ভৌতিক ঘটনা

ভৌতিক ঘটনা

পেনসিলভ্যানিয়ার সুপ্রিম কোর্টের এক বিচারপতির অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছিল একবার। তখনও তিনি বিচারপতি হননি, একটি জেলা শহরে অ্যাটর্নি হিসাবে কাজ করছিলেন। একদিন তিনি নিজেই এক্কাগাড়ি হাঁকিয়ে দূরে কোথাও যাচ্ছিলেন। যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে তখন ওটাই ছিল রীতি আর ফ্যাশন।

পথঘাট তাঁর অজানা। সূর্য অস্ত যাবার মুখে একটা গ্রাম্য সরু পথে তিনি ঢুকে পড়লেন। পথের ডান দিকে পাথরের একটা দীর্ঘ পাঁচিল, অনেকটা জায়গা জুড়ে, কিন্তু ভেতরে কোনো ঘরবাড়ি চোখে পড়ল না। আশেপাশেও কোনো বাড়ি নেই, জনমানবহীন নির্জন পথ। ঠিক পথ ধরে এগোচ্ছেন কি না তা যে কাউকে জিজ্ঞাসা করবেন তারও উপায় নেই। এমন সময় একটু দূরে একজন লোকের ওপর তাঁর চোখ পড়ল। লোকটি পাঁচিলের ওপর বসে আছে। ভদ্রলোক অনেকটা নিশ্চিন্ত হলেন, লোকটির কাছ থেকে পথের নিশানা জেনে নেবেন। তিনি যখন লোকটির প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে, সে তখন হঠাৎ পাঁচিল থেকে নেমে হাঁটা শুরু করল, তারপরই মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে গেল।

ভদ্রলোক ভাবলেন লোকটি বোধ হয় মূর্ছা গেছে। তিনি তাড়াতাড়ি এক্কা থেকে নেমে তার দিকে এগুলেন। লোকটি পড়ে যাবার পর একবারও নড়ে-চড়েনি, কিংবা তাঁর চোখের আড়াল হয়নি। কিন্তু আরও একটু এগুবার পর তিনি আর তাকে দেখতে পেলেন না। যেন ভোজবাজির মতো হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। তবু চোখের ভুল মনে করে যেখানে লোকটিকে তিনি পড়ে যেতে দেখেছিলেন সেখানে গিয়ে দাঁড়ালেন। না, কোনো চিহ্নই নেই লোকটির।

ভদ্রলোক হতবুদ্ধির মতো তাঁর ঘোড়ার কাছে ফিরে এলেন। অনেকদিনের পুরোনো ঘোড়া, শান্ত প্রকৃতির, কিন্তু সে যেন ভীষণ ভয় পেয়েছে। তার দু-চোখ বিস্ফারিত, ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ছে আর গা বেয়ে দর দর করে ঘাম ঝরছে। ভদ্রলোক ঘোড়ার কাঁধে হাত দিতেই সে ভীষণ চমকে উঠল। ঘোড়া আর নড়তে চায় না, তিনি প্রায় টানতে টানতেই তাকে নিয়ে এগুলেন। ওই স্থানটি অতিক্রম করামাত্র ঘোড়া হ্রেষাধ্বনি করতে করতে জোরকদমে ছুটল। প্রায় আধ মাইল পথ যাবার পর ভদ্রলোক একটি বাড়ি দেখতে পেলেন। গাড়ি থামিয়ে তিনি ওই বাড়ির একজন মহিলাকে সেই পাথুরে পাঁচিল সম্বন্ধে হালকাভাবে প্রশ্ন করলেন। মহিলা একটু যেন অদ্ভুতভাবে তাঁর দিকে তাকালেন। তারপর বললেন ওই পথ দিয়ে পারতপক্ষে কেউ যাতায়াত করে না। পাঁচিল ঘেরা বাড়িটা বেশ কয়েক বছর আগে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, শুধু পাঁচিলটাই অক্ষত আছে। ওই বাড়িতে কয়েকটা নৃশংস খুন হয়েছিল, তারপর থেকেই ভূতুড়ে বাড়ি বলে ওটার বদনাম আছে।

মহিলার বক্তব্য থেকে ভদ্রলোকের মনে সন্দেহ রইল না যে, তিনি যা দেখেছেন তা তাঁর দৃষ্টিভ্রম নয়। তা ছাড়া তাঁর ঘোড়ার ভয় পাবার ব্যাপারটাও তো উড়িয়ে দেওয়া যায় না। পশুদের বোধ হয় ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আছে, তা দিয়ে মানুষের অনুভূতির বাইরে কোনো জীবের অস্তিত্ব তারা টের পায়।

পশুদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সম্বন্ধে আমেরিকার এক মহিলা একটি ঘটনা জানিয়েছিলেন। তাঁদের একটি কুকুর ছিল, নাম মার্সেলা। কুকুরটি ভদ্রমহিলার স্বামীর খুব অনুরক্ত ছিল। ব্যাবসার তাগিদে ভদ্রলোককে প্রায়ই বাইরে যেতে হত। সেই সময় কুকুরটি ভদ্রমহিলার শোবার ঘরে মেঝেয় ঘুমুত। এক রাত্রে ভদ্রলোক দূরে অন্য এক শহরে গেছেন, হঠাৎ কুকুরটির ডাকে ভদ্রমহিলার ঘুম ভেঙে গেল। তিনি আলো জ্বালিয়ে ভাবলেন বাড়িতে বোধ হয় চোর ঢুকেছে। কুকুরটির গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠেছে, ঘেউ ঘেউ শব্দটাও কেমন যেন চাপা। তারপর সে শোকার্তের মতো ডাকতে লাগল। পরক্ষণেই সে আলমারির কোণে জড়োসড়ো হয়ে যেন ককিয়ে ককিয়ে কেঁদে উঠল। ভদ্রমহিলা তার ব্যবহারে বিস্মিত হলেন।

নীচে গিয়ে তিনি দেখলেন দরজা-জানলা সব বন্ধ, তাঁর বাচ্চা ছেলেমেয়ে দুটিও পাশের ঘরে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমুচ্ছে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই তিনি দূর পাল্লা টেলিফোনে খবর পেলেন যে তাঁর স্বামী এক মোটর দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। ভদ্রমহিলার দৃঢ় ধারণা মার্সেলা তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে ওই মর্মান্তিক ঘটনা উপলব্ধি করেছিল, কিংবা তাঁর স্বামীর অশরীরী মূর্তিকে দেখতে পেয়েছিল।

বিখ্যাত ঔপন্যাসিক মার্ক টোয়েন একসময় ‘পেনসিলভ্যানিয়া’ নামে এক স্টিমারে কাজ করতেন। একদিন রাত্রে যখন স্টিমারটি সেন্ট লুই বন্দরে নোঙর করেছিল, টোয়েন তাঁর বোনের বাড়িতে ঘুমিয়ে ছিলেন। তিনি একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলেন। তাঁর ছোটোভাই হেনরি, একটা ধাতব শবাধারে শুয়ে আছে, তার বুকের ওপর সাদা ফুলের একটা তোড়া, তোড়ার মাঝখানে একটা টকটকে লাল ফুল। স্বপ্নটা এত স্পষ্ট যে ঘুম ভেঙে যাবার পরেও টোয়েন বুঝতে পারেননি স্বপ্ন দেখেছেন। তিনি মৃত ভাইকে দেখার জন্য তাড়াতাড়ি পোশাক পরে নিলেন, কিন্তু বাইরে কিছুটা হাঁটতেই তাঁর খেয়াল হল তিনি যা দেখেছেন তা স্বপ্নমাত্র। তিনি তাঁর বোনের কাছে স্বপ্নের ঘটনা খুলে বললেন।

‘পেনসিলভ্যানিয়া’ টোয়েন এবং তাঁর ভাই হেনরিকে নিয়ে নিরাপদে নিউ অরলিনসে পৌঁছুল। সেখানে টোয়েন অন্য একটি স্টিমারে বদলি হলেন, হেনরি কিন্তু পুরোনো জাহাজ পেনসিলভ্যানিয়াতেই রয়ে গেলেন। টোয়েন যে স্টিমারে বদলি হয়েছিল সেটি পেনসিলভ্যানিয়া সমুদ্রযাত্রা করার দু-দিন পর বন্দর ছাড়ল। এদিকে মেমফিস নামে এক জায়গার কাছে ‘পেনসিলভ্যানিয়া’ প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে গেল। দুঃসংবাদ পেয়ে ছুটে এলেন টোয়েন। তিনি তাঁর ভাইকে আরও তিরিশজনের সঙ্গে গুরুতর আহত অবস্থায় একটা হাসপাতালে দেখতে পেলেন। দুর্ঘটনার ষষ্ঠ রাত্রে মৃত্যু হল হেনরির।

হেনরির মৃতদেহ মর্গে নিয়ে যাওয়া হল। অবসাদ আর শোকে টোয়েন ঘুমিয়ে পড়লেন। বেশ কয়েক ঘণ্টা পরে তিনি হেনরির মৃতদেহের কাছে গেলেন। অন্যান্য মৃতদেহের জন্য সাধারণ কাঠের কফিনের ব্যবস্থা হয়েছিল, কিন্তু হেনরির অল্প বয়স আর সুন্দর চেহারায় অভিভূত হয়ে সেখানকার মহিলারা তার জন্য একটি ধাতুনির্মিত শবাধার চাঁদা তুলে সংগ্রহ করেছিলেন। টোয়েন স্বপ্নে যেমনটি দেখেছিলেন ঠিক সেইরকম শবাধারে ভায়ের মৃতদেহ শায়িত দেখতে পেলেন, শুধু বুকের ওপর সাদা ফুলের তোড়াটা নেই। তিনি যখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্বপ্নে দেখা ঘটনার সঙ্গে বাস্তব ঘটনার অদ্ভুত সাদৃশ্যের কথা ভাবছেন ঠিক সেই সময় একজন প্রৌঢ়া ঘরে ঢুকলেন। ভদ্রমহিলার হাতে সাদা ফুলের একটি তোড়া, মাঝখানে লাল টকটকে একটা রক্তগোলাপ। তিনি ফুলের তোড়াটি সযত্নে হেনরির বুকের ওপর রাখলেন। টোয়েনের স্বপ্ন আশ্চর্যভাবে অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *