৩১. শিশুপাল বধ ও যুধিষ্ঠিরের রাজসূয়যজ্ঞ সমাপন

এত বলি শিশুপাল করিছে গর্জ্জন।
হাসিয়া বলেন তবে কমললোচন॥
সকল নৃপতিগণ শুন দিয়া মন।
যত দোষ করিয়াছে এই দুষ্ট জন॥
যাদবীর গর্ভে জাত এই দুরাচার।
নিরবধি করিয়াছে যাদব অপকার॥
এককালে আমি পুরী দ্বারকা হইতে।
প্রাগ্‌জ্যোতিষপুরে গিয়াছিলাম দৈবেতে॥
এই দুষ্ট শুনিলেক আমি নাই ঘরে।
সসৈন্যেতে গেল দুষ্ট দ্বারকা-নগরে॥
উগ্রসেন রাজা ছিল রৈবত পর্ব্বতে।
মাতুলের উপরোধ না ধরিল চিতে॥
লুঠিয়া দ্বারকাপুরী গেল দুরাশয়।
কহ শুনি হেন কর্ম্ম কার প্রাণে সয়॥
তবে কত দিনে পিতা অশ্বমেধ কৈল।
সঙ্কল্প করিয়া যজ্ঞ তুরঙ্গ ছাড়িল॥
যদুগণে নিয়োজিল অশ্বের রক্ষণে।
ঘোড়া হরি লৈয়ে গেল এই ত দুর্জ্জনে॥
ইহার অন্তরে তবে শুন সর্ব্বজনে।
সৌবীরেতে মহোৎসব হৈল কত দিনে॥
বভ্রু নামে যাদবের ভার্য্যা গুণবতী।
তারে বলে হরি নিল এই পাপমতি॥
তদন্তরে শুন সবে এ দুষ্ট কাহিনী।
ভদ্রা নামে কন্যা ছিল যাদবনন্দিনী॥
বসুরাজে বরেছিল সেই ত কন্যায়।
তারে হরি নিল দুষ্ট প্রবন্ধ-মায়ায়॥
মাতুলের কন্যা হয় ভগিনী ইহার।
তারে হরি নিয়া গেল এই দুরাচার॥
ইত্যাদি যতেক দোষ কহিব কতেক।
সাক্ষাতে দেখিলে হয় বিদিত প্রত্যেক॥
করিলাম সে সকল দোষের মার্জ্জন।
কেবল পিতৃস্বসার সত্যের কারণ॥
সাক্ষাতে শুনিলে সবে যে মন্দ বলিল।
সর্ব্বজনে শুনিলে যে এই ভাল হৈল॥
পরোক্ষের কথা যত শুনিলে শ্রবণে।
প্রত্যক্ষের যত কর্ম্ম দেখ বিদ্যমানে॥
বহু সহিলাম আর সহিবারে নারি।
মৃত্যুপথ চাহে আজি এই পাপকারী॥
আর শুন রাজগণ এ দুষ্টের কথা।
লক্ষ্মীরূপা রুক্মিণী ভীষ্মক নৃপসুতা॥
বিবাহ করিতে তারে করিলেক মন।
শূদ্রে যেন চাহে বেদ করিতে পঠন॥
শিশু যেন চন্দ্রমারে ধরিবারে চায়।
হবির্ভাগ চণ্ডালেতে কভু নাহি পায়॥

এতেক বলেন যদি শ্রীমধুসূদন।
শিশুপালে নিন্দা করে যত রাজগণ॥
কৃষ্ণের বচন শুনি শিশুপাল হাসে।
গোবিন্দেরে নিন্দা করে অশেষ বিশেষে॥
নির্লজ্জ তোমারে আমি কি বলিব আর।
তোমার দুষ্কর্ম্ম যেন বিখ্যাত সংসার॥
ভীষ্মকের কন্যা মোরে করিল বরণ।
বহু দিন হয় নাহি জানে সর্ব্বজন॥
হরিয়া লইলি তারে রাজসভা হৈতে।
পুন সেই কথা কহ নির্লজ্জ মুখেতে॥
কহ কৃষ্ণ দেখিয়াছ শুনেছ ক্ষবণে।
বরপূর্ব্বা কন্যা হরিয়াছে কোন্‌ জনে॥
তোমা বিনা পৃথিবীতে ক্ষত্ত্রিয় ভিতরে।
কে করেছে নাম ধরি বলহ আমারে॥
গোকুলে করিলি যত জানে সর্ব্বজনা।
হরিলা কি পরদার যত ব্রজাঙ্গনা॥
কিবা তোর ক্রিয়া কর্ম্ম কি তোর আচার।
সভামধ্যে কহ পুন করি অহঙ্কার॥
শিশুপালের দোষাদি ক্ষমিয়াছি আমি।
দোষ না ক্ষমিয়া মোর কি করিবা তুমি॥
ক্ষম বা করহ ক্রোধ যেই লয় মতি।
তোমার কি শক্তি যে করিবা আমা প্রতি॥

এতেক বলিল যদি চেদীর ঈশ্বর।
শুনি সুদর্শনে আজ্ঞা দিলেন শ্রীধর॥
সুদর্শন মহাচক্র অগ্নি যেন জ্বলে।
শিশুপাল শির কাটি ফেলে ভূমিতলে॥
বজ্রাঘাতে চূর্ণ যেন হৈল গিরিবর।
দেখিয়া বিস্মিত হৈল সব ক্ষিতীশ্বর॥
শিশুপাল-অঙ্গতেজ হইয়া বাহির।
আকাশে উঠিল যেন দ্বিতীয় মিহির॥
একদৃষ্টে দেখিছেন সব রাজগণে।
পুন আসি প্রণমিল কৃষ্ণের চরণে॥
কৃষ্ণের চরণে লিপ্ত হৈল আচম্বিত।
তাহা দেখি সভাজন হইল বিস্মিত॥
বিনা মেঘে বরিষয় গগনেতে জল।
কম্পিত নির্ঘাত শব্দে বৈল চলাচল॥
আর যত রাজগণ গর্জ্জিবারে ছিল।
ভয়েতে আকুল হৈয়া সবে লুকাইল॥
অধর কামড়ে কেহ ঠারাঠারি করে।
কোন কোন রাজা স্তুতি করে গোবিন্দেরে॥

সহোদরগণে বলিলেন যুধিষ্ঠির।
সৎকার কর শিশুপালের শরীর॥
শিশুপালপুত্ত্রে করি চেদীর ঈশ্বর।
ধর্ম্মরাজে নিবেদিল যত নৃপবর॥
সম্পূর্ণ হইল যজ্ঞ সিদ্ধ হৈল কাজ।
লক্ষ রাজা উপরে হৈলে মহারাজ॥
তোমার মহিমা যত কহেছি বিশেষ।
আজ্ঞা কৈলে যাই সবে নিজ নিজ দেশ॥
রাজগণ বচন শুনিয়া ধর্ম্মরায়।
কহিলেন ভ্রাতৃগণে পূজহ সবায়।
যথাযোগ্য মান্য করি ভূমিপতিগণে।
অগ্রসরি কত পথ যাও জনে জনে॥
রাজার আজ্ঞায় নানাবিধ রত্ন দিয়া।
পাঠাইল রাজগণে সন্তোষ করিয়া॥