০২. যদুকুল ক্ষয়ার্থে কৃষ্ণ-বলরামের যুক্তি

মুনি বলে শুন পরীক্ষিতের নন্দন।
মুষল বৃত্তান্ত কহি শুনহ কারণ॥
মুষল ঘষিয়া ক্ষয় কৈল শিশুগণ।
সেই হ্রদে হৈল নল-খাগ্‌ড়ার বন॥
শেষ লৌহ জলে যেই টানিয়া ফেলিল।
জলে ছিল মৎস্যরাজ তাহারে গিলিল॥
ধীবর আইল মৎস্য করিতে ধারণ।
জালে বন্দী হৈল মৎস্য দৈবের কারণ॥
লৌহ শেষ পায় মৎস্য কাটিবার কালে।
জরা নামে এক ব্যাধ এসে সেই স্থলে॥
মাগিয়া লইল লৌহ ধীবরের স্থানে।
কর্ম্মিগৃহে ফলা গড়াইয়া দিল বাণে॥
এখানে দ্বারকাপুরে দেব নরহরি।
যদুবংশ বিনাশিতে হৃদয়ে বিচারি॥
অবধান কর দেব রেবতীরমণ।
ভারাবতারণে আইলাম এ ভুবন॥
দুষ্ট দৈত্য মারিয়া খণ্ডিনু পৃথ্বিভার।
ততোধিক যদুকুল হইল আমার॥
ইহা সব বিদ্যমানে নহে ভার শেষ।
অধিক যাতনা ক্ষিতি পায় ত বিশেষ॥
ইহার উপায় দেব চিন্তিয়াছি আমি।
যদুকুল ক্ষয় করি হবে স্বর্গগামী॥
মম বংশ ক্ষয় করে আছে কোন্‌ জন।
ব্রহ্মশাপ লক্ষ্য করি করিব নিধন॥
প্রভাসে যাইব চল স্নান করিবারে।
যদুবংশ সঙ্গে করি লহ সবাকারে॥
এইমতে দুই ভাই উঠিয়া ত্বরায়।
মাতা পিতা অগ্রে যান লইতে বিদায়॥
হেনকালে অমঙ্গল দেখি অপ্রমিত।
ভূমিকম্প উল্কাপাত অতি বিপরীত॥
সঘনে নির্ঘাত শব্দ দশদিকে হয়।
দিবসেতে ধূমকেতু হইল উদয়॥
দ্বারকায় জলচর হয় মূর্ত্তিমান।
টলমল করয়ে দ্বারকাপুরীখান॥
কাষ্ঠ শিলা মৃত্তিকা প্রতিমা যত ছিল।
কেহ অট্ট হাসে কেহ বিদারী পড়িল॥
নৃত্য করি বুলে কেহ নগর ভিতরে।
অকস্মাৎ ভাঙ্গি পড়ে দেউল মন্দিরে॥
শৃগাল কুক্কুর সব ডাকে উচ্চৈঃস্বরে।
প্রিয়া প্রিয়া দ্বন্দ্ব হয় নগরে নগরে॥
অকালে উদয় হৈল দেব রবি শশী।
সিংহিকা তনয় তাহে অপূর্ব্ব গরাসী॥
হাহাকার শব্দ করে নগরের লোক।
স্বর্গের দেবতাগণ করে মহাশোক॥
এইরূপে উৎপাত হইল সুবিস্তার।
দেবগণ সংহতি আইল সৃষ্টিধর॥
অন্তরীক্ষে থাকিয়া যতেক দেবগণ।
করিলেন বহুমতে প্রভুর স্তবন॥
নমস্তে কমলাকান্ত বিশ্বরূপ হরি।
নমস্তে ক্ষীরোদশায়ী মধুকৈটভারি।
নির্লেপ নিগূঢ় নিরাকার নিরঞ্জন।
অনন্ত আকার বিশ্বরূপ সনাতন॥
সত্ব রজঃ তমোগুণে এ তিন প্রকার।
লীলায় করহ সৃষ্টি লীলায় সংহার॥
চন্দ্র সূর্য্য আকাশ পৃথিবী জলনিধি।
পবন বরুণ ইন্দ্র গঙ্গা নদ নদী॥
সকল তোমার অঙ্গ কেহ ভিন্ন নহে।
অন্যরূপে বিলাসে তোমার সর্ব্ব দেহে॥
অপার তোমার লীলা কে বুঝিতে পারে।
আপনি করিলা লীলা দানব সংহারে॥
ক্ষিতিভার হেতু পূর্ব্বে করলে গোহারি।
এই হেতু পৃথিবীতে এলে ত্বরা করি॥
অসুর বধিয়া খণ্ডাইলা পৃথ্বিভার।
ধর্ম্ম সংস্থাপন আর অসুর সংহার॥
চিরদিন শূন্য আছে বৈকুণ্ঠভুবন।
সবাই প্রার্থনা করে তব আগমন॥
নররূপ ধরিয়া রহিলে ক্ষিতিতলে।
কৃপা করি যত লোক কৃতার্থ করিলে॥
দারুণ দুরন্ত দৈত্যগণ দুষ্টমতি।
লীলায় সংহারি ভার খণ্ডাইলে ক্ষিতি॥
অপার তোমার লীলা কহে বেদকৃতী।
রিপুভাবে দৈত্যগণে দিলা উর্দ্ধগতি॥
এমন তোমার দয়া কে বুঝিতে পারে।
মিত্রামিত্র ভাব নাই তোমার বিচারে॥
কৃপায় করিলে পার যত পাপীগণে।
পতিতপাবন নাম ইহার কারণে॥
এইরূপে বিধাতা কহিল স্তুতিবাণী।
হাসিয়া উত্তর দেন দেব চক্রপাণি॥
অচিরে বৈকুণ্ঠে যাব শুন বিধিবর।
নিজ নিজ গৃহে যাও যতেক অমর॥
ভার নিবারিতে আমি আসি পৃথিবীতে।
ততোধিক ভার ক্ষিতি হৈল আমা হৈতে॥
যদুবংশ বৃদ্ধি হৈল আমার কারণ।
অন্যরূপে নাহি হয় সব নিবারণ॥
ব্রহ্মশাপ লক্ষ্য করি সংহারিব ভার।
অচিরে যাইব আমি স্থানে আপনার॥
অতএব নিজ স্থানে করহ গমন।
যথাসুখে বিহার করহ দেবগণ॥
শুনিয়া সানন্দ ব্রহ্মা আদি দেবগণ।
প্রদক্ষিণ করি বন্দে শ্রীহরি-চরণ॥
তবে যত দেবগণে লইয়া সংহতি।
গেলেন বিদায় হৈয়া দেব প্রজাপতি॥

বলভদ্র সহ হরি করিয়া বিধান।
পুত্রগণে ডাকিয়া করিল আজ্ঞা দান॥
বিবিধ উৎপাত দেখ হ’ল বারে বার।
সবে মেলি করহ ইহার প্রতিকার॥
প্রভাস তীর্থেতে সবে করহ প্রয়াণ।
আপদ খণ্ডিবে সব তাহে কৈলে স্নান॥
শীঘ্রগতি সজ্জা কর সব পুত্রগণ।
সবে চল যদুবংশে আছে যত জন॥
স্ত্রীগণ কেবল মাত্র রহিবেক ঘরে।
হরির আদেশে সবে চলিল সত্বরে॥
প্রভুর আদেশ পেয়ে যত যদুগণ।
প্রভাসে যাইতে সজ্জা করে সর্ব্বজন॥
পুত্রগণে আদেশ করিয়া দুই ভাই।
শীঘ্রগতি আইলেন মাতাপিতা ঠাঁই॥
তত্ত্বকথা নিভৃতে কহেন দুইজন।
মায়াজাল ছাড়ি দেহ শুনহ বচন॥
পুত্র পরিবার বন্ধু দেখ যত জন।
মায়াময় ফাঁস এই নিগূঢ় বন্ধন॥
হেন মায়াজাল এড়ি তত্ত্বে দেহ মন।
সংসারের মায়ামদ ত্যজ দুই জন॥
নিজ নিজ কর্ম্মার্জ্জিত ভুঞ্জে দুই কালে।
সুখ দুঃখ আপন অর্জ্জিত কর্ম্মফলে॥
ইহা জানি ব্রহ্মজ্ঞান কর আচরণ।
পাইবা উত্তম গতি শুন দুইজন॥
এত বলি প্রবোধিয়া জনক-জননী।
প্রভাসেতে যাত্রা করিলেন চক্রপাণি॥
উগ্রসেনে সম্বোধিয়া দেব দামোদর।
দারুকে বলেন রথ আনহ সত্বর॥
আজ্ঞামাত্র দারুক রথের সজ্জা করি।
শুভক্ষণে আরোহণ করেন শ্রীহরি॥
মুষল পর্ব্বের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান॥