২৩. ইতিহাসের এ অধ্যায়কে

ইতিহাসের এ অধ্যায়কে মুঙ্‌লার বিবাহ-খণ্ড বলা যেতে পারে। কিছু জমিজমা হস্তান্তর হবে এমন খবর এনেছিলো ছিদাম। এমন সব খবর আজকাল তার কাছে

সবসময়েই পাওয়া যায়। এমন নয় যে সে জমি কিনবে। তার চাইতে তীক্ষ্ণ দৃষ্টির অভাব থাকতে পারে অন্য অনেকের, কিন্তু তাদের ক্রয়ক্ষমতা আছে। আলেফ সেখ, ছমিরুদ্দিন, গহরজান, মিহির সান্যাল ছাড়াও মুকুল রায় আছে, রেবতী চক্রবর্তী আছে।

কেষ্টদাস বললো, ছিদামের কাছেই শোনেন।

রামচন্দ্র বললো, ছেলেমানুষ কী বলতে কী শুনছে।

ছিদাম ঘরে ছিলো, সে বললো, না জ্যাঠা, খবর ঠিক। সানিকদিয়ারের সকলেই জানে মহিম সরকার জমি বেচবি।

কেন, তার কীসের অভাব? শুনি তার আট বেটা পাঁচ মিয়ে সবাই বাঁচে।

তা আছে। তার সকলের ছোটোমিয়ের বিয়ে দিবি, তাই নাকি জমি বেচবের চায়। কয় যে কবে আছি কবে নাই। তখন ছোটোমিয়ের বিয়ে তার দাদারা দিবি কিনা দিবি, ঠিক কী। তা ছোটোমিয়ের নামে চৌদ্দ বিঘা জমি লেখা আছে, সে জমি বেচে নগদ টাকা করে ধুমব্রাকে বিয়ে দিবের চায়। এক পাত্র নাকি জুটছে।

ছিদাম কাছে এসে বসলো। তার কাছে জমিজিরাতের খবর ছাড়াও গ্রামের সাধারণ খবরও পাওয়া যায়, বিশেষ করে কোথায় কোন অন্যায় অবিচার হচ্ছে তার লম্বা ফর্দ। রামচন্দ্র ও কেষ্টদাস কচিৎ কখনো প্রতিকারের পথ বাৎলায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে চুপ করে থাকে। একদিন কেষ্টদাস রাগ করে বলেছিলো, না রে বাপু, যত রাজ্যের লোক তোর কাছেই বা লাগায় কেন্ এত কথা। নালিশ করার লোক কি তাদের নাই আর?

এ ধরনের কথায় ছিদাম অপ্রতিভ হয় না। সে হয়তো বলে বসে, যা-ই কও, চিতে সা আবার শয়তানি লাগাইছে, তার জোগানদার ছমিরুদ্দিন না আলেফ সেক বুঝি না। বেশি দাম হলিও এতদিন জিনিস পাতে, এখন পাও না কে?

আজ ছিদাম সেসব কথা বললো না। মহিম সরকারের জমিজিরাতের কথা নিয়েই মশগুল হয়ে রইলো।

রামচন্দ্র ছেলেমানুষকে ঠাট্টা করার সুরে বললো, তুমি যদি নেও জমি, দামদস্তুর করতে পারি।

আমি! ছিদাম হেসে ফেলো। দাম শুনি তিন হাজার।

বাড়িতে ফিরে রামচন্দ্র দেখলো বাইরের দিকে কেরোসিনের কুপির আলোয় বসে মুঙ্‌লা গোরুর জন্য খড় কুচোচ্ছে। রামচন্দ্রর স্ত্রী সনকা দিনের বেলাতেই রান্নার কাজ শেষ করে রাখে। চাঁদের স্নান আলো ভিতরদিকের বারান্দায় যেখানটায় পড়েছে সেখানে নিঃসঙ্গ সনকা নীরবে বসে আছে। কোনো কাজ নেই, নিজেকে ব্যাপৃত রাখার জন্য কোনো অকাজের কাজও সে আবিষ্কার করেনি। চিরদিনই সে স্বল্পভাষী। সংসারের আঘাতে সে আরও অন্তর্মুখী হয়ে গেছে। দিনের বেলায় সংসারের কাজ থাকে, পাড়াপড়শী দু’একটি স্ত্রীলোক আসে। কিন্তু সন্ধ্যার পর রামচন্দ্র কথা বলার জন্য কেষ্টদাসের বাড়িতে কিংবা অন্যত্র যায়, মুঙ্‌লা নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তখন স্তব্ধতাই সনকার সঙ্গী। রামচন্দ্র নিরুপায়। পুরুষ হয়ে স্ত্রীকে সঙ্গ দেওয়ার অর্থ, মন ও দেহ দুটিকেই নষ্ট করা। বোষ্টমরা স্ত্রীদের সাহচর্য দেয় বলেই তারা পৌরুষহীন।

গায়ের জামাটা ঘরে খুলে রেখে এসে রামচন্দ্র বললো, আসলাম। রামচন্দ্রর স্ত্রী উঠে দাঁড়ালো, মুঙ্‌লার কাছ থেকে কুপি চেয়ে এনে রামচন্দ্রর হাত-পা ধোবার জল, গামছা, খড়ম এগিয়ে দিলো।মুঙ্‌লা এসব কাজে তার শাশুড়ির সহায়তা করে। সে তামাক সেজে এনে দিলো। বারান্দার নিচু জলচৌকিটায় বসে তামাক খেতে খেতে রামচন্দ্র লক্ষ্য করলো কুয়োতলায় দাঁড়িয়ে মুঙ্‌লা হাতমুখ ধুচ্ছে। সনকা কুপি নিয়ে রান্নাঘরে ভাত বাড়তে গেছে।

আজই আকস্মিকভাবে চোখে পড়লো তা নয়, এর আগেও এসব লক্ষ্য করেছে রামচন্দ্র। বাড়িটার চেহারা আর ফিরলোনা, যদিও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঘরে আবার ধান উঠেছে। দুর্ভিক্ষের ক্ষতচিহ্নের মতো শোকটা রয়েই গেলো। সনকা কিন্তু একটি অদ্ভুত কথা বলেছিলো একদিন। বাল্যকালে তার দুরন্তপনায় রুষ্ট হয়ে এক প্রতিবেশী বলেছিলো তার মাকে-সনকানাম রেখেছে আহ্লাদ করে, ওর ভাগ্য সনকার মতোই হবে। এ যেন এক ধরনের সান্ত্বনা যে এই সন্তানশোক তার ভাগ্য-নির্ধারিত, যেমন তার নাম সনকা হওয়া, কিংবা রামচন্দ্রর মতো প্রচণ্ড স্বামী পাওয়া।

একরাত্রিতে রামচন্দ্র স্ত্রীকে বললো, মহিম সরকার যে কী হয় তোমার?

বাপের পিসাতো ভাই।

শুনছি নাকি সে তার ছোটোমিয়ের বিয়ে দেয়।

তা দেওয়া লাগে। চোদ্দ পনরো বছর হলো বোধায়।

অন্যের ছেলেমেয়ের বিয়ের কথা শুনলে নিজের ছেলেমেয়ের বিয়ের কথা বয়স্ক লোকদের মনে হয়। কিছুকাল বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে রামচন্দ্র বললো, কে, তোমার মুঙ্‌লার আবার বিয়ে দিতে হয় নাকি?

তা কি আর আমি দিবো? তুমি শ্বশুর, তার বাপ এখনো বাঁচে।

এরপরে অনিবার্যভাবেই মেয়ের কথা মনে পড়লো। দুজনের দীর্ঘশ্বাস দুজনের কানে গেলো। রামচন্দ্রর মনে হলো একটি ছোটোবউ এসে যদি এ-বাড়ির ঘর-দরজায় ঘুরঘুর করে বেড়ায় তাহলে সনকার নিঃসঙ্গতা কিছু কমে।

কাজকর্ম আজকাল কম। মহোৎসবের জন্য যে-চাদরটা মুঙ্‌লা তার জন্য কিনে এনেছিলো সেটা কাঁধে ফেলে অনির্দিষ্ট গতিতে পথ চলতে চলতে সে একদিন সানিকদিয়ারের পথ ধরলো। নিজে সে চিকন্দির অধিবাসী হলেও তার অধিকাংশ জমি সানিকদিয়ারে। কাজেই সানিকদিয়ারে তার যাওয়া-আসা আছে। সানিকদিয়ারে পৌঁছে তার মনে হলো–এখানে কেন এলাম। সে কি এখন হাজিসাহেবের বাড়িতে যাবে? না, তার দরকার নেই। সেখানে ছমিরুদ্দিনের সঙ্গে দেখা হতে পারে এবং কমিটির কথায় অপ্রিয় কথা উত্থাপিত হতে পারে। ছমিরুদ্দিন জানে ছিদাম ও মুঙ্‌লার দল আজকাল ফুড় কমিটি নিয়ে বিরূপ সমালোচনা করছে। এরপর তার মনে হলো,

সে মহিম সরকারের বাড়িতে যাবে। সেখানে খবর আছে।

মহিম সরকারের বাড়িতে পৌঁছতেই সে সমাদৃত হলো। মহিম সরকার নিজে এগিয়ে এলো।

আসেন, জামাই।

রামচন্দ্র নমস্কার করে বললো, ভালো আছেন, কাকা? আসলাম একটু খোঁজখবর নিতে।

প্রাথমিক আলাপ-আলোচনার পর গালগল্প হলো। বেলার দিকে লক্ষ্য রেখে রামচন্দ্র বললো : এবার উঠবের হয়।

তাও কী হয়? ছান-আহার এখানেই হবি। আমি লোক পাঠায়ে মিয়েক খবর দিতেছি। রামচন্দ্র ‘না’ ‘না’ করতে মহিম সরকার তার ছোটোছেলেকে ডেকে বললো, এঁয়াক চেনো, বলাই? তা না-চেনো, চিকন্দির রামচন্দ্র মণ্ডলের বাড়িতে যায়ে কয়ে আসো মহিম সরকার, কয়েছে জামাই এ-বেলা তার বাড়িতে থাকবি। মহিম সরকারের ছোটো ছেলে রামচন্দ্রর দিকে চোরাদৃষ্টিতে তাকাতে তাকাতে চলে গেলো।

স্নানাহারের পর রামচন্দ্র বললো, কাকা, জমি নাকি বেচেন?

না। মিয়ের বিয়ে দিতে হবি। তা এক পাত্র পাই শহরে। ভাবছি, মিয়ের নামে জমি, সে কি আর শহর থিকে ভোগ করবের আসবি? তার চায়ে নগদ টাকা করে দিবো। কে জামাই, জমি নিবেন? তা নিলেও সুখ পাই। ভাববো, এক জামাই না নেয়, আর এক জামাই নিছে; জমি ঘরের বার হয় নাই। কিন্তুক’

কী কিন্তুক, কন্ জামাই। জমি নিবের চায় ছমিরুদ্দিন, সে শাসায় অন্য কেউ আগালে। আমি ভাবছি ছমিরেক আসবের দেবো না আমার জমির পাশে। ঐ জমিটুকের এক লপ্তে আমার আর দুই মিয়ের জমি আছে। পাশে ছমিরুদ্দিন জমি নিলে মামলা কাজিয়া হবের পারে।

কিন্তুক—

রামচন্দ্রর কিন্তুকের অর্থ তিন হাজার টাকা ধাঁ করে বের করে দেবে এমন ক্ষমতা তার নেই। আর তাছাড়া দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে এক কাঁধে জমি আর এক কাঁধে ঋণ নিয়ে আগেকার মতো চলার দুঃসাহসও যেন তার কমে গেছে।

রামচন্দ্র বসে বসে গোঁফ পাকাতে পাকাতে হঠাৎ বলে ফেলো, কেন, কাকা, এমন জামাই যদি হয়, মিয়ে আপনার চোখের উপরে থাকে, জমি আপনার বেচা লাগে না।

জমি কে বেচবের চায়? মিয়ে চোখের উপরে থাকে জমি ভোগ করবি এমন জামাই কনে পাই?

কাকা, মুঙ্‌লা দেখছে?

মুঙ্‌লা?

হয়, মুঙ্‌লা।

যে-মুঙ্‌লার তুমি বাপ হইছে?

তার বাপ এখনো বাঁচে।

তাইলেও, তোমার জমিজিরাত দ্যাখে সেই ছাওয়াল?

হয়।

হুম। মহিম সরকার তার ডাবা হুঁকোয় মুখ দিয়ে মুহুর্মুহু ধোঁয়া টানতে লাগলো। তারপর ‘ধরেন’ বলে হুঁকোটা রামচন্দ্রর হাতে দিয়ে বাড়ির ভিতরে চলে গেলো। প্রায় পনরো মিনিট পরে

মহিম ফিরলো। তার সঙ্গে তার সাত ছেলে।

মহিম সরকার বললো, কিন্, জামাই, মুঙ্‌লার কথা কী কবেন।

কী আর কবো। তার বাপ বাঁচে। মুঙ্‌লা আমার কাছে থাকে।

মহিম সরকারের বড়োছেলে বললো, লোকে তো জানে মুক্ল আপনের ছাওয়াল।

তা কয় লোকে।

মহিম সরকারের মেজোছেলে বললো, মানুষ বলাবলি করে আপনের সম্পত্তির সেই হার।

তা কউক, মিথ্যা কী কয়?

মহিম সরকার বললো, মুঙ্‌লার বিয়ে দিবেন, জামাই?

না দিয়েই বা কী করি, কন্।

রামচন্দ্র বিকেলের দিকে বাড়ি ফিরলো। পথে কথাটা সে ভাবলো। এ কথা স্পষ্ট কোথাও উচ্চারিত হয়নি যেমুঙ্‌লার সঙ্গে মহিম সরকারের মেয়ের বিবাহের সম্ভাবনা আছে, কিন্তু রামচন্দ্র মুঙ্‌লার কথা উত্থাপন করেছিলো এবং মহিম সরকার সপুত্রক তাকে প্রশ্নাদি করেছিলো এই সম্ভাবনাকে সম্মুখে রেখে। রামচন্দ্র ব্যাপারটাকে দুদিন গোপন করে রাখলো, তারপর স্ত্রীকে বললো, এমন বিয়ে হয় নাকি?

একদিন গোরুগাড়ি করে সনকা মহিম সরকারের বাড়িতে গিয়ে একবেলা কাটিয়ে এলো, আর একদিন দুই বেটা বউকে সঙ্গে নিয়ে সস্ত্রীক মহিম সরকার রামচন্দ্রর বাড়িতে এলো। এরপরে একদিন রামচন্দ্র মুঙ্‌লার বাবার কাছে গিয়ে অনেক আলাপ করে এলো। তারপর রাষ্ট্র হলো মহিম সরকারের ছোটোমেয়ের সঙ্গে মুঙ্‌লার বিবাহ হচ্ছে।

বিবাহের তখনো কিছু দেরি আছে। একদিন ছিদাম এসে অত্যন্ত ভক্তিসহকারে রামচন্দ্রকে প্রণাম করলো। রামচন্দ্র ‘আহা-হা, করো কী, করো কী বলতে বলতে ছিদাম প্রণাম সেরে উঠে দাঁড়ালো। রামচন্দ্র তাকে শাসনের ভঙ্গিতে কাছে টেনে নিয়ে বললো, গোঁসাই অধিকারীর ছাওয়াল হয়ে আমার পায়ে হাত দেও, এ কী কথা?

কেন্‌, জ্যাঠা, আপনে আমার জ্যাঠা হবের পারেন না?

এ কথা কও যে।

গাঁয়ের লোকে কয়–

কী কয়?

এমন পাকা বুদ্ধি আর কারো দেখি নাই, একটানে পনরো বিঘা জমি ঘরে উঠলো। ছিদামের ভঙ্গিতে চপলতা ছিলো কিন্তু রসিকতা ছিলো না। সে যেন পথের উপরে দাঁড়িয়ে পথপ্রদর্শককে শ্রদ্ধাভরে প্রণাম জানাতে গিয়ে আলোক-বিহ্বল হয়ে মন্ত্রের গাম্ভীর্য ভুলে গেছে।

মাসদুয়েকের মাথায় বিবাহের দিনটি এসে পড়লো। দিঘা থেকে ভাড়াকরা ডে-লাইট এনে, সানিকদিয়ারের জীবন ঢুলির ডোল-ডগর বসিয়ে, গাঁয়ের লোকজনকে আদর-অভ্যর্থনা করে বউ ঘরে তুলো রামচন্দ্র। বিবাহের দিনেই কাগজে কাঁচা লেখার কাজ শেষ হয়েছিলো, তিন-চার দিন পরে দুখানা গোরুগাড়ি করে রামচন্দ্র ও মহিম সরকার সদরে গিয়ে সম্পত্তি রেজেস্ট্রি করে এলো।

মুঙ্‌লার বাবা এসেছিলো। যে শিশু-মুঙ্‌লাকে রামচন্দ্রর হাতে প্রায় দত্তকের মতো সে অর্পণ করেছিলো তাকে দেখে চিনতেই পারলো না চট করে। তার পরিচয় পেয়ে মহিম সরকার অবশ্য তাকেও যথাযোগ্য সমাদর করেছিলো।

কিন্তু হুঁশিয়ার মহিম সরকার।নগদ খরচ করতে নারাজ। বরযাত্রীদের ভালো করে খাওয়ালো সে, গহনার অধিকাংশ রামচন্দ্রকেই দিতে হলো। কিছু ঋণ হলো তার।

মুঙ্‌লার বউয়ের নাম ভান্‌মতি । মহিম সরকারের নিকষ কৃষ্ণ রং পায়নি সে কিন্তু দেহগঠন পেয়েছে। অত্যন্ত স্বাস্থ্যবতী মেয়ে। চোদ্দ-পনরো বছর বয়স হলো, কিন্তু পূর্ণতায় তাকে বিশ বছরের বলে ভুল হয়। প্রথম দিন যখন সে নববধূর পোশাক ছেড়ে সংসারের কাজে নামলো, সনকা তাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠেছিলো।

ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পারলেও আরো ভালো করে জানার জন্য ভান্‌মতি মুঙ্‌লাকে জিজ্ঞাসা করলো, তোমার মা কাঁদলেন কে?

বলা উচিত কিনা এই ভেবে মুঙ্‌লা চুপ করে রইলো।

ভান্‌মতি আবার বললো, আমি আসে কি খারাপ করলাম?

এ অবস্থায় মুঙ্‌লার বয়সের একটি ছেলে যেমন করে পারে তেমনি করেই মুঙ্‌লা বললো, তুমি এ বাড়িতে আলো আনছো।

ভান্‌মতি সুর বদলে বোকার অভিনয় করে বললো, হয়, বাবা তোমাক একটা বিলেতি হারিকেন দিছে।

ঘরের কোণে একটা নতুন হারিকেন মৃদুভাবে জ্বলছিলো। সেটাকে দেখিয়ে ভান্‌মতি খিলখিল করে হেসে উঠলো। কিন্তু মুঙ্‌লা হাসিতে যোগ দেওয়ামাত্র শাসনের ভঙ্গিতে বললো পাশের ঘরে ওনারা আছেন।

কিছুপরে ভান্‌মতি বললো, শ্বশুরেক দেখলে ভয় করে কিন্তুক আমার শাশুড়ির মতো মানুষ আর কনে পাবো। আমার বউদিদিদের চাইতে অনেক ঠাণ্ডা।

.

কিছুদিন যেতে না যেতে অসুবিধা হলো ছিদামের। কিছুদিনের মধ্যে সে আর মুঙ্‌লা সুহৃৎ মিত্রই হয়নি, অবিচ্ছেদ্য সঙ্গীও হয়েছে। গ্রামের পথে একজনকে দেখলে আর-একজনকে যে কাছাকাছি পাওয়া যাবে তা আন্দাজ করে নেওয়া চলে। সেই মুঙ্‌লা এমন হলো যে নিজে থেকে আসে না, ডেকে আনলে ছটফট করে।

একদিন ছিদাম কথাটা পদ্মকে বললো, কে, এমন হয় কেন?

পদ্ম কিছু না বলে হাসলো।

ছিদাম বললো, এবার ধান রোপার কী করবো ভাবে পাই না।

কে, গতবার কি আমি পারি নাই?

পারছো, লোকে কিন্তু ভালো কয় নাই।

পদ্ম একটু ভেবে বললো, ধান রোপার সময় সে আসবি। তার খেতের জন্যি তোমাকে ডাকবি।

কিন্তু এসব মনোভাব প্রকাশের দুর্বল চেষ্টামাত্র। ছিদাম বাল্যে মাতৃহারা। পিতা উদাসীন। পদ্মর কাছে সাহচর্য ও স্নেহ পেয়েছে বটে কিন্তু মুঙ্‌লার কাছে যা পেয়েছে তার তুলনা হয় না। বুক ভরে ওঠার, শরীরে শক্তি এনে দেওয়ার মতো কিছু অন্য কেউ দেয়নি তাকে। সারাদিন একত্রে কাজ করেছে তারা, তবু ছিদামের ধান পৌঁছে দিয়ে যখন মুঙ্‌লা বাড়ি ফিরবে বহুদিনের অদর্শনের পর যেমন হতে পারে, তেমনি করে দুজনে দুজনকে প্রগাঢ় আলিঙ্গনে বদ্ধ করেছিলো। এটা একটা সূচক ঘটনা।

একদিন পদ্ম বললো, ছাওয়ালের বিয়ের কথা ভাবো নাকি?

কেষ্টদাস বললো, ভাবে কী করি!

ছাওয়ালের মন খারাপ তাই কলাম।

কারণটা কেষ্টদাস বুঝতে পারলো কিন্তু উদাস ভঙ্গিতে সে বললো, আমি কি রামচন্দ্র, যে নাম শুনলে মিয়ে নিয়ে আসবে লোকে?

কানাঘুষায় কথাটা শুনে ছিদাম কিন্তু পদ্মর উপরে রাগ করলো।

বিয়া দিবা? চৈতন্য সার ধার এখনো শুধি নাই। খাবা কী? পরবা কী?

কথাটায় পরুষ সুর থাকায় পদ্ম হকচকিয়ে গেলো, একটু অপমানিত বোধ করলো সে। কিন্তু ছিদাম যখন চলে যাচ্ছে তখন তার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে পদ্মর মনে হলো : কথাটা ও মিথ্যা বলেনি। যদি শক্তিহীন পিতা এবং নিঃসম্পর্কিত একটি স্ত্রীলোককে প্রতিপালনের ভার ওকে বইতে না হতো তবে নিজের মনের মতো একটি স্ত্রী নিয়ে গৃহী হবার পক্ষে ওর শক্তি যথেষ্টই আছে। মনের গভীরতর স্থানে প্রবেশ করে পদ্ম স্থির করলো, দুইটি পুরুষের স্ত্রী হয়ে কালযাপন করার পর তার বোঝা উচিত ছিদামের মনের অবস্থাটা কী হতে পারে। কোনো কড়া কথা ছিদামকে বলা উচিত নয়, আর বোধহয় একটু হেসে কথা বলা উচিত।

সে খানিকটা বা অভিনয় করে, কিছুটা বা হৃদয়কে প্রসারিত করে ছিদামের বন্ধু-বিরহ দূর করতে চেষ্টা করলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *