৩৮. রামচন্দ্রর দিন

রামচন্দ্রর দিন ভালোই কাটছিলো। তার নবদ্বীপের জীবন চিকন্দির জীবনের তুলনায় সার্থকতর মনে হচ্ছে। মনের সর্বত্র একটা শুচিতার আকাশ বিরাজ করছে। গঙ্গায় স্নান করে চরের শাদা বালির উপর দিয়ে ফিরতে তার একদিন মনে হলো, সূর্যের যে আলোটা তার গায়ে এসে পড়েছে তারও যেন মানুষকে পবিত্র করার শক্তি আছে।

সওয়া-পাঁচ আনা দাম চেয়েছিলো দোকানদার, অনেক কষাকষি করে সাড়ে চার আনায় সে একখানা ছবি কিনেছে। তাতে দেখা যায় মানুষের পাকস্থলী, হৃৎপিণ্ড ও মস্তিষ্কে বৃন্তল দ্বারা পরস্পর সংযুক্ত কতগুলো পদ্ম আছে। একদিন সে একটি মন্দির থেকে বেরুচ্ছিলো। তখন বেলা আটটা-নটা হবে। রোদটা গায়ে পড়ে কষ্ট দিচ্ছে না কিন্তু সেটা যে দৃঢ় কিছু, তা অনুভব হচ্ছে। সে যে ছবিটা কিনেছে তার মতো কিন্তু আকারে বড়ো একটা ছবি মন্দিরের একটা থামে ঝুলোনো ছিলো সেই ছবির দিব্যকান্তি পুরুষটির দেহের অভ্যন্তর থেকে তিনটি প্রস্ফুটিত পদ্ম বিকশিত হয়ে রয়েছে। মন্দির থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে রামচন্দ্রের মনে হলো, তার বুকের মধ্যেও একটি পদ্ম ফুটিফুটি করছে। সম্ভবত ছবিতে দেখা পদ্মর মতো গোলাপি নয় সেটা, তার হয়তো স্বর্ণাভা নেই, বরং বোধ হয় তার ত্বকের সঙ্গে সামঞ্জস্যে কালচে-লাল রঙেরই হবে সেটা। রামচন্দ্রর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। পদ্মগুলিকে সত্যিই অনুভব করা যায় কিনা, এবং সেগুলিকে আরও জায়গা করে দেওয়া উচিত–এই দুটি অধস্ফুট চিন্তা থেকে রামচন্দ্র গভীর নিশ্বাস টেনে খানিকটা সময় দমটা ধরে রাখলো। তার ত্বক ভেদ করে হু-হুঁ করে ঘাম বেরিয়ে এলো।

কিছুক্ষণ পরে সে চারিদিকের লোকজনদের লক্ষ্য করলো। পিছনে তার স্ত্রী সনকা এবং কেষ্টদাস আসছিলো। চারিপাশের অন্য অনেক লোককে যেমন, কেষ্টদাস ও সনকাকেও তেমনি অত্যন্ত দুর্বল বলে মনে হলো তার। ওদের বুকের পদ্ম স্বভাবতই তার নিজের পদ্মটির তুলনায় স্বল্পপরিসর হবে। কেষ্টদাসের বুকের পদ্মটি দুর্গাপূজার জন্য বহুদূর থেকে তুলে আনা পদ্মকলির মতো হয়তোবা শুকিয়ে গেছে।

বাসায় ফেরার পর বহুক্ষণ ধরে একটা অব্যক্ত আনন্দ তার মনের মধ্যে ঘোরাফেরা করলো। নিচু গলায়, তার দরাজ গলা যতদূর নিচু করা সম্ভব, কয়েক মিনিট সে নামকীর্তন করলো। কিন্তু তাতেও যেন তার অনুভবটার প্রকাশ হলো না। সনকাকে কাছে ডেকে নিয়ে তার মুখের দিকে চেয়ে রইলো। সনকাকে যেন বিষাদ-মলিন দেখাচ্ছে, আর সেই বিষাদ গাঢ়তর তার ঠোঁটের কোণ দুটিতে। বিস্মৃতপ্রায় অতীতের বিহ্বল দিনগুলিতে সনকার অভিমান বেদনা দূর করার জন্য যা করতো তেমনি করে সনকাকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে যেন নিজের স্বাস্থ্যের সৌরভে তাকে পরিপূর্ণ করে দেওয়ার জন্যই তার ওষ্ঠাধরে নিজের ওষ্ঠাধর স্পর্শ করালো।

.

অন্য আর একটি বিষয় হচ্ছে শোক। এখানেও শোকের রাজ্যপাট। তবু মন্দিরে ঘুরে দেবমূর্তিগুলিকে অনুভব করে রামচন্দ্রর মনে হলো কিছুই হারায় না।

সে ইতিমধ্যে স্থির করে ফেলেছে বাকি জীবনটা এমনি করেই কাটিয়ে দেবে। একটিমাত্র প্রতিবন্ধক আছে সে-পথে, সেটা হচ্ছে উপজীবিকা সম্বন্ধীয়। কেষ্টদাস কিছুনা করেও এ-আখড়া ও-আখড়ায় ঘোরাফেরা করে আহার্য-পরিধেয়, এমন কী একটি বাসস্থান সংগ্রহ করে ফেলেছে। যে কয়েকটি টাকা সঙ্গে নিয়ে এসেছিলো রামচন্দ্র, সনকার অত্যন্ত হিসেবি হাতে খরচ হয়েও যখন সেটা শেষের কাছাকাছি এসে পৌঁছলো তখন দুর্ভাবনা হওয়ারই কথা। কিন্তু একটা ঘটনা ঘটে গেলো। শুনে কেষ্টদাস বললো, এখানে আসেও জড়ায়ে পড়লেন? আর রামচন্দ্র তার স্ত্রীকে বললো, ভাগ্যমানের বোঝা ভগোমান বয়।

গঙ্গার ওপারে শ্রীমায়াপুর ধামে গিয়েছিলো রামচন্দ্র। ফিরতিপথে পথচারীদের গল্পে সে যোগ দিয়েছিলো। তাদের মধ্যে একজন দুঃখ করে বলছিলো–তার সব জমি বেদখল হয়ে গেলো। আলাপ-পরিচয়ে কথা অনেকদূর গড়ালো। যখন তারা খেয়ার নৌকোয় উঠে বসেছে কেষ্টদাস শুনতে পেলো রামচন্দ্র বলছে: বেশ তো, চার-পাঁচ বিঘা আমাকে দেন। বর্ষার আগেই জঙ্গল কাটে বসে যাবো।বর্গাতে চষবো জমি। চাষের খরচ আধাআধি, ফসল আধাআধি। তাহলে জমিও আপনার দখলে থাকলো।

চিন্তা করেও সুখ। তার জমির পাশেই থাকবে গঙ্গা, আর গঙ্গা পার হলে নবদ্বীপধাম। আর কী চাই পৃথিবীতে? বাড়িতে মুঙ্‌লা অর্থাৎহকদারের হাতে জমিজিরাত-ইহলাকে সুবন্দোবস্ত। আর পরলোকের সুব্যবস্থা করার জন্য পাওয়া গেলো চার-পাঁচ বিঘা জমি।

সনকা বললো, সগ্‌গে যায়েও ধান ভানবা?

সে-কাম তো তোমার, সুনু। আমি খানটুক জমি পাই, নিবো। সন্নবন্ন অস্মিতের দানা ফলবি সে-জমিতে। সেখানে আমি দিবো চাষ, আর তুমি ভাব্বা ধান।

রামচন্দ্র সনকার হাত থেকে ককেটা নিয়ে ফুঁ দিতে লাগলো।

একদিন কেষ্টদাস বললো, শুনছেন মণ্ডল, দেশ বলে ভাগ হতিছে?

এসে আবার কী?

হয়। এক ভাগ হিঁদুর, আর এক ভাগ মোসলমানের।

ভাগ কে করে? ইংরেজ? তার নিজের জন্যি কী রাখবি? রামচন্দ্র হো-হো করে হেসে উঠলো।

কী আবার রাখবি! মনে কয়, খাসের জমি পত্তনি দিতেছে। মনে কয়, বিলেতে বসে খাজনা পাবি।

‘ধুর, এ হবের পারে না।

খেয়া নৌকোয় নানা ধরনের যাত্রীর মুখে মুখে অসংলগ্ন ও অসংপৃক্ত চিন্তাধারা কিছুক্ষণের জন্য একত্র হয়। একদিন সেখানেও রামচন্দ্র দেশভাগের কথাটা শুনতে পেলো।কয়েকজন বয়স্ক লোক এই ব্যাপারটার ভয়াবহ পরিণতি নিয়ে আলোচনা করলো। একটি অপেক্ষাকৃত অল্পবয়স্ক ভদ্রলোক বললো–এর আগে মুসলমানের রাজত্ব ছিলো এ দেশে। তখন কি হিন্দু ছিলোনা দেশে? মুসলমান নবাব আর হিন্দু প্রজা মনকষাকষি করেছে, মারপিট করেছে, কিন্তু আবার মিলেমিশেও থাকতো।

অন্য একজন বললো, ওদেরই ক্যাডর, ওদেরই পুলিস এমন যদি হয়? অন্যায়ের নালিশ হবে কোথায়?

রামচন্দ্রর কৌতূহল হলো কিন্তু ভদ্রলোকদের আলাপে যোগ দিতে সাহস হলো না। তার ধারণা হলো এসব আলাপ-আলোচনা তার জ্ঞানের বহির্ভূত বিষয়।

এদিকে রামচন্দ্রর জমি চাষের ব্যাপারটা আরও কিছুদূর অগ্রসর হয়েছে। রামচন্দ্র নদী পার হয়ে লোকটির বাড়িতে গিয়েছিলো। যে জমি সে দেখালো তার অধিকাংশ ময়নাকাটা, পিটুলি প্রভৃতি অকেজো গাছের জঙ্গলে ঢাকা। সে-জঙ্গল দূর করে জমি দখল কিংবা বেদখল করা,দুটিই সমান কষ্টসাধ্য ব্যাপার। যার পায়ের তলায় মাটি নেই সে ছাড়া এমন মাটিতে কেউ লোভ করে না।

কিন্তু বেদখল হওয়ার ব্যাপার একেবারে মিথ্যানয়। সেই জঙ্গলের আশেপাশে খেলার ঘরের মতো ছোটো ছোটো ঘর তুলে কয়েক ঘর লোক বাস করতে শুরু করেছে। এদের মুখ চোখ দেখলে মনে হয়, দৃশ্যমানচরাচর এদের চোখের সম্মুখে পাক খাচ্ছে, মস্তিষ্ক কোনো বিষয়ের প্রকৃত ছাপটা নিতে পারছে না।

রামচন্দ্র ভাবলো, এরা কি তেমন সব গ্রামবাসী যারা কলে কাজ পাওয়ার আশায় গ্রাম ছাড়ে?

রামচন্দ্র এগিয়ে গিয়ে তাদের মধ্যে একজনকে প্রশ্ন করলো, তোমরা কনে থিকে আলে?

আইলাম।

তা তো আসছেই। কিন্তু এখানে থাকবা কনে, খাবা কী?

করণ কী? দ্যাশ যে আমাগোর না। বাগ অইছে।

এখানে জমি চষবা? রামচন্দ্র হাসলো মনে মনে। দেখো কাণ্ড! পৃথিমি কি সানিকদিয়ার জোলা, বাঁধ দিয়ে জমিভাগ করবা?

কই পামু?

জঙ্গল কাটবা? আচ্ছা, যদি জমিত লাঙল দেই, তোমাক ডাকবো।

বাসায় ফিরে রামচন্দ্রর দুর্ভাবনার অন্ত রইলো না। সাবধানী মনে অমঙ্গলের আশঙ্কা সাধারণের চাইতে বেশি আসে। তার মনে এমন কথাও উঠলো-আঁ, তাই নাকি? মুঙ্‌লারাও এমন কোনো জঙ্গলের ধারে এমন বোকা বোকা মুখ করে বসে আছে নাকি? শিবো, শিবো!

কেষ্টদাসকে রামচন্দ্র তার দুঃস্বপ্নের কথা বললো। এখন কেষ্টদাস যে-কোনো পরিস্থিতির লাগসই গল্প পুরাণাদি থেকে উদ্ধার করে কিংবা নিজেও কখনো কখনো তৈরি করে বলতে পারে। ঘটনাটা এবং রামচন্দ্রর আশঙ্কার কথা শুনে সে বললো, লোভে আপনেক বিভীষণ দেখাইছে।

হতে পারে, অসম্ভব কী! লোভের মতো এত কঠিন নেশা আর কীসের হয়। রাগ বলল, হিংসা বলল, তার তবু কিছু নিবৃত্তি আছে। লোভের শেষ নেই, সারা দিনরাতে এক মুহূর্ত সে নেশা কাটে না। ঘুমে রাগ দূর হয়, লোভ তখনো বিকৃত মুখে ভয় দেখাতে থাকে।

একদিন তার পাড়ায় ঢুকতে ঢুকতে রামচন্দ্র শুনতে পেলো একজন খাকি-পোশাক-পরা লোক তার খোঁজ করছে। পুলিস নাকি? রামচন্দ্র কোনদিকে না তাকিয়ে নিজের ঘরখানিতে গিয়ে ঢুকলো। সনকাকে বললো, কও তো, এ বিপদ আবার কন থিকে আসে?

লোকটি পুলিসনয়। ডাকঘর থেকে এসে চিঠি বিলি করে বেড়ায়। সে যখন রামচন্দ্রর দরজার সম্মুখে দাঁড়িয়ে বললো চিঠি আছে, চার আনা পয়সা লাগবে’তখন রামচন্দ্র সদ্য-বিপদমুক্তির স্বস্তিতে বললো, চার আনা এই চিঠির দাম, আর এই চার আনা নেন পান খাবেন।

লোকটি চিঠি রেখে চলে গেলে রামচন্দ্র কিছুক্ষণ সেটা হাতে নিয়ে বসে রইলো। একখানা বড়ো কাগজ চৌকোণা করে ভাঁজ করা, তার উপরে বড়ো বড়ো বাঁকাচোরা অক্ষরে ভুসো কালিতে বোধহয় ঠিকানা লেখা। রামচন্দ্র উল্টে-পাল্টে দেখলো টিকিট নেই কিন্তু ডাকঘরের অনেক ছাপ পড়েছে।

সনকা বললো, কে লিখছে চিঠি?

কে লিখবি কও? যদি লেখে তো সেই মুঙ্‌লারাই লিখছে।

এখানে একটু থিতু হয়ে বসেই সে মুঙ্‌লাকে চিঠি লিখিয়েছিলো, সগগে আছি। আমার জন্যি ভাববা না।

দুপুরে আহারাদির পর সনকাকে সঙ্গে করে দরজায় তালা এঁটে রামচন্দ্র বার হলো কেষ্টদাসের সন্ধানে। কেষ্টদাসকে পাওয়া গেলে তাদের আখড়ার গাছতলায়। কেষ্টদাস বললো, বসেন।

রামচন্দ্রর স্ত্রী গাছটার পিছন দিকে আড়ালে বসলো। রামচন্দ্র কেষ্টদাসের সম্মুখে বসে বললো, একখান চিঠি আসছে, পড়া লাগে।

ভান্‌মতি চিঠি লিখেছে। বর্ণাশুদ্ধি, ব্যাকরণ ভুল তো বটেই, হস্তাক্ষরও অনেক জায়গায় দুপাঠ্য। কেষ্টদাস পড়লো :

বাবা মা আমার পোনাম লইবেন। আমি আপনাদের বউ ভানুমতি লিখতেছি। পরে সমাচার এই চাষবাসের অবস্থা ভালো না। সানিকদিয়ারে এক নুতোন রাজা হইছে তার। ভয়ে সেথাকার হিন্দুরা পালাইতেছে। চিকোনদিহিতে নাকি আর এক রাজা, তার ভয়ে মোছলমানরা পলাবি। আর লিখি আপনাদের ছেলে চাষবাসে মন দেয় না। নায়েবের সাথে ঝগড়া করিয়াছে। সনধায় খোলকরতাল লইয়া গান করে। গোঁসাইয়ের বাড়িতে কোথা হইতে তার তিন-চারজন আপ্তজন আসিয়াছে তারা পদ্দকে তাড়াইয়া দিয়াছে। আপনারা কবে আসিবেন। আসা লাগে। ইতি।

চিঠিটায় আরও কিছু লেখা ছিলো। প্রথমে লিখলেও ভান্‌মতি পরে সেগুলি কেটে দিয়েছে। কেষ্টদাস অল্প চেষ্টাতেই সেই অস্পষ্ট এবং গোপন করা বক্তব্যটা ধরতে পারলো। সে লিখেছিলো, পদ্ম সাপের পাকের মতো জড়িয়ে ফেলেছে সংসারটাকে। সারা দিনরাতে মুঙ্‌লা পদ্মর সঙ্গে পাঁচ বার দেখা করতে যায়, ভান্‌মতির সঙ্গে দুটো কথা বলে কিনা সন্দেহ।

চিঠি পড়া শেষ করে সেটাকে রামচন্দ্রর হাতে ফিরিয়ে দিয়ে কেষ্টদাস মাটির দিকে চেয়ে রইলো। তার গুরুর আদেশ, খুব রাগের সময়ে মাটির দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকবে। এটা রাগের ব্যাপার নয়। মনের চারিদিকে ধুলোমাটির হোক, গঙ্গামাটির হোক, একটা স্তর পড়েছে, কিন্তু তার উপরেও পদ্মর সম্বন্ধে ভানুমতির বক্তব্যগুলি আর রাখা যাচ্ছে না। মনের আবরণ পুড়তে পুড়তে কাঁচা মাংসে যেন তাপ লাগছে। মাটির দিকে চেয়ে থেকে তার মনে হলো এ অবস্থায় কী করা যায় গুরু বলে দেয়নি। সেজন্যই বোধহয় গুরুকে স্মরণ করেও কেষ্টদাস কিছুতেই আর নিজেকে স্থির রাখতে পারছেনা। মনের উপর থেকে অঙ্গারটিকে বাইরে নিক্ষেপ না করলেই যেন নয়।

কেষ্টদাস বললো, মণ্ডল, বাড়িতে যান। আমি পারি বৈকালে যাবে। এখন শরীলটা কাহিল লাগতেছে, একটুক শোবো।

চিঠিটা হাতে নিয়ে রামচন্দ্ররা নিজের বাসায় ফিরে এলো। ভানুমতির চিঠিতে লুকিয়ে রাখা হাহাকারে শুধু কেষ্টদাসের রোগজীর্ণ বুকের দেয়াল যেন ভেঙে পড়ার মতো হলো।

রামচন্দ্র তার স্ত্রীকে পথেই একবার প্রশ্ন করলো, কও, সনকা, কও; তুমি কও আমার কী করা এখন?

কী আর করবা। ভান্‌মতিক চিঠি লেখো ভয় না করে। তার বাপেক লেখো দেখাশুনা করবের।

তখনকার মতো নির্লিপ্তের ভঙ্গিতে তামাক সাজতে বসলো রামচন্দ্র। কিন্তু কিছুক্ষণ বাদেই সে প্রশ্নটায় ফিরে এলো। এখন কী করা?

সনকা আমল দিলো না। সে বললো, একটু বাজারে যাবা? দু-চার পয়সার আনাজ আনা নাগতো।

কিন্তু রামচন্দ্র বাজারে গেলো না। সে পায়চারি করতে লাগলো; কেষ্টদাস আসবে বলেছিলো, তার প্রতীক্ষাতেও দু-একবার রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালো। কেষ্টদাস এলো না।

রাত্রিতে রামচন্দ্র বললো, সনকা, গাঁয়ে যাওয়া লাগে।

কিও কী? আবার সেখানে কেন? জমিজিরাত সব অন্যেক দিয়ে দিছো।

সে সব নষ্ট হয় যে।

তোমার কী লোকসান?

রামচন্দ্র যুক্তিটাকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে লাগলো। সেই অবসরে সনকাও চিন্তা করলো। রামচন্দ্রকে তার জমিজিরাত এবং মণ্ডলী থেকে পৃথক করে নিলেও যে তার এতকিছু অবশিষ্ট থাকে এ সে কোনোদিন কল্পনা করতে পারেনি। সেজন্য যৌবনেও ধানে এবং ধুলোতে জড়ানো যে রামচন্দ্রকে সে পেয়েছিলো তার চাইতে ঐকান্তিক কিছু পাওয়ার তৃষ্ণা তার ছিলো না, কিন্তু এই প্রৌঢ়ত্বে এসে সে দুদিনে যা পেয়েছে তার লোভ জমিজমা সংসারের চাইতে অনেক শক্তিশালী। কিন্তু মুঙ্‌লার মুখটাও মনে পড়ে গেলো সনকার। ভাৰ্মতি রান্নাবান্না করতে পারে বটে কিন্তু তাহলেও হয়তো মুঙ্‌লা সময়মতো আহার্য পায় না। আর, নায়েবের সঙ্গে ঝগড়া লেগেছে। নায়েবরা অত্যন্ত নির্দয় হয়। যদি সে মুঙ্‌লাকে ধরে নিয়ে গিয়ে মারধোর করে!

নিজের হক রাখবে যোল আনা,নায়েব জমিদারও খাতির করে, সেই মণ্ডলী বুদ্ধি ছেলেমানুষ মুঙ্‌লা কোথায় পাবে?

সনকা অস্বস্তিতে বিছানায় উঠে বসলো।

রামচন্দ্র বললো, উঠলা যে?

এখন কী করা, তাই কও। রামচন্দ্রর প্রশ্নটা সনকার মুখে।

কী করবা? যা দিয়ে দিছি তাতে আর লোভ কেন্? রামচন্দ্র সনকার যুক্তিটায় ফিরে এলো।

লোভ না হয় না করলা। কিন্তু মুঙ্‌লা গান বাঁধে নায়েবের সঙ্গে ঝগড়া করে, এ কী কথা, কও?

রামচন্দ্রও বললো, লোভ না হয় না করলাম। কিন্তুক এ জীবনে যা করলাম তা যদি ছিটায়ে ছড়ায়ে যায়, কষ্ট হওয়া লাগে কি না-লাগে?

‘তা তোমার হউক না হউক। আমার ছাওয়াল-মিয়ে সেখানে, আর তুমি এখানে পলায়ে থাকবা!

পরদিন সকালে রামচন্দ্র ঘরের মেঝে খুঁড়ে সরা-ঢাকা একটা মাটির হাঁড়ি বার করলো। তা থেকে বার্লির ছবি আঁকা টিনের কৌটো বেরুলো। আপদ-বিপদে সম্বল দেড় কুড়ি টাকা। সনকা রান্নার ফাঁকে ফাঁকে উঠে এলো হিসাবের ব্যাপারে সাহায্য করতে। সে একবার বলে গেলো, বাড়িভাড়া তিন টাকা দিতে হবে; আর একবার এসে বললো, মুঙ্‌লার জন্য একটা ছিটের জামা আর ভান্‌মতির জন্য শাখার চুড়ি কিনতে হবে।

আহার শেষ করেই রামচন্দ্র বললো, কেষ্টদাস গোঁসাই আজ ঠিকই আসবি, তার আগে বারায়ে পড়ি চলো।

কেন্‌? তাক নিলে কেনাকাটার সুবিধা হতো।

কিন্তুক সে কবি, কবি এমন কথা নাই, যদি কয় কিছু?

তা পারে।

কেষ্টদাসের চোখে পড়তে না হয় এমন সব ঘোরাপথ ধরে রামচন্দ্র তার সামান্য কেনাকাটার ব্যাপার শেষ করলো। তারপর বাড়িওয়ালাকে ভাড়ার টাকা কটা পৌঁছে দিয়ে সনকার হাত ধরে গ্রামমুখো হলো। তখন সন্ধ্যার অন্ধকার হয়েছে। পুণ্যাত্মা কেষ্টদাস আজকাল রাত্রিতে অত্যন্ত কম দেখে। পথে দেখা হলেও পাশ কাটিয়ে পালানো যাবে।

খেয়া নৌকায় বসে রামচন্দ্র সখেদে বললো, গোঁসাইয়ের সঙ্গে দেখা করে আলাম না।

.

রামচন্দ্র সস্ত্রীক ট্রেনে চলেছে। গাড়িতে ভিড়। এত ভিড় ক্যান, কোথা যাতিছে এত্ত মানুষ? দুটি বেঞ্চের তলায় কোনোরকমে মালপত্র রেখে যাত্রীদের পায়ের কাছে কোনোরকমে সনকার বসবার জায়গা করে দিয়ে রামচন্দ্র দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। তার বোকা-বোকা মুখে ও সন্ত্রস্ত চোখ দুটিতে তার মনের ভূত-ভবিষ্যৎ পরিব্যাপ্তঝড়ের কোনো চিহ্ন ফুটলেও কারো চোখে পড়ছেনা। কিংবা  কারই বা দৃষ্টি আছে তখন অন্য কাউকে লক্ষ্য করার?

বন্দর দিঘার স্টেশন যেন ঠাণ্ডা হিম। শেষরাত্রির এই গাড়িটা থেকে নেমে নিদ্রাবঞ্চিত যাত্রীরা সোরগোল করলো না। তারা যেন এখানে আসতে চায়নি, কী করে এলো তাও বুঝতে পারছে না। ফিরিওয়ালারা ঘুমিয়ে রইলো। দু-একজন কুলি ঘুমের ঘোরে কুলি’বলে মৃদুস্বরে ডাকাডাকি করলো। আগের দিন প্রায় এরকম সময়েই পাশের প্ল্যাটফর্ম থেকে অনেক লোকজনের সোরগগালের মধ্যে পাশাপাশি সাজানো কয়েকখানা রিজার্ভ কামরায় সান্যালমশাই যাত্রা করেছেন। সে খবর অবশ্য রামচন্দ্রকে কেউ দিলো না।

রামচন্দ্রর বরং ভয় করে উঠলো। ভোর হওয়ার আগের মুহূর্তের ধূসর রঙের আকাশ আর কালচে নীল পৃথিবী মিলিয়ে যেন এক সুরঙ্গপথ তার সামনে। এরকম যেন সেই জীবনে এই প্রথম দেখছে।

সনকা বললো, এখনই যাবা?

রামচন্দ্র তার ঝোলাগুলোকে কাঁধে তুলে বুক চিতিয়ে বললো, মনে হয়, একটু সাহস করা লাগবি।

রূপপুরের কাছাকাছি যখন, মানুষ চেনা যায় কি যায় না। পথের ধারে দাঁড়িয়ে একজন বললো, চিকন্দির মণ্ড না? আলেন? সগলে যায়! রামচন্দ্র গোঁফে হাত রাখলো। সনকা জিজ্ঞাসা করলো, কী কয়? বোঝাটা ভার বোধ হওয়ায় রামচন্দ্র কাঁধ বদলে নিলো, বললো, চলো।

রামচন্দ্ররা যখন বুধেডাঙার কাছাকাছি পৌঁছলো তখন প্রভাত হচ্ছে। দিগন্তের কাছে পদ্মার খানিকটায় যেন আলতা গোলা, সেই আলতা ক্রমশ কঠিনের রূপ নিয়ে গোল হয়ে উঠছে।

সনকা বললো, ভোর হতিছে।

কিন্তু খেতে লোক নাই কেন্‌?

তুমি বাদে সকলেই জানে খেত মাটি, দু দণ্ড পরে গেলে পলায় না, রাগও করে না।

বুধেভাঙার ঘুম ভাঙছিলো। অল্পবয়সী কেউ একজন একপাল হাঁস তাড়িয়ে নিয়ে পদ্মার দিকে যাচ্ছে দেখতে পাওয়া গেলো। সে রামচন্দ্রকে দেখতে পেয়ে পথের উপরে দাঁড়ালো। ছিদামের জ্যাঠা না? আসলেন?

হয়। তুমি ইজু না? ভালো?

হয়।

কয়েক পা এগিয়ে রামচন্দ্ররা দেখতে পেলো একটি স্ত্রীলোক পথের ধারে দাঁড়িয়ে শুকনো বাঁশ কঞ্চি কেটে কেটে ছোটো করছে।

সনকা রামচন্দ্রকে চুপিচুপি জিজ্ঞাসা করলো, এমন সুন্দর মিয়ে কার?

রামচন্দ্র এবার হাসিমুখে জবাব দিলো, কার মিয়ে সুন্দর হলে তা বাপেরা টের পায় না। তা এটা রজব আলির বাড়ি। তার এক ভাইয়ের বিটি সুন্দর হইছে, শুনছি।

এই জায়গাটা পরিচিত লাগছে না? রামচন্দ্র অনুভব করলো, এখানেই তো বিলমহলের এরশাদ, জসিমুদ্দিন, লাকেন, চিকন্দির সীমানায়। এর পরেই দাদপুরী কৈবর্তদের রাবণ, অগ্নিকুমার, মুকুন্দ, চিকন্দিতে পা দিলেই। একেকজনা শয়ে শয়ে মানুষ। আমু আর এরশাদ দাঁড়ালি কয় শ’ হয়? সে ফোপাতে লাগলো।

পৌঁছে যাওয়ার স্বস্তিটা অনুভব করতে লাগলো রামচন্দ্র।

তারা যখন নিজের বাড়ির সম্মুখে এসে পৌঁছলো তখন বেলা হয়েছে। কিন্তু তখনো বাড়ির ভিতরে যাওয়ার সব দরজা বন্ধ। এরকম হওয়া উচিত নয়। রামচন্দ্রর মনে আবার নানা অমঙ্গল চিন্তা ভিড় করে এলো। কিন্তু সনকা তাকে বাইরের বারান্দায় অপেক্ষা করতে বলে ঘরের পাশ দিয়ে গিয়ে অন্দরে যাওয়ার আগড়টা খুলে দিলো।

ভানুমতি বাড়ির মধ্যে কাজ করছিলো। সে আশা করতে পারেনি প্রায় একমাস আগে যে চিঠি দিয়েছিলো সে তার এত শক্তি হবে যে রামচন্দ্রকে টেনে আনতে পারবে। শ্বশুর-শাশুড়িকে প্রণাম করে উঠে দাঁড়িয়ে সে কথা খুঁজে পেলো না, ঝরঝর করে কেঁদে ফেলো।

কী হইছে? কাঁদিস কেন? থির হ, সবই শোনবো’ রামচন্দ্র এবংসনকা দুজনে কথা মিলিয়ে মিলিয়ে সান্ত্বনা দিলো।

মুঙ্‌লা কনে? এত বেলায় ঘুমায় নাকি?

ভানুমতি বললো, অনেক রাত্তিরে ফিরছে।

হুঁ। আচ্ছা, সে সবই আমি দেখবো। তামাক সাজে আন।

তামাক খেতে খেতে হৃষ্ট হলো রামচন্দ্র। সে স্ত্রীকে লক্ষ্য করে বললো, জীবকালে আর নড়তেছি না, তা কয়ে দিলাম।

দুপুরে দিবানিদ্রা শেষ করে আবার তামাক নিয়ে বসে রামচন্দ্র সংসারে প্রবেশ করবে স্থির করলো। কিন্তু তখন মুঙ্‌লার সঙ্গে জনান্তিকে কথা বলার সুযোগ হলো না তার। কয়েকজন প্রতিবেশী এলো। আলাপ-আলোচনার ধারাটা তখনকার মতো রামচন্দ্রর তীর্থবাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রইলো। শুধু তাদের একজন দুজন প্রশ্নের আকারে উত্থাপন করলো কথাটা, তুমি তো বিদেশে গিছলে, কী শুনে আলে? দেশ নাকি ভাগ হতেছে?

বুঝি না। কোনকার কোন দুই রাজা যুদ্ধ বাধালো একবার, ধান না পায়ে উজাড় হলাম। কনে কোন শহরে দুইজনে বাধালো কাজিয়া, খেত-খামারের কাজ বন্ধ করলাম। আবার দ্যাখো কন থিকে কোন দুই জন আসে দেশ ভাগ করতিছে।

ভাগ নাকি হয়ে গেছে। একজন বললো।

তাইলে জানতাম। অপর একজন বললো।

জানবা কী করে সীমানায় খাল কাটবি, না, বেড়া দিবি?

কিছু একটা তো করবি?

তারা চলে গেলে রামচন্দ্র মুঙ্‌লাকে ডাকলো।

মুঙ্‌লা এসে বলল, কেন, বাবা, দিঘায় শুনে আলাম দেশ নাকি ভাগ-বণ্টক হবি?

তা যাক। দেশ কি তোমার না আমার? তুমি কি নায়েবের সঙ্গে ঝগড়া কাজিয়া করছো?

মুঙ্‌লা অপরাধীর মতো মুখ নিচু করলো।

তাইলে ঝগড়া করছে। তা করলা কেন্‌?

ছিদামের জমি নিয়ে গোল। কেষ্টদাস কাকার কোন কুটুম দাদপুর থিকে উঠে আসছে। আসে ছিদামের ঘরবাড়ি দখল নিছে। নায়েবেক কয়ে জায়গাজমি নিজের নামে লিখাতেছে।

কে, তা করে কে?

কয়, চারদিকে গোল, চিকন্দিতে নিশ্চিন্দি।

নিচ্চায়। তার বাদে?

পদ্মক তাড়ায়ে দিছে।

হুম।

পদ্ম কাঁদে আসে কলো-আমি এখন কনে যাই?

হুম। আগো।

নায়েবেক কলাম-পদ্ম আছে থাক, খাজনা তার কাছে নেন, বাইরের লোক আনে লাভ অলাভ কী? কয় যে-মিয়েছেলে জমি-বা চবি কী, খাজনাবা দিবি কী?

ন্যায্য। তার পাছে?

কলাম–আমি জামিন থাকবো।

মণ্ডলের বেটা মণ্ডল হইছে, কেন্‌?

নায়েব শোনে নাই, পদ্মক উঠায়ে দিছে। কেষ্টদাস কাকার বাড়িতে তার কুটুমরা বসছে। পদ্ম মোহান্তর এক ভিটায় বসছে ঘর তুলে। তা, কোটে যায়ে মামলা করবো তা শাসাইছি নায়েবেক।

যা করছে, করছে। কোটে যাওয়া কাম নি। দেখতেছি। বললো রামচন্দ্র।

ভান্‌মতি শক্ত মেয়ে, রামচন্দ্র ফিরে আসায় সে নিজেকে বলিষ্ঠতর বোধ করছে। তার চিঠিতে যে কয়েকটি কথা সে লিপিবদ্ধ করেও কেটে দিয়েছিলো, সেগুলির সে পুনরুত্থাপন করলো না।

দু-চারদিন নির্ঝঞ্ঝাটে কেটে গেলো। তারপর অতিক্রুদ্ধ আকাশে যেমন মেঘগুলি ধীরে ধীরে পাকাতে শুরু করে, সেই আকাশের তলে থমথমে পদ্মার মনোভাব বোঝা যায় না, বালি ওড়ে আর বালির পাড়ে আলকাতরা রঙের ছোটো ছোটো ঢেউ আছড়ে পড়ে, তেমনি করেই সংবাদটা আত্মপ্রকাশ করতে লাগলো।

একদিন সকালে রামচন্দ্র সানিকদিয়ারে গিয়েছিলো তার বেহাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে। দৃশ্যটা দেখে তার সরসতা শুকিয়ে গেলো, প্রাণ আই ঢাই করতে লাগলো, কথা জুয়ালো না।

তীর্থভ্রমণ নয়, দেশ-পর্যটন নয়, শ্মশান-যাত্রা। রামচন্দ্র ব্যাপারটা অনুমান করে নিতে পারলো। এবং অনুমান করে সে মহিমের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো।

কাকা, এ কী দেখি?

রাম রে, তুমি আসছো? কও, এ কী হলো? এ কোন পাপ?

কিন্তুক যাবেন কে?

পাঁচ-ছটি গোরুগাড়িতে মহিমের পরিবারের সকলের অস্থাবর সম্পত্তি ধরবে কিন্তু তার স্থাবর সম্পত্তির এতটুকুও তার সঙ্গে যাবে না।

রামচন্দ্র আবার বললো, না গেলি হয় না?

পরে আর যাওয়া যাবি নে! জামাই তাই লিখছে।

নীরবে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে রামচন্দ্র বললো, মিয়েক দেখে যাবেন না, কাকা?

আবার নীরবতা। মহিমের দিকবিখ্যাত জোয়ান ছেলেরা পটুহাতে গোরুগাড়ি বোঝাই করছে। তাদের জোয়ান কিংবা পটু দেখাচ্ছে না। বাড়ির ভিতরে একটা চাপা কান্নার শব্দ উঠছে।

রামচন্দ্র নিজের বাড়িতে ফিরে চললো। তার চিরবিশ্বস্ত পা দুখানা যেন মোমের তৈরি বলে মনে হচ্ছে। প্রথমেই তার মনে হলো, সে যে কত বড়ো বোকা এতদিনে তা প্রতিপন্ন হলো। এত বড়ো দুর্ঘটনা ঘটছে এবং ঘটে গেছে এ সম্বন্ধে সে একেবারে অজ্ঞ। দূরে দূরে ছিলো বলেই কি এমন হলো। ঘটনাটা সে অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে অস্বীকার করতে চায়, সংবাদটা সম্বন্ধে সে অত্যন্ত বিমুখ বলেই কি সে এমন চূড়ান্ত নির্বুদ্ধিতায় নিশ্চিন্ত হয়ে আছে? আর মহিমের গোরুর গাড়ির বহর যখন সানিকদিয়ার চিকন্দির উপর দিয়ে দিঘার দিকে যাত্রা করবে পথের দু-পাশের লোকগুলির মনের অবস্থা কি হবে? আতঙ্কগ্রস্ত মানুষের সেই ছুটোছুটির মধ্যে বুদ্ধি আবর্তে পড়ে মার খাবে। ঝড়ের মুখে নৌকো বাঁচে না।

রামচন্দ্র বাড়িতে পৌঁছে মুঙ্‌লাকে খবর দিলো তার শ্বশুর আসছে সপরিবারে। ভান্‌মতি বললো, হঠাৎ যে?

রামচন্দ্র এই সামান্য প্রশ্নটার উত্তর দিতে গিয়ে আকাশ-পাতাল অন্বেষণ করে গোঁফ চুমরে মাটির দিকে দৃষ্টি আনত করে বললো, তীখ করতে যাবি।

ভান্‌মতি ফোঁপানি গোপন করতে সরে গেলো।

মহিম সরকার তার গোরুর গাড়ির বহর নিয়ে এসেছিলো। একদিন একরাত রামচন্দ্র তার বেহাইকে সপরিবারে ধরে রাখলো। দ্বিতীয় দিন সকালে গাড়ির বহর নিয়ে মহিম সরকার রওনা হলো। ভাৰ্মতি কাঁদলো, সনকার চোখে জল এলো, রামচন্দ্র তার হুঁকো হাতে ঘর-বার করলো। কথাটাও গোপন রইলো না। তার পাড়ার লোকরা বলাবলি করলো, নতুন নবাব এসেই মহিম সরকারকে তাড়িয়েছে।

এরপর রামচন্দ্র সঠিক সংবাদ সংগ্রহের চেষ্টায় ছুটোছুটি শুরু করলো। একটি বিষয়ে সে কৃতনিশ্চয় হয়েছে : এদিকে এক রাজা আর ওদিকে এক নবাব। দেশ ভাগ হয়েছে। দুই নাম হয়েছে, একই ফলের দুটি টুকরোর।

একজন বললো একদিন, শুনছেন, মণ্ডল, হাজির বেটা ছমির খোনকার রায়দের ভিটা দখল নিছে?

কেন, তা নেয় কেন? রামচন্দ্র আশ্চর্য হয়ে গেলো। এটাই কি এখন থেকে কী ঘটবে তার উদাহরণ? কে দিলো তাকে দখল?

কিন্তু ঠিক কোথায় কতদূরে সেই রাজসিক সীমারেখা, খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আর তাকেও কি দেশ ছেড়ে যেতে হবে? ইতিমধ্যে অনেক দেরি করে ফেলেছে সে। যে-অবস্থায় সে বসেছিলো তেমনি অবস্থাতেই সে ছুটলো সান্যাল-কাছারির দিকে। ইতিমধ্যে দু-একজন প্রতিবেশী বলেছে বটে, গড়-চিকন্দিতে সান্যালরাই রাজা থাকবে। এখানে কোনো নবাবের অনুপ্রবেশ হবে না। তাহলেও বিষয়টি নির্ণীত হওয়া প্রয়োজন।

রামচন্দ্র কাছারিতে প্রবেশ করলো দুঃসময়ে। কাছারির অর্ধেক দরজা বন্ধ। সান্যালমশাইয়ের। খাস কামরার দরজায় মস্তবড়ো একটা তালা ঝুলছে। কাছারিতে দাঁড়িয়ে অন্দরমহলের দোতলার যে জানালাগুলি চোখে পড়ে সেগুলিও বন্ধ। দুপুরের মতো তাজা রোদে এটা ঘুমের দৃশ্য হতে পারে না। এতক্ষণে অন্তত একজন বরকন্দাজেরও দেখা পাওয়া উচিত ছিলো। বরকন্দাজ এলো না। আমলারা কোথায়? প্রজারা? সব শুসান্ দিগরের গোরস্থান!নায়েব নিজেই বেরিয়ে এলো কাছারির একটি ঘর থেকে। নায়েবের হাতে হুঁকো, সে যেন বার্ধক্যে নুয়ে পড়েছে। রামচন্দ্রর। মনে হলো মুঙ্‌লা নায়েবের সঙ্গে যে কলহ করেছে সেটা মিটিয়ে ফেলা উচিত, কিন্তু এই পরিস্থিতিতে সেটাকে মূল্যহীন বোধ হলো।

নায়েব বললো, তুমিও বুঝি সেই খবরটাই চাও? অনেকেই জিজ্ঞাসা করেছে।

কী খবর?

খবরটা সত্যি। কর্তা আর গিন্নি চলে গেছেন দেশভ্রমণে।

রামচন্দ্র এত বড়ো নির্দয় সংবাদ আশা করেনি। অভিভূতের মতো সে বললো, ছাওয়ালরা?

তার আগেই গেছে। দেশ ভাগের কথা শুনলে, রামচন্দ্র?

রামচন্দ্রর মনে হলো দুঃস্বপ্নের মধ্যে কেউ তার বুকে চেপে বসেছে।

কিছুক্ষণ পরে নায়েব বললো, চৌহুদ্দিটা ঠিক কী হলো বুঝতে পারছি না।

রামচন্দ্র অর্থহীন ভাবে ‘আজ্ঞা’ শব্দটা উচ্চারণ করে উঠে দাঁড়ালো। চৈতন্য সাহা, মিহির সান্যাল কিংবা রেবতী চক্রবর্তীর কাছে সে নিজে থেকে কখনো যায় না। কিন্তু এই দুঃসময়ে প্রত্যেকের সাহায্য অন্য সকলের দরকার হয়ে পড়তে পারে।

রেবতী চক্রবর্তী গিয়েছে তার মেয়ের বাড়িতে, কৃষ্ণনগরে, সপরিবারেই। মিহির সান্যাল আপাতত সদরে বাসা ভাড়া করে আছে, সেখানে কালেকটারের অফিস কাছে, হিন্দুদের সংখ্যার কিছু জোর আছে। অবাক হয়ে গেলো রামচন্দ্র–এসব কী কথা?

রামচন্দ্র লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটতে লাগলো। অভ্যস্ত মুদ্রাদোষের ফলে তার একখানা হাত বারংবার গোঁফটাকে স্পর্শ করছে যদিও শূন্য আকাশের দিকে লক্ষ্য করতে গিয়ে তার মুখখানা কাঁদো কাঁদো হয়ে গেলো। এ কী হলো, কও?

কথাটা আকস্মিকভাবে একটা যুক্তির আকার নিয়ে মনে ফিরে এলো তার।কাঁচা কাজ কখনো সে করেনি। তার জমির প্রতিটি হাত, প্রতিটি আঙুল কাগজে লেখা, রেজিস্ট্রি করা। তার কি কিছুই মূল্য নেই?

পথে চলতে চলতে তার মনে হলো, এর আগে এদেশে নবাবের রাজত্ব ছিলো, তখন কি মানুষ চাষবাস করে নাই?

কী হবি, কও। কী হবি, অ্যাঁ?

.

ভক্ত কামার চলে যাওয়ার সময়ে যেমন হয়েছিলো তেমনি করে প্রতিবেশীরা আবার আসতে শুরু করলো তার কাছে।

কও, রামদাদা, কিসের লোভে তুমি থাকবা?

লোভে, না?

একদিন খবর এলো মহিম সরকারের এক জ্ঞাতির মুখে।

মুঙ্‌লার শশুরের জমি গেছে অন্যের দখলে। দেখছে না কারা দখলে নিছে?

হুঁ।

সানিকদিয়ারের সনাভূঁইয়ের জমি তোমার গিছে ধরে রাখবের পারো।

হুঁ।

তোমার বাড়ির দশ হাতের মধ্যে নবাবের সীমানা।

জানছি। আর কত কবা তোমরা, কও ভাই? আর্তনাদ করে উঠলো রামচন্দ্র।

কী করা?

রামচন্দ্র বাক্‌পটু নয়। সে উঠে গিয়ে লোকটির মুখের সম্মুখে দরজা বন্ধ করে দিলো।

বন্ধ দরজার এপারে দরজায় হাত রেখে দাঁড়িয়ে তার অত বড় শরীরটা থরথর করে কেঁপে উঠলো। আশ্চর্য! চিকন্দিও কি থাকবে না তবে?

রাত্রিতে সনকাকে সে বললো, সব গিছে তোমার। পাঁচ বিঘে ছুঁই আছে চিকন্দির।

ফিরে আসার পরে একমাসের মধ্যে রামচন্দ্র এই প্রথম তার সঙ্গে জনান্তিকে কথা বললো। অথচ নবদ্বীপে থাকার সময়ে এমন সব রাত্রিগুলি কত কথায় রামচন্দ্র পূর্ণ করে দিতো।

তুমি যে কইছিলে নবদ্বীপে একটুক জমি পাবা?

সব যাতেছে তবু তোমার ভয় নাই! রস করো?

সনকা বললো, ভয় করবের শিখাও নাই।

সনকার কথাটা মনের মধ্যে সঞ্চারিত হলে রামচন্দ্র ঘন ঘন নিশ্বাস নিতে লাগলো। সঘন নিশ্বাস নেওয়ার কথা সে শুনেছে কেষ্টদাসের মহাভারত পাঠের সময়ে। কী করবে সে, আবার সেই পাঁচ বিঘা থেকে জীবন আরম্ভ করবে?

সে ভাবতে চেষ্টা করলো। গত বছরের দাঙ্গায় দাদপুরী রাবণ আর অগ্নিকুমার, বিলমহলী এরশাদ আর লাবেন, এদিকের মুকুন্দ আর ওদিকের জয়নাল খেতে লাঙল জুড়ে নবাবদের দাঙ্গা তাড়িয়েছিলো। তেমন বর্ষা কি নামবে না? হা-হা, বর্ষা!

বাইরের দরজা বন্ধ করে সে নিজের বাড়ির ভিতরে চোখ ফিরিয়ে আনলো।

আর্থিক স্বাধীনতা মানুষের চিন্তাধারায় পরিবর্তন আনবে এটা স্বাভাবিক। মুঙ্‌লার ব্যবহারে সেরকম কিছু দৃষ্টিকটু হয়ে দেখা না দিলেও তার কিছু আছে তাও অস্বীকার করা যায় না।

রামচন্দ্র বললো, কোনদিকে আগাই, তা ক, মুঙ্‌লা।

একটু ইতস্তত করে মুঙ্‌লা বললো, শ্বশুর লিখছে–

কী লিখছে, কবে লিখছে?

কইছে বদ্ধোমানে জমি নিছে। কইছে সকলেক সেখানে যাতি।

ভান্‌মতিকে নিয়ে যাবা?

গেলে তাই লাগে।কইছে আমার এখানকার জমির বলা দশ বিঘা জমি পাইছেবদ্বোমানে। এক মোসলমান এখানে আসবি। আপনেকেও লেখছে চিঠি। মুঙ্‌লা কোমরের কাপড় থেকে একখানা চিঠি বার করে দিলো।

রামচন্দ্র চিঠিটা নিলো, অভিমানভরে বললো, যাও তবে।

মুঙ্‌লা কার্যান্তরে গেলে রামচন্দ্র গোয়ালঘরে কাছে গেলে। ভাগ্যে সে কোনোদিনই চিঠি পড়তে শেখেনি। এ কি আর বানান করে ছাপার অক্ষরে মহাভারত পড়ার চেষ্টা? অবাক হয়ে সে দেখলো বলদগুলি ও গাভীটির মুখের কাছে ঘাস নেই। গাভীটি রামচন্দ্রর দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য গভীর সুরে একটা চাপা শব্দ করলো। কিছু খড় পেড়ে বলদগুলি এবং গাভীটার সম্মুখে দিয়ে রামচন্দ্র লাঙলগুলির খোঁজ করলো। পাশাপাশি দুখানা থাকবার কথা। রামচন্দ্র লক্ষ্য করে দেখলো একখানার লোহার রং তখনো ওঠেনি, অপরখানায় মরচে ধরেছে। তখন তখনই এক টুকরো হঁট খুঁজে নিয়ে লাঙলের ফলা দুটি এক এক করে ঘষতে বসে গেলো। আধ ঘণ্টা চেষ্টার পর সে যখন উঠে দাঁড়ালো ফলাগুলি তখন অনেকটা উজ্জ্বল হয়েছে, কিন্তু দীর্ঘকাল ধরে মাটির ঘর্ষণে যেমন রুপোয় পরিবর্তিত হওয়ার মতো ব্যাপারটা হয় তেমনটা অবশ্যই হলো না।

মুঙ্‌লার মন বন্ধোমানে গেছে এই তিক্ত চিন্তাটিকে গলাধঃকরণ করার মতো মুখ নিয়ে সে বাড়ির ভিতরে এসে বললো, ভানুমতি, তোমরা চাষবাস করো নাই, না?

সনকা বেরিয়ে এসে বললো, ভানু কি বলবি? ছাওয়ালেক জিজ্ঞাসা করো।

রামচন্দ্র কাচুমাচু মুখ করে তামাক সাজতে বসলো।

সারাদিন ছটফট করে বেড়ালো সে, সারাটা রাত জেগে কাটালো।

পরদিন সকালে, সকাল তখনো হয়নি, কিছু রাত আছে, রামচন্দ্র হাঁক দিলো, মুঙ্‌লা, মুঙ্‌লা!

হাঁকাহাঁকি শুনে সনকা ভীতস্বরে বললো, কী হইছে?

কনে তোমার ছাওয়াল? রামচন্দ্র গর্জন করে উঠলো।

ঘুমায়। কী করবি? কাম কই?

কী করবি, না? কাম নাই, না?

মুঙ্‌লা চোখ ডলতে ডলতে উঠে এলো।

তুমি আমার জামাই, না ছাওয়াল?

তিরস্কারে মুঙ্‌লার মুখ বিবর্ণ হয়ে গেলো।

লাঙল জোড়ো। দুই লাঙল চাই।নবাবের দেশে চাষ পড়ে, তোমাগের দেশে চাষ হবিনে? কে? সময় যায়, না আসে?

কিন্তু গভীরতর কিছু অপেক্ষা করছিলো রামচন্দ্রর জন্য।

আগের দিন দু-এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। ভোররাতে মাটিতে পা দিয়ে রামচন্দ্র বললো, মুঙ্‌লাক তুলে দেও।

সনকা বললো, অনেক রাতে আসছে।

কে, কোথায় গিছিলো?

সনকা কিছু বললো না। রামচন্দ্র বাড়ির দিকের দাওয়ায় পা দিয়ে দেখলো প্রায়-অন্ধকার বারান্দায় কে একজন শুয়ে আছে।

কে?

ভানুমতি ধড়মড় করে উঠে দাঁড়িয়ে ঘরে চলে গেলো।

রামচন্দ্রর খটকা লাগলো। কুয়োতলায় হাত-মুখ ধুতে ধুতে সে প্রশ্ন করলো সনকাকে, বউ বাইরে কে?

মনে হলো সনকা কিছু বলবে কিন্তু এবারেও সে কিছু না বলে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো।

রামচন্দ্র ক্ষিপ্তর মতো গর্জন করে উঠলো, কে, এটা কার বাড়ি? এ কোথায় আলাম?

সনকা বিপদ বুঝে ফিরে এলো। রামচন্দ্রর এরকম ক্রোধ সে এর আগে দেখেছে বলে মনে করতে পারলো না। স্বরটা যথাসম্ভব নিচু করে সে বললো, এখন যদি জমিতে যাবা যাও। পরে সব কবো।

নবদ্বীপ থেকে ফিরে এসে সনকা লক্ষ্য করেছিলো ভান্‌মতি যেন আগের তুলনায় বিষণ্ণ। সে স্থির করেছিলো জমিজমাসংক্রান্ত এবং সাংসারিক ব্যাপার, তার পিতৃবংশের আকস্মিক দুর্ভাগ্য, এ সবই তার বেদনার কারণ। আজ সকালের মতো ব্যাপার এর আগেও তার চোখে পড়েছে। ঘটনার কারণটা অনুসন্ধান করা দরকার এ তারও মনে হয়েছিলো। কিন্তু খুব সম্ভব এটা স্বামী-স্ত্রীর কোনো মান অভিমানের ব্যাপার এবং সে ক্ষেত্রে বাইরে থেকে খুব বেশি খোঁজ না নেওয়াই মঙ্গলের হবে কিনা এটাই চিন্তা করছিলো সে।

কিন্তু রামচন্দ্রকে উত্তর দিতে হবে। সনকা অবসর বুঝে ভান্‌মতিকে প্রশ্ন করলো। ভানুমতি প্রথমে স্তব্ধ হয়ে রইলো, তার পরে কাঁদলো। তারপর তার অন্তর্নিহিত বেদনাটা প্রকাশ করে ফেলো। চিঠিতে লিখেও যা সে কেটে দিয়েছিলো, এখন তা আর গোপন রইলো না।

রাত্রিতে সনকা ভান্‌মতির আশঙ্কা ও অভিমানের কথা বললো রামচন্দ্রকে। শুনে তার মনে হলো, ঘটেছে, এতদিনে চূড়ান্তটা ঘটেছে, সপ্তরথী ঘিরেছে তাকে। অহহ! ভগোমান! অহহ!

পর পর তিন-চারদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়ালো সে। যেন সে একটা সমাধানের অন্বেষণ ও পশ্চাদ্ধাবন করছে। অন্তরের আত্যন্তিক জ্বালাটাকে ভান্‌মতি ও সনকার চোখের আড়ালে রাখবার চেষ্টায় বাড়িতে সে সহিষ্ণুতার পাহাড়ের মতো হয়ে রইলো। তারপর আকস্মিকভাবে একদিন সে অশ্রুপাত করার জন্য নির্জনতা খুঁজে বার করলো। শিবমন্দিরের সেই ভগ্নাবশেষে গিয়ে নিঃসঙ্গ দীর্ঘকাল বসে রইলো। তারপর একসময়ে মন্দিরের বাঁধানো চত্বরটায় লুটিয়ে লুটিয়ে কাঁদলো। এ কান্না তার জীবনে অপরিহার্য হয়ে উঠেছিলো। আজকের সূত্রপাতটার জন্যই যেন সে অপেক্ষায় ছিলো। সকালে সে তার বাড়ির সীমায় দাঁড়িয়ে দেখতে পেয়েছে, নবাবের এলাকায় কে একজন তার সনাঊয়ের জমিটুকুতে চাষ দিচ্ছে। এরকমটা হবে সে কল্পনা করেছিলো কিন্তু তাসত্ত্বেও দৃশ্যটা চোখে পড়ামাত্র পুরনো দিন তার অন্তরে গর্জন করে উঠতেই সে অন্যায়কারীর দিকে ছুটে যাচ্ছিলো। কিন্তু সে শুকনো জোলার খাত পার হতে যাবে এমন সময়ে একজন প্রতিবেশীকে সাবধান করে দিলো–ওটানবাবের এলাকা। চাঁদকে চোখে দেখতে পেলেও সেখানে যাওয়ার কল্পনা করা যায় না, প্রিয়তমার মৃতদেহ চোখের সম্মুখে দেখেও যেমন আর কিছুই করার থাকে না তেমনি হয়েছিলো রামচন্দ্রর।

উঠেবসে গায়ের ধুলো ঝেড়ে চোখের জলে ভিজে যাওয়া গোঁফজোড়াকাপড়ে মুছেকিছুটা শান্ত হলো রামচন্দ্র। এ কী হলো পৃথিবীর! মানুষের এত কষ্ট কেন? কোনো কোনো রোগে রক্তমোণ করা নিয়ম ছিলো সেকালে। এ যেন তেমনি কোনো চিকিৎসা। কিন্তু রামচন্দ্র গোরর চিকিৎসা জানলেও নিজে কখনো কোনো পশুর রক্তমোণ করেনি। এ যেন কোনো অত্যন্ত খুঁতখুঁতে কৃষকের বোয়ার বেছন বাছাইকরা। মাটি থেকে শিকড়সুদ্ধ চারাগাছগুলিকে টেনে টেনে তুলছে। কিন্তু সে কৃষক যেন সাধারণ কৃষকের চাইতে কম জানে কিংবা অত্যন্ত বেশি জানে। চারাগুলিকে বারে বারে তুলছে আর লাগাচ্ছে, আর লাগানোর আগে চারাগুলির কোমলতম শিকড়ে যে মাটিটুকু লেগে থাকে আছড়ে আছড়ে সেটুকুও ঝেড়ে ফেলেছে। অহহ। একবার না, তিনবার। সেই দুর্ভিক্ষ, তারপর দাঙ্গা, তারপর এই দেশভাগ।

ছিদামের কথা মনে পড়লো। ছিদাম, ছিদাম। অহো, অহো। মানুষ যদি চারা হয় এমন চারা আর কে? কিন্তু তাকে আর একরকম! বছনে ফেলে ছিঁড়েই ফেলো। রামচন্দ্র এই জায়গায় ধর্ম ও সমাজবিধান নিয়ে মনে মনে আলোচনা করলো যদিও কোনো গূঢ় তত্ত্বের কাছাকাছি যেতে সে পারলো না, তার মনে হলো ছিদামকে আলিঙ্গন করে বুকে নেওয়ার মতো সমাজ হলে ভালো হতো। তারপর তার মনে হলো বুধেডাঙার সান্দারপাড়ায় জন্মালে ছিদাম কত সুখী হতে পারতো। কিন্তু তার নিজের বর্তমান সমাজব্যবস্থার সঙ্গে সর্বপ্রকারে বিধিমুক্ত সান্দার-সমাজের তুলনাটা মনে আসতেই তার মনটা গুটিয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পরে সে সমাজকে ছেড়ে ব্যক্তিকে অবলম্বন করলো। সমাজে যা হয় তোক। ছিদাম কেন সুখী হতে পারলো না। ছিদামকে যে এই সমাজে পাঠালো তার কাছে কি এই সমাজের লোহার বাঁধন অজ্ঞাত ছিলো? হায়, হায়! সে কি লোহা যে আগুনে তাতানো লোহার বেড় তার গায়ে পরালে সে বেড়টাকে নিজের করে নিয়ে আরও শক্ত হবে?

একটা হিংসা তার মনের মধ্যে জাগতে শুরু করলো। তার ভূত-ভবিষ্যৎ ব্যাপ্ত করে সহস্র বাধা। সেই বাধাগুলিকে ধ্বংস করার জন্য একটা হিংস্রতা মনের মধ্যে গুঁড়ি মেরে চলতে লাগলো। চতুর্দিকের ঘনসন্নিবিষ্ট অরাজকতার অরণ্যে একক চলতে হবে তাকে। সান্যালমশাইরাও নেই। একা থাকতে হবে। একা যেন তাকে কোনো গড় রক্ষা করতে রেখে গেছে কেউ।

সপ্তাহকাল পরে এক দুপুরবেলায় হাতে একটা প্রকাণ্ড লাঠি নিয়ে রামচন্দ্ৰনতুন ঘরটির কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।’পদ্ম আছো?

পদ্ম ঘরেই ছিলো, বেরিয়ে এসে রামচন্দ্রর দিকে এগিয়ে এলো। রামচন্দ্র লক্ষ্য করলো পদ্মর স্নান শেষ হয়েছে, চুলগুলি চূড়া করে বাঁধা, পানের রসে ঠোঁট দুটি টুকটুক করছে। পরনের ডুরি শাড়িটা একেবারে নতুন বলে মনে হয়। আর তার চোখ দুটি দেখে রামচন্দ্রর মনে হলো, যেন সে কাজলও পরেছে।

রামচন্দ্র অনুভব করলো এইবার লাঠিটা শক্ত করে ধরা দরকার। কিন্তু পদ্ম তো সত্যি সাপ নয়। সে এগিয়ে এসে নিচু হয়ে রামচন্দ্রকে প্রণাম করলো। প্রণাম করার সময়ে অনেকটা সময় পদ্মর দুখানি হাত যেন রামচন্দ্রর ধূলিভরা কর্কশ পা দুখানি স্পর্শ করে রইলো।

রামচন্দ্র বললো, তোমার সাথে কথা আছে, কন্যে।

বসেন।

তা বসি। রামচন্দ্র ঘরের দাওয়ায় উঠে বসে বললো, মুঙ্‌লা আসে?

আসে।

তার বাড়িতে বউ আছে।

তা জানি তো।

এ কি ন্যায্য হতিছে তোমার?

কী অন্যাই? আমাক সকলেই তাড়াবি?

রামচন্দ্রর ক্রোধ উদ্বেল হয়ে উঠলো, কিন্তু স্ত্রীলোক যে। সে জোড়হাতে পদ্মর হাত ধরে অভারাক্রান্ত গলায় বললো, রাক্ষুসি, আমার এক ছাওয়ালেক খাইছো, আর একটাক ফিরায়ে দেও।

পদ্ম ফিক করে হাসলো।

তুমি হাসো? তুমি হাসো!

ভয় পান কে? এই বললো পদ্ম, কিন্তু তার হাসি হাসি মুখ যেন অপমানে কালো হয়ে উঠলো।

পরাজিত রামচন্দ্র উঠে দাঁড়ালো। মনের উপরে জোর চলে না। একবার জবরদস্তি করতে গিয়ে ছিদামের ওই দশা হলো। হে ভগোমান। ধনবল জনবল কিছুই কি আর অবশিষ্ট থাকবে না?

পদ্ম বললো, বসেন, আপনেক একটা সত্যি কথা কবো। মুঙ্‌লা এখনো ঠিক আছে। তবে তার মনের কথা আমি জানিনে। পদ্মর চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়তে লাগলো।

পদ্মকে সে অবিশ্বাস করেনি। ভান্‌মতির প্রতি মুঙ্‌লা যদি অবহেলা দেখিয়েও থাকে এখন তার সুখশান্তির পথে হয়তো চিরকালের জন্য কাটা পড়েনি। রামচন্দ্র কথাগুলিকে ওজন করে দেখার জন্য সময় নিতে লাগলো। একদিন চিন্তা করতে করতে তার স্মরণ হলো, একসময়ে একান্তে পদ্ম তাকে একটি অবিশ্বাস্য এবং অপূর্ব কথা বলেছিলো। এটা তার চিন্তাকে নতুন খাতে প্রবাহিত করলো।

সেদিন পূর্ণিমা নয়, এমনকী কোনো বিশেষ তিথি পর্যন্ত নয়। রামচন্দ্র আবার পদ্মর বাড়িতে গেলো। কন্যে আছো?

আছি।

পদ্ম।

কন্।

পদ্ম, তুমি বিয়ে করবা?

না।

রামচন্দ্র আবার চিন্তা করলো।

তোমাক এ গাঁ ছাড়তে হবিনে। এখানে আসো, আমার কাছে আসে বসো, মনের কথা কও।

পদ্ম ঘরের খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে রইলো।

কই, আসো।

পদ্ম রামচন্দ্রর সম্মুখে এসে বসলো।

রামচন্দ্র বললো, পদ্ম, এখন থিকে লোকে জানুক তুমি রামচন্দ্র মণ্ডলের।

পদ্ম কথা বললো না, তার সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো।

রামচন্দ্র বললো, আর একখান ঘর তোলবো আমার বাড়িতে। তখন তোমাক নিয়ে যাবো। গাঁয়ের লোক-সকলেক ভোজ দিয়ে জানায়ে দিবো।

পদ্ম কাঁদতে লাগলো।

দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে রামচন্দ্র বললো, আর এক কথা। রঙিন কাপড় পরবা না। আর চুল কাটে ফেলবা। আর পান–তা পান খাতে পারো। আচ্ছা, চুলও রাখো। আর সন্ধের পর কখনো দেখা করবা না।

ঘটনাটা ঘটিয়ে দেওয়ার পর রামচন্দ্র অনুভব করলো এক কঠিন দুশ্চর পথ ধরে সে রওনা হয়েছে। যত সহজে কথাটা রাষ্ট্র করে দেওয়া যাবে ভেবেছিলো সে তত সহজ নয় বিষয়টি। এ নিয়ে আর যাই করা যাক উৎসব করা যায় না।

সনকাকেও বলা যায়নি, অথচ তাকেই তো সর্বাগ্রে সব কথা বলা দরকার।

প্রায় একমাস হয়ে গেছে। সেদিনের সেই একান্ত অদ্ভুত প্রস্তাবের পর রামচন্দ্রর সঙ্গে পদ্মর একটিবার মাত্র দেখা হয়েছে। সেদিন হাটবার। রামচন্দ্র হাটে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে এমন সময়ে একটি ছোটো ছেলে এসে তাকে বললো, পদ্ম নাকি তাকে ডেকেছে। . রামচন্দ্র যাবো কি যাবো না করতে করতে অবশেষে পদ্মর কুটিরে গিয়েছিলো। এবং একটি অনাস্বাদিতপূর্ব করুণ মাধুর্যে তার অন্তর সিক্ত হয়ে রইলো সমস্তটা পথ।

পদ্ম বললো, আমি হাটে গেলি কি রাগ করেন?

না। আমিই যাবো।

তাহলে আমার ভাড়ার দেখে যান কী কী লাগবে।

আচ্ছা, আচ্ছা, দেখবের হবি নে।

পদ্ম তার চুলগুলি কেটে ফেলেছে। অবশিষ্ট চুলগুলি থলো থলো হয়ে কাধ পর্যন্ত ঝুলছে। পরনে শাদা থান জোটেনি কিন্তু শারির পাড় ছিঁড়ে ফেলেছে।

রামচন্দ্র বললো, সন্ধ্যার পর সওদা দিয়ে যাবনে।

পদ্ম কেঁপে উঠলো।

রামচন্দ্র জিজ্ঞাসা করলো, কী হলে?

কিছু না। ছাওয়ালেক দিয়ে পাঠায়ে দিবেন সওদা। আর কাল দুই পরে ভানুমতিকে একবার পাঠায়েন ছাওয়ালের সঙ্গে।

তা দিবো।

রামচন্দ্র ভাবলো, জনবলকে সে ক্ষয় থেকে রক্ষা করেছে, কিন্তু সে নিজে কি সবদিক রক্ষা করে চলতে পারবে? বৃষ্টি নামে কই? আকাশ ফাটে বৃষ্টি নামে কই? হা-হা!

.

কয়েকদিনহলোবর্ষা নেমেছে। জলদিবা থামেভিজে ভিজে বাতাস চলতে থাকে। রামচন্দ্র জানে কাছে কোথাও ‘সাইকোলোন’ হলে এদিকে এমনটা হয়। বর্ষার জলে ভিজে এবার তার শরীরটাও খারাপ করেছে। সে নাকি একবার কোন মাঠে জলবৃষ্টির সোহগে শুয়ে থেকেছিল। একদিন একরাত। বয়স বেড়েছে সন্দেহ কী!

রামচন্দ্র তার ঘরে একটা মাদুরে শুয়ে খোলা দরজা দিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে ছিলো। তার বাড়ির চৌহদ্দি নির্ণয় করার বড়ো আমড়াগাছটার কচি কচি নরম পাতায় তখনো বৃষ্টির জল দেখা যাচ্ছে। জল থেমেছে কিন্তু পাখপাখালিরা পাতার আড়ালে ঝুটোপুটি করে খেলা করলে যেমন দেখা যায় তেমনি মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে।কাঠবিড়ালিওনয়, পাখিওনয়। ছোটো ছোটো টুকরো বাতাসেই এমনটা করছে। রামচন্দ্রর দৃষ্টি অতঃপর মাটিতে পড়লো। তার বাড়ির সম্মুখে যে জমিটা, তার উপরে জলজমেছে। বিঘৎপরিমাণ হবে সেজল গভীরতায়, কিন্তু চেয়ে থাকতে থাকতে মনে হয়, বন্যার জল। তা বন্যাও হতে পারে।

রামচন্দ্র চিন্তা করলো। অনেকদিন পরে সে আবার তার নিজের মনের সাক্ষাৎ পেয়েছে। নবদ্বীপে যাওয়ার আগে সেকখনোই বুঝতে পারেনি এমন করে নিজের মনকে লক্ষ্য করা যায়।

ইতিমধ্যে রামচন্দ্র এক উপাখ্যান সৃষ্টি করেছিলো। দেশ ভাগ হওয়ার কথা শুনেই সনকা আবার প্রস্তাব তুলেছিলো নবদ্বীপে যাওয়ার। তাকে নিরস্ত করার জন্য কিছুটা মিথ্যা, খানিকটা সরস, কিছু বা নিজের কিংকর্তব্যমূঢ়তা মিলিয়ে সে বলেছিল, বুঝলা না, বউ, ধরো যে তোমার মহাভারতে ক্ষত্রিয়র ধম্ম লেখা আছে, ব্রাহ্মণের ধম্ম লেখা আছে, কিন্তু আমার ধম্ম। কই লিখছে? তাইলে আমি চাষই করবো।

এখন সে কথাটা তার মনে পড়লো। কিছুক্ষণ কৌতুকবোধটা অনুভব করে পরে সে, স্বগতোক্তি করলো–এ জীবনে ধম্ম করা হবি নে। ভগে!মানের ইচ্ছা না।নইলে ফের সেই নতুন করে জীবন আরাম্ভন। এই দ্যাখো কী ব্যাপার! আমরা তো রোপা-ধান একবার ক্ষেত থেকে তুলে আর এক ক্ষেতে বসাই। তুমি তিনবার করলা, কে, ভগোমান?

রামচন্দ্র পাশ ফিরলো কিন্তু আত্মগত চিন্তার জের টেনে চললোধম্ম তুমি চাও না বুঝছি। আচ্ছা, তাতে আমি চটি না। তুমি পদ্মর ব্যাপারে কিন্তু আমাকে কঠিন পরীক্ষায় ফেলায়ো না। সনকা কাঁদবি, তা যেন হয় না। ধম্ম আমি চাই না, যদি না দিবা। কিন্তুক সজ্ঞানে যে যাই। মুঙ্‌লাক, পরের ছাওয়ালেক ভালোবাসে অন্যাই করছি? আমি তো চুরি করি নাই তাক।

একদিন এমন হবি। পেরথম বর্ষার ঢল মারতি মারতি খেতে যখন এক হাত পেরমান জল, মুঙ্‌লা আসে কবি বাবা ওঠো, আজ ক্ষেতে যাতে হবি। না গেলিই না। ততদিনে মুঙ্‌লা কাজ শিখছে, কাজেই তাক ফাঁকি দেওয়া যাবি নে।কবের হবি, শরীলটা বেজুত, কাল সকালে যাব, একদিনে আর কী হবি। কাউকে জানা নাই। ভান্‌মতি আর মুঙ্‌লা যখন বাদলার ভরে বেলা টের না পায়ে উঠি কি না-উঠি করতিছে সুখশয়ান ছাড়ে, তখন সনকাকে ডাকে কবো-আমি চলোম, বউ। যাওয়ার আগে তোমাক কয়বার ‘সুনু’ কয়ে ডাকি। মুক্ত বিহঙ্গের মতো আত্মার যাওয়া-আসা-কেষ্টদাস কইছে। পথে যাতি যাতি পদ্মর সঙ্গে একবার দেখা করবের হবি? তারপরও কি খেতের চারিদিকে কয়েক পাক উড়বি তার আত্মা?

জ্বরের ঘোর ও তার ভাবটা কাটলে ঈষৎআরক্ত চোখ মেলে দেখলোরামচন্দ্র, তার শিয়রে বসে সনকা।

রামচন্দ্র বললো, ভান্‌মতি কই? তার মনে হয়েছিলো পদ্মর গলার রুপোর চিকটা যেন ভানুমতি পরেছে। ভানুমতিদের সে কি বন্দোমানেই যেতে বলবে?

জল খাবের চালে, খাবা? সনকা বললো।

না। জ্বর বেশি আসছে, না? রামচন্দ্র হাসলো।

এমন সময়ে মুঙ্‌লা ঘরে এলো। তার সর্বাঙ্গ কর্দমাক্ত।

বাবা, ক্ষেতে জল হইছে পেরায় এক হাত। আটকায়ে রাখবো, না কমায়ে দেই বুলি না। ওদিকে পদ্মাও নাকি কাপতিছে।, না দেখে কতে পারি নে। কাল দেখবো। রামচন্দ্র হাসলো।’কেন, সে আবার ফোপায় কে? স্বপ্নের কথাটা মনে পড়লো তার। কিছুক্ষণ বাদেই সে শুনতে পেলো মুঙ্‌লা ও ভান্‌মতি কী একটা ব্যাপার নিয়ে হাসাহাসি করছে। আনন্দ বোধ হলো তার।

সে বললো, সুনু, কথাখান্ গায়ে জড়ায়ে দেও।

মুঙ্‌লারা হাসাহাসি করছিলো না, বন্যার ব্যাপার নিয়ে যেসব কথা হচ্ছিলো গ্রামে তা নিয়ে। আলোচনা করছিলো। বিপদ নিশ্চয়ই, তাহলেও অভিনবত্ব যেন বিপদটার প্রতি উৎসুক করেছে। কলাগাছের ভেলাবাঁধতে হবে, মাছ ধরবার জন্য একটা জালও চাই, যদিও সেটা হয়তো প্রলয়ের কালো জল।

.

সুরতুন গহরজান সান্দারের বাড়িতে গিয়েছিলোতার বুড়িবিবিকে অনুনয়-বিনয় করতে। বুড়ি রাজী হয়েছে তার অভিজ্ঞতা দিয়ে ফতেমাকে সাহায্য করতে। ফতেমা আসন্নপ্রসবা।

বুধেডাঙার পথে কোথাও কোথাও একহাঁটু জল। মাথার উপরে জলভরা আকাশ। পদ্মার দিকে তাকিয়ে ভয় করে। দিগন্তের পরিধি অত্যন্ত সংকুচিত। দিনদুপুরে সন্ধ্যার পূর্বাবস্থা।

ঘরে আহার্য নেই, চাল বেয়ে হু-হু করে জল পড়ে। যেভাবে বৃষ্টির জল জমে যাচ্ছে তাদের বাড়ির উঠোনে হয়তোবা বিকেল নাগাদ উঁচু ঘরটাতেও জল উঠবে। আর সেই ঘরে বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে ফতেমা। বৃষ্টির জল এবার কেন সহসা এত বেশি হলো এ বলা শক্ত। এমন জল থাকলে গরজানের বুড়ি বিবি কী করে আসবে? সুরতুনের নিজেরই চলতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু তার কষ্টর চাইতে ফতেমার কষ্ট শতগুণ বেশি। ফতেমার মতো সাহসী এবং সহিষ্ণু মেয়ে ভয়ে যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।

তবে একটা কথা এই, ভাবলো সুরতুন, সব অগাধ জলে মানুষের বুদ্ধি থৈ পায় না। ফতেমার কী দোষ যদি সে নিজে ইচ্ছা করে এই কষ্টে জড়িয়ে পড়ে থাকে। সে নিজেও কী করে জড়িয়ে পড়লো এই সংসারে, তার উত্তর নেই। ইয়াজ, কোথাকার কে? সে এসে কাধ পেতে দিলো। আর যেন তার দেখাদেখি সুরতুন নিজেও এই সংসারের নৌকা ঠেলার জন্য কাদায় নেমে দাঁড়িয়েছে। লাভক্ষতির হিসাবে একে ব্যর্থশ্রম ছাড়া আর কী-ই বা বলা চলে?

ফতেমার কথাই বিচার করো। সব চাইতে শক্ত, সব চাইতে বুদ্ধিমান।কীকরলো সে? জেবু অলীক ভয়ে মুহ্যমান হয়ে পড়েছিলো, আর ফতেমা জেনেশুনে একী ঘটালো? এমন হতে পারে নাকি জেবুন্নিসার ভয়ই তাকে এ-পথের কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলো? একটা কথা সুরতুন শত চেষ্টাতেও বুঝতে পারবে না-ছাওয়াল-চাওয়া’কী করে ফতেমার জীবনের সঙ্গে যুক্ত হলো।  সে সন্তান চাইতো বলেই ফুলটুসির ছেলেদের নিয়ে আতিশয্য করতে কিংবা তাদের সঙ্গে নকল মায়ের অভিনয় করেই ছাওয়াল-চাওয়া’ জেগে উঠেছিলো তার?

ফতেমার মতো বুদ্ধিমতী মেয়ে যদি বুদ্ধিহীনার মতো ব্যবহার করতে পারে তবে পৃথিবীতে বুদ্ধিমতী কথাটাই নিরর্থক। বুদ্ধিমতী হলে সে নিজে কী করতো? মাধাইকে নেয়া তার পক্ষে বুদ্ধিমতীর কাজ হতে একথা শুধু ফতেমা বলে না, ইয়াজও একদিন বলেছিলো, এমনকী সে নিজেও ভেবে শিউরেছিল একদিন। মাঝখানের কয়েকটি দিন। তার দু পারে তার ও মাধাইয়ের জীবন পৃথকভাবে প্রবাহিত, বিস্তৃত। সে প্রবাহ কখনো কাছাকাছি এসেছে, কখনো দূরান্তরে সরে গেছে। শুধু সেই কয়েকটি দিনে জীবনের সম্মিলিত প্রবাহ কী অপূর্ব সব অনুভূতি সৃষ্টি করেছিলো। কিন্তু ভাগ্যে তখন ফতেমার মতো কোনো বোকামি সে করে বসেনি, নতুবা আজ বিপন্নতার কোন গভীরতায় তাকে নামতে হতো কে জানে।

সুরতুনের মনে হলো তার পায়ে চলার ছপছপ শব্দ ছাপিয়ে ফতেমার বেদনার্ত কান্না ভেসে আসছে।

মাধাইয়ের শেষ খবর এনে দিয়েছে ইয়াজ। মাথাই এখন আর পথে বেরোয় না। আধা মাইনার ছুটির পর এখন তার বিনি-মাইনার ছুটি চলছে। তাও নাকি আর মাত্র দু মাস চলবে। তারপর? রেল কোম্পানির ঘর ছেড়ে দিয়ে চাঁদমালার ভাটিসিদ্ধ করার উনুনের পাশে গিয়ে বসতে হবে। এসব কথা মাধাই-ই নাকি হাসিমুখে বলেছে। মাধাই নাকি একটা বাঁশি ফুকায় আর কাঁদে। সেটাই নাকি এখন তার একমাত্র কাজে দাঁড়িয়েছে। গাঁজা খায়। চাঁদমালা মদ নিয়েও আসে মাঝেমাঝে।

বর্ণনা করতে করতে দুটি বিষয়ের দিকে ইয়াজ সুরতুনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলো। সানাইয়ের বাজনা শুনে প্রাণ কেমন করে, আর তার পায়ের নোংরা ন্যাকড়া বাঁধা-ঘায়ে মাছি। ভনভন করে, সেদিকে চেয়ে ঘৃণায় গা শিউরে ওঠে।

শুনতে শুনতে সুরতুনের চোখের সম্মুখে চালের মোকামে দেখা একটি ভিক্ষুকের চেহারা ভেসে উঠেছিলো।দু পায়ের সব আঙুল খসে গেছে। নোংরা চট ও কাপড়ের ফালিতে পা দুখানা জড়িয়ে বাঁধা। প্ল্যাটফর্মে ঘষটে ঘষটে চলে, বিকৃত হাত দুখানা তুলে আঁউ-আঁউ করে যাত্রীদের কাছে ভিক্ষা চায়।

একটা বিমুখতায় সুরতুন শিউরে ওঠে।

জলে ডোবা একটি গর্তে পা পড়েছিলো সুরতুনের। পড়ে যেতে যেতে সে সামলে নিলো বটে কিন্তু ব্যথাও পেলো। বিরক্ত হয়ে সে ভাবলো-যে ছাওয়ালের বাপ নাই সে কি বাঁচে? ফতেমার কাছে যে আসছে সে কষ্ট পেতে এবং দিতে আসছে। কী বোক, কী বোকা!

বাড়িতে ফিরে উঠোনের একহাঁটু জল থেকে বড়ো ঘরটায় বারান্দায় উঠে দাঁড়িয়ে সুরতুন শুনতে পেলো ফতেমা কথা বলছে রজব আলির সঙ্গে।

কেমন আছে ভাবি? সে প্রশ্ন করলো।

এখন একটু ভালো। রজব আলি বললো, কেরাসিন একটুক আনা লাগবি। আন্ধার হলে দুই’পরে’।

সুরো বললো, কও, এমন চেহারা হলে দিনের, ভাবিক বাঁচান্‌ যাবি?

সুরতুন বারান্দায় দাঁড়িয়ে পথের দিকে চেয়ে ছিলো। দিঘার যে বড়ো সড়কটা আজকাল প্রায় পরিত্যক্ত,সহসা সুরতুনের মনেহলো তার উপরে হাট বসেছে। অবাক হয়ে সে দেখছিলো। অনেকটা সময় লক্ষ্য করে তার মনে হলো হাটটা যেন গতিশীল, সেটা এগিয়ে আসছে।

সুরতুন রজব আলিকে বললো, কিন্তু তার দৃষ্টিও সংকীর্ণ। সে দেখে কিছু ঠাহর করতে পারলো না।

ইয়াজ তার হাঁসগুলোকে খুঁজতে গিয়েছিলো, সে হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এলো। বারান্দায় উঠে। দাঁড়িয়ে সে ঘোষণা করলো, বান, বান।

সে কী! কনে?

এখানে, ওখানে, সব জায়গায়।

চিকন্দি থেকে সোজাসুজি দিঘা যাওয়ার সড়কটা সানিকদিয়ারের পাকা সাঁকোর উপর দিয়ে গিয়েছে। তার একটা শাখা ধরে চরনকাশি ও বুধেভাঙার পাশ দিয়ে দাদপুরের সীমানা ছুঁয়ে মনসার গ্রামে কাদোয়ায় যাওয়া যায়। এই সড়কটি পদ্মার বর্তমান খাতের সঙ্গে সমান্তরাল। রাস্তাটার যেদিকে বুধেভাঙা চরনকাশি প্রভৃতি, তার বিপরীত দিকে অর্থাৎ পদ্মা ও রাস্তাটার মধ্যবর্তী জায়গাটিতে দু-চারটি ছোটো ছোটো কিন্তু কৃষিসমৃদ্ধ গ্রাম আছে। এসব গ্রামে প্রতি বর্ষাতেই পদ্মার জল ঢুকে পড়ে। দুটি মাসকষ্টের, তারপর সেই জলই আশীর্বাদ বলে গণ্য হয়। . চিকন্দি উঁচু। সে সড়ক চিকন্দিতে সাধারণ একটা পথ, বুধেভাঙার কাছে এসে সেটা গ্রামের চাইতে ক্রমশ উঁচু করে উঠেছে। তার কারণ সড়কের কমোন্নতি নয়, গ্রামই নিচু। কিন্তু এসব মোটামুটি হিসাব থেকে বলা যায় না রাস্তার ওপারে লবচর, লুপপুর ডুবলে এদিকের বুধেভাঙা বা চরনকাশি বাঁচবে কিনা।

সুরতুন দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে দেখতে পেলে কয়েকটি বিপন্ন চেহারার লোক সপরিবারে বুধেভাঙা পার হয়ে চিকন্দির দিকে চলে গেলো। তাদের মধ্যে একজন বয়োবৃদ্ধ বুক চাপড়াচ্ছে আর কাঁদছে। দেখতে দেখতে ভিড়টা বাড়তে লাগলো। এই পথ ধরে যখন এত লোক আসছে, চরনকাশি আর মাধবপুরের মধ্যে দিয়ে দিঘা-সানিকদিয়ার-চিকন্দির পাকা সাঁকোর উপর দিয়ে যে-সড়ক তাতে না জানি কত লোক জমেছে।

ইয়াজ বেরিয়ে গিয়ে আসল খবরটা নিয়ে এলো। সড়কের আর পদ্মার মধ্যবর্তী জায়গাগুলিতে জল প্রতি ঘণ্টায় তিন-চার সুত করে বাড়ছে। তা বাড়ুক। চরনকাশির জোলায়। পাকা সকোর তলা দিয়ে ই-ই করে জল ঢুকছে, তা হোক। আসল খবর হচ্ছে, বাঁধটাই ফেটে গেছে। দিঘায় জল ঢুকছে। স্টেশনের উপরে ওঠেনি, বন্দরে একহাঁটু হয়েছে। আর ভয়ের কথা এই, এদিকে যেমন এক সুত দু সুত করে জল বাড়ছে তেমন নয়,কলকল করে সে জল ডাকছে, প্ল্যাটফর্মের গায়ে সে জল ছলাৎ ছলাৎ করে ধাক্কা দিচ্ছে।

বর্ণনা শেষ করে ইয়াজ বললো, ওই যে দেখছে, ওর মধ্যে দিঘা বন্দরের ভদ্রলোকরাও আছে।

কিন্তুক দিঘা বন্দর শুনছি নবাবের হইছে।

কী কও? সে কথা জিগাইছিলাম। বন্দরের একজন কলে, নবাবি আর যে রাজগি না কী কলে। তা সব সমান। খোদার গজব। রাজগির থিকে নাকি এই ঢল নামতিছে। সাম বণ্টক করে সেসব বাঁধ দিচ্ছিলো এখন সবকাটতিছে। গাং এক বহতা না হলি, এক জায়গা জমলি তালগাছও থৈ পাবি নে।

রহমান খোদা! বললো রজব আলি।

কী রহম দেখলা? ইয়াজ ভিজে গা গরম করার জন্য তামাক সাজতে বসলো।

ঘরের মধ্যে ফতেমা এসব শুনতে পেলো কিনা সে জানে। তার অব্যক্ত বেদনার আর্তনাদ মাঝে মাঝে বাইরে এদের কানে আসতে লাগলো। গহরজানের বুড়িবিবি এখনো আসেনি।

সুরতুন বারান্দায় দাঁড়িয়ে কন্যার্তনরনারীর সন্ত্রস্ত পলায়ন লক্ষ্য করতে লাগলো।যেন কথাটা আকস্মিকভাবেই তার মনে পড়লো এমনি ভঙ্গিতে সুরতুন দরজার কাছে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলো, ইজু, দিঘার বন্দর ডুবলি র‍্যালের কোঅটর ডোবে?

তা হবি।

ইজু, তোমার মামু মাধাই সেখানে আছে। তার নড়াচড়ার খ্যামতা নাই।

তা নাই।

সুরতুন একটা খুঁটি চেপে ধরে দাঁড়িয়ে রইলো।

বিকেলের দিকে হঠাৎ সে বারান্দা থেকে নেমে দ্রুতগতিতে হাঁটতে শুরু করলো, অবশেষে ছুটতে। পায়ে পায়ে জলের শব্দ হচ্ছে, জলে গতি আটকাচ্ছে।

পিছন পিছন ছুটতে ছুটতে ইয়াজ যখন সুরতুনের কাছে গিয়ে পৌঁছলে তখন সুরতুন দিঘা সড়কের এমন এক জায়গায় এসে পৌঁছেছে যেখানে পথটা ধসে গিয়েছে, এবং তার উপর দিয়ে একটা জলের স্রোত চলেছে। সন্ধ্যার অন্ধকারে স্রোতটার গভীরতা বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু সেটা অনেকখানি চওড়া এবং অত্যন্ত তীব্র। সুরতুনের সর্বাঙ্গ কর্দমাক্ত। ছুটে চলতে গিয়ে পড়েও গিয়েছিলো সে। তার পরিধেয় বস্ত্রের দু-এক জায়গায় ফালি ফালি হয়ে ছিঁড়ে গিয়েছে।

সুরতুন অন্ধকারে কালো সেই জলস্রোতের মধ্যে নামার জন্য পা বাড়িয়েছে, তখন ইয়াজ হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, থামোথামো। ও জল কি পার হওয়া যায়?

সুরতুন থমকে দাঁড়িয়ে বললো, মাধাই যে একা আছে।

তাহলেও তোমাক যাতে দিতে পারি না।

কথা বলতে বলতে সুরতুন জলে নেমে পড়েছিলো। স্রোতে দাঁড়াতে পারছেনা, তবু অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করছে। ইয়াজ সুরতুনের চোখের অস্বাভাবিক ঔজ্জ্বল্য লক্ষ্য করেছিলো। কথা বলার সময় সেটা নয়। যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি সুরতুনের কাছে গিয়ে শক্ত মুঠোয় তার দু হাত চেপে ধরে টানতে টানতে সড়কে ফিরিয়ে আনলো।

সুরতুন প্রথমে তার হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলো, তার পরে হিংস্র ভর্ৎসনার সুরে বললো, যা চাও, তা তুমি পাবা না। আমাক ছুয়ো না কলাম। হাত ছাড়ো, হাত ছাড়ো।

দু হাতে সুরতুনকে জাপটে ধরে সরিয়ে আনতে আনতে ইয়াজ বললো, আ-ছি ছি। কও কী! শোনন, সুরা, শোনো। এ পথে যাওয়া যাবি নে। দ্যাখো, চায়ে দ্যাখো, জলের ওপারে এপারে লোক থ হয়ে দাঁড়ায়ে আছে। শোনন, সুরো, শোনো, দিঘায় ঘোরাপথে যাওয়া যায় না কি দ্যাখো।

সুরতুন সম্বিৎ পেলো। কেঁদে কেঁদে বললো, কে, ইজু, এত লোক বাঁচে, মাধাই বাঁচলি কী দোষ?

দোষ কী। আসো যাই, দেখি।

.

তিনদিন পরে সুরতুন আর ইয়াজ ফিরে এলো।

অনেক কায়িক শ্রম, ততোধিক সহিষ্ণু দৃঢ়তা, অনেক বুদ্ধি ও ততোধিক সাহসের পরিচয় দিয়ে ইয়াজ মাধবপুর পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলো। সে গ্রামেরও অধিকাংশ প্রায় একটি দিন জলমগ্ন ছিলো। মাধবপুরের পর আরও দুখানা বন্যামগ্ন গ্রাম পার হতে পারলে দিঘার রেলের রাস্তায় ওঠা যায়। কিন্তু সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের শেষে তাদের থেমে দাঁড়াতে হয়েছিলো। সন্ধ্যার ধূসর দিগন্ত পর্যন্ত জল, আকাশে ফসফরাসের বিকীর্ণ তেজের মতো মেঘের স্তর চোয়ানো একটা আলো। সেই অস্পষ্টতায় জলকে সজীব কোনো ক্ষুধাতুর প্রাণীর মতো মনে হচ্ছিলো। সেই, অকূল পাথারের ওপারে মাধাই, আর এপারে সে। জলকাদায় বসে পড়ে উজ্জ্বিত জানুতে মুখ। লুকিয়ে দীর্ঘক্ষণ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে সুরতুন অবশেষে ইয়াজের ডাক শুনে উঠে। দাঁড়িয়েছিলো।

একটা আশ্রয় খুঁজে নেওয়া দরকার হয়েছিলো। পিছনে ফেরাও সম্ভব নয়। দিনের বেলায়। যেখানে প্রাণ হাতে করে চলতে হয়েছিলো সেখানে জল নিশ্চয়ই আরও বেড়েছে, রাত্রির অন্ধকারে সে পথে ফেরার আশা বাতুলতা। তখনো হয়তো জল বাড়ছেই। মাধবপুর গ্রামটির সব চাইতে উঁচু জমি দিঘা চিকন্দি সড়কের এই অংশটুকু, সেইজন্যই হয়তো এখনো সেখানে পায়ের তলায় মাটি ছিলো। অধিকাংশ বাড়িই পরিত্যক্ত। দু-একটিমাত্র বাড়িতে মিটমিট করে আলো জ্বলছে। তাতে বোঝা যায় অধিবাসীরা ঘর আঁকড়ে পড়ে আছে। কিন্তু আরও জল বাড়লে খাঁচায় বন্ধ পাখির মতো ডুবে মরবে। ইয়াজের প্রাণও ভয়ে হিম হয়ে গিয়েছিলো।

জল, কাদা, কোথাও বা ভিজে ভিজে বালির উপর দিয়ে সন্তর্পণে চলতে চলতে চরনকাশির জোলার ধারে এসে এইমাত্র সুরতুন ও ইয়াজ থমকে দাঁড়ালো। যেখানে জোলা ছিলো, মাধবপুর যাওয়ার সময়ে যে জোলা সাঁতার দিয়ে পার হতে হতে ইয়াজের আশঙ্কা হয়েছিলো স্রোত ঠেলে সুরতুন হয়তো ওপারে যেতে পারবে না, সেই জোলায় এক ফোঁটা জল নেই। কোথাও পলি, কোথাও বালিতে ঝুঁজে গেছে সেটা। সেখানে দাঁড়িয়ে বুধেডাঙা চোখে পড়লো। কালো কাদার একটি বিক্ষুব্ধ পাথার।

তার মধ্যে মধ্যে কাত হয়ে পড়া কুটিরগুলো, হেলে পড়া কাদামাখা গাছ।

তিনরাত দুদিনের মধ্যে একবারই মাত্র খেয়েছে তারা, একরাতই ঘুমিয়েছে। একটি অপরিসীম ক্লান্তিতে চরাচর আচ্ছন্ন। শুধু চোখে-মুখে ছাপ পড়া নয়, সুরতুনের গলার স্বরও বসে গেছে, কথা বলতে গেলে অস্পষ্ট একটা শব্দ হচ্ছে মাত্র। কিছুই মনে পড়ছেনা তার, শেষ পর্যন্ত কীভাবে কোথায় তারা আশ্রয় পেয়েছিলো। আশ্ৰয়টা বোধহয় খুব উঁচু একটা কিছু ছিলো। হয়তো তা কোনো গৃহস্থের পোয়ালের পুঁজ, ইয়াজ তাকে সেখানে টেনে তুলতে হাঁপাচ্ছিলো। আর হঠাৎ যখন গুমগুম শব্দ হতে হতে আকাশ থেকে আবার বৃষ্টি নামলো ইয়াজ পাঁজা পাঁজা খড় এনে নিজেকে এবং তাকে ঢাকবার চেষ্টা করেছিলো।

বুধেডাঙার দিকে তাকিয়ে তার ফতেমার কথাই প্রথম মনে পড়লো। তার শরীরের সেই অবস্থায় বন্যার আকস্মিক আক্রমণে সে বেঁচেছে এ আশা করা অযৌক্তিক।

আর মাধাই?মাধাই যদি চাঁদমালার সাহায্যে প্রাণরক্ষা করতে পেরে থাকে, এখন সুরতুনের মনে হচ্ছে সে বাঁচাটাই নিরর্থক হয়েছে। এই পৃথিবীতে কারো পক্ষেই বাঁচাটা লাভজনক নয়।

ক্লান্তিতে সে এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যখন অন্তরে ক্ষোভ বা দুঃখ বলতে আর কিছু নেই। নিজেকেও যেন শরীরের বাইরে অন্য আর একটি শরীর বলে মনে হচ্ছে।

এখন সকাল হচ্ছে–এই অনুভবটা আবার হলো তার। কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত তাদের একটা গন্তব্য স্থান ছিলো, এখানে এসে সেটা মিলিয়ে গেছে। এখন সবকিছুই পদ্মা। আকাশে দ্যাখো, সেখানে পদ্মা প্রতিফলিত শাদা শাদা বালির পাড়ের মতো মেঘগুলিকে ঢেকে ঢেকে দিয়ে ধোঁয়াটে কালো মেঘের প্রবাহ।

আর জীবন কী? সেটাও যেন পদ্মার মতো একটা কিছু। সে না থাকলে কিছুই থাকে না, থেকেও শুধু ভয় আর বেদনা। দিনের আলোয় আলোর চাইতেও প্রখর হয়ে জ্বলে,ঝড়ের সন্ধ্যায় মুখ কালো করে সে চাপা গলায় গর্জাতে থাকে কোথায় বাঁধ কাটবে। এই জীবন কখন কার কোন প্রতিরোধ ধসিয়ে দিয়ে আবর্তের মধ্যে টেনে নেবে এ কেউ বলতে পারেনা।কী সার্থকতা এই নাকানি-চোবানি খাওয়ার?

সুরতুনের অবাক লাগলোভাবতে, এত ঠকেও মানুষের শিক্ষাহয়না। তখন কিছুক্ষণের জন্য বর্ষণ থেমেছে। ভিজে খড়গুলো সরিয়ে কিছু নতুন খড় এনে ইয়াজ নিজেকে এবং সুরতুনকে আবৃত করে নিতে পেরেছিলো।

ইয়াজ বলেছিলো, কেন, সুরো, আমরা কি বাঁচবো না?

বাঁচে কী হয়?

চিন্তা করার মতো অবসর নিয়ে ইয়াজ বলেছিলো, কে, আমি চাষ-আবাদ করে তোমাকে খাওয়াবের পারি না?

কিন্তু এর সইতেও চুড়ান্ত বিস্ময়ের কিছু আছে। সুরতুনের এই শরীরের ভিতর থেকে এক অচেনা শরীর যেন আকস্মিকভাবে আত্মপ্রকাশ করেছিলো। তার বোকামিগুলি যখন ইয়াজের ক্ষেপ কামনার উত্তর হয়ে উঠতে লাগলো, ক্লান্ত আবেগের করুণা নিয়ে তার মন তখনো মাধাইয়ের কথাই ভাবছে। কিন্তু মাধাইয়ের বেদনায় ব্যথাতুর মন নিয়েও তার সেই নতুন শরীরকে খানিকটা স্নেহ না দিয়ে পারেনি সে। এখনো সেজন্য বিষয় নয়।

আকাশে থেকে থেকে মেঘ ডাকছে। পদ্ম মুখ কালো করে আছে।

ইয়াজ বললো, ওঠো, সুরো, চরনকাশির বড়ো সেখের বাড়িত কিছু খাবের পাওয়া যায় কিনা দেখি।

সুরো বললো, তা যেন দেখবা, সে কোন দ্যাশ? দ্যাশ না ভাগ হইছে? আমরা না মোছলমান?

ইয়াজ বললো, হয়! সুরো সান্দারনি এক মোছলমান, আমুও আর এক হেঁদু। ফতেমাকে আম্মা কতাম, বাপ কেডা জানি নে। এই না চরনকাশি।

সুরতুন কাদামাটিতে আধশোয়া ভঙ্গিতে পা ছড়িয়ে বসেছিলে। তাদের কিছুদূরে একটা ছোট বেতের কুনকে কাদায় আধড়োবা। কোনো গৃহস্থ বাড়ি থেকে ভেসে এসে থাকবে। কী করে তার তলায় কয়েকটা কলাই আটকে ছিলো। ঘোরের মধ্যে সুরতুন দেখলোসরু শাদা শাদা কিছু সেখানে, কীট যেন, কল যেন। তার ভয় ভয় করলো।

ইয়াজ উঠে দাঁড়িয়েছিলো। দূরে চিকন্দির সান্যালবাড়ির উল্টানো পিরিচের মতো চুড়াটা চোখে পড়লো। সে বললো, দ্যাখো।

সুরতুন দীর্ঘনিশ্বাস ফেলো।

সুরতুন দেখতে পেলো কে একজন তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। খুব ধীরে ধীরে পা মেপে মেপে জোলার ধার দিয়ে সে আসছে। একবুকশাদা শাড়ি, একটা অত্যন্ত লম্বা জামায় হাঁটু পর্যন্ত ঢাকা। লোকটি এক-একবার থেমেহাতের লাঠিটাবালির মধ্যে পুঁতে দিয়ে তারপর সেটাকে তুলে লাঠির ডগাটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কী একটা পরীক্ষা করলো। এ প্রক্রিয়াটি সে অনেকবারই করছে।

ইয়াজ বললো, চরনকাশির বড়ো ভাই আলেফ সেখ না? হয়, তাই। ওই যে, সুরো, যার– ছাওয়াল কাজিয়ায় মারা গেলো।

আহা-হা, পাগল হইছে?

না, মনে কয়। চাষ দেওয়ার কথা ভাবে। বালির কত নিচে মাটি ও বোধায় দ্যাখে।

সুরতুন তখন চিন্তা করছে : ফতেমার হয়তো মৃত্যু হয়েছে, কিন্তু সে নিজে রক্ষা পেলো। তার কারণ এই ছেলেমানুষ ইয়াজ ফতেমাকে সাহায্য না দিয়ে তাকে সাহচর্য দিয়েছে। শহরের হাক সুখের জীবন ছেড়ে বুধেডাঙার মাটিতে বসে কপাল চাপড়ানো যেমন ইয়াজের খেয়াল,

এটাও যেন তেমনি কিছু।নতুবা ফতেমাকেইয়াজ শুধুমুখে আম্মা’বলে ডাকতোনা, গভীরভাবে ভালোবাসত তাকে। আপন বোনের চাইতে, দিদির চাইতে কম নয়।

ইয়াজ বললল, লোকে কয়, মজিদে আল্লার সাথে কথা কয়। কয়, আল্লা, জমি দিবার হয় দিও, না দেও সেও আচ্ছা। আমাক আর জমির পিছে ছোটায় না। আমি অথব্ব। হিদুর জমি ধরি নাই। কবা, জমির লোভ খারাপ। কিন্তুক, খোদা রহমান, আমার ছাওয়াল কী লোভ করছিলো? এই কয়ে খুব কাঁদে। তার বাদে চোখ মুছে কয়, তোমাক কলাম তা কাউকে কয়ো না। তা হোক, সুরো, ওঠো আমার কাপড়ের থিকে আর কিছুছিড়ে দিতেছি, বুকে-পিঠে জড়ায়ে নাও।বড়ো সেখ তার পাকামজিদের দিকে যাতেছে। মন কয়, সেখানে আরো লোকজন আছে। কিছু খাবের পাওয়া যাতি পারে।

বন্যা থেমে গেলে হয়তো বোঝা যাবে, পদ্মা এবার আবার পাশ ফিরলো কিনা–এটা তার প্রসাদ কিংবা রোষ।

থেকে থেকে পদ্মার মুখ কালো হয়ে উঠছে তখনো, ফুলে ফুলে উঠছে তার বুক। উপরে ডড ড করে মেঘ ডাকছে। পুরাণটা যদি জানা থাকে হয়তো কারো মনে হতে পারে, কেউ যেন অন্য কাউকে বলছে : দয়া করো, দয়া করো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *