৫৫. যুধিষ্ঠিরাদির বন গমন ও ধৃতরাষ্ট্রের প্রশ্ন

শাশুড়ীর দুঃখ দেখি দ্রৌপদী কাতর।
সচেতন করি কহে, যুড়ি দুই কর।।
উঠ উঠ মহাদেবি, না বাড়াও শোক।
কর্ম্ম করি, শোচনা না করে জ্ঞানী লোক।।
আজ্ঞা কর, বনে যাব সহ স্বামিগণ।
যে আজ্ঞা করিবে তুমি, করিব পালন।।
এত বলি স্বামী সহ চলে বনবাস।
তপ্ত অশ্রুজল বহে, মুক্ত কেশপাশ।।
পাছু গোড়াইয়া যায় ভোজের নন্দিনী।
পুত্রগণ দেখি দেবী বুকে হানে পাণি।।
হেঁটমুখে দাণ্ডাইল পঞ্চ সহোদর।
চতুর্দ্দিকে হাসে যত কৌরব বর্ব্বর।।
রোদন করয়ে যত সুহৃদ সুজন।
পঞ্চ ভাই বিবর্জ্জিত বস্ত্র-আভরণ।।
দেখিয়া পড়িল শোকসাগর অগাধে।
অশ্রুজলে ভাসে মাতা কহে গদগদে।।
নিষ্পাপ নির্দ্দোষ সদাচার যে উদার।
তার হেন দেখি বিধি! এ কোন্ বিচার।।
ইহা সবাকার কিছু না দেখি অধর্ম্ম।
হেন বুঝি এই পাপ মম গর্ভে জন্ম।।
অভাগিনী পাপী আমি আজন্ম দুঃখিনী।
মম দোষে এত দুঃখ, মনে অনুমানি।।
তেজে বীর্য্যে বুদ্ধে ধর্ম্মে কেহ নহে ন্যূন।
ত্রিজগৎ-বিখ্যাত যে মম পুত্রগণ।।
হীন বীর্য্যবন্ত বৈরী বেড়ি চারিপাশে।
রাজ্য ধন লইয়া পাঠায় বনবাসে।।
পূর্ব্বে যদি জানিতাম এ সব বারতা।
শতশৃঙ্গ হইতে কি আসিতাম হেথা।।
বড় ভাগ্যবান পাণ্ডু স্বর্গবাসে গেল।
পুত্রদেব এত দুঃখ চক্ষে না দেখিল।।
সঙ্গে গেল ভাগ্যবতী মদ্রের নন্দিনী।
আমি না গেলাম সঙ্গে অধম পাপিনী।।
তাহার সদৃশ তপ আমি না করিনু।
পাপ হেতু কষ্ট আমি ভুঞ্জিতে রহিনু।।
লোভেতে রহিনু পুত্রগণেরে পালিতে।
তেঁই হৈল পুত্রগণের এ দুঃখ দেখিতে।।
হে পুত্র! আমারে ছাড়ি না যাহ কাননে।
কৃষ্ণা তুমি আমা ছাড়ি বঞ্চিবা কেমনে।।
বিধি মোরে বান্ধিলা এ দুঃখের নিগড়ে।
সেই হেতু পাপ আয়ু আমারে না ছাড়ে।।
হায় পাণ্ডু মহারাজ ছাড়িলা আমারে।
অনাথ করিয়া সাধু-সুপুত্রগণেরে।।
ওরে পুত্র সহদেব ফিরে চাহ মোরে।
কেমনে আমার মায়া ছাড়িলা অন্তরে।।
তিলেক না বাঁচি তোমা না দেখি নয়নে।
কেমনে রহিবে প্রাণ তোমার বিহনে।।
ভাই সব যদি সত্য না পারে ছাড়িতে।
সবে যাক্ তুমি রহ আমার সহিতে।।
হেনমতে কুন্তীদেবী করেন রোদন।
প্রবোধিয়া প্রণমিয়া যায় পঞ্চ জন।।
প্রবোধ না মানে কুন্তী, যায় দৌড়াইয়া।
বিদুর কহেন তাঁরে বহু বুঝাইয়া।।
ধরিয়া লইয়া গেল আপনার ঘরে।
কুন্তী সহ কান্দে যত নারী অন্তঃপুরে।।
নগরের লোক যত করয়ে ক্রন্দন।
