২৮. কুরুসৈন্যের কুরুক্ষেত্রে যাত্রা

মুনি বলে, শুন রাজা শ্রীজনমেজয়।
কুরুক্ষেত্রে আসিলেন পাণ্ডুর তনয়।।
সাত অক্ষৌহিণী সেনা করিয়া সাজন।
রহেন উত্তরভাগে সিংহের গর্জ্জন।।
চর আসি দুর্য্যোধনে করে নিবেদন।
কুরুক্ষেত্রে সাজি এল পাণ্ডুপুত্রগণ।।
শুনিয়া নৃপতি আজ্ঞা দিল দুঃশাসনে।
শীঘ্রগতি ডাকি আন যত সভাজনে।।
রণসজ্জা করি আসিয়াছে শত্রুগণ।
শুভযাত্রা দেখি সৈন্য করহ চলন।।
পাইয়া রাজার আজ্ঞা বীর দুঃশাসন।
দৈবজ্ঞ আনিয়া দিন করিল গণন।।
রাজারে কহিল তবে বীর দুঃশাসন।
তৃতীয় প্রহরে যাত্রা অতি শুভক্ষণ।।
সাজিবারে আজ্ঞা দিল যত সৈন্যগণে।
জয় শব্দ করে যত সৈন্য হৃষ্টমনে।।
অসংখ্য সাজিল রথী, লিখিতে না পারি।
অর্ব্বুদ অর্ব্বুদ কত সাজিল প্রহরী।।
গজ বাজী পত্তি সাজে রথ অগণন।
সমুদ্র প্রমাণ সৈন্য সাজে কুরুগণ।।
ধ্বজ ছত্র পতাকায় ঢাকিল আকাশ।
বাসুকী সৈন্যের ভারে পায় বড় ত্রাস।।
টলমল করে পৃথ্বী যায় রসাতলে।
প্রলয় কালেতে যেন সমুদ্র উথলে।।
একাদশ অক্ষৌহিণী করিল সাজন।
এক শত ক্রোশ যুড়ি রহে সৈন্যগণ।।
তবে দুর্য্যোধন রাজা আনি সভাজনে।
ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ কর্ণ পৃষত-নন্দনে।।
জয়দ্রথ সোমদত্ত ভগদত্ত বীর।
পঞ্চ ভাই ত্রিগর্ত্ত সহিত নৃপতির।।
শল্য মদ্রেশ্বর আর সুশর্ম্মা নৃপতি।
সবারে বিনয় করি কহে নরপতি।।
ক্ষত্রমধ্যে পরাপর নাহি শাস্ত্রনীত।
যুদ্ধেতে উপেক্ষা করা না হয় উচিত।।
পিতা পুত্রে যুদ্ধ হৈলে না করি উপেক্ষা।
সে কারণে না করিবে কাহার প্রতীক্ষা।।
প্রাণ উপেক্ষিয়া সবে করিবে সমর।
নিকটে সাজিয়া এল পাণ্ডুর কোঙর।।
শুনি অঙ্গীকার কৈল যত বীরগণ।
হইল সানন্দচিত্ত গান্ধারী নন্দন।।
তবে শত ভাই সঙ্গে রাজ দুর্য্যোধন।
যাত্রা করি সজ্জীভূত হৈল সেইক্ষণ।।
বিদায় লইতে গেল বাপের সদন।
নমস্কার করি কহে ভাই শত জন।।
প্রসন্ন হইয়া তাত করহ আদেশ।
শুভদিন আজি, যাব কুরুক্ষেত্র দেশ।।
তোমার প্রসাদে তাত হবে রিপুক্ষয়।
যুদ্ধ করিবারে আজ্ঞা দেহ মহাশয়।।
শুনিয়া হইল অন্ধ ক্রোধিত অন্তর।
মনে মনে অনুশোচ করিল বিস্তর।।
আশীর্ব্বাদ দিল হেঁট করিয়া বদন।
মায়ের নিকটে তবে গেল দুর্য্যোধন।।
শত ভাই কহে কথা করিয়া প্রণতি।
প্রসন্ন হইয়া মাতঃ দেহগো আরতি।।
শুনিয়া সুবলসুতা সজল লোচন।
আশ্বাসিয়া পুত্রগণে বলিল বচন।।
ইতর তোমার রিপু নহে পাণ্ডুসুত।
একৈক পাণ্ডব জিনিবেক পুরুহূত।।
দেবের অজেয় রিপু বিখ্যাত ভুবনে।
জীয়ন্তে পাণ্ডবে কেহ না পারিবে রণে।।
সে কারণে তাহা সহ কলহ না রুচে।
মোর ‍বাক্যে প্রীতি কর যদি মনে ইচ্ছে।।
শুনিয়া কহিল তবে রাজা দুর্য্যোধন।
হেন বাক্য মাতা নাহি বলিও কখন।।
কর্ণ মোর পক্ষ আর দ্রোণ মহাশয়।
পিতামহ ভীষ্ম বীর সংগ্রামে দুর্জ্জয়।।
অশ্বথামা কৃতবর্ম্মা কৃপ মহাবীর।
শল্য মদ্রেশ্বর রাজা সংগ্রামে সুধীর।।
লক্ষ লক্ষ বীরগণ আমার সহায়।
পাণ্ডুপুত্রে সমরেতে মারিব হেলায়।।
পাণ্ডবের পরাজয়, মোর হবে জয়।
নাহিক সংশয় ইথে, কহিনু নিশ্চয়।।
আশীর্ব্বাদ কর মাতা, বিলম্ব না সয়।
ক্ষণ বহি যায় মাতা করহ বিদায়।।
এত শুনি কৈল মাতা মলিন বদনে।
যদি ধর্ম্মে থাক তবে জয়ী হবে রণে।।
আরো এক কথা পুত্র শুন দুর্য্যোধন।
যথা ধর্ম্ম তথা জয়, বেদের বচন।।
এই বাক্য মুখে বলে মাতা সুবদনী।
আকাশে নির্ঘাত বাণী হৈল ঘোরধ্বনি।।
বিনা মেঘে রক্তবৃষ্টি হয়ত গগনে।
মহাঘোর শব্দ করি ডাকে মেঘগণে।।
বায়স শকুনিগণ উড়য়ে আকাশে।
মন্দতেজ হৈল রবি, কর না প্রকাশে।।
নগর নিকটে আসি ডাকে শিবাগণ।
এইরূপে যাত্রাকালে হৈল কুলক্ষণ।।
অহঙ্কারে দুর্য্যোধন কিছু না মানিল।
মায়েরে বিদায় মাগি রথে আরোহিল।।
ভীষ্ম দ্রোণ কৃতবর্ম্মা কৃপ মহামতি।
কর্ণ আদি করি সাজে যত মহারথী।।
জয় শব্দ করি চলে রাজা দুর্য্যোদন।
কুরুক্ষেত্রে উত্তরিল যত কুরুগণ।।
শত ক্রোশ যুড়ি রহে কৌরবের সেনা।
রথ রথী গজ বাজী পত্তি অগণনা।।
প্রলয়ের সিন্ধু সম সৈন্যের গর্জ্জনে।
জগৎ বধির হৈল, না শুনি শ্রবণে।।
তবে দুর্য্যোধন রাজা হয়ে হৃষ্টমন।
উলূকে ডাকিয়া আজ্ঞা দিল সেইক্ষণ।।
যাহত উলূক তুমি, বিলম্ব না সহে।
দেখহ আমার সৈন্য কোথা কত রহে।।
যে দেখিবে বিবরিয়া কহিবে পাণ্ডবে।
যুদ্ধ কর আসি সবে শক্তি অনুভবে।।
কহিবে ভীমেরে মোর নিষ্ঠুর বচন।
মোর সঙ্গে আসি শক্তিমত কর রণ।।
দ্রৌপদীর অপমান আর দাসপণ।
যত দুঃখ পেলে বনে করিয়া ভ্রমণ।।
সে সব স্মরিয়া সাহসেতে করি ভর।
মোর সঙ্গে আসি তুমি করহ সমর।।
আমারে জিনিয়া সুখে ভুঞ্জ বসুমতী।
নতুবা আমার হাতে হইবে সদগতি।।
অর্জ্জুনে কহিবে দম্ভ করিয়া বিস্তর।
পূর্ব্বের যতেক দুঃখ স্মরহ অন্তর।।
যে প্রতিজ্ঞা করেছিলে, করহ পালন।
আমারে জিনিয়া সুখে ভুঞ্জ ত্রিভুবন।।
নতুবা কর্ণের হাতে দেখিবে শমন।
অবিলম্বে কর আসি, যাহা লয় মন।।
কৃষ্ণেরে কহিবে দম্ভ করিয়া অপার।
পাণ্ডবের পক্ষ হয়ে হও আগুসার।।
যেই মায়া দেখা‌ইলে সভা বিদ্যমানে।
সে মায়া করিয়া এস অর্জ্জুনের সনে।।
সহদেব নকুলেরে কহিবে বচন।
পূর্ব্ব দুঃখ ভাবি দুই জনে কর রণ।।
কহিবে ধর্ম্মেরে মোর বচন বিশেষে।
ব্রহ্মচারী বলি তোমা জগতেতে ঘোষে।।
ধার্ম্মিকের শ্রেষ্ঠ তোমা, বলে সর্ব্বজন।
তপস্বী বলিয়া তোমা করি যে গণন।।
এখন সে সব কথা হইল প্রচার।
বিড়াল তপস্বী প্রায় তব ব্যবহার।।
পূর্ব্বেতে তাহার শুনিয়াছি যে কারণ।
সেই অভিপ্রায়ে তব তপ আচরণ।।
মুখে মাত্র বল ধর্ম্ম, অন্তরেতে আন।
বিড়াল তপস্বী প্রায় হারাইবে প্রাণ।।
এত শুনি সবিস্মরেয় উলূক তখন।
নৃপতিরে জিজ্ঞাসিল বিনয় বচন।।
বিড়াল তপস্বী হয়েছিল কি কারণে।
আপনার দোষে সেই মরিল কেমনে।।
পশু হয়ে কৈল কেন তপ আচরণ।
বিবরিয়া কহ, শুনি ইহার কারণ।।
উদ্যোগ পর্ব্বের কথা অমৃত-সমান।
ব্যাসের রচিত দিব্য ভারত পুরাণ।।
মস্তকে বন্দিয়া ব্রাহ্মণের পদরজ।
কাশীদাস কহে গদাধর দাসাগ্রজ।।