০৭. দেবদাসীর অন্য নাম গণিকা

০৭. দেবদাসীর অন্য নাম গণিকা

দাসপ্রথারই একটা বিশেষ দিক এই দেবদাসী প্রথা। বিজয়ী জাতি বিজিত জাতিদের দাসে পরিণত করত। পুরুষ বন্দিরা দাস, নারীরা হত দাসী। দাসদের নিয়ে কী করা হত, সে বিষয়টি এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। তবে বিজিত বন্দি নারীরা হতেন ভোগের বস্তু। লালসা নিবৃত্তির যন্ত্র মাত্র। দাসত্বের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছেন নারী। অসম্মানিত হয়েছেন চরমভাবে। তাঁদের শরীর তাঁদের অধিকারে ছিল না। সেই অধিকার ছিল ভোগীদের। হাটে বিক্রি হত নারী। সেই হাটে নগ্ন করে দেখা হত নারী-শরীর। পছন্দ হলে ক্রেতারা ভোগের জন্য নিয়ে যেত। নারীদেহ চিরদিনই ভোগের সামগ্রী। বিংশ শতাব্দীর শেষপ্রান্তে এসেও এই পণ্য ব্যাবসায় ভাটা পড়েনি। এখান থেকেই শুরু হল দেবদাসীর চর্চা। এটি একটি ঘৃণিত প্রথা। ধর্মের মোড়কে বেশ্যাবৃত্তির মহান স্বীকৃতি। এরা নিতান্তই ভোগসুখের উপকরণ হিসাবে ব্যবহৃত হল মেয়েরা। রাজা, রাজপুরুষ মায় পুরোহিতদের যৌন-মনোরঞ্জন করাই হল এঁদের অবশ্য কর্তব্য। পুরোহিতদের পৌরোহিত্যেই এই পবিত্র’ প্রথা যুগ যুগ ধরে চলে এসেছে। আর এই যৌন-মনোরঞ্জনের আয়োজন হয় মন্দির বা দেবালয়ে। দেবতার নামে চলে নারীমাংসের উৎসব। শুধু ভারতেই নয়, এই প্রথা সারা বিশ্বজুড়ে চলে নানা মুখোশে, নানা রূপে। তবে ভারতে এই প্রথা ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল।

নারীপণ্যের একটা বিশাল বাজারই হল মন্দির। মন্দিরে হত বলেই দেবদাসী, মন্দির ছাড়া অন্য কোথাও হলে ‘গণিকা’। ভারতীয় নারীসমাজ বহুকাল যাবৎ এই প্রথার কারণে অসম্মানিত এবং অত্যাচারিত। এই প্রথা কেন বিস্তার লাভ করেছে, অতীত ও বর্তমানের অবস্থা বোঝা ও জানা প্রয়োজন।

মিশর পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্য দেশ বলে পরিচিত। এই দেশেই আমরা দেখতে পাই প্রথম দেবদাসী বৃত্তির কথা। আমন, আমনের স্ত্রী মুট এবং তাঁদের পুত্রসন্তান খোন সু–এই তিন দেবতার প্রতিষ্ঠা করেন মিশরের রাজারা। খ্রিস্টজন্মের প্রায় ১৪০০ বছর আগে রাজা তৃতীয় আমেস হোটেপ থিবস নগরীতে মহাসমারোহে মন্দির নির্মাণ করেন। মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে বিপুল পরিমাণে ধনসম্পদ লুঠ করে এই মন্দির নির্মাণ এবং দেবতার ভোগের উপকরণের জন্য ব্যয় করেন। এই মন্দিরে দাসদাসীও প্রচুর মজুত ছিল। এই সময়ের একটি দলিল থেকে জানা যায়, তৃতীয় রামেসিস আমন মন্দিরের জন্য ৮৬,৪৮৬ জন দাসদাসী উৎসর্গ করেছিলেন। ‘Great Harris Papyrus’ নামে এই দলিলটি সম্ভবত মন্দিরে দেবদাসী নিয়োগের প্রামাণ্য দলিল।

