৪১. সভাজন প্রতি বিকর্ণের উত্তর

দ্রৌপদী যতেক কহে, কেহ নাহি শুনে।
ভীষ্মবীর প্রত্যুত্তর দেন কতক্ষণে।।
কহিতে না পারি আমি ইহার বিধান।
ধর্ম্ম সূক্ষ্ম বিচারিয়া কহিতে প্রমাণ।।
অন্য দ্রব্যে অন্যের নাহিক অধিকার।
দ্রব্য মধ্যে গণ্য হয় ভার্য্যা কিবা আর।।
আপনা হারিল আগে ধর্ম্মের নন্দন।
পশ্চাৎ হারিলা কৃষ্ণা, জানে সর্ব্বজন।।
দ্রুপদ নন্দিনী পঞ্চ পাণ্ডবের নারী।
একা যুধিষ্ঠির তাহে নহে অধিকারী।।
রাজ্যদেশ ধন জন সব যদি যায়।
যুধিষ্ঠির-মুখে নাহি মিথ্যা বাহিরায়।।
হারিল বলিয়া মুখে বলিয়াছে বাণী।
কি কহি ইহার বিধি, কিছু নাহি জানি।।
এত বলি নিঃশব্দে রহেন ভীষ্ম ধীর।
যুধিষ্ঠিরে চাহি বলে বৃকোদর বীর।।
ওহে মহারাজ! কভু দেখেছ নয়নে।
আপন ভার্য্যাকে হারে, বল কোন্ জন।।
কপটী জুয়ারী যদি হয় কোন জন।
তা সবার থাকিলে ইতর নারীগণ।।
সে সব নারীরে তারা নাহি করে পণ।
তুমি মহারাজ কর্ম্ম করিলা যেমন।।
রাজ্য দেশ ধন জন হারিলা যতেক।
ইহাতে তোমারে ক্রোধ না করি তিলেক।।
আমা সহ সকল তোমার অধিকার।
এই সে হৃদয়ে তাপ সম্বরিতে নারি।।
পাশায় করিলা পণ কৃষ্ণা হেন নারী।
তব কৃত কর্ম্ম রাজা দেখহ নয়নে।।
দ্রৌপদীরে পরিহাস করে হীনজনে।।
এই হেতু তোমারে জন্মিল বড় ক্রোধ।
ক্ষুদ্র লোক কহে ভাষা, নাহি কিছু বোধ।।
ধনঞ্জয় বলে, ভাই কি কথা কহিলে।
নৃপে হেন ভাষা নাহি কহ কোন কালে।।
আজি কেন কটূত্তর বলিলে রাজায়।
তব মুখে হেন বাক্য কভু না বেরয়।।
পরম পণ্ডিত তুমি ধর্ম্মজ্ঞ যে গণি।
শত্রুর কপটে ছন্ন হৈলে হেন জানি।।
সদাই শত্রুর ভাই এই যে কামনা।
ভাই ভাই বিচ্ছেদ হউক পঞ্চ জনা।।
শত্রুর কামনা পূর্ণ কর কি কারণ।
জ্যেষ্ঠ-শ্রেষ্ঠ মহারাজে না কর নিন্দন।।
রাজারে বলিলে হেন কি দোষ দেখিয়া।
দ্যূত আরম্ভিল শত্রু কপটে ডাকিয়া।।
আপন ইচ্ছায় রাজা না খেলেন দ্যূত।
ডাকিলে না খেলিলে হবেন ধর্ম্মচ্যুত।।
ভীম বলে, ধনঞ্জয় না বলিহ আর।
হীনজন প্রভুত্ব না পারি সহিবার।।
হরি বিনা অন্য চিত্ত নাহিক আমার।
দুই ভুজ কাটিয়া ফেলিব আপনার।।
ক্ষুদ্রের প্রভুত্ব দেখিতেছি যে নয়নে।
তবে ভুজ রাখি আর কোন্ প্রয়োজনে।।
যাহ সহদেব শীঘ্র অগ্নি আন গিয়া।
অগ্নি-মধ্যে দুই ভুজ ফেলিব কাটিয়া।।
এইরূপে পঞ্চ ভাই তাপিত অন্তর।
দুঃখের অনলে দহে সর্ব্ব কলেবর।।
বিকর্ণ নামেতে ধৃতরাষ্ট্রের তনয়।
পাণ্ডবের দুঃখ দেখি দুঃখিত হৃদয়।।
বিশেষে কৃষ্ণার ক্লেশ নারিল সহিতে।
সভাজন চাহি বীর লাগিল কহিতে।।
সভামধ্যে আছে বড় বড় রাজগণে।
দ্রৌপদীর প্রত্যুত্তর নাহি দাও কেনে।।
পুনঃ পুনঃ দ্রৌপদী যে কহিছে সভায়।
সভাসদ লোকে হেন বুঝিতে যুয়ায়।।
সভায় থাকিয়া যদি বিচার না করে।
সহস্র-বৎসর পচে নরক-ভিতরে।।
এই ভীষ্ম ধৃতরাষ্ট্র বিদুর সুমতি।
কুরুকুলে হর্ত্তা কর্ত্তা এই তিন কৃতী।।
এ তিন জনেরে নারি করিতে হেলন।
তোমরা উত্তর নাহি দাও কি কারণ।।
এই দ্রোণাচার্য্য কৃপ শ্রেষ্ঠ দ্বিজকুলে।
ক্ষত্রকুলে আচার্য্য যে খ্যাত ভূমণ্ডলে।।
তোমরা সকলে ভয় করহ কাহারে।
উত্তর না দাও কেন দ্রৌপদীর তরে।।
আর যে আছয়ে বহু বহু রাজগণ।
বুঝিয়া উত্তর নাহি দাও কি কারণ।।
পুনঃ পুনঃ দ্রৌপদী কহিল বার বার।
যার যেই চিত্তে আসে, করহ বিচার।।
এই মতে পুনঃপুনঃ বিকর্ণ কহিল।
একজন সভাস্থলে উত্তর না দিল।।
কাহার মুখেতে নাহি পাইয়া উত্তর।
ক্রোধভরে বিকর্ণ কচালে করে কর।।
নিশ্বাস ছাড়িয়া পুনঃ কহে সভাজনে।
উত্তর না দেহ সবে কিসের কারণে।।
তোমরা যে কেহ কিছু না দিলা উত্তর।
আমি কিছু কহি শুন সব নরবর।।
চারি ধর্ম্ম নৃপতির হয়েছে বিধান।
মৃগয়া দেবন দান প্রজার পালন।।
এই যে নৃপতি ধর্ম্ম দেবনে পশিল।
ইচ্ছাসুখে নহে, সবে কপটে ডাকিল।।
যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীরে নাহি কর পণ।
কপটেতে কহিলেন সুবল নন্দন।।
আগে নরপতি আপনাকে হারিয়েছে।
কৃষ্ণার উপর কিবা প্রভুপণ আছে।।
বিশেষে সমান কৃষ্ণা এ পঞ্চ জনার।
একা ধর্ম্ম-নৃপতির নাহি অধিকার।।
সে কারণে দ্রৌপদী পাশায় নাহি জিত।
তোমরা কি বল, আমি কহি সে উচিত।।
বিকর্ণ-বচন শুনি যত সভাজন।
সাধু সাধু বলি সবে বলয়ে বচন।।
বিকর্ণ-বচন শুনি কর্ণে ক্রোধ হৈল।
দুর্য্যোধনে চাহি তবে কহিতে লাগিল।।
অনেক বিচার বুদ্ধি দেখি যে ইহায়।
অগ্নি কাষ্ঠে জন্মিয়া সংহার করে তায়।।
সেই মত অগ্নিরূপে এই তব কুলে।
হেন অপরূপ কহিলেক সভাস্থলে।।
এ সভায় যত লোক কিছু নাহি জানে।
কেহ না কহিল, এ কহিল সে কারণে।।
সবে জানে, কৃষ্ণা জিতা হইয়াছে পণে।
বুঝিয়া উত্তর নাহি দেয় কোন জনে।।
বালক হইয়া সভা মধ্যেতে আইল।
বৃদ্ধের সমান নীতি-বচন কহিল।।
কি জানহ ধর্ম্ম তুমি, কি জান বিচার।
কৃষ্ণা জিতা নহে যে, সে কেমন প্রকার।।
যুধিষ্ঠির যখন সর্ব্বস্ব কৈল পণ।
জিনিল পাশায় তাহা সুবল-নন্দন।।
সর্ব্বস্বের বাহির কি দ্রৌপদী সুন্দরী।
বিশেষ কহিল যবে গান্ধারাধিকারী।।
দ্রৌপদীর পণ কর বলিয়া বলিল।
শুনিয়া পাণ্ডব কেন নিবৃত্ত না হৈল।।
আর যে কহিলা কৃষ্ণা একবস্ত্রা হয়।
সভামধ্যে ইহারে আনিতে না যুয়ায়।।
বহু ভর্ত্তা যার, তার কিবা ভয় লাজ।
তাহার কিসের লজ্জা আসিতে সমাজ।।
যতেক সংসার এই বিধাতা সৃজিল।
ভার্য্যার একই স্বামী নিয়ম করিল।।
দুই স্বামী হৈলে বলি তারে দ্বিচারিণী।
পঞ্চ স্বামী হৈলে পরে বেশ্যামধ্যে গণি।।
সভায় আসিবে বেশ্যা লাজ তার কিসে।
এমত বিচার মম মনেতে আইসে।।
দুর্য্যোধন বলে, এই শিশু অল্পমতি।
কি জানে বিচার-তত্ত্ব ধর্ম্ম-সূক্ষ্ম-গতি।।
তবে আজ্ঞা করিল নৃপতি দুঃশাসন।
পাণ্ডবগণের আন বস্ত্র আভরণ।।
দ্রৌপদীর বস্ত্র আর যত অলঙ্কার।
ঝটিতে আনিয়া দেহ অগ্রেতে আমার।।
এত শুনি ততক্ষণে পঞ্চ সহোদর।
বস্ত্র অলঙ্কার ফেলি দিলেন সত্বর।।
একবস্ত্র পরিহিতা দ্রৌপদী সুন্দরী।
দুঃশাসন টানিতেছে বসনেতে ধরি।।
ছাড় ছাড় বলি কৃষ্ণা ঘন ডাক ছাড়ে।
সভামধ্যে ধরি তর অঙ্গ-বস্ত্র কাড়ে।।
সঙ্কটে পড়িয়া দেবী না দেখি উপায়।
আকুল হইয়া কৃষ্ণা স্মরে যদুরায়।।
ঝরঝর ঝরে অশ্রুজল দুনয়নে।
কাতরেতে কৃষ্ণা ডাকে দেব নারায়ণে।।