3 of 8

অপমান

অপমান

…‘অপমানে হতে হবে

তাহাদের সবার সমান’..

—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবীন্দ্রনাথের এই বহুখ্যাত পঙ্‌ক্তিটি পাঠ করেনি এবং শোনেনি এমন বঙ্গভাষী খুঁজে পাওয়া যাবে না। অনেকেই ছাত্রজীবনে পরীক্ষার খাতায় এই পঙ্‌ক্তির ব্যাখ্যা লিখেছেন, এখনও হয়তো অনেকের মুখস্থ আছে সম্পূর্ণ অনুচ্ছেদটি, হয়তো বা পুরো কবিতাটিই।

‘অপমানিত’ নামের এই কবিতাটি শুধু বাংলাতেই নয়, ভাষান্তরিত হয়ে ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজ্যেও যথেষ্ট সুপরিচিত।

এই কবিতার মূল কথা ছিল—“যাকে তুমি নীচে ফেল সে তোমাকে নীচে বাঁধবে, তুমি যাকে পেছনে রেখেছ সে তোমাকে পেছনে টানছে।”

সবাই জানেন, এই ‘তুমি’ কোনও মানুষ নয়, এখানে সমাজের কথা বলা হয়েছে। এই সামান্য তরল রচনায় সমাজ নিয়ে কোনও রসিকতা করার সাহস আমার নেই, বিশেষ করে যেখানে রবীন্দ্রনাথকে প্রথমেই জড়িত করে ফেলেছি।

আমি বরং ব্যক্তিগত মান-অপমানের তুচ্ছ কাহিনীতে যাই; সেখানেও অবশ্য অপমানিত লোকটিকে যতক্ষণ চেনা না যাচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্তই আমি নিরাপদ।

প্রথমে অতি সাবধানে ও সন্তর্পণে এক রাজনৈতিক নেতাকে স্মরণ করি। তাঁর নির্বাচনী এলাকায় একটি সাহিত্যসভায় আমরা কিছু না বুঝে ভুল করে অংশগ্রহণ করতে গিয়েছিলাম।

গিয়ে দেখি এই বিতর্কিত নেতা, মেধার থেকে পেশির জন্যেই যিনি বেশি পরিচিত, তিনি সেই সাহিত্য সম্মেলনের অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি।

যেমন হয়, আমাদের সঙ্গে নেতা ভদ্রলোক অত্যন্ত ভাল ব্যবহার করলেন, আমরা তাঁর সৌজন্যে মুগ্ধ হলাম। তাঁর বিষয়ে আমাদের মনে মনে যে একটা ভুল ধারণা ছিল তার জন্যে মনে মনেই লজ্জিত বোধ করলাম।

সে যা হোক, আসল ঘটনা অন্য। আসল ঘটনা হল ভদ্রলোকের বক্তৃতা। আমাদের সুস্বাগতম জানিয়ে ভদ্রলোক উদ্বোধনী বক্তৃতায় বললেন, ‘আপনারা এত গুণীজন এখানে এসেছেন, সে জন্যে সামান্য ধন্যবাদ জানিয়ে আমি আপনাদের অপমান করতে চাই না।’

এবং ঠিক পরেই তিনি বললেন, ‘আমি আপনাদের প্রত্যেককে শতশত ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’

জানি না, সেদিন আমরা সত্যি সত্যি অপমানিত হয়েছিলাম কিনা।

কিন্তু আমরা তো এমন অনেক লোককে জানি, যাঁরা কোনওদিন অপমানিত হননি। কেউ তাঁদের কোনওদিন অপমান করতে পারবে না। তাঁদের অপমানবোধই নেই।

এই সূত্রে একটি পুরনো চিঠি আগাগোড়া উদ্ধৃত করছি। এটি ঠিক হাসির নয়, একটি করুণ কাহিনী।

শ্রীদুর্গা শরণ্‌ম

কলিকাতা

৭ই ভাদ্র

প্রিয় গদাধর,

কলিকাতায় আসিবার পর গত আড়াই মাস নানা কারণে আমি তোমাকে কোনও পত্র দিতে পারি নাই।

ইহার মানে এই নয় যে আমি তোমাদের ভুলিয়া গিয়াছি। কিন্তু যাহাকে বলে “মাথার ঘায়ে কুত্তা পাগল” আমারও সেই অবস্থা দাঁড়াইয়াছে।

এখানে জয়রামবাবুর বাড়িতে যখন আমি বাজার সরকারের চাকুরি লইয়া আসিলাম, তুমি সকলই জান, আশা ছিল বেতন কম হইলেও সৎভাবে নিজের আত্মসম্মান রক্ষা করিয়া জীবিকা নির্বাহ করিতে পারিব।

কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক।

এখানে আসিবার দুই-তিনদিনের মধ্যে ইহাদের ব্যবহারে আমি তাজ্জব হইয়া গিয়াছি। ইহারা কী চায়, বুঝিতে পারি না।

একদিন বড় বড় বেগুন আনিলাম, খুব রাগারাগি করিল, বড় বেগুন যেন বিষ। পরের দিন ছোট ছোট আলু আনিলাম, আলুর ব্যাগ রাস্তায় ছুড়িয়া ফেলিয়া দিল।

অন্যান্য ব্যাপার আরও জটিল। একদিন এ-বাড়ির বড় গিন্নিমা সন্ধেবেলা আমাকে সদরের দরজা ভেজাইয়া দিতে বলিলেন। আমি জানি ইহা আমার কাজ নয়, সুতরাং নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও গলির মোড়ের টিউবওয়েল হইতে চারি বালতি জল আনিয়া বাহিরের দরজা ভেজাইলাম, সে বড় গিন্নিমার আদেশ বলিয়াই। কিন্তু ইহার পরিণাম কী হইল? বাড়ির সমস্ত লোক, এমনকী ঝি-চাকর পর্যন্ত উল্লুক, বেল্লিক, গাধা বলিয়া গালাগাল করিতে লাগিল।

এইরকম অনবরত চলিতেছে।

সেদিন বিকালে ছোটসাহেব একজোড়া কোট-প্যান্টলুন তাড়াতাড়ি বোপর বাড়ি হইতে ইস্তারি করিয়া আনিতে আদেশ দিলেন। বলিলেন, সন্ধেবেলা পার্টি আছে, এই পোশাক পরিয়া যাইবেন। আমি কী করিয়া জানিব বাড়ির সামনের কাচের জানলা-দরজা দেওয়া দামি দোকানে জামাকাপড় ইস্তারি করা হয়। আমি রাস্তায় রাস্তায় ভাঁটিখানা খুঁজিলাম, কিন্তু কোথাও দেখিতে না পাইয়া অবশেষে বহু পথ ঘুরিয়া, বহু পথ ঘুলাইয়া চেতলা হইতে রাত বারোটা নাগাদ কোট-প্যান্ট ইস্তারি করিয়া যখন পরিশ্রান্ত, ঘর্মাক্ত, অভুক্ত অবস্থায় আসিয়াছি তখন ছোটসাহেব অন্য পোশাকে, (সেটি কিঞ্চিৎ ময়লা, দোমড়ানো) পার্টি হইতে টলিতে টলিতে ফিরিতেছেন। হঠাৎ আমাকে ধোপদুরস্ত টাটকা ইস্তারি-করা কোট-প্যান্ট হাতে সম্মুখে দেখিয়া তিনি কেমন উত্তেজিত হইয়া শুয়োরের বাচ্চা, কুত্তার বাচ্চা বলিতে লাগিলেন। বাচ্চা তবু পূর্বে শুনিয়াছি, ছোটসাহেব আরও কিছু-কিছু অশ্রাব্য শব্দের পুত ও ভাই বলিয়া আমাকে সম্বোধন করিতেলাগিলেন।

ভয়াবহ ঘটনা ঘটিয়াছে পরশুদিন, ৫ই ভাদ্র, শনিবার সন্ধেবেলা। প্রতি শনিবার এ-বাড়িতে বড়সাহেব পার্টি দেন। একতলার বাইরের ঘরে পার্টি হয়। আট-দশজন লোক আসে, মদ খাওয়া হয়। আমি বাড়ির মধ্যে রান্নাঘর হইতে মাছভাজা, মাংসের বড়া এইসব আনিয়া দিই। ফ্রিজ খুলিয়া সোডা, বরফ, জল।

পরশুদিন রাত্রিতে হঠাৎ সোড়া ফুরাইয়া গেল। বড়সাহেব আমাকে রাস্তার দোকান হইতে সোডা আনিতে বলিলেন। আমি বুদ্ধি করিয়া বড়সাহেবকে খুশি করিবার জন্য আইসক্রিম সোডা আনিলাম। আমি যদিও কোনওদিন মদ খাই নাই; সোডা খাইয়াছি, সোডা অতি বিস্বাদ। একদিন আইসক্রিম-সোডা খাইয়াছিলাম, খুব ভাল লাগিয়াছিল। তাই যত্ন করিয়া আইসক্রিম-সোডা আনিয়া বড়সাহেব ও তাঁহার ইয়ারদের পানীয়ের গেলাসে ঢালিয়া দিলাম।

সঙ্গে সঙ্গে তাহারা খেপিয়া গেল। ওয়াক থুঃ, ওয়াক থুঃ করিতে লাগলি। উহারা নাকি হুইস্কি খাইতেছিল। হুইস্কির সঙ্গে আইসক্রিম-সোডা মিশাইয়া খাইলে নাকি বমি আসে। যখন সবাই জানিতে পারিল আইসক্রিম-সোডা আমিই আনিয়াছি, সবাই আমাকে তাড়া করিয়া আসিল । এক মাতাল স্টুপিড, স্কাউন্ড্রেল বলিয়া আমার কান মলিয়া দিল। বড়সাহেব নিজে পা হইতে চপ্পল খুলিয়া সেই চপ্পল আমার মুখে মারিয়া ঠোঁট ফাটাইয়া দিলেন।

ভাই গদাধর, আর কী লিখিব। সবই তো বুঝিলে। ইহারা আমাকে অহর্নিশি গালাগাল করিতেছে। “শুয়োরের বাচ্চা,” “পুঙ্গির পুত” এইসব বলিতেছে, জুতা মারিয়া ঠোঁট ফাটাইয়া দিয়াছে।

আমি ভয়ংকর দুশ্চিন্তায় আছি। ইহার উপরে ইহারা আবার আমাকে অপমান না করে। যতই কষ্ট হউক, গদাধর, তুমি আমাকে জাননা, অপমান করিলে আমি এই কাজ তখনই ছাড়িয়া দিব। না-খাইয়া থাকিব তবু ভাল, তবু অপমানিত হইয়া কাজ করিব না।

ইতি

তোমার বন্ধু

ভবনাথ

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *