১৭. নৃপনারায়ণের চিঠি এসেছে

নৃপনারায়ণের চিঠি এসেছে–এ সংবাদটা অনসূয়া পেলেন রূপুর মুখে। এ চিঠি রোজ আসে না। নৃপনারায়ণ বলেছিলো–যে চিঠি অন্য লোকে পড়ে, যার যাওয়া-আসা অন্য কারো মর্জির উপরে নির্ভর করে তার আদান-প্রদান বন্ধ থাক। মা চোখের জল চেপে বলেছিলেন–কোনো পক্ষ অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়লে এর ব্যতিক্রম করতে হবে।

চিঠির খবরে অনসূয়া বিচলিত হলেন সুতরাং। নৃপ কি রাজরোষমুক্ত হয়ে চিঠি দিতে পেরেছে কিংবা সে কি অসুস্থ? একটি আনন্দের আশা এবং একটি আশঙ্কার দুশ্চিন্তায় তিনি বললেন, তুই তো খুব দুষ্টু হয়েছিস রূপু; কই, চিঠি দে।

‘তোমাকে কী করে দেবো? বউদির চিঠি যে।

ও। অনসূয়া খবরে কাগজের পাতা ওল্টালেন।

রূপু তবু দাঁড়িয়ে রইলো।

অনসূয়া বললেন, আর কিছু বলবি?

দাদা ভালো আছে, মা। নাগপুরের কাছে কোথায় অন্তরীণ হয়ে আছে। বউদি বললেন তোমাকে খবর দিতে।

মনে হলো অনসূয়া কিছু বলার জন্যই মুখ তুললেন, কিন্তু কিছু না বলে উঠে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন, রূপু, রামনন্দনকে একটু ডেকে দিয়ো। মণিমালার বাড়িতে যেতে হবে।

ঘণ্টাখানেক পরে রূপু সদর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দেখলো–রামনন্দন খাজাঞ্চিখানা থেকে কামদার ঝালর এনে পাল্কির ছাদের উপরে বিছিয়ে দিতে দিতে অন্দর থেকে অনসূয়াও বেরিয়ে এসে পাল্কিতে চড়লেন। রামনন্দন আর তার ছেলে পাল্কির দু পাশে চলতে লাগলো।

মণিমালার বাড়িতে যাবার কথা ছিলো বটে; কথাটা ছিলো রূপুও সঙ্গে যাবে। অনসূয়া রূপুকে বলতেই যেন ভুলে গেলেন।

সদানন্দ মাস্টার সাতদিনের জন্য অন্যত্র গিয়েছে। রূপুকে সে সাত দিন ছুটি দিয়ে গেছে। বিকেলের দিকে রূপু পায়ে পায়ে সুমিতির ঘরে গিয়ে দাঁড়ালো, সুমিতি তখন ব্যালকনিতে বসে একটা সেলাই নিয়ে ব্যস্ত ছিলো।

এসো, ছোটোবাবু। মা বুঝি নিয়ে গেলেন না?

তা নয় ঠিক। ছুটি আছে, বেড়াতে গেলে ভালোই হতো।

চলো না হয় দুজনে বেরিয়ে পড়ি।

যাবে তাই? যতক্ষণ না পাল্কি ফিরতে দেখি চলতে থাকবো। মার সঙ্গে সঙ্গে ফেরা যাবে।

মন্দ কী, এখানে এসে এসে এ পর্যন্ত বেরুইনি।

আমি আসছি। বলে রূপু চলে গেলো।

প্রস্তাবটা করার সময়ে সুমিতি হাল্কাভাবেই বলেছিলো, কিন্তু রূপু যখন অত তাড়াতাড়ি কথাটাকে কার্যকরী করতে ছুটলো তখন তাকেও কাপড় পাটে প্রস্তুত হতে হলো।

ঘর থেকে বেরুতে সুমিতি বললো, তোমার ভয় ভয় করবে না তো?

আমার? কেন?

আমার একদিন করেছিলো, যেদিন প্রথম গ্রামে আসি। বললো সুমিতি।

রসো, আসছি। বলে কথার মাঝখানে রূপু দৌড়ে চলে গেলো।

রূপু একটি রিভলবার নিয়ে ফিরে এলে সুমিতি বললো, ও কী, ও তুমি চালাতে জানো নাকি?

এটা টিপলেই চললো।

সুমিতি কপট গাম্ভীর্যে বললো, তাহলে তো বড়ো ভালো জিনিস। কিন্তু এ তোমাদের বাড়িতে আছে, এ যে বিশ্বাসই হয় না। আর থাকলেই-বা তুমি পেলে কোথায়?

ফিরে এসে বাবাকে বলবো, তাঁর দেরাজ থেকে নিয়েছি। তখন দেখো তিনি খুশি হবেন। তুমি সঙ্গে আছো বলেই ভাবনা।

তা বটে। সুমিতি গম্ভীর হয়ে রূপুর ভবিষ্যৎ দৃষ্টিকে ধন্যবাদ দিলো, পরক্ষণেই বললো, কিন্তু কথাটা ভাবো। যার দাদা রাজদ্রোহী বলে অন্তরীণ, তার হাতে রাজা রাখছে বিপ্লবের অস্ত্র। এরাজ্যে এও সম্ভব।

রূপু পরিহাসের সুরটুকু ধরতে পারলেও সহসা উত্তর দিতে পারলো না। তার মনে পড়লো এরকম কথা একবার সে মামার বাড়িতে গিয়েও শুনেছিলো। সেখানে কথা হয়েছিলো-ভাগ্নে বিপ্লব করে বেড়ায় আর মামা করেন রাজ্যরক্ষা। সান্যালমশাইয়ের পরিহাস থেকেই কথাটা উঠেছিলো। সুমিতির পরিহাসটা প্রায় সেরকম বলে ঘটনাটা মনে পড়লো রূপুর। সে বললো, আমার যেন মনে পড়ছে আমাদের বন্দুকগুলোর লাইসেন্স নিয়ে মাঝে মাঝে কী গোলমাল হয়, আর নায়েবমশাই সদরে ছোটেন। তারপরে সব ঠিক হয়ে যায়।

নায়েবমশাই সেখানে গিয়ে কী বলেন তা কি জানো?

অবশ্যই আত্মরক্ষার কথা বলেন।

এমন যদি হয়নায়েবমশাই তোমার দাদার চাল-চলনের সংবাদ দিয়ে তার বিনিময়ে লাইসে ঠিক রাখেন?

তা কখনো হতে পারে?

পারে।নায়েবমশাই জমিদারির কাজে যা সব করেন তার সবগুলো ন্যায়সংগত নয় এ তো তুমিই বলেছো। সুমিতির লুকোনো হাসি রূপুর চোখে ধরা পড়লো না।

তাহলেও–আচ্ছা, আজই আমি বাবাকে জিজ্ঞাসা করবো।

কী সর্বনাশ! লক্ষ্মীভাই!নায়েবমশাই প্রকৃতপক্ষে অতি ভালোমানুষ এতে আর সন্দেহ কী? তার চাইতে এ আমরা কোথায় এলাম তাই বলল। ডান দিকে তো তোমাদের বাগানই চলছে। বাঁদিকে জঙ্গলটা কীসের? আমার মনে হচ্ছে তোমাদের সদর দরজা থেকে চারশ গজের মধ্যে এ জায়গাটায় পৌঁছেও আমার গা শিউরে উঠেছিলো। অবশ্য তখনো সদর দরজা চোখে পড়েনি।

এটাকে নিয়ে এক মুশকিল হয়েছে। কেটে উড়িয়ে দেওয়া যায় না, ওর ভিতরে একটা শিবমন্দির আছে। মাঝে মাঝে চারিদিকের জঙ্গল কেটে দেওয়া হয়, কিন্তু সবচাইতে উঁচু গাছগুলো মন্দিরের গা বেয়ে বেয়ে উঠেছে। সেগুলো কাটতে গেলে মন্দিরটাই ধসে যাবে।

ওখানে অনেক সাপ আছে নিশ্চয়ই।

তা হবে কেন? গাজনের সময়ে এবার দেখো। তার আগে থেকে দু-তিনদিন ওর ভিতরে গাজনের সন্ন্যাসীরা থাকে। সাপ থাকলে কি আর থাকতে পারতো। কিন্তু বউদি, কথাটা ভাবা দরকার, বাড়িতে বিপ্লবী থাকলেও বন্দুকের লাইসেন্স সবক্ষেত্রে থাকে কিনা।

আবার সেই কথা! আজ আমি গ্রাম চিনতে বেরিয়েছি।

কিছুটা পথ নীরবে চলে সুমিতি বললো, তোমাদের বাগানটাকে দেখে আমার একটা গল্প মনে পড়ে। এক রাজার বাগানের ভিতরের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে পথ যেখানে হারিয়ে গেছে সেখানে ছিলো এক দৈত্যের বাড়ি।

রূপু হা হা করে হেসে উঠলো।

বাঃ?হাসছো কেন? তোমার সমস্যাটাই আমি এতক্ষণ ভাবছিলাম অন্য কথা বলতে বলতে। তোমার দাদার বিপ্লব তো আর আগ্নেয়াস্ত্রের দুমদাম নয়। সেটা বলে কয়ে করা, ধীরে ধীরে ক্রমাগত এগিয়ে যাওয়া গান্ধিয়ানা। হাতে পেলেও বোমা ছুঁড়বে না তোমার দাদা, এ খবর রাজা রাখেন।

রূপুর মনে যে প্রশ্নটা উঠেছে এটাকে তার একটা সমাধান বলে মনে হয় বটে,তথাপি খানিকটা কৌতুকবোধ, কিছুটা কৌতূহলের মতো হয়ে প্রশ্নটা ভেসে বেড়াতে লাগলো।

কিন্তু রূপু স্থির করলো অনভিপ্রেত আলাপটা সুমিতির সম্মুখে চালিয়ে যাওয়াটা ভালো হবে না। সে বললো, বাগানের মধ্যে দৈত্যদের প্রাসাদ আছে এটা আমারই আবিষ্কার বলতে পারো। কয়েক বছর আগে বাগানের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিলাম আমি।

সুমিতি বললো, একদিন এক চাঙারি খাবার, আর এক ফ্লাস্ক’জল নিয়ে আমি আর তুমি তিন-চার ঘণ্টার জন্যে বাগনে হারিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করব।

সুমিতি ও রূপুর পথ এই জায়গাটায় গ্রামের অন্যতম প্রধান পথটিতে এসে মিশেছে। দু-একটি করে তোক চোখে পড়তে লাগলো। তাদের অধিকাংশই সন্ত্রস্তের ভঙ্গিতে পথ ছেড়ে সরে দাঁড়ালো, কিন্তু পথের পাশে দাঁড়িয়ে হাঁ করে চেয়েও রইলো সুমিতির দিকে। রূপু ফিসফিস করে বললো, সান্যালবাড়ির কোনো বউকে এমন কাছে ওরা কখনো দ্যাখেনি। আমি সঙ্গে না। থাকলে সঙের পেছনে ছেলের দলের মতো দল বেঁধে ওরা তোমার পিছন পিছন চলতো।

সুমিতি হেসে বললো, তাহলে আমি কী করতাম? ওদের সকলকে নিয়ে হাঁটতে পদ্মার জলে ডুব দিতাম?

হাসি থামাতে হলো,ওদের। পথটা এখানে মোড় নিয়েছে। মোড় ঘুরতেই ওরা দেখতে পেলো কয়েকজন কৃষক যাচ্ছে।

সুমিতি জনান্তিকের সুরে বললো, কী সর্বনাশ, দল বেঁধে যায় যে! হাতে লাঠি, কাঁধে নতুন গামছা সব!

তাতে কী হলো? ডাকাত?

ওরা কী বলে শোনো।

রপুরা শুনতে পেলো :

বুঝলা না মামু, ধামি একটা আমারও কেনা লাগবি।

এখন কি আর তেমন পাবা? বাঁশেরবাদার হাটে সেইবার আসছিলো কয়–যে শিলোটি ব্যাতের।

ধামি যৈ সৈ, চাচা, আমার মনে কয় হাঁসেও বানাতে হবি।

ভক্ত নাই। দিঘায় যাতে হবি।

নিজেদের কথায় মশগুল হয়ে এরা চলে গেলো।

রূপু বললো, শুনলে, ডাকাতরা কী বললো?

খুব সুখী বলে মনে হলো।

ধানের ছড়াগুলো দেখে অনেকেই এবার বলছে ধান খুব ভালো হবে।

প্রায় ঘণ্টাদুয়েক এ-পথ সে-পথ ধরে চলে শেষ যে-পথটা ধরে এরা চলছিলো সেটা এখানে এসে শেষ হয়েছে। সম্মুখে যাবার উপায় নেই তা নয়, কিন্তু বেলেমাটির পায়ে-চলা পথে হাঁটতে গেলে জুতোর সবটাই ধুলোয় বসে যাচ্ছে। অবারিত মাঠ, অধিকাংশ জমিতে ধানের চাষ। দূরে দূরে চার-পাঁচটি করে কুঁড়ের এক-একটি গুচ্ছ। এখানে মাটি ক্রমাগত নিচু হয়ে গেছে দিগন্তের দিকে। পদ্মার নীলরেখায় সীমাবদ্ধ সেই দিসীমান্ত। আকাশে রং লাগছে। সেদিকে চেয়ে থাকতে থাকতে মনে হয় আকাশ গড়িয়ে রঙের কয়েকটি স্রোতধারা পদ্মার দিকে নেমে আসছে।

এরা এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে দেখতে পেলো একটি পুরুষ এবং একটি স্ত্রীলোক। আসছে। সুমিতি বললো, আমাদের ছায়া নাকি?

রূপু দূর থেকে ঠাহর করে বললো, দারোগার কাছে রামচন্দ্রর জন্যে যে কেঁদেছিলো সেই পদ্ম বলে মনে হচ্ছে। সঙ্গেরটি ছিদাম, ওকেও চিনি, ও গান করে।

পদ্ম ও তার সঙ্গী এদের দেখতে পেয়ে থামলো। পদ্ম প্রণাম করার জন্য নিচু হচ্ছিলো, সমিতি বললো, এখানে নয়। কোথায় গিয়েছিলে?

পদ্ম বললো, এক হাল জমি আছে।

জমিতে তুমি কী করো?

পদ্মর সঙ্গী বলল, সখ করে গিছলো।

পদ্ম কিন্তু ঝিরঝির করে হেসে বললো, না, দিদিঠাকরুন, ছিদাম পরের ক্ষেতে খেটে বেড়ায়, নিজের জমিতে নিড়ানির কাজে মন থাকে না, তাই নিয়ে গিছলাম।

ছিদাম বললো, ও জমিতে তোমার সংসার চলে?

ওটুক নিজের তো।

কীর্তনের মাধ্যমে কৃষকদের মধ্যে একটা সাড়া এনে দেওয়ার জন্য সাধারণ কৃষকের চাইতে ছিদামকে বেশি পরিচিত বলে মনে হলো রূপুর। সে বললো, তুমি কি আরও বেশি জমি চাষ করতে পারো? তা যদি হয় একসময়ে কাছারিতে যেয়ো।

আজ্ঞে যাবো।

এদের আলাপে ছেদ পড়লো। হুম্ হুম্ শব্দ করতে করতে অনসূয়ার পাল্কিটা প্রায় এদের গায়ের উপরে এসে পড়লো। কথা বলতে বলতে এরা এতক্ষণ পাল্কির চাপা শব্দটা খেয়াল করেনি। পাল্কিকে পথ করে দেওয়ার জন্য সুমিতি ও রূপুকে পথ থেকে নেমে দাঁড়াতে হলো। আট বেহারার পাল্কিটা অত্যন্ত দ্রুতগামী সন্দেহ কী!

বেহারাদের পায়ে যে ধুলো উড়ছিলো সেটা একটু থিতোলে সুমিতি বললো, চলো, আমরাও ফিরি।

.

সুমিতি ও রূপু, তাদের পিছনে পদ্ম ও ছিদাম চলতে শুরু করলো। রূপু একসময়ে বললো, রোজ না হলেও মাঝে মাঝেই বেড়াতে বেরুলে কেমন হয় বউদি?

আশাতীত ভালো একটা কিছু হয়।

কিন্তু তখন তারা জানতো না তাদের এই বাইরে আসা কতদূর গড়াতে পারে। কিছুক্ষণ পরেই রামনন্দন ও রামপীরিত পথের পাশে কুর্নিশ করে দাঁড়ালো। সুমিতি ও রূপু তাদের পার হয়ে গেলেই পদ্ম ও ছিদামকে আড়াল করে তারা নিঃশব্দে পিছন পিছন চলতে লাগলো।

তখনো পথে অন্ধকার হয়নি, দু-একটি ঝিঁঝি ডাকতে শুরু করেছে মাত্র, তবু আর একটু দূরে একটি দাসী হিংকসের বড়ো একটা লণ্ঠন হাতে করে দাঁড়িয়ে আছে দেখতে পেলো রূপু। দাসী নিঃশব্দে সঙ্গ নিলো। এতখানি সতর্কতার কারণ খুঁজে না পেয়ে সুমিতি কুণ্ঠিত হলো।

.

রাত্রিতে আহারাদির পর্ব মিটে গেলে সুমিতি নিজের ঘরে বসে সকালের ডাকে আসা চিঠিটা আবার পড়ছে এমন সময়ে একজন দাসী এসে খবর দিলো অনসূয়া তাকে ডাকছেন।

সুমিতি অনসূয়ার ঘরে গেলে তিনি তাকে বললেন, তোমাকে একটা কথা কিছুদিন থেকেই বলবো ভাবছি।

অনসূয়া সঙ্গে সঙ্গে কথাটা না বলে হিসেবের একটা খাতায় চোখ বুলোতে লাগলেন। আঙুলের ডগায় হিসেব করে যোগটা ঠিক আছে দেখে খাতাটা সরিয়ে রেখে চশমা খুলে মুখ তুললেন।

সুমিতি, তুমি এ বাড়ির বড়োবউ।কতকগুলো ব্যাপারে তোমাকে তেমনি হয়েই চলতে হবে। এ কথাগুলো তোমাকে বলছি, এর মধ্যে আমার রক্ষণশীলতার লক্ষণ অবশ্যই দেখতে পাবে। আমার কিন্তু ধারণা, তোমার নিজের মঙ্গলের জন্যই কিছুটা রক্ষণশীলতার প্রয়োজন আছে। আচ্ছা, তুমি কি খোকাকে কখনো রান্না করে খাইয়েছে?

দু-একবার।

তুমি কি লক্ষ্য করেছে, তার রুচিটা কোনো কোনো বিষয়ে তোমার সঙ্গে মেলে না? আমি আহারের রুচির কথাই বলছি।

আলাপটার গতি কোন দিকে তা বুঝতে না পারলেও বুদ্ধিমতী সমিতি আলাপটা যাতে গুরুভার হয়ে চেপে না বসে সেজন্যই উত্তর দিল, আপনার ছেলে দুধের চাইতে মাছ বেশি পছন্দ করেন।

ধরতে পেরেছে। কিন্তু আরও সূক্ষ্ম ব্যাপার আছে, যেমন আমি বলতে পার তপসে মাছ সে মোটেই খায়না। রুইয়ের কালিয়ায় টম্যাটো পছন্দ করে। তার দই-মাছ মিষ্টি হওয়া প্রয়োজন।

আমি এত লক্ষ্য করার সুযোগ পাইনি। আপনার ছেলে এবার বাড়িতে এলে আপনি দেখিয়ে দেবেন, আমি নিজে বেঁধে দেবো।

অনসূয়া যেন হাসলেন, বললেন, ছেলে দূরে আছে বলেই তার আহারের কথা এত মনে পড়ছে আমার, তানয়। এই রুচিই তার চিরদিন থাকবে এমনও নয়। মায়ের রান্নার পদ্ধতি ছেলেরা ভালোবাসে। আহারের বেলায় যেমন অন্যান্য কিছু কিছু ব্যাপারও তেমনি, ছেলেরা নিজের বংশের প্রথাগুলোকে ধরে রাখে।

অনসূয়ার কথার সুরে উপদেশ ছিলো, বক্তব্যগুলি ভাষার দিক দিয়েও গুরুভার। সুমিতি অস্বস্তি বোধ করলো।

অনসূয়া চশমা চোখে দিলেন, হিসেবের খাতাটা আবার টেনে নিলেন; তারপর বললেন, তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে, তোমাকে বেশি বলার দরকার হবেনা। জীবনের গোড়ার দিকে তার রুচির

পরিপন্থী হওয়া তোমাদের ভবিষ্যৎ জীবনকে দুর্বল করে দেবে।

সুমিতি বললো, আমার সংসার শুধু আপনার ছেলেকে নিয়ে নয়।

কথাটার অর্থ পরিষ্কার করে নেওয়ার জন্য অনসূয়া সুমিতির মুখের দিকে চাইলেন, বললেন, তুমি কি বুঝতে পেরেছে কোনো অসংকীর্ণমনা পুরুষ নিজের পরিজন-বন্ধুবর্গের বাইরে গিয়ে শুধু স্ত্রীকে নিয়ে সবটুকু সুখী হতে পারে না, বিচ্ছিন্ন হলে তার জীবনরস কিছুটা শুকিয়ে যায়?

সুমিতি বুঝতে পারলো, এই মার্জিত কথাগুলি শুধুমাত্র মতামত বিনিময় নয়, হয়তো সে নিজের অজ্ঞাতে দ্বিতীয়বার এঁদের কোনো পারিবারিক প্রথাকে আঘাত করেছে। সুমিতির বোধ হলো এর চাইতে অনসূয়া যদি সোজাসুজি তিরস্কার করতেন ব্যাপারটা এমন গুরুভার হতো না।

অনসূয়া বললেন, তোমার বিশ্রামের সময় হলো সুমিতি।

সমিতি প্রায় নীরবে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের ঘরে চলে এলো।

অনসূয়াও উঠে দাঁড়ালেন। পাশের দরজায় দৃষ্টি দিয়ে তিনি দেখলেন সান্যালমশাই তখন শুতে আসেননি। ওপাশের দরজায় হাত দিতে দরজা খুলে গেলো। রূপুর ঘরে রূপুও নেই। তখন অনসূয়া বারান্দা দিয়ে সান্যালমশাইয়ের বসবার ঘরে গেলেন।

দেওয়ালগিরির আলোয় সান্যালমশাই বসে আছেন। বসবার ভঙ্গিটা স্তব্ধ, কিন্তু ক্লান্ত নয়। সমস্ত ঘরখানা যেন একটি নীরব জলাশয়ের মতো শীতল স্নিগ্ধতা। প্রায় এক মিনিট কাল অনসূয়া দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইলেন, অবশেষে সান্যালমশাই যেন তাকে লক্ষ্য করলেন। অনসূয়ার ঘরে আসা আর সান্যালমশাইয়ের কথা বলার সময় ব্যবধানটা থেকেই এরকম মনে হলো।

অনসূয়া পাশে বসলে সান্যালমশাই বললেন, আজ খুব ব্যস্ত ছিলে?

মণির বাড়িতে গিয়েছিলাম, মেয়েটার শরীর ভালো নয়; ওর শাশুড়িকে বলে এলাম, দু তিন মাসের জন্য মেয়েকে আসবার অনুমতি দিতে।

নিজেকে যেতে হলো কেন?

তাতে কী, একটু ঘুরে আসা হলো।

তা হলো। মেয়ের বাড়িতে একটু ঘুরতে তোমার মতো একজন যায় না। মনে হচ্ছে যেন মনসার শাশুড়ি তাকে আসতে দেবে না আন্দাজ করেছিলে। সমাজে তুমি নেমে গেছে?

এ খবরে তোমার কী দরকার?

কিছুমাত্র না। সান্যালমশাই হাসলেন।

মেয়ের মা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওটা মেনে নিতে হয়। পুতুল খেলার সময় থেকেই ছেলের মায়েদের কাছে হার মানতে হচ্ছে।

সান্যালমশাই বললেন, ছেলের খবর পেয়েছো?

বেটা-বউকে চিঠি লিখেছে ছেলে, সে আলোচনা করা কি তোমার উচিত হবে?

সান্যালমশাই কথা ঘুরিয়ে নিলেন,বললেন, রূপু বলছিলো, আজ সে আর তার বউদি গ্রামের পথে বেড়াতে গিয়েছিলো।

আমি তা জানি।

সুমিতি ওদের কলকাতা শহরে নিশ্চয়ই বাইরে বেরুতে। এখানে যদি অন্দরে আবদ্ধ হয়ে থাকে সেটা স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো হবে না।

কুমারী-জীবন আর বধূ-জীবন তো এক নয়। অনসূয়া বললেন।

তা নিশ্চয়ই নয়, রূপু বলছিলো বটে বউদিদিকে নিয়ে পথে বেরুতে তার ভয় ভয় করছিলো, সেজন্যে আমার দেরাজ থেকে রিভলবার নিয়ে গিয়েছিলো।

খবরটা নতুন। অনসূয়া একটু থেমে বললেন, রিভলবার নেওয়াটা তার পক্ষে উচিত হয়নি।

তা হয়নি, তা হলেও ছেলে যখন নিজের থেকে কোনো কাজ করে তখন চিন্তা করে দেখতে হয় তার মনের গড়নটা কীরকম হয়েছে। দেখছি রূপুর মর্যাদাবোধটা জন্মেছে।

অনসূয়া চুপ করে রইলেন।

লঘুতার সুরে সান্যালমশাই বললেন, রূপু একটা কথা বলেছে, তাই ভাবছিলাম। সে বলছিলো, ছেলে রাজার শত্রু আর বাবা রাজার বন্ধু, এ কী করে হয়, কী করে চলতে পারে এমন ব্যবস্থা!

‘ঠিক বুঝতে পারলাম না।

রাষ্ট্রদ্রোহ-নিবারণ-আইনে ছেলে অন্তরীণ আর তার বাবাকে দেওয়া হয়েছে অস্ত্রশস্ত্র। দুই পুরুষে মতের পার্থক্য থাকতে পারে তো।

ভাবতে গিয়ে মনে হচ্ছে, সমাজের এটা একটা কৌতুককর অবস্থা। তোমার বাড়িতে না হলেও অন্যত্র গৃহবিবাদ আছে বৈকি। কিন্তু আমি ভাবছিলাম রূপুর কথা; সে বলে, হয় তারা তার দাদাকে কিছুমাত্র মূল্য দেয় না, কিংবা তার বাবাকে অপদার্থ মনে করে।

ছেলে বলেছে?

না, ঠিক এ কথাগুলো বলেনি, কিন্তু তার বক্তব্যকে বিশদ করলে এই দাঁড়ায় বটে। তার দাদাকে যদি তারা সত্যিকারের মূল্য দিতো তবে তাকে আর্থিক ও অন্যান্য পার্থিব সুযোগ থেকে বঞ্চিত করার জন্যে আমাকেই তারা আঘাত করতো, কিংবা এমন হতে পারে তারা ভেবেছে ছেলেকে আমি নিজেই শাসন করবো যদি সে প্রকৃতই বর্তমান ব্যবস্থায় পরিবর্তন চায়।

সান্যালমশাই উঠে দাঁড়ালেন। টেবিলের উপরে রাখা বইখানি ও তাঁর চশমা হাতে নিয়ে অনসূয়া তাঁর পাশে পাশে ঘর থেকে পার হলেন। বারান্দা দিয়ে চলতে চলতে দেখতে পেলেন তারা, রূপুর ঘরের দরজা খোলা, সে মশারি না ফেলে ঘুমিয়ে পড়েছে। হাসিমুখে সান্যালমশাই দরজার কাছেদাঁড়ালেন। অনসূয়া ঘরে ঢুকে মশারি ফেলে দিলেন। ঘরের দেয়ালগিরির আলোটা মৃদু করে দিয়ে, পড়ার টেবিলের বড়ো ল্যাম্পটা নিবিয়ে দিলেন। রূপুর ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে নিজের ঘরের ভিতর দিয়ে সান্যালমশাইয়ের ঘরে গিয়ে অনসূয়া বই ও চশমা বিছানার পাশের ছোটো টেবিলটায় রেখে আলোর ব্যবস্থা ঠিক করলেন।

পড়বে এখন?

কিছুক্ষণ পড়ি।

আলো নিবিয়ে মশারি ফেলে দিয়ে।

অনসূয়া নিজের ঘরে এসে ঘুমোবার জন্য প্রস্তুত হলেন। দেয়ালের গায়ে কিছুদিন আগে ঝুলানো বড়োছেলের ছবিটির দিকে চোখ পড়লো তাঁর। মোষের শিঙের সরু ফ্রেমে আঁটা এই ছবিটি ছেলের এক বন্ধুর সাহায্যে অনেক যত্নে আনানো হয়েছে। ছবির দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে তার মনে হলো সেই পুরনো কথাটা-তার বড়ছেলের মুখাবয়বে যে প্রখরতা আছে সেটা সান্যালমশাই কিংবা রূপুতে নেই।নাক, এবং চিবুকেই এই পার্থক্যটা বেশি স্পষ্ট। অবাক বোধ হয়, পাঁচ-ছটি বছরে ছেলের কী পরিবর্তন হয়ে গেলো। পরিবর্তনেরই বয়েস, পঁচিশ হলো। কিন্তু সে যদি দুরন্ত মানুষ না হয়ে জমিদারের ছেলে হয়ে থাকতো, হয়তো পরিবর্তনটাকে এমন আমূল বোধ হত না।

দেয়ালের কুলুঙ্গিতে একটি লালপাথরের মূর্তি আছে। বাড়িতে যে অষ্টধাতুর দ্বিভুজ জটাজুট সমন্বিত সন্ন্যাসী শিবমূর্তির পূজা হয় তারই প্রতিরূপ এটা। একটি ঘিয়ের প্রদীপ রোজ সন্ধ্যায় এখানে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় যখন মন্দিরে আরতি হতে থাকে।

বাড়ির কত্রী হিসাবে গৃহবিগ্রহের পূজার আয়োজন অবশ্যই তাকে করে দিতে হয় কিন্তু নিজে তিনি মন্দিরে খুব কমই যান। তাঁর প্রথম বয়সে লোকে জানতো সংসারের সকলের খাওয়া পরার ব্যাপার নিয়েই তাকে অত্যন্ত ব্যস্ত থাকতে হয়। এখনও সংসারের অন্য লোকেরা জানে সংসার ব্যস্ত অনসূয়া মন্দিরে আসবার সময় পান না। শুধু সান্যালমশাই নন, কিছু কিছু রূপুও এখন জানে ব্যাপারটা ঠিক এরকম নয়। অনসূয়া বলেন কাসর-ঘণ্টার বাজনা এবং পুরোহিতের মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যে ব্যক্তিগত ভগবানকে খুঁজে পাওয়া যায় না। অনসূয়ার ভগবান সম্বন্ধে ব্যক্তিগত মতামত আছে। ভগবান আছেন, তিনি সর্বত্র বিরাজমান, কিন্তু দল বেঁধে তাকে ডাকা যায় না। তার সঙ্গে প্রত্যেকের ব্যক্তিগত সম্পর্ক আছে, সেটাকে খুঁজে নিতে হয়। তাঁকে সোজা বাংলাতে ডাকা উচিত, সর্বজ্ঞ একজনের পক্ষে কোনো ভাষাই অবোধ্যনয়। সান্যালমশাই জানেন এসব কারণেই মন্দিরে যখন পরিবারের অন্য অনেকে উপস্থিত, অনসূয়াকে তখন সেখানে দেখা যায় না। ঘিয়ের প্রদীপটি জ্বালিয়ে দেওয়ার সময়ে শোবার ঘরের ছোটো মূর্তিটির সম্মুখে কখনন কখনো তিনি কিছুক্ষণের জন্যে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে থাকেন। রূপু একদিন দেখে ফেলে প্রশ্ন করেছিলো, কী বললে, মা? প্রথমে কিছু না বলে মৃদু মৃদু হাসলেন অনসূয়া, পরে বললেন, বললাম, হে মহাজীবন, হে মহামরণ, লইনু শরণ। গানের সুরটা আজ সকাল থেকে বার বার মনে আসছে।

সান্যালমশাই আর একটু জানেন–অনসূয়ার পিতৃগোষ্ঠীতে এককালে আচার্য কেশব সেনের প্রভাব এসে পড়েছিলো।

বিছানায় শুয়ে অনসূয়ার চোখ পড়লো কুলুঙ্গিতে। তিনি হাতজোড় করে বললেন, তুমি মনের মধ্যে দেখতে পাও। আমাকে অশান্তি থেকে রক্ষা করো। তুমি তো সমস্ত অশান্তি গ্রহণ করেও আত্মস্থ।

অন্য অনেকদিন এরকম প্রার্থনা করার পরমুহূর্তে তিনি ঘুমিয়ে পড়তে পারেন, কিন্তু আজ চোখ বুজতে গিয়ে চোখ পড়লো বড়োছেলের ফটোটার উপরেই। ঘরে দেয়ালগিরির অত্যন্ত মৃদু একটা আলো, সে আলোকে ছবিটিকে সংকীর্ণ ও ক্লান্ত দেখাতে লাগলো। তার বুকটা ধক ধক করে উঠল। মনে মনে বললেন–আমি এতটুকু রাগ করিনি খোকার উপরে। সে যদি নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করে থাকে তাই বলে আমি কি তার উপরে রাগ করে থাকতে পারি! সে আমাকে চিঠি দেয়নি, সুমিতিকে লিখেছে, এতে অন্য অনেক মায়ের অভিমান হতো। অভিমান হওয়া সংগত। কিন্তু এক্ষেত্রে তিনি নিজেই তো ছেলেকে নিষেধ করেছেন।

তবুও কথাগুলি ভগবানকে নিবেদন করার মতো সত্য নয় বলে অনুভব হলো তাঁর। তিনি একটা ক্ষোভকে আড়াল করার জন্য মনসার বাড়িতে অত তাড়াতাড়ি চলে গিয়েছিলেন এরকম একটা কথা কেউ যেন বললো।

এরপর চিন্তা করলেন অনসূয়া : এ বিষয়ে তিনি দৃঢ় হয়েই বলতে পারেন যে, ছেলের কাছে তাঁর মূল্য কমেছে এ কিছুতেই তিনি বিশ্বাস করবেন না। ক্ষোভ যদি হয়ে থাকে তবে তো ছেলে হার মেনেছে বলে, সেন্সর করা চিঠি পাঠাতে রাজী হয়েছে সেই জন্য। সুমিতির জন্যই ছেলের এই পরাজয়।

কিন্তু পাছে শাসনে কিছুমাত্র বিরাগ থাকে এই ভয়ে সন্ধ্যায় বারংবার মনে হলেও সুমিতিকে তরস্কার করেননি। সান্যালবংশের কোনো বধূ পায়ে হেঁটে চলেছে অথচ সঙ্গে পাইক-বরকন্দাজ দাসদাসী নেই, এ কল্পনা করা অসম্ভব। এর আগে এক দারোগাকে ধন্যবাদ দেওয়ার জন্য তাকে সামনে বসিয়ে চা খাইয়েছিলো সুমিতি।-সুমিতি, তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে, তোমার বুঝতে পারা উচিত কেন আজ খোকার রুচির কথা উত্থাপন করেছিলাম।

আজ কি ঘুম হবে না? চতুর্থ পর্যায়ে চিন্তার সূত্রপাত হলো। ছেলের রুচি নিয়ে অতগুলি কথা বলা ভালো হয়নি। এই পাঁচ-সাত বছর জেলখানায় ঘুরে, অন্তরীণ থেকে রুচি বলে কি কিছু-আর অবশিষ্ট আছে তার?

সান্যালকে এ বিষয়ে বলে তার পরামর্শ নিতেও পারেননি অনসূয়া। সুমিতিকে উপদেশ দিয়ে স্যান্যালের কাছে যখন গিয়েছিলেন তিনি তখন পরামর্শ করার ইচ্ছা ছিলো, কিন্তু সান্যালের সম্মুখে গিয়ে তার মনে হলো সেই স্তব্ধ শান্তিকে বিঘ্নিত করার মতো কঠিন নয় সমস্যাটা। তাছাড়া–এ কথাও তার মনে হয়েছিলো অস্পষ্টভাবে,কথাটা উত্থাপন করার ক্রটিতে সান্যালমশাই যেন মনে না করেন, সুমিতিকে তিনি ঈর্ষা করছেন।

অনসূয়া উঠে জল খেলেন। একবার তার ইচ্ছা হলো বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াবেন কিন্তু পরক্ষণেই তিনি স্থির করলেন সেটা উচিত হবেনা, কারো চোখে পড়ে গেলে বিষয়টা আলোচনার বষয়বস্তু হয়ে উঠবে। ভিজে আঙুল চুলগুলির মধ্যে চালাতে চালাতে নিজেকে তিনি লিলেন-চুলগুলো আজ খুলেই দেওয়া হয়নি।

.

মনসা এসেছে। সকালে চায়ের টেবিলেই খবরটা এসেছিলো। একটা তরল হাসির শব্দ সুমিতিকে আকৃষ্ট করেছিলো। রূপু উঠে গিয়ে দেখে এসে বলেছিলো, মণিদিদি এলো।

সুমিতি তখন থেকেই তার প্রতীক্ষা করছিলো, হাতের সেলাইটায় মন বসছিলো না। কিন্তু মনসা যখন এলো তখন প্রায় দুপুর। কাঁধের উপরে গামছা জড়িয়ে ঘরে ঢুকে সুমিতি কিছু বলার আগেই তাকে প্রণাম করে প্রায় একই নিশ্বাসে বললো, চলো ভাই, স্নান করে আসি।

অবাক হওয়ার কথা।

সুমিতি তার হাত ধরে বললো, আচ্ছা লোক তো, সেই সকালে এসেছে আর এতক্ষণে সময় পেলে?

মনসা বললো, আমি বলতে পারি, তোমারই এতক্ষণ যাওয়া উচিত ছিলোননদিনীর খোঁজে। আজকাল ননদিনীকে কেউ ভয় পাচ্ছে না।

সুমিতি হেসে ফেলো, বললো, বোসো।

মনসা বললো, তুমি কিছু নও, বউদি। গাল পেতেই রইলাম শুধু।

মনসার আলিঙ্গন-মুক্ত হয়ে সুমিতি বললো, স্নানের এমন কি তাগাদা আছে?

তুমি অন্দরের পুকুরে স্নান করবে এমন অনুমতি রোজ পাওয়া যায় না। জেঠিমা আজ একবার বলতেই রাজী হলেন।

দু’পাঁচ মিনিট কথা বলেই মনসা বললো, তেল কোথায় ভাই, সিল্ক পরে জলে নামতে অসুবিধা হবে।

সুমিতি কাপড় পালটে নিতে নিতে মনসা সুমিতির তেল চিরুনি গামছা নিয়ে এলো। কার্পেটে বসে সুমিতির চুলে তেল দিয়ে আঁচড়ে এলো–খোঁপায় বেঁধে তার হাত ধরে টেনে তুলে বললো, দেরি কোরো না আর, এখনি জেঠিমার কোনো দূত এসে পড়বে।

চক্‌-মেলানো অন্দরমহলের চত্বরের উপর দিয়ে হেঁটে গিয়ে লোহার কীলক বসানো দরজা দিয়ে মনসার পিছনে সমিতি কর্মমহলে উপস্থিত হলো। চলতি ভাষায় বাড়ির এ অংশটার নাম। রান্নাবাড়ি, যেমন অন্দরমহলের নাম ভেতর-বাড়ি এবং বহির্মহলের নাম কাছারি। ইতিপূর্বে সুমিতি মাত্র একদিনের জন্যই আসতে পেরেছে এ অঞ্চলে কিন্তু এত লক্ষ্য করতে পারেনি। আমিষ-নিরামিষ রান্নাঘর, ভাড়ার ও গৃহবিগ্রহের মন্দিরে বিভক্ত এ অংশটা একটা নতুন বাড়ি বলে মনে হলো। উঠোনে পাঁচ-সাতটি ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ে খেলা করছে, দু-একটি বায়না ধরে কাঁদছে। নিরামিষ ঘরের বারান্দায় কয়েকটি বিধবা বসে তরকারি কুটছে। আমিষ ঘরের বারান্দায় ইতিমধ্যে কেউ কেউ খেতে বসেছে। কথাবার্তায় লোকচলাচলে মহলটি গমগম করছে। এতটা প্রাণচাঞ্চল্য অন্দরমহলে বসে অনুভূত হয় না। সেখানে চত্বরে দু-একটি ছেলে খেলা করে কখনো কোনো বিকেলে, একতলায় নামলে কখনো কখনো দু-একজনের কথাবার্তা কানে আসে বটে কিন্তু দোতলায় তার খুবই কম পৌঁছায়। বিশেষ করে দুপুরের কয়েক ঘণ্টা, এবং সন্ধ্যা থেকে প্রভাত অর্থাৎ যতক্ষণ সান্যালমশাই অন্দরে থাকেন সমগ্র মহলটা স্তব্ধ গম্ভীর হয়ে থাকে।

আবিষ্কারের মধ্যে দিয়ে চলে সুমিতি মনসার পিছনে খিড়কির ছোটো দরজা পেরিয়ে পুকুরের পাড়ে উপস্থিত হলো। প্রকাণ্ড কিছুনয়, তবুসুমিতির শহুরে অভিজ্ঞতায় বড়ো বলেই মনে হলো। পুকুরের তিনদিকে বাগানের বড়ো বড়ো গাছ প্রাচীরের চূড়ার মতো দাঁড়িয়ে। সেই গাছগুলির পায়ের কাছে মানুষের বুকসমান-উঁচু আগাছার জঙ্গল প্রাচীরের মতো পুকুরের তিনদিক ঘিরে রেখেছে। ওদিকের ঘাটগুলি কোথায় ছিলো জঙ্গলে ঠাহর করা যায় না। শুধু বাঁ দিকের জঙ্গলের প্রাচীরে একটা ছেদ আছে। সেখানে জলের কিনারায় খেজুরগাছের গুঁড়ির একটা ঘাট। এদিকে খিড়কির ঘাটে এখনো চুন-সুরকির সেকেলে আস্তর দেওয়া সিঁড়ি অনেকগুলি অটুট আছে। কিন্তু ব্যবহার কমই হয়, শুকনো পাতায় ঘাটের চাতালটুকু ঢেকে রয়েছে। কালো জল। পুকুরের মাঝামাঝি জায়গায় একটা ছোটো দাম তৈরি হচ্ছে। এক-দেড় হাত উঁচু ঘাসও তাতে চোখে পড়ে। গোটাকয়েক ডাহুক বসে আছে সেই দামে।

জলের কাছাকাছি গিয়ে গা ছমছম করে উঠলো সুমিতির। শিউরে উঠে সে বললো, এ জলে ম্যালেরিয়া হয় না, মণি?

ততক্ষণে শাড়ি হাঁটুর কাছে তুলে গায়ের আঁচল কোমরে জড়িয়ে মনসা জলের কিনারায় নেমে গেছে। সে বললো, সে তো শুনেছি মশার কামড়ে হয়। সাঁতার জানো তো, ভাই?

সুমিতি জলের ধারে নেমে এলো, বললো, কেউ যদি এসে পড়ে?

তুমি কি ভেবেছো জেঠিমা এতক্ষণে দরজায় কোনো তাতারনীকে বসাননি? বলতে বলতে কালো জলকে শাদা করে দুমদুম করে হাত-পা ছুঁড়ে সাতরাতে লাগলো মনসা।

আবক্ষ জলে নেমে সুমিতি বললো, এমন জল থাকতে স্নানের ব্যবস্থা ইদারায় কিংবা ঘরে কেন?

‘আমরা বোধ হয় ক্রমশ গোলালো পলিজ-শিলায় রূপান্তর নিচ্ছি।

সেটা কী রকম ব্যাপার?

এ বাড়ির লোকেদের চরিত্রে আগে অনেক কোণ ছিলো, খুব কাছে এলে খোঁচা লাগতো। এখন স্ট্রিইল্ড হচ্ছি।

ভাই ননদিনী, এ কথাগুলো যেন অন্য কোথাও শুনেছি।

মনসা কাছে এসে দাঁড়িয়েছিলো, বললো, আমি আশ্চর্য হবো না যদি শুনে থাকো। দাদা এরকম ধরনের কথা বলেন।

চাতালে উঠে সুমিতি বললো, জঙ্গলটা সাফ করিয়ে নাও না কেন?

দাদা ফিরে এলে হবে। তার ছিপের সুতোত ছিড়লে চলবে না, জলে রোদ না লাগলে মাছের স্বাস্থ্যও ভালো থাকেনা। অবশ্য আজকের এই নির্জনতা তোমার জন্যে, অন্যান্য দিন দাস দাসীরা এমন সময়ে স্নান করে।

তাহলে তাদের কষ্টের কারণ হলাম।

কষ্ট আর কী, একদিন না হয় আধঘণ্টা দেরিই হবে।

তোমাদের জন্যেই কি ওদের এমন কষ্ট রোজই করতে হয়?

দাদা এখন ছোটো নয়। তিনি এলে দাসদাসীরা অবশ্যই দূরে থাকে। আমার কথা স্বতন্ত্র। মতির মা সঙ্গে না এলে স্নান করে সুখ নেই, তার মতো সাঁতার কেউ জানে না, মেজে-ঘষে দিতেও তার জুড়ি নেই।

কাপড় পালটে মনসা আবার সুমিতির ঘরে এসে ডাকলো, খেতে এসো বউদি। স্নানের ব্যাপারে যেমন আহারের ব্যাপারেও তাই। সুমিতির আহার্য বামুনঠাকরুনের হাতে অন্দরমহলের দোতলাতেই আসতো, যেমন আসে সান্যালমশাই এবং রূপুর।

সুমিতিকে সঙ্গে নিয়ে আমিষ ঘরের বারান্দায় উঠে মনসা বললো, ভাত দাও, বামুনদিদি। দিই দিদি; তারণের মা, ঠাই করে দে বাছা। বলে দরজার কাছে এসে বামুনঠাকরুন সুমিতিকে দেখে বিস্মিত হয়ে গেলো, কী করবে ভেবে পেলো না।

দুমদুম করে দুখানা সিঁড়ি পেতে মনসা বললো, বোসো ভাই, বউদি, এতদিন ওরা তোমাকে হক কষ্ট দিচ্ছে। কত রকমের চচ্চড়ি ছ্যাচড়া বামুনদিদি নিজে রান্না করে একা একা খায় তা তুমি কল্পনা করতেও পারবে না।

ভাত নিয়ে এসে বামুনঠাকরুন বিব্রত হয়ে বললো, সে কি তারণের মা, অবাক হয়ে কী দেখছো, জল গড়িয়ে দিতে পারোনি?

থাক্, থাক্‌, ও অবাক হয়ে দেখুক। বউদি, যাও তো ভাই, একটু জল গড়িয়ে আনো।

আহার-পর্ব মিটলে মনসা বললো, তুমি এবার বিশ্রাম করা গে, রোদ পড়লে আমি আবার আসবো। তখন সুখদুঃখের কথা হবে।

আমার ঘরের ভেতরে তো রোদ নেই।

তা নেই। দেখলাম আজ এখনো জেঠিমার স্নান হয়নি। তারপরে স্বর নিচু করে মনসা বললো, এবাড়ির বউ হওয়ার ওই এক কষ্ট, দিবাভাগে সাক্ষাৎ হয় না।

সুমিতির ভাবতে অবাক বোধ হলো অন্দরমহলের পিছনে এবাড়ির আর একটি মহল আছে।

মনসার কথায় যদি অতিশয়োক্তি না থাকে তবে এবাড়ির বড়োছেলের সম্বন্ধেও সে কিছুটা নতুন সংবাদ পেয়েছে। সান্যালমশাই, রূপু ও সদানন্দ, এ তিনজনের চালচলন দেখে নৃপনারায়ণ বাড়িতে এলে কীভাবে থাকে তার কতগুলি কাল্পনিক চিত্র সে এঁকেছিলো মনে মনে। কিন্তু মনসার কথায় এখন মনে হচ্ছে ছবিগুলো একদেশদর্শী হয়েছে। মনসা তার দাদার নামে অত্যুৎসাহী। এ যেন অনায়াসে কল্পনা করা যায় মনসা ও নৃপনারায়ণ দুজনে তিন মহলে, বাগানে, পুকুরে দুরন্তপনা করছে এবং তাদের অস্তিত্ব দিয়ে ভরে রাখছে। মূলত নৃপনারায়ণ হয়তোবা সান্যালমশাই থেকে খুব পৃথক নয়, কিন্তু তার ক্ষেত্রে আভিজাত্যের মর্মর যেন কোথায় চিড় খেয়েছে, আর সেই ফাটলে প্রাণশক্তি উচ্ছ্রিত হচ্ছে। মনসা যেন তার প্রতিভূ।

বিকেলে মনসা এসে বললো, চলো, বেড়াতে যাই।

বাগানের বড়ো বড়ো ফলের গাছগুলির নিচে ছায়াপথের মতো রাস্তা। সে পথে চলতে চলতে মনসা প্রকাশ করলো সে তিন মাস থাকতে এসেছে, এবং এই তিন মাস সে যজ্ঞের উৎসৃষ্ট তণ্ডুল হাঁসদের সঙ্গে খুঁটে খুঁটে খাবে। সুমিতি তার কথার অর্থ চট করে ধরতে পারেনি। পরে যখন মনসা বললো, উপমাটা ভালো হয়নি, একসঙ্গে লব কুশকে মানুষ করার মতো শক্তি তার নেই, তখন সুমিতি বুঝতে পারলো মনসা অন্তর্বত্নী।

সুমিতি তাকে প্রশ্ন করেছিলো, ননদিনী, তুমি বুঝি ইহজীবনে দাদাকে অনুকরণ করাই ধর্ম বলে গ্রহণ করেছো?

অনুকরণ কি আর এখন সম্ভব হয়। যখন মেয়েমানুষ হইনি তখন অবশ্য দাদার ঘুড়ি-লাটাই ছিপ বড়শি আমার ব্যবহারেও লাগতো।

হঠাৎ গলার স্বর গম্ভীর হলো মনসার, সে বললো, তোমাকে গোপনে বলি, বউদি, লোকে বলে যার কথা ভাবা যায় তার মতো চরিত্র হয় সন্তানের। এসব ধারণার মূলে যদি কিছু সত্যি থাকে তবে আমার ছেলেও যেন তার মামার মতো হয়।

নির্লজ্জ!

কেন বলো তো?

প্রথম সন্তান হবে, লজ্জায় মাটিতে মিশে যাবে, তা নয়–কথাটা ঘুরালো সুমিতি।

তাও বটে। বলতে বলতে সত্যি মনসা লাল উঠলো লজ্জায়।

চার-পাঁচ দিন পরে। নিজের ঘরে সুমিতি বসেছিলো। রূপুকে সঙ্গে করে মনসা কোথায় বেড়াতে গিয়েছে। সময়টা এখন অলস মধ্যাহ্ন। কোন কথায় এ কথাগুলো উত্থাপিত হলো সুমিতি ধরতে পারছে না। তার মনে হলো একবার মনসা রহস্যছলে জিজ্ঞাসা করেছিলোতার দাদাকে সুমিতি কেন বিয়ে করেছে। কোনো একটি লোককে কেন ভালোবাসলাম এ নির্ণয় করা দুরূহ ব্যাপার। কোনো কোনো ভালোবাসা ত্বকগভীর মোহ বলে প্রমাণিত হয়, অন্য দু’এক ক্ষেত্রে বিশ্লেষণের সঙ্গে সঙ্গে ভালোবাসা ক্রমাগত নতুন হতে থাকে।

সুমিতি অনুভব করলো নৃপনারায়ণের চাকচিক্য অন্য অনেকের তুলনায় অকিঞ্চিৎকর, তবু সে কেন দুর্নিবার বলে তাকে আকর্ষণ করলো তা বলা কঠিন। এ বিষয়ে তথ্যের কাছে পৌঁছুতে গেলে প্রশ্ন করার মতো লোক দরকার।

সেদিনই সন্ধ্যাবেলায় মনসা গল্প করতে এসে কিছুকাল এটা-ওটা নিয়ে আলাপ করার পর বললো, একটা কথা তোমাকে বলা দরকার, ভাই; আমার এক অবাক করা অভিজ্ঞতা হয়েছিলো। যা বলতে ইচ্ছে করে এবং যা তোমাকেই বলা যায়।

কী এমন অভিজ্ঞতা?

তার আগে তুমি বলো, আমি যা বলবো সেটাকেই চূড়ান্ত সত্যি বলে মেনে নেবে, মনে কানো প্রশ্ন রাখবে না?

চেষ্টা করবো। তোমার উপরে বিশ্বাস আমার সহজে নষ্ট হবে না।

যত সহজে কথাটা বলতে পারবে ভেবেছিলো মনসা, বলতে গিয়ে দেখলো বলাটা তত সহজ এয়। কথা হারানো নয় শুধু, লজ্জায় সে রাঙা হয়ে উঠলো। তবু সে ধীরে ধীরে বললো, আমি মার আমার দাদা আবাল্য খেলার সঙ্গী ছিলাম।

তা ছিলে।

খেলাধুলো, লেখাপড়া, ঘোড়ায় চড়া—

আজকালকার দিনে শহরে ঘোড়ায় চড়ে বেড়ানোর জায়গা পাওয়া কঠিন বটে।

তোমরা হলে হয়তো মোটর নিয়ে চলতে, মোটর ভেঙেচুরে তেলকালি মেখে দুজনে সটাকে নিয়ে ঠুকঠাক করতে। মনসা বললো।

এরকম অভিজ্ঞতা কারো কারো হয়।

আসল কথা এই, দাদাকে আমি ভালোবাসতাম।

সব বোনই তার দাদাকে ভালোবাসে।

তা নয়। আমার দাদা তখনো ভালোবাসার প্রকৃতি বিচার করার পক্ষে অনভিজ্ঞ। আমিও কি তখন সেটার স্বরূপ বুঝতে পেরেছি? আমার দাদার কোনো পরিবর্তন হয়েছিলো কিনা জানি না, হয়েছিলো বলে আমার বিশ্বাস নয়, কিন্তু আমার শ্রদ্ধায় একসময়ে উত্তাপের সঞ্চার য়েছিলো।

তার মানে? তুমি কী বলতে চাও?

তোমার গলায় যে আশঙ্কা ফুটে উঠেছে ঠিক তা-ই। প্রায় একটা বছর এই উত্তাপে আমি লেছি, বিয়ের পরে বুঝলাম এই উত্তাপকেই প্রেম বলে।

পোড়ামুখী।

তা বলো। এ কথা স্বামীকে বলা যায়নি, দাদাকে তো যাবেই না। তুমি তো এমন বিপদে পড়োনি, বউদি, তবু আশা করছি তুমি খানিকটা বুঝবে, কারণ তুমি ভালোবেসেছো। কেউ কি জানে সেই উত্তাপকেই আলোতে পরিণত করতে আমায় কত কষ্ট করতে হয়েছে। অধ্যাত্ম রামায়ণও পড়তে হয়েছিলো। পুড়তে ভালো লাগে তবু পুড়বো না, উত্তাপ ভালো লাগে তবু দূরে থাকবো। আর দাদার কাছে গোপন রাখতে হবে।

সুমিতি মনসার মুখের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইলো।

কিছু পরেই অবশ্য সুমিতি দুষ্টুমির হাসিতে চোখ ভরে বললো, তুমি কি আমাকে ঘরছাড়া করতে চাও?

সে উত্তাপ নেই আর। কিন্তু খুব জবাব দিয়েছে।

একটু বিরতির পরে মনসা বললো, এবার তোমার কথা বলল। আমি ভেবেছি দাদার সঙ্গে তোমার আলাপ রাজনীতির ক্ষেত্রে। তা যদি হয়, ও ব্যাপারে তোমাদের মতৈক্য ছিলো বলে ধরে নিতে পারি। আর তা যদি হয়, আমাদের সামন্ততান্ত্রিক জীবন তোমার ভালো লাগার কথা নয়।

সুমিতি বললো, আসলে হয়তো আমি আর তুমি এক। রাজনীতি আমার ছলনা। প্রয়োজনের অতিরিক্ত এনার্জি ছিলো, সেটা ব্যয় করা দরকার হলো। যদি ধীর স্থির হতাম, হয়তো সেলাই করতাম, ছবি আঁকতাম, দুম্পাঠ্য কবিতা লিখতাম। তা পারিনি বলে কতগুলি সমবয়সী ছেলেমেয়ের সঙ্গে হৈহৈ করে বেড়াতাম।

সেদিনকার আলাপের শেষ দিকটায় দুজনের বাচ্চাতুর্যের ঝলমল আবহাওয়ার আড়ালে দুটি সখি-হৃদয় স্নিগ্ধ হয়ে উঠলো।

পরিহাসের ছলে সে যা বলেছে সেটার কতটুকু তার নিজের সম্বন্ধে খাটে, মনসা চলে গেলে সুমিতি তাই ভাবলো৷ নিজে সে অন্যের তুলনায় অস্থির প্রকৃতির কিনা এটাই প্রথম প্রশ্ন; দ্বিতীয়ত, যাকে এতদিন একটা আদর্শবাদ বলে সে মনে করেছে সেই রাজনীতি তার নিছক অবসর বিনোদনের ব্যাপার ছিলো কিংবা অন্য কিছু, এর বিচার করতে গিয়ে জীবনে সে এই প্রথম অনুভব করলো, নিজের কৃতকর্মগুলিকে বিচার করতে বসলে কীরকম অপূর্ব অনুভব হতে পারে।

.

দুপুরের পর রান্নাবাড়ির দিকে যাওয়ার আগে কোনো কোনো দিন এ জায়গাটায় অনসূয়া বসেন। বারান্দাটার এ অংশটা ঢাকা এবং এখানে দেয়াল থাম প্রভৃতি চিত্রিত। পাথরের তৈরি বড়ো একটা পাল্কি বলে ভ্রম হয়। এখানে অনসূয়াকে দেখলে পরিবারস্থ অনেকেই অগ্রসর হয় আবেদন ইত্যাদি জানানোর জন্য।

শ্যামার মা বললো, বড়দিদি, কাল শ্যামার জন্মদিন।

তুমি কাল সকালে একবার মনে করিয়ে দিয়ে, তরু।

এবারে ছ বছর হলো। ওর লেখাপড়ার কী করি?

অনসূয়া যেন একটু চিন্তা করলেন। মনসার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, মণি, তোর লেখাপড়ার কী ব্যবস্থা হয়েছিলো রে?

মনসা বললো, তখন নবদ্বীপের ঠাকরুন ছিলেন, প্রথমে তার কাছে পড়েছিলাম, তার পরে দাদার পিছনে ঘুরে বেড়াতাম।

তাহলে? আচ্ছা, তরু, তুমি এক কাজ করো না হয়, সুমিতির কাছে প্রস্তাব কোরো, তার সাহায্য চেয়ো। তার হাতে মেয়ে তোমার ভালোই মানুষ হবে।

একটি দাসী এসে বললো, বড়ো-মা, বাড়িতে জামাই এসেছে।

তাহলে তুই কাজে এলি কেন? তা বেশ করেছিস। বামুনঠাকরুনকে বলিস জামাইয়ের জন্য যেন পরিষ্কার করে থালা গুছিয়ে দেয়। সকাল সকাল চলে যাস কিন্তু।

দাসী চলে গেলে তরু বললো, বড়দিদি, শ্যামার জন্যে আমি নিশ্চিন্ত হলাম।

কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে এটা-ওটা বলে সেও চলে গেলো।

মনসা অনসূয়ার পিছনে গিয়ে তার খোঁপা খুলে দিয়ে দু হাতে তার চুল নিয়ে বসলো।

ও কী করিস?

পাকা চুল তুলে দিই।

পাকা?

তা হবে না? দিদিমা হতে যাচ্ছ যে।

পাকা চুল থাকার কথা নয়, অনসূয়ার এখন বিয়াল্লিশ চলছে। কিন্তু পাকা চুল তুলবার নাম করে মনসা প্রথমে চিরুনি, পরে চুলের কাটা নিয়ে এলো।

তোর শরীর ভালো যাচ্ছে তো মণি? একটা কথা তোকে বলি, বাপু। এ সময়ে একসঙ্গে অনেকটা খাওয়া যায় না, খেতেও নেই, অথচ পুষ্টির ব্যাঘাত করলেও চলবে না।

তাই বলে সব জিনিসই খাওয়া যায়?

কী খাওয়া যায়, তাই বল।

তা বলবো একসময়ে। এখন একটা কাজের কথা আছে শোনোকাল কাকিমার তিথিপালন।

কালই নাকি দিনটা?

হ্যাঁ, কালই পড়েছে তিথির হিসেবে।

অনসূয়ার সুরটা একটু উদাস হয়ে গেলো, তিনি বললেন, তোমার এ অবস্থায় কিন্তু উপোস করতে নেই।

কী যে তুমি বলো। তুমি চিরকাল পারলে আর আমরা পারবো না?

তোমরা আবার কে কে হচ্ছো?

বউদিরও করা উচিত, সে তো এ বাড়ির বউ।

বুদ্ধিমতী মনসা কথাটা তখন-তখনই ঘুরিয়ে নিলো, আর অনসূয়ার সামনে একটা আয়না এগিয়ে দিলো।

দুষ্টু মেয়ে, এ কী করেছিস?

তুমি ভাঙতে পারবে না, জেঠিমা, আমি কিন্তু তাহলে রাগ করে যাচ্ছেতাই করবো।

কিন্তু আয়নার দিকে অনসূয়া একাধিকবার চাইতে পারলেন না। তার চুলগুলি যত্নের অভাবে ইদানীং রুক্ষ ও অগোছালো দেখায়। অনসূয়ার এ বাড়িতে প্রবেশের ছাড়পত্র ছিলো দেহবর্ণ এবং মুখের গঠন। এ বাড়িতে আসবার পর তার চুলের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিলো, যৌবনে তিনি যত সুপ্রতিষ্ঠিত হচ্ছিলেন। সেকালে যাকে আলবার্ট বলতো তেমনি কায়দায় ঢেউ-তোলা চুলের ছোটো ঝপটা কপালে নামিয়ে মাথার পিছন দিক জুড়ে মস্ত একটা খোঁপা করে দিয়েছে মনসা। অনসূয়ার রূপ যেন ইতিহাস থেকে বর্তমানে চলে এলো।

মনসা আবার বললো, তাতে কী হয়েছে, সব সময়েই তো তোমার মাথায় ঘোমটা রয়েছে।

রান্নাবাড়িতে পা দিয়ে অনসূয়ার একটা অব্যক্ত অনুভব হলো। সুকৃতির কথা, সুকৃতি এবং সুমিতির তুলনা। দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী এলে অতীত স্ত্রীলোকটির পরিবেশে নতুনটিকে যেমন কৌতূহলের বিষয়ীভূত বলে মনে হয়, এ যেন কতকটা তেমনি। যে ভগ্নস্তূপ কালায়ত বিস্মৃতির গভীরতায় তলিয়ে যাচ্ছিলো তার উপরে নতুন কিছুর কাঠামো খাড়া করে নির্মম আলোয় পার্থক্যটা যেন দেখিয়ে দেওয়া। সুকৃতির পর সুমিতি এই বাড়িতে আসবে, এ যেন একই চরিত্রের ভিন্ন ভিন্ন পোশাকে ও অঙ্কে প্রবেশ করে চরিত্রের আর একটি দিক ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা।

তাঁর আকস্মিকভাবে মনে হলোপ কি জানতো সেই কলঙ্কের কথা? তা সম্ভবনয়।দুর্ঘটনা বলেই সে জানে; আর সে জানাই কি সুমিতির প্রতি তার মনকে করুণ এবং পরে সংবেদনশীল করেছিলো?

মনসা যা বলে গেলো সেটা একটা আড়ম্বরহীন সাধারণ ব্যাপার। মনসা প্রায় তার বাল্য থেকেই অনসূয়ার অনেক উপবাসের সঙ্গী, তার কথা স্বতন্ত্র। অনেকসময় বাড়ির অন্য লোকেরা জানতেও পারে না। অনসূয়ার নিয়মিত একাধিক বার্ষিক উপবাসগুলির একটি হিসাবে দিনটি অলক্ষ্যে গড়িয়ে চলে যায়।

রান্নামহলের ব্যবস্থাপনা শেষ করে অনসূয়া দেখলেন মনসা ঠিক পথেই চলেছে। ব্যাপারটা সুমিতির কাছে প্রকাশ করার মধ্যে কুণ্ঠাবোধ আছে কিন্তু অপ্রকাশ রাখাও যেন একটা গোপনবৃত্তি। অবশেষে তিনি স্থির করলেন-হয়তো মনসাই বলবে, এবং হয়তো সুমিতিও উপবাস করবে। নতুবা বাড়ির লোকগুলির চোখে সুমিতি যেন কিছুটা হীন হয়ে যাবে।  

মনসার এবারকার চালচলন অনসূয়ার কাছে অর্থযুক্ত বলে বোধ হলো। সে যেন সুমিতিকে এ বাড়ির সকলের সঙ্গে মিলিয়ে দিতে চায়। তা ভালোই হবে যদি মনসা সফল হয় এ ব্যাপারে। ছেলের প্রেমপাত্রী ও তার শ্রদ্ধাস্পদের মধ্যে ব্যবধান গড়ে ওঠা নিশ্চয়ই ভালো নয়।

সুকৃতির জন্য মন করুণ হয়েছিলো, সেই মনে অনসূয়া চিন্তা করলেন : সুমিতি বুদ্ধিমতী মেয়ে, সে কি বুঝতে পারবে না যে ব্যক্তি-অভিমান শুনতে যত জোরদার আসলে ততটা নয়। আমি যা, আমাকে সেই ভাবে গ্রহণ করো, এটা আধুনিক কিন্তু অর্থহীন কথা।

.

সুমিতির শরীরটা একটু খারাপ, সকালে উঠতে দেরি হয়েছিলো, মানে অনিচ্ছা বোধ করে হাত মুখ ধুয়ে এসে সে নিজের ঘরে বসে একখানি পত্রিকায় চোখ রেখেছিলো। এতক্ষণে চায়ের ট্রে নিয়ে দাসীর এবং প্রায় তার সঙ্গে রূপুর এসে যাওয়ার কথা। এমন সময়ে মনসা এলো।

বউদি, তোমার চা পাঠাতে আমি নিষেধ করেছি। আজ উপোস করতে হবে, পারবে তো?

তোমার কথাগুলো এমন যে রসিকতা কিংবা অন্য কিছু বোঝা কঠিন।

তা নয়, তুমি আমার সঙ্গে এসো।

মনসার সঙ্গে সুমিতি অন্দরমহলের একতলায় একখানি ঘরে গিয়ে দাঁড়ালো। বহুদিন বন্ধ থাকার জন্য ঘরখানিতে সোঁদা সোঁদা গন্ধ। সুমিতি দেখতে পেলো দুজন দাসী কাপড়ের টুকরো দিয়ে ঘরের আসবাবপত্রগুলি মুছচে। স্পিরিটের গন্ধও এলো নাকে। কোনো একটি স্মৃতিঘরে নাম করা লোকের ব্যবহৃত শয্যা-উপাদান, বসনভূষণ যেমন সাজানো থাকে তেমনি করেই এ ঘরখানা সাজানো। বিছানার পাশে ছোটো একটা টিপয়ে একটা বইও আছে। খাটের পায়ের দিকে মখমলের একজোড়া মেয়েলি চটি।

মনসা বললো, এটা আমাদের কাকিমার ঘর।

কাকিমা? কাকিমা বলতে কি সুকৃতিকেই নির্দিষ্ট করছেনা মনসা? তা যদি হয় তবে এ সবই কি সুকৃতির ব্যবহৃত জীবন-উপকরণ? মৃত্যুর আগের দিন কি সুকৃতি ওই বইখানি পড়েছিলো?

সুকৃতির যখন মৃত্যু হয় তখন সুমিতির শৈশবকাল। দীর্ঘদিনের ব্যবধানে ঘটনাটা মনে পড়লেও তা শোক বহন করে না।

সুকৃতির একটা পূর্ণাবয়ব প্রতিকৃতি ছিলো সেই ঘরে। সবুজ রঙের বেনারসি শাড়ি পরে সুকৃতি লীলাভরে নিজের আঙুলগুলো যেন দেখছে। হাল্কা গড়ন ছিলো সুকৃতির, ছবিতে যেন একটি ফুলের গুচ্ছকে সাজিয়ে রাখার কায়দায় আঁকা হয়েছে। ঠিক এত বড়ো কোনো ফটো বা তেলরঙের ছবি সুমিতিদের বাড়িতে নেই, কিন্তু তাই বলে চিনতে অসুবিধা হবে এমন নয়। বরং চিনে এই লাভ হলো যে উদ্বেল অশ্রুগ্রন্থিগুলো প্রবাহের পথ পেয়ে স্নিগ্ধ হলো কিছুটা।

মনসা বললো, বউদি, মালা আনিয়ে রেখেছি, পরিয়ে দাও। আজ কাকিমার মৃত্যুতিথি। সেইজন্যেই আজ তোমাকে উপোস করতে বলেছি।

সুমিতি উত্তর দিলো না, অনেকক্ষণ নির্নিমেষ দৃষ্টিতে সুকৃতির ছবির দিকে চেয়ে রইলো, তারপর মালাটা পরিয়ে দিলো।

যে কথাটা প্রথম সে বললো সেটা এই–দিদি এত সুন্দরী ছিলেন, আমার ধারণা ছিলো না, মনসা। এমন বউই তোমাদের বাড়িতে মানায়।

বাইরে এসে সুমিতি বললো, তোমরা আর কী করো, মনসা?

আর কিছু নয়। সমস্ত দিন এ ঘরটা খোলা থাকে। সন্ধ্যায় প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয় আর এক বৎসরের জন্যে।

ছবিটা আমার শোবার ঘরে নিয়ে যাওয়া যায় না?

কী এমন আপত্তি তাতে? জেঠিমাকে বলবো।

দিনটার মাঝামাঝি সময়ে সুমিতি তার ঘরে অর্ধশায়িত অবস্থায় মনসার সঙ্গে আলাপ করছিলো। কিছুক্ষণ আগে মনসা যা বলেছে তা থেকে ধরে নেওয়া যায়, হয়তোবা এই পরিবারের আত্মপ্রসারের একটা সময় এসেছিলো, ঠিক তখনই সুকৃতির মৃত্যু গতিটাকে মন্থর করে দিয়েছে।

তদানীন্তন রাজনৈতিক আবহাওয়া বিশ্লেষণ করতে করতে মনসা বলেছিলো, কাল আমাদের আঘাত করেছিলো। কালের স্রোত যে পথ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে তা থেকে অনেক দূরে আমাদের অবস্থান, তবু তারই একটা আবর্তসংকুল ধারা প্লাবনের মতো এসে আমাদেরকাল সম্বন্ধে সচেতন করেছিলো, বিমুখও করেছে।

বর্তমানে ফিরে মনসা বললো, বউদি, কাকিমার ছবি তোমার ঘরে এনে রাখো। সে ভালোই হবে। কাকিমাকে জেঠিমা গভীরভাবে ভালোবাসতেন, কিন্তু সে গোপন ভালোবাসা বাইরে প্রকাশ করতে পারেন না। যে সাহস দেখাতে গিয়ে তিনি মাঝপথে থেমে গেছেন, তুমি যদি পারো তাহলে হয়তো তিনি খুশিই হবেন।

সুমিতি বললো, এ বাড়ির কারো সাহসের অভাবেই যে এই গোপন ব্যবস্থা, তা নাও হতে পারে।

কথাটা বলতে বলতে সুমিতি অনসূয়ার সম্বন্ধে এই রকম ধারণা করলো : এটা জীবনের একটা বিশিষ্ট ভঙ্গি। দু’এক ক্ষেত্রে মায়েদের সন্তানহে গোপন রাখতে হয়। সেটা যে সাহসের অভাবেই তা নয়, শালীনতাবোধও অনেকসময়ে আজীবন দুঃখ বহনের পরামর্শ দেয়। কুন্তির সাহসের অভাব ছিলো না। অনসূয়ার এ ব্যাপারেও যেন কতকটা তেমনি এক মনোভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছ। এ বাড়ির যা কিছু সব বিধৃত রয়েছে অনসূয়াতে, সেইজন্যই তার এই সংযম। যে বিধান তিনি ভাঙতে পারেন অনায়াসে, যার জন্য তার কৈফিয়ত নেওয়ার কেউ নেই, সেটাই যেন ভাঙা কঠিন ঠিক সেইজন্যেই।

দিনটা একেবারে শেষ হয়ে যাওয়ার আগে মনসা দুজন ভৃত্যের সহায়তায় সুকৃতির ছবিটা সুমিতির ঘরে পৌঁছে দিলো।

.

এখন সন্ধ্যা। সান্যালমশাইয়ের ঘরে এসে অনসূয়া বললেন, আমাকে ডেকেছো?

খুঁজছিলাম। উপাসনা হয়েছে?

এ জীবনে সেটা আর হলো কোথায়?

মামার বাড়ির দেওয়ানজির গল্প তোমার মনে পড়ে?

শুনেছিলাম যেন।

তাকে বোধ হয় তার বেদিটা ছাড়া কল্পনা করা কঠিন। আমি তাকে বোধ হয় শৈশবে দেখেওছিলাম। বকের পাখার মতো শাদা চুল, অতিশীর্ণ এক বৃদ্ধ ঘন্টার পর ঘন্টা স্তব্ধ হয়ে তার মর্মর বেদিটায় বসে আছেন। তার পরে যারা দেওয়ান হয়েছিলো তারা সকলেই ম্যানেজারের পদবীতে রাজ্য শাসন করতো। যে রানী তাকে নিয়োগ করেছিলেন, যে রাজার আমলে তিনি নীলকরদের শাসন করেছিলেন তারা কেউ নেই। রাজার ছেলে তখন জমিদার। দেওয়ানজির স্থাপিত স্কুল ধ্বংস হয়ে গেছে, তার লাইব্রেরির সেকেলে বইগুলো ধুলোর মতো মূল্যহীন, কিন্তু তার সেই মর্মর বেদি আর তিনি যেন অবিনশ্বর একটি উপাসনা। উপাসনার কথায় তিনিও বলতেন–পারলাম কোথায় ডাকতে?

একটা স্বল্প বিরতির পরে অনসূয়া বললেন, হঠাৎ তার কথা মনে হলো কেন?

ঠিক বুঝতে পারছি না। তোমাকে ডেকেছিলাম কেন তাই বলি শোনো। তোমার ছেলেরা বড়ো হয়েছে, এখন ওদের জীবনের উপকরণে খানিকটা আয়াস প্রয়োজন।

ওদের কষ্ট কোথায় দেখলে?

কষ্ট নয়। বিশিষ্ট অভ্যাস হওয়ার বয়স হচ্ছে ওদের। শোবার ঘরের আলো কী রকমটা দরকার, সেফে কী ধরনের বই থাকা উচিত, কিংবা আদৌ বই থাকবে কিনা এমন সব রুচিবৈশিষ্ট্য ওদের হয়েছে বৈকি, অন্তত হলে অন্যায় হয় না। সুমিতিরও এবিষয়ে কিছু বলার থাকতে পারে।

এদিকটায় আমার খেয়াল ছিলো না।

তাতে এমন কিছু ত্রুটি হয়নি তোমার। সুমিতির জন্যে আমি একটা মহলের কথা চিন্তা করছি। পাশাপাশি দুখানা শোবার ঘর, একটা স্বতন্ত্র বসবার ঘর, একটা বাড়তি ঘর যা লাইব্রেরি কিংবা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যায়। এবং সেই সঙ্গেই ভাবছি রূপুর জন্যে যে-মহলটা হবে এখন থেকেই তারও পরিকল্পনাটা ঠিক করে রাখা দরকার।

অনসূয়া কিছু বলার আগেই সান্যালমশাই হেসে আবার বললেন, এতে নিশ্চয় তোমার ছেলেরা জমিদার পরিবারের সহজলব্ধ আয়াসে অমানুষ হয়ে যাবে না। এ ধরনের কথা নিয়ে একসময় তাদের অনেক দাম্পত্য বিতর্ক হয়ে গেছে। উকিলের মেয়ে অনসূয়া সে সময়ে জমিদারগোষ্ঠী সম্বন্ধে যে মতটি পোষণ করতেন সেটা শ্রদ্ধার নয়। অনসূয়ার পক্ষে এখন সেই মনোভাবটিকে মনের মধ্যে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। তার ধারণা হয়েছিলো এমন একজনের সঙ্গে তার বিবাহ হয়েছে যার বিরাট প্রাসাদের কোন কক্ষে কত উপপত্নী আছে তার নিশ্চয়তা নেই। নিজের রূপের উপরে তার অভিমান হয়েছিলো। রূপের জন্যই বিবাহ। সে সময়ে তিনি স্বামীকে ভয় করতেন, ঘৃণা করতেন। পরে কর্তব্যবোধকে আঁকড়ে ধরে থাকতে থাকতে প্রথমে ঘৃণা তারপর ভয় চলে গিয়েছিলো। কিন্তু তাসত্ত্বেও অনসূয়া নিশ্চিন্ত নন। যে অত্যাচার বৃত্তির পোষণ করেছে এই পরিবারের একাধিক পুরুষ, সেটা অর্জিত গুণ হয়ে এদের রক্তধারায় চলছে না তা কে বলবে? তখন অনসূয়ার ছেলেপুলে হয়নি, দু-একটা কথা বলার মতো সাহস তিনি অর্জন করেছেন, একদিন সেই কিশোরী অনসূয়া বলেছিলেন–আমাদের ছেলেরা যেন নীতিজ্ঞানহীন না হয়। কথাটা দুঃসাহসে বলে ফেলে অনসূয়া লজ্জায় মুখ লুকিয়েছিলেন, প্রায় পুরো দুটো দিন স্বামীর সম্মুখে আসেননি। পরবর্তীকালে এই লজ্জা থাকার কথা নয়, ছিলোও না। ছেলে মানুষ করা নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর তখন বহু বিতর্ক হয়েছে। সেসব বিতর্কে অনসূয়ার পক্ষে মূল কথা ছিলো–অনায়াসলভ্য জীবনের উপকরণ মানুষকে অপদার্থ করে। অনেকসময়ে অনসূয়ার কথা মেনে নিলেও কখনো কখনো সান্যালমশাই বলেছেন–তোমাদের এই ব্রাহ্মশালীনতাবোধ, এই নীতিবোধের খর্য ভিক্টোরিয়ান ইংলন্ড থেকে ধার করা। এই পালিস সে যুগের ইংরেজদের বৈশিষ্ট্য ছিলো। এর সত্বস্তুটুকু আবার পিউরিটানদের থেকে ধার করা। কিন্তু খোঁজ নিলে জানতে পারবে, কি এদেশের ব্রাহ্মগোষ্ঠীতে, কি ওপারের ইংরেজ সমাজে বর্তমান এত বাছবিচার নেই। অবশ্য অনসূয়ার শুচিপ্রিয়তাকে মূল্যও দিয়েছেন তিনি।

কিন্তু এই বর্তমানে অনসূয়াকে তার শুচিপ্রিয়তার কথা তুলে টুকতে কৌতুক বোধ হলো। সান্যালমশাই বললেন, কিছু বললে না?

সহজলব্ধ জীবনের উপকরণ-প্রাচুর্য বয়স্ক মানুষদেরও সংসারে অরুচি আনতে পারে, এবং সে অরুচিবোধটাকে দূর করার জন্যে সে কুপথ্য করতেও পারে। কিন্তু ছেলের জন্যে ঘর তুলতে চাচ্ছো তাতে কি এমন অন্যায় হবে? আমার ঘরগুলো তুলবার সময়ে আমার রুচির মূল্যও তুমি দিয়েছিলে।

তুমি যখন মত দিচ্ছো তাহলে বলি শোনো : এঞ্জিনিয়ার না করবে, কিন্তু পরিকল্পনাটা আমাদেরই করা দরকার। তুমি এসো, আমার পরিকল্পনাটা তোমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছি।

দুজনে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন, সেখানে দাঁড়িয়ে সান্যালমশাই অনসূয়াকে তার পরিকল্পনাটা বুঝিয়ে দিলেন। অনসূয়াও আলোচনা করলেন।

ফিরে এসে সান্যালমশাই বললেন, বলল, এ কি আমার উচিত নয়, এমন করে ওদের গুছিয়ে দেওয়া?

তুমি যে ছেলেদের আমার চাইতেও বেশি ভালোবাসো এ তারই প্রমাণ।

বলো কী, এ কি আমারই আত্মবিস্তারের চেষ্টা নয়?

অনসূয়া কিছু না বলে মুখ নিচু করে হাসতে লাগলেন।

অমন মধুর করে হাসছো কেন?

এখন বুঝতে পারছি কেন তোমার দেওয়ানজিদের কথা মনে পড়ছে।

কেন, কেন?

তোমার বর্তমান মনের অবস্থায় সান্যালদের রক্ত আবার উদ্দাম হয়ে উঠেছে, বিস্তার চাইছে। তোমার বহু-ঘোষিত শান্তির বিপরীত। যা এতদিন পেয়েছে ভেবেছিলে তাকে ত্যাগকরে আসতে হচ্ছে বলেই মনের এখানে-ওখানে লুকিয়ে থেকে সেটা আত্মপরিচয় দিচ্ছে।

তাই কি? ওরে, তামাক দে।

কেউ শুনলো কিনা দেখবার জন্য উঠে গিয়ে অনসূয়া দেখলেন একজন দাসী এগিয়ে আসছে।

কী মা?

তামাক চাইলেন।

হাসিমুখে অনসূয়া ফিরে এসে বসলেন।

কিছু বলবে মনে হচ্ছে। সান্যালমশাই বললেন।

এবার ধান কীরকম হয়েছে?

ইংরেজিতে যাকে বাম্পার ক্রপ বলে।

প্রজারা বোধ হয় কেউ টাকা ফেলে রাখবে না?

তা কি এখনই বলা যায়? তবে শুনছি বিলের পয়স্তি জমি চাষযোগ্য হচ্ছে, এদিকেও চর জেগেছে বুধেভাঙার লাগোয়া।

অনসূয়া হেসে বললেন, তোমাদের দেশের প্রবাদটাই মনে পড়ছে; তোমারও ধানের নেশা লেগেছে।

সান্যালমশাই কথা না বলে তামাকে টান দিতে দিতে মৃদু মৃদু হাসলেন।

সুকৃতির তৈলচিত্রে রোদ এসে পড়েছে। দেয়ালের যে জায়গাটায় টাঙানো হয়েছে ছবিটা  সেখানে সকালে ঘন্টাখানেক রোদ পড়ে। মনসা লক্ষ্য করে বলেছিলো, নষ্ট হয়ে যাবে না তো, বউদি?

বলা কঠিন। এ যদি আমাদের মাস্টারমশাইয়ের আঁকা হয়ে থাকে তবে তিনিই আমাদের সমস্যার সমাধান করতে পারেন।

পরদিন সকালে যখন রোদ পড়ার কথা, সদানন্দ এলো। ফুটবল দিয়ে মেপেজুখে জায়গাটা ঠিক করে ছবিটাকে বসিয়ে দিয়ে সে বললো, তা যা-ই বলুন, মনটিকে ঠিক ধরা যায়নি ছবিতে।

মনসা বললো, কেন, মাস্টারমশাই?

তখন আমি ভেবেছিলাম অত্যন্ত হাল্কা ফুলের মতো একটি মন ছিলো এঁর। পরে যত ভেবেছি ততই আমার মনে হয়েছে, অত্যন্ত অভিমানী মেয়ে। সে অভিমানটা যেন ফোটেনি।

হতে পারে তা। মনসা বললো, আপনি এ ছবিটার একটা জোড়া আঁকুন না।

তা মন্দ হয় না, সদানন্দ বললো, তা মন্দ হয় না যদি এ জায়গাটায় সুমিতি-মায়ের একটা ছবি থাকে। কিন্তু এক বিপদ হয়েছে, জানো মণি, আমি যেন কারো প্রভাবে পড়েছি, পোর্ট্রেট আঁকতে হলে যেমনটা দরকার সেটা আছে কি না-আছে। তা হলেও ভালো প্রস্তাব।

সদানন্দমাস্টার চলে গেলো।

সুমিতি বললো, মণিদিদি, তুমি কিন্তু কখনো ছবি আঁকার কথা মনে করিয়ে দিয়ো না।

যদি তোমার এখনকার কোনো মনোভাব তার কল্পনাকে আকর্ষণ করে থাকে তবে ছবি আঁকার কথা মনে করিয়ে দিতে হবে না। আর তখন তুমি প্রত্যাখ্যান করতেও পারবে না। সেটা তোমার নিজের কাছেই বাড়াবাড়ি বলে মনে হবে।

কি বিপদ ঘটালে তুমি! তুমি নিজে কখনো সিটিং দিয়েছো?

মনসার চোখে হাসি ফুটলো। সে বললো, ভাই বউদি, তুমি কি আমাকে এত কুরূপা মনে করো যে বয়ঃসন্ধির সময়েও কোনো শিল্পীর শ্রদ্ধা আকর্ষণ করবো না?

‘ভালো হয়েছিলো নিশ্চয়ই ছবি?

তাকে মানুষের ছবি বলে মনে হয় না। আমার চোখ দুটো কি জুলফির উপর দিয়ে বয়ে গিয়ে কান ছুঁয়ে আছে?

সে ছবি কোথায়, ভাই?

আগে জ্যাঠামশাইয়ের ঘরে থাকতে দেখেছি, এখনো আছে বোধ হয়।

সুমিতি বোধ করি মনে মনে ছবিটাকে কল্পনা করার চেষ্টা করলো। একটু পরে সে বললো, মাস্টারমশাইকে আমার অপূর্ব মনে হয়। তোমার রবিনহুডের গল্প মনে আছে?

কেন বলো তো? ফ্রায়ার টাকের কথা বলছো? তার পরে খিলখিল করে হেসে উঠে মনসা বললো, ঠিক ধরেছো। মাস্টারমশাইকে বলবো।

বলো কি?

না, না, উনি শুনে খুশি হবেন। বলবেন, তার ছাত্রদের দলে মিশবার উপযুক্ত একজনই এসেছে।

কথার মোড় ফিরিয়ে সুমিতি বললো, কথাটা যখন উঠলো, বলি তোমাকে। একই জায়গায় বিশ-ত্রিশ বছর চাকরি করা অসাধারণনয়, তাহলেও ওঁর মতোশিক্ষিত এবং গুণী লোকের পক্ষে রকম একটা গ্রামে জীবন কাটিয়ে দেওয়া খুব প্রাত্যহিক ঘটনা নয় কিন্তু।

জেঠিমা ওঁর ব্যক্তিগত ব্যাপারের খোঁজ খবর রাখেন। তাঁর কাছে শুনেছি শৈশবে ওঁর বাবার মৃত্যু হয়। ছাত্র অবস্থাতেও উনি সত্য আর দু-তিনটি ছোটো ভাই বোনকে পালন করতেন। তারপর অর্থোপার্জন করে বোনের বিয়ে দিয়ে সংসারকে একটু খাড়া করে দিয়ে এখানে চলে আসেন।

নিজের আত্মীয়-স্বজনের খবর রাখেন না?

রাখেন বৈকি। আগে দেখেছি বছরে দুবার ছুটি নিয়ে চার-পাঁচ মাস অন্যত্র গিয়ে থাকতেন। একবার ওঁর বোন এসেও কিছুদিন এখানে ছিলেন। ছোটো এক ভাই এখন কী একটা ভালো। চাকরি করে, ওঁদের মা তার কাছেই থাকেন। কিন্তু সব চাইতে ছোটোটির কথা অবাক করার মতো।

কী হয়েছে তার?

গল্পের বইয়ের রোমান্টিক নায়কের মতো বিনিপয়সায় য়ুরোপে গিয়েছিলো লেখাপড়া শিখতে। তার কোনো খবর পাওয়া যায় না। পয়সার জন্যে সে দেশলাই ফিরি করতে শুরু করেছিলো–এই শেষ খবর।

কাহিনীটা সুমিতিকে অন্যমনস্ক করেছিলো। একটু পরে সে বললো, এই বেদনাবোধের জন্যেই কি মাস্টারমশাই সমাজবিমুখ?

তা কী করে বলবে? সদানন্দ নামটা জেঠিমা রেখেছেন ওঁর স্বভাব দেখে। শোনা যায়, বিয়ের ভয়ে পালিয়েছিলেন–একদিকে মা, অন্যদিকে সহপাঠিনী সেই মেয়েটি। দুজনের মাঝখানে পড়ে, আমার মনে হয়, মাস্টারমশাই সত্যিকারের পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেছিলেন।

মনসা যে সুরে কথা বলে তেমনি করে সুমিতি বললো, কাপুরুষ।

আসলে ফ্রায়ার টাক। বললো মনসা। একটু পরে আবার বললো, চোখের সামনে পাথর হয়ে থেকে কষ্ট না দিয়ে নিজেকে লুকিয়ে ফেলেছে।

মনসার খোঁজে একজন দাসী এলো, তার হাতে ট্রেতে চায়ের সম্ভার।

আজ রবিবার? মনসা জিজ্ঞাসা করলো, আমার মনে ছিলো না। এসোবউদি, রবিবার করা যাক।

সুমিতি বললো, রবিবারে কি তোমার দুবার ব্রেকফাস্ট হয়? তোমাদের দেশে রবিবারের চিহ্ন বুঝি চা?

তা বলতে পারো। এইটুকুই তো আছে। ফুর্সিও নেই, কোতল করি এমন মোবারকও নেই। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মনসা বললো, এর আগে একদিন রসিকতা করে বলেছিলে, রাজনীতি তোমার সময় কাটানোর ছল। সেদিন তোমাকে বুঝতে পারিনি, তারপর মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে তুলনা করে তোমাকে যেন চিনতে পারলাম। সক্রিয় রাজনীতিতে নিরুৎসাহ মাস্টারমশাই আমাদের দাদার জেলখাটা মতবাদের গোড়ার কথা জুগিয়েছেন। এ যেন ভূগোল শেখান, ছাত্রকে ভুল শেখানো যায় না বলেই ঠিকটা শিখিয়ে দিয়েছেন। যেন সেকালের কোনো শস্ত্রবিদ, সন্তুষ্ট হলে দিগ্বিজয়ের অস্ত্র দেন কিন্তু নিজে শস্ত্রচালনায় বীতস্পৃহ। তেমনি যেন তোমার ব্যাপার। বিদ্রোহ করাটা যুক্তিগ্রাহ্য, যেমন স্নান করা কিংবা বই পড়া, তার একটি প্রকাশ রাজার প্রতি তোমার বিরোধ, নতুবা শস্ত্রের নেশায় ক্ষত্রিয়ের মতো বিরোধের নেশায় তুমি চলতে চাওনি।

সুমিতি হেসে বললো, ননদিনী, এ তোমার ভাইবউয়ের দোষ ঢাকবার চেষ্টা। সৎ চিন্তা নয়।

তা কেন হবে? এককালে যদি অঙ্ক করে থাকো চিরকালই কি অঙ্কই করতে হবে, কাব পড়া বারণ? কিংবা পৃথিবীর আধখানা ভাঙাগড়া তো মেয়েদের শরীরে, তাদের জীবনে। বিপ্লবী যদি আবার মানুষও হয়, বসতে হয় না তাকে সেই দুখানা পায়ের কাছে?

মনসা চা শেষ করে বললো, চলো বউদি, রবিবারে। তুমি কি তোমার বাড়িটাকে চিনেছো এতদিনেও? একটা উপবন আছে তোমার তা কি দেখেছো?

সুমিতি বুঝলো মনসা কোথাও যেতে চায়। কিন্তু সে দ্বিধা করতে থাকলো। তখন মনসা উঠে আলনার কাছে গেলো। সুমিতির জন্য শাড়ি বাছাই করতে গিয়ে আলনায় একেবারে নতুন। একটাকে দেখে সে বললো–বাহ্, এই তো দেখছি সিল্কের খদ্দর। তা হলে রূপুর সমস্যা মিটেছে। গতবারে বলছিলো শুনেছিলাম, বউদি খদ্দরে অভ্যস্ত, কী যে হবে? এটাই পরো না হয়। আমি বাগিচাকে নির্জন করে আসি।

মনসা ফিরে এলে তারা খিড়কি দরজা দিয়ে বাগিচার পথে বেরিয়ে পড়লো।

অনেক জায়গা পেলে যে রকম হতে পারে বাগানটা আয়তনে তেমনি। দেশী নানা সুস্বাদ ফলের গাছ তো বটেই বিদেশী ক্ষণপ্রসবী গাছও সেখানে সে অবস্থায় থাকা স্বাভাবিক। তারা ফুলের কেয়ারিগুলোকে পার হয়ে ফলের গাছগুলোর মধ্যেকার বীথিগুলো দিয়ে চলতে থাকলে মনসা, এটা তোমার হিমসাগরের লাইন, এটা তোমার ক্ষীরসাপাতির–এমন পরিচয় করে দিতে লাগলো।

সুমিতি একবার জিজ্ঞাসা করলো, এত কি তোমাদের খেতে লাগে? এ তো বেশ একটা ক্যানিং ইনডাস্ট্রির জোগাড়।

মনসা বললো, রাম কহ, তোমরা আবার ইনডাস্ট্রিতে কবে গেলে?

সুমিতি বললো, তা কেন, গ্রামে তো আরও মানুষ আছে। গ্রামের অন্যত্রও এরকম গাছ হতে পারে।

ছায়ায়, আলোয়, ছায়াতে আলোর জালিকাটা পথে তারা ঘুরতে থাকলো। হিমসাগর,ন্যাংড়া এসব নামের সঙ্গে পরিচয় থাকায় শহরের মেয়ে সুমিতির সে সব সুস্বাদের উৎস সম্বন্ধে এই প্রথম কৌতূহল আর তার নিবৃত্তি হচ্ছিলো। তার একবার সেসবের জন্য আমাদের এসব’ এরকম মমতা বোধ হলো। কিন্তু মনসা বললো, মাস্টারমশাইয়ের কথা কি দাদার কাছে শোননি? তিনি তোমাকে ইনডাস্ট্রির কথা বলতে পারবেন হয়তো।

সুমিতি হাসতে হাসতে বললো, তিনি হয়তো বলবেন কেন ইনডাস্ট্রি হয় না, তার অবশ্য বিজ্ঞানসম্মত কারণ আছে, কিন্তু এখন আমার তা মাথায় আসছে না।

মনসা বললো, বিউটিফুল। প্যাঁচটা ঠিক ধরেছো। হয়তো আসল কথা, বাজার কোথায়?

চলতে চলতে সুমিতি বললো, অথচ, রূপুর মতো ছোটো ছেলেটি যদি এই সিল্কের খদ্দর জোগাড় করে থাকে, প্রমাণ করা করা যায় এখানকার মানুষেরা ইনডাস্ট্রির পক্ষে অনুপযুক্ত নয়।

মনসা বললো, হয়তো চাপড়ির সেই তাঁতীর বোনা। হয়তো রূপুর পরামর্শে এই সুতোটা সে মুর্শিদাবাদে জোগাড় করেছে। হয়তো সে তাঁতী মাস্টারমশাইয়ের ছাত্র। সে কিন্তু অন্য সময়ে চালানি একশ’ বিশ কাউন্টের সুতোয় ধুতি শাড়ি বুনে থাকে। তোমার ক্লান্তি বোধ হচ্ছে না তো? তুমি কি গ্রামের মেয়েদের দিয়ে সিল্কের সুতো কাটানোর কথা ভাবছো?

চলতে চলতে সুমিতির মনে পড়লো সদানন্দ আর তার স্কুলের কথা। ইতিমধ্যে কবে যেন কে যেন সেই ছোট্ট স্কুলটার কথা বলছিলো।কী শেখানো হয় সেখানে?কারা ছাত্রছাত্রী সেখানে? যে বলছিলো সেই স্কুলের কথা তার মতে দুর্ভিক্ষে ছাত্ররা পালিয়েছে। হয়তো তা সত্য নয়।

হয়তো সেই ঘটনার পরে সদানন্দর মন অন্যদিকে সরেছে।

সুমিতি ভাবলো, আজ সদানন্দকে কি খানিকটা বেশি চিনতে পেরেছে সে? সদানন্দর অত্যন্ত লম্বা ঝুলের সিল্কের পাঞ্জাবি, মাথাভরা টাক ও মুখভরা হাসির সঙ্গে ফ্রায়ার টাকের ছবির মিল থেকে সেই নামটা মনে পড়েছিলো। ফ্রায়ারের ভোগে আসক্তি ছিলোনা বলা যায় না। অন্যদিকে সে এক ধরনের বিদ্রোহী ছিলো বটে। তখনকার সমাজ ও রাষ্ট্রকে সে ঘৃণা করতো বলেই সে বনবাস বেছে নিয়েছিলো।

সদানন্দর মস্তিষ্ক যখন সামন্ততান্ত্রিক জীবনধারার বিরুদ্ধে যুক্তি দিতে থাকে, তখন তার মস্তিষ্কের অন্য অংশ যেন এই পলাতক জীবন, যা সামন্ততন্ত্র-আশ্রিত, তাকে বেছে নেয়। এ কি অন্তর্ঘাত? অথবা এ কি ঘুণপোকার স্বভাব? ও, না না, সে নিজের চিন্তায় হেসে ফেলো। ইনটেলেকচুয়াল বলতে এরকমই হয়। নতুবা বলতে হয় কোনো দুজন মানুষের চরিত্র এক নয়।

মনসা বললো, কথা বলছে না, ভাবছ বুঝি খুব?

সুমিতি বললো, না, ননদিনী, বিপ্লবীদের একজোড়া পায়ের কাছে বসার কথা ভাবছিলাম।

মনসা হেসে বললো, তুমি কি কারো বিদগ্ধা প্যারিসিনীকে ত্যাগ করে নিরক্ষরা তাকায়া মাওরিনীর পায়ের কাছে বসার কথা শোননি?

সুমিতি ভাবলো: গগ্যাঁর সেটা একরকমের বিপ্লব বটে। কিন্তু তারা তখন খিড়কির পুকুরের দিকে চলে আসছিলো। পথের পাশে একটা ছাদহীন লতায় ঢাকা একটা উঁচু দেয়াল দেখে সে জিজ্ঞাসা করলো, হটহাউস নাকি, ভাই? নাকি মেয়েদের পোশাক পরার জন্য?

মনসা বললো, না গো, অত দূরে তাহলে সে অসুবিধার বন্দোবস্ত এখানে মানা হতো না। ওটা প্রকৃতপক্ষে টেনিসের স্ক্রিন যা লতায় ঢেকেছে।

বেড়ানো উদ্দেশ্য বটে, ক্লান্ত হওয়া পর্যন্ত নয়। তারা পুকুরের পার ধরে খিড়কির ঘাটের দিকে বরং চললো।

মনসা বললো, আচ্ছা, বউদি, একটা কথা বলবো ভাবি। খুব কৌতূহল আমার। তোমার আধুনিকতার সাহসকে আর ভালোবাসার ক্ষমতাকে আমি অবাক হয়ে দেখি। এটা বেশ ভালোই যে তুমি যেন বলছে আমি যেমন তাই থাকব, ভালোবাসতে এসেছি, আমাকে নেবে কিনা, তা তোমাদের দেখার। বোঝাই যাচ্ছে এই গ্রাম্য আভিজাত্যের প্রাচীনতাকে তুমি যাচাই করছে। হয়তো দেখছো সেই প্রাচীনতা আর আভিজাত্য এত গভীর, যেন আকাশপট, যা তোমার আধুনিকতার আলোকে অনায়াসে ধারণ করে। এদিক দিয়ে কিন্তু তুমি আর জেঠিমা একই জাতের।

সুমিতি বললো, ভাই, মণি, তুমি কবি আর তোমার কথা বলার ধরন অনেকটাই তোমার দাদার মতো।

মনসা সুমিতির মুখের দিকে চেয়ে হাসলো, বললো, হয়তো দুজনেই ওটা জেঠিমার ঠোঁট থেকে পেয়েছি। কিন্তু বলল, জেঠিমা এ বাড়িতে এসেছিলেন টেনিস র‍্যাকেট আর চার্চ অর্গান নিয়ে,তুমি কী নিয়ে এসেছে জানতে ইচ্ছা করে। বিশ্বাস হয় না, এ তোমার নিছক আন্ডারগ্রাউন্ডে আসা।

পুকুরের পার ঘুরে তারা খিড়কির বাঁধানো ঘাটে এসেছিলো। তখন অনেকে জলে নেমেছে মানে।

মনসা যেন জলে ভাসা সেই নানা রঙের পাখপাখালি দেখতে, তাদের সঙ্গে কথা বলতে ঘাটে গিয়ে দাঁড়ালো। সুমিতি তাকে অনুসরণ করছিলো, কিন্তু কোথা থেকে কীভাবে হঠাৎ তার মনে পড়ে গেলো এই ঘাটেই আত্মহত্যা করেছিলো সুকৃতি। হয়তো তারপর থেকেই অনসূয়া আর এদিকে আসেন না। সুমিতির পা দুখানা যেন পাথরের হয়ে সেই স্নানের ঘাটের সঙ্গে জুড়ে গেলো।যেন কী এক ইয়ত্তাহীন পরিবর্তন ঘটেছে এই জলে। কেন তা আর কোনদিনই জানা যাবে না। সমিতির মুখে যেন সেই ইয়ত্তাহীনতার নীল লাগছে। ততক্ষণে মনসা শাড়ি গুটিয়ে জলের প্রান্তে দাঁড়িয়েছে, যেন কুলকুচো করা, পা ধুয়ে নেয়া তার খুব দরকার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *