৩৬. আর একটি ধানের খন্দ

আর একটি ধানের খন্দ এসেছে এবং চলেও গেছে। ইয়াজ ভেবেছিলো সে খুব একটা কিছু করেছে, কিন্তু জমিদারের ফসল তুলে দিয়ে, লাঙল জোয়ালের জন্য ধার শোধ করে যা অবশিষ্ট আছে তাতে আর এক ধানের খন্দ পর্যন্ত সংসারকে এগিয়ে নেওয়া যাবেনা। সংসারটা খুব ছোটো নয়, ফতেমা, সুরতুন, রজব আলি এবং সে নিজে।

ইয়াজের গায়ে গ্রামের শ্যাওলা পড়েছে। যখন সে শহরের একান্ত দুঃসহ দারিদ্র্যের মধ্যে কাটাতো তখন তার চেহারায় ও অভ্যাসে কিছু শহুরে ছাপ ছিলো। তার চুল কাটার কায়দা দর্শনীয় ছিলো, একটা রঙিন সিল্কের ছেঁড়া-ছেঁড়া গেঞ্জি সে গায়ে দিত, কখনো কখনো ডোরাকাটা কাপড়ের পায়জামা পরতো, বিড়িটা সিগারেটটা খেতো। এখন তার ধূলিমলিন একমাথা চুলে সেসব দিনের জুলফির কায়দা ডুবে গেছে। পরনে অধিকাংশ সময়ে একটা গামছা থাকে, নেহাৎ যদি কোনদিন দিঘায় যাওয়ার দরকার হয় একটি খাটো মলিন মমাটা থান কাপড়ের কয়েক হাত সে ব্যবহার করে।

কিন্তু তার ছনমন করে বেড়ানোর স্বভাব যায়নি। তার সঙ্গে আর একটি ভাব যুক্ত হয়েছে, সেটা হচ্ছে কী করি–কী করি। আলেফ সেখের গোরুগাড়ি চালানোর কাজ হয়েছে তার। তার জন্য পারিশ্রমিক কী পায়, সে-ই জানে। কিন্তু যখন সে দিঘা থেকে ফিরে আসে তখন মনের। স্ফুর্তি চেপে রাখতে না পেরে উঁচু গলায় গান জুড়ে দেয়। সে গানের ভাষা দুর্বোধ্য, সুর ভয়াবহ। সে তার এই অপূর্বর্গঠন পরিবারটিকে একটি জেলের পরিবারে রূপান্তরিত করবে এমন সম্ভাবনা। দেখা দিয়েছিলো একসময়ে। এখন সেটা নেই, কিন্তু জলের উপরে এবং তা থেকে জালের দিকে টানটা থেকে গেছে। একটা খ্যাপলা জাল সে নিজেই বুনেছে। গাব দিয়ে সেটাকে মাজবার সময় একটা কলহ হয়েছিলো। সুরতুন বলেছিলো, আমার অকাজের সময় নাই। মনে হলো ইয়াজ একটা খুনই করে ফেলবে। সে জালটিকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলার জন্য ঘর থেকে দা হাতে নিয়ে বেরুতেই ফতেমা এসে দাঁড়ালো, তার হাত চেপে ধরলো, দা কেড়ে নিলো। ধমক দিয়ে বললো, দূর হও, বজ্জাত কোথাকার। তুমি মানুষ কাটবা!

ইয়াজ রাগের মাথায় চিৎকার করে কী বললো তা বোঝা গেলো না। অত চিৎকার করতে গেলে স্পষ্ট করে চিন্তা করাও যায় না। কিন্তু মনে হলো সে বলছে, তুমি কি আমার আপন মা যে অমন করে গাল দিবা?

কিছুদিন সে সুরতুনের সঙ্গে কথাই বললো না।

কিন্তু একদিন সন্ধ্যার পর, আকাশে গুমোট মেঘ, ইয়াজ বললো, সুররা, আজ মনে কয় মাছ ভাসবি।

ধরো গা।

তার আগে তোমাক ধরবের চাই। তুমি একটু চলো, একলা ভয় ভয় করে। জালেরা নাকি তুক করে রাখে।

মাছ ধরতে গিয়ে বিপদই হলো সেদিন। প্রথম টানেই জালটা আটকে গেলো এক বাঁশের খোঁটায়। সুরতুনকে নামতে হলো গলা জলে, জালের দড়ি ধরে দাঁড়াতে হলো। ততক্ষণে ডুব দিয়ে দিয়ে ইয়াজ জাল ছাড়িয়ে দিলো খোঁটা থেকে।

কিন্তু আসলে সেদিন কপাল ভালো ছিলো। পাটকাঠির মশাল হাতে বালির পাড়ে দাঁড়িয়ে নদীর ঠাণ্ডা বাতাসে ভিজে কাপড়ে সুরতুন ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলো বটে, ইয়াজ নানা জাতের ছোটো ছোটো মাছে খালুইটা ভরে তুলো।

এমন মাছ সে অনেকদিন পায়নি কিন্তু তার চাইতে অন্য আর একটি কারণে সন্ধ্যাটা গুরুত্ব অর্জন করলো। পাশ দিয়ে গেলে মানুষ বলে মনে হয় কিন্তু লোক চেনা যায় না অমনি অস্পষ্ট অন্ধকারের মধ্য দিয়ে দুজনে চলছে। ঠাণ্ডা লাগানোতে জ্বর হতে পারে কিনা তাই নিয়ে কথাটার সূত্রপাত।

জ্বর হলে আর কী হবি, না-হওয়া কালে ভয়। মরতি পারলে সব ফরসা। বললো সুরতুন।

লঘু পরিহাসের ভঙ্গিতে ইয়াজ সুরতুনকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে হাসির সঙ্গে মিশিয়ে বললো, ষাট, বালাই, মরবা কে? কেউ বিয়ে করবের চায় না বলে?

বড়ো বলে মানো না, কেন্?

ওই দ্যাখো আবার রাগ করলা? ঠাট্টা করলাম তাও বোঝো না? বড়োই তো। অনুপ্তের মতো বললো ইয়াজ।

কিছুদূর যাওয়ার পর ইয়াজ বললো, আচ্ছা, সুরো, একটা কথা কবা? তুমি মাধাইয়ের ঘরে থাকলা না কেন?

পরের ঘরে থাকবো কেনে?

মিয়েমানুষ তা থাকে। এখানে কৈল তোমার বড়ো কষ্ট।

কষ্ট আর কী, দুনিয়ায় তা নাই কনে?

তাইলেও এমন চেহারা তোমার তখন হয় নাই। যেদিন তুমি আসলা সেদিন যেন রূপ ফাটে ফাটে পড়ে। আর এখন শুকায়ে কী হইছে।

সুরতুন নিরুত্তর।

কলে না?

কী কবো? তুই একখান শাড়ি কিনে আনিস, পরবো। সুরতুন হাল্কা কথায় চিন্তা ঢাকতে চেষ্টা করলো।

গোরুগাড়ি হাঁকিয়ে ইয়াজ সপ্তাহে একদিন দিঘায় যায়। একবার সেখান থেকে ফিরে সে বললো, মাধাই বায়েনের সঙ্গে দেখা হইছিলো।

ফতেমা বললো, কেমন দেখলি?

তা সেইরকম। শিস দিয়ে বাজারের মধ্যে ঘুরতিছিলো।

তোকে কিছু কলে?

না। আম্মা, তোমার জয়নুল-সোভানেক দেখলাম। তারা তাগরে আব্বার দোকান জাঁকায়ে বসেছে। একজন কলে, কসাই আবার নিকা করছে, কিন্তু ধরছে ক্ষয়কাশ।

জয়নুল-সোভানও তোকে কিছু কলে না?

আমি তাদের সামনে গিছি? দূর থিকে দাঁড়ায়ে দেখলাম।

এবার গেলি কথা কয়ে আসিস। ফতেমা বললো।

কিন্তু মাধাইয়ের সম্বন্ধে সে কিছু সংবাদ সংগ্রহ করেছিলো। বাঁশ, নলখাগড়া প্রভৃতির সাহায্যে তার নিজের জন্য যে কুঁড়েটা সে তুলেছে সন্ধ্যার পর সংবাদটা দেওয়ার জন্য সুরতুনকে সেখানে ডেকে নিলো ইয়াজ, কিংবা ছল করে সুরতুনই গেলো সেখানে।

মাধাই দেখলাম সুখেই আছে। চাঁদমালা না কে একজন তার সঙ্গে ছিলো। দেখলাম মাধাই তাকে বাজার সওদা করে দিলো।

আর কিছু কবি?

সুরতুন উঠে দাঁড়ালো। সে বৃথাই ভেবেছিলো, বাইরেটা শুকিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মনের ক্ষতটিও শুকিয়ে গেছে।

.

সুরতুনের মনে হয়, অন্য কারো জন্য প্রাণ পোড়া কিছুনা। সেটা একটা খেয়ালের খেলামাত্র। কিন্তু অদ্ভুত নেশা তার। একটা পুরনো ঘটনাও মনে পড়ে গেলো সুরতুনের।

বেল্লাল সান্দারের জেবু নামে এক মেয়ে ছিলো। জ্বরে ভুগে ভুগে জীর্ণ-শীর্ণ, মাথার চুলগুলিও তেমন করে আর বাড়েনি। শুকনো চেহারার পনেরো-ষোলো বছরের একটি মেয়ে ছিলো সে। পাড়ার মেয়ে স্বজাতীয়দের মেয়ে ছাড়াও সুরতুনের সঙ্গে নিকট-পরিচয় হওয়ার আর একটু কারণ ছিলো। ফসল উঠে যাওয়ার পর সুরতুন-ফতেমার সঙ্গী হয়ে ভোররাতে সে ধান কুড়োতে যেতো।, ধানের কাজ শেষ করে তখন বাঙালরা চলে গেছে, এমন এক সন্ধ্যায় পা টিপে টিপে অতি সন্তর্পণে জেবু এসে দাঁড়িয়েছিলো ফতেমার কাছে।

–কেন রে জেবু?

–ও যে চলে যাবি।

–কেডা যায়?

জেবু ফেঁপাতে ফেঁপাতে বললো–রোমজান।

–তাতে তোর কী? ধানের সময় নানা দেশের লোক আসে যায়। ধান নিয়ে পলাইছে?

–না। আমার কী হবি?

জেবুর একটি ভ্রান্ত ধারণা হয়েছিলো যে সে প্রজাবতী।

কথাটা শুনে প্রথমে খানিকটা নির্দয় রঙ্গ করলো ফতেমা। তারপর জেবুন্নিসাকে আসন্ন মাতৃত্বের লক্ষণগুলি বুঝিয়ে দিতে গিয়ে সে দেখলো, নিজেও সে সে-বিষয়ে অত্যন্ত কম জানে।

সেবার সেসব পুবদেশী বাঙাল এসেছিলো তাদের মধ্যে একজন ছিলো রমজান। বছর কুড়ি বয়স হবে কি না-হবে, কিন্তু এত লম্বা যে মানুষ একশো বছরেও তেমনটা হয় কিনা সন্দেহ। সেই দৈর্ঘ্যের ফলে তার হাত দুটো লটপট করতো, পা দুখানা ন্যাকপ্যাক করতো। চটে জড়ানো একটু পুটুলি,একটা মাথাল, একটা কাস্তে নিয়ে সে এসেছিলো ধান কাটতে সেই যেবার দুর্ভিক্ষের আগে ধানের বান ডেকেছিলো।

সড়কের ধারে বলে বেল্লালের বাড়িতেই সে তামাক খেতে ঢুকেছিলো। তার সঙ্গীরা ততক্ষণে এগিয়ে গিয়ে চিকন্দি ও সানিকদিয়ারের খেত খুঁজে কাজ ঠিক করে নিয়েছে। তখনকার দিনে বাঙালদের অনেকেই বুধেডাঙায় সান্দারপাড়ায় তাদের দাওয়ার আশ্রয় নিতো। এটা একটা প্রথায় দাঁড়ানোর মতো ব্যাপার হয়ে উঠেছিলো। বাড়ির মালিককে তারা এক কাঠা করে ধান দিতো। রমজান বেল্লালের বারান্দাতেই বসে রইলো। সন্ধ্যার পর একবার বেরুলো সে।কাছে যে খেতটা পেলো তার মালিকের সঙ্গে দর কষাকষি না করে মালিক যা বললো তাতেই রাজী হয়ে আবার। বেল্লালের বাড়িতে ফিরে এলো সে।

দেখা গেলো নোকটা ধানের কাজে যতই আলস্য দেখাক, আসলে কাজ না করে থাকতে পারেনা। ধান কাটার পরিশ্রমসাধ্য কাজ করে এসে একটু জিরোতেনা-জিরোতে সে বলে–আজ বুঝি দড়িদড়া পাকান নাই?

বেল্লাল হেসে বলে–তোমাদের দেশে সাঁঝেও বুঝি লোকে বিচ্ছাম করে না?

এমন না হলে জেবুকে ধান কুড়োনোর জন্য ভোররাতে ফতেমার বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার সময় পায় সে।

ক্ষেতের ধান ঘরে উঠেছে। নদীর ঘাট থেকে বাঙালদের ধানবোঝাই নৌকাগুলো রওনা হয়ে যাচ্ছে। ঋক বেঁধে উড়ে আসে এরা, তেমনি চলে যায়। ঝকছাড়া দু-একটা বোকা পাখি যদি পড়ে থাকে, তবে সেটা ডানায় যত না জোর তার চাইতে বেশি তোড়জোড় করে উড়তে, তেমনি করতে লাগলো রমজান।

তখন ফতেমা ইয়াকুবকে বলে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করলো। ইয়াকুব প্রথমে রাজী হয়নি কিন্তু ফতেমা বাপের বাড়ির দিকে চলে যাবে শুনে সে লম্বা লম্বা পায়ে দৌড় দিলো হাঁক দিতে দিতে। কুস্তির প্যাঁচে ঘায়েল করে চোর ধরার মতো রমজানকে সে ধরে আনলো। নিজের আঙিনায় পৌঁছে ইয়াকুব বললো–শালা, পলাও কেন্ চুরি করে?

রমজান ভীত হলো না।

এরপরে ইয়াকুব এবং ফতেমা জেবু ও রমজানের জন্য একখানা ঘর তুলে দিয়েছিলো। বাঁশঝাড় থেকে কুড়িয়ে-আনা কঞ্চি এবং নদীতীর থেকে সংগ্রহ করা কাশ দিয়ে দেখ-দেখ করে ঘর উঠলো একখানা। বেল্লালের বাড়ির বুড়োকুকুরটা যৌতুকের মতো জেবুর সঙ্গে এসেলিল।

কিন্তু দুর্ভিক্ষের প্রথম পদসঞ্চারে জেবু ও রমজানের মৃত্যু হলো। ডুবন্ত অবস্থায় তারা পরস্পরকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলো।

ফতেমার ব্যাপার চিন্তা করতে গিয়েই সুরতুনের এত কথা মনে পড়েছে। ফতেমা জেবুনয়। অনেক অভিজ্ঞতা সে অর্জন করেছে এই জীবনে, কিন্তু তবু এবার ধান কাটার দিনে ফতেমার পায়ের তলা থেকে শক্ত মাটি যেন সরে-সরে যেতে লাগলো। এ বিষয় নিয়ে সুরতুন ফতেমার সঙ্গে আলোচনাও করেনি। কিন্তু একসময়ে সুরতুন স্থির করেছিলো ফতেমা যদি তার সঙ্গে চলেও যায় তবুও ফতেমা উধাও হয়ে যাওয়ার এক মুহূর্ত আগেও এ ব্যাপারটির কথা কারো কাছে সে বলবে না।

সেই লোকটির মতো কাউকে এ অঞ্চলে চোখে পড়ে । সে যেন সান্যালবাড়ির কেউ, এমনি তার গায়ের রং। আর তার চোখ দুটি অবিস্মরণীয়।নীল চোখ,নীলের মধ্যে যেন পাটকিলে রঙের আঁশ। তার চোখের দিকে চোখ পড়লেই মনে হতো, রোজ যাদের দেখা যায় এ যেন তাদের কেউ নয়। ধান কাটতে এসেছিলো। নিতান্ত দরিদ্র ভূমিহীনদের একজন। এদিকের চলিত প্রথা অনুসারে বুধেডাঙার এই বাড়িটাতে দু কাঠা ধান দেওয়ার কড়ারে ধান কাটার দিন পনেরো থাকবে এই ব্যবস্থা হয়েছিলো।

এদিকে সুরতুনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলো ফতেমা নিজেই, কথা দিয়ে নয়, কাজে। একটা রঙিন তফন কিনে এনে সে সুরতুনের হাতে দিয়ে বলেছিলো–বাঙালেক ডি । দিশেহারা না হলে এমন দয়া আসে না মনে।

চলে যাওয়ার সময় হলে সে লোকটি বললো–আমি আবার আসবো।

ফতেমা ঘরের ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো। খানিকটা চিড়ে-গুড় একটা ছোটো পুটুলিতে বেঁধে এনে লোকটির সম্মুখে রেখে এই কথাটা সে শুনতে পেলো। অদ্ভুত একরকম নিঃশব্দ হাসিতে আচ্ছন্ন হয়ে ফতেমা বললোতা আসবের হবে কেন্ যদি কাজ না থাকে?

ইয়াজ বললো–আপনে ঘাটে যান মোসাহেব। আপনের ধানের বস্তাগুলো আমি দিয়ে আসতেছি।

রজব আলি লোকটার সঙ্গে গল্প করতে করতে পদ্মার ঘাটে যেখানে লোকটির দলের নৌকাটা বাঁধা ছিলো সেখানে গিয়েছিলো।

বাড়ির সকলেই যেন লোকটির গুণে মুগ্ধ হয়েই তাকে সমাদর করতে লাগলো।

তফাত এই, ভাবলো সুরতুন, একটা সংসারকে যে চালায়, বহন করে, ধরে রেখেছে, সেই ফতেমা জেবুর মতো হাহাকার করতে পারে না, অনুশোচনাতেও ভেঙে পড়ে না। অন্য কথায়, অর্ধেক ভেঙে ভেঙে পড়তে পড়তে কোনো কোনো গাছ যেমন কোনো গোপন শিকড়ের জোরে সামলে নেয় ফতেমা যেন তেমন কিছু করেছে।

কিন্তু ‘হা অন্ন’ ‘হা অন্ন’ করাই যেন যথেষ্ট কষ্ট নয়, তাই এ বেদনাও মানুষকে সইতে হয়।

.

এখন ইয়াজ বুঝতে পেরেছে, সুরতুন ও ফতেমা একই যৌথ কারবারের অংশীদারের মতো পাশাপাশি চললেও সুরতুন যেন কোনো কোনো ব্যাপারে এখনো সংকুচিত। ইয়াজের উপার্জনের কিছুমাত্র তার ব্যবহারে লেগেছে, এ ভাবতে গিয়ে যেন সেকুণ্ঠিত। প্রকৃতপক্ষে সে এই পরিবারের কেউ নয় এ ভাবটি তার এতদিনেও যায়নি। ইয়াজের ইচ্ছা হয় সে সুরতুনের মনোভাব দূর করবে। তার ইচ্ছাটা হয় এবং সে অনেক সময়ে বলে, কী ভাবো সুরো?

এবং সে দিঘায় গেলে সময়ের একান্ত অভাব না হলে মাধাইয়ের খবর নেওয়ার চেষ্টা করে। মাধাই এবং সুরতুনের মধ্যে একটি যোগাযোগ স্থাপন করার ব্যাপারে সে ক্রমশই উৎসাহিত হয়ে উঠেছে। কিন্তু কাজে ডুবে থাকতে হয় তাকে, কাজেই সব সময়ে সুরতুনের অন্তরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করতে সে পারে না। তবু বাল্যে আকাশের মেঘ দেখে যেমন কৌতূহল হতো তার, তেমনি হয় সুরতুনকে নিঃশব্দে আঙিনায় চলে-ফিরে বেড়াতে দেখলে।

এরকম মনোভাব থেকেই একদিন ইয়াজ রজব আলিকে জিজ্ঞাসা করলো,কে,নানা, সুরো তোমার ভাইয়ের বিটি, তাক বিয়া দিবা না?

নতুবা এমন অভিভাবকসুলভ আলাপ করার পক্ষে ইয়াজের বয়স যথেষ্ট নয়। বয়সের হিসাবে ইয়াজ সুরতুনের চাইতে ছোটোই হবে।

আবার যেদিন ইয়াজের সঙ্গে সুরতুনের নির্জনে দেখা হলো, দুজনে হাট থেকে ফিরছিলো, ইয়াজ বললো, সুরো, আমার মনে হয় তোমার বুকের মধ্যে কী আছে তা দেখি।

কেন্‌, এমন হয় কেন্?

আমার যেন মনে হয় তোমার সুখ নাই। তোমাক যেন চিনবের পারলেম না।

মানুষ চেনা কি সহজ? সুরতুন হাসিমুখে বললো। টেপির মায়ের সেই বাবাজির গানের । একটা কলি তার মনে এসেছিলো।

আচ্ছা, সুরো–

এমন রূপ তোমার, লোকে তোমাক নিবের চায় না কেন্‌?

ছাই!

কথাটা মিথ্যা নয়, সুরতুনের রূপ যেন পুড়ে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। দেহবর্ণ মলিন হয়েছে, ধানহীন দিনে স্বাভাবিকভাবেই মেদহীন হয়েছে তার দেহ, স্তন শুকিয়ে গেছে চৈত্রের মাটির মতো, তবু সেই করুণ মুখে টিকলো নাকটি আছে, এবং টানা টানা দেখায় চোখ দুটি, আর সেই চোখের কোলে ক্লান্তির কালিমা।

কও কী? ইয়াজ বললো, আমার মনে কয় তোমার কী কী অভাব জানে নিই। নতুন কাপড়েও তোমার রূপ যেন বাড়ে না, ঢাকা পড়ে।

সুরতুন বললো, এমন কথা কী কয়?

.

ইয়াজ দিঘায় গিয়েছিলো এবং সাধ করেই সে মাধাইয়ের সঙ্গে দেখা করেছিলো। বাড়িতে ফিরে সে অন্য কোনো কথা বলার আগেই ফতেমার কাছে গিয়ে বললো, মাধাইয়ের খুব অসুখ। বাঁচে কি না বাঁচে।

কস কী?

তখন দুপুর। সুরতুন উঠোনের একপ্রান্তে বসে শুকনো ডালপালা কেটে কেটে লকড়ি তৈরি করছিলো। ফতেমা রান্নার জোগাড় করে নিয়েছিলো। রান্না ফেলে সে সুরতুনের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো, শুনছো না, সুরো, বায়েনের খুব অসুখ।

সে কি যাতে কইছে? সুরতুন প্রশ্ন করলো।

কী কস, ইজু? ফতেমা ইয়াজকে প্রশ্ন করলো।

না। আমি যাওয়াতেই রাগ করছে। ইয়াজ বললো।

তবে? সুরতুন প্রশ্ন উত্থাপন করলো।

ফতেমা বললো, কিন্তুক তার যদি ভারি ব্যারাম হয়?

সুরতুন অত্যন্ত মৃদুগলায় বললো, সে যদি রাগ করে তাইলে আমরা যায়ে কী করি?

সে মুখ নিচু করে আবার লকড়ি কাটতে লাগলো।

ফতেমা চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে থেকে বললো, না গেলি হয় না, সুরে, যাওয়াই লাগে।

সেদিন ফতেমাদের বাড়িতে আহারাদির কোনো ব্যবস্থা হলো না। কিছুক্ষণ পরেই সুরতুন ও ফতেমা ইয়াজকে নিয়ে দিঘায় রওনা হলো।

ফতেমারা যখন মাধাইয়ের ঘরে গিয়ে পৌঁছলো তখন বেলা পড়ে আসছে। মাধাই তার ঘরের মধ্যে শয্যায় বসে উড্ডিত জানুতে কপাল রেখে করুণ স্বরে হা-হুঁতাশ করছে।

সুরতুন বললো, ভাবি, এখন কী করবা?

কী করতে কস?

ফতেমা আর-একটি মুহূর্ত চিন্তা করলো, তারপর দ্বিধা ত্যাগ করে মাধাইয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে তার পিঠে হাত রাখলো।

মাধাই চমকে উঠে মুখ তুললল। একডালি চুল, একমুখ দাড়ি, চোখ দুটি লাল।

ফতেমা বললো, কী হলো, ভাই?

ইয়াজ বলেছিলো মাধাই রাগ করবে, কিন্তু সে দু হাত বাড়িয়ে দিলো ফতেমার দিকে, ভঙ্গিটা যেন শিশুর কোলে উঠতে চাওয়ার মতো। ফতেমা আরও কাছে সরে দাঁড়ালো, মাধাইয়ের মাথাটা নিজের বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে সে বলতে লাগলো, ভয় নাই, ভয় নাই।

কিছুক্ষণ পরে মাধাই বললো, বুন, চলো আমরা বাইরে যায়ে বসি।

মাধাই বারান্দায় এলো। সে মাটিতে বসতে যাচ্ছিলো, ইয়াজ এগিয়ে এসে একটা চট পেতে দিলো।

ফতেমা বললো, ভাই শোও, একটুক ঘুমাও; না হয় শুয়ে শুয়েই কথা কও।

মাধাই অত্যন্ত বাধ্য একটি কিশোরের মতো শুয়ে পড়লো। ইয়াজ কিছুদূরে মাটিতে বসেছিলো, তাকে দেখিয়ে মাধাই প্রশ্ন করলো, আমার ভাগনা বুঝি?

সুরতুন বারান্দার উপরে চটের একপ্রান্তে বসেছিলো, মাধাই অনেকটা সময় তার দিকেও চেয়ে রইলো। মনে হলো, মাধাইয়ের দেহ-মন স্নিগ্ধ হয়েছে, এবার সে একটু ঘুমোলেও পারতো। কিন্তু বকবক করতে লাগলো। পুরনো কথা উত্থাপন করে যেন তার স্মৃতিশক্তির পরীক্ষা দিচ্ছে। একসময়ে সে বললো, আমার কি এত লোক?

সন্ধ্যার আগে চাঁদমালা এসেছে। সে যেন আরও স্থূলাঙ্গী হয়েছে। একটি রঙিন শাড়ি তার পরনে। এজন্য তার খরচ হয় না। যে কাপড় সে কাঁচতে আনে প্রয়োজনতো তার মধ্যে থেকে বেছে নিয়ে সে পরে। চোখে সে কাজল দিয়েছে। দু হাত ভরা রেশমি চুড়ি। ঘরে ঢুকে একটা ঝোলা থেকে গুটিকয়েক মাটির খুরি, একটা দেশী মদের বোতল নামিয়ে রেখে সে ঘরের মধ্যেজ ঘুটঘাট করে কাজ করতে শুরু করলো।

মাধাই বললো, দেখছোনা, ওই আমার চাঁদমালা। বড়ো ভালোমানুষ। সব ব্যবস্থাই ও করে। র‍্যাশন আনে, বাজারে বেশি দামে বাড়তি র‍্যাশন বেচে। ওর কোনো খরচাই নাই। শুধু সাঁঝে এক বোতল ঢকঢক করে খায়ে ঘুমাতে পারলি মহা খুশি। যেন কত কাল ঘুমায় না। ও নিজেও কাপড় কাঁচে, যে টাকা পায় তাও আমার জন্যিই খরচা করে।

এসব কথা চাঁদমালার সাক্ষাতেই হলো। প্রত্যুত্তরে কোনো কথা বলা দূরের কথা, যেন সে শুনতেই পায়নি এমনিভাবে ঘরের যে কাজটুকু অবশিষ্ট ছিলো তা করে একটা কালি-পড়া টোল-খাওয়া কেটলি নিয়ে চলে গেলো আবার।

মাধাই বললো, ফতেমা, এবার তোমাদের যাওয়া লাগে।

কেন্‌? চাঁদমালা কি রাগ করবি?

তা করে মিয়েমানুষরা, কিন্তুক চাঁদমালা তা করবি নে। মুখ দেখে মনে হয় আজ সারাদিন তোমাদের খাওয়া হয় নাই। এখন বাড়ি যায়ে সেসব করো গা। যখন কাঁদে কাঁদে ভগোমানেক ডাকতেছিলাম তখন আসে বড়ো ভালো করছিলা। আমাক জানা থাকলো, আমার মড়া শিয়াল কুকুরে খাবি নে।

এমন কথা কয়ো না। চাঁদমালা যদি তোমার বউ, তবে তোমার চিকিচ্ছা করায় না কেন?

মাধাই একটু চিন্তা করে বললো, চিকিচ্ছা করায়ে কীহবি, তাতে কি আমার চাঁদমালা সারবি?

বুঝতে না পেরে ফতেমা বললো, চাঁদমালার কী হইছে?

মাধাই যা বলতে চেয়েছিলো সেটা বলার আর চেষ্টা করলো না সে। কথাটা বলেই বরং অকারণে কটু কথা বলার অনুশোচনা হলো তার। চাঁদমালাকে রোগজ্ঞানে পরিত্যাগ করার কোনো না যুক্তিই এখন আর নেই তার পক্ষে।

কিন্তু ফতেমা যেন একটি যুদ্ধক্ষেত্রে এসে দাঁড়িয়েছে। এখানে নির্মম ও ভয়লেশশূন্য না হলে চলবেনা, এমনি ভঙ্গিতেই সে বললো, ভাই, তুমি চাঁদমালায় সুখ পাতেছো না আর। সে তোমার মুখ দেখে বুঝবের পারি। সুরোকে নিয়ে থাকো। দুইজনাই সুখী হবা।

কথাগুলো শুনে উদ্যত কান্না নিয়ে চোখ-মুখ আড়াল করলো সুরতুন কিন্তু তার মনে হলো যেন বলপ্রয়োগ করা দরকার কোনো কোনো বিষয়ে। ফতেমা ঠিকই বলছে, এখন আর চুপ করে থাকার সম

উত্তর দিতে সংকোচ বোধ হয়েছিলো মাধাইয়ের, পরে সে বললো, এখন আর তা হয় না। কিন্তু সে লক্ষ্য করলো সুরতুনও তার মুখের দিকে চেয়ে আছে। এতক্ষণে একটি কথাও সে বলেনি। সে তখন বললো, আয় সুরো, আমার কাছে আয়।

দিনের আলোয় আর পাঁচজনের চোখের সম্মুখে প্রিয়জনকে আদর করায় রুচিহীনতাই সূচিত হয়। কিন্তু এটা যেন কোনো সন্ন্যাসীর নিস্পৃহতা এবং ঔদাস্য, সাধারণের হিসাবে যা মাপা যায় না। ফতেমা, এমনকী ইয়াজ পর্যন্ত অত্যন্ত আগ্রহের দৃষ্টি দিয়ে মাধাইয়ের এ ভঙ্গিটিকে সমর্থন করতে লাগলো।

সুরতুনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মাধাই যেন বলীয়ান হয়ে উঠলো। তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। যেন সে হাসতেও পারে এমন ভঙ্গি করে বললো, এক জোয়ানের গল্প জানো না? সারা দেশে সব চায়ে বড়ো জোয়ান হবি বলে সে কী কী খাতে। কিন্তু কোবরেজমশা যা কইছিলোতার চেয়ে বেশি খাতে লাগলো, তার পরে তার মাংস চামড়া খসে খসে গেলো। আমিও খুব সুখ চাইছিলাম, ফতেমা, আমারও তেমন অবস্থা।

কী কও বুঝি না।

মাধাই হেসে বললো, দ্যাখো তে কি বোকা আমি! মনকে ভালো করতে চাইছিলাম। শরীল আমাক মারে খুন করছে।

ফতেমা বললো, তোমার এ সকল কথা বুঝি না। কী অসুখ তোমার, তাই কও। আর পুরো যদি যত্ন করবি সে-অসুখ সারে না কেন্ তাই কও।

বুনেক তা কওয়া যায় না। ডাক্তার উপর-উপর সারায়ে দিছে, কিন্তু জানি, সারা শরীলে সে-বিষ ছড়ায়ে আছে। রাতে ঘুম নাই। সুরোক সে বিষ দিয়ে কী হবি?

সুরতুন একাগ্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মাধাইয়ের মুখের দিকে চেয়ে আছে। তার তখন মনে হলো মাধাইয়ের নাকটি যেন কিছু বিকৃত, তার মুখের ত্বক যেন কোথাও কোথাও সংকুচিত। কিন্তু এ তার চোখের ভুলও হতে পারে। সারা দেহে বিষ ছড়িয়ে গেছে, এ কিছুতেই বিশ্বাস করা যায় না। আর হাসির কথা ভাবো যা একটু আগে মাধাইয়ের মুখে ফুটে উঠেছিলো। সুরতুনের মুখ একটি আকস্মিক হাসিতে ঝলমল করে উঠলো; সে বললো, কে, বায়েন, সেই ভাসান পালাগানে কার যেন গায়ের চামড়া খুলে খুলে গিছিলো, তারপর তো জোড়া লাগছিলো।

পালাগানের কোনো চরিত্রের কথা নয়। মাধাইয়ের গল্পটার পাল্টা আর একটা গল্প বলা, যার বীজ মাধাইয়ের কথা থেকেই সংগ্রহ করেছে সে। তবু সুরতুনের মুখের হাসি ও তার গলার সুরে একটা গোটা পালাগানের সবটুকু রস সঞ্চিত।

ফতেমা যেন আশ্বাসে সোজা হয়ে বসলো।

কিন্তু বিমূঢ় ভাবটা সাময়িক। মাধাই বললো, যাও, যাও। আমি কি পাথর? অমন করে লোভ দ্যাখাও কেন্? কী লাভ? কী লাভ? কিছুক্ষণের মধ্যেই মাধাই কেঁদে কেটে ফুঁপিয়ে অত্যন্ত অস্থির হয়ে পড়লো। শুধু সুরতুন নয়, জীবনও তার আওতার বাইরে চলে গেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *