প্রেম ও কলেরা – ৩

ডাক্তার লুসিডাস অলিভেল্লার স্ত্রী আমিন্তা দেশাম্প আর তাঁদের একই রকম পরিশ্রমী সাত কন্যা রজত-জয়ন্তির মধ্যাহ্ন ভোজের যাবতীয় খুঁটিনাটি এমন সুচারু রূপে সম্পন্ন করেছিলেন যাতে ঘটনাটি বছরের সেরা সামাজিক ঘটনা বলে চিহ্নিত হতে পারে। তাঁদের পারিবারিক ভবন ছিল ঐতিহাসিক জেলার একেবারে কেন্দ্ৰে, প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী এক ভবন, যার আসল প্রকৃতি ফ্লোরেন্সের এক স্থপতি নষ্ট করে দিয়েছিল। ওই স্থপতি একটা কু-বাতাসের মতো এখানে আসে, নবীকরণের ধ্যান- ধারণা নিয়ে। সপ্তদশ শতাব্দির অনেক ধ্বংসাবশেষকে সে রূপান্তরিত করে ভেনেশীয় প্রাসাদে। ডাক্তার অলিভেল্লার শহরের ওই বাড়িতে ছিল ছটি শোবার ঘর, সুন্দর হাওয়া চলাচলের ব্যবস্থা রাখা একটি বড় খাবার ঘর ও একটি বড় অভ্যর্থনা কক্ষ, কিন্তু শহর থেকে এবং শহরের বাইরে থেকে আসা অতিথিদের জন্য এ জায়গাও যথেষ্ট হতো না। বাড়ির উঠানটি ছিল কোনো মঠের নির্জন প্রকোষ্ঠের মতো, তার মাঝখানে কুলকুল ধ্বনি তোলা একটা পাথরের ফোয়ারা, হেলিওট্রোপ ফুলের টব তার চারপাশে সাজানো, গোধূলিলগ্নে সেটা বাড়িটিকে সুরভিত করে তুলতো, কিন্তু তার লতামণ্ডিত পথ ও চত্বরে এত বিপুল সংখ্যক প্রাচীন ও মর্যাদাবান পরিবারের সদস্যদের স্থান সঙ্কুলান হত না। তাই সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে ভোজসভা তাঁদের গ্রামের বাসভবনে অনুষ্ঠিত হবে, মোটরে করে মহাসড়ক দিয়ে গেলে মাত্র দশ মিনিটের পথ। সেখানে আছে এক একরের বেশি জায়গা নিয়ে বিশাল উঠান, বড় বড় লরেল গাছ, আর পাশের শান্ত প্রবাহিত নদীতে অজস্র স্থানীয় জলপদ্মের সম্ভার। সিনোরা অলিভেল্লার তত্ত্বাবধানে ডন সাঙ্কোর হোটেল থেকে আসা লোকরা রৌদ্রালোকিত জায়গাগুলিতে রঙিন ক্যানভাসের চাঁদোয়া টানিয়ে দিয়েছে, লরেল গাছগুলির নিচে একটা বড় পাটাতনের ওপর একশো বিশজন অতিথির জন্য অনেকগুলি টেবিল সাজিয়েছে, প্রত্যেক টেবিলের ওপর লিনেনের টেবিলক্লথ বিছিয়ে দিয়েছে, আর সব চাইতে সম্মানিত টেবিলের উপর স্থাপন করেছে সেদিনের সদ্য তোলা তাজা গোলাপের গুচ্ছ। একটা কাঠের মঞ্চ ও তারা নির্মাণ করেছে, সেখানে ব্যান্ডের শিল্পীরা শুধু নির্ধারিত গান ও নাচের বাজনা বাজাবে। সিনোরা অলিভেল্লার সর্বজনশ্রদ্ধেয় শিক্ষক আজকের ভোজসভায় পৌরহিত্য করবেন। তাঁকে একটা সানন্দ চমক দেবার উদ্যেশ্যে সিনোরা অলিভেল্লা স্কুল অব ফাইন আর্টস থেকে চার সদস্যের একটি বিশেষ বাদক দলকে নিয়ে এসেছেন। স্বামীর ডিগ্রি লাভের বার্ষিকীর তারিখের সঙ্গে পেন্টেকস্টের রবিবারের তারিখটি না মিললেও উৎসবের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য তাঁরা এই তারিখটিই বেছে নেন।

পাছে সময়াভাবে অপরিহার্য কিছু বাদ পড়ে যায় এই ভয়ে তিন মাস আগে থেকে আজকের আয়োজন শুরু করা হয়। তাঁরা সিনেগা দ্যা ওরো থেকে জ্যান্ত মুরগি কিনে আনেন। সমগ্র উপকূল জুড়ে ওই মুরগি ছিল বিখ্যাত, শুধু তাদের আকার ও স্বাদের জন্যই নয়, আরো একটা কারণে। সেই ঔপনিবেশিক যুগ থেকে এই সব মুরগি বন্যার জল জমা মাটিতে খুঁটে খুঁটে খাবার খেয়েছে এবং মাঝে মাঝে তাদের পাকস্থলিতে খাঁটি সোনার ছোট ছোট পিণ্ড পাওয়া গেছে। তাঁর স্বামীর উল্লেখযোগ্য অর্জনসমূহকে যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শনের জন্য সিনোরা অলিভেল্লা, তাঁর কয়েকটি মেয়ে ও পরিচারক নিয়ে, বিলাসবহুল সামুদ্রিক জাহাজে বেরিয়ে পড়েন এবং সব জায়গা থেকে সর্বোৎকৃষ্ট জিনিসগুলি সংগ্রহ করেন। তিনি পূর্বাহ্নেই সব কিছু অনুমান করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়েছিলেন, শুধু একটা বিষয় তিনি খেয়াল করেননি, উৎসব উদযাপিত হবে এ বছর জুন মাসে, এক রবিবারে, যখন দেরিতে বর্ষা নামে। মাত্র আজ সকালে হাই ম্যাস-এ গিয়ে তিনি এই বিপদটি সম্পর্কে সচেতন হন। বাতাসের আর্দ্রতা তাঁকে শঙ্কিত করে তোলে। তিনি দেখেন যে আকাশ ভারি ও নিচু হয়ে এসেছে, সমুদ্রের দিগন্ত রেখা প্রায় দেখা যায় না। এই সব অশুভ লক্ষণ সত্ত্বেও অ্যাস্ট্রনমিক্যাল অবসার্ভেটরির পরিচালক, যার সঙ্গে গির্জাতেই তাঁর দেখা হয়, তাকে স্মরণ করিয়ে দেন যে এই শহরের সমগ্র বিক্ষুব্ধ ইতিহাসে এমনকি নির্মমতম শীতের সময়েও পেন্টেকস্টের সময় কখনো বৃষ্টি হয়নি। কিন্তু ঘড়িতে যখন বারটার ঘণ্টা বাজলো, অনেক অতিথি যখন বাইরের মাঠে প্রাক-লাঞ্চ হালকা সুরা পান করছিলেন তখন অকস্মাৎ একটা প্রচণ্ড বজ্রপাতের শব্দ হল, মাটি কেঁপে উঠল থরথর করে, সমুদ্রের দিক থেকে একটা মত্ত হাওয়া এসে টেবিল-চেয়ার উল্টে দিল, চাঁদোয়া উড়িয়ে নিল, আর গোটা আকাশ একটা বিধ্বংসী বর্ষণ ধারায় ভেঙে পড়ল।

ঝড়ের তাণ্ডবলীলার মধ্যে ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো, দেরিতে আসা আরো কয়েকজন অতিথির সঙ্গে, পথে তিনি যাদের দেখা পান, অনেক কষ্টে নিমন্ত্রণদাতার বাড়িতে এসে উপস্থিত হন। তিনিও তাঁদের মতো এক পাথর খণ্ড থেকে অন্য পাথর খণ্ডে লাফ দিয়ে কর্দমাক্ত উঠান পার হতে চাইলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত একটা হলুদ ক্যানভাসের চাঁদোয়ার নিচে ঢেকে ডন সাঙ্কোর লোকেরা তাঁকে বহন করে নিয়ে গেল। ওরা বাড়ির ভেতরে নতুন করে আলাদা আলাদা টেবিল স্থাপন করল, এমনকি শোবার ঘরগুলিতেও, আর অতিথিরা তাঁদের বিরক্ত মেজাজ লুকাবার কোন চেষ্টা করলেন না। ঝড়ো হাওয়ায় বৃষ্টির ঝাপ্টা এড়াবার জন্য বাড়ির জানালাগুলি বন্ধ করে দেয়া হয়, ফলে গোটা বাড়ি হয়ে উঠেছিল একটা জাহাজের বয়লার রুমের মতো উষ্ণ। উঠানের টেবিলগুলিতে প্রত্যেক অতিথির নামাঙ্কিত কার্ড ছিল। তদানীন্তন প্রথা অনুযায়ী একাংশ ছিল পুরুষদের জন্য সংরক্ষিত, অন্য অংশ মেয়েদের জন্য। কিন্তু বাড়ির ভেতর নামাঙ্কিত কার্ডগুলি সব এলোমেলো হয়ে যায়, অতিথিরা যে যেখানে পারলেন বসে পড়লেন, আর অন্তত এই একবারের মতো আমাদের সামাজিক কুসংস্কারের আগল ভেঙে বাধ্যতামূলক ভাবে মেয়েপুরুষ একসঙ্গে বসে গেলেন। ওই জলপ্লাবনের মধ্যে আমিন্তা অলিভেল্লাকে যেন সর্বত্র একই সময়ে উপস্থিত দেখা গেল। তাঁর চুল ভিজে চুপচুপ, তাঁর অপূর্ব সুন্দর পোশাকটি কাদায় কাদাময়, কিন্তু এই দুর্ভাগ্যের মধ্যেও তিনি তাঁর অপরাজেয় হাসিটি অটুট রেখেছেন, এই শিক্ষা তিনি নিয়েছিলেন তাঁর স্বামীর কাছ থেকে, ওই হাসি দুর্ভাগ্যকে কোন ছাড় দেয় না। তাঁর মেয়েরাও ছিল একই ধাতুতে তৈরি। তাদের সহায়তায় টেবিলের আসনগুলি সুশৃঙ্খল রাখতে তিনি সম্ভাব্য সব কিছু করলেন। ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো বসলেন মাঝখানে, তাঁর ডানপাশে বসলেন আর্চবিশপ অবডুলিও রে। ফারমিনা ডাজা বসলেন তাঁর স্বামীর পাশে, যেমন তিনি সব সময় বসতেন, তাঁর ভয় হত পাছে তাঁর স্বামী খেতে খেতেই ঘুমিয়ে পড়েন কিংবা জামায় স্যুপ ফেলে দেন। ডাক্তার উরবিনোর উল্টোদিকে বসেছেন ডাক্তার লুসিডাস অলিভেল্লা, প্রায় পঞ্চাশ বছরের সুরক্ষিত এক ব্যক্তি, কিছুটা মেয়েলি ধরনের, যাঁর উৎসবমুখর ভাবভঙ্গির সঙ্গে তাঁর নির্ভুল রোগ নির্ণয় ক্ষমতার কোনো মিল ছিল না। টেবিলের অন্যান্য অংশে বসেছিলেন প্রাদেশিক সরকার ও পৌর কর্পোরেশনের অফিসাররা, আর গত বছরের সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার বিজয়িনী সুন্দরী, যাকে পথ দেখিয়ে সঙ্গে নিয়ে আসেন গভর্নর এবং নিজের পাশে বসান। যদিও এই সব আমন্ত্রণে বিশেষ পোশাক পরতে অনুরোধ করার কোনো প্রচলিত প্রথা ছিল না, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে মধ্যাহ্ন ভোজের আমন্ত্রণে, তবু মহিলারা পরে এসেছিলেন নৈশকালীন গাউন ও দামি অলঙ্কার, আর বেশির ভাগ ভদ্রলোক টাইসহ ডিনার জ্যাকেট, কেউ কেউ ফ্রককোটও। শুধু বিশেষ পরিশীলিত কয়েকজন, যাদের মধ্যে ডাক্তার উরবিনোও ছিলেন, তাঁরা তাদের সাধারণ পোশাক পরে এসেছিলেন। প্রতিটি টেবিলে ছিল ছোট্ট সোনালি নকশা আঁকা ফরাসি ভাষায় মুদ্রিত পরিবেশিতব্য খাদ্যদ্রব্যের নাম-তালিকা।

সর্বনাশা গরমে আতঙ্কিত ও দিশেহারা সিনোরা অলিভেল্লা বাড়ির সর্বত্র ঘুরে ঘুরে ভদ্রলোকদের লাঞ্চ খাবার সময় তাঁদের কোট খুলে রাখতে বললেন। কিন্তু এ কাজে প্রথম এগিয়ে আসার সাহস কেউ দেখালেন না। আর্চবিশপ ডাক্তার উরবিনোকে বললেন যে এক দিক থেকে এ একটা ঐতিহাসিক লাঞ্চ : এই প্রথম বারের মতো দেশ স্বাধীন হবার পর যে দু’টি পরস্পরবিরোধী দল গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে দেশটিকে রক্তাক্ত করেছে তারা একসঙ্গে এক টেবিলে বসেছে, তাদের ক্ষত নিরাময় ও ক্রোধ প্রশমিত হয়েছে। এই চিন্তা উদারপন্থীদের উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে মিলে গেল, বিশেষ করে অপেক্ষাকৃত অল্প বয়সীদের ক্ষেত্রে, যারা পঁয়তাল্লিশ বছরের রক্ষণশীল আধিপত্যের পর তাদের দল থেকে এবার একজন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করতে সক্ষম হয়েছে। ডাক্তার উরবিনো অবশ্য একমত হন নি, তবে তিনি আর্চবিশপের মন্তব্যের প্রতিবাদ করতে ও চান নি, যদিও আর্চবিশপকে তাঁর বলতে ইচ্ছা হয়েছিল যে যারা এই পার্টিতে এসেছেন তারা তাদের মতবাদের ভিত্তিতে এখানে আসেন নি, তারা এসেছেন তাদের বংশ মর্যাদার ভিত্তিতে, যে ব্যাপারটি সর্বদাই রাজনীতির সঙ্কট ও যুদ্ধের ভয়াবহতার ঊর্ধ্বে অবস্থান করে এসেছে। তাঁর মতে একজন উদারপন্থী রাষ্ট্রপতি হুবহু একজন রক্ষণশীল রাষ্ট্রপতির মতোই, তবে তাঁর পোশাক-পরিচ্ছদ অত সুন্দর নয়!

যেমন আকস্মিকভাবে বর্ষণধারা শুরু হয়েছিল তেমনি আকস্মিক ভাবেই তা একসময় ক্ষান্ত হল, আবার মেঘমুক্ত আকাশে সূর্য হেসে উঠলো, কিন্তু ঝড়ের তাণ্ডবে বেশ কয়েকটি গাছ শিকড়শুদ্ধ উপড়ে পড়েছে। আর উপচেপড়া জলস্রোত উঠানকে একটা জলাভূমিতে পরিণত করেছে। সব চাইতে বেশি বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে রান্নাঘর। বাড়ির পেছন দিকে ইটের উপর বসিয়ে কাঠের উনুন বানানো হয়েছিল, বাবুর্চিরা কোনো রকমে তাদের হাঁড়িগুলি বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়। জলভর্তি রান্নাঘরকে ঠিকঠিক করতে ও পেছনের গ্যালারিতে নতুন উনুন বসাতে তাদের অনেকটা সময় অপচয় হয়। কিন্তু দুপুর একটা নাগাদ সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। শুধু মিষ্টি এখনো এসে পৌঁছায় নি। সিস্টার্স অব সেইন্ট ক্লেয়ারের ওপর এটার ভার ছিল, তারা কথা দিয়েছিলেন যে বেলা এগারোটার আগেই তা এখানে পৌঁছে যাবে। এখন ভয় হল মহাসড়কের এক জায়গায় যে খাতটি আছে তা হয়তো জলমগ্ন হয়ে গেছে। আজকের চাইতে কম শীতের সময়েও ওই জায়গা ডুবে যেতো, আর সেক্ষেত্রে এখানে মিষ্টি এসে পৌঁছাতে কমপক্ষে আরো দু’ঘণ্টা লেগে যাবে।

আবহাওয়া পরিষ্কার হওয়া মাত্র ওরা ঘরের জানালাগুলি খুলে দেয়। গন্ধকযুক্ত ঝড় বাইরের বাতাস পরিশুদ্ধ করে দিয়েছিল, সেই বাতাস বাড়িতে ঢুকে বাড়িটাকে শীতল করল। তখন বারান্দার বেদিতে ব্যান্ড তাদের অনুষ্ঠান শুরু করল। এবার গোলমাল আরো বেড়ে গেল। বাড়ির ভেতরের তামার পাত্রগুলি থেকে খটাং খটাং শব্দ ভেসে এলো, আর ওই শব্দ ছাপিয়ে গান শোনার জন্য প্রত্যেকে হইচই করে উঠল। অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে প্রায় কান্নার অবস্থায় পৌঁছেও হাসিমুখ অক্ষুণ্ণ রেখে আমিস্তা অলিভেল্লা খাবার পরিবেশন করার নির্দেশ দিলেন।

স্কুল অব ফাইন আর্টস-এর দলটি মোৎসার্ভের লা শেজ দিয়ে তাদের অনুষ্ঠান শুরু করল। প্রথম পঙ্ক্তিগুলির সময় একটা আনুষ্ঠানিক নীরবতা বিরাজ করে। কিন্তু তারপর অনেকের উচ্চ কণ্ঠ শোনা যেতে থাকে। ডন সাঙ্কোর কৃষ্ণাঙ্গ পরিচারকরা ঘন করে বসানো টেবিলগুলির মধ্যে দিয়ে গরম ভাপ ওঠা খাবার পাত্রগুলি নিয়ে কোনরকমে ঠেলেঠুলে এগিয়ে যায়, কিন্তু এতসব হট্টগোল এবং বিভ্রান্তির মধ্যেও ডাক্তার উরবিনো প্রোগ্রামটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ওই দিকে তাঁর একটা চ্যানেল ঠিক খোলা রাখতে সক্ষম হন। তাঁর বর্তমান সময়ে মনঃসংযোগের ক্ষমতা এতটাই হ্রাস পেয়েছিল যে দাবা খেলার সময় পরবর্তী কী চাল দেবার পরিকল্পনা তিনি করছেন তা তিনি কাগজে লিখে রাখতেন। তবু এখনো একটা গুরুত্বপূর্ণ সংলাপ চালিয়ে যাবার পাশাপাশি একই সঙ্গে তিনি একটা কনসার্টও চমৎকার অনুসরণ করতে পারতেন। অবশ্য অস্ট্রিয়ায় বাসকালে তাঁর এক অতি বিশিষ্ট বন্ধু জনৈক জার্মান অর্কেস্ট্রা কন্ডাক্টরকে যে চূড়ান্ত অসামান্য ক্ষমতার অধিকারী হতে তিনি দেখেছিলেন তা তিনি কখনো অর্জন করতে পারেন নি। ওই শিল্পী টানহাউসার শুনতে শুনতে ডন জিওভানির স্বরলিপি পড়তেন।

অনুষ্ঠান সূচিতে মোৎসার্তের পরে ছিল শুবার্টের মৃত্যু এবং কুমারী মেয়ে। ডাক্তার উরবিনোর মনে হল এটা ওরা বড় বেশি সহজবোধ্য নাটকীয়তার সঙ্গে বাজাচ্ছে। তিনি ঢাকনা দেয়া পাত্রগুলির ঝন ঝন শব্দের মধ্য দিয়ে কান খাড়া করে বাজনাটা শোনার চেষ্টা করলেন, এই সময় লজ্জায় গাল লাল হয়ে যাওয়া একটি তরুণের ওপর তাঁর চোখ পড়ল আর তরুণটি তখনই মাথা নেড়ে তাঁকে সম্ভাষণ জানালো। তিনি যে তাকে কোথাও দেখেছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু কোথায় সেটা কিছুতেই মনে করতে পারলেন না। প্রায়ই এ ব্যাপারটা ঘটছিল, বিশেষ করে মানুষের নামের ক্ষেত্রে, যাদের তিনি খুব ভালো করে চেনেন তাদের ক্ষেত্রেও, কিংবা কোনো একটা গান বা বাজনার সুরের ক্ষেত্রে এবং তখন তিনি এমন তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় আক্রান্ত হতেন যে একদিন রাতে তাঁর মনে হয়েছিল যে সকাল পর্যন্ত ওই যন্ত্রণা ভোগ করার চাইতে তাঁর মরে যাওয়াই শ্রেয়। এই মুহূর্তে তিনি প্রায় সে-অবস্থায় উপনীত হচ্ছিলেন, এমন সময় একটা দয়াবান বিদ্যুৎ-চমক তাঁর স্মৃতিকে আলোকিত করে দিল। গত বছর এই ছেলেটি তাঁর ছাত্র ছিল। ওকে এখানে এই বিশেষ নির্বাচিত ব্যক্তিদের মধ্যে দেখে তিনি বিস্মিত হলেন, কিন্তু ডাক্তার অলিভেল্লা তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিলেন যে এ হচ্ছে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পুত্র এবং এখন সে আইন সম্পর্কিত চিকিৎসাবিদ্যার অঙ্গনে একটি অভিসন্দর্ভ তৈরি করছে। ডাক্তার উরবিনো সানন্দ হাত নাড়ার মাধ্যমে তাকে সম্ভাষণ জানালেন, তরুণ ডাক্তারও উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নুইয়ে তার উত্তর দিলেন। কিন্তু তখনো, আসলে কখনই, তিনি উপলব্ধি করেন নি যে সেদিন সকালে জেরেমিয়া দ্য সাঁৎ- আমুরের বাড়িতে তিনি যে তরুণ প্রশিক্ষণার্থী চিকিৎসককে দেখেছিলেন এই তরুণ সেই ব্যক্তিই। বার্ধক্যকে আরেকবার পরাজিত করতে পেরেছেন এই সুখানুভূতি নিয়ে তিনি প্রোগ্রামের শেষ নিবেদনের তরল স্বচ্ছ গীতিময়তার মধ্যে নিজেকে সমৰ্পণ করলেন কিন্তু সঙ্গীতটি কী তা তিনি ধরতে পারলেন না। পরে তরুণ চেল্লোবাদক, সবে মাত্র যে ফ্রান্স থেকে ফিরে এসেছে, তাঁকে জানায় যে এটা গেব্রিয়েল ফরে-র সৃষ্টি, যার নামই ডাক্তার উরবিনো শোনেন নি, যদিও ইউরোপের সঙ্গীত জগতের সর্বশেষ খবরাখবর সাধারণত তিনি ভালো ভাবেই রাখতেন। ফারমিনা ডাজা তাঁর ওপর চোখ রাখছিলেন, যেমন সব সময় রাখতেন, কিন্তু বিশেষ করে সেই সব সময় যখন সর্বজনসমক্ষে তাঁর মধ্যে আত্মদর্শনের প্রবণতা জেগে উঠতো। ফারমিনা নিজের খাওয়া থামিয়ে তাঁর পার্থিব হাতটি স্বামীর হাতের ওপর আলতো ভাবে রেখে বললেন, আর ও বিষয়ে ভেবো না। ডাক্তার উরবিনো গভীর আনন্দের সুরের তীর থেকে তাঁর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাস্য করলেন, আর তখনই তাঁর স্ত্রী যে বিষয় নিয়ে ভয় করছিলেন তিনি আবার সে বিষয় নিয়ে ভাবতে শুরু করলেন। জেরোমিয়া দ্য স্যাৎ-আমুরের কথা তাঁর মনে পড়লো। এই মুহূর্তে সে নানা রকম সম্মানের নিদর্শন সংবলিত তার ভুয়া সামরিক ইউনিফর্ম পরে কফিনে শুয়ে আছে, শিশুরা তাদের প্রতিকৃতি থেকে তাকে দেখছে অভিযোগভরা চোখ নিয়ে। ওর আত্মহত্যার কথা বলার জন্য ডাক্তার উরবিনো আর্চবিশপের দিকে মুখ ফেরালেন, কিন্তু আর্চবিশপ আগেই সে খবর শুনেছেন। হাই ম্যাস-এর সময় এ বিষয়ে অনেক কথা হয়েছে, এমনকি জেনারেল জেরোমিয়া আর্গোট ক্যারিবীয় শরণার্থীদের পক্ষ থেকে অনুরোধ করেছেন, জেরেমিয়া দ্য সাঁৎ-আমুরকে যেন পবিত্র মাটিতে সমাধিস্থ করা হয়। আর্চবিশপ বললেন, ওই অনুরোধের মধ্যেই আমার মনে হয় যথাযথ শ্রদ্ধার অভাব প্রকাশ পেয়েছে। তারপর অধিকতর সদয় কণ্ঠে তিনি জানতে চাইলেন কেউ তার আত্মহত্যার কারণ জানে কিনা। ডাক্তার উরবিনো জবাব দিলেন, বার্ধক্যভীতি। তাই ছিল সঠিক শব্দটি, কিন্তু ডাক্তার উরবিনোর মনে হল তিনি যেন এইমাত্র তা আবিষ্কার করেছেন। ডাক্তার অলিভেল্লা তাঁর সব চাইতে কাছে বসা অতিথিদের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তিনি তাঁর কথা থামিয়ে তাঁর শিক্ষকের কথোপকথনে অংশ নিয়ে বললেন, এটা খুবই দুঃখের ব্যাপার যে আজকাল আর প্রেমের জন্য কাউকে আত্মহত্যা করতে দেখা যায় না। প্রিয় ছাত্রের মুখে নিজের ভাবনার প্রতিধ্বনি শুনে ডাক্তার উরবিনো বিস্মিত হলেন না।

তিনি বললেন, তার ওপর আবার সোনালি সায়নাইডের সাহায্যে।

যখন তিনি এ কথা বললেন তখনই ওর চিঠি তাঁর মধ্যে যে তিক্ততার জন্ম দিয়েছিল তাকে ছাপিয়ে উঠল ওর প্রতি তাঁর অনুকম্পার বোধ। এর জন্য তিনি তাঁর স্ত্রীকে ধন্যবাদ দিলেন না। তিনি ধন্যবাদ দিলেন সঙ্গীতের অলৌকিকত্বকে। এর পর তিনি আর্চবিশপকে বললেন যে সন্ধ্যাবেলায় দীর্ঘকাল, দিনের পর দিন, দাবা খেলার মধ্যে দিয়ে তিনি ওই জাগতিক সন্তকে চিনতে পেরেছিলেন। তিনি শিশুদের সুখের জন্য তার নিবেদিতচিত্ততা, সকল পার্থিব বিষয়ে তার জ্ঞানের ব্যাপ্তি, তার সর্বপ্রকার বিলাসবর্জিত কঠোর জীবনযাত্রা প্রণালীর কথা আর্চবিশপকে জানালেন। জেরেমিয়া দ্য স্যাৎ-আমুর তাঁর আত্মার বিশুদ্ধতা দিয়ে যেভাবে নিজের সমস্ত অতীত থেকে নিজেকে চিরতরে বিচ্ছিন্ন করে এনেছিল তাতে ডাক্তার উরবিনো নিজেই অবাক হন। তারপর তিনি তার ফটোগ্রাফিক প্লেটগুলি ক্রয় করার উপকারিতার কথা মেয়রকে বললেন। একটা প্রজন্ম যারা হয়তো তাদের ওই প্রতিকৃতিগুলির বাইরে আর কোথাও কোনো সুখের সন্ধান পাবে না এবং যাদের হাতে ন্যস্ত হবে এই শহরের ভবিষ্যত তাদের ইমেজগুলি সংরক্ষিত করার জন্য এটা করা দরকার। একজন জঙ্গি শিক্ষিত ক্যাথলিককে আত্মহত্যার মতো একটি কাজকে সন্তজনিত বিবেচনা করতে দেখে আর্চবিশপ রীতিমত বিস্মিত ও লজ্জিত হলেন কিন্তু জেরেমিয়ার ছবির নেগেটিভগুলি দিয়ে একটা আর্কাইভ গড়ার প্রস্তাবে রাজি হলেন। মেয়র যখন জানতে চাইলেন কার কাছ থেকে সেগুলি কিনতে হবে তখন ব্যাপারটার গোপনীয়তায় ডাক্তার উরবিনোর জিভ যেন আগুনে পুড়ে গেল। তিনি শুধু বললেন আমি তার ব্যবস্থা করবো। মাত্র পাঁচ ঘণ্টা আগে তিনি যে রমণীকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এখন তার প্রতি নিজের বিশ্বস্ততা প্রদর্শন করে তিনি নিজেকে দায়মুক্ত অনুভব করলেন। ফারমিনা ডাজা ব্যাপারটা লক্ষ করলেন, তিনি নিচু গলায় স্বামীর কাছ থেকে কথা আদায় করলেন যে ডাক্তার শেষকৃত্যানুষ্ঠানে যোগ দেবেন। চিন্তামুক্ত হয়ে ডাক্তার বললেন, অবশ্যই তিনি তাতে যোগ দেবেন, না যোগদানের প্রশ্নই ওঠে না। আহারোত্তর বক্তৃতাগুলি ছিল সংক্ষিপ্ত ও সরল। ব্যান্ড একটা জনপ্রিয় সুর বাজাতে শুরু করল, অনুষ্ঠানসূচিতে যার উল্লেখ ছিল না। অতিথিরা হাঁটতে হাঁটতে বারান্দায় বেরিয়ে এলেন। ডন সাঙ্কোর লোকেরা উঠানটা জলকাদা মুক্ত করে নাচের উপযোগী করার চেষ্টা করছিল। কয়েকজন অতিথি তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। যে সব অতিথি বিশেষ সম্মানীয়দের টেবিলে বসেছিলেন শুধু তারাই বসার ঘরে অবস্থান করছিলেন। পারস্পরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জ্ঞাপনের সময় সর্বশেষ পর্বে ডাক্তার উরবিনো এক চুমুকে আধগ্লাস ব্র্যান্ডি পান করায় সবাই আনন্দ প্রকাশ করছিল। কারো মনে পড়ল না যে ইতিপূর্বে খাবার টেবিলে তিনি একই কাজ করেছিলেন, একটা বিশেষ আইটেম খাবার সময় এক চুমুকে আধগ্লাস ঐ ক্রু পান করেছিলেন। কিন্তু ওই অপরাহ্ণে তাঁর হৃদয় তাই দাবি করেছিল তাঁর কাছে, আর এই আত্মপ্রশ্রয়দান তাঁকে চমৎকার ভাবে পুরস্কৃত করে, আবার বহু বছর পরে, তাঁর মধ্যে গান গাইবার ইচ্ছা জাগায়, এবং তিনি গাইতেনও, তরুণ চেল্লোবাদক জানালো যে সে তাঁর সঙ্গে বাজাবে, কিন্তু এই সময় একটা ঘটনা ঘটলো। হঠাৎ সাম্প্রতিক কালের একটা নতুন মোটরগাড়ি উঠানের কাদাভর্তি গর্তের ওপর দিয়ে সঙ্গীতের দলকে কাদাজলে সিক্ত করে, তার হর্নের শব্দে খামার আঙিনার হাঁসগুলিকে চমকে দিয়ে, একেবারে বারান্দার সামনে এসে থামলো। আর গাড়ি থেকে নামলো ডাক্তার মার্কো অরেলিও উরবিনো ডাজা ও তার স্ত্রী, তাদের দুজনের হাতেই লেসের কাপড়ে আবৃত দুটি ট্রে। ঠিক ওই রকম আরো ট্রে দেখা গেল গাড়ির ভেতরে আসনের উপর, এমনকি চালকের পাশে মেঝের উপরেও। ওগুলি ছিল বিলম্বে হাজির হওয়া মিষ্টির পাত্র। সবাই হাততালি দিয়ে উঠলো, হাসি-ঠাট্টা করলো এবং এ সবের পালা শেষ হলে ডাক্তার অরেলিও উরবিনো ডাজা গম্ভীরভাবে জানলেন যে ঝড় শুরু হবার আগেই সিস্টার্স অব সেইন্ট ক্লেয়ার তাঁকে অনুরোধ করেছিল তিনি যেন মিষ্টির পাত্রগুলি এখানে পৌঁছে দেন, কিন্তু তাঁকে যখন একজন খবর দিল যে তাঁর বাবা-মার বাড়িতে আগুন লেগেছে তখন তিনি মহাসড়ক ছেড়ে ও দিকে চলে যান। তাঁর ছেলে কাহিনীটা শেষ করার আগেই এ কথা শুনে ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো অস্থির হয়ে ওঠেন, কিন্তু তাঁর স্ত্রী তাঁকে মনে করিয়ে দিলেন যে তোতাপাখিটা উদ্ধারের জন্য তিনি নিজেই অগ্নিনির্বাপকদের খবর দিয়েছিলেন। যাই হোক, মিষ্টি এসে পড়ায় আমিন্তা অলিভেল্লার মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল। অতিথিরা ইতিমধ্যে কফি পান করে ফেললেও তিনি বারান্দার চত্বরে তাঁদের মিষ্টি পরিবেশন করার সিদ্ধান্ত নিলেন, তবে ডাক্তার জুভেনাল উরবিনোর অলঙ্ঘনীয় দিবানিদ্রার সময় প্রায় পার হয়ে যাচ্ছিল।

সেদিন তাঁর দিবানিদ্রা তিনি গ্রহণ করতে সক্ষম হন, যদিও খুব সংক্ষিপ্ত ও অস্থিরতাপূর্ণ হয় সে-নিদ্রা, কারণ বাড়িতে ফিরে তিনি দেখতে পান যে আগুন লাগলে যে ক্ষতি হত অগ্নিনির্বাপক দল তাঁর বাগান ও বাড়িঘরের প্রায় সেই রকম ক্ষতিই সাধন করেছে। তোতাকে ভয় দেখাবার জন্য তারা তাদের শক্তিশালী নলের সাহায্যে নিক্ষিপ্ত প্রচণ্ড জলধারা দিয়ে একটা গাছকে সম্পূর্ণ নিষ্পত্র করে ফেলেছে, অনিয়ন্ত্রিত একটা জোরালো জলধারা শোবার ঘরের জানালা ফুটো করে ভেতরে ঢুকে আসবাবপত্র এবং দেয়ালে ঝোলানো নাম না জানা কতিপয় পূর্বপুরুষের প্রতিকৃতির অপূরণীয় ক্ষতি করেছে। ওদের ট্রাকের ঘণ্টাধ্বনি শুনে সত্যিই আগুন লেগেছে ভেবে প্রতিবেশীরা সদলে সেখানে উঠে এসেছিল। রবিবারের জন্য সেদিন স্কুল বন্ধ না থাকলে গোলমালটা আরো বেশি হত। অগ্নিনির্বাপক দল যখন দেখলো যে তাদের সম্প্রসারিত মই দিয়েও পাখিটার নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না তখন তারা তাদের দা দিয়ে গাছটার শাখা-প্রশাখা কাটতে শুরু করে। সৌভাগ্যক্রমে ডাক্তার উরবিনো ওই সময়ে ফিরে না এলে তারা গাছটার শাখা-প্রশাখা একেবারে কাণ্ড পর্যন্ত কেটে ফেলতো। চলে যাবার সময় তারা বলে গেল যে গাছটা সম্পূর্ণ ছেঁটে ফেলার অনুমতি পেলে তারা বিকালে পাঁচটার পর আবার আসবে। বেরিয়ে যাবার সময় তারা ভেতরের বারান্দা ও বসার ঘর কর্দমাক্ত করে দিয়ে যায়, ফারমিনা ডাজার প্রিয় তুর্কি গালিচাটাও ছিঁড়ে ফেলে। এই সবই ছিল অপ্রয়োজনীয়, কারণ সবার ধারণা সার্বিক গোলমালের মধ্যে তোতাটা প্রতিবেশীদের উঠানের ভেতর দিয়ে চম্পট দিয়েছে। ডাক্তার উরবিনো ঝোপঝাড়ের মধ্যে তার খোঁজ করলেন, বিভিন্ন ভাষায় তাকে ডাকলেন, শিস দিলেন, গান গাইলেন, কিন্তু কোনো উত্তর মিললো না। তখন তিনি ধরে নিলেন যে ওটা উধাও হয়ে গেছে। এরপর তিনি যখন শুতে গেলেন তখন প্রায় তিনটা বাজতে চলেছে। তবে শোবার আগে ঈষদুষ্ণ অ্যাসপারাগাস দ্বারা বিশুদ্ধিকৃত তাঁর প্রস্রাবের মধ্যে একটা গোপন উদ্যানের ঘ্রাণ গ্রহণ করে তিনি তাৎক্ষণিক আনন্দ উপভোগ করে নিলেন।

তিনি ঘুম থেকে জেগে উঠলেন একটা দুঃখের অনুভূতি নিয়ে। আজ সকালে বন্ধুর মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর যে দুঃখ হয়েছিল এটা সে দুঃখ নয়। সম্প্রতি দুপুরের ঘুমের পর একটা অদৃশ্য মেঘ তাঁর আত্মাকে মথিত করতো। তাঁর মনে হতো এটা বিধাতার একটা বিজ্ঞপ্তি। তিনি এখন তাঁর জীবনের সর্বশেষ অপরাহ্ণগুলি যাপন করছেন। তিনি এই মুহূর্তে ওই দুঃখানুভূতিতে আক্রান্ত হলেন। বয়স পঞ্চাশ হবার আগে পর্যন্ত তিনি তাঁর দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলির আকৃতি আর ওজন আর অবস্থা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না। ধীরে ধীরে তাঁর প্রাত্যহিক দিবানিদ্রার পর জেগে উঠে চোখ বন্ধ করা অবস্থায়, তিনি এক এক করে তাঁর দেহের ভেতরের বস্তুগুলি অনুভব করতে শুরু করেন, তাঁর অনিদ্রাপীড়িত হৃৎপিণ্ড, তার রহস্যময় যকৃত, তাঁর দুর্বোধ্য অগ্নাশয়। তিনি ইতিমধ্যেই আবিষ্কার করেছিলেন যে সবচাইতে বৃদ্ধ যারা তারাও তাঁর চাইতে অল্পবয়সী এবং তাঁর প্রজন্মের রূপকথার মতো গ্রুপ প্রতিকৃতিগুলির মধ্যে একমাত্র তিনিই এখনো জীবিত আছেন। তিনি যখন প্রথম বিস্মৃতির আক্রমণগুলি অনুভব করেন তখন তিনি তাঁর মেডিক্যাল স্কুলের এক শিক্ষকের কাছে শোনা একটা কৌশলের দ্বারস্থ হন : যে-মানুষের কোনো স্মৃতি নেই সে কাগজের মধ্য থেকে তা তৈরি করে নেয়। কিন্তু এটা ছিল এক ক্ষণস্থায়ী মোহ, কারণ এক সময় তিনি এমন একটা পর্যায়ে এসে উপনীত হন যেখানে পকেটে রাখা লিখিত স্মারকগুলি কিসের স্মারক তাই তিনি ভুলে যেতেন, যে-চশমা চোখে পরে আছেন তাই খুঁজে বেড়াতেন বাড়ির সর্বত্র, দরজা তালাবন্ধ করার পরও আবার চাবি ঘোরাতেন, যা পড়ছিলেন তার মর্ম বুঝতে ব্যর্থ হতেন। কারণ প্রাথমিক সূত্রগুলি তিনি বিস্মৃত হয়েছিলেন, কিংবা চরিত্রগুলির পারস্পরিক সম্পর্ক আর তাঁর মনে থাকে নি। কিন্তু যা তাঁকে সব চাইতে বিচলিত করে তা হল তাঁর নিজের যুক্তির শক্তিতে তাঁর আস্থার অভাব, তাঁর মনে হল, অপ্রতিরোধ্য কোনো জাহাজডুবির মতো, তিনি তাঁর সুবিচারের বোধ ও শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন।

নিজের অভিজ্ঞতা ব্যতীত আর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছাড়াই ডাক্তার উরবিনো জানতেন যে অধিকাংশ মারাত্মক ব্যাধিরই আপন আপন বিশেষ গন্ধ আছে, কিন্তু কোনো গন্ধই বার্ধক্যের গন্ধের মতো অত সুনির্দিষ্ট নয়। এটা তিনি পেয়েছেন শব ব্যবচ্ছেদের টেবিলে মৃতদেহকে মাথা থেকে পায়ের বুড়ো আঙুল পর্যন্ত চিরে ফেলার সময়। যে সব রোগী খুব সাফল্যের সঙ্গে তাদের বয়স লুকিয়ে রাখে তাদের মধ্যেও তিনি ওই গন্ধ পেয়েছেন। তিনি তাঁর নিজের কাপড়ের ঘামের গন্ধে এবং অরক্ষিত মুহূর্তে তাঁর ঘুমন্ত স্ত্রীর নিঃশ্বাসেও ওই গন্ধ পেয়েছেন। তিনি ছিলেন মৌলিকভাবেই একজন প্রাচীন ধাঁচের খ্রিস্টান, তা না হলে তিনি হয়তো জেরেমিয়া দ্য সাঁৎ-আমুরের সঙ্গে একমত হতেন যে বার্ধক্য একটা অশোভন অবস্থা এবং বেশি দেরি হয়ে যাবার আগেই তার পরিসমাপ্তি টানা উচিত। তিনি শয্যায় ছিলেন একজন ভালো ব্যক্তি, কিন্তু তাঁর মতো একজন মানুষের জন্যও তাঁর একমাত্র সান্ত্বনা ছিল তাঁর যৌন প্রশান্তির মধ্যে, তাঁর যৌন ক্ষুধার ধীর গতির সহৃদয় অবলুপ্তির মধ্যে। একাশি বছরে পৌঁছে তাঁর এই বোধটুকু খুব স্বচ্ছ ছিল যে এই জগতের সঙ্গে তিনি বাঁধা রয়েছেন কয়েকটি সরু সুতা দিয়ে এবং ঘুমের মধ্যে অবস্থানের সামান্য একটু পরিবর্তনের ফলেই সেই সুতা ছিন্ন হয়ে যেতে পারে এবং এখন সেই সুতাগুলি অক্ষত রাখতে তিনি যদি যথাসাধ্য চেষ্টা করেন তার কারণ মৃত্যুর অন্ধকারের মধ্যে ঈশ্বরকে না খুঁজে পাবার ভয়। ফারমিনা ডাজা এ সময় ব্যস্ত ছিলেন অগ্নিনির্বাপক দল কর্তৃক বিধ্বস্ত শোবার ঘরটি ঠিকঠাক করার কাজে। চারটা বাজার একটু আগে তিনি তাঁর স্বামীর প্রাত্যহিক পানীয় বরফকুচি দেয়া এক গ্লাস লেমোনেড নিয়ে আসতে বললেন, তারপর স্বামীকে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানের জন্য পোশাক পরে নিতে বললেন। ওই অপরাহ্ণে ডাক্তার উরবিনোর হাতে ছিল দুটি বই; অ্যালেক্সিস কারেল রচিত অজানা মানুষ এবং এক্সেল মুন্থ রচিত সান মিশেলের কাহিনী। দ্বিতীয় বইটির পৃষ্ঠা এখনো কাটা হয় নি, তিনি পাচিকা ডিনা পার্ডোকে শোবার ঘর থেকে তাঁর মার্বেলের কাগজ কাটা ছুরিটা নিয়ে আসতে বললেন, তিনি ওটা ওখানে ফেলে রেখে এসেছেন। ছুরিটা যখন আনা হল ততক্ষণে তিনি অজানা মানুষ-এর যে জায়গায় একটা খাম দিয়ে চিহ্ন দেয়া ছিল সেখান থেকে পড়তে শুরু করে দিয়েছিলেন, শেষ হবার মাত্র কয়েক পৃষ্ঠা বাকি আছে। তিনি ধীরে ধীরে পড়ছিলেন, ঈষৎ মাথা ধরেছে, খাবার সময় শেষ পর্বে যে আধগ্লাস ব্র্যান্ডি পান করেছিলেন তাকেই মাথা ধরার কারণ হিসেবে মনে মনে চিহ্নিত করলেন। পড়ার মধ্যে থেমে থেমে লেমোনডের গ্লাসে চুমুক দিলেন, সময় নিয়ে বরফের টুকরা চুষলেন। পায়ে মোজা পরে আছেন, গায়ের জামা মাড় দেয়া কলারবিহীন, সবুজ ডোরাকাটা ইলাসটিক সাসপেন্ডারটা কোমর থেকে ঝুলছে। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানের জন্য পোশাক বদলাবার কথা ভাবতেই তাঁর বিরক্তি বোধ হল। একটু পরেই তিনি পড়া বন্ধ করলেন, তারপর তাঁর বেতের দোল-চেয়ারে খুব আস্তে আস্তে দুলতে শুরু করলেন। তিনি ব্যথিত চিত্তে সামনের উঠানের কলা গাছগুলি দেখলেন, পত্রপল্লব মুড়ানো আম গাছটি দেখলেন, বৃষ্টির পর উড়ে বেড়ানো উইপোকার ঝাঁক দেখলেন, আরেকটি অপরাহ্ণের স্বল্পস্থায়ী ঐশ্বর্য দেখলেন যা আর কখনো ফিরে আসবে না। তিনি যে কখনো পারামারিবো থেকে আনা একটি তোতাপাখির মালিক ছিলেন যাকে তিনি একজন মানুষের মতই ভালবাসতেন সে কথা তিনি সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছিলেন। আর ঠিক তখনই তিনি পাখিটির কণ্ঠস্বর শুনলেন : রাজকীয় তোতা মনে হল খুব কাছে থেকে কথাটা বলল, তার একেবারে পাশ থেকে, আর তখনই তিনি তাকে আম গাছটার সব চাইতে নিচু ডালটিতে বসে থাকতে দেখলেন।

বদমাশ কোথাকার! ডাক্তার উরবিনো চেঁচিয়ে উঠলেন

তোতাটাও একেবারে একই গলায় উত্তর দিল, আপনি আমার চাইতেও বড় বদমাশ, ডাক্তার।

তাকে দৃষ্টির আওতায় রেখে তিনি তার সঙ্গে কথা বলতে থাকলেন, খুব সতর্কতার সঙ্গে তাঁর জুতা পরলেন যেন পাখিটা ভয় না পায়, তার সাসপেন্ডার বাহুর উপরে টেনে তুললেন, তারপর উঠানে নেমে গেলেন। উঠান তখনো কাদাময়। তিনি তাঁর লাঠি দিয়ে মাটি পরীক্ষা করতে করতে এগিয়ে গেলেন, বারান্দার সিঁড়ির তিনটি ধাপে যেন হোঁচট খেয়ে পড়ে না যান সেদিকে খেয়াল রাখলেন। তোতাটা নড়লো না। সে মাটির এতো কাছে বসেছিল যে ডাক্তার উরবিনো তার দিকে নিজের বেড়াবার লাঠিটা বাড়িয়ে দিলেন, সে যেন তার রুপার হাতলের ওপর বসতে পারে, প্রায়ই সে এ রকম বসতো, কিন্তু এবার পাখিটা এক পাশে সরে গিয়ে পার্শ্ববর্তী মাচায় বসলো, আরেকটু উঁচুতে, কিন্তু গাছের পাশে রাখা বাড়ির মইটার সাহায্যে তার কাছে যাওয়া ছিল এখন আগের চাইতে সহজ। আগুন নির্বাপকরা এসে পৌঁছার আগেই মইটা ওখানে এনে রাখা হয়েছিল। ডাক্তার উরবিনো উচ্চতাটা হিসাব করলেন, মইটার দুটি ধাপ উঠলেই তিনি পাখিটাকে ধরতে পারবেন। তিনি একটা মিষ্টি বন্ধুত্বপূর্ণ গান গাইতে গাইতে প্রথম ধাপটা উঠলেন, বদমেজাজি পাখিটার মন অন্য দিকে ফেরাতে চেষ্টা করলেন, আর পাখিটা তখন সুর বাদ দিয়ে গানের কথাগুলি অবিকল পুনরাবৃত্তি করল, কিন্তু ভীত বা লজ্জাকাতর ভঙ্গিতে গাছের ডালটার আরো একটু উপরে সরে গেল। ডাক্তার উরবিনো বিশেষ কোনো অসুবিধা ছাড়াই এবার দ্বিতীয় ধাপে উঠলেন, মইটা তিনি ধরেছিলেন তাঁর দু’হাত দিয়ে, আর পাখিটা যেখানে ছিল সেখানে বসেই আবার গোটা গানটার কথাগুলি বলে যেতে লাগল। ডাক্তার এবার তৃতীয় ধাপে উঠলেন, তারপর চতুর্থ ধাপে, তিনি শাখাটার উচ্চতার হিসাবে একটু ভুল করেছিলেন, এরপর তিনি বাঁ হাতে মইটা ধরে তাঁর ডান হাত দিয়ে পাখিটকে পাকড়াও করতে চেষ্টা করবেন। পুরনো পরিচারিকা ডিনা পার্ডো তাঁকে মনে করিয়ে দিতে আসছিল যে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানে যাবার জন্য তাঁর দেরি হয়ে যাচ্ছে। এমন সময় সে মই-এর ওপর দাঁড়ানো একটা মানুষের পিঠ দেখতে পেলো, সবুজ ডোরাকাটা ইলাসটিক সাসপেন্ডারটা না দেখলে সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারতো না যে মানুষটা আর কেউ নয় স্বয়ং ডাক্তার উরবিনো।

সে চিৎকার করে উঠলো হা, ভগবান, আপনি তো মারা পড়বেন।

একটা বিজয়ীর নিঃশ্বাস ফেলে ডাক্তার উরবিনো তোতার টুটি চেপে ধরলেন। কিন্তু পর মুহূর্তেই তিনি তাকে ছেড়ে দিলেন। কারণ মইটা তার পায়ের নিচ থেকে পিছলে সরে যায়। এক মুহূর্তের জন্য তিনি শূন্যে হাওয়ায় ভেসে রইলেন। আর তিনি উপলব্ধি করলেন যে ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন না করে, কোনো কিছুর জন্য অনুতাপ করার আগেই, কারো কাছ থেকে বিদায় না নিয়েই এই পেন্টেকস্টের রবিবারে চারটা বেজে সাত মিনিটে তিনি মৃত্যুবরণ করতে চলেছেন।

ফারমিনা ডাজা এই সময় রাতের খাবারের স্যুপটা ঠিক হয়েছে কিনা চেখে দেখছিলেন। হঠাৎ তাঁর কানে এলো ডনা পার্ডোর আতঙ্কিত চিৎকার, দাস-দাসীদের হট্টগোল, সমস্ত পাড়ার হইচই এর শব্দ। হাতের চামচটা মাটিতে ফেলে দিয়ে বয়সের অপ্রতিরোধ্য ওজন সত্ত্বেও তিনি প্রাণপণে ছুটে যাবার চেষ্টা করলেন, চেঁচাতে লাগলেন উন্মাদিনীর মতো, যদিও আম গাছের নিচে কী ঘটেছে তা তিনি তখনো জানেন না। যখন তিনি দেখলেন যে তাঁর মানুষটা কাদার মধ্যে চিৎ হয়ে পড়ে আছে তখন তাঁর বুকের খাঁচার ভেতর তাঁর হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে উঠল। তিনি দেখলেন যে তাঁর স্বামী এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছেন, কিন্তু মৃত্যুর শেষ আঘাত তিনি প্রাণপণে প্রতিহত করে চলেছেন যেন ফারমিনা তাঁর কাছে পৌঁছাবার সময় পায়। চারপাশের হট্টগোল সত্ত্বেও, ফারমিনাকে ছাড়া মরতে হচ্ছে এই অপুনরাবৃত্তনীয় বেদনার অশ্রুজলের মধ্য দিয়ে, তিনি তাঁকে চিনতে পারলেন। তিনি তাঁর দিকে শেষবারের মতো তাকালেন এবং এই শেষ বারে তাঁর দুটি চোখ এমন উজ্জ্বল, এমন বেদনার্ত, এমন সকৃতজ্ঞ দেখলো যা ফারমিনা তাঁদের অর্ধশতাব্দির মিলিত জীবনে আগে কখনো দেখেন নি। ডাক্তার উরবিনো তাঁর শেষ নিঃশ্বাসটুকু দিয়ে কোনো রকমে উচ্চারণ করলেন, তোমাকে আমি কতটা ভালবেসেছি একমাত্র ঈশ্বর তা জানেন।

স্মরণীয় মৃত্যু ছিল এটা, এবং অকারণে নয়। ফ্রান্সে উচ্চতর বিশেষ পড়াশোনা শেষ করার পর এই প্রদেশের শেষ কলেরা মহামারীর দুর্যোগ প্রতিরোধে ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো যে নতুন চূড়ান্ত ব্যবস্থা নেন তা তাকে সমগ্র দেশে খ্যাতিমান করে তুলেছিল। এর আগের মহামারীতে তিন মাসের কম সময়ের মধ্যে শহরের মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ প্রাণ হারিয়েছিল। মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে ছিলেন তাঁর পিতা, যিনি নিজেও একজন শ্রদ্ধাভাজন চিকিৎসক ছিলেন। ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো তাঁর তাৎক্ষণিক মর্যাদা এবং উত্তরাধিকর সূত্রে প্রাপ্ত অর্থের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ অনুদান দিয়ে মেডিক্যাল সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। ক্যারিবীয় প্রদেশগুলিতে এটাই ছিল প্রথম এবং বহু বছরের জন্য একমাত্র মেডিক্যাল সোসাইটি, যার আজীবন সদস্য ছিলেন তিনি। তিনিই এখানে জল সরবরাহের প্রথম কৃত্রিম প্রণালী, প্রথম পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং আচ্ছাদিত সর্বজনীন বাজারের প্রচলন করেন, যার ফলে লাস অ্যানিমাস উপসাগর দিয়ে ময়লা আবর্জনা বাইরে বেরিয়ে যাবার সুযোগ পায়। তিনি ভাষা একাডেমি ও ইতিহাস একাডেমিরও সভাপতি ছিলেন। চার্চকে প্রদত্ত তাঁর সেবার জন্য জেরুজালেমের ল্যাটিন প্যাট্রিয়ার্ক তাঁকে নাইট অব দি অর্ডার অব দি হোলি সিপালকার সম্মানে ভূষিত করেন এবং ফরাসি সরকার তাঁকে প্রদান করেন লিজিয়ন অব অনারের কমান্ডারের পদমর্যাদা। তিনি শহরের প্রতিটি ধর্মীয় ও নাগরিক সমিতিকে উৎসাহিত করতেন। রাজনীতিতে উৎসাহবর্জিত শহরের কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তি দেশপ্রেমী সংস্থা নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। সংস্থাটি সরকার ও স্থানীয় ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে তৎকালীন পরিবেশের তুলনায় বেশ দুঃসাহসিক প্রগতিশীল ধ্যান-ধারণায় উদ্বুদ্ধ করতে চেষ্টা করত। ডাক্তার উরবিনো ওই সংস্থার কর্মকাণ্ডে বিশেষ উৎসাহ দিতেন। এই সব কাজের মধ্যে সব চাইতে স্মরণীয় ছিল বায়ু নিয়ন্ত্রিত বেলুনের পরীক্ষামূলক উড্ডয়ন। বিমান-ডাকের কোনো রকম যৌক্তিক সম্ভাবনার কথা কেউ ভাবার বহু আগে এই বেলুনের উদ্বোধনী উড্ডয়নের সময় এর মাধ্যমে সান হুয়ান ডি লা সিনেগাতে একটি পত্র প্রেরণ করা হয়েছিল। শিল্পকলা কেন্দ্রের ধারণাও তাঁর মস্তিষ্ক থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। ওই কেন্দ্র কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত স্কুল অব ফাইন আর্টর্স যে ভবনে শুরু হয়েছিল আজও সেখানেই আছে। প্রতি এপ্রিলে যে কবিতা উৎসব অনুষ্ঠিত হয় বহু বছর ধরে তিনি তারও একজন পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।

যে কাজটি অন্তত বিগত একশ’ বছর ধরে সবাই অসম্ভব ভেবে এসেছিল তাও তিনি সম্ভব করে তুলেছিলেন; তা হল ড্রামাটিক থিয়েটারের পুনর্নির্মাণ। ঔপনিবেশিক যুগ থেকে ওই ভবনটি মুরগি-ঘর ও খেলুড়ে রাতা মোরগের প্রজনন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। তাকে এবার নাট্যশালায় রূপান্তরিত করার জন্য একটা বিরাট জমকালো নাগরিক আন্দোলন গড়ে তোলা হয়। ওই আন্দোলনে শহরের প্রতিটি সংস্থা যুক্ত হয়, যার সার্থক পরিণতিতে ড্রামাটিক থিয়েটারটি নতুন রূপে পুনর্নির্মিত হয়, যদিও অনেকে মনে করেন যে এত বড় আন্দোলন যোগ্যতর কোনো লক্ষ্য অর্জনে পরিচালিত হলে ভালো হত। যাই হোক, নাট্যশালার উদ্বোধন হল, যদিও তখনো আসন অথবা আলোর সব ব্যবস্থা হয় নি, দর্শক-শ্রোতৃকুলকে নিজেদের চেয়ার ও আলো নিয়ে আসতে হত বিরতির সময়ের জন্য। ইউরোপের বড় বড় অনুষ্ঠানে যে প্রথা ছিল এখানেও তা প্রচলিত হল। ক্যারিবীয় গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহের মধ্যে ও মহিলারা তাঁদের দীর্ঘ পোশাক ও পশমের কোট পরলেন। কোনো কোনো অনুষ্ঠানমালা এত দীর্ঘ ছিল যে শেষ হতে হতে সকালের প্রার্থনার সময় হয়ে যেতো। ওই দীর্ঘ সময় টিকে থাকার জন্য ভৃত্যকুলকে তাদের প্রভুদের জন্য চেয়ার, আলো, খাবার দাবার ইত্যাদি নিয়ে প্রেক্ষাগৃহে প্রবেশ করার অনুমতি দিতে হয়। মরশুম শুরু হয়েছিল একটা ফরাসি অপেরা কোম্পানি দিয়ে। তাদের নতুনত্ব ছিল অর্কেস্ট্রা দলে বীণার ব্যবহার, আর তাদের অবিস্মরণীয় বিজয় গৌরব ছিল অপূর্ব কণ্ঠস্বর ও নাটকীয় প্রতিভার অধিকারী এক তুর্কি গায়িকা, যে খালি পায়ে ঘুরে ঘুরে গান গাইতো আর যার পায়ের আঙুলে ছিল মূল্যবান পাথরখচিত কয়েকটা আংটি। তবে প্রেক্ষাগৃহ তেলের প্রদীপের ধোঁয়ায় এতই আচ্ছন্ন হয়ে যায় যে প্রথম অঙ্কের পরই মঞ্চ প্রায় দেখা যাচ্ছিল না, আর শিল্পীদের কণ্ঠও প্রায় রুদ্ধ হয়ে পড়ে, অবশ্য সাংবাদিকরা এসব ছোটখাটো ত্রুটির কথা তাদের প্রতিবেদন থেকে বাদ দিয়ে ঐতিহাসিক ঘটনার গৌরবগাথাই বাড়িয়ে লেখেন। নিঃসন্দেহে ডাক্তার উরবিনোর সাহসী উদ্যোগগুলির মধ্যে এটাই সবচাইতে বেশি সংক্রামক হয়ে ওঠে। শহরের সব চাইতে বিস্ময়কর অঙ্গনও এই সংক্রমণের শিকার হয় এবং ইসোল্ড আর ওটেলো আর আইডা আর সিগফ্রিডের একটা গোটা প্রজন্ম গজিয়ে ওঠে। কিন্তু ব্যাপারটা ডাক্তার উরবিনো-প্রত্যাশিত চরম পর্যায়ে গিয়ে কখনো পৌঁছায় নি। তিনি চেয়েছিলেন যে ইতালিপন্থী আর ওয়াগনারীয়রা বিরতির সময় লাঠি আর ছড়ি নিয়ে পরস্পরের মুখোমুখি হবে, কিন্তু তেমনটা ঘটেনি।

ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো, প্রায়ই এবং শর্তহীন ভাবে, নানা সরকারি পদ গ্রহণের জন্য অনুরুদ্ধ হন, কিন্তু যে সব চিকিৎসক তাদের পেশাগত মর্যাদা ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়দা লোটে তিনি ছিলেন তাদের নির্মম সমালোচক। তিনি যদিও সর্বদাই একজন উদারপন্থী বলে বিবেচিতে হতেন এবং পার্টি-প্রার্থীকেই ভোট দিতে অভ্যস্ত ছিলেন তবু সেটা ছিল বিশ্বাসের চাইতেও বেশি একটা ঐতিহাসিক প্রশ্ন। সম্ভবত উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন পরিবারগুলির মধ্যে তিনিই ছিলেন শেষ সদস্য যিনি আর্চবিশপের বাড়ি যাবার সময় রাস্তার উপরেই হাঁটু গেড়ে বসতেন। তিনি নিজেকে বর্ণনা করতেন একজন স্বভাবসিদ্ধ শান্তিবাদী বলে, জাতির মঙ্গলের স্বার্থে উদারপন্থী ও রক্ষণশীলদের পুনর্মিলনের পক্ষে এক নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তি রূপে। কিন্তু জনসমক্ষে তাঁর আচরণ ছিল এতই স্বাধীন ও স্বয়ম্ভর যে কোনো গোষ্ঠীই তাঁকে তাদের সভ্য বলে দাবি করতো না। উদারপন্থীরা তাঁকে মনে করতো একজন প্রাচীন যুগের গুহাবাসী, রক্ষণশীলরা ভাবতো তিনি প্রায় একজন মেসন সম্প্রদায়ের সদস্য, আর মেসনরা তাঁকে পবিত্র ক্যাথলিক প্রতিষ্ঠানের একজন গোপন স্বার্থরক্ষাকারী বলে প্রত্যাখ্যান করেছিল। তাঁর কম কঠোর সমালোচকদের মূল্যায়নে তিনি ছিলেন শুধু একজন অভিজাত, জাতি যখন অন্তহীন গৃহযুদ্ধের রক্তক্ষরণে মরতে চলেছে তখন তিনি কবিতা উৎসবের আনন্দে মুগ্ধ ও আত্মহারা।

তাঁর মাত্র দুটি কাজ ছিল এই প্রতিচ্ছবির সঙ্গে সঙ্গতিহীন। একশ’ বছরেরও বেশি কাল ধরে তাঁদের পারিবারিক বাসভবন ছিল মারক্যুইস ডি কাসালডুয়েরার ভূতপূর্ব প্রাসাদ। ডাক্তার উরবিনো সেটা ত্যাগ করে নব্য ধনীদের পাড়ায় একটা নতুন বাড়িতে উঠে যান। দ্বিতীয় কাজটি ছিল বংশ গৌরব বা বিরাট ধন ঐশ্বর্য বিহীন নিম্নতর শ্রেণীর একটি সুন্দরী রমণীকে বিয়ে করা। ঐতিহ্যবাহী পারিবারিক নামের দীর্ঘ পুচ্ছবিশিষ্ট মহিলারা আড়ালে এটা নিয়ে ঠাট্টা করতেন, কিন্তু এক সময় তারাও স্বীকার করতে বাধ্য হন যে ওই রমণী স্বাতন্ত্র্য ও চরিত্রের গুণে তাদের সবাইকে নিষ্প্রভ করে দিয়েছে। ডাক্তার উরবিনো এই সব এবং জনসাধারণের মধ্যে তাঁর ইমেজের অন্যান্য ফাঁক-ফাটল সম্পর্কে সুঅবিহিত ছিলেন। তিনি যে একটি প্রাচীন পারিবারিক নামের শেষ সদস্য, তাঁর সঙ্গে সঙ্গেই যে ওই নামটি অবলুপ্ত হতে যাচ্ছে এ সম্পর্কে তাঁর চাইতে বেশি সচেতন আর কেউ ছিল না। তাঁর ছেলে, মার্কো অরেলিও, পঞ্চাশ বছর বয়স, তাঁর মতোই এক ডাক্তার, সকল প্রজন্মের পরিবারের জ্যেষ্ঠ পুত্রদের মতই উল্লেখযোগ্য কিছুই সে করে নি, এমনকি একটি সন্তানেরও জন্ম দেয়নি। ডাক্তার উরবিনোর একমাত্র কন্যা, ওফেলিয়া, নিউ অর্লিয়ান্সের এক নিরেট ব্যাংক কর্মচারীকে বিয়ে করেছে এবং চরম পরিণতিতে পৌঁছেছে তিনটি কন্যার জন্ম দিয়ে, কিন্তু একটি পুত্র সন্তানেরও নয়। ইতিহাসের জোয়ারে তাঁর রক্তপ্রবাহ আর বইবে না এ চিন্তা তাঁকে কষ্ট দিলেও নিজের মৃত্যু বিষয়ে তাঁকে যে ভাবনা সব চাইতে বিচলিত করতো তা হল তাঁকে ছাড়া ফারমিনা ডাজা নিঃসঙ্গ একা জীবন কিভাবে যাপন করবে সে-ভাবনা।

যাই হোক, এই ট্র্যাজেডি শুধু তাঁর বাড়িতেই আলোড়ন তোলে নি, সাধারণ মানুষকেও তা আলোড়িত করে। একটা কিছু দেখার আশায় তারা রাস্তায় ভিড় জমায়। তিনদিনের শোক পালনের কথা ঘোষিত হয়, সকল সরকারি ভবনে পতাকা রাখা হয় অর্ধ-নমিত, আর গির্জাগুলিতে বিরতিহীন ভাবে ঘণ্টা বাজতে থাকে এবং ওদের পারিবারিক সমাধিস্থলের ভূগর্ভস্থ কক্ষ সিলমোহর না করে দেয়া পর্যন্ত ওই ঘণ্টাধ্বনি অব্যাহত থাকে। স্কুল অব ফাইন আর্টস-এর একটি দল একটা মৃতুমুখোশ বানায়, পরিকল্পনা ছিল যে পরে একটা প্রমাণ সাইজ আবক্ষ মূর্তির জন্য এটা ছাঁচ হিসেবে ব্যবহৃত হবে, কিন্তু পরবর্তী সময়ে ওই পরিকল্পনা বর্জিত হয়, কারণ শেষ মুহূর্তে যে- আতঙ্কের চিহ্ন ডাক্তারের মুখে ফুটে উঠেছিল তার বিশ্বস্ত বাস্তববাদী প্রতিফলন খুব শোভন হবে বলে বিবেচিত হয় নি। জনৈক বিখ্যাত চিত্রশিল্পী এই সময়ে ইউরোপ যাবার পথে এখানে থেমেছিলেন, তিনি করুণ রসসিক্ত বাস্তবধর্মী একটি বিশালাকার ক্যানভাস আঁকেন, সেখানে নিয়তির মারাত্মক মুহূর্তে মই-এর ওপর ডাক্তার উরবিনো চিত্রিত হয়েছেন, তোতা পাখিটিকে বন্দি করার জন্য তিনি তখন সবেমাত্র তাঁর হাত প্রসারিত করেছেন। এই ছবিতে যা কাহিনীটির নির্ভেজাল সূত্রকে অস্বীকার করে তা এই যে ডাক্তারের পরনে তাঁর কলারবিহীন শার্ট ও সবুজ ডোরাকাটা সাসপেন্ডারের পরিবর্তে দেখানো হয় মাথায় বাউলার হ্যাট ও গায়ে কালো ফ্রককোট, যা বহু আগের কলেরা মহামারীর সময়ের একটি প্রাচীন পদ্ধতিতে মুদ্রিত ছবি থেকে নকল করা হয়। সবাইকে ছবিটি দেখার সুযোগ দানের উদ্দেশ্যে ট্র্যাজেডিটি সংঘটিত হবার পরবর্তী কয়েক মাস তা দি গোল্ডেন ওয়াইর-এর বিশাল গ্যালারিতে প্রদর্শিত হয়। তখন শহরের সকল মানুষ তার সামনে দিয়ে এক এক করে শ্রদ্ধাভরে হেঁটে যায়। তারপর যে সব সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের কীর্তিমান পৃষ্ঠপোষকের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো সঙ্গত বলে মনে করে তাদের দেয়ালেও ছবিটি প্রদর্শিত হয়। এবং সব শেষে একটি দ্বিতীয় শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের পর সেটা স্কুল অব ফাইন আর্টস-এ টানিয়ে রাখা হয়, বহু বছর পর যা চিত্রকলার ছাত্ররা সেখান থেকে টেনে নামিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের খোলা চত্বরে পুড়িয়ে ফেলে, কারণ তারা তাঁকে দেখে ঘৃণ্য কলাকৈবল্যবাদ ও একটি বিশেষ সময়ের প্রতীক রূপে।

ফারমিনা ডাজার বৈধব্যের প্রথম মুহূর্ত থেকেই একটা জিনিস স্পষ্ট হয়ে ওঠে। স্বামী তাঁর অসহায়ত্ত নিয়ে যে ভয় করেছিলেন তা ছিল অমূলক। কোনো বা কারো স্বার্থসিদ্ধির জন্যই স্বামীর মৃতদেহকে ব্যবহৃত না হতে দেবার সিদ্ধান্তে তিনি ছিলেন অটল। প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে যখন শ্রদ্ধাজ্ঞাপক তারবার্তা এলো যে তাঁর স্বামীর মরদেহ প্রাদেশিক সরকারের অ্যাসেমব্লি চ্যাম্বারে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় কিছু সময়ের জন্য রাখা হবে, জনগণের শ্রদ্ধা জানানোর সুবিধার্থে, তখনও তিনি তাতে সম্মতি দেন নি। আর্চবিশপ নিজে যখন অনুরোধ করলেন যে ডাক্তার উরবিনোর মৃতদেহ এক রাতের জন্য ক্যাথিড্রালে থাকুক, ধর্মীয় মর্যাদায় তা সেখানে প্রহরা দিয়ে রাখা হবে, শান্ত দৃঢ়তার সঙ্গে সে অনুরোধও তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি শুধু অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার প্রাথর্নার সময় তাঁর স্বামীর মরদেহ ওখানে রাখতে সম্মত হন। তাঁর পুত্র এত জায়গা থেকে এত বিভিন্ন ধরনের অনুরোধ আসতে দেখে হতবিহ্বল হয়ে যায়। সে যখন আর্চবিশপের অনুরোধ রক্ষার জন্য মধ্যস্থতা করতে এগিয়ে আসে তখনও ফারমিনা ডাজা তাঁর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন নি। তিনি তাঁর গ্রামীণ সিদ্ধান্তে অটল থাকেন যে মৃতদেহ একমাত্র পরিবারের ধন, রাত জেগে ধর্মীয় প্রহরা দেয়ার কাজ বাড়িতেই পালিত হবে, পাহাড়ি কফি আর ভাজা পিঠা খেতে খেতে যার ইচ্ছা হবে সে এবং তার যেভাবে খুশি সেভাবে সে ডাক্তারের জন্য অশ্রু বিসর্জন করতে পারবে। ঐতিহ্যানুসারে নয় রাত ধরে জেগে থেকে বিলাপের যে প্রথা তা পালিত হবে না। শেষকৃত্যানুষ্ঠানের পরে বাড়ির দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। অন্তরঙ্গ বন্ধুবৃন্দ ছাড়া আর কারো জন্য সে দরজা খোলা হল না।

মৃত্যুর শাসনাধীনে বাড়িটি চলতে থাকে। প্রতিটি মূল্যবান সামগ্রী সুরক্ষার জন্য তালাবন্ধ করে রাখা হল। দেয়ালে দেয়ালে দেখা গেল সেখানে ইতিপূর্বে ঝোলানো ছবিগুলির চিহ্নরেখা, ছবিগুলি সব নামিয়ে ফেলা হয়েছে। বাড়ির এবং প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ধার করে আনা চেয়ারগুলি বসার ঘর থেকে শোবার ঘর পর্যন্ত দেয়ালের পাশে সারিবদ্ধ ভাবে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। শূন্য জায়গাগুলি মনে হল বিশাল, আর বড় আসবাবগুলি একপাশে সরিয়ে রাখার ফলে সৃষ্ট শূন্যতার মধ্যে লোকজনের কণ্ঠস্বরে একটা অপার্থিব অনুরণন শোনা গেল। শুধু কনসার্ট পিয়ানোটি ঘরের এক কোনে দাঁড়িয়ে রইল, একটা সাদা চাদরে আবৃত। পাঠাগারের ঠিক কেন্দ্রস্থলে। নিজের বাবার বড় টেবিলের ওপর কোনো শবাধার ছাড়া শুইয়ে রাখা হল তাঁকে, যিনি একদা ছিলেন জুভেনাল উরবিনো দ্য লা কাল, শেষ চূড়ান্ত ভীতির রেখা যার মুখাবয়বে এখন প্রস্তরীভূত হয়ে আছে, তাঁর পরনে আস্তিনহীন ঢোলা কালো একটা জামা, পাশে রক্ষিত নাইটস অব দি হোলি সিপালকারের সামরিক তরবারি। তাঁর পাশে, শোকের পূর্ণ- পোশাকপরিহিতা, মাঝে মাঝে কেঁপে ওঠা, কিন্তু তা ছাড়া প্রায় সম্পূর্ণ অনড়, ফারমিনা ডাজা-কে দেখা গেল। আবেগের বিশেষ কোনো অবিব্যক্তির প্রকাশ না ঘটিয়ে লোকজনের শোকজ্ঞাপন ও সমবেদনা গ্রহণ করলেন তিনি, পরদিন বেলা ১১টা পর্যন্ত, তারপর তিনি বাড়ির বারান্দায় স্বামীর কাছ থেকে শেষ বিদায় নিলেন, রুমাল নেড়ে তাঁকে তাঁর শেষ বিদায় সম্ভাষণ জানালেন। উঠানে ডিনা পার্ডোর চিৎকার শুনে বেরিয়ে এসে স্বামীকে কাদার মধ্যে পড়ে মৃত্যুবরণ করতে দেখার পর নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা তাঁর পক্ষে সহজ হয় নি। তাঁর প্রথম প্রতিক্রিয়া হয়েছিল আশার, কারণ ডাক্তারের চোখ দুটি ছিল খোলা এবং তার মধ্যে এমন একটা উজ্জ্বল আলো জ্বলজ্বল করছিল যা ইতিপূর্বে তিনি কখনো দেখেন নি। তিনি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলেন তাঁকে একটি মুহূর্ত দেবার জন্য, তিনি যেন তাঁর স্বামীকে তাঁদের সকল দ্বিধাসন্দেহ সত্ত্বেও কতো ভালবেসেছিলেন সে কথা বলতে পারেন, এটা জানার আগে যেন তাঁর স্বামীর মৃত্যু না ঘটে। তাঁকে নিয়ে আবার নতুন করে জীবন শুরু করার একটা অদৃশ্য আকুলতা তিনি অনুভব করেন, যে সব কথা এতদিন না বলা ছিল তা যেন এবার বলতে পারেন, যেসব কাজ অতীতে বাজে ভাবে করেছেন এবার যেন তা সুন্দর ভাবে সম্পন্ন করতে পারেন তার জন্য তিনি প্রার্থনা করেন। কিন্তু মৃত্যুর অমোঘ অনমনীয়তার কাছে আত্মসমর্পণ করতে তিনি বাধ্য হন। তাঁর তীব্র বেদনা সমস্ত পৃথিবীর বিরুদ্ধে এক অন্ধ ক্রোধে বিস্ফোরিত হল। এমনকি তাঁর নিজের বিরুদ্ধেও এবং এটাই তাঁকে একা তাঁর নিঃসঙ্গতার মুখোমুখি হবার সাহস ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা যোগালো। এরপর থেকে তাঁর আর শান্তি ছিল না, কিন্তু তাঁর কোনো বাক্য বা আচরণের মধ্যে যেন শোকের প্রকাশ না ঘটে সে বিষয়ে তিনি অত্যন্ত সতর্ক থাকলেন। শুধু একবার তাঁর গভীর ব্যথার প্রকাশ ঘটে, তাও অনিচ্ছাকৃত ভাবে, যখন রবিবার রাত এগারোটায় ওরা বিশপের আশীর্বাদধন্য কফিনটা বাড়িতে নিয়ে আসে, তখনো কফিনের মধ্যে জাহাজের মোমের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তার তামার হাতল আর ভেতরের নরম সিল্কের লাইনিং। ডাক্তার অরেলিও উরবিনো ডাজা দেরি না করে কফিন বন্ধ করার নির্দেশ দিলেন, প্রচণ্ড গরমে অজস্র ফুলের গন্ধে বাড়ির বাতাস ইতিমধ্যে ভারি হয়ে উঠেছিল, তা ছাড়া তাঁর মনে হল তিনি যেন তাঁর বাবার ঘাড়ের কাছে লালচে ছায়ার প্রথম আভাস দেখতে পাচ্ছেন। নীরবতার মধ্যে হঠাৎ একজনের মৃদু গলার মন্তব্য শোনা গেল, এই বয়সে বেঁচে থাকতেই একজন মানুষের অর্ধেক ক্ষয় হয়ে যায়। ওরা কফিনের ডালা বন্ধ করে দেবার আগে ফারমিনা ডাজা তার আঙুল থেকে নিজের বিয়ের আংটিটি খুলে স্বামীর আঙুলে পরিয়ে দিলেন, তারপর জনসভায় কথা বলার সময় তাঁর স্বামী মূল প্রসঙ্গ ছেড়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলে তিনি সর্বদা যা করতেন তাই করলেন, তাঁর হাত তিনি ঢেকে দিলেন নিজের হাত দিয়ে। তাঁকে উদ্দেশ করে তিনি বললেন, খুব শিগগির আবার আমাদের দেখা হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *