২৩. পরশুরামের তীর্থপর্য্যটন

ভীষ্ম বলিলেন শুন ধর্ম্মের নন্দন।
আর কিছু ইতিহাস শুন দিয়া মন।।
কৌণ্ডিন্য নামেতে মুনি বিখ্যাত ভুবন।
তীর্থযাত্রা করি তিনি করেন ভ্রমণ।।
ভাগীরথী বারাণসী প্রভাস পুষ্কর।
বিন্দুক্ষেত্রে বিন্দুহ্রদ বিরজা দুষ্কর।।
ইন্দ্রদ্যুন্ন সরোবর সরযূ কেদার।
মান সরোবর আদি তীর্থ হরিদ্রার।।
একে একে সব তীর্থ করিয়া ভ্রমণ।
ব্রহ্মহ্রদক্ষেত্রে তবে করিল গমন।।
বিপুল বিস্তার হ্রদ দেখিতে সুন্দর।
বৃহৎ কুম্ভীর থাকে তাহার ভিতর।।
পূর্ব্বেতে পরশুরাম ভৃগুবংশপতি।
টাঙ্গিতে হ্রদের দ্বার কাটেন ঝাটিতি।।
খণ্ডিত হইয়া জল হইল বাহির।
হরিদ্বার দিয়া বহে মাহস্রোত নীর।।
দ্বার মুক্ত করি স্নান করে তপোধন।
মাতৃবধপাপে রাম হইল মোচন।।

এত শুনি জিজ্ঞাসেন ধর্ম্মের নন্দন।
কহ শুনি পিতামহ সবিস্ময় মন।।
মহাধর্ম্মশীল রাজা ভৃগুবংশমণি।
কি কারণে মাতৃবধ করিলেন শুনি।।
সর্ব্ব গুরু হৈতে শ্রেষ্ঠ গণি যে জননী।
হেন কর্ম্ম কি কারণে করিলেন মুনি।।

ভীষ্ম বলিলেন তাহা শুনহ রাজন।
ভুবনে বিখ্যাত জমদগ্নি তপোধন।।
রেণুকা নামেতে তাঁর ভার্য্যা গুণবতী।
পুত্র বাঞ্ছা করি স্বামী সেবা করে অতি।।
ক্রমে ক্রমে পঞ্চ তার জন্মিল নন্দন।
কনিষ্ঠ তাহার রাম প্রতাপে তপন।।
ধনুর্ব্বেদ শিখিলেন বশিষ্ঠের স্থানে।
রামের সমান বীর নাহি ত্রিভুবনে।।
একদিন জমদগ্নি ছলিতে কুমারে।
গৃহিণীকে জল আনি দেহত আমারে।।
শীঘ্রগতি জল আনি দেহত আমারে।
তর্পণ করিব আমি জানাই তোমারে।।
এত শুনি কলসী আনিয়া শীঘ্রতর।
জল আনিবারে যায় সিন্ধু সরোবর।।
হেনকালে চলি যায় ঘৃতাচী অপ্সরী।
তার রূপে মুগ্ধ হয় গাধির কুমারী।।
মুহূর্ত্তেকে তার রূপ করে নিরীক্ষণ।
যতক্ষণ তার প্রতি চলিল নয়ন।।
সে কারণে বিলম্ব হইল কতক্ষণ।
জললয়ে দ্রুত গতি করিল গমন।।
বিলম্ব দেখিয়া মুনি ক্রোধিত হইল।
জ্যেষ্ঠ পুত্রে চাহি দ্রুত ডাকিয়া কহিল।।
জননীর মাথা কাটি আনহ ত্বরিত।
এত শুনি জ্যেষ্ঠপুত্র হইল ভাবিত।।
মাতৃবধ-পাপ চিন্তি না শুনিল বাণী।
আর তিন পুত্রেরে বলিল মহামুনি।।
কেহ না শুনিল বাক্য ক্রোধে মুনিবর।
কনিষ্ঠ নন্দন রামে বলিল সত্বর।।
জননী সহিত কাটি চারি সহোদর।
আমার আজ্ঞায় তাত ফেলাও সত্বর।।

এতেক শুনিয়া রাম বিলম্ব না করি।
মাতৃ সহ কাটিলেন সহোদর চারি।।
দেখিয়া পুত্রের কর্ম্ম সবিস্ময় মন।
তুষ্ট হৈয়া জমদগ্নি বলেন বচন।।
চিরজীবী তাত তুমি হও মম বরে।
তোমা সম বীর কেহ নহিবে সংসারে।।
আর যেই বর ইচ্ছা মাগ মম স্থানে।
শুনিয়া কহেন রাম পিতার চরণে।।
যদ্যপি আমায় পিতা তুমি দিবা বর।
জীউক আমার মাতা চারি সহোদর।।

এত শুনি সৌম্যদৃষ্টে চাহি তপোধন।
ভার্য্যা সহ জীয়াইল চারিটি নন্দন।।
মাতৃবধ সঞ্চারিল রামের শরীরে।
না খসে হাতের টাঙ্গি পড়িল ফাঁপরে।।
কহ তাত কি হইবে ইতার প্রকার।
হাত হৈতে টাঙ্গি কেন না খসে আমার।।
এত শুনি ধ্যান করি মহা তপোধন।
ক্ষণেক চিন্তিয়া বলে শুনহ নন্দন।।
মাতৃবধ পাপ তাত দুষ্কর সংসারে।
দৈবযোগে সঞ্চারিল তোমার শরীরে।।
নিরাহারী ব্রতী হয়ে এক সন্বৎসর।
মান অহঙ্কার ত্যজি শিরে জটাভার।।
সংসারের যত তীর্থ করহ ভ্রমণ।
তবেত তোমার পাপ হইবে মোচন।।
পৃথিবীর যত তীর্থ করিয়া ভ্রমণ।
তবেত যাইবে তাত কৌশল ভূবন।।
বিষ্ণুযশা নামে দ্বিজ জগতে বিদিত।
তাহার বাটীতে গিয়া হবে উপনীত।।
জিজ্ঞাসা করিবে তারে ইহার প্রকার।
তবেত হস্তের টাঙ্গি খসিবে তোমার।।

শুনিয়া বিলম্ব আর কিছু না করিল।
তীর্থ পর্য্যটন হেতু সত্বরে চলিল।।
গয়া গঙ্গা বারাণসী করিয়া ভ্রমণ।
তদন্তরে প্রভাসেতে করিল গমন।।
তদন্তরে মানসরে করিল গমন।
বিন্দুক্ষেত্রে বিন্দুসর করিল ভ্রমন।।
উভয় পথেতে যত যত তীর্থ ছিল।
একে একে ভৃগুরাম সকল ভ্রমিল।।
পশ্চিম দ্বারকা আদি যত তীর্থগণ।
প্রদক্ষিণ দ্বারকা আদি যত তীর্থগণ।।
প্রদক্ষিণ করি সব করেন ভ্রমণ।
দক্ষিণ দিকেতে মাসি হৈল উপনীত।।
যত তীর্থ দক্ষিণেতে না হয় বর্ণিত।
ইন্দ্রদ্যুন্ন সরোবর সরযু কেদার।
গোদাবরী বৈতরণী রেবা নদী আর।।
একে একে সর্ব্ব তীর্থ করিল ভ্রমণ।
জনকের বাক্য তবে হইল স্মরণ।।
সত্বরে চলিয়া গেল কৌশল নগরে।
উপনীত হৈল গিয়া বিষ্ণুযশা ঘরে।।
ভয়ঙ্কর মূর্ত্তি রামে দেখি দ্বিজবর।
জিজ্ঞাসা করেন আসি রামের গোচর।।
বিশীর্ণ শরীর কেন মলিন বদন।
মেঘেতে আচ্ছন্ন যেন রবির কিরণ।।

এত শুনি রাম করিলেন নিবেদন।
যেই মত জননীরে করিল নিধন।।
যেই মতে স্বহস্তে কাটিল ভ্রাতৃগণ।
পুনশ্চ পাইল তারা যেমতে জীবন।।
একে একে সকল করিল নিবেদন।
শুনিয়া হইল দ্বিজ সবিন্ময় মন।।
হৃদয়ে ভাবিয়া তবে বলিল বচন।
খসিবে হস্তের টাঙ্গি শুন দিয়া মন।।
ব্রহ্মহ্রদে গিয়া স্নান করহ ত্বরিত।
তবেত হস্তের টাঙ্গি হইবে স্খলিত।।
সেই সে হ্রদের কথা শুন দিয়া মন।
ব্রহ্মার সৃজন সেই অদ্ভূত গঠন।।
চক্রাকারে ঘুরে জল ঘূর্ণমান বায়।
সেই হ্রদে যেই স্নান করিবারে যায়।।
দৃষ্টিমাত্র জল তার উঠে উথলিয়া।
ডুবায়ে মারিতে বারি যায় খেদাড়িয়া।।
পুণ্য আত্মা হয় যদি পায় সে জীবন।
সে কারণে তথায় না যায় কোন জন।।
পূর্ব্বের বৃত্তান্ত আছে ব্রহ্মার নিয়ম।
নারদের মুখে শুনি বাড়িল সম্ভ্রম।।
ব্রহ্মঋষি সুতপা নামেতে তপোধন।
ব্রহ্মলোকে গিয়া ঋষি দিল দরশন।।
বসিয়াছে প্রজাপতি সভার ভিতর।
মেনকা অপ্সরী যায় শূন্যে করি ভর।।
পরমা সুন্দরী কন্যা মোহে ত্রিভুবন।
দেখি হেঁটমুখ কৈল প্রজাপতিগণ।।
সেইকালে সুতপা কামেতে মত্ত হৈয়া।
কন্যার বদন কুচ চাহে নেহারিয়া।।
দেখিয়া সক্রোধ চিত্ত হৈয়া পদ্মসন।
সুতপারে কহিলেন সক্রোধ বচন।।
মম লোকে আসিয়া করহ অনাচার।
এই পাপে কুম্ভীরত্ব হইবে তোমার।।
এইক্ষণে মম হ্রদে হইবে পতন।
কতদিন পরে তব হইবে মোচন।।
ভৃগুপতি যাবে মাতৃবধ খণ্ডিবারে।
তাবৎ থাকিয়া সেই হ্রদের ভিতরে।।
টাঙ্গির প্রহারে হ্রদদ্বার করি চির।
তথা স্নান যখন করিবে ভৃগুবীর।।
সেইক্ষণে গ্রাহরূপ ত্যজি শীঘ্রপতি।
তদন্তরে জীব অংশে হইবে উৎপত্তি।।
যুগল নয়ন অন্ধ হবে কর্ম্মদোষে।
শৃঙ্গারেতে রত হবে পশুর সদৃশে।।
এতেক বলিতে শীঘ্র হইল পতন।
গ্রাহরূপে সেই তীর্থে আছে তপোধন।।
শীঘ্রগতি তথাকারে করহ গমন।
তবে সে তোমার পাপ হইবে মোচন।।

এত শুনি ভৃগুরাম চলিল ত্বরিত।
ব্রহ্মহ্রদ-কূলেতে হইলা উপনীত।।
দেখি ভৃগুবরে জল উথলি চলিল।
পর্ব্বত প্রমাণ নীর খেদিয়া আসিল।।
শোষক মন্ত্রেতে নিবারিল ঘোর পানী।
হ্রদদ্বার মুক্ত কৈল টাঙ্গিঘাত হানি।।
হ্রদে স্নান করি তবে করিল তর্পণ।
খসিল হাতের টাঙ্গি আনন্দিত মন।।
হেনকালে কুম্ভীর দুরন্ত ভয়ঙ্কর।
রামের চরণে আসি ধরিল সত্বর।।
ধরিয়া কুম্ভীর কূলে তোলে ভৃগুমণি।
শাপে মুক্ত হয়ে গ্রাহ ছাড়িল পরাণী।।
মৃতদেহ দেখি রাম সবিস্ময় মন।
নিজ গৃহে গেল তীর্থ করিয়া ভ্রমণ।।
মহাভারতের কথা অমৃত লহরী।
শুনিলে অধর্ম্ম খণ্ডে পরলোকে তরি।।
মস্তকে বন্দিয়া ব্রাহ্মণের পদরজ।
কহে কাশীদাস গদাধর দাসাগ্রজ।।