির মধ্যে না গেলেই ভালো হতো। মালগুলো ঠিক মতো…..

বাধা দিয়ে কত্তা বললো আমাকে জ্ঞান দিতে এসো না। কি করতে হবে আমি ভালো বুঝি। যাও, দাড়ি পরে মাজারে গিয়ে ওই ঘোড়াগুলোকে সামলাও গে।

পায়ের শব্দ শুনে বুঝলাম কফ জড়ানো গলা চলে গেলো।

কত্তা এবার কাকে যেন বললো, ওই টিকটিকি তিনটাকে এখানে নিয়ে আয় দুরি।

আনছি কত্তা–বলে দুরি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

আমরা এবার রীতিমতো প্রমাদ শুনলাম। ওরা যদি টের পায় আমরা পালিয়েছি টানেলের সবগুলোর মুখ বন্ধ করে দেবে। একবার মনে হলো জানাজানি হওয়ার আগে আরেকবার বেরোবার চেষ্টা করি, আবার ভাবলাম কত্তার কথা থেকে আরো কিছু জানা যেতে পারে। ঠিক তখনই একজৰ এসে বললো, কত্তা পুলিশ এসে গেছে।

পুলিশ? বলছিস কী তুই? আগের মতো চেঁচিয়ে উঠলো কত্তা–পুলিশ আসবে কোত্থেকে? থানায় মাসে মাসে টাকা দেয়া হয় কী জন্যে? সত্যি সত্যি পুলিশ দেখেছিস, না পুলিশের পোশাক পরা বজ্জাত স্কাউটগুলোকে দেখেছিস?

পাগলা পীরের কিরে ওস্তাদ, ওগুলো পুলিশ।

পীর আবার কোথায় পেলি, বড় যে কিরে কাটছিস? চিনলি কী করে পুলিশ?

জিপে করে এসেছে কত্তা। দুটো জিপ বোঝাই।

এক্ষুণি যা, তিন আর পাঁচ নম্বর রাস্তার মুখ বন্ধ করে দে। মন্দিরে বোমা ফাটিয়ে পুলিশগুলোকে ওদিকে নিয়ে যা। দক্ষিণের রাস্তা যেভাবে হোক ভোলা রাখতে হবে।

যাচ্ছি কত্তা। বলে লোকটা চলে গেলো।

তখনই আরেকজন এসে ঢুকলো। বললো, টিকটিকি তিনটা পালিয়েছে কত্তা।

তোরা এসব কী বলছিস? সবাই মিলে আমাকে পাগল করে ফেলবি দেখছি। শিগগির সব কটা রাস্তার মুখে পাহারা বসা। নওলাকে বলে দিয়েছি তিন আর পাঁচ বন্ধ করে দিতে। যেভাবে হোক বজ্জাত তিনটাকে আমি চাই। আমার পেটে লাথি মেরেছে ওগুলো। নিজের হাতে আমি ওদের শায়েস্তা করবো।