রামেসিস বংশের শেষ রাজার মৃত্যুর পর মিশরের শাসনভার যুগ্মভাবে তানিসের ফারাও ও থিবসের প্রধান পুরোহিতের উপর ন্যস্ত হয়। তানিসের রাজকন্যারা থিবসের মন্দিরে আমনদেবের স্ত্রী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকেন। সমাজের উচ্চকোটি নারী থেকে ক্রীতদাসী পর্যন্ত মন্দিরের দেবদাসী হিসাবে অংশগ্রহণ করত। আসিরীয় ও ব্যাবিলনীয় সভ্যতার ইতিহাসে দেবী ইশরাতের সঙ্গিনীরূপে নারীরা মন্দিরে দেবদাসী হিসাবে নিযুক্ত হত। এসময় ব্যাবিলনের দেবতারা হলেন–মারডুক, শামাশ, তাম্বুজ ও ইশতার। প্রাচীন ব্যাবিলনে প্রতিটি বিবাহযোগ্যা নারী দেবী ইশতারের মন্দিরে বসে থাকবেন। প্রথমেই যে পুরুষ অভীষ্ট নারীর কোলে একটি রৌপ্যমুদ্রা ফেলবেন, সেই পুরুষের সঙ্গেই নারীটি যৌনমিলনে প্রবৃত্ত হবেন। বিবাহ-পূর্ব বেশ্যাবৃত্তি এভাবেই শুরু হয়ে যেত। মন্দির-দাসীদের এই হল বেশ্যাবৃত্তির ইতিহাসের বাধ্যতামূলক সোপান।

আফ্রিকার উত্তর উপকূলে ফিনিশীয় মন্দিরগুলিতেও নর্তকী ও দেবদাসীর কথা জানা যায়। প্রাচীন গ্রিসের মন্দিরগুলোতেও দেবদাসী নিযুক্ত হত। Hierodule নামে এই দেবদাসীরা সূর্যদেবতা অ্যাপোলোর মন্দিরে সর্বত্রই দেবদাসী থাকত। শুধু অ্যাপোলোর মন্দিরেই নয়, গ্রিসের অন্যান্য মন্দিরেও দেবদাসী মজুত থাকত যথেষ্ট সংখ্যায়। এদের কাজ ছিল নৃত্যগীত প্রদর্শন এবং বাধ্যতামূলক গণিকাবৃত্তি। কেবলমাত্র পুরোহিত, রাজা ও ক্ষমতাশালীদের কাছেই এরা ভোগ্যা ছিল। আর্টেমিসের মদিরা দেব বাছুজের মন্দিরে দাসীরা বাধ্য হত এক বিচিত্র জীবনযাপনে। এই দাসীদের কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হত। যেমন–Maenad, Amazon ইত্যাদি। Maenad নারীদের শিশু বয়স থেকেই দেবদাসীর উপযুক্ত করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। Amazon নারীরা যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শিনী। তাঁরা এতটাই উৎসর্গীকৃত ছিল যে, ডান কাঁধে তূণ রাখতে যাতে বাধা সৃষ্টি না-হয়, সেজন্য ডানদিকের স্তনটি কেটে ফেলতেন। বস্তুত একস্তনী হয়ে যেতেন বলেই এঁদের নাম A-mazon। এঁদের যে সন্তানসন্ততি হত, তাঁর মধ্যে কন্যাসন্তানটিকেই বাঁচিয়ে রাখা হত এবং পুরুষসন্তানদের হত্যা করা হত, নতুবা দেশ থেকে বিতাড়িত করা হত। কন্যাসন্তানদের বাঁচিয়ে রাখা হত মানে এই নয় যে, সন্তান খুব আদরনীয় ছিল। আদরনীয় ছিল, তবে তা ছিল ভোগ্যবস্তু বানানোর জন্য।

রোমান সভ্যতাতেও দেবদাসী প্রথার সন্ধান পাওয়া যায়। দাসনির্ভরশীল এই রোমান সভ্যতার জিউস, জুনো ও ভেনাসের মন্দির সহ অন্যান্য মন্দিরগুলিতে প্রচুর দেবদাসীও নিযুক্ত থাকত। পুরোহিতদের মনোরঞ্জন করাই ছিল মূল কাজ। তবে রাজা ও রাজপুরুষদেরও ভোগ্য ছিল। মনে করা হত, দেবতার ভোগ আর রাজাদের ভোগ সমপর্যায়ের। দেবদাসীদের পাশাপাশি রাজনটী ও নগরনটীদেরও আবির্ভাব হয়েছিল এ সময়। এদের Hataera বলা হত। তবে এঁদের সম্মান-মর্যাদা ছিল বেশ। এঁদের মতামতেরও মূল্য দিতেন জ্ঞানীগুণীরা।

Hataera-দের মতো জাপানের Geisha-দেরও যথেষ্ঠ মর্যাদা ছিল। সুন্দরী শিক্ষিতা এই নারীরা শুরুতে আলাপাচারণে শ্রোতাদের মোহাবিষ্ট করার কাজে নিয়োজিত হলেও পরে অবশ্য সরাসরি গণিকাবৃত্তিতে প্রবিষ্ট হতেন। তবে প্রাচীন জাপানে দেবদাসী ছিল কি না সে বিষয়ে কিছু জানা যায় না। ইনকা সভ্যতাতেও আমরা দেবদাসী প্রথার সন্ধান পাই। ইনকা সম্রাটদের সূর্যের সন্তান বলা হত। ইনকার সূর্যের মন্দিরের তত্ত্বাবধানের জন্য পুরোহিত ছিল। এই মন্দিরে নারীরা সূর্যকুমারী হিসাবে মন্দিরবাসিনী হত। মন্দিরবাসিনী এই নারীদের কাজ ছিল পুরোহিত ও রাজবংশীয়দের মনোরঞ্জন করা। দেবদাসী প্রথা ছিল আটজেক সভ্যতার ইতিহাসেও।

ভারতে দেবদাসী প্রথা নামে গণিকাবৃত্তি একেবারে জাঁকিয়ে প্রাচীন যুগে এবং মধ্যযুগে, যা বর্তমান যুগেও ফল্গুনদীর মতো বহমান। ভারতের দেবদাসী প্রথার সূচনার ইতিহাস ঘাঁটলে আমরা খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর এক গুহালিপি পাই। যে গুহালিপিতে সুতনুকা নামে এক দেবদাসীর কথা জানতে পারি। উল্লিখিত উত্তীর্ণ লিপিতে বলা হয়েছে–“সুতনুকা নাম দেবদাসিক্য তং কাময়িখ বালানশেয়ে দেবদিন্নে নাম লুপদকখে”। অর্থাৎ, সুতনুকা নামে দেবদাসী, তাঁকে কামনা করেছিল বারাণসীবাসী দেবদিন্ন (দেবদত্ত) নামে রূপদক্ষ। যোগীমায়া গুহা, সীতাবেন্দা ইত্যাদি নামে যে গুহার সন্ধান পাওয়া গেছে, লিপির সাহায্যে দ্বিধাহীনভাবে প্রমাণিত হয়েছে, এই গুহামঞ্চবাসীরা মূলত দেবদাসী শ্রেণির ছিল। পুরাণাদিতে আমরা যে স্বৰ্গবেশ্যা তথা অপ্সরাদের কথা জানতে পাই, তাঁরা ছিল আসলে হাই-প্রোফাইলের দেবদাসী।

ভরতের নাট্যশাস্ত্রে আমরা অপ্সরাদের পাচ্ছি নৃত্যগীতশিল্পী ও অভিনেত্রী হিসাবে, যাঁরা তথাকথিত দেবতাদের মনোরঞ্জনে ব্রতী হতেন। অপ্সরারা কোনো অলৌকিক বা কাল্পনিক অস্তিত্ব নয়, তাঁরা প্রকৃতপক্ষে রক্তমাংসের মানবী মাত্র। নাট্যশাস্ত্রের শুরুতেই এইসব নাট্যকুমারীদের কথা এবং অপ্সরাদের কথা বলা হয়েছে। এই নাট্যকুমারীরা একটি বিশেষ গোষ্ঠীভুক্ত ছিল, একথাও উল্লেখ আছে। এঁদের যে-কোনোভাবে সংগ্রহ করে অতি সহকারে নৃত্যগীতবাদ্য শিক্ষা দিয়ে রঙ্গমঞ্চে হাজির করা হত, তার বিশদ বর্ণনা আছে ভরতের নাট্যশাস্ত্রে। প্রসিদ্ধ তামিল নাটক ‘শিল্পপ্পাদিকর’-এর কয়েকটি অধ্যায়ে দক্ষিণ ভারতীয় প্রাচীন সংগীত ও নৃত্যের উল্লেখ আছে। এই নৃত্য অবশ্যই দেবদাসী নৃত্য। ধনবানদের বিলাসকলার অন্যতম প্রধান উপকরণ ছিল নারী। আর নারীরা ছিলেন সুশিক্ষিতা, সুবেশা এবং অবশ্যই কামশাস্ত্রনিপুণা।

বঙ্গদেশে দেবদাসী প্রথার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় অষ্টম শতকে কলহনের ‘রাজতরঙ্গিনী’ গ্রন্থে, নর্তকী কমলার প্রসঙ্গে। বঙ্গদেশে পালযুগেও দেবদাসী প্রথার অনেক বর্ণনা পাওয়া যায়। গুপ্তযুগেও এইসব নর্তকীদের সম্বন্ধে বহু বর্ণনা পাওয়া যায়। বিজয়সেনের দেওপাড়া প্রশস্তিও এই প্রথার ব্যাপকতার ইঙ্গিত মেলে। দেওপাড়া প্রশস্তির কবি উমাপতি ধর লিখেছেন–বিষ্ণুমন্দিরে উৎসর্গীকৃত দেবদাসীরা যেন রূপ ও সৌন্দর্যের দ্বারা কামদেবতাকে পুনরুজ্জীবিত করেছেন। ভট্ট ভবদেবের ভুবনেশ্বর প্রশস্তিও একই কথা বলেছে। দ্বাদশ শতাব্দীর সূচনায় কর্ণরাজের রত্নগিরি তাম্রশাসন থেকে জানা যায়, তাঁর রানি কর্পূরশ্রী সলোনপুরের বৌদ্ধমন্দিরের দেবদাসী ছিলেন। কর্পূরশ্রীর মা মাহুনদেবীও দেবদাসী ছিলেন। কর্ণাটকে দ্বাদশ শতাব্দীর সূচনায় চালুক্যরাজ বিক্রমাদিত্য ইত্তাগিতে চণ্ডালেশ্বর মন্দির প্রতিষ্ঠা করে বিভিন্ন দেশ থেকে সুন্দরী নারীদের এনে সেখানে দেবদাসীরূপে নিয়োগ করেন। পহুবী লিপিগুলিতে দেবদাসীদের কথা উল্লেখ আছে। দেবদাসীদের নিয়ে আলাদা বর্ণনা পাওয়া যায় ‘মেঘদূত’ সহ বিভিন্ন কাব্যে।

সম্প্রতি “কর্ণাটক রাজ্যের দেবনগর জেলার উত্তরঙ্গমালা দুর্গা মন্দিরে রাতের বেলায় নারীদের দেবতার নামে উৎসর্গ করার অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে”–এই মর্মে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের আবেদনের ভিত্তিতে সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন এক বেঞ্চ রাজ্যের মুখ্যসচিবকে ওই অনুষ্ঠান বন্ধ করার নির্দেশ দেন। এই কুপ্রথা কার্যত নারীদের যৌনশোষণ, যা ভারতে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল ১৯৮৮ সালে। আশা ছিল এর ফলে দেবদাসীদের সামাজিক যৌনশোষণ বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু তা হয়নি। এখনও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতে, মহারাষ্ট্রে, ওড়িশায় এবং দেবতাকে উৎসর্গ করার নামে দেবদাসীদের প্রধানত দেহভোগের কাজেই ব্যবহার করা হয়। দেবতা বা মন্দিরে উৎসর্গ করার পর তাঁদের পরিচয় হয় দেবদাসী। কোনো কোনো অঞ্চলে তাঁদের বলা হয় যোগিনী।

প্রায় হাজার বছরের প্রাচীন এই প্রথা ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এর পিছনের বড়ো কারণগুলি হল চরম দারিদ্রতা, বর্ণবৈষম্য ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। গরিব ঘরের মা-বাবা তাঁদের কুমারী মেয়েদের রজস্বলা হওয়ার আগেই নিয়ে আসত মন্দিরে। প্রথমে কুমারী মেয়েদের নিলাম করা হয়। তারপর মন্দিরের প্রধান পুরোহিত উৎসর্গ করার নামে বিগ্রহের সঙ্গে কুমারী তথাকথিত ‘বিয়ে’ দিয়ে দেন। এর ফলে সেই মেয়ের কোনো পুরুষই স্বামী হতে পারে না। নিরাকার দেবতাই তাঁর একমাত্র স্বামী। খাওয়া-পরার বিনিময়ে মন্দিরের বাসিন্দা হয়ে তাঁদের সারাজীবন কাটিয়ে দিতে হয়। কায়িক পরিশ্রমের সঙ্গে সঙ্গে মন্দিরের প্রধান পুরোহিত থেকে মন্দিরের অন্যান্য পুরুষদের সঙ্গে যৌনক্রিয়া করতে হত। এছাড়াও সমাজের উচ্চবর্গীয় ধনী কিংবা সামন্তপ্রভুদের রক্ষিতার ভূমিকা পালন করতে হয়। মন্দিরের পূজারী ব্রাহ্মণ এবং সামন্তপ্রভুদের যোগসাজসে কৃষক ও কারুশিল্পী বা কারিগরদের উপর ধর্মীয় প্রভাব খাঁটিয়ে দেবদাসীদের গণিকাবৃত্তিকে দেওয়া হয় ধর্মীয় সিলমোহর। উৎসর্গের পর দেবদাসীকে ভোগ করার প্রথম অধিকার মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের। আজব ব্যাপার, অন্য কোনো পুরুষকে নিজের স্বামী রূপে গ্রহণ করা যাবে না, কিন্তু যৌনমিলনে কোনো বাধা নেই! এই ধর্মীয় প্রথার উৎপত্তির ইতিহাস নিয়ে নানা কাহিনি, বিতর্ক এবং বিভিন্ন জনশ্রুতি প্রচলিত আছে। দেবদাসীদের তথ্য ঐতিহাসিক বা পুরাতাত্ত্বিক বিভিন্ন মন্দিরের গাত্রে আজও উৎকীর্ণ আছে।

দক্ষিণের তিরুপতি মন্দিরে দেবদাসী সংগ্রহের প্রাচীন পদ্ধতি সম্পর্কে খ্রিস্টান মিশনারি অ্যাবে জে এ র্দুবা এক সমীক্ষায় লিখেছেন–“বছরের একটি বিশেষ দিনে এই মন্দিরের পুরোহিতেরা ভগবান বেঙ্কটেশ্বরের প্রতিমূর্তি নিয়ে শোভাযাত্রা বের করতেন এবং পথে যত সুন্দরী মেয়ে চোখে পড়ত তাঁদেরকে দেবদাসী করার দাবি জানাত। শুধু কুমারী মেয়েই নয়, সুন্দরী বিবাহিত মেয়েদেরও দাবি করত তাঁরা। এ থেকেই বোঝা যায়, দেবদাসী করার জন্য মেয়েদেরকে জোর করেই তুলে আনা হত।” দুবার এহেন মন্তব্য। গবেষক পণ্ডিত জি জি ফ্রজার পশ্চিম আফ্রিকায় দেবদাসী সংগ্রহের যে অভিনব উপায়ের উল্লেখ করেছেন, তা থেকে জানা যায়–মেয়েদের জোর করে তুলে এনে দেবদাসী থেকে গণিকা বানানো হত। ফ্রিজার লিখেছেন–“পুরোহিতরা একটা বিশেষ দিনে নগরের পথে পথে ঘুরে বেড়াত এবং সেদিন দুয়ারের বাইরে যত কুমারী মেয়ে পেত তাঁদের সবাইকে ধরে নিয় যেত মন্দিরে দেবদাসী করার জন্যে।”

রাজ্য জয় করে রাজারা যেমন গোরু-ছাগলের মেয়েদের মতো তুলে আনত, তেমনই সেইসব মেয়েদের ধরে ধরে দেবদাসী তথা গণিকায় পরিণত করত। আদতে এভাবেই দেবতাদের বউ বানানোর অছিলায় মেয়েদেরকে গণিকা বানিয়ে গণভোগ্যা বানিয়ে নিত সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। ১৮৬৭-৬৮ সালে জন শর্ট লন্ডনের অ্যানথ্রোপলজিক্যাল সোসাইটিতে ভারতের দেবদাসীদের প্রসঙ্গে একটি বিস্ফোরক রিপোর্ট পেশ করেন। রিপোর্টে বলা হয়েছে–মন্দিরে দেবদাসীদের কুমারীত্ব’ বহিরাগত ধনীদের কাছে চড়া দামে বিক্রি করা হত। তারপর তাঁরা গণিকাবৃত্তিতে নিয়োজিত হত।

এ প্রসঙ্গে বলা যায়, সব মেয়েকে যে জোর করে দেবদাসী বানিয়ে নেওয়া হত, তা কিন্তু নয়। দেবদাসী মাহাত্ম এমন পর্যায়ে প্রচার করা হয়েছিল যে, অনেকেই স্বেচ্ছায় দেবতার কাছে নিজেদের উৎসর্গ করে দিত। পুণ্যলাভের আশাতেও মা-বাবারা দেবতার সঙ্গে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিত। তবে এঁদেরকে মন্দিরে আত্মসমর্পণ করতে হত না, গণভোগ্যাও হতে হত না। অবশ্যই দেবতা বিয়ে করে দেবতার কাছে আত্মসমর্পণ করে সারাজীবন কাটিয়ে দিত। এমনই এক বিখ্যাত দেবদাসী মীরা তথা মীরাবাঈ। রাজস্থানের এক অভিজাতবংশীয় হিন্দু পরিবারের সন্তান। বাল্যকালে এক পরিব্রাজক সন্ন্যাসীর দ্বারা আরাধিত একটি কৃষ্ণমূর্তির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন এবং কৃষ্ণকে স্বামী হিসাবে গ্রহণ করেন। তাঁর মা তাঁর এই ভক্তিভাবের সমর্থক ছিলেন। শৈশবেই চিতোররাজ রানা সংগার জ্যেষ্ঠ পুত্র ভোজরাজের সঙ্গে মীরার বিয়ে হয়। কিন্তু বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন তিনি শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। স্বামী ভোজরাজকে বলেন, তিনি মীরার শরীর পাবেন, কিন্তু মন পাবেন না। কারণ মীরা তাঁর মনপ্রাণ সব কৃষ্ণের পায়ে নিবেদন করেছে।

ভবিষ্যপুরাণে আছে–“বেশ্যাকম্বকং যস্তু দদ্যাৎ সূর্যায় ভক্তিতঃ সগচ্ছেৎ পরমং স্থানং যত্র তিষ্ঠতি ভানুমান”। মহাকবি কালিদাস তাঁর মেঘদূতে উজ্জয়িনী মহাকাল মন্দিরে চামরহস্তা দেবদাসীদের ‘বেশ্যা’ বলে পরিচিত করিয়েছেন। দেবদাসী সৃষ্টির পিছনে ছিল মানুষের অশিক্ষা, কুশিক্ষা, ভুল ধারণা ও ধর্মান্ধতা। সাধারণ মানুষ মনে করত আত্মজাকে দেবদাসী করে দিতে পারলে শুধু দাতার নয় কন্যারও স্বর্গলাভের একটা পাকা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। যে ভাবনা থেকে নবমবর্ষীয় কন্যাকে কুলীন বৃদ্ধের কাছে গৌরীদান করত ভারতীয় হিন্দু পিতামাতারা। যেমনভাবে বোঝানো হত মৃত স্বামীর সঙ্গে চিতায় উঠে সহমরণে গেলে সরাসরি স্বর্গের জমি নিশ্চিত। সতী হিসাবেও পুজো পাবে সেই অভাগা নারী। আসলে এমনই বোঝানো হত। বোঝাত হিন্দু সমাজের পুরোহিতকুল।

কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে দেবদাসীদের আলোচনা করেছেন। তবে তিনি দেবদাসী শ্রেণির আইনকানুন লিপিবদ্ধ করেননি। তিনি এটা অবশ্যই বলেছেন যে, এসব ব্যাপারে আইনকানুনের দায়িত্ব পুরোহিত তথা পুরোহিততন্ত্রের। অর্থাৎ মধ্যযুগ থেকেই দেবদাসীদের উপর ওই পুরোহিতকুলের অধিকার ইতিহাস স্বীকৃত। যাঁরা দূরদর্শনে ‘অগ্নিজল’ ধারাবাহিকটি চাক্ষুষ করেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই এতদিনে জেনে গেছেন দেবদাসী নিয়ন্ত্রণে পুরোহিতদের কী দাপট! পুরোহিতদের আধিপত্য এতটাই যে দোর্দণ্ডপ্রতাপ রাজাও ভয়ে সিঁটিয়ে থাকত। রাজাদের তরফ থেকে দেবদাসীদের বিষয়ে কোনো ভালো-মন্দ পরামর্শই পুরোহিতরা গ্রহণ করত না। পুরোহিতরা নিজেরা যেসব আইনকানুন বা বিধিনিষেধ আরোপ করত, তা অতি যত্নে গোপন রাখা হত। পুরোহিততন্ত্র নিজেদের স্বার্থেই দেবদাসীদের লোকচক্ষুর আড়ালে রাখত চাইত। যা কিছু আড়ালে-আবডালে তাতেই মানুষের মোহবৃদ্ধি। এটাই মনস্তাত্ত্বিক বিষয়।

দেবদাসীদের মোটামুটি ছয় ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন–(১) বিক্রিতা, (২) ভৃত্যা, (৩) ভক্তা, (৪) দত্তা, (৫) হৃতা এবং (৬) অলংকারা। এই বিভাজন কেন? এই ভাগ-বিভাগ কেন? আসুন একটু বিস্তারিত জেনে নিই।

(১) বিক্রেতা : এই মেয়েদের অর্থের বিনিময়ে কিনে নেওয়া হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এরা অত্যন্ত গরিব পরিবারের সুন্দরী মেয়ে। অধিক মেয়েদের পিতামাতারা অর্থের বিনিময়ে এরকম দু-একটি মেয়েকে তুলে দিত পুরোহিতদের মালিকানায়। দেবদাসীর গর্ভজাতা মেয়েও এই দলেই অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। এইসব মেয়েরা যৌবনপ্রাপ্তা হলে মন্দিরের পুরোহিত নিজে অথবা তাঁর প্রিয়পাত্রকে দিয়ে সেই মেয়ের কৌমার্য নষ্ট করে দেবদাসী হিসাবে নিয়োগ করতেন।

(২) ভৃত্যা : বিশেষণ পড়েই বুঝতে পারছেন এরা আসলে ভৃত্য বা চাকরানি শ্রেণির। তাই স্বাভাবিকভাবেই এরা পদমর্যাদায় ‘বিক্রেতা’ দেবদাসীর নিচে। যৌবনবতীদের কর্তব্য ছিল মন্দিরের অতিথিবর্গকে দেহদানের মাধ্যমে শরীরী-পরিসেবা দেওয়া।

(৩) ভক্তা : স্বেচ্ছায় কোনো মহিলা (কুমারী, সধবা, স্বামী পরিত্যক্তা যে কেউ) মন্দির কর্তৃপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ করে যখন দেবদাসী হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে, তাহলে সে ভক্তা। ভক্তিই এদের আধার। এরা অতি উচ্চ সম্মানের পদাধিকারী। তবে এদেরকে যৌনকর্মে লিপ্ত হতে হত না।

(৪) দত্তা : কোনো ধর্মান্ধ পুণ্যলোভী পিতা মনোবাসনা চরিতার্থ করার জন্য, মানত রাখার জন্য, স্বেচ্ছায় নিজের মেয়েকে মন্দিরে দান করলে সেই মেয়ে দত্তা হয়।

(৫) হৃতা : এই মেয়েদের মূলত চুরি করে আনা হত। নিরুদ্দিষ্টার সন্ধান পেত না সেই অঞ্চলের নগরকোটালও। সেই মেয়ে বহুদূর দেশে মন্দিরের অন্ধকূপে বন্দিনী হিসাবে থাকত।

(৬) অলংকারা : যে-কোনো শ্রেণির দেবদাসীই রূপ-গুণ নৃত্যগীত পারদর্শিতার বিচারে অলংকারা পদে উন্নীতা হতে পারে। ঐহিক বিচারে এই মেয়েরা শীর্ষস্থানীয় হলেও শ্রদ্ধা ও সম্মানের দিক থেকে ভক্তা শ্রেণির নিচে।

দেবদাসী প্রথা নির্মূল হয়ে গেছে বলে যাঁরা নিশ্চিন্তের ঢেঁকুর তোলেন। তাঁদের বলি, তুলবেন না সেঁকুর। খবর আছে। কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, মহারাষ্ট্রের কিছু মন্দিরে এখনও বিগ্রহের কাছে মেয়েদের বিসর্জন দেওয়া হয়। আজকের দেবদাসীরা আর দেবতার দাস নয় অনেকক্ষেত্রেই। মূলত তাঁরা লোলুপ পুরুষের লালসার শিকার। আর এই লালসা তৃপ্ত করতে এগিয়ে এসেছে যেসব মন্দিরের রক্ষক, সেগুলির মধ্যে শ্রেষ্ঠ কর্ণাটকের ইয়েলাম্মা মন্দির। যেহেতু মন্দিরকন্যাদের বিয়ে হয় না, তাই তাঁদের বিনা বাধায় সম্ভোগ করে সমাজের বিভিন্ন স্তরের পুরুষরা। যে পূজারী দেবদাসী অর্পণের কাজে লিপ্ত, তিনি মোটা অঙ্কের অর্থপ্রাপ্ত হন। যাঁরা এই প্রথাকে তাঁদের জাতিগত ঐতিহ্যের অংশ মনে করেন, তাঁরা বড়োই তৃপ্ত হন! তা ছাড়া ইয়েলাম্মা মন্দিরের মেয়েরা প্রকৃত অর্থে দেবদাসী নন। এঁরা না বোঝেন চৌষট্টি কলা, না কোনো ধনীব্যক্তির রক্ষিতা। একপ্রকার খোলাখুলিভাবেই দেহবিক্রিই তাঁদের কাজ।

মহারাষ্ট্র ও কর্ণাটকের প্রান্তিক জেলাগুলি থেকে প্রতি বছর প্রায় ৫০০০ হরিজন শ্রেণির মেয়েদেরকে ইয়ালাম্মার কাছে অর্পণ করা হয়। এই প্রথার পিছনে শুধু বহু যুগের বিশ্বাস এবং অজ্ঞতা আছে তা নয়–আছে আর্থিক কারণ, আছে পুরোহিতদের প্ররোচনা। প্রাচীন প্রথার এই দুঃসহ আধুনিকীকরণ সবচেয়ে বেশি প্রচলিত কর্ণাটকের বেলগাঁও, ধারওয়ার, বিজাপুর, গলবর্গা ও বেলারি জেলায়। অন্যদিকে মহারাষ্ট্রের সিতারা, কোলাপুর, শোলাপুর ও ওসমানাবাদ অঞ্চলে এবং তেলেঙ্গানাতে যথাক্রমে ১০,০০০ এবং ২৫,০০০ দেবদাসী আছে। বংশপরম্পরায় এই মেয়েরা পুরুষদের ভোগ্যা।

সর্বোপরি যেটা না বললে অন্যায় হবে, তা হল–দেবদাসীরা ভারত-সংস্কৃতিকে দিয়েছে অনেক সম্পদ। কথাকলি, ভারতনাট্যম, মোহিনী-আউম, কুচিপুড়ি–এ সবই দেবদাসী সংস্কৃতি। যুগে যুগে এঁর দেবদিন্নদের উদ্বুদ্ধ করেছে মন্দিগাত্র অলংকরণে–কোনারক, খাজুরাহো, বেলুড়, হালেবিড থেকে বাঁকুড়ার মন্দিরেই রয়ে গেছে শ্বাশত প্রমাণ। তাঁদের দান অক্ষয়, অমর।

দেবদাসী প্রথার বিরুদ্ধে বহুদিন ধরে সংগ্রাম চলছে। তা সত্ত্বেও জাতীয় বা আন্তর্জাতিক ভাবনায় বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। ১৯২৯ সালে ডাঃ মুথুলক্ষ্মী রেডিড নামে এক মনস্বিনী মহিলার নেতৃত্বে দেবদাসী প্রথা উচ্ছেদের যে সংগ্রাম শুরু হয়, তার ফলে দেবদাসী প্রথা বিলোপের জন্য মাদ্রাজ বিধানসভায় আইন প্রণয়ন করে এই প্রথা নিষিদ্ধ করা হয়। বোম্বাই বিধানসভায় ডাঃ হরি সিং গৌরও অনুরূপ চেষ্টা করেছিলেন। ১৯৪৭ সালে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে দেবদাসী প্রথা নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আক্ষেপ এই যে, ভারতে দেবদাসী প্রথা আজও বিলুপ্ত হল না। এখনও যেসব অঞ্চলে দেবদাসী বহাল তবিয়তে চলছে, সেগুলি হল–কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র, গোয়া ও কেরলের একটা বড়ো অংশ। তাই দেবদাসী প্রথা বিলুপ্তির জন্য আন্দোলন থেমে যায়নি। ফলে আবার নতুন করে শুরু হয়েছে দেবদাসী-বিরোধী আন্দোলন। নেতৃত্ব দিচ্ছেন ‘দেবদাসী মুক্তি বাহিনী। নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও, আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কীভাবে দেবদাসী রমরম করে চলছে, সে ব্যাপারে স্থানীয়ভাবে কয়েকটি সমীক্ষা করা হয়েছে। সেই সমীক্ষায় উঠে এসেছে চমকপ্রদ তথ্য। জানা গেছে, এই দেবদাসী প্রথার মাধ্যমে মুম্বাই, বেঙ্গালুরু, দিল্লি, চেন্নাই পতিতালয়গুলি সমৃদ্ধ করা হচ্ছে। কারা এই প্রথাকে জিইয়ে রাখতে চাইছে কীভাবে রাখতে পারছে, সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা প্রয়োজন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *