১৯. গণিকালয়ের নাম সোনাগাছি

১৯. গণিকালয়ের নাম সোনাগাছি

গণিকা ও গণিকালয় নিয়ে লেখালেখি হবে, অথচ সোনাগাছি নিয়ে আলোচনা হবে না! সোনাগাছি নিয়ে আলোচনা করার জন্য তাই আলাদা একটি অধ্যায় রাখা হল। সোনাগাছি’, এই শব্দটি ফিসফিস করে উচ্চারণ করতে হয় ভদ্রসমাজকে। অনেকে অবশ্য সোনাগাছি না-বলে গণিকাপল্লি বোঝাতে ‘বি কে পাল অ্যাভিনিউ’ বা ‘চিৎপুর’ বা ‘যাত্রাপাড়া’ও বলে থাকে। সোনাগাছি, এই শব্দটির সঙ্গে গণিকাপল্লির ৪০০ বছরের ইতিহাস আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। সুনামেই হোক বা দুর্নামেই হোক–গণিকালয় হিসাবে সোনাগাছি অদ্বিতীয়তম্। ‘সোনাগাছি’ আর ‘গণিকালয়’ আজ একটি সমার্থক শব্দ। বাংলা সাহিত্যে-সিনেমায় কখনোই উপেক্ষিতা হয়নি। বাংলা সাহিত্যে-সিনেমার আনাচে-কানাচে সোনাগাছির অন্ধকার উঠে এসেছে।

বস্তুত ব্রিটিশ-ভারত সরকারের আমলেই সোনাগাছি বৃহৎ আকার ধারণ করে। এলাকা বৃদ্ধি আজও অব্যাহত। শুধু ঊনবিংশ শতাব্দীই নয়, বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত সোনাগাছির সীমানা ছিল উত্তরে কর্নওয়ালিস স্ট্রিট (বর্তমানে বিধান সরণি), দক্ষিণে চিৎপুর রোড (বর্তমানে রবীন্দ্র সরণি), পূর্বদিকে শোভাবাজার বি কে পাল অ্যাভিনিউ এবং পশ্চিমে জোড়াসাঁকো ঠকুরবাড়ির প্রায় সংলগ্ন অঞ্চল। পরে সোনাগাছির মাঝখান দিয়ে একটা রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। উত্তর থেকে দক্ষিণে, অর্থাৎ বাগবাজার থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত। শুরুতে চিত্তরঞ্জন, পরে ভূপেন্দ্র বসু অ্যাভিনিউ। চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের পূর্বদিকের অঞ্চলটায় ক্রমশই নির্বাসিত হল গণিকারা। সোনাগাছির উল্টোদিকের দর্জিপাড়া অঞ্চলটি ক্রমশই গৃহস্থদের দখলে চলে যাচ্ছে। অথচ এই দর্জিপাড়াই একসময় গণিকাপল্লির সমার্থক ছিল। এখন সেখান থেকে গণিকাদের পাততাড়ি গোটাতে হয়েছে। নবনির্মিত গৃহস্থ পাড়ায় গণিকাদের জায়গা দিতে নারাজ ভদ্র বাবুবিবিরা। এইভাবেই দর্জিপাড়া হাতছাড়া হয়ে গেল গণিকাদের। এলাকা ছোটো হোক বা বড়ো, এখন পুরো অঞ্চলটিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘রেড লাইট এরিয়া হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। অনেকে বলেন এশিয়ার সর্ববৃহৎ নিষিদ্ধপল্লি। ভারতের তো বটেই, পশ্চিমবঙ্গেরও।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতেই সোনাগাছির জন্ম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঠাকুর্দা দ্বারকানাথ ঠাকুর ইংরেজদের হাতে তামুক খেতে খেতে ‘প্রিন্স’ উপাধিও পেয়ে গেছেন। আর এটা পেয়েছেন ইংরেজদের ভেট দিয়ে। ভেটের মধ্যে অন্যতম ছিল নারীশরীর। দ্বারকানাথ নিজেও ছিলেন প্রচণ্ড নারীবিলাসী। স্বদেশ-বিদেশ যেখানের তিনি থাকুন না-কেন নারীই তাঁর নিত্যসঙ্গী। তিনি জাহাজের ব্যাবসা, নীলের ব্যাবসা, সিল্কের ব্যাবসা সবেতই দখল নিয়েছিলেন ইংরেজদের আনুকূল্যে। ইংরেজদের আনুকূল্যে পেয়েছিলেন বিশাল জমিদারি। জোড়াসাঁকো থেকে শোভাবাজারের জমি। এই অংশেই ছিল সোনাগাছি অঞ্চল। আসলে এই অঞ্চলটির আদি নাম সোনাগাজির চত্বর। এই সোনাগাজিই লোকের মুখ-ফেরতা হয়ে হয়ে এখন সোনাগাছি। কেউ বলেন, স্বর্ণ নামে এক বাইজি ওই এলাকায় বাস করত। তাঁর নাম থেকেই সোনাগাছি। আবার কেউ বলেন, সোনাগাজি বা মুসলিম পির সনা উল্লাহ গাজি নামে এক পির বসবাস করত। তাঁর নামে একটি মসজিদও আছে এই এলাকায়। ৩০০ বছরের পুরোনো সেই মসজিদ। সেই সোনাগাজি থেকেই নাকি সোনাগাছি।

বিভিন্ন সময়ে কলকাতা শহরে আরও অনেক নিষিদ্ধপল্লি গড়ে উঠেছিল। যেমন মধ্য কলকাতার বউবাজার এলাকার হারকাটা গলি, দক্ষিণ কলকাতার কালীঘাট অঞ্চল, খিদিরপুর সহ আরও বহু জায়গায় তৈরি হয় গণিকাপল্লি। একসময় হুতোম কলকাতাকে ‘বেশ্যাশহর’ আখ্যা দিয়েছেন। বুলবুলির লড়াইয়ে কলকাতা শহরে হুতোমি ডিকশনে ‘বেশ্যাবাজী’ ছিল বড়ো মানুষের এলবাত। শুধু সোনাগাছি অঞ্চলেই আছে ১০,০০০ যৌনকর্মী। আছে কয়েকশো বহুতল বাড়ি। সোনাগাছি অঞ্চলে যৌনকর্মীরা আসে সাধারণত নেপাল, বাংলাদেশ থেকে এবং ভারতের অন্য রাজ্য থেকেও। আছে নানা ভাষাভাষীর মানুষ। গোটা ভারতবর্ষই ঢুকে পড়েছে সোনাগাছির অন্দরমহলে। এখানকার কোনো বাড়ি ৫ কামরার তো কোনো বাড়িতে ২৫ কামরা। এমন কয়েকশো বাড়িতে যৌন পরিসেবা দিয়ে চলেছে যৌনকর্মীর মেয়েরা। আবার দেখা গেছে একই ঘরে একাধিক পার্টিশন দিয়ে যৌনকর্ম চলে। সেই পার্টিশনগুলি এতটাই সংকীর্ণ যে, কোনোমতে দুটো শরীরই আটতে পারে।

সোনাগাছির বর্তমান অবস্থান উত্তর কলকাতার মার্বেল প্যালেসের উত্তরে চত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ, শোভাবাজার ও বিডন স্ট্রিটের সংযোগস্থলের কাছে। নানা ক্যাটাগরির যৌনকর্মী অপেক্ষা করে থাকেন রসিক ক্লায়েন্টদের জন্য। শরীর-মূল্য প্রতি ঘণ্টায় ১০০ টাকা থেকে ২০০০ টাকা বা তারও বেশি। এই সমস্ত পল্লি এলাকায় ঢুকলেই। চোখে পড়বে গলির দু-ধারে এবং আশেপাশে বিভিন্ন বয়সের মেয়েরা দাঁড়িয়ে আছে। এঁরা মুখে সস্তার রং মেখে উৎকট প্রসাধনে সেজে বিশেষ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে। এঁরা নিজের নিজের ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে, গলির মুখে দাঁড়ায়, দরজায় চৌকাঠে। এঁদের শরীর-মূল্য খুবই কম। উচ্চমূল্যে, অতি উচ্চমূল্যে শরীর বিক্রি করেন এমন যৌনকর্মীও আছে এই পল্লিতে। তাঁদের খুঁজে নিতে হয়। যাঁর যেমন সামর্থ্য সে তেমন মূল্যের যৌনকর্মীর যৌন পরিসেবা নেন। তবে যিনি যে মূল্যেই যৌন-পরিসেবা নিক না-কেন কন্ডোম বাধ্যতামূলক। শুধু সোনাগাছিই নয়, কন্ডোম ছাড়া কোনো এলাকার কোনো যৌনকর্মীই যৌন-পরিসেবা দেয় না।

সোনাগাছিতে বেশকিছু বিলাসবহুল বাড়ি আছে, যেখানে উচ্চমূল্যের যৌনকর্মীরা থাকে। বাড়িগুলি বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন–প্রেমবন্ধন, নাইট লাভার্স, ১২ নম্বর, কাঞ্চন প্যালেস, গঙ্গা-যমুনা, নীলকমল ইত্যাদি। এঁদের বেশিরভাগই ভিনরাজ্যের। আগ্রা, দিল্লি, পাঞ্জাব ইত্যাদি প্রদেশ থেকে আসা মেয়েরা। এঁরা শীততাপনিয়ন্ত্রিত ফানিশড সুগন্ধযুক্ত ঘরেই যৌন পরিসেবা দিয়ে থাকে। যদিও এইসব বাড়িগুলি ছাড়াও অন্য বাড়িতেও যৌনকর্মীরা ফার্নিশড ঘর না-হলেও শীততাপনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা রেখেছে। তবে তার জন্য অতিরিক্ত ৬০০ টাকা গুণতে হয় ক্লায়েন্টকে। নামাঙ্কিত বাড়িগুলির মাসিক ভাড়া ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা। তাহলে বুঝতেই পারছেন এইসব বাড়ির যৌনকর্মীদের শরীর-মূল্য কত হতে পারে! যেমন গুড় তেমন মিষ্টি আর কী! এইসব যৌনকর্মীর শুধু যৌন-পরিসেবাই দেয় না, সঙ্গে নাচ-গানও চলে। শুধু নাচ-গানও শুনতে বা দেখতেও কেউ কেউ আসে এখানে। নাচ বলতে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে নাচ। যৌনমিলন ছাড়া এই ধরনের কাজের রেটও আলাদা। ৩২০০ টাকা থেকে শুরু। যৌনকর্মে আলাদা রেট। আজকাল সোনাগাছির কিছু কিছু বাড়িতে ম্যাসাজ সেন্টারের নামেও এক ধরনের যৌনপেশা চালু হয়েছে। বলা হয়, ১৫ মিনিটের ‘ফুল বডি ম্যাসাজের রেট ৫০০ টাকা, ‘অন্য কিছু চাইলে প্রতি ঘণ্টায় ১৫০০ টাকা। পারিশ্রমিকের এত বৈচিত্র্য ভারতের আর কোনো গণিকালয়ে পাওয়া যায় না। যেমন সোনাগাছির ‘আগ্রাওয়ালিদের কোঠি’ বলে পরিচিত এই বাড়ির যৌনকর্মীদের কাছ থেকে যৌন পরিসেবা নিতে হলে বেশ চড়া মূল্য গুণতে হয়। যে-কোনো যৌনপল্লিতে প্রবেশ করলেই দুটি শব্দ আপনার কানে আসবে। একটি হল—‘বসবে’? এখানে বসবে’ মানে আমার সঙ্গে শোবে’? দ্বিতীয় শব্দটি হল–‘শট’। শট শব্দের মানে যোনিমূলে লিঙ্গের প্রবেশ (Penetration)। অর্থাৎ ক্লায়েন্ট কতবার যৌনমিলন করবেন। প্রতি যৌনমিলনে রেট নির্ধারিত হয়। এক একটি ইনিংস কমপক্ষে এক ঘণ্টার হয়ে থাকে। তবে। ক্লায়েন্টের বীর্যস্থলনের সঙ্গে সঙ্গে একটি শট শেষ হয়ে যায়।

সোনাগাছিতে তিন শ্রেণির গণিকাদের পাওয়া যায়—(১) যাঁরা এই অঞ্চলের স্থায়ী বাসিন্দা। এঁরা হয় বিক্রি হয়ে আসা, নয় পাচারকৃত হয়ে আসা, নয় প্রতারণার শিকার হয়ে আসা। (২) যাঁরা স্থায়ী বাসিন্দা নয়, সকালে এসে কাজ করে সন্ধ্যায় নিজের বাড়ি ফিরে যায়। প্রয়োজন হলেই ফুল নাইট’ কাজ করে। ফুল নাইট কাজ তখনই করে, যখন কোনো একজন ক্লায়েন্ট তাঁকে সারা রাতের জন্য চায়। এঁদের বয়স মোটামুটি তিরিশের নিচে। এঁরা স্বেচ্ছায় এই পেশা বেছে নিয়েছে। এবং (৩) এঁরা স্থায়ী বসিন্দা যেমন নয়, তেমন বাড়ি থেকে এসেও এখানে ঢোকে না। এঁরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা এসে কাছাকাছি বিভিন্ন মানুষের যাতায়াতের জায়গায় দাঁড়ায়। যেমন–উল্টাডাঙা বা শিয়ালদহ স্টেশন সংলগ্ন এলাকা, বুকিং কাউন্টারের সামনে, ভিআইপি ফুটব্রিজের উপরে, আশেপাশে ক্লায়েন্টের জন্য অপেক্ষা করে। এছাড়া ছবিঘর, প্রাচী, মেট্রো, পূরবী সিনেমা হলের সামনে শো টাইমে দাঁড়ায়। ক্লায়েন্ট জুটে গেলে তাঁকে নিয়ে সোজা সোনাগাছির কোনো ঘরে নিয়ে এসে যৌন পরিসেবা দেয়। কেউ কেউ কাছাকাছি হোটেলেও পরিসেবা দেয়। এইসব যৌনকর্মীরা সাধারণত মধ্যবয়স্কা ও পড়ন্ত যৌবনা। এঁরাও স্বেচ্ছায় এই পেশা বেছে নিয়েছে। সবাই যে শুধুমাত্র পেটের জন্য আসে, তা নয়। কথা বলে জানা গেছে, অনেক মেয়েরা বহুগামিতা চেতনা থেকেও এই পেশায় আসে। তাঁদের বহু পুরুষের সঙ্গ না পেলে ভালো লাগে না। তাঁদের কাছে যৌনতা একটা প্যাশন। জনৈক শরীর-ব্যাবসায়ী স্পষ্টত জানালেন–“আমি আমার ক্লায়েন্টদের ক্লায়েন্ট’ ভাবি না। বন্ধু ভাবি এবং ভাবাই। আর্থিক লেনদেন থাকলেও ক্লায়েন্টদের বন্ধু হই এবং বন্ধুত্বসুলভ আচরণ করি। ক্লায়েন্টদেরও বোঝাতে সক্ষম হই যে, আমি তোমার কিছু মুহূর্তের জন্য যৌনসঙ্গী হলেও, বন্ধুও। বিভিন্ন পুরুষের সঙ্গে সেক্স করতে আমার ভালো লাগে। বিচিত্র যৌন অভিজ্ঞতা হয় আমার, যা খুবই মজাদার। পূর্ণ স্বাধীনতায় আমি আমার কাজ করি। ইচ্ছে হল করি, ইচ্ছে না হলে করি না। বাড়িতে রেস্ট নিই। আমি সোনাগাছি অঞ্চলে কাজ করি বটে। কিন্তু থাকি না। ঘড়ি ধরে বাড়ি থেকে বেরোই, আবার ঘড়ি ধরে বাড়িতে ঢুকে যাই। বেরোনোর সময় কোনো ক্লায়েন্ট এলেও ছেড়ে দিই। বাড়ির সবাই জানে আমি চাকরি করি। এটা আমার কাছে এখন আর পেশা নয়, নেশা। অর্থ ও যৌনসুখ দুই-ই পাই।”

অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর বখে যাওয়া বাঙালি বাবু’ সম্প্রদায় এই অঞ্চলে নিজ নিজ উপপত্নীদের প্রতিপালন করতেন। এই অঞ্চলের বেশ কিছু বাড়ি নির্মিত হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে। প্যারিসের যৌনকর্মীরাও এই সোনালি অঞ্চলের (Golden District) খ্যাতি সম্পর্কে অবহিত ছিল। সেই বাবু সম্প্রদায় আজ নিশ্চয় নেই। তবে অন্য এক বাবুরা তো আছেন যাঁরা লুকিয়ে গণিকাদের সঙ্গ নেন। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থেকে সমাজের মান্যগণ্য অনেক ব্যক্তিবাবুরাই গণিকালয়ে পদধূলি দেন। সোনাগাছিতে আর-এক ধরনের ‘বাবু’-র সন্ধান পাওয়া যায়। আসুন, সেইসব বাবুদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই।

সোনাগাছির অন্দরমহলে ‘বাবু’ কাকে বলে? নিষিদ্ধপল্লিতে ‘বাবু’, ‘বসা’, ‘বাড়ি’ ইত্যাদি শব্দগুলির চালু আছে। শুধু বাবুদের কথাই বলি, সাধারণ ক্লায়েন্ট বা খরিদ্দারদের আর বাবুদের মধ্যে তফাতটা বুঝে নিই। বাবু তাঁরাই, যাঁরা যৌনকর্মীদের খরিদ্দার। সাধারণ খরিদ্দাররা শুধুমাত্র যৌন উত্তেজনা প্রশমণ করতে যৌনকর্মীদের সঙ্গ নেয় কিছু সময়ের জন্য। এঁদের অন্য কোনো দায় নেই। পয়সা ফেলবে, তার বিনিময়ে যৌনসুখ নেবে। ফেলো কড়ি মাখো তেল। কিন্তু বাবুদের দায় আছ। দায় থাকে। বাবু হল বাঁধা কাস্টমার, যাঁর সঙ্গে একজন যৌনকর্মীর সম্পর্ক প্রায় স্বামী-স্ত্রীর মতো। সেই সম্পর্কে ভালোলাগা থাকে, ভালোবাসা থাকে, আবার একটু আশ্রয়ের জন্যেও হতে পারে। এই যৌনকর্মীরা মূলত সোনাগাছি এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা। বাঁধা খরিদ্দারের দায়িত্ব অনেক বেশি। এঁরা বসন্তের পাখি নয়। এঁদের কেউ কেউ উপাসনালয়ে গিয়ে শাখাসিঁদুর পরিয়ে বিয়েও করে নেয়। কাঁধে তুলে নেয় আজীবনের দায়িত্বভার। এঁরা গণিকাপল্লিতে ‘বাবু’ হিসাবেই পরিচিত।

সমাজের যে-কোনো স্তরের খরিদ্দাররাই বাবু হতে পারে। কোনো বাছবিচার নেই। অফিসের পিওন থেকে শুরু করে কোনো উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী, ডাক্তার, আইনজীবী, মাফিয়া ডন, পুরোহিত, কুলি-কামিন, ঠ্যালাওয়ালা–কে নয়! তবে সব মাছ যেমন ইলিশ নয়, তেমন সব পুরুষই জাত-বাবু নয়। বাবুদেরও প্রকারভেদ আছে। বাবুদের দায়বদ্ধতাকে কেন্দ্র করেই প্রকারভেদ।

(১) টাইমের বাবু : ইনি সেই পুরুষ, যিনি কাম্য নারীর কাছে টাইমে আসেন, টাইমেই যান। মধু খেতে আসেন, খাওয়া হলেই ফুড়ৎ। ইনি বসন্তের পাখি। দায়িত্ব তো নেই-ই, উলটে বিপদ বুঝলেই ধা। তবে নীতিগতভাবেই এই পুরুষটি অন্য মেয়ের ঘরে যান না। তাই ইনি বাঁধা বাবুর মর্যাদা পান।

(২) সাহসী বাবু : ইনি সেই পুরুষ, যিনি ভালোবাসার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। যৌনকর্মীটিকে বিয়েও করেছেন। বিয়ে করে নিজের বাড়িতেও নিয়ে যান মর্যাদার সঙ্গে নিজের বাড়ি না-থাকলে ঘর ভাড়া করেও অন্যত্র থাকেন।

(৩) অভিজাত বাবু : ইনি সেই পুরুষ, যিনি ভালোবাসার বিবিকে সাহস করে নিজের বাড়ি বা অন্য কোথাও নিয়ে যেতে পারে না। তবে বিবিটির সারাজীবনের দায়িত্ব নেন। অন্য কোনো বাবুর সঙ্গে সেই বিবি সহবাস করতে পারবে না। তবে বাবুটি মেয়েটির ‘যৌনকর্মী’ হিসাবে বিশ্বস্ত থাকবেন, এমন কোনো গ্যারান্টি নেই। বাবুটি অন্য একাধিক যৌনকর্মীর সঙ্গে শোবেন, শুতে পারেন।

(৪) খাওয়া-মোছা বাবু : এই বাবু অবশ্য কাঠ-বেকার পুরুষ। কোনো যৌনকর্মীর অন্নে প্রতিপালিত হয়। বিনিময়ে ঘর মুছে দেওয়া, রান্না করে দেওয়া, বাজার করে দেওয়া, বিভিন্ন ফাইফরমাস খাটা ইত্যাদি।

পড়ন্ত বয়সে যৌনকর্মীদের পরিণতি কী? এই প্রশ্নটার উত্তর তো খুঁজতে হবে। দুটি পরিণতি দেখতে পাওয়া যায়–(১) গেরস্ত হওয়া এবং (২) হাফ-গেরস্ত হওয়া। গেরস্ত হওয়া মানে যদি কোনো বাঁধা বাবু’, সে মজুর দালাল পাতি চাকুরে বা ব্যাবসায়ী যেই হোক তাকে ধরে কপালে সিঁদুর নিয়ে কোথাও সংসার পাতা যায়। অপরদিকে হাফ-গেরস্ত মানে অন্তত কোনো বাঁধা বাবু’ পাওয়া, যে তাঁকে বিপদে-আপদে দেখবে, হয়তো দু চার পয়সা মূলধন দিয়ে সাহায্য করবে, যাতে কিনা সে কালেকালে বাড়িওয়ালি’ হয়ে উঠতে পারে। এইভাবেই তাঁর পেশার উত্তরণ হয়। এই দুয়ের মধ্যে কিছুই না-হলে ক্ৰমে ওই পল্লিতেই ঝি-গিরি করে পেট চালাতে হয়। নয়তো পথে পথে ভিক্ষে করে বেড়াতে হয়। যদি দেশ-গাঁঘর-আত্মীয় বলে কিছু খুঁজে পাওয়া যায়, তবে। সেখানেই বেঁচে থাকার অন্তিম ঠাঁই মেলে।

যে সমস্ত পুরুষরা ওই পাড়ায় থাকে তাঁরা অধিকাংই নেশাগ্রস্ত, বেকার, গণিকাদের উপার্জনের নির্লজ্জ পরজীবী। ওইসব নিষ্কর্মা গুলিশোর পুরুষরাই ওদের (গণিকাদের) প্রহার করে, অত্যাচার করে। সংগঠনের সদস্য অলংকৃত করে, মতামত প্রদান করে। এইসব পুরুষপুঙ্গবদের হাত থেকে, দালালদের হাত থেকে, মাসিদের হাত থেকে অত্যাচারিত মেয়েদের রক্ষা করতে পারবে কারা? সংগঠন? সংগঠনের কর্মকাণ্ডে মিশে গেছে অত্যাচারী যাঁরা, তাঁরাও। গণিকাপল্লির স্থায়ী বাসিন্দা দুর্ভাগা গণিকাদের কথা বলবে কারা? সংগঠন? ওদের কণ্ঠ কারা? সংগঠন ও স্বেচ্ছাসেবীরা, যাঁরা মৌচাকে রানি-মৌমাছি হয়ে বসে আছে পিরামিডের চূড়ায়। সংগঠনের অফিস আছে, অফিসে মোটা বেতনের চাকুরে আছে, সংগঠনের প্রেস আছে, সভা-সমিতি আছে। সংগঠনের রাজনীতি আছে। পাড়া কোন রাজনৈতিক দলের কুক্ষিগত থাকবে, তা নিয়ে নিত্য লড়াই-সংঘর্ষ আছে।

যৌনপল্লির মেয়েদের যৌনজীবন ঠিক কেমন? গড়পড়তা একজন যৌনকর্মীকে প্রতিদিন কমপক্ষে চারবার যৌন-সম্পর্ক করতেই হয়। দিনের বা রাতের খরিদ্দারটির জন্য যখন সে ‘বসছে’, তখন সে অবসন্ন, ক্লান্ত। সপ্তাহে সাতদিন, মাসে তিরিশ দিনে, বছরে তিনশো পঁয়ছট্টি দিন নিরন্তর যৌবন বিক্রি করতে হয় যৌনকর্মীদের। ইচ্ছা হলে কাজ করব, না-ইচ্ছা হলে কাজ করব না–এমন চিন্তা মাথাতেই আনতে পারবে না। যৌনপল্লির এইসব স্থায়ী বাসিন্দারা। এঁদের একপ্রকার যৌনদাসীই বলা যায়। এঁরা শ্রমিক, যেমন কলকারখানায় কায়িক শ্রমের বিনিময়ে অর্থোপার্জন করে। ভালো না-লাগলেও একঘেয়ে লাগলেও শ্রম দিয়ে যেতে হয়। কারণ এই শ্রমটা না-দিলে সেই যৌনকর্মীর মুখে ভাত উঠবে না। বসিয়ে বসিয়ে কে কাকে খাওয়ায় এ পৃথিবীতে!

বিচ্ছিন্ন প্রবাসী শ্রমিকদের বস্তির মধ্যে গণিকাপল্লি এখনও জাঁকিয়ে বসতে পারেনি, যেখানে কলকাতার মেয়েরা ওভারটাইম খাটে। গণিকাদের কাজ হল যথাযথ অর্থের বিনিময়ে পুরুষদের যৌনসুখ দিতে হয়। শুধুই কি যৌনসুখ? একজন পুরুষ যখন মূল্য দিয়ে একতাল নারীমাংস ভাড়ায় নেয়, তখন সে মনে করে সব কিনে নিয়েছে। তখন যৌনসুখ যৌনকর্মীদের মাথায় উঠে যায়। ক্রেতাপুরুষটি মনে করে মূল্য যখন সে দিয়েছে, তখন সে যা খুশি করতে পারে। সে যেমন সঙ্গম করতে পারে, তেমনি যৌন-বিকৃতি চরিতার্থ করতে পারে, যৌনকর্মীকে প্রহার করতে পারে, ধর্ষকাম মেটাতে পারে, যৌনকর্মীর যৌনাঙ্গে জ্বলন্ত সিগারেট ঠুসে দিতে পারে।

শুধু কলকাতার সোনাগাছিই নয়। সোনাগাছি ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি প্রসিদ্ধ যৌনপল্লি আছে কলকাতাতে। যেমন হাড়কাটা গলি, বউবাজার, খিদিরপুর আরও অনেক। কলকাতা ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলাতে অসংখ্য গণিকাপল্লি আছে। জেলার হোটেল ও রিসোর্টগুলিতেও যৌনকর্মীদের রমরমা ব্যাবসা চলে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *