০১৩. অমৃতের নিমিত্ত সুরাসুরের দ্বন্দ্ব ও শ্রীকৃষ্ণের মোহিনীরূপ ধারণ

মুনিগণ বলে শুন সূতের নন্দন।
শুনিলাম যে কথা সে অদ্ভূত কথন॥
অমর অসুর মিলি সমুদ্র মথিল।
উপজিল যত রত্ন দেবতারা নিল॥
রত্নের বিভাগ কিছু পায় কি অসুর।
কহ শুনি সূতপুত্র শ্রবণে মধুর॥
সৌতি বলে দৈত্যগণ একত্র হইয়া।
দেবগণ হৈতে সুধা লইল কাড়িয়া॥
সবে শ্রম করিলেন সমুদ্র মন্থনে।
যে কিছু উঠিল সব নিল দেবগণে॥
ঐরাবত হস্তী নিল বাজী উচ্চৈঃশ্রবা।
লক্ষ্মী কৌস্তুভাদি মণি শত-চন্দ্র আভা॥
অমরের ভাগে পাছে হয় সুধা হাণ্ডি।
সকল লইল যেন শিশুগণে ভাণ্ডি॥
এত বলি কাড়িয়া লইল দৈত্যগণ।
দেব-দৈত্যে কলহ হইল ততক্ষণ॥
মধ্যস্থ হইয়া হর কলহ ভাঙ্গিয়া।
তবে দৈত্যগণ প্রতি কহেন ডাকিয়া॥
অকারণে দ্বন্দ্ব সবে কর কি কারণ।
সবার অর্জ্জিত সুধা লহ সর্ব্বজন॥
শিবের বচনে সবে নিবৃত্ত হইল।
কে বাটিয়া দিবে সুধা সকলে কহিল॥

হেনকালে নারায়ণ ধরিয়া স্ত্রীবেশ।
ধীরে ধীরে উপনীত হৈল সেই দেশ॥
রূপেতে হইল আলো চতুর্দ্দশ পুর।
সুবর্ণ-রচিত তাঁর চরণে নূপুর॥
কোকনদ জিনি পদ মনোহর গতি।
যে চরণে জন্মিলেন গঙ্গা ভাগীরথী॥
যার গন্ধে মকরন্দ ত্যজি অলিবৃন্দ।
লাখে লাখে পড়ে ঝাঁকে পেয়ে মধুগন্ধ॥
যুগ্ম ঊরু রম্ভাতরু চারু দুই হাত।
মধ্যদেশ হেরি ক্লেশ পায় মৃগনাথ॥
নাভিপদ্ম জিনি পদ্ম অপূর্ব্ব-নির্ম্মাণ।
কুচযুগ ভরা বুক দাড়িম্ব সমান॥
ভুজ সম ভুজঙ্গম মৃণাল জিনিয়া।
সুরাসুর মূর্চ্ছাতুর যাহারে হেরিয়া॥
পদ্মবর জিনি কর চম্পক অঙ্গুলি।
নখবৃন্দ জিনি ইন্দু প্রভা গুণশালী॥
কোটি কাম জিনি ধাম বদন-পঙ্কজ।
মনোহর ওষ্ঠাধর গরুড়-অগ্রজ॥
নাসিকায় লজ্জা পায় শুষ্ক-চঞ্চুখানি।
নেত্রদ্বয় শোভা হয় নীলপদ্ম জিনি॥
পুষ্পচাপ হরে দাপ ভ্রু-দ্বয় ভঙ্গিমা।
ভালে প্রাতঃ দিননাথ দিতে নারে সীমা॥
পীতবাস করে হাস স্থির সৌদামিনী।
দন্তপাঁতি করে দ্যুতি মুক্তার গাঁথনি॥
দীর্ঘকেশে পৃষ্ঠদেশে বেণী লম্বমান।
আচম্বিতে উপনীত সবা বিদ্যমান॥
দৃষ্টিমাত্রে সর্ব্বগাত্রে কামাগ্নি দহিল।
সুরাসুর তিনপুর ঢলিয়া পড়িল॥
সবে মূর্চ্ছাগত হৈল দেখিয়া মোহিনী।
কতক্ষণে চেতন পাইল শূলপাণি॥
মোহিনীর প্রতি হর একদৃষ্টে চান।
দুই ভূজ প্রসারিয়া ধরিবারে যান॥
কন্যা বলে যোগী তোর কেমন প্রকৃতি।
ঘনাইয়ে আস বুড়া হ’য়ে ছন্নমতি॥
এত বলি নারায়ণ যান শীঘ্রগতি।
পাছে পাছে ধাইয়া চলেন পশুপতি॥
হর বলে হরিণাক্ষি মুহূর্ত্তেক রহ।
দাঁড়াইয়া তুমি মোরে এক কথা কহ॥
কে তুমি কোথায় থাক কাহার নন্দিনী।
কি হেতু আইলে তুমি কহ সত্যবাণী॥
ত্রৈলোক্যের মধ্যে যত আছে রূপবতী।
তব পদ-নখ-তুল্য নহে কার’ জ্যোতি॥
দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, শচী, অরুন্ধতী।
উর্ব্বশী, মেনকা, রম্ভা, তিলোত্তমা, রতি॥
নাগিনী, মানুষী, দেবী ত্রৈলোক্যবাসিনী।
সবে মোরে জানে আমি সবাকারে জানি॥
ব্রহ্মাণ্ডে আছহ কভু না শুনি না দেখি।
কোথা হৈতে এলে কহ সত্য শশীমুখী॥
কন্যা বলে বুড়া তোর মুখে নাহি লাজ।
তোরে পরিচয় দিতে আমার কি কাজ॥
তৈল বিনে বিভূতি মাথায় জটাভার।
তাম্বূল বিহনে দন্ত স্ফটিক আকার॥
বসন না মিলে পরিধান ব্যাঘ্রছড়ি।
দীঘল করের ন’খ পাকা গোঁফদাড়ী॥
অঙ্গের দুর্গন্ধে উঠে মুখেতে বমন।
না জানি আছয়ে কি না বদনে দশন॥
মম অঙ্গ গন্ধে দেখ ব্রহ্মাণ্ড পূরিত।
অঙ্গের ছটাতে দেখ ত্রৈলোক্য দীপিত॥
কোন লাজে চাহ তুমি করিতে সম্ভাষ।
কেমন সাহসে তুমি আইস মম পাশ॥