২৪. শ্রীকৃষ্ণের প্রতি বিদুরের স্তব ও তাঁহার গৃহে শ্রীকৃষ্ণের ভোজন

কুন্তী কাছে বসিয়াছিলেন নারায়ণ।
নানা কথা আলাপনে অতি হৃষ্টমন।।
হেনকালে আইল বিদুর নিজালয়।
স্কন্ধ হৈতে ভিক্ষাঝুলি ভূমিতে নামায়।।
গৃহে প্রবেশিতে দেখে দেবকী-নন্দন।
কহে গদ গদ হয়ে সজল লোচন।।
আমার ভাগ্যের কথা কহিতে না পারি।
কৃপা করি মম গৃহে আসিলে মুরারি।।
কোন দ্রব্য দিয়া আমি পূজিব তোমারে।
আছুক অন্যের কাজ, অন্ন নাহি ঘরে।।
বড় ভাগ্যহীন আমি, অধম বঞ্চিত।
ক্ষমিবে আমারে প্রভু দেখিয়া দুঃখিত।।
এত বলি দণ্ডবৎ হয়ে করে স্তুতি।
নমো নমো পূর্ণব্রহ্মা জগতের প্রতি।।
তুমি আদি তুমি অন্ত ‍তুমি মধ্যরূপ।
সকল সংসার প্রভু তোমর স্বরূপ।।
নমো নমো আদি ব্রহ্মা মৎস্য-রূপধর।
নমো নমো হয়গ্রীব, নমস্তে ভূধর।।
নমস্তে বরাহ হিরণ্যাক্ষ-বিদারক।
নমো ভৃগুপতিরূপ ক্ষত্রকুলান্তক।।
নমো কূর্ম্ম অবতার মন্দার ধারণ।
নমস্তে মোহিনীরূপ অসুর মোহন।।
নমস্তে নৃসিংহরূপ দৈত্য বিনাশক।
নমো রাম অবতার রাবণ নাশক।।
নমস্তে বামনরূপ বলিদ্বারে দ্বারী।
বাসুদেব নমো জয় নমস্তে মুরারি।।
ভবিষ্যতি অবতার, নমো বুদ্ধকায়।
নমো কল্কি অবতার, ম্লেচ্ছবিনাশায়।।
কি জানি তোমার স্তুতি আমি হীনজ্ঞান।
ব্রহ্মা শিব আদি যাঁরে সদা করে ধ্যান।।
তুমি সে প্রকৃতিপর দেব নিরঞ্জন।
আত্মরূপে সর্ব্বভূতে তোমার গমন।।
শিষ্টের পালন কর, দুষ্টের সংহার।
এই হেতু জগৎপতি নাম যে তোমার।।
কে বলিতে পারে তব গুণ অগোচর।
তোমার মহিমা বেদ শাস্ত্রের উপর।।
এরূপে বিদুর করে নানাবিধ স্তুতি।
প্রসন্ন হইয়া তারে কহেন শ্রীপতি।।
পরম মহৎ তুমি সংসার ভিতরে।
তব তুল্য ধর্ম্মশীল নাহি চরাচরে।।
ভক্তবশ আমি থাকি ভক্তের অধীনে।
অধিক নাহিক প্রীতি ভক্তজন বিনে।।
মেরুতুল্য রত্ন যে অভক্ত জয় দেয়।
তাহাতে আমার তুষ্টি কিঞ্চিৎ না হয়।।
অল্প বস্তু দেয় যদি ভক্তি সহকারে।
তাহাতে যতেক তুষ্টি, কে কহিতে পারে।।
শ্রীহরির স্নেহবাক্য বিদুর শুনিল।
প্রতি অঙ্গ পুলকিত কহিতে লাগিল।।
কি দিয়া করিব তুষ্ট আমি অভাজন।
আপনার গুণে কৃপা কর নারায়ণ।।
ভক্তের অধীন তুমি দয়ার সাগর।
কৃপা করি পদছায়া দেহ গদাধর।।
কৃপা করি মোরে স্নেহ কর হৃষীকেশ।
তোমার মহিমা আমি না জানি বিশেষ।।
বিদুরের স্তবে তুষ্ট হয়ে নারায়ণ।
কৌতুকে কহেন পুনঃ কপট বচন।।
বিদুর সে সব কথা হইবে পশ্চাতে।
সম্প্রতি কাতর আমি অত্যন্ত ক্ষুধাতে।।
স্তবেতে কাহার কবে পূরিল উদর।
খাদ্যবস্তু আন কিছু জুড়াক অন্তর।।
স্নান করি বসিয়াছি বিনা জলপানে।
যে কিছু আছয়ে শীঘ্র আন এইখানে।।
শুনিয়া বিদুর গৃহে করিল প্রবেশ।
তণ্ডুলের খুদমাত্র আছে অবশেষ।।
তাহা আনি দিল পদ্মাপতি পদ্মকর।
পদ্মা সহ পদ্মাপতি বান্ধিল অন্তরে।।
সন্তুষ্ট হইয়া কৃষ্ণ করেন ভক্ষণ।
বিদুর লজ্জিত হয়ে না মেলে নয়ন।।
পুনশ্চ বিদুর কহে দেব দামোদরে।
আজ্ঞা কর যাই আমি ভিক্ষা-অনুসারে।।
নগরে যে পাই ভিক্ষা অতিরিক্ত নয়।
এত শুনি হাসি কন দেবকী তনয়।।
ভিক্ষার কারণ বহু কৈলে পর্য্যটন।
পুনঃ যাবে ভিক্ষাতে, না রুচে মম মন।।
যে কিছু পাইলে তাহা করহ রন্ধন।
সবে মেলি বাঁটিয়া তা করিব ভক্ষণ।।
শুনিয়া বিদুর আজ্ঞা করিল কুন্তীরে।
রন্ধন করিয়া কুন্তী দিলেন সত্বরে।।
সাত্যকি সহিত কৃষ্ণ বিদুরের বাসে।
ভোজনান্তে আচমন করিলেন শেষে।।
তাম্বূল না ছিল ঘরে, দিল হরীতকী।
ভক্ষণ করিলা কৃষ্ণ পরম কৌতুকী।।
বিদুর সাত্যকি আর দেব নারায়ণ।
ইষ্ট আলাপনে করিলেন জাগরণ।।
বিদুর বলেন, দেব কর অবধান।
কি হেতু হস্তিনাপুরে তোমার প্রয়াণ।।
পাণ্ডবের দূত হয়ে এলে অভিপ্রায়ে।
ধর্ম্মনীতি বুঝাইতে গান্ধারী-তনয়ে।।
তব বাক্য না রাখিবে কভু দুর্য্যোধন।
সম্প্রীতে ছাড়িয়া রাজ্য না দিবে দুর্জ্জন।।
ভীষ্ম দ্রোণ বুঝাইল ব্যাস মুনিবর।
কার বাক্য না শুনিল কৌরব পামর।।
গোবিন্দ বলেন, যাহা কহিলে প্রমাণ।
না করিবে সম্প্রীতে সে পাণ্ডবে সম্মান।।
তথাপিহ লোকধর্ম্মে তরিবার তরে।
ধর্ম্ম-আত্মা যুধিষ্ঠির পাঠাইলা মোরে।।
পঞ্চ ভাই জন্যে মাগি লব পঞ্চ গ্রাম।
এই হেতু আসিলাম দুর্য্যোধন-ধাম।।
বিদুর বলেন, দেব এ কথা না কহ।
ভালে ভালে শীঘ্রগতি হেতা হতে যাহ।।
যে মন্ত্রণা করিয়াছে বলিবারে ভয়।
দুষ্ট দুর্য্যোধন আরা রাধার তনয়।।
দুঃশাসন সহ দুষ্ট বসিয়া নিভৃতে।
যুক্তি করিয়াছে তোমা বান্ধিয়া রাখিতে।।
এত শুনি গোবিন্দের ক্রোধে কাঁপে বক্ষ।
কুম্ভকার চক্র যেন ফিরে দুই অক্ষ।।
অরুণ লোচন ক্রোধে রক্ত বিম্ব জিনি।
বলেন বিদুর প্রতি দেব চক্রপাণি।।
এত অহঙ্কার করে কুরু পাপকারী।
ইহার উচিত শাস্তি দিতে আমি পারি।।
মুহূর্ত্তেকে পারি সবা করিতে সংহার।
বাতি দিতে কুরুকুলে না রাখিব আর।।
গোবিন্দের বাক্যে বিদুরের ভীত মন।
করযোড় করি পুনঃ বলেন বচন।।
তোমারে বান্ধিতে পারে, কাহার শকতি।
ত্রিভুবনে হর্ত্তা কর্ত্তা তুমি জগৎপতি।।
ভকতে বান্ধিতে পারে মাত্র ভক্তিপাশে।
আপন বন্ধন তুমি লহ অনায়াসে।।
যে ‍কালে গোকুলে বাল্যলীলা করেছিলে।
একদিন যশোদার ক্রোধ বাড়াইলে।।
ক্রোধেতে যশোদা তোমা করিল বন্ধন।
মায়াতে মোহিত হয়ে করিলা এমন।।
যত দড়ি যশোমতী আনে ক্রোধমনে।
বান্ধিতে না আঁটে দুই অঙ্গুলি প্রমাণে।।
দেখিয়া মায়ের দুঃখ হৈল তব দয়া।
লইলে বন্ধন তুমি ত্যজি নিজ মায়া।।
মায়ার পুত্তলী তুমি নানা মায়া জান।
আদি নিরঞ্জন তুমি, পূর্ণ ভগবান।।
তোমার এতেক ক্রোধ কি হেতু না জানি।
আমারে দেখিয়া ক্রোধ ক্ষম চক্রপাণি।।
তোমারে বান্ধিতে পারে, আছে কোন্ জন।
কিবা অল্পমতি ছার রাজা দুর্য্যোধন।।
কি করিতে পারে তোমা, কাহার শকতি।
সর্ব্ব অপরাধ ক্ষম দেব জগৎপতি।।
বিদুরের বাক্যে শান্ত হৈল নারায়ণ।
জল দিলে যথা নিবর্ত্তয়ে হুতাশন।।
পুনরপি হাসি হাসি বলে জনার্দ্দন।
লঙ্ঘিতে না পারি আমি তোমার বচন।।
ক্ষমিলাম কৌরবের দোষ যে সকল।
অচিরাতে পাবে দুষ্ট সমুচিত ফল।।
খণ্ডিতে না পারি আমি ধর্ম্মের উত্তর।
সে কারণে আসিলাম হস্তিনা নগর।।
এত বলি ক্রোধহীন হন নারায়ণ।
বিদুর প্রবোধ পেয়ে আনন্দিত মন।।
নানা কথা আলাপেতে ছিলা তিন জন।
কথা শেষে করিলেন সকলে শয়ন।।
উদ্যোগপর্ব্বের কথা অমৃত-সমান।
ব্যাস বিরচিত দিব্য ভারত-পুরাণ।।
কাশীরাম দাস কহে রচিয়া পয়ার।
যাহার শ্রবণে হয় ভবসিন্ধু পার।।