০৭-৮. পিকনিকে আরেক ঝামেলা

০৭. পিকনিকে আরেক ঝামেলা

দূর থেকে নেলী খালাদের ছবির মতো বাংলো দেখে চোখ জুড়িয়ে গেলো। চারপাশে নকশাকাটা কাঠের রেলিং ঘেরা চওড়া বারান্দা, উঁচু এ্যাসবেস্টসের চাল, পোর্টিকোর দুপাশ থেকে বোগেনভিলিয়ার লতানো ঝাড় চালের অর্ধেক ঢেকে ফেলেছে, গুচ্ছ গুচ্ছ সাদা ফুল ফুটে আছে প্রজাপতির ঝাঁকের মতো। নেলী খালা বললেন, যাই বলিস, জাহেদ কিন্তু চমৎকার বাংলো ম্যানেজ করেছে। অনেক আগে চা বাগানের বিলেতি ম্যানেজার নাকি সখ করে বানিয়েছিলো।

আমি জানতে চাইলাম, সাহেব ভূতের উৎপাত নেই তো?

আমার কথা শুনে ললি মৃদু হাসলো। নেলী খালা হাসতে হাসতে বললেন, না, এখনো শুরু হয় নি।

পোর্টিকোর নিচে জীপ থামতেই সবার আগে ছুটে এলো স্ক্যাটরা। এক লাফে নেলী খালার গায়ের ওপর পা তুলে আদরের জন্য চোখ বুজে গলাটা বাড়িয়ে দিলো। তারপর আমাদের গা শুঁকে অভ্যর্থনা জানালো। নেলী খালা বললেন, স্ক্যাটরা জায়গাটা খুব পছন্দ করেছে।

ভেতর থেকে নানু বেরিয়ে এলেন। খবরের কাগজ পড়ছিলেন বোধ হয়–হ্যাতে নিয়েই বেরিয়েছেন। মৃদু হেসে বললেন, আমি আরো আগে আশা করছিলাম তোমাদের। ট্রেন নিশ্চয়ই লেট করেছে!

আমি আর বাবু নানুর পা ছুঁয়ে সালাম করলাম! টুনি বললো, পুরো পঁচিশ মিনিট লেট করেছে ট্রেন।

বাবু বললো, বাংলাদেশের ট্রেন পঁচিশ মিনিট লেট করেছে, এটা বলার মতো কোনো ব্যাপার নয়।

কে বলেছিলো বাংলাদেশের ট্রেনে উঠতে? সুযোগ পেয়ে বাবুকে খোঁচাতে ভুললো না টুনি–আমেরিকা থেকে কয়েকখানা ট্রেন সঙ্গে নিয়ে এলে না হয় বুঝতাম।

আড়চোখে তাকিয়ে দেখি, বাবু টুনিকে জিব দেখিয়ে ভালো মানুষের মতো নানুর আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালো। আর টুনি কিছু বলতে গিয়ে ললির চিমটি খেয়ে থমকে গিয়ে কটমট করে তাকালো বাবুর দিকে। নেলী খালা বললেন, মেয়েদের পাশের ঘরটা তোমাদের। এখনো সব গোছানো হয় নি, কাল থেকে তোমরা আমাকে আমাকে ঘর গোছাতে সাহায্য করবে।

টুনি আদুরে গলায় বললো, বারে, কাল যে আমাদের পিকনিক যাওয়ার কথা নেলী খালা!

বাবু গম্ভীর হয়ে বললো, নেলী খালা আমাদের বলেছেন ঘর গোছাতে। আমাদের নিশ্চয়ই পিকনিকে যাওয়ার কথা নয়।

বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। হাসতে হাসতে নেলী খালা বললেন, ললি, টুনি আগেই ঠিক করে রেখেছে, তোমরা আজ এলে, কাল তোমাদের নিয়ে পিকনিক করবে।

নানু বললেন, তোমরা ঘরে যাও। কাপড়-জামা বদলে মুখ-হাত ধুয়ে খেতে এসো। নেলী, বড়িবিকে টেবিল লাগাতে বলল। জাহেদ বলেছে ওর ফিরতে রাত হবে।

টুনি যাওয়ার আগে বাবুকে টুক করে একটু খানি ভেংচি কাটলো, কেউ দেখতে পেলো না, এমনকি ললিও নয়। বাবু একটু গম্ভীর হয়ে ঘরে ঢুকে দরজাটা আস্তে করে বন্ধ করলো–টুনিটা ভারি ফাজিল হয়েছে। এই বলে বিছানার ওপর বসলো।

নুলিয়াছড়ির বাড়ির মতো ঘরগুলো বড়ো না হলেও দেখতে সুন্দর। এক দিকের দেয়ালে পুরোনো আমলের ফ্রেমে বাঁধানো সমুদ্রে সূর্য ডোবার পেইন্টিং, নিচে দুটো গদিওয়ালা চেয়ার, অন্য দিকের দেয়ালে বারান্দামুখি দুটো বড়ো কাঁচের দরজা। একদিকে বড় একটা ওয়ার্ডরোব, মাঝখানে দুটো সিঙ্গেল খাট। খাটের পাশে ছোট বেডসাইড কার্পেট। মেঝেতে লাল-কালো সিমেন্টের চৌকো নকশা আঁকা।

আমি সুটকেস খুলে দরকারি কাপড়গুলো ওয়ার্ডরোবে রাখতে রাখতে বললাম, চুনির জন্য কী এনেছিলে, দেবে না?

বাবু ততক্ষণে বিছানায় শুয়ে পড়েছে। সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে বললো, তার আগে ললির সঙ্গে কথা বলতে হবে।

আমি হাসতে হাসতে বললাম, টুনিকে তুমি দুবার জিব দেখিয়েছে। একহাতে তালি বাজে না বাবু।

আমার কথা শুনে বাবু হেসে ফেললো–দুবার নয় তিনবার, টুনি দেখিয়েছে চার বার। তুমি সব দেখেছো তাহলে?

না দেখে উপায় কি! ললিও দেখেছে। কাল পিকনিকে যাচ্ছো তো? ঘর গোছাতে চাইলে আমাকে পাচ্ছে না।

না গিয়ে উপায় কি! লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বাবু একটু করুণ গলায় বললো, জানতাম, ওদের পেলে তুমি আমার দিকে ফিরেও তাকাবে না।

আমি হেসে ফেললাম–সন্ধ্যের পর তুমি কতবার আমার সঙ্গে কথা বলেছো হিসেব রেখেছি।

কী সাংঘাতিক! বিছানা থেকে তড়াক করে লাফিয়ে উঠলো বাবু। তুমি এত কিছু খেয়াল করো নাকি! বুঝেছি, ললির কপালে অনেক দুর্ভোগ আছে।

ললি তো বলে ওর জন্য আমাকে দুর্ভোগ পোহাতে হবে।

কেন, ও কী করেছে?

হার্টের অসুখটা নিয়ে ও বড়ো বেশি ভাবে।

কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে বাবুর ছেলেমানুষি থেমে গেলো। গম্ভীর হয়ে বললো, বেচারা! ওর অসুখের কথা মনে হলে সত্যি খারাপ লাগে। টুনি একবার লিখেছিলো, ডাক্তার নাকি বলেছে হঠাৎ একটা কিছু হয়ে যেতে পারে।

আমি কোনো কথা না বলে মাথা নেড়ে সায় জানালাম। কথাটা আমিও জানি। লক্ষ্য করেছি গতবারের চেয়ে এবার ললিকে একটু বেশি গম্ভীর মনে হচ্ছে।

বাইরে থেকে নেলী খালা ডাকলেন, আবির, বাবু, তাড়াতাড়ি মুখ হাত ধুয়ে খেতে এসো।

ঘর থেকে বেরিয়ে দেখি সবাই খাবার টেবিলে বসে গেছে। জাহেদ মামা তখনো আসেন নি। বড়িবি ট্রেতে করে বাটি এনে টেবিলে রাখছে। নুলিয়াছড়ির মতো ললি আর টুনি বসেছে একদিকে। নেলী খালাও ওদের সারিতে। আমরা ওদের মুখোমুখি বসলাম। মাঝখানে বসেছেন নানু।

টেবিলের বাটিতে ধোয়া-ওঠা মাংস আর কয়েক রকম সবজির রান্না। দেখে টের পেলাম বেশ খিদে লেগেছে। নানু বললেন, সবাই নিজে নিজে তুলে নাও, খেতে বসে লজ্জা কোরো না।

খাওয়া শেষ করে ঘরে এসে বাবু বললো, মনে হচ্ছে কাল সারদিন না খেলেও চলবে।

আমি হেসে বললাম, কাল টুনি রান্না করবে। না খেয়ে বুঝি পার পাবে?

বাবুও হেসে ফেললো–তাই তো বলছি। উল্টো-পাল্টা কি-না-কি রান্না করে, না খেলেও অসুবিধে হবে না।

কে উল্টো-পাল্টা বেঁধেছে শুনি? বলতে বলতে ঘরে ঢুকলেন নেলী খালা।

আপনি না। আমি টুনির কথা বলছি। আমতা-আমতা করে বাবু বললো, কাল পিকনিকে কি-না-কি রান্না হয়–

পিকনিকে যদি উল্টো-পাল্টা রান্না না হয় তবে তো অর্ধেক মজাই মাটি। আজ আর রাত জেগে না। কাল ভোরে উঠতে হবে। মেয়েদেরও বলেছি ঘুমিয়ে পড়তে। এই বলে নেলী খালা ঘরের আলো নিভিয়ে নীল ডিম লাইট জ্বালিয়ে চলে গেলেন।

আমার সত্যি সত্যি ঘুম পেয়েছে। হাই তুলে বাবু বললো, তুমিও শুয়ে পড়ো আবির।

সারা দিনের ট্রেন জার্নির পর আমারও ঘুম পাচ্ছিলো। স্লিপিং ড্রেস পরে কম্বলের নিচে ঢুকে চোখ বন্ধ করতেই মনে হলো ট্রেনের কামরায় শুয়ে আছি আর ট্রেনটা পাথারিয়া কতদূর, পাথারিয়া কতদূর বলে এক বিশাল প্রান্তরের মাঝখান দিয়ে ছুটে চলেছে। ট্রেনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দুটো লাল-সাদা মাসতাং ঘোড়ার পিঠে চেপে ছুটছে পল নিউম্যান আর রবার্ট রেডফোর্ড। দেখতে দেখতে ট্রেনটা চলে গেলো টেক্সাসের দিগন্ত জোড়া মরুভূমির ভেতর। রুক্ষ প্রান্তরের এখানে-সেখানে একটা দুটো বিরাট ক্যাকটাস গাছ দাঁড়িয়ে আছে। ট্রেনের দুলুনি অনুভব করতে করতে এক সময় গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম।

পুরো নয় ঘন্টা ঘুমিয়ে ছিলাম একেবারে মড়ার মতো। হঠাৎ মনে হলো রবার্ট রেডফোর্ড কি যেন বলছেন। চোখ কচলে পিটপিট করে তাকিয়ে দেখি রেডফোর্ড বলছে আর কত ঘুমোবে ইয়ংম্যান!

পাশ ফিরে শুতে যাবো, কানের ভেতর কে যেন পালক দিয়ে সুড়সুড়ি দিলো। ধড়মড় করে উঠে বসে দেখি টুনি ফিক ফিক করে হাসছে, পেছনে জাহেদ মামা দাঁড়িয়ে। হাসিমুখে বললেন, অনেকক্ষণ ধরে ডাকছি শোনো নি?

হাই তুলতে তুলতে বললাম, আমি তো ভাবলাম রবার্ট রেডফোর্ড।

টুনি হি-হি করে হাসতে হাসতে বললো, জাহেদ মামা, দেখেছেন? বাবুর কাছে আমেরিকার গল্প শুনতে শুনতে ঘুমের ভেতরও ওখানকার স্বপ্ন দেখছে। এইবার আসলটাকে দেখাচ্ছি। এই বলে টুনি বাবুর কানের ভেতর পালক দিয়ে সুড়সুড়ি দিলো।

বাবু কম্বলে মাথা ঢেকে বললো, আবির, ভালো হবে না বলছি।

টুনির হাসি আর থামে না। আমি বাবুকে ধাক্কা দিলাম–আমাকে নয়, যাকে বলার তাকে বলো?

টুনি একছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। বাবু বিরক্ত হয়ে উঠে বসলোকাকে কী বলবো?

জাহেদ মামাকে দেখে বাবু লজ্জা পেলো। বললো, জাহেদ মামা, কখন এসেছেন? নেলী খালা আপনার জন্য বসে আছেন।

এসে এক ঘুম দিয়ে উঠেছি। এখন সকাল সাতটা। সবাই তোমাদের এক ঘন্টা আগে উঠে রেডি হয়ে আছে। বাথরুমে গরম পানি আছে। গোসল সেরে ফেলো।

তাই তো! মনে পড়লো, আজ পিকনিক। কম্বল ফেলে ছুটলাম বাথরুমে। বাবু গেলো আরেকটায়। কুড়ি মিনিটের ভেতর দুজন তৈরি হয়ে খাবার টেবিলে এলাম। নেলী খালাদের নাশতা খাওয়া ততক্ষণে হয়ে গেছে। বললেন, তোমরা এতোটা পথ ট্রেন জার্নি করেছে, তাই আগে ঘুম ভাঙাই নি। টুনি জোর করে জাহেদকে পাঠালো তোমাদের ঘুম ভাঙাবার জন্য।

ললি, টুনি স্টোর-রুম থেকে জিনিসপত্র বের করছিলো। মাঝে মাঝে টুনির গলা শোনা যাচ্ছিলো। বড়িবি একটা একটা করে পরোটা ভেজে গরম থাকতে থাকতে আমাদের এনে দিচ্ছিলো। একটু পরে ললি এসে বললো, লাকড়ি কি এখান থেকে নিতে হবে নেলী খালা?

সাদা প্যান্টের ওপর সাদা-কমলা জংলী ছাপের কামিজ আর তার ওপর কমলা রঙের কার্ডিগান পরেছে ললি। চুলগুলো খোলা, কাল বোধ হয় শ্যাম্পু করেছে। চশমার নিচে বিষণ্ণ মায়াময় দুটি চোখ। মুখটাকে মনে হলো শিশির-ভেজা ভোরের শিউলি ফুলের মতো। আমার দিকে একবার তাকিয়ে মৃদু হাসলো ললি। নেলী খালা বললেন, লাকড়ি যদি এখান থেকে নেবে, তাহলে আর পিকনিক কেন ললি! তোমাদের জাহেদ মামা একটু আগে বলছিলো, বাবুর্চিকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে। ওকে আমি বকে দিয়েছি।

টুনি চেঁচিয়ে ডাকলো, এতোক্ষণ ওখানে কী করছো ললিপা? সব কাজ আমি একা করবো নাকি!

ললি একটু লজ্জা পেয়ে চলে গেলো। নাশতা শেষ করে আমি আর বাবু গেলাম ওদের যদি সাহায্যের দরকার হয়। বাবু জানতে চাইলো, কী করতে হবে বলো।

টুনি বললো, এতোক্ষণে এলেন–কী করতে হবে। জিনিসপত্রগুলো নিয়ে জীপে তুললে তো হয়।

বাবু আর আমি হাঁড়ি-পাতিল, বালতি, পানিভর্তি জেরিকেন, চারটা মুরগি আর টুকরি বোঝাই জিনিসপত্র নিয়ে জীপে রাখলাম। বাবু এসে বললো, এবার বলো তোমাদের জীপে তুলে দেবো নাকি!

টুনি বাবুকে জিব দেখিয়ে বললো, সখ কত দেখোনা ললিপা!

ললি মৃদু হেসে বললো, আমি কিন্তু তোমাকে কিছু বলি নি বাবু।

সরি। একটু লজ্জা পেলো বাবু–আমরা কি এখনই রওনা দেবো?

নেলী খালা এসে বললেন, তোমরা গাড়িতে উঠে বসো। জাহেদ আমাদের নামিয়ে দিয়ে যাবে।

আমরা যাচ্ছি কোথায় ললি?

প্রশ্ন শুনে আমাদের দিকে তাকালো ললি। বললো, কাল সকালে গিয়ে দেখে এসেছি। বেশি দূরে নয়। জায়গাটা সুন্দর। অনেক গাছ আছে, পুকুর আছে।

আমরা চারজন জীপের পেছনে উঠলাম। স্ক্যাটরা আমাদের আগে থেকেই উঠে বসেছিলো। নেলী খালা আর জাহেদ মামা একটু পরেই এলেন। নানু দুপুরে যাবেন। জাহেদ মামা জীপে স্টার্ট দিয়ে বললেন, ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে আমার কাজ শেষ হয়ে যাবে। তারপর সোজা চলে আসবো তোমাদের কাছে।

নেলী খালা বললেন, জিনিসপত্র সব ঠিকমতো দেখে নিয়েছে তো ললি?

টুনি বললো, আমি সব লিস্ট মিলিয়ে নিয়েছি নেলী খালা। ললিপার যা ভুলো মন!

জাহেদ মামা গাড়ি চালাতে চালাতে বললেন, কবিদের একটু ভুলো মন হয়।

লজ্জায় লাল হয়ে ললি বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলো। কদিন আগে কচি কাঁচার আসরে ললির কবিতা ছাপা হয়েছে। আমি যদিও লুকিয়ে গল্প লিখি, এখন পর্যন্ত আমার কোনো লেখা কোথাও ছাপতে দিই নি। এর আগে ললির পাঁচটা কবিতা কচি কাঁচার আসর আর খেলাঘরে ছাপা হয়েছে। টুনি বললো, স্কুলে আমাদের বাংলার ডালমুট আপা ললিপার নাম দিয়েছেন কামিনী রায়।

ললি একটু বিরক্ত হয়ে বললো, এসব কথা তোমার কাছে কে শুনতে চেয়েছে টুনি?

জাহেদ মামা বললেন, কামিনী রায়ের মতো কবি হতে পারাটা খারাপ কিছু নয় ললি।

বাবু বললো, আমি তোমাদের স্কুলে থাকলে টুনির নাম রাখতাম গেছোনী রায়।

বুঝতে না পেরে টুনি ঠোঁট বাঁকালো–এটা কোনো নাম হলো? গেছোনী মানে কী?

বাবু গম্ভীর হয়ে বললো, গেছোনী মানে গেছে পেত্নি, মানে তুমি।

কী! চিৎকার করে টুনি বাবুকে মারার জন্য যেই হাত তুলেছে, তক্ষুণি জীপটা গর্তে পড়ে ঝাঁকুনি খেলো আর বাবুর মাথার সঙ্গে টুনির মাথার ঠোকাঠুকি হয়ে গেলো।

নেলী খালা মৃদু হেসে জাহেদ মামাকে বললেন, আস্তে চালাও, আমরা এসে গেছি।

দশ মিনিটের ভেতর আমরা পিকনিকের জায়গায় চলে এলাম। ললি ঠিকই বলেছিলো, এক কথায় অপূর্ব সুন্দর জায়গা। জীপটা এসে থামলো বিশাল পুরোনো এক রেইনট্রির নিচে। গাছের গুঁড়িটা বেগুনি, সাদা আর গোলাপি অর্কিড ফুলে ছেয়ে আছে। পাশে বেশ বড়ো একটা পুকুর। দুদিকে উঁচু টিলার মতো। গাছগুলো সব অনেক পুরনো। বুনোলতা আর আগাছায় জঙ্গল হয়ে আছে। পুকুরটা কেউ ব্যবহার করে বলে মনে হলো না। অর্ধেকের বেশি সবুজ দাম-শ্যাওলায় ছেয়ে গেছে। পানির রঙ টলটলে কালো। মাঝে মাঝে একা দুটো বড়ো মাছ ঘাই দিচ্ছে। চারদিক একেবারে শুনশান, গুবরে পোকার উড়ে যাওয়ার শব্দও শোনা যাচ্ছে। কোথাও ঝোঁপের আড়ালে বুনো ফুল ফুটেছে। মিষ্টি অথচ কড়া একটা গন্ধে বাতাস ভারি হয়ে আছে। বাবু বললো, এর চেয়ে সুন্দর জায়গায় পিকনিক করার কথা আমি ভাবতেও পারি না।

জাহেদ মামা আমাদের নামিয়ে দিয়ে জিপে সোঁ-সে শব্দ তুলে চলে গেলেন। জীপের শব্দ মিলিয়ে যাবার পর আবার সেই ঝাঁঝালো গন্ধ-ভরা নিরবতা। নেলী খালা দুটো বড় চাদর পাশাপাশি বিছিয়ে জিনিসপত্র সব গুছিয়ে রাখলেন। ঘড়ি দেখে বললেন, নটা বাজতে চলেছে। আবির, বাবু জলদি কিছু শুকনো পাতা আর লাকড়ি নিয়ে এসো। ততক্ষণে আমরা চুলোটা বানিয়ে ফেলি।

স্ক্যাটরা বোধ হয় প্রকৃতির ডাক শুনেছিলো। জীপ থামার সঙ্গে সঙ্গেই একছুটে জঙ্গলে ঢুকে গেছে। আমি আর বাবু ধারালো কাটারি নিয়ে জঙ্গলের দিকে গেলাম। একটু পরেই শুনি স্ক্যাটরার গগ গলার আওয়াজ। সন্দেহজনক কিছু দেখলে ও এরকম শব্দ করে। বাবু আমার দিকে তাকালো। পা টিপে টিপে স্ক্যাটরার কাছে গিয়ে কাউকে দেখতে পেলাম না। কোথাও জনমানুষের কোনো সাড়া নেই। দুটো ঘুঘু পাখি শুধু অবিরাম ডেকে চলেছে।

আমাদের দেখে স্ক্যাটরা খুশি হয়ে সামনের ঝোঁপটার দিকে দৌড়ে গেলো। ঠিক তক্ষুণি রোগা লিকপিকে একটা লোক ঝোঁপের ভেতর থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসে আমাকে সামনে পেয়ে দুহাতে জড়িয়ে ধরলো-ইয়াল্লা! আস্তা আজরাইল আইছে রে। ইতা আমারে খাইয়া ফালাইব রে!

লোকটার কাণ্ড দেখে শুধু আমি আর বাবু নয়, স্ক্যাটরা পর্যন্ত হতভম্ব হয়ে গেলো। খুবই নিরীহ চেহারার, পরনে লুঙ্গি, গায়ে চাদর, মাঝবয়সী লোকটা তড়বড় করে বললো, আফনারার কুত্তারে আটকাইক্কা। ইড়া মানুষ মারি ফালাইতো ফারে। আমি তারে কিছু করছি না। আমি কয়টা লাকড়ি খড়ি টুকাইতে আইছিলাম। আমি আর কুন দিন আইতাম নারে।

আমি বললাম, ভয় পাওয়ার কিছু নেই, ওটা খুব ভালো কুকুর। চোর-ডাকাত আর খারাপ লোক ছাড়া কাউকে কামড়ায় না।

আমি চুর-ডাকাইত না। ইটাগঞ্জ চা বাগানে আমার চাচাতো ভাইর বাসায় বেড়ানিত আইছিলাম। আমারে আফনেরা বাঁচান।

বাবু বললো, তুমি কি লাকড়ি বিক্রি কর?

ক্যামনে বেচি? জঙ্গলে লাকড়ি কাটতে গেলে ফারমিশন লাগে। আমি রান্ধার লাগি কয়টা লাকড়ি টুকানিত আইছিলাম। কুত্তাটা আমারে দেখিয়া যে আওয়াজ দিছে শুনিয়া আমি জানের ডরে ওই জায়গায় লুখাইছিলাম।

লোকটাকে যে স্ক্যাটরার পছন্দ হয় নি ওর তাকানো দেখেই সেটা বোঝা যাচ্ছিলো। মাঝে মাঝে গগরু শব্দ করছিলো। তাতে লোকটা ভয়ে আরো জড়সড় হয়ে পারলে মাটির তলায় ঢুকে যায়। আমি মজা করার জন্যে বললাম, তুমি যদি ভালো লোক হতে স্ক্যাটরা তোমাকে দেখে এমন রেগে যেতো না। সত্যি করে বলল কে তুমি? এখানে কী করছিলে?

লোকটা কী বলতে যাবে, স্ক্যাটরা মৃদু গর্জন করলোঘেউ। অচেনা কোনো নার্ভাস টাইপের লোকের পিলে চমকাবার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট। লোকটা হাউমাউ করে বললো, আমার কুন দুষ নাই। এক ব্যাটায় আমারে দশ ট্যাকা দিয়া কইছে, গাড়িআলা সাব, বিবি সাবে কিতা কয় না কয় সব হুনিয়া তার খাছে গিয়া খইতাম।

লোকটার কথা শুনে বাবুর চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে গেলো। অবাক আমিও কম। হই নি। বলে কী লোকটা! আমাদের ওপর কে ওকে গোয়েন্দাগিরি করতে লাগলো? ধমক দিয়ে লোকটাকে প্রশ্ন করলাম, কে তোমাকে টাকা দিয়েছে? কোথায় থাকে সে? কোথায় দেখা করতে বলেছে?

আমার সঙ্গে সঙ্গে স্ক্যাটরাও বললো, ঘেউ।

আঁতকে উঠে লোকটা বললো, তারে আমি চিনি না। আগে কুনদিন দেকছি না! আমারে কইছে ইটাগঞ্জ বাগানের রাস্তার মোড়অ মগরিবের অক্তে যাইতে। আমারে আফনারা ছাড়িয়া দেউক্কা। আমার কুন দোষ নাই। আর কুনদিন আমি এই কাম করতাম না।

তোমাকে এখন ছাড়া যাবে না। লাকড়ি যা কেটেছে ওগুলো নিয়ে আমাদের সঙ্গে চলো। এই বলে আমি স্ক্যাটরার দিকে তাকালাম–স্ক্যাটরা, খেয়াল রাখবে লোকটা যাতে পালাতে না পারে।

স্ক্যাটরা, কটমট করে লোকটার দিকে তাকিয়ে বললো, ঘেউ, ঘেউ।

লোকটার চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো, হাঁটতে ঠোকাঠুকি হতে লাগলো, ঢোক গিলে কোনো রকমে বললো, আমি পলাইমু না।

লোকটা যে, ঝোঁপের ভেতর লুকিয়েছিলো, বাবু সেখানে গিয়ে গোছা বাঁধা লাকড়ি দেখতে পেলো। স্ক্যাটরা না থাকলে লোকটা কখানো ওর আসল উদ্দেশ্যের কথা স্বীকার করতো না। যে-ই ওকে পাঠাক, সে নিশ্চয়ই স্ক্যাটরার কথা ভাবে নি। লাকড়ির বোঝাটা এনে লোকটার মাথায় চাপিয়ে বাবু বললো, চলো এবার।

দুহাতে মাথার বোঝা আঁকড়ে বারবার পেছনে তাকাতে তাকাতে লোকটা আমাদের আগে আগে হাঁটতে লাগলো। স্ক্যাটরা যতক্ষণ আছে, লোকটা কোথাও পালাতে পারবে না। বাবু চাপা উত্তেজিত গলায় বললো, তোমার কী মনে হয় আবির, লোকটাকে কে পাঠিয়েছে?

আমিও ঠিক এই কথাটাই ভাবছিলাম। বললাম, আমার মনে হয় এর পেছনে পাকড়াশীর হাত থাকতে পারে।

অচেনা এক লোকের মাথায় লাকড়ির বোঝা চাপিয়ে আমাদের আসতে দেখে নেলী খালা একটু অবাক হলেন। বললেন, এইটুক পথে এতটুকু একটা বোঝা নেয়ার জন্য ফুলবাবুদের বুঝি কুলি ভাড়া করতে হয়েছে?

স্ক্যাটরা ছুটে গিয়ে নেলী খালাকে বললো ঘেউ ঘেউ।

আমি কাষ্ঠ হেসে বললাম, কুলি কাকে বলছো নেলী খালা! একে পাঠানো হয়েছে তোমার আর জাহেদ মামার ওপর নজর রাখার জন্য।

আমার কথা শুনে ললি টুনি আকাশ থেকে পড়লো। নেলী খালার অবস্থাও ওদের মতো–কে পাঠিয়েছে ওকে?

বুঝতে পারছি না। সম্ভবত পাকড়াশী।

ললি অবাক হয়ে জানতে চাইলো, কোন পাকড়াশী?

টুনি একটু বিরক্ত হয়ে ললিকে বললো, তুমি কয়টা পাকড়াশীকে চেনো ললিপা? নুলিয়াছড়ির পাজি পাকড়াশীটার কথা মনে নেই?

নেলী খালা খেই না পেয়ে বললেন, একে কিভাবে পেলে খুলে বলো তো সব! আহ্ স্ক্যাটরা, সরো এখন। আমরা সিরিয়াস কথা বলছি।

স্ক্যাটরা ওর কাজের জন্য একটু আদর পেতে নেলী খালার পায়ে নাক ঘষতেই বিরক্ত হয়ে নেলী খালা ওকে ধমক দিলেন। স্ক্যাটরা মুখ কালো করে আমার কাছে চলে এলো। তারপর কটমট করে লোকটার দিকে তাকাতেই মাথার বোঝা ফেলে এক লাফে সে নেলী খালার আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালো।

স্ক্যাটরাকে বকছো কেন? ও না থাকলে এই শয়তানটাকে বুঝি ধরতে পারতাম। শোন তাহলে। লোকটাকে ধরার পুরো ঘটনাটা নেলী খালাকে খুলে বললাম।

সব শুনে নেলী খালা এসে স্ক্যাটরাকে আদর করলেন, কী লক্ষ্মী দেখো তো! আমি মিছেমিছি বকলাম।

ললি বললো, একে এখন কী করবে?

নেলী খালা বললেন, যা করার জাহেদ এসে করবে। এই লোক, ওই গাছটার নিচে গিয়ে বসো। পালাবার চেষ্টা করলে স্ক্যাটরা তোমাকে কুচি কুচি করে ফেলবে।

স্ক্যাটরাকে কিছুই বলতে হলো না। লোকটা ওর দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে জারুল গাছটার নিচে গিয়ে বসলো। স্ক্যাটরা একবার নেলী খালাকে তাকিয়ে দেখলো। তারপর হেলেদুলে লোকটার অল্প দূরে গিয়ে সামনের পায়ের ওপর মুখ রেখে শুয়ে পড়লো।

.

০৮. ছবি করার আমন্ত্রণ

স্ক্যাটরার কাণ্ড দেখে আমরা হেসে বাঁচি না। সিঁড়িঙ্গে লোকটা ভয়ে কাঠ হয়ে স্ক্যাটরাকে দেখতে লাগলো।

মুখ টিপে হেসে নেলী খালা বললেন, এবার কোনো চিন্তা নেই। সবাই এসো, রান্নাটা সেরে ফেলি।

একটু পরে টুনি গিয়ে লোকটার হাতে দুটো বাতি ধরিয়ে দিয়ে বললো, যাও, পুকুর থেকে পানি নিয়ে এসো।

লোকটা একবার অসহায় চোখে স্ক্যাটরার দিকে তাকালো। তারপর বালতি হাতে । পুকুরের দিকে যেতেই স্ক্যাটরা ওর পিছু নিলো। নেলী খালা বললেন, টুনি, ভালো বুদ্ধি বের করেছো তো!

ফিক করে হেসে টুনি বললো, আমরা সবাই কাজ করবো, ও বুঝি বসে বসে খাবে!

আমরা সবাই লোকটার উপস্থিতি ভুলে গিয়ে পিকনিকের রান্না নিয়ে মেতে উঠলাম। আমি মাটি কেটে দুটো চুলো বানাতে বানাতে বাবু, নেলী খালা মুরগি কেটে বেছে রেডি করলো। ললি টুনি আগে থেকেই তরকারি কুটছিলো। পেঁয়াজ কাটতে বসে ললির চোখের পানি আর নাকের পানিতে একাকার। নিরীহ গলায় টুনি বললো, কার জন্য কেঁদে বুক ভাসাচ্ছো লালিপা?

ললি রুমালে নাক-চোখ মুছে বললো, তুমি খুব ফাজিল হয়েছে টুনি।

বাবু বললো, আমি বইয়ে পড়েছি, গেছোনীরা কখনো কাঁদে না।

আবার অসভ্য কথা? এই বলে টুনি উঠে গিয়ে ধুপ করে বাবুর পিঠে একটা কিল বসালো। নেলী খালা তখন অল্প দূরে বসে মাংস ধুচ্ছিলেন বলে এসব দেখতে পেলেন না। ললি বললো, তুমি কিছু বললে ভালো কথা আর বাবু বললে বুঝি অসভ্য কথা?

ললিকে বাবুর পক্ষ নিয়ে বলতে দেখে টুনির মুখ ভার হলো–ঠিক আছে ললিপা, এখন থেকে তুমি ওদের সঙ্গেই থেকো। আমি রাতেও তোমার সঙ্গে থাকবে না।

বাবু বললো, তোমাদের তো বলা হয় নি, লোকটা নেলী খালাদের বাংলোর কথা কী বলেছিলো!

বাবুর কথা বলার ধরন দেখে আমি মুখ টিপে হাসলাম। জানি, বাবু এখন বানিয়ে বানিয়ে একটা গল্পো বলবে। ললি জানতে চাইলো, কী বলেছিলো বাবু?

নেলী খালাদের বাংলোটা এক বিলেতি সাহেবের, এ কথা তোমরা শুনেছে। তবে সেই সাহেব যে মেমটাকে গুলি করে খুন করে নিজের গলায় ফাঁসি দিয়ে মরেছিলো সে কথা আমাদের ওই লোকটা বলেছে। এখানকার সবাই দেখেছে, প্রতি পূর্ণিমার রাতে মুণ্ডুকাটা এক সাহেব ঘোড়া ছুটিয়ে বাংলোর চারপাশে ঘুরে বেড়ায়, আর মেমটা বাংলোর বারান্দায় হাঁটে।

সত্যি লোকটা এসব কথা বলেছে? ললির কথা শুনে মনে হলো, ও বাবুর কথা বিশ্বাস করেছে।

টুনি শুকনো গলায় বললো, আমাদের ওরা ভয় দেখাচ্ছে ললিপা!

ওরা বলছো কেন? হাসতে হাসতে বললাম, আমি কিছু বলেছি?

ঢোক গিলে ললি বললো, তুমি তখন এসব কথা বলে নি কেন?

কি জ্বালা! লোকটা যদি কিছু না বলে, আমি কোত্থেকে বলবো?

দেখলে তো ললিপা, বাবু কী পাজি! টুনি আশ্বস্ত হয়ে বললো, তুমি তো সব সময় ওর হয়ে আমাকে বকো!

বাবু করুণ গলায় বললো, তোমরা যদি বলো আমি কারো সঙ্গে ঠাট্টা করতে পারবো না, তাহলে কালই আমি ঢাকা চলে যাচ্ছি।

ললি অপ্রস্তুত হয়ে বললো, বা রে, আমরা কখন বললাম, ঠাট্টা করা যাবে না? তুমি তো জানো, টুনির ভীষণ ভূতের ভয়!

তোমার বুঝি কোনো ভয় নেই ললিপা! টুনি আবার রেগে গেলো–ঠিক আছে, তুমি থেকো তোমার ঘরে। আমি আবিরদের সঙ্গে থাকবো।

কেন আবিরদের সঙ্গে থাকবে? নেলী খালা এসে মুখ টিপে হেসে বললেন, আমি বলে দিয়েছি না, ছেলেরা মেয়েরা আলাদা ঘরে শোবে!

নেলী খালার কথার ধরন দেখে টুনি ছাড়া আমরা সবাই হো-হো করে হেসে ফেললাম। কোণঠাসা হয়ে টুনি বাবুকে জিব দেখিয়ে ভাব করলো।

সবাই মিলে কাজ করাতে দুপুর একটার মধ্যে আমাদের ডিমের খিচুড়ি, মুরগির মাংস, সবজি ভাজি আর সালাদ তৈরী হয়ে গেলো। ঠিক একটা দশে জাহেদ মামা এলেন নানু আর বড়িবিকে নিয়ে আমরা ততক্ষণে চাদর ঝেড়ে প্লেট ধুয়ে সাজিয়ে ফেলেছি।

জাহেদ মামা জীপ থেকে নামতে নামতে বললেন, খিদে যা লেগেছিলো, খিচুড়ির গন্ধ পেয়ে ডবল হয়ে গেছে। একি! এ লোকটা কোত্থেকে এসেছে?

জাহেদ মামার পরনে আর্মির ইউনিফর্ম দেখে লোকটা হাউমাউ করে ছুটে এসে ওঁর পায়ে পড়লো–আমার কুন দুষ নাই সাব। এই কাম জীবনেও করতাম নায়। এই আমি নাকো কানো ধরছি। আমারে এই কুত্তার আথ থাকি বাঁচাইন।

জাহেদ মামা অবাক হয়ে বললেন, কি করেছে স্ক্যাটরা? ওকে কি কামড়ে দিয়েছে?

স্ক্যটরা ওকে কিছু করে নি। আপনাদের বাঁচিয়েছে পাকড়াশীর গোয়েন্দাগিরি থেকে। এই বলে আমি পুরো ঘটনাটা আরেকবার বললাম।

স্ট্রেঞ্জ! বলে জাহেদ মামা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর আপন মনে বললেন, পাকড়াশী আমাদের কথা শোনার জন্য এতো ব্যস্ত হবে কেন? মনে হচ্ছে আর কেউ হতে পারে। এরপর লোকটাকে বললেন, মগরেব পর্যন্ত তুমি আমাদের কাছে থাকবে। যে লোক তোমাকে টাকা দিয়েছে, তাকে দেখাতে পারলে তুমি ছাড়া পাবে, নাহলে থানায় পাঠাবো।

লোকটা আশ্বস্ত হয়ে বললো, এই কুত্তার থাকি থানা অনেক বালা।

নানু কম কথা বলেন। সব শুনে তিনি শুধু বললেন, খাওয়ার পর আমরা দেরি করবো না। ঘরে ফিরে বিশ্রাম নেয়া যাবে।

নেলী খালা আদুরে গলায় বললেন, আব্ব, আমাদের পিকনিকের কী হবে!

পিকনিক আরেক দিন করতে পারবে। নানু কথা বাড়াতে চাইলেন না।

আমাদের খাওয়ার সময় লোকটাকেও খেতে দেয়া হলো। ওর খাওয়ার ধরন দেখে মনে হলো বহুদিন ভালো কিছু পেটে পড়ে নি। সবাই যথারীতি নেলী খালার রান্নার প্রশংসা করলো। আর নেলী খালাও যথারীতি লালটাল হলেন। স্ক্যাটরাকে মশলা-দেয়া রান্না খাওয়ানো হয় না। ওর জন্য নেলী খালা আলাদা রান্না করেছিলেন। স্ক্যাটরার চেহারা দেখে মনে হলো রান্না ওরও পছন্দ হয়েছে।

সবার খাওয়া শেষ হলে টুনি লোকটাকে দিয়ে এঁটো প্লেট, গ্লাস, হাঁড়ি-পাতিল সব ধোয়ালো। লোকটার চেহারায় ভয় ভয় ভাবটা আর নেই, তার বদলে চোখের ভেতর ধূর্তামির ভাব। নিজে থেকেই কাজ করতে চাইছে। আমি বাবুকে বললাম, চারপাশে নজর রেখো, লোকটার সঙ্গে আর কেউ থাকতে পারে।

বাবু মৃদু হেসে বললো, স্ক্যাটরাকে দেখছো না? ও ঠিকই টের পাবে।

বড়ো রকমের কাজের দায়িত্ব পেয়ে স্ক্যাটরাকে রীতিমতো গর্বিত মনে হচ্ছিলো। লোকটার ওপর নজর রাখার সময় মাঝে মাঝে আড়চোখে আমাদের দিকে তাকাচ্ছিলো।

জিনিসপত্র জাহেদ মামা আর বড়িবি গোছালো। সব গাড়িতে তোলার পর নেলী খালা বললেন, আমি আব্বু আর বড়িবিকে নিয়ে চলে যাই। গাড়িতে সবার জায়গা হবে না।

আমি হেসে বললাম। সবার না হলেও জাহেদ মামার নিশ্চয় হবে। জাহেদ মামাকে তুমি নিয়ে যেতে পারো!

জাহেদ মামা বললেন, আমার অবশ্য একটু তাড়াতাড়ি যাওয়া দরকার। তোমরা কি পথ চিনে যেতে পারবে?

কী যে বলেন! বাবু আত্মবিশ্বাসের গলায় বললো, আমরা ঠিকই পথ চিনতে পারবো।

টুনি বললো, বা রে, আমাদের সঙ্গে স্ক্যাটরা আছে না!

নানু মৃদু হেসে বললেন, জাহেদ, ওরা যখন চাইছে না, তোমার চলে আসা উচিত।

জাহেদ মামা হেসে বাবুর পিঠ চাপড়ে জীপে গিয়ে বসলেন। জীপটা চোখের আড়াল হতেই লোকটা গোপনে এদিকে-ওদিক তাকালো। মনে হলো কারো অপেক্ষায় আছে। স্ক্যাটরা গম্ভীর গলায় একবার ঘেউ বলার সঙ্গে সঙ্গে লোকটা ভিজেবেড়াল হয়ে গেলো। টুনি নেলী খালার মতো গলা ভারি করে বললো, এই লোক, তুমি সামনে হাঁটবে। পালাবার মতলব করলে তোমার কি হবে, সেটা স্ক্যাটরা ভালোমতোই জানে।

জীপে আসতে যেখানে দশ মিনিট লেগেছিলো।, পায়ে হেঁটে বাংলো পৌঁছতে আমাদের সেখানে আধ ঘন্টার বেশি লাগলো। বাংলোর কাছে এসে দেখি লনে নেলী খালার সঙ্গে বসে গল্প করছেন কিশোর পারেখ আর তার ম্যানেজার বন্ধু। গেটের বাইরে ওদের জীপটা দাঁড় করানো।

আমাদের দেখেই কিশোরদা ফুর্তিভরা গলায় বললেন, আরে এসো এসো! দারুণ কাজ করে ফেলেছো শুনলাম! এই বুঝি সেই স্পাইটা?

স্পাই বললে সিনেমায় যেরকম স্মার্ট হিরো দেখা যায়, শুটকো লোকটাকে মোটেই সেরকম মনে হয় না। টুনি বললো, এ মা, এটাকে আপনি স্পাই বলছেন! শুনলে মাসুদ রানারা হার্টফেল করবে।

বাবু বললো, কিশোরদার মতো হ্যাঁণ্ডসাম না হলে স্পাই মানায় না।

কিশোরদা একট অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, কী যে বলো! ওসব বইয়ে আর ছবিতেই হয়। রিয়েল লাইফে স্পাইদের খুব সাদামাটা চেহারার হতে হয়। মনে রাখার মতো চেহারা হলেই বিপদ।

কিশোরদার বন্ধু মনিদা নেলী খালাকে বললেন, এ লোকটাকে থানায় দেয়া দরকার, মিসেস আহমেদ।

আমি বললাম, থানায় দেয়ার আগে জানতে হবে কে ওকে টাকা দিয়েছিলো। যে এ কাজ করেছে, সে নিশ্চয়ই নেলী খালাদের ভালো চায় না।

মণিদা বললেন, এই উচ্চিংড়ির কাছ থেকে কথা বের করা কী এমন কঠিন কাজ। আমার হাতে দশ মিনিটের জন্য ছেড়ে দিন, পেট থেকে সব কথা বের করে ফেলবো।

নেলী খালা ইংরেজিতে বললেন, মারধোর করা আমি পছন্দ করি না মিস্টার মুনির। এ ব্যাপারে যা করার জাহেদ এসে করবে।

হা-হা করে হাসলেন মণিদা–আমি কি একবারও বলেছি মারধোর করবো! বাগানে আমাকে কুলি চরিয়ে খেতে হয়। কথা বের করার কিছু কৌশল আমাকে রপ্ত করতে হয়েছে। ফিজিক্যাল টর্চার আমারও অপছন্দ, খুবই প্রিমিটিভ ব্যাপার ওটা।

আমরা সবাই লনে রাখা বেতের চেয়ারে বসে আছি। লোকটা অল্প দূরে দাঁড়িয়ে মণিদার কথায় কিম্বা স্ক্যাটরার ভয়ে রীতিমতো কাঁপছিলো। নেলী খালা মণিদাকে বললেন, দেরি করবেন বললেন, মারধোর না করে যদি কথা বের করা যায়, করুন।

মনিদা বললেন, সবার সামনে হবে না। আমি ওকে নিয়ে আড়ালে যেতে চাই। সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে গেলে অসুবিধে হবে মিসেস আহমেদ?

না, অসুবিধে কিসের। নেলী খালা নির্লিপ্ত গলায় বললেন, দেরি করবেন না, আমি চা দিতে বলছি। আপনার বাগানের চা পরখ করে দেখি।

টেবিলের ওপর দেখলাম পলিথিন ব্যাগে তিন-চার পাউণ্ড চায়ের পাতা। নেলী খালা ব্যাগটা নিয়ে ঘরের দিকে গেলেন। মণিদা লোকটাকে শক্ত গলায় বললেন, আমার সঙ্গে এসো।

ওরা দুজন চলে যাবার পর কিশোরদা মৃদু হেসে বললেন, তোমরা নাকি এ্যাডভেঞ্চার খুব পছন্দ করো? তোমাদের নেলী খালা বলছিলেন, কসেস বাজারে তোমরা কিভাবে একটা স্মাগলারকে শায়েস্তা করেছিলে। দারুণ ইন্টারেস্টিং। শুনে মনে হয়েছে, এ প্লটটা নিয়ে ছোটদের জন্য দারুণ একটা ছবি হতে পারে।

সত্যি বলছেন! চোখ দুটো মার্বেলের মতো গোল করে টুনি বললো, ছবিতে কারা এ্যাকটিং করবে? আমাদের নাম থাকবে তো?

তোমাদের নাম থাকবে না কেন? এ্যাকটিং ও তোমরা করবে, যদি তোমাদের কারো গার্জেনদের আপত্তি না থাকে।

ফ্যানটাস্টিক আইডিয়া! উত্তেজিত গলায় বাবু বললো, আমাদের কারো গার্জেনই আপত্তি করবে না।

মিষ্টি হেসে কিশোরদা বললেন, আমি তোমাদের নেলী খালার কাছে ঘটনাটা শুনেই ছবি করার কথা বলেছি। তিনি বললেন, তোমরা চাইলে ওঁর কোনো আপত্তি নেই।

আপনি কী ভালো কিশোরদা! বাচ্চাদের মতো খুশিতে চেঁচিয়ে উঠলো টুনি–ললিপা, কি মজা হবে, তাই না?

ললি মৃদু হেসে বললো, ছবি করার জন্য কি নুলিয়াছড়ি যেতে হবে?

মনে হয় ওখানে যাওয়া ঠিক হবে না। শুটিং এখানেও হতে পারে। কসেসবাজার গিয়ে কিছু প্যাঁচওয়ার্ক করে নেবো।

আমি বললাম, এখানে ওরকম পুরোনো বাড়ি পাবেন কোথায়?

ওটাই প্যাঁচওয়ার্কের ব্যাপার। এখানকার কয়েকটা ঘর ওরকমভাবে সাজিয়ে নিলেই হয়ে যাবে। তোমরা ছাড়া আর কেউ তো জানে না নুলিয়াছড়ির ঘর-বাড়ি কেমন ছিলো! কিশোরদার মুখে মিটিমিটি হাসি।

ললি বললো, আপনি আমাদের সঙ্গে ঠাট্টা করছেন না তো!

ছিঃ, ঠাট্টা করবো কেন? সিরিয়াস গলায় কিশোরদা বললেন, বেশ কিছু দিন ধরে ছোটদের জন্য একা শর্ট ফিচার ফিল্ম করবো ভাবছিলাম। গত বছর বিবিসিও আমাকে বলেছিলো এ নিয়ে ভাবতে। আসলে কানাডা বা আমেরিকায় ওখানকার ছেলেমেদের নিয়ে ছবি করার ব্যাপারে আমি খুব একটা উৎসাহ পাচ্ছিলাম না। ছোটদের জন্য ওয়াইল্ড লাইফের ওপর একটা ভেবে রেখেছি, যদিও ওটা ঠিক ফিচার ফিলম হবে না। তোমাদের আপত্তি না থাকলে হাতের কাজটা শেষ করেই ওটা শুরু করবো। এই ফাঁকে একটা স্ক্রিপ্টও লিখে ফেলবো। তবে আগেই বলে রাখি, যা ঘটেছিলো হুবহু সেরকম হবে ভেবো না। গল্পের জন্য রদবদল হতে পারে অনেক কিছু।

বাবু ব্যস্ত হয়ে বললো, আপনি যতো খুশি রদবদল করুন, আমাদের মোটেই আপত্তি নেই। টুনির ঝোলানো খোঁপা দুটো যদি মাথার ওপর শিং-এর মতো উঁচিয়ে থাকে, তাহলেও আপত্তি করবো না।

কী? চেঁচিয়ে উঠে টুনি বাবুকে কিল মারার জন্য চেয়ার থেকে উঠতেই বাবু দৌড় লাগালো। টুনিও দৌড়ালো ওর পেছন পেছন। কিশোরদা হাসতে হাসতে বললেন, বাবুর কথা বলার ধরন আর টুনির এক্সপ্রেশন লক্ষ্য করেছো আবির? ছবির জন্য দারুণ হবে!

নেলী খালা ট্রেতে করে চা এনে টুনি, বাবু কোথায় জিজ্ঞেস করলেন। বললাম, টুনি বাবুকে মারার জন্য তাড়া করছে। ওরা এখন চা খাওয়া পছন্দ করবে না। কিশোরদা কী বলছেন, জানো নেলী খালা?

জানি, ছবি করার কথা তো? সবাই রাজি হলেও জাহেদ নিশ্চয়ই অভিনয় করতে রাজি হবে না

ওটাও আমি ভেবে রেখেছি। হাসতে হাসতে কিশোরদা বললেন, এ ছবি করার জন্য আমাকে ঢাকা থেকে এক জন ক্যামেরাম্যান, দুতিনজন এ্যাসিসটেন্ট আর কিছু জিনিসপত্র আনতে হবে। আমি ঠিক করেছি আপনি আপত্তি না করলে মেজর জাহেদের পার্টটা আমিই করবো।

নেলী খালা অপ্রস্তুত হলেন–অভিনয়ের ব্যাপার, আপত্তির কী আছে!

নেলী খালার কথা শেষ না হতেই দেখি মণিদা লোকটাকে নিয়ে সার্ভেন্টস কোয়ার্টার থেকে বেরুলেন। এতোক্ষণ স্ক্যাটরাও ওখানে বসে ছিলো। লোকটাকে দূরে বসিয়ে মণিদা এসে ওর চেয়ারে বসলেন। ক্লান্ত গলায় বললেন, লোকটা সম্ভবত কিছুই জানে না মিসেস আহমেদ।

কিশোরদা প্রশ্ন করলেন, সম্ভবত বলছিস কেন মণি?

বলছি এ জন্যে, বারবার সে একই কথা বলেছে। আমি যে পদ্ধতিতে কথা বলি, সাধারণ নার্ভের লোক এতোক্ষণ স্টিক করতে পারে না। লোকটা হয় ইনোসেন্ট–-পয়সার জন্য এমন কাজ করতে রাজি হয়েছে, নাহলে বলতে হবে বড়ো ধরনের কোনো অভিনেতা। থানায় নিয়ে আদিম পদ্ধতিতেই কথা বের করতে হবে। মিসেস চৌধুরীর পছন্দ-অপছন্দকে পুলিশের লোকেরা গুরুত্ব নাও দিতে পারে।

তাহলে থানায় দেয়ার দরকার নেই। নেলী খালা বললেন, আমারও মনে হয় লোকটা তেমন কিছু জানে না।

আমি বললাম, থানায় দিলে পুলিশ অবশ্য চেক করে দেখতে পারতো লোকটা তার যে পরিচয় বা ঠিকানা দিয়েছে সেটা সত্যি কিনা।

পরিচয় মিথ্যে বলে নি। মণিদা বললেন, ওটা আমি যাচাই করে নিয়েছি। লোকটা ইটাগঞ্জ টী এস্টেটের কথা বলেছে, ওটা আমারই বাগান। আজ সন্ধ্যায় ওকে ছেড়ে নজর রাখলেই হবে কে আসে ওর কাছে।

তোর এ আইডিয়াটা মন্দ নয়। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে কিশোরদা বললেন, আশা করি মেজর জাহেদ এ বিষয়ে আপত্তি করবেন না।

না না, আপত্তি করবে কেন? আসলে কদিন ধরে জাহেদ এতো ব্যস্ত যে এ নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় ওর নেই। লোকটার ওপর নজর রাখার ব্যাপারে বাবুরা আপনাকে সাহায্য করতে পারবে। এই বলে আমার দিকে তাকিয়ে নেলী খালা মুখ টিপে হাসলেন।

মণিদা একটু ভেবে বললেন, আমার মনে হয় বাবুদের এ কাজে জড়ানো ঠিক হবে না। অচেনা লোকজন দেখলে কেউ যদি আসার কথা ভেবে থাকে, সিদ্ধান্ত পাল্টাতে পারে। আমি বরং আমার গার্ড দুটোকে বলবো দূর থেকে লোকটাকে চোখে চোখে রাখতে।

ওকে কি সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চান? জানতে চাইলেন নেলী খালা।

আপনার আপত্তি না থাকলে নিয়ে যেতে পারি। যদি অন্যরকম কিছু দেখি, রাতে আপনাদের সঙ্গে না হয় যোগাযোগ করবো।

কিশোরদা বললেন, আজ তাহলে উঠি মিসেস আহমেদ। যে কদিন আছি মাঝে মাঝে বিরক্ত করবো। আর আপনি কিন্তু জাহেদ সাহেবকে আমার শু্যটিংএর ব্যাপারে বলবেন। কাল সকালে অফিসে ওঁর সঙ্গে দেখা করবো।

নেলী খালা মৃদু হেসে বললেন, ঠিক আছে, বলবো।

লোকটাকে সঙ্গে নিয়ে কিশোরদারা চলে গেলেন। নেলী খালা আমাকে বললেন, টুনি, বাবু বেড়াতে বেরিয়েছে, তোমরাও না হয় কিছুক্ষণ বেড়িয়ে এসো। দূরে কোথাও যেও না।

ললি মিষ্টি হেসে বললো, স্ক্যাটরাকে নিয়ে যাই?

ওকে কি রেখে যেতে পারবে? হাসতে হাসতে নেলী খালা বললেন, বেড়ানোর সুযোগ পেলে ও আর কিছু চায় না।