লাখ টাকার আবর্জনা

লাখ টাকার আবর্জনা

মরচে-ধরা পেঁচানো সিঁড়িটার সামনে পৌঁছে হতাশ হয়ে ওপরদিকে তাকাল। রায় বুঝতে পারছে, তার পক্ষে অতগুলো ধাপ ভেঙে পাঁচতলার ওপরে ওই চিলেকোঠায় ওঠা সম্ভব নয়। তাহলে কি ফিরে যাবে? রাস্তার ধারে দাঁড়-করানো সোলার স্কুটারটার দিকে নজর পড়ল। ব্যাটারির অবস্থা কাহিল, এখন অন্তত ঘণ্টাছয়েক রোদ্দুরে চার্জ না করলে বাড়ি অবধি ফেরা যাবে কি না সন্দেহ। কী কুক্ষণে যে মাথায় ঢুকেছিল শর্মার সঙ্গে দেখা করার কথা। কিন্তু দেখা না করেই বা উপায় কী! কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। তার মানে পোশাকের এয়ারকন্ডিশনারটাও ঠিকমতো কাজ করছে না। শুধু অচল আর অচল। রায়ের জীবনের চারধারে ভাঙাচোরাদের ভিড় বেড়েই চলেছে। ভিডিয়োকোনটা চালু থাকলে কি আর মান্ধাতার আমলের সোলার স্কুটার চড়ে খুটুর খুটুর করে আড়াইশো মাইল পেরিয়ে শর্মার সঙ্গে দেখা করতে আসত? অবশ্য ভিডিয়োকোনটা অচল নয়, তিন বছর ট্যাক্স দেওয়া হয়নি। কিন্তু শর্মাও যে তাকে কোনওরকম সাহায্য করতে পারবে, সেরকম কোনও আশার আলো চোখে পড়ছে না। ওর বাসস্থানের অবস্থান তো রায়ের চেয়েও শোচনীয়। কিন্তু এত দূরে এসে দেখা না করে ফেরা সম্ভব নয়।

পনেরো-কুড়ি ধাপ উঠেই হাঁটুর ব্যথাটা টের পায় নতুন করে। জিরিয়ে নিতে হয়। এসক্যলেটর আর ভ্যাকুয়াম টানেলের যুগে প্রাক্তন অ্যাস্ট্রনট ভিক্টোরিয়ান আমলের কাস্ট আয়রন স্পাইরাল সিঁড়ি দিয়ে ঘামতে ঘামতে হাঁপাতে হাঁপাতে ওপরে উঠছে। ভাবলে হাসিও পায়, আবার জেদও চেপে বসে–একটা কিছু সত্যিই করা দরকার। এভাবে চলতে পারে না।

দরজার কাছে পৌঁছে রেলিংটা দু-হাতের মুঠোয় চেপে ধরে ঝুঁকে পড়ল রায়। চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। শরীরের নিচের অর্ধেকটা, ওপরদিকটাকে যেন নিচে টেনে নামাতে চাইছে। বুকভরে বারকয়েক শ্বাস নিল। অক্সিজেন সিমুলেটরের নলে মুখ গুঁজেও এখন লাভ হবে না। তিন বছর আগে শেষবারের মতো রিফিল করেছিল।

ঘরের মধ্যে সরকারি সিল ভেঙে ইলেকট্রনিক মিটারের ওপর ঝুঁকে বসে ছিল শর্মা। আঁতকে উঠল। নিউমেটিক চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল।

রিনা! রিনা! ফিসফিস করে ডাকল শর্মা।

–কে এল দেখ তো! এরকম নিঃশব্দে… বলে দিয়ে আমি নেই।

রিনা শুকনো মুখে এসে দাঁড়াল কিচেন থেকে, আমার হাতে যে কেরোসিনের গন্ধ পাবে। তুমি দরজা খোল।

–শ-শ। এক লাফে শর্মা ইলেকট্রনিক বোর্ডের চৌকো সবুজ সুইচটা টিপে দিল। শব্দনিরপেক্ষ ব্যবস্থা।

–সাতসকালে কে বলেছিল তোমায় কেরোসিন ঘাঁটতে! এখন উপায়?

 শর্মার চোখে চোখ রেখে রিনা বলল, কোনও খবর তো রাখ না, গ্যাস-ক্যাপসুল আর পাঁচটা আছে। এরপর তো কাঁচা জিনিস চিবিয়ে খেতে হবে। তোমারই বা সাতসকালে বেআইনি রিপেয়ারিং নিয়ে বসার কী দরকার ছিল? যাও ওদিকে–আমি দেখছি।

ইন্টারকমে মুখ দিয়ে রিনা বললে, বাড়িতে কেউ নেই। আমি রাঁধুনি, দরজা খুলতে পারব না।

ভাঙা কাঁসির মতো শোনাল কথাগুলো। হাঁটুর বাতের ব্যথা ভুলে হাসি পায় রায়ের। পাঁচতলার টঙে ঘর নিয়েছে, সঙ্গে কোনও হেলিপ্যাড কুকিং নেই, সেখানে রাঁধুনি আসবে কোত্থেকে? এখন তো সবই হেলিকপ্টার-কুকিং সার্ভিস। নিশ্চয় বিশেষ কোনও মতলব আছে শর্মার। অবশ্য শর্মা চিরকালই এই টাইপের–ভাঙবে তবু মচকাবে না। তা ভালো। যে জন্যে আসা, সেটা উদ্ধার হবে।

রায় ইন্টারকমে বলল, ওস্তাদি মারার দরকার নেই। আমি প্রোটেকশন ফোর্সের লোক নই বাবা। মিশন স্যাটার্ন, প্রোজেক্ট নাম্বার ওয়ান-জিরো জিরো-ওয়ান-এর রায় বলছি।

রায়! শর্মা নিজেই এবার এগিয়ে এসে দরজা খুলল।

রিনা সরে যায় একপাশে। দুই বন্ধু কয়েক মিনিট নীরবে পর্যবেক্ষণ করে একে অন্যকে।

ভিটামিন ভেকিসিয়েন্সি। ফটি ভিশন।–রায়ের প্রথম উক্তি।

–বাত! দুটো হাঁটুই জখম মনে হচ্ছে।–শর্মার সমালোচনা।

 –তোমরা যে ডাক্তারির কম্পিটিশন জুড়ে দিলে!–রিনা বলল।

–ডাক্তারি নয়, ডাক্তারি নয়! কুড়ি বছরের অভিজ্ঞতা! আমাদের হাত দিয়ে কত অ্যাস্ট্রনটের লাইসেন্স ইস্যু হয়েছে জান? বল রায়?

-ওই পুরানো কচকচানি নিয়েই থাক। তা এতই যদি করেছ, এখন ভুলেও কেউ খবর নেয় না কেন! বেঁচে আছি না…

–নেবে নেবে! আবার খবর নেবে। আমরা বহুদিন কোনও খবর হয়ে উঠিনি,  তাই কেউ আমাদেরও খবর নেয় না। যাক, বুঝলে রায়, বহুদিন চা-কফি জোটেনি…

অসম্ভব। ইচ্ছে থাকলেও সামর্থ্য নেই। আমরা দু-মাস ধরে প্রায় আধকাঁচা খেয়ে আছি। রিনা কোনওরকমে ম্যানেজ করে… কথা থামিয়ে সামনে ঝুঁকে পড়ল শর্মা। কোনও বিপদের সম্ভাবনা নেই জেনেও ফিসফিস করে বলল, কেরোসিন আনছে।

–সে কী! ধরা পড়লে যে…

–আমি একটা স্পেশাল স্টোভ বানিয়ে দিয়েছি। ধোঁয়া এবং গন্ধকে এমনভাবে প্রসেস করে দেয় যে, ডিটেক্টর যন্ত্র ধরতে পারে না। বাদ দাও ওসব–তোমার খবর শুনি। মাথার অর্ধেকটা দেখছি নেড়া মাঠ করে ফেলেছ।

–আর তুমি যে নিজের কপালটাকে রুল-টানা কাগজ বানিয়েছ। উপায় নেই ব্রাদার আমরা দুজনে একই নৌকোয়…

-ফুটো।

–কি বললে?

-বললাম ফুটো। নৌকোটা ফুটো। হাজার চেষ্টা করলেও শেষ অবধি ভাসিয়ে রাখা যাবে না।

–যাক, তাহলে বুঝতে পেরেছ! চল, তাহলে নৌকোর মায়া ত্যাগ করে শেষবারের মতো আবার রকেটে চাপি।

বেতের মতো লিকলিকে শীর্ণ চেহারার শর্মা এভাবে হাসির ঝড় তুলতে পারে, খুবই অপ্রত্যাশিত। রিনা বেরিয়ে এল পাশের ঘর থেকে।

–শোন রিনা, শোন, রায়ের কথা শোন। রকেট ট্রিপের কথা ভাবছে। ম্যালনিউট্রিশনে রায়ের শরীরটাই শুধু ভেঙে পড়েনি, মস্তিষ্কের ঘিলুও শুকিয়ে গেছে।

আর তোমারও কাণ্ডজ্ঞান লোপ পেয়েছে। না হলে রসিকতা ধরতে পার না। রিনা ধমক লাগায়। এতদিন পরে একজন বন্ধু এল, কেউ তো পা মাড়ায় না, তার সঙ্গে এরকম অভদ্রতা রিনার ভালো লাগে না। চা-কফি খাওয়াতে না পারুক, দুটো ভালো কথা বলতে তো বাধা নেই।

রায় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। বাঁ হাত কোমরে, ডান হাত থুতনিতে ঠেকিয়ে, কিন্তু কেটে কেটে উচ্চারণ করল, আমায় পাগল ভাবার কোনও কারণ নেই। চিন্তা না করে আমার মতো অবস্থায় আড়াইশো মাইল পথ সোলার স্কুটারে চড়ে আসত না। আমার প্রভিডেন্ট ফান্ডের সব টাকা তুলে নিয়েছি এবং তার সবটাই ইনভেস্ট করেছি।

–কী বলছ রায়? এ তো সুইসাইড।

কিংবা ইন আদার ওয়ার্ডস–বাঁচার জন্য শেষ চেষ্টা। এটাকে কি বেঁচে থাকা বলে।

রিনার মুখে ভয়ের আভাস। শর্মার ভুরু থেকে অবিশ্বাস দূর হয়নি। বোধহয় সেটা লক্ষ করেই রায় বলল, বিশ্বাস করতে পারছ না তো? শোন, নেভিগেটর দাস আর অ্যাস্ট্রনট ওয়েল্ডার মণ্ডল কনট্রাক্ট সই করে আমাদের টিমে যোগ দিয়েছে, শুধু…

–না! ওকে আমি যেতে দেব না। কেন আপনি… রিনার ছেঁড়াখোঁড়া ভয়গুলো জমে রাগের চেহারা নেয়। এই বয়সে আবার এ কী পাগলামি! সারাজীবন সে অনেক সয়েছে। যতবার স্পেশ ফ্লাইটে গেছে শর্মা, ততবার মহাশূন্যের নীরবতা আর অন্ধকার ভোগ করেছে রিনা। শুধু পার্সোনাল ভিডিয়োর পরদায় প্রতিদিন দু-ঘণ্টা চোখের দেখা পাওয়ার আশায় যেন শবরীর প্রতীক্ষা। কতবার মহাশূন্যে পাড়ি দিয়েছে শর্মা? কম করে বার পঁচিশ নিশ্চয়। শর্মা রিটায়ার করার পরে রিনার মনে হয়েছিল, এতদিনে বুঝি সে সত্যিকার প্রাণ ফিরে পেল। কিন্তু জমানো টাকা ফোরাতে দেরি হয়নি, একের পর এক বাড়ি বদল করতে হয়েছে, তারপরে খাবারেও টান–বছর দশেকের মধ্যে দ্রুত বদলে গেছে পৃথিবীটা, কিন্তু সে যা-ই হোক–রিনা বরং সমস্ত অসুবিধা ভোগ করতে রাজি কিন্তু আর মহাকাশে ছোটা নয়, আর দরকার নেই তিন-চার মাসের জন্য হিরো হওয়ার, খবরের কাগজে নাম ছাপার… এতবার এত কাণ্ড করেও যদি আজ এই হাল হয়, আরেকবার চেষ্টা করেই কি সুফল হবে কোনও…।

নিজের মনের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে সময়ের হিসাব হারিয়ে ফেলেছিল রিনা। তাকিয়ে দেখল, ঠাট্টা-ইয়ারকি ও অবিশ্বাসের পর্ব শেষ করে দুই বন্ধুর আলোচনা এখন ক্রমশই পরস্পরের প্রতি আস্থা বাড়িয়ে তুলছে। ওদের কথাগুলো মাঝে মাঝেই রীতিমতো জটিল হয়ে উঠছে, মানে বোঝা দুষ্কর।… আর কিছু না হোক, শুধু সেলিনিয়ামের কথাই ভাব, কী ক্রাইসিস, অথচ…

রিনার মুখ ফুটে প্রায় বেরিয়ে এসেছিল, যতই ফন্দি আঁট, যেতে তোমায় দেব না…

 কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে সিগারেট ধরাল শর্মা। শুধু তা-ই নয়, রায়কেও অফার করেছে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না রিনা। তিন মাস আগের কথা। সারাদিন চেষ্টা করেও শর্মা ধারে এক প্যাকেট সিগারেট জোগাড় করতে পারেনি। যে লোকটার দিনে দশ প্যাকেট না হলে চলত না, পয়সার অভাবে… তারপরে রিনা অবশ্য মাইনে পেয়েই সিগারেট কিনে এনেছিল। এক-আধ প্যাকেট নয়, পুরো এক মাসের রসদ। কিন্তু অদ্ভুত একটা ভয় পেয়ে বসেছে শর্মাকে। সিগারেট ফুরিয়ে যাবার ভয়। প্যাকেট হাতে তোলে, নাড়াচাড়া করে আবার রেখে দেয়। জিজ্ঞেস করলে বলে, থাক, পরে খাব। রিনা বোঝে, সিগারেট ছাড়া সে কোনও কাজে মনঃসংযোগ করতে পারেনি। চার-পাঁচটা ইলেকট্রনিক যন্ত্র সারাবার কাজ পেয়েছে, যদিও সারাবার কাজ মানেই বেআইনি ব্যাপার, কিন্তু কোনওটাতেই বেশি দূর এগতে পারেনি।

শর্মাকে সিগারেট ধরাতে দেখে বুকের মধ্যে কোথায় যেন দমটা আটকে গেল রিনার। সেটা আনন্দে না যন্ত্রণায়, বুঝতে পারছে না। কতদিন পরে স্বাভাবিক হতে পেরেছে শর্মা… রিনা নিঃশব্দে কিচেনে এসে ঢুকল। শর্মার তৈরি স্মোকলেস স্টোভ ধরিয়ে চায়ের আয়োজন শুরু করে দিয়েছে।

-তাহলে তুমি রাজি?

রায়ের প্রশ্নের সুরেই বোঝা যায়, উত্তর সে পেয়েই গেছে।

-কিন্তু আমি ভাবছি, লাইসেন্স জোগাড় হবে কী করে? শর্মার মাথায় অন্য চিন্তা, আমায় দেখলেই তো আনফিট বলে দেবে। ওদিকে তোমার হাত আমার চেয়েও খারাপ।

-মণ্ডল আর দাসও তথৈবচ!

রায়ের কথা শুনে মনে হয় না এ নিয়ে তার কোনও মাথাব্যথা আছে।

-তাহলে?

-তাহলে আবার কী? পুরোপরি ফিট হলেও কি লাইসেন্স দিত! তুমি বোধহয় খবর রাখ না, স্পেস ভেইকল অফিস থেকে বর্তমানে অ্যাটমিক মহাকাশযান ছাড়া পারমিট দেওয়া হয় না। আমাদের তরল জ্বালানির রকেটের কথা শুনলেই তারা শিউরে উঠবে। তা ছাড়া বললামই তো, কম্পিউটার পাইলট জোগাড় করা যাবে না। তোমায়-আমায় মিলে সেই আগের বারের মতো চোখ, কান আর হাতের ওপর ভরসা রেখে যাত্রা করতে হবে।

তার মানে পুরোপুরি ইললিগাল। ধরা পড়লে…

–ধরা পড়বে না। কারণ ধরার মালিক যে, সে-ই জোগাচ্ছে পুঁজি। না হলে, কোথা থেকে পেতাম রকেট, যন্ত্রপাতি, জ্বালানি, আয়োজনের টাকা… ব্রাদার, তোমাকে স্বীকার করতেই হবে যে, একেবারে আটঘাঁট বেঁধেই নেমেছি!

অন্য কোনও ভাবনায় শর্মা নিশ্চয় মগ্ন ছিল। হঠাৎ বলে উঠল, তার মানে ধরে নিতে পারি, কোনও গ্রাউন্ড কন্ট্রোল ছাড়াই আমাদের…

–শ-শ-নং সমি অব ইয়া রিম্ ঝিম্ (আন্তর্জাতিক সাংকেতিক ভাষায় বাধা দিল রায়) এসব কথা কানে গেলে মিসেস যে ভয় পাবে।

সম্মতি জানিয়ে বারতিনেক ঘাড় নেড়ে শর্মা বলল, কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না, যে শয়তানটা টাকা ঢালছে, তার কী লাভ?

-তারই তো সবচেয়ে লাভ। কোনও রিস্ক নেই। আমাদের রোজগারের অর্ধেক সে নেবে। বাকিটা আমাদের চারজনে ভাগ করে নেব। ওর পুঁজি আর আমাদের রিস্ক–এইভাবেই বাটোয়ারা হবে।

রিনা চা দিয়ে বেরিয়ে গেল। ওর উপস্থিতিতে দু-জনে মন খুলে কথা বলতে পারছে না। তা ছাড়া ভেসে-আসা এক-একটা শব্দ তাকে যেরকম বিচলিত করছে, কতক্ষণ নিজেকে সামলে রাখতে পারত, বলা শক্ত।

.

মাথায় জোড়া প্রপেলারওয়ালা আর গায়ে সবুজ ছাপওয়ালা চার্টার্ড হেলিকপ্টার নিউগিনির অরেঞ্জ রেঞ্জে চারজনকে নামিয়ে দিয়ে বিদায় নিল। ভূতাত্ত্বিক ও প্রাণীতাত্ত্বিক অভিযাত্রীর দল হিসাবেই পৌঁছেছে ওরা। এইখান থেকে দুর্গম বনের মধ্যে দিয়ে মাইল তিনেক পায়ে হাঁটার পর ওরা রকেট উৎক্ষেপনকেন্দ্রে পৌঁছাবে। পৃথিবীর নিরক্ষরেখায় অবস্থিত সমুদ্রতলের আড়াই মাইল ওপরে এই কেন্দ্রটি দীর্ঘকাল ব্যবহার হয়নি। কংক্রিটের পথটা বুনো ঝোঁপের আড়ালে প্রায় অদৃশ্য। কালেভদ্রে প্রযুক্তিবিদ্যার ইতিহাস লেখার উপাদান সংগ্রহ করতে দু-চারজন গবেষক এখানে আসে। তাদেরই কেউ বোধহয় অ্যাস্টনটসের গ্রামে যাবার এই পথটা আবিষ্কার করে রাস্তার ধারে ধারে ফলক বসিয়েছিল। সেইগুলো এখন রকেট ঘাঁটির দিক নির্দেশ করেছে।

গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে চলেছে চারজনে। চেহারা দেখে এদের নভশ্চর বলে শনাক্ত করা অসম্ভব। রায় খোঁড়াচ্ছে, শর্মা প্রায়ই হোঁচট খাচ্ছে (চোখেও কম দেখে), দাস ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে। শারীরিকভাবে সবচেয়ে পটু বোধহয় মণ্ডল। বগলে ক্রাচ গুঁজে কাঠের পা খটখট শব্দে সবার আগে আগে চলেছে সে। তাদের অভিযানের চূড়ান্ত সাফল্য নির্ধারিত হবে মণ্ডলের হাতে। তার হাঁটুর তলা থেকে বাদ দেওয়া ডান পায়ের ঘাটতিটুকু মহাশূন্যের কর্মক্ষেত্র তার ভারহীনতার গুণেই পুষিয়ে দেবে।

মিনিট পনেরো হাঁটার পরে দম নিতে থামল সকলে।

–আর কত হাঁটাবে বাবা রায়? দাস প্রশ্ন করে, রকেট অবধি পৌঁছাতে পারব? নাকি দম ফেটে তার আগেই..

কী আর করা যাবে বল! ভাড়া করা হেলিকপ্টারকে তো আর লঞ্চিং সাইটে নিয়ে আসা যেত না, জানাজানি হয়ে যাবে।

-তা এমন বিদঘুটে জায়গা থেকে রকেট ছাড়ার দরকার কী ছিল? মণ্ডল বলল। কেন এত জ্বালানি বাঁচানো হচ্ছে জান? প্রথমত, জায়গাটা পৃথিবীর ঘন বায়ুস্তরের অনেকটা ওপরে। তা ছাড়া পৃথিবীর ঘণ্টায় হাজার মাইল গতিতে পশ্চিম থেকে পূর্বে পাক খাওয়াটাও রকেটকে সাহায্য করবে। তত্ত্বকথা আওড়ায় শর্মা।

তার চেয়েও বড় কথা, এই রকেটটা এখানেই পড়েছিল। সারানো হয়েছে। এমনকী, আন্ডারগ্রাউন্ড ট্যাঙ্কেও প্রচুর জ্বালানি ছিল। সামান্য কিছু আনতে হয়েছে। না হলে কি আর এমন সুযোগ আমরা পেতাম?

রায়ের এই সত্যভাষণ বোধহয় কারওরই মনোবল বাড়াতে সাহায্য করল না। কিছুক্ষণের নীরবতার পরে আবার যাত্রা শুরু হল। হাঁটতে হাঁটতেই যেন দিবাস্বপ্ন দেখছে শর্মা। আকাশ-ছোঁয়া একটা বাড়ির চোদ্দোতলার জানালায় পৌঁছাতে আর পাঁচ-ছ-ফুট বাকি। মাথার ওপরে গভীর রাত্রি। পায়ের নিচে কালো শূন্যতা। শুধু ওই বন্ধ জানালার অন্য পাশে অনেক আলো। হঠাৎ পা পিছলে গেল। মুখ হাঁ করেও শব্দ বার করতে পারল না। চোরের আর্তনাদের জন্য কোনও দরদ অপেক্ষা করে না। দু-হাতে কার্নিশ ধরে দোল খাচ্ছে, না শর্মা নয়, একটা দুঃসাহসী চোর। তারপর…

.

কোনও কাউন্টডাউনের মহড়া নেই, কোনও গ্রাউন্ড কন্ট্রোলের বালাই নেই। বিদায় জানাবার জন্য কেউ অপেক্ষা করছিল না, তবু প্রত্যেকেই হাত নেড়ে অনুষ্ঠানের মর্যাদা রক্ষা করেছে। যে যার সিটে শুয়ে পড়ল। শৰ্মা চালু করে দিয়েছে অয়েল পাম্প। শুরু হয়ে গেছে স্পন্দন। জীবন্ত হয়ে উঠছে বুড়ো রকেটটা। লাল সুইচটার ওপর হাত রেখে শর্মাও শুয়ে পড়ল। তার স্ট্র্যাপ আঁটতে সাহায্য করছে রায়।

রেডি।

বুস্টার রকেটের কান-ফাটানো শব্দ আর শরীরের ওপরে ত্বরণের মন মন চাপ। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার। তারপরেই একটু হালকা ভাব। একটু ঝাঁকানি দিয়ে রকেট থেকে খসে পড়ল জ্বালানির খালি ট্যাঙ্কটা। প্রশান্ত মহাসাগরে সামান্য একটু ঢেউ উঠবে।

এবার রকেটের নিজস্ব ইঞ্জিনের গর্জন। টিভি স্ক্রিনে চোখ রেখে ব্যস্ত হাতে একের পর এক কন্ট্রোল প্যানেলের সুইচ গিয়ার নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছে শর্মা। ঠিক সেই পনেরো বছর আগেকার নিপুণতা ফিরে পেয়েছে।

না! না!হঠাৎ নেভিগেটর দাসের আর্তনাদে পাশ ফিরে তাকাল। দাস ঝুঁকে পড়েছে। রায়ের ওপরে। স্পেস স্যুটের একপাশ দিয়ে লাল রক্তের ধারা ছড়িয়ে পড়েছে।

নির্বিকার কণ্ঠে মণ্ডল বলল, স্পেস স্যুটের ইয়ার প্লাগ নিশ্চয় ডিফেকটিভ ছিল। তা ছাড়া ব্লাড প্রেশারও নিশ্চয় বেশি ছিল রায়ের। ভাগ্যিস, আমাদের কারও ভাগ্যে ওইরকম পুরানো বাতিল পোশাক জোটেনি, তাহলে এইখানেই যাত্রার ইতি হয়ে যেত। আমি মরলে কে উপগ্রহ কাটাছেঁড়া করত, নেভিগেটর বা ইঞ্জিনিয়ার মরলেও বিপদ ছিল…

দাস আবার আর্তনাদ করে উঠল, ডেড! হি ইজ ডেড!

–দাস! গম্ভীর আদেশ এল শর্মার, টেক চার্জ।

–ছেলেমানুষী করো না, যে গেছে, সে গেছে, আমরা তিনজন তো আছি এখনও! ফিরে চলল শর্মা! প্লিজ মণ্ডল, আই ওয়ান্ট টু গো ব্যাক।

-ইমপসিবল! তা হয় না। তুমি জান তা সম্ভব নয়।

দাস কন্ট্রেলের চার্জ নিল।

এখন শর্মা কিছুক্ষণের জন্য নিশ্চিন্ত। নোজ স্টিয়ারিং রকেট ছুঁড়ে দাসকে এখন মহাকাশযানকে নির্দিষ্ট কক্ষে স্থাপন করতে হবে, নিয়ন্ত্রণ করতে হবে তার গতি, তারপর স্থাপন করতে হবে পৃথিবীর ছায়ায়, পরিত্যক্ত একটি কৃত্রিম উপগ্রহের কাছে। এমন কিছু দুরূহ ব্যাপার নয়। মাইক্রোপ্রসেসরে প্রোগ্রাম একটা করাই আছে।

রায়ের দিকে তাকাল শর্মা। আশ্চর্য, ভয়, দুঃখ কি যন্ত্রণা কিছুই অনুভব করল না। শুধু মনে পড়ল, পনেরো দিনের মধ্যে ফিরতে না পারলে, রিনা একটা চিঠি পাবে। সে ব্যবস্থা করেই এসেছে। রিনাকে অনর্থক কষ্ট দিতে চায় না। দুঃসংবাদ যদি থাকে, যত তাড়াতাড়ি পাওয়া যায়, ততই ভালো। দুর্বিষহ প্রতীক্ষার পর্বটা তো সংক্ষিপ্ত হয়।

টিভির পরদায় ফুটে উঠল কসমো ৯৫৭-এর প্রতিবিম্ব। পরদার ডান কোণে একটি বিন্দু এবার রকেটের দিক পরিবর্তন করে বিন্দুটাকে নিয়ে আসতে হবে পরদার ঠিক কেন্দ্রে, চেরা দাগটার কেন্দ্রে। তারপর শুরু হবে মণ্ডলের খেলা।

প্রশংসা করতে হয় দাসকে। প্রচণ্ড মানসিক চাপের মধ্যেও সামান্য জ্বালানি খরচ করেই মহাকাশযানকে সে লক্ষ্যে নিয়ে এসেছে।

মহাশূন্যে ভ্রমণের পোশাক পরে এয়ারলকের গোলাকার দরজা ও সুড়ঙ্গ পেরিয়ে। ভাসতে ভাসতে বেরিয়ে গেল মণ্ডল তার ওয়েল্ডিং-কাটার নিয়ে। পরিত্যক্ত কৃত্রিম উপগ্রহ ৯৫৭-কে সে টুকরো টুকরো করে তার থেকে সংগ্রহ করে আনবে দুর্মূল্য সেলিনিয়াম ও আরও অনেক ধাতু ও যন্ত্র। তারপর সেই মণিমাণিক্য বোঝাই করে ফিরবে তারা পৃথিবীতে। আর বোধহয় কখনও এমন ঝুঁকি নিতে হবে না, চোরের মতো জীবনযাপন করতে হবে না, বেআইনি কাজ করে সংগ্রহ করতে হবে না জীবিকা…

অবজার্ভেশন জানলায় চোখ রেখে মণ্ডলের কাজ দেখছিল শর্মা। সৌর-ব্যাটারি বসানো একটা পাখনা খুলে ফেলেছে ইতিমধ্যেই। শর্মা ভাবছিল, নিজেদের চোর মনে করার। কোনও যুক্তিসংগত কারণ নেই। মহাকাশে গত পঁচিশ বছর ধরে যত আবর্জনা জমেছে, কেউ তো পরিষ্কার করার চেষ্টা করেনি আজ অবধি। যদিও বৈজ্ঞানিক নিবন্ধে এ নিয়ে লেখালেখি কম হয়নি। কাজেই আজ যদি তারা একটা বাতিল যন্ত্রকে কেটেকুটে সরিয়ে দেয়, তাতে তো সবারই উপকার। মণ্ডল ব্যাকপ্যাক রকেট-গান ছুঁড়ে সরে গেল একপাশে। মহাকাশের উজ্জ্বল অন্ধকারে তার চারধার জুড়ে এখন অগুনতি নক্ষত্রের অপূর্ব দৃশ্য। এখানে তারারা টুইঙ্কল টুইঙ্কল করে না। কিন্তু মহাকাশ দৃশ্য দেখে মোহিত হওয়ার অবসর নেই মণ্ডলের।

-মণ্ডলকে ডেকে নাও শর্মা!

দাসের ঠান্ডা শান্ত গলা যেন ছুরির মতো বিঁধল শর্মাকে। এর আগে তার উত্তেজনা বা আর্তনাদও কিন্তু এভাবে নাড়া দেয়নি। ফিরে তাকাল।

দাস ফুয়েল ইন্ডিকেটরের দিকে শুধু দুটি আকর্ষণ করল। এক ফোঁটা জ্বালানি অবশিষ্ট নেই।

শর্মার নির্বাক দৃষ্টির উত্তরে দাস শুধু বলল, মিটারটা প্রথম থেকেই কাজ করছিল না। তাই এতক্ষণ বুঝতে পারিনি। কিন্তু ট্যাঙ্ক যে পুরো ভরতি ছিল, সে তো তুমি নিজেই পরীক্ষা করেছে।

করেছি, কিন্তু জ্বালানির মান তো পরীক্ষা করিনি। নিশ্চয় গ্রেড ঠিক ছিল না তাই থ্রাস্ট ডেভেলপ করতে যা দরকার, তার চেয়ে বেশি জ্বালানি পুড়েছে।

মণ্ডলকে ডেকে নাও শর্মা, আর লাভ কী! খামকা পরিশ্রম করে?

তবু অবজার্ভেশন জানলায় চোখ রেখে বসে রইল শর্মা। বিদায় নেবার সময় ছোট্ট একটা টবে গোলাপ গাছের কুঁড়িটাকে দেখিয়ে রিনা বলেছিল, তুমি ফিরে এসে টুকটুকে লাল একটা ফুল দেখতে পাবে।

-খুব মজা লাগছে, না? বিকৃত শোনাল দাসের রূঢ় কণ্ঠ। ওই লোকটা এখনও জানে না, হাজার মাল বোঝাই করুক, যত দামি মালই সংগ্রহ করুক, আমাদের জীবন এইভাবে পৃথিবীর চারধারে পাক খেতে খেতেই ফুরিয়ে যাবে। পৃথিবীর দিকে মুখ ফেরাবার আর কোনও উপায় নেই। একজন মরা মানুষ আর যক্ষের মতো আগলে… না, না, শৰ্মা আমি বলছি, ওকে ডেকে নাও। মণ্ডলের সঙ্গে এরকম ইয়ারকি… আমি সহ্য করতে পারছি না।

দাস হঠাৎ জাপটে ধরেছিল শর্মাকে। এক ঝটকায় ছিটকে দিল তাকে শর্মা। ভারশূন্যতা তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল অন্য ধারে। দাঁতে দাঁত চেপে শর্মা বলল, ডোন্ট বি স্টুপিড। মণ্ডল এখনও বেঁচে আছে। যতক্ষণ না জানতে পারছে ফেরার উপায় নেই, ততক্ষণই বেঁচে থাকবে। কেন, কেন আমরা ওকে আরও কিছুক্ষণ বাঁচার সুযোগ দেব না!

মিনিটকয়েকের নীরবতার পরে দাস বলল, ঠিকই বলেছ শর্মা, আমারই ভুল।

মণ্ডলের কাজ শেষ হয়েছে। বায়োনিক কৃত্রিম হাত মহাকাশযানের কার্গো-বে-র মধ্যে গুপ্তধন বোঝাই করা হল। এয়ারলক পেরিয়ে মণ্ডল ভেতরে ঢুকল। মুখে বিজয়ীর হাসি।

শর্মা দাসের দিকে তাকাল। দাস মুখ ফিরিয়ে নিল।

ব্যাপার কী? দু-জনেই বোবা হয়ে গেলে নাকি!–মণ্ডল হাসতে হাসতেই বলল।

আবার নীরবতা। কে দেবে দুঃসংবাদ? মৃত্যুর বার্তা।

–ও! বুঝেছি। তাহলে এতক্ষণে জানতে পেরেছ তোমরা?–মণ্ডলের কথা শুনে দু-জনেই ফিরে তাকাল। কী বলছে মণ্ডল।

আমি তো আগেই জানতে পেরেছি যে, আমরা আর ফিরতে পারব না। ইচ্ছে করেই বলিনি, বলে তো লাভ নেই।

-তাহলে, তাহলে, তুমি শুধু এই সেলিনিয়াম সংগ্রহ করার জন্যে…।

–না, শুধু শুধু নয়। আমি জানি, কাল হোক বা পরশু, আবার কেউ না কেউ আসবে, ঠিক আমাদেরই মতো মহাকাশের আবর্জনা ঘেঁটে কিছু কুড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তাদের কথা ভেবেই কাজটা একটু এগিয়ে রাখলাম। আমাদের পরিত্যক্ত মহাকাশযানটার যদি কেউ খোঁজ পায়, খুব অল্প পরিশ্রমেই তারা সফল হবে… শর্মা চোখ বুজে বিড়বিড় করে আওড়াচ্ছিল, রিনা, তোমার লাল গোলাপটা মণ্ডলকেই দিয়ো। ওটা ওরই প্রাপ্য।

[প্রথম প্রকাশ: কিশোর বিস্ময়, ১৯৮৪ অগাস্ট]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *