১১-১২. মধ্যরাতে আক্রমণ

১১. মধ্যরাতে আক্রমণ

টুটুল আর আসিফ এসে দেখলো, বারান্দায় হেডমাস্টার মা আর দিদার সঙ্গে বসে কথা বলছেন। দিদার মন খারাপ বলে ওদের ধমক না দিয়ে বললেন, তোমরা গোসল করে এসো। তোমাদের কাকা জরুরি আলাপ করবেন।

ওরা দুজন কোনো কথা না বলে কাপড় পাল্টে পুকুরে গেলো। সেদিন আর টুটুলের সাঁতার কাটা হলো না। দুজনেই তাড়াতাড়ি ফিরলো।

মা খাবার বেড়ে বসে ছিলেন। হেডমাস্টারকে নিয়ে ওরা খেতে বসলো। খেতে-খেতে হেডমাস্টার বললেন, আমার দুটো সন্দেহ হচ্ছে। এক–যারা উড়ো চিঠি দিয়ে ভয় দেখিয়েছিলো তারা তাকে আটক করেছে। আর দুই হচ্ছে–শান্তিবাহিনী। চট্টগ্রাম থাকার কি কোনো সম্ভাবনা আছে?

মা বললেন, না। থাকলে বলে যেতো, না হয় খবর পাঠাতো।

আসিফ বললো, শান্তিবাহিনী কেন ধরবে?

হেডমাস্টার চিন্তিত গলায় বললেন, সেটা আমিও ভাবছি। গোলাবাড়ি গিয়ে আমাদের ড্রিল মাস্টার যতীন লারমার সঙ্গে কথা বলবো। ওর সঙ্গে শান্তিবাহিনীর যোগাযোগ আছে। শান্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়লে ও খবর দিতে পারবে।

যদি শান্তিবাহিনীর হাতে ধরা না পড়ে? দিদা শুকনো খরখরে গলায় প্রশ্ন করলেন।

অন্য কেউ ধরলেও শান্তিবাহিনীর সেটা অজানা থাকবে না। ওরা খোঁজ নিতে পারবে।

মা আস্তে-আস্তে বললেন, ও তো কারো সাতে-পাঁচে ছিলো না। ওকে কেন ওরা ধরবে?

দিদা বিরক্ত হয়ে বললেন, মগের মুলুকে কাকে তুমি নীতিকথা শেখাবে বৌমা? ধরেছে আমাদের ওপর চাপ দিয়ে কিছু টাকাপয়সা আদায় করার জন্য। দুদিন বাদেই দেখো টাকা চেয়ে চিঠি পাঠাবে।

হেডমাস্টার কোনো কথা বললেন না। দিদার কথায় যে যুক্তি আছে এটা অস্বীকার করা যাবে না। টুটুল হেডমাস্টারকে বললো, কাকা, আপনি গিয়ে বিদ্যুৎকে একবার পাঠাবেন?

কেন পাঠাবো না বাবা? বললেন হেডমাস্টার তোমাদের এত বড় বিপদ! আমি নিজেও দরকার হলে এসে থাকবো। তবে খোঁজখবর নেয়ার জন্য আমার পক্ষে গোলাবাড়ি থাকাই উচিত হবে। কাল খবর না পেলেও পরশুর মধ্যে আশা করি পেয়ে যাবো। মা, আপনারা ঘাবড়াবেন না।

খেয়ে উঠে হেডমাস্টার আর দেরি করলেন না। টুটুলকে বললেন, আমি গিয়েই বিদ্যুৎকে পাঠিয়ে দেবো। আমাকে না বলে তোমরা কোথাও যেও না।

হেডমাস্টার চলে যাওয়ার ঘণ্টা দুয়েক পরে জীপে করে পুলিশ এলো। অল্পবয়সী একজন সাব ইন্সপেক্টর বারান্দায় দিদাকে দেখে সালাম দিয়ে বললো, আমি খাগড়াছড়ির ছোট দারোগা। এটা তো বাশার সাহেবের বাড়ি?

হ্যাঁ বাবা, উদ্বিগ্ন গলায় দিদা বললেন কোনো খবর পেলে?

না, এখনো পাই নি। বললো ছোট দারোগা–অ্যাকসিডেন্ট হয় নি, সে খবর পেয়েছি।

অচেনা গলার শব্দ আর নিকি-মিকির ঘেউঘেউ শুনে টুটুল আসিফ বেরিয়ে এলো। দারোগা বললো, আপনারা কি বাশার সাহেবের ছেলে?

হ্যাঁ। বললো টুটুল–বাবার ব্যাপারে কী করছেন আপনারা?

চিটাগাং থেকে খাগড়াছড়ি পর্যন্ত সবগুলো থানা আর ফাঁড়িতে খবর পাঠানো হয়েছে। আর্মি ক্যাম্পেও খবর দেয়া হয়েছে। তিনি যদি ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের পথে নিখোঁজ হন সেক্ষেত্রে আমাদের কিছু করার নেই। তবে খাগড়াছড়ির পথে কিছু হলে আমরা দু-তিন দিনের ভেতরই ট্রেস করতে পারবো বলে আশা রাখি। এই বলে সাব ইন্সপেক্টর আসিফের দিকে তাকিয়ে বললো, আপনারা এখানে আসার পর কি সন্দেহজনক কিছু ঘটেছে? কাউকে কি সন্দেহ হয়?

না। পরিষ্কার গলায় বললো আসিফ কারো সঙ্গে শত্রুতা থাকলে তো সন্দেহ করবো!

চিন্তিত মুখে মাথা নাড়লো দারোগা। দিদা বললেন, গাড়িসুদ্ধ একটা মানুষ কর্পূরের মতো উবে যাবে মগের মুল্লুক ছাড়া এমনটি আর কোথায় হবে! শোন বাবা দারোগা, আল্লা না করুক, আমার ছেলের কিছু হলে তোমাদের কাউকেই আমি ছাড়বো না বলে দিলাম।

দারোগা কাষ্ঠ হাসলো–আমাদের দিক থেকে সবরকম ব্যবস্থাই নেয়া হয়েছে। আপনারা কি এটা খবরের কাগজে নিউজ করতে চান?

দিদা বিরস গলায় বললেন, যেন এখানকার লোকজন খবরের কাগজ পড়ে? তোমাদেরও বলি, বেশি ঢাকঢোল পিটিও না। শত্রুপক্ষ বেগতিক দেখলে খুনখারাপি করতে পারে। চুপি-চুপি গোয়েন্দা লাগিয়ে খবর নাও।

আসিফ মনে-মনে দিদার বুদ্ধির প্রশংসা না করে পারলো না। ও জানে, বাবাকে যদি আজেবাজে লোক টাকার জন্য ধরে থাকে, বেশি হৈচৈ হলে স্রেফ মেরে ফেলবে। তবে শান্তিবাহিনী যদি ওকে ধরে, সরকারের সঙ্গে বন্দি মুক্তি বা অন্য কোনো বিষয়ে দর কষাকষি করতে চায়, সেক্ষেত্রে অবশ্যই তাকে বাঁচিয়ে রাখবে। আর সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য খবরটা ভালোমতো প্রচার হোক এটাও তারা চাইবে। তবে এই মুহূর্তে বেশি হৈচৈ না করাই ভালো।

দারোগা বললো, আপনি যা বলবেন, সেভাবেই হবে।

এতেও দিদা খুশি হলেন না–নিজেরাও কিছু বুদ্ধি খাটাও। আমি যদি সব বলবো, তোমরা কি আমার হেঁসেল সামলাবে?

ছোট দারোগা কাষ্ঠ হেসে বিদায় নিলো।

সন্ধ্যায় টুটুল আসিফকে বললো, সেগুনতলায় বসে যারা নজর রাখছে, আমরা যদি তাদের ওপর পাল্টা নজর রাখার ব্যবস্থা করি তাহলে কেমন হয়?

আমার মনে হয় না টুটুল ওরা আর নজর রাখবে। তবু করমালিকে বলতে পারো। সন্ধের পর আমাদের বাড়ি ছেড়ে থাকা ঠিক হবে না।

সেই ভালো। বলে টুটুল করমালিকে চুপি-চুপি বুঝিয়ে দিলো কি করতে হবে–কাক-পক্ষী যেন টের না পায় করমালি। তোমার বৌকেও বলবে না।

করমালি বললো, আঁর হ্যাড এ্যাত হাতল ন।

কিছু না বুঝেই টুটুল বললো, ঠিক আছে, যাও।

বিদ্যুৎ যখন এলো, রাত তখন সাড়ে নটা। সবাই খেতে বসেছে। মা ওকে বললেন, তুমিও খেতে বসে যাও বিদ্যুৎ।

বিদ্যুৎ কোনো কথা না বলে বারান্দায় গিয়ে কোনো রকমে মুখ-হাত ধুয়ে বসে গেলো। টুটুলের সঙ্গে একবার চোখাচোখি হলো। টুটুল বুঝলো, খবর আছে।

খেয়ে উঠে টুটুল বললো, আমরা বাইরে বসছি দিদা। তোমরা শুয়ে পড়ো। দিদা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আপন মনে শুধু বললেন, আমার চোখে কি আর ঘুম আছে।

বাইরে এসে ঘাসের ওপর বসলো ওরা তিনজন। বিদ্যুৎ চাপা গলায় বললো, ফণী এসেছিলো। কাকাকে শান্তিবাহিনী গ্রেফতার করেছে।

কেন? একসঙ্গে প্রশ্ন করলো টুটুল আর আসিফ।

কেন সেটা ফণী বলতে পারে নি। ও দেখেও নি। যারা গ্রেফতার করেছে তাদের একজনের কাছে ফণী শুনেছে। ওদের ক্যাপ্টেন বিক্রম নাকি অর্ডার দিয়েছে।

কোত্থেকে ধরেছে? আসিফের প্রশ্ন।

গোলাবাড়ি আসার পথে। ধরে সেখান থেকে সাত মাইল দূরে বর্ডারের কাছে এক ঘাঁটিতে নিয়ে গেছে।

হেডমাস্টার কাকা শুনেছেন? জিজ্ঞেস করলো টুটুল।

শুনেছেন। বাবা বললেন, তোমাকে না হলে আসিফদাকে কাল ভোরে আমার সঙ্গে যেতে।

তাহলে আমিই যাবো। বললো টুটুল–তোমার পা এখনো ভালোমতো শুকোয় নি বড়দা। তা ছাড়া বাড়িতে বড় কেউ থাকা দরকার।

ঠিক আছে টুটুল, তুমিই যাবে। কিন্তু কীভাবে যাবে তোমরা?

বাবা যতীন কাকার চিঠি নিয়ে যাবেন। ফণী কিছুটা পথ এগিয়ে দেবে, কিন্তু ঘাঁটিতে যাবে না।

উড়ো চিঠির ব্যাপারে ফণী কি বললো? জানতে চাইলো টুটুল।

আমরা যা ভেবেছিলাম তাই। ও বললো, শান্তিবাহিনীর নামে করলেও এটা কখনো শান্তিবাহিনীর কাজ হতে পারে না। এটা স্রেফ হুমকি দিয়ে টাকা আদায়ের ফন্দি।

ঠিক তখনই ওরা দূরের পাহাড়ে করমালির চিৎকার শুনলো, ও বদ্দা, ও মেজদা, জলদি আইয়েন, দইচ্ছি।

শিগগির এসো। বলে টুটুল ছুটলো পাহাড়ের দিকে। পেছন-পেছন অত জোরে না পারলেও আসিফ আর বিদ্যুৎও ছুটলো সেদিকে। পাহাড়ে উঠতে গিয়ে দুবার হোঁচট খেলো বিদ্যুৎ। গিয়ে দেখলো করমালি চিমসেমতো একটা লোককে পিছমোড়া করে ধরে রেখেছে। দেখেই বোঝা যায় গায়ে বেশি জোর নেই। টুটুল আর করমালি দুদিক দিয়ে ধরে নিয়ে চললো বাড়ির দিকে।

করমালির চিৎকার শুনে, নাকি টুটুলদের ছোটা দেখে দিদা আর মা হ্যাঁজাক নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন। ব্যগ্র গলায় দিদা বললেন, কি হয়েছে রে! কাকে ধরে আনলি?

লোকটার চেহারা চাকমাদের মতো। পরনে প্যান্ট-শার্ট, তবে সেগুলোর অবস্থা খুব সুবিধের নয়। চেহারায় বেশ রাগী-রাগী ভাব। টুটুল লোকটাকে বললো, ভালোয়-ভালোয় বল তো তুমি কে? না হলে উত্তম-মধ্যমের ব্যবস্থা হবে।

লোকটা কোনো কথা না বলে চুপ করে রইলো। করমালি বললো, আঁর আতে ছাড়ি দেন। হলদাই কতা বার করুম। বলেই লোকটার ঘাড়ের ওপর এক ঘা বসিয়ে দিলো–কিরে অডা, কতা কস না কিলুই? সাবে কিয়া কয় হুনস ন?

লোকটা তবু চুপ করে রইলো। করমালি আরেক ঘা বসিয়ে বললো, এরোই, বালায়-বালায় কতা ক। হলদানি শুরু কইল্লে ট্যার হাইবি কার আতে হইড়ছস।

লোকটা গোঁ ধরে দাঁড়িয়েই রইলো। বিদ্যুৎ বললো, করমালি, তুমি থামো। তারপর শক্ত গলায় চাকমা ভাষায় কি যেন বললো লোকটাকে।

লোকটা কয়েক মুহূর্ত বিদ্যুতের মুখের দিকে তাকিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। তারপর হুমড়ি খেয়ে ওর পা জড়িয়ে হাউহাউ করে কি যেন বললো। বিদ্যুৎ ধমক দিয়ে থামতে বললো ওকে। তারপর দাঁড়াতে বললো। লোকটা কান্না থামিয়ে উঠে দাঁড়ালো। এরপর শুরু হলো বিদ্যুতের জেরা। লোকটা ফোঁপাতে-ফোঁপাতে ওর কথার জবাব দিচ্ছিলো। মাঝখানে দুবার জোরে কেঁদে উঠতেই বিদ্যুতের ধমক খেলা।

টুটুলরা সবাই অবাক হয়ে যেন অচেনা ভাষার কোনো নাটক দেখছিলো। অধৈর্য হয়ে দিদা বললেন, লোকটার কিছু আমাদের বল বিদ্যুৎ! কতক্ষণ হাঁ করে তোদের অংবং গিলবো।

লোকটাকে জেরা করার সময় অসম্ভব উত্তেজিত ছিলো বিদ্যুৎ। দিদার কথা শুনে লজ্জা পেয়ে বললো, লোকটার নাম মিতিঙ্গা। বাড়ি হচ্ছে মহালছড়ির কেরেঙ্গানলে। দুজন চাকমা দেওয়ান নাকি ওকে বলেছে, এ বাড়ির ওপর নজর রাখার জন্য। ওকে এর জন্য দু শ টাকা দিয়েছে ওরা। ওদের সঙ্গে শান্তিবাহিনীর কোনো যোগাযোগে আছে কি না ও জানে না বলছে। ওদের একটা চিঠি ও এ বাড়িতে রেখে গিয়েছিলো। ওরা কোথায় থাকে ও জানে না। রোজ সন্ধ্যা থেকে রাত নটা-দশটা পর্যন্ত ওর ডিউটি। বাড়িতে কতজন লোক আছে, বাইরে থেকে কারা আসে, কে কখন বাইরে যায় আর ফেরে এসব দেখা হচ্ছে ওর কাজ। দুদিন আগে ওদের সঙ্গে ওর শেষ দেখা হয়েছে। এ পর্যন্ত তিনবার ওদের দেখেছে। ওরা বলেছে, এ বাড়ির লোকরা চাকমাদের ক্ষতি করতে চায়, নাকি সরকারের গুপ্তচর। ওকে পুলিশে দিলে ওর বৌ-বাচ্চারা না খেয়ে মরে যাবে। ও খুব গরিব। এই বলে থামলো বিদ্যুৎ।

দিদা বললেন, চেহারা দেখেই বোঝা যায় মিটমিটে শয়তান। ভেবেছে গরিব বললে গলে গেলাম আর কি! হাবুর খবর না পাওয়া পর্যন্ত ওকে আটকে রাখো। থাকবে করমালির জিম্মায়। করমালি, ওকে মারধোর কোরো না। তবে পালাতে গেলে কী করবে আমি জানি না। দিদা রায় ঘোষণা করে–চলো বৌমা, বলে মাকে নিয়ে ঘরে চলে গেলেন।

টুটুল ডেকে বললো, ও দিদা, বাবার খবর না শুনলে তুমি ঘুমোবে কী করে?

দিদা বেরিয়ে এসে বললেন, কী বলছিস ছোঁড়া?

হ্যাঁ দিদা, কাল আনতে যাবো বাবাকে।

বেঁচে থাক ভাই! কে, বিদ্যুৎ বুঝি খবর এনেছে?

হা দিদা, এবার কি মাকে বলবে আমাদের এক কাপ চা খাওয়াতে?

মা আর দিদা হেসে ঘরে গেলেন।

বিদ্যুৎ লোকটাকে দিদার রায় শোনাবার পর সে আরেক দফা কাঁদতে চাইলো, তবে বিদ্যুতের ধমক খেয়ে আর পারলো না।

হলদানি ন খাইলে এই জাত সোজা অয়নি? বলে করমালি লোকটাকে নিয়ে চলে যাবে এমন সময় আসিফ বললো, লোকটা ওর সিগারেট কোন দোকান থেকে কেনে বিদ্যুৎ জিজ্ঞেস করো তো।

বিদ্যুৎ উত্তরটা জেনে বললো, ওই লোক দুটো নাকি ওকে দশ প্যাকেট এই সিগারেট আর একটা বড় টর্চ দিয়েছে।

আসিফ করমালিকে বললো, ঠিক আছে, নিয়ে যাও। বাইরে থেকে তালা দিয়ে তোমাদের পাশের ঘরে রাখো।

ঘরে এসে ওরা চা খেলো। আসিফ বললো, উড়ো চিঠির রহস্য কিছুটা সমাধান হয়েছে। বাকিটা হবে তোক দুটোকে পেলে।

টুটুল বললো, আজ রাতে মনে হয় কিছু ঘটতে পারে। লোক দুটো যদি জানতে পারে ওদের ওয়াচারকে আমরা আটকে রেখেছি, ওকে ছাড়াবার চেষ্টা নিশ্চয়ই করবে।

মাথা নেড়ে সায় জানালো আসিফ সবার একসঙ্গে জেগে কাজ নেই। তোমরা দুজন ঘুমিয়ে পড়ো, আমি বারান্দায় বসে পাহারা দেবো।

না। টুটুল বললো, তুমি বরং ঘুমোও বড়দা, ফিজিক্যাল ফিটনেস তোমাদের চেয়ে আমার অনেক বেশি।

ভালো বলেছো। তোমাকে পাহারায় রেখে আমি ঘুমোবো!

তাহলে বিদ্যুৎ ঘুমোক। একা রাত জাগতে হবে না জেনে খুশি হলো টুটুল।

আমার ঘুম এলে তো! বলে বিদ্যুৎ ওদের সঙ্গী হলো।

তিনজন চুপচাপ বারান্দায় বসে রইলো। রাত বাড়তে লাগলো। মাঝে-মাঝে খুব নিচু গলায় বিদ্যুৎ আর টুটুল কথা বলছিলো। সামান্য দূরে বসে আসিফ একটার পর একটা সিগারেট টানতে-টানতে ভাবছিলো কবে বাবা ফিরছেন, যার কাছে ও পার্টির খবর পাবে।

অনেক রাতে ভাঙা এক টুকরো চাঁদ ওঠাতে অন্ধকার কিছুটা ফ্যাকাসে হলো। আসিফ হঠাৎ হাত তুলে টুটুলদের ইশারায় ডাকলো। টুটুলরা কাছে এলে চাপা গলায় বললো, গেটের ওপাশে দেখো তো, দুটো ছায়ার মতো দেখলাম।

কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর ওরা খেয়াল করলো দুটো লোক সীমানার বেড়া টপকাতে না পেরে গেটের কাছে এসেছে।

টুটুল ফিসফিস করে বললো, বারান্দায় থাকলে দেখতে পাবে। চলো আড়ালে যাই।

ভেতরে গিয়ে টুটুল বড় টর্চ আর বাবার বন্দুকটা এনে জানালার কাছে দাঁড়ালো। টর্চটা আসিফকে দিয়ে বললো, ইশারা পেলেই ওদের মুখের ওপর ধরবে।

ভেতর থেকে ওরা দেখলো, লোক দুটো বাইরে থেকে গেটের তালা খুলতে না পেরে অতি কষ্টে টপকালো। তারপর নিচু হয়ে মিনিট খানেকের মধ্যে গেট খুলে ফেললো। ইশারায় বাইরে কাউকে ডাকলো। টুটুলরা অবাক হয়ে দেখলো, দশ-বারোজন লোক এসে জড়ো হয়েছে গেটের কাছে।

একসঙ্গে এতগুলো লোক হামলা করলে ঠেকানো যাবে না। চাঁদের আবছা আলোতে ওরা দেখলো, সবার মুখ কালো কাপড়ে ঢাকা। কয়েকজনের হাতে লম্বা রামদা। বন্দুক আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না।

মুহূর্তের ভেতর সিদ্ধান্ত নিলো টুটুল। চাপা উত্তেজিত গলায় আসিফকে বললো, ভেতরে গিয়ে গুলীর বাক্সটা আনন। টর্চের আলোটা গেটের ওপর জ্বালিয়ে ওটা বারান্দায় রেখে সরে যাও। তোমরা লাঠি নিয়ে তৈরী থাকো। মা-দিদাকে তুলে দাও।

ওরা সব কটা গেটের ভেতরে ঢুকেছে। এক জায়গায় জড়ো হয়ে কীভাবে হামলা চালাবে তারই শেষ ব্রিফিং। নিচ্ছিলো। সেই মুহূর্তে আট-ব্যাটারির জোরালো আলো ওদের মুখের ওপর পড়লো। ওদের চমকে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে টুটুল চিৎকার করে বললো, হল্ট! একপা এগুলে গুলী করবো।

কথাটা বলেই টুটুল ঘরের ভেতর ঢুকে বন্দুকের নলটা বের করে রাখলো। ঠিক তখনি বাইরে থেকে টর্চর আলো লক্ষ্য করে কে যেন গুলি ছুঁড়লো।

আসিফ চাপা গলায় বললো, টুটুল, ফায়ার।

পরপর দুটো গুলী করলো টুটুল। বাইরে আর্ত চিৎকার শুনলো।

পাল্টা ফায়ারিং-এর শব্দ হলো। গুলী লেগে টর্চটা ছিটকে পড়লো। টুটুলও একই সঙ্গে গুলী ছুঁড়েছিলো। আরো একটি আর্তনাদ শোনা গেলো গেটের পাশে।

আসিফ বললো, চালিয়ে যাও টুটুল।

বন্দুকে গুলী ভরে পরপর আরো চারবার ফায়ার করলো টুটুল। আরো একজনের আর্তনাদ শুনলো ওরা। উত্তেজিত গলায় টুটুল বললো, তিনটা লেগেছে।

এমন সময় বিকট চিৎকার শুনলো ওরা। হুঙ্কার দিয়ে বল্লম হাতে করমালি বেরিয়ে এসেছে ধর-রে-ধর-রে বলে।

আসিফ টুটুলকে হ্যাঁচকা টান দিয়ে লাঠিটা বর্শার মতো উঁচিয়ে ধর ধর, বলে করমালির সঙ্গে ছুটলো। টুটুল আরেকবার গেটের দিকে গুলী ছুঁড়ে ধর ধর করে চিৎকার করে ছুটলো। সঙ্গে বিদ্যুও। দিদা নিকি-মিকিকে ছেড়ে দিয়েছেন। ওরাও গলা ফাটিয়ে ঘেউঘেউ করতে-করতে ছুটলো। মনে হলো এক বিশাল কোলাহলের মতো করমালির বৌও বেরিয়ে এসেছে লম্বা লাঠি উচিয়ে। সবাই এক সঙ্গে ধর ধর করে চিৎকার করে গেটের দিকে ছুটছে। সবার ওপরে শোনা যাচ্ছে করমালির আমানুষিক হুঙ্কার।

চোখের পলক ডাকাতের দল পিছন ফিরে ছুটলো। আহতদের অন্যরা টেনে-হেঁচড়ে নিচ্ছিলো। গেটের কাছে এসে আসিফ সবাইকে থামালো। নিচের দিকে দৌড়োতে গিয়ে ডাকাতদের কয়েকজন হুমড়ি খেয়ে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে করমালির গর্জন শুনে পড়িমরি করে উঠে দৌড়ালো।

টুটুল সবার দিকে তাকিয়ে বিজয়ীর হাসি হাসলো। চাঁদের ফ্যাকাশে আলোয় দেখা গেলো সবার মুখে সেই হাসি ছড়িয়ে পড়েছে।

আজ রাতের মতো নিশ্চিন্ত। বললো টুটুল।

বাফের জর্মে আর আইতো ন। যেই ধাবানি খাইছে! বললো করমালি।

চলো, ঘরে চলো। আসিফ সবাইকে নিয়ে ঘরে এলো।

দিদা বললেন, করমালির সাহস তো কম নয়! যদি গুলী করতো ওরা?

করমালির বাহাদুরি নয়ে বললো, আঁর এই চিল্লানিরে বাগেও ডরায় দাদি আম্মা। যেগুন আইছে হেগুনের ত কইতরের হরান। আর আঁই ত একলা ন। বদ্দারা লগে আছিল না! কোগারে হালাইছেন মেজদা?

টুটুল বললো, তিনটার গলা শুনেছি।

মা বললেন, বুঝেছি, তোমরা অনেকক্ষণ গল্প চালাবে। মা, ওদের একটু চা করে

দি।

আহা, দাও না বৌমা। বাছাদের ওপর তো কম ধকল যায় নি। করমালি, তোমরাও বসো। বিস্কুট থাকলে ওদের কখানা দিও বৌমা। এই বলে দিদা টুটুলদের দিকে তাকালেন, টের পেলি কী করে? বুঝি রাত জেগে পাহারা দিচ্ছিলি?

টুটুল মাথা নিচু করে ঘাড় চুলকে বললো, হ্যাঁ দিদা।

দিদা ওর চুলের গোছা নেড়ে আদর করে বললেন, এবার গিয়ে বাপকে নিয়ে এসো। দেখবো কত বাহদূর!

কালই পেয়ে যাবে দিদা। নিশ্চিন্ত গলায় বললো টুটুল।

.

১২. শান্তিবাহিনীর সঙ্গে অন্যরকম লড়াই

দুপুরের পর থেকে একটানা নয় মাইল হাঁটতে হলো টুটুল আর হেডমাস্টারকে। পথ দেখিয়ে এনেছে যতীন মাস্টারের ভাইপো শান্তিবাহিনীর ফণী। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে অবিরাম চড়াই-উতরাই ভেঙে, কখনো পাহাড়ী ঝরনার স্রোত উজিয়ে, কখনো দড়ি দিয়ে বোনা ঝুলন্ত পুল পেরিয়ে অবশেষে ওরা ঘাঁটিতে এসে পৌঁছলো। দূরে একটা তালগাছ দেখিয়ে ফণী টুটুলকে বললো, ওটা ইণ্ডিয়ায়।

বিদ্যুতের বন্ধু হওয়াতে ফণীর সঙ্গে টুটুলের এরই মধ্যে দিব্যি ভাব জমে গেছে। ঘাঁটিটা দূর থেকে দেখিয়ে ফণী বিদায় নিলোআমার আর যাওয়া উচিত হবে না টুটুল। আমাদের ঘাঁটি দু মাইল পুবে। এখান থেকেই আমি বিদায় নেবো। ক্যাপ্টেন বিক্রমকে সব বুঝিয়ে বোলো। তোমার বাবার বিরুদ্ধে অভিযোগ খুবই গুরুতর। তবে কাকা আর তুমি যদি পুরো ব্যাপারটা বোঝাতে পারো, মনে হয় তাকে ছেড়ে দিতে পারে। এই বলে টুটুলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ফণী দ্রুত জঙ্গলের গভীরে হারিয়ে গেলো।

না, প্রথম থেকেই বাবার ব্যাপারে ফণী কোনো আশা দিতে পারে নি। বাবার কথায় বেশ কিছু লোক শান্তিবাহিনীকে খাজনা দেয়া বন্ধ করায় ক্যাপ্টেন বিক্রম ভীষণ চটেছে। বড় চাকুরে ছিলেন বলে বাবা এখনো বেঁচে আছেন। অন্য কেউ হলে মৃত্যুদণ্ড সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর হতো।

রামগড়ের বনে তখন সন্ধ্যা নেমেছে। পশ্চিমের আকাশ আগুনের মতো লাল। উত্তরের আকাশে নানা রঙের ছেঁড়া-ঘেঁড়া মেঘ ভাসছে আর পুবের আকাশে সন্ধ্যার ধুসর ছায়া। ঘরে ফেরা পাখিদের বিচিত্র শব্দে সারা বন মুখর হয়ে আছে। টুটুলের কাছে টর্চ আর হেডমাস্টারের হাতে ছাতা ছাড়া অন্য কিছু নেই। ফণী অবশ্য আগেই বলেছিলো কোনো অস্ত্র সঙ্গে নেয়া যাবে না, এমনকি ছুরিও নয়।

কিছুদূর এগুতেই একজন রাইফেলধারী চাকমার সঙ্গে দেখা হলো ওদের। হেডমাস্টার চাকমাদের ভাষায় জানালেন, ক্যাপ্টেন বিক্রমের সঙ্গে দেখা করতে চান, যতীন লারমার চিঠি এনেছেন।

ভাবলেশহীন লোকটা ওদের নিয়ে কাঠের ফ্রেমে কাঁটাতার পঁাচানো গেটের পাশে বেড়ার ঘরটায় নিয়ে বসালো। ভালোভাবে সার্চ করে দেখলো ওদের সঙ্গে অস্ত্র জাতীয় কিছু আছে কি না, তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে বেরিয়ে গেলো।

এক প্রহরী এসে ঘরে হারিকেন জ্বালিয়ে দিয়ে জানালো, টুটুলদের অপেক্ষা করতে হবে।

ঘরের দরজার কাছে প্রহরী মোতায়েন হয়েছে। টুটুলরা চুপচাপ বসে রইলো। এখানে ওরা যা বলবে তাই করতে হবে। ফণী বার-বার টুটুলকে বলে দিয়েছে, কোনো ব্যাপারে কৌতূহল প্রকাশ করবে না। মনে রেখো আমাদের জনসংহতি প্রকাশ্য সংগঠন বটে, শান্তিবাহিনী কিন্তু গোপন বাহিনী। টুটুলরা এখন বসে আছে শান্তিবাহিনীর সবচেয়ে শক্তিশালী ঘাঁটির একটিতে।

প্রায় এক ঘন্টা পর ডাক পড়লো ওদের। ততক্ষণে ঝিমোতে শুরু করেছে টুটুল। ডাক শুনে সে চোখ কচলে হেডমাস্টারের পেছন-পেছন গেলো।

আগের ঘরে বসেই ক্যাপ্টেন বিক্রম ওদের সঙ্গে দেখা করলো। টেবিলের ওপর বাংলাদেশের একটা ম্যাপ বিছিয়ে কি যেন দেখছিলো। টুটুলরা ঘরে ঢোকার পর চোখ না তুলেই বললো, বসুন।

কিছুক্ষণ পর ম্যাপটা ভাঁজ করে আলমারিতে তুলে রেখে বললো, আপনারা যতীনদার চিঠি এনেছেন?

চিঠিটা পকেট থেকে বের করে ক্যাপ্টেনের হাতে দিলেন হেডমাস্টার। পড়ে ভুরু কুঁচকে গেলো ক্যাপ্টেন বিক্রমের। যতীন মাস্টার দুজনের পরিচয় দিয়ে লিখেছিলেন–বন্দি ইঞ্জিনিয়ারের ব্যাপারে ওদের কিছু বলার আছে। বিক্রম যেন সময় দেয়।

আপনি তাঁর ছেলে? টুটুলের দিকে তাকিয়ে বললো ক্যাপ্টেন–বলুন কি বলার আছে।

আমার অনেক বলার আছে। আগে আমি জানতে চাই, বাবাকে কী কারণে আপনারা বন্দি করেছেন।

আপনার বাবা আমাদের বিরুদ্ধে লেগেছেন–তাই। তিনি গোলাবাড়ির লোকজনদের বারণ করেছেন আমাদের যেন খাজনা না দেয়। তিনি নিজে দিতে চান না সে ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে নিশ্চয়ই বোঝাঁপড়া হবে, কিন্তু অন্যকে প্ররোচিত করে তিনি অত্যন্ত অন্যায় কাজ করেছেন।

তাকে আটকে রেখে কী করবেন? জানতে চাইলেন হেডমাস্টার।

আজ রাতে মেজর রিক আসবেন। ওঁর ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তিনিই নেবেন।

কি ধরনের সিদ্ধান্ত তিনি নিতে পারেন বলে আপনি মনে করেন?

তিনি যে অন্যায় করেছেন, তার জন্য চরম শাস্তির বিধান রয়েছে আমাদের। মেজর রিক কী সিদ্ধান্ত নেবেন সেটা তার ব্যাপার।

টুটুল বললো, আমি কি আমার বাবার সঙ্গে একবার দেখা করতে পারি?

কয়েক মুহূর্ত কি যেন ভাবলো ক্যাপ্টেন–ঠিক আছে, শুধু আপনি একা যাবেন। এই বলে প্রহরী ডাকলো।

টুটুলকে দেখে অবাক হয়ে গেলেন বাবা। ছোট ঘরটার এক পাশে সরু একটা তক্তপোষে বসে বাইরে তাকিয়ে ছিলেন তিনি। বিছানার ওপর পাইপ আর তামাকের পাউচ। কোণে টিমটিম করে হারিকেন জ্বলছিলো। টুটুল ঘরে ঢুকে বাবা বলে ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো।

এলি কীভাবে? এরা কি তোদের খবর পাঠিয়েছিলো?

খবর অন্য জায়গায় পেয়েছি। তুমি ভালো আছো তো বাবা?

বাবার মুখে দুদিন শেভ না করা খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। চোখের কোণে ক্লান্তির ছাপ। তবে হাসির সজীবতা কমে নি–তোর কি মনে হয় খুব একটা খারাপ আছি?

দাড়ি না কাটলে তোমাকে অন্যরকম লাগে বাবা।

তোকে দেখে ভীষণ খুশি লাগছে টুটুল। আমার মন বলছিলো তুই আসবি। একা এসেছিস?

না, হেডমাস্টার কাকাকে নিয়ে এসেছি।

ওঁকে বাইরে রেখে এলি কেন, ডাক এখানে?

না বাবা, হুকুম নেই। শুধু আমাকে দেখা করার অনুমতি দিয়েছে।

ও, তাই বুঝি। বাবার গলা অপ্রসন্ন শোনালো। একটু চুপ থেকে বললেন, তোরা সবাই ভালো ছিলি তো? আসিফ ভালো আছে?

সবাই ভালো আছে। জানো বাবা, কাল বাড়িতে ডাকাত পড়েছিলো। বিরাট দল। সবাই মিলে তাড়িয়েছি। রীতিমতো গানফাইট হয়েছে।

বলিস কী!

গত রাতের পুরো ঘটনা বাবাকে বললো টুটুল। শুনে বাবার চোখ ছানাবড়া। টুটুলের জন্য গর্বে তাঁর বুক ভরে গেলো। বললেন, তোর মা, দিদা ভয় পায় নি?

ভয় পাবে কেন? আমাদের কাছে বন্দুক ছিলো তো!

ওই যে বললি, চিচিঙ্গা না কিতিঙ্গা–যাকে ধরেছিস, ও এখন কোথায়?

মিতিঙ্গা। আটকে রেখে দিয়েছি। প্রথমে ভেবেছিলাম শান্তিবাহিনীর লোক। পরে বিদ্যুৎ জেরা করে বার করলো ও আসলেই ডাকাতদের ইনফর্মার। দিদা বলেছেন, শান্তিবাহিনীর হাতে তুলে দিতে। দেখুক ওরা শান্তিবাহিনীর নামে কি হচ্ছে।

শান্তিবাহিনীর কথা শুনে ঠোঁট বাঁকালেন বাবা। তাঁর সঙ্গে যে ব্যবহার করেছে, এদের জন্য এতটুকু সহানুভূতি আর অবশিষ্ট নেই। মেজর রিক না মিক কে আসবে বলছে, দেখা যাক সে কোন পদের! বললেন, হ্যাঁরে, তোদের সঙ্গে এরা খারাপ ব্যবহার করে নি তো?

খারাপ আর কী! ইতস্তত করে বললো টুটুল, তবে আন্তরিক বলে মনে হলো না। তোমার সঙ্গে দেখা করবো বলাতে যেমন হেডমাস্টার কাকাকে আসতে দিলো না। আজ রাতে নাকি মেজর রিক আসবে। তোমার ব্যাপারে সে-ই সিদ্ধান্ত নেবে।

বাবা কয়েক মুহূর্ত কী যেন ভাবলেন। তারপর শান্ত গলায় বললেন, আমার কিছু হলে তুই সোজা চিটাগং গিয়ে জেনারেল মঞ্জুরের সঙ্গে কথা বলবি। স্কুলে ও আমার দু ক্লাস নিচে পড়তো। ভালোভাবে চেনে আমাকে। ঢাকায় থাকতে কয়েকবার দেখাও হয়েছে।

তোমার কী হতে পারে বলে ভাবছো বাবা? কথা বলতে গিয়ে সামান্য কেঁপে গেলো টুটুলের গলা।

ক্যাপ্টেনটাকে তো রীতিমতো মাথামোটা বলে মনে হলো। এমন লোক হলে যা হয়; যুক্তি বোঝে না। ওর কথা শুনে মনে হলো আমাকে মৃত্যুদণ্ড দিতে পারলেই ও খুশি হয়। দেখা যাক, ওর মেজরের কাছে কী ধরনের রিপোর্ট করে।

বাবার কথা শুনে রীতিমতো ভয় পেলো টুটুল। ফণীর কথা মনে হলো। ফণীও বাবার ব্যাপারে কোনো আশা দিতে পারে নি। ফিসফিস করে বললো, বাবা, চলো পালিয়ে যাই।

বাবা মৃদু হাসলেন–তুই কি ভয় পেয়েছিস টুটুল? পালিয়ে কোথায় যাবো? কমলছড়ি? সেটাও তো এদের এলাকা।

হোক না এদের এলাকা। জায়গাটা তো আমাদের। দরকার হলে আমরা আর্মির সাহায্য নেবো।

না টুটুল। শান্ত গলায় বাবা বললেন, পুলিশ বা আর্মির ভরসায় আমি বাঁচতে চাই না। আমি মারা গেলে তোরা না হয় ওদের সাহায্য নিস। আমি এদের পলিটিক্যালি ফেস করতে চাই। তোকে তো কতবার বলেছি, মৃত্যু মানুষের জীবনে একবার আসে। মানুষ হিসাবে আমাদের আলাদা একটা মর্যাদা আছে। পালিয়ে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে সেই মর্যাদাকে হারিয়ে বাঁচা। এভাবে বাঁচার কোনো অর্থ হয় না টুটুল।

তুমি যুক্তির কথা বলছো বাবা। এখানে তো সব জংলী ব্যাপার। হয় লড়ে জিততে হবে, নয় পিছু হটে যেতে হবে।

আমি লড়তে চাই টুটুল। তবে সেটা হবে অন্যরকম লড়াই।

বাবার কথা শুনে ভয় পেলো টুটুল। বুঝলো, বাবাকে তার যুক্তি থেকে কোনোভাবে টলানো যাবে না। আর যাবে না বলেই মেজর রিকও ক্যাপ্টেন বিক্রমের মতো হেরে গিয়ে বাবার মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করবে। ভয়ের পাশাপাশি এক ধরনের অহঙ্কারও সে

অনুভব করলো বাবার জন্য।

একজন প্রহরী এসে ঘুরে ঢুকলো। বললো, মেজর রিক এসেছেন। আপনাদের যেতে হবে।

প্রহরী ওদের দুজনকে নিয়ে ক্যাপ্টেন বিক্রমের ঘরে গেলো। ক্যাপ্টেনের চেয়ারে বাবার বয়সী যে চাকমাটি বসে আছেন, কেউ বলে না দিলেও তার কর্তৃত্বপূর্ণ চেহারাই বলে দিলো তিনি মেজর রিক। টেবিলের এক পাশে ক্যাপ্টেন বিক্রম আর হেডমাস্টার বসে আছেন। চোখের ইশারায় সামনের দুটো খালি চেয়ার দেখিয়ে মেজর বললেন, বসুন।

টুটুল আর বাবা বসতেই ক্যাপ্টেন বিক্রম চাকমা ভাষায় কি যেন বললো মেজরকে। মাথা নেড়ে সায় জানালেন মেজর। ক্যাপ্টেন বিক্রম ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে ভাবলেন মেজর। তারপর বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনাকে এখানে কেন আনা হয়েছে, আশা করি ক্যাপ্টেন বিক্রমের কাছ থেকে জানতে পেরেছেন।

বাবা মাথা নেড়ে সায় জানালেন–জেনেছি।

এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?

ক্যাপ্টেন বিক্রমের সঙ্গে আমার কী কথা হয়েছে আপনি নিশ্চয়ই শুনেছেন?

শুনেছি। সামান্য হাসলেন মেজর–এই আলোচনার টেবিলে ভুলে যান আপনি আমাদের বন্দি।

আলোচনার শেষে নিশ্চয়ই আপনারা সেটা আবার মনে করিয়ে দেবেন?

নির্ভর করছে আলোচনার ফলাফল কী দাঁড়ায় তার ওপর।

বাবা ধীরেসুস্থে পাইপে তামাক ভরে ধরালেন। কয়েকবার টানতেই তামাকের মিষ্টি গন্ধে ঘরটা ভরে গেলো। টুটুলের মনে হলো–বাবা যে বলেছিলেন অন্যরকম লড়াই করবেন, তারই বুঝি প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। বাবার জন্য ভয় আর লড়াইয়ের উত্তেজনায় সারা শরীর টানটান হয়ে গেলো টুটুলের। মনে-মনে প্রতিজ্ঞা করলো, বাবার কিছু হলে এই মেজর আর ক্যাপ্টেনকে সে কখনো ক্ষমা করবে না।

আলোচনাটা আপনিই শুরু করুন মেজর রিক। শান্ত গলায় বাবা প্রথম আঘাত করার সুযোগটা প্রতিপক্ষকে দিলেন।

গম্ভীর হয়ে গেছেন মেজর-আপনাকে নিশ্চয়ই বলতে হবে না ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত আমরা কতভাবে বঞ্চিত হয়েছি, লুণ্ঠিত হয়েছি, নির্যাতিত হয়েছি, নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে অকাতরে জীবন দিয়েছি!

জানি। মনে হলো বাবা শক্তি সঞ্চয় করছেন।

বাঙালিরা আমাদের ওপর যে ধরনের অত্যাচার করছে, আপনি কি সেটা সমর্থন করেন?

বাঙালি বললে একটা গোটা জাতিকে বোঝায়। আপনি কি গোটা বাঙালি জাতিকে অভিযুক্ত করছেন?

অবশ্যই। যে এখানে আসে, সে-ই একজন শোষক আর উৎপীড়ক হয়ে দাঁড়ায়। পাহাড়ীদের তারা ঘৃণার চোখে দেখে। আপনাদের সরকার আমাদের সব জমি বাঙালিদের ইজারা দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে আমাদের মাইনরিটি বানাবার মতলব করেছে।

সরকার আর গোটা বাঙালি জাতিকে আপনি এক করে দেখছেন। এটা ঠিক নয়।

তাই নাকি! মেজরের গলায় বিদ্রূপ–এই সরকারকে তো আপনারাই ভোট দিয়ে গদিতে বসিয়েছেন। নাকি অন্য কেউ? এই সরকার যদি বাঙালিদের সরকার না হবে তাহলে এরা কাদের সরকার দয়া করে বলবেন কি?

বাঙালিরা নিশ্চয়ই জিয়াউর রহমানকে ভোট দিয়েছে। তবে এই ধরনের ভোটের যে কোনো অর্থ হয় না সেটা নিশ্চয়ই আপনাকে বুঝিয়ে বলতে হবে না? জিয়ার পেছনে আর্মি আছে। হাতে টাকা আছে। টাকা দিয়ে কি আপনাদের এলাকা থেকে ভোট কেনা হয় নি?

