০৩২. শিব আরাধনার্থ অর্জ্জুনের হিমালয়ে গমন

ব্যাসদেবে দেখি পূজে পাণ্ডু পুত্রগণে।
আশীর্ব্বাদ করি মুনি বসেন আসনে।।
যুধিষ্ঠির প্রতি তরে কহে মুনিবর।
শত্রুগণে ভয় তব হয়েছে অন্তর।।
তোমার হৃদয় তত্ত্ব জানিলাম আমি।
সে কারণে হেথা আইলাম শীঘ্রগামী।।
শত্রুর যে ভয়, তাহা ত্যজ নৃপবর।
আমি যাহা বলি, তাহা করহ সত্বর।।
অশুভ সময় গেল, হইল সুকাল।
এক বিদ্যা দিব আমি, লহ মহীপাল।।
এই বিদ্যা হৈতে হবে শিব দরশন।
তোমারে সদয় হইবেন ত্রিলোচন।।
নর ঋষি মূর্ত্তি তব ভাই ধনঞ্জয়।
এই মন্ত্রবলে ক্ষিতি করিব বিজয়।।
এই বন ত্যজি রাজা যাহ অন্য বন।
এক স্থানে বহু বধ হয় মৃগগণ।।
বনে এক ঠাঁই বসি কোন কর্ম্ম নাই।
তীর্থ দরশন করি ভ্রম ঠাঁই ঠাঁই।।
এত বলি একান্তে লইয়া মহামতি।
যুধিষ্ঠিরে দেন বিদ্যা নাম প্রতিস্মৃতি।।
মন্ত্র দিয়া মুনিরাজ গেলেন স্বস্থান।
মন্ত্র পেয়ে যুধিষ্ঠির হরিষ বিধান।।
ব্যাস অনুমতি পেয়ে কুন্তীর নন্দন।
দ্বৈতবন ত্যজিয়া গেলেন সেইক্ষণ।।
উত্তর মুখেতে সরস্বতী নদীতীরে।
গিয়া উত্তরিনে কাম্যক বনান্তরে।।
কাম্যক বনের মধ্যে নিলেন আশ্রয়।
বড়ই নিগম বন, নাহি কোন ভয়।।
মৃগয়া করেন নিত্য, পোষেণ ব্রাহ্মণ।
বড়ই নিগম বন, নাহি কোন ভয়।।
মৃগয়া করেন নিত্য, পোষেন ব্রাহ্মণ।
পিতৃশ্রাদ্ধ দেবার্চ্চন করে অনুক্ষণ।।
কতদিনে মুনিবাক্য করিয়া স্মরণ।
নিকটে ডাকিয়া পার্থে বলেন বচন।।
ভীষ্ম দ্রোণ ভূরিশ্রবা কৃপ কর্ণ দ্রৌণি।
সর্ব্বশাস্ত্রে বিশারদ জানহ আপনি।।
যত বলবান রাজা আছে পৃথিবীতে।
সবাই হইল ভাই দুর্য্যোধন ভিতে।।
আমার কেবল ভাই তোমার ভরসা।
দুঃখে তুমি উদ্ধারিবে করিয়াছি আশা।।
সে সবারে জিনিতে হইল উপদেশ।
উগ্রতপ কর গিয়া, সেবহ মহেশ।।
যেই বিদ্যা আমারে দিলেন পিতামহ।
ইহা জপ ত্বরিতে মিলহ শিব সহ।।
ইন্দ্র আদি দেবগণ দিবেন দর্শন।
তাঁ সবারে সেবিয়া পাইবে অস্ত্রগণ।।
পূর্ব্বে বৃত্রাসুর হেতু যত দেবগণ।
আপনার অস্ত্র ইন্দ্রে দিল সর্ব্বজন।।
পাইবে সকল অস্ত্র ইন্দ্রে তুষ্ট কৈলে।
সর্ব্বত্র হইবে জয় শিবেরে ভজিলে।।
হিমালয় গিরি আজি করহ গমন।
নিকটে তথায় দেখা পাবে ত্রিলোচন।।
এত বলি দিব্য বিদ্যা দিয়া সেইক্ষণ।
আশিস্ করিয়া শিরে করেন চুম্বন।।
আজ্ঞা পেয়ে বাহির হৈলেন ধনঞ্জয়।
গাণ্ডীব নিলেন তূণ যুগল অক্ষয়।।
চতুর্দ্দিকে দ্বিজগণ শুভ শব্দ কৈল।
বাহির হবার কালে দ্রৌপদী বলিল।।
জন্মকালে যা বলিল যত দেবগণ।
সে সকল প্রাপ্তি হৌক সেবি ত্রিলোচন।।
যত কটু ভাষায় বলিল দুর্য্যোধন।
সেই অগ্নি তাপে অঙ্গ হয়েছে দহন।।
উপায় করহ তারে সমুচিত ফলে।
নির্ব্বিঘ্ন হইয়া পুনঃ আইস মঙ্গলে।।
এতেক বলিয়া দেবী করিল বিদায়।
অর্জ্জুন বিচ্ছেদে বড় মনস্তাপ পায়।।
দেব দ্বিজ গুরুজনে বন্দিয়া তখন।
বাহির হৈলেন পার্থ হরষিত মন।।
চলিলেন ধনঞ্জয় উত্তর মুখেতে।
অল্পদিনে উত্তরেন হেমন্তপর্ব্বতে।।
হিমাদ্রির পারে গন্ধমাদন ভূধর।
ইন্দ্রকীল গিরি হয় তাহার উত্তর।।
বহু কষ্টে তথায় গেলেন ধনঞ্জয়।
শূণ্যবাণী হৈল, ইথে করহ আশ্রয়।।
আগে পথ নাহি আর মানুষ যে যায়।
শুনি পার্থ মহাবীর রহেন তথায়।।
হেনকালে একজন জটিল তপস্বী।
ডাকিয়া অর্জ্জুনে বলে নিকটেতে আসি।।
কে তুমি, কবচ খড়গ ধনু অস্ত্র ধরি।
কি হেতু আইলে তুমি পর্ব্বত উপরি।।
অস্ত্রধারী হয়ে তুমি এলে কি কারণ।
এ পর্ব্বতে নিবসে নিষ্কাম যত জন।।
ধনু অস্ত্র ফেলহ, ফেলহ শর তুণ।
দিব্যগতি পেলে অস্ত্রে কোন্ প্রয়োজন।।
বড় তেজোবন্ত ‍তুমি, আইলে সে কারণ।
শুনিয়া নিঃশব্দ হয়ে রহেন অর্জ্জুন।।
উত্তর না পাইয়া বলয়ে জটাধর।
বর মাগ ধনঞ্জয়, আমি পুরন্দর।।
করযোড়ে অর্জ্জুন মাগেন বর দান।
কৃপা যদি কর তবে দেহ অস্ত্রগণ।।
ইন্দ্র বলে, হেথা আসি কি কাজ অস্ত্রেতে।
দেবত্ব লইয়া ভোগ করহ স্বর্গেতে।।
পার্থ বলে যদি হেথা ইন্দ্রপদ পাই।
তথাপি ত্যজিতে আমি নারি চারি ভাই।।
দুর্গম অরণ্যে রাখি আসি ভ্রাতৃগণে।
অস্ত্র বাঞ্ছা করি আমি শত্রুর নিধনে।।
সে সবারে ত্যজি আমি রহিব কেমনে।
সতত করিবে চিন্তা আমার কারণে।।
অস্ত্র দেহ পুরন্দর কৃপা যদি মনে।
ইন্দ্র বলে, আগে তুষ্ট কর ত্রিলোচনে।।
তাঁর অনুগ্রহে সব সিদ্ধ হবে কাজ।
এত বলি অন্তর্হিত হন দেবরাজ।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।