আমি সুচরিতা বলছি

আমি সুচরিতা বলছি

প্রমথেশ আমাকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল, আমাকে দেখে না বলে আমি ওকে দেখা দিলাম বলেই বোধ হয় ঠিক। ও আর মালবিকা গড়িয়াহাটায় একটা বড়ো দোকানে হাত ধরাধরি করে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। মস্ত একটা হল নিয়ে দোকানের শো-রুম। ওখানে দেশের ভিনরাজ্যের শাড়ি থেকে শুরু করে, বিছানার চাদর, রেডিমেড পোশাক এমনকী গৃহস্থালির নানান প্রয়োজনীয় জিনিসও পাওয়া যায়। এ ছাড়াও আছে মনোহারী বিভাগ। দোকানটার খুব নাম, খদ্দেরের ভিড় লেগেই আছে।

ওরা ওখানে কেন এসেছে আমি জানি। প্রমথেশ মালবিকাকে বিয়ে করতে চায়। মালবিকাও যে এ ব্যাপারে গররাজি তা নয়, তবে এখনও মনস্থির করতে পারেনি। ওর স্বামী মারা যাবার পর ও বড়ো নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছে। একটা সন্তান থাকলেও কথা ছিল, কিন্তু ভগবান সেদিক থেকেও ওকে বঞ্চিত করেছেন। ওর এখন একটা অবলম্বন দরকার। ওখানে ওরা কেনাকাটা করতে এসেছিল।

মালবিকা কিন্তু আমাকে দেখতে পায়নি। ও হাসতে হাসতে প্রমথেশকে কী-একটা কথা বলল কিন্তু প্রমথেশের দিক থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে ও মুখ ফিরিয়ে তাকাল, তারপর প্রমথেশের বিস্ফারিত দৃষ্টি লক্ষ করে ভ্রূকুটি করে বলল, ‘কী, ভূত দেখেছ নাকি, চোখ-মুখের চেহারা সেরকমই দেখাচ্ছে।’

‘মনে হল সুচরিতাকে দেখলাম,’ অস্ফুট কণ্ঠে জবাব দিল প্রমথেশ।

‘সুচরিতা!’ মালবিকা অবাক হয়ে বলল, ‘তুমি কি জেগে স্বপ্ন দেখছ নাকি! সুচরিতা এখানে আসবে কোথা থেকে! সে তো…’

‘আমি স্পষ্ট দেখলাম,’ প্রমথেশ ওর কথা শেষ হবার আগেই বলে উঠল, ‘কী আশ্চর্য!’

‘কাকে দেখতে কাকে দেখেছ,’ মালবিকা বলল, ‘তোমার আজকাল দেখছি খুব মনের ভুল হয়, আগে তো এমন ছিল না।’

আমার হাসি পেল। আমরা চারজন অর্থাৎ আমি, মালবিকা, প্রমথেশ আর দেবজ্যোতি এই চারজন কলেজে পড়ার সময় বন্ধু ছিলাম। একই কলেজে পড়ার সুবাদে আমাদের সম্বোধন ‘তুমি’ থেকে ‘তুই’তে এসে দাঁড়িয়েছিল। ওরা এখন বিয়ে করবে বলে নতুন করে ‘তুমি’ অভ্যেস করছে।

কলকাতার উপকণ্ঠে একটা কো-এড কলেজে আমরা পড়তাম। আমার বাবা ছিলেন ইস্কুল মাস্টার। তা ছাড়া বাড়িতে ছাত্র পড়াতেন। আমাদের অবস্থা মোটামুটি বলা যায়। আমার পরে আরও দুই ভাই। আমার গায়ের রং ময়লা, রোগা চেহারা, তাই আমার বিয়ে হওয়া যে মুশকিল তা আমি জানতাম। আমাকে ভবিষ্যতে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে এটাও আমার অজানা ছিল না, তবে পড়াশুনায় আমি ভালোই ছিলাম।

মালবিকা সুন্দরী, ওদের বাড়ির অবস্থা খুব ভালো। তার জন্য ওর মধ্যে কোনো অহংকার ছিল না, বরং আমি লেখাপড়ায় ভালো বলে ও আমাকে একটু সমীহই করত। আমরা দু-জনে মনের কথা অকপটে খুলে বলতাম।

কলেজে নিজেদের ক্লাসের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে যেমন আলাপ থাকে, প্রমথেশ আর দেবজ্যোতির সঙ্গে আমাদের তেমন আলাপই ছিল। পরে আস্তে আস্তে ওরা আমাদের বন্ধু হয়ে ওঠে। তবে প্রমথেশ যে গোড়া থেকেই মালবিকার রূপে মুগ্ধ সেটা না বোঝবার মতো বোকা আমরা ছিলাম না, এ নিয়ে আমি আর মালবিকা আড়ালে হাসাহাসি করতাম।

প্রমথেশের কিন্তু বেশ পুরুষালি চেহারা, মেয়েরা ওর দিকে আড়চোখে তাকাত। আমরা ওকে ‘মদনদেব’ বলে ঠাট্টা করতাম আর ও অপ্রস্তুতের হাসি হাসত। ওর বাবা রাইটার্সে কেরানির কাজ করতেন, বাড়ির অবস্থা তেমন ভালো ছিল না।

দেবজ্যোতির ছোটোখাটো চেহারা কিন্তু ও ছিল খুব শার্প আর মেধাবী ছাত্র। ওর মধ্যে কোনোরকম ন্যাকামি আমি কখনো দেখিনি। সব ব্যাপারেই ও ছিল সিরিয়াস। ওর বাড়ির অবস্থা ছিল বেশ সচ্ছল।

আগেই বলেছি আমাদের কলেজ ছিল কলকাতার উপকণ্ঠে। আমি থাকতাম সোদপুর, মালবিকা দমদম, প্রমথেশ হালিশহর আর দেবজ্যোতি কাঁকিনাড়া।

আমাদের কলেজ থেকে একটু দূরে একটা মাঠ ছিল। সেখানে গোরু ছাগল চরে বেড়াত। দু-একজন রাখল ওখানে গোরু নিয়ে আসত। মাঠের একপ্রান্তে একটা পোড়োমন্দির ছিল। আসলে মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ কিন্তু ভেতরে কিছু অংশ অক্ষত ছিল। গোটা দুই পিরিয়ড অফ থাকলে কিংবা কোনো কারণে তাড়াতাড়ি কলেজ ছুটি হয়ে গেলে আমরা চারজন ওখানে চলে যেতাম, চাতালে বসে আড্ডা মারতাম আর বাদাম ভাজা খেতাম।

কলেজ থেকে বেরিয়ে আমি ইউনিভার্সিটিতে ভরতি হলাম। মালবিকা আর পড়ল না। শুনলাম ওর বিয়ের কথাবার্তা চলছে।

প্রমথেশ চাকরির জন্য উঠে-পড়ে লাগল। একটা চাকরি পেয়েও গেল। আসামের এক চা বাগানে কুলিকামিনদের সুপারভাইজারের চাকরি। ওই চা বাগানের ডাক্তার ছিলেন ওর মা-র মামাতো দাদা। তাঁর সুপারিশ আর প্রমথেশের পুরুষালি চেহারা, এই দুটো চাকরি পেতে সাহায্য করল ওকে। ওখানে যাবার পরেও কিছুদিন ও আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিল, তাতেই জেনেছিলাম ওর সেই মামাবাবু চাকরি থেকে অবসর নিয়ে কলকাতা চলে গেছেন। ও বড়ো একা হয়ে পড়েছে, আর কোনো বাঙালি নেই ওখানে। তারপর আস্তে আস্তে ওর চিঠি আসা কমতে কমতে বন্ধ হয়ে গেল।

দেবজ্যোতি ব্যাঙ্গালোরে ইলেকট্রনিক্স নিয়ে পড়ার সুযোগ পেয়ে চলে গেল। আমাকে ইউনিভার্সিটিতে পড়তে যেতে হত, তা ছাড়া পড়াশুনার চাপ, নানান কাজ, বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার সময় হয়ে উঠছিল না।

বছরখানেক পর মালবিকার বিয়ে গেল। ও আমাদের তিন বন্ধুকেই নেমন্তন্ন করেছিল কিন্তু প্রমথেশ আর দেবজ্যোতি আসতে পারেনি।

মালবিকার ভালো বিয়েই হয়েছিল। বর ইঞ্জিনিয়ার। বিয়ের পর বরের সঙ্গে ও নাসিকে চলে গেল।

কিছুদিন পরে আমি একটা চাকরি পেয়ে গেলাম, তার জন্য আমাকে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বসতে হয়েছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের মানবসম্পদ মন্ত্রকের অধীনে সমাজকল্যাণ বিভাগে চাকরি। গোটা পূর্বাঞ্চলের সদর দপ্তর হল কলকাতায়। সেখানেই আমার পোস্টিং। তবে বাইরে বাইরে ঘুরতে হবে, বিশেষ করে যেসব অঞ্চলে অনুন্নত সম্প্রদায় মানুষের বাস, সেখানে তাদের মধ্যে গিয়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে হবে। আমার পদ হল ফিল্ড অফিসার। কয়েক মাস শিক্ষানবিশ থাকার পর আমাকে ফিল্ড ওয়ার্কে যেতে হল। বছর দুই কেটে গেল, তারপর আমার কাজ পড়ল অসমের এক চা বাগানে, যেখানে কুলিকামিনদের অধিকাংশই আদিবাসী বা অনুন্নত সম্প্রদায়ের মানুষ। তাদের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থা খতিয়ে দেখে আমাকে একটা রিপোর্ট দাখিল করতে হবে। এই সম্প্রদায়ের মধ্যে শিক্ষা এবং নানারকম সামাজিক সুযোগ সুবিধে বিস্তারের সুপারিশ থাকবে সেই রিপোর্টে। ওই চা বাগানেই কাজ করে প্রমথেশ। কলকাতার আপিস থেকেই ওখানে আমার থাকার ব্যবস্থা হল, তা ছাড়া ওখানকার আঞ্চলিক দপ্তরের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হল যাতে আমার কোনো অসুবিধে না হয়। আমি অবিশ্যি প্রমথেশকে চিঠি লিখে আমার ওখানে যাবার কথা জানিয়ে দিলাম।

আমি কিন্তু একা যাইনি, আমার সঙ্গে আরো দু-জন সহকর্মী ছিল, তারা অবিশ্যি পুরোনো কর্মচারী এবং অভিজ্ঞ।

ওখানে পৌঁছে দেখলাম চা বাগানটা শহর থেকে বেশ দূরে। শুধু বাগিচার ম্যানেজার, আপিসের কিছু লোকজন আর কুলিকামিনরাই ওখানে থাকে। তাদের সংখ্যা অবিশ্যি কম নয়। তবে চা বাগিচার এলাকার চারপাশে আদিবাসী আর অনুন্নত সম্প্রদায়ের অনেক মানুষের বাস। তাদের জীবিকাও নানারকম। শিক্ষা, চিকিৎসা এসব সুযোগ সুবিধে থেকে তারা বঞ্চিত।

এদের নিয়েই আমাদের কাজ করতে হবে, একটা সুষ্ঠু পরিকল্পনা ছাড়া এদের মঙ্গলের জন্য কিছু করা সম্ভব নয়।

যেদিন আমরা গিয়ে পৌঁছুলাম তার পরের দিন থেকেই আমরা কোমর বেঁধে কাজে নেমে পড়লাম। ওদের দিক থেকেও এ ব্যাপারে খুব উৎসাহ দেখা গেল।

কাজের মধ্যে এমন ডুবে ছিলাম যে, প্রমথেশের কথা একেবারেই মনে ছিল না। যখন মনে পড়ল তখন অবাক হয়েই ভাবলাম ওকে চিঠি দেওয়া সত্ত্বেও আমার সঙ্গে ও দেখা করল না কেন! ও কি ওখানে নেই! খোঁজ করতেই জানতে পারলাম আমার ধারণা ভুল, গত চার বছরের ওপর ও ওখানে চাকরি করছে, একবারও ছুটি নিয়ে দেশে যায়নি। সেদিনই বিকেলে কাজকর্ম চুকে যাবার পর আমি ওর বাড়ি গেলাম, চা-বাগানের এক কামিনই আমাকে ওর বাড়ি পৌঁছে দিল।

প্রমথেশ ঘরের ভেতর ছিল। বাইরে দুটি বাচ্চা খেলা করছিল। ধুলোবালিতে মাখামাখি, দেখেই বোঝা যায় আদিবাসী সন্তান।

আমার ডাকাডাকিতে প্রমথেশ বেরিয়ে এল। আমাকে দেখে ওর মুখ কেমন যেন হয়ে গেল। আমি দেখলাম ওর রং ময়লা হয়ে গেছে, চেহারায় আগের মতো জৌলুস নেই, রোগাও হয়েছে।

‘কী রে,’ আমি বললাম, ‘তোকে চিঠি দিয়েছিলাম, দেখা করলি না, এখন মনে হচ্ছে আমাকে দেখে খুশি হোসনি।’

‘আয়, ভেতরে আয়,’ ও যেন কষ্ট করে মুখে হাসি টেনে বলল।

ও আমাকে ঘরের ভেতর নিয়ে গেল।

ঘরে আসবাব তেমন নেই, তবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। আমাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে ও আমার মুখোমুখি বসল, তারপর বলল, ‘আমি তোর চিঠি পাইনি তো।’

আমার কেন যেন মনে হল ও সত্যি কথা বলল না।

‘কিন্তু আমি এখানে এসেছি সে-খবরটাও কি পাসনি?’ আমি অনুযোগের সুরে বললাম।

‘কলকাতা থেকে তিনজন এসেছে আদিবাসীদের ব্যাপারে, তাই শুনছি,’ প্রমথেশ বলল, ‘তার মধ্যে তুই আছিস কেমন করে জানব!’

‘তবে কলকাতা থেকে লোক এল, তাদের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে হল না?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম। ‘এখানে একা একা পড়ে আছিস, কলকাতার খবর জানতে ইচ্ছে করে না?’

‘আমি তো কলকাতার লোক নই।’ প্রমথেশ একটু হাসবার চেষ্টা করল, ‘আমার বাড়ি হল হালিশহর।’

ঠিক সেই সময় বাইরের বাচ্চা দুটো ঘরের ভেতর এল, ছোটোটা প্রমথেশের কোলে চেপে বসল। আমি তো অবাক। প্রমথেশ তাড়াতাড়ি তাকে কোল থেকে নামিয়ে আমার দুর্বোধ্য ভাষায় ওদের কিছু বলল, মনে হল বকল।

আর তখুনি ঘরে ঢুকল আঁটোসাঁটো চেহারার এক আদিবাসী রমণী। গায়ের রং তামাটে, কিন্তু চেহারায় চটক আছে।

ছোটো বাচ্চাটাকে কোলে তুলে সে প্রমথেশের দিকে তাকিয়ে কী যেন বলল, তারপর আমার দিকে কৌতূহলের দৃষ্টিতে তাকাল।

‘কে এ?’ আমি না জিজ্ঞেস করে পারলাম না।

‘এই…আমার কাজকর্ম করে,’ প্রমথেশ একটু আমতা আমতা করে জবাব দিল।

আমার কিন্তু সন্দেহ হল। বড়ো বাচ্চাটার মুখের সঙ্গে প্রমথেশের মুখের সাদৃশ্য চোখে না পড়ার মতো নয়। এমনকী প্রমথেশের বাঁ-থুতনির আঁচিলটা পর্যন্ত বাচ্চাটা পেয়েছে।

‘মিথ্যে কথা কেন বলছিস,’ আমি একটু ধমকের সুরেই বললাম, ‘বড়োটা যে তোরই ছেলে তা দেখেই বোঝা যায়।’

অপরাধী ধরা পড়লে মুখের যেমন অবস্থা হয়, তেমন ভাব ফুটে উঠল প্রমথেশের চোখে-মুখে, তারপর মেয়েটির দিকে তাকিয়ে কী যেন বলল। সে ঘাড়া নেড়ে বাচ্চা দুটিকে নিয়ে ভেতরে চলে গেল। কমলেশ এবার বলল, ‘তুই ঠিকই ধরেছিস, আমি ফেঁসে গেছি রে।’

‘ফেঁসে গেছিস মানে!’ আমি একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

‘মানে,’ একটু ইতস্তত করে প্রমথেশ বলল, ‘এখানে একা থাকতাম, খাওয়া-দাওয়ার অসুবিধে হচ্ছিল তাই মেয়েটিকে রেখেছিলাম। কিন্তু ফেঁসে গেলাম। মেয়েটি একদিন বলল ওর বাচ্চা হবে। আমি ওকে কিছু টাকা দিয়ে বিদেয় করতে চেয়েছিলাম কিন্তু ওদের সমাজ এসব ব্যাপারে ভীষণ কড়া। তারা বলল মেয়েটিকে বিয়ে করতে হবে নইলে ওরা আমাকে ছাড়বে না। এমনকী ম্যানেজারের কাছে ওদের মেয়েকে নষ্ট করার অভিযোগ এনে আমার শাস্তি দাবি করবে বলে শাসাল। আমাকে বাধ্য হয়েই বিয়ে করতে হল।’

‘বাধ্য বলছিস কেন!’ আমি একটু রাগত কণ্ঠেই বললাম, ‘তোর শিক্ষা, দীক্ষা, রুচি এসব জলাঞ্জলি দিয়ে মেয়েটার সর্বনাশ করেছিলি তখন পরিণামের কথা মনে হয়নি!’

‘তুই আর কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিসনি সুচরিতা।’

প্রমথেশ বলল, ‘আমি জ্বলছি নিজের জ্বালায় আর তুই আমাকে জ্ঞান দিচ্ছিস।’

‘জ্ঞান নয়,’ আমি বললাম, ‘তোর মতো পুরুষমানুষদের জন্য আমার করুণা হয়। মানুষ হয়ে জন্মেছিস, নিজের ওপর সামান্য নিয়ন্ত্রণও থাকবে না! একটা অবলা নারীর সর্বনাশ করে এখন বলছিস ফেঁসে গেছিস। এই তোদের পৌরুষ!’

‘সে তুই যাই বলিস,’ প্রমথেশ বলল, ‘আমি এখান থেকে চলে যাব, এই নরক থেকে আমাকে মুক্তি পেতেই হবে।’

‘আর তোর বউ, বাচ্চা দুটোর কী হবে?’

‘কী আর হবে। মেয়েটা খেটে খাবে, এখানে ওদের সম্প্রদায়ের সব মেয়েই কাজ করে, কেউ বসে থাকে না। তা ছাড়া ওদের জাতের লোক ওকে দেখবে, আমাদের মতো নয়।’

‘তার মানে তুই ওদের ফেলে পালিয়ে যাবি!’

‘তুই পাগলের মতো কথা বলছিস।’ প্রমথেশ এবার একটু উষ্মার সঙ্গে বলল, ‘ওদের নিয়ে আমি দেশে ফিরতে পারব! আমাদের সমাজ গ্রহণ করবে ওদের। তা ছাড়া এ জায়গা ছেড়ে ও কোথাও যাবে না, নিজেদের লোকজনের মধ্যে থাকতেই ওরা ভালোবাসে। এখান থেকে কয়েক মাইল দূরে শহরেই যেতে চায় না, তো একেবারে পশ্চিম বাংলায়! তোর মাথা খারাপ হয়েছে।’

‘মাথা খারাপ আমার হয়নি,’ আমিও গলা চড়িয়ে বললাম, ‘তোর হয়েছে, তা না হলে ওদের ফেলে পালিয়ে যাবার কথা ভাবছিস, আমি তো ভাবতেই পারছি না।’

এই সময় মেয়েটি আবার ওখানে এল। একটা থালায় দু-পেয়ালা চা আর কিছু শুকনো খাবার নিয়ে এসেছে। আমার সামনে থালাটা নামিয়ে ও আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসল।

আমার বড়ো দুঃখ হল ওর জন্য। কিন্তু ওকে যে কিছু বলব তার উপায় নেই। ওদের ভাষা আমার কাছে যেমন দুর্বোধ্য, আমার ভাষাও তেমন ও বুঝতে পারবে না। ওদের মধ্যে কাজ করার সময় এমন একজন স্থানীয় লোকের সাহায্য আমাদের নিতে হয় যে ওদের ভাষা বোঝে। প্রমথেশ এ ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করবে না।

আমি যখন চলে আসব, প্রমথেশ আমাকে বলল, ‘তুই আমার সমস্যাটা একবারও ভেবে দেখলি না। সারা জীবন এখানে এই অশিক্ষিত, কুসংস্কারগ্রস্ত পরিবেশে আমাকে কাটাতে হবে। একটা ভুলের জন্য সারাজীবন আমাকে মাশুল দিতে হবে। একসময় আমরা বন্ধু ছিলাম, তোর কাছ থেকে একটু সহানুভূতি আশা করেছিলাম।’

এর কয়েকদিন পরেই আমি কলকাতায় ফিরে এলাম, আসার আগে প্রমথেশের সঙ্গে আর দেখা করলাম না।

তারপর কাজেকর্মে প্রমথেশের কথা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। কিছুদিন পর আমাদের কলেজের এক সহপাঠীর মুখে খবর পেলাম মালবিকার স্বামী মারা গেছে। আমাকে আবার আপিসের কাজে বাইরে যেতে হল, এবার উড়িষ্যার এক অনগ্রসর অঞ্চলে। সেখানে কিছুদিন থাকতে হল।

কলকাতার আপিসে ফেরার পর আরও কিছুদিন কেটে গেছে, হঠাৎ একদিন শিয়ালদহ স্টেশনে প্রমথেশের সঙ্গে দেখা। আমাকে দেখেই ও বলল, ‘আমি চলে এসেছি।’

‘চলে এসেছিস, না পালিয়ে এসেছিস,’ আমি বললাম, ‘বউ বাচ্চাদের পথে বসিয়ে এলি?’

‘না, পথে বসাব কেন।’ প্রমথেশ বলল, ‘শেষ পর্যন্ত পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে আমি মুক্তি পেলাম।’

‘মাত্তর পাঁচ হাজার টাকা!’ আমি যেন কথাটা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।

‘হ্যাঁ, ওটাই ওদের কাছে অনেক।’ প্রমথেশ বলল, ‘আমি বলেছিলাম ওখানে আমার শরীর টিকছে না, আমি দেশে ফিরে যাব। তখন ওদের সমাজ ওই টাকায় রফা করল। আমার সঙ্গে এখানে আসতে রাজিও ছিল না মেয়েটা।’

‘সেটা অবিশ্যি সে বুদ্ধিমতীর মতোই কাজ করেছে। আমি ঠেস দিয়ে বললাম, ‘তুই ওকে এখানে এনে হয়তো মেয়ে পাচারকারীদের হাতে তুলে দিতিস। অন্তত নিজের লোকজনের মধ্যে ও মানসম্মান নিয়ে থাকবে।’

তুই শুধু আমার দোষটাই দেখছিস,’ প্রমথেশ একটু অসহিষু; কণ্ঠে বলল, ‘তা ছাড়া আমার বিয়েটা একদিক দিয়ে বিয়েই নয়। ওদের জোরজবরদস্তিতে ওদের প্রথায় বিয়ে করতে হয়েছিল, সেটা আমাদের সমাজ বিয়ে বলে মানবে না।’

‘হুঁ! সব বুঝলাম, কিন্তু মেয়েটা এখন দু-দুটো বাচ্চা নিয়ে সারাজীবন কী করবে?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘ওদের সমাজ ওকে দেখবে, তা ছাড়া ওকে বিয়ে করার লোকও আছে। কোনো মেয়েকে তার স্বামী ছেড়ে গেলে, ওদের সমাজে তার আবার বিয়ের ব্যবস্থা আছে। মেয়েদের অধিকার সম্বন্ধে ওদের সচেতনতা অনেক বেশি, আমাদের মতো পুরুষশাসিত সমাজ নয়।’ তারপরই একটু বাঁকা হাসি হেসে ও বলল, ‘তা ছাড়া ওর হাতে এখন কড়কড়ে পাঁচ হাজার টাকা, ওকে বিয়ে করার পাত্রের অভাব হবে না।’

আমি ওর সঙ্গে এ নিয়ে আর তর্ক করতে চাইলাম না। আসলে আমার প্রবৃত্তি হল না।

‘মালবিকার খবরটা শুনলাম,’ প্রমথেশ কথার মোড় ঘুরিয়ে বলল, ‘ভেরি স্যাড। ও শিগগিরই ফিরে আসবে।’

‘ওর সঙ্গে আমার অনেকদিন যোগাযোগ নেই।’ এবার আমি একটু অপরাধীর মতো বললাম।

বিদায়ের আগে প্রমথেশ আমাকে বলল, ‘তোর কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে। বল রাখবি।’

‘না শুনে কী করে বলি।’ আমি জবাব দিলাম।

‘পুরোনো বন্ধুত্বের খাতিরেই তোকে অনুরোধ করছি, চা-বাগানের ঘটনা তুই কাউকে বলিস না। আমি অন্যায় করেছি তার জন্য শাস্তিও পেয়েছি, তুই এ নিয়ে আর জলঘোলা করিস না।’

‘দেখা যাবে।’ আমি জবাব দিয়েছিলাম।

তার পরেই আবার আমাকে ফিল্ড ওয়ার্কের জন্য বেরুতে হল। কিছুদিন ব্যস্ততার মধ্যে কাটল। কলকাতায় ফিরে এসে মাসকয়েক বিশ্রাম, আপাতত বাইরে যাবার কোনো পরিকল্পনা নেই। এই সময় খবরটা কানে এল আমার। প্রমথেশ আর মালবিকাকে একসঙ্গে দেখা যাচ্ছে। শোনা যাচ্ছে প্রমথেশ নাকি ওকে বিয়ে করতে চায়, মালবিকা এখনও মনস্থির করতে পারেনি, তবে শেষ পর্যন্ত বোধ হয় রাজি হয়ে যাবে।

খবরটা শুনে আমি স্তম্ভিত হলাম। মালবিকা আমার প্রাণের বন্ধু ছিল, প্রমথেশের মতো একটা চরিত্রহীন, দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষ ওকে বিয়ে করবে এটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারলাম না। মালবিকার কাছে ও যে চা-বাগানের ঘটনা চেপে গেছে সে-বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ ছিল না।

আমি ওর বাড়ির ঠিকানায় একটা চিঠি দিলাম। লিখলাম, যা শুনছি তা যদি সত্যি হয় তবে আমি মালবিকাকে সব জানাব।

সঙ্গেসঙ্গেই ওর জবাব এল। ও আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়। অনেক অনুনয় বিনয় করে লিখেছে, একবার আমার সঙ্গে কথা বলে তারপর ও সিদ্ধান্ত নেবে। তাড়াহুড়ো করে কিছু করবে না। এমনকী আমার কথা শুনতে ও রাজি। আমরা কলেজে পড়ার সময় যে পোড়োমন্দিরের চাতালে বসে আড্ডা মারতাম ও সে-জায়গায় দেখা করতে বলেছে। নিরিবিলিতে কথা বলার এমন জায়গা আর নেই। ওর সঙ্গে কথা না বলে আমি যেন হুট করে কিছু না করে বসি সেই অনুরোধও ছিল চিঠিতে। আমাদের দেখা করার কথাটাও যেন আমি গোপন রাখি একথাও লিখেছিল।

ওর কাকুতি ভরা চিঠিটা পড়ে আমার মায়াই হল, যতই হোক একসময় আমরা বন্ধু ছিলাম।

যেদিন চিঠিটা পেলাম তার দু-দিন পরেই দেখা করার কথা, বিকেল পাঁচটায়। আমার কোনো অসুবিধে ছিল না, আপিস থেকে একটু আগে বেরুলেই হবে। তবে ওই জায়গাটা ও বেছে নিল কেন তা আমার মাথায় ঢুকল না, নিরিবিলি জায়গা কি আর ছিল না!

যা হোক নির্দিষ্ট দিনে আমি ওখানে গেলাম। প্রমথেশ আগেই এসেছিল। ও আমাকে দেখে একগাল হেসে বলল, ‘যাক বাঁচালি, আমি ভেবেছিলাম শেষ পর্যন্ত হয়তো আসবি না, তুই যা মেজাজি।’

আমরা দু-জনে পাশাপাশি বসলাম। ও আমাকে বোঝাতে চেষ্টা করল ওর ফেলে-আসা জীবনটা একটা বিগত অধ্যায়, ও নতুন করে বাঁচতে চায়। মালবিকাকে ও কলেজ থেকেই অন্য চোখে দেখত, তবে বিয়ের প্রস্তাব তোলার মতো স্পর্ধা কোনোদিনই ওর হয়নি। মালবিকা বড়োলোকের মেয়ে সুন্দরী আর ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। এখন মালবিকা বদলে গেছে, স্বামীর মৃত্যুর পর ও এখন খুব একলা হয়ে পড়েছে তাই সাহস করে প্রমথেশ কথাটা পেড়েছিল। মালবিকা ওর প্রস্তাব উপেক্ষা করেনি। ও নিজেও এখানে এসে একটা চাকরি জুটিয়ে নিয়েছে, তা ছাড়া মালবিকার যা আছে তাতে কোনোদিন ওকে অন্যের ওপর নির্ভর করে চলতে হবে না। আমি যদি এখন ওদের মিলনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াই তবে দুটি জীবনই নষ্ট হয়ে যাবে!

কথা বলতে বলতে প্রমথেশ একটা খুব বড়ো রুমাল দু-হাতে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পাকাচ্ছিল। আমি সেদিকে তাকিয়ে বললাম, ‘ঠিক আছে, আমি বাধা হব না, তবে তুই মালবিকাকে সব খুলে বল, তারপর ও যদি তোকে বিয়ে করতে রাজি থাকে আমার কিছু বলার নেই।’

প্রমথেশ অধৈর্য কণ্ঠে বলল, ‘তোর সেই এক কথা, ওটা মন থেকে মুছে ফেলতে পারছিস না!’

‘কী করে পারব,’ আমি জবাব দিলাম, ‘আমি নিজে মেয়ে হয়ে আরেকজন মেয়েকে তুই যেভাবে পায়ে ঠেলে চলে এসেছিস তা কী করে মেনে নেব! এ তো নারী জাতির অপমান।’

‘তোর একগুঁয়েমিই তোর এই সর্বনাশের কারণ হবে,’ প্রমথেশের গলা এবার কঠিন শোনাল, ‘তোকে আমি সুযোগ দিয়েছিলাম কিন্তু তুই সেটা নিতে পারলি না।’

‘কী বলতে চাস তুই?’ আমার গলাও এবার চড়ল।

‘বলতে চাই, তোর মরণ তুই-ই ডেকে আনলি…’

হঠাৎ পাকানো রুমালটা আমার গলায় ফাঁসের মতো লাগিয়ে ও দু-হাতে মোচড়াতে লাগল।

এতক্ষণে আমি ওর মতলব বুঝলাম। কেন ও আমাকে এই নিরিবিলি জায়গায় দেখা করতে বলেছিল তাও আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল। এখানে ওর কুকীর্তির কোনো সাক্ষী থাকবে না। কিন্তু এ উপলব্ধিটা বড়ো দেরিতে হল আমার। ও শক্তিমান পুরুষ, বলিষ্ঠ দু-হাতে রুমালের দু-প্রান্ত ধরে ও টানছিল, আমার বাধা দেবার কোনো ক্ষমতাই ছিল না। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে, চোখ দুটো যেন ঠেলে বেরিয়ে আসছে, জিভও বেরিয়ে এসেছে…তারপর আর কিছু আমার মনে নেই।

