প্রস্তুতি পর্বের রচনা (গল্প)

প্রস্তুতি পর্বের রচনা (গল্প)

বুভুক্ষু সে দিন

একাদশীর বাঁকা চাঁদটা ধীরে ধীরে বড় শিমুল গাছটার ওপরে উঠে এসেছে। স্নিগ্ধ আলোকে সমস্ত গ্রামটা একটা অস্পষ্ট সৌন্দর্যের লীলানিকেতন মনে হচ্ছে। ভাঙা ভিতে, আবার ছোট ছোট নতুন নতুন ঘর উঠেছে। আগের সেই পোড়া বীভৎস রূপটা এখন ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে গেছে। পুকুর পাড়ে সেই নিম গাছটায় সকাল বেলা আবার মাছরাঙা এক ধ্যানে বোসে থাকে, বকগুলো ঠিক আগের মতো বিল জুড়ে উড়ে এসে পড়ে।

ধুসর বেলে পথটা সাপের পিঠের মত চক্‌চক্ করছে। রাত্রি দ্বিপ্রহর। গাছগুলো শ্রান্তিতে ঝিমাচ্ছে। পথের পাশে ননী গোপালের বাড়ি। মাস সাতেক হলো ভারত থেকে দেশে ফিরেছে। দেশে ফিরেছে বটে কিন্তু একা; তার স্ত্রী, ঠিক দেবদূতের মতো তার ছোট ছোট দুটি সন্তান, তার মা-বাবা এরা কেউই আসেনি। জিজ্ঞেস করলে বলে— জানিনে। হঠাৎ দেখলে শিউরে উঠতে হয়। সে ননী বাবু আর নেই। তার অভিনয়ের ভঙ্গিতে কথা বলা, চলন— যেন দুরন্ত এক স্রোতস্বিনী আজ স্রোত-হারা হয়ে পড়েছে। সত্যি কান্না পায় ননী বাবুকে দেখলে।

মোড়লের বাড়ি মিটিং বসেছিলো—ভাঙলো মাঝরাতে। পথ দিয়ে একা একা আসতে গা-টা কেমন ছম্ ছম্ করছিলো। বারবার আশেপাশে সামনে পেছনে তাকাতে তাকাতে চলছিলাম। মনে মনে ভাবছি যেভাবে ডাকাতের উপদ্রব বেড়ে চলেছে তাতে গাঁয়ে বাস করা যাবে বোলে মনে হয় না। আবার ভয় হচ্ছিলো এই রাত দুপুরে আবার কোনো ডাকাত দলের সাথে যদি দেখা হয় তাহলে তো গেছি…। শংকিত মনে চলতে চলতে হঠাৎ দূরে মনে হলো একটা আলো জ্বলছে মিটমিট কোরে। থমকে দাঁড়ালাম, ডাকাত-টাকাত নয় তো। একটু ভালো কোরে অনুমান কোরে দেখলাম, না আলোটা কোনো ঘরের বারান্দায় জ্বলছে। অতএব নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। ক্রমে ক্রমে কাছে আসতে আসতে দেখলাম— আশ্চর্য, ননী বাবুর ভাঙা ভিতের এক কোনায় চাটাই দিয়ে ঘেরা একটা ঘরের মতো তৈরি স্থানে ননী বাবু বোসে আছেন আকাশের দিকে তাকিয়ে। আরো নিকটে এলাম, দেখলাম সামনে একটা মাটির পাত্রে ধুপ জ্বলছে, পাশে এক গোছা কালো চুলের মতো কী যেন রাখা

একেবারে নিকটে এলাম, আস্তে আস্তে পেছনে এসে দাঁড়ালাম। ওকে ডাকতে আমার কেমন যেন ভয় হলো। তবুও শেষ পর্যন্ত ডাক দিতে মনস্থ করলাম। ধুপের ধুসর ধোঁয়া ননী বাবুর সমস্ত অঙ্গ ঘিরে যেন প্রনাম করছে, তারপর ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে শূন্যে। চাঁদটা আরো উজ্জ্বল হয়েছে— আগের অস্পষ্ট অনেক কিছুই এখন পরিষ্কারভাবে পরিস্ফুটিত হয়েছে। হাতের ছাতাটা পাশে রেখে পায়ের আঙুলের উপর ভর কোরে বসলাম। একটু সাহস এনে বল্লাম ‘ননী বাবু এতো রাতে আপনি এখানে কী করছেন?’ হঠাৎ ভূত দেখার মত চমকে উঠলেন। ‘কে, কে তুমি? কি চাও?’

ঘাবড়ে গেলাম, এমন শান্ত মিষ্টিভাষী লোকের যে এতো দারুন কর্কশ স্বর হতে পারে আমি কল্পনাও করতে পারিনি।

আমি… মানে… আ…মি…।

লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো একদম আমার মুখের কাছে। দু-পা পিছিয়ে গেলাম ভয়ে। হঠাৎ যেন তার সমস্ত আক্রোশ আতংক স্তিমিত হয়ে গেল, নিজের স্থানে বসতে বসতে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বল্লেন ‘ও আপনি!’ আমি কিছু বলতে পারলাম না, চুপ কোরে রইলাম। ধুপের পাত্রটার মধ্যে কিছু নারকেলের খোসা দিতে দিতে বল্লেন ‘তা আপনি এতো রাতে এখানে কি জন্য এসেছেন?’ মনে হলো সে কন্ঠস্বর অনেক চেনা সেই আগেরকার ননী বাবুর— যে ননী বাবু কথায় কথায় হাসতেন, সুন্দর কোরে অভিনয়ের ঢং-এ গুছিয়ে গুছিয়ে কথা বলতেন। আমরা তখন নবম কি দশম শ্রেনীতে পড়ি। প্রায়ই উনি আসতেন আমাদের স্কুলে— যখন টিফিন হতো। সে কি গল্প। কখনও হাসাতে হাসাতে পেটে খিল ধরিয়ে দিতেন, আবার কখনও কখনও তার গল্পের নায়ক বা নায়িকার বেদনায় আমাদের চোখও ছল ছল কোরে উঠতো।

ভাবলাম জিজ্ঞেস করি যে তার পরিবারের কী হয়েছে। কিন্তু কেন জানি পারলাম না। আরো একটা জিনিশ লক্ষ্য করলাম উনি আমায় আপনি বোলে সম্বোধন করছেন। অথচ আমি উনার চেয়ে অনেক ছোট। এই তো সেদিনও তো বল্লেন “কীরে পাঞ্জাবি সৈন্যের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরবি তো?”

আমি বলেছিলাম “নিশ্চয়ই”।

হঠাৎ কোরে বোলে ফেল্লাম “ননীবাবু আমায় বলবেন আপনার কী হয়েছে?”

ফ্যাল ফ্যালিয়ে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। আমিও কেমন যেন হতবাক হয়ে রইলাম। দেখলাম ঠোঁট দুটো অসম্ভব ভাবে কাঁপছে। যেন প্রবল জলোচ্ছাস সামনে বাধা পেয়ে গুমরে গুমরে উঠছে।

“আপনার যদি কষ্ট হয় বলতে, দরকার নেই আমার শোনার।”

ইঙ্গিত কোরে বসতে বল্লেন আমায়। বসলাম তার সামনে। আকাশে বোধহয় ধীরে ধীরে মেঘ জমছে। অনেকটা আঁধার হয়ে এসেছে।

ননী বাবু গম্ভীর কন্ঠে বোলে চল্লেন “যেদিন প্রথম মিলিটারি এলো গ্রামে প্রথমেই খবর পেয়েছিলাম। বাড়ির সবাইকে নিয়ে পালিয়ে গিয়ে উঠলাম পাশের গ্রামে। কারন আমাদের ভয় ছিলো বেশি— আমরা হিন্দু। কিন্তু আমাদের ভুল হলো। সে গ্রামে আগে থেকেই মিলিটারি এসে পড়েছিলো। গ্রামের ভিতর উঠতেই কে যেন দেখিয়ে দিলো, ঐ যে হিন্দুরা পালিয়ে যাচ্ছে। কী হলো বলতে পারি না। পাশে বাবা লুটিয়ে পড়লো, ছোট ছেলেটাকে কোলে নিয়ে দৌড় দিলাম, জ্ঞান ছিলে না। পেছনে দু’তিন বার একটা করুন আর্তনাদ শুনলাম, কিন্তু ফিরে তাকাতে পারলাম না। দৌড়াতে দৌড়াতে অনেক দূরে এসে পড়লাম, দেখলাম ওরা কেউ নেই। ছোট ছেলেটা ক্ষুধায় কাঁদতে লাগলো। কী খেতে দেবো! চারিদিক একবার তাকালাম, দেখলাম কোনো বাড়িঘর নেই, শুধু কতোগুলো পোড়া ভিত খাঁ খাঁ করছে। অসহায়ের মত ছেলেটাকে একটা গাছের ছায়ায় শোয়ায়ে রেখে দূরে একটা নারকেল গাছ দেখে তার কাছে ছুটলাম। কিন্তু নিয়তি—নারকেল গাছের কাছে পৌঁছানোর আগেই দেখলাম সে গাছের তলে কতোগুলো মিলিটারি বোসে আছে। আমি তখন এতো কাছে এসে পড়ছি যে আর পেছনে পালাতে পারছি না। ওরা তখনও আমায় লক্ষ্য করেনি। নিজেদের গল্পে মেতে আছে।

হঠাৎ কী ভাবলাম জানি না, মনে পড়লো খানিক আগে আমার মা, বাবা, স্ত্রী ও বড় ছেলের বিয়োগের কথা। মনে হলো আমায় যদি ওরা মেরে ফেলে তাহলে ছোট ছেলেটাকে বাঁচাতে পারবো না। হঠাৎ দিলাম দৌড় কিন্তু কোনদিক দৌড়াচ্ছি প্রথমে খেয়াল করতে পারিনি। পেছনে বার কয়েক গুলির আওয়াজ শুনলাম, এক সময় ক্লান্ত হয়ে থামলাম। কিন্তু এ কোথায়! সে গাছও নেই, মনে পড়লো ছেলেটাকে রেখেছিলাম গাছের ছায়ায়। আবার ফিরে চল্লাম পেছনে, কিন্তু হায়। পাগলের মত দুদিন এভাবে চল্লাম তবু সে স্থানে আর ফিরে যেতে পারলাম না। আমার বেনু, আমার বেনু…”

ডুকরে কেঁদে উঠলেন ননী বাবু। এতোক্ষন অভিভূত হয়ে শুনছিলাম, চমক ভাঙলো, ধীরে ধীরে জিজ্ঞেস করলাম ‘তারপর আর কোনো সন্ধান পাননি?’ চোখ মুছতে মুছতে উত্তর দিলেন “না।”

একটা প্যাঁচা ক্যাচ ক্যাচ করতে করতে পাখা জাপটে মাথার উপর দিয়ে চ’লে গেল।

ননী বাবু উদ্ভ্রান্তের মতো তাকিয়ে রইলেন আকাশের দিকে। রিক্ততার বেদনা তার অন্তরের সবটুকু স্থান নিদারুনভাবে ক্ষত কোরে দিয়েছে। তার দিকে তাকাবার কেউই নেই। চাঁদটা তখন অস্ত গিয়েছে পশ্চিমের সুউচ্চ গাছটার তলে।

[রচনাকাল : ১৯৭২]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *