গ্রন্থ ও রচনাপরিচয়

পরিশিষ্ট – গ্রন্থ ও রচনাপরিচয়

উপদ্রুত উপকূল

প্রকাশ : ফাল্গুন ১৩৮৫, ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯। প্রকাশক : আহমদ ছফা, বুক সোসাইটি, ৩৮ বাংলাবাজার, ঢাকা। মুদ্রণ : মডার্ন টাইপ ফাউন্ডার্স, প্রিন্টার্স এন্ড পাবলিশার্স লিঃ, ২৪৪ নবাবপুর রোড, ঢাকা ১। গ্রন্থস্বত্ব : বীথিকা শারমিন। প্রচ্ছদ : কাজী হাসান হাবীব। আলোকচিত্র : শামসুল ইসলাম আলমাজী। পৃষ্ঠা সংখ্যা : ৮ + ৬৪। মূল্য : পাঁচ টাকা। উৎসর্গপত্র :

থামাও, থামাও এই মর্মঘাতী করুণ বিনাশ
এই ঘোর অপচয় রোধ করো হত্যার প্লাবন

শিরাজ শিকদার
শেখ মুজিবুর রহমান
আবু তাহের

ভূমিকা :

গ্রন্থে কিছু শব্দের বানানে পরিবর্তন চোখে পড়বে। ধ্বনিকে মূল ভিত্তি ধ’রে এই পরিবর্তন করা হয়েছে। আর ইংরেজি ফুলস্টপের মতো নোতুন যে যতিচিহ্নের ব্যবহার করেছি— সেটি অর্ধ-কমা। এ-সবের সম্পূর্ণ দায়িত্ব আমার।

আমার অসন্তুষ্ট পিতা, সদা-শংকিত জননী, যার বুকে লালিত হয়েছি সেই মা, বিক্ষুব্ধ আত্মীয়বৃন্দ, অপরিচিত অনুরাগী, শুভাকাংখি, স্বজন, বিশ্বাসঘাতক প্রেমিকাগণ (একজন ছাড়া), বন্ধু, শত্রু, পাঠক এবং উপদ্রুত উপকূলের আটকোটি মানুষ— সবার জন্যে আমার শুভেচ্ছা।

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ
২১. সিদ্ধেশ্বরী. ঢাকা

২য় প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ১৯৮৭ (ফাল্গুন ১৩৯৩)। গ্রন্থস্বত্ব : বীথিকা শারমিন। প্রকাশক : সৈয়দ রাজা হুসাইন, সব্যসাচী, ১ গোবিন্দ দত্ত লেন, লক্ষ্মীবাজার, ঢাকা। প্রচ্ছদ : মাসুদুল হাসানের তৈলচিত্র অবলম্বনে ইউসুফ হাসান। অলংকরণ : জাহাঙ্গীর সাত্তার। মুদ্রণ : ইত্যাদি প্রিন্টার্স, নীলক্ষেত, ঢাকা।

এ সংস্করণে কবি ‘দুর্বিনীত জলের সাহস’ কবিতাটির শিরোনাম বদলে কেবল ‘সাহস’ রেখেছেন। ভূমিকা থেকে বাদ দিয়েছেন বন্ধনীভুক্ত ‘একজন ছাড়া’ অংশটি। এছাড়া বানানে সকল মূর্ধন্য ‘ণ’-কে দন্ত্য ‘ন’ করা হয়েছে। রুদ্রসমগ্র-তে এই সব্যসাচী সংস্করণের পাঠ অনুসৃত হয়েছে।

ফিরে চাই স্বর্নগ্রাম

প্রকাশ : ফাল্গুন ১৩৮৭, ফেব্রুয়ারি ১৯৮১। প্রকাশক : দ্রাবিড় প্রকাশনী, ১১/১ উত্তর বাসাবো, ঢাকা। মুদ্রন : আনন্দ, ১৯/১ আই, শেখ সাহেব বাজার, ঢাকা। গ্রন্থস্বত্ব : লীমা নাসরীন। প্রচ্ছদ : কালিদাস কর্মকার ও রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। আলোকচিত্র : মোহাম্মদ আলী মিনার। পৃষ্ঠাসংখ্যা : ৮ + ৪৮। মূল্য : পাঁচ টাকা। উৎসর্গপত্র :

বিশ্বাসের তাঁতে আজ আবার বুনতে চাই
জীবনের দগ্ধ মসলিন

ভূমিকা :

স্বর্নগ্রাম কোনো গ্রাম নয়। স্বর্নগ্রাম হচ্ছে আমাদের ইতিহাস, জাতিসত্তা আর প্রেরনাময় ঐতিহ্যের প্রতীক। স্বর্নগ্রাম বাঙালির আত্মার নাম, রক্তের নাম। বৃক্ষের বিকাশের জন্যে যেমন মাটিতে শিকড় বিস্তার করা প্রয়োজন, একটি জাতির বিকাশের জন্যেও তেমনি প্রয়োজন তার-মাটিতে তার-ইতিহাসে সাহিত্যে, শিল্পে, দর্শনে, বিজ্ঞানে, তার প্রেরনাময় ঐতিহ্যে শিকড় বিস্তার করা। আর সে কারনেই এই আত্মানুসন্ধান, এই স্বরূপ অন্বেষন। বানানের ব্যাপারে আমার আগের চিন্তা ভাবনা এই বইতেও অক্ষুণ্ন রয়েছে। তবে দুটি ন- এর পরিবর্তে এই গ্রন্থে শুধু দন্ত্য ন ব্যবহার করেছি। সবাইকে শুভেচ্ছা।

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ
১১/১ উত্তর বাসাবো ঢাকা

মানুষের মানচিত্র

প্রকাশ : এপ্রিল ১৯৮৪। প্রকাশক : সৈয়দ রাজা হুসাইন, সব্যসাচী, ১ গোবিন্দ দত্ত লেন, লক্ষ্মীবাজার ঢাকা ১. মুদ্রন : শামীম প্রিন্টিং ওয়ার্কস, ১২ ফোল্ডার স্ট্রিট, ঢাকা ৩। গ্রন্থস্বত্ব : মুহম্মদ সাইফুল্লাহ। প্রচ্ছদ : এস. এম. সুলতানের তৈলচিত্র ফার্স্ট প্লান্টেশন অবলম্বনে মোশতাক দাউদী। পৃষ্ঠাসংখ্যা : ১৪ + ৩২। মূল্য : পনেরো টাকা। উৎসর্গপত্র :

কেউ কি বেহুলা নেই হাড়ের খোয়াব নিয়ে বৈরী জলে ভাসে?

বইটির শুরুতে অর্থাৎ নামপত্রের আগের পৃষ্ঠায় কবি ও কবিতাগুলো সম্পর্কে একটি পরিচিতি ছাপা হয়েছে। সেটি উল্লেখ করা হল :

বাংলাদেশের কবিতায় রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ এখন একটি অত্যন্ত পরিচিত নাম। মুক্তি আন্দোলনে তারুন্যের প্রিয় নাম। প্রথম কাব্যগ্রন্থ থেকেই তিনি মানুষের অগ্রযাত্রার সংগ্রামে অঙ্গীকারবদ্ধ। তাঁর কবিতার অন্তর-বিষয় নির্মিত হয়েছে স্বদেশের ঐতিহ্য, ইতিহাস এবং মানুষের জীবন ও মানস-চিন্তার উপকরনে। সভ্যতার অগ্রযাত্রার এই পর্যায়ে মানুষ শৃংখলিত হয়েছে তার স্বরচিত কারাগারে। কিন্তু মানুষ কখনোই তার নিয়তিকে প্রতিরোধহীন মেনে নেয়নি। নির্মান এবং বিনাশ মানুষের একান্ত প্ৰবনতা। ‘মানুষের মানচিত্রে’ সেই শৃংখল, সেই কারাগার, সেই অন্ধকারের উন্মোচন ঘটেছে। ভাষার সাবলীল অন্তরঙ্গতা রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ-র কবিতাকে করেছে অনায়াসবোধ্য। অবাধে এই কবিতার সড়কে-গলিতে বিচরন সম্ভব। ‘উপদ্রুত উপকূল’ এবং ‘ফিরে চাই স্বর্নগ্রাম’-এর ধারাবাহিকতা ‘মানুষের মানচিত্রে’ স্মরনীয় প্রকাশ লাভ করেছে।

ভূমিকা :

স্বীকারোক্তি

পৃথিবীতে তখনো মানুষ ব্যক্তিস্বার্থে ভাগ হয়ে যায়নি। ভূমির কোনো মালিকানা হয়নি তখনো। তখনো মানুষ শুধু পৃথিবীর সন্তান। অরন্য আর মরুভূমির, সমুদ্র আর পাহাড়ের ভাষা তখন আমরা জানি। জীবনের স্বাভাবিক নিয়মে আমরা সে-ভাষা শিখেছি। আমরা ভূমিকে কর্ষন কোরে শস্য জন্মাতে শিখেছি। আমার বিশল্যকরনীর চিকিৎসা জানি। আমরা শীত আর উত্তাপে সহনশীল ত্বক তৈরি করেছি আমাদের শরীরে। আমরা তখন সোমরস, নৃত্য আর শরীরের পবিত্র উৎসব শিখেছি।

আমাদের নারীরা জমিনে শস্য ফলায় আর আমাদের পুরুষেরা শিকার করে ঘাই হরিন, সীল, খরগোশ। আমরা সবাই মিলে খাই আর পান করি। জ্বলন্ত আগুনকে ঘিরে সবাই আমরা নাচি আর প্রশংসা করি পৃথিবীর। আমরা আমাদের বিস্ময় আর সুন্দরগুলোকে বন্দনা করি। পৃথিবীর পূর্নিমা রাতের ঝলোমলো জোস্নায়, পৃথিবীর নারী আর পুরুষেরা সবুজ পাহাড়ের অরন্যে এসে শরীরের উৎসব করে। তখন কী গৌরবময় আমাদের মৃত্যু! তারপর… ভারি জিনিশ টানার জন্যে যে চাকা তৈরি করেছিলাম তাকে ব্যবহার করলাম আমরা আমাদের পায়ের পেশীদের আরাম দেবার জন্যে। আমরা আমাদের চোখকে সুদূরপ্রসারি করার জন্যে দূরবীন আর সূক্ষ নিরীক্ষনের জন্য অনুবীক্ষন তৈরি করলাম। নিসর্গ-হত্যায় মেতে উঠলো আমাদের যন্ত্রের শানিত দাঁত। আমাদের মস্তিষ্ককে আরো নিখুঁত এবং ব্যাপক করার জন্যে আমরা তৈরি করলাম কম্পিউটার।

একটার পর একটা খাঁচা নির্মান করেছি আমরা। আবার সে-খাঁচা ভেঙে নোতুন খাঁচা বানিয়েছি। আবার খাঁচা ভেঙেছি— আবার খাঁচা বানিয়েছি। খাঁচার পর খাঁচায় আটকা পড়তে পড়তে, খাঁচার আঘাতে ভাঙতে ভাঙতে, টুকরো টুকরো হয়ে আজ আমরা একা হয়ে গেছি। প্রত্যেকে একা হয়ে গেছি। কী ভয়ংকর এই একাকিত্ব! কী নির্মম এই বান্ধবহীনতা!! কী বেদনাময় এই বিশ্বাসহীনতা!!!

এই নিখিলের এই সৌরমন্ডলের এই পৃথিবীর এই একভাগ স্থলের এই এশিয়ার এই ভারতের এই বাংলার এই বাংলাদেশের কীর্তনখোলা নদীর পাড়ে যে শিশুর জন্ম। যার শৈশব আর কৈশোর দক্ষিন সমুদ্রের নোনা বাতাস আর মোংলা নদীর ঘোলা জলে ধোয়া। দিগন্ত বিস্তৃত মাঠে ছুটে বেড়ানোর অদম্য স্বপ্ন যে কিশোরের। যার শৈশব কেটেছে গ্রামে। একেবারে গ্রামে। অথচ অনাহারে নয়, শীত-কষ্টে নয় বরং খাদ্য ও অর্থের উপর খানিক অশ্রদ্ধা নিয়ে। যার কৈশোর অনাহারি বন্ধুদের খিদের কষ্ট দেখেও তাদের খেতে দিতে না- পারায় কেটেছে। যে তার পিতার সচ্ছলতা আর মাতার সম্পদের আস্থা ও নিরাপত্তায় বেড়ে উঠেছে। যে তার পিতামাতার পারিবারিক মর্যাদার লড়াইয়ে বিধ্বস্ত-দাম্পত্যের বিদ্বেষ আর অবহেলা আক্রান্ত। জোস্না যাকে প্লাবিত করে। বন-ভূমি যাকে দুর্বিনীত করে। নদীর জোয়ার যাকে ডাকে নেশার ডাকের মতো। যার ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে ঔপনিবেশিক অত্যাচারী ইংরেজের তৈরি শিক্ষাপদ্ধতি। গোলাম বানানোর যন্ত্র। যার উপর প্রয়োগ করা হয়েছে এক হৃদয়হীন আচারের ধর্ম। ধর্ম নয়, ধর্মের পোশাক। যে তরুন উনসত্তুরের আন্দোলনে ছিলো। যে প্রচন্ড ইচ্ছার পরও অস্ত্র-হাতে স্বাধীনতা যুদ্ধে যেতে পারেনি। যে তরুনের বিশ্বাস-স্বপ্ন-সাধ স্বাধীনতা-উত্তরকালে ভেঙে খান-খান হয়েছে। অন্তরে রক্তাক্ত যে তরুন নিরুপায় দেখেছে নৈরাজ্য, প্রতারনা আর নির্মমতাকে। বিশাল জলোচ্ছাস আর দুর্ভিক্ষ যার নিভৃত স্বপ্নগুলো দুমড়ে-মুচড়ে তছনছ করেছে। যে যুবক দেখেছে এই সবকিছুর ভেতরেও একটি প্রচন্ড আগুন। এক বেগবান অনল-প্রবাহ। দেখেছে পবিত্র বিশ্বাস আর ভালোবাসার স্রোতকে বিপথগামী করতে।

যে যুবক মিছিলে নেমেছে। বুলেটের সামনে দাঁড়িয়েছে। আকন্ঠ মদের নেশায় চুর হয়ে থেকেছে। অনাহারে উড়নচন্ডী ঘুরেছে। ভয়ানক অনিশ্চয়তা আর বাজির মুখে ছুঁড়ে দিয়েছে নিজেকে। যে পুরুষ এক শ্যামল নারীর সাথে জীবন বিনিময় করেছে। যে পুরুষ ক্ষুধা, মৃত্যু আর বেদনার কবিতা লিখছে এখনো। লিখছে বিক্ষোভ আর স্বপ্নের কবিতা— সে আমি। আমি একা। এই ব্রহ্মান্ডের ভেতর একটি বিন্দুর মতো আমি একা। আমার অন্তর রক্তাক্ত। আমার মস্তিষ্ক জর্জরিত। আমার শরীর লাবন্যহীন। আমার স্বপ্ন নিয়ন্ত্রিত। আমার জিভ কাটা। তবু এক নোতুন পৃথিবীর স্বপ্ন আমাকে কাতর করে। আমাকে তাড়ায়… আমাদের কৃষকেরা শূন্য পাকস্থলি আর বুকে ক্ষয়কাশ নিয়ে মাঠে যায়। আমাদের নারীরা ক্ষুধায় পীড়িত। হাড্ডিসার। লাবন্যহীন। আমাদের শ্রমিকেরা স্বাস্থ্যহীন। আমাদের শিশুরা অপুষ্ট, বীভৎস-করুন। আমাদের অধিকাংশ মানুষ ক্ষুধা, অকালমৃত্যু আর দীর্ঘশ্বাসের সমুদ্রে ডুবে আছে। পৃথিবীর যুদ্ধবাজ লোকদের জটিল পরিচালনায়, ষড়যন্ত্রে আর নির্মমতায় আমরা এক ভয়াবহ অনিশ্চয়তা আর চরম অসহায়ত্বের আবর্তে আটকা পড়েছি। কী বেদনাময় এই অনিশ্চয়তা! কী বীভৎস এই ভালোবাসাহীনতা!! কী নির্মম এই স্বপ্নহীনতা!!!

আজ আমরা আবার সেই বিশ্বাস আর আনন্দকে খুঁজে পেতে চাই। আজ আমরা আবার সেই সাহস আর সরলতাকে ফিরে পেতে চাই। আজ আমরা আবার সেই শ্রম আর উৎসবকে ফিরে পেতে চাই। আজ আমরা শোষন আর শঠতা, অকালমৃত্যু আর ক্ষুধার হাত থেকে মুক্তি পেতে চাই।

আমাদের সমৃদ্ধ এই বিজ্ঞান নিয়ে। আমাদের অভিজ্ঞতাময় এই শিল্পসম্ভার নিয়ে। আমাদের দূরলক্ষ্য আর সূক্ষবীক্ষন নিয়ে। আমাদের দ্বন্দ্বময় বেগবান দর্শন নিয়ে আমরা ফিরে যাবো। আমাদের বিশ্বাসের পৃথিবীতে। আমাদের সমতার পৃথিবীতে। আমাদের শ্রম, উৎসব, আনন্দ আর প্রশান্তির পৃথিবীতে।

পরমানুর সঠিক ব্যবহার আমাদের শস্যের উৎপাদন প্রয়োজনতুল্য কোরে তুলবে। আমাদের কারখানাগুলো কখনোই হত্যার অস্ত্র তৈরি করবে না। আমাদের চিকিৎসাবিজ্ঞান নিরোগ করবে পৃথিবীকে। আমাদের মর্যাদার ভিত্তি হবে মেধা, সাহস আর শ্রম। আমাদের পুরুষেরা সুলতানের ছবির পুরুষদের মতো স্বাস্থ্যবান, কর্মঠ আর প্রচন্ড পৌরুষ-দীপ্ত হবে। আমাদের নারীরা হবে শ্রমবতী, লক্ষীমন্ত আর লাবন্যময়ী।

আমাদের শিশুরা হবে পৃথিবীর সুন্দরতম সম্পদ। আমরা শস্য আর স্বাস্থ্যের, সুন্দর আর গৌরবের কবিতা লিখবো। আমরা গান গাইবো আমাদের বসন্ত আর বৃষ্টির বন্দনা কোরে। আমরা উৎসব করবো শস্যের। আমরা উৎসব করবো পূর্নিমার। আমরা উৎসব করবো গৌরবময় মৃত্যু আর বেগবান জীবনের I

কিন্তু এই স্বপ্নের জীবনে যাবার পথ আটকে আছে সামান্য কিছু মানুষ। অস্ত্র আর সেনা- ছাউনিগুলো তাদের দখলে। সমাজ পরিচালনার নামে তারা এক ভয়ংকর কারাগার তৈরি করেছে। তারা বস্ত্রহীনতা দিয়ে আমাদের বন্দি করেছে। তারা চিকিৎসাহীনতা দিয়ে আমাদের বন্দি করেছে। তারা জুলুম দিয়ে আমাদের বন্দি করেছে, বুলেট দিয়ে বন্দি করেছে।

তারা সবচে’ কম শ্রম দেয় আর সবচে’ বেশি সম্পদ ভোগ করে। তারা সবচে’ ভালো খাদ্যগুলো খায় আর সবচে’ দামি পোশাকগুলো পরে। তাদের পুরুষদের শরীর মেদে আবৃত। কদাকার। তাদের মুখ লাবন্যহীন চর্বিতে ঢাকা। তাদের মেয়েদের মুখের ত্বক দ্যাখা যায় না। প্রসাধনে আবৃত। তাদের মেয়েরা আলস্য আর কর্মহীনতায় কাতর। পঙ্গু। তাদের ঈর্ষা কুটিলতাময়। কুৎসিত। তাদের হিংসা পর্বতপ্রমান। তাদের নির্মমতা ক্ষমাহীন। তাদের জুলুম অশ্রুতপূর্ব।

তারা আমাদের জিভ কেটে নিতে চায়। তারা আমাদের মেধাকে বিকৃত করতে চায়। তারা আমাদের পেশীগুলোকে অকেজো কোরে দিতে চায়। আমাদের সন্তানদেরও তারা চায় গোলাম বানাতে।

একদা অরন্যে যেভাবে অতিকায় বন্যপ্রানী হত্যা কোরে আমরা অরন্য-জীবনের শান্তি ফিরিয়ে এনেছি, আজ এইসব কদাকার অতিকায় বন্য মানুষগুলো নির্মূল কোরে আমরা আবার সমতার পৃথিবী বানাবো। সম্পদ আর আনন্দের পৃথিবী বানাবো। প্রশান্তির পৃথিবী বানাবো।

… … … … …

‘মানুষের মানচিত্র’ আমাদের নির্যাতিত জীবনের কিছু প্রমান। আমাদের সমাজে সবচে’ কম সুবিধা যাঁরা ভোগ করে। একবেলা পেট ভ’রে খেতে পারাটাই যাঁদের বিলাসিতা বিত্তবান আর আধা-বিত্তবানের চাপে যাঁদের পিঠ ঠেকে গেছে দেয়ালে। হিমালয়ের মতো বিশাল অন্ধকারের ভার যাঁদের অহরহ দ’লে পিষে মারছে। ‘মানুষের মানচিত্রে’ সেই অন্ধকার জীবনের সামান্য কিছু ছবি আঁকার চেষ্টা করা হয়েছে। ক্ষুধার অন্ধকার, বস্ত্রহীনতার অন্ধকার, বাস্তুহীনতার অন্ধকার, চিকিৎসাহীনতার অন্ধকার, শিক্ষাহীনতার অন্ধকার আর শোষনের অন্ধকারে যে বিশাল জনগোষ্ঠী ধুকে ধুকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, বাংলা কবিতায় তাঁদের বড়ো একটি দ্যাখা যায়নি।

‘মানুষের মানচিত্র’ জীবনের অন্ধকারে বীভৎস উপস্থিতি আমার অনেক স্নিগ্ধ রুচির পাঠককে বিব্রত করেছে। কবিতায় ‘এই সব নোংরামির আমদানী’কে তিরস্কার করেছে কেউ কেউ। বলাবাহুল্য তাঁরা বিত্তবান শ্রেনীর অধিবাসী। যাঁরা অভিনন্দন জানিয়েছে তাঁদের অধিকাংশই নিম্ন ও মধ্যবিত্তের এবং তাঁরা অধিকাংশই সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার পক্ষে। ‘মানুষের মানচিত্রে’ প্রধানত ভাঙাচোরা জীবনের মানুষদের উপস্থিত করতে চেষ্টা করেছি। এখন তাদের কন্ঠে দিতে হবে জীবনের দাবি আর সংগ্রামের ভাষা। সমাজের চূড়ান্ত শোষনের অবস্থাটা জানা যায় সেই সমাজের একটি নারীর জীবন উন্মোচন করলে। শোষিত পুরুষও তার ঘরের নারীর উপর শোষন চালায়। এই বই-এ এ-রকম অনেক নারীচরিত্রের সাথে পাঠকের দ্যাখা হবে।

আমার মনে হয়েছে, বাংলাদেশের কবিতায় এক নোতুন বলদীপ্ত তাজা কোমল ভাষার নির্মান হতে চলেছে। প্রচলিত অভিজাত ভাষার ক্রিয়াপদ অক্ষুণ্ন রেখে লোকজ শব্দের মিশালের মধ্যেই রয়েছে এই নোতুন ভাষার প্রানশক্তি। প্রাথমিক প্রয়োগ হিসেবে ‘ফিরে চাই স্বর্নগ্রামে’র কয়েকটি কবিতায় এ-জাতীয় কাজ করেছিলাম বছর চার-পাঁচ আগে। এই গ্রন্থে আরো ব্যাপকভাবে এই কাজটি করার চেষ্টা করেছি। সর্বক্ষেত্রে সার্থক হয়নি কিন্তু যেখানে হয়েছে, বোঝা যায়, কতোখানি দীপ্রগতি আর অন্তরঙ্গ গভীরতা ধারন করতে পারে এই ভাষা। ‘মানুষের মানচিত্রে’ দক্ষিন বাংলার লোকজ শব্দই বেশি ব্যবহার করেছি। সম্প্রতি কেউ কেউ অবিকল আঞ্চলিক ভাষায় কবিতা লেখার চেষ্টা করেছেন। কাজটি ক্ষতিকর। ভবিষ্যতে এতে এক ব্যাপক সাহিত্যিক অরাজকতার সৃষ্টি হতে পারে।

বিশ চরন আর বাইশ মাত্রার সমিল অক্ষরবৃত্তে এই বই-এর কবিতাগুলো লেখা হয়েছে, কয়েকটি কবিতা ইচ্ছাকৃতভাবে অমিল রেখেছি। লক্ষ্য করলে প্রায় প্রতিটি কবিতায় অন্ধকার শব্দটি চোখে পড়বে— এটাও ইচ্ছাকৃত। বানানোর ব্যাপারে আগের সব সিদ্ধান্তই বহাল রয়েছে। সবার জন্যে রক্তিম শুভেচ্ছা।

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ
৮ ফাল্গুন ১৩৮৯

গ্রন্থভুক্ত কবিতা : এই গ্রন্থে ৩২টি কবিতা স্থান পেয়েছে। আলাদা শিরোনামের পরিবর্তে ১, ২, ৩… ৩২ পর্যন্ত সংখ্যাক্রম ব্যবহৃত হয়েছে।

ছোবল

প্রকাশ : ফাল্গুন ১৩৯২, ফেব্রুয়ারি ১৯৮৬। প্রকাশক : দ্রাবিড় প্রকাশনী, ঢাকা। গ্রন্থস্বত্ব : সোফিয়া শারমিন। পৃষ্ঠা সংখ্যা : ৮ + ৩৯। মূল্য : অফসেট- পঁচিশ টাকা, বুকপ্রিন্ট- পনেরো টাকা। উৎসর্গপত্র :

শুধু রক্তে আজ আর কৃষ্ণচূড়া ফুটবে না দেশে
অস্ত্র চাই, অস্ত্র চাই, স্বপ্নবান অস্ত্র চাই হাতে

ভূমিকা

আমাদের স্বপ্ন এক অস্ত্রহীন পৃথিবীর। অথচ এ-মুহূর্তে অস্ত্র-বাহকদের হটাতে অস্ত্রের প্রয়োজন, প্রয়োজন সশস্ত্র উত্থানের।

দেশে বিরাজমান সামরিক শাসন, অন্তসারশূন্য রাজনীতি, নেতৃত্বে বিশ্বাসঘাতী আপোসকামিতা, লুটতরাজে মত্ত প্রশাসন, বল্গাহীন বিত্তবানের বিলাসের ঘোড়া। নৈরাজ্যই সবচে’ সত্য এখন। সত্য এখন অন্ধকার। আর অন্ধকারে আগুনই হচ্ছে একমাত্র অবলম্বন। আগুন সংক্রামিত হোক। আগুন ছড়িয়ে পড়ুক।

পৃথিবী হোক একটি দেশের নাম। পৃথিবী হোক একটি গ্রামের নাম, একটি পরিবারের নাম। কারন মানুষ কোনো দেশের সন্তান নয়, মানুষ পৃথিবীর সন্তান।

এ-পৃথিবী অস্ত্র নির্মাতার নয়, অস্ত্রবাহকের নয়, অত্যাচারীর নয়— এ-পৃথিবী আমাদের। এই স্বপ্ন সংক্রামিত হোক। এই স্বপ্ন আগুনের মতো প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠুক।

বানানের ব্যাপারে আমার আগের সব চিন্তা-ভাবনাই বহাল রয়েছে। কাব্য-বিশ্বাসও অপরিবর্তিত। পৃথিবীর সংগ্রামী মানুষের জন্যে আমার রক্তিম শুভেচ্ছা

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ
১৬.১২.৮৫

গল্প

প্রকাশ : ফাল্গুন ১৩৯৩, ফেব্রুয়ারি ১৯৮৭। প্রকাশক : উষা রানী দাস, নিখিল প্রকাশন, লালবাগ, ঢাকা ১১। মুদ্রন : উষা আর্ট প্রেস, ১২৭/১ লালবাগ, ঢাকা। গ্রন্থস্বত্ব : মেরী শারমিন। প্রচ্ছদ : কৃষ্ণ বেরার স্কেচ নিয়ে মিশ্র মাধ্যমে ইউসুফ হাসান। আলোকচিত্র : নাসির আলী মামুন। অলংকরন : জাহাঙ্গীর সাত্তার। পৃষ্ঠা সংখ্যা : ৮ + ৪০। মূল্য : বিশ টাকা। উৎসর্গপত্র :

তোমার সামনে জানালায় শিক আঁটা

দিয়েছিলে সকল আকাশ

প্রকাশ : ভাদ্র ১৩৯৫, আগস্ট ১৯৮৮। প্রকাশক : চিত্তরঞ্জন সাহা, মুক্তধারা, ৭৪ ফরাশগঞ্জ, ঢাকা ১১০০। মুদ্রক : প্রভাংশুরঞ্জন সাহা, ঢাকা প্রেস, ৭৪ ফরাশগঞ্জ, ঢাকা ১১০০। গ্রন্থস্বত্ব : আবীর আবদুল্লাহ। প্রচ্ছদ : হাশেম খান। পৃষ্ঠা সংখ্যা : ৮ + ৪০। মূল্য : ২৪ টাকা। উৎসর্গপত্র :

নাড়ায়, ভেতরে কেউ নিবিড় কড়া নাড়ায়

মৌলিক মুখোশ

প্রকাশ : ১ ফাল্গুন ১৩৯৬, ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৯০। প্রকাশক : সাঈদ হাসান তুহিন, সংযোগ প্রকাশনী, ঢাকা। মুদ্রন : জাকির আর্ট প্রেস, ঢাকা। গ্রন্থস্বত্ব : সুবীর ওবায়েদ। প্রচ্ছদ : রুহুল আমিন কাজলের তৈলচিত্র অবলম্বনে ইউসুফ হাসান। আলোচিত্র : গোলাম হিলালী। পৃষ্ঠা সংখ্যা : ৮ + ৪০। মূল্য : পঁচিশ টাকা। উৎসর্গপত্র :

আমাদের স্বপ্নগুলো ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছে কাক ও শকুন

এক গ্লাস অন্ধকার

প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ১৯৯২। প্রকাশক : মজিবর রহমান খোকা, বিদ্যাপ্রকাশ, ৩৮/৪ বাংলাবাজার ঢাকা। প্রচ্ছদ : খালিদ আহসান। গ্রন্থস্বত্ব : ইরা শারমিন। পৃষ্ঠা সংখ্যা : ৮ + ৫৬। মূল্য : চল্লিশ টাকা। উৎসর্গপত্র :

এক গ্লাস অন্ধকার হাতে নিয়ে বোসে আছি।
শূন্যতার দিকে চোখ, শূন্যতা চোখের ভেতরও—
এক গ্লাস অন্ধকার হাতে নিয়ে একা বোসে আছি।

বিষ বিরিক্ষের বীজ

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর এ কাব্যনাট্যটি ‘থিয়েটার স্কুল’-এর ৫ম ব্যাচের সমাপনী প্রযোজনা হিশেবে মঞ্চস্থ হয় ১৭ আগস্ট ১৯৯৫-তে। নাটকটির নির্দেশক আবদুল্লাহ আল মামুন ‘নির্দেশকের নিবেদন’-এ লেখেন :

থিয়েটার স্কুলের পঞ্চম ব্যাচের প্রযোজনা প্রকল্প হিসাবে এবার বেছে নেয়া হয়েছে কাব্যনাট্য “বিষ বিরিক্ষের বীজ”। বাংলাদেশের গৌরবদীপ্ত তারুণ্যের কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ-র এই বিস্ময়কর রচনাটি আমার হস্তগত হবামাত্র আমি চমকে উঠি। এমন একটি শক্তিশালী নাটক এর আগে আমাদের দৃষ্টিগোচর হল না কেন? পঞ্চম ব্যাচের প্রযোজনা প্রকল্প হিসাবে তাই রুদ্র-র এই নাটকটি নির্বাচিত করে আমি ব্যক্তিগতভাবে এবং আমাদের থিয়েটার স্কুল প্রতিষ্ঠানগতভাবে কিছুটা হলেও দায়মুক্ত। রুদ্র-র এই নাটকটি তাঁর অযুতসম্ভাবনাময় কবিসত্তার স্বাক্ষর বহন তো করছেই, সেই সাথে এই সত্যটাকেও প্রতিষ্ঠিত করছে যে, একজন সমাজ ও রাজনীতি সচেতন কবির দেশ ও দশের প্রতি কমিটমেন্ট থাকা অতীব জরুরী। এই কাব্যনাটকে রুদ্র তার রাজনৈতিক বিশ্বাস অত্যন্ত চাঁছাছোলা প্রকাশ করেছেন। অনেকে তাঁর এই বিশ্বাসের সঙ্গে হয়ত একমত হবেন না। কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। কেননা একটা সার্থক নাটক হিসাবে “বিষ বিরিক্ষের বীজ” সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ।

কাব্যনাট্যটি ১৯৯৯ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটার’ কর্তৃক মঞ্চস্থ হয়। এরপর ২০০০ সালে ১৮ ফেব্রুয়ারিতে শিমুল মুস্তাফার নির্দেশনায় ‘বৈকুণ্ঠ আবৃত্তি একাডেমী’ কর্তৃক শওকত ওসমান মিলনায়তনে নাটকটি পরিবেশিত হয়।

গান

কৈশোরে কবিতার পাশাপাশি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ শতাধিক গানও লিখেছিলেন। রবীন্দ্র ও নজরুল সঙ্গীতের প্রভাবে রচিত সেসব গানের সুর সম্পর্কে কিছু জানা যায় নি। আশির দশক থেকে তিনি পুনরায় গানের বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এ সময় ধর্ষিতা শবমেহের, জগন্নাথ হলের ছাদ ধ’সে ছাত্রদের মৃত্যু, কবি বেঞ্জামিন মলয়েসির ফাঁসি, টোকাই, নূর হোসেন—এসব বিষয় নিয়ে বেশ কিছু গণসঙ্গীত রচনা করেন। ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠীর ৫টি ক্যাসেটে তা পরিবেশিত হয়। ক্যাসেটভুক্ত এসব গানের তালিকা নিম্নরূপ :

ক্যাসেটরুদ্রের গানসুর
শোকার্ত বাংলা :এই জীবন দিয়ে জানিয়েফকির আলমগীর
 কষ্টের কথা বলতে গেলেফকির আলমগীর
 নানান রঙের দালান উঠছেফকির আলমগীর
টোকাই :সংবাদপত্রের টোকাই না ভাইফকির আলমগীর
 সারাজীবন এই জীবনেরফকির আলমগীর
শৃঙ্খল মুক্তির গান :নূর হোসেনের রক্তে লেখাফকির আলমগীর
 রোমের রাজা বাঁশি বাজায়ফকির আলমগীর
শবমেহের :শবমেহেরের কপাল তার হাতেপান্না দাস
 ইচ্ছা ছিল মনে আশা ছিল মনেফকির আলমগীর
 এই দেহ বানাইছে আল্লায়পান্না দাস
 পাপ কারে কয় স‍ইফকির আলমগীর
সাম্য সুরের গান :ভাঙাচোরা মন, বলফকির আলমগীর
 মুক্তি পাক মুক্তি পাকফকির আলমগীর

১৯৮৯ সালের শেষ দিকে নিজ গ্রাম মিঠেখালিতে রুদ্র গ’ড়ে তোলেন গানের সংগঠন ‘অন্তর বাজাও’। এসময় গান লেখার পাশাপাশি গানের সুরও তিনি করেন। রুদ্রের রচিত ও সুরারোপিত গান নিয়ে তাঁর মৃত্যুর পর ‘রুদ্রের গান : ভালো আছি ভালো থেকো’ নামে একটি অডিও ক্যাসেট প্রকাশিত হয়—

রুদ্রের গান / ভালো আছি ভালো থেকো

প্রকাশ : ১৯৯৬। কথা ও সুর : রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। সংগীত পরিচালনা : রেশাদ। প্রযোজনা ও স্বত্ব : রুদ্র পরিবার। পরিবেশনা : মধুমতি ইলেকট্রনিক্স, ৩১/১ পাটুয়াটুলী, ঢাকা, ১১০০। সার্বিক তত্ত্বাবধানে : সুমেল সারাফাত।

ক্যাসেটে রুদ্রের গান সম্পর্কে লেখা হয়েছে—

মূলত কবি হিসেবে স্বীকৃত রুদ্র, নিভৃতে, সংবেদনশীলতার সাঁকো ধরে হাঁটতে গিয়ে শিল্পকলার আর একটি সৃজনী পথে পা রেখেছিলেন একদিন।

ধ্যানী বৈরাগ্য ও তীক্ষ্ণ অনুসন্ধিৎসা বুকের গভীর থেকে তুলে আনে যে বাউলের সুর, আবহমান বাংলার সেই সুরে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ বেঁধেছিলেন গানগুলি।

লিখেছেন সহজ সরল ভাষায়, সুর করেছেন আরও সহজ করে। পথ-চলতি মানুষ, ক্ষেতের চাষী, নির্মাণ শ্রমিক, শহুরে নাগরিক মন এক কাতারবন্দি হয়ে ওঠে যে ভাষায়- সুরে, রুদ্রের গান মানে সেইসব।

রুদ্রের গান, সব ধরনের কষ্ট স্বীকার করে যাঁরা কণ্ঠ দিয়েছেন, সহযোগিতা করেছেন যাঁরা— তাঁদের সকলের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।

ক্যাসেটভুক্ত গান :

এপিঠ

১. ও নিঠুর দরিয়ার পানি – সুবীর নন্দী

২. দিন গেল দিন গেলরে – খালিদ

৩. অন্তর বাজাও – এম. এ. খালেক

৪. ছিঁড়িতে না পারি – শুক্লা দে

৫. আমার ভিতর বাহিরে – রফিকুল আলম

৬. দরোজাটাকে খোলা – শাহীন খান

ওপিঠ

১. ঘেরে ঘেরে ঘেরাও – গোলাম মহম্মদ

২. আমরা পাড়ি দেব – খালিদ হাসান মিলু

৩. বৃষ্টিবরন – শাওন

৪. হারানো সুর ফিরে এলো – মাহমুদুজ্জামান বাবু

৫. ভালো আছি ভালো থেকো – সাবিনা ইয়াসমিন

অগ্রন্থিত কবিতা

এ অংশে গ্রন্থিত হয়েছে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর অগ্রন্থিত কবিতা। ১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত রচিত এসব কবিতা রচনাসমগ্র-তে রচনাকালের ক্রম অনুসারে বিন্যস্ত হয়েছে। ‘অগ্রন্থিত কবিতা’ বলতে রুদ্রের গ্রন্থভুক্ত নয়, কিন্তু বিভিন্ন দৈনিক, সাহিত্যপত্র ও সংকলনে প্রকাশিত হয়েছে এবং অপ্রকাশিত— এমন কবিতাকেই বোঝানো হয়েছে। এসব কবিতার প্রকাশস্থান ও প্রকাশকালের তালিকাটি বেশ দীর্ঘ হওয়ায় তা এখানে গ্রন্থিত করা সম্ভব হল না। আগ্রহী পাঠক রুদ্রের প্রকাশিত কবিতার একটি তালিকা পাবেন— বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত তপন বাগচীর রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ জীবনীগ্রন্থে।

গল্প

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ রচিত ৯টি গল্প গ্রন্থিত হয়েছে এ অংশে। রুদ্রের জীবদ্দশায় প্রকাশিত ৪টি গল্পের প্রকাশস্থান ও প্রকাশকাল নিচে দেয়া হল :

১. নিজস্ব লড়াই— সাপ্তাহিক বিচিত্রা, ঢাকা, ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৯০

২. ইতর— সাপ্তাহিক পূর্ণিমা, ঢাকা, ২৫ জুলাই ১৯৯০

৩. সোনালি শিশির- ভারত বিচিত্রা, ঢাকা, অক্টোবর ১৯৯০

৪. উপন্যাসের খসড়া— কবিতার দশদিক, ঢাকা

চলচ্চিত্র কাহিনী

শেষ-জীবনে রচিত এ চলচ্চিত্র কাহিনীটির কোনো শিরোনাম রুদ্র দেন নি। ১৯৯০-৯১ সালের দিকে রচিত এ কাহিনীটি সম্ভবত কোনো ফরমায়েসি রচনা। রুদ্র এর পুনর্লিখনও শুরু করেছিলেন। কিছুদূর অগ্রসর হয়ে তা অসমাপ্ত অবস্থায় রেখে গেছেন। এখানে কবির প্রথম ও সমাপ্ত লেখাটিই গ্রন্থিত হয়েছে।

চিত্রনাট্য

বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস-জীবনের পটভূমি নিয়ে রচিত এ চিত্রনাট্যটি রুদ্র শেষ করতে পারেন নি। শিরোনামহীন ও তারিখবিহীন এ চিত্রনাট্যের রচনাকাল সম্ভবত ১৯৯০/১৯৯১ সাল।

সম্পাদকীয়, গদ্য ও বক্তৃতা

সম্পাদকীয় : ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় কবিতাপত্র ‘অনামিকার অন্য চোখ এবং চুয়াত্তোরের প্রসব যনত্রনা’।

১৯৭৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি সম্পাদনা করেন ‘অশ্লীল জোৎস্নায়’।

১৯৭৮ সালের মে মাসে রুদ্র, আলী রিয়াজ ও মঈনুল আহসান সাবের-এর যৌথ সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় প্রবন্ধ সংকলন ‘স্বরূপ অন্বেষা’। এ গ্রন্থের সম্পাদকীয়টি লেখেন রুদ্র।

গদ্য : এ অংশে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর ৭টি গদ্য গ্রন্থিত হয়েছে। এসবের মধ্যে প্রকাশিত ৫টি গদ্যের রচনাস্থান ও রচনাকাল নিম্নে উদ্ধৃত হল :

১. ‘এক দশকের কবিতা’, কণ্ঠস্বর, ঢাকা, মার্চ ১৯৭৬

২. ‘নব্য জসীমিজম ও বহমান লোককাব্যধারা’, একবিংশ, ঢাকা, ১৯৮৮

৩. ‘প্রতিক্রিয়া’, মাসিক ডাইজেস্ট, ঢাকা, সেপ্টেম্বর ১৯৯০

৪. ‘জাতীয় কবিতা পরিষদের ভূমিকা’, পরিচয়, ঢাকা, সেপ্টেম্বর ১৯৯০ ৫. ‘ভিন্নস্বর অন্যমত’, দৈনিক সংবাদ, ঢাকা, ১৪ জুন ১৯৯১

গ্রামের বাড়ি মিঠেখালিতে রুদ্রের প্রতিষ্ঠিত ‘অগ্রদূত ক্রীড়া চক্রে’র ঘোষণাপত্রটি এখানে গ্রন্থিত হল। গ্রন্থিত হল অসমাপ্ত এবং অপ্রকাশিত আরো দুটি লেখা “বাংলাদেশের কবিতা’ সংকলন প্রসঙ্গে” ও “কাফের লেখকদের সম্পর্কে’। ‘অন্যান্য গদ্য’ শিরোনামের অন্তর্ভুক্ত ১নং অংশটি প্রকাশিত হয়— দৈনিক চিত্রালী (৪ নভেম্বর ১৯৭৭) এবং ২নং অংশটি প্রকাশিত হয় ‘পদাবলীর অষ্টম কবিতা-সন্ধ্যা’ স্যুভেনিরে (৩১ আগস্ট ১৯৮২)। ৬নং একটি লিফলেট। ১৯৯১-এর নির্বাচনে মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে নিজ এলাকায় রুদ্র এই লিফলেটটি প্রচার করেন।

বক্তৃতা : এ পর্বে গ্রন্থিত হল ৩টি বক্তৃতা। রুদ্রের পাণ্ডুলিপিতে এ বক্তব্য তিনটির খসড়া পাওয়া গেছে।

পত্রগুচ্ছ

এ অংশে গ্রন্থিত রুদ্রের পত্রের সংখ্যা ১৭। ১৫, ১৬ ও ১৭ নং চিঠি বাদে বাকি চিঠিগুলো প্রকাশিত হয়েছে প্রামাণ্য রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, রোদের সকাল সকালের রোদ গ্রন্থে এবং মানব জমিন (ঈদ সংখ্যা, ২০০৪) ও অভিমত (ঈদ সংখ্যা, ২০০৪) পত্রিকায়।

প্রস্তুতি পর্বের রচনা

এ অংশে ১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালে রচিত রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কবিতা, গান, গল্প, গদ্য ও নাটিকা থেকে নির্বাচিত রচনাংশ গ্রন্থিত হয়েছে। ১৯৭২ সাল থেকেই রুদ্র লেখালেখির প্রতি পূর্ণ মনোযোগী হয়ে ওঠেন। ‘৭২-এর পূর্বে তারিখবিহীন ‘আমার দেশ’ ও ‘মেঘনা’ নামে দুটি কবিতা কবির পাণ্ডুলিপিতে পাওয়া গেছে। হাতের লেখা থেকে ধারণা করা যায়— এ কবিতা দুটি কবির ১১/১২ বছর বয়সের রচনা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *