২৫. কৌরব সভায় শ্রীকৃষ্ণের পুনরাগমন

রজনী বঞ্চিয়া সুখে বিদুরের ঘরে।
প্রভাতে উঠিয়া দেব হরিষ অন্তরে।।
প্রাতঃক্রিয়া সমাপিয়া শুভযাত্রা করি।
বিদুরের সঙ্গে করি চলেন শ্রীহরি।।
সাত্যকি চলিল সঙ্গে আর চেকিতান।
চারি জন চলি যান কুরু বিদ্যমান।।
সভা করি বসি আছে অন্ধ নরপতি।
হেনকালে উপনীত দেব জগৎপতি।।
কৃষ্ণ-আগমন রাজা জানি সেইক্ষণ।
বহু মান্য করি দিল বসিতে আসন।।
হেনকালে উপনীত যত সভাজন।
ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ কর্ণ পৃষত-নন্দন।।
পঞ্চ ভাই ত্রিগর্ত্ত দেশের নরপতি।
আসিল যতেক রাজা সবে মহামতি।।
শত ভাই সহ বসি রাজা দুর্য্যোধন।
যার যেই আসনেতে বসে সর্ব্বজন।।
আসিল যতেক মুনি জানিয়া কারণ।
নারদ পুলস্ত্য আর দেবল তপন।।
মার্কণ্ড অগস্ত্য বিভাণ্ডক তপোধন।
আসিল যতেক মুনি অন্ধের ভবন।।
যথাযোগ্য আসনেতে বৈসে মুনিগণ।
শুন দুর্য্যোধন রাজা হয়ে একমন।।
ধর্ম্ম আত্মা যুধিষ্ঠির ধর্ম্মেতে তৎপর।
ধম্ম চিন্তি পাঠাইল তোমার গোচর।।
কুলক্ষয় জানি মনে সবে ক্ষমা দিল।
বিনয়ে আমাকে সেই এখানে পাঠাল।।
যা বলিল ধর্ম্মরাজ, শুন বলি তাই।
ভাই ভাই বিরোধেতে প্রয়োজন নাই।।
নিয়ম হইল পূর্ব্বে তোমার সাক্ষাতে।
নানা কষ্ট ভুঞ্জি মুক্ত হইলাম তাতে।।
আমার বিভাগ রাজ্য যে হয় ‍ উচিত।
তাহা ছাড়ি দিয়া মম সঙ্গে কর প্রীতি।।
সভামধ্যে যত কিছু কৈলে অপমান।
সে সকল অপরাধে আছি ক্ষমাবান।।
সে সকল দুঃখ আমি নাহি করি মনে।
অদৃষ্ট যেমন মম, ঘটিল তেমনে।।
এইরূপ কহিলন ধর্ম্মের কুমার।
ভীম ধনঞ্জয় মাদ্রীপুত্র দুই আর।।
যাহা চিত্তে লয়, তাহা কর নরবর।
এত শুনি ধৃতরাষ্ট্র করিল উত্তর।।
শুনিলে কি দুর্য্যোধন কৃষ্ণের বচন।
যাহা বলি পাঠাইল পাণ্ডুপুত্রগণ।।
পাণ্ডবেরা তব কিছু না কর অকার্য্য।
উচিত ছাড়িয়া দিতে তাহাদের রাজ্য।।
যে নিয়ম করেছিল, হইল মোচন।
তবে তার সহ দ্বন্দ্ব কর কি কারণ।।
এমত করিলে তোমা না সহিবে ধর্ম্ম।
সংসার যুড়িয়া হবে তব অপকর্ম্ম।।
পূর্ব্ব অধিকার তার ছিল যত দূর।
যত রাজ্য ধন রত্ন ছিল গ্রাম পুর।।
তাহা দিয়া প্রীতি কর পাণ্ডবের সনে।
নাহি দিলে পরিণামে পাবে দুঃখ মনে।।
দুর্য্যোধন বলে, তাত না বুঝিয়া কহ।
জীয়ন্তে কি প্রীতি হবে পাণ্ডবের সহ।।
নাহি দিব রাজ্য আমি, যুদ্ধ করি পণ।
ইহার বিধান এই, শুনহ রাজন।।
শক্তি থাকে পাণ্ডবের, করিবেক রণ।
যুদ্ধে জিনি আমা সবে লবে রাজ্য ধন।।
এত শুনি ধৃতরাষ্ট্র হইল বিরত।
কহিতে লাগিল তবে সভাসদ্ যত।।
ভীষ্মবীর বলে আর দ্রোণ মহাশয়।
কৃপ অশ্বথামা আর পৃষত তনয়।।
কহিল নারদ মুনি ধর্ম্মশাস্ত্রমত।
এ কর্ম্ম তোমার রাজা না হয় উচিত।।
সংসারে অজেয় পঞ্চ পাণ্ডুর তনয়।
তাহা সহ যুদ্ধ তব উচিত না হয়।।
স্বধর্ম্মে থাকিলে হয় জয়ী ত্রিভুবনে।
অর্জ্জুনের গুণকর্ম্ম না যায় বর্ণনে।।
দেবের অবধ্য কালকেয়াদি মারিল।
গন্ধর্ব্বের ভয় হতে তোমারে রাখিল।।
নিবাতকবচগণে করিল নিধন।
খাণ্ডব দহিয়া করে অগ্নির তর্পণ।।
মহাবল যদুগণে সমরে জিনিল।
সুভদ্রা জিনিয়া আনি বিবাহ করিল।।
দ্রৌপদীর স্বংন্বরে বীর ধনঞ্জয়।
এক লক্ষ রাজগণে করে পরাজয়।।
বাহুযুদ্ধে পরাজয় করে পশুপতি।
একেশ্বর বিজয় করিল সব ক্ষিতি।।
ভীমের বিক্রম সবে জান ভালমতে।
লক্ষ লক্ষ নিশাচরে মারে মুষ্ট্যাঘাতে।।
হিড়িম্ব কির্ম্মীর বক আদি নিশাচর।
হেলায় সংহার করিলেক বৃকোদর।।
শত ভাই কীচকেরে মারিল নিমিষে।
ত্রিভুবন নাহি আঁটে ভীম যদি রোষে।।
হেন জন সহ তোমা বিরোধে কি কাজ।
অদ্ধরাজ্যে পাণ্ডবেরে দেহ কুরুরাজ।।
না দিলে প্রমাদ বড় হইবে তোমার।
পাণ্ডবের হাতে হবে সবংশে সংহার।।
আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়ে, পৃথ্বী যদি ভাসে।
দিনকর তেজোহীন, সপ্তসিন্ধু শোষে।।
ইন্দ্র আদি দেব যদি তব পক্ষ হয়।
জিনিতে নারিবে তবু পাণ্ডব সদনে।।
বিনয় করিয়া দোষ খণ্ডাহ এক্ষণে।।
গলায় কুঠার বান্ধি দন্তে তৃণ করি।
শীঘ্রগতি যাহ, যথা ধর্ম্ম অধিকারী।।
যত ধন রাজ্য নিলে জিনিয়া পাশাতে।
তাহার দ্বিগুণ করি দেহত সাক্ষাতে।।
ইন্দ্র প্রস্থে আনি অভিষেক কর।
এই কর্ম্মে তব হিত দেখি কুরুবর।।
এতেক নারদ মুনি বলিল বচন।
বলিল পরশুরাম জানিয়া কারণ।।
ব্যাস বুঝাইল কত, না শুনিল কানে।
পৌলস্ত্য যে বুঝাইল বেদের বিধানে।।
অনন্তর বুঝাইল যত সভাজন।
কারো বাক্য না শুনিল গান্ধারী নন্দন।।
অদৃষ্ট মানিয়া তবে ধৃতরাষ্ট্র বলে।
কালেতে কুবুদ্ধি ফল দুর্য্যোধনে ফলে।।
সে কারণে কারো বাক্য না শুনে শ্রবণে।
এত শুনি মৌনী হয়ে রহে সভাজনে।।
অদৃষ্ট মানিয়া তবে অম্বিকা নন্দন।
নিশ্বাস ছাড়িয়া হেঁট করিল বদন।।
পুনরপি হাস্যমুখে বলে নারায়ণ।
জানিলাম দুর্য্যোধন তোমার যে মন।।
অবশেষে বলিলেন যদুবংশপতি।
কহি, অবধান কর কুরুকুল-পতি।।
অর্দ্ধ রাজ্য ছাড়ি যদি না দিবে রাজন।
তোমার অধীন হৈল পাণ্ডুপুত্রগণ।।
পঞ্চ পাণ্ডবেরে ছাড়ি দেহ পঞ্চ গ্রাম।
সুখে তুমি ভোগ কর এই ধরাগ্রাম।।
পাণ্ডব নগর কুশস্থল সিদ্ধিগ্রাশ।
ইন্দ্রপ্রস্থ আর যে বারণাবত নাম।।
এই পঞ্চ গ্রাম ছাড়ি দেহ পাণ্ডবেরে।
দ্বন্দ্বে কার্য্য নাহি রাজা কহিনু তোমারে।।
পঞ্চ গ্রাম দিয়া শান্ত কর পঞ্চ জন।
পৌরুষ বৈভব যদি বাঞ্ছাহ রাজন।।
উভয় কুলের আমি সদা চিন্তি হিত।
মম বাক্যে পাণ্ডুপুত্রে করহ সম্প্রীতি।।
বনে বনে ভ্রমে পাণ্ডবেরা পঞ্চ জন।
বলহীন, কোন মতে ধরয়ে জীবন।।
যুদ্ধে অসমর্থ তারা, নারিবে জিনিতে।
না হয় উচিত, জ্ঞাতি হহন করিতে।।
জ্ঞাতিবধ মহাপাপ, সর্ব্বশাস্ত্রে গণি।
সে কারণে উপেক্ষা না কর নৃপমণি।।
এতেক বলিল যদি দেব জগৎপতি।
পুত্রে দোষী বলি কহে অন্ধ নরপতি।।
দুর্য্যোধন ক্রোধে ওঠে আসন হইতে।
গোবিন্দে চাহিয়া তবে লাগিল কহিতে।।
তীক্ষ্ম সূচী অগ্রদেশে ধরে যত ভূমি।
বিনা যুদ্ধে পাণ্ডবেরে নাহি দিব আমি।।
প্রতিজ্ঞা করিনু আমি, না হবে খণ্ডন।
পশ্চিমে উদয় যদি হয় ত তপন।।
আকাশ পড়য়ে ভূমে, পৃথ্বী জলে ভাসে।
দিনকর তেজে যদি হয় দ্বিজগণ।।
তথাপি প্রতিজ্ঞা মকম না হবে খণ্ডন।
পাণ্ডবেরে ছাড়িয়া না দিব রাজ্যধন।।
এত শুনি মৌন হয়ে রহে লক্ষ্মীপতি।
বলেন ক্ষণেক পরে ধৃতরাষ্ট্র প্রতি।।
দূত হয়ে আসিলাম দুই কুল হিতে।
শুনিনু অদ্ভুত কথা বিদুর-মুখেতে।।
কোন্ দোষে করিলাম শুনহ রাজন।
আমারে বান্ধিতে চাহে তোমার নন্দন।।
কে কারে বান্ধিতে পারে দেখ বিদ্যামনে।
ক্ষমা করি শুধু মাত্র চাহি তোমা পানে।।
ক্ষুদ্র মৃগে মারে যথা কেশরী প্রচণ্ড।
নাগেরে গরুড় যথা করে খণ্ড খণ্ড।।
সেইরূপ দেখি আমি যত কুরুগণে।
মুহূর্ত্তে মারিতে পারি যদি করি মনে।।
তোমার অপেক্ষা হেতু ক্ষমিয়াছি আমি।
নহে কেন পাণ্ডবেরা ভ্রমে বনভূমি।।
এত বল উচ্চৈঃস্বরে হাসে নারায়ণ।
হাসিতে হাসিতে হৈল আরক্ত লোচন।।
কম্পান্বিত কলেবর দেখি লাগে ভয়।
দেবমায়া সৃজিলেন দেব দয়াময়।।
নিজ অঙ্গে দেখালেন এ তিন ভুবন।
দিব্য চক্ষু সব জনে দেন নারায়ণ।।
দিব্য চক্ষু পেয়ে সবে একদৃষ্টে চায়।
যতেক দেখিল, তাহা কহনে না যায়।।
দেবতা তেত্রিশ কোটি দেখে পৃষ্ঠদেশে।
নাভিপদ্মে দেখে ব্রহ্মা আছে সবিশেষে।।
নারদ বক্ষেতে শোভে দেব তপোধন।
নয়নে দেখয়ে একাদশ রুদ্রগণ।।
ঊনপঞ্চাশৎ বায়ু অশ্বিনী কুমার।
অনন্ত বাসুকি আদি যত নাগ আর।।
গোবিন্দের পুরোভাগে করে নানা স্তুতি।
তবে আর নানাবিধ দেখয়ে বিভূতি।।
স্থাবর জঙ্গম দেখে যত দেহিগণ।
গোবিন্দের অঙ্গে দেখে এ তিন ভুবন।।
বিশ্বরূপ নিরখিয়া সবে মূর্চ্ছা গেল।
গোবিন্দের অগ্রে সবে কহিতে লাগিল।।
জগতের কর্ত্তা তুমি, জগতের পতি।
সৃজন পালন তুমি, সংহার মূরতি।।
অপার মহিমা তব, বেদে অগোচর।
নিজ রূপ সম্বরহ দেব গদাধর।।
এইরূপে স্তুতি কৈল যত ‍মুনিগণ।
ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ আদি যতেক সুজন।।
স্তুতি বশে সুপ্রসন্ন হয়ে জগৎপতি।
বিশ্বরূপা মায়া ছাড়িলেন সে বিভূতি।।
দুর্য্যোধনে পুনরপি বুঝাইল সবে।
কারো বাক্য দুর্য্যোধন না শুনিল তবে।।
সভা হৈতে উঠি তবে চলে সর্ব্বজন।
নিজস্থানে গেল তবে যত মন্ত্রিগণ।।
সাত্যকির হাতে ধরি চলেন শ্রীহরি।
যত দ্রব্য দিয়াছিল কুরু-অধিকারী।।
কোন দ্রব্য না নিলেন হয়ে ক্রোধমন।
শীঘ্রগতি করিলেন রথে আরোহন।।
বিস্ময় মানিল ধৃতরাষ্ট্র নরপতি।
অনর্থ হইল, বলে ভীষ্ম মহামতি।।
মৌনভাবে রহিলেন অম্বিকা-নন্দন।
কুন্তীর নিকটে কৃষ্ণ করেন গমন।।
সম্ভাষি সবারে, পরে কুন্তীরে নমিয়া।
বহু কথা কহিলেন নিকটে বসিয়া।।
তাবৎ বৃত্তান্ত সব কহিলেন তাঁরে।
চলিলেন চক্রপাণি সম্ভাসি সবারে।।
পথে কর্ণ সহ মিলিলেন জনার্দ্দন।
কর্ণের সহিত হৈল রহস্য কথন।।
কন্যাকালে কুন্তীগর্ভে তোমার উৎপত্তি।
তুমি কর্ণ মহাবীর, কুন্তীর সন্ততি।।
যুধিষ্ঠির নৃপতির তুমি সহোদর।
আপনা না চিন কর্ণ তুমি কি বর্ব্বর।।
ধর্ম্মশাস্ত্র পড়িয়াছ, করিয়াছ দান।
ব্রাহ্মণ সভাতে করে তোমার বাখান।।
তোমার কনিষ্ঠ পাণ্ডবেরা পঞ্চ ভাই।
এ হেন সম্বন্ধ কর্ণ বড় ভাগ্যে পাই।।
দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র অভিমন্যু আদি।
পূজিবে ভৃত্যের সম তোমা নিরবধি।।
নকুল অর্জ্জুন সহদেব ভীম বীর।
তব পদ ধোয়াইবে রাজা যুধিষ্ঠির।।
সুবর্ণ রজত কুম্ভে তব অভিষেকে।
রাজকন্যা সেবিবে যে দেখিবে প্রত্যেকে।।
পঞ্চজনে দ্রৌপদী যে করিবে সেবন।
অগ্নিহোত্র করিবেক ধৌম্য তপোধন।।
তোমারে সিঞ্চিবে আজি বিপ্র চারিবেদী।
পাণ্ডবের পুরোহিত কুশল-সংবাদী।।
যুবরাজ হবে তব রাজা যুধিষ্ঠির।
ধবল চামর লয়ে বিচিত্র শরীর।।
মস্তকে ধরিবে ছত্র বীর বৃকোদর।
রথের সারথি হবে পার্থ ধনুর্দ্ধর।।
সুধীর শিখণ্ডী তব হবে আগুসার।
এ সব বচন কর্ণ ধরিবে আমার।।
বৃষ্ণিবংশ লয়ে তব পিছে যাব আমি।
এ সব সম্পদ কর্ণ ভোগ কর তুমি।।
বলিলেন এইমত নিজে দামোদর।
ভক্তি করি কর্ণ তবে দিলেন উত্তর।।
সূর্য্যের ঔরসে জন্ম কুন্তীর উদরে।
সূর্য্যের বচনে মাতা বিসর্জ্জিলা মোরে।।
সূত মোরে পেয়ে পালে আপনার ঘরে।
আমারে পুষিল রাধা যত্ন পুরঃসরে।।
স্তন দিয়া পুষিলেন, জানে সর্ব্বজন।
সর্ব্বলোকে বলে মোরে রাধার নন্দন।।
ধর্ম্মেতে পাণ্ডুর সুত, কুন্তীগর্ভে জাত।
যুধিষ্ঠিরে না কহিবে এ সব বৃত্তান্ত।।
অনুরোধ করিবেন ধর্ম্ম নৃপবর।
আমি পুনঃ সর্ব্বথা না যাব দামোদর।।
আমি যদি পাই রাজ্য দিব দুর্য্যোধনে।
সত্যভঙ্গ তথাপি না করি, লয় মনে।।
দুর্য্যোধন কৈল মোরে বিস্তর পোষণ।
রাজ্য ধন দিল দিব্য রতন ভূষণ।।
তের বর্ষ ভুঞ্জিলাম রাজ্য আদি সুখ।
দুর্য্যোধন প্রসাদেতে নাহি কোন দুঃখ।।
করিব নিতান্ত রণ অর্জ্জুন সহিত।
প্রতিজ্ঞা করিনু, সর্ব্ব কৌরব বিদিত।।
যদ্যপি জানি যে আমি পাণ্ডবের জয়।
সবান্ধবে দুর্য্যোধন হইবেক ক্ষয়।।
অর্জ্জুনের হাতে হৈবে আমার নিধন।
দ্রোণাচার্য্যে মারিবেক দ্রুপদ নন্দন।।
ধৃতরাষ্ট্র পুত্র এই শত সহোদর।
পাঠাবে শমন ঘরে বীর বৃকোদর।।
তথাপিহ না ত্যজিব রাজা দুর্য্যোধনে।
ক্ষত্রিয়ের ধর্ম্ম জান প্রতিজ্ঞা পালনে।।
আপনি জানহ কৃষ্ণ সকল রহস্য।
সকল কৌরব নাশ হইবে অবশ্য।।
যেখানে তোমার নাম, সেইখানে জয়।
ইথে অন্যমত নাহি, শুন মহাশয়।।
যথা কৃষ্ণ তথা জয়, জানি যে সর্ব্বথা।
আমার প্রতিজ্ঞা নষ্ট না হইবে তথা।।
কেবল নিমিত্তভাগী এই তিন জন।
দুঃশাসন দুর্য্যোধন সুবল-নন্দন।।
কৌরব পাণ্ডব-যদ্ধে রুধিবে কর্দ্দম।
মরিবে পাণ্ডব হাতে কৌরব অধম।।
পাণ্ডব হইবে জয়ী, কুরু পরাজিত।
অবিলম্বে জনার্দ্দন হইবে নিশ্চিত।।
মঙ্গল না দেখি আমি কৌরবের কাজে।
উৎপাত অদ্ভুত দেখি গ্রহগণ মাঝে।।
গগণেতে উল্কাপাত নির্ঘাত সহিত।
পৃথিবী কম্পিতা হয়, দেখি বিপরীত।।
ভয়ানক শব্দ করি কান্দে অশ্ব গজ।
অকস্মাৎ খসি পড়ে যত রথধ্বজ।।
গৃধ্র পক্ষী কাক বক মূষিক সঞ্চান।
কৌরবের পাছে পাছে দেখি বিদ্যমান।।
মাংস আর রক্তবৃষ্টি ঊর্দ্ধে বহে বাত।
কৌরবগণের মৃত্যু দেখি জগন্নাথ।।
দুঃষ্বপ্ন দেখিনু আমি, শুন ‍নায়ায়ণ।
অমৃত পায়স ভুঞ্জে পাণ্ডুপুত্রগণ।।
পৃথিবী প্রসবে ধর্ম্ম, দেখিয়া এমন।
পর্ব্বতে উঠিয়া ভীম করে মহা রণ।।
রতন কবচ গায়ে দেখি সুশোভন।
পুষ্পমালা গলে শোভে ধবল বসন।।
হাতেতে ধবল ছত্র নামে সরোবর।
স্বপ্ন আমি দেখিলাম শুন দামোদর।।
পাণ্ডব হইবে জয়ী, কুরু পরাজয়।
অচিরে হইবে কৃষ্ণ, নাহিক সংশয়।।
এত বলি কর্ণ বীর করিল গমন।
প্রেমরূপে গোবিন্দেরে দিয়া আলিঙ্গন।।
কর্ণবীর গেল যদি আপন ভবন।
সৈন্যগণ সহ চলিলেন জনার্দ্দন।।
নানাবাদ্য কোলাহলে চলেন ত্বরিত।
বিরাট নগরে হইলেন উপনীত।।
হরিহরপুরগ্রাম সর্ব্বগুণধাম।
পুরুষোত্তম নন্দন মুখটি অভিরাম।।
কাশীরাম বিরচিত তাঁর আশীর্ব্বাদে।
সদা চিত্তে রহে যেন দ্বিজ পাদপদ্মে।।