ঘরে ঘরে কান্দে যত কুলবধূগণ।।
বাল বৃদ্ধ যুবা কান্দে, শিশুগণ পিছু।
ক্রন্দনের শব্দ বিনা নাহি শুনি কিছু।।
নগরেতে মহাশব্দ, ক্রন্দনের রোল।
প্রলয়কালেতে যেন সাগর কল্লোল।।
শুনিয়া হইল ব্যগ্র অন্ধ নৃপমণি।
শীঘ্রগতি বিদুরের ডাকাইল আনি।।
ধৃতরাষ্ট্র বলে, শুন মন্ত্রী-চূড়ামণি।
নগরেতে মহাশব্দ, ক্রন্দনের ধ্বনি।।
হেন বুঝি কান্দে সবে পাণ্ডব কারণ।
কহ শুনি, কিরূপেতে যায় তারা বন।।
ক্ষত্তা বলে, যুধিষ্ঠির যায় হেঁটমুখে।
সবিষাদ চিত্তেতে বসনে মুখ ঢাকে।।
দুই বাহু বিস্তারিয়া যায় বৃকোদর।
অর্জ্জুনের অশ্রুজল বহে নিরন্তর।।
নকুল যাইছে ছাই সর্ব্বাঙ্গ মাখিয়া।
সহদেব যায় মুখে কর আচ্ছাদিয়া।।
দ্রুপদ-নন্দিনী যায় সবার পশ্চাতে।
আলুলিত কেশভার কান্দিতে কান্দিতে।।
ধৌম্য পুরোহিত সঙ্গে করে বেদধ্বনি।
বিষাদিত চিত্ত অতি কুশমুষ্টি পাণি।।
ধৃতরাষ্ট্র বলে, কহ ইহার কারণ।
এরূপে পাণ্ডব কেন যাইতেছে বন।।
বিদুর বলেন, রাজা কহি, দেহ মন।
কপটে সর্ব্বস্ব নিল তব পুত্রগণ।।
পাণ্ডব প্রধান তবু না হয় ক্রোধিত।
যুধিষ্ঠির তব পুত্রগণে সদা প্রীত।।
কদাচিৎ ভস্ম যদি হয় নেত্রানলে।
তেঁই কৈল হেঁটমুখ ঢাকিয়া অঞ্চলে।।
ভীম বলে, মম সম নাহিক বলিষ্ঠ।
সংসারেতে যত বীর সকলের শ্রেষ্ঠ।।
ইহার উচিত শাস্তি করিব আসিয়া।
এত বলি যায় বীর ভুজ প্রসারিয়া।।
অর্জ্জুনের অশ্রুজল বহে অনিবার।
সেই মত বরষিবে অস্ত্র তীক্ষ্মধার।।
প্রত্যক্ষ ভবিষ্য ভূত সহদেব জানে।
বংশ-নাশ জানি হস্ত দিয়াছে বদনে।।
এই মত ভস্ম আমি করিব বৈরীরে।
সে হেতু নকুল ভস্ম মাখিল শরীরে।।
যাজ্ঞসেনী দেবী যায় করিয়া রোদন।
এই মত কান্দিবেক শত্রু-নারীগণ।।
কুশ হস্তে লয়ে যায় ধৌম্য তপোধন।
সঙ্কল্প করিল কুরু-শ্রাদ্ধের কারণ।।
নগরের লোক সব করিছে রোদন।
আমা সবাকার প্রভু প্রভু যাইতেছে বন।।
সঘনে কম্পিত ভূমি, দেখ নৃপমণি।
বিনা মেঘে গগনে শুনি যে ঘোর ধ্বনি।।
সহসা হলেন ক্রুদ্ধ দেব পুরন্দর।
ঘন মেঘে লুকাইল দেব দিবাকার।।
দৃষ্টি নাহিক চলে গভীর অন্ধকার।
উল্কাপাত বজ্রাঘাত শুনি নিরন্তর।।
অকস্মাৎ ভাঙ্গি পড়ে দেউল প্রাচীর।
ক্ষণে ক্ষণে রাজা কম্পি উঠয়ে শরীর।।
এই সব চিহ্ন রাজা কৌরব বিনাশে।
কেবল হইল রাজা তব কর্ম্মদোষে।।
মহাভারতের কথা অমৃত লহরী।
কাশী কহে, শুনিলে তরয়ে ভব বারি।।