০২৪. পরীক্ষিতের নিকট তক্ষকের আগমন

সৌতি বলে, অবধান কর মুনিগণ।
এমত উপায় বহু কৈল মন্ত্রিগণ।।
কাশ্যপ নামেতে মুনি সর্পমন্ত্রে গুণী।
রাজারে দংশিবে সর্প লোকমুখে শুনি।।
ধন ধর্ম্ম যশঃ পাব ভাবি দ্বিজবর।
ত্বরা কির গেল দ্বিজ হস্তিনা-নগর।।
তক্ষক আইসে বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের রূপে।
বটবৃক্ষতলে দেখা পাইল কাশ্যপে।।
তক্ষক বিলল, দ্বিজ এলে কোথা হৈতে।
কোথাকারে যাহ বড় গমন ত্বরিতে।।
কাশ্যপ বলেন, পরীক্ষিত নরবর।
আজি তাঁরে দংশিবে তক্ষক-বিষধর।।
সে কারণে যেই আমি রাজার সদনে।
মন্ত্রবলে রক্ষা আমি করিব রাজনে।।
তক্ষক বলিল, তুমি অবোধ ব্রাহ্মণ।
কার শক্তি আছে রাখে তক্ষক-দংশন।।
নিজ গৃহে ফিরি যাহ শুন দ্বিজবর।
অকারণে লজ্জা পাবে সভার ভিতর।।
কাশ্যপ বলিল, শুন গুরু মন্ত্রবলে।
রাখিতে পারি যে আমি তক্ষক দংশিলে।।
শুনিয়া তক্ষক ক্রুদ্ধ হৈল অতিশয়।
আমিই তক্ষক বলি দিল পরিচয়।।
নিবারিতে পার যদি আমার দংশন।
এই বৃক্ষ দংশি দেখি করহ রক্ষণ।।
কাশ্যপ বলিল, তুমি দংশ তরুবর।
মন্ত্রবলে রাখি দেব আপন গোচর।।
এতেক কাশ্যপ বাক্য তক্ষক শুনিয়া।
দংশিলেক তরুবর যার ভস্ম হৈয়া।।
লাফ দিয়া ভস্মমুষ্টি কাশ্যপ ধরিল।
দেখ মোর মন্ত্রবল তক্ষকে বলিল।।
মন্ত্র পড়ি ভস্মমুষ্টি গর্ত্তেতে ফেলিল।
দৃষ্টিমাত্র সেইক্ষণে অঙ্কুর হইল।।
দুই পত্র হয়ে হৈল দীর্ঘ তরুবর।
শাখা-পত্র পূর্ব্বে যথা আছিল সুন্দর।।
দেখিয়া তক্ষক হৈল বিষণ্ণ-বদন।
কাশ্যপে চাহিয়া বলে বিনয়-বচন।।
পরম পণ্ডিত তুমি গুণে মহাগুণী।
তোমার চরিত্র লোকে অদ্ভুত কাহিনী।।
রাখিতে আছয়ে শক্তি দেখিনু তোমার।
কেমনে আমার বিষে কৈলা প্রতিকার।।
আমা হৈতে রাখ হেন আছয়ে শকতি।
রাখিতে নারিবা পরীক্ষিত নরপতি।।
পূর্ব্বেতে দহিল তারে ব্রাহ্মণের বিষে।
সেই বিষ ভয় করে দেব জগদীশে।।
পদাঘাত খাইয়া করিল কৃতাঞ্জলি।
বহু স্তব কৈল ভয়ে পাছে দেয় গালি।।
ব্রাহ্মণের গালিতে কলঙ্কী শশধর।
ব্রাহ্মণের গালিতে ভগাঙ্গ পুরন্দর।।
আর যত জন আছে দেখ পৃথিবীতে।
হেন জন কে না ডরে বিপ্রের গালিতে।।
ব্রহ্মশাপে বিরোধ করিতে যদি মন।
তবে তথাকারে তুমি করহ গমন।।
যশ লভিবারে যদি যাবে দ্বিজবর।
না পারিলে লজ্জা পাবে সভার ভিতর।।
ধন ইচ্ছা করি যদি যাহ তথাকারে।
আমি দিব যাহা নাহি রাজার ভাণ্ডারে।।
এতেক বচন যদি তক্ষক বলিল।
শুনিয়া কাশ্যপ দ্বিজ মনেতে ভাবিল।।
ভাল বলে ফণিবর, লয় মোর মন।
ব্রহ্মশাপে বিরোধ নাহিক প্রয়োজন।।
নিশ্চয় জানিনু আয়ু নাহিক রাজার।
চিন্তিয়া তক্ষক-বাক্য করিল স্বীকার।।
কাশ্যপ বলিল, আমি দরিদ্র ব্রাহ্মণ।
তবে আর কেন যাব পাই যদি ধন।।
যাইতাম ধন-ধর্ম্ম-যশের কারণে।
ব্রহ্মশাপ বিরোধে হইল ভয় মনে।।
তুমি যদি দেহ ধন যাইব ফিরিয়া।
এত শুনি ফণী মণি দিলেক লইয়া।।
যাহার পরশে হয় লৌহাদি কাঞ্চন।
হৃষ্ট হৈয়া বাহুড়িল দরিদ্র ব্রাহ্মণ।।
বাহুড়ি কাশ্যপ গেল, চিন্তে ফলিবর।
আস্তে আস্তে কহে লোক করয়ে উত্তর।।
কেহ বলে, নৃপতিরে ব্রহ্মশাপ দিল।
সপ্তম দিবস আজি আসি পূর্ণ হৈল।।
কেহ বলে, রাজা বড় করিল উপায়।
এক স্তম্ভে মঞ্চ করি বসি আছে তায়।।
কাহার নাহিক শক্তি যাইতে তথায়।
কেমনে তক্ষক গিয়া দংশিবে রাজায়।।
নানাবিধ মহৌষধি আছে চারিভিতে।
গুণিগণ শূণ্যপথ রুধিল মন্ত্রেতে।।
পরস্পর এই কথা বলে সর্ব্বজন।
শুনিয়া চিন্তিল চিত্তে কদ্রুর নন্দন।।
সহচরগণ প্রতি বলিল বচন।
ব্রাহ্মণের মূর্ত্তি এবে ধর সর্ব্বজন।।
কেবল যাইতে নাহি ব্রাহ্মণের মানা।
ব্রাহ্মাণের মূর্ত্তি তবে ধর সর্ব্বজনা।।
ফলফুলে আশীর্ব্বাদ করিবে রাজারে।
এই ফল-গুটী লৈয়া দিবে তাঁর করে।।
শীঘ্রগতি না যাইবে যাবে ধীরে ধীরে।
চিনিতে না পারে যেন রাজ-অনুচরে।।
এত বলি ফল মধ্যে করিল আশ্রয়।
শুনিয়া সকল নাগ বিপ্রমূর্ত্তি হয়।।
সেই ফল নানা পুষ্প হাতে করি নিল।
যথা মঞ্চে নরপতি তথায় চলিল।।
ব্রাহ্মণের রোধ নাই রাজার দুয়ারে।
ফল-ফুলে আশিস্ করিল নরবরে।।
আনন্দে নৃপতি তার ফল ফুল নিল।
ক্ষত ফল দেখি রাজা নখে বিদারিল।।
ক্ষুদ্র এক পোকা তাহে লোহিত বরণ।
কৃষ্ণবর্ণ মুখ তার দেখিল রাজন।।
হেনকালে নৃপতি বলিল মন্ত্রিগণে।
ব্রহ্মশাপে মুক্ত আজি হই সাত দিনে।।
মুহূর্ত্তেক অস্ত হৈতে আছে দিনমণি।
ব্রহ্মশাপ ব্যর্থ হৈল অদ্ভুত কাহিনী।।
এই হেতু আশঙ্কিত হইতেছে মন।
অব্যর্থ ব্রাহ্মণ শাপ হইল খণ্ডন।।
এই পোকা তক্ষক হউক এইক্ষণ।
দংশুক আমারে রহুক ব্রাহ্মণ-বচন।।
এতেক বলিয়া পোকা মস্তকে রাখিল।
শুনিয়া সকল মন্ত্রী না হৌক বলিল।।
হেনমতে রাজা মন্ত্রী করয়ে বিচার।
ততক্ষণে তক্ষক ধরিল নিজাকার।।
প্রলয়ের মেঘ যেন করয়ে গর্জ্জন।
শব্দ শুনি ভয়েতে পলায় মন্ত্রিগণ।।
ভয়ঙ্কর মূর্ত্তি দেখি সবে হৈল ডর।
জড়াইল লাঙ্গুলে রাজার কলেবর।।
সহস্রেক ফণা ধরে ছত্রের আকার।
শব্দ করি ব্রহ্মতালু দংশিল রাজার।।
নৃপতিরে দংশিয়া চলিল অন্তরীক্ষে।
রক্তপদ্ম আভা-তনু দেখে সর্ব্বলোকে।।
রাজা সহ মঞ্চ জ্বলে বিষের আগুনে।
কান্দে মন্ত্রিগণ সব রাজার মরণে।।
অন্তঃপুরে শুনিয়া কান্দয়ে সর্ব্বজন।
প্রেতকর্ম্ম রাজার করিল ততক্ষণ।।
অগ্নিহোত্রে মৃত তনু করিল দাহন।
শ্রাদ্ধ শান্তি কৈল তাঁর বিহিত লক্ষণ।।
মন্ত্রিগণ-সহ যুক্তি করি সব প্রজা।
তাঁর পুত্র জন্মেজয় তাঁরে কৈল রাজা।।
বয়সে বালক শিশু বড় বুদ্ধি মন্ত।
পরাক্রমে জন্মেজয় দুষ্টের দুরন্ত।।
দেখিয়া রাজার গুণ যত মন্ত্রিগণ।
কাশীরাজ কন্যা সহ করিল বরণ।।
বপুষ্টমা নামে কাশীরাজের নন্দিনী।
নানারত্নে ভূষিয়া দিলেন নৃপমণি।।
বিভা করি জন্মেজয় আসে গৃহে লৈয়া।
চিরদিন ক্রীড়া করে আনন্দিত হৈয়া।।
এক পত্নী বিনা তাঁর অন্যে নাহি মন।
ঊব্বশী সহিত যেন বুধের নন্দন।।
নাগের চরিত্র আর কাশ্যপের কর্ম্ম।
পরীক্ষিত-স্বর্গবাস জন্মেজয়-জন্ম।।
এ সব রহস্য-কথা শুনে যেই জন।
বংশবৃদ্ধি ধনবৃদ্ধি হরিপদে মন।।
সবাঞ্ছিত ফল পায়, কহিলেন ব্যাস।
সর্ব্বপাপে মুক্ত হয় পুণ্যের প্রকাশ।।
আদিপর্ব্বে ভারত অমৃতবৎ কথা।
কাশীরাম দাস কহে পাঁচালীর গাঁথা।।