২৯. উলূকের নিকট দুর্য্যোধন কর্ত্তৃক বিড়াল-তপস্বীর উপাখ্যান কীর্ত্তন

রাজা বলে, শুন শুন ওহে অনুচর।
সত্যযুগে ছিল এক তাপস-প্রবর।।
সর্ব্বগুণ সমন্বিত ছিলেন ব্রাহ্মণ।
সুঘোষ তাঁহার নাম, শাস্ত্রে বিচক্ষণ।।
সুশীলা নামেতে তাঁর ভার্য্যা গুণবতী।
পুত্রবাঞ্ছা করি ধনী সেবে পশুবতী।।
পুত্র না জন্মিল তাঁর, যুবাকাল গেল।
বিপ্রের বৈরাগ্য বড় অন্তরে হইল।।
ভার্য্যা সহ বনে গেল তপস্যা কারণ।
হিমালয় গিরি উত্তরিল দুই জন।।
দেখিয়া বিচিত্র বন প্রীতি পায় মনে।
রচিয়া কুটীর তথা রহে দুই জনে।।
এক দিন গেল ঋষি ফলের কারণ।
ভ্রমিতে ভ্রমিতে দেখে দৈব নির্ব্বন্ধন।।
অনাথ মার্জ্জার শিশু পড়ি আছে বনে।
ব্রাহ্মণ দেখিয়া শিশু চাহে চারি পানে।।
পলাইতে শক্তি নাহি শিশু কলেবর।
চতুর্দ্দিকে বেড়িয়াছে বায়স পামর।।
তার দুঃখ দেখি বিপ্র-হৃদে হৈল দয়া।
জিজ্ঞাসিল মার্জ্জারের নিকটেতে গিয়া।।
একাকী হেথায় তুমি কিসের কারণ।
মাতা পিতা বন্ধু তব নাহি কোন জন।।
বিড়াল বলয়ে, কেহ নাহিক সংসারে।
প্রসবিয়া মাতা মোর গেছে কোথাকারে।।
জননী ছাড়িয়া গেল দৈব নির্ব্বন্ধনে।
একাকী অনাথ হয়ে রহিয়াছি বনে।।
মুনি বলে, আমি তোমা করিব পালন।
বঞ্চিবে পরম সুখে আমার সদন।।
অপুত্রক আছি আমি, পুত্র নাহি হয়।
পুত্রবৎ করি তোমা পালিব নিশ্চয়।।
এত শুনি বিড়ালের হৃষ্ট হৈল মন।
বিপ্রের চরণে আসি করিল বন্দন।।
বিড়াল লইয়া মুনি আসিল কুটীরে।
পালন করিতে তারে দিলেন ভার্য্যারে।।
বিড়াল পাইয়া তুষ্টা হইল সুন্দরী।
পালন করিল তারে পুত্রবৎ করি।।
মায়া মোহে বন্ধ হয়ে সব পাসরিল।
বিড়াল লইয়া দোঁহে নগরে আসিল।।
পুনরপি গৃহধর্ম্ম করে দুই জনে।
বলবন্ত হৈল সেই অধিক পালনে।।
স্বভাব পশুর জাতি ছাড়িবারে নারে।
বহু উপদ্রব করে গৃহস্থের ঘরে।।
যজ্ঞ-হবি নষ্ট করে, পায়সান্ন খায়।
মারিতে আসিলে লোক পলাইয়া যায়।।
ক্রোধে নগরের লোক দুঃখী মনে মন।
সবে ব্রাহ্মণেরে গালি দেয় অনুক্ষণ।।
কোথায় তপস্যা তব, কোথায় ব্রহ্মণ্য।
পুত্রহীন হয়ে তুমি হলে মতিচ্ছন্ন।।
বিড়ালেরে এত স্নেহ পুত্রবৎ কর।
সহজে পশুর জাতি মনে নাহি ডর।।
এইরূপে বলে মন্দ নগরের জন।
ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণী ক্রোধে জ্বলিল তখন।।
ধরিয়া ঈষিকাবাড়ি প্রহারে বিড়ালে।
বান্ধিয়া রাখিল তারে হাতে পায়ে গলে।।
দিন দুই তিন তারে রাখিল বন্ধনে।
বড়ই বৈরাগ্য হৈল বিড়ালের মনে।।
কোনমতে পারি যদি ছাড়াতে বন্ধন।
তপস্যা করিয়া পাপ করিব মোচন।।
গৃহবাসে কার্য্য নাহি, যাব বনবাস।
অনাহারে পাপ আত্মা করিব বিনাশ।।
এরূপে বিড়াল মনে মনে যুক্তি করি।
দন্তেতে কাটিল তবে বন্ধনের দড়ি।।
সেইক্ষণে গৃত হৈতে হইল বাহির।
দণ্ডক কাননে গিয়া হইলেক স্থির।।
বিন্দু সরোবরে তথা করি স্নানদান।
একে এক সর্ব্বতীর্থে করিল প্রয়াণ।।
তীর্থ প্রদক্ষিণব্রত করি একে একে।
বিড়াল তপস্বী বলি খ্যাত হৈল লোকে।।
সমুদ্রের কাছে দ্বীপ অতিরম্য নামে।
বহু মূষাগণ তথা থাকে অনুক্রমে।।
তথা গিয়া উত্তরিল বিড়াল সন্ন্যাসী।
দেখিয়া সকল মূষা মনে ভয় বাসি।।
হাহাকার করি সবে পলায় তরাসে।
আশ্বাসি বিড়াল তবে কহে সবিশেষে।।
আমারে দেখিয়া ভয় কর কেন মনে।
পরম ধার্ম্মিক আমি, সর্ব্বলোকে জানে।।
তপস্যা করিয়া মোর চিরকাল গেল।
হিংসা হেন বস্তু মোর কখন নহিল।।
পবন আহারী আমি, শুন মূষাগণ।
আমারে তিলেক ভয় না কর কখন।।
আনন্দ কৌতুকে সবে ভ্রমহ নির্ভয়ে।
তপস্যা করিব আমি তোমার আশ্রয়ে।।
এত শুনি মূষাগণ হৈল হৃষ্টমন।
যার যেই স্থানে ক্রমে আসে সর্ব্বজন।।
মর্য্যাদা করিয়া বহু স্থাপিল বিড়ালে।
নির্ভয়েতে মূষাগণ ভ্রমে কুতূহলে।।
কত দিন গেল, তবে জন্মিল বিশ্বাস।
যার যেই শিশুগণ রাখে তার পাশ।।
দূরবনে যায় সবে আহার কারণ।
নারিল ছাড়িতে লোভ বিড়ালের মন।।
সহজে পশুর জাতি, নাহি আত্ম পর।
চারিদিকে চাহি তার ফুলে কলেবর।।
উদর পূরিয়া খায় মূষা শিশুগণে।
হাত মুখ মুছি পুনঃ বসে সে ধেয়ানে।।
খাইতে খাইতে লোভ অধিক হইল।
দিনে দিনে মূষা শিশু অনেক খাইল।।
এ সকল তত্ত্ব নাহি জানে কোন জন।
দিনে দিনে অল্প হয় মূষা শিশুগণ।।
এক মূষা বুদ্ধিমন্ত তাহাতে আছিল।
অল্প শিশুগণ দেখি হৃদয়ে ভাবিল।।
এ বেটা তপস্বী ভণ্ড, জানিনু লক্ষণে।
চুরি করি খায় যত মূষা শিশুগণে।।
তদন্ত জানিতে সেই নিকটে রহিল।
আর মূষাগণ সব দূরবনে গেল।।
চারি পানে চাহিয়া বিড়াল ততক্ষণ।
দশ ‍পাঁচ শিশু ধরি করয়ে ভক্ষণ।।
দেখিয়া প্রবীণ মূষা করে হাহাকার।
সব মূষাগণে গিয়া দিল সমাচার।।
শুনিয়া সকল মূষা হৈল দুঃখীমন।
উপায় সৃজিল তার নিধন কারণ।।
এই যুক্তি করি সবে হয়ে একমন।
দ্বীপের চৌদিকে সবে করয়ে খনন।।
খনিল গভীর গর্ত্ত দীর্ঘেতে বিস্তর।
তাহাতে পড়িয়া মরে বিড়াল পামর।।
সেইমত যুধিষ্ঠির কৈল আচরণ।
মুহূর্ত্তেকে মোর হাতে হারাবে জীবন।।
উলূক এতেক শুনি আনন্দিত মনে।
সাধু সাধু বলি প্রশংসিল দুর্য্যোধনে।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।