০০৩. ধৃতরাষ্ট্র কর্ত্তৃক বিদুরের অপমান ও যুধিষ্ঠিরের নিকটে বিদুরের গমন

বনে চলিলেন পঞ্চ পাণ্ডুর নন্দন।
চিন্তাকুল অন্ধরাজ, স্থির নহে মন।।
মন্ত্রিরাজ বিদুরে আনিল ডাক দিয়া।
জিজ্ঞাসিল ধৃতরাষ্ট্র মধুর বলিয়া।।
বিচারে বিদুর তুমি ভার্গবের প্রায়।
পরম ধরম বুদ্ধি আছয়ে তোমায়।।
কুরুবংশ তোমার বচনে সবে স্থিত।
কহ শুনি বিচারিয়া যাতে মম হিত।।
অরণ্যেতে গেল পঞ্চ পাণ্ডুর নন্দন।
যাহে শ্রেষ্ঠ যুক্তি হয় করহ এখন।।
যেমতে আমার বশ হয় সর্ব্বজন।
যেরূপে স্বচ্ছন্দে বিহরয়ে পুত্রগণ।।
বিদুর বলেন, রাজা কর অবধান।
ধর্ম্ম হতে বিজয় হইবে সর্ব্বজন।।
নিবৃত্তিতে পাই ধর্ম্ম, ধর্ম্মে সব পাই।
ধর্ম্মসেবা কর রাজা, কোন চিন্তা নাই।।
তোমার উচিত রাজা এ কর্ম্ম এখন।
নিজপুত্র ভ্রাতৃপুত্র করহ পালন।।
সে ধর্ম্ম ডুবিল রাজা তোমার সভায়।
দুষ্টমতি দুর্য্যোধন শকুনি সহায়।।
সত্যশীল যুধিষ্ঠিরে কপটে জিনিল।
বিবসনা কুলবধূ সভাতে করিল।।
তুমি ত তখন নাহি করিলে বিচার।
এবে কি উপায় বলি না দেখি যে আর।।
আছে যে উপায় এক যদি কর রায়।
সগর্ব্বে সবংশে থাক বলি হে তোমায়।।
পাণ্ডবের যত কিছু নিলে রাজ্যধন।
শ্রীঘ্রগতি আনি তারে দেহ এইক্ষণ।।
দ্রৌপদীরে দুঃশাসন কৈল অপমান।
বিনয় করিয়া চাহ ক্ষমা তার স্থান।।
কর্ণ দুর্য্যোধন কর পাণ্ডবের প্রীত।
এই কর্ম্ম হয় প্রীত দেখি তব হিত।।
তুমি কৈলে যদি নাহি মানে দুর্য্যোধন।
তবেত তাহারে রাখ করিয়া বন্ধন।।
পূর্ব্বে যত বলিলাম করিলে অন্যথা।
এখন যে বলি রাজা রাখ এই কথা।।
জিজ্ঞাসিলে সেই হেতু কহি এ বিচার।
ইহা ভিন্ন অন্য নাই উপায় ইহার।।
বিদুর বচন শুনি অন্ধ ডাকি কয়।
যতেক কহিলে তাহা কিছু ভাল নয়।।
আপনার হিত হেতু চিন্তিলাম নীত।
তুমি যত বল, তাহা পান্ডবের হিত।।
আপনার মূর্ত্তিভেদ আপন নন্দন।
তারে দুঃখ দিব পর পুত্রের কারণ।।
এবে জানিলাম তব কুটিল বিচার।
তোমারে বিশ্বাস আর নাহিক ‍আমার।।
অসতী নারীরে যদি করয়ে পালন।
বহুমতে রাখিলে সে না হয় আপন।।
পাণ্ডবের হিত তুমি করহ এখন।
যাহ বা থাকহ তুমি যাহা লয় মন।।
এত শুনি উঠিল বিদুর মহাশয়।
ডাকি বলে, কুরুবংশে মজিল নিশ্চয়।।
শুন ওহে মহারাজ বচন আমার।
অহিত আমারে জ্ঞান হইল তোমার।।
পশ্চাতে জানিবে রাজা এ সব বচন।
ঠেকিবে যখন দায়ে, জানিবে তখন।।
এত বলি শীঘ্র করি বিদুর চলিল।
আর দুই এক বাক্য ক্রোধেতে বলিল।।
চিত্তে মহাতাপ হেতু না গেল মন্দির।
হস্তিনা নগর হৈতে হইল বাহির।।
যথা বনে আছে পঞ্চ পাণ্ডুর নন্দন।
শীঘ্রগতি তথাকারে করিল গমন।।
যুধিষ্ঠির ছিল কাম্য কানন ভিতর।
মৃগচর্ম্ম পরিধান সঙ্গে সহোদর।।
চতুর্দ্দিকে সহস্র সহস্র দ্বিজগণ।
ইন্দ্রেরে বেড়িয়া যেন আছে দেবগণ।।
কতদূরে বিদুরে দেখিয়া কুরুনাথ।
ভ্রাতৃগণে বলে ঐ আইল খুল্লতাত।।
কি হেতু বিদুর আইল না বুঝি বিচার।
পুনঃ কি বিচার কৈল সুবল কুমার।।
পুনঃ কিবা পাশা হেতু দিল পাঠাইয়া।
রাজ্য হতে আমি কিছু না আসি লইয়া।।
কেবল আয়ুধমাত্র আছয়ে আমার।
আয়ুধ জিনিয়া নিতে করেছে বিচার।।
পঞ্চ ভাই করিছেন বিচার এমত।
হেনকালে উপনীত বিদুরের রথ।।
যথাযোগ্য পরস্পর করি সম্ভাষণ।
জিজ্ঞাসেন যুধিষ্ঠির কুশল বচন।।
আমরা আইলে বনে অন্ধ কি কহিল।
বিদুর কহিল, শুনে যে কথা হইল।।
কুরবংশহিত হেতু জিজ্ঞাসেন মোরে।
সেই মত সুযুক্তি দিলাম আমি তাঁরে।।
যতেক কহিনু আমি সবাকার হিত।
অন্ধ রাজা শুনি তাহা বুঝে বিপরীত।।
রোগীজনে যথা দিব্য পথ্য নাহি রুচে।
যুব নারী বৃদ্ধস্বামী য‍থা নাহি ইচ্ছে।।
ক্রুদ্ধ হয়ে আমারে বলিল কুবচন।
যাহ বা থাকহ তুমি নাহি প্রয়োজন।।
সে কারণে তারে ত্যজি আইলাম বন।
তোমা সবাকারে বনে করিতে ‍ালন।।
ভাল হৈল অন্ধরাজ ত্যজিল আমারে।
তোমা সবা সহ বনে রহিব বিহারে।।
তবে ত বিদুর বহু করিল সুনীত।
যুধিষ্ঠির পঞ্চ ভাই লইয়া ত্বরিত।।
বনপর্ব্ব অপূর্ব্ব রচিলেন অমৃত।
কাশীদাস কহে সাধু, পিয়ে অনুব্রত।।