০৫. ভদ্রকালী পর্ব্বতে পাণ্ডবদের গমন ও হরি পর্ব্বতে দ্রৌপদীর দেহত্যাগ

মুনি বলে শুন পরীক্ষিতের নন্দন।
চলিল উত্তরমুখে ভাই পঞ্চজন।।
দেখিল অপূর্ব্ব এক পর্ব্বত উপর।
অতি অপরূপ শিবলিঙ্গ মনোহর।।
চন্দ্র সূর্য্য স্ফটিক জিনিয়া শুভ্রকায়।
স্তব করিলেন রাজা মহেশের পায়।।
তোমার প্রসাদে করি স্বর্গ আরোহণ।
এত বলি প্রণমিয়া করেন গমন।।
বহু কষ্টে ‍রাক্ষস আশ্রম এড়াইয়া।
ভদ্রকালী নামে গিরি আরোহেণ গিয়া।।
দেখেন পর্ব্বতে উঠি পাণ্ডুর নন্দন।
সপ্তরথে সূর্য্য আদি গ্রহদেবগণ।।
তাহা দেখি ছয় জন হরিষ অন্তরে।
ভদ্রকালী দেবী দেখিলেন গিরিপরে।।
প্রনাম করিয়া বর মাগেন যতনে।
এই বর দাও মাতা মাগি তব স্থানে।।
যুধিষ্ঠির কন দেবী কর মোরে দয়া।
কলিকালে জাগ্রতা থাকিবা মহামায়া।।
রাজা প্রজা অন্যায় যে করে অবিচারে।
খণ্ড খণ্ড হবে তারা তোমার খর্পরে।।
অমর নগর সম সুন্দর শোভন।
বিদ্যাধরি অপ্সরী জিনিয়া কন্যাগণ।।
লীলাবতী নামে কন্যা ভূপতি তাহাতে।
পাটে অধিকার করে পুরুস বর্জ্জিতে।।
পঞ্চ ভাই পাণ্ডবে দেখিয়া নিজ পুরে।
অগ্র হয়ে কহিলেন সবার গোচরে।।
রাজ্য নিতে এল কিবা কোন নরপতি।
আমার পর্ব্বতে এল অপরূপ গতি।।
সর্ব্বকাল এই রাজ্য মম অধিকার।
যে হুউক সমরে করিব মহামার।।

এত বলি হাতে অস্ত্র অনুক লইয়া।
যুধিষ্ঠিরে রাখিল পর্ব্বতে বসাইয়া।।
কোন নারী জিজ্ঞাসা করলি পাণ্ডবেরে।
কেবা তুমি কোথা যাবে কেন এই পুরে।।
রাজা বলে কন্যাগণ না হও অস্থির।
পৃথিবীর রাজা আমি নাম যুধিষ্ঠির।।
কি কারণে তোমা সবে ভাব অন্য কথা।
রাজ্য দেশ লইতে না আসি আমি হেথা।।
কলি আগমন হবে পৃথিবী ভুবনে।
স্বর্গে আরোহণ মোরা করি সে কারণে।।

এত শুনি কন্যাগণ চলিল ধাইয়া।
লীলাবতী রাণীকে সংবাদ দিল গিয়া।।
শুনি লীলাবতী কন্যা ফেলে ধনুর্ব্বাণ।
লক্ষ নারী সাজ করে বিবিধ বিধান।।
নানা অলঙ্কার অঙ্গে ‍সাজন করিয়া।
যুধিষ্ঠির অগ্রে কহে হাসিয়া হাসিয়া।।
জিতেন্দ্রিয় রাজা তুমি মহাপুণ্যবান।
অতএব এতদূরে করিলে প্রয়াণ।।
মম ভাগ্যে আসিয়াছ আমার নগর।
আমি দাসী হব তুমি হও রাজ্যেশ্বর।।
ভদ্রকালী পর্ব্বতেতে আমি অধিকারী।
হীরা মণি মাণিক্যে মণ্ডিত মম পুরী।।
যাবৎ থাকিবা ভদ্রকালীর পর্ব্বতে।
তাবৎ থাকিব রাজা তোমার সহিতে।।
জরা মৃত্যু ব্যাধি ভয় নাহি কোন পীড়া।
স্বর্গ হতে এ স্থানে আনন্দ পাবে বাড়া।।

যুধিষ্ঠির বলেন যে শুন লীলাবতী।
নিঃশত্রু করিয়া আমি ছাড়িলাম ক্ষিতি।।
কলি আগমনে আজ্ঞা দেন নারায়ণ।
রাজ্য ত্যজি কর গিয়া স্বর্গ আরোহণ।।
করেছি সঙ্কল্প আমি মর্ত্ত্যের ভিতর।
রাজ্য না করিব, যাব অমর নগর।।
অতএব ক্ষমা মোরে দাও কন্যাগণ।
সুরপুরী যাব আমি যথা নারায়ণ।।

যুধিষ্ঠির নৃপতির চরিত্র দেখিয়া।
পুনরপি কহে কন্যা ঈষৎ হাসিয়া।।
বুদ্ধি নাহি কিছু তব ধর্ম্মের নন্দন।
কি সুখ পাইবা স্বর্গে দেখি নারায়ণ।।
আমাদের সঙ্গে তুমি থাক নিরন্তর।
স্বর্গের অধিক ফল পাবে অতঃপর।।
যুধিষ্ঠির বলিলেন কৃষ্ণ সঙ্গ হৈতে।
অন্য সুখ নাহি ভাল লাগে মোর চিতে।।
শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদে মরি শুন কন্যাগণ।
অতএব যাব আমি অমর ভুবন।।
রাজার বিনয় বাক্য শুনি নারীগণ।
বাহুড়িয়া নিবর্ত্তিয়া গেল সর্ব্বজন।।
লীলাবতী কন্যা গেল পেয়ে মনোদুঃখ।
পঞ্চ ভাই চলিলেন উত্তরাভিমুখ।।

কত দূরে দেখিলেন পাণ্ডুর নন্দন।
ভদ্রেশ্বর নামে লিঙ্গ অতি সুশোভন।।
ত্রৈলোক্য বিখ্যাত শিব অতি মনোহর।
নানা রত্নে বিরচিত প্রবাল প্রস্তর।।
তাহা দেখি পাণ্ডবের হরষিত মন।
পঞ্চ ভাই করিলেন প্রণাম স্তবন।।
স্নানদান করি সবে ফল পুষ্প লৈয়া।
পূজা করি স্তব করে চৌদিক বেড়িয়া।।
বর মাগিলেন অতি মনের কৌতুকে।
করিলেন যাত্রা সবে উত্তরাভিমুখে।।

হরিনাম পর্ব্বতে করেন আরোহণ।
দেখেন পর্ব্বতে মণি মাণিক্য রতন।।
(মিসিং)
ঐরাবত নামে হস্তী ফিরে পালে পালে।
দেব যক্ষ মরে, অঙ্গ হিমেতে ভেদিলে।।

মহাহিমে শীত ভেদি যায় কত দূর।
পাছে পড়ি দ্রৌপদীর অঙ্গ হৈল চুর।।
বিষম দারুণ হিমে শীর্ণ কলেবর।
মুর্চ্ছিত হইয়া পড়ে পর্ব্বত উপর।।
অন্তকাল জানি দেবী চিন্তে নারায়ণ।
স্বামীগণ মুখ চাহি ত্যজিল জীবন।।
পাঞ্চালীর পতন পর্ব্বত হরিনামে।
অগ্রগামী রাজা না জানের কোন ক্রমে।।
পাছে বৃকোদর পার্থ দেখি বিপরীত।
ডাক দিয়া যুধিষ্ঠিরে বলেন ত্বরিত।।
পাঞ্চালী পড়িয়া পথে ত্যজিল শরীর।
শুনি তবে আকুল হৈলেন যুধিষ্ঠির।।
মহাভারতের কথা রচিলেন ব্যাস।
পাঁচালী প্রবন্ধে কহে কাশীরাম দাস।।