২০. হরিমন্দির মার্জ্জনের ফল

ভীষ্ম বলিলেন শুন রাজা ধর্ম্মরায়।
আর কিছু ধর্ম্মকথা কহিব তোমায়।।
গোবিন্দেরে করয়ে যে স্তুতি আচরণ।
নানা উপহার দিয়া করয়ে পূজন।।
সোমবার দ্বাদশী দিবস শুভক্ষণে।
ক্ষীর জলে স্নান যে করায় নারায়ণে।।
বংশের সহিত যায় বৈকুণ্ঠ ভুবন।
কদাচ না পায় সেই যমের তাড়ন।।
ভাদ্রমাসে কৃষ্ণাষ্টমী রোহিণী লক্ষণে।
ক্ষীরজলে স্নান যে করায় নারায়ণে।।
উপবাস করি হরি করয়ে চিন্তন।
ত্রিভঙ্গ ললিত দিব্য মূর্ত্তি নারায়ণ।।
সর্ব্বপাপে মুক্ত হয় সেই মহাশয়।
বংশের সহিত হয় বৈকুণ্ঠে বিজয়।।
গোবিন্দ মন্দির যেই করয়ে মার্জ্জন।
তাহার পুণ্যের কথা না যায় কথন।।
অজ্ঞানে সজ্ঞানে করে নাহিক বিচার।
সর্ব্ব ধর্ম্ম লভে সেই মহাপাপে পার।।
পূর্ব্বে শুনিলাম আমি দেবলের মুখে।
সেই হেতু মহারাজ কহিব তোমাকে।।

সাবধান হয়ে রাজা শুন একচিত্তে।
যজ্ঞধ্বজ নাম ছিল ইক্ষ্বাকু বংশেতে।।
মহাধর্ম্মশীল রাজা বিখ্যাত সংসার।
একচ্ছত্র জম্বুদ্বীপ যাঁর অধিকার।।
রাজধর্ম্ম যত সব ত্যজিয়া রাজন।
স্বহস্তে করেন হরিমন্দির মার্জ্জন।।
বীতিহোত্র নামে তার কুল পুরোহিত।
এ সব দেখিয়া যজ্ঞধ্বজের চরিত্র।।
সচিন্তিত হৃদয় হইয়া তপোধন।
একদিন নৃপতিরে জিজ্ঞাসে কারণ।।
কহ শুনি রাজা তুমি সর্ব্ব ধর্ম্মান্বিত।
সর্ব্বশাস্ত্রে বিজ্ঞ তুমি বিচারে পণ্ডিত।।
কি কর্ম্ম অসাধ্য তব আছে পৃথিবীতে।
যাহা ইচ্ছা করিবারে পারহ করিতে।।

এত শুনি হাসিয়া বলয়ে নরপতি।
ইহিতাস কথা কহি কর অবগতি।।
ছিলাম পূর্ব্বেতে দুষ্টমতি পাপাচার।
পরদ্রব্য চুরি হিংসা করেছি অপার।।
বৃষলী আসক্ত আমি হয়ে একেবারে।
গৃহের যতেক ধন দিলাম তাহারে।।
গৃহের যতেক ধন দিলাম তাহারে।
মম কর্ম্ম দেখি পিতৃ মাতৃ ভ্রাতৃগণ।।
ক্রুদ্ধ হৈয়া সবে মোরে করিল তাড়ন।
সবাকার বাক্য আমি করি অবহেলা।।
রাহু যেন নিঃশঙ্কে গ্রাসয়ে চন্দ্রকলা।
মাহক্রুদ্ধ হৈল তবে যত ভ্রাতৃগণ।
প্রহার করিয়া মোরে করিল বন্ধন।।
নিবারিতে না পারিল অশেষ বিশেষে।
গৃহ হৈতে দূর করি দিল অবশেষে।।
ক্রোধে গৃহ হৈতে আমি হইয়া বারিত।
মহাঘোর বনে গিয়া পশিনু ত্বরিত।।
অনাহারে অবসন্ন হইল শরীর।
ঘোর বনে পাই এক বিষ্ণুর মন্দির।।
বৃষ্টিজলে কর্দ্দম আছিল মন্দিরেতে।
পরিষ্কার করি শেষে শুইনু তাহাতে।।
দৈবযোগে এক সর্প তাহাতে আছিল।
নিদ্রার আবেশে মোর চরণে দংশিল।।
সেইক্ষণে কালপূর্ণ হইল আমার।
দুই যমদূত এল বিকৃতি আকার।।
মহাপাশে শীঘ্র মোরে করিল বন্ধন।
হেনকালে বিষ্ণুদূত আসে দুইজন।।
ক্রোধে যমদূতে চাহি বড়ই গর্জ্জিল।
পাশ হৈতে মুক্ত মোরে ত্বরিত করিল।।
দেখি সবিস্ময় হৈল যমদূতগণ।
করযোড়ে বিষ্ণুদূতে করে নিবেদন।।
মোরা দোঁহে হই ধর্ম্মরাজ অনুচর।
তাঁর আজ্ঞা ধরি মোরা মস্তক উপর।।
সংসারের মধ্যে যত মরে জীবগণ।
পশু পক্ষী মনুষ্যাদি জন্তু অগণন।।
সবারে লইয়া যাই যমের সদন।
পাপ পুণ্য বুঝি যম করেন তাড়ন।।
এই যজ্ঞমালী পাপী বিখ্যাত জগতে।
ইহার পাপের কথা না পারি কহিতে।।
কি কারণে পাপমুক্ত করিলে ইহারে।
কেবা দোঁহে পরিচয় দেহত আমারে।।

এত শুনি হাসি দোঁহে করিল উত্তর।
মোরা দুইজনে হই বিষ্ণুর কিঙ্কর।।
জগতের র্হ্ত্তা কর্ত্তা দেব নারায়ণ।
তাঁর আজ্ঞা মাথে ধরি করি যে ভ্রমণ।।
হরিনাম স্মরণ করয়ে যেই জন।
হরি পূজা করে হরিমন্দির মার্জ্জন।।
শ্রবণ কীর্ত্তন নাম করয়ে বন্দন।
দাস্যভাব সখ্যভাব আত্ম নিবেদন।।
তারে অধিকার তব নাহি কদাচন।
সর্ব্বপাপে মুক্ত আছে সেই মহাজন।।
গোবিন্দ মন্দির এই করিল মার্জ্জন।
ইথে অধিকার তব নাহি কদাচন।।

এতেক বলিয়া দুই হরির কিঙ্কর।
লয়ে গেল শীঘ্র মোরে বৈকুণ্ঠনগর।।
সহস্র শতেক যুগ তথা হৈল স্থিতি।
অদন্তর ব্রহ্মলোকে করিনু বসতি।।
শতকল্প ব্রহ্মলোকে করিনু বিহার।
তদন্তর ইন্দ্রলোকে হই আগুসার।।
চতুর্দ্দশ মন্বন্তর কাল পরিমাণ।
যত ভোগ করি স্বর্গে না হয় বাখান।।
তদন্তর এই মহা ইক্ষ্বাকুবংশেতে।
সেই পুণ্যে আসিয়া জন্মিনু পৃথিবীতে।।
অজ্ঞানে করিনু হরিমন্দির মার্জ্জন।
তাহাতে ‍এ গতি হৈল শুন তপোধন।।
জ্ঞানে যেবা করে হরিমন্দির মার্জ্জন।
শুদ্ধভাব হইয়া পূজয়ে নারায়ণ।।
পৃথিবীর রেণু যদি পারি যে গণিতে।
তাহার পুণ্যের কথা না পারি কহিতে।।

ভীষ্ম বলিলেন রাজা করহ শ্রবণ।
এত শুনি বীতিহোত্র হন তুষ্ট মন।।
কয়যোড়ে নৃপতিরে করিল বন্দন।
সর্ব্ব ধর্ম্ম ত্যজি নিল গোবিন্দ শরণ।।
শান্তিপর্ব্ব ভারতের অপূর্ব্ব কথন।
একচিত্তে একমনে শুনে যেই জন।।
সর্ব্ব দুঃখে তরে সেই নাহিক সংশয়।
পয়ার প্রবন্ধে কাশীদাস দেব কয়।।