মেজর একটু বিব্রত হলেন–হ্যাঁ, কিছু বেইমান আমাদের মধ্যেও আছে। সব সরকারই আমাদের ভেতর থেকে দু-একটা বেইমান জোগাড় করে ছোটখাটো উপমন্ত্রী বানায়, যারা এখানে এসে টাকা দিয়ে ভোট কেনে।

আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষ খুবই গরিব। এরা যদি কারো কাছ থেকে একবেলা ভাত খাবার পয়সা পায়–তাকে ভোট দিয়ে আসে। জানে না কেন ভোট দিচ্ছে, কাকে ভোট দিচ্ছে, চেনে শুধু ভোটের মার্কা। আপনি এ-ও জানেন নিশ্চয়ই, কোথাও যদি এরকম মানুষ বেশি না পাওয়া যায়, সরকারি লোকেরা ব্যালট পেপারে ছাপ মেরে ভোটের বাক্স ভরিয়ে দেয়। এই সরকার কোনো অবস্থায় গোটা জাতির প্রতিনিধি হতে পারে না।

বাবার কথা শোনার সময় মেজরের ভুরু মাঝে-মাঝে কুঁচকে যাচ্ছিলো, কপালে ভাঁজ পড়ছিলো। টুটুল বুঝলো কথাগুলো মেজরের পছন্দ হচ্ছে না। দেশের সরকার সম্পর্কে তার মনোভাবের কথা বাবা আরো বললেন।

বাবার কথা শেষ হবার পর মেজর রুক্ষ গলায় বললেন, তারপরও তো জিয়াই আপনাদের প্রেসিডেন্ট। রাজা ত্রিদিব রায়ের মাকে উপদেষ্টা আর ছেলে দেবাশীষকে পুতুল খেলার রাজা বানিয়ে ভেবেছেন আমাদের স্বর্গ পাইয়ে দিয়েছেন। কই, কখনো তো আপনাদের বলতে শুনি নি পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের ওপর অত্যাচার হচ্ছে, জুলুম হচ্ছে। আপনারা সবসময় ভুলে যান আমরা সংখ্যায় কম হতে পারি, কিন্তু আমাদের আলাদা একটা ভাষা আছে, সংস্কৃতি আছে, সমাজ আছে, আমাদের আলাদা সত্তা আছে। আপনাদের এক প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব তো ঘোষণাই করেছিলেন, আমাদের এদেশে থাকতে হলে বাঙালি হতে হবে। আমাদের ওপর সরকারের জুলুমের বিরোধিতা না করে পরোক্ষভাবে আপনারা সরকারের এইসব অন্যায়কে সমর্থন করছেন।

মেজরের কথায় রাগ উপচে পড়ছিলো। তবু বাবা এতটুকু ধৈর্য হারালেন না। মেজরের কথা বলার সময় আস্তে-আস্তে পাইপ টানছিলেন তিনি। কথা শেষ হবার পর শান্ত গলায় বললেন, সরকারের শোষণ-পীড়ন বাংলাদেশের নব্বই ভাগ মানুষের ওপরই চলছে। শুধু আপনাদের ওপর জুলুম হচ্ছে বললে পুরো সত্য বলা হয় না। আপনি এদেশের কৃষকের অবস্থা দেখুন, শ্রমিকের অবস্থা দেখুন, খেটে খাওয়া মানুষের অবস্থা দেখুন; তাদের ওপর কত ধরনের জুলুম হচ্ছে আশা করি আপনাকে বুঝিয়ে বলতে হবে না।

না, তার দরকার হবে না। তবে আপনার জানা দরকার হদ্দ গরিব সব বাঙালি চাষা মজুর যারা এখানে এসে বসত করছে, তারাও পাহাড়ীদের ওপর জুলুম কোনো অংশে কম করছে না। আমাদের জমির ধান চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে, গরু-ছাগল নিয়ে যাচ্ছে, বাড়ির বৌ-ঝিদের নিয়ে যাচ্ছে। তারা জানে তাদের পেছনে আপনাদের থানা-পুলিশ আছে, আর্মি আছে। কোর্ট-কাঁচারি সবই আপনাদের। আমাদের বিচার চাইবার কোনো জায়গা নেই। যাবার কোনো জায়গা নেই। আমরা মরিয়া হয়ে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছি। আগে আমরা বলতাম স্বায়ত্তশাসন চাই। এখন বলি স্বাধীনতা ছাড়া আমাদের আর কোনো পথ নেই। যারা আমাদের বিরোধিতা করবে তারাই আমাদের শত্রু। আমাদের মাটিতে বাঙালিদের কোনো জায়গা হবে না।

বাবা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, আগে আমরা ভাবতাম এদেশ থেকে ব্রিটিশরা চলে গেলে আমরা স্বাধীন হবো, পাকিস্তান পাবো, সুখে থাকবো। ব্রিটিশ চলে গেলো, সাধারণ মানুষের অবস্থা বদলালো না। পাকিস্তান আমলে আমরা বলতাম পাঞ্জাবিরা চলে গেলে, আমরা পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে বাংলাদেশ বানালে সুখে থাকবো। পাঞ্জাবিরা গেলো, বাংলাদেশ এলো, সুখ কি এলো? আমার মনে হয় মেজর, এভাবে স্বাধীনতার দাবি তুলে আপনারা ঠিক করছেন না। আপনারা স্বাধীনতা পেলেই কি পার্বত্য চট্টগ্রামে শোষণ-পীড়ন বন্ধ হবে? বাঙালিদের জায়গা কি আপনাদের স্বজাতিরা নেবে না–যেমনটি নিয়েছে পাঞ্জাবিদের হটিয়ে বাঙালি শোষকরা? আপনি চাকমা। আপনি কি জানেন পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্য সব জাতি আপনাদের কি চোখে দেখে? কদিন পর টিপরা, মুরং কি মগরা আলাদাভাবে স্বাধীনতা চাইবে না?

আপনি কী বলতে চান? রীতিমতো ক্রুদ্ধ শোনালো মেজরের গলা।

আমি চাই শোষণ-পীড়নহীন বাংলাদেশ। যে দেশে বাঙালিসহ অন্য সব জাতি সমান অধিকার আর মর্যাদা নিয়ে বাস করবে, কোনো অভাব থাকবে না, জুলুম থাকবে না। খেটে খাওয়া মানুষ নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই নিয়ন্ত্রণ করবে, দেশের শাসনভারও তাদের ওপর থাকবে। আপনাদের সংগ্রামের সঙ্গে দেশে অন্য সব খেটে খাওয়া মানুষের মুক্তির লড়াই এক সুতোয় গাঁথা না হলে সত্যিকারের মুক্তি আসবে না।

বুঝেছি। মেজরের গলায় এবার উপহাস–আমাদের এলাকায় সিরাজ সিকদার আর আবদুল হকদের কিছু ছেলে কাজ করে। ওরাও এরকম কথা বলে। একটু থেমে মেজর গম্ভীর গলায় রায় ঘোষণা করলেন বাঙালিদের আমরা বিশ্বাস করি না। ওরা সব বিশ্বাসঘাতক।

টুটুল লক্ষ্য করলো, মেজরের শেষ কথাটি শুনে বাবা ভীষণ গম্ভীর হয়ে গেলেন। হেডমাস্টার এতক্ষণ কোনো কথা না বলে চুপচাপ বসে ছিলেন। বললেন, আমি এত বছর এখানে মাস্টারি করছি। ভালো করা ছাড়া কারো ওপর কোনো জুলুম করেছি এমন কথা কি কেউ বলতে পারবে? যতীন লারমা আমাদের খুব ভালো করেই চেনেন। তাঁর ভাইপো শান্তিবাহিনীর ফণী আমার ছেলের একমাত্র বন্ধু। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব যেদিন এই এলাকায় এসেছেন সেদিনই আপনাদের সম্পর্কে তাঁর সঙ্গে আমার দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। আপনাদের প্রায় সব বক্তব্যই তিনি সঠিক মনে করেন। তাঁর সম্পর্কে ভালো করে খোঁজখবর না নিয়ে এভাবে তাঁকে ধরে এনেছেন, গোলাবাড়িতে এর খুব প্রতিক্রিয়া হয়েছে। বাঙালিদের এভাবে ঢালাওভাবে সমালোচনা করা উচিত হচ্ছে না আপনার।

মেজর কাষ্ঠ হাসলেন–ব্যতিক্রম সব জায়গায় আছে। আপনারা দু-একজন ব্যতিক্রম হতে পারেন, তার মানে এই নয় যে বাঙালিমাত্রেই আমাদের বন্ধু!

এমন সময় একজন প্রহরী এসে মেজরকে কি যেন বললো। মেজর সায় জানালেন। প্রহরী চলে যাবার পর মেজর সহজ গলায় বললেন, অনেক কথা বলতে হবে আপনাদের সঙ্গে। আমাদের অবস্থাটা বুঝতে হবে আপনাদের। তার আগে রাতের খাবার খেয়ে নেয়া যাক। আমি এখানেই খাবার দিতে বলেছি।

একজন এসে টেবিলে খাবার সাজালো। ক্যাপ্টেন বিক্রম এসে ঘরে ঢুকলো। চেহারা দেখে মনে হয় একজন বন্দির সঙ্গে একটেবিলে বসে মেজরের খাওয়ার ব্যাপারে মোটেই খুশি নয় সে। মেজর বললেন, আমাদের সঙ্গে বসে পড়ো ক্যাপ্টেন বিক্রম।

টুটুলের পাশের খালি চেয়ারাটায় বসলো ক্যাপ্টেন। একটা টিনের প্লেট টেনে নিলো। খাবার খুবই সামান্য। মোটা আটার রুটি আর ডাল। ডালটা বেশ ঘন। খেতে খারাপ লাগলো না টুটুলের, তবে ঝালটা পরিমাণে অনেক বেশি। টুটুলকে বারকয়েক পানি খেতে দেখে মেজর বাবাকে বললেন, আপনার ছেলের জন্য ঝালটা একটু বেশি মনে হচ্ছে। আপনাদেরও কি লাগছে?

বাবা খেতে-খেতে বললেন, আপনার কথার চেয়ে বেশি ঝাল নয়।

এতক্ষণে মেজর সহজভাবে হাসলেন–আপনি রেগে গেছেন মনে হচ্ছে। আপনার ওপর আমাদের রাগও কিন্তু কম নয়, কী বলো ক্যাপ্টেন বিক্রম?

ক্যাপ্টেন চাকমা ভাষায় মেজরকে কি যেন বললো। মেজর জবাব দিলেন। ক্যাপ্টেন আবার কিছু বললো। আবারও মেজর জবাব দিলেন। কথা বলতে-বলতে ক্যাপ্টেন বিক্রম বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠলো। মেজরকেও অপ্রসন্ন মনে হলো। টুটুল ওদের কথায় ইঞ্জিনিয়ার শব্দটি ছাড়া আর কোনো শব্দের অর্থ বুঝলো না। শুধু এটুকু বুঝলো, ওরা বাবাকে নিয়ে আলোচনা করছে।

খাওয়া শেষ হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে ক্যাপ্টেন আর মেজরের আলোচনা শেষ হলো। আলোচনার শেষে ক্যাপ্টেনের চেহারায় রাগ আর মেজর অসম্ভব গভীর।

খাবারের এঁটো প্লেট সরিয়ে নেয়ার পর মেজর গম্ভীরভাবে হেডমাস্টারকে বললেন, এবার আমি ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের সঙ্গে একা কথা বলবো। ক্যাপ্টেন বিক্রম, এদের শোবার জায়গা দেখিয়ে দাও।

আসুন আমার সঙ্গে। বলে ক্যাপ্টেন ওদের নিয়ে দুটো ঘর পেরিয়ে একটাতে ঢুকলো। ছোট ঘরে পাশাপাশি দুটো তক্তপোষ রাখার পর সামান্য একটু চলাচলের পথ রয়েছে মাঝখান। একটা তক্তপোষের নিচে হারিকেন জ্বলছিলো।

আপনারা শুয়ে পড়ুন। আমি পাশের ঘরে আছি। এই বলে ক্যাপ্টেন ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

ক্যাপ্টেন বিক্রম চলে যাবার পর টুটুল চাপা গলায় হেডমাস্টারকে বললো, ওরা দুজন বাবাকে নিয়ে কী কথা বললো কাকা?

ক্যাপ্টেন তোমার বাবাকে ছেড়ে দেয়ার ঘোর বিরোধী। চিন্তিত গলায় বললেন হেডমাস্টার—মেজর বললেন, তোমার বাবা যদি ওদের কথায় রাজি হয় তাহলে শর্তসাপেক্ষে তাকে ছেড়ে দেয়া যেতে পারে। ক্যাপ্টেন বলছে, তাহলে নাকি এখানকার সবাই বিদ্রোহ করবে। তোমার বাবার জন্য ওদের আয়ের একটা বড় অংশ বন্ধ হয়ে গেছে।

কী ধরনের শর্ত, কিছু বলেছে?

না।

আপনার কী মনে হয় কাকা? বাবাকে ওরা কি ছাড়বে না? কথা বলতে গিয়ে গলা কেঁপে গেলো টুটুলের।

বুঝতে পারছি না টুটুল। তোমার বাবার আত্মমর্যাদাবোধ এতো বেশি, কখন ওদের কোন কথায় রেগেমেগে কী বলে বসেন বলা মুশকিল। দেখলে না, বাঙালিদের বিশ্বাসঘাতক বলাতে কীরকম রেগে গিয়েছিলেন? তখন বাধ্য হয়ে আমাকে কথা বলতে হলো, যা ওরা পছন্দ করে নি।

মেজরের সঙ্গে বাবার কথা বলার সময় বাবাকে একবারই উত্তেজিত হতে দেখেছে টুটুল। হেডমাস্টার যদি মাঝখানে কথা না বলতেন, নির্ঘাত শক্ত কোনো কথা মেজরকে শুনিয়ে দিতেন বাবা।

দূরে জঙ্গলের ভেতর শেয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছিলো। মাঝে মাঝে বুনো কুকুরের দলও ডাকছিলো। ঝিঁঝি পোকাদের একটানা ঝিম ধরানো শব্দের কোনো বিরাম নেই। হঠাৎ ফেউয়ের ডাক শুনলো টুটুল। তার মানে বিপদ কাছেই আছে। বিদ্যুৎ ওকে ফেউয়ের ডাক চিনিয়ে দিয়েছে। বলেছে, ফেউ ডাকলে বুঝতে হবে কাছাকাছি বাঘ আছে। ডোরাকাটা রয়েল বেঙ্গল নয়, কালো পাহাড়ী চিতা। গভীর জঙ্গলে থাকে।

বাবার কথা ভাবলো টুটুল। কী শর্ত দিতে চায় মেজর? ক্যাপ্টেন বিক্রম নিশ্চয়ই বাধা দেবে। কোনো অপমানজনক শর্ত বাবাও মেনে নেবেন না। বাবার কিছু হলে মেজর বা ক্যাপ্টেন কাউকেই সে ছেড়ে দেবে না–এখানে আসার পর দ্বিতীয় বার প্রতিজ্ঞা করলো টুটুল। অসহায় রাগে কান দুটো গরম হয়ে গেছে ওর। বার বার এপাশ-ওপাশ করেও অনেক রাত পর্যন্ত ঘুমোতে পারলো না। হেডমাস্টার সবই টের পেলেন। বুকের ভেতর থেকে উঠে আসা দীর্ঘশ্বাস অতি কষ্টে চাপলেন। তিনি যে জেগে আছেন টুটুলকে সেটা জানাতে চান না।