০০৬. কির্ম্মীর বধোপাখ্যান

ধৃতরাষ্ট্র কহে, কহ বিদুর সুজন।
কিরূপে করিল ভীম কির্ম্মীর নিধন।।
এত শুনি উঠি গেল দুষ্ট দুর্য্যোধন।
ক্ষত্তা বলে, শুন রাজা কির্ম্মীর নিধন।।
যে কর্ম্ম করিল রাজা বীর বৃকোদর।
করিতে না পারে কেহ সুরাসুর নর।।
হেথা হতে পাণ্ডবেরা যবে গেল বন।
পাইল তৃতীয় দিনে কাম্যক কানন।।
সে বনেতে নিবসে কির্ম্মীর নিশাচর।
দেবের অবধ্য পরাক্রমে পুরন্দর।।
নিশাকালে পাণ্ডবেরা যান কাম্যবন।
ধাইল মনুষ্য দেখি রাক্ষস দুর্জ্জন।।
দুই হস্তে আগুলিল পাণ্ডবের পথ।
হনুমান পূর্ব্বে যেন মৈনাক পর্ব্বত।।
রাক্ষসী মায়া কৈল ঘোর অন্ধকার।
মুখ মেলি আসে যেন গিলিতে সংসার।।
নাকের নিশ্বাসে উড়ি যায় তরুগণ।
চতুর্দ্দিকে পশু ‍ধায় শুনিয়া গর্জ্জন।।
পাণ্ডব দেখিল, আসে রাক্ষস দুর্জ্জন।
ভয়েতে দ্রৌপদী দেবী মুদিল নয়ন।।
ব্যস্ত হয়ে পঞ্চজন মধ্যে লুকাইল।
হস্তে ধরি বৃকোদর আশ্বাস করিল।।
জানিয়া রাক্ষসী মায়া ধৌম্য তপোধন।
রক্ষোঘ্ন মন্ত্রেতে মায়া কৈল নিবারণ।।
অন্ধকার গেল, দৃষ্ট হৈল নিশাচর।
জিজ্ঞাসা করেন তারা ধর্ম্ম ‍নৃপবর।।
কি নাম, কে তুমি, হেথা এলে কি কারণ।
কি করিব প্রীতি তব, কহ প্রয়োজন।।
কির্ম্মীর বলিল, আমি নিশাচর জাতি।
কাম্যক অরণ্য মধ্যে আমার বসতি।।
মনুষ্য তপস্বী ঋষি যত বিপ্রগণে।
যারে পাই তারে বধি উদর পূরণে।।
দৈবে মোরে ভক্ষ্য আনি মিলাইল বিধি।
দরিদ্র পাইল যেন মহারত্ন নিধি।।
কে তুমি, কোথায় যাহ, কিবা ‍নাম শুনি।
কি কারণে কাম্যবনে এ ঘোর রজনী।।
যুধিষ্ঠির বলে, আমি পাণ্ডুর নন্দন।
আমি ধর্ম্ম, এই মম ভাই চারি জন।।
রাজ্যভ্রষ্ট হয়ে মোরা আইনু হেথায়।
কিছুদিন কাটাইব তোমার আশ্রয়।।
ভাল ভাল বলি বল দুষ্ট নিশাচর।
যাহারে খুঁজিয়া ফিরি দেশ দেশান্তর।।
একচক্রা নগরেতে মোর ভ্রাতা ছিল।
এই দুষ্ট ভীম তারে নিপাত করিল।।
ব্রাহ্মণের গৃহে দুষ্ট ছিল দ্বিজবেশে।
সেই হেতু সদা আমি ভ্রমি দেশে দেশে।।
আমার পরম সখা হিড়িম্বে মারিল।
তার স্বসা হিড়িম্বাকে বিবাহ করিল।।
রাক্ষসের বৈরী ভীম জানে সর্ব্বজন।
মম হস্তে হবে তার অবশ্য মরণ।।
ভীমের রুধিরে বক ভ্রাতার তর্পণ।
অগ্নিতে পোড়ায়ে মাংস করিব ভোজন।।
রাক্ষসের এতেক কঠোর বাক্য শুনি।
বেগে ভীম এক বৃক্ষ উপাড়িয়া আনি।।
গাণ্ডীব ধনুকে গুণ দিল ধনঞ্জয়।
তারে নিবারিয়া ভীম নিশাচরে কয়।।
ভ্রাতৃ-সখা শোকে দুষ্ট করিস্ বিলাপ।
আজি তাহা সবা সহ করাব আলাপ।।
মুহূর্ত্তেক রহ দুষ্ট না পালাস্ পাছে।
বকের দোসর করাইব এই গাছে।।
এত বলি প্রহারিল বীর বৃকোদর।
বৃত্রাসুরে বজ্র যেন মারে পুরন্দর।।
না কম্পয়ে রাক্ষস অটল গিরিবর।
দগ্ধ কাষ্ঠদণ্ড হানে ভীমের উপর।।
দণ্ড নিবারিল ভীম সব্য পদাঘাতে।
পদ্মবন ভাঙ্গে যেন মাতঙ্গ কোপেতে।।
করাঘাতে পদাঘাতে মুণ্ডে মুণ্ডে বাড়ি।
আঁচড় কামড় চড় ভুজে ভুজে তাড়ি।।
দোঁহার উপরে দোঁহে বজ্রমুষ্টি মারে।
শরবনে অগ্নি যেন চড় চড় করে।।
হেনমতে মুহূর্ত্তেক হইল সমর।
মহাভঙ্কর যেন দানব অমর।।
ভীমসেন অতি ক্রুদ্ধ আরো ম্গ্ন দুঃখে।
তাহে আরো নিশাচর পড়িল সম্মুখে।।
ক্ষুধিত গরুড় যেন ‍ভুজঙ্গ পাইল।
জ্বলন্ত অনলে যেন পতঙ্গ পড়িল।।
ভয়ঙ্কর বেশে ভীম করিল দলন।
বলবস্ত রাক্ষস সহিল কতক্ষণ।।
অতি ক্রোধে ভীমসেন ধরিল রাক্ষসে।
পৃষ্ঠে জানু দিয়া পুনঃ ধরে পদে কেশে।।
মধ্যেতে ভাঙ্গিয়া তার কৈল দুইখান।
মহানাদ করি দুষ্ট ত্যজিল পরাণ।।
হৃষ্ট হয়ে চারি ভাই দিল আলিঙ্গন।
সাধু সাধু প্রশংসা করিল মুণিগন।।
দ্রৌপদীরে আশ্বাসিয়া কহে বৃকোদর।
এইমত সব শত্রু যাবে যমঘর।।
এইরূপে কির্ম্মীরে মারিল বৃকোদর।
তথায় যাইনু যবে হেরি পাই ডর।।
দেখি পথে পড়িয়াছে পর্ব্বত প্রমাণ।
আমি জিজ্ঞাসিলাম যে মুনিগণ স্থান।।
মুনিমুখে শুনিলাম সব বিবরণ।
এত কহি নীরব হৈল বিদুর সুজন।।
ভীমের এ বীরত্বের শুনিয়া কাহিনী।
নীরবে নিশ্বাস ফেলে অন্ধ নৃপমণি।।
পাণ্ডবের বীরত্ব অবনীতে অতুল।
ধৃতরাষ্ট্র শুনিয়া হইল চিন্তাকুল।।
অরণ্যপর্ব্বের কথা অমৃত-সমান।
কাশীরাম দাস কহে, সাধু করে পান।।