যখন আমার হুঁশ হল, দেখলাম আমার হালকা শরীরটা শূন্যে ভাসছে, আর আমি যখন বেঁচেছিলাম সেই শরীরটা মাটিতে নিঃসাড়ে পড়ে আছে। প্রমথেশকে দেখতে পেলাম না।

এরপর আরও একটু কাহিনি আছে। আমার মৃতদেহ পরদিন সকালে একটি কিশোর ওখানে গোরু চরাতে গিয়ে ওখানকার লোকদের খবর দেয়, পুলিশ আসে।

প্রমথেশকে কেউ দেখেনি তাই তাকে সন্দেহ করার কোনো কারণ ছিল না। আমার ব্যাগে আমার পরিচয়পত্র, আরও সব কাগজ ছিল। তা থেকে পুলিশ আমার আপিস আর আমার বাড়িতে যোগাযোগ করেছিল, কিন্তু কেন আমি ওখানে ওই পোড়োমন্দিরে গিয়েছিলাম তা কেউ বলতে পারেনি। কী করে পারবে, আমি তো কাউকে প্রমথেশের সঙ্গে দেখা করতে যাবার কথা বলিনি, ওর অনুরোধ আমি রেখেছিলাম। তখন তো আর ওর অভিসন্ধি আমি বুঝিনি। আমার ওপর কোনো অত্যাচার হয়নি, ধস্তাধস্তির কোনো চিহ্ন ছিল না, তাই এই খুনের তদন্তে পুলিশ বিভ্রান্ত হয়েছিল। আমার কোনো শত্রু ছিল না, প্রেমিক ছিল না, আপিসের কাজে কোনো গোলমাল ছিল না, কোনো দিক দিয়ে এগোবার রাস্তা পেল না পুলিশ। ‘রহস্যময় হত্যা,’ কাগজে কাগজে এই মন্তব্যই করা হয়েছিল।

এই কাহিনি যেখানে শুরু হয়েছে, তা হল ওপরের ঘটনার পরের অধ্যায়। দু-মাস কেটে গেছে। আমার খুনের ব্যাপারটা এখন আর কোনো খবর নয়। এই দু-মাস আমার আত্মা অনেক কষ্ট পেয়েছে, কিন্তু আমি স্থিরপ্রতিজ্ঞ, মালবিকার সর্বনাশ হতে আমি দেব না। প্রমথেশের মুখোশ আমি খুলে দেবই দেব। অনেক ভেবেচিন্তে আমি একটা মতলব ঠাওরেছি। তারই প্রথম সূচনা ওই বিপণিতে প্রমথেশকে দেখা দেওয়া। ওর মানসিক সংযম আমি নষ্ট করে দেব। এমন চরম অবস্থায় ওকে আমি পৌঁছে দেব যে, শেষ পর্যন্ত ও স্বীকার করতে বাধ্য হবে আমাকে ও খুন করেছে।

প্রথম দিন আমাকে দেখে ভূত দেখার মতো ও চমকে উঠেছিল, কিন্তু ঘটনা তো তাই। ওকে আমি বার বার দেখা দেব, ওর মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে।

ওই ঘটনার কয়েকদিন পরে প্রমথেশ আর মালবিকা একটা রেস্তরাঁয় বসে খাচ্ছিল। সূর্য অস্ত গেছে অনেকক্ষণ। মালবিকা বিয়েতে সম্মতি দিয়েছে তবে ও একটু সময় চায়, অন্তত ছয় মাস। প্রমথেশ আবার দেরি করতে রাজি নয়, ওর ইচ্ছে তাড়াতাড়ি শুভ কাজটা হয়ে যাক। ওর ভয় আছে, আবার যদি কোনো বাধা আসে। ওরা খাচ্ছিল আর নীচু গলায় এই নিয়ে কথা বলছিল। হঠাৎ প্রমথেশ মুখ তুলে তাকাল আর ওর সর্বাঙ্গ যেন হিম হয়ে গেল। ওর কয়েক হাত দূরে একটা খালি টেবিলে বসে ওর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছিলাম আমি।

‘কী হল!’ মালবিকা প্রশ্ন করল।

‘কিছু দেখতে পাচ্ছ?’ প্রমথেশ কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল।

ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাল মালবিকা, তারপর বলল, ‘না তো, কী দেখার কথা বলছ?’

‘সুচরিতা…’ কোনোমতে উচ্চারণ করল প্রমথেশ।

‘সুচরিতা!’ রেস্তরাঁয় চোখ বুলিয়ে মালবিকা বলল, ‘আমার মনে হয় তোমার নার্ভের অসুখ হয়েছে কিংবা সুচরিতার কথা সবসময় তুমি ভাব। সেদিনও ওকে দেখার কথা বলেছিলে।’ তারপরই দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, ‘অত ভালো মেয়েটা! কে যে অমনভাবে ওকে খুন করল আর কেনই-বা করল কে জানে! ভগবান যেন সেই খুনিকে চরম শাস্তি দেন।’

প্রমথেশের সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল।

এরপর আরও কয়েকবার আমি প্রমথেশকে দেখা দিয়েছি, ব্যঙ্গভরে হেসেছি। আমি বুঝতে পারছি ওর মানসিক দৃঢ়তা আস্তে আস্তে ভেঙে পড়ছে।

তারপরই একদিন আমি চরম আঘাত হানলাম। মালবিকা কলকাতায় একটা ফ্ল্যাট কিনেছিল। বাপের বাড়ির সম্পত্তির অংশ আর স্বামীর টাকাপয়সা, দুই-ই ও পেয়েছিল।

সেদিন রাত্তিরে প্রমথেশ ওর ফ্ল্যাটে বসে গল্প করছিল, মানে তাড়াতাড়ি বিয়ের জন্য পীড়াপীড়ি করছিল, ঠিক সেইসময় আমি দেখা দিলাম। তবে এবার প্রমথেশকে নয়, মালবিকাকে।

আমাকে দেখে ওর দু-চোখ বিস্ফারিত হল, মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। ও ভীষণ ভয় পেয়েছে বুঝতে পেরে আমার খুব খারাপ লাগল। আমি ডান হাতের তর্জনী ঠোঁটের ওপর রেখে ওকে চুপ থাকতে ইশারা করলাম। তারপর ঠোঁট থেকে আঙুল সরিয়ে সেটা প্রসারিত করলাম প্রমথেশের দিকে। মালবিকা যেন হতভম্ব হয়ে গেছে, কিছু বুঝতে পারছে না। কিন্তু তার পরে আমি যা করলাম তাতে ওর মুখে ফুটে উঠল বিস্ময়ের ছাপ। আমি আমার গলার দু-দিকে দু-হাত রেখে যেন কিছু দিয়ে গলায় ফাঁস দিচ্ছি এমন ভান করলাম, তারপরেই আবার আঙুল দিয়ে দেখালাম প্রমথেশকে। আস্তে আস্তে মালবিকার চোখে-মুখে ফুটে উঠল উপলব্ধির চিহ্ন, আমার ইঙ্গিতটা ও বুঝতে পেরেছে। আমি মিলিয়ে গেলাম।

প্রমথেশ কিন্তু বকবক করেই যাচ্ছিল, এত যে কাণ্ড ঘটে গেল তার কিছুই ও টের পায়নি।

হঠাৎ ওকে থামিয়ে দিয়ে মালবিকা বলে উঠল, ‘প্রমথেশ, সুচরিতা যেদিন মারা যায় সেদিন তুমি এখানেই ছিলে তাই না?’

হঠাৎ এই প্রশ্নে প্রমথেশ কেমন যেন থতোমতো খেল, তারপর বলল, ‘হ্যাঁ…মানে…একথা জিজ্ঞেস করছ কেন?’

‘তোমার সঙ্গে সেদিন ওর দেখা হয়েছিল?’

‘আমার সঙ্গে! না তো।’ প্রমথেশ যেন আকাশ থেকে পড়েছে এমন ভান করল, কিন্তু ওর বলার ভঙ্গিতে এমন একটা কৃত্রিমতা ছিল যা কানে বাজে। মালবিকার মুখ গম্ভীর হয়ে গেল, ওর কপালে ফুটে উঠল গভীর চিন্তার রেখা।

‘কী ব্যাপার!’ প্রমথেশ জিজ্ঞেস করল, ‘হঠাৎ এ প্রশ্ন করলে কেন?’

‘সুচরিতার মৃত্যু রহস্যজনক,’ মালবিকা জবাব দিল, ‘পুলিশ কোনো সূত্র পায়নি, কিন্তু সুচরিতা নিজে যদি কে ওকে খুন করেছে জানিয়ে দেয়!’ মালবিকা জিজ্ঞাসাপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল প্রমথেশের মুখের দিকে।

‘তোমার কি মাথা খারাপ হল নাকি?’

প্রমথেশ প্রতিরোধের কণ্ঠে বলল, ‘মরা মানুষ কথা বলে এমন কখনো শুনিনি।’

‘তুমিই তো দু-দিন আমাকে বলেছিলে সুচরিতাকে দেখেছ, এই সেদিনও রেস্তরাঁয় খাবার সময় একথা বলেছিলে।’

‘সেটা আমার মনের ভুল,’ প্রমথেশের গলায় আর তেজ নেই।

‘আমিও কিন্তু ওকে দেখেছি,’ মালবিকা এবার দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ‘ও মনে হয় আমাকে বলতে চায় কে ওর খুনি।’

প্রমথেশের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল, ও ঢোঁক গিলে বলল, ‘যত সব গাঁজাখুরি।’

ওর আর বসল না, যেন পালিয়ে বাঁচল।

এর পরেই দেবজ্যোতি এল কলকাতায়। ও এখন একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির ডিরেক্টর, কিন্তু স্বভাব আগের মতোই আছে। মালবিকার সঙ্গে ও দেখা করল। আমি তখন মালবিকার ফ্ল্যাটে ছিলাম তবে অশরীরে। আমাদের কোথাও যেতে বাধা নেই। দেবজ্যোতি যে সেদিন ওখানে আসবে তা আমি জানতাম। আমাদের অনেক কিছু ক্ষমতা আছে, যেমন এই কাহিনি আমি একজন লেখককে দিয়ে লেখাচ্ছি, তিনি এ ধরনের লেখায় সিদ্ধহস্ত তাই তাঁর কলমে আমি ভর করেছি।

দু-চার কথার পর মালবিকা দেবজ্যোতিকে সেদিনের ঘটনা খুলে বলল। আমাকে ও কীভাবে দেখেছিল সেকথা বলতে বলতে ও কেঁদে ফেলল। আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল।

দেবজ্যোতি কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইল তারপর বলল, ‘প্রমথেশ আমাদের বন্ধু ছিল তবে ওকে আমি কখনোই তেমন পছন্দ করতাম না। ভীষণ স্বার্থপর। কিন্তু একটা কথা আমি বুঝতে পারছি না, সুচরিতাকে ও খুন করবে কেন, আবার এমন জায়গায় যেখানে আমরা আড্ডা মারতাম।’

‘ওই জায়গাটা নির্জন বলেই বোধ হয় প্রমথেশ ওখানে ওকে নিয়ে গিয়েছিল।’

‘কিন্তু কেন!’ দেবজ্যোতি বলল, ‘সুচরিতাকে আমরা ভালোভাবেই জানতাম, প্রমথেশ বলল আর সঙ্গেসঙ্গে ওর পেছন পেছন গেল এমন মেয়ে ও ছিল না। এর পিছনে নিশ্চয়ই একটা গূঢ় কারণ আছে, সেটা আমাদের জানতে হবে।’

কিছুক্ষণ দু-জন চুপচাপ বসে রইল, তারপর দেবজ্যোতিই আবার বলল, ‘আচ্ছা সুচরিতাকে তো চাকরির ব্যাপারে আদিবাসীদের বাস এমন সব জায়গায় যেতে হত। ও আমাকে চিঠিতে তাই লিখেছিল। প্রমথেশ অসমের যে চা-বাগানে কাজ করত সেখানে আদিবাসী বা উপজাতি নিশ্চয়ই ছিল। চা-বাগানের কুলিকামিনরা বেশির ভাগ ওদের সম্প্রদায়ের মানুষ হয়। সুচরিতাকে কি কখনো যেতে হয়েছিল সেখানে?’

‘তা আমি বলতে পারব না,’ মালবিকা জবাব দিল, ‘আমি অত দূরে থাকতাম, সুচরিতার সঙ্গে পরের দিকে আর যোগাযোগ ছিল না। তারপর আমারও কপাল পুড়ল…’

‘হুঁ!’ দেবজ্যোতি একটা স্বগতোক্তি করে বলল, ‘আমি সুচরিতার আপিসে গিয়ে খোঁজ নেব ওকে ওই চা-বাগান অঞ্চলে যেতে হয়েছিল কি না। যদি তাই হয়, আমি নিজে যাব সেখানে, খোঁজখবর করব। আমার মনে হয় রহস্যের চাবিকাঠি ওখানেই আছে।’

দেবজ্যোতির ওপর কৃতজ্ঞতায় আমার মন ভরে গেল। ও চিরকালই সিরিয়াস, যা শুরু করবে তার শেষ না দেখে ছাড়বে না।

দিন পনেরো পরের ঘটনা। মালবিকার ফ্ল্যাটে দেবজ্যোতি আর প্রমথেশ এসেছে। সন্ধে হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। প্রমথেশকে মালবিকাই খবর পাঠিয়ে আনিয়েছে।

দেবজ্যোতিকে দেখে প্রমথেশ বলল, ‘আরে দেবু তুই কবে এলি, আমাকে খবর দিসনি তো!’

‘আমি তো তোর খবর নিতেই গিয়েছিলাম।’ দেবজ্যোতি জবাব দিল, ‘সময় পেলাম কই!’

‘আমার খবর! তার মানে?’ প্রমথেশ ভুরু কোঁচকাল।

‘মানে আর কিছুই না,’ দেবজ্যোতি ঠান্ডা গলায় জবাব দিল, ‘সুচরিতার মৃত্যু নিয়ে আমি আর মালবিকা আলোচনা করেছিলাম। ও খুন হয়েছে আমরা যেখানে আড্ডা মারতাম সেখানে অর্থাৎ ও জায়গাটার সঙ্গে পরিচিত এমন কেউ ওকে ওখানে নিয়ে গিয়েছিল। জায়গাটা নিরিবিলি। অথচ ওর কোনো শত্রু ছিল না, কারো সঙ্গে প্রেমের ব্যাপারও ছিল না। তাই সমস্ত ব্যাপারটা আমার কাছে ধোঁয়াটে মনে হয়েছিল।

‘আমি খোঁজ নিয়ে জানলাম অসমে যে চা-বাগানে তুই কাজ করতিস সুচরিতাকে একবার সেখানে যেতে হয়েছিল। আমিও তাই করলাম অর্থাৎ ওখানে গেলাম, আর তোর কীর্তিকাহিনি সব শুনে এলাম। সুচরিতাও সব জেনেছিল। তুই এদিকে এখানে ফিরে আসার পর মালবিকাকে বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলি। মালবিকার মুখেই শুনলাম ও প্রায় রাজি হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু বাদ সাধল সুচরিতা। ও নিশ্চয়ই তোকে বলেছিল তোর কীর্তি মালবিকার কাছে ফাঁস করে দেবে, ওর মুখ বন্ধ করা তোর দরকার হয়ে পড়েছিল। তাই তুই ওকে কথায় ভুলিয়ে ওই পুরোনো মন্দিরে নিয়ে গিয়েছিলি। ও জায়গাটার কথা আমরা চারজনই জানতাম। ওখানেই গলায় ফাঁস দিয়ে তুই ওকে খুন করেছিস।’

‘না-না-না,’ প্রমথেশ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, ‘এ সবই তোর মনগড়া কাহিনি, কোনো প্রমাণ নেই…’

ঠিক তখুনি আমি দেখা দিলাম, ওরা তিনজনেই আমাকে দেখল। আমি ডান হাতের তর্জনী প্রমথেশের দিকে বাড়িয়ে দিলাম। তারপর হাত দুটো গলার দু-পাশে এনে ফাঁস ধরে টানবার ভঙ্গি করলাম, আমার জিভ বেরিয়ে এল।

সেই বীভৎস দৃশ্য দেখে ওরা যেন হতভম্ব হয়ে গেছে। তারপর প্রমথেশই উন্মত্তের মতো চিৎকার করে উঠল, ‘তোকে আমি সরিয়ে দিয়েছিলাম, তুই আবার আমার পথের কাঁটা হয়ে এসেছিস! তোকে আবার আমি খুন করব…’

উন্মাদের মতো ও দু-হাত বাড়িয়ে আমার দিকে তেড়ে এল, যেন আমার গলা টিপে ধরবে। কিন্তু শূন্যেই ওর দু-হাত রয়ে গেল, আমি ততক্ষণে মিলিয়ে গেছি।

‘হ্যাঁ, ওকে আমি খুন করেছি, গলায় ফাঁস দিয়ে মেরেছি, এক-শোবার মারব,’ প্রমথেশ পাগলের মতো বলতে লাগল, ‘ও আমার পথের কাঁটা, ও আমার পথের কাঁটা, ও আমার পথের কাঁটা…’

ওর দু-কষ দিয়ে ফেনা বেরুচ্ছে, দু-চোখ রক্তবর্ণ। দেবজ্যোতিই পুলিশে খবর দিল। তারা এসে দেখল প্রমথেশ সেই একই কথা বলে যাচ্ছে, খুনের স্বীকারোক্তি। ওকে ওরা হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে গেল, ও তখন বদ্ধ উন্মাদ।

আমাকে আর কোনোদিন দেখা যাবে না। এই ঘটনার কয়েকদিন পর দেবজ্যোতি আর মালবিকা আমাদের বাড়ি গেল। আমার আত্মার শান্তির জন্য গয়ায় পিণ্ডদানের কথা বলল। ওরা ছিল আমার অভিন্নহৃদয় বন্ধু, যদি আমার বাড়ির লোকের আপত্তি না থাকে তবে ওরা দু-জন গয়ায় গিয়ে আমার পিণ্ড দেবে একথাও বলল। আমার বাড়ির থেকে আপত্তি করার কোনো কারণ ছিল না।

গয়ায় পিণ্ড দেবার সময় ওরা দু-জন মনে মনে প্রার্থনা করেছিল, ‘সুচরিতা, তোর আত্মা শান্তি লাভ করুক, তুই স্বর্গধামে ঈশ্বরের চরণে গিয়ে আশ্রয় নে, ওটাই তোর জায়গা।’

অনেক তপস্যা করলে এমন বন্ধু মানুষের জোটে, আমি ওদের কাছে কৃতজ্ঞ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *