প্লাবন – কর্নেল সমগ্র ৭ – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
ক্লারা ও প্রদোষ
ওরা যখন কলকাতা থেকে বেরোয়, তখন আকাশে ঘন মেঘ ছিল। ভোরবেলা থেকেই থেমে থেমে বৃষ্টি পড়ছিল। ঝিরঝিরে বৃষ্টি। কখনও ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি। বাতাস বইছিল এলোমেলো। আগের সন্ধ্যায় টিভিতে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে কী একটা আসতে পারে বলা হয়েছিল, গুরুদাস বুঝতে পারেননি। ভোরে যখন গ্যারেজ থেকে প্রদোষ গাড়ি বের করছিল, লাল টুকটুকে নতুন ফিয়াট মোটরগাড়ি, গুরুদাস বারান্দা থেকে বলেন, নর্থে জল জমতে পারে রাস্তায়। প্রদোষ কিছু বলল না দেখে ফের বলেন, বিটি রোডে পৌঁছুলে অবশ্যি অসুবিধে হবে না। পুত্রের মেমবউ ক্লারা, ক্লারা গ্যালার রায়, ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে অল্পস্বল্প লাগেজ গাড়ির ব্যাকসিটে বোঝাই করে। ক্লারার পরনে লালপেড়ে গরদের শাড়ি। সিঁথিতে বাড়াবাড়ি করা সিঁদুর। শ্বশুর-শাশুড়ির পায়ে গলবস্ত্রে প্রণাম করে এসে গাড়িতে ঢোকে। প্রদোষের গায়ে ফিকে লাল গেঞ্জি, পরনে জিনস, পায়ে বিদেশি কাউবয় জুতো। ক্লারা আস্তে প্রদোষকে বলে প্রণাম করে এলে না? প্রদোষ একবার ঘুরে শুধু বউয়ের দিকে তাকায়, মাছের চোখে। ক্লারা। একটু হাসে। গাড়ি রাস্তায় পৌঁছুলে প্রদোষ বলে, সিগারেট। ক্লারা হাসিখুশি মুখে বলে, তুমি কি ভাবছ আমি সত্যিই সিগারেট ছাড়ি নি? তুমি এমন কথা কেন ভাবছ? প্রদোষ বলে, তুমি একটা–সে থামলে ক্লারা আহ্লাদী হয়ে বলে, বলো, বলো আমি একটা–প্রদোষ বলে না। মিটিমিটি হেসে নিজেই সিগারেট ধরায়। ক্লারা বৃষ্টির ছাঁট সত্ত্বেও জানালার কাঁচ নামিয়ে দেয় এবং নাকে আঁচল চাপা। দেওয়ার ভঙ্গি করে।
এভাবেই গাড়িটা, টুকটুকে লাল রঙের ফিয়াট মোটর গাড়িটা পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার গতিতে কলকাতা পেরিয়ে চৌত্রিশ নম্বর জাতীয় সড়কে পৌঁছুলে মেঘ ফুটে সূর্যের ছটা বেরিয়ে এল। রাস্তায় খানাখন্দ, পিচ উঠে ছত্রভঙ্গ স্টোনচিপস, মাঝে মাঝে বাম্প। তাই গাড়িটা সমান গতিতে ছুটতে পারছিল না। কৃষ্ণনগর পৌঁছুতে ঘণ্টা চারেক, তারপর রাস্তাটা মোটামুটি ভালই, যদিও ট্রাক, বাস, টেম্পো যথেষ্ট। দুজায়গায় যুবকরা গাড়ি আটকে পুজোর চাঁদা নিল– ক্লারা অকৃপণ এবং প্রদোষ ক্রুদ্ধ, একটা নদীর ব্রিজ পেরুনোর সময় বলল, দিস ইজ ইন্ডিয়া। ক্লারা বলল, আমার ভাল লাগছে। ওগুলো নিশ্চয় ধানক্ষেত?
প্রদোষ বলল, ধানক্ষেত না পাটক্ষেত আমি জানি না। ক্লারা বলল, একটু থামো। ওই লোকটাকে লোকটার পাশ দিয়ে গাড়িটা জোরে বেরিয়ে গেলে ক্লারা বলল, তুমি একটা প্রদোষ হাসতে লাগল।
আকাশ আবার ঘন মেঘে ঢেকে গেল। কিন্তু শরৎকালের মেঘের স্বাভাবিক গর্জন শোনা যাচ্ছিল না। বিদ্যুৎ ঝিলিক দিচ্ছিল না। টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যে গাড়িটা বহরমপুর পৌঁছুল কাটায় কাটায় একটায়। ক্লারা বলল, আমি ক্ষুধার্ত। প্রদোষ বলল, চলো, গঙ্গার ব্রিজে গিয়ে খাব। ক্লারা বলল, আঃ! আমি মাছ-ভাত খাব। দিদি বলছিল বহরমপুর হোটেলে মাছ-ভাত পাওয়া যায়। গাড়িটা তখন চলন্ত। প্রদোষ বলল, মৃণালদি একটা-1 ব্রিজটা উঁচু, অত্যন্ত উঁচু। মাঝামাঝি গিয়ে গাড়ি থামাল প্রদোষ। ঘুরে হাত বাড়িয়ে কলো কিটব্যাগটা আনল। ক্লারা নদী দেখছিল। বলল, অবিকল মিসিসিপির মতো। প্রদোষ বলল, মোটেও না। লঞ্চ, স্টিমার, মোটরবোট দেখতে পাচ্ছ কি? ক্লারা বলল, তুমি মিসিসিপির খুব ভেতরটা দেখেছ কি? নিশ্চয় দেখনি! প্রদোষ লাঞ্চ-প্যাকেট বের করতে করতে বলল, ভেতরে মানে? ক্লারা যা বোঝাতে চাইছিল, পারল না। শুধু বলল, এদিকে পাহাড় দেখছি না। ভেবেছিলাম পাহাড় থাকবে। প্রদোষ বলল, কাম বেবি! ক্লারা চটে গিয়ে বলল, তুমি অমন করে কথা বলবে না। প্রদোষ খাচ্ছিল। সেদ্ধ ডিম, সেদ্ধ আলু, মৃণালিনীর হ্যামবার্গার তৈরির চেষ্টা, মাছভাজাও ছিল। খান আষ্টেক ভেজিটেবল স্যান্ডউইচ, দুটো মাংসের চপ প্রকাণ্ড, পেঁয়াজকুচি ও টমাটোসস, নুন-গোলমরিচ গুঁড়োর প্যাকেট। ক্লারা নাকের ডগা কুঁচকে বলল, দিদিকে কিছু বোঝানো যায় না। প্রদোষ বলল, মাছ তো আছে। খাও। অগত্যা ক্লারা একটা মাছভাজা আলতোভাবে চিবুতে থাকল। নিচে নদীর দিকে দৃষ্টি। তার মিসিসিপি নদীর কথা মনে পড়ছিল। এখন বৃষ্টিটা বন্ধ। মেঘ ভেঙে খানিকটা রোদ গড়িয়ে আসছিল। গাড়ি থেকে নেমে ক্লারা ভাল করে নদীটা দেখতে গেল। বুকসমান উঁচু রেলিঙে ভর করে ঝুঁকে রইল। কিন্তু রোদটা ঢেকে আবার বৃষ্টি এল ঝিরঝিরিয়ে। প্রদোষ ডাকল, ক্লারা! ক্লারা ভিজছে টের পেয়ে গরদের শাড়ি ভাল করে লেপটে জড়িয়ে হাসতে হাসতে গাড়িতে ফিরল। প্রদোষ ঘড়ি দেখে কিটব্যাগ থেকে বিদেশি বিয়ারক্যান বের করছিল। ক্লারা আগেই জানিয়ে দিল, সে শুধু বিশুদ্ধ জল খাবে। প্রদোষ হাসতে হাসতে বলল, তুমি একটা–
একটা রেললাইন পেরিয়ে যাওয়ার পর দুধারে বিশাল মাঠ, জল থইথই অবস্থা, ধানগাছের ডগাটুকু শুধু জেগে আছে। এই রাস্তাটা হাইওয়ে নয়। ঘুরে ঘুরে চলেছে কালো পিচের রাস্তা। মাঝে মাঝে কংক্রিট। কংক্রিটের ফাটলে জল। কোথাও গর্ত আর স্টোনচিপস্। তারপর জনহীন গ্রাম, অথবা রাস্তার ধারে টালি বা তেরপলের ঘরে জড়োসড়ো কিছু লোক, যাদের কয়েকবার চা খাওয়া হয়ে গেছে। দুধারে ক্রমাগত ন্যাড়া উঁচু-উঁচু সব গাছ। ক্লারা জিগ্যেস করেছিল, গাছগুলো এমন হল কেন? প্রদোষ বলেছিল, দেখতে পাচ্ছ না? ডাল কেটে নিয়েছে। ক্লারা বলেছিল, কেন? প্রদোষ বলেছিল, বুঝতে পারছি না। ক্লারা বলেছিল, তুমি ভুল পথে যাচ্ছ না তো? প্রদোষ বলেছিল, চেনা পথ। মামার বাড়ি এপথে অসংখ্যবার গেছি। চলো, তোমাকে দেখাচ্ছি, একবার মামার অ্যামবাসাডার কোথায় অ্যাকসিডেন্ট করেছিল। তখন দুপুর রাত্রি। পাশে একটা গাছ থাকায় গাড়িটা আটকে যায়। আসলে তখন রাস্তাটা নতুন। চাকা স্লিপ করেছিল। কারণ প্রচণ্ড বৃষ্টি–না, এমন নয়। রেইনিং ক্যাটস্ অ্যান্ড ডগস্, ইউ নো! ক্লারা হাসছিল। কেন হাসছিল প্রদোষ জানে না। : মামার অ্যাকসিডেন্টের জায়গাটা দেখাতে ভুলে গেল প্রদোষ। এবার অসমতল মাঠ। চড়াই ও উৎরাই। একটা বাঁকের পর রাস্তা ধীরে নেমেছে। দু-ধারে ধানক্ষেত উপচে জল রাস্তা ছুঁতে চেষ্টা করছে। নিচুতে সমতল কিছুদূর একধারের জল অন্যধারের ধানক্ষেতে গিয়ে পড়ছে। গাড়িটা পাতলা জলের স্রোত পেরুচ্ছিল সাবধানে। প্রদোষের মুখ একটু গম্ভীর। ক্লারার মুখে হাসি ঘন হয়ে লেগে আছে। খোঁপা থেকে আঁচল বার বার সরে যাচ্ছিল। মৃণালিনী খোঁপাটা যত্ন করে বেঁধে দিয়েছিল। জল পেরিয়ে যেতে হঠাৎ জোরালো ঝাঁকুনি খেল গাড়িটা। খোঁপাটা কীভাবে খসে গেল। ক্লারা গোছানোর চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল।
রাস্তা আবার উৎরাইয়ে উঠতে লাগল। বৃষ্টিটা কমেছে। কিন্তু আকাশ মেঘে ঢাকা। গতি বাড়িয়ে আবার একটা বাঁক, বাঁকের মুখে বিদ্যুৎ সাব-স্টেশন, হাসপাতাল, কিছু দোকানপাট, রাস্তার ওপর ভিড়। প্রদোষ তেতো মুখে বলল, আবার চাঁদা! ক্লারা পার্স খুলতে তৈরি হল। ভিড়টা একটা ট্রাকের সঙ্গে কথা বলছিল। ট্রাকটা চলে গেল। প্রদোষের গাড়ি এসে পৌঁছুলে ভিড়টা সামনে দাঁড়াল। প্রদোষ বলল, কী? চাঁদা চাই? ভিড়ের মুখপাত্র সে-কথায় কান না করে বলল, যাবেন না স্যার! তাদের কেউ কেউ গরদের শাড়ি পরা মেমসায়েবটিকে লক্ষ্য করছিল। তারা তত অবাক হয়েছে, মনে হচ্ছিল না। প্রদোষ বলল, কী ব্যাপার? মুখপাত্র বলল, তিলেডাঙ্গা ব্যারেজ থেকে জল ছেড়েছে। প্রদোষ বলল, তাতে কী হয়েছে? এক যুবক খ্যাখ্যা করে হেসে বলল, ছেড়ে দাও নিবারণদা! গিয়ে দেখুন– ফিরে আসতে হবে। যুবকটি ক্লারাকে কেমন চোখে দেখছিল। তাই প্রদোষ, রাগী ও গোঁয়ার প্রদোষকুমার রায়, যাকে ভুল করে ক্লারা প্রথম প্রথম প্রদেশ বলে ডাকত, বলল, সরুন। মুখপাত্র বলল, যাবেন কোথায় স্যার? প্রদোষ বলল, বাদলপুর। মোহিনীমোহন ত্রিবেদী আমার মামা। মুখপাত্র করজোড়ে বলল, নমস্কার স্যার! এম এল এ মশাইকে বলবেন, আমার নাম পাঁচুগোপাল মুখার্জি। তবে আমার মতে, রিস্ক আছে। মৌরীর ওপারে হোল এরিয়া ফ্লাডেড। মৌরী ব্রিজে উঠে যদি তেমন দেখেন, ফিরে আসবেন। আমার বাড়ি, ওই যে দেখছেন, ওই যে–
লাল টুকটুকে ফিয়াট গর্জে উঠে বেরিয়ে গেল। সেই কেমন-চোখ-করে ক্লারাকে-দেখা যুবকটি সম্ভবত শালা মেমওলা বলে গাল দিল। ক্লারা হাসতে হাসতে বলল, প্রদোষ, অ্যাডভেঞ্চার বাংলায় কী? প্রদোষ কিছু বলল না। ক্লারা। বলল, খুব ভাল লাগছে। লোকগুলি খুব ভাল। ওরা আমাদের সাহায্য করতে চাইল। প্রদোষ, তুমি ওদের কথা শুনলে না, সেটাও ভাল লাগছে। বলো না, অ্যাডভেঞ্চারের বাংলা কী।
প্রদোষকে ভালবেসে এবং ভারতকে ভালবেসে ক্লারা গ্যান্সলার এক বছর ধরে বাংলা শিখেছিল। ভালবাসা থেকে একটা ভাষা শেখা, তারপর বউ হওয়া মোট তিনটে বছর লেগে গেছে। ক্লারা বিড়বিড় করে মুখস্থ করছিল, পাঁচুগোপাল মুখার্জি…পাঁচুগোপাল মুখার্জি..পাঁচুগোপাল মুখার্জি।
পাঁচ কিলোমিটার পরে মৌরী নদীর ব্রিজ। ব্রিজের উঁচু অংশে গাড়ি থামাল প্রদোষ। ক্লারা বেরুল। বৃষ্টি থেমেছে। কিন্তু আকাশ মেঘে ঢাকা। প্রদোষ বেরিয়ে চোখে বাইনোকুলার রেখে দেখতে দেখতে বলল, রাস্তায় জল। কিন্তু ট্রাকটা তো যাচ্ছে। কী করব? তার প্রশ্নে ঈষৎ কাতরতা ছিল। ক্লারা বাইনোকুলারটা ওর হাত থেকে নিয়ে এক মিনিট দেখার পর বলল, ট্রাকটা চলে গেল। চলো, আমরা যাই। প্রদোষের ঠোঁট ফাঁক হল, কিছু বলার ইচ্ছা। কিন্তু সেই মুহূর্তে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ দিয়ে এক ঝলক হলুদ আলো, তারপর ব্রিজের ডাইনে কাস্তে হাতে একটা প্রায় ন্যাংটা লোক। লোকটা থমকে দাঁড়িয়ে গেল। ক্লারা ব্যস্তভাবে হাত নেড়ে তাকে ডাকতে লাগল, আপনি আসুন! আপনি শুনুন! প্রদোষও গলা চড়িয়ে লোকটাকে ডাকল, এই যে ভাই! শোনো, শোনো! লোকটা আসলে ভয় পায়নি। অবাক হয়েছিল। সে বুঝতে পেরেছিল কী প্রশ্ন তাকে করা হবে। তাই সে কয়েক পা এগিয়ে এসে বলতে লাগল, তিলেপাড়া। বেরেজের জল ছেড়েছে। নাবালের গাঁগেরাম ভেসে গেছে। ওই যে বাঁধ। দেখছেন, দেখে এলাম এক্ষুনি, বাঁধে ফাটল ধরেছে। আর দেরি করবেন না। যাবেন তো চলে যান। যান, যান! সে কাস্তে নাড়া দিতে দিতে কথা বলছিল। মেমসায়েব দেখছিল। গরদের শাড়ি পরা মেমসায়েব সে এই প্রথম দেখল। প্রদোষ বুঝতে পারছিল, লোকটি– এই প্রিমিটিভ, প্রায়-ন্যাংটা, যদিও অবাক, তাদের খুব একটা পাত্তা দিচ্ছে না। সে গাড়িতে ঢুকে স্টার্ট দিল এবং রেগে গিয়ে দেখল, ক্লারার হাতে ক্যামেরা এবং ক্লারা লোকটির ছবি তুলল। লোকটি হলুদ দাঁত বের করেছিল। ক্লারা গড়িতে ফিরে হাসিখুশি মুখে বলল, লোকটা ভাল। গাড়ি চলতে থাকার সময় সে লোকটার উদ্দেশে হাত নাড়ল। লোকটা সভ্যতা বোঝে। সে তার কাস্তেটা নাড়তে থাকল। ব্রিজের পর ঢালুতে নামতে নামতে ক্লারা জানালা দিয়ে মুখ বের করে মুখটা ঘুরিয়ে সামনে হাত নাড়ছিল। জলের প্রথম স্পর্শে ফিয়াট মৃদুগতি হল। কিংক্রিটস্ল্যাবে চাকা মাঝে মাঝে স্লিপ। করছিল। কিছুদূর যাওয়ার পর প্রদোষ বলল, জল বাড়ছে। ডাইনে জড়াজড়ি করে থাকা ঝোপজঙ্গল, বাঁদিকে ডুবুডুবু ধানক্ষেত। ক্লারা ঝুঁকে জল দেখছিল। বলল, স্রোত আছে। প্রদোষ ঠোঁট কামড়ে ধরেছে। তার ভুরু কুঁচকে গেছে। কারণ জলটা ক্রমশ বাড়ছে এবং স্রোতটা জোরালো হচ্ছে। গাড়িটা অদ্ভুত গোঁ গোঁ শব্দ করছে। একখানে থেমে গেল। প্রদোষ বলল, ইমপসিল। ব্যাক করতে হবে। ক্লারা বলল, সে কী! প্রদোষ ব্যাকগিয়ার টানল। গাড়িটা পিছু হাটছিল। হটতে হটতে গোঁ গোঁ করতে করতে হঠাৎ থেমে গেল। প্রদোষ ঠাণ্ডা মাথায় বলল, কারবুরেটারে জল ঢুকেছে।
সে নেমেই হাঁটু জল। সামনে এগিয়ে ঢাকনা তুলে ইঞ্জিনের ভেতর মাথা ঝুলিয়ে দিল। ক্লারা বলল, আমি দেখছি। ক্লারা জলে শাড়ি ভিজিয়ে ইঞ্জিনের কাছে এল। দেখেই বলল, নিরুপায়। প্রদোষ, আমরা এক কাজ করতে পারি। প্রদোষ শুধু ঠাণ্ডা মাথায় বলল, কী? ক্লারা বলল, ঠেলে ব্রিজে নিয়ে যাওয়া কষ্ট নয়, পরিশ্রম হবে। দু-জনে ঠেলতে লাগল, সামনে থেকে। প্রদোষের একহাতে স্টিয়ারিং। কিন্তু জলটা পেছনেও বেড়েছে। বাড়ছে। স্রোত জোরালো হচ্ছে। হাঁটু ছাড়িয়ে জল উঠলে প্রদোষ গলার ভেতর বলল, ইমপসিবল! ক্লারা দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক দেখছিল। হঠাৎ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, ওটা কী? প্রদোষ চমকে উঠেছিল। বলল, কী? ক্লারা আঙুল তুলে রাস্তার ঝোপজঙ্গলের দিকটা দেখাল। প্রদোষ বলল, এ মাউন্ড! ক্লারা বলল, গাড়িটা থাক। চলো, আমরা ওখানে যাই। তুমি বলছিলে পাহাড় নেই। ওই তো পাহাড়। প্রদোষ করুণ হাসল। আহা, পাহাড় নয়, ওটা একটা মাউন্ড ঢিবি। ক্লারা ব্যস্তভাবে বলল, দেরি কোরো না। জিনিসগুলি তুমি নাও, আমি নিই। চলো, আমরা ওখানে যাই। জল খুব বাড়ছে। এই দেখ জল কোথায় উঠেছে। তার মুখে হাসি। সে গাড়ির দরজা খুললে জল ঢুকে গেল। তার কিটব্যাগ আর মালপোয়ার হাঁড়িটা সে নিল। ক্যামেরা আর তার ব্যাগটা জলের ভেতর খুঁজে পেল না। প্রদোষ হতবাক দাঁড়িয়ে। ক্লারার তাড়ায় সে তার ব্রিফকেসটা তুলে নিল। যখন দু-জনে জলের ভেতর অনেকটা এগিয়ে গেছে, প্রদোষের মনে পড়ল বিয়ারক্যান ভর্তি প্যাকেটটার কথা। বলল, যাক গে! ক্লারার শাড়িটা অসুবিধায় ফেলেছে। জল এদিকে এক কোমর। জঙ্গলে ঢাকা ঢিবিটার কাছে পৌঁছুতে জল বুক ছুঁল। কিন্তু ক্লারা হাসছিল। সামনে পায়ে-চলা, হলুদ, ন্যাড়া একটা পলি রাস্তা উঠে গেছে। দু ধারে শ্লেটপাথরের স্ল্যাব পড়ে আছে। বোঝা গেল, এগুলো একদা সিঁড়ির ধাপ ছিল। খানিকটা উঠে প্রদোষ বসে পড়ল। ক্লারা তাড়া দিল, ওঠ! কিন্তু সেও পা বাড়াল। ঘুরে দেড়শো মিটার দূরে খোলামেলা এবং জলেঢাকা রাস্তায় গাড়িটা, লাল টুকটুকে ফিয়াট গাড়িটা দেখতে লাগল। গাড়িটা ভাসছে কিনা বোঝা যাচ্ছিল না। প্রদোষ চুপ। ক্লারা আবার তাকে তাড়া দিল। কারণ বৃষ্টি এসে গেল আবার। প্রদোষকে উঠতে হল। উঠে দাঁড়িয়ে সে আস্তে বলল, শিট! ক্লারা ভুরু কুঁচকে বলল, তুমি একটা–
গাড়িটা, লাল টুকটুকে মোটর গাড়িটা দুলছে। বাঁদিকে সামান্য দূরে শাদা ব্রিজটার দিকে চাকা। ঝর ঝর, প্রপাতের মতো গর্জন। গর্জন হঠাৎ থেমে জলের শব্দ। উঁচু হয়ে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো পালে পালে ঢেউ আসছে। গাড়িটা দুলতে দুলতে একপাশে কাত হতে হতে ভেসে যেতে থাকল। অতল ধানক্ষেতের ভেতর একটা নিচু গাছের গুঁড়িতে একটুখানি আটকে থাকার পর গাড়িটা, লাল টুকটুকে মটর গাড়িটা ছিটকে বেরিয়ে গেল। ভাসতে ভাসতে, ওল্টটাতে ওল্টটাতে, এক সময়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। ক্লারা বলল, আমি দুঃখিত। প্রদোষ শ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। সে বলবে ভাবছিল, তোমারই জন্য গাড়িটা গেল। তুমি ভারতের গ্রামের পুজো দেখতে জেদ ধরেছিলে, আমি না। ঢিবিটা উঁচু। প্রদোষ ক্লান্ত। ক্লারা চমৎকার উঠছে। দু ধারে ভাঙাচোরা পাথরের স্ল্যাব। একটা ধ্বংসাবশেষ। গাছপালা ঝোপঝাড় ফুঁড়ে বৃষ্টি নেমেছে। সামনে ভাঙা নিচু পাথরের দেয়াল, মধ্যিখানে খালি পায়ে-চলা রাস্তা। ক্লারাকে ভেজা শাড়ি জড়ানো কিম্ভুত প্রাণী দেখাচ্ছিল। ক্লারা খুব মজা পাওয়ার মতো করে বলছিল, খুব ভাল। খুব ভাল। তখন প্রদোষ বলল, তুমি একটা
.
ডাঃ ব্ৰজহরি কুণ্ডু
ডাক্তার ব্রজহরি কুণ্ডু, কাদরা সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের জনপ্রিয় নতুন ডাক্তার, বাহান্ন-চুয়ান্ন বছর বয়স, অনিবার্যভাবে মাথায় টাক, বেঁটে, নাদুসনুদুস, সারাক্ষণ খুশি খুশি ভাব, মুখে ও হাতে বরাভয়, বৃষ্টিবাদলা অগ্রাহ্য করে বর্ষাতি ও টুপি পরে সাইকেল চেপে জিতপুরের কালোবরণ মণ্ডলমশাইকে দেখতে গিয়েছিলেন। দূরত্ব তিন কিলোমিটার, তেমন কিছুই না। তাছাড়া তিনি কর্তব্যপরায়ণ মানুষ। আইন মেনে চলেন। ঘোর নীতিবাগীশ। রোগীদের হিতোপদেশ দিয়ে থাকেন, অর্থাৎ ওষুধ-পথ্যের সঙ্গে চারিত্রিক ও আচরণীয় সব কিছু। তার নিজস্ব একটি জীবনদর্শন আছে। মুমূর্ষ মণ্ডলমশাইকে তিনি বলছিলেন, প্রতিটি মানুষ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, বুঝলেন মণ্ডলমশাই, শুধু সেই জায়গাটুকু যদি সুন্দর করে সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখতে পারে, তাহলেই সারা পৃথিবীটা সুন্দর হয়। ব্যসযোগ্য হয়। অবশ্য এই বাক্যটি ব্ৰজহরি কোন বইয়ে পড়ে নোটবইয়ে টুকে রেখেছিলেন। মৃতপ্রায় মণ্ডলমশাই বলেছিলেন, খালি মাথাটা কেমন করছে- এই মাথাটা!
মণ্ডলমশাইয়ের বড়ছেলে বারীন্দ্র প্রাইমারি স্কুল-শিক্ষক। সদর দরজার কাছে ব্ৰজহরির হাতে দশ টাকার নোট গুঁজে দিলে ব্রজহরি খুব চটে গেলেও হাসলেন। তুমি তো জানো বারীন্দ্র, সরকারি রেটের বাইরে আমি এক পয়সা নিইনে। তুমি আমাকে চারটে টাকা দাও।
বারীন্দ্র জিভ কেটে বললেন, ও কী কথা ডাক্তারবাবু! এই দুর্যোগে বেরিয়েছেন, আমাদের সৌভাগ্য।
ব্ৰজহরি কিছুতেই নেবেন না। সাইকেলটি মণ্ডলমশাইদের বাড়ির মাহিন্দার কাঁধে বয়ে আনছিল। গ্রামের পথে প্রচুর জলকাদা। টিপটিপিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। বারীন্দ্র ছাতা মাথায় ডাক্তারবাবুর পেটমোটা ব্যাগটা বয়ে আনছিলেন। পিচ রাস্তার মোড়ে পৌঁছে বললেন, খুব দুঃখ পাব, ডাক্তারবাবু!
ব্ৰজহরি পিচে গামবুট ঠুকে নোটটা নিলেন এবং পকেট থেকে তিনটে দু টাকার নোট বের করে মাহিন্দার কানাইকে দিতে গেলেন। কানাই সাইকেল নামিয়েছে সবে, জোরে চেঁচিয়ে উঠল, না, না! ঠিক এই সময় বৃষ্টি ও বাতাসের ভেতর দিয়ে মণ্ডলমশাইদের বাড়ির দিক থেকে কান্নার কোলাহল ভেসে এল। বারীন্দ্র ভাঙা গলায় বলে উঠলেন, ওই যাঃ! বলেই প্যাঁচপেচে কাদায় দৌড়তে শুরু করলেন।
কানাই টাকাগুলো কোমরের কাপড়ের ভাঁজে চালান করে দিয়ে ফিক করে হাসল।
ব্ৰজহরি ভুরু কুঁচকে বললেন, হাসছ কেন হে তুমি? মানুষের মৃত্যু হলে হাসতে নেই। যাও, গিয়ে দেখ।
কানাই গম্ভীর মুখে বলল, সে-আপনি কী জানবেন জাক্তারবাবু? ওই যে কাঁদছে শুনছেন, আমি গাঁ জুড়ে হাসি শুনছি। শালা মোড়লমশাই গাঁসুদ্ধ জ্বালিয়ে শেষ করেছে। আমাকেও!
ব্ৰজহরির সাইকেল চাপাটা দেখার মতো। হ্যান্ডেল ধরে কিছুদূর দৌড়ে যান, তরপর প্যাডেলে একটা পা রাখেন, আরও কিছুটা ওই অবস্থায় দৌড়ান, তারপর সিটে চেপে বসেন। কানাই একটা মানুষের মৃত্যুতে হেসেছে, তাকেই ছ-টাকা, বখশিস বলা চলে না, সাইকেল বওয়ার মজুরি বাবদ দিয়েছেন, এটা তাকে ক্ষুব্ধ করেছিল। তদুপরি ওই কুৎসিত গাল। মনে হল, ওকে দুটো টাকা দেওয়া উচিত ছিল।
রাস্তাটা ততবেশি চওড়া না। একটা ট্রাক আসছিল সামনে থেকে। প্রচণ্ড গতিশীল খালি ট্রাক। ট্রাকের পেছনে তেরপল মুড়ি দেওয়া লোক উঁকি দিচ্ছিল। কংক্রিট স্ল্যাব থেকে সাইকেল নামাতে হল। লোকগুলো চেঁচিয়ে তাকে কিছু বলে গেল। বুঝতে পারলেন না। ট্রাকটা চলে গেলে স্ল্যাবের উঁচু কিনারা দিয়ে সাইকেলের চাকা ওঠানো গেল না। বাঁকের মুখে বাঁশবনের কাছে স্ল্যাবের সঙ্গে সমতল হয়েছে কিনারা, সেখানে আবার রাস্তা ফিরে পেলেন। বৃষ্টিটা বাড়ল। জোরে বাঁক ঘুরে যেতেই দেখলেন রাস্তার ওপর দিয়ে হাল্কা জলের স্রোত। আন্দাজ হাত দশেক গিয়ে বুঝলেন জল গভীরতর হচ্ছে। তখন সাইকেল থেকে নামলেন। আশা ছিল, কিছুদূর এভাবে যেতে পারলে মৌরী নদীর ব্রিজের চড়াই অংশটাতে পৌঁছে যাবেন। কিন্তু জল কোমর অব্দি এবং প্রচণ্ড টান। ব্ৰজহরি সাইকেল কাঁধে তুলে ধরলেন। বুঝলেন, তিনি বিপন্ন। জল সাইকেলটা ঠেলে দিচ্ছে তাঁর ওপর, সেই প্রবল চাপে তিনি ডাইনে সরে যাচ্ছেন ক্রমাগত। তখন সাইকেলটা মাথার ওপর ওঠানোর জন্য তুলতেই ব্যাকসিটে ডাক্তারি ব্যাগটা চোখে পড়ল। ডাক্তার নিজের ডাক্তারি ব্যাগের কথা ভুলে যাবেন? ব্ৰজহরি সাইকেল ও ডাক্তারি ব্যাগের মধ্যে ডাক্তারি ব্যাগটাই বেছে নিলেন। সাইকেলটা ছেড়ে দিলে সেটা ওল্টটাতে ওল্টটাতে ভাসতে ভাসতে নিখোঁজ হয়ে গেল। ধূসর বৃষ্টিরেখার ভেতর কিছু স্পষ্ট নয়, কিন্তু হঠাৎ মনে পড়ে গেল বাঁদিকে এখানেই তো–ওই তো!
ব্ৰজহরি ডাক্তার ব্যাগটা মাথায় রেখে বর্ষাতিসুদ্ধ নিজের বেঁটে মোটাসোটা শরীরকে বয়ে নিয়ে জঙ্গলে ঢিবিটার দিকে পা বাড়ালেন, পা মানে গামবুট। প্রথমে ব্যাগটা ডাঙায় এগিয়ে দিলেন। তারপর আঁকুপাকু করে নিজেকে টেনে হিঁচড়ে তুললেন। মসৃণ একটুকরো শ্লেটপাথরের স্ল্যাবে বসে একটু হাসলেন ব্ৰজহরি কুণ্ডু। কেন হাসলেন, তিনি নিজেই জানেন না।…
.
পুঁতি ও চাক্কু
বীরহাটার মোড়ে এলাকার নামী লোক হাজি বদরুদ্দিনকে পৌঁছে দিয়ে সাইকেল-রিকশোর সিট থেকে এক লাফে নেমে চাক্কু বলেছিল, আর দুটো টাকা বখশিস লাগবে হাজিসায়েব!
হাজি বদরুদ্দিন চাক্কুকে ভাল জানেন। দরকার হলে চাক্কু চাক্কুর মতোই তাঁর পেটে ঢুকে যাবে। টিপটিপে বৃষ্টির ভেতর ব্যাকুল চোখে তাকিয়ে লম্বা-চওড়া, ঢিলে আজানুলম্বিত সবুজ পাঞ্জাবি, চেককাটা লুঙ্গি ও সাদা সচ্ছিদ্র আঁটোসাটো টুপি পরা ধর্মভীরু লোকটি ব্যাপক নির্জনতা লক্ষ্য করার পর একটি পাঁচ টাকা ও একটি দুটাকার নোট বাড়িয়ে দিলেন। শহরে মামলা ছিল আজ। ব্যাংক থেকে কিছু টাকাও তুলেছেন। দেওয়ানি মামলার শুনানির যা রীতি, গোরে ঢোকার পরও রায় দেওয়া হবে কি-না অনিশ্চিত। তেতো হয়ে বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে শোনেন, বাস বন্ধ। রেডিওতে খবর হয়েছে তিলেঝাড়া ও মশালজোড় ব্যারেজে জল ছেড়েছে। এই সময় চাক্কুকে দেখে দোনামনা করে শিরীষতলায় এগিয়ে যান বদরুদ্দিন। চাক্কু সিগারেট টানছিল। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যায়, তবে ভাড়া লাগবে পাঁচ টাকা।
চাক্কুর এটা উপরিলাভ। সে আজ বৃষ্টিবাদলা হোক, পৃথিবী জলতল হোক, সব কিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে যাক, বীরহাটার এদিকে আসতই। কিন্তু সে যে আসতই, সেটা বলেনি হাজিসায়েবকে। পাঁচ মাইল রাস্তায় দু জায়গায় একটু জল ছিল। হাল্কা জলের স্রোত এধারের ধানক্ষেত থেকে ওধারের ধানক্ষেতে, তারপরের বার এধারের পাটক্ষেত থেকে ওধারের পাটক্ষেতে। চাক্কু একটু রোগা চেহারার জোয়ান হলেও গায়ে ও পায়ে প্রচণ্ড জোর।
মোড়ে হাজিসায়েবকে নামিয়ে চাক্কু নির্বিকার মুখে নোট দুটো নিয়ে নীল ফরেন ফুলপ্যান্টের পকেটে চালান করে দিয়েছিল। সে যখন প্রকৃত রিকশোচালক, তখন সে ডোরাকাটা আন্ডারওয়্যার হাফপ্যান্ট হিসেবে পরে। গায়ে নীলচে সুতীর কলারওয়ালা ছেঁড়া গেঞ্জি চাপায়। রোদের দিন হলে একটা টুপিও। স্যান্ডেল জোড়া আটকানো থাকে হ্যাঁন্ডেলের সামনে। কিন্তু আজ তার অন্য বেশ। ফুলপ্যান্টটা হাঁটু অব্দি গুটোতে হয়েছিল, তাহলেও তার গায়ে প্যারাশুট কাপড়ের চকরাবকরা ফুলহাতা জ্যাকেট। মাথায় ক্রিকেট দর্শকদের ব্যবহৃত টুপি। সামনে বাতাস ও বৃষ্টির ছাঁটে তাকে দস্তুরমতো লড়াই করে এগোতে হয়েছে। তাই বীরহাটার মোড়ে অশথতলায় দাঁড়িয়ে কাদা রাস্তায় হাজি বদরুদ্দিনকে প্রায় পালিয়ে যাওয়ার মতো হাঁটতে দেখে তার পস্তানি হয়েছিল, অনায়াসে দু টাকার বদলে পাঁচটা টাকা দাবি করতে পারত।
আরও এক মাইল কষ্ট করে এগিয়ে সে রিকশো থামায়। রিকশোটা রাস্তার কিনারায় নিয়ে যায়, দুটো চাকায় চেন আটকে তালা ঝোলায়। তারপর সিটের তলা থেকে ব্যাগটা বের করে। বাঁদিকের ধানক্ষেত ও পাটক্ষেতের ভেতর দিয়ে আল রাস্তায় কোনাকুনি হেঁটে যেতে থাকে। কিছুক্ষণ পরে মৌরীনদীর ধারে বাঁধে পৌঁছে যায়। জল বাঁধের কিনারা ছুঁয়েছে দেখে সে একটু অস্বস্তিতে পড়ে যায়। তাছাড়া ওপারটা যদূর চোখ যায় সমুদ্র।
কিছুদূর চলার পর বাঁধের গা ঘেঁষে দাঁড়ানো ঝুপসি বটতলায় অবিশ্বাস্যভাবে চাক্কু দেখতে পায় পুঁতিকে। পুঁতি গুঁড়ির খোকলে সেঁটে দাঁড়িয়ে ছিল। তার শাড়ি ভিজে গেলেও তাকে চকচকে দেখাচ্ছিল। খোঁপা এবং টিপে তাকে নববধূ দেখে চাক্কু দাঁত বের করেছিল। পুঁতি বলেছিল, যাও। তোমার সঙ্গে আর কথাই বলব না।
চাক্কু ঘড়ি দেখে বলেছিল, একটুও বেটাইম হয়নি। সওয়া তিনটে বাজছে। আমার আসার কথা চারটেতে।
পুঁতি দু হাতে ওর ঘড়িপরা আঁকড়ে ঘড়িটা দেখে বলেছিল, আমার কি ঘড়ি আছে? মনিন্দের (মজুমদার) মশাইকে জিগ্যেস করলাম, কটা বাজে মশাই? বললে, টাইম জেনে কী করবি? খাবি, না মুখ ধুবি? পুঁতি খিলখিল করে হাসতে লাগল। শেষে তাড়া দিয়েছিল, চলো, চলো! এতক্ষণ মাসি পাড়া মাথায় করে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কই, ওঠ! কী?
চাক্কুর একটু অন্য ইচ্ছে ছিল। জনহীন বটতলা, এক ঝলক রোদ্দুর হঠাৎ ফুটে মিলিয়ে গেল, বৃষ্টিটা থেমেছে, নিচে ভরা নদীর কলকল শব্দ, চকচকে পুঁতি স্বপ্ন কিংবা স্বপ্ন নয়। সে পুঁতিকে টানলে পুঁতি টের পেয়ে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। বলল, হুঁ, গাছে না উঠতে এক কাদি।
চাক্কু শ্বাসের সঙ্গে হাসল। তারপর ব্যাগের ভেতর থেকে খুঁজে সিঁদুরের মোড়ক বের করে বলল, এস। পরিয়ে দিই। সাক্ষী বটগাছ।
ঠিক এই সময় তাদের খুব কাছে বাঁধের ওপর দিয়ে নদী উপচে এল। সামনে ফাটল। পুঁতি ভয় পাওয়া গলায় বলে উঠল, না, না। এখানে নয়। বাঁধের গতিক দেখতে পাচ্ছ না? শিগগির চলো এখান থেকে।
চাক্কু গলার ভেতর বলল, চলো!
ওরা বাঁধ ধরে কিছুটা হেঁটেছে, পেছনে প্রচণ্ড শব্দে ধস ছাড়ল। প্রপাতের মতো জল পড়তে থাকল নিচু মাঠটাতে। পুঁতি ও চাক্কু হন্তদন্ত হাঁটতে থাকল। ডানদিকের মাঠটা দেখতে দেখতে জলময়। বৃষ্টি আবার এল ঝিরঝিরিয়ে। হিজল-জাম-জারুলের ঠাস বুনোট বাঁধের গায়ে কিছুদূর। তারপর আবার খোলামেলা। একটু দূরে উত্তর-পূর্ব কোণে মৌরীনদীর সাদা ব্রিজ দেখা যাচ্ছিল। পুঁতি দম আটকানো গলায় বলল, বিরিজে চলো বিরিজে!
কিন্তু ব্রিজের দিকে যেতেই সামনে আবার হুড়মুড় করে ধস, আবার জলপ্রপাত। চাক্কু পুঁতির হাত ধরে টেনে বাঁদিকের পাটক্ষেতে নেমে গেল। পাটক্ষেতের ভেতর পোকামাকড়, বনচড়ুইয়ের একটা ঝক, তেঁড়া সাপ, দুঃস্বপ্নের ভেতর দিয়ে হাঁটু জল, কোমরজল, তারপর পাটক্ষেতের শেষে বুক জল। যত এগোতে থাকে, তত জল বাড়ে। বৃষ্টিতে সব ধূসর। জলের প্রচণ্ড টান। দুটিতে দুটি ব্যাগ এক হাতে মাথার ওপর তুলে সাবধানে পা বাড়ায়। তারপর পুঁতি চেঁচিয়ে ওঠে, দরগা! দরগা! চাক্কু সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারে। তারা স্রোতের চাপে যেখানে এসে পৌঁছেছে, সেটা একটা উঁচু বিশাল ঢিবি–ঘন জঙ্গলে ঢাকা। খোঁড়া পিরের দরগা।
প্রথমে ওঠে চাক্কু একটা ঝোপ আঁকড়ে। তারপর হাত বাড়িয়ে তার। প্রেমিকাকে টেনে তোলে। বড়-ছোট, উঁচু-নিচু লাইম কংক্রিটের চাঙড় ছড়ানো ঢালু পিঠে। গাছগুলো না থাকলে কবে নিচে গড়িয়ে পড়ে যেত। একটা চাঙড়ে বসে চাক্কু একটু হাসে। বলে, রিকশোটা–
পুঁতি বলে, নিজে বাঁচলে বাপের নাম। কই, সিগারেট থাকলে দাও, টানি।
চাক্কু বলে, পকেটের প্যাকেটটা ভিজে গেছে। টাকাগুলোও। দেখছ? বলে সে ব্যাগে হাত ভরে। থামো, আরেক প্যাকেট আছে। কিন্তু আগুন? দেশলাই কাঠিটার অবস্থা দেখ।
পুঁতি বলে, চলো! দরবেশবাবার কাছে যাই। আগুন পাব।
চাক্কু ওঠে। করুণ দাঁত বের করে বলে, শালা কানা নাকি হাত গুনতে জানে। দুটো টাকা নেবে তো নেবে, জিগ্যেস করব আমার রিকশোটা আছে না, ভেসে গেল।
পুঁতি জিভ কেটেছিল। পা বাড়িয়ে বলে, ওই যে গাল দিলে বাবাকে– দেখবে তাও জানতে পেরেছে।
চাক্কু একুট ভড়কে গেল। সে সহজে ভড়কায় না। কিন্তু এখন দুঃসময়।
.
বিপ্লবী নেতা ঘনশ্যাম রুদ্র
সত্তরের দশকে বিপ্লবী কৃষক পার্টির স্থানীয় নেতা ঘনশ্যাম রুদ্রের দশবছর জেল হয়েছিল। বেরিয়ে আসতে আশির দশক। কিছুদিন চুপচাপ ছিলেন। কিন্তু চুপচাপ থাকা তার পক্ষে অসম্ভব। সবসময় গোয়েন্দা পুলিশের গতিবিধি, স্থানীয় নৈরাজ্য ও বদমাইসি, খবরের কাগজের বিবিধ উত্তেজক খবর এবং তার আদর্শবাদ অথবা স্বভাব, এইসব মিলে তাঁকে অস্থির করে ফেললে তিনি তাঁর মহকুমা শহরের পৈতৃক বাড়ি থেকে গা ঢাকা দেন। গ্রামে-গ্রামে গড়েতোলা পার্টি ইউনিটগুলোর অস্তিত্ব খুঁজে না পেয়ে এবং পার্টিকমরেডদের জঙ্গি যুবকরা কেউ জোতদারদের ভাড়াটে গুণ্ডা, কেউ খুনে ডাকাত বা ছিনতাইবাজ হয়ে গেছে জেনে খুব দমে যান। কিন্তু তিনি সহজে কিছু ছেড়ে দেবার পাত্র নন। কয়েক মাসের স্টোয় পূর্ব-পরিচয়ের খেই ধরে কয়েকটি গ্রামে এবার শুধু ভাগচাষী ও ক্ষেতমজুরদের ইউনিট গড়ে তুলতে সক্ষম হন। এলাকায় শিক্ষিতের হার নগণ্য এবং দারিদ্র্যও ভীষণ। কিন্তু জোতদার ও প্রান্তিক চাষীরা আগের তুলনায় সংঘবদ্ধ। ফলে তাকে বার দুই খুন করার চেষ্টা হয়। তারপর পুলিশ পেছনে লাগে। আজ দুপুরে ক্ষেতমজুর নাকু শেখের বাড়িতে সবে খেতে বসেছেন, পুলিশ ঢোকার খবর হয়। খাওয়া ফেলে ঘনশ্যাম রুদ্রকে গা ঢাকা দিতে হয়। নাকু তাকে পাটক্ষেতের ভেতর পৌঁছে দিয়ে চলে যায়।
ঘনশ্যাম রুদ্র রোগা গড়নের মানুষ। বয়স পঁয়তাল্লিশ বছর প্রায়। তামাটে। রঙ। মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা। লম্বা খাড়া নাক, পাতলা ঠোঁট, বড়বড় কান, চোখদুটি সুন্দর। তিনি চিরকুমার। তাঁর পরনে, খেতে বসার সময় ফিকে নীল লুঙ্গি ও গেঞ্জি ছিল। ব্যাগে ছিল ধুতি-পাঞ্জাবি। পাটক্ষেতের পর ডাইনে ঘুরে মৌরীনদীর বাঁধে উঠবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু পুলিশের কথা ভেবে সোজা নাকবরাবর ধানক্ষেতের আলে হাঁটতে হাঁটতে সামনে দেখলেন অগাধ জল। মরিয়া হয়ে জলে নেমে বুঝলেন ভুল হয়েছে। জলে স্রোতের টান। কিন্তু ঘনশ্যাম রুদ্র সহজে দমে যান না। জল যত বাড়ে, তত রেগে যান। পা বাড়িয়ে অভিজ্ঞ ঘনশ্যাম আল খুঁজে এগোতে থাকেন। কখনও পা হড়কে ক্ষেতের গভীরে পড়ে যান, আবার ওঠেন আলের ওপর। এভাবে চলতে চলতে বৃষ্টি, বৃষ্টির পর পায়ের স্যান্ডেল জলের তলায় ফেলে আসা, তারপর হাতের ব্যাগ উঁচু করে কোমর জল ভাঙতে ভাঙতে সাঁতার জল এবং ঘনশ্যাম চিতসাঁতার দিতে থাকেন, ব্যাগটি উঁচুতে। একসময় হঠাৎ তাঁর মনে হয়, বিপ্লবের আগে কিছু গঠনমূলক কাজকর্মের জন্য অপেক্ষা করা দরকার, যে-কাজ প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিবর্গ নিজেদের স্বার্থেই করবে। একহাতে প্রকৃতি, অন্য হাতে প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে লড়াই করা পণ্ডশ্রম। বাঁধটা মজবুত হলে জোতদারদের লাভ হয় ঠিকই, কিন্তু বিপ্লবীদের যাতায়াত ও লড়াইয়ের জন্য প্রয়োজনীয় শক্ত মাটিও পাওয়া যায়। এইসব ভাবতে ভাবতে নিজের ওপর চটে গেলেন ঘনশ্যাম। পা নামিয়ে মাটি খুঁজলেন পেলেন না। ভয় হোল, কতক্ষণ এভাবে ভেসে থাকবেন এবং একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়বেনই, তখন তাঁকে খুব আদিম ধরনের মৃত্যুকে মেনে নিতে হবে। তারপরই জলের ভেতর কী একটা শক্ত জিনিসের জোর ধাক্কা খেয়ে ঘুরে ভেসে ডুবে যাচ্ছে এবং আবার ভেসে উঠছে এমন দুটো, তিনটে বা পুরো চারটে টায়ার, মোটর গাড়িরই টায়ার দেখে ভীষণ অবাক হয়ে গলেন। একটা ভেসে যাওয়া উল্টেটা মোটরগাড়ি থেকে মরিয়া হয়ে তফাতে সরে গেলেন ঘনশ্যাম রুদ্র। এইসময় বৃষ্টিটা থেমে গেছে। আরও অবিশ্বাস্যভাবে মেঘের ফাঁকে রোদ্দুর কিন্তু আবার রোদ্দুর মুছে জমাট মেঘ, তারপর ঝিরঝির করে আবার বৃষ্টি–ধূসরকার ভেতর কালো টানা, লম্বাটে একটা দেয়ালের মতো জিনিস। ঘনশ্যামকে স্রোত সেদিকে টেনে নিয়ে গেল। তারপর মাটি পেলেন। দেখলেন এটা একটা বাঁশবন। কোমর জলে বাঁশঝাড়ের ভেতর যখন হাঁটছেন, তখন মনে পড়ল, পিচের রাস্তা আছে ওধারে।
কঞ্চি ও কাঁটাঝোপে তাঁর লুঙ্গি ও নিম্নাঙ্গ ক্রমাগত ছড়ে যাচ্ছিল। জ্বালা করছিল। বাঁশবন পেরিয়ে গিয়ে পিচের রাস্তার বদলে জলের রাস্তা দেখে একটু ভড়কে গিয়েছিলেন প্রথমে। কিন্তু স্রোতটা পিচরাস্তার মহকুমা শহরের দিকেই বয়ে চলেছে। ঘনশ্যাম রুদ্র পুলিশ, বিপ্লব, এসব জরুরি ব্যাপার ছেড়ে হিসেব করছিলেন, ছমাইল দূরত্ব স্রোতে যদি ভেসেও চলেন, ঘণ্টা দেড়-দুই লাগবে। ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে যাবে।
কিন্তু প্রচণ্ড ক্লান্তি, জলে ও স্রোতে ধাক্কা এবং আজগুবি ওল্টটানো গুবরেপোকার মতো একটা মটরগাড়ির উপদ্রব, কোমরে ব্যথা, পা-অব্দি কাটাখোঁচে ছড়ে যাওয়া, তার চেয়ে বড় কথা অসহায় অবস্থায় প্রকৃতির হাতে একজন বিপ্লবীর অপমৃত্যু হবে– রাগী সাপের মতো ফুঁসতে ফুঁসতে ডাইনেবাঁয়ে তাকাতে গিয়ে একটু তফাতে জঙ্গলে ঢিবিটা চোখে পড়ামাত্র ঘনশ্যাম হুড়মুড় করে জল ভেঙে স্রোতের বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে জয়ী হলেন।
উঁচুতে উঠে যাওয়া ঢিবির মাটিতে ধেবড়ে বসে ব্যাগটা মাথায় রেখে শুয়ে পড়তে চাইলেন ঘনশ্যাম রুদ্র। মাথার দিকে টেরচা হয়ে আটকে আছে। একটা লম্বাটে শ্লেটপাথর। কীসব আঁকিবুকি খোদাই করা আছে। এই ঢিবিটা বাইরে থেকে দেখা ঘনশ্যামের। শুনেছেন এটা পিরের দরগা। যাই হোক, আপাতত একটা আশ্রয়। পাথরটাতে ব্যাগ রেখে হাঁটু ভাজ করে আধশোয়া হলেন ঘনশ্যাম। দেখলেন, লুঙ্গি কয়েক জায়গায় ফদা-ফাই, কিছু ক্ষতচিহ্ন ধুয়ে গেলেও আবার রক্ত জমছে, তবে আগে শুকনো জামাকাপড় পরে নেওয়ার দরকার ছিল।
ইচ্ছে করছে না। মাথার ওপর ঝাকড়া একটা গাছ, বড়-বড় পাতা। বৃষ্টি আটকালেও পাতা থেকে মোটা ফোঁটা পড়ছে। কিন্তু শরীর ঘনশ্যামকে নড়তে দিচ্ছে না। চোখ বুজে আধশোয়া অবস্থায় রয়ে গেলেন। তাঁকে যথাযথ মড়া দেখাচ্ছিল, ক্ষতবিক্ষত এবং ডাঙায় আটকে পড়া মড়া।
.
বাউল হরিপদ
গত শ্রাবণে ঝুলন পূর্ণিমার রাতে মহকুমা শহরের রাজবাড়িতে রাসের মেলায় হরিপদ বাউল তার কষ্টার্জিত তৃতীয় সাধনসঙ্গিনী হরিমতাঁকে হারিয়ে ফেলে প্রতিজ্ঞা করেছিল, যেটা একটা গান, এবং বাউলরা যা কিছু করে, গানেই করে :
ভবের হাটে একলা হেঁটে চলো রে মোনকানা…
বাউলদের গান এরকমই সাদাসিধে, লাইনবাঁধা, যেটুকু বাঁকা সেটুকুর মানে গুরু ছাড়া কেউ জানে না বলে পাশ কাটিয়ে যেতে হয়। একতারা হাতে হরিপদ আশ্বিন অব্দি এই গানটা প্রচুর বদলেছে। কাল কাঁদরা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডাক্তার। ব্ৰজহরি কুণ্ডুকে গানটা শোনাতে শোনাতে সে হেসে অস্থির। ব্ৰজহরি সব কিছুতে সিরিয়াস। হাসির কারণ জানতে চাননি। হরিপদ এমন মাতিয়ে দিয়েছিল যে রোগীরা একবাক্যে স্বীকার করেছিল, সংসারে অর্থাৎ ভবসংসারে একলা হাঁটাই ভাল। রাতে হরিপদ ডাক্তারবাবুর বাসায় থেকে যায়। ব্ৰজহরি নিরামিশাষী। কাজেই হরিপদর খুব খাওয়া হয়েছিল। সকালে সে চা-বিস্কুট খেতে মাধুকরীতে বেরিয়ে যায়। পাকা রাস্তার কাছাকাছি গ্রামগুলোর চেয়ে প্রত্যন্ত গ্রামগুলোত এখনও বাউলগানের আদর আছে। আদড়-কুসুমখালিতে এক সদ্-গেরস্থ তাকে কুমড়োর ঘাট আর খেসারির ডাল দিয়ে ভাত খাওয়ায়। তারপর হরিপদ মৌরীনদীর ধারে বাঁধ দিয়ে পিড়িং পিড়িং করে একতারা বাজাতে বাজাতে গাইতে গাইতে আসছিল। সকাল থেকে ছিটেফোঁটা বৃষ্টি, দুপুরে থেমে-থেমে, কখনও ঝিরঝিরিয়ে বৃষ্টি। ব্রিজের দিকে আসতে আসতে বাধা পেল। বাঁধ ভেঙে নদী মাঠ ভাসিয়েছে। জয়গুরু বলে হরিপদ পিছিয়ে এল। অনেকটা পিছিয়ে বাঁদিকে তাকিয়ে ভাবছে কী করবে, খোঁড়া পিরের দরগাটা চোখে পড়ল। সে গেরুয়া বেনিয়ান ও গেরুয়া লুঙ্গি খুলে ঝোলায় পুরে মালকোচা মেরে গামছা পরে জলে নামল। একহাতে একতারা অন্য হাতে ঝোলা। একবুক জল ভেঙ্গে হরিপদ জয়গুরু বলে ঢিবিতে পৌঁছুল।
এদিকটায় ঝোপজঙ্গল খুব ঘন। গুঁড়ি মেরে উঠতে উঠতে সে চাপা স্বরে কথাবার্তা শুনতে পেল। তখন সে গামছা নিংড়ে উলঙ্গ শরীর মুছে তারপর ঝোলার ভেতর থেকে শুকনো লুঙ্গি ও বেনিয়ান বের করল। আবার সে পরিপূর্ণ বাউল। একতারা পিড়িং পিড়িং করতে করতে ধ্বংসস্তূপের ভেতর দিয়ে এগিয়ে গেল।
.
বংকুবিহারী দারোগা
কাঁদরা থানার বড়বাবু বংকুবিহারী ধাড়ার হাতে গোপন তথ্য ছিল, দাগী ডাকাত ইসমাইল নতুন ঘাঁটি করেছে কালীতলায়। এমন অখাদ্য গ্রাম, না যাবে জিপ না সাইকেলও। তার ওপর বৃষ্টি, জলকাদা। এলাকায় হাঙ্গামা চুরিডাকাতি লেগেই আছে। শেষ রাত্রে হানা দিতে হলে সন্ধ্যার পর বেরুতে হয়। তখন ভাগে পেলেন মাত্র দুজন সেপাই।
ইসমাইলের মাথার দাম ঘোষিত হয়েছে পাঁচহাজার টাকা। এটা এ বাজারে কিছুই না। কিন্তু বিবিধ উন্নতির ইশারা আছে। বংকুবিহারী ঝুঁকি নিয়েছিলেন। প্রাণের ঝুঁকিও বলা চলে। ইসমাইল ডাকু এ পর্যন্ত তিনজন সেপাই এবং দুজন অফিসার কোতল করেছে।
কেদার চৌকিদার মৌরী নদীর এপারে তালভোঙা নিয়ে অপেক্ষা করছিল। তালডোঙায় চারটে লোক, ডুবুডুবু অবস্থা, আর কেদারের মতে, নদীর ভাবগতিক ভাল না, তবু এ একটা লড়াই। ইয়াসিন মোল্লার বাড়ির ভেতরে চুপিচুপি মুর্গির মাংস আর মোটা চালের ভাত খাওয়া হল। মোল্লার ঘরে তক্তাপোষে মশারি খাঁটিয়ে শোবার ব্যবস্থা হয়েছিল দারোগাবাবুর। সেপাই দুজন মেঝেয়, অবশ্য তারাও মশারি পেল। ভীষণ মশার উপদ্রব। শুধু বেচারা কেদার দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে ঢুলতে ঢুলতে মশার কামড় খেয়ে ঢোল। শেষ রাতে মোল্লা জাগিয়ে দিলেন। সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে।
তখন কালীতলায় বানের জল ঢুকছে। সারা গ্রামে চাঁচামেচি, নদীর বাঁধের দিকে জল ভেঙে মানুষজন এগিয়ে যাচ্ছে। তালডোঙায় কাচ্চাবাচ্চা, স্ত্রীলোক, ক্রন্দন, সে এক বীভৎস ঘটনা। কেদারের তালডোঙাটি নদীর ধারে বাঁধা ছিল। পাওয়া গেল না, ইসমাইল ডাকু দূরের কথা! মোল্লা আশ্বাস দিলেন, শিগগির তালডোঙা যোগড় করে ফেলবেন। সেই তালডোঙাটি আসতে ভোর হয়ে গেল। তখন আর কেদারের পাত্তা নেই। সে তার সংসার বাঁচাতে গেছে।
হতাশ, ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ বংকুবিহারী সেপাই দুজনকে বললেন, তোমরা পরের বার যাবে। আমাকে পৌঁছে দিয়ে আসুক। মোল্লা সেপাই দুজনকে পরামর্শ দিলেন, বেগতিক দেখলে তারা যেন ঘরের চালে চড়ে বসে। মোল্লাই এখন কাণ্ডারী। তার ভিটেটি উঁচু মাটিতে। কিন্তু ভোরের আলোয় জলের হালচাল দেখে তার ভাল ঠেকছিল না। তালডোঙাটি কোনোক্রমে মৌরীনদী পার করে অন্যপারের বাঁধে পৌঁছে দিলেন দারোগাবাবুকে। তারপর যে চলে গেলেন সেপাইদের আনতে, তো গেলেনই। তখন বাঁধে ভিড়। কাচ্চাবাচ্চা, স্ত্রীলোক, ছাগল, হাঁস-মুরগি গেরস্থালির সরঞ্জাম, প্রচণ্ড ক্রন্দন। তার ওপর থেমে-থেমে বৃষ্টি। বংকুবিহারী বেলা নটা অব্দি অপেক্ষা করে বাঁধের দুদিকে তাকিয়ে ঠিক করতে পারছিলেন না কোনদিকে যাবেন। কেউ তাকে পাত্তা দিচ্ছিল না। যাকেই জিগ্যেস করেন, সেই প্রলাপ বকতে থাকে। অগত্যা বাঁধ বরাবর পূর্বে হাঁটতে থাকলেন। এপারের বাঁধটা অক্ষত আছে। তারপর তাঁর ব্রিজ এবং পাকা রাস্তাটির কথা স্মরণ হল। তখন বুঝলেন, ঠিক রাস্তায় চলেছেন। মাইলখানেক চলার পর ডাইনে একটা ছোট্ট গ্রাম পেলেন। গ্রামটি উঁচু ভিটের ওপর অবস্থিত। কিন্তু কোনো লোকজন দেখতে পেলেন না। একটি স্ত্রীলোক বাঁধে গাইগরু বাঁধতে এসেছিল। কেন কে জানে, তাঁকে দেখে ঘোমটা টেনে পাথরের মূর্তি হয়ে রইল। সামনে কোথাও বাঁধ ভেঙেছে কি না জানার ইচ্ছা ছিল বংকুবিহারীর। রাগ করে বংকুবিহারী পা বাড়ালেন। নদী এঁকেবেঁকে চলেছে। বাঁধটা কখনও কাছে, কখনও দূরে সরে গেছে, ব্রিজটি দেখা যাচ্ছে না, ভিজে জবুথবু বংকুবিহারী পরের গ্রামটিতে পৌঁছে ডাইনে একটা ঘরের বারান্দা দেখা মাত্র গুলি খাওয়া বাঘ অথবা শেয়ালের মতো কুঁজো হয়ে ছুটে গেলেন। বারান্দায় কয়েকজন লোক বসেছিল উদ্বিগ্ন মুখে। তারা ভড়কে গেল। তারপর শশব্যস্তে সেলাম দিতে থাকল।
দারোগাবাবু এই গ্রামেরই মোড়ল মশায়ের বাড়ি শেষ পর্যন্ত অতিথি হন। তার প্রচণ্ড খিদে পেয়েছিল। খিদে ও ঘুম। ফলে এই গ্রামে তিনি দুপুর অব্দি থেকে যান। আর এই গ্রামেই অন্য প্রান্তে বিপ্লবী ঘনশ্যাম রুদ্র ক্ষেতমজুর। সমিতির বৈঠক করছিলেন। গ্রামের চৌকিদার পাটক্ষেত থেকে ফিরে ঘুমন্ত বংকুবিহারীর জন্য অপেক্ষা করে। ঘুম ভাঙলে খবরটি দেয়। তার আগে অবশ্য দেরিতে পাওয়া খবরের ধাক্কায় ঘনশ্যাম রুদ্র মুখের আহার ফেলে পালিয়ে গিয়েছিলেন।
এই গ্রামের চৌকিদারই বংকুবিহারীকে সামনের দিকে বাঁধ ভাঙার খবরটিও দেয় এবং কোনাকুনি আলপথে দ্রুত যাওয়ার পরামর্শ দেয়। সে কিছুদূর ধানক্ষেত, পাটক্ষেত ও জঙ্গলের ভেতর দারোগাবাবুকে এগিয়ে দিয়েও আসে। বংকুবিহারী তারপর জলের সামনে পৌঁছান। আর পিছিয়ে যাওয়ার মানে ফের একটা পরাজয়। বংকুবিহারী রিভলবারটি, বেল্টট, বুলেট কেস আকাশে তুলে হাঁটুজল, কোমরজল, বুকজল ভাঙতে ভাঙতে খোঁড়াপিরের ঢিবিটি চোখে পড়ায় সেদিকে সাঁতার কাটতে কাটতে এগিয়ে যান। তিনিও কিছুক্ষণ নেতিয়ে একটুকরো লাইমকংক্রিটে ঠেস দিয়ে পড়ে থাকেন। চাকরি, জীবন, সবকিছুর প্রতি অত্যন্ত বীতশ্রদ্ধ।
.
এক বারবধূ
মহকুমা শহরের বাগানপাড়া গলির বারবধূ শাওনি খোঁড়াপিরের দরগায় সিন্নি। মেনেছিল মাসখানেক আগে। সিন্নির উদ্দেশ্য মাসির মৃত্যু। সে শুনেছিল খোঁড়া। পির জাগ্রত আত্মা। পাঁচটা খুদে মাটির ঘোড়া, মাটির সরায় খই ও বাতাসা, একখানা নতুন গামছা যত্নে পড়ের ব্যাগে ভরে সে চুপি-চুপি বেরিয়ে বাসে চেপেছিল। কাদরা পেরিয়ে রাস্তায় জল। বাস দাঁড়িয়ে গেল। যাত্রীরা বুঝিয়ে সুঝিয়েও ড্রাইভারকে রাজি করাতে পারল না। তখন বৃষ্টি পড়ছিল। আর মাইল তিনেক গেলে দরগা। শাওনি জল ভেঙে এগোতে থাকল। যাত্রীরা তখন তুমুল হল্লা করছে। কিছুদূর চলার পর জল বাড়ছিল। স্রোতে টলতে টলতে বারবধু শাওনি একবার পিছু ফিরে দেখল, তার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ, বাসটা জলে ডুবতে ডুবতে পিছু হটছে। সে মুচকি হাসল। আবার হাঁটতে থাকল জলের ভেতর। খোঁড়া পিরের দরগায় পৌঁছুতে তার ঘণ্টা দুই মতো লাগল। হাতে ঘড়ি না থাকলেও সে ঘণ্টা মাপতে পারে। সে যখন ঢিবির মাটিতে হাত রাখল, তখন এত ক্লান্ত যে ওঠার জন্য পা তুলতে পারছে না। সে সাবধানে ব্যাগটা একটা ঝোপের গোড়ায় হাত বাড়িয়ে আটকে রেখে শরীরটা টেনে তুলতে থাকল। সে পিরবাবাকে ডাকছিল বিড়বিড় করে। তারপর সে বুঝল, কেউ তাকে টেনে তুলে নিল। সে চোখ বুজে ফেলেছিল, নির্জীব। তারপর যে তার হাত ধরে টেনে তুলেছিল, সে মৃদুস্বরে বলল, তুমি কি একটু কষ্ট করে উঠতে পারবে? তখন চোখ খুলেই বারবধূটি চমকে উঠল। স্বপ্ন, না সত্যি সত্যি? একটা ধপধপে শাদা দাড়িওয়ালা মুখ, লম্বাচওড়া এক মানুষ– পিরবাবাই কি? সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। কাঁদতে কাঁদতে একটানে উঠে বসে ধনুকের মতো বেঁকে পায়ে মাথা কুটতে গেল। গিয়ে স্বপ্নটা ভেঙে গেল। পায়ে কালো অদ্ভুত গড়নের জুতো। এক শাদা দাড়িওয়ালা সায়েব গায়ে রেনকোট, মাথায় টুপি। বারবধূ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। সায়েব লোকটি ফের বাংলায় বলল, এখানে ভিজো না। আমার সঙ্গে এস। ওখানে ঘর আছে। কী? উঠতে কষ্ট হচ্ছে? ধরতে হবে? শাওনি ধরা গলায় বলল, না। আমি যেতে পারব।
.
এবং একটি কুকুর
সাহেবলোকটি স্বনামখ্যাত কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। ছোট ও বড় ধ্বংসপ, ঝোপঝাড় ও ভাঙা দেউড়ির আড়ালে টলতে টলতে বারবধূটি অদৃশ্য হলে তিনি ডাইনে ঘুরলেন। ওদিকটা ঢালু এবং ঝুরিওয়ালা একটি বটগাছ আছে। সেখানে জার্মান মেয়েটি ক্লারা গ্ল্যান্সলারকে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন। চোখে চোখ পড়লে ক্লারা ডাকল, কর্নেল! কর্নেল তার কাছে গেলেন। ক্লারার পরনে সিল্কের শাড়ি। মাথায় লাল রুমাল বাঁধা। খালি পা। ওর কপালটা বড় বেমানান। বাংলার গ্রামে এদেরই উঁচকপালি মেয়ে বলা হয়। ক্লারা হাসছিল। বলল, স্থানটি মূলত একটি সমাধিক্ষেত্র। এই দেখুন একটি সমাধি। কোনো ক্রস দেখছি না। অতএব স্থানটি মূলত মোজলেম সমাধিক্ষেত্র।
তুমি ঠিকই বলেছ। কর্নেল বললেন। তবে কষ্টকর সমাধিক্ষেত্রের বদলে কবরখানা বলতে পরো ডার্লিং!
ক্লারা নড়ে উঠল।..হ্যাঁ, হ্যাঁকবরখানা। তারপর নীল চোখে রহস্যের ভঙ্গি ফুটিয়ে বলল, আশাকরি এটা চুণ্ডু খানের কবর নয়। আপনি অ্যারাবিক পার্সিয়ান জানেন কি! ওই দেখুন, স্মৃতিফলকে কীসব লেখা আছে।
কর্নেল ঝুরির আড়ালে গিয়ে বললেন, তুনি দরবেশসায়েবের গল্পটা বিশ্বাস করো কি?
করি। ক্লারা বলল। ভারতের সবকিছুই বিশ্বাসযোগ্য।
তোমাকে বলেছি ডার্লিং, একটার পর একটা করে তোমার বিশ্বাস ভেঙে যাবে, তখন তুমি কষ্ট পাবে। কর্নেল বৃষ্টির ছাঁট বাঁচিয়ে চুরুট ধরিয়ে নিলেন। ধোঁয়ার মধ্যে ফের বললেন, সত্যে পৌঁছুতে হলে অবিশ্বাস দিয়ে শুরু করতে হয়।
ক্লারা একটু ক্ষুব্ধ হল। বলল, আপনি প্রদোষের প্রতিধ্বনি করছেন। আমার ননদিনীর নাম মৃণালিনী। তাকে আমি দিদি বলি। সে বলল, তাদের মামার বাড়িতে পূজার প্রতিমার চোখ থেকে অশ্রু ঝরে। আমি দিদিকে বিশ্বাস করি। সুতরাং তার কথায় বিশ্বাস করি।
কর্নেল হঠাৎ তাকে একটানে সরিয়ে আনলেন। ক্লারা হকচকিয়ে উঠেছিল। কর্নেল বললেন, কিন্তু সাপকে বিশ্বাস করতে নেই। সাপটি বিষাক্ত। ওই দেখ।
ক্লারা এবার সাপটিকে দেখতে পেল। সাপটি ক্লারা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, তার একহাত তফাত দিয়ে এঁকেবেঁকে এগিয়ে যাচ্ছিল। কর্নেল ইটের চাঙড় তুলতে গেলে ক্লারা তাকে বাধা দিল। সাপটি সম্ভবত মাটিতে স্পন্দনের প্রবলতা টের পেয়ে একটা স্কুপের ভেতর লুকিয়ে পড়ল। কর্নেল বললেন, আমাদের খুব সাবধানে চলাফেরা করা উচিত, ডার্লিং! চুণ্ডু খানের আত্মার চেয়ে সাপ। বিপজ্জনক। এস, আমরা দরবেশসায়েবের ডেরায় ফিরে যাই।
ক্লারা মুগ্ধদৃষ্টে এদিক-ওদিক দেখতে দেখতে বলল, যত দেখছি, অবাক হচ্ছি। ঠিক এমন কোনো স্থানেই আমি আসতে চেয়েছিলাম। খুব ভেতরে, অনেক অনেক ভেতরে। যেখানে ভারতের আত্মা আছে।
বৃষ্টিটা হঠাৎ থেমে গেল। ক্লারা কর্নেলকে অনুসরণ করছিল। উঁচু সব গাছের পাতা থেকে বৃষ্টির আটকেপড়া ফোঁটাগুলি অনর্গল ঝরছিল। ভিজে যাচ্ছিল ক্লারা। দরবেশের ডেরায় পৌঁছুতে অনেকটা ঘুরে যেতে হবে স্তূপ ও জঙ্গলের দরুন। টিবির সমতল অংশটা কর্নেলের মাপে আন্দাজ দশ একর। পশ্চিম ঘুরে ফাঁকায় পৌঁছে রোদ্দুর দেখা গেল। ঘড়িতে সাড়ে চারটা বাজে। কর্নেল ঝুঁকে একটা লম্বাটে পাথরের স্ল্যাব তুলে নিয়ে বললেন, দেখছ? আশ্চর্য ব্যাপার!
ক্লারা বলল, কী, কী?
পাথরটার একপিঠে দেবীমূর্তি, অন্যপিঠে অ্যারাবিক বা পার্সিয়ান কিছু লেখা আছে।
ডাক্তারবাবু বলছিলেন এটা হিন্দুরাজার প্রাসাদ ও মন্দির ছিল। মোজলেমরা তা অধিকার করে।
পাথরটা রেখে কর্নেল চাপা হেসে উঠলেন। আরও আশ্চর্য ব্যাপার তোমাকে দেখানো যায় ডার্লিং, যদি তুমি অশালীন মনে না করো। তোমার ক্যাথলিক, এবং ইওরোপীয় সংস্কারের কথা ভেবেই বলছি।
ক্লারা শক্ত মুখে বলল, আমি ভারতীয় এবং হিন্দু।
ভাল কথা। তাহলে ওই দেখ।
পশ্চিমের খোলামেলা ঢালু ঘাসজমিটায় দাঁড়িয়ে বংকুবিহারী ভিজে খাকি শার্ট-প্যান্ট খুলে ঝোপে শুকোতে দিচ্ছেন। পরনে শুধু গেঞ্জি আর আন্ডারওয়্যার। জুতোজোড়া একটা লাইমকংক্রিটে রেখে পাশে বসলেন। মোজা খুললেন। শুকোতে দিলেন। রিভলবার ও বুলেটকেসসহ চওড়া বেল্টট কোলে রাখলেন। গোঁফ পাকাতে শুরু করলেন।
ক্লারা চাপা হেসে বলল, ভারতে সবচেয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে আইনরক্ষকরা।
কর্নেলও একটু হাসলেন। তোমাকে পাসপোর্ট-ভিসা চাইছিলেন। তুমি দেখালেই পারতে!
কেন দেখাব? প্রদোষ ভারতীয় নাগরিক। আমি তার বিবাহিতা স্ত্রী। প্রশ্নই ওঠে না।
কিন্তু তুমি তো আমাকে বলেছ তোমার পাসপোর্ট-ভিসা আছে। তাছাড়া এবিষয়ে আইনটি জটিল।
ক্লারা আরও আস্তে বলল, দেখতাম শেষ পর্যন্ত। কিন্তু প্রদোষ যখন বলল, সে স্থানীয় আইনসভার সদস্যের আত্মীয়, তখন পুলিশ অফিসার লোকটি চুপ করে গেল।
ক্লারা, আরও একটু আশ্চর্য!
কই, কই! আমি দেখতে চাই। সে কর্নেলের কাছ ঘেঁষে দাঁড়াল।
একটা কুকুর। কর্নেল আঙুল তুলে দেখালেন।
কুকুরটা সাঁতার কেটে এসে দু ঠ্যাং বাড়িয়ে দিল। তারপর কয়েকবার চেষ্টার পর ডাঙায় উঠল। গা ঝাড়া দিল বারবার। তারপর সামনে তাকিয়ে বংকুবিহারীকে দেখেই মুখ তুলে ঘেউজাতীয় শব্দ করল। বংকুবিহারী আন্যমনস্ক ছিলেন নিশ্চয়। উঠে তাড়া করার ভঙ্গি করলেন। তখন কুকুরটা লেজ গুটিয়ে স্তূপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল।
ক্লারা বলল, আমার ভয় করছিল, যদি পুলিশ অফিসার গুলি করেন হতভাগ্য কুকুরকে!
কুকুরটি ঘোরাপথে ঘুরে কর্নেল ও ক্লারার খুব কাছে এসে পড়ল। তারপর সম্ভবত ক্লারাকে দেখে, তার পায়ে বৈদেশিক ঘ্রাণ থাকা সম্ভব, ঘেউ ঘেউ করতে থাকল। ভঙ্গিটি মারমুখী। ক্লারা হাসতে হাসতে আদুরে গলায় বলল, অমন করে না! প্রিয় কুকুর, তুমি কি ভাবছ আমি তোমার শত্রু? আমি তোমার বন্ধু।
বংকুবিহারী ঘুরে দেখছিলেন। গর্জন করে বললেন, কর্নেল! বজ্জাতটাকে তাড়িয়ে দিতে পারছেন না? নাকি আমি যাব?
কর্নেল হাত তুলে বললেন, না না। আমি দেখছি। আপনি ইউনিফর্ম শুকিয়ে নিন। রোদ্দুরটা এখনও কিছুক্ষণ থাকবে মনে হচ্ছে।
কর্নেল এগিয়ে গেলেন কুকুরটার দিকে। কুকুরটা পিছু হটতে থাকল। তারপর তার চাচামেচি থেমে গেল। সে লেজ নাড়তে নাড়তে আরও পিছু হটতে হটতে দরগা-সংলগ্ন জরাজীর্ণ ঘরদুটোর কাছে গিয়ে জোরে গা-ঝাড়া দিয়ে ভেঙেপড়া আরেকটা ঘরের বারান্দায় গিয়ে বসে পড়ল।…
.
অন্ধ দরবেশের আস্তানা
ডিবির ঠিক মাঝখানে বর্গাকৃতি খোলামেলা একটা প্রাঙ্গণ। প্রাঙ্গণে একটা উঁচু বিলি কবর। কবরটি কালো পাথরের, কিন্তু সেটি বিরাট, অন্তত চার ফুট উঁচু ইটের চতুষ্কোণ স্তম্ভের মাথায় রয়েছে। স্তম্ভের ফাটলে-ফাটলে প্রচুর উদ্ভিদ, প্রচণ্ড সবুজ ও প্রাণবন্ত। কবরের ধারে চারদিকেই অসংখ্য ক্ষুদে মাটির ঘোড়া, বিমূর্ত–দিশি ভাস্কর্য সেগুলি। এটিই খোঁড়া পিরের দরগা। নিচেও কয়েকটি লাইমর্কংক্রিটের কবর আছে। সেগুলি দরগার সেবায়েত খাদিমদের। একসময় প্রাঙ্গর্ণের চারদিকেই একতলা ইটের ঘর ছিল। মুসাফিরখানা বলা হত। দূর দূরান্তের ভক্তদের রাত্রিবাসের জন্য ঘরগুলি কোনো মুসলিম শাসক তৈরি করেছেন। পশ্চিমের দুটি ঘর এখনও অক্ষত। কারণ মেরামত করা হয় প্রতি বছর। সেই ঘরের একটিতে থাকেন বর্তমান খাদিম, কালো আলখেল্লা, লুঙ্গি ও পাগড়িপরা প্রকাণ্ড চেহারার লোক, চোখে কালো চশমাপরা, তাঁকে স্থানীয় লোকেরা বলে কানা দরবেশ। তিনি নাকি কথা বলেন না মাঝে মাঝে, সেটা তার মৌনব্রত! জীর্ণ একটি গালিচায় বারান্দায় বসে আছেন, হাতে ফুট তিনেক লম্বা, চ্যাপ্টা ও ভারি চিমটে। চিমটেটি লোহার। গোড়ার দিকটায় পেতলের অনেকগুলি আংটা। বুকে চিমটেটি ঠুকছেন এবং ঝুমঝুম শব্দ হচ্ছে। একটু-একটু দুলছেন সারাক্ষণ। গলায় কয়েকটা লাল-নীল-সবুজ পাথরের মালা। মাজে মাঝে তিনি হাঁক ছাড়ছেন, চুল্ল! চুল্লুর সাড়া না পেয়ে বলছেন, বেতমিজটা আবার পালিয়েছে। বাবারা, মায়েরা! আপনারা আমার মেহমান। কিন্তু চুল্লু না এলে আপনাদের কিছু খাওয়াতে পারব না।
কেউ খাওয়ার কথা বলেননি অবশ্য। ক্লারা ও প্রদোষ, না ডাক্তার ব্ৰজহরি কুণ্ডু, না ঘনশ্যাম রুদ্র, না পুঁতি ও চাক্কু, না দারোগা বংকুবিহারী, না হরিপদ বাউল। প্রথমে কিছুক্ষণ সবাই অন্ধ দরবেশের সামনে ও পাশে চুপচাপ বসে তত্ত্ব কথা শুনেছে। তারপর কেউ-না-কেউ বৃষ্টির মধ্যে বা বৃষ্টি থামার সময় ঢিবির চারিদিক ঘুরে জলের অবস্থা দেখে এসেছে। জল ক্রমশ বাড়ছে। প্রতিটি মুখ নিষ্প্রাণ, ক্লারা বাদে। প্রদোষ বিরক্ত ও ক্ষুদ্ধ। সে ক্লারাকে বোঝাতে পারেনি তারা বিপন্ন এবং প্রকৃতির করতলগত।
কর্নেল নীলাদ্রি সরকার মহকুমা শহর নবাবগঞ্জে তার সামরিক জীবনের বন্ধু। ক্যাপ্টেন সদাশিব চৌধুরীর বাড়ি এসেছিলেন। আসার পথে এই ঢিবিটি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ক্যাপটেন চৌধুরীর কাছে ঢিবিটির কথা প্রসঙ্গক্রমে তোলায় তিনি বলেন, আর্কেওলজিক্যাল সার্ভে দফতরে বহুবার চিঠি লিখেছি, খুঁড়ে দেখুন আপনারা। এই মাউন্ডটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। গত বছর দুজন ভদ্রলোক এসে দেখেও যান। তারপর কী হয়েছে জানি না। তবে ওখানে একজন পিরের দরগা আছে শুনেছি। একজন অন্ধ দরবেশ থাকেন শুনেছি। তাঁর নাকি বুজরুকি ক্ষমতা আছে। ইচ্ছে করলে দেখে আসতেও পারেন। তবে আমার সময় হবে না, দুঃখিত। দেখতেই তো পাচ্ছেন, কী অবস্থা চলেছে!
ক্যাপ্টেন চৌধুরী আর্মিতে সার্জেন ছিলেন। এখন বিনাপয়সায় রোগী দেখেন এবং প্রি হেলথকেয়ার ইউনিট গড়েছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা সাহায্য করে তাকে।
কর্নেল খোঁড়া পিরের দরগায় পৌঁছন সকাল দশটায়। তখন বৃষ্টি ছিল, দুপাশের মাঠে ধানক্ষেতের ডগা দেখা যাচ্ছিল, তবে পিচরাস্তায় জল ওঠেনি, বাস চলছিল। পিচরাস্তা থেকে বিশ গজ দূরে ঘনজঙ্গলে ঢাকা ঢিবিটিতে উঠে ধ্বংসাবশেষ দেখে কর্নেল একটি প্রাচীনতা অনুভব করেন। তারপর বিধ্বস্ত, পাথরের ফটক পেরিয়ে অন্ধ দরবেশের কাছে যান। দরবেশের মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি, তবু বয়স অনুমান করা কঠিন। অন্ধদের স্মরণশক্তি স্বভাবত তীক্ষ্ণ। দরবেশ বলে ওঠেন, বাবা, আপনি যেই হোক, শিগগির চলে যান! বান আসছে। চারদিক ডুবে যাবে।
কর্নেল অবাক হয়ে বলেন, কীভাবে বুঝলেন বান আসছে!
চুল্লু বলে গেল।
কে সে?
আছে একজন। আপনি শিগগির চলে যান।
কর্নেল দরবেশের সামনে একটা পাঁচ টাকার নোট রেখে বলেন, সেলামি নিন দরবেশসায়েব!
কত দিচ্ছেন? দরবেশ হাত বাড়িয়ে ঠিকই টাকা তুলে নিয়ে বলেন, পাঁচ টাকা!
কিছু কথা আছে, দরবেশসায়েব!
শিগগির বলুন। বান আসছে। চুল্লুও আবার এসে পড়বে। বিপদ হবে আপনার।
চুল্ল কে?
দরগার দক্ষিণে তার কবর আছে।
বুঝলাম। কে ছিলেন তিনি– মানে যখন বেঁচে ছিলেন?
এই জায়গার মালিক। নাম ছিল শাহ্ ফরিদ। লোকে বলত চুল্লু খান। সে প্রায় দুশো বছর আগের কথা।
আপনি এখানে কতদিন আছেন?
তা একশো সত্তয়া-শো বছর হয়ে গেল প্রায়।
আপনার বয়স কত?
বলব না। আপনি চলে যান। বান আসছে। দেরি করলে আর যেতে পারবেন না।
কর্নেল এবার একটি দশ টাকার নোট দরবেশের সামনে রেখে বলেন, সেলামি, দরবেশসায়েব! আমি একটা দিন আপনার কাছে কাটাতে চাই। ধর্মকথা শুনতে চাই।
দরবেশ নোটটি তুলে নিয়ে বলেন, আরও দশ দিতে হবে।
নিন।
দরবেশ মোট পঁচিশ টাকা পেয়ে আলখেল্লার ভেতর চালান করে বলেন, আপনার নিবাস?
কলকাতা।
নাম?
কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।
দরবেশ হাসলেন। সঙ্গে খাবার-দাবার আছে, নাকি আমার সঙ্গে খাওয়া দাওয়া করবেন? শুধু খিচুড়ি খেতে হবে। খাবেন?
চুল্লু খানকে বললে বেঁধে দেয় না?
তা দেয় মাঝে মাঝে। তবে ও বড় বেতামিজ। দরবেশ উঠে দাঁড়ান। আপনি এই সতরঞ্জি বিছিয়ে বসুন। বলে তাক থেকে সঠিকভাবে হাত বাড়িয়ে একটা বিবর্ণ ছেঁড়া সতরঞ্জি টানেন। ধপাস করে ফেলে দেন কর্নেলের সামনে। তারপর বলেন, চা খাবেন? চা চিনি দুধ সব মজুত আছে। বাথান আছে নদীর ওদিকে। আধসের করে দুধ দিয়ে যায় গয়লারা। পিরবাবার মানত চিরকাল।
চিরকাল শব্দটা জোরের সঙ্গে উচ্চারণ করে অন্ধ দরবেশ তালা খুলে ঘরে ঢোকেন। ঘরের ভেতর কোনো জানালা নেই। অন্ধকার ছমছম করছিল। দরবেশ বেরিয়ে আসেন একটি কেরোসিন কুকার নিয়ে। বারান্দার তাকে কেটলি ছিল। একটা বাঁশের চুপড়িতে মাটির ভাঁড় ছিল অজস্র। বারান্দার কোনায় গর্তের ভেতর বসানো ছিল একটা মাটির জালা। তাতে জল ছিল। কর্নেল প্রশ্ন করে জেনে নেন, যারা মানত দিতে আসে, তারা একঘড়া করে জল আনে। এই জালায় ঢেলে দেয়। এটা একটা নিয়ম। এতে বেশি পুণ্য হয় মানুতে ভক্তদের।
চা, চিনি, চাল-ডাল-আনাজপাতি-তেলমসলা সবই ভক্তদের দান। একজন অন্ধ লোক এভাবে বেঁচে আছেন এবং তাঁর শরীরটিও নধর, কর্নেল খুব অবাক হয়ে যান। অন্ধ দরবেশ চমৎকার চা করতে পারেন। চা খেতে খেতে মারফতি তত্ত্বকথা এবং মাঝে মাঝে চুল্লুর প্রেতাত্মার দুষ্টুমির বিবরণ শুনতে শুনতে কর্নেল একসময় বলেন, আমি দেখে আসি বান এল নাকি। আপনি এবার খিচুড়ি রান্না করুন! বারোটা বাজে প্রায়।
কর্নেল ঢিবির চারদিকে সত্যি বানের জল দেখে একটু অস্বস্তি অনুভব করেন। কিন্তু আর কিছু করার নেই। জায়গাটা তার ভাল লেগেছে। এই ঐতিহাসিক ধ্বংসাবশেষ, জঙ্গল, অন্ধ দরবেশ, চুল্লুর প্রেতাত্মা প্রভৃতির সঙ্গে চারদিক থেকে জলের উপচে-ওঠা তার জীবনে আরও একটি রোমাঞ্চকর সংযোজন ঘটাবে। ফিরে গিয়ে দেখেছিলেন খিচুড়ি তৈরি এবং দরবেশ তার প্রতীক্ষা করছেন। বলেছিলেন, একদণ্ড দেরি করলে চুল্লু এসে খেয়ে নিত। আসুন, বসে পড়ুন।…
.
সূর্যাস্তের আগে একঘণ্টা
রোদ্দুর দেখে লোকগুলি ছত্রভঙ্গ হয়েছিল, শাওনি বাদে। শাওনি দরবেশের সামনে চুপচাপ বসে ছিল। ঘনশ্যাম রুদ্রের পরনে এখন ধুতি ও পাঞ্জাবি, খালি পা। বংকুবিহারী দারোগাকে দেখার পর থেকে তাঁর প্রচণ্ড উদ্বেগ, তবে বংকুবিহারী তাকে কখনও দেখেননি। তুব পুলিশের স্বভাব। নামধাম জিগ্যেস করায় বলেছেন, হর্ষনাথ নন্দী। বাড়ি কোনো এক কেশবপুরে নদীয়া জেলায়। পেশা শিক্ষকতা। বাসে চেপে নবাবগঞ্জ থেকে ফিরছিলেন। নবাবগঞ্জে তার এক পিসতুতো দাদা থাকেন। জনৈক হোমিওপ্যাথ ডাক্তার, নাম হর্ষনাথ বটু। বটু? এ আবার কেমন পদবি? এমন পদবির কথা তো শোনেননি বংকুবিহারী।
পশ্চিমের ঢালে রোদ্দুর পড়েছে, সেদিকে গিয়ে বংকুবিহারীকে ইউনিফর্ম শুকোতে দেখে ঘনশ্যাম হাত তিরিশেক তফাতে একটা ঝোপের আড়াল খুঁজে নিয়েছেন। ভিজে লুঙ্গি ও গেঞ্জি শুকোচ্ছেন।
ডাঃ ব্ৰজহরি কুণ্ডু রাগ করে সি ভিটামিন ট্যাবলেট দ্বিতীয়বার মুখে গুঁজে চুষতে চুষতে রোদ্র নিতে গিয়ে বাঁয়ে বংকুবিহারী এবং ডাইনে ঘনশ্যামকে দেখে মাঝামাঝি একটা জায়গা বেছে নিলেন, যেটা টিপি থেকে ঝরনার মতো জলস্রোত নেমে যাওয়ার রাস্তা, তার পাশে একটা চাঙড়। স্রোতরেখাঁটিতে নুড়ি ও ইটের গুঁড়ো। তার মনে হল, ঝরনার পাশে বসে আছেন। তার বর্ষাতি, টুপি ও ডাক্তারি পেটমোটা বাকসো অথবা ব্যাগটি দরবেশের ঘরের বারান্দায় আছে।
ঘনশ্যাম থেকে অনেকটা তফাতে পুঁতি ও চাক্কু একটা প্রকাণ্ড এবং কাত হয়ে পড়া হিজলগাছের ডালে পাশাপাশি বসল। চাক্কু পুঁতির কাঁধে হাত রাখলে পুঁতি ঝটপট এদিক-ওদিক তাকিয়ে নিল। তারপর আস্তে বলল, কী হবে বলো তো?
প্রদোষ ক্লারার টানে বেরিয়ে এসে দরবেশের ঘরের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল। দুজনেই চুপচাপ। তবে ক্লারা হাস্যমুখী।
কর্নেল সবাইকে সাপ সম্পর্কে সাবধান করে দিয়েছেন। তাই প্রত্যেকে মাঝেমাঝে পায়ের কাছে বা আশেপাশে তাকিয়ে নিচ্ছে, যদিও দরবেশ বলেছেন, বাবার দরগায় সাপ কখনও দংশ্যাবে না। কর্নেল আবার তিনদিকে চক্কর মেরে চতুর্থ দিক পশ্চিমের রোদ্দুরে পা বাড়ালে কুকরটি তাঁর সঙ্গ নিল। কুকুরটি রোগা ও নেড়ি, হাল্কা বাদামি রঙের। কর্নেল তাকে শিস দিয়ে কাছে ডাকলে সে লেজ নাড়তে নাড়তে কাছে গেল। কর্নেল জ্যাকেটের পকেট হাতড়ে দৈবাৎ কয়েকটা চকোলেট পেয়ে গেলেন। একটা চকোলেট মোড়ক খুলে মুখে গুঁজে দিতে গেলে কুকুরটা পিছিয়ে গেল। তখন সামনে ফেলে দিলেন। তখন কুকুরটা সেটা শুঁকে দেখে মুখে নিল এবং চিবুতে থাকল। কুকুরটি ক্ষুধার্ত।
এই সময় কোথায় পিড়িং পিড়িং শব্দে একতারা বেজে উঠল। কর্নেল শব্দের দিকে ঘুরে দেখলেন, হরিপদ বাউল বংকুবিহারীর কাছে মর্যাদাজনক দূরত্ব রেখে নিচু একটা চাঙড়ে বসে আছে। বংকুবিহারী সম্ভবত তাকে গান গাইতে বললেন। কারণ তারপর বাউলটি ঘুমঘুম স্বরে গান গাইতে থাকল।
কর্নেল! কর্নেল! ব্ৰজহরি ডাক্তার তাকে ডাকছিলেন চাপা স্বরে। তিনি কর্নেলের ঠিক নিচেই।
কর্নেল তার কাছে গেলেন। কুকুরটি দুঠ্যাঙ ভাঁজ করে এবং দুঠ্যাঙ সোজা রেখে চকাস চকাস শব্দে চকোলেট চুষছিল অথবা কামড়াচ্ছিল। কর্নেল ব্ৰজহরির কাছে গেলে ব্ৰজহরি ইশারায় তাকে বসতে বললেন। একটা মোটা শেকড় বেরিয়ে এসেছে ঢালু মাটি খুঁড়ে। মসৃণ ভিজে শেকড়। কর্নেল শেকড়টাতে বসলে ব্ৰজহরি চাপা স্বরে বললেন, একটা সিরিয়াস ব্যাপার ঘটেছে, জানেন?
কর্নেল একটু হাসলেন। কী?
আমাদের মধ্যে একজন প্রসটিটুট আছে।
বলেন কী! কে?
ব্ৰজহরি আরও গোমড়ামুখে বললেন, যে মেয়েটা সবশেষে এল। মানত দিল।
কর্নেল নির্বিকার মুখে বললেন, শাওনির কথা বলছেন?
ব্ৰজহরি খুব অবাক এবং প্রায় মূৰ্ছিত হবার ভঙ্গিতে বললেন, চেনেন নাকি ওকে! কী অদ্ভুত কথা!
কর্নেল হাসলেন। …দারোগাবাবু সবাইকে নামধাম জিগ্যেস করছিলেন, তখন শুনেছি।
আমি মশাই শুনিনি! ব্ৰজহরি ভরাট গলায় বললেন। পুলিশের দিকে তাকাতেও আমার খারাপ লাগে।
তাহলে আপনি কীভাবে জানলেন শাওনি প্রসটিট্যুট?
ব্ৰজহরি ফিসফিস করে সাপের গজরানির মতো বললেন, ওই রিকশোওলা ছোকরাটা– ওকে চিনি, ওর রিকশোয় বহুবার চেপেছি, কিছুক্ষণ আগে আমাকে বলেছে, ডাক্তারবাবু মেয়েটা বেশ্যা। বুঝলেন না? রিকশাওয়ালারা ওদের চেনে। চেনা স্বাভাবিক কি না বলুন?
কর্নেল স্বীকার করলেন। খুবই স্বাভাবিক! বলে আধপোড়া চুরুটুটি পকেট থেকে বের করে লাইটার জ্বেলে ধরালেন। কুকুরটা নেমে এসে তাঁর পায়ের কাছে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ডাক্তারবাবুর দিকে দাঁড়িয়ে রইল। ব্ৰজহরি গুমোটমুখে মাথানিচু করে ঘাস কুচি করছিলেন। সেই অবস্থায় বললেন, একটা কথা ভাবছি। ভীষণ খারাপ লাগছে ভাবতে।
কী কথা, ডাক্তারবাবু?
শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে মাথা নিচু রেখে ব্ৰজহরি বললেন, রিলিফের নৌকো যদি বেরোয়, এ তল্লাটে আসবে না। কারণ এটা মাঠের মধ্যিখানে। এটা গ্রাম নয়, দরগা। দরগা ডোবার চান্স নেই যে দরবেশবাবাকে উদ্ধার করতে হবে। কাজেই একমাত্র ভরসা, যদি দরবেশবাবার কোনো ভক্ত তার খোঁজ নিতে আসে! কিন্তু প্রব্লেম হল, এ তল্লাটে তালডোঙারই রেওয়াজ। জেলেরাও তালডোঙা ব্যবহার। করে। কাজেই
ব্ৰজহরি থেমে গেলে কর্নেল বললেন, হুঁ বলুন!
তালডোঙ্গা বিপজ্জনক। মাত্র একবার চাপতে হয়েছিল রোগী দেখতে। গিয়ে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা! ব্ৰজহরি মাথা নিচু রেখে আরেকটা ঘাস ছিঁড়ে বললেন, কিন্তু তার চেয়ে ভয়াবহ একজন বেশ্যার সঙ্গে এখানে থাকা। দরগার মাটি পর্যন্ত দূষিত হয়ে গেছে, আমি টের পাচ্ছি! .একটু পরে ফের বললেন, আর ওই পুলিশ! সেও কম বিপজ্জনক নয়। বিশেষ করে কাঁদরা থানার ওই অফিসারটির সম্পর্কে অনেক খারাপ কথা শুনেছি। ভীষণ দুর্নীতিপরায়ণ– ভীষণ! আপনি জানেন, আমার নামে কারা পিটিশন করেছিল হাসপাতালের ওষুধ নিয়ে চোরাকারবার করি বলে? তারপর ওই লোকটা এল। বলল, রফা করে নিন।
করলেন, নাকি করলেন না?
মুখ তুলে অদ্ভুত এবং নিঃশব্দ হাসলেন ডাক্তার ব্রজহরি কুণ্ডু। আমি রফা করব? গরিবের ডাক্তার বলে আমার প্রচণ্ড জনপ্রিয়তা আছে– আমি কেন রফা করব? পাল্টটা পিটিশন গেল। উল্টেট দারোগাবাবুরই ট্রান্সফার হয়-হয় অবস্থা! এসে হাতে ধরে বলেই কুকুরটিকে দেখতে পেয়ে ব্ৰজহরি হ্যাঁৎ হ্যাঁৎ শব্দে হাত নাড়তে থাকলেন।
কুকুরটি দাঁত বের করে ধমকাল। ব্ৰজহরি রেগে গিয়ে এবং আতঙ্কে ঝরনারেখাঁটি ডিঙিয়ে চলে গেলেন এবং অনিবার্যভাবে পড়লেন বংকুবিহারীর কাছে। হরিপদ বাউল ঝুমঝুম সুরে গান গাইছিল। বংকুবিহারী সহাস্যে বললেন, বসুন ডাক্তারবাবু! বড় ভাল গায়-তাই না?….
ক্লারা পা বাড়ালে প্রদোষ ফুঁসে উঠল, ক্লারা! হোয়াট ডু ইউ থিংক ইউ আর গোয়িং টু ডু?
ক্লারা ঘুরে মিষ্টি হেসে বলল, তুমি ইংলিশ বোলো না! খারাপ লাগে। তাছাড়া আমার মাতৃভাষা কী তুমি জানো। একথা ঠিক, আমার পরিবার যুদ্ধের সময় জার্মানি ছেড়ে আ্যামেরিকা গিয়েছিল। আমার পরিবার সেজন্য ইংলিশ বলে। আমিও বলতাম। কিন্তু এখন আমি ভারতীয়। কারণ আমি তোমার স্ত্রী।
প্রদোয হাসবার চেষ্টা করে বলল, ভারতীয় বলে কিছু নেই!
ঠিক। আমি বাঙালি। বলে ক্লারা হাসতে হাসতে নেমে গেল ঢাল বেয়ে। সে একেবারে জলের ধারে গিয়ে একটুকরো পাথরের স্ল্যাবে বসল। পা দুটো জলে রাখল। জল নিয়ে খেলতে থাকল।
প্রদোষ একটু দাঁড়িয়ে থেকে পেছনের ভাঙাচোরা ঘরগুলোর ভেতর দিয়ে প্রাঙ্গণে চলে গেল। একটা ভিজে কবরের ওপর বসে সিগারেট ধরাল। একটু পরে ঘুরে দেখল, মানত দিতে আসা কেমন-চেহারার মেয়েটি তার দিকে এগিয়ে আসছে। প্রদোষ চুপচাপ সিগারেট টানতে থাকল।
শাওনি এসে তার সামনের একটা কবরে নিঃসঙ্কোচে বসে একটু হাসল। …বাবু, আপনার মেমবউ কোথায়?
প্রদোষ তাকাল। কেন?
আমাকে একটা সিগারেট দেবেন?
প্রদোষ ভুরু কুঁচকে তাকাল।
শাওনি হাত বাড়িয়ে বলল, দিন না বাবু একটা সিগারেট! তখন থেকে সিগারেটের গন্ধ শুঁকে মাথা খারাপ। দিন না!
প্রদোষ তাকে দেখতে দেখতে বলল, কোথায় থাকো তুমি?
নবাবগঞ্জেতে। আমার নাম শাওনি। শাওনি বারবধূর হাসি হেসে বলল। ভিজে কাপড় গায়ে শুকিয়ে গেল। ভেতরটা ঠাণ্ডা হিম। আহা, দিন না একটা– আচ্ছা, আপনার মুখেরটা দিন!
প্রদোষ হাসল।…তুমি সিগারেট খাও?
খাই। বলে শাওনি দুহাত তুলে এলিয়েপড়া ভিজে চুল ঝাড়ার ভঙ্গি করার পর খোঁপা বাঁধতে থাকল। সে ইচ্ছে করেই বুক দেখাল। তারপর ব্লাউজে হাত রেখে বলল, এম্মা! এখনও ভিজে ন্যাতা হয়ে আছে। করছি কী। আমার যে নিমুনি হবে! সে প্রদোষের চোখের সামনে ব্লাউজটি খুলে ফেলল, শাড়িটা আড়াল করার ছলও করল, এবং বেশ্যারা যা করে থাকে!
প্রদোষ তাকে গিসারেট দিলে সে বলল, এম্মা! ধরিয়ে দিন! কী মানুষ আপনি! উঁহু খামোকা লাইটার জ্বেলে কী হবে? হাতেরটাতে ধরিয়ে দিন।
প্রদোষ এদিক-ওদিক তাকিয়ে নিয়ে জ্বলন্ত সিগারেটটা বাড়িয়ে দিল। শাওনি দুহাত চেপে ধরে ঝুঁক এল। প্রদোষ শিহরিত হল। নিজের ইচ্ছা ও সংস্কারের বিরুদ্ধে এ শিহরন জৈব। সিগারেট ধরিয়ে নেবার সময় বারবধূটির দুটি চোখ তার দিকে নিবদ্ধ, এতে প্রদোষের শরীর কেঁপে উঠল। আস্তে বলল, তুমি কে?
শাওনি হাত ছেড়ে দিয়ে সিগারেট টেনে ধোঁয়ার মধ্যে বলল, শাওনি।
ধোঁয়া প্রদোষের মুখের দিকে ছুঁড়েছিল। প্রদোষের শরীর ভারি হয়ে গেল। এবার সে মেয়েটিকে বুঝতে পারল। লজ্জিত ও বিব্রত হল। সে ঝটপট উঠে। দাঁড়াল। আচ্ছন্ন অবস্থায় ভাঙা দেউড়ির দিকে হাঁটতে থাকল। ক্লারা আছে পশ্চিমে, যেখানে রোদ্দুর। প্রদোষ চলেছে পূর্বে তূপের ভেতর একফালি পায়েচলা রাস্তায়। একটা প্রকাণ্ড গাছের তলায় পৌঁছে সে ঘুরল। দেখল শাওনি তার দিকেই আসছে। কাছে এলে প্রদোষ শক্ত গলায় বলল, কী চাই?
সাওনি হাসল। বাবু, দশটা টাকা দিন না!
প্রদোষ মাথা ঠাণ্ডা রেখে বলল, নেই।
আহা, দিন না! আপনার অনেক টাকা আছে, আমি জানি!
তুমি কে, আমি বুঝতে পেরেছি।
সাওনির কোমরে ব্লাউজটা গোঁজা। একটা স্তন খোলা। বাঁকা হেসে প্রদোষের মুখের ওপর ধোঁয়া ছেড়ে বলল, কৈ, দিন। বেশি না, দশটাকা।
প্রদোষ জৈবতাবশে ক্রুদ্ধ, কিন্তু সংস্কারবশে বিব্রত, শেষে হাত তুলে বলল, আর একটা কথা বললে থাপ্পড় খাবে!
তার আগেই আমি চাঁচাব। হাসতে লাগল শাওনি। চেঁচিয়ে লোকগুলোকে জড়ো করব। আপনার মেমবউ এসে শুনবে। সেটা কি ভাল হবে?
প্রদোষের ভেতরটা হিম হয়ে গেল। গলার ভেতর বলল, তুমি আমাকে ব্ল্যাকমেল করছ! এখানে একজন পুলিশ অফিসার আছেন।
শাওনি একটুও দমে গেল না…পুলিশটুলিশ দিয়ে কিছু হবে না। আপনার মেমবউ জেনে যাবে–
প্রদোষ গর্জনের চেষ্টা করল। …সে বিশ্বাস করবে না এসব কিছু! সে আমাকে জানে।
শাওনি আরও হাসল। মেম হোক আর যাই হোক, মেয়েমানুষ। আমিও মেয়েমানুষ। মেয়েমানুষ কী আমি জানি। কৈ, ছাড়ুন, দেরি করবেন না।
প্রদোষ শেষ চেষ্টার মতো বলল, দেব না।
শাওনি ব্লাউজটা ফড়ফড় করে ছিঁড়ে ঝটপট গায়ে ঢোকাল। কোমরের কাপড় ঢিলে করতে করতে বলল, তাহলে আমি চেঁচাই? তারপর মাটিতে পড়ার ভঙ্গি করল।
প্রদোষ দ্রুত প্যান্টের পেছনপকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে দশটা টাকা ওর হাতে গুঁজে দিল। সে কাঁপছিল। জীবনে একবার এমন অবস্থায় পড়েছিল। সেটা সানফ্রানসিসকোতে মার্কেট স্ট্রিট নামে একটা রাস্তার গলিতে। মেয়েটি অবশ্য নিগ্রো ছিল। দশ ডলারের নোটটি নিয়ে বলেছিল, ম্যান! হোয়েন ইউ আর ইন দা মার্কেট স্ট্রিট এরিয়া, ইউ মাস্ট নো হোয়্যার আর ইউ গোয়িং! ঠিক সেইরকম হয়ে গেল। কোথায় যাচ্ছ, আগে জেনেশুনে তবে যাও? নৈলে এরকম, অথবা আরও সাংঘাতিক কিছু। প্রদোষের কপালে ঘাম ফুটল।
টাকাটা কোমরের কাছে গুঁজে শাওনি মিষ্টি হাসল। চাপা স্বরে বলল, বেশি চাইতে পারতাম। চাইলাম না। আপনার মেমবউয়ের খাতিরে। তবে রেট পঁচিশ। রাত্তিরে ইচ্ছে হলে চোখ টিপে জানিয়ে দেবেন।
সে গাছটির কাণ্ডে ঘষে সিগারেট নেভাল। তারপর হাল্কা পায়ে আগাছার জল ভেঙে উত্তরের ঢালের দিকে চলে গেল। প্রদোষ শ্বাস ছেড়ে ভারি পা ফেলে দেউড়ির দিকে এগোল। ভাবছিল, কথাটা পুলিশ অফিসারটিকে জানানো উচিত কি না…।
ঘনশ্যাম রুদ্র আড়চোখে তাকিয়ে দেখছিলেন কর্নেলকে। সায়েবচেহারার ওই শাদা দাড়িওলা বৃদ্ধটির হাবভাব এবং অমায়িক কথাবার্তায় সন্দেহজনক কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। ক্যাপ্টেন সদাশিব চৌধুরি একজন কর্নেলের বন্ধু হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু একটা কিন্তু আটকে যাচ্ছে মাথার ভেতর। কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরোর লোক নয় তো? রিটায়ার্ড মিলিটারি অফিসারদের বহু গুরুত্বপূর্ণ কাজে লাগানো হয়।
এই যে হর্ষবাবু! কর্নেল নেমে এলেন কাছে।
ঘনশ্যাম হাসবার ভঙ্গি করলেন। … আসুন কর্নেলসায়েব! অবস্থা দেখুন। এই আমাদের দেশ!
কর্নেল বাইনোকুলারে চোখ রেখে কিছু দেখার পর একটু তপাতে একটা পাথরের স্ল্যাবে বসলেন।… আপনি ঠিকই বলেছেন। প্ল্যানিং-এর পর প্ল্যানিং। অথচ এই অবস্থা।
সায় পেয়ে ঘনশ্যাম সিরিয়াস হলেন। … সম্ভবত আমূল পরিবর্তন ছাড়া–
বিপ্লব বলুন!
ঘনশ্যাম একটু হাসলেন।…বিপ্লব মানেই তো রক্তক্ষয়! রক্ত দিতে প্রস্তুত থাকা চাই। কে দেবে? আমি ওসবে বিশ্বাস করি না। গঠনমূলক পথেই আমাদের এগোতে হবে।
কর্নেল জলের দিক আঙুল তুলে বললেন, ওই দেখুন গঠনমূলক পথের অবস্থা। জলের তলায়।
ঘনশ্যাম হাসতে লাগলেন। আপনি নিশ্চয় বাঁধটার কথা বলছেন? দোষ তো বাঁধের নয়, যারা বাঁধ বেঁধেছে, তাদের। তারা দুর্নীতিবাজ!
কুকুরটা মাটি শুঁকতে শুঁকতে ঘনশ্যামের খুব কাছে এসে পড়ল এবং তার কাছাকাছি আরেকটা চাঙড়ে একঠ্যাঙ তুলে হিসি করল। ঘনশ্যাম বললেন, এ কী! এটা আবার কোত্থেকে এল?
কর্নেল বললেন, আপনারা যেভাবে এসেছেন।
বেচারা! ঘনশ্যাম প্রণীটিকে দেখতে দেখতে বললেন। তবে আপনি ঠিকই বলেছেন। আমাদের সঙ্গে এখন ওর প্রভেদ নেই, এটাই সান্ত্বনা। আপনি কলকাতার মানুষ। গ্রামের বন্যা হয়তো এই প্রথম দেখছেন। দেখার প্রয়োজন ছিল আপনার জীবনে। একটা অভিজ্ঞতা হল।
কর্নেল হাসলেন। কলকাতাতেও আজকাল বন্যা হয়।
হ্যাঁ, কাগজে পড়েছি। …ঘনশ্যাম একটু ইতস্তত করে বললেন। …একটা কথা মাঝে মাঝে আমার মাথায় আসে। গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতা করি। সামান্য মাইনে পাই। ফলে আমার মধ্যে নানা ক্ষোভ থাকা স্বাভাবিক। আপনি কথাটা দয়া করে অন্যভাবে নেবেন না!
না, না। বলুন আপনি! কর্নেল কুকুরটিকে আরেকটি চকোলেট দিলেন। ঘনশ্যাম ব্যাপারটি দেখে মনেমনে রেগে গেলেন। কিন্তু মুখে হাসি এনে বললেন, আগে দেশে এত ঘন ঘন বন্যা হত না। সেইসঙ্গে ধরুন, এত দাঙ্গাহাঙ্গ মা, খুনোখুনি, এত বেশি নৈরাজ্য, দলাদলি ছিল না। যত দিন যাচ্ছে, তত এসব বাড়ছে। আপনার কি মনে হয় না এসবের পেছনে কোনো চক্রান্ত আছে?
থাকতেও পারে। হয়তো আছে।
নিশ্চয় আছে। ঘনশ্যাম জোর দিয়ে বললেন। আমি সামান্য শিক্ষক। আমার খালি মনে হয়, কোনো বৈদেশিক শক্তি অথবা একাধিক বৈদেশিক শক্তি দেশটাকে বিপর্যস্ত করে ফেলতে চাইছে।
আপনার ধারণা অস্বীকার করা যায় না।
ঘনশ্যাম চাপা স্বরে বললেন, দেশে ইদানিং সায়েব, বিশেষ করে মেমসায়েব এত বেশি সংখ্যায় আসছে কেন? মেমসায়েবরা বউ হয়েও আসছে! তাদের প্রকৃত পরিচয় কী, কে বলতে পারে? তারা সি আই এর চর কি না?
কর্নেল মুখে গাম্ভীর্য ফুটিয়ে বললেন, আপনি কি ক্লারা সম্পর্কে সন্দেহ করছেন কিছু?
ঘনশ্যাম আস্তে বললেন, আমার ধারণা। মেমসায়েবের শাড়ি পরে থাকা, বারবার সবাইকে বলা : আমি হিন্দু, আমি ভারতীয়! কী মানে হয় এর, আমার মাথায় তো ঢুকছে না!
কর্নেল একই গাম্ভীর্যে বললেন, আপনি ঠিকই বলেছেন। তবে আমরা যদি ইউরোপীয় সেজে থাকতে পারি, ইওরোপীয়রা এদেশে এসে ভারতীয় সেজে থাকলে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছুনো
বাধা দিয়ে ঘনশ্যাম বললেন, দুটোর মধ্যে তফাত আছে। আপনি যাই বলুন, মেমসায়েব বাঙালি বউ হয়ে সিঁথিতে সিঁদুর পরে পুজো দেখতে যাবে, এটা বাজে কৈফিয়ত। দারোগাবাবু লোকটি বদমেজাজি। নৈলে আমি তখনই– মানে, পাসপোর্ট-ভিসা দেখতে চাওয়ার সময় ওকে ইনসিস্ট করতাম। করলাম না। কারণ পুলিশও তো ধোয়া তুলসীপাতা নয়। যাই হোক, এ বিষয়ে আপনার একটা কর্তব্য আছে বলে মনে করি। কারণ আপনি মিলিটারিতে ছিলেন। আপনি একজন প্রাক্তন সৈনিক। আপনি ইনসিস্ট করুন। দেখবেন, ওই ট্যাশ ছোকরারও প্রকৃত তথ্য বেরিয়ে আসবে। ওরা দুজনে মৌরীনদীর বাঁধে ডিনামাইট চার্জ করে বাঁধটাকে বুঝলেন তো?
কর্নেল শুধু বললেন, হুম! তারপর উঠে দাঁড়ালেন। কুকুরটিও পা বাড়াল।
ঘনশ্যাম ডাকলেন, শুনুন! আরও একটা কথা আলোচনার ছিল।
বলুন!
ঘনশ্যাম করুণ হাসলেন। … আমার ধারণা, প্রত্যেকেরই খিদে পেয়েছে বা পাবে। সে বিষয়ে কিছু করা যায় কি না, আপনিই লিড নিন।
কর্নেল এবার একটু হাসলেন। দরবেশের ঘরে প্রচুর চাল-ডালের স্টক, আছে। ভাববেন না। অবশ্য বেশি টাকা দিতে হবে। চাঁদা করে দেওয়া যাবে। রান্নার জন্য বড় পাত্রও আছে। ভাড়ায় পাওয়া যাবে। আমি কথা বলে রেখেছি। আর একটা কথা
ঘনশ্যাম দ্রুত বললেন, বলুন!
ডাক্তারবাবুর কাছে শুনলাম, সব শেষে যে মেয়েটি এসেছে, সে একজন প্রস। আর ডাক্তারবাবু শুনেছেন রিকশাওয়ালা যুবকটির কাছে! এখন কথা হল, সেও আমাদের সঙ্গে খাবে। আশা করি, আপনার আপত্তি হবে না।
ঘনশ্যাম নির্মল হেসে বললেন, তাতে কী? এই দূষিত সমাজব্যবস্থায় দেহ বেচে যারা খায়, তাদের প্রতি ঘৃণা নেই আমার। বরং সিমপ্যাথি আছে।…
কর্নেল ওপরে উঠে গেলেন। তার একটু পরেই আচমকা শাওনি এসে পড়ল। সে লাফিয়ে লাফিয়ে নামছিল। ঘনশ্যামের পাশ দিয়ে নেমে জলের ধারে গেল। পরিব্যাপ্ত জলে শেষবেলার রোদ ঝিলমিল করছে। ঘনশ্যাম দুঃখিত চোখে তাকে দেখছিলেন। তারপর চাপা শ্বাস ফেললেন।
শাওনি ঘুরে বলল, বাবু, দেশলাই আছে?
ঘনশ্যাম একটু অবাক হয়ে বললেন, না। কেন?
শাওনি আধপোড়া সিগারেটটা দেখাল। তারপর বলল, আপনি খান না সিগারেট?
ঘনশ্যাম মাথা দোলালেন। তার বিস্ময়টুকু, নিজেই টের পেলেন, বাবুজনোচিত সংস্কার। বহুবছর তার কেটেছে সমাজের নিম্নবর্গীয় মানুষজনের সঙ্গে এবং তাদের স্ত্রীলোকেরা ধূমপান করতে অভ্যস্ত। কিন্তু এই যুবতীটিকে তিনি কোন বর্গে ঠাই দেবেন, বুঝতে পারছিলেন না। এর পরনের শাড়িটা, ব্লাউজটা এবং চোখেমুখে যে ঝলমলে ভাব– এমন একটা দুঃসময়েও, ঘনশ্যামের কাছে। বিসদৃশ ঠেকছিল। একমিনিট পরে তিনি নড়ে উঠলেন। মনে পড়ে গেল, এই মেয়েটিই সবার শেষে এসেছে। কর্নেল এর কথাই এইমাত্র বলে গেছেন। হু, এই তাহলে সেই দেহ-বেচে-বেঁচে-থাকা হতভাগিনীটি! ঘনশ্যাম ওর দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
শাওনি বাঁকা হাসল। দাড়িওলা বুড়ো সায়েবকে চুরোট খেতে দেখেছি। আগুন চাইলাম। বলল কী, নিচের বাবুর কাছে যাও। বুড়ো-হাবড়ার কাছে আগুন থাকে? শাওনির বাঁকা হাসি অশালীনতায় ফেটে পড়ল। তা নিচের বাবু। তো এখনও তত বুড়ো হয়নি। সেও বলে, আগুন নেই!
ঘনশ্যাম একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, বাঁচালতা কোরো না! অন্য কারুর কাছে। দেখ গিয়ে।
শাওনি চোখে ঝিলিক এনে বলল, ঠিক আছে। তারপর জলের দিকে আদ্ধেকটা ঘুরে ব্লাউজের বোতাম খুলল। আনমনা ভঙ্গি করে বলল ফের, তুলোভরা বেসিয়ের খানা শুকুতে দিয়েছি আমি। কোন্ নিমেগে লম্পট সেটা জলে ফেলে দিয়েছে। ভাসতে ভাসতে চলে গেল। এখন থাকো খালি বুকে আর লম্পটদের নোলায় জল গড়াক।
এত অশালীনতা সহ্য হল না ঘনশ্যামের। গম্ভীর মুখে বললেন, দেখ মেয়ে, তুমি খুব বেশি বাড়াবাড়ি করছ।
কে, করছে না? শাওনি পা দিয়ে জল ঠেলতে ঠেলতে বলল। দেউড়ির দিকে রাস্তার অবস্থা দেখতে গেলাম, তো ওই যে মেমওলা লোকটা, সে আমাকে জড়িয়ে ধরতে এল!
ঘনশ্যাম ইচ্ছার বিরুদ্ধে হেসে ফেললেন, তবু হাসিটি ঘৃণার। বললেন, ওরা তো ওইরকম। ওদের শ্রেণীধরনই তাই। যাই হোক, তুনি চেঁচামেচি করলেই পারতে! এখানে দারোগাবাবু আছেন!
হুঁ, বড়বাবুও তো বাঘের মতো হাঁ করে আছে। কতবার ইশারা করল, চোখ ঠারল–বাব্বাঃ!
ঘনশ্যাম ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লেন। জানি! ওরাও ওদের প্রভুর নকল করে। তা হ্যাঁ গো মেয়ে, তোমার বাড়ি কোথায় ছিল? তুমি এ পথে এলে কেন? বলো, তোমার জীবনের কথা বলো, শুনি।
ঘনশ্যাম জাঁকিয়ে বসলেন। শাওনি জলের ধার থেকে কাছে এল। এত কাছে যে ভীষণ অস্বস্তি হতে থাকল ঘনশ্যামের। তারপর বারবধূর স্বভাববশে, তাছাড়া এই লোকটিকে যথেষ্ট নিরীহ মনে হয়েছে, শাওনি খপ করে তাঁর পাঞ্জাবির বুকপকেটে হাত পুরে দিল। ঘনশ্যাম হাতটা চেপে ধরলেন এবং বিপথগামিনী এক হতভাগিনীর প্রতি দার্শনিক প্রক্রিয়ায় ছিঃ, করে না এইরকম স্নেহমাখা তিরস্কারের ভঙ্গিতে ঠেলে সরিয়ে দিতে চাইলেন। এর ফলে একটা ধস্তাধস্তি শুরু হল। ঘনশ্যাম বাঁ হাতে তার গালে থাপ্পড় মারতে গেলেন। কিন্তু চতুরা মুখ ঘুরিয়ে নেওয়ায় তার কানের দুলে থাপ্পড়টা পড়ল। দুলের ওপরদিকটা খাঁজকাটা হওয়ার দরুন ঘনশ্যামের হাতের আঙুল ও তালুর সন্ধিতে একটা জায়গা ছড়ে গেল।
এইসময় ওপরদিক থেকে নেমে আসছিলেন ডাঃ ব্রজহরি কুণ্ডু। শেষবেলায় আকাশ পরিষ্কার হয়েছে এবং ঝলমলে রোদ্দুর ফুটেছে। এর ফলে প্রত্যেকেই বিশাল ও প্রশস্ত ঢিবিটার চারদিকে ব্যাকুলতা ও প্রত্যাশায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। প্রত্যেকের অবস্থা খাঁচায় বন্দী বুনোপাখির মতো। এদিকে রোদ্দুর প্রত্যেককে শুকনো করেছে এবং নেতিয়ে পড়া জবুথবু অবস্থাটি শরীর থেকে ঘুচে গেছে।
প্রত্যেকেই স্বাস্থ্য ফিরে পেয়েছে। উদ্ধারের জন্য ছটফট করছে। তাছাড়া বিষাক্ত সাপটার কথাও রটে গেছে, আর এই চুল্লুর প্রেতাত্মা রাতের অন্ধকারের জন্য যে বিভীষিকাটি ওত পেতে আছে।
হরিপদর গান শুনে ব্ৰজহরির অন্তরাত্মা পরিশুদ্ধ। তার মুখে প্রসন্নতার প্রগাঢ় ছাপ। তিনি এই স্কুলশিক্ষককেই খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। দার্শনিক আলোচনার উপযুক্ত দোসর হওয়ার সম্ভাবনা যাঁর। বলতে আসছিলেন, বাউল-টাউলের গানই ভাল। ওদের তত্ত্বকথায় মাথামুণ্ডু নেই। দরবেশসায়েবের ইসলামি সুফিতত্ত্বও এইরকম গোমমেলে। তার চেয়ে বড় কথা, বাউল-টাউল বলুন আর যাই বলুন। মশাই, ওদের ওই সাধনসঙ্গিনী– মানে মেয়েমানুষের ব্যাপারটা ভারি সন্দেহজনক। আপনি ভেবে দেখুন, ব্রহ্মচর্য মানুষকে পরমাত্মার কাছে সরাসরি পৌঁছে দেয়। এজন্যই নারী সম্পর্কে প্রাজ্ঞ মনুর উক্তি হল—
ব্ৰজহরি মনে মনে ঠিক এই কথাগুলি হর্ষনাথ মাস্টারমশাইকে বলতে বলতে নেমে আসছিলেন, কর্নেল একটু আগে তার খোঁজ দিয়েছেন কিন্তু আচমকা চোখে অশালীন দৃশ্যটি ধাক্কা দিল। তিনি থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন। তারপর সম্বিৎ ফিরলে গর্জে উঠলেন, ধিক! ধিক! ধিক আপনাকে হর্ষবাবু!
শাওনি প্রায় চোখের পলকে পাশের ঝোপের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল। ঘনশ্যাম রাগে কাঁপছিলেন। মুখ তুলে ভাঙা গলায় বললেন, আমার ফার্স্ট এইড দরকার। রক্ত পড়ছে। তিনি বাঁ হাতের তালুতে ডানহাতের বুড়ো আঙুল চেপে ধরলেন। বিমর্ষ ও বিপন্ন মুখে ফের বললেন, আপনার কাছে ডাক্তারি ব্যাগ আছে দেখছি! প্লিজ, একটু পট্টি-ফটি বেঁধে দিন।
ব্ৰজহরি বিকৃত মুখে বললেন, আছে। কিন্তু আপনার জন্য কিছুই করব না।
সে কী! ঘনশ্যাম রেগে গেলেন। মানুষের বিপদে-আপদে আপনি ডাক্তার, আপনি–
বাধা দিয়ে ব্রজহরি বাঁকা হেসে বললেন, আপনার লাম্পট্যের শাস্তি আমি এনজয় করতে চাই।
ঘনশ্যাম মুখ নিচু করে রক্তের ফোঁটা দেখতে দেখতে গলার ভেতর বললেন, ঠিক এজন্যই ডাক্তারদের খতম করার স্লোগান দেওয়া হত।
কথাটা না বুঝতে পেরে ব্রজহরি আরও বাঁকা হেসে বললেন, বেশ্যার সঙ্গে প্রেম করছিলেন। প্রেমদংশনে রক্তপাত ঘটেছে।
আপনি আপনি ভুল দেখেছেন! ঘনশ্যাম চড়া গলায় বললেন। মেয়েটা আমার পকেটে হাত ঢুকিয়েছিল!
আরও বাঁকা কথা বলার জন্য নেমে এলেন ব্ৰজহরি…সাহস পায় কোত্থেকে? কৈ আমার পকেটে তো হাত ঢোকাতে আসেনি!
ঘনশ্যাম বললেন, আসেনি আসবে। তখন কী করেন, দেখা যাবে। তাও তো আমি থাপ্পড় মেরেছি!
হা হা করে হাসলেন ব্রজহরি। আর আমি একটা বেশ্যাকে বুকে টেনে নেব! আপনার মতো!
ক্ষোভে দুঃখে প্রায় কেঁদে ফেলার ভঙ্গিতে ঘনশ্যাম বললেন, আমাকে আপনি কী ভেবেছেন? আমাকে আপনি জানেন না। তাই এই সব জঘন্য কথাবার্তা বলতে বাধছে না আমার সম্পর্কে।
জানি বলেই তো আপনার কীর্তি দেখে দুঃখ হচ্ছে!
জানেন? বলুন, কে আমি? চার্জ করলেন ঘনশ্যাম। বলুন, কী জানেন আমার সম্পর্কে?
ব্ৰজহরি নির্বিকার মুখে বললেন, আপনি স্কুল-টিচার বলে পরিচয় দিয়েছেন। আমার সন্দেহ হয়েছিল আপনার হাবভাব দেখে। চোরা চাউনি, জড়োসড়ো বসে থাকা, দূরে-দূরে চলাফেরা, আত্মগোপনের চেষ্টা। কথাটা একবার দারোগাবাবুর কাছে তুলেছিলাম। উনি আমাকে সাপোর্ট করলেন। বললেন, ওয়াচ করবখন।
ঘনশ্যাম ভেতর-ভেতর নেতিয়ে গেলেন। কঁপা কাঁপা স্বরে বললেন, আপনি আমার পেছনে লেগেছেন বুঝতে পারছি। আপনি আমার ওপর নজর রেখেছেন তাহলে! কিন্তু আপনাকে আমি সাবধান করে দিচ্ছে, ভুল করবেন না। প্রয়োজনে আমি স্বমূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করতে পারি।
ঘনশ্যাম বানের জলে রক্ত ধুতে গেলেন। ব্রজহরি একটু দমে গিয়েছিলেন ওই সব কথাবার্তা শুনে। রক্ত ধুতে ধুতে ঘনশ্যাম ঘাড় ঘুড়িয়ে আরক্তিম চোখে তাকে দেখলেন। ওই চাউনি দেখে ভয় পেয়ে গেলেন ব্রজহরি। এই পবিত্র ঢিবিতে ইতিমধ্যে একজন বেশ্যার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এবার একজন খুনে প্রকৃতির লোক, সম্ভবত লোকটি দাগী ক্রিমিন্যাল, আবিষ্কৃত হল। ভারি পা ফেলে ঢাল বেয়ে উঠতে হাঁপ ধরে গেল ডাক্তার ব্রজহরি কুন্ডুর।
একটা স্তূপের আড়ালে পৌঁছে কর্নেলকে সামনে পেলেন। কুকুরটির মুখের ওপর চকোলেট ধরে খেলা করছেন কর্নেল। নেড়ি কুকুরটি মুখ উঁচু করে সেঁতো হেসে দুঠ্যাং সামনে তুলে যেন নৃত্য করছে। কথাটি বলতেন ব্রজহরি। কুকুরটা দেখে রাগ ও ভয় হওয়ায় অন্য পাশে ঘুরে চলে গেলেন। দারোগাবাবুর উদ্দেশেই।…
উপড়ে পড়া হিজলের মোটা ডালটাতে বসে ঝগড়া করছিল পুঁতি চাক্কুর সঙ্গে। ওই বেশ্যা মাগীটার সঙ্গে তোমার চেনা আছে জানলে কক্ষনো তোমার সঙ্গে আসতাম না!
চাক্কু বলল, আহা! কথাটা কিছুতেই বুঝছ না তুমি। রিকশা চালায় যারা, তারা ওদের চিনবে না? সব রিকশোওলা চেনে। বাগানপাড়ার গলিতে রিকশো চাপিয়ে খদ্দের পৌঁছে দেয়। চিনবে না?
পুঁতি গাল ফুলিয়ে বলল, চালাকি কোরো না। আমি বুঝেছি।
চাক্কু রেগে গেল এতক্ষণে। …কলাটি বোঝো তুমি! বেশি রেট পেলে বাগান পাড়ার গলিতে কোন রিকশোওলা ঢুকবে না! আমিও ঢুকেছি। তাতে কী হয়েছে?
পুঁতি চোখ মুছে বলল, একটুও বিশ্বাস করি না। ভাব না থাকলে অমন করে সাবার সামনে চোখঠার দিয়ে হাসতে পারে কেউ! তারপর আমাকে পর্যন্ত চোখঠারে যেন কী বলল!
বাজে বোলো না। ওদের ওই স্বভাব। চাক্কু সিগারেট ধরাল। গুম হয়ে টানতে থাকল।
পুঁতি তবু থামল না।…আমি দুজনের চোখে-চোখে কথা দেখেই বুঝেছি আমার বরাতে কী আছে! আমি কিছুতেই যাব না তোমার সঙ্গে। সাঁতার কেটে গাঁয়ে ফিরে যাব।
চাক্কু খাপ্পা হয়ে বলল, পারিস তো তাই যা! কান পচিয়ে দিলে মাইরি; এত করে বলছি– পিরবাবার থান এটা, সিথেয় নিজের হাতে সিঁদুর পরিয়ে দিলাম, তবু সন্দ! অত যদি সন্দ, তবে চলে যা!
পুঁতি ডাল থেকে মাটিতে পা রাখল। সোজা দাঁড়িয়ে বলল, যাব। যাবার আগে ওই মাগীর রক্ত দেখে তবে যাব!
পুঁতি ঝোপঝাড় ভেঙে বেগে ওপরে উঠে গেল। চাক্কু ঘুরে তার চলে যাওয়া দেখল। তারপর একটু হাসল। তিনক্রোশ পথ পেরিয়ে পুঁতি গাঁয়ে। ফিরতে পারবে না। ফিরলেও দাঁড়াবে কোথায়! ডুবো গাঁ। হারামজাদি মাসি মেরে ভাসিয়ে দেবে বানের জলে। চাক্কু মুখ নামিয়ে নোখ খুঁটতে থাকল।
একটু পরে গায়ে ছায়া পড়লে সে মুখ তুলে দেখল, শাওনি। শাওনি মুখ টিপে হেসে বলল, কী রে চাক্কু? মেয়েটা অমন করে চলে গেল কেন?
চাক্কু দুঃখে হাসল।…তোকে খুন করতে। তুই মাইরি যা করিস– যাঃ!
শাওনি চাপা স্বরে এবং চোখ নাচিয়ে বলল, কোথায় যোগাড় করলি? সত্যিসত্যি বউ?
হুঁ। বউ ছাড়া কে?
শাওনি ওর হাত থেকে সিগারেটটা ছিনিয়ে নিয়ে টানতে টানতে বলল, সিঁথিয় টাটকা সিঁদুর! বৃষ্টিতে জলে সাঁতরে এসেছিল। আর সিঁথিয় টাটকা সিঁদুর! এই দেখ আমার সিঁদুরের অবস্থা! দেখতে পাচ্ছিস?
চাক্কু বলল, শাওনি! ছেনালিপনার জায়গা না এটা। পাছায় এমন লাথি মারব, জলে গিয়ে পড়বি। বাগানপাড়ায় গলিতে যা করার করিস। এখানে নয়।
শাওনি একপা পিছিয়ে ভয় পাওয়ার ভঙ্গি করে বলল, তোকে বিশ্বাস নেই। তাও পারিস! একটা কথা বলব, শুনবি?
চাক্কু তাকাল। কিন্তু চোখে মিটিমিটি হাসি।
শাওনি ফিস ফিস করে বলল, ছুঁড়িটা তোর বউ-টউ না। ভাল খদ্দের আছে, দিবি?
শাওনি! চাক্কু গর্জন করল।
পাঁচশো টাকা পাবি। শাওনি একই সুরে বলল। গাদাকে জিগ্যেস করিস। সে একটা ছুঁড়ি এনেছিল গাঁওয়াল থেকে। এটার চেয়ে পুরুষ্টু। শাওনি সেই মেয়েটির বুকের মাপ দেখাল। পুঁতির বুকের সঙ্গে যে উপমাটা দিল, তা অশ্লীল। তারপর ফিক করে হাসল।…যে খদ্দেরের কথা ভেবে নিয়ে যাচ্ছিস, তাকে আমি চিনি। গুলাই তো? আমার খদ্দের এক বাবু। খুব বড়লোক। একেবারে বোম্বাই চালান করে দেবে তোর গায়ে আঁচড়টিও লাগতে দেবে না।
চাক্কু তার ব্যাগে হাত ভরে একটা কী বের করল। সেটা থেকে বেরিয়ে এল চকচকে ইঞ্চি ছয়েক ফলা। কদর্য গাল দিয়ে বলল, মাগীর গলা কেটে ভাসিয়ে দেব বানের জলে ফের যদি একটা কথা বলেছিস!
শাওনি বাঁকা হেসে বলল, আচ্ছা! দেখা যাবে!
সে হাল্কা পায়ে ঢাল বেয়ে উঠে গেল। চাক্কু শ্বাস ফেলে স্প্রিংয়ের চাক্কুটা বন্ধ করে ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখল! তারপর পুঁতিকে খুঁজতে গেল। তার ভাবনা হচ্ছিল, পুঁতি বিপন্ন।…
বাউল হরিপদ ভুলুণ্ঠিত দণ্ডবৎ করে বলল, দারোগাবাবু! এবার অনুগ্রু করে হরিপদকে ছুটি দিন।
বাউলগান শুনে বংকুবিহারীর মনে উড়ুউড়ু ভাব। মিঠে হেসে বললেন, ছুটি নিয়ে যাবি কোথায় বাবা? চতুর্দিকে তো অথৈ সমুদ্র– কূলকিনারাহীন!
হরিপদ হাসল।…এ সঙ্কটে গুরুই ভরসা দারোগাবাবু! গুরুই উদ্ধার করবেন।
সে একতারাটি পিড়িং পিড়িং করতে করতে উঠে গেল। সূর্য জলের ওপর ঝুঁকে এসেছে। অপার জলে লালচে ছটার ঝিলিমিলি। বংকুবিহারী এতক্ষণে ইউনিফর্ম পরলেন। রিভলবার, বেল্ট ইত্যাদিতে ফের আইনরক্ষকে রূপান্তরিত হলেন। ক্ষিদে পেয়েছে। দরবেশবাবার ঘরে চালডাল থাকা সম্ভব। দেখা যাক।
হঠাৎ খুব কাছ থেকে কেউ ডাকল, দারোগাবাবু, অমনি প্রচণ্ড চমকে অভ্যাসবশে রিভলবারের বাঁটে হাত চলে গেল বংকুবিহারীর। প্রেতাত্মায় তাঁর বিশ্বাস আছে। কেমন নাকিস্বরে ডাক, ভেবেছিলেন চুল্লু। কিন্তু দেখলেন, চুল্ল নয়, একটি মেয়েমানুষ। ভুরু কুঁচকে বংকুবিহারী বললেন, অ্যাই মাগী! লুকোচুরি খেলে বেড়াচ্ছিস কেন?
শাওনি জিভ কেটে বলল, ওম্মা! সে কী কথা! একটা নালিশ করতে এসে গালমন্দ খেলাম!
ছেনালি রাখ। কী নালিশ তোর?
শাওনি খুঁ খুঁ করে কান্নার ভঙ্গি করল।…হতে পারি বেশ্যা! পেটের দায়ে খাতায় নাম লিখিয়েছি। তাই বলে কি মানুষ নই? আপনি এর একটা বিহিত করুন, দারোগাবাবু!
বংকুবিহারী একটু শান্ত হয়ে বললেন, কী হয়েছে?
শাওনি ফুঁপিয়ে উঠল…জামাকাপড় শুকোতে যেখানে যচ্ছি, একলা পেয়ে মিনসেরা আমাকে টানাটানি করছে।
হ্যা হ্যা করে হাসলেন বংকুবিহারী।…তুই কি সতীলক্ষ্মী? তোর হাত ধরে টানল তো কী হয়েছে? পয়সা চাইলেই পারতিস। নালিশের কী আছে এতে? আঁ?
শাওনি চোখ মুছে বলল, হুঁ, পয়সা! তার বেলা নেই কেউ।
ভুরু নাচিয়ে বংকুবিহারী চাপা স্বরে বললেন, নাম বল্ শুনি!
শাওনি বলল, ওই মেমওলা বাবু–তাপরে…
দ্রুত আইনরক্ষক বললেন, বলিস কী!
আপনার দিব্যি। এ পিরবাবার থান।
হ্যাঁ রে, ওর তো জার্মান তরুণী বউ। ওর তোকে পছন্দ হল?
শাওনি ঠোঁট বাঁকা করে বলল, জানেন না, ঘরে সুন্দর-সুন্দর বউ ফেলে লোকে আমাদের কাছে আসে? আসে না বলুন?
বংকুবিহারী ভেবে বললেন, হু। তা সত্যি। তবে ওই ছোকরার ব্যাপারে আমি নাচার। ওর মামা এম এল এ। এঁদে লোক। রাইটার্সে কথা তুললে আরও অখাদ্য জায়গায় বদলি করে দেবে। চেপে যা! আর কে বল্!
শাওনি বলল, ওই যে লম্বা নাক আধবুড়ো লোকটা..
বুঝেছি। স্কুলটিচার– কী যেন নামটা? বংকুবিহারী ফিক ফিক করে হাসতে লাগলেন।…এই বিপদেও মানুষের আদিরিপু মাথা চাড়া দেয়, ভাবা যায় না। মানুষ এক হারামজাদা জীব, বুঝলি? প্রত্যেকটা মনুষ বর্ন ক্রিমিনাল। কেউ পারে, কেউ পারে না এই আর কী! বুঝলি কিছু?
শাওনি বলল, আর ওই পেটমোটা ডাক্তারবাবু!
যাঃ! জিভ কেটে বংকুবিহারী বুটে পা ঢোকালেন এবং চাঙড়ে বসলেন। মোজা শুকোয়নি। তুই এটা একেবারে বানিয়ে বলছিস! ডাক্তার কুণ্ডুকে আমিই চিনি। ধার্মিক মানুষ। বিয়ে পর্যন্ত করেননি।
শাওনি অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, আপনি পুলিশের লোক। কিন্তু আমি বেশ্যা। আপনার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ চিনি।
বংকুবিহারী মোজা দুটো কাঁধে রেখে হাসলেন।…ঠিক আছে। আর?
আর রিকশাওলা ছোঁড়া।
ওর তো সঙ্গে বউ আছে!
বউ ঝগড়া করে দরবেশবাবার কাছে বসে আছে। শাওনি চাপা স্বরে বলল, আমার একটা সন্দেহ হয়েছে। ঘুড়িটাকে ভাগিয়ে নিয়ে বেচতে যাচ্ছে ছোঁড়াটা। জেরা করুন, গুঁতোর চোটে বেরিয়ে পড়বে।
কথাটা মনে ধরল বংকুবিহারীর। ভুরু যথেষ্ট কুঁচকে বললেন, দেখছি।
শাওনি দমআটকানো গলায় বলল, আমাকে ধরে টানাটানি করছিল। শেষে চাক্কু বের কল। ওর ব্যাগে ইপিরিং-এর চাক্কু আছে। এতটা বড়ো!
বংকুবিহারী সিরিয়াস হয়ে বললেন, তখন তুই ওর সঙ্গে শুয়ে পড়লি?
না। বিনি পয়সায় আমি কারুর সঙ্গে শুই না। দৌড়ে পালিয়ে এলাম। আপনাকে নালিশ করতে এলাম।…শাওনি ঠোঁট কামড়ে একটা ভঙ্গি করল, যেন সে ক্রুদ্ধ কিন্তু অসহায়।
বংকুবিহারী হঠাৎ ফিক করে হাসলেন।… হা রে, ওই কর্নেলবুড়ো কিছু বলেনি তো?
শাওনিও হাসল।..বুড়োসায়েবের শরীলে আর আগুন নেই। কুকুর নিয়ে খেলে বেড়াচ্ছে।
বংকুবিহারী উঠে দাঁড়ালেন। পা বাড়িয়ে বললেন, প্রব্লেম হল, তুই একজন বেশ্যা। ওরা তোর বিরুদ্ধে পাল্টটা চার্জ আনলেই মামলা কেঁচে যাবে। তবে ওই রিকশোওলা ছোঁড়াটার কাছে ড্যাগার আছে বললি। সেটা সিজ করে নিচ্ছি। আর শোন, তোর সঙ্গে আমার একটা কথা আছে।
শাওনি কাছে গিয়ে বলল, বলুন!
আইনরক্ষক চাপাস্বরে বললেন, ওই মেমসায়েটার দিকে নজর রাখতে পারবি? ও কী করছে, কার সঙ্গে কী কথা বলছে-টলছে, কিছু আঁকছে-টাকছে কি না…
শাওনি নিঃশ্বাসের সঙ্গে বলল, বুঝেছি।..
ক্লারা পাথরের স্ল্যাবে বসে জলে শাদা পা ছড়িয়ে সূর্যাস্তের প্রতীক্ষা করছিল। পায়ের শব্দে ঘুরে শাওনিকে দেখতে পেল। মিষ্টি হেসে ডাকল, এস তুমি। এখানে বসো। এস এস।
শাওনি একটু তফাতে বসে বলল, দিদি, আপনি আমাদের কথা বলতে পারেন?
কেন পারব না? ক্লারা গর্বিত ভঙ্গিতে বলল। বলছি না? আচ্ছা, এবার বলো, তোমার নাম কী?
শাওনি।
শাওনি কথার মানে জানো তুমি?
হুউ। শ্রাবণ মাসে জন্মে তাই মা নাম রেখেছিল শাওনি।
তুমি খুব ভাল মেয়ে। ক্লারা হাত বাড়িয়ে তার একটা হাত নিল।…তোমার হাতের সঙ্গে আমার হাতের পার্থক্য শুধু রঙের। কারণ আমি বিষুব রেখার বহু দূরে উত্তরে জন্মেছিলাম। তুমি বিষুব রেখার দিকে কর্কটক্রান্তিতে। ও! তুমি কতটা লেখাপড়া করেছ, শাওনি?
আমি লেখাপড়া জানি না। শাওনি মেমসায়েবকে খুঁটিয়ে দেখছিল। তার হাতটাতে অস্বস্তি। গা ঘিনঘিন করা সাদাটে হাত। যেন চামড়াছাড়ানো হাত।
ক্লারা বলল, তুমি কিছু কাজ করো কি? কী কাজ করো?
কিছু না।
ক্লারা হেসে ফেলল। ..বুঝলাম। তোমার স্বামী করে। সে কী করে?
শাওনি ফোঁস করে উঠল। অত কথায় কী কাজ?
ক্লারা হাসতে লাগল। …তুমি হঠাৎ রেগে গেলে কেন? আমি শুনেছি, ভারতের লোকেরা এসব প্রশ্ন শুনলে খুশি হয়। যাইহোক, দেখছি কথাটা ভুল। ঠিকই তো। অন্যের ব্যক্তিগত জীবনে প্রবেশ শিষ্টতা-বহির্ভূত আমি তোমাকে এসব প্রশ্ন আর করব না।
শাওনি হাতটা ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করল। ক্লারা মজা পেয়ে গেল। বলল, তুমি আমাকে দিদি বলেছ। চলো, তোমাকে আমিই মিষ্টান্ন খাওয়াব- তার আগে ছাড়ব না। এবং তুমি নিশ্চয় ক্ষুধার্তও।
ক্লারা তাকে টেনে ওঠাল। শাওনি টের পাচ্ছিল মেমসায়েবের গায়ে জোর আছে। পা বাড়ালো শাওনি। আস্তে বলল, হাত ছাড়ুন যাচ্ছি।
ক্লারা বলল, কিছুতেই নয়। দরকার হলে আমার বোনকে তুলে নিয়ে যাব!
ক্লারা! ক্লারা!
ক্লারা মুখ তুলে দেখল প্রদোষ দাঁড়িয়ে আছে ওপরে। ক্লারা বলল, একজন বোন পেয়েছি।
প্রদোষ একলাফে নেমে এল। …হোয়াট ডু ইউ থিংক ইউ আর ডুয়িং? সি ইজ আ প্রসটিটিউট আ ব্ল্যাকমেলার।
ক্লারা হকচকিয়ে গিয়েছিল। সেই সুযোগে শাওনি একঝটকায় ছাড়িয়ে নিল। নিজেকে। সে প্রস শব্দটার সঙ্গে পরিচিত। বাঁকা হেসে বলল, পস! তখন পস। কে ধরে টানাটানি করতে খুব মজা লাগছিল, তাই না? দশটা টাকা দিয়ে ভিজে মাটিতে শোওয়ার জন্য পায়ে ধরতে বাকি! বলব না ভেবেছিলাম, বলিয়ে ছাড়লে!
প্রদোষ হুংকার দিয়ে ঘুসি তুলে ঝাঁপ দিল বারবধূটির দিকে। কিন্তু ক্লারা তাকে ধরে ফেলল। শাওনি দৌড়ে ঝোপঝাড় ভেঙে পালিয়ে গেল।
প্রদোষ শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, আই মাস্ট কিল দা ডার্টি বিচ!
ক্লারা তাকে ছেড়ে দিল।
প্রদোষ দম নিয়ে বলল, সি ইজ আ ব্ল্যাকমেলার। আই শুড ন্যারেট দা। ইনসিডেন্ট লেটার অন। লেটস গো ব্যাক, বেবি!
ক্লারা তার চোখে চোখ রেখে নির্বিকার মুখে বলল, তোমাকে এই শেষবার বলছি, প্রদোষ। তুমি আমাকে ইংলিশ বলবে না। যদি জার্মানভাষা শিখতে পারো– বলবে, নতুবা বাংলা বলবে, যদিও আমি জানি, তুমি জার্মানভাষা শিখবে না। তুমি এমন মানুষ প্রদোষ, যে হাত বাড়িয়ে সবকিছু চায়, কষ্ট করে না। ভারত ইংলিশম্যানেদের উপনিবেশ ছিল। সুতরাং ইংলিশ শেখা তোমার পক্ষে স্বাভাবিক। কিন্তু তুমি ভারতীয়। তুমি জানো না ইংলিশম্যানরা ভারতীয়দের ঘৃণা করে। আমেরিকাবাসীরা করে না।
ক্লারা হাল্কা পা ফেলে ঢাল বেয়ে দরগার দিকে উঠে গেল। প্রদোষ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। বেশ্যা-মেয়েটা সম্ভবত তাকে আবার ব্ল্যাকমেল করে গেল। একটা কিছু করা দরকার। তার চোয়াল আঁটো হয়ে গেল।…
.
একটি তালডোঙা
কুকুরটা খেলতে-খেলতে হঠাৎ থেমে গেল। তারপর বাঁদিকে মুখ ঘুরিয়ে ভেউ ভেউ করে উঠল। যেন কাউকে ধমক দিচ্ছে সে। কর্নেল হাসলেন।… চুল্লুকে দেখতে পাচ্ছিস নাকি রে? ভয় পাওয়ার কিছু নেই, তুই লুল্লু। কী? নামটা পছন্দ হল তো? কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। কুকুরটা ঢিবির উত্তর-পূর্ব কোণের দিকে কাকে ধমক দিতে দিতে এগিয়ে চলেছে। কর্নেল শিস দিলেন। আ-তু-তু ডাকলেন দিশি প্রথায়। শেষে ধমক দিলেন, লুল্লু! ফিরে আয় বলছি! কুকুরটা– লুল্লু ফিরল না।
সূর্য ডুবে গেছে। খোঁড়া পিরের দরগার জঙ্গলে ফাঁকে-ফোকরে লালচে রোদ্দুরের ফালিগুলি মুছে দিয়েছে আসন্ন সন্ধ্যার ধূসরতা। পোকামাকড়ের ডাক শোনা যাচ্ছে, চাপা, দুরবর্তী এবং বিস্তৃত। মাথার উপর গাছপালার ঘন ডাল ও পাতা। আকাশের অবস্থা বোঝা যায় না। কুকুরটা কোথায় চলেছে দেখার জন্য পা বাড়ালে সাপের কথা মনে পড়ল কর্নেলের। পাতলুনের পকেট থেকে ছোট্ট কিন্তু জোরালো টর্চটি বের করলেন। এখনও যথেষ্ট আলো আছে বলে জ্বাললেন না। একটু পরে জলের শব্দ শুনতে পেলেন। ঢিবিটা চারদিক থেকে ঘিরে জলের মারমুখী চেহারা এবং উত্থান। ঘণ্টা দুই আগে এইসব মাদারগাছের অনেক নিচে জল দেখেছিলেন। এখন ঢালু মাদারগাছের জটলার ভেতর জল। বন্যা বাড়ছে তবে ধীরে। কর্নেল ডাকলেন, লুল্লু!
লুল্লু মাদারগাছের পাশে উঁচু চাঙড়ের ওপর দাঁড়িয়ে কাকে শাসাচ্ছিল। তার পাশে গিয়ে অবাক হলেন! একটা কালো তালডোঙা– তালগাছের গুঁড়ি কেটে বানিয়ে যাতে আলকাতরা মাখানো হয়, শেকড়ে বাঁধা। শেকড়টা নেমে গেছে একটা শিরীষগাছ থেকে। শেকড়ের পাশে ঘন ঘাস। ঘাসগুলোর পাতা চ্যাপ্টা, লম্বাটে ছিপছিপে গড়ন। সবে সোজা হচ্ছে।
কেউ ডোঙা বেয়ে এসেছে এবং দ্রুত সেটা বেঁধে রেখে দরগায় গেছে। ঘাসের ভেতর গামবুটে-ঢাকা একটা পা নামিয়ে বাঁদিকে মাদার-জঙ্গলের পেছনটা দেখতে উঁকি মারলেন কর্নেল। কারণ লুল্লু সেদিকে মুখ ঘুরিয়েছিল।
কাউকে দেখতে পেলেন না। ডোঙাটার ভেতর ফুট সাতেক লম্বা একটা বৈঠা পড়ে আছে। এগিয়ে গিয়ে বৈঠাটা তুলে নিলেন কর্নেল। একটু ভাবলেন। তারপর শেকড় থেকে, দড়িটা খুলে ডোঙায় উঠলেন। ভীষণ টলমলে এই ধরনের জলযানে চাপার অভ্যাস তার আছে। ব্রাজিলের অববাহিকার দুর্গম জঙ্গলে হিংস্র উপজাতি নিভারো ইন্ডিয়ানরা ঠিক এইরকম ক্যানো ব্যবহার করে। ডোঙাটা বেয়ে ঢিবির পূর্ব দিকে পৌঁছুতে সেই স্মৃতি ফিরে এল এবং চলে গেল। একটু দূরে ডুবন্ত অথই পিচরাস্তার ওধারে বাঁকা বনটা কালো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেয়ালের মতো। লুল্লু ঢিবির কিনারা ধরে তাকে অনুসরণ করছিল। দক্ষিণ-পূর্ব কোণ ঘুরে ঢালু পাড়ে গলা পর্যন্ত জলে ডুবে থাকা ঝোপের কাছে পৌঁছে আবার একটু ভাবলেন কর্নেল।
ডুবন্ত ঝোপের ভেতর ঢুকে বৈঠা দিয়ে জলের গভীরতা দেখে নিয়ে কর্নেল ডাঙার কাছে গেলেন। তারপর একটা অদ্ভুত কাণ্ড করে ফেললেন। নেমে ডোঙাটা কাত করে ধরলেন। জল ঢুকতে ঢুকতে ডোঙাটা ডুবে গেল! সেটাকে জলের ভেতর ঝোপের তলায় ঠেলে দিলেন। ডোঙাটার কোনো চিহ্ন রইল না। বৈঠাটাও ঝোপের ভেতর লুকিয়ে রেখে উঠে এলেন। দেখলেন, লুল্লু নেই।
লুল্লুর দেখা পাওয়া গেল বিধ্বস্ত দেউড়ির কাছে। সেখানে উল্টোদিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে শাওনি। লুল্লু তার কাপড় শুকচ্ছে আর লেজ নাড়ছে। কর্নেলের পায়ের শব্দে শাওনি ঘুরল। মুহূর্তের জন্য কর্নেলের মনে হল সে ভীষণ চমকে উঠেছে। কিন্তু সেই সময় ডাক্তার ব্ৰজহরি কুণ্ডুর ডাক শোনা গেল, কর্নেলসায়েব! কর্নেলসায়েব! সঙ্গে সঙ্গে শাওনি প্রাঙ্গণ পেরিয়ে হন্তদন্ত চলে গেল।
ব্ৰজহরির পাশ দিয়ে যাবার সময় সম্ভবত মেয়েটা কিছু রসিকতা করে গেল। কারণ ব্রজহরি হুংকার ছেড়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। থাপ্পড়ের ভঙ্গিতে ডানহাতটা উঠে ধীরে নেমে গেল। কর্নেল ডাকলেন ডাক্তারবাবু!
ব্ৰজহরি একটু হাসলেন। আপনাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি।
বলুন!
চাপাস্বরে ব্রজহরি বললেন, ফকির-দরবেশ এমন গলাকাটা দোকানদারি করতে পারে, ভাবা যায় না। পঞ্চাশ টাকায় রফা হল। তাও চাল-ডালের যা পরিমাণ, এতগুলো লোকের আধপেটা হবে। কুমড়ো আছে শুনলাম। বলে, দেওয়া যাবে না। জ্বালানি কাঠের পাঁজা আছে ঘরভর্তি। খানকতক চেলা কাঠ দিয়ে বললে এতেই হয়ে যাবে। হরিপদ ওই ভাঙা ঘরটার ভেতর উনুন বানাচ্ছে। আমরা দুজনে রাঁধব। আর
বলুন!
ব্ৰজহরি কাঁচুমাচু মুখে বললেন, মেমসায়েব পুরো টাকা দিতে যাচ্ছিল, তা কি উচিত? শেষ পর্যন্ত চাদা করে চল্লিশ উঠেছে– মানে, আমি পাঁচ, মেমসায়েব আর এম এল এর ভাগ্নে মিলে দশ, টিচার ভদ্রোলোক পাঁচ, রিকশোওলা আর তার বউ দশ– ওই মেয়েটাকেও দুমুঠো দেওয়া হবে, তবে ওঁর চাদা নেওয়া হবে না, এখন
কর্নেল দ্রুত পার্স বের করে একটা কুড়ি টাকার নোট গুঁজে দিলেন ওঁর হাতে।
ব্ৰজহরি ফ্যাঁচ শব্দে হাসলেন।…ভগবানের আশীর্বাদে রাতটা ভালয়-ভালয় কাটলে আগামীকাল দেখবেন, ঠিকই রিলিফের নৌকো আসবে। বলে আবার গলা চাপলেন।…একটা কথা বলি! এভাবে ঘুরবেন না একা-একা। জায়গাটা ভাল না।
কর্নেল সিরিয়াস ভঙ্গিতেই বললেন, আপনি কি চুল্লুর কথা ভাবছেন?
আমি প্রেতাত্মায় বিশ্বাস করি। ব্ৰজহরি ঝটপট বললেন। তা ছাড়া একটু আগে
উনি ভয়-পাওয়া মুখে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন দেখে কর্নেল বললেন, কিছু কি দেখেছেন?
দেখেছি। ব্ৰজহরি ফিসফিস করে বললেন। এদিকে-সেদিকে আপনাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। হঠাৎ ওদিকে গাছপালার আড়ালে যেন কালো রঙের একটা কিছু যাই হোক, আসুন। টাকা না দিলে দরবেশ ব্যাটাচ্ছেলে হাঙ্গামা বাধাতে পারে। লোকটা খাঁটি ফকির-দরবেশ নয়।…
.
সূর্যাস্তের পর এক ঘন্টা
আবার ঝিরিঝিরে বৃষ্টি। বারান্দায় অন্ধ দরবেশ নমাজের পর ধ্যানে বসেছেন। বুকে চিমটে টুকছেন। ঝুমঝুম শব্দ হচ্ছে। তার সামনে ঘরটা বন্ধ। তালা আঁটা। পাশের ঘরে ছেঁড়া সতরঞ্জি বিছিয়ে বসে আছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কয়েকজন লোক। এখন গম্ভীর, নিশ্চুপ ও বিমর্ষ। ক্লারা দরজার কাছে ঘনশ্যাম কোণে। পুঁতি-চাক্কু মাঝামাঝি দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসেছে। বংকুবিহারী মাঝখানে হাঁটু দুমড়ে বসেছেন। শাওনি ক্লারার কাছে বসে অন্ধকারে বৃষ্টি পড়া দেখছে। পাশের ভাঙা ঘরটাতে ব্ৰজহরি ও হরিপদ খিচুড়ি রান্না করছেন। কর্নেল বারান্দায় বসে উনুনে ঝলসে-ওঠা দুটি মুখ দেখছিলেন। দুটি মুখই মাঝে-মাঝে হেলে-পড়া ছাদটির দিকে তাকিয়ে নিচ্ছে। ঝুলন্ত কড়িকাঠের ওপর ছাদটা কোনোক্রমে আটকে আছে। যে কোনো মুহূর্তে ধসে পড়তে পারে। ধোঁয়ায় নাক-মুখ কুঁচকে ব্ৰজহরি হাতা দিয়ে প্রকাণ্ড ডেকচির ফুটন্ত চাল-ডাল নাড়তে থাকলেন। হরিপদ গুনগুন করে গান গাইতে লাগল। বৃষ্টির শব্দের ভেতর ফোঁপানির মতো সুরটা।
বৃষ্টি এসেই সবাইকে চুপ করিয়ে দিয়েছে। উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে। কোণঠাসা করে ফেলেছে। বিকেলের রোদ্দুরটা খুব আশা যুগিয়েছিল। ফলে জোট ভেঙে লোকগুলো ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু সন্ধ্যা এবং আবার বৃষ্টি তাদের একত্র করেছে। তা ছাড়া চুল্লু!
কর্নেল লুল্লুকে খুঁজছিলেন। ব্ৰজহরির সঙ্গে এখানে আসার সময় কুকুরটার কথা ভুলে গিয়েছিলেন। তারপর আর তার পাত্তা নেই। সম্ভবত বৃষ্টির শুরুতে সে কোনো ভাঙা ঘরের ভেতর আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু বৃষ্টি দেখে সে-ও কি আতঙ্কে চুপ করে গেল?
বৃষ্টি বাড়ল। বাতাস উঠল। তখন দরবেশ আচ্ছন্ন স্বরে ডাকলেন, চুল্লু!
বংকুবিহারীও অমনি চাপাস্বরে ডাক দিলেন, কর্নেল!
বলুন!
বারান্দায় ছাঁট লাগছে না? এখানে আসুন।
কর্নেল টর্চ জ্বেলে পাশের ঘরে গেলেন। তখনও দরবেশ চাপা-গলায় বলছেন, চুল্লু! চুল্লু! চুল্লু! বংকুবিহারী হাসবার চেষ্টা করে বললেন, আমার টর্চটা সেপাইদের কাছে থেকে গেছে। জানি না বরাতে কী ঘটল! একেবারে ইন্টিরিয়ারে তো! প্রিমিটিভ অবস্থা যাকে বলে!
কর্নেল হাসলেন।..আপনার দাগী আসামির কথাও ভেবে দেখুন!
ওর কিছু হয়নি। বংকুবিহারী আস্তে বললেন। ও ব্যাটাকে চেনেন না। ওর নাকি অনেকগুলো প্রাণ। সহজে যাবার নয়।
চাক্কু বলল, কার কথা বলছেন সার?
বংকুবিহারী বললেন, হ্যাঁরে, চাক্কু না ফাল্লু, ইসমাইলকে চিনিস?
আজ্ঞে নাম শুনেছি। চোখে দেখিনি কখনও।
চুপ ব্যাটা! তুই ইসমাইলের চেলা! তোকে দেখেই বুঝেছি।
চাক্কু হাসল। …বিপদের সময় এটা কী একটা কথা হল সার? সবাই জানে আমি রিকশো চালিয়ে খাই। ডাক্তারবাবুকে জিগ্যেস করুন। তাপরে এই শাওনিকে জিগ্যেস করুন!
বংকুবিহারী হঠাৎ রেগে গেলেন। বললেন, কর্নেল! একবার টর্চ জ্বালুন তো! প্লিজ! আমি দেখাচ্ছি।
কর্নেল ক্ষুদে টর্চট জ্বাললেন। বংকুবিহারী হাত বাড়িয়ে খপ করে চাক্কুর ঝোলাটা টেনে নিলেন। চাক্কু ভড়কে গেল। বংকুবিহারী ঝোলাটা উপুড় করে ধরলেন। একটা হাফপ্যান্ট, লাল গেঞ্জি, চিরুনি, একটা মানিব্যাগ, আধ-শুকনো একটা লুঙ্গি ছড়িয়ে পড়ল। বংকুবিহারী চার্জ করলেন, ড্যাগারটা কোথায় লুকোলি? কাছে আয়। সার্চ করি।
চাক্কু বলল, করুন সার্চ। তবে ড্যাগার একটা ছিল। রাতবিরেতে বদমাশ পেসেঞ্জার
চুপ! কোথায় রেখেছিস ড্যাগার?
জানি না। আমারও তো অবাক লাগছে। ব্যাগেই ছিল।
বংকুবিহারী ওকে দাঁড় করিয়ে রীতিমতো সর্বাঙ্গ সার্চ করলেন। কর্নেল বললেন, টর্চের ব্যাটারি শেষ হয়ে যাবে দারোগাবাবু! ক্ষমা করবেন। বলে টর্চ অফ করে দিলেন।
বংকুবিহারী বললেন, তোর বউকে চালান করেছিস! দেখি, ওর ব্যাগটা দে!
বারান্দার কোণে দরবেশের ঘরের দরজার পাশে রাখা মিটমিটে হেরিকেনের আলো টেরচা হয়ে এ-ঘরে ঢুকেছিল। পুঁতি হতবাক। তার ব্যাগেও ছোরাটা নেই। বংকুবিহারী বললেন, শাওনি! ওর বডি খুঁজে দ্যাখ তো!
শাওনি পুঁতির গায়ে হাত দিতে গেলে পুঁতি ধাক্কা দিল ওকে। ক্লারা বলে উঠল, এ কী হচ্ছে? কী করছেন আপনারা? এমন বিপদের মধ্যে আইনের কোনো ভূমিকা থাকা উচিত নয়। কর্নেল, আপনি ওদের বলুন। বাধা দিন।
দরবেশ হাঁক দিলেন এইসময়, চুল্ল! তারপর বাইরে কী একটা ঘটল। কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ হল। ব্ৰজহরি ও হরিপদকে বারান্দায় দেখা গেল। ব্ৰজহরি ভাঙা গলায় বললেন, ছাদটা ধসে গেল। একচুলের জন্য বেঁচে গেছি।
হরিপদ বলল, হায় গুরু! এতগুলো লোকের মুখের আহার! হায় হায় গো!
ব্ৰজহরি গর্জন করলেন, এমন হবে জানতাম। সবই জানি, কেন এমন হচ্ছে। কেন আবার নেচার ক্ষেপে গেল, কেন মুখের খাদ্য ধ্বংস হল–ক্লারা বলল, কেন, আপনি বলুন। আমরা শুনি।
ব্ৰজহরি বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করলেন, এবং ইংরেজিতে, যেহেতু ক্লারা মেমসায়েব। ইউ নো ম্যাডাম, দা ডেভিল! ইউ নো হিম ওয়েল। অলসো ইউ নো দা স্টোরি অফ দা বাইবেল– দা সেক্রেড বুক অফ ইওর রিলিজিয়ন, ম্যাডাম
আপনি বাংলায় বলুন! আমি জার্মান। ইংলিশ জানি না।
ডাক্তার ব্রজহরি কুণ্ডু গ্রাহ্যই করলেন না। দা স্যাটান লেট লুজ! শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন। হেয়ার ইজ দা সিম্বল! এ প্রসটিস্যুট! দা ডেভিলস্ ডটার ইজ ইন দিস্ সেক্রেড প্লেস, ম্যাডাম! তারপর যুগপৎ কর্নেল ও বংকুবিহারীর উদ্দেশে বললেন, কর্নেলসায়েব! দারোগাবাবু! আপনারা লক্ষ্য করেছেন কিনা জানি না, আমি করেছি। আমার দৃষ্টিশক্তি তীক্ষ্ণ। যে মুহূর্তে ওই হারামজাদি মেয়েমানুষটা এ মাটিতে পা দিয়েছে, তখন থেকে একটার পর একটা বিপদ ঘটছে কি-না বলুন!
শাওনির হাসি শোনা গেল। …ওরে ড্যাকরা মিনসে! আমি বুঝি না কাকে ইংরিজি-মিংরিজি করে গাল দেওয়া হচ্ছে? আমি নেকি?
ব্ৰজহরি তীক্ষ্ণদৃষ্টে আবছা আঁধারে তাকে দেখার চেষ্টা করে বললেন, বেরো! বেরিয়ে যা বলছি!
শাওনি চ্যাঁচাল। …তুই বেরো! ডাক্তার না ফাঁকতার! জল বেচে টাকা খায়, তার আবার বড় বড় কথা? তুই জল বেচে খাস, আমি শরীল বেচে খাই। খাবো।
ব্ৰজহরি ভাঙা গলায় বললেন, আপনারা সহ্য করছেন? দারোগাবাবু! কর্নেল!
বংকুবিহারী বললেন, আহা! জানেন তো ওরা ওই রকমই। কেন ঘাঁটাতে গেলেন ওকে?
শাওনি দারোগাবাবুর সাহসে আবার চাঁচাল। ভেংচি কেটে বলল, স-ই-হ্য। করছেন! স-ই-হ্যওলা ডাক্তারবাবু রে আমার! তখন জলের ধারে একলা পেয়ে পিরীত করতে লজ্জা করেনি?
ব্ৰজহরি মুখে দু হাত চাপা দিয়ে হো হো করে কেঁদে ফেললেন। বসে পড়লেন ধপাস করে। বাউল হরিপদ ফোঁস করে নাক ঝেড়ে কান্না জড়ানো গলায় বলে উঠল, হা গুরু! জয় গুরু! এ কী হচ্ছে গো বাবার দরগায়!
ঢিবি জুড়ে গাছপালা দুলছে, টালমাটাল হচ্ছে, মেঘ গর্জে-গর্জে উঠছে, বিদ্যুতের ছটায় ছটায় ঝলসে উঠছে মুহূর্তকাল, আবার বৃষ্টিময় অন্ধকার মুঠোয় চেপে ধরছে সব কিছু, এবং দরবেশ আবার চেঁচিয়ে উঠলেন, চুল্লু! তখন ঘনশ্যামের কথা শোনা গেল, যা আরও ভয়ঙ্কর : এ ঘরখানা ধসে পড়বে না।
বংকুবিহারী ব্যস্তভাবে বললেন, কর্নেল! টর্চ জ্বালুন তো! মনে হল জল চোঁয়াচ্ছে ছাদ থেকে।
কর্নেল ছাদে টর্চের আলো ফেললেন। সত্যি জল চোঁয়াচ্ছে কয়েকটা জায়গায়। চাক্কু দেশলাই জ্বালানোর চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল। প্রদোষ লাইটার জ্বেলে বলল, টর্চ আনতে ভুলে গেছি!
শিগগির সে লাইটার নিভিয়ে দিল। ক্লারা বলল, চলুন, আমরা বারান্দায় যাই।
তার বলার তর সয়নি কারুর, ভিড় করে চলে এল বারান্দায়। ধাক্কাধাক্কিও হল খানিকটা। কিন্তু দরবেশ হাত বাড়িয়ে লণ্ঠন নিভিয়ে দিলেন। বংকুবিহারী বললেন, আশ্চর্য! নেভালেন কেন?
অন্ধ দরবেশ বুকে চিমটে ঠুকতে ঠুকতে আওড়ালেন, চুল্লু! রাখুন মশাই আনপার চুল্লু! বংকুবিহারী খাপ্পা হয়ে বললেন। কর্নেল! টর্চ জ্বালুন। হেরিকেনটা জ্বালা দরকার।
কর্নেল টর্চ জ্বালালেন। বংকুবিহারী হিংস্রভাবে হেঁটে হেরিকেনটা আনতে যাচ্ছেন, দরবেশ এক অদ্ভুত কাণ্ড করলেন। হেরিকেনটা তুলে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন ভেতর থেকে। বংকুবিহারী বললেন, আশ্চর্য!
আবার বিদ্যুতের ঝিলিক। মেঘের গর্জন। বংকুবিহারী ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, সাধুসন্ত মানুষরা কেন পাগল হয়, বুঝি না!
ব্ৰজহরি সামলে নিয়েছেন। ফোঁস করে নাক ঝেড়ে বললেন, হয়। আসলে আমরা সাধারণ মানুষেরা মেটিরিয়্যালি বিচার করে সাধুসন্ত ফকির দরবেশদের পাগল বলি। কিন্তু স্পিরিচুয়ালি দেখলে, ওটাই স্যানিটি– সুস্থতা।
ঘনশ্যামের কণ্ঠস্বর শোনা গেল : আমরাও পাগল হয়ে যাব শিগগির, যা লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
সন্দেহজনক শব্দ খুটখাট। বংকুবিহারী বললেন, টর্চ! টর্চ!
কর্নেল ভারি গলায় বললেন, ব্যাটারি শেষ হয়ে যাবে। এমার্জেন্সির জন্য দরকার হবে। আপনি চুপচাপ বসুন তো দারোগাবাবু!
প্রদোষ লাইটার জ্বালল। কিন্তু কিছু দেখা গেল না।
বংকুবিহারী ফের বললেন, আশ্চর্য! দরবেশ নিশ্চয় ঘরে ঢুকে খাওয়া-দাওয়া করছেন।
ঘনশ্যাম বলল, লোকটা স্বার্থপর। ভণ্ড। চুল্লু-টুলু বোগাস। সব কিছু বোগাস! রিলিজিয়ন ইজ দা ওপিয়াম অফ দা পিপল!
ধুর মশাই! বংকুবিহারী বললেন। আপনি দেখছি কমিউনিস্ট! আজকাল টিচারমাত্রেই কমিউনিস্ট। কেন কে জানে!
ঘনশ্যাম থেমে গেলেন। ব্রজহরি ভাঙা গলায় ডাকলেন, হরিপদ!
হরিপদ তার পাশেই। বলল, বলুন গুরু!
ব্ৰজহরি বললেন, বৃষ্টি কমলে কর্নেলসায়েব, প্লিজ একবার ওকে নিয়ে গিয়ে দেখবেন– যদি খিচুড়িটা উদ্ধার করা যায়? ডেকচির মুখে ঢাকনা দেওয়া ছিল বলেই বলছি। ইটকাঠ সরিয়ে-টরিয়ে যদি–
ক্লারা বলল, আমাদের কাছে কিছু খাদ্য আছে। মিষ্টান্ন। আপনারা খেতে পারেন।
হরিপদ বলল, জয় গুরু! জয় গুরু!
বংকুবিহারী বললেন, দ্যাটস এ গুড নিউজ ম্যাডাম!
প্রদোষ বলল, নেই। ও ঘরে রেখে গিয়েছিলাম, তখন কেউ খেয়ে ফেলেছে। ক্লারা বলল, সে কী বিচিত্র কথা! এমন হওয়া উচিত ছিল না। তুমি কি সত্যই দেখেছ?
হ্যাঁ। তুমিও গিয়ে দেখতে পার।
বংকুবিহারী ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন, চাবকাতে ইচ্ছে করে না? এমন বিপদ আপদের মধ্যেও চোর হতে পারে মানুষ! সে জন্যই তো বলছিলাম, মানুষ বর্ন-ক্রিমিন্যাল।
সায় দিলেন ব্রজহরি। …অনেকাংশে ঠিক। তবে কথাটা অন্যভাবেই বলা উচিত। মানুষ জন্মায় দু ঠেঙে জন্তু হয়ে। অনেক সাধনায় তাকে মানুষ হতে হয়। শিক্ষা-সংস্কৃতি, নীতিবোধ– এসব তো সঙ্গে করে কেউ জন্মায় না। তবে মেমসায়েবদের সন্দেশ-ইন্দেশ কে চুরি করে খেয়েছে, আমরা জানি। জেনেও মুখ খোলার উপায় নেই। দা স্যাটান লেট লুজ!
বংকুবিহারী হাঁকরালেন, শাওনি! এ তোর কাজ।
শাওনি বলল, বেশ করেছি। যা পারেন, করুন।
তোকে গুলি করে ভাসিয়ে দেব, হারামজাদি মেয়ে। বংকুবিহারী অভিমানেই বললেন। ক্ষিদেয় প্রত্যেকের নাড়ি জ্বলে যাচ্ছে। অন্তত একটা করে সন্দেশ খেয়ে জল খেলেও ওঃ!
ঘনশ্যাম বললেন, কিন্তু জল? ওয়াটার ওয়াটার এভরিহোয়্যার, বাট নট এ ড্রপ টু ড্রিংক!
আপনি হাসছেন মশাই? বংকুবিহারী তেড়ে গেলেন। একি হাসির সময়?
ব্ৰজহরি বললেন, আহা! ওই কোনায় পোঁতা জালায় জল আছে। খান না!
শাওনি বলল, আমি এঁটো করে রেখেছি। ধম্মপুতুরেরা খাক না বেশ্যার এঁটো জল। সে খি খি করে হাসতে লাগল।
ব্ৰজহরি নড়ে বসলেন। …কী বললি, কী বললি?
শাওনি বলল, শুধু এঁটো? খেয়েছি, খেয়ে হিসি করে দিয়েছি। ধম্মপুত্তুররা খাবে বলে!
এই অশ্লীলতার ধাক্কা প্রথমে লাগল ব্ৰজহরিকে, তারপর চাক্কুকে, তারপর ঘনশ্যামকে, শেষে প্রদোষকেও। ভয়াবহ এই অশ্লীলতা, কারণ ওঁরা ওই জল অ্যালুমিনিয়মের পাত্রে তুলে খেয়েছেন মাত্র ঘণ্টাখানেক আগে। চারজনে একসঙ্গে উঠে এল শাওনির উদ্দেশে। বিদ্যুতের ছটায় ওকে দেখামাত্র চারজনে চ্যাংদোলা করে তুলল। পুঁতি চেঁচাতে থাকল, বানের জলে! বানের জলে!
বাতাসের ঝাপটানি ও বৃষ্টির ভেতর, প্রাঙ্গণে বারবধূটিকে চারজন রাগী পুরুষ, প্রতিশোধবশেই নামিয়ে দিল এবং ঠেলে ফেলে দিয়ে ফিরে এল। ব্রজহরি বারন্দায় এসে বললেন, নজর রাখুন! সারবন্দি দাঁড়ান সবাই! এলেই ভাগিয়ে দেবেন!
শাওনি ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। দুবার দারোগাবাবুকে চিৎকার করে ডাকল। সাড়া না পেয়ে প্রাঙ্গণে কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে ভিজতে ভিজতে চূড়ান্ত অশ্লীল গাল দিতে শুরু করল। ক্লারা হতবাক হয়ে বসেছিল। এতক্ষণে উঠে এসে চেরা গলায় বলল, এটা অমানবিক! আপনারা মানুষ না পশু?
ঘনশ্যাম গর্জন করলেন, শাট আপ ইউ, সি আই এ এজেন্ট!
এতে প্রদোষ চটে গেল। …আপনি মশাই বাড়াবাড়ি করছেন। আমার স্ত্রীকে আপনি
ঘনশ্যাম বাধা দিয়ে বললেন, আপনাদের দুজনকেই অ্যারেস্ট করা হবে। আপনারা কারা আমি জানি!
বংকুবিহারীর গলা শোনা গেল, চুপ করুন তো মশাই! কমিউনিস্টগিরি পরে ফলাবেন।
ক্লারা নেমে গিয়ে শাওনিকে বলল, এস বোন। আমরা পাশের ঘরে থাকব। ঘরের ছাদ ভেঙে পড়বে যখন, পড়বে। যন্ত্রণা থেকে নিষ্কৃতি পাব।
শাওনি ওর হাত ছাড়িয়ে হন হন করে চলে গেল। ক্লারা অবাক হয়ে ফিরে এল। কর্নেল ডাকলেন, শাওনি! শাওনি! যেও না- ওটা নেই। খুঁজে পাবে না।
শাওনির সাড়া এল না। বংকুবিহারী সন্দিগ্ধ স্বরে বললেন, কী খুঁজে পাবে না কর্নেল?
একটা তালডোঙা।
মাই গুডনেস! তালডোঙা- কোথায় তালভোঙা?
কর্নেল শুধু বললেন, ছিল।
আহা, ব্যাপারটা খুলে বলুন না মশাই!
কর্নেল একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, সকালের জন্য অপেক্ষা করুন। সকালে সব বোঝা যাবে। তারপর একটু হাসলেন। …চুল্লুর ব্যাপার আর কী!
ভ্যাট! আপনিও খালি– রাগে থেমে গেলেন আইনরক্ষক।…
.
গানের আসর
বৃষ্টিটা হঠাৎ থেমে গেল। বাতাসও বন্ধ হল। কিন্তু গাছপালা থেকে টুপটাপ জল পড়ার শব্দ ধারাবাহিক। কখনও কোনো পাখির ডানাঝড়া এবং নড়ে বসার আচমকা ঝরঝর শব্দে চমক ছিল। ব্ৰজহরিই শুধু বলে উঠেছিল, কিসের শব্দ? কেউ জবাব দেয়নি। হয়তো চুল্লুর প্রেতাত্মা! তারপর ধীরে জেগে উঠল পোকামাকড়ের ডাকাডাকির শব্দ।
চাক্কু অন্ধকারে উঠে দাঁড়ালে বংকুবিহারী টের পেলেন। বললেন, কে?
আমি।
বংকুবিহারী ধমক দিলেন, আমি কে?
আজ্ঞে, আমি! চাক্কু মরিয়া হয়ে বলল। শিবপদ!
ঘনশ্যাম, ব্ৰজহরি, প্রদোষ চমকানো স্বরে বলে উঠলেন, কে, কে?
হরিপদ বাউল হাসল। …তাহলে আরেকজন পাওয়া গেল। কী করে এলে গো? কখন এলে? জানতেও তো পারিনি। সাড়াশব্দ দিয়ে আসবে তো?
ক্লারা বলে দিল, নতুন লোক নয়। ও রিকশাচালক।
বংকুবিহারী হ্যা হ্যা করে হাসলেন। …ও! চাক্কু! তা শিবপদ-টদ করচিস কেন বাবা? আর যাচ্ছিসটা কোথায়?
চাক্কু বলল, ঘুম পাচ্ছে। ও ঘরে সতরঞ্জি আছে। ঘুমুতে চললাম দারোগাবাবু!
বংকুবিহারী বললেন, যাসনে ছাদ চাপা পড়তে। চুপচাপ বসে থাক এখানে।
পুঁতি চাপাস্বরে বলল, মরণপাখা উঠেছে! ছটফটিয়ে বেড়াচ্ছে।
চাক্কু গ্রাহ্য করল না। পাশের ঘরটাতে গিয়ে ঢুকল। ঢুকেই চমক-খাওয়া স্বরে বলল, কে, কে?
বারান্দায় সাড়া পড়ে গেল। বংকুবিহারী ব্যস্তভাবে বললেন, কর্নেল! কর্নেল! টর্চ, টর্চ! ব্ৰজহরি, ঘনশ্যাম। প্রদোষ, হরিপদ একগলায় আলো, আলো রব তুললেন। তারপর পাশের ঘর থেকে শাওনির সাড়া পাওয়া গেল। …হাবাতে মিনসেরা! এইটুকুতেই অস্থির! গলায় ইট ঢুকিয়ে দেবে চুল্ল! থামো সব– একটু দাঁড়াও না!
ক্লান্তি, উদ্বেগ, বন্যার জল ওঠার এবং চুল্লুর আতঙ্গ প্রগাঢ়। তাই সবাই চুপ করে গেল। চাক্কু দ্রুত ফিরে এল। এটা পুঁতির ভাল লেগেছে। সে আস্তে বলল, শোবে তো এখানেই লুঙ্গি বিছিয়ে শোও! চাক্কু মেনে নিল।
বংকুবিহারী ডাকলেন, শাওনি!
শাওনির গলা ভেঙে গেছে। বিকৃত শোনাল। …কী?
তুই যে পেত্নী হয়ে গেলি রে! আঁ? আইনরক্ষক হাসলেন। ডোঙা খুঁজে পেলি?
পাবার সময় হলে ঠিকই পাব।
খুলে বল না বাবা!
আপনাকে বলে কী লাভ? শাওনি গলার ভেতর বলল। মিনসেরা আমার খোয়ার করল, তখন তো কই আটকাতে এলেন না? আমি মানুষ তো বটি। আমি যাও বলতাম, মরে গেলেও বলব না!
বংকুবিহারী বললেন, তুই খাওয়ার জলটা নষ্ট করে প্রচণ্ড অন্যায় করেছিস!
ক্লারা বলে উঠল, নিশ্চয় সে ক্রোধবশত বলেছে। সত্যই এ কাজ সে করতে পারে না।
ব্ৰজহরি বললেন, হোয়াই ডু উই ফরগেট ম্যাডাম, সি ইজ এ প্রসটিট্রিট অ্যান্ড সি ক্যান ডু এভরিথিং– এভরিথিং! সি অলওয়েজ ডাজ অল সর্টস অফ ন্যাস্টি থিংস! সি ইজ অ্যান এভিল ম্যাডাম!
ক্লারা রাগ করে বসে রইল। বংকুবিহারী ডাকলেন, কর্নেল!
কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। হরিপদ বলল, তখন যেন উঠে গেলেন মনে হল।
ব্ৰজহরি বললেন, ধুস! উঠে গেলেন অন্ধকারে হাতে টর্চ, জ্বাললেন না? এই তো ঘুমোচ্ছেন।
তার নাড়া খেয়ে ঘনশ্যাম বললেন, আমি, আমি!
প্রদোষ লাইটার জ্বেলে সিগারেট ধরাল। ক্ষণিক আলোয় দেখা গেল, কর্নেল নেই। বংকুবিহারী চড়া গলায় ডাকলেন, কর্নেল! কর্নেলসায়েব। সাড়া না পেয়ে চাপাস্বরে বললেন, এই লোকটির গতিবিধি সন্দেহজনক ঠেকছে। অবশ্য আমি নজর রেখেছি।
ব্ৰজহরি হাসবার চেষ্টা করে বললেন, বাইরে থেকে কিছু বোঝবার যো নেই। কে কী!
হরিপদ বলল, সেটাই তো কথা গো বাবারা, মায়েরা! বাইরে যিনি, ভেতরে তিনি না, অন্যজনা। ভেতরকার জনাই মূলাধার। সেজন্যেই তো গুরু বলেছেন : এই মানুষে সেই মানুষ আছেন বসে/ পেলে দেখা নাইকো রক্ষা ধরবি তাকে কষে/…
বংকুবিহারী বললেন, সুরে গাও হে! গলা ছেড়ে গাও!
সবাই সায় দিলেন। এই অন্ধকার দরগা, কবরখানা, ধ্বংসপ, জঙ্গল, বন্যার গ্রাস এবং প্রেতাত্মা চুল্লু দিয়ে তৈরি ভূখণ্ডে প্রকৃতির মুঠোয় ধরাপড়ার বিপন্নতা এই দুঃসময়! হরিপদ বাউলের গান জরুরি ছিল। একতারাটি পিড়িং পিড়িং করে দেয়ালে ঠেস দিয়ে সে সুর মেলাল– তা না না না রি রি রি গুরু গো, হায় গুরু-উ-উ-উ…
গানের মাঝমাঝি প্রাঙ্গণে টর্চ জ্বলল। সবাই দেখেও দেখল না। কর্নেল ফিরলেন। বারান্দায় এসে একপাশে চুপচাপ বসে পড়লেন। গান থামলে বংকুবিহারী বললেন, কী যে করে বেড়াচ্ছেন কর্নেলসায়েব! কখন চুপ করে বেরিয়ে যাচ্ছেন, কোথায় যাচ্ছেন!
কর্নেল বললেন, তালডোঙাটা খুঁজতে গিয়েছিলাম।
আবার হেঁয়ালি! বংকুবিহারী রাগ করে বললেন। কার তালডোঙা, কোথায় ছিল, তা বলবেন না! খালি তালডোঙা, তালডোঙা! শাওনিও বলছে তালভোঙা। ব্যাপারটা কী? আপনারা কেউ কি দেখেছেন?
ঘনশ্যাম বললেন, ডোঙাটোঙা আমি তো মশাই দেখিনি কোথাও। চক্কর মেরে ঘুরেছি। ডাক্তারবাবু দেখেছেন কি?
ব্ৰজহরি বললেন, নাঃ। প্রদোষ বলল, না। ক্লারা বলল, না। চাক্কু, পুঁতি, হরিপদ বলল, না। তখন কর্নেল বললেন, কিন্তু মনে রাখবেন, তালডোঙাটাই আপনাদের উদ্ধারের জন্য জরুরি।
বংকুবিহারী বললেন, সেটা অস্বীকার করছে কে? যদি সত্যি ওটা থেকে থাকে, সকাল হোক। খুঁজে দেখা যাবে।
ঘনশ্যাম বললেন, স্বপ্ন, স্বপ্ন!
ব্ৰজহরি দুঃখে হাসলেন। ঠিক বলেছেন! পিরবাবা আমাদের পরীক্ষা করছেন। মায়াডোঙা! একটা মায়াডোঙা দেখিয়ে আশার ছলনায় ভোলাচ্ছেন। এর কারণটা কি কেউ বুঝতে পেরেছেন? পারেননি। এই পবিত্র জায়গায় পাপের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। আমাদের সাবধান হওয়া উচিত।
ক্লারা প্রশংসা করে বলল, ভারতীয়রা দার্শনিক। আমার প্রকৃত অভিজ্ঞতা হল। আপনি আরও বলুন।
বলল হরিপদ বাউল। একতারার বাজনায় এবং গানে।
‘মায়ারূপি জগৎ-সংসারে-এ-এ/গুরু, ভেল্কি লয়ে দেখাও খেলা আজ আমারে ॥‘
ঝোঁকের মাথায় অথবা আবেগে সে উঠে নাচতে নাচতে গাইতে লাগল। বংকুবিহারী শাবাশ, ভাল!…
.
প্রথম হত্যাকাণ্ড
একটার পর একটা গান গেয়ে-গেয়ে এবং নেচে ক্লান্ত হরিপদ যখন বসে পড়ল, তখন সবাই ঢুলছে এবং আইনরক্ষকের নাক ডাকছেও বটে। ক্লারা জেগে থাকার চেষ্টা করেও পারেনি। প্রদোষ অন্ধকারে তাকে টেনেছিল। সে ঘুমন্ত দেখে প্রদোষও চোখ বুজেছিল। মধ্যরাতে আবার টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়তে থাকল। হরিপদর গলা ভেঙে গিয়েছিল। ভাঙা গলায় জয়গুরু বলে সে মেঝেয় গড়িয়ে পড়েছে। বৃষ্টিটা এলে টর্চ জ্বেলে দেখে নিলেন প্রাঙ্গণে জল উঠেছে নাকি। ওঠেনি এবং বারান্দায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে লোকগুলো ঘুমিয়ে পড়েছে। অবাক লাগছিল এই ঘুম দেখে। প্রাঙ্গণে আস্তে আস্তে নেমে গেলেন কর্নেল। যেন কেউ ঘুম ভেঙে চমকে না ওঠে।
কর্নেল রেনকোট টুপি পরে আসলে লুল্লুকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। কোথাও তার পাত্তা নেই। নির্বোধ কুকুরটা কি তার তীক্ষ্ণ জৈব বোধের দরুন টের পেয়েছে এই ঢিবিটাও ডুবে যাবে এবং তাই মরিয়া হয়ে জলে সাঁতার কেটে পালাতে গেছে? কিন্তু তাহলে ওর নির্ঘাত মৃত্যু। চারদিকে দূরসুদূর মাঠ এখন সমুদ্র। হতভাগা কুকুরটা।
টর্চের আলো কমে এসেছে। ভাঙা দেউড়ির কাছে গিয়ে একটু দাঁড়ালেন। পেছনে হাত দশেক দূরে দরগাটা। টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যে কী একটা শব্দ কানে এল। আস্তে বললেন, কে?
অমনি আশেপাশে অন্ধকারে কয়েকটা ঢিল পড়ল। কর্নেল টর্চ জ্বেলে এগিয়ে গেলেন দরগর কাছে। চারপাশে খুঁজে কাউকে দেখতে পেলেন না। গাছের মাথায় একটা শব্দ হল। পাখির ডানা থেকে জল ঝাড়ারই শব্দ। তারপর আবার চড়বড় করে ঢিল পড়ল কয়েকটা। কর্নেল হাসতে হাসতে চাপাস্বরে বললেন, চুল্লু! আমি ভয় পাই না। কাজেই ভয় দেখানোর চেষ্টা কোরো না।
খি খি হাসি শোনা গেল। ঢং করে বেড়ানো হচ্ছে রাতদুপুরে!
শাওনি! কর্নেল চর্চ নিভিয়ে দিলেন।
শাওনি দরগার ওধার থেকে বেরিয়ে এল। বুড়োসায়েব কী খুঁজে বেড়াচ্ছে। তখন থেকে? সে হিসহিস করে বলল। তালডোঙাটা তো? নেই। যে এসেছিল, সে নিয়ে গেছে। নৈলে আম্মো কি পড়ে থাকতাম এই ভাগাড়ে?
কর্নেল বললেন, তুমি কি লুল্লুকে দেখেছ, শাওনি?
কাকে?
লুল্লু কুকুরটা। দেখেছ ওকে?
শাওনি একটু চুপ করে থাকার পর শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, দেখেছি। বটতলায় পড়ে আছে।
পড়ে আছে মানে?
চুল্লুকে বিরক্ত করছিল। চুল্লু ছাড়বে কেন? পেঁচিয়ে গলা কেটেছে মনে হল। বিজলির ছটায় রক্ত দেখলাম।
কর্নেল শক্ত হয়ে বললেন, হুঁ। কখন দেখেছ?
সন্ধেবেলায় যখন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এল।
চলো, দেখিয়ে দাও।
আবার একটু চুপ করে থাকার পর বারবধূ আস্তে বলল, সকালে দেখবেন। চুল্লু রেগে আছে। শুয়ে পড়ুন গে যদি বাঁচতে চান। বলে ফিসফিস করে উঠল ফের, আপনাকে সতর্ক করতে এসেছিলাম। আর বেরুবেন না এমন করে।
সে দ্রুত চলে গেল আস্তানাঘরের দিকে। কিন্তু ভোলা প্রাঙ্গণ হয়ে নয়, বাঁদিকের জঙ্গলের ভেতর দিয়ে গেল। কর্নেল পকেট থেকে এতক্ষণে রিভলবার বের করলেন। টর্চের আলো ক্রমশ লালচে হয়ে আসছে। জ্বেলে লাভ নেই। বরং অন্ধকারে দৃষ্টি পরিষ্কার হবে। বিদ্যুতের ঝিলিকে জঙ্গলের ভেতরটাও ঝলসে যাচ্ছে মাঝে মাঝে। ফাঁকা জায়গা বেছে বেছে নজর রেখে বটতলার দিকে দক্ষিণে এগিয়ে গেলেন। জল উঠে এসেছে বটতলায়। সাপটির কথা মনে পড়ায় টর্চ জ্বাললেন সঙ্গে সঙ্গে। তারপর দেখলেন বটের কোটরের নিচের দিকে জলে দুলছে কুকুরটার মৃতদেহ। গলা ফাঁক। রক্ত ধুয়ে গেছে কখন। কর্নেল দেখেই সরে এলেন।…
.
দ্বিতীয় হত্যাকাণ্ড
কোথাও একটা খুট খুট শব্দ এবং ক্লারা তাকাল। বুঝল সে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল। দেখল ভোর হয়ে গেছে। তার খুব কাছে দাঁড়িয়ে অন্ধ দরবেশ তাঁর ঘরের শেকলে তালা আঁটছেন। ক্লারা বলল, সুপ্রভাত। দরবেশ জবাব দিলেন না। ঘুরে পা বাড়িয়ে লম্বা চিমটেটি দিয়ে সামনের মাটি ছুঁয়ে ছুঁয়ে হেঁটে চললেন। বর্গাকৃতি চওড়া বারান্দায় দেয়াল ঘেঁষে জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আছে। লোকগুলো ক্লারা দরবেশের ঘরের দরজার পাশে কোণের দিকে এবং প্রদোষ পাশেই পা ছড়িয়ে চিত হয়ে ঘুমোচ্ছে। তার পায়ের কাছে পাশের সেই ঘরটার দরজা। সেখানে চৌকাঠে ব্যাগ রেখে মাথা দিয়েছে হরিপদ বাউল, বুকের ওপর একতারা। তার পাশেই ডাক্তার ব্ৰজহরি কুণ্ডু কাত হয়ে শুয়েছেন। উল্টোদিকের দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছেন কর্নেল, গায়ে রেনকোট, মাথাটি বুকের ওপর ঝুলন্ত এবং টুপিতে মুখ ঢাকা। তাঁর পাশে ঘনশ্যাম ওরফে হর্ষনাথ কুঁকড়ে শুয়ে আছেন। বংকুবিহারী ঠিক মাঝখানে। কিন্তু চাক্কু ও পুঁতি নেই। ক্লারা একটু অবাক হল। দরবেশ চিমটে বাড়িয়ে দারোগাবাবুকে ছুঁয়ে পাশ কাটিয়ে প্রাঙ্গণে নামলেন। দারোগাবাবুর প্রচণ্ড নাক ডাকছে। দরবেশ প্রাঙ্গণে চক্ষুষ্মন মানুষের মতো হেঁটে দরগার কাছে গেলে ক্লারা বুঝতে পারল, এখানকার প্রতি ইঞ্চি মাটি ওঁর জানা।
ক্লারা চাক্কু ও পুঁতিকে খুঁজতে বসে থাকা অবস্থায় হরিপদর মাথার পাশ দিয়ে পাশের ঘরটার ভেতর উঁকি দিল। দেখল পুঁতি ঘুরে কাত হয়ে শুয়ে
আছে এবং চাক্কু চিত। শালীনতাবশে ক্লারা সরে এল। তারপর মনে পড়ল। শাওনির কথা। সঙ্গে সঙ্গে কোনায় তার ও প্রদোষের মাথার কাছে রাখা কিটব্যাগ, সুটকেস দেখে নিল। ব্লাউজের ভেতর হাত রেখে তার ছোট্ট পাসটাও আছে দেখে নিশ্চিন্ত হল। কিন্তু শাওনি নেই। সে কোথায় থাকতে পারে বুঝতে পারল না ক্লারা। নাকি সাঁতার কেটে চলে গেছে? দুঃখিত মনে ক্লারা উঠল। শাড়িটা গুছিয়ে পরল। মনে পড়ল, সেবার নভেম্বরে ক্যালিফর্নিয়ার ইওনিসিটি ন্যাশনাল পার্কে পাহাড়ে ট্রেকিং করতে গিয়ে ক্লিভল্যান্ড পাসের ওধারে আটকে গিয়ে চার বন্ধুর জীবনমরণ অবস্থা ঘটেছিল। তবে ওদের সঙ্গে ক্যাম্প এবং স্লিপিং ব্যাগ ছিল। রেডিও-ট্রান্সমিটার ছিল। ফিনিক্স থেকে একটা লোক নিজের হেলিকপ্টারে উদ্ধার করে নিয়ে যায়। কিন্তু এটা ভারত নামে দেশ। এখানে সবই অন্যরকম, বিরক্তিকর হলেও রহস্যময় সারা রাত যা সব টের পেয়েছে, ফিসফিস কথাবার্তা অথবা জলের শব্দ, বাতাসের শব্দ, পোকামাকড়ের শব্দ মিশে ওইরকম মনে হচ্ছিল। কারা বা কেউ চলাফেরা করে বেড়াচ্ছিল কোথাও। এবং চুল্লু!
ক্লারা প্রাঙ্গণে মেনে চুল্লুর নিদর্শন খোঁজার জন্য এদিকে-ওদিকে তাকাচ্ছিল। দরবেশ দরগার ওপাশে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করছেন চোখে পড়ল। চোখে কালো চশমা। কালো আলখেল্লা। সত্যিই কি চুল্লু নামে কোনো অশরীরী প্রেতাত্মা দরবেশের অনুগত ভৃত্য? ক্লারা কয়েক পা এগিয়ে গেল। প্রাঙ্গণের ওপর আকাশ নির্মেঘ। লাইমকংক্রিটের একটুকরো ভিজে চত্বরে দরবেশ হাঁটু দুমড়ে বসে প্রর্থনা করছিলেন। ক্লারা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল। রহস্যময় পুরুষ।
রহস্যময় পুরুষটি বুকে চিমটেটি ঝুনঝুন শব্দে ঠুকতে শুরু করলেন। তারপর বললেন, চুল্লু! ক্লারা চমকে উঠল। কারণ সঙ্গে সঙ্গে বটগাছের ওদিকে কোথাও কী একটা পাখি ডানা ঝটপট করে এসে বসল অথবা উড়ে গেল। ক্লারা একটু ভয় পেল। ভিজে জঙ্গলের ভেতর এখনও প্রচুর অন্ধকার জড়িয়ে আছে। তার চারদিক ঘিরে তাকে ফাঁদে ফেলার জন্য অসংখ্যাসংখ্য চুল্ল বুঝি ওতে পেতে আছে। নিজের অলক্ষে ক্লারা বুকে ক্রশ আঁকার ভঙ্গি করেই টের পেল, অভ্যাস! ননদিনীর শেখানো রামনাম বিড়বিড় করে উচ্চারণ করতে করতে ক্লারা বারান্দায় পৌঁছুল। লোকগুলিকে এবং প্রদোষকে দেখে তার সাহস ফিরে এল। তারপর আইনরক্ষক এবং তার কোমরে খাপে ভরা আগ্নেয়াস্ত্রটি দেখে ক্লারা নিজের ভয়পাওয়াটাকে মনে মনে তিরস্কার করল। এই তো সে দেখতে চেয়েছিল, পৌঁছুতে চেয়েছিল এরকম যথার্থ আদিমতায়, প্রকৃতির অভ্যন্তরে– যেখানে প্রেতাত্মা ও সন্তপুরুষ, সাপ এবং ডাইনি ক্ষিদে এবং মৃত্যুর কারুকার্য। এই তো সেই প্রাচ্যদেশীয় গভীরতা! পাপ-পুণ্য আলো-অন্ধকার জীবন-মৃত্যুর রহস্যলোক।
ক্লারা একটু হাসল। ঘুমন্ত লোকগুলির দিকে তাকাল। বংকুবিহারীর নাক ডাকা দেখে ক্লারা নিঃশব্দে হাসতে লাগল। তারপরই তার চোখ গেল আইনরক্ষকের মাথার দিকে মেঝেয় পোঁতা জলের জালাটির দিকে। জালাটির মাথায় ঢাকনা চাপানো এবং মেঝে থেকে ইঞ্চি চারেক উঁচু জালাটির কিনারা। ঠিক তারই পেছনে দেয়ালের কোনায় কালো কী একটা জড়ানো পেঁচানো জিনিস। দৃষ্টিস্বচ্ছ ক্লারা চিত্রবিচিত্র একটি কুণ্ডলীপাকানো সাপকে আবিষ্কার করল এবং মাতৃভাষায় চেঁচিয়ে উঠল।
প্রথমে টুপি সরিয়ে কর্নেল সাড়া দিলেন, কী হয়েছে ডার্লিং?
সাপ! সাপ! প্রকৃত একটি সাপ।
কোথায়?
পুলিশমহাশয়ের মাথার কাছে। আপনি লক্ষ্য করুন, দেখুন। ওই যে, ওই সাপটি।
কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে সাপটিকে দেখে বললেন, বিষাক্ত মনে হচ্ছে। তবে কালকের সেই সাপটা নয়। এটার দিশি নাম বাঁকরাজ।
বাউল হরিপদ তড়াক করে উঠে ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছিল। বলল, কী হয়েছে গুরু?
কর্নেল ঝুঁকে ঘুমন্ত বংকুবিহারীর জুতোসুদ্ধ পাদুটো ধরে হাঁচকা টানে সরিয়ে আনলেন। অমনি বংকুবিহারী তড়াক করে উঠে কোন ব্যাটারে বলে রিভলবার বের করলেন। ওদিকে ক্লারা প্রদোষকেও টেনেছে নিরাপদ দূরত্বে এবং প্রদোষও লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। এসবের ফলে ঘনশ্যাম ও ব্রজহরি জেগে গেলেন। হরিপদ চেঁচিয়ে উঠল, সাপ! সাপ! পাশের ঘর থেকে পুঁতি ও চাক্কু উঠে এসে উঁকি দিল দরজায়।
কুণ্ডলীপাকানো বাঁকরাজ সাপটি এবার লম্বা হওয়ার চেষ্টা করছিল। সে মাটিতে প্রচণ্ড স্পন্দন টের পেয়েছিল। বংকুবিহারী সাপ শুনেই কয়েক পা পিছিয়ে এসেছিলেন। এবার রিভলবার তাক করলেন। প্রাঙ্গণে দরবেশ চেঁচিয়ে উঠলেন, চুল্লু! বংকুবিহারী হিংস্রমূর্তি হয়ে তোর চুল্লুর নিকুচি করেছে ব্যাটা, এইবলে পর পর দুবার গুলি ছুড়লেন। প্রথম গুলিতে জালার মাটির ঢাকনা গুঁড়িয়ে গেল। দ্বিতীয় গুলিটি সাপটির লেজে লাগল। ক্রুদ্ধ সাপটি তেড়ে এল। দুপদাপ শব্দে সবাই তখন প্রাঙ্গণে। আহত সাপটি ছোবল ছুড়ছে, ফণা নেই, চেরা জিভ লক লক করছে। কর্নেল প্রাঙ্গণ থেকে টুকরো ইট তুলে তার মাথায় মারলেন। সঙ্গে সঙ্গে সাপটি ওলটপালট খেতে খেতে নেতিয়ে পড়ল। কর্নেল আরেক টুকরো ইট তুলে মাথাটা ঘেঁচে দিলেন। তারপর লেজ ধরে তুলে জলে ফেলতে গেলেন। বংকুবিহারী শ্বাস-প্রশ্বাসের মধ্যে বললেন, এমার্জেন্সির জন্য কিছু বুলেট মজুত রাখা উচিত। নয়তো ওকে– বাপস! একেবারে মাথার কাছে–ওঃ।
দরবেশ বারান্দায় উঠে বললেন, চুল্ল! তারপর চিমটে বাড়িয়ে অভ্যাসমতো এগিয়ে দরজার তালা খুলতে থাকলেন। হরিপদ ভীত মুখে বলল, গুরুর কৃপায় বেঁচে গেছেন দারোগাবাবু?
ব্ৰজহরি বললেন, পিরবাবার দয়ায়! কী বলেন হর্ষবাবু?
ঘনশ্যাম মুখ বাঁকা করে বললেন, দয়াটায় নয় মশাই। ওসব বাজে কথা। বাইচান্স গায়ে হাতটা পড়েনি তাই।
ক্লারা দেখতে গেল, কর্নেল কোথায় সাপটাকে ফেলছেন। প্রদোষ একটু হাসল। বংকুবিহারীর উদ্দেশে বলল, অন্তত এসময় একটু চা পেলে মন্দ হত না। দরবেশসায়েব তো চা খান মনে হচ্ছে। ওই দেখুন কেটলি। কেরোসিন কুকারও।
বংকুবিহারী বারান্দায় উঠে বললেন, দরবেশসায়েব। কাল রাত্তিরে তো দানাপানি বরাতে জোটেনি আমাদের। এখন আমরা কি একটু চা পেতে পারি?
ব্ৰজহরি বললেন, টাকাকড়ি দেওয়া যাবে অবশ্য। ফের চাঁদা তুলব।
দরবেশ তখন ঘরে। একটা তক্তাপোশ দেখা যাচ্ছিল। সেটা আড়াল করে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, আপনারা খুব জুলুম করছেন বাবারা মায়েরা। আমি অন্ধ মানুষ। আমি কী খেয়ে বাঁচব? আপনারা সাঁতার কেটে চলে যান দরগা থেকে। আর বর্ষা হবে না। আসমান খালি হয়েছে। চলে যান। এ অন্ধের ওপর আর জুলুম করবেন না।
ব্ৰজহরি জিভ কেটে বললেন, না না। জুলুম করব কেন? আপনি সিদ্ধপুরুষ। আপনি ইচ্ছে করলেই মুখের খাদ্য জুটে যাবে।
ঘনশ্যাম বললেন, রিলিফের নৌকো এসে যাবে দেখবেন। এখন আমাদের প্রাণ বাঁচান।
দরবেশ শুধু বললেন, চুল্লু। তারপর তক্তপোশে পা ঝুলিয়ে বসে বুকে চিমটে ঠুকতে থাকলেন।
ঘনশ্যাম ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন, ছেড়ে দিন। কই চলুন দেখি জলের অবস্থা। রিলিফের নৌকোও নিশ্চয় দেখতে পাব। ডাকব চেঁচিয়ে।
ব্ৰজহরি শ্বাস ফেলে বললেন, তাই চলুন। রাস্তার দিকটায় যাওয়া যাক। নিশ্চয় ওখান হয়ে রিলিফের নৌকো যাবে।
হরিপদ জয়গুরু বলতে বলতে একতারা পিড়িং পিড়িং করতে করতে ওঁদের সঙ্গ ধরল। একটু পরে বংকুবিহারীও ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বারান্দা থেকে নামলেন। তিনিও দেউড়ির দিকে ওঁদের অনুগামী হলেন।
চাক্কু বলল, পারবি সাঁতার কাটতে?
পুঁতি বলল, তোমার মাথা খারাপ? জলতল অবস্থা। দরগায় জল উঠল বলে- দেখবে।
চাক্কু গেল দক্ষিণে বটগাছের দিকে। একটু পরে পুঁতি ওকে অনুসরণ করল। চাক্কু ভাঙা মুসাফিরখানার ভেতর ঢুকেই বলল, উরে বাস! দরগায় জল ঢুকল বলে।
পুঁতি বলল, বললাম তোমাকে। আমি ডুবোদেশের মেয়ে। বুঝতে পারি। মানুষের পাপ যেবছর বেশি হয়, সেবার পিথিমি জলতল হয়। পাপ খোঁড়াপিরের দরগায় পর্যন্ত হাজির। আমাকে পর্যন্ত ছুঁতে এল, এত সাহস।
চাক্কু রাগ করে বলল, তোর খালি ওই কথা। ডাক্তারবাবুর মতো।
আমি বানের জলে চান করলে গা ঘিনঘিন যাবে না। পুঁতি নাকের ডগা কুঁচকে বলল। বেশ্যা মাগীর সাহস, আমাকে সার্চ করতে এল।
চাক্কু গম্ভীর হয়ে গেল। আস্তে বলল, ডেগারখানা কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস বল তো?
পুঁতি খাপ্পা হয়ে বলল, আমি তার কী জানি? নিজেই লুকিয়েছে। ভেবেছিলে, যদি মাগীর বুকে বসিয়ে দিই– সেই ভয়ে।
চাক্কু ওর দিকে নিষ্পলক চোখে তাকাল। তারপর সিগারেটের প্যাকেট বের করল। দেশলাই কিছুতেই জ্বালাতে না পেরে সে প্রদোষের কাছে চলে গেল। পুঁতি দাঁড়িয়ে রইল। ঠোঁট কামড়ে ধরে সে ভাঙা ঘরটার ভেতর দিয়ে বিস্তীর্ণ জলের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলল।
প্রদোষ প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে ছিল। লাইটার জ্বেলে চাক্কুর সিগারেট ধরিয়ে দিল। নিজেও ধরাল সিগারেট। তারপর বলল, এখানে প্রচণ্ড সাপ! তাই না?
চাক্কু বলল, হ্যাঁ সার। পেচণ্ড। আসলে চারদিক জলতল হলে সাপগুলান ডাঙা মাটিতেই তো ছেণ্টার নেবে। বলুন তাই কি না? তাও তো আগের মতো সাপ আর নাই। ফলিডল-টলের চোটে মারা পড়েছে। এদিকে ধরুন, শেয়াল বলতেও আর নাই। নৈলে দেখতে পেতেন। বাপ-ঠাকুর্দার মুখে শুনেছি বাঘও ছিল। এই দরগায় নমো করতে আসতো। কত লোক দেখেছে। নৈলে বানের সময় বাঘও দেখতে পেতেন। তবে বিপদের সময় তো। বাঘ–
ক্লারা কর্নেলকে খুঁজে না পেয়ে ফিরে এসেছিল। কথা শুনছিল। চাক্কু থামলে সে ব্যস্তভাবে বলল, বলুন আপনি বলুন। খুব ভাল লাগল শুনতে। আর কী সব হত, বিস্তারিত বলুন।…
.
তৃতীয় হত্যাকাণ্ড
ভাঙা দেউড়ির পর কয়েকপা এগিয়ে থমকে দাঁড়িয়েছিলেন ওঁরা ব্ৰজহরি, ঘনশ্যাম, বংকুবিহারী, হরিপদ। হরিপদর একতারা থেমে গিয়েছিল। সামনে জল। ছত্রখান ঐতিহাসিক পাথরের স্ল্যাবগুলোর তলা ও ওপর দিয়ে বন্যা ছলকে আসছে। ঢালুতে উঁচু গাছপালার গুঁড়ি অব্দি ডুবে গেছে। ঝোপঝাড় তলিয়ে গেছে। গাছপালার আড়ালে কিছুটা দূরে বাঁশবনের ভেতর কচুরিপানার আঁক আটকে আছে দেখে হরিপদ বলে উঠল, ওই গো! পাটুলির বিল ভেসে গেছে। নতুন বাঁধ। টিকবে কেন?
ব্ৰজহরি গুম হয়ে বললেন, তাহলে হোল সাবডিভিসন জলের তলায়।
বংকুবিহারী আনমনে প্রশ্ন করলেন, কেন?
ব্ৰজহরি একুট বিরক্ত হয়ে বললেন, এরিয়ায় আমি নতুন এসেছি। আমার চাইতে আপনারই জানার কথা বেশি।
পাটুলি-আটুলি আমার জুরিশডিকশন নয়। বংকুবিহারী তেমনি আনমনে বললেন। ওদিকটা অন্য থানা।
ব্ৰজহরি আক্ষেপে বললেন, আমরা পরমাণু বোমা ফাটাতে পারি। স্যাটেলাইট পাঠাই স্পেসে। ভাল করে একটা বাঁধ বাঁধতে পারি না। এই তো অবস্থা!
ঘনশ্যাম চুপ করে থাকতে পারলেন না, যাদিও ভেবেছিলেন মুখ খুলবেন না। বললেন, সোস্যাল কন্ট্রাডিকশনটা বুঝতে হবে। ফিউডালিজম যখন ক্যাপিটালিজমের পোশাক পরতে চায় তৃতীয় বিশ্বের কথাই বলছি, যেমন ধরুন
বংকুবিহারী ধমক দিলেন, ধূর মশাই! নেচার। সায়েবদের দেশে ফ্লাড হয় না?
ঘনশ্যাম মরিয়া হয়ে বললেন, নেচারকে অস্বীকার করছি না। কিন্তু স্টালিন বলেছেন, প্রকৃতির নিজস্ব নিয়ম আছে। আমরা নিয়মকে বদলাতে পারি না, কন্ট্রোল করতে পারি। এখন কথা হল, কন্ট্রোলিং সিস্টেমের মধ্যে যদি দ্বন্দ্ব থাকে, তাহলে কী হবে?
বংকুবিহারী রাগ করে হাসলেন। ..স্টালিন-ফালিন করে কোনো লাভ হবে না মশাই! এটা কমিউনিস্টগিরি ফলানোর সময় নয়।
ব্ৰজহরি বললেন, আপনাদের মাথায় আসল ব্যাপারটা ঢুকছে না। দুর্নীতি করাপশান! রন্ধ্রে রন্ধ্রে ওই পাপ ঢুকছে। বাঁধে বলুন, যেখানে বলুন, ওই এভিল অ্যাক্টিভ। দা স্যাটান লেট লুজ!
ঘনশ্যাম বললেন, ওসব মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারণা। পাপ এভিল-টেভিল বাজে কথা। পাপ করে কেন মানুষ? পাপ করার ঢালাও সুযোগ তো আছেই, উপরন্তু বেঁচে থাকার দায়। ওই মেয়েটির কথাই ধরুন। কী যেন নাম– শাওনি!
ব্রজহরি বললেন, আবার সাত-সকালে ওই নাম! আমনি চুপ করুন তো!
আপনি মহা ধার্মিক! ঘনশ্যাম ব্যঙ্গ করে বললেন। হিন্দু ধর্ম নাকি সর্বজীবে ব্রহ্মদর্শন করতে বলে। আর খ্রিস্টান ধর্ম বলে, পাপকে ঘৃণা করো, পাপীকে নয়!
ব্ৰজহরি তেড়ে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, বংকুবিহারী বাধা দিলেন। ধূর মশাই! খালি এঁড়ে তক্ক। ছাড়ুন তো ওসব। ওই দেখুন, সূর্য উঠছে। রিলিফের নৌকো খুঁজুন—এবারে স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যাবে।
হরিপদ একতারায় পিড়িং করলে বংকুবিহারী তাকেও থামিয়ে দিলেন। বললেন, ক্ষিদেয় নাড়ি জ্বলছে আর খালি পিড়িং পিড়িং! মেমসায়েবকে শোনাও গিয়ে। ওদের নাকি ক্যাপসুল চুষে ক্ষিদে মেটে।
অগত্যা ব্ৰজহরি একটু হাসলেন। বিবেকানন্দ বলেছেন, খালি পেটে ধর্ম হয় না। বুঝলেন তো?
ঘনশ্যাম আপন মনে চাপা গলায় বললেন, সর্বত্র একই অবস্থা। একদিকে প্রচুর খাদ্য, অন্যদিকে অনাহার। একদিকে প্রাচুর্য, অন্যদিকে অভাব।
ব্ৰজহরি অনিচ্ছাসত্ত্বেও শুনে ফেললেন।…তা অস্বীকার করা চলে না। যেমন, চোখের সামনেই দেখছি।
বংকুবিহারী সন্দিগ্ধস্বরে বললেন, কী?
ব্ৰজহরি ম্লান হেসে বললেন, দরবেশের ঘরে প্রচুর চাল-ডাল আছে চা-চিনি। আছে। আর আমরা ক্ষিদেয় মরছি। কিন্তু
ঘনশ্যাম ঝটপট বললেন, কিন্তু টা কিসের? কোনো কিন্তু নেই।
আহা, অন্ধ মানুষ! সাধুসন্ত। ব্ৰজহরি গোঁফ চুলকোতে থাকলেন। জোর করলে পাপ হবে। না হলে তো কেড়ে খেতে পরামর্শ দিতাম এতক্ষণ।
ঘনশ্যাম বললেন, কোনো পাপ হবে না। আপনারা আসুন আমার সঙ্গে।
বংকুবিহারী ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, ইউ আর রাইট। চলুন, আগে অনুরোধ করব ফের। তারপর
হরিপদ ব্যাকুল হয়ে বলে উঠল, দোহাই বাবুমশাইরা! শাপ লাগবে। বিপদ হবে আরও।
ব্ৰজহরি দ্রুত বদলে বললেন, আহা! টাকা দিয়েই চাইব ফের।
ঘনশ্যাম পা বাড়িয়ে বললেন, সব সহ্য করা যায়, ক্ষিদে সহ্য করা যায় না। চলুন, আমিই লিড নিচ্ছি।
ঘনশ্যাম আগে, তার পেছনে বংকুবিহারী, তার পেছনে দোনামনা করে ব্ৰজহরি, শেষে জয় গুরু, তোমার ইচ্ছা, বলে হরিপদ। প্রাঙ্গণে দরবেশের ঘরের বারান্দার নিচে দাঁড়িয়ে হাত-মুখ নেড়ে চাক্কু কথা বলছিল। সামনে ক্লারা। বারান্দায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে প্রদোষ। ঘনশ্যাম গিয়েই বললেন, আসুন। আমরা দরবেশের ঘরে ঢুকব। চাল-ডাল বের করব। চলে আসুন সব।
ক্লারা টের পেয়ে চেঁচিয়ে উঠল, না না! ওই কাজ করবেন না। একটু ধৈর্য ধরুন আপনারা।
বংকুবিহারীর ইশারায় চাক্কু একলাফে বারান্দায় উঠল। তারপাশে ঘনশ্যাম। চাক্কু দরজার দিকে এগিয়ে বলল, দরবেশবাবা! চাল-ডাল কী সব আছে বের করে দাও। দারোগাবাবুর হুকুম হয়েছে।
দরবেশ তার আগেই দরজার সামনে দাঁড়িয়েছেন। দুহাতে চিমটে তুলে বললেন, আয়! কে আসবি আয়! কুঁড়ে ফেলব তোদের। চুল্ল! চুল্লু! চুল্লু! চিমটেটা ভারি, লম্বা এবং সূচলো। সামনে খোঁচা মারতে থাকলেন ক্রমাগত। সেই সঙ্গে চিৎকার, চুল্লু! চুল্ল! চুল্লু! ঘনশ্যাম বললেন, চাক্কু! ওর চিমটেটা কেড়ে নাও। চাক্কু সুবিধে করতে পারল না। বন্ধুবিহারী প্রচণ্ড রেগে গিয়ে রিভালবার বের করে। বললেন, গুলি ছুড়ব বলে দিচ্ছি! ঘনশ্যাম চ্যাঁচামেচি করে বলতে থাকলেন, ছুড়ুন! ছুডুন! এ মুহূর্তে লোকটা মানবতার শত্রু! ওকে গুলি করে মারলে আপনার কি হবে না। আপনি পুলিশ। পুলিশকে রাষ্ট্র প্রয়োজনে খুন-খারাপির অধিকার দিয়েছে। ব্ৰজহরি রক্ষার চেষ্টা করছিলেন।…দরবেশবাবা! দরবেশবাবা! টাকা। দেব– আমরা চাদা করে টাকা দেব। আমাদের ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে। দরবেশ চিমটেটা নেড়ে এবার কান্নাজড়ানো স্বরে চেঁচালেন, চুল্লু! সেই সময় চাক্কু পাশ থেকে খপ করে চিমটের ডগা ধরে ফেলল। ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে গেল। দরবেশ চৌকাঠে পা আটকে টানতে থাকলেন চাক্কুকে। ঘনশ্যাম বললেন, ইট! ইট মারো! ক্লারা বড়ো চোখে তাকিয়ে দেখছিল। ঘুরে প্রদোষের দিকে তাকাল। প্রদোষ উঠে এসে তাকে সরিয়ে নেবার জন্য হাত ধরল। ক্লারা হাত ছাড়িয়ে নিল। ঘনশ্যাম ইট কুড়োতে প্রাঙ্গণে নেমেছিলেন। ইট কুড়িয়ে বারান্দায় উঠেছেন, এমন সময় চিলাচানি চেঁচাতে চেঁচাতে পুঁতি দৌড়ে এল, খুন! খুন! বেশ্যামাগি খুন হয়ে পড়ে আছে!
সঙ্গে সঙ্গে খাদ্যের জন্য সংঘর্ষ থেমে গেল। বংকুবিহারী বললেন, কী, কী?
পুঁতি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ওইখানে বানের জলে আটকে আছে। গলা ফাঁক।, আপনারা গিয়ে দেখুন! বুড়োসায়েব দাঁড়িয়ে আছে যান শিগগিরি!–
পুঁতি ধপাস করে বারান্দায় বসল। সে স্নান করেছে। ভিজে শাড়ি। চুলে জল গড়াচ্ছে। সবাই দৌড়ে বেরিয়ে গেলেন। দরবেশ ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন।…
.
চতুর্থ হত্যাকাণ্ড
কাল বিকেলে বংকুবিহারী যে চাঙড়টাতে বসে ইউনিফর্ম শুকোচ্ছিলেন, বন্যার জল সেটা ডুবিয়ে নিশ্চিহ্ন করেছে। জল উঠে এসেছে আস্তানা ঘরের পেছন দিকটায়, যেখানে ছোট-বড় ধ্বংসস্তূপ, খালি স্লেট পাথর, ফণিমনসার ঝোপ। শাওনি চিত হয়ে আটকে আছে সেই ঝোপের গায়ে। জল দুলছে, তার মড়াটা দুলছে। গায়ের শাড়ি আটকে আছে কাঁটায়। তা না হলে হয়তো ভেসে চলে যেত।
বংকুবিহারী একটুখানি ঝুঁকে থেকে সোজা হলেন। কর্নেলের দিকে তাকালেন। কর্নেল ফণিমনসার শরীর ছুঁড়ে বেরুনো মোচার মতো ফুলগুলো দেখছিলেন। বংকুবিহারী আস্তে বললেন, এখানেই ছিল?
কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। সাপটা ছুঁড়ে ফেলার পর চোখে পড়েছিল।
ব্ৰজহরি ডাক্তারের অভ্যাসে মড়াটা দেখতে পা বাড়ালেন। শাওনির মুখটা ওপাশে ঘুরে ছিল। একটা ডাল ভেঙে মুখটা সোজা করে দিলেন। পেছনে ক্লারার চমকে ওঠা কণ্ঠস্বর শোনা গেল। হরিপদ কাঁপা কাঁপা গলায় বলতে থাকল, হায় গুরু! জয় গুরু! প্রদোষ ক্লারাকে টেনে সরিয়ে নেবার চেষ্টা করল। পারল না। বংকুবিহারী গাঢ় স্বরে বললেন, কী মনে হল ডাক্তারবাবু?
ব্ৰজহরি চেষ্টা করলেন। কী মনে হবে? মাডার! বিশুদ্ধ হত্যাকাণ্ড।
কিন্তু একটা ব্যাপার লক্ষ্য করুন। বংকুবিহারী ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন। স্ট্যাবিং নয়। আচমকা অ্যাটাক নয়। ধীরেসুস্থে গলায় প্যাঁচ। মুসলমানরা যেভাবে হালাল– করে। চাক্কু!
চাক্কু চমকে উঠে বলল, সার।
তোর কাছে একটা ড্যাগার ছিল। বংকুবিহারী সন্দিগ্ধভাবে বললেন। এখনও সত্যি কথাটা বল!
চাক্কু ঝটপট বলল, রেতের বেলা তো সাচ করলেন সার!
চুপ! ধমক দিলেন বংকুবিহারী। তোর বউকে সার্চ করা হয়নি করতে দেয়নি তোর বউ। শাওনি তাকে সার্চ করতে গিয়ে গণ্ডগোল হল। কই, কোথায় সে? তাকে তো দেখছি না!
চাক্কু বলল, দরবেশের বারান্দায় বসে আছে। ডাকতে বলেন তো ডাকি!
বংকুবিহারী পা বাড়াতে গিয়ে ঘুরে বললেন, আপনারা কেউ কোথাও যাবেন না। এখানেই থাকুন। বলে চলে গেলেন দরগার দিকে। চাক্কু সেদিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে রইল। চোখ নিষ্পলক।
কর্নেল ডাকলেন। ডাক্তারবাবু! বডিটা টেনে তোলা দরকার। আসুন।
ব্ৰজহরি ইতস্তত করে বললেন, দারোগাবাবু
আপনি তো ডাক্তার। বডি পরীক্ষা করে অনুমান করতে পারবেন না কতক্ষণ আগে মেয়েটি মারা গেছে?
জলে পড়ে থাকা বডি! ব্ৰজহরি বিরক্ত হয়ে বললেন। মর্গের টেবিলে ছাড়া কিছু বোঝা অসম্ভব।
রাইগর মৰ্টিস শুরু হয়েছে কি না বলেই কর্নেল একটু হাসলেন। ভুল হচ্ছে। আমরা শাওনিকে কখন শেষবার দেখেছি, ঠিক করা দরকার। আমি দেখেছি শেষবার, তখন রাত্তির প্রায় সওয়া দুটো। ডাক্তারবাবু, আপনি?
আমি ঘুমুচ্ছিলাম।
হর্ষনাথবাবু?
ঘনশ্যাম ঠোঁট কামড়ে ধরে দূরের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। বললেন, আমিও ঘুমুচ্ছিলাম।
প্রদোষবাবু?
প্রদোষ সপ্রতিভ ভঙ্গিতে বলল, আমি কাউকে লক্ষ্য করিনি।
ক্লারা!
ক্লারা একটু ইতস্তত করল। তারপর বলল, রাত্রি তিনটার সময় পাশের ঘরে কেউ ঢুকেছিল। ভোরবেলা দেখলাম এই রিকশাওলা ভদ্রলোক আর তার স্ত্রী শুয়ে আছেন ওই ঘরে। ভাবলাম, তারাই হবে। কিন্তু–
কিন্তু কি?
ক্লারা বলল, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে শাওনি ঢুকেছিল। কারণ একজনকে ঢুকতে দেখেছলাম। চাক্কু, তোমরা কখন শুতে গিয়েছিলে পাশের ঘরে?
চাক্কু, বলল, বৃষ্টি থামলে পরে।
তার মানে চারটের কাছাকাছি। কর্নেল বললেন। তোমরা ও-ঘরে ঢুকে শাওনিকে দেখনি নিশ্চয়?
আজ্ঞে না সার! সে থাকলে বুঝতে পারতাম।
বংকুবিহারীর গজরানি শোনা গেল। চাক্কু! চাক্কু! এদিকে আয়! তোর বৌ পালিয়েছে সাঁতার কেটে। তাকে খুঁজে পেলাম না। তার মানে, তোর বউ মার্ডার করে পালিয়েছে। বলতে বলতে আইনরক্ষক এসে চাক্কুর গেঞ্জির কলার খামচে ধরলেন। হাতে রিভলবার।
কর্নেল হন্তদন্ত উঠে গেলেন তার কাছে।..খুঁজে পেলেন না পুঁতিকে?
না। বংকুবিহারী হুংকার দিলেন। রাত্তিরেই আমার সন্দেহ হয়েছিল চাক্কুর বউ ফেরোশাস টাইপের। শাওনিকে সার্চ করার সময় তার আটিচুড মনে পড়ছে। আপনাদের?
কর্নেল একটু হাসলেন। কিন্তু লুল্লু– মানে কুকুরটাকেও কি গলা পেঁচিয়ে কেটে ভাসিয়ে দিয়েছিল পুঁতি?
হোয়াট? আইনরক্ষক চাক্কুকে ছেড়ে লাফিয়ে উঠলেন। কী বলছেন আপনি?
হ্যাঁ। শাওনির মতো গলাকাটা কুকুরটা ওই বটতলায় পড়ে আছে।
বংকুবিহারীর সঙ্গে সবাই দৌড়ে গেল সেদিকে। শুধু দাঁড়িয়ে রইল চাক্কু। কর্নেল আস্তে বললে, চাক্কু! তুমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে যে? পুঁতিকে খুঁজতে ইচ্ছে করছে না?
চাক্কু ফুঁসে উল। পুঁতি যদি মার্ডার করে থাকে, বেশ করেছে। সে না করলে আমিই কাজটা করতাম। যদি বলেন কেন করতাম, তাহলে খুলে বলি।
বলো।
শাওনি কাল বিকেলে বলছিল, ভাল খদ্দের আছে টাউনে। পাঁচশো টাকা দেবে– মানে, পুঁতির দাম।
আর পুঁতি তোমার বউ। কাজেই এ কথায় তোমার রাগ হওয়া উচিত।
বউ? চাক্কু ভুরু কুঁচকে মুখ নামাল। গলার ভেতর বলল, পুঁতি ঠিক বউ নয়। তবে হ্যাঁ, ওর সিঁথেয় সিঁদুর দিতে হয়েছিল। কেন– কী, আপনারা কী ভাববেন। অবশ্যি–
বলো, বলো!
টাউনে গিয়ে ঠিকই বিয়ে করতাম ওকে। তবে এখনও ও আমার বউ না বউ হত পারে।
পরে শব্দটার ওপর খুব জোর দিল চাক্কু। কর্নেল ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, পুঁতি কি সাঁতার কেটে পালাতে পারে বলে তোমার মনে হয়?
চাক্কু একটু ভেবে বলল, তা পারলেও পারে। ডুবোদেশের মেয়ে। সাঁতার জানে। তবে মুখে বলছিল, এত জলে সাঁতার কেটে যেতে পারবে না। দেখছেন না, এত উঁচু দরগার গলা পর্যন্ত জল?
কর্নেল বললেন, আমার সঙ্গে এসো তো!
চাক্কু তাকে অনুসরণ করল। ডাইনে গাছপালার ভেতর দিয়ে দক্ষিণে বট গাছটার তলায় বংকুবিহারীদের দেখা যাচ্ছিল। উত্তেজিতভাবে কথা বলছেন ওঁরা। দরগা পেরিয়ে ডাইনে ঘুরলেন কর্নেল। ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে এগিয়ে বললেন, ওই যে ঝোপের ডগাটা দেখতে পাচ্ছ। ওর তলায় একটা তালডোঙা ডোবানো আছে। টেনে নিয়ে এস।
চাক্কু ভীষণ অবাক হল। তারপর গেঞ্জি, প্যান্ট খুলে একটা গাছের শেকড়ে রেখে, কাঁধের ব্যাগটাও, ডোরাকাটা আন্ডার-প্যান্ট পরা অবস্থায় সাবধানে নামল। গলা জলে দাঁড়িয়ে সে পা বাড়িয়ে খুঁজতে থাকল তালডোঙাটা। বলল, কৈ? কিছু নেই।
কর্নেল বললে, নিশ্চয় আছে। খুঁজে দেখ। বাঁধা আছে ঝোপের গোড়ায়। বৈঠাও ঢোকানো আছে দেখবে।
চাক্কু ডুব দিল। জলে বুজকুড়ি উঠতে থাকল। ভেঁস করে মাথা তুলে চোখ-মুখের জল হাত দিয়ে মুছে সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ডোঙা নেই। বৈঠা নেই। মনে হল, দড়ি আছে একটুখানি।
দড়িটা খুলতে পারবে না?
দেখছি। বলে চাক্কু আবার ডুব দিল। ভেঁস করে মাথা তুলে বলল, নাঃ। পারা যাবে না।
ঠিক আছে। উঠে এস।
চাক্কু উঠে এসে ব্যাগ থেকে ছোট্ট তোয়ালে বের করে মাথা ও মুছতে থাকল। কর্নেল বললে, এবার কী মনে হচ্ছে তোমার?
চাক্কু হাঁপধরা গলায় বলল, কী মনে হবে? হারামজাদি বোধ করি ভোঙাটা ডোবানো আছে জানত। ও ডোঙা বাইতে পারে। নিয়ে পালিয়ে গেছে।
কর্নেল চোখে বাইনোকুলার রেখে বহুদূর খুঁজলেন। বাঁ-দিকে– পূর্বে বাঁশবন তাই দৃষ্টি আটকে গেল। পুঁতি যদি বাঁশবনের দিকে ডোঙাটা নিয়ে যায়, দেখতে পাওয়া সম্ভব নয়। বাঁশবনটার ওধারে কিছু দেখা যাবে না এ টিবি থেকে।
কর্নেল ও চাক্কু দরগার কাছে গিয়ে দেখলেন সবাই দরবেশের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। বংকুবিহারী কর্নেলকে দেখে বললেন, আপনারা কি পুঁতিকে খুঁজতে গিয়েছিলেন? খি খি শব্দে হাসলেন আইনরক্ষক।…কান টানলে মাথা আসে। চাক্কু, তোকে অ্যারেস্ট করলাম। চুপ করে এখান বস্। আয়! বস্ এখানে।
চাক্কু বলল, ডোঙা
কথা কেড়ে বংকুবিহারী বললেন, ভোঙা পরে। কর্নেল সায়েব বলবেন। ডোঙার কথা। বলুন!
কর্নেল বললেন, তার আগে যে তালভোঙা নিয়ে এখানে এসেছিল, তাকে খুঁজে বের করা দরকার। আমার বিশ্বাস কোথাও সে লুকিয়ে আছে। তার মানে, যদি তাকে পাওয়া যায়, তবে বোঝা যাবে পুঁতিই ডোঙাটা নিয়ে পালিয়েছে। তা না হলে, আমার ভয় হচ্ছে—
ভয় পরে। আইনরক্ষক আদেশ জারি করলেন। প্রত্যেকে একেক দিকে খুঁজতে থাকুন। তন্ন তন্ন খুঁজে দেখুন। কিন্তু সাবধান করে দিচ্ছি, কেউ সাঁতার কেটে পালানোর চেষ্টা করবেন না। যে পালাতে যাবেন, তাকেই মার্ডারার বলা হবে। আন্ডারস্ট্যান্ড?
ক্লারা আস্তানাঘরের উত্তর-পশ্চিম কোণে একটা চাঙড়ের দিকে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ বলল, ওটা কী? তারপর দৌড়ে গেল। গিয়েই চিৎকার করে উঠল, হত্যা! হত্যা! সবাই দৌড়ে গেল। চাঙড়ের পেছনে পুঁতি শুয়ে আছে। রক্ত।…
.
কিছু সূত্র এবং থিওরি
টাটকা রক্ত। গলা ফাঁক। এখনও গাড়িয়ে পড়ছে। গাছপালার জটিলতা ছুঁড়ে দিনের প্রথম রোদ্দুর উঁকি দিচ্ছে। আকাশে আলতোভাবে ভেসে চলেছে। টুকরো-টুকরো সাদা মেঘ। ফাঁকা জায়গাগুলো প্রচণ্ড নীল। ঘনশ্যাম আকাশ দেখার ভান করছিলেন। ক্লারা মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রদোষ তার কাঁধে হাত রেখেছে। সেও এই ভয়ংকর বাস্তবতা থেকে উল্টেটাদিকে দাঁড়িয়েছে। চাক্কু পলকহীন চোখে তার প্রেমিকার বুকের পাশে বসে রক্ত দেখছে। বংকুবিহারীর হাতে রিভলবার। চারদিকে ঘুরে-ঘুরে দেখছেন। ডাক্তার ব্রজহরি কুণ্ডু ঠোঁট কামড়ে ধরেছেন, দেখছেন এবং চোখ পিটপিট করছেন। কর্নেল হাঁটু ভাজ করে পুঁতির দেহের চারপাশে ভিজে ঘাম ও মাটি খুঁজছেন। দেখছিলেন, রক্তের ধারা ঢাল গড়িয়ে বন্যার দুলন্ত জলে মিশে যাচ্ছে। পুঁতির দুটো পা জলে ভাসছে। দুলছে। একটা ঝোপের ডগাটুকু জেগে আছে পায়ের নিচে এবং সেই ডগায় বসে আছে একটা ঝলমলে প্রজাপতি। কর্নেল প্রজাপতিটা দেখতে থাকলেন। ভাবলেন, প্রজাপতির জাল হলে সহজে এই অসাধারণ প্রজাপতিটা ধরা যায় অবশ্য। কিন্তু মনস্থির করতে পারলেন না। সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। গাঢ় নৈঃশব্দ্য ভেঙে কিছু বলবেন ভাবলেন। বললেন না।
বংকুবিহারী ফোঁস শব্দে শ্বাস ছাড়লে ব্ৰজহরি ভাঙা গলায় বললেন, আমিই বলেছিলাম
কর্নেল অন্যমনস্কভাবে বললেন, কী?
হঠাৎ ছ্যাৎরানো কণ্ঠস্বরে ব্ৰজহরি চেঁচিয়ে উঠলেন, দা স্যাটান লেট লুজ! আমরা কেউ বাঁচব না। প্রত্যেককে এইরকম চিত হয়ে পড়ে থাকতে হবে– গলা ফক, চাপচাপ রক্ত, মুখে মাছি!
হরিপদ বাউল সবার পেছনে দুহাঁটুর ফাঁকে মাথা গুঁজে নিঃশব্দে কাঁদছিল। মুখ তুলে ভিজে গলায় বলল, হায় গুরু! বলেই ফুঁপিয়ে উঠল।
বংকুবিহারী গর্জন করলেন, এই ব্যাটা! ন্যাকামি করিস নে। আর ডাক্তারবাবু, আপনাকেও বলছি– ওসব পাগলামি ছাড়ুন। ইউ আর অল আন্ডার অ্যারেস্ট! আইনরক্ষক প্রত্যকের দিকে রিভালবারের নল তুলে বললেন, ইউ! ইউ! ইউ! ইউ! চাক্কু, তুই নির্দোষ। কারণ তুই আমার সামনে ছিলিস। তুই খালাস! তারপর কর্নেলের উদ্দেশে বললেন, আপনার গিতিবিধি সন্দেহজনক। কাল থেকে আমি লক্ষ্য করছি। আপনার সঠিক পরিচয়–
কর্নেল তার কথার ওপর বললেন, কোনো ধস্তাধস্তির চিহ্ন নেই। এটাই আশ্চর্য! মেয়েটি সম্ভবত বাধা দেবার এবং চেঁচাবার সুযোগ পর্যন্ত পায়নি। এ থেকে মনে হয় খুনী ওর চেনা লোক।
বংকুবিহারী ক্রুদ্ধভাবে তাকিয়ে থাকলেন ওঁর দিকে। ঘনশ্যাম হাসবার চেষ্টা করে বললেন, এই দুটি ঘটনার–না, তিনটি ঘটনায়, মানে হতভাগা কুকুরটিকেও হিসেবে ধরা উচিত, প্রমাণিত হল আমাদের সমাজব্যবস্থার স্বরূপ। তবে দারোগাবাবু যে বললেন, উই আর আন্ডার অ্যারেস্ট! এতেও এই সমাজব্যবস্থায় আইনের ভূমিকা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে।
ব্ৰজহরি ক্ষুব্ধ। বললন, এই মেয়েটি সদ্য খুন হয়েছে। ওই দেখুন, এখনও রক্ত বেরুচ্ছে গলগল করে। এবং ওকে যখন খুন করা হচ্ছে, তখন আমরা প্রত্যেকে দারোগাবাবুর সামনে উপস্থিত ছিলাম। এ অবস্থায় প্রমাণিত হচ্ছে, আমরা কেউ ওকে খুন করিনি। সুতরাং হর্ষনাথবাবু ইজ কারেক্ট।
ঘনশ্যাম আরও জোর পেয়ে বললেন, কারেক্ট। কিন্তু একটু ভুল হল ডাক্তারবাবু! আমরা যখন আস্তানাঘরে মেয়েটিকে খুঁজতে এলাম, তখন একজন আমাদের মধ্যে উপস্থিত ছিল না।
বংকুবিহারী বললেন, কে সে?
ঘনশ্যাম ক্লারার দিকে আঙুল তুলে বললেন, ওই মেমসায়েব। মনে করে দেখুন, মেমসায়েবই এখানে দাঁড়িয়ে হত্যা হত্যা করে চেঁচাচ্ছিলেন।
ক্লারা কী বলতে যাচ্ছিল, প্রদোষ ঘুষি তুলে বলল, আর একটা কথা বললে দাঁত ভেঙে দেব।
ঘনশ্যাম শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, চেষ্টা করে দেখতে পারো! তোমার মতো বিস্তর বুর্জোয়া-পাতি বুর্জোয়া আমার দেখা আছে। এস, চলে এস!
ব্ৰজহরি মাঝখানে দাঁড়িয়ে বললেন, হচ্ছেটা কী? দারোগাবাবু, আবার একটা খুনোখুনি হয়ে যাবে যে!
ক্লারা প্রদোষকে টানতে টানতে আস্তানাঘরের দিকে নিয়ে গেল। বংকুবিহারী হাল ছেড়ে দিয়ে বসে পড়লেন একটা চাঙড়ে। শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, মরুক। সবাই মরুক। আমার কিছু করার নেই। আমার মাথা ভোঁ-ভোঁ করছে।
ব্ৰজহরি বললেন, নার্ভাস ব্রেকডাউন! চলুন, আপনাকে একটা ট্যাবলেট দিই। আমিও একটা খাব। আমারও মাথাটা কেমন করছে। মনে হচ্ছে চেঁচামেচি করি। সব ভাঙচুর করে ফেলি। চাক্কু, উঠে আয়! তোকেও একটা ট্যাবলেট দেব। চাক্কু! শুনতে পাচ্ছিস কী বলছি? কর্নেল, দেখুন তো ছোকরার কী হল?
চাক্কু এতক্ষণে দুহাতে মুখ ঢেকে হাঁউমাউ করে কেঁদে উঠল। হরিপদ গিয়ে তাকে ধরল। টানতে টানতে নিয়ে এল উঁচু জায়গায়। চাক্কু নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে ভাঙা গলায় বলল, আমাকে ছেড়ে দাও। আমি জলে ডুবে মরি। আমার আর বেঁচে থাকতে মন চায় না।
ঘনশ্যাম তার কাধ ধরলেন। ..মরবি কেন বাবা? লড়াই করে বরং মরবি। আয়, আমার সঙ্গে আয়। তোকে একটা-একটা করে বুঝিয়ে দিচ্ছি, গণ্ডোগোলটা কোথায়। কেন সবার আগে মেয়েদের গায়েই আঘাতটা পড়ে।
ঘনশ্যাম ও হরিপদ চাক্কুকে টানতে টানতে আস্তানাঘরের দিকে নিয়ে গেলেন। ব্ৰজহরি ভুরু কুঁচকে নাকে রুমাল চেপে বললেন, কর্নেলসায়েব! দারোগাবাবু! এই টাটকা রক্তের কাছে আর কিছুক্ষণ থাকলে আমরা সত্যি পাগল হয়ে যাব। চলুন, দরবেশের ওখানে যাই। সুস্থ মস্তিষ্কে চিন্তা-ভাবনা করি। আসুন!
বংকুবিহারী গুম হয়ে বসে রইলেন। কর্নেল বললেন, ডাক্তারবাবু, কাল আপনি যেন কাকে দেখেছিলেন!
ব্ৰজহরির মনে পড়ল। নড়ে দাঁড়ালেন।…তাই তো! দেখেছিলাম যেন কালোমতো একটা কিছু ওই যে গাছগুলো দেখছেন, ভাঙা দেয়ালটার কাছে।
বংকুবিহারী গলার ভেতর বললেন, তালডোঙাটার কথাও ভাবা উচিত।
কর্নেল বললেন, হ্যাঁ তালডোঙাটা একটা বড় সূত্র। ধরুন, তালডোঙা চেপে যে এখানে এসেছিল তাকে শাওনি চিনত। আমি গিয়ে পড়ায় সে গা ঢাকা দিয়েছিল। তারপর শাওনি অথবা সে আড়াল থেকে দেখেছিল, আমি তালডোঙাটা কোথায় লুকিয়ে রাখছি।
বংকুবিহারী বললেন, আপনি মশাই অদ্ভুত লোক! আমাদের তক্ষুনি সেটা না জানিয়ে অমন করে এটা লুকোতে গেলেন কেন? ঠিক এই পয়েন্টটাতে আপনার অ্যাক্টিভিটি অত্যন্ত ডাউটফুল। তাই না ডাক্তারবাবু?
ব্ৰজহরি বাঁকা হেসে বললেন, উঁহু! ভেবেছিলেন আপনি বাঁচলে বাপের নাম। একা সুড়ুৎ করে কেটে পড়বেন আর কী! সেলফিশ অ্যাটিচ্যুড একেই বলে।
কর্নেল একটু হাসলেন। না ডাক্তারবাবু! লোকটা কে, আমার জানা দরকার ছিল।
বংকুবিহারী বলেন, কেন?
যেহেতু সে গা-ঢাকা দিয়েছিল আমার সাড়া পেয়েই।
ব্ৰজহরি চঞ্চল হয়ে চাপা স্বরে বললেন, একটা থিওরি মাথায় আসছে।
আইনরক্ষক দ্রুত বললেন, বলুন, বলুন!
ব্ৰজহরি চারিদিক দেখে নিয়ে তেমনি চাপা স্বরে বললেন, শাওনিও তালডোঙাটা– কর্নেলসায়েবের কথায় বিশ্বাস রেখেই বলছি, লুকিয়ে রাখা দেখেছিল। ধরুন, সে শেষরাত্তিরে সেটা জল থেকে তুলে এই দ্বীপ থেকে– হ্যাঁ, এটা এখন দ্বীপই বলা যায় কি না বলুন আপনারা?
বলা যায়। বংকুবিহারী সায় দিলেন। দ্বীপ বৈকি। চারদিকে অগাধ জল। সমুদ্র! মাঝখানে একটা দ্বীপ!
ব্ৰজহরি উত্তেজনায় বসে পড়লেন, আরেকটা চাঙড়ে।…ধরুন, ডোঙাটা তুলে জল বের করে শাওনি রেডি হয়েছে, এমন সময় লোকটা টের পেয়ে তাকে–
বংকুবিহারী বললেন, ওয়ান্ডারফুল! তাই বটে!
ব্ৰজহরি উৎসাহ পেয়ে বললেন, এছাড়া অন্য ব্যাখ্যা হয় না।
কর্নেল একটু হেসে বললেন, কিন্তু ডোঙাটা লুকোনো ছিল দক্ষিণপূর্ব কোণে। শাওনির ডেডবডি পাওয়া গেছে পশ্চিমে অনেক দূরে। আস্তানাঘরের পেছনের ঢালে ফণিমনসার ঝোপে।
ব্ৰজহরি বলেন, কোনো গণ্ডগোল নেই! সোজা হিসেব। ফ্লাডের জল দরগার চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে লক্ষ্য করুন। বডিটা ভাসতে ভাসতে ওখানে চলে গেছে। ফণিমনসার কাটায় আটকে গেছে।
কিন্তু তাহলে পুঁতিকে খুন করল কে? কর্নেল বললেন। হত্যার পদ্ধতি– অবিকল এক। শ্বাসনালী কেটে হত্যা।
ব্ৰজহরি দমে গিয়ে শ্বাস ছাড়লেন। বংকুবিহারী বললেন, লোকটা ধরুন, চলে যায়নি। কোনো উদ্দেশ্য ছিল তার। এবং পুঁতি তাকে চিনতে পেরেছিল।
ব্ৰজহরি আবার উৎসাহ পেলেন।…ঠিক তাই। আমরা যখন ওদিকে শাওনির বডির কাছে, তখন সে এখানে তালডোঙাটা লুকিয়ে– ওই ঝোপগুলোর মধ্যে লুকোনো সহজ, এবং
বংকুবিহারী বললেন, ভাসমান অবস্থায় লুকিয়ে, বলুন!
হুঁ, ভাসমান অবস্থায়। ব্ৰজহরি বললেন। তালডোঙায় নেমেই সে পুঁতির মুখোমুখি হল!
বংকুবিহারী বললেন, পুঁতি তাকে চিনত। কাজেই পুঁতিকে সে– মাই গুডনেস! বংকুবিহারী লাফিয়ে উঠলেন। লোকটা নিশ্চয় ইসমাইলড়াকু–যাকে ধরতে ফাঁদ পেতেছিলাম!
ব্ৰজহরি প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন। কাঁটায়-কাঁটায় মিলে যাচ্ছে সব! দুয়ে দুয়ে চারই হচ্ছে। পুঁতিকে মেরে রেখে বেগতিক বুঝে ডাকু ব্যাটা ডোঙায় চেপে পালিয়ে গেছে। কারণ ঠিক তখনই মেমসায়েব এদিকে আসছিল।
কর্নেল বললেন, কিন্তু জলটা হঠাৎ বেড়ে যাচ্ছে দেখছেন! পুঁতির কোমরুঅব্দি ভাসছে। ওই দেখুন!
মাই গুডনেস! বংকুবিহারী চমকে উঠে তাকালেন সেদিকে। পুঁতির বডিটা দুলছে। ভয় পাওয়া গলায় বলেন, ফের, কিছু করার নেই। উই আর হেল্পলেস! দা নেচার ইজ বিয়ন্ড দা রিচ অফ এনি হিউম্যান ল।
ব্ৰজহরি উদাত্ত স্বরে বললেন, আস্তানাঘরের ছাদে উঠব বেগতিক দেখলে। যদি দেখি, সেখানেও জল উঠছে, গাছে গিয়ে চাপব। পরস্পরকে হেল্প করব। কোঅপারেশন হল মানুষের টিকে থাকার মূল কথা। দা রুট অফ হিউম্যান একজিটেন্স। চলে আসুন! নেচারকে জয় করার ক্ষমতা মানুষের আছে। ভাববেন না!
বংকুবিহারী পা বাড়িয়ে বললেন, ট্যাবলেট দেবেন বলছিলেন।
দেব। আসুন। কর্নেলসায়েব! কী দেখছেন? ইসমাইলকে পালাতে দেখছেন নাকি?
কর্নেল একটা উঁচু লাইম-কংক্রিটের চাঙড়ে উঠে চোখে বাইনোকুলার রেখে উত্তরে কিছু দেখতে দেখতে বললেন, মৌরীনদীর ব্রিজটা খুঁজে পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে, ভেঙেচুরে ভেসে গেছে।
বংকুবিহারী খাপ্পা হয়ে বললেন, যাক! ধ্বংস হয়ে যাক সবকিছু। আর পারা যায় না মশাই।
ব্ৰজহরি তার কাঁধে হাত রেখে পা বাড়ালেন। বললেন, পাপ জমেছিল পৃথিবীতে। ধুয়ে মুছে যাচ্ছে যাক। আবার সব নতুন হয়ে যাবে। সৃষ্টি স্থিতি, তারপর প্রলয়। আবার সৃষ্টি। আবার স্থিতি। আবার প্রলয়। দা ইটারন্যাল প্রসেস!
গমগমে কণ্ঠস্বরে এসব কথা বলতে বলতে চিকিৎসক ও আইনবক্ষক আস্তানাঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন।
কর্নেল চাঙড় থেকে নেমে পুঁতিকে টেনে উঁচুতে এনে রাখলেন। তারপর চোখে পড়ল, ওর ডান হাতের মুঠিতে কী একটা আটকে আছে। দেখলেন, কিন্তু কিছুই করলেন না। একফালি কাপড়ের মতো কিছু পুঁতি খামচে ধরেছিল মরিয়া হয়ে চাপা নিঃশ্বাস ফেলে কর্নেল আস্তানাঘরের দিকে পা বাড়ালেন। হয়তো ব্রজহরি ও বংকুবিহারীর থিওরিই ঠিক। কোনো এক ইসমাইল ডাকু একটি কুকুর এবং দুটি চেনা মেয়েকে খুন করে পালিয়ে গেছে। কারণ এখানে দারোগাবাবুকে আবিষ্কার করে ভড়কে গিয়েছিল সে, যে-দারোগাবু তাকে ধরার জন্য হানা দিয়েছিলেন দুর্গম এক গ্রামে।
কিন্তু–
কর্নেল থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন। চাক্কুর কাছে নাকি একটি স্প্রিংয়ের ড্যাগার ছিল। কাল রাতে সেটা তার ব্যাগ থেকে উধাও হয়েছে। যথেষ্ট অন্ধকার ছিল বারান্দায়। ইসমাইলের পক্ষে তা হাতানো হয়তো অসম্ভব ছিল না। কিন্তু–
আরও একটা কিন্তু আছে। সেটাই মারাত্মক। সব জটিল করে দিচ্ছে সেটা। সমস্যা হল, জল না নামলে আপাতত কিছু করা যাবে না। কর্নেল আবার পা বাড়ালেন। আগে ভাবতে পারেননি বন্যাটা এত বেশি হবে।…
.
খিচুড়ি! খিচুড়ি
ঘনশ্যাম রুদ্র বারান্দায় পা ঝুলিয়ে বসে আছেন। তাঁর পাশে চাক্কু। চাক্কুর কাঁধে তার হাত। ওপাশে বাউল হরিপদ। ঘনশ্যাম চাপা স্বরে চাক্কুকে বোঝাচ্ছিলেন, এই কথাটা তোমার বোঝা উচিত বাবা! যখনই কোনো বিপদ আসে, সেই বিপদের প্রথম ধাক্কাটা তোমাদের মতো গতর-খাঁটিয়ে মানুষের গায়েই লাগে। কেন এমন হয়? স্বীকার করছি ওই শাওনি মেয়েটি বেশ্যা ছিল। কিন্তু কেন সে বেশ্যা হয়েছিল? খুঁজে দেখলেই কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরুবে। নিশ্চয়ই কেউ তাকে ঠকিয়ে ভুলিয়ে-ভালিয়ে একটা সুস্থ সংসার থেকে টেনে এনে মুখ্যত বাগানপাড়ার গলিতে ঢুকিয়েছিল। তারপর আর হতভাগিনী সেখান থেকে বেরুনোর রাস্তা খুঁজে পায়নি। তারপর
হরিপদ বলে উঠল বাবুমশাই, তাহলে একটা কথা বলি?
বলো, বলো, ঘনশ্যাম উৎসাহে সোজা হয়ে বসলেন।
হরিপদ একটু হাসল। …ওই যে মেজিকওলারা টাকার মেজিক দেখিয়ে বলে, বাবাসকল! মা সকল! সব মিথ্যে, পেট সত্যি। পেট! বাবুমশাই, পেট!
অসাধারণ বলেছ তুমি। ঘনশ্যাম সায় দিলেন। পেট– মানে, ক্ষিদে। এই যে তুমি বাউল হয়ে বেড়াচ্ছ হরিপদ, তুমি যে গুরু-গুরু করে স্লোগান দিচ্ছ, হেঁয়ালি আওড়াচ্ছ– আমার গায়ে হাত দিয়ে বলো, ক্ষিদে পেলে তোমার গুরু-টুরু তত্ত্ব-টত্ত্ব কোথায় থাকে? তখন কারুর কারুর কাছে দুমুঠো খাওয়ার জন্য সাধতেই হয়।
হরিপদ বিব্রতভাবে জিভ কেটে বলল, মাধুকরী বাবুমশাই, মাধুকরী!
হঠাৎ রেগে গেলেন ঘনশ্যাম।…চালাকি! পলাতক মনোবৃত্তি! এই চাক্কু রিকশো চালিয়ে খায়। সেও একজন যোদ্ধা। আর তুমি হরিপদ, তুমি কাপুরুষ। ছদ্মবেশী ভিখিরি। অলস, অকর্মণ্য, শ্রমবিমুখ, পরান্নভোজী!
আরও কিছু বলতেন, বংকুবিহারী ও ব্ৰজহরি এসে গেলেন। ব্রজহরি প্রাঙ্গণে। দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে আস্তানাঘর-সংলগ্ন ধসে পড়া ঘরটার দিকে একবার তাকালেন। বললেন, গতরাতে ওই ঘরটাই ধসে পড়েছিল কি না দেখুন তো দারোগাবাবু!
বংকুবিহারী বিরক্তমুখে বললেন, আমি কী করে বলব? আমার মাথায় অন্য চিন্তা। আমারই উপস্থিতিতে দু-দুটো খুন করে পালিয়ে গেল ইসমাইল ডাকু। দিস ইজ এ চ্যালেঞ্জ।
হরিপদ তড়াক করে লাফিয়ে উঠল।…হা ডাক্তারবাবু, ওই সেই ঘর। ওখানেই ডেকচিটা চাপা পড়েছে।
ব্ৰজহরি বললেন, ক্ষিদেয় নাড়ি জ্বলে যাচ্ছে। আপনারা আসুন, হাত লাগান। ইট-ফিট সরিয়ে খিচুড়ির ডেকচিটা উদ্ধার করা যাক। আসুন, আসুন সবাই!
বংকুবিহারী হাত বাড়িয়ে বললেন, ক্যাপসুল! আগে প্রত্যেককে একটা করে ক্যাপসুল দিন–ইউ প্রমিল্ড, মাইন্ড দ্যাট!
হ্যাঁ– ক্যাপসুল। মাল্টিভিটামিন এনার্জি ক্যাপসুল! বলে ব্ৰজহরি ব্যস্তভাবে বারান্দায় উঠলেন। ওষুধের ব্যাগটি যথাস্থানে ছিল বর্ষাতি ঢাকা। একটা কৌটো বের করলেন ব্যাগ থেকে। প্রত্যেককে বিলি করলেন এবং নিজেও একটা গিলতে গেলেন– গিয়েই বললেন, কিন্তু জল? জল ছাড়া ট্যাবলেট গেলা এ মুহূর্তে সম্ভব নয়। কারণ আমার গলা শুকিয়ে আছে। আপনাদের কী অবস্থা?
সবার আগে ঘনশ্যাম বারান্দায় পুঁতে রাখা জালার ঢাকনা তুলে বললেন, প্রচুর জল! চলে আসুন সব।
ব্ৰজহরি হাঁ হাঁ করে উঠলেন, কী করছেন, কী করছেন মশাই? ওতে এক বেশ্যার নোংরা পদার্থ মেশানো আছে! কী করে সব ভুলে যান বুঝি না! বরং বানের জল শুদ্ধ।
ঘনশ্যাম গ্রাহ্য করলেন না। বারান্দার দেয়ালের তাকে রাখা বাঁশের চুপড়ি থেকে একটি মাটির ভাঁড় নিয়ে সহাস্যে জালার জল তুলে কোঁৎ করে ক্যাপসুলটি গিললেন। বংকুবিহারী সন্দিগ্ধ স্বরে বললেন, কী বুঝলেন হর্ষবাবু?
কী বুঝব? বিশুদ্ধ জল।
কোনো গন্ধ-টন্ধ।
নাঃ! ঘনশ্যাম প্রাঙ্গণে নামলেন। বললেন, চাক্কু! হরিপদ! ওঁরা বাবু। ওঁরা গন্ধ শুঁকে জল পান করেন। তোমরা বাবু নও। যাও, দেরি কোরো না। ক্যাপসুল খেয়ে আমাদের শিগগির কাজে নামা দরকার।
কর্নেল প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে চারদিক দেখছিলেন। ঘুরে একটু হেসে বললেন, ডাক্তারবাবু, আপনি আশা করি শিবান্ধু কথাটির সঙ্গে পরিচিত? প্রাচীন ভারতে শিবাম্বুপান প্রচলিত ছিল। এখনও শিবাম্বু চিকিৎসা পদ্ধতি দেশে চালু আছে। বংকুবিহারী লাফিয়ে উঠলেন।…দ্যাটস্ রাইট, দ্যাটস্ রাইট! মনে পড়ে গেছে।
ব্ৰজহরি তেতেমুখে বললেন, ধুর মশাই! সে তো স্ব-মূত্র পান! আপনি যতই বিদ্যে ফলান, আমি ও পথে নেই!
বলে ব্ৰজহরি সোজা ভাঙা দেউড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন। বোঝা গেল, শুদ্ধ বানের জলেই কাপসুল গিলবেন। ক্লারা অবাক চোখে তাকিয়ে ছিল। বলল, কর্নেল। বিষয়টি সম্পর্কে আমি জানতে চাই। কারণ আমি প্রাচীন ভারত সম্পর্কে অত্যন্ত কৌতূহলী।
প্রদোষ বাঁকা মুখে বলল, ক্লারা! ইউ আর আ ম্যাড গার্ল! হি ইজ টকিং নসেন্স, ডোন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড?
ক্লারা তাকে অগ্রাহ্য করে কর্নেলের কাছে এল। কর্নেল তাকে শিবায়ু চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যাখ্যা করতে থাকলেন। ততক্ষণে বংকুবিহারী জালার জলে ক্যাপসুল গিলেছেন। তার দেখাদেখি হরিপদ এবং চাক্কুও গিলেছে। ঘনশ্যাম ধসে পড়া ঘরের ইট ও লাইমকংক্রিট সরানোর কাজে হাত দিয়েছেন। বংকুবিহারী চাঙ্গা হয়ে হরিপদ ও চাক্কুকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর পাশে গেলেন। ধুপধাপ ধড়াস শব্দে ধ্বংসপ জড়ো হতে থাকল নিচের প্রাঙ্গণে। প্রদোষ পা বাড়িয়ে বলল, আই মাস্ট ফলো দা ফিজিশিয়ান; এবং দেউড়ির দিকে এগিয়ে গেল ক্লারা মুগ্ধভাবে শিবান্ধুতত্ত্ব শোনার পর জালার জলে ক্যাপসুল গিলল। এই সময়। কর্নেলও জালার কাছে গেলেন। তারপর চাপা স্বরে বললেন, যাই হোক, শেষ কথাটি তোমাকে বলা উচিত ডার্লিং। শাওনি সত্যিই তেমন কিছু করেনি– করতে পারে না। কারণ তার এটুকু বুদ্ধি ছিল যে এই জলবন্দী অবস্থায় জালার জলটা তাকেও খেতে হবে। আসলে ওটা তার ক্ষোভের প্রকাশ ছাড়া কিছু নয়!
ক্লারা বলল, হ্যাঁ– সে বিষয়ে আমিও এখন একমত হলাম।
কর্নেল ক্যাপসুলটি জলের সাহায্যে গিলে বললেন, আরও একটা কথা। এই দরগায় শাওনি এসেছিল মানত দিতে। তুমি জানো না, এদেশে বেশ্যারা ধর্ম মানে। ঠাকুর দেবতা পিরে ভক্তি করে। প্রাণের দায়েই হয়তো করে। কাজেই পিরের দরগার জল নোংরা করার মতো সাহস তার থাকাই সম্ভব নয়।
ক্লারা হাসল। সঠিক কথা। জলে ইউরিনের গন্ধ পেলাম না।
বংকুবিহারী ডাকছিলেন, কৈ– সব আসুন! হাত লাগান! কর্নেল, মেমসাহেব! ডাক্তারবাবু! প্রদোষবাবু!
কর্নেল ও ক্লারা ব্যস্তভাবে এগিয়ে গেলেন। ব্রজহরি ও প্রদোষ এসে পড়লেন। পুরোদমে খিচুড়ি উদ্ধার চলতে থাকল। প্রায় আধ ঘণ্টা পরে ডেকচির একাংশ দেখতে পাওয়া গেল। আরও পনের মিনিট পরে পুরোটা বেরুল। হরিপদ, চাক্কু ও ঘনশ্যাম বিজয়দর্পে সেটি বয়ে এনে বারান্দায় রাখলেন। প্রকাণ্ড ডেকচিটির গায়ে প্রচুর চুণসুরকিকাদা মেখে আছে। ব্ৰজহরি উদ্বোধনের ভঙ্গিতে ঢাকনাটি তুললেন। তারপর আনন্দে চেঁচিয়ে উঠলেন, ভেরি গুড! সবাই ঝুঁকে পড়লেন। দেখলেন এবং আনন্দে চঞ্চল হলেন সুঘ্রাণে।
এইসময় দরবেশের ঘরের দরজা খুলে গেল। অন্ধ দরবেশ দরজায় দাঁড়িয়ে একটু কাশলেন। তারপর কাতর স্বরে বললেন, বাবাসকল মা সকল! আমিও ভুখা আছি। দয়া করে আমাকেও দুমুঠো দেবেন।
হবে না! বংকুবিহারী তেড়ে গেলেন। ভেংচি কেটে বললেন, ভুখা আছি! ঘরভর্তি চালডাল একটা কুমড়ো পর্যন্ত!– আবার বলা হচ্ছে ভুখা আছি!
ব্ৰজহরি বললেন, আপনি বড় স্বার্থপর দরবেশসায়েব! সাধুমহাত্মা লোকেদের এমন স্বভাব কখনও দেখিনি– এই প্রথম দেখলাম। তখন আপনাকে কত করে সাধলাম। টাকা দিতে চাইলাম পর্যন্ত।
ঘনশ্যাম বললেন, আহা! অন্ধমানুষ! ছেড়ে দিন।
চাক্কু বাঁকামুখে বলল, ওনার চ্যালা চুল্লু আছে না? চুল্লুকে হুকুম করলেই তো মুখের আহার এনে দেবে।
দরবেশ হাসলেন। চুল্লুকে যে আপনারা বাবাসকল মা সকল খেপিয়ে দিয়েছেন! চুল্প কথা শুনছে না। খুনখারাপি করতে শুরু করেছে। করেনি? দয়া করে আর ওর নাম মুখে আনবেন না। আমিও আনব না। দুমুঠো আমাকেও দেন। তার বদলে থালা-বাসন যা লাগে আমি দিচ্ছি। সিন্দুকে অনেক থালা মজুত আছে। বাবাসকল, মা সকল! এসব থালা কতকালের পুরনো জানেন? সেই যখন বাদশা মুর্গিন খাঁর আমল।
ব্ৰজহরি ব্যস্তভাবে বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে। থালা দিন। তাহলে আপনাকেও দু মুঠো দেব।
দরবেশ বললেন, আপনার গলা শুনে মনে হয়, আপনার মনে ভক্তি আছে। আসুন বাবা, আপনি আসুন। অন্য কাউকে ঘরে ঢুকতে দেব না। আমি অন্ধ হলেও খোঁড়াবাবার দয়ায় সব দিনবরাবর নজর হয় আমার। আপনি আসুন। কিন্তু হুঁশিয়ার, অন্য কেউ ঘরে ঢুকলে কলজেয় চিমটে বিঁধিয়ে দেব বলে দিচ্ছি।
ব্ৰজহরি ভয়ে-ভয়ে ভেতরে ঢুকলেন। ঘরটি অপ্রশস্ত। ভ্যাপসা গন্ধটা অস্বস্তিকর। একটা তক্তপোশ, তাতে নোংরা বিছানা। একপাশে একটা কাঠের সিন্দুক। আবছা অন্ধকার। কোনো জানালা নেই। শুধু একটি ঘুলঘুলি আছে। পেছন দিকের দেয়ালে– উঁচুতে। দরবেশ দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। চিমটে বাগিয়ে ধরেছেন। বললেন, সিন্দুকে তালা নেই। খুলে থালা বের করুন। আপনারা কজন আছেন?
ব্ৰজহরি আড়ষ্টভাবে বললেন, সাতজন। আপনাকে নিয়ে আটজন।
নখানা বের করুন।
কেন দরবেশবাবা?
চুল্লুর ভাগ। দরবেশ চাপা স্বরে বললেন। চুলুরও ক্ষিদে পেয়েছে। খেতে না পেলে আরও রেগে যাবে।
গুনে-গুনে অগত্যা নখানা থালা বের করলেন ব্ৰজহরি। বারান্দায় গিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। বললেন, থালাগুলো দেউড়ির ওদিক থেকে ধুয়ে আনো হরিপদ। উঁহু, একা যেও না। চাক্কু যাও!
ঘনশ্যাম বললেন, আমিও যাই ওদের সঙ্গে। এখন থেকে পদে-পদে সতর্ক হওয়ার দরকার।
তিনজনে চীনেমাটির সুদৃশ্য থলাগুলো নিয়ে ধুতে গেলেন। দরবেশ দরজার মুখে বসে বুকে চিমটেটি ঠুকতে শুরু করলেন। ঝুনঝুন শব্দ হতে থাকল। ঠোঁট কাঁপতে লাগল। বিড়বিড় করে কিছু আওড়াচ্ছেন। ক্লারা চাপাস্বরে কর্নেলকে বলল, উনি প্রার্থনা করছেন!
কর্নেল কিছু বললেন না। গাছপালার ফাঁক দিয়ে ঝকমকে রোদ এসে বারান্দার কিছু অংশ এবং প্রাঙ্গণে পড়েছে। চোখে বাইনোকুলার রেখে আকাশ দেখতে থাকলেন। বংকুবিহারী বিরক্ত হয়ে বললেন, কী দেখেন খালি, বুঝি না!
কর্নেল আস্তে বললেন, শকুন!
হোয়াট? বংকুবিহারী আকাশের দিকে তাকালেন।
শকুনরা টের পেয়েছ এখানে তিনটে মড়া আছে। ওরা আসছে। ক্লারা দৌড়ে বারান্দার কোনায় রাখা কিটব্যাগ থেকে প্রদোষের বাইনোকুলারটি খুঁজে নিয়ে এল। চোখে রেখে বলল, কৈ? আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না।
কর্নেল বাইনোকুলার নামিয়ে বললেন, তোমার কাছে ক্যামেরা আছে ক্লারা?
ক্লারা দুঃখিত মুখে বলল, গাড়ির আসনে রেখেছিলাম। ভেসে গেছে গাড়ির সঙ্গে। প্রদোষ এজন্য দায়ী। শীঘ্র. নামতে বলল গাড়ি থেকে। আমিও ভুলে গেলাম। সৌভাগ্যই বলব, এই বাইনোকুলারটি প্রদোষের গলায় আটক থাকায় নিষ্কৃতি লাভ করেছে।
বংকুবিহারী সহাস্যে বললেন, আপনার বাংলাভাষাটা এখনও প্র্যাকটিস হয়নি ম্যাডাম!
ক্লারা জবাব দিতে যাচ্ছিল, থালাসহ দলটি ফিরে আসায় বাধা পড়ল। ব্ৰজহরি বললেন, আগে কথামতো দরবেশবাবা আর তার ইয়ে– অর্থাৎ অশরীরী আত্মাটির জন্য দুটো থালা আমাকে দিন।
খিচুড়ি একেবারে আঠা। তাতে কারুর আপত্তি নেই। দরবেশ থালাদুটি হস্তগত করেই তক্তাপোশে রাখলেন এবং দরজা বন্ধ করে দিলেন। চুল্লুর সঙ্গে আহার করবেন বোঝা গেল। এবং চুল্লু বহিরাগতদের দেখা দেবে না, তাও বোঝা গেল।
বারান্দায় বসে চটাস চটাস হাপুস হুপুস শব্দ করে ক্ষুধার্ত লোকগুলি খেতে শুরু করল। কর্নেল দ্রুত থালা শেষ করে বললেন, দারোগাবাবু! এবার আরেকটা কাজে হাত লাগানো দরকার। শাওনি ও পুঁতির বডি দুটো তুলে এনে পাশের ঘরে রাখতে হবে। ওই শুনুন! গাছের ডগায় শকুন বসল।
বংকুবিহারী ঢেকুর তুলে বললে, ছেড়ে দিন!
কর্নেল এঁটো থালা ধুতে যাবার জন্য পা বাড়িয়েছিলেন। বললেন, ভুলে যাবেন না–এটা মার্ডার। বডি পোস্টমর্টেম করতে হবে। কেসডায়েরি লিখতে হবে। খুনীকে খুঁজে বের করতে হবে। আপনার অনেক দায়িত্ব।
বংকুবিহারী বিরসমুখে বললেন, এখন তো ফ্লাড মশাই! ফ্লাডের জল কি সহজে নামবে ভাবছেন? ততদিনে বডি পচে ভুট হয়ে যাবে। আর খুনী তো ইসমাইলডাকু! তাকে যথাসময়ে অ্যারেস্ট করা যাবে। এখন ওসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই।
হরিপদ এঁটো থালা নিয়ে শূন্য ডেকচিতে উঁকি দিচ্ছিল। ব্ৰজহরি বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল নেড়ে বললেন, কী দেখছিস বাবা? সব মুছে-টুছে পরিষ্কার করে সমানভাগে ভাগ করে দিয়েছি।
হরিপদ এঁটো হাত ঢুকিয়ে বলল, গুরুর ইচ্ছে ডাক্তারবাবু! তলায় পোড়াটুকুন আছে। ছাড়ি কেন?
ক্লারা খুশি মুখে খাচ্ছিল। প্রদোষ তেলোমুখে, ক্লারা বলল, সুন্দর! অসাধারণ। খিচুড়ি! সত্যই সুস্বাদু খিচুড়ি!
ব্ৰজহরি শুধরে দিলেন। হল না। ম্যাডাম! খিচুড়ি, খিচুড়ি!…
.
প্রতীক্ষা, সন্দেহ, ত্রাস
কর্নেল দুহাঁটুতে হাত রেখে কুঁজো হয়ে সাপটিকে দেখছিলেন। বুনো ফুলের একটি জাঁকালো ঝোপ এক টুকরো ধ্বংসস্তূপের গা ঘেঁষে গজিয়ে উঠেছে। তার ভেতর চকরাবকরা ছায়া। সেখানে চিত্রবিচিত্র ছোট্ট সাপটি কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। প্রাকৃতিক ক্যামফ্লেজের ফলে সাপটির অস্তিত্ব টের পাওয়া সহজ নয়। কিন্তু কর্নেল প্রকৃতিকে নিবিড়ভাবে জানেন, চেনেন। প্রকৃতির কাছাকাছি হলেই তার যেন একটি বাড়তি ইন্দ্রিয় শামুকের শুড়ের মতো খুলির ভেতর সন্তর্পণে উত্থিত হয়। বিভীষিকারও সৌন্দর্য আছে প্রকৃতিতে, সাপটি দেখতে দেখতে ভাবছিলেন কর্নেল। বৃষ্টিধোয়া নিসর্গে এখন যত উজ্জ্বলতা, তত বিভীষিকা দুহাত নিচে বন্যার জল দুলছে। সাপটি এবং বন্যা দু-ই প্রকৃতির সৌন্দর্য ও বিভীষিকার যুগপৎ প্রতীক বলা চলে। তবে প্রকৃতি জীবিত ও মৃতে ফারাক করে না। ওই রক্তাক্ত মৃতদেহগুলিও এখন প্রকৃতির অন্তর্গত হয়ে গেছে। রক্ত ও কান্নার পৃথক মূল্য দেয় না প্রকৃতি।
পেছনে একটু শব্দ। কর্নেল দ্রুত সোজা হলেন। ঘুরে দাঁড়ালেন। দেখলেন, ক্লারা।
ক্লারা হাসল। আপনি সম্ভবত ভয় পেয়েছিলেন!
পেয়েছিলাম। কর্নেল স্বীকার করলেন। কিন্তু তুমি এভাবে একা ঘুরে বেড়িও না। ভারতীয় প্রকৃতি খুব বিপজ্জনক। এ তোমাদের সাজানো-গোছানো হাতেগড়া মার্কিন প্রকৃতি নয়। এর নিজস্বতা আছে, ক্লারা! প্রচণ্ডরকমের নিজস্বতা!
কর্নেল হাসছিলেন। ক্লারা সিরিয়াস হয়ে বলল, কিছুটা বুঝতে পেরেছি। এই নিজস্বতা আমাকে আকর্ষণ করছে। এ একটা আশ্চর্যজনক আদিমতা। এর ভেতরে ঢুকতে চাই। ভেতরে আপাতত একটি সাপ আছে। কর্নেল ঝোপটির দিকে আঙুল দেখালেন। দেখতে পারো!
ক্লারা উৎসাহে ঝুঁকে গেল। কিন্তু সাপটিকে দেখতে পেল না। কর্নেল উঁকি মেরে দেখে বললেন, হুঁ, লুকিয়ে পড়েছে। সরে এসো। আর শোনো, এভাবে একা ঘুরো না। প্রদোষ কোথায়?
ক্লারা কয়েক পা সরে একটু ফাঁকায় দাঁড়িয়ে বলল, বাইনোকুলার নিয়ে ওদিকে কোথাও দাঁড়িয়ে আছে। ত্রাণকারীদের নৌকা খুঁজছে। দারোগামহাশয় আদেশ দিয়েছেন, চারদিকে সকলে ত্রাণকারীদের নৌকা খুঁজবে। আমি চাই, ত্রাণকারীদের নৌকা দেরি করে আসুক। কারণ আমার কাছে বিষয়টি অত্যন্ত উপভোগ্য।
কর্নেল জ্যাকেটের ভেতর পকেট থেকে একটি চুরুট বের করে লাইটার জ্বেলে ধরালেন। তারপর ক্লারার দিকে ঘুরলেন। ক্লারা, আমার মনে হয়, তোমার প্রদোষের কাছে যাওয়া উচিত। সে তোমার জন্য উদ্বিগ্ন হতে পারে।
ক্লারা শক্ত মুখে বলল, হবে না। আমার স্পষ্ট বলা উচিত, সে আমাকে আর পছন্দ করছে না।
কর্নেল আস্তে বললেন, এ তোমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার।
তথাপি আপনাকে জানাতে চাই। আপনি শুনুন। আমি কিছু লুকিয়ে রাখা সঠিক মনে করি না।
কর্নেল অবাক হয়ে তাকালেন। ক্লারাকে রাগী দেখাচ্ছিল। বললেন, বলো ক্লারা!
ক্লারা চাপাস্বরে বলল, কাল বিকেলে একটা ঘটনা ঘটেছিল। প্রদোষ যদিও বলল, শাওনি তাকে ব্ল্যাকমেল করছে, আমি বিশ্বাস করিনি। প্রদোষকে আমি জানি। সে শাওনিকে একা পেয়ে অসভ্যতা করে থাকবে। সে আমাকে বিবাহ করে সুখী হয়নি। সে প্রকৃতপক্ষে একজন মেমসাহেব অর্জন করতে চেয়েছিল। ভারতে সে এটি একটি কৃতিত্ব হিসাবে দেখাতে চেয়েছে। একটি খেলার সামগ্রী মাত্র! এবং আমি জানি, ভারতীয় মাত্রেই এতে গৌরবান্বিত বোধ করে।
কর্নেল হাসলেন না। আর গম্ভীর হয়ে বললেন, বুঝলাম।
এখনও বুঝতে পারেননি! ক্লারা তেতো মুখে বলল। আমার কথাটা ভেবে দেখুন। আমি কী চেয়েছিলাম? একজন ভারতীয় পুরুষকে। প্রদোষ আমাকে ইওরোপীয় পোশাকে দেখতে চায়। আমার এই ভারতীয় নারীর পোশাক তার সহ্য হয় না। আমরাও সহ্য হয় না প্রদোষের ইওরোপীয় পোশাক।
হুঁ–বুঝলাম।
ক্লারা একই সুরে বলল, আমি প্রকৃত ভারতীয় পূজা দেখতে চেয়েছিলাম। প্রদোষ তার মামার বাড়িতে পূজা দেখাতে নিয়ে এল। বন্যায় এই দ্বীপে আটক হলাম। প্রদোষের গাড়ি ভেসে গেল। এখন বুঝতে পারছি, তার উদ্দেশ্য ছিল সগৌরবে মামার বড়িতে একটি খেলার সামগ্রী প্রদর্শন। কারণ সে এই আটক অবস্থার মধ্যে সর্বদা আমাকে ইওরোপীয় পোশাক পরতে বলছে। সুতরাং আমার সিন্ধান্ত, আমি ত্রাণকারীদের নৌকা এলে আপনার সঙ্গে কলিকাতা ফিরে যাব। তারপর–
কর্নেল হঠাৎ বললেন, শাওনি প্রদোষকে ব্ল্যাকমেল করেছিল বললে?
ক্লারা নিষ্ঠুর মূর্তিতে বলল, প্রদোষই তাকে হত্যা করেছে বলে আমার এখন সন্দেহ হচ্ছে।
হুঁ! কিন্তু পুঁতিকে?
প্রদোষের পক্ষে অসম্ভব নয়। পুঁতির দিকেও তার চোখ পড়েছিল সম্ভবত।…ক্লারার চোখে জলের ফোঁটা দেখা গেল। আস্তে বলল, আমি তার চরিত্রের ইতিহাস কতটুকু জানি? শুধু এইটুকু আভাস দিতে চাই, সে একজন অতিশয় কামুক পুরুষ।
বলেই ক্লারা চলে গেল। গাছপালা-ঝোপজঙ্গলের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল। কর্নেল ফের ঝুঁকে গেলেন ফুলন্ত ঝোপটির দিকে। সাপটিকে খুঁজতে থাকলেন।…
ব্ৰজহরি গাছের শেকড়ে বসে জলের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। ডানদিকে কিছুটা দূরে কুকুরটিকে ছিঁড়ে খাচ্ছে এক ঝক শকুন। ভাবছিলেন, কর্নেলসায়েব লোকটির মাথা এখনও ঠাণ্ডা আছে। বাদবাকি সবাই প্রায়ই প্রায় পাগল হয়ে গেছে। ব্ৰজহরির নিজের অবস্থাও তাই সেটা বুঝতে পারছেন। এই যে হাটাৎ-হঠাৎ মনে হচ্ছে জলে ঝাঁপ দিতে, সেটাও পাগলামির লক্ষণ বলা চলে। জোর করে ইচ্ছেটাকে ঠেকিয়ে রাখছেন। কখনও ইচ্ছে করছে শকুনগুলোকে ঢিল ছুঁড়ে তাড়ান। বড় চাচামেচি করছে ব্যাটাচ্ছেলেরা! আবার তখনই মনে হচ্ছে, বেশ্যা মেয়েটাকে অমন করে তুলে এনে পাশের ঘরটাতে রাখা হল, মেমসায়েবের দরদ উথলে উঠল এবং ভাবা যায় না, একটা সুন্দর সিল্কের শাড়িতে ঢেকে দিল,তা না করে শকুনগুলোর মুখের সামনে ছুঁড়ে ফেলা উচিত ছিল না?
আর ওই মেয়েটাকেও! আগে যদি জানতেন, ওকে রিকশোওলা ছোকরা ভাগিয়ে এনেছে, তাহলে তারও বডি তুলতে বাধা দিতেন। দারোগাবাবুর কাছে সব কবুল করল ছোকরা, ধমকের চোটেই করল– অথচ দারোগাবাবুটি তাকে কিছু বললেন না আর! নিশ্চয় টাকা খেয়েছেন। বংকুবিহারী যে ঘুসখোর; ব্ৰজহরি তা জানেনই। নতুন কথা আর কী?
পেছনে একটা শব্দ হল। দারুণ আঁতকে উঠে ব্ৰজহরি তড়াক করে দাঁড়িয়ে ঘুরলেন। বংকুবিহরীকে দেখে হাসলেন …ও আপনি? আসুন, আসুন। এক্ষুনি আপনার কথা ভাবছিলাম। অকেদিন বাঁচবেন।
আর বাঁচা! বংকুবিহারী শ্বাস ছেড়ে বললেন। সে-আশা ছেড়ে দিয়েছি। আপনিও দিন।
ভয় পাওয়া মুখে ব্রজহরি বললেন, সে কী! নতুন কিছু কি ঘটেছে?
বংকুবিহারী প্রায় গর্জন করলেন। ওই শকুনগুলো! ওরা কেন এসেছে বুঝতে পারছেন না? আমাদের জ্যান্ত ছিঁড়ে-ছিড়ে খাবে।
ব্ৰজহরি ব্যস্তভাবে বললেন, সেটাও তো ভাবছিলাম এতক্ষণ। চলুন, ইটপাটকেল। ছুঁড়ে ওদের তাড়িয়ে দিই!
বংকুবিহারী রুমাল বের করে ঘাম মুছলেন মুখের। তারপর শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, দূরে একটা নৌকো দেখতে পেয়েছিলেন ওই ভদ্রলোক এম এল এর ভাগ্নে। ছাদ থেকে বাইনোকুলারে দেখেছিলেন।
তারপর, তারপর?
তারপর আর কী? চলে গেল।
রুমাল নাড়তে বললেন না কেন। আগুন জ্বেলে ধোঁয়ার সাহায্যেও অবশ্য দৃষ্টি আকর্ষণ করা যেত।
ধূর মশাই! বাইনোকুলারে দেখা নৌকো। খালি চোখে দেখাই গেল না। বংকুবিহারী কান পাতলেন ডানদিকে। অসহ্য! শকুনগুলোর একটা ব্যবস্থা করা দরকার।
ব্ৰজহরি একটা ইট কুড়িয়ে নিলেন পায়ের কাছ থেকে। পা বাড়িয়ে বললেন, চলুন! সবাইকে ডাক দিন। প্রচুর ইট আছে সাবধানে। আগে ইটগুলো এক জায়গায় জড়ো করে তারপর একসঙ্গে ছুঁড়তে শুরু করব।
বংকুবিহারী গুম হয়ে ভাবছিলেন। বললেন, পরে, পরে। ভাবছি, একটা গুলি ছুঁড়ে দেখব। একটা মারা পড়লে রিঅ্যাকশান বোঝা যাবে ওদের। ব্রজহরি লাফিয়ে উঠলেন।…তাই তো! আপনার কাছে পিস্তল আছে!
এটা পিস্তল নয়, রিভলবার।
একই কথা। ব্ৰজহরি খুশিতে হাসলেন।
একই কথা নয় মশাই! বংকুবিহারী বললেন। পিস্তল আর রিভলবার আলাদা জিনিস। ছটা গুলি ছিল। সাপ মারতে দুটো গেছে। আর চারটে আছে। পিস্তল হলে আঠারোটা পর্যন্ত গুলি থাকত। ভাবতে হত না! কিন্তু রিভলবার বলেই ভাবতে হচ্ছে। এখনও আমরা নিরাপদ নই।
ফের চমকে উঠলেন ব্ৰজহরি। চাপাস্বরে বললেন, তেমন কিছু কি–
বংকুবিহারী চারদিক দেখে নিয়ে বললেন, কর্নেলসায়েবের তালডোঙার গপ্পো আমি বিশ্বাস করি না।
হু। লোকটি সন্দেহজনক। গতিবিধিও সন্দেহজনক।
আমার দৃঢ় ধারণা খুনী আমাদের মধ্যেই আছে, চেনা যাচ্ছে না।
বলেন কী! ব্রজহরি ভড়কে গেলেন। তাহলে তো একা-একা বসে রিলিফের নৌকোর খোঁজ করা বড় বিপজ্জনক। রীতিমতো রিস্কি।
রিস্কি হলেও উপায় নই। বংকুবিহারী নির্বিকার মুখে বলেন। সাবধানে থাকলেই হল। একটু ফাঁকা জায়গা দেখে বসলেই হল। আপনি যেখানে বসেছিলেন, পেছনে গাছের গুঁড়ির আড়াল থেকে খুনী আপনার ওপর ঝাঁপ দিলেই হল! শেষে–
কাঁচুমাচু মুখে ব্রজহরি বাধা দিলেন, কী যে বলেন! আমাকে কেন খুন করবে কেউ?
কিছু বলা যায় না। সাবধানে থাকুন। বলে বংকুবিহারী বুটের শব্দ তুলে চলে গেলেন।
ব্ৰজহরি ইটটি ফেললেন না। একটু এগিয়ে ফাঁকা জায়গায় একটা লাইম কংক্রিটের চাঙড়ে বসলেন। খুব দুঃখিত দেখাচ্ছিল তাঁকে। দারোগাবাবুটি তাঁকে এভাবে ভয় না দেখালে পারতেন। তিনি এলাকায় আসা অব্দি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। রাতদুপুরে ঝড় বৃষ্টিতে রোগীর বাড়ি থেকে ডাক এলে তিনি তক্ষুনি বেরিয়ে পড়েন। একটি পয়সা বেশি ভিজিট নেন না। এমন মানুষকে কে খুন করবে কেনই বা করবে?
হঠাৎ একটু চমক খেলেন মনে-মনে। ওই লোকটা স্কুল-শিক্ষক বলে পরিচয় দিয়েছেন যে, হুঁ–হর্ষনাথ! হর্ষনাথ কাল বিকেলে বেশ্যাটার ওপর জবরদস্তি করছিল। বেশ্যাটাকে ব্ৰজহরি ভীষণ ঘৃণা করেছেন, সে জানে। বেশ্যাটা শেষ পর্যন্ত খুন হয়েছে। এখন কথা হল, হর্ষনাথ যদি তাকে খুন করে, থাকে তাহলে ব্ৰজহরিকেও খুন করার ইচ্ছে জেগে ওঠা তার পক্ষে অসম্ভব নয়। প্রতিহিংসাবশত–হুঁ, প্রতিহিংসা! কারণ তার পয়লানম্বর পাপ অর্থাৎ ধর্ষণের চেষ্টার বাধা ছিলেন ব্রজহরি!
ব্ৰজহরি মরিয়া হয়ে গেলেন এবং ইটটি শক্ত করে ধরলেন। মনে মনে বললেন, আয়! কাম অন! মুণ্ডু থেঁতো করে দেব ব্যাটাচ্ছেলের!…
তখন ঘনশ্যাম একটা ইটের চাঙড়ে বসে ঢুলছিলেন। ভাবনার ক্লান্তিজনিত ঢুলুনি। খালি পেটে বিপ্লব হয় না। প্রকৃতি বাধা দিলে বিপ্লব হয় না। রোগা, ক্ষুকাতর ক্ষেতমজুর দিয়ে বিপ্লব হয় না। সংগঠন গড়ে ছোটখাটো লড়াই করতে করতে বড় লড়াইয়ের দিকে এগোনো যায় বটে, কিন্তু বিপ্লব আলাদা জিনিস। বিপ্লব সামরিক ঘটনা। কারণ রাষ্ট্র সামরিকভাবে শক্তিশালী। তাই পাল্টা সামরিক সংগঠন চাই। ধুস! কী করলেন এতটা কাল– জীবনভর?
নিজের ওপর রেগে গিয়ে ঘনশ্যামের ঢুলুনিটা কেটে গেল। দেখলেন, বন্যার জল ইঞ্চি ছয়েক নেমে গেছে। সামনে তাকালেন। রিলিফের নৌকো না ঘোড়ার ডিম! ঘণ্টায় তিন ইঞ্চি করে যদি জলটা নামে, তাহলে মাটি জাগতে কতক্ষণ লাগবে হিসেব করতে গিয়ে পেছনে শব্দ। দারুণ চমকে ঘুরে বসলেন ঘনশ্যাম।
দারোগাবাবু বংকুবিহারী। বললেন, কী? চোখে পড়ল কিছু?
ঘনশ্যাম মাথা দোলালেন। তারপর গম্ভীর মুখে আঙুল বাড়িয়ে বললেন, জল নামছে। এই দেখুন!
বংকুবিহারীর নজর গেল আঙুলের দিকে। আঙুলটা তর্জনী এবং ডগায় পট্টিবাঁধা। বললেন, আঙুল কাটলেন কিসে?
ঘনশ্যাম হকচকিয়ে বললেন, খিচুড়ি বের করার সময় ইট সরাতে গিয়ে
বংকুবিহারী বাধা দিলেন। কিন্তু তখন আমরা কেউ দেখিনি। আপনি বলেননি!
আহা, তেমন বলার মতো কিছু নয় বলেই বলিনি। জাস্ট একটুখানি আঁচড় মাত্র।
আমাদের সঙ্গে একজন ডাক্তার আছেন। আপনি তাকে বললেই ব্যান্ডেজ পেতেন। বংকুবিহারী সন্দিগ্ধভাবে বললেন। তাছাড়া এ টি এস ইঞ্জেকশানও পেতেন। কারণ এ থেকে টিটেনাস হওয়াও অসম্ভব নয়। কিন্তু সে-সব কিছুই করেননি। ওটা কী জড়িয়েছেন?
ঘনশ্যাম ভেতর-ভেতর খাপ্পা। কিন্তু মুখে কাঁচুমাচু ভাব ফুটিয়ে বললেন ছেঁড়া লুঙ্গির একটা ফালি।
কোথায় পেলেন?
ঘনশ্যাম ফোঁস করে বললেন, আশ্চর্য!
আশ্চর্য তো বটেই। বংকুবিহারী ঝুঁকে গেলেন তার দিকে। কৈ, খুলুন– দেখি কী অবস্থা।
যদি না দেখাই? ঘনশ্যামের মুখ লাল। চোখ বড়ো। নাকের ফুটো ফুলে উঠল।
বংকুবিহারী গলা চড়িয়ে বলেলেন, তাহলে আপনাকে অ্যারেস্ট করা হবে।
বেশ। করুন। ঘনশ্যামের মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল। এ ঘনা রুদ্রকে অসংখ্যবার অ্যারেস্ট করা হয়েছে।
বংকুবিহারী চমকে উঠে বললেন, ঘনা রুদ্র? মাই গুডনেস! তার মানে ঘনশ্যাম রুদ্র? পলিটিকাল অ্যানডার? রিভলবার বেরিয়ে এল ঝটপট।.ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট। উঠুন! আর আপনার ব্যাগটা দিন।
বাঁকা হেসে ঘনশ্যাম তার কাপড়ের ব্যাগটা ছুঁড়ে দিলেন সামনে। বংকুবিহারী সেটা কুড়িয়ে নিয়ে রীতিমতো তল্লাস করে ফেরত দিলেন। বললেন, আপনি আসুন আমার সঙ্গে।
নিয়ে যাবেনটা কোথায়? ঘনশ্যাম খ্যাখ্যা করে হেসে উঠলেন। মরিয়া হাসি। চলুন, নিয়ে চলুন! যাচ্ছি!
বংকুবিহারী ঠোঁট কামড়ে ধরে ভাবছিলেন। পুলিশ রেকর্ডে লোকটিকে বিপজ্জনক ব্যক্তি বলে উল্লেখ করা আছে। বলা যায় না, রিভলবার বা পিস্তল থাকতেও পারে জামার পকেটে কিংবা কোমরে ধুতির ভঁজে লুকোনো। তার চেয়ে বড় কথা, গ্রেফতার করে বড়জোর আস্তানা ঘরে নিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু তারপর? বন্যার জল কখন নামবে, কিংবা কখন দৈবাৎ একটা রিলিফের নৌকো এসে পড়বে– সেই অনিশ্চিত সময়ের জন্য তাকে পাহারা দিয়ে বসে থাকতে হবে। কী করা উচিত ঠিক করতে পারছিলেন না অইনরক্ষক।
ঘনশ্যাম বাঁকা মুখে বললন, কী হল? আসুন!
বংকুবিহারী, রিভলবার তুলে শাসালেন।…গুলি করে ঠ্যাং ভেঙে দেব। দুই ঠ্যাঙে দুটো গুলি। পড়ে থাকবেন। কাতরাবেন। পালাতে পারবেন না।
সোজা দাঁড়িয়ে একটা পা বাড়িয়ে দিলেন ঘনশ্যাম।…ভাল কথা! করুন গুলি! ঠ্যাঙ ভেঙে না হয়ে পড়েই রইলুম। ঘনা রুদ্রের শরীর অনেক গুলির দাগ আছে। যদি দেখতে চান, দেখাতে পারি। কিন্তু তারপর কী হবে, সেটাও বলে দিই। আপনার বউ বিধবা হবে। কারণ আমার কমরেডরা আপনাকে জবাই করবে। ঠিক যেভাবে ওই মেয়ে দুটোকে জবাই করা হয়েছে, তার চেয়ে বীভৎসভাবে। কেন? না– আপনি তাদের নেতার ঠ্যাং ভেঙেছেন। একটা নয়, দুটো ঠ্যাং! মাইন্ড দ্যাট।
হঠাৎ বংকুবিহারী হ্যাঁ হ্যাঁ করে হাসতে লাগলেন। …ধুর মশাই! বিপদের সময় কীসব রসিকতা হচ্ছে! চেপে যান। কাউকে বলবেন না আপনি ঘনাবাবু। আমিও বলব না। বুঝলেন না? বিপদের সময় সাপে-নেউলে বাঘে-গরুতে এক হয়ে যায়। তখন শত্রু-মিত্র ভেদাভেদ থাকে না। আপনাকে জাস্ট একটু ভড়কি দিয়ে দেখে নিলাম। বসুন। নজর রাখুন। রিলিফের নৌকো দেখলেই চেঁচাবেন। যত জোরে পারেন চেঁচাবেন। আমরা সবাই এসে জড়ো হব একসঙ্গে চেঁচাব।
এটা বংকুবিহারীর ধূর্তামি। মনে মনে বললেন, রোশো ব্যাটাচ্ছেলে বিপ্লবী না টিপ্লবী! সময় এলে ব্যবস্থা হবে। ভুলিয়ে-ভালিয়ে যতক্ষণ রাখা যায়।
আর ঘনশ্যাম মনে মনে বললেন, খুব দিয়েছি! ভয় পেয়ে গেছে ব্যাটাচ্ছেলে!
বংকুবিহারী রিভলবারটি খাপে ভরলেন এবং পা বাড়িয়ে গম্ভীর হয়ে গেলেন। তিনি চলে গেলে ঘনস্যাম চাঙড়টাতে বসে পড়লেন। আবার ঢুলতে শুরু করলেন। ইচ্ছার বিরুদ্ধেই।…
চাক্কু রাঙা চোখে তাকিয়ে ছিল জলের দিকে। একটা দোনামনা ভাব। তাকে পেয়ে বসছিল। একবার ভাবছিল, এক্ষুনি ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কেটে পালিয়ে যাবে, এই ভয়ঙ্কর দরগায় তার আর এক মুহূর্ত থাকতে ইচ্ছে করছে না– আবার ভাবছিল, তাহলে দারোগাবাবু তাকে সন্দেহ করবেন, সময়মতো হাজতে ঢুকিয়ে বেদম ঠ্যাঙানি দেবেন, আর খুনের দায়টা তো পড়বেই তার ঘাড়ে।
কিন্তু এ ভারি অদ্ভুত ব্যাপার, একখানা রিলিফের নৌকোও নজর হচ্ছে না কেন? এও ঠিক এ দরগাটা চারদিকে ফাঁকা মাঠের মধ্যিখানে। তবে একটু তফাত দিয়ে পাকা রাস্তা আছে। সেখান দিয়েও কোনো নৌকো চলাচল করছে না। কেন? করলে হরিপদর মুখে খবর হত। সে ওদিকেই বসে আছে। কোথাও।
এর একটাই মানে হয়– চুল্ল! চুল্লুর কথা সে শুনেছে ছেলেবেলা থেকে। চুল্লু এক চ্যালা– অশরীরী আত্মা। সে নাকি খোঁড়াপিরের দরগা পাহারা দেয়। চাক্কুর মনে হল, কানা দরবেশই চুল্লুকে লেলিয়ে দিয়েছেন তাদের ওপর। দিয়েছেন, তার একটাই কারণ, ওই বেশ্যা হারামজাদি! খোঁড়াপিরের পবিত্র দরগায় বেশ্যা এসে বেশ্যাগিরি করে বেড়াচ্ছিল– কে জানে, দরবেশবাবার সঙ্গে ও ঢলাঢলি করতে গিয়েছিল কি না! হয়তো গিয়েছিল; চাক্কু নড়ে বসল। আলবাৎ গিয়েছিল। সে জন্যই চুল্লুকে দিয়ে ওকে জবাই করিয়েছেন দরবেশবাবা। কিন্তু পুঁতি?
চাক্কু ভেবে পেল না, পুঁতি কী দোষ করল দরবেশবাবার কাছে? নাকি পুঁতি ক্ষিদের জ্বালায় দরবেশবাবার সঙ্গে ঢলাঢলি করতে গিয়েছিল? পেটের জ্বালা বড় জ্বালা। দরবেশবাবার ঘরে খাবার-দাবার আছে। পুঁতি কি পোড়া পেটের জন্য দরবেশবাবাকে–
চাক্কু চমকে উঠে ঘুরল। পেছনে পায়ের শব্দ।
মেমসায়েব। মুখে পাগলাটে হাসি। বললেন, আপনি এখানে আছেন?
আপনাকে খুঁজছিলাম।
চাক্কু বলল, আজ্ঞে?
ক্লারা একটা লম্বাটে পাথরের স্ল্যাবে বসল। আপনার কাছে গল্প শুনতে এলাম। ক্লারা একটা ঘাস ছিঁড়ে নিল হাত বাড়িয়ে। বলল, আমি জানি, আপনি ভীষণ দুঃখিত। শোকগ্রস্ত। আপনার স্ত্রী নিহত হয়েছেন। কিন্তু আমার ধারণা, কথাবার্তা শোক দূর করে। আপনি কিছু কথা বলুন, এই দেশ সম্পর্কে অথবা আপনার যা ইচ্ছা।
চাক্কু রোদ্দুরে দেশলাই শুকিয়ে নিয়েছে। সিগারেটের প্যাকেটে এখনও তিনটে সিগারেট আছে। সে একটা ধরিয়ে জোরে টান দিল। ধোঁয়ার ভেতর বলল, কথা বলতে ইচ্ছে করছে না মেমসায়েব! আর নতুন কথা কী বলব?
ক্লারা বলল, আমার মতো আপনার অবস্থা। আপনি কি আমাকে একটা সিগারেট দিতে পারেন?
চাক্কু জানে, দেখেছে, মেমসায়েবরাও সিগারেট টানে। তার কাছে মেমসায়েব সিগারেট চাওয়ায় সে খুশি হল। সিগারেট ও দেশলাই দিল।
ক্লারা হাল্কা একটা টান দিয়ে হাসল। ..ভারতে আসার আগে আমি ধূমপান ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, এই বিপদের অবস্থায় ধূমপান একটা শান্তি। আপনাদের দেশে নারীরা ধূমপান করেন না শুনেছি।
চাক্কু অগত্যা হাসল। …করে। করে বৈকি।
ধূমপান, অর্থাৎ সিগারেটের কথা বলছি!
বুঝেছি। চাক্কু বলল জোরগলায়। বাবু ভদ্রলোকের বাড়ির মেয়েরা না খেতে পারে। গাঁগেরামে আমাদের মতো ঘরে, আজ্ঞে, সিগারেট কোথা পাবে? তবে বিড়ি-তামাকটা খায়। তাপরে আজ্ঞে, মদ-তাড়িও খায়।
ক্লারা উৎসাহে বলল, বলুন, বলুন! আমাকে ভুল বলা হয়েছিল বুঝতে পারছি।…
প্রদোষ আস্তানাঘরের ছাদের কার্নিশে বসে বাইনোকুলারে সুদূর জল দেখতে দেখতে বাঁ-দিকে ঘুরেই অবাক হল। বাইনোকুলারে দেখল ক্লারার ঠোঁটে সিগারেট, তার পাশে রিকশোওলা ছোকরাটি। অসহ্য লাগায় প্রদোষ বাইনোকুলার নামিয়ে ফেলল। রাগে ও ঘৃণায় সে অস্থির কিন্তু এ মুহূর্তে কী করবে ঠিক করতে পারল না। আদিম ভারতের ভেতরে ঢুকে পড়তে চেয়েছিল ক্লারা। ঘটনাচক্রে অনেকখানি ঢুকে পড়েছে। প্রদোষ তার উপলক্ষ মাত্র। প্রদোষ তার নিতান্ত চাবিকাঠি। প্রদোষের স্ত্রী সেজে ক্লারা ভারতে ঢুকেছে এবং যথাসময়ে তাকে ফেলে চলে যাবে। আমেরিকায় ফিরে গিয়ে বইটই লিখে ফেলবে। সব পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে প্রদোষের কাছে। প্রদোষ ঠোঁট কামড়ে ধরল।…
ঢুলুনি কেটে গেল ঘনশ্যামের। পাশের ঝোপটা নড়ছে। খস খস শব্দ। বললেন, কে, কে?
কর্নেল সাড়া দিলেন, আমি।
ঘনশ্যাম গম্ভীর হয়ে বললেন, ঝোপের ভেতর সাপখোপ থাকতে পারে। ওখানে ঢুকে কী করছেন?
কর্নেল বেরিয়ে এলেন। …জলের অবস্থা দেখছিলাম। ইঞ্চি সাত-আট নেমেছে মনে হল। বলে কর্নেল একটু হাসলেন। দারোগাবাবুর সঙ্গে তর্কাতর্কি করছিলেন। কী ব্যাপার?
ঘনশ্যাম ভুরু কুঁচকে বললেন, আপনাকে বলার কোনো দরকার আছে কি? সব সময় লক্ষ্য করছি, সবতাতে আপনি নাক গলিয়ে বেড়াচ্ছেন। কে আপনি? আপনার সঠিক পরিচয় কী?
ঘনশ্যামবাবু, আমার পরিচয় গোপনের প্রয়োজন হয় না।
ঘনশ্যাম চমকানো গলায় বললেন,–হুঁ–যা সন্দেহ করেছিলাম। আপনি সি বি আই অফিসার?
মোটেও না ঘনশ্যামবাবু! কর্নেল চোখে বাইনোকুলার রেখে দূরে কিছু দেখতে দেখতে বললেন। আমার নাম সত্যিই কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। তবে নাকগলানোর কথা বললেন, ওটা আমার স্বভাব। কাল বিকেলে আপনি শাওনিকে থাপ্পড় মেরেছিলেন। তার ফলে ওর কানের গয়নায় আপনার আঙুল কেটে যায়। কথাটা দারোগাবাবুর কাছে গোপন না করলে আপনি স্কুলটিচার হর্ষনাথই থেকে যেতেন। আসলে, সহজ সত্য গোপন করতে গেলে ঝামেলা বাড়ে।
ঘনশ্যাম মুখ বাঁকা করে বললেন, বাঃ! বলেছেন ভালো! ওই বাঁকামুখো দারোগাবাবুটিকে আপনি চেনেন না! আসল কথাটা বললে ঠিকই ধরে নিত আমিই শাওনিকে খুন করেছি।
উনি কিন্তু তাই ধরে নিয়েছেন!
আমি শাওনিকে খুন করিনি। ঘনশ্যাম রোখের মুখে উঠে দাঁড়ালেন। আমি বিপ্লবী। বিপ্লবীরা অকারণ নরহত্যা করে না। তাছাড়া ওই হতভাগিনীর প্রতি বিপ্লবী মানুষের সিম্প্যাথিই স্বাভাবিক।
কর্নেল বাইনোকুলার নামিয়ে একটু হেসে বললেন, ঠিক তাই।
তাহলে প্রত্যেকের পেছনে ওত পেতে বেড়াবেন না। আমাকে একলা থাকতে দিন।
থাকুন। কিন্তু সাবধান!
তার মানে?
কর্নেল পা বাড়িয়ে ছিলেন। ঘুরে আস্তে বললেন, আপনি কি এর আগে কখনও এই দরগায় এসেছেন?
নাঃ। কেন এ কথা জিগ্যেস করছেন জানতে পারি?
এমনি। বলে কর্নেল উঠে গেলেন ঢালের ওপর। ঘনশ্যাম তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। কর্নেল অদৃশ্য হয়ে গেলে ফোঁস করে শ্বাস ফেললেন।…
কর্নেল দরগার প্রাঙ্গণে গিয়ে দেখলেন, অন্ধ দরবেশ চিমটে বুকে ঠুকতে ঠকতে দরগার দিকে চলেছেন। আস্তানাঘরের দরজায় তালা। নির্ভুল অভ্যস্ত পদক্ষেপে দরবেশ উঁচু দরগা বা পিরের কবরের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। হাঁক দিলেন, চুল্ল। তারপর দরগার কিনারায় প্রকাণ্ড চিমটেটি রেখে নমাজ পড়া শুরু করলেন। কর্নেল ঘড়ি দেখলেন সাড়ে বারোটা বাজে। দক্ষিণের বটতলার ওখানে শকুনের চেঁচামেচি থেমেছে। শকুনগুলো চলে যায়নি। বংকুবিহারীকে খুঁজছিলেন। দেখতে পেলেন না। আছেন কোথায়, রিলিফের নৌকোর প্রতীক্ষা করছেন।…
ব্ৰজহরি ভাবছিলেন, আর পারা যায় না। আস্তানাঘরের বারান্দায় গিয়ে শুয়ে পড়বেন। রিলিফের নৌকোর আশা বৃথা। উঠতে গিয়ে চমকে বললেন, কে, কে?
দেখলেন, কর্নেলসায়েব। তখন হাসলেন।..ও! আপনি! কিন্তু সাড়া না দিয়ে আসতে আছে এমন করে? যা অবস্থা!
কর্নেল বললেন, কিছু দেখতে পেলেন ডাক্তারবাবু?
ব্ৰজহরি দঃখের মধ্যে হাসলেন।…মরীচিকা! বুড়ো আঙুলও নেড়ে দিলেন অভ্যাসমতো।…খালি মরীচিকা দেখছি কর্নেলসায়েব!
নৌকোর মরীচিকা?
শুধু নৌকোর কেন– কতরকম!
যেমন?
চুল্লুর। ইচ্ছার বিরুদ্ধে খ্যাখ্যা করে আরও হাসতে লাগলেন ডাক্তার ব্রজহরি কুণ্ডু।
চুল্লুকে দেখলেন বুঝি?
শব্দ শুনলাম, বুঝলেন? শব্দ খসখস, মচমচ, ধুপধাপ! বলে ব্ৰজহরি গাছপালার দিকে আঙুল তুললেন। যদি বলেন বাতাস, তত বাতাস। চুল্ল তো চুল্লু! তবে গলা নামিয়ে ফের বললেন, কাল একটা কালোমতো জিনিস দেখেছিলাম কয়েক সেকেণ্ডর জন্য। কিছুক্ষণ আগেও মনে হল, ওই ভাঙা ঘরগুলোর ভেতর কী একটা দেখলাম। আপনি যদি সঙ্গে যান, খুঁজে দেখতে আপত্তি নেই। কারণ আমার ধারণা, আমাদের অজানা কেউ এই দরগার ঢিবিতে লুকয়ে আছে। আসুন না, দেখি–
আচ্ছা ডাক্তারবাবু, আপনি কি এই দরগায় আগে কখনও এসেছেন?
নাঃ। কেন বলুন তো?
এমনি। বলে কর্নেল চলে গেলেন বাঁদিকের ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে। ব্ৰজহরি তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর ভাবলেন, লোকটা কে? সত্যিই কি কোনো রিটায়ার্ড কর্নেল? বড় রহস্যময় গতিবিধি এই বুড়ো ভদ্রলোকের। শাদা দাড়িগুলো আসল, না নকল? দারোগাবাবুর কাছে কথাটা তুলতে হবে এক্ষুনি। ব্ৰজহরি হন্তদন্ত পা বাড়ালেন বংকুবিহারীর খোঁজে।….
চাক্কু মেমসায়েবকে এই দরগার খোঁড়া পিরের কাহিনী শোনাচ্ছিল। এক বর্ষার দিনে একজন লোক মানত করতে এসে বৃষ্টিতে আটকে পড়েছিল। পিরসায়েব তাকে বলেন, থাক বাবা–এই বৃষ্টিতে বেরুসনি। দুমুঠো রান্না করি। খা। খেয়ে ঘুমো। কিন্তু খবর্দার, আমি যতক্ষণ রান্না করব, চোখ বুজে থাকবি। চোখ খুললে তোর বিপদ, আমারও বিপদ। কিন্তু লোকটা চোখ বুজে কতক্ষণ থাকবে? তাছাড়া তার প্রচণ্ড ইচ্ছে, ব্যাপারটা দেখবে। সে চোখ খুলে দেখে কী, পিরসায়েব উনুনে একটা ঠ্যাং ভরে রেখেছেন আর সেই ঠ্যাংটাই জ্বলছে। কাঠের বদলে ঠ্যাং! ব্যস! লোকটাও পাগল হয়ে গেল তাই দেখে। এদিকে মানুষের চোখ পড়ায় পিরসায়েবের ঠ্যাংটাও গেল পুড়ে। খোঁড়া হয়ে গেলেন। সেই থেকে খোঁড়া পির নাম। চাক্কুর ঠাকুর্দার কাছে শোনা কথা।
গল্প শুনতে শুনতে হঠাৎ পেছনে শব্দ। দুজনে চমকে উঠেছিল। ঘুরে দেখল, কর্নেল। বললেন, এই যে ক্লারা! তুমি এখানে আমি তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম!
ক্লারা উদ্বিগ্নমুখে বলল, কেন বলুন? কিছু কি বিপদ হয়েছে?
না। কর্নেল একটা চাঙড়ে বসলেন। কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে খুঁজিনি।
তবে—
বলুন পিতা!
তুমি আমাকে পিতা বললে!
বলতে ইচ্ছা হল। ক্লারা একটু হাসল।…আপনাকে মাঝে মাঝে খ্রিস্টীয় ফাদার দেখায়। আমি কী বলতে চাইছি, আশা করি বুঝেছেন। অবশ্য আপনি একজন কলোনেল- দুঃখিত, আমেরিকাবাসীরা কর্নেল বলে না– মুখের ভুল!
ক্লারা! কর্নেল জার্মান ভাষায় বললেন, প্রদোষ সম্পর্কে তোমার ধারণা হয়তো ভুল। ওর সঙ্গে তুমি মিটমাট করে নাও। আমি সাহায্য করতে রাজি। কারণ তুমি আমাকে যে অর্থে হোক, পিতা বলে ডেকেছ!
ক্লারা অবাক হয়ে জার্মান ভাষায় বলল, আপনি জার্মান জানেন?
জানি। যাই হোক, তুমি ওর কাছে যাও। তার সঙ্গে কথা বলো। দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে।
ক্লারা একটু চুপ করে থাকার পর বলল, ঠিক আছে। আমি চেষ্টা করতে রাজি। কিন্তু প্রদোষ আমার সঙ্গে কথা বলছে না।
তুমি এখনই যাও। ওকে নেমে আসতে বলো ছাদ থেকে। বলো, জরুরি দরকার আছে।
ক্লারা কর্নেলের মুখের দিকে তাকাল। তারপর ছোট্ট শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। আস্তে আস্তে চলে গেল। তার চলার ভঙ্গি দেখে কর্নেল বুঝলেন, হয়তো প্রদোষের কাছে সে যাচ্ছে না। মনে মনে বিরক্ত হয়ে নিছক স্থানত্যাগ করছে। মেয়েটি অদ্ভুত প্রকৃতির যেন। কর্নেল ডাকলেন, চাক্কু!
চাক্কু হাঁ করে তাকিয়ে দুজনকে লক্ষ্য করছিল এতক্ষণ। বলল, আজ্ঞে সার?
তুমি আগে কখনও এ দরগায় এসেছ?
আজ্ঞে না, স্যার। তবে পেসেঞ্জার পৌঁছে দিয়েছি নিচের রাস্তায়।
পুঁতি কখনও এসেছিল কি না জানো?
পুঁতি– চাক্কু স্মরণ করার চেষ্টা করে বলল, তা এসে থাকতেও পারে। কেন সার?
কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুটটি লাইটার জ্বেলে ধরিয়ে বললেন, আচ্ছা চাক্কু, পুঁতিকে কে খুন করেছে বলে তোমার মনে হয়?
চাক্কু মুখ নামিয়ে এক টুকরো ইট পায়ের কাছে পাথরের স্ল্যাবে ঠুকতে ঠুকতে বলল, আমার ডেগারখানা পুঁতি কখন হাতিয়েছিল– তা পরে মনে হয়, শাওনিকে তাই দিয়ে খুন করেছিল…
পুঁতি? কর্নেল ঝুঁকে গেলেন তার দিকে।
চাক্কু গলার ভেতর বলল, পুঁতি খুব তেজী মেয়ে ছিল। নদীর ধারের ডুবো দেশের মেয়ে। ওর ওইরকমই। কখন আমার পাশ থেকে উঠে গিয়ে শাওনিকে আচমকা ধরে গলায় প্যাঁচ দিয়ে থাকবে।
কিন্তু পুঁতিকে কে খুন করল তাহলে?
চাক্কু এদিক-ওদিক তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, হরিপদকে সন্দ হয় আমার।
কেন বলো তো? সে তো বাউল!
চাক্কু তেতোমুখে বলল, হতে পারে বাউল-বোষ্টম। বাইরে থেকে কাউকে কি চেনা যায় সার? এই যে আমাকে দেখছেন, আম্মো কি কম? কম নইকো। এই বিপদের মধ্যে আটকে আছি, তাই। নৈলে
কর্নেল হাসলেন না। গম্ভীর হয়ে বললেন, নৈলে তুমি হরিপদকে জবাই করতে বুঝি?
হ্যাঁ–হ্যাঁ। চাক্কু শক্তমুখে বলল। সার! আমি এখন মরিয়া। আমার মাথায় খুন চড়ে আছে।
বুঝলাম। কিন্তু হরিপদ কেন খুন করবে পুঁতিকে?
চাক্কু একটু দোনামনা করার পর চাপাস্বরে বলল, তাহলে আসল কথাটা খুলে বলি, সার?
বলো, বলো!
শাওনির আসল নাম ছিল হরিমতী। চাক্কু আরও ফিসফিসিয়ে উঠল। শাওনির সব কথা আমার জানা। আমি, সার, এই তল্লাটের ছেলে। হরিমতী ছিল এলোকেশী বোষ্ট্রমীর মেয়ে। হরিপদ তাকে কিনেছিল এলোকেশীর কাছে। বাউলবোষ্টমরা কড়ি দিয়ে বোষ্টুমী কেনে, জানেন তে? কণ্ঠিবদল হয়– সেটাই ওদের বিয়ে বলতে পারেন। তো আগের বছর নবাবগঞ্জেতে ঝুলনের মেলার সময় হরিমতী হরিপদকে ছেড়ে এক বাবুর রাখনি হয়েছিল। রাখনি বোঝেন তো সার?
রক্ষিতা?
আজ্ঞে! চাক্কু মাথা দোলাল। রক্ষিতে। হরিপদ আমার চেনা লোক। আমি সব জানি। এবার আপনি ইশারায় বাকিটা বুঝে নেন। বাবুর সঙ্গে বনিবনা হল না, তখন হরিমতী কী করবে? শাওনি হয়ে বাগানপাড়ায় ঢুকল। আমি, সার, রিকশা চালিয়ে খাই। অনেক লোকের অনেক খবর আমার জানা। বাগানপাড়ার গলির খবরও জানা।
কর্নেল একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, শাওনিকে এখানে দেখে হরিপদ কি কিছু বলেছিল তাকে কিংবা তোমাকে?
চাক্কু জোরে মাথা দোলাল। না–বলেনি। বললে শাওনি হরিপদকে একশো খিস্তি না করে ছাড়ত ভাবছেন? তবে
তবে কী?
চাক্কু শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, কাল রেতের বেলা হরিপদর গানখানা মনে করে দেখুন। সেই গানখানা, সার! মরা মানুষ পড়ল ধরা ছিমতী (শ্রীমতী) ভাগীরথীতে/চিত হয়ে ভাসচে জলে ঠুকরে খায় ডাল-কোয়োতে (দাঁড়কাকে)। গানখানা শুনে আমার কেমন যেন সন্দ বলুন সন্দ, ধন্দ বলুন ধন্দ, লাগছিল। তাপরে যখন গলাকাটা শাওনিকে জলে সেইরকম অবস্থায় দেখলাম, পেথমে হরিপদ শালাকে ধরিয়ে দেবার ইচ্ছে হয়েছিল। কিন্তু পুঁতি হঠাৎ বলল, চান। করব। আর হরিপদ অমন করে কাঁদছিল– আপনি দেখেননি?
লক্ষ্য করিনি। তখন শাওনিকে ওই অবস্থায় দেখে আমি তো বটেই, আমরা সবাই কেমন হয়ে পড়েছিলাম। কর্নেল স্বীকার করার সুরে বললেন। হ্যাঁ– তখন সবার চোখ ছিল শাওনির দিকে।
চাক্কু বলল, আমার ছিল না। আমি পেথমে পুঁতিকে, তাপরে হরিপদকে দেখছিলাম। শাওনি কাল বিকেলে পুঁতির সামনে আমার সঙ্গে মস্করা করতে গেল। পুঁতি ক্ষেপে গেল আমার ওপর। শাওনির ওপরও বটে! শাওনি আমাকে বলছিল, মেয়েটাকে ভাগিয়ে এনেছি আমি। বেচে দিলে পাঁচশো টাকা পাইয়ে দেবে। কাজেই বুঝলেন সার? শাওনিকে পুঁতিই আমর ডেগার দিয়ে মেরেছে।
কর্নেল সায় দেবার ভঙ্গিতে বললেন, হু। পুঁতির রাগের আরও একটা কারণ থাকতে পারে। রাত্রে দারোগাবাবুর কথায় শাওনি ওকে সার্চ করতে গিয়েছিল।
ঠিক ধরেছেন, সার! চাক্কু নড়ে বসল। হ্যাঁ– এক্কেবারে ঠিক। সকালে পুঁতি চান করতে গিয়েছিল মনে হয়, কাপড়ে রক্ত-উক্ত ছিল!
কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। পা বাড়াতে গিয়ে ঘুরে বললেন, তুমি দারোগাবাবুকে এসব কথা বলেছ নাকি?
না। চাক্কু মুখ নামিয়ে বলল। বলিনি। তখন বলব বলব ভাবছিলাম, হঠাৎ মনে হল
চাক্কু থেমে গেলে কর্নেল বললেন, কী?
ইসমাইল ডাকুর কথা বলছিলেন দারোগাবুবু। তাছাড়া তালডোঙাটা! কাজেই সার, দোনামনায় পড়ে গেলাম। চাক্কু শ্বাস ছাড়ল জোরে। পুঁতি ইসমাইলকে চিনত। ওদের তল্লাটের লোক ইসমাইল। পুঁতি তাকে দেখে দারোগাবাবুকে ডাকবে এই ভয়ে শালা ডাকু হয়তো পুঁতিকে মেরে পালিয়েছে। কিন্তু এখানে বসে ভাবতে-ভাবতে মনে হচ্ছে, ইসমাইল তালডোঙা নিয়ে দরগায় লুকুতে এসেছিল। রাত্তিরটা কোনো গাছতলায় লুকিয়ে থেকে ডোঙাটা খুঁজে বের করে পালিয়ে গেছে। কেননা, দরগায় দারোগাবাবু হাজির। সার! এইসব কথা ভাবতে ভাবতে মনে হল, এটা হরিপদরই কাজ। হরিমতী বলুন বা শাওনি বলুন, মেয়েটা তার কণ্ঠিবদলকরা বউ তো বটে। পুঁতি তাকে মেরেছে। তাই হরিপদ পুঁতিকে মেরেছে। আমি এর শোধ না নিয়ে ছাড়ব না, তাতে শূলি-সি যা হবার হবে।
কর্নেল একটু হাসলেন। না চাক্কু! তুমি ওকে মারতে গেলে ও চাঁচাবে। তখন দারোগাবাবু ডাক্তারবাবু– সবাই দৌড়ে যাবে।
চ্যাঁচাতে দেব ভাবছেন নাকি? গলা টিপে ধরব পেছন থেকে।
সম্ভবত পারবে না। হরিপদ তোমার চেয়ে তাগড়াই লোক। তার গায়ে জোরও আছে। কর্নেল মিটি মিটি হাসছিলেন।…তাছাড়া হরিপদর কাছে তোমার ছোরাটা আছে। তাই না?
চাক্কু আগুনজ্বলা চোখে তাকিয়ে বলল, আজ্ঞে, সেই ভেবেই তো এতক্ষণ দোনামনা করছি। নৈলে কখন শালাকে গলা কেটে জলে ভাসিয়ে দিতাম।
সে ইটের টুকরোটা ঠুকতে ঠুকতে গুঁড়িয়ে ফেলার চেষ্টা করতে থাকল। মুখটা নিচু। কর্নেল প্রাঙ্গণে গিয়ে দেখলেন, দরবেশ দরগার কাছে নমাজ পড়ে আস্তানার বারান্দায় গেছেন এবং সেই জীর্ণ গালিচাটি পেতে হাঁটু মুড়ে বসে বুকে চিমটে ঠুকছেন। বিড়বিড় করে জপ করছেন এবং মাঝে মাঝে হাঁক দিচ্ছেন, চুল্ল!
কর্নেল পাশের ঘরে কাপড়ঢাকা বডি দুটো উঁকি মেরে দেখে বারান্দায় পা ঝুলিয়ে বসলেন। আকাশের যে অংশটা দেখা যাচ্ছে, সেখানে কয়েকটা বৃষ্টিমেঘ খুব ধীরে ভেসে যাচ্ছে। বিকেলে আবার বৃষ্টি নামবে হয়তো। বাতাস বন্ধ। ভ্যাপসা গরম। নিঝুম দরগার বনভূমিতে পাখ-পাখালির ডাক মাঝে মাঝে। বাইনোকুলারে পাখি দেখার ইচ্ছে করছে না আর। চারদিক থেকে আবছা জলের শব্দ। যদি ফের বৃষ্টি নামে, জল ফের বাড়বে। আকাশের দিকে তাকিয়ে মেঘের গতিবিধির ওপর কিছুক্ষণ নজর রাখলেন কর্নেল। তারপর উঠে পড়লেন। বংকুবিহারীর খোঁজে এগিয়ে গেলেন।…
হরিপদর একতারা চুপ। আর পিড়িং পিড়িং করে সুর দিতে বিরক্তি আসছে। একটা ছাতিম গাছের গোড়ায় ইটের মস্তো চাঙড়। তার ওপর বসে জলে পা ডুবিয়ে রেখেছিল সে। জলটা কমছে। সে বিড় বিড় করল, জয় গুরু! জয় গুরু! তারপর একটু চমকে উঠল। পাশে ও পেছনে ছাতিম গাছের ওপাশে ঘন ঝোপ। ধ্বংসপ জুড়ে জঙ্গল গজিয়ে আছে। যেন পায়ের শব্দ শুনেছিল। বলল, কে গো বাবা?
কেউ সাড়া দিল না। একটু হাসল হরিপদ।…মনের ভুল! আপনমনে বলল সে। তারপর গুনগুনিয়ে উঠল। ‘ওরে মোনকানা/তুমি মানুষ চিনেও চিনলে / লোকে ডেকে চিনিয়ে দিলে তুমি বললে চিনলাম না/ওরে আমার মোনকানা ॥‘
সেই সময় সামনের আকাশে ঘর-ঘর গুরু-গুরু শব্দ। গান থামিয়ে দিল হরিপদ। উত্তরপূর্ব কোণ থেকে প্রকাণ্ড কালো ভোমরার মতো কী একটা উড়ে আসছে। শব্দটা বাড়ছে। হরিপদ তাকিয়ে রইল। আস্তানার দিকে চ্যাঁচামেচি শুরু হয়েছে।…
.
হেলিকপ্টার এবং পঞ্চম হত্যাকাণ্ড
আস্তানাঘরের ছাদ থেকে হেলিকপ্টারটা বাইনোকুলারে এখন দেখেছিল প্রদোষ। তারপর সে চেঁচিয়ে উঠেছিল, হেলিকপ্টার! হেলিকপ্টার! ক্লারা ঘনশ্যামের সঙ্গে কথা বলছিল। দুজনেই দৌড়ে এসেছিল প্রাঙ্গণে। হেলিকপ্টারটা শব্দ শুনে ব্ৰজহরি এসে পড়ে বিকট চেঁচিয়ে বললেন, প্রদোষবাবু! প্রদোষবাবু! রুমাল নাড়ুন! রুমাল নাড়ুন! দৌড়ে এলেন কর্নেল, বংকুবিহারী, তারপর চাক্কু। সবাই চ্যাঁচামেচি জুড়ে দিলেন। প্রদোষ উঁচুতে আছে। সে রুমাল নাড়তে লাগল। হেলিকপ্টারটা উত্তরপূর্ব কোণ থেকে এসে আস্তানাঘরের ওপর পৌঁছুলে প্রদোষ আরও জোরে রুমাল নাড়তে থাকল। ব্ৰজহরি ছাদে চড়ার চেষ্টা করছিলেন। ভাঙা দেয়ালে উঠে টাল সামলাতে না পেরে আছাড় খেলেন। বংকুবিহারী উঠে পড়লেন। তাঁর সঙ্গে কর্নেলও। শেষে ঘনশ্যাম এবং চাক্কু। কেউ হাত নাড়ছেন, কেউ রুমাল। হেলিকপ্টারের লোকেদের নিশ্চয় চোখে পড়েছে। কারণ হেলিকপ্টারটা চক্কর খাচ্ছে দরগার ওপর। অনেকটা নিচুতে নেমেও এল। তারপর একবার চক্কর দিয়ে দক্ষিণে চলে গেল। বংকুবিহারী ক্ষোভে দুঃখে এবং রাগে গর্জন করলেন, শুওরের বাচ্চা! নিচে থেকে ব্রজহরি চেঁচিয়ে উঠলেন, গুলি করে নামান! গুলি করে নামান ব্যাটাচ্ছেলেকে! অমনি বংকুবিহারী পিস্তল বের করে সত্যিই দু-দুটো গুলি ছুড়লেন– তখন হেলিকপ্টার দূরে, কর্নেল বললেন, কী হচ্ছে দারোগাবাবু? হেলিকপ্টারে কোনো মিনিস্টার থাকতে পারেন! শুনেই বংকুবিহারী দারুণ চমকে বললেন, সরি! আমি পাগল হয়ে গেছি বিলিভ মি! রিভলবার সঙ্গে সঙ্গে কোষবদ্ধ করে শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে ফের বললেন, আই ডোন্ট কোয়ার মিনিস্টার অর ফিনিস্টার! কর্নেল বললেন, অবশ্য আপনার গুলি ছোঁড়া মিনিস্টার দেখতে পাননি– ভাববেন না। বংকুবিহারী ধপাস করে বসে বললেন, বয়ে গেল। আমি চাকরি ছেড়ে দেব। আমি একটা থানার অফিসার-ইন-চার্জ। দুদিন ধরে আমি নিখোঁজ। কারুর মাথায় এল না আমি কোথায় আছি– কী অবস্থায় আছি? জাস্ট পাঁচমাইল দূরে থানা। ব্ৰজহরি দ্বিতীয় চেষ্টায় উঠে এলেন ছাদে। হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন, নিশ্চয় থানার অফিসাররা বোট নিয়ে খুঁজতে বেরিয়েছেন ও তল্লাটে– মানে যে তল্লাটে গিয়েছিলেন। ওঁরা কেমন করে বুঝবেন, আপনি দরগায় আছেন? বংকুবিহারী ভেবে বললেন, — তা ঠিক। ঘনশ্যাম বললেন, দেখে গেল– নিশ্চয় বোট পাঠাবে। ওয়েট করুন। তারপর নিচের প্রাঙ্গণে ক্লারাকে দেখতে পেয়ে বললেন, ম্যাডাম! এখানে চলে আসুন। উঁচুতে থাকলে ওদের নজরে পড়ত। ভেরি ইজি, ম্যাডাম! কাম হেয়ার! জয়েন আস্। ঘনশ্যাম আনন্দে হেসে ফেললেন। কিন্তু বংকুবিহরী আচমকা গর্জে উঠলেন, ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট। ডোন্ট ফরগেট ঘনশ্যামবাবু! ঘনশ্যামবাবুর মুখের হাসি মুছে গেল। গলার ভেতর বললেন, ঠিক আছে। হাজতখাটা আমার বহুকালের অভ্যেস! বলে বসে পড়লেন কার্নিসে। ক্লারা উঠে এল খুব সহজেই। সে চাক্কর পাশে বসে আস্তে বলল, আপনার কাছে আর সিগারেট আছে? চাক্কু বলল, আজ্ঞে না মেমসায়েব! প্রদোষ ভুরু কুঁচকে কথাটা শুনল। তারপর পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা ছুঁড়ে দিল তার দিকে। ক্লারা কিন্তু হাসল। বলল, ধন্যবাদ। তারপর চাক্কুকে বলল, আপনি দেশলাই জ্বালুন। প্রদোষ রাগ করতে গিয়ে হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল, উই আর অল ম্যাড- এভরিবডি! ব্ৰজহরি ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে ছিলেন ঘনশ্যামের দিকে। এতক্ষণে বললেন, ও মশাই! আপনার নাম তো হর্ষনাথবাবু। আপনি ঘনশ্যামবাবু হলেন কখন? ঘনশ্যাম গর্বিত হেসে ললেন, আমি বিপ্লবী কৃষক-মজদুর পার্টির নেতা ঘনশ্যাম রুদ্র! আন্ডারগ্রাউন্ড ছিলাম! আমার নাম আপনার জানা উচিত ছিল। বংকুবিহারী বললেন, শাট আপ! আর একটি কথা নয়। এইসময় কর্নেল বললেন, কিন্তু হরিপদ- সে কোথায়? ব্ৰজহরি বললেন, আছে কোথাও। সংসারত্যাগী মানুষ। আউল-বাউল লোক। গুরুর নাম জপছে নিরিবিলিতে। বলে ডাকতে থাকলেন, হরিপদ! ও হরিপদ! হরিপদো—ও–ও! কর্নেল ছাদ থেকে ব্যস্তভাবে নেমে গেলেন। বংকুবিহারী মন্তব্য করলেন, পাগল!
তারপর কতক্ষণ কর্নেলের পাত্তা নেই। ক্লারা সিগারেট টেনে নিচে জল লক্ষ্য করে ছুঁড়ে ফেলল। জলে পৌঁছুল না। নিচে একটা পাথরের ফলকের খাঁজে আটকে গেল। ক্লারা যেন সেটা জলে না ফেলে ছাড়বে না এমভাবে কার্নিশ থেকে ভাঙা দেয়াল বেয়ে নেমে গেল। প্রদোষ ফের বলল, উই আর অল ম্যাড! ঘনশ্যাম ঘুরে মেমসায়েবকে নামতে দেখলেন। ব্ৰজহরিও দেখলেন, মুখে। ভয়ের ছাপ। পড়ে হাড়গোড় ভাঙবে, সে ভয় নেই- মেমসায়েবরা সত্যিই আজব দেশের আজব প্রাণী!
ক্লারা কিন্তু আস্তানাঘরের প্রাঙ্গণে চলে গেছে। তারপর হন হন করে হেঁটে চলেছে। সে গাছপালার আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেলে প্রদোষ কার্নিশের ধারে চাক্কুর পাশে রাখা সিগারেটের প্যাকেটটা আনতে গেল। ব্ৰজহরি বললেন, আমাদের নজর রাখা দরকার। বোট আসবে। হেলিকপ্টারে মিনিস্টার যখন দেখে গেছেন, তখন বোট আসতে বাধ্য। প্রদোষ একটা সিগারেট ধরালে চাক্কু সবিনয়ে বলল, সার! একটা দিন না আমাকে। প্রদোষ তার দিকে তাকাল। তারপর একটা সিগারেট ছুঁড়ে দিল। চাক্কু দুহাতে সেটা লুফে নিল। বংকুবিহারী বললেন, আমি স্মোক করি না। তবে ইচ্ছে করছে। দিন তো মশাই একটা টেনে দেখি!
বংকুবিহারী সবে সিগারেট ধরিয়েছেন, ক্লারার চিৎকার ভেসে এল, আবার হত্যা! আবার একটি হত্যা! আপনারা আসুন! সকলে আসুন!
উত্তরপূর্ব কোণে ধ্বংসস্থূপের ফাঁকে ক্লারাকে দেখা যাচ্ছিল। প্রচণ্ড হাত নেড়ে চিৎকার করছে, হত্যা! ভীষণ হত্যা!
বংকুবিহারী উঠে দাঁড়ালেন। ঘনশ্যামের কথা ভুলে ধুড়মুড় করে ভাঙা দেয়াল দিয়ে নামলেন, দৌডুলেন। রিভলবার বের করেই ছুটে চললেন। ব্ৰজহরি কাঁপতে কাঁপতে বললেন, সর্বনাশ! সর্বনাশ! সর্বনাশ! আবার কে গেল? প্রদোষ নির্বিকার মুখে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানতে থাকল। চাক্কু শ্বাস ছেড়ে বলল, হরিপদ গেল!
ব্ৰজহরি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। তারপর হাতপায়ে ভর করে হাঁচড়-পাঁচড় করে নামতে শুরু করলেন। ঘনশ্যামও নেমে গেলেন। তারপর গেল চাক্কু। প্রদোষ একা দাঁড়িয়ে রইল ছাদে।…
উত্তরপূর্ব কোণে বন্যার জলের ধারে হরিপদ উপুড় হয়ে পড়ে আছে। চাপ চাপ রক্ত গলা থেকে বেরিয়ে জলকে লাল করছে। তার পা দুটো ওপরদিকে, মাথাটা জলে। একতারাটা ছিটকে পড়ে আছে। ব্ৰজহরি, ঘনশ্যাম, চাক্কু ও ক্লারা একটু তফাতে দাঁড়িয়ে আছেন। ওঁদের দৃষ্টি বন্যার অবাধ জলের দিকে। বংকুবিহারী ও কর্নেলের দৃষ্টি হরিপদর দিকে। কর্নেল আস্তে বললেন, আমি আসার আগেই হরিপদ মারা পড়েছে। বংকুবিহারী এবার ভয় পাওয়া গলায় বললেন, চুল্লু! চুল্লু আছে।
কর্নেল হঠাৎ ব্যস্তভাবে বললেন, বডিটা তুলে আস্তানাঘরে নিয়ে যাওয়া দরকার। শকুনগুলো ওত পেতে আছে। আসুন ঘনশ্যামবাবু! ডাক্তারবাবু! চাক্কু! দেরি করা ঠিক নয়। শিগগির!…
.
ভিজে আগন্তুক এবং তালডোঙা রহস্য
আবার আকাশ মেঘে ঢেকে গেছে এবং তারপর প্রচণ্ড বৃষ্টি। মাঝে মাঝে মেঘের গর্জন। বজ্রপাত। আস্তানাঘরের বারান্দায় জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। লোকগুলি। পাশের ঘরে তিনটি কাপড়টাকা লাশ এবং তাদের গলা ফাঁক। এবার ঘনিয়ে এসেছে সত্যিকার সন্ত্রাস। ব্ৰজহরির মতে একজন বেশ্যার মৃত্যু, যত বীভৎস হোক, ততকিছু আতঙ্ক ছড়াতে পারেনি। তার আগে একটি কুকুরের মৃত্যু তো গ্রাহ্য করার মতো ঘটনাই হয়ে ওঠেনি। আর একজন ঘর-পালানো, গ্রাম্য নিম্নবর্গীয় সমাজের মেয়ের মৃত্যু, বারবধূটির মৃত্যুই স্বাভাবিক মনে হয়েছিল। কিন্তু বাউল হরিপদর মৃত্যু জোর ধাক্কা দিয়েছে সবাইকে। ব্ৰজহরি কাঁপা কাঁপা গলায় শেষে বললেন, এবার কে? কার পালা?
বংকুবিহারীর হাতে এখনও রিভলবার। একটু নড়ে বসে বললেন, আপনি চুপ করুন। আমাকে ভাবতে দিন!
ঘনশ্যাম ম্রিয়মান কণ্ঠস্বরে বললেন, আমি নাস্তিক। ভূত-ভগবান মানি না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, কী একটা আছে- একটা ব্লাইন্ড ফোর্স! নেচারের কতটুকুই বা সায়েন্স ভেবেছে? নেচারের মধ্যে ডায়ালেকটিক্স- মানে দ্বন্দ্ব আছে। বিরোধী শক্তি আছে।
বংকুবিহারী ফের বললেন, আঃ! চুপ করুন তো মশাই!
ক্লারা বলল, চুপচাপ থাকলে আমরা আরও ভয় পাব। দারোগামহাশয়, আমাদের কথাবার্তায় অনুগ্রহপূর্বক আপত্তি করবেন না।
প্রদোষও আর চুপ করে থাকতে পারছিল না। বলল, আমার একটা স্টোরি মনে পড়ছে অ্যারাবিয়ান নাইটসের।
ব্ৰজহরি বললেন, বলুন, বলুন!
প্রদোষ বলল, সিন্দবাদ এপিসোড। সেই যে এক রাক্ষসের হাতে সিদ্বাদ আর তার সঙ্গীরা বন্দী হল, রাক্ষস রোজ সেলের ভেতর হাত ঢুকিয়ে একজনকে বের করে নেয়, খেয়ে ফেলে, তারপর এইভাবে প্রতিদিন একজন। করে বন্দী–
ঘনশ্যাম দ্রুত বললেন, একজ্যাক্টলি! ঠিক তাই হচ্ছে। ব্লাইন্ড ন্যাচারাল ফোর্সের হাতে আমরা বন্দী।
ব্ৰজহরি কাঁপা-কাঁপা গলায় বলেন, এবং একজন করে তার হাতে ধরা পড়ছি। আমরা! ওঃ,ভয়াবহ! এবার কার পালা কে জানে?
বংকুবিহারী গলার ভেতর বললেন, আরে মশাই, সেটাই তো ভাবছিলাম! চুল্লু তার সিম্বল। চুল্লু আছে। চুল্লু ছাড়া এসবের কোনো অর্থ হয় না। তিরিশ বছর আমার পুলিশ লাইফ! অনেক মিসস্ট্রিয়াস ব্যাপার দেখেছি। এমন কখনও দেখিনি।
দরবেশে একইভাবে তার ঘরের দরজার সামনে জীর্ণ গালিচায় বসে দুলতে দুলতে জপ করছিলেন এবং বুকে চিমটে ঠুকছিলেন। ঝুম ঝুম চাপা শব্দ তালে-তালে। বলে উঠলেন, চুল্লু! সঙ্গে সঙ্গে ভীষণ শব্দে কোথাও বাজ পড়ল। আস্তানা কেঁপে উঠল।
চাক্কু ফিসফিসিয়ে ব্ৰজহরিকে বলল, দরবেশবাবাকে ধরুন সবাই মিলে। বাঁচলে উনিই বাঁচাতে পারেন।
ব্ৰজহরি আর্তকণ্ঠস্বরে বললেন, দরবেশবাবা! দরবেশবাবা!
অন্ধ দরবেশ দুলতে দুলতে বুকে চিমটে ঠুকতে ঠুকতে ফের বললেন, চুল্লু! প্রাঙ্গণে, চারদিকের ঘন জঙ্গলে, চাপ চাপ ধ্বংসপে বৃষ্টির শব্দ, মেঘের গর্জন– ধারাবাহিক। মাঝে মাঝে ঝোড়ো, দমকা বাতাসে গাছপালা নড়ে উঠছে। ছাট আসছে বারান্দায়। কর্নেল বর্ষাতিটি ফের গায়ে চড়িয়েছেন এবং দেয়ালে হেলান দিয়ে শেষপ্রান্তে বসে আছেন। দাঁতে কামড়ানো জ্বলন্ত পাইপ। বারান্দার ভেতর আবছায়ায় সন্ত্রস্ত লোকগুলির দিকে মুখ ফেরালেন। আস্তে বললেন, বন্যাটা আবার বেড়ে যাবে হয়তো।
এই কথায় আবার আতঙ্ক ছড়াল। ব্ৰজহরি প্রাঙ্গণের দিকে ঘুরে চমকানো গলায় বললেন, ওই তো বেড়েছে! কবরগুলো ডুবেছে!
কর্নেল বললেন, না। ওগুলো বৃষ্টির জল।
প্রদোষ ক্ষোভে বলল, হেলিকপ্টারটা আমাদের দেখে গেল। অথচ এখনও বোট পাঠাল না। দু ঘণ্টা– টু আওয়ার্স পাড় অ্যাওয়ে! দিস ইজ ইন্ডিয়া।
দিস ইজ ইন্ডিয়া! সায় দিলেন ঘনস্যাম। ধনতন্ত্রের পোশাকপরা সামন্ততন্ত্রের এটাই নিয়ম।
ব্ৰজহরিও সায় দিলেন। রেডটেপিজম! মিনিস্টার নবাবগঞ্জের হেলিপ্যাডে নেমে এখন সার্কিটহাউসে বসে গরম-গরম কফি খাচ্ছেন। অফিসারদের হয়তো বলেছেন, জলবন্দী একজন লোকের কথা। এখন ফাইল চালাচালি হচ্ছে। রিলিফ অফিসারের কাছে সেই ফাইল পৌঁছুতে বছর ঘুরে যাবে এবং অবশেষে যখন বোট আসবে, দেখবে আটখানা গলাকাটা ডেডবড়ি ছিঁড়ে খাচ্ছে একদঙ্গল শকুন!
ব্ৰজহরির মুখে বীভৎসতা ফুটে উঠেছিল। ঘনশ্যাম চাপা গর্জন করলেন, রেভোলিউশন! বিপ্লব! বিপ্লব না হলে–
বংকুবিহারী পাল্টা গর্জন করলেন, শাট আপ! ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট। ডোন্ট ফরগেট দ্যাট!
এই সময় চাক্কু হঠাৎ চমকানো গলায় বলল, পাশের ঘরে কে যেন ঢুকল!
সবাই নড়ে উঠলেন। পাশে ঘরের দরজার ভেতর দৃষ্টি চলে গেল। তিনটি কাপড়টাকা লাশের ওপর জল পড়ছে। ছাদ চুঁইয়ে টুপ টাপ…টুপ টাপ। কাপড়ে রক্তের ছোপ ফুটে উঠেছে। ক্লারা বলল, আমি দেখতে চাই। সে উঠতে গেলে প্রদোষ তাকে টেনে বসিয়ে দিল। বংকুবিহারী বললেন, কে ওঘরে? সাড়া না দিলে গুলি ছুড়ব!
কোনো সাড়া এল না। চাক্কু দম আটকানো স্বরে বলল, পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। ওই তো দাঁড়িয়ে আছে।
চাক্কু পাশের ঘরের দরজার পাশে বসে ছিল। সে কথাটা বলেই সরে গেল ব্ৰজহরির কাছে। ব্ৰজহরি সরে গেলেন ঘনশ্যামের কাছে। দরবেশ বলে উঠলেন, চুল্লু! চুল্লু! চুল্লু! আবার বাজ পড়ল কোথায়।
বংকুবিহারী উল্টোদিকের দেয়ালে কর্নেলের পাশে বসে ছিলেন। রিভলবার তুলে বললেন, কে আছ। সাড়া না দিলে সত্যি গুলি ছুড়ব!
ক্লারা ক্ষোভে ফুঁসে উঠল।…আমাদের মতো কেউ কি এই উচ্চভূমিতে আশ্রয় গ্রহণ করতে পারে না? কেন তাকে গুলিবিদ্ধ করবেন আপনি? আপনি আইনরক্ষক অথবা ঘাতক?
বংকুবিহারী খাপ্পা হয়ে বললেন, দিস ইজ ইন্ডিয়া, নট ইউ এস এ, ম্যাডাম! ডোন্ট ইন্টারভেন।
ক্লারা বলল, আপনি মাতৃভাষায় কথা বলুন। অথবা জার্মান ভাষায় বলুন। আমি জার্মান।
ঘনশ্যাম লাফিয়ে উঠলেন।…তাহলে বুঝুন কে এই মেমসায়েব! কাল বিকেলেই আমি ডাক্তারবাবুকে বলছিলাম- বলছিলাম না ডাক্তারবাবু?
ব্ৰজহরি রুদ্ধশ্বাসে বললেন, তক্কাতর্কি নয়, তক্কাতর্কি নয়। বড় দুঃসময়। সবাই কাছাকাছি বসে থাকুন। যে যার ইষ্টনাম জপ করুন। চাক্কু যাকে দেখেছে, সেই চুল্ল! অশরীরী আত্মা। এই দরগার গার্ড। বুঝলেন না আপনারা?
কর্নেল উঠে গেলেন পাশের ঘরের দরজায়। ব্ৰজহরি হাত বাড়িয়ে তাঁর বর্ষাতি খামচে বাধা দিতে গেলেন। কিন্তু কর্নেল ও-ঘরে ঢুকে পড়েছেন ততক্ষণে।
তারপর কেউ ফুঁপিয়ে উঠল ও-ঘরে…সার! সার! আমাকে মারবেন না! আমি ঝাঁপুইহাটির লোক। আমার নাম হরমুজ আলি, সার। বড় ঠেকায় পড়ে। ঘরে ঢুকেছি!
কর্নেল শান্তভাবে বললেন, বারান্দায় এস। এঘরটা ধসে পড়তে পারে।
কর্নেলের পিছু-পিছু নীল গেঞ্জি আর চেককাটা লুঙ্গিপরা এক যুবক কুঁকড়ে ঢুকল। ভিজে একাকার। ভয়ে কিংবা বৃষ্টিজনিত ঠাণ্ডায় কাঁপছে। বংকুবিহারী গোল চোখে তাকিয়ে দেখছিলেন। বললেন, তোমাকে চেনা-চেনা ঠেকছে যেন! কোনপথে ওঘরে ঢুকলে? ছাদ ফুঁড়ে, নাকি সিঁদ কেটে? ও-ঘরে তো আর দরজা-জানালা নেই!
জবাব দিলেন কর্নেল। ওপরের বড় ঘুলঘুলিটা লক্ষ্য করেননি কেউ। ওখান দিয়ে দেয়াল ধরে নামা যায়।
ঘুলঘুলি দিয়ে? বংকুবিহারী অবাক হয়ে বললেন। বুঝেছি! আভ্যেস আছে। তাহলে। অ্যাই ছোকরা, কী নাম বলছিলে যেন?
সার, আমার নাম হরমুজ আলি। বড়ি ঝাঁপুইহাটি।
ক্লারা বলে উঠল, ওর পোশাক বদলানো দরকার। আমি দিচ্ছি।
প্রদোষ বাধা দিল।…ডোন্ট ডু দ্যাট, বেবি! ইউ আর আ ম্যাড গার্ল!
ক্লারা গ্রাহ্য করল না। নিজের কিটব্যাগ খুলে একটা তোয়ালে ছুঁড়ে দিল হরমুজ আলির দিকে। তারপর বলল, আপনি চিন্তা করবেন না। আমার শেষ শাড়িটি দিচ্ছি। আপনি লুঙ্গির মতো পরুন।
কর্নেল ওঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে। একটু পরে বললেন, যাও, পরে এস।
হরমুজ লাশ তিনটিকে এড়িয়ে কোণে চলে গেল। একটু পরে ক্লারার জংলিছাপ সূতী শাড়িটি লুঙ্গির মতো পরে তোয়ালে জড়িয়ে বারান্দায় এল। নিজের ভিজে লুঙ্গি এবং গেঞ্জিটি বারান্দার ধারে গিয়ে নিংড়ে জল বের করল। তারপর শুকনো জায়গায় রেখে ধুপ করে বসে পড়ল কর্নেলের পায়ের কাছে। বংকুবিহারী বললেন, তোমাকে বড্ড চেনা-চেনা ঠেকছে কেন হে?
হরমুজ ঠাণ্ডায় কুঁকড়ে বলল, সার! আমি পাটের দালালি করি। আগাম দাদন দিয়েছি অনেক গাঁয়ে। ফেলাডে পাটের অবস্থা দেখতে বেরিয়েছিলাম। কাজেই দেখে থাকবেন বৈকি আমাকে! কত জায়গায় ঘুরি।
কর্নেল তার পাশে বসলেন। তারপর একটু হেসে বললেন, তালডোঙাটা কি তোমার?
হঠাৎ একথায় হরমুজ হকচকিয়ে গেল। বলল, সার, আমি–
তালডোঙাটা তোমারই। কর্নেল আস্তে কিন্তু শক্ত মুখে বললেন। কাল বিকেলে তুমি এখানে এসেছ। তাই না?
হরমুজ আগের মতো ফুঁপিয়ে উঠল।..সার, আমি– বলেই সে থেমে গেল। কাঁদতে শুরু করল।
কর্নেল বললেন, কান্নাকাটির কারণ নেই। তুমি কাল তালডোঙা চেপে দূরগায় এসেছিলে!
হরমুজ কান্না থামিয়ে বলল, আজ্ঞে সার! সব পাট ডুবে গেছে। বছরকার দাদনের টাকা আটকে গেল। তাই খোঁড়াপিরের দরগায় মানত দিতে এসেছিলাম।
এসে শাওনির পাল্লায় পড়েছিলে! তুমি ওকে চিনতে।
আজ্ঞে সার!
শাওনি তোমকে কী বলেছিল!
চাক্কু লাফিয়ে উঠল হঠাৎ।…দারোগাবাবু! দারোগাবাবু! মিথ্যে বলছে। ওকে চিনতে পেরেছি। ওর নাম কালু! ইসমাইলের সাগরেদ! ওকে সবাই বলে গলাকাটা কালু!
বংকুবিহারী রিভলবার তাক করে বললেন, নড়ো না। নড়লেই মুণ্ড ছ্যাঁদা করে দেব। হুঁ–তাই চেনা-চেনা ঠেকছিল। কালুই বটে!
কর্নেল বললেন, তুমি তাহলে হরমুজ নও, কালু?
কালু. কর্নেলের পা চেপে ধরল।…আমাকে বাঁচান সার! কাল থেকে ভোঙা হারিয়ে গাছে লুকিয়ে ছিলাম। শেষে নিজেই ধরা দিতে এলাম দারোগাবাবুর কাছে। বংকুবিহারী ভেংচি কেটে বললেন, ধরা দিতে এলাম? গাছের ডালে লুকিয়ে থেকে শুওরের বাচ্চা তিন-তিনটে লোকের গলা কেটেছ। তারপর এসেছ ধরা দিতে! নড়ো না। চুপ করে বসে থাকো।
কালু হাউমাউ করে বলল, না সার! আমি কাউকে খুন করিনি। পিরের নামে কিরে করে বলছি, আমি খুন করিনি।
কর্নেল বললেন, একটু চুপ করুন দারোগাবাবু! কালু, কান্না থামাও। আমার কথার জবাব দাও। শাওনি তোমাকে কী বলেছিল?
কালু চোখ মুছে বলল, শাওনি বলল এখানে দারোগাবাবু আছে। তারপর বলল, পালিয়ে যাও। আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাও। তাই শুনে আমি বললাম, ঠিক আছে। আয়! এমন সময় হঠাৎ আপনি এসে পড়লেন। আপনার পরনে ওই ডেরেস। ভাবলাম দারোগাবাবু আসছেন। অমনি শাওনিকে বললাম, আঁধার হোক। আমি ছাতিম গাছে লুকিয়ে থাকছি। তাপরে সার, আঁধার হল। কিন্তু নেমে গিয়ে তালডোঙাটা খুঁজেই পেলাম না। সারারাত্তির বিষ্টির মধ্যে খুঁজে বেড়িয়েছি। পাইনি।
রাত্রে শাওনির সঙ্গে তোমার দেখা হয়নি আর?
আজ্ঞে না। কালু দুহাঁটুর ফাঁকে মুখ গুঁজে বলল। ভোরবেলা ঠিক করলাম সাঁতার কেটে পালাব। কিন্তু অথৈ দরিয়া, সার! ভরসা হল না। তারপর আপনাদের আনাগোনা দেখে ফের একটা ঝাকড়া গাছে চড়ে লুকিয়ে ছিলাম।
কুকুরটাকে খুন করল কে?
পিরের কিরে সার, আমি দেখিনি।
শাওনিকে?
সার এ কালু খামোকা একটা ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করে না!
শাওনি তোমার কথা দারোগাবাবুকে বলে দিতে পারে– এই ভয়ে তুমি ওকে খুন করেছ!
কালু ফের হাউমাউ করে উঠল, আমি ওকে খুন করিনি। খোদার কসম, পিরের কসম! শাওনি আমার কথা বলতে যাবে ক্যানে সার? সেও তো দরগা থেকে পালিয়ে বাঁচতে চায়। বলুন, তাই কিনা?
কেন?
কালু চোখ মুছে বলল, চুল্লুর ভয়ে। চুলুর কথা কে না জানে তল্লাটে?
কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট জ্বেলে বললেন, এখন তুমি ধরা দিতে এলে কেন?
বৃষ্টি। কাল কাতর স্বরে বলল। বৃষ্টি আর সহ্য হল না। তার ওপর কাছেই বাজ পড়ল। এদিকে গায়ে ব্যথা। জ্বর এসেছে মনে হচ্ছে। তার ওপর না-খাওয়া না-দাওয়া! কতক্ষণ পারে মানুষ, আপনি বলুন সার?
তুমি শাওনি, পুঁতি আর হরিপদর খুনি হওয়া টের পেয়েছিলে!
আজ্ঞে। গাছ থেকে দেখেছি আপনারা লাশ নিয়ে আসছেন।
তাহলে ওদের কে খুন করল তাও নিশ্চয় দেখেছ?
বংকুবিহারী গর্জন করলেন, দেখার কী আছে মশাই! আপনি যেন কোন মহাপুরুষের মতো বুলি আওড়াচ্ছেন। ওর নাম গলাকাটা কালু শুনেও কিছু বুঝতে পারছেন না?
কালু কান্নাজড়ানো গলায় বলল, খুন করা আমি দেখিনি। আপনারা একটা করে লাশ বয়ে এনে ও-ঘরে ঢোকাচ্ছেন, ওই টুকুন খালি দেখেছি।
বংকুবিহারীর ধৈর্য চলে গেল। উঠে এলেন রিভলবার উঁচিয়ে। ডাকলেন, চাক্কু, উঠে আয়! আসামিকে পিঠমোড়া করে বাঁধ। হুঁ–ওর লুঙ্গি ছিঁড়ে ফেল। ছেঁড় বলছি হতভাগা!
চাক্কু ভিজে লুঙ্গির সেলাই-বরাবর ফরফর করে ছিঁড়ে ফেলল। লুঙ্গিটা লম্বা করে পাক দিয়ে মোটা রশিতে পরিণত করল। প্রচণ্ড উদ্যমে কালুকে পিঠমোড়া করে বাঁধল। তারপর ভিজে গেঞ্জিটা দিয়ে দুটো পাও বেঁধে ফেলল। কালু বাধা দিল না। বংকুবিহারী ক্লারার তোয়ালেটা তুলে ছুঁড়ে দিলেন।…নিন ম্যাডাম। কেচে নেবেন কিন্তু।
ব্ৰজহরি কাঠ হয়ে দেখছিলেন ব্যাপারটা। ঘনশ্যাম, প্রদোষ এবং ক্লারাও। তারপর শুধু ক্লারা আস্তে বলল, পাশবিক এবং অমানবিক। আমি বিশ্বাস করি না ওই যুবকটি হত্যাকারী।
কর্নেল বললেন, ডাক্তারবাবু, একটা অনুরোধ। দেখুন তো কালুর সত্যি জ্বর কি না?
ব্ৰজহরি কুণ্ঠিতভাবে বললেন, গলাকাটা কালুর নাম আমি শুনেছি। ওকে ছুঁতে ঘেন্না হয়। তবু বলছেন যখন, দেখছি। এথিকস্। ফিজিসিয়ানদের এথিকস্! বলে ব্ৰজহরি উঠে এসে কালুর গলার কাছে হাত রেখে বিকৃত মুখে বললেন, হুঁ, জ্বর। তারপর নিজের জায়গায় গিয়ে বসলেন। ঘনশ্যাম ফোঁস করে শ্বাস। ছাড়লেন। বৃষ্টিটা এবার কমে এসেছে। শুধু মেঘের ডাক থামছে না।…
.
ঘনশ্যামের অন্তর্ধান
নেচার আবার আজ খুব হঠাৎ ফুঁসে উঠছিল। কেন জানেন? প্রাঙ্গণে কবরগুলির আনাচে-কানাচে জমে-ওঠা বৃষ্টির জল এড়িয়ে গিয়ে একটা পাথরের স্ল্যাবে দাঁড়ালেন ব্ৰজহরি এবং ঘনশ্যামের উদ্দেশে কথাটা বললেন।
ঘনশ্যাম নেমে গিয়ে একটা পাথরের কবরে দাঁড়িয়েছিলেন। যেন বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন, মৃতরা জড় পদার্থমাত্র। তিনি এসব মানেন না। বললেন, কেন?
ব্ৰজহরি একটু হাসলেন। খুনীকে ধরিয়ে দেবার জন্য। কী হারে বাজ পড়ছিল, বলুন! বাজের ভয়ে গলাকাটা কালু গাছ থেকে নেমে আসতে বাধ্য হয়েছে কি না? সারেন্ডার করতে হয়েছে কি না তাকে? তারপর দেখুন এখন আবার স্বাভাবিক, মেঘ সরেছে। রোদ্দুর ফুটছে। নেচার ইজ স্মাইলিং!
আস্তানাঘরের পেছনে গাছপালার ফাঁকে বিকেলের ঝলমলে রোদ্দুর পিচকিরির ধারায় উপচে আসছে। তাই দেখিয়ে ব্ৰজহরি ফের বললেন, নেচার ইজ বিশ্বমাতৃকা। মানুষ কিছু বুঝেও বোঝে না। দুরন্ত অবাধ্য শিশু। তাই মা তাকে কিল থাপ্পাড়টা মেরে থাকেন। এবার দেখুন, সব শান্ত হয়ে গেছে।
ঘনশ্যাম বাঁকা মুখে বললেন, কিন্তু রিলিফের নৌকো কোথায়? কটা বাজছে দেখুন তো ডাক্তারবাবু?
ঘড়ি দেখে ব্ৰজহরি বলেন, চারটে পাঁচ। তিন ঘণ্টা আগে– উঁহু, সম্ভবত ঘণ্টা চারেক আগে হেলিকপ্টারটা আমাদের দেখে গেছে। অথচ এখনও বোট পাঠাচ্ছে না কেন? সচরাচর এসব বড় ফ্লাডে আর্মি নামানো হয়। এবার হলটা কী?
ঘনশ্যাম বললেন, আমার ধারণা, ততবেশি নৌকো পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ মহকুমার অসংখ্য গ্রাম ডুবে গেছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ এবং গবাদি পশুর কথা ভাবুন! তাদের চেয়ে আমাদের উদ্ধার ওরা জরুরি মনে করছে না দিস মাচ আই ক্যান এক্সপ্লেন!
ইউ আর রাইট। ব্ৰজহরি সমর্থন করলেন। ওরা খবর ঠিকই পেয়েছে। মিনিস্টারের মুখে। কিন্তু আগে যারা ভেসে যাচ্ছে, তাদের কথাই ভেবেছে। ইউ আর রাইট! বাট উই আর হাংগ্রি!…
বারান্দায় বসে ক্লারা কান করে শুনছিল। চাপাস্বরে প্রদোষকে বলল, আমার ধারণা, প্রদোষ ওই দুজন ভদ্রলোক পরস্পরের মধ্যে ইংলিশ বেশি পরিমাণে বলতে শুরু করেছেন। এটা খুব আশ্চর্যজনক।
কর্নেল শুনতে পেয়ে জার্মান ভাষায় বললেন, স্বাভাবিকতা ফিরে আসছে, ক্লারা!। স্বাভাবিক অবস্থায় এদেশের শিক্ষিতেরা পরস্পর ইংরেজিতে বাক্যলাপে অভ্যস্ত।
প্রদোষ জার্মান জানে না। শিখতে চেষ্টা করেছিল মাত্র। ক্লারা তাকে বুঝিয়ে দিল। তখন প্রদোষ বাংলায় বলল, কর্নেলসায়েব! আমার স্ত্রীকে আপনি উল্টো বোঝাচ্ছেন। বরং এদেশের শিক্ষিত লোক উত্তেজনা বা রাগ হলে ইংরেজি বলে। তার মানে যখন স্বাভাবিকতা থাকে না, তখন।
কর্নেল হাসলেন।…আমি ভেবেছিলাম প্রদোষবাবু বাংলা ভুলে গেছেন।
প্রদোষ এ মন্তব্যে ক্ষুণ্ণ হল। স্মার্ট ভঙ্গিতে বলল, ইংরেজি বলাটা আমার ক্ষেত্রে অভ্যাসের ব্যাপার। দুবছর আমি স্টেটসে ছিলাম।
হতে পারে। বংকুবিহারী মন্তব্য করলেন। তবে কর্নেল যা বলেছেন, ঠিক। আমরা উন্মাদ অবস্থায় ছিলাম। খুনী ধরা পড়ার পর আমরা স্বাভাবিক হতে পেরেছি। বোট এসে গেলে আমরা পুরো স্বাভাবিক হয়ে উঠব। দা সিচুয়েশন ইজ প্লাজুয়্যালি বিকামিং নর্মাল। দা কিলার ইজ অ্যাট আওয়ার হ্যান্ড অ্যান্ড ইউ আর নাও সেইফ। নো চান্স অফ অ্যানাদার মার্ডার! নো ফিয়ার! আইন রক্ষক সগৌরবে রিভলবার দোলাতে দোলাতে অনর্গল যথেষ্ট ইংরেজি বাক্য উচ্চারণ করতে থাকলেন। তার এবং চাক্কুর মাঝখানে বন্দী গলাকাটা কালু কুঁকড়ে বসে আছে। তবে ঠকঠক করে কাঁপছে। দরবেশ এখন ঘরে। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ…
কর্নেল উঠে বর্ষাতিটা খুলে কালুর গায়ে জড়িয়ে দিলেন। বংকুবিহারী চোখ কটমটিয়ে তাকালেন। কিন্তু বাধা দিলেন না। কর্নেল প্রাঙ্গণে নেমে গেলেন। তাঁকে আস্তানাঘরের পেছন দিকে যেতে দেখা গেল।
ব্ৰজহরি তার উদ্দেশে বললেন, নৌকো দেখলে খবর দেবেন কর্নেলসায়েব!
ঘনশ্যাম কান পেতে কী শুনছিলেন। বললেন, কী একটা গুরুগুরু শব্দ শুনছি যেন?
উত্তেজনায় ব্রজহরি চঞ্চল হয়ে বললেন, কই? কই? আমি তো শুনতে পাচ্ছি না! মাই ইয়ার্স আর শার্প।
হু, গুরগুর শব্দ। বলে ঘনশ্যাম পূর্বদিকে যেদিকে ভাঙা দেউড়ি, পা বাড়ালেন। ব্ৰজহরি বললেন, যান, যান! দেখে আসুন! গো অ্যান্ড সি!
বংকুবিহারী আপন খেয়ালে ইংরেজিতে কথা বলছেন, লক্ষ্য একান্তভাবে মেমসায়েব ক্লারা। খুনী এবং চোর-ডাকাত ধরার যতরকম মারাত্মক অভিজ্ঞতা শোনাচ্ছেন। ঘনশ্যামের চলে যাওয়ার দিকে দৃষ্টি নেই। ব্ৰজহরি ডেকে তাকে বললেন, দারোগাবাবু! কোনও গুরগুর ভয়েজ শুনতে পাচ্ছেন কি? ওই শুনুন! ব্ৰজহরি লাফিয়ে উঠলেন। ইয়েস! দে আর কামিং! হিয়ার, হিয়ার!
ক্লারা ও প্রদোষ উঠে প্রাঙ্গণে এল। ক্লারা কান করে বলল, হ্যাঁ তারা আসছেন! আসছেন!
বংকুবিহারীও শুনতে পেলেন। কিন্তু উত্তেজিত হলেন না। মাথা ঠাণ্ডা রেখে বললেন, ডাক্তারবাবু! আপনারা যান! গো অ্যান্ড টেল দেম আই অ্যাম হিয়ার– উইথ থ্রি ডেডবডিজ অ্যান্ড দেয়ার কিলার। গো গো টেল দেম!
ব্ৰজহরি বললেন, ঘনশ্যামবাবু হ্যাঁজ অলরেডি গন! আই অ্যাম টায়ার্ড অ্যান্ড হাংগ্রি।
হোয়াট? বংকুবিহারী নড়ে উঠলেন। পরমুহূর্তে ফ্যাচ করে হাসলেন। …যাক না। একা তো ওকে নিয়ে যাবে না। এতগুলো লোক দেখেছেন মিনিস্টার আকাশ থেকে। হি হ্যাঁজ সিন আস। অ্যান্ড অলসো কিল আ ম্যান ইন দা পোলিস ইউনিফর্ম! ডাক্তারবাবু, অলসো টেল দেম অ্যাবাউট এ পলিটিক্যাল প্রিজনার।
ক্লারা প্রদোষকে টানতে টানতে নিয়ে গেল দক্ষিণে। শব্দটা সেদিক থেকেই শোনা যাচ্ছিল। শব্দটা বাড়ছিল। ব্ৰজহরি দাঁড়িয়েই রইলেন। তখন বংকুবিহারী হেঁড়ে গলায় চেঁচালেন, ম্যাডাম ক্লারা! টেল দেম, উই হ্যাড টু ডেঞ্জারাস প্রিজনার্স হেয়ার, অ্যান্ড থ্রি ডেডবডিজ– থ্রি! থ্রি-ই-ই-ই!
ব্ৰজহরি বারান্দায় গিয়ে তার ডাক্তারি ব্যাগ এবং বর্ষাতিটা ঊরুর ওপর রেখে বসে রইলেন। প্রচণ্ড উত্তেজনার পর প্রচণ্ড ক্লান্তি তাঁকে পেয়ে বসেছে। মাঝে মাঝে উঃ ওঃ শব্দ করতে থাকলেন।…
প্রদোষ বটগাছটার দিকে তাকিয়ে চমকানো স্বরে বলল, হরিবল্! ভালচার্স!
ক্লারা তার কাছ থেকে বাইনোকুলারটা নিল! চোখে রেখে বলল, একটা সামরিক মোটরচালিত ক্ষুদ্র নৌকা একটি বৃহৎ নৌকাকে টেনে আনছে। সামরিক এবং অসামরিক কয়েকজন লোক আছেন।
প্রদোষ তার হাত থেকে বাইনোকুলার নিল। চোখে রেখে দেখতে দেখতে বলল, হোয়াট ডু য়ু থিংক বেবি? আই অ্যাম ড্যাম সিওর দ্যাট মাই আঙ্ক হ্যাঁজ সেন্ট দেম! ইউ নো, মাই ড্যাডি হ্যাড অলরেডি গিভ হিম আ ট্রাঙ্ককল মেসেজ দ্যাট উই হ্যাড স্টার্টেড ফ্রম ক্যালকাটা। দা ট্রাংককল ডিড দা ম্যাজিক, ইউ নো!
তুমি একটা ক্লারা হেসে উঠল। সে ফাঁকা জায়গায় একটা উঁচু চাঙড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাত নাড়তে থাকল। সে যেন নাচতে সুরু করেছে।
প্রদোষ তার কাণ্ড দেখে হেসে ফেলল। বলল, তুমি একটা–
মিলিটারি স্পিডবোটের শব্দ ঢিবির পূর্বদিকে এসে থেমে গেল। বংকুবিহারী উঠে দাঁড়িয়ে ইউনিফর্ম ঠিকঠাক করতে ব্যস্ত হলেন। কিন্তু রিভলবারটি হাতে। কারণ এ একটা চরম মুহূর্ত। বললেন, চাক্কু! ওকে ধরে থাক। আমি রিসিভ করব ওঁদের।
চাক্কু বলল, যাবে কোথায় শালা? ঘেঁটি ধরে আছি। আপনি যেখানে যাবেন, যান না সার!
বংকুবিহারী প্রাঙ্গণে নেমে বললেন, যাব কোথায়? এখানেই ওয়েট করব। বলে রিভলবারটা সরকারি শালীনতাবশে কোষবদ্ধ করে অ্যাটেনশন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলেন।
চাক্কু চাপা গলায় গলাকাটা কালুকে বলল, এই শালা! আমার ড্যাগারখানা কোথায়?
কালু হিপিয়ে উঠল।..বিশ্বেস কর– খোদার কসম, পিরবাবারর কসম। আমি খুন করিনি!
চাক্কু ওর পাঁজরে গুঁতো মারল।…বল্ শালা, কোথায় আমার ড্যাগার?
কালু আবার ককিয়ে বলল, বিশ্বেস কর—
ব্ৰজহরি বিরক্ত হয়ে বললেন, অ্যাই চাক্কু! হচ্ছেটা কী? পুলিশের কাজ পুলিশ করবে।
এই শালা পুঁতিকে কেটেছে! চাক্কু ফুঁসে উঠল। এমন অবস্থা না হলে একে আমি এতক্ষণ গলা কেটে পুঁতে ফেলতাম। আমার নাম চাক্কু! আম্মো কম যাই নে। বল্ কালু, আমার ড্যাগার কোথায়? এখনও বল্ বলছি!…
কর্নেল স্পিডবোট এবং নৌকোটি বাইনোকুলারে দেখছিলেন। বাঁদিকে গাছপালার আড়ালে তা অদৃশ্য হলে ঘুরে পা বাড়ালেন। আস্তানাঘরের পেছনে অনেকটা জায়গা জুড়ে ধ্বংসাবশেষ, ঝোপঝাড় এবং উঁচু গাছপালা। একসময়ে পেছন দিকটাতেও কয়েকখানা ঘর ছিল বোঝা যায়। এদিকটা ঢিবির পশ্চিম অংশ। ঝলমলে বিকেলের সূর্য প্রচুর রোদ্দুর ছড়াচ্ছে। বন্যার জল বাড়বে ভেবেছিলেন, বাড়েনি। বরং এতক্ষণ বৃষ্টিসত্ত্বেও অন্তত একমিটার, নেমে গেছে।
পা বাড়াতে গিয়ে পূর্বমুখী হয়েছেন, ডানদিকের গাছে ঝটপট শব্দে কী একটা বসল। দেখলেন, একটা শকুন। ঘুরে সেদিকে মুখ করে দাঁড়ালেন। আবার একটা শকুন এসে বসল। পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যে গাছটা শকুনে ভরে গেল। তারপর গাছটার নিচের দিকে তাকাতেই চোখে ছটা লাগল কিসের। চোখ ধাঁধানো ছটা। কাচের টুকরো কি? রোদ্দুরে কী একটা ঝকঝক করছে ইটের চাঙড়ের নিচে। চাঙড়টার আধখানা জলে ডুবে গিয়েছিল। এখন জল নেমে গেছে। জিনিসটার কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন। ছ-সাত ইঞ্চি লম্বা ফলা– একটা ছুরি। স্প্রিংয়ের ছুরি!
দ্রুত কুড়িয়ে নিয়ে স্পিংয়ে চাপ দিলেন। ফলাটা বাঁটে ঢুকে গেল। রক্তের চিহ্ন থাকা সম্ভব নয়। বন্যার জলে ধুয়ে গেছে। গলাকাটা কালু ছুরিটা এখানেই ছুঁড়ে ফেলেছিল তাহলে? ছুঁড়ে ফেলেছিল, কারণ তার আর কাউকে হত্যার প্রয়োজন ছিল না। কুকুরটা তাকে বিরক্ত করছিল। তাই কুকুরটাকে সে জবাই করেছিল, শাওনি তাকে চিনতে পেরেছিল। হয়তো অভ্যাসবশে শাওনি তাকে দারোগাবাবুর হাতে ধরিয়ে দেবে বলে ব্ল্যাকমেল করেছিল, কিংবা না করলেও সে ভেবেছিল, শাওনির তাকে ধরিয়ে দেবার সম্ভাবনা আছে। তাই শাওনিকে সে জবাই করেছিল। কিন্তু পুঁতি? পুঁতির সামনে সে দৈবাৎ পড়ে গিয়েছিল, অথবা যেভাবেই হোক পুঁতি তাকে চিনতে পেরেছিল। তাই সে ঝুঁকি নেয়নি। পুঁতিকেও আচমকা একা পেয়ে জবাই করেছে। হরিপদ? হরিপদও কি তাকে চিনতে পেরেছিল? — তাছাড়া আর কী কারণ থাকতে পারে? হরিপদর গানগুলোতে কী যেন আভাস ছিল। নিশ্চয় ছিল। কিন্তু হরিপদ পুঁতির মতোই ভয়ে অথবা ঝুটঝামেলা এড়ানোর জন্য কথাটা খুলে দারোগাবাবু কিংবা অন্য কাউকে বলেনি। এদিকে হরিপদ একটা দারুণ ঝুঁকি খুনীর কাছে। কারণ দু-দুটো খুন কে করেছে, হরিপদ নিশ্চয় টের পেয়েছে। তাই পুঁতির মতো আচমকা পেছন থেকে ধরে ফেলে হরিপদকেও জবাই করেছে। হরিপদর গানই হয়তো তার নিজের মৃত্যুর কারণ! হুঁ, খুব সরল অথচ অভ্যস্ত পদ্ধতিতে হত্যা। আচমকা পেছন থেকে একটা হাত বাড়িয়ে চিবুক খামচে ধরে মাটিতে শুইয়ে একলাফে বুকে বসে গলায় জোরালো একটা প্যাঁচ। চাক্কুর ছুরিটা বিদেশী ক্ষুরের মতো ধারালো। গতরাতে অন্ধকারে হত্যাকারী বারান্দায় ভিড়ে মিশে গিয়েছিল। চাক্কুর ছুরিটা তখনই চুরি করে থাকবে সে। তবে এও ঠিক, সে জানত চাক্কুর ব্যাগে একটা ছুরি আছে। নিশ্চয় সে দেখেছিল ছুরিটা ঝোপের আড়াল থেকে। চাক্কু বলেছে, তার একটা ড্যাগার ছিল। কিন্তু তার আগে কি চাক্কু কোনো কারণে ড্যাগারটা বের করেছিল? নিশ্চয় করেছিল।
আবার ঝুপঝাঁপ শব্দে শকুন এসে বসছে। ব্ৰজহরি কর্নেলের উত্তেজিতভাবে ডাকছিলেন। কর্নেল ঢাল বেয়ে দ্রুত আস্তানা ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন। আবার কিছু ঘটল কি?
কিন্তু গিয়ে দেখলেন, জনাতিনেক সৈনিক এবং জনাচার স্বেচ্ছাসেবী যুবক তিনটি মৃতদেহ প্রাঙ্গণে নামিয়েছে। বংকুবিহারী গলা টা কালুর পায়ের বাঁধন খুলে তার ঘাড় ধরে নামিয়ে আনলেন। বললেন, বডি ওঠান আপনারা। নৌকোয় নিয়ে যান একে-একে।
স্বেচ্ছাসেবীদের বুকে ব্যাজ। লেখা আছে : তরুণ সংঘ, কাঁদরা। ব্ৰজহরিকে একজন বলল, আপনিও যে এখানে আটকে আছেন, জানতাম না ডাক্তারবাবু! আমরা ভেবেছিলাম–
বংকুবিহারী তাড়া দিলেন, মেক্ হেস্ট ভলান্টিয়ার্স! পরে সব কথা হবে।
স্বেচ্ছাসেবীদের একজন পুঁতির মুখের কাপড় তুলেই ঢেকে দিল। আঁতকে ওটা স্বরে বলল, বাপস্!
মেক হেস্ট! মেক হে প্লিজ! বংকুবিহারী ফের তাড়া দিলেন।
চারজন স্বচ্ছাসেবী পুঁতির মড়াটা ওঠাল– দুজন বুকের কাছে ধরল, দুজন পা দুটো ধরল। চাক্কু ডুকরে কেঁদে কোমরের তলাটা ধরল।
পুঁতিকে নিয়ে গেলে সৈনিক তিনজন পরস্পরের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। তারপর একজন মাথার দিকে, একজন কোমরের তলা, তৃতীয়জন পায়ের দিকটা ধরে অনায়াসভঙ্গিতে নিয়ে গেল একটা মৃতদেহ। বংকুবিহারী তারিফ করে বললেন, কেমন ট্রেন্ড হ্যান্ড দেখছেন কর্নেল? সরি, ইউ আর অলসো এ মিলিটারিম্যান!
কর্নেল একুটু হাসলেন।…ছিলাম!
বংকুবিহারী কান করলেন না। তৃতীয় লাশটির দিকে তাকিয়ে বললেন, ডাক্তারবাবু! দেখুন তো এটা কে?
ব্ৰজহরি পা বাড়িয়ে বললেন, আপনি দেখুন। আমি আর ওতে নেই!
হন্তদন্ত চলে গেলেন ডাক্তার ব্ৰজহরি কুণ্ডু। বংকুবিহারী গুম হয়ে বললেন, নেই বললে চলবে না। এক নম্বর উইটনেস ডোন্ট ফরগেট দ্যাট!
কর্নেল কাপড় একটু তুলে দেখে বললেন, হরিপদ। তারপর ঢেকে দিলেন।
বংকুবিহারী বললেন, মেমসায়েবকে তো এম এল এর ভাগ্নে টানতে টানতে নিয়ে গেল। যাক্ গে, হরিপদকে নিয়ে গেলে আমাদের ছুটি! এই ভয়ঙ্কর জায়গা ছেড়ে যেতে পারলে বাঁচি!
কর্নেল বললেন, ঘনশ্যামবাবু নৌকোয় গিয়ে বসেছেন বুঝি?
নড়ে উঠলেন আইনরক্ষক।…মাই গুডনেস! তা তো জানি না। দেখেছ কাণ্ড? বলে পূবদিকে কড়া চোখে তাকালেন। সেইসময় স্বেচ্ছাসেবীরা দরগার কাছে এসে পৌঁছুলে গলা চড়িয়ে বললেন, নৌকোয় লম্বা নাক, রোগামতো এক ভদ্রলোক আছেন দেখলেন? ধুতি-পাঞ্জাবি পরা– আই মিন, পলিটিকাল লিডার ঘনশ্যাম রুদ্র! একজন স্বেচ্ছাসেবী বলল, ঘনশ্যাম রুদ্র? বলেন কী দারোগাবাবু? তিনি তো শুনেছি আন্ডার গ্রাউন্ডে আছেন। মলোচ্ছাই! বংকুবিহরী খাপ্পা হয়ে বললেন। নৌকোয় তাকে দেখলেন কি না জিগ্যেস করছি! অপর একজন স্বেচ্ছাসেবী বলল, তাকে আমরা দেখিনি। তবে নাম শুনেছি। সে না কি সাংঘাতিক লোক।
অপর একজন স্বেচ্ছাসেবী বলল, ধুস! যত গর্জায়, তত বর্ষায় না। কত লিডার দেখলাম লাইফে। আয়, হাত লাগা!
চতুর্থ স্বেচ্ছাসেবী হাসলেন। …ওয়েট! জওয়ানরা আসুক। ওদের ডেকে এসেছি। কী হেভি ডেডবডি মাইরি!-আড়াইমণ ওজন যেন।
বংকুবিহারী বললেন, কর্নেল! ওরা বডি আনুক। আসুন, আমরা নৌকোয় গিয়ে দেখি দু নম্বর অসামি আছে না কি! এরা মনে হচ্ছে, খেয়াল করে দেখেনি। চলে আসুন!
কর্নেল বললেন, আপনি চলুন দারোগাবাবু! আমি যাচ্ছি।
ইউ আর স্টিল ম্যাড। বলে ক্রুদ্ধ আইনরক্ষক গলাকাটা কালুকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে চললেন। সৈনিকদের আসতে দেখা গেল ভাঙা দেউড়ির ওখানে। তারা এগিয়ে এলে স্বেচ্ছাসেবী চার যুবক এক গলায় বলে উঠল, কাম অন ব্রাদার্স! কাম অন! সৈনিকরা হাসল। একজন বলল, মুর্দা হোনে সে আদমি বহৎ হেভি হো যাতা!
অন্য একজন কর্নেলের দিকে তাকিয়ে বলল, উও ডাগদারবাবু কর্নিলসাবকা বাত বোলা। আপ কোন হ্যায়? আপকো তো কর্নিল-ঊর্মিল নেহি মালুম হোতা। কঁহা হ্যায় উও কর্নিলসাব?
কর্নেল জ্যাকেটের ভেতর হাত ভরে তাঁর আইডেন্টিটি কার্ড বের করে তার সামনে ধরলেন। সঙ্গে সঙ্গে সে এবং তার দুই সঙ্গী খটাখট শব্দ তুলে স্প্রিংয়ের পুতুলের মতো স্যালুট দিল। স্বেচ্ছাসেবী যুবকরা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। কর্নেল বললেন, আপলোগোঁকা মদত্ চাক্তা হোড়া।
ইয়েস স্যার! হমলোগ রেডি। একজন সৈনিক বলল। বোলিয়ে, ক্যা করনে পড়ে গা?
কর্নেল স্বেচ্ছাসেবীদের দিকে ঘুরে বললেন, আপনারা নৌকো বয়ে নিয়ে যেতে পারবেন না?
একজন স্বেচ্ছাসেবী দ্বিধাগ্রস্ত ভঙ্গিতে বলল, পারব হয়তো তবে জলে টান ধরেছে। বড্ড স্রোত।
কর্নেল একটু ভেবে বললেন, ঠিক আছে। সোলজার্স! আপলোগ সবকো পঁহুছা, দে কর তুরন্ত চলা আইয়ে। ইন্তেজার করুঙ্গা ময়! কিতনা টাইম লাগে গা?
একজন সৈনিক বলল, আধা ঘণ্টা, স্যার! বহৎ কারেন্ট হ্যায়! নেহি তো জলদি আ যাতা।
দ্বিতীয় সৈনিক বলল, আভি যানেকা টাইম উও নাওকে নিয়ে জাস্তি টাইম লাগেগা। স্পিডবোট হ্যায়, স্যার! একেলা আনেসে দশ মিনিট–ব্যস!
ঠিক হ্যায়! কর্নেল গলা চড়িয়ে বললেন। ওর শুনিয়ে যাকে দারোগাবাবু কো বোলিয়ে, উনকা পলিটিকাল প্রিজনারকো পড়নে চাহতা তো আপকা সাথ ফিরভি আনা পড়ে গা। উনকো সমঝ দিজিয়ে ইয়ে বাত।
পলিটিক্যাল প্রিজনার! সৈনিকেরা পরস্পরের দিকে তাকাল।
কর্নেল বললেন, হাঁ বহৎ খতরনাক আদমি! ঘনশ্যাম রুদ্র!
একজন সৈনিক বলল, তো কুছ আর্মস ভি ক্যাম্পসে লানা পড়ে গা, স্যার?
নেহি। আর্মসকা কৈ জরুরত নেহি! জলদি কিজিয়ে।
সৈনিকরা আবার কর্নেলকে স্যালুট ঠুকে মৃতদেহে হাত লাগাল। স্বেচ্ছাসেবীরাও হাত লাগানোর ভঙ্গি করল। হরিপদর মৃতদেহ নিয়ে চলে গেল ওরা। তারপর নির্জন হয়ে উঠলে খোঁড়া পিরের দরগা। বিকেলের রোদ্দুর ক্রমে লালচে হয়ে উঠেছে। কর্নেল বাইনোকুলারে চোখ রেখে চারদিকে ঘুরে-ঘুরে গাছপালাগুলো দেখতে থাকলেন। কী একটা পাখি ডাকছে, যার ডাক সব পাখির ডাকের ভেতর আলাদা– শ্রুতিপারের ধ্বনি যেন ওই ডাকে। কী পাখি ওটা? শেষবেলায় পাখিরা তুমুল হল্লা করছে গাছে-গাছে। খুঁজে বের করা কঠিন বটে।
কর্নেল উত্তর-পূর্ব কোণের ছাতিম গাছটার দিকে এগিয়ে গেলেন। ওখানে হরিপদ খুন হয়েছিল। গিয়েই চমকে উঠলেন। একবুক জলে দাঁড়িয়ে ঘনশ্যাম রুদ্র কী একটা টানাটানি করছেন।
কর্নেল হেসে ফেললেন। ঘনশ্যামবাবু!
ঘনশ্যাম হকচকিয়ে ঘুরে কর্নেলকে দেখতে পেলেন এবং করুণ হেসে বললেন, ডোঙাটা
হ্যাঁ, ডোঙাটা। কর্নেল বললেন। আপনি কী ভাবে টের পেলেন?
ঘনশ্যাম বললেন, জল কমে গেছে তো! কালো রেখার মতো দেখা যাচ্ছিল। একটা ডাল ভেঙে হাঁটুজলে নেমে গিয়ে ডালটা দিয়ে পরখ করে বুঝলাম, তালডোঙাটাই বটে। কিন্তু হিতে বিপরীত হল। উল্টেট গেল তো গেল। কিছুতেই চিত করাতে পারছি না! পারলে তো এতক্ষণ কেটে পড়তাম। বৈঠারও দরকার হত না। হাতদুটোই যথেষ্ট ছিল।
আপনি ওটা ডুবিয়েই রাখুন। উঠে আসুন! দারোগাবাবু চলে গেছেন আসামী নিয়ে।
ঘনশ্যাম দুঃখিতমুখে বললেন, কিন্তু আমি যে আটকে গেছি। প্রচণ্ড ক্ষিদেও পেয়েছে। উঠে আসুন।
দেরি করবেন না। শিগগির!
ঘনশ্যাম আন্ডারপ্যান্ট পরে জলে নেমেছিলেন। বিমর্ষভাবে উঠে এলেন। ঝোপের ভেতর লুকোনো ব্যাগে ধুতি-জামা-গেঞ্জি ছিল। একটা গামছাও। কর্নেলের তাড়ায় ঝটপট গা মুছে ধুতি-গেঞ্জি-পাঞ্জাবি পরে নিলেন আগের মতো। স্যান্ডেল গতকাল খুইয়েছেন বন্যার জলে। খালি পা। ফিসফিস করে বললেন, তা আপনি একা রয়ে গেলেন যে? এক নৌকোয় জায়গা হল না বুঝি?
কর্নেল একটু হেসে বললেন, আপনাকে ফেলে যাই কী করে? চুল্লুর পাল্লায় পড়ে
ওসব আমি বিশ্বাস করি না! অশরীরী আত্মা-টাত্মা স্রেফ বাজে কথা। ঘনশ্যাম ফুঁসে উঠলেন।…তার চেয়ে বলুন, আমাকে ধরিয়ে দেবার জন্য আপনি থেকে গেছেন। আমি তো বুঝতেই পেরেছি, আপনি একজন গোয়েন্দা।
কর্নেল আস্তে বললেন, আপনি জোর বেঁচে গেছেন ঘনশ্যামবাবু! চুল্লু এতক্ষণ আপনার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আপনাকে ডুবিয়ে মারত। না– গলা কাটত না। কারণ চাক্কর ড্যাগারটা এখন আমার হাতে। এই দেখুন!
স্প্রিংয়ের ছুরটা দেখেই আঁতকে উঠলেন ঘনশ্যাম।…সর্বনাশ! কোথায় পেলেন?
দেখাচ্ছি। আসুন আমার সঙ্গে। চাপা স্বরে কথাটা বলে কর্নেল ঘনশ্যামকে অবাক করে তার পাঞ্জাবিটা গলার কাছে খামচে ধরে টানলেন। প্রাঙ্গণের কবরখানায় পৈৗছে দেখা গেল, অন্ধ দরবেশ পিরের দরগার সামনে ভিজে চত্বরে দাঁড়িয়ে বিকেলের নমাজ পড়ছেন। কর্নেল জোরে হাঁটছিলেন। ঘনশ্যামকে, বিব্রত ও ভীত দেখাচ্ছিল। আস্তানাঘরের পেছনে গিয়ে দেখা গেল, একদঙ্গল শকুন জলের ধারে দাঁড়িয়ে আছে। দেখেই কর্নেল ফিসফিস করে বললেন, কিছু। বুঝতে পারছেন ঘনশ্যামবাবু?
ঘনশ্যাম রাগী মুখে বললেন, না তো। কিছু বুঝতে পারছি না। কেনই বা আমাকে আপনি এমন করে টানাটানি করছেন?
কর্নেল তেমনি ফিসফিস করে বললেন, ওখানে একটি লাশ পোঁতা আছে। শকুনগুলো গন্ধ পেয়েছে। কিন্তু জল নামতে দেরি আছে। আসুন। আস্তানাঘরে যাই।
কর্নেল ঘনশ্যামের জামা ছেড়ে হাত ধরে টেনে আনার ভঙ্গিতে হন্তদন্ত ঢাল বেয়ে উঠে এলেন। অন্ধ দরবেশ দরগার কাছে দাঁড়িয়ে এবার বুকে চিমটে ঠুকছেন। কর্নেল হঠাৎ গলা চড়িয়ে বলেন, ঘনশ্যামবাবু! আপনাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পালানোর চেষ্টা করবেন না। চুপ করে বারান্দায় বসুন। যা বসুন বলছি।
ঘনশ্যাম সত্যিকার রাগে পাল্টটা গলা চড়িয়ে বললেন, যান, যান! আমাকে জাঁক দেখাবেন না! কী সব উদ্ভুট্টে কাজকারবার! তক্ষুণি ভদ্রলোকের মতো কথাবার্তা, আবার তক্ষুণি অপমানজনক ব্যবহার! অদ্ভুত লোক তো মশাই আপনি!
বলে টপাস করে বারান্দায় পা ঝুলিয়ে বসলেন। কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, আপনি বলছিলেন আমি পুলিশের গোয়েন্দা। কাজেই ঘনশ্যামবাবু, আমার চোখকে ফাঁকি দেওয়ার সাধ্য আপনার নেই। পালাবেন ভেবেছিলেন, তাই না?
ঘনশ্যাম আর কোনো কথা বললেন না। আঙুল খুঁটতে থাকলেন মুখ নামিয়ে। দরবেশের প্রার্থনা শেষ। চিমটে বাড়িয়ে মাটিতে ঠুকতে ঠুকতে এগিয়ে আসছিলেন। বারান্দায় উঠে হাঁক ছাড়লেন, চুল্লু! তারপর তালা খুলতে দরবেশ যখন দরজা খুলে ঘরে ঢুকতে যাচ্ছেন, তখন কর্নেল বললেন, দরবেশ সায়েব! আপনার ওপর আর আমরা জুলুম করব না। এখনই বোট এসে যাবে। এই আসামীকে নিয়ে আমরা চলে যাব। তবে দয়া করে যদি একটু চা খাওয়ান, ভাল হয়। দশটা টাকাই না হয় নেবেন।
দরবেশ আস্তে বললেন, দুধ নাই বাবাসকল মা সকল! খালি চা আর একটুখানি চিনি আছে।
কর্নেল উঠে গিয়ে পায়ের কাছে একটা দশ টাকার নোট রাখলেন। বললেন, টাকাটা নিন!!
অন্ধ দরবেশ টাকাটা চিমটে দিয়ে ঠিকই খুঁজে পেলেন এবং চিমটেতে আটকে তুলে নিলেন। তারপর ঘরে ঢুকে তক্তপোশের তলা থেক কেরোসিন কুকার বের করে বললেন, নিন বাবাসকল, মা সকল! জালায় পানি আছে। বারান্দার তাকে কেটলি আছে। ভাড় আছে। চা-চিনি দিচ্ছি।
কর্নেল কেরোসিন কুকার ধরানোর সময় স্পিডবোটের শব্দ শুনতে পেলেন। দরবেশ কাগজের পুরিয়ায় চা ও চিনি নিয়ে ডাকলেন, বাবা সকল, মা সকল! চা-চিনি!
চা-চিনি পুরিয়া নিয়ে কর্নেল বললেন, আপনিও খাবেন তো দরবেশসায়েব?
আপনাদের ইচ্ছা বাবাসকল, মা সকল!
তাহলে বসে পড়ুন এখানে। কই, আপনার আসন নিয়ে আসুন!
দরবেশ ঘর থেকে জীর্ণ গালিচাটি বের করে বিছিয়ে বসলেন। বুকে চিমটে ঠুকে বিড়বিড় করে বলতে থাকলেন, চুল্ল! চুল্ল চুল্লু! মোটরবোটের আওয়াজ বাড়ছিল ক্রমশ বাড়তে বাড়তে একসময় থেমে গেল আওয়াজটা। কর্নেল জালা থেকে জলতুলে কেটলি ভরছিলেন। হঠাৎ ঘুরে দেখলেন, বারান্দায় ঘনশ্যাম নেই। প্রাঙ্গণের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে এক পলকের জন্য তাঁকে ধ্বংসস্কৃপের ফাঁকে দেখা গেল। কর্নেলের ঠোঁটের কোনায় হাসি ফুটে উঠল। কিন্তু কিছু বললেন না। কেটলি চাপিয়ে দিলেন কেরোসিন কুকুারে।…
.
চুল্লু! চুল্লু!
সৈনিকেরা ফিরে এসেছে। একজন সশস্ত্র। কাদরা থানার ওসি বংকুবিহারী ধাড়া আসেননি। পাঠিয়েছেন থানার সেকেন্ড অফিসার ধরণীধর সমাদ্দারকে। ইনি ঢ্যাঙা, ফো, টানটান গড়নের মধ্যবয়সী মানুষ। সঙ্গে দুজন তাগড়াই কনস্টেবল, হাতে মাস্কেট। সৈনিকদের স্যালুট ঠোকা দেখে তারাও জৰ্বর স্যালুট ঠুকল। ধরণীধরকে।
বড়বাবু বংকুবিহারী ততকিছু বলেননি। তাই নেহাতই নমস্কার করে ফেলেছিলেন। কর্নেলকে। সৈনিকদের এবং কনস্টেবলদ্বয়ের স্যালুট ঠোকা তাঁকে বিব্রত করায় তিনিও একখানা স্যালুট ঠুকে বসলেন। কর্নেল মিটিমিটি হেসে পাল্টটা স্যালুট ঠুকে বললেন, আপনারা বসুন আগে। একটু চা খান। বৈঠ যাইয়ে সব।
ধরণীধর বললেন, কর্নেলসায়েব! কিছু যদি মনে করেন, একটা কথা বলি?
হবে। কথা হবে। একটু বসুন। কর্নেল হাসলেন। র চায়ে আপত্তি নেই আশা করি। সোলজার্স?
সশস্ত্র সৈনিকটি মুচকি হেসে বলল, জরুর পিয়েঙ্গে, স্যার! হমলোগ বহৎ টায়ার্ড! চায় পিনে কা মওকা মিলা নেহি অভিত।
ছোট্ট মাটির ভাঁড়ে একটুখানি করে চিনি মেশানো লিকার ঢেলে বিলি করলেন কর্নেল। দরবেশকে পুরো ভাঁড়ই দিলেন। দরবেশ চিমটে ঠোকা বন্ধ। করে ভাড় নিয়ে সশব্দে চুমুক দিয়ে হাঁকলেন, চুল্লু!
ধরণীধর একটু অবাক হয়ে বললেন, কী ব্যাপার?
কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, চুল্লু এ দরগার পাহারাদার– অশরীরী আত্মা! সেই তো গলাকাটা কালুকে ভর করেছিল। তাই তিন-তিনটে মানুষের প্রাণ গেছে, বুঝলেন তো?
শুনে ধরণীধর হাসলেন।…কালুর নামটাই গলাকাটা। এর আগে সে অনেকের গলা কেটেছে। ইদানিং সে ইসমাইল ডাকুর দলে ভিড়েছে বলে খবর ছিল আমাদের হাতে। যাই হোক, এতদিনে তাকে বড়বাবু হাতেনাতে ধরেছেন। প্রমোশন হয়ে যাবে বড়বাবুর।
সৈনিক আর কনস্টেবলরা বারান্দার নিচে দাঁড়িয়ে দু চুমুকেই চা শেষ করেছে। ভাড়গুলো ছুঁড়ে ফেলায় কিছু আওয়াজ হল। দরগার বনভূমির তলায় আবছায়া, মাথায় ফিকে গোলাপী রোদ্দুর। পাখিদের হট্টগোল তুমুল বেড়েছে। কর্নেল চটুকু শেষ করে বললেন, হ্যাঁ- কালু বা হরমুজ আলি এর আগেও গলা কেটেছে শুনেছি। কিন্তু এভাবে তিন-তিনটে মানুষ এবং একটা কুকুরের গলা চব্বিশঘণ্টার মধ্যে কখনও কি সে কেটেছে?
ধরণীধর স্বীকার করলেন, না– তা কাটেনি।
তাহলে? কর্নেল গলার ভেতর বললেন, চুল্ল! চুল্লু তাকে ভর করেছিল। দরবেশসায়েব কী বলেন?
দরবেশও ভরাটগলায় বললেন, চুল্লু!
ধরণীধর কালো আলখেল্লা ও কালো পাগড়িপরা দরবেশকে দেখতে দেখতে বললেন, এই দরবেশসায়েবের কথা শুনেছি। ইনি এক সাধক পুরুষ, তাও শুনেছি। তা উনি নাকি কথা বলেন না কারুর সঙ্গে?
কর্নেল বললেন, একেবারে বলেন না, তা নয়। তবে খুব দরকার হলে বলেন। উনি খুব জ্ঞানী মানুষ। গতকাল ওঁর সঙ্গে শাস্ত্র আলোচনা করতে গিয়েই বুঝেছিলাম, উনি যা কিছু বলেন, সবই সিম্বলিক। যেমন, ওই চুল্ল! চুল্লু হলো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এভিলের মানে, সবকিছু মন্দের উৎস। তার মানে, যা কিছু মন্দ জিনিস, চুল্লু থেকেই বেরিয়ে আসছে।
ধরণীধর একটু ব্যস্ততা দেখিয়ে বললেন, প্লিজ কর্নেলসায়েব! ঘনশ্যাম রুদ্র
হুঁ, বেলা পড়ে এসেছে। এবার অপারেশন শুরু করা দরকার। কর্নেল উঠে প্রাঙ্গণে এসে দাঁড়ালেন। চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, ফের, ঘনশ্যামবাবুর পক্ষে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। চারদিকের বিশাল মাঠের মাঝখানে এই উঁচু ঢিবি। কাজেই উনি এখানেই লুকিয়ে আছেন– থাকতে বাধ্য। বাই দা বাই, বন্যার জলের গভীরতা কতটা বলতে পারেন?
ধরণীধর বলার আগে একজন সৈনিক বলে দিল, কমসে কম বিশ ফুট হোগা, স্যার!
ধরণীধর সায় দিলেন। তা হবে। হোল এরিয়া একেবারে ফ্ল্যাট ল্যান্ড সমতলই বটে। কাজেই সর্বত্র জলের ডেস্থ একইরকম।
কর্নেল বললেন, আপনারা টর্চ এনেছেন। কাজেই অসুবিধা নেই। তবে একটা কথা। দল বেঁধে খুঁজতে হবে। কারণ, একা-একা কম্বিং অপারেশন চালানো বিপজ্জনক।
ধরণীধর একটু বিরক্ত হয়ে বললনে, তাতে কি লাভ হবে? আমরা চক্কর দেবে, ঘনশ্যামবাবুও চক্কর দিতে থাকবেন। তার চাইতে তিন দলে ভাগ হয়ে তিনদিক থেকে–
বাধা দিয়ে কর্নেল বললেন, না, না! সাবধান, সাবধান! চুল্লু সত্যি ভয়ঙ্কর। সে যে-কোনও মুহূর্তে হামলা করবে। আসুন, আমরা প্রথমে ঢিবির পশ্চিম দিক থেকে শুরু করি।
বিরক্তমুখে ধরণীধর কর্নেলকে অনুসরণ করলেন। দিগন্তে সূর্য লালরঙের চাকা হয়ে সবে রঙবেরঙের মেঘের ভেতর লুকিয়ে গেল। বিস্তীর্ণ উত্তরঙ্গে বন্যার জলে একটু লালচে ছটা খেলছে। বাঁদিকে শকুনের দঙ্গল জলের ধারে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। ধরণীধর বললেন, মড়াটড়ার আশায় বসে আছে। বন্যা হলে অনেক জন্তু মারা পড়ে। ভেসে এসে ঢিবিতে আটকে যেতে পারে।
কর্নেল আস্তে বললেন, ধরণীবাবু, ওখানে একটা লাশ পোঁতা আছে।
ধরণীধর চমকে উঠেছিলেন। কিন্তু কর্নেল দ্রুত চুপ বলায় থমকে দাঁড়ালেন। চাপাস্বরে শুধু বললেন, সে কী!
কর্নেল গলা চড়িয়ে বললেন, চলুন ধরণীবাবু, এখান থেকে দক্ষিণদিক হয়ে সার্চ করা যাক।
শকুনগুলোকে এড়িয়ে গাছপালা, ঝোপঝাড়ে, ধ্বংসস্তূপের ভেতর সাতজন লোক কম্বিং অপারেশন শুরু করল। সবার আগে ধরণীধর। একহাতে টর্চ, অন্যহাতে রিভলবার। গাছপালার ভেতর এখনই অন্ধকার জমেছে। টর্চ জ্বেলে। গাছের ওপর, ডালপালার ভেতর, ঝোপের আড়াল, ধ্বংস্তূপ তন্নতন্ন খোঁজা হচ্ছে। দক্ষিণে বটতলায় গিয়ে কর্নেল বাঁদিকে ঘুরে দেখলেন দরবেশ দরগার কাছে নামাজ পড়ছেন। দলটা ঘুরে পূর্বে পৌঁছুল। নিচে দুটি সাদা মোটরবোট দেখা গেল আবছায়ার ভেতর। ধরণীধর বুদ্ধিমান। একজন সশস্ত্র কনস্টেবলকে একটা বোটে বসিয়ে রখেছেন। কর্নেল বললেন, ধরণীবাবু! আপনার প্রশংসা করা উচিত।
ধরণীধর মনে-মনে অসন্তুষ্ট। বিরক্ত। কারণ, এভাবে কম্বিং অপারেশন অর্থহীন। কিন্তু কথাটা শুনে অগত্যা একটু হাসলেন। কেন বলুন তো কর্নেলসায়েব?
আমাদের পলিটিক্যাল প্রিজনার যাতে ওই বোটে করে পালাতে না পারে, আপনি তার উপযুক্ত ব্যবস্থা করে রেখেছেন, দেখছি। বলে কর্নেল হঠাৎ হন্তদন্ত সোজা হাঁটতে শুরু করলেন উত্তর দিকে। একজন সৈনিক বিরক্ত হয়ে বলে উঠল, ইয়ে ক্যা হো রাহা?
ধরণীধর চাপা স্বরে বললেন, এর একটা বোঝাপড়া করা দরকার। কোনো মানে হয়?
একজন কনস্টেবল্ বলল, স্যার! বড়বাবু বোলা না, কর্নিসাব পাগলা আদমি!
হুঁ, বোলা। ধরণীধর শক্ত মুখে বললেন। ছোড় দো উনকো। এক কাম করো। তেওয়ারি, তুম ইয়ে তিন জওয়ানলোগোঁকা সাথ সিধা দরবেশবাবাকা ডেরাকি পিছেসে স্টার্ট করো। সাউথসাইড দেখ লিয়া। ওয়েস্টসে স্টার্ট কারকে ইস্টমে সার্চ করো। হমলোগ ইধারসে নর্থবরাবর ওয়েস্টমে সার্চ করতা। গো! জলদি!
তেওয়ারিজি তিনজন সৈনিককে নিয়ে ভাঙা দেউড়ি দিয়ে সোজা আস্তানার দিকে চলে গেল। ধরণীধর দ্বিতীয় কনস্টেবলকে বললেন, ধনেশ্বর! আও মেরা সাথ…।
উত্তর-পূর্ব কোণে ছাতিমতলায় কর্নেল দাঁড়িয়ে ছিলেন। হাতে লম্বা একটা ডাল। উরু পর্যন্ত ভিজে গেছে পাতলুন। ধরণীধর এসেই বললেন, কী ব্যাপার?
সাপ।
ধরণীধর চমকে গেলেন। কই সাপ? কোথায় সাপ?
কর্নেল ডালটা জলে ফেলে দিয়ে বললেন, পলিয়ে গেল। যাই হোক, এই ঢিবিতে কিন্তু প্রচুর সাপ এসে জুটেছে। সাবধান ধরণীবাবু!
ধরণীধর বিরক্ত মুখে বললেন, জানি। দেখেশুনেই পা ফেলছি।
বলে ছাতিম গাছটাতে টর্চের আলো ফেলে খুঁজতে থাকলেন পলিটিক্যাল প্রিজনার ঘনশ্যাম রুদ্রকে। কনস্টেবল ধনেশ্বর সামনের জঙ্গলে আলো ফেলল। কর্নেল বললেন, আর খুঁজে লাভ নেই। ধরণীবাবু! আপনাদের দ্বিতীয় আসামী পালিয়ে গেছে।
অসম্ভব। ধরণীধর শক্তমুখে বললেন। সাঁতার কেটে পালানোর মতো ক্ষমতা ঘনশ্যাম রুদ্রের নেই। আমাদের রেকর্ডে আছে ওঁর স্বাস্থ্যের অবস্থা কী। আই অ্যাম সরি, কর্নেল সায়েব! ইউ হ্যাভ মিসলেড আস।
বলেন কী। কর্নেল হাসলেন।
এগেন– সরি। ধরণীধর পা বাড়ালেন। প্লিজ লেট মি ডু মাই ডিউটি।
দুজনে আলো ফেলতে ফেলতে বুটের শব্দ তুলতে তুলতে এগিয়ে গেলেন ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে। কর্নেল আপনমনে হাসছিলেন। ঘনশ্যামবাবুকে ইচ্ছে করেই যথেষ্ট সময় দিয়েছেন পালানোর জন্য। ভোঙাটি উদ্ধার করে পালাতে পেরেছেন, কারণ ভোঙাটি যথাস্থানে নেই। খুঁজে পাননি কর্নেল।
প্রাঙ্গণের কবরখানায় গিয়ে দেখলেন দরবেশ নমাজ সেরে বারান্দায় গিয়ে বসেছেন। যথারীতি বুকে চিমটে ঠুকছেন। কর্নেল বারান্দায় উঠলে দরবেশ হাঁকলেন, চুল্লু!
কর্নেল তার কিটব্যাগ ও বর্ষাতি বারান্দার ধারে নিয়ে এলেন। পা ঝুলিয়ে বসে কিটব্যাগ খুলে চুরুটের কৌটো বের করলেন। একটি চুরুট জ্বেলে টানতে থাকলেন। একটু পরে ধরণীধরদের দেখা গেল। প্রাঙ্গণে এসে ধরণীধরবাবু নিচু গলায় কী নির্দেশ দিচ্ছেন। এমনসময় কর্নেল ডাকলেন, ধরণীবাবু! এখানে আসুন! জরুরি কথা আছে। শিগগির! ঘনশ্যামবাবু।
ঘনশামবাবু শুনেই ধরণীধর সদলবলে প্রায় দৌড়ে এলেন। হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন, কই? কই? বাট প্লিজ, ডোন্ট মিসলিড এগেন! হোয়্যার ইজ দ্যাট ম্যান?
আপনি শান্তভাবে বসুন। বলছি।
আঃ! আবার
ধরণীধর, সত্যিই ঘনশ্যামবাবু পালিয়ে গেছেন। বিশ্বাস করুন আমরা কথা।
কিন্তু পালালেন কীভাবে? দেখেছেন আপনি তাকে পালাতে?
দেখেছি বলতে পারেন। নিশ্চয় পারেন।
ধরণীধর খাপ্পা হয়ে বললেন, আশ্চর্য! দেখেছেন, কিন্তু আমাদের বলেননি!
ঘনশ্যামবাবু
আগে আমার কথার জবাব দিন। আমাদের সেটা এতক্ষণ বলেননি কেন?
কর্নেল মিটিমিটি হাসছিলেন। বললেন, ঘনশ্যামবাবু একটা তালডোঙায় চেপে পালিয়ে গেছেন।
তালডোঙা? ধরণীবাবু ধপাস করে বসে পড়লেন। তারপর নড়ে উঠলেন মাই গুডনেস! বড়বাবু গলাকাটা কালুর তালডোঙাটার কথা বলেছিলেন মনে পুড়ছে!
কর্নেল শান্তভাবে বললেন, তালডোঙাটা প্রথমে আমি লুকিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু চুল্লু আড়াল থেকে দেখে সেটা দড়ি ছিঁড়ে জলের তলা থেকে উদ্ধার করেছিল। তারপর আজ কোনো এক সময়ে চুল্লু ওটা ছাতিমতলায় জলে ডুবিয়ে রেখেছিল। জল কমে এলে ঘনশ্যামবাবুর সেটা চোখে পড়ে। চুল্লু তাকে মেরে ফেলত। গলা কেটে নয়, গলা টিপে জলে ডুবিয়ে। দৈবাৎ আমি গিয়ে পড়ায়। উনি বেঁচে যান। চুল্লু কেটে পড়ে।
কী খালি চুল্লু-চুল্লু করছেন আপনি! ওসব আমি বিশ্বাস করি না!
চুল্লুকে বিশ্বাস করেন না? নাকি আমার কথা?
তেতোমুখে সিগারেট জ্বেলে ধরণীধর বললেন, দুটোই।
কিন্তু দুটোই নিখাদ সত্যি! চুল্লু সত্যিই আছে!
হ্যাণ্ডেরি! ধরণীধর তার বড়বাবুর ভঙ্গিতে বললেন। আপনার মাথার ঠিক নেই। জলবন্দী অবস্থায় থেকে ক্ষিদের চোটে আপনার সেন্স অফ রিজনিং লোপ পেয়েছে। খালি চুল্লু-চুল্লু করছেন।
অন্ধ দরবেশ হাঁক দিলেন, চুল্লু! তারপর উঠে দাঁড়ালেন। দরজার তালা খুলতে চাবি বের করলেন আলখেল্লার ভেতর থেকে।
কর্নেল বললেন, দরবেশসায়েব! এঁরা চুল্লুর কথা বিশ্বাস করছেন না। .. দয়াকরে এঁদের বলুন, চুল্লু কে? চুল্লু কে ছিল? কত বছর আগে চুল্লু খাঁ নামে এর জায়গিরদার এই এলাকার মালিক ছিল?, দরবেশসায়েব! বলুন তো এঁদের সেই সাংঘাতিক গল্পগুলো! কত খুন খারাপি করেছিল চুল্লু খাঁ, সেইসব কথা বলুন।
দরবেশ সবে তালা খুলেছেন, কর্নেল এক লাফে উঠে গিয়ে পেছন থেকে দুহাতে তাকে জাপটে ধরে এক প্যাঁচে বারান্দায় ধরাশায়ী করলেন..ধরণীবাবু! হেল্প মি! চুল্লুকে ধরে ফেলেছি।
ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই হকচকিয়ে গেছে। ততক্ষণে কর্নেল দরবেশের বুকে চেপে বসেছেন, চিমটেটি তার তলায় লম্বালম্বি হয়ে আছে। বারান্দায় আবছা অন্ধকারে কয়েকটা টর্চের আলোয় দৃশ্যটা চোখে পড়ল। ধরণীধর বললেন, ব্যাপার কী? কর্নেল! কর্নেল! ও কী করছেন?
কর্নেল দরবেশের চোখ থেকে কালো চশমাটা খুলে ছুঁড়ে ফেললেন। তারপর হ্যাঁচকা টানে পাগড়ি উপড়ে ফেললেন। পাগড়ির সঙ্গে পরচুলা ও দাড়িও হাতে উঠে এল। কর্নেল শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, ধরণীবাবু! ডাকু ইসমাইলকে কখনও দেখেছেন?
মাই গড! ধরণীবাৰু এতক্ষণে লাফ দিলেন। কনস্টেবল দুজন একগলায় চেঁচিয়ে উঠল, ইসমাইল ডাকু! ওহি তো ইসমাইল ডাকু!
কর্নেল চিমটেটি কেড়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। দরবেশবেশী ঈসমাইল শুয়েই রইল। তেওয়ারি ও ধনেশ্বর তাকে টেনে ওঠাল। ধরণীধর তার বুকে রিভলবারের নল ঠেকিয়ে বললেন, ধনেশ্বর! হ্যান্ডকাপ হ্যায় তুমহারা পাস। লাগা দো!
দুই কনস্টেবল ইসমাইলের দুটো হত পিঠের দিকে টেনে হ্যান্ডকাপ পরাল। ইসমাইল চুপ। সৈনিকত্রয় বারান্দার সামনে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে। ব্যাপারটা তাদের এখনও তত বোধগম্য নয়। কর্নেল ঘরের ভেতর ঢুকে তক্তাপোসের তলায় নিজের টর্চটি জ্বেলে বললেন, ধরণীবাবু! দেখে যান।
ধরণীবাবু দরজার কাছে গুঁড়ি মেরে তক্তাপোসের তলা দিয়ে টর্চের আলো ফেললেন। বললেন, কী কাণ্ড! একটা ফোকর দেখছি!
হু, চিমটে দিয়ে এই সুড়ঙ্গটা খুঁড়েছিল ইসমাইল। ভেতর থেকে যখন-তখন দরজা বন্ধ করার এই হল রহস্য। কর্নেল টর্চের আলোয় ঘরের ভেতরটা দেখতে দেখতে বললেন। দরজা বন্ধ করে ইসমাইল এই ফোকর দিয়ে বাইরে বেরুত। আমাদের অলক্ষ্যে সকলের গতিবিধির ওপর নজর রাখত। গলাকাটা কালু ওর সাগরেদ। একটা তালডোঙা এনেছিল ওকে নিয়ে যেতে। কিন্তু হঠাৎ শাওনি, তারপর আমাকে এবং দরগায় এতগুলো লোকজন, এমন কী স্বয়ং দারোগাবাবুকে দেখে কালু ঝটপট গাছের ডালে লুকিয়ে পড়েছিল। আমি তালডোঙাটা লুকিয়ে রেখেছিলাম– নেহাত একটা খটকা বেধেছিল বলেই। কিন্তু ইসমাইল মহা ধূর্ত। যেভাবে হোক, ব্যাপারটা দেখেছিল। তারপর কোনো এক সময়, নিশ্চয় গতরাতেই ওটা উদ্ধার করে ছাতিমতলার নিচে লুকিয়ে রেখে এসেছিল।
ধরণীধর বললেন, কিন্তু তখনই পালিয়ে যেতে পারতো। কেন পালায়নি?
কর্নেল হাসলেন। পালায়নি, তার কারণ অন্ধ দরবেশের জমানো টাকাকড়ি খুঁজে পাচ্ছিল না। ওই দেখুন, সিন্দুকের ভেতরটা ওলটপালট হয়ে আছে। আর এই দেখুন, এখানে খোঁড়াখুঁড়ির চেষ্টা। আমরা আসার আগেই অন্ধ দরবেশকে সম্ভবত গলা টিপে মেরে–
সর্বনাশ! বলেন কী? ধরণীধর অবাক হয়ে বললেন। তাহলে কি শকুনগুলো যেখানে বসে আছে, ওখানেই অন্ধ দরবেশের ডেডবডি পোঁতা আছে?
আছে। গতকাল এখানে এসে ঘোরাঘুরি করতে করতে জায়গাটা আমার চোখে পড়েছিল। ঘাসের আর কাদামাটির চাবড়া চাপানো দেখে সন্দেহ হয়েছিল আমার। সদ্য কেউ যেন কিছু পুঁতেছে। ব্যাপারটা বোঝার জন্যই আসলে দরগায় থেকে গেলাম। তারপর হঠাৎ নদীর বাঁধ ভেঙে বন্যা এসে পড়ল। জায়গাটা ডুবে গেল। ওখানেই ইসমাইল আসল দরবেশকে মেরে পুঁতেছে।
ধরণীধর বারান্দা থেকে পরচুলা আর চিমটেটা কুড়িয়ে নিলেন। বললেন, ইসমাইল ডাকুর ছদ্মবেশ ধরার কথা পুরনো পুলিশ রেকর্ডে আছে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। অথছ দেখছি, ব্যাপারটা সত্যি। একবার নাকি নবাবগঞ্জ বাজারে ফকির সেজে হাত পেতে বসে থাকত। পুলিশের নাকের ডগায়! ধরণীধর হাসতে লাগলেন।
ধনেশ্বর বলল, স্যার! আর কেতনা দের হোগা?
ধরণীধর কিছু বলার আগে কর্নেল বেরিয়ে এসে বললেন, উসকো লে যাইয়ে! বোটমে যাকে বৈঠিয়ে। সোলজার্স! গো উইথ দেম!
ধরণীধর বললেন, আমাদের আর এখানে থাকার দরকার আছে কি কর্নেলসায়েব?
দরকার আছে, ধরণীধরবাবু! কর্নেল বললেন। আমার ধারণা, এই ঘরে অন্ধ দরবেশের জমানো টাকাকড়ি তো আছেই, আগের আমলের আরও দামী কিছু থাকা সম্ভব। এই দরগায় যুগ যুগ ধরে লোকেরা মানত দিয়েছে। বহু দামী জিনিসপত্রও দিয়ে থাকবে।
গুপ্তধন? ধরণীধর মুচকি হেসে বললেন।
অসম্ভব নয়। এটি একটি প্রাচীন ঐতিহাসিক জায়গা। কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুটটি বারান্দার কোণ থেকে উদ্ধার করে লাইটার জ্বেলে ধরালেন। বললেন তার চেয়ে বড় কথা দরবেশের ডেডবডিটা শকুনের মুখে এভাবে অরক্ষিত অবস্থায় ফেলে রাখা যায় না। আপনি বরং এক কাজ করুন। একটা বোটে ওরা আসামী নিয়ে চলে যাক। বাই দা বাই, আপনাদের বোটে যদি কিছু ফুড থাকে নিয়ে আসুন। আমি ভীষণ ক্ষুধার্ত!
রিলিফের জন্য কিছু ফুডপ্যাকেট দেখেছি জওয়ানদের বোটে! নিয়ে আসছি। বলে ধরণীধর সদব্বলে চলে গেলেন।
কর্নেল ঘর থেকে খুঁজে দরবেশের লণ্ঠনটি নিয়ে এলেন বারান্দায়। জ্বালতে গিয়ে কয়েকমুহূর্ত অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন। প্রকৃতই এক অন্ধ দরবেশ এই নির্জন দরগায় এই লণ্ঠনটি জ্বেলে রাত কাটাতেন। হয়তো নিজেকেই সাহস দিতে মাঝে মাঝে হাঁক দিতেন, চুল্লু! চুল্লু! ডাকু ইসমাইল চমৎকার নকল করেছিল এই ডাকটি।
বারান্দার ধারে জ্বলন্ত লণ্ঠনটি রেখে প্রাঙ্গণের কবরখানায় নামলেন কর্নেল। চারপাশে গা ছমছমকরা অন্ধকার বনভূমি ঘিরে আবছা ছলছল বন্যাজলের শব্দের সঙ্গে পোকামাকড়ের ডাক মিশে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও বিভীষিকা একাকার হয়ে যাচ্ছে। তারপর হঠাৎ একটা বাতাস এল শনশনিয়ে। যেন ফিসফিস করে উঠলেন অন্ধ দরবেশ, চুল্লু! চুল্ল! চুল্ল!
কর্নেল শক্ত হয়ে দাঁড়ালেন। হু, শকুনগুলো ওত পেতে আছে। বন্যার জল আলগা করে বসানো ঘাসের চাবড়া টেনে নামিয়ে নিয়ে গেলে মাটি গলে দরবেশের লাশ বেরিয়ে পড়বে সারারাত সেই প্রতীক্ষা শকুনদের। ভোরবেলা তারা বাঁকা ধারালো ঠোঁট বাগিয়ে পা বাড়াবে।
তাই এরাতটাও দরগায় কাটাতে হবে। কর্নেল সিন্ধান্ত করলেন। ধরণীধরকে বলবেন কথাটা, যদি ধরণীধর থাকতে রাজি না হন, একাই থাকবেন কর্নেল। শকুনের মুখ থেকে হতভাগ্য অন্ধ মানুষটির মৃতদেহ রক্ষা করা তার কর্তব্য। কর্নেলের মনে হল, চারপাশ থেকে মৃত মানুষটির অসহায় আর্তনাদ বাতাসে স্পন্দিত হচ্ছে, চুল্লু! চুল্লু! চুল্লু!…
.
বংকুবিহারীর পুনরাবির্ভাব
বন্দী ইসমাইল ডাকুকে একটি মোটরবোটে পাঠিয়ে দিয়ে ধরণীধর কয়েকটা ফুডপ্যাকেট বগলদাবা করে এনেছিলেন। তিনিও ক্ষুধার্ত। খাওয়া সেরে আস্তানাঘর খুঁজে চা ও চিনির কৌটো পাওয়া গেছে। দুধ সত্যি নেই। কর্নেল চা করেছেন কুকার জ্বেলে। চা খেতে খেতে ধরণীধর বলছিলেন, এমন ভয়ংকর বন্যা নাকি মহকুমায় গত একশোবছরে দেখা যায়নি। আর্মি না নামালে একাধিক মানুষ মারা পড়ত। তবে গৃহপালিত জীবজন্তু বন্যা ঝেটিয়ে নিয়ে গেছে। আসার পথে প্রচুর ডেডবডি দেখলাম। হরিব!
সেইসময় আবার মোটরবোটের শব্দ। দুজনেই কান পাতলেন। শব্দটা দরগার ঢিবির পশ্চিমে শোনা যাচ্ছিল। আওয়াজ বাড়তে বাড়তে কাছে এসে থেমে গেল। আলোর ঝলকানি দেখা গেল। দুজনে প্রাঙ্গণে নেমে গেলেন। তাদের ওপর আলো পড়ল। তারপর বংকুবিহারীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল। কণ্ঠস্বর বলা ভুল, গর্জন মিশ্রিত আর্তনাদ যেন, কর্নেল! ধরণীবাবু! ওকে পালাতে দেবেন না। অ্যারেস্ট দ্য ম্যান, দ্যাট দরবেশ।
দুজনে মুচকি হাসলেন শুধু। বংকুবিহারী সদলবলে মাটি কাঁপিয়ে প্রাঙ্গণে এসে বারান্দায় টর্চের আলো ফেলে দেখলেন, আস্তানাঘরের দরজা খোলা। এক লাফে বারান্দায় উঠে ঘরে ঢুকে চেঁচিয়ে উঠলেন, হোয়ার ইজ দ্যাট বাস্টার্ড? পালিয়ে গেছে? তাকেও পালাতে দিলেন আপনারা? ধরণীধর কিছু বলার আগে কর্নেল বললেন, গলাকাটা কালু নিশ্চয়ই কবুল করেছে কিছু?
হ্যাঁ। বংকুবিহারী হাঁফাতে-হাঁফাতে বললেন। কিন্ত কোথায় সে? কীভাবে পালিয়ে গেল?
কর্নেল হাসলেন।…পালাতে পারেনি। দরবেশরূপী ইসমাইলকে নিয়ে কনেস্টেবলরা এতক্ষণ থানায় পৌঁছে গেছে। আপনি পশ্চিমদিক ঘুরে এসেছেন, সম্ভবত তাই মোটরবোটটি দেখতে পাননি।
তাই? বলে ধপাস করে বারান্দায় বসে পড়লেন বংকুবিহারী। তারপর ফাঁচ করে হাসলেন। আপনি মশাই, সত্যি বড় অদ্ভুত মানুষ! খুলে বলুন তো সব, শুনি।
কর্নেল বললেন, কালু কী কবুল করেছে বলুন আগে।
বংকুবিহারী শ্বাস ছেড়ে বললেন, কালু আর ইসমাইল কালীতলা গ্রামে এক সাগরেদের বাড়ি লুকিয়েছিল। আমার হানা দেবার খবর চরের মুখে পেয়ে মাঝরাত্তিরেই কেটে পড়েছিল। দুজনে এই দরগায় গা ঢাকা দিতে এসেছিল। কিন্তু দুবৃত্তদের স্বভাব এবং লোভ! দরবেশের কাছে লোকেরা টাকাকড়ি সোনাদানাও মানত দেয়। সেগুলোর লোভে দুই ডাকু নিলে বেচারা অন্ধ দরবেশেকে গলা টিপে মারে। তারপর ওঁর চিমটেখানি তো দেখেছেন? বেশ, মজবুত আর সূচলল।
কর্নেল বললেন, সাধুদের যেমন ত্রিশূল, ফকির-দরবেশদের তেমনি চিমটে থাকে। আসলে আত্মরক্ষার অস্ত্র।
বংকুবিহারী বললেন, ওই চিমটে দিয়ে গর্ত খুঁড়ে একখানা লাশ গুম করে দুজনে। তারপর এই ঘরে খোঁজাখুঁজি শুরু করে। দেয়াল, মেঝে সবখানে খোঁড়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ততক্ষণে সকাল হয়ে গেছে। দৈবাৎ কোনো লোক মানত দিতে এসে পড়তেও পারে। তাই কালুকে পুবের দেউড়ির ওখানে পাহারা দিতে পাঠায় ইসমাইল। এমন সময় একজন সাদা দাড়িওলা বুড়ো সায়েব মানে আপনি!
খ্যা খ্যা করে হাসতে লাগলেন বংকুবিহারী। কর্নেল বললেন, হ্যাঁ আমি এসে পড়ায় ওদের কাজে বাধা পড়া স্বাভাবিক।
বংকুবিহারী ফের সিরিয়াস হয়ে বললেন, কালু দৌড়ে এসে খবর দেয়। ইসমাইল বলে, তুই পালিয়ে যা এখান থেকে। কালু কেটে পড়ে। আর ইসমাইল দরবেশের আলখেল্লা পরে বুঝলেন তো? কালু একটা গ্রামে ছিল। একটা তালডোঙা চুরি করে ওস্তাদকে উদ্ধার করতে আসে। কালু তখন আমাদের যা-যা বলেছিল, সবই শুনেছেন। শুধু একটা কথা চেপে রেখেছিল সে। সেটা হল- দরবেশই ইসমাইল ডাকু!
হাঃ! বংকুবিহারী শ্বাসের সঙ্গে বললেন। কিন্তু আপনি মশাই অদ্ভুত! সব জেনেও চুপচাপ ছিলেন! কেন?
কর্নেল হাসলেন। আসলে নিশ্চিত হতে পারছিলাম না। পরিস্থিতিটা বড্ড জট পাকিয়ে গিয়েছিল। প্রত্যেককেই সন্দেহ করা চলে, এমন একটা অবস্থা। অবশেষে চাক্কুর ড্যাগারটা কুড়িয়ে পেয়ে নিশ্চিত হয়েছিলাম। তাই বাই দা বাই, আপনার পলিটিক্যাল প্রিজনার ঘনশ্যামবাবু
লাফিয়ে উঠলেন বংকুবিহারী। মাই গুডনেস! ওর কথা তো ভুলেই গেছি! তাকে খোঁজা দরকার।
কালুর তালডোঙা উদ্ধার করে ঘনশ্যামবাবু পালিয়ে গেছেন।
বংকুবিহারী হঠাৎ নিস্তেজ ভঙ্গিতে বললেন, মরুক গে। বিপ্লবী না হাতি! পাতি-বিপ্লবী। ওকে নিয়ে আপাতত মাথাব্যথা নেই। ডাকু ইসমাইল ধরা পড়েছে, এতই হইচই পড়ে যাবে। তাছাড়া আমি বড্ড টায়ার্ড।
বলে হাই তুললেন। চলুন, থানায় গিয়ে আপনার বক্তব্য শুনব ডিটেই শুনব।
কর্নেল বললেন, কিন্তু এখানে লোক থাকা দরকার। দরবেশের ডেডবডিটা পোঁতা আছে। একদঙ্গল শকুন ওত পেতে রয়েছে। ভোরে ওরা হানা দেবে।
ধরণীবাবু থাকুন। কনস্টেবলরা রইল। বংকুবিহারী বললেন। ধরণীবাবু! বি কেয়ারফুল।
ধরণীবাবু বললেন, ঠিক আছে স্যার, মার্নিং-এ শকুনিবধ পর্ব শুরু হবে। ভাববেন না।
কর্নেল বংকুবিহারীকে অনুসরণ করলেন। যেতে যেতে ঘুরে অন্ধকার নিঝুম দরগার দিকে একবার তাকালেন। আবার একটা বাতাস এসেছে। বনভুমি জুড়ে অন্ধ অসহায় এক দরবেশের আত্মা ফিসফিসিয়ে ডাকছে, চুল্লু! চুল্লু! ….
Leave a Reply