২.৪ ভয়ংকর ষড়যন্ত্র

ভয়ংকর ষড়যন্ত্র  

বেঈমান-গাদ্দারের অপবিত্র খুন কায়রোর বালুকাময় জমিন চুষে নেয়নি এখনো। তার আগেই দুশ অশ্বারোহী নিয়ে কায়রো এসে পৌঁছেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর ভাই তকিউদ্দীন। সুলতান আইউবী শিরচ্ছেদ করেছেন ষড়যন্ত্রকারী আমলাদের। মনে হচ্ছিল, কায়রোর মাটি এই মৃত মুসলমানদের খুন চুষে নিয়ে নিজের বুকে স্থান দিতে বিব্রতবোধ করছে, যারা খৃস্টানদের সাথে যোগ দিয়ে সালতানাতে ইসলামিয়ার পতাকাকে ভূলুণ্ঠিত করার ষড়যন্ত্র করছিল।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী লাশগুলো দেখলেন। কর্তিত মস্তকগুলোকে রেখে দেয়া হয়েছে নিষ্প্রাণ দেহগুলোর বুকের উপর। অবিচ্ছিন্ন রয়েছে মাত্র একটি মস্তক। এটিই সবচে বড় গাদ্দারের লাশ, যার উপর পরিপূর্ণ ও অখণ্ড আস্থা ছিল সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর। একটি তীর লোকটির ধমনীতে ঢুকে গিয়ে অপরদিক দিয়ে বের হয়ে গিয়েছিল। এটিই কায়রোর নগর প্রশাসক মোসলেহুদ্দীনের লাশ। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী যখন তাকে হাজির করে সেনাবাহিনীকে তার অপরাধের বিবরণ দিচ্ছিলেন, তখন ইসলাম-প্রেমী উত্তেজিত এক সৈনিক একটি তীর ছুঁড়ে তার ধমনী এফোঁড়-ওফোড় করে দিয়েছিল। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী সৈনিকের এই বেআইনী আচরণ্য ছিল সামরিক আইনের পরিপন্থী- এ জন্য ক্ষমার চোখে দেখলেন যে, কোন ঈমানদারই ইসলামের বিরুদ্ধে গাদ্দারী বরদাশত করতে পারে না। সৈনিকদের মধ্যে এই ঈমানী জযবা সুলতান আইউবী নিজেই সৃষ্টি করেছেন।

লাশগুলো দেখে সুলতান আইউবীর চেহারায় এতটুকু খুশীর ঝলকও পরিলক্ষিত হল না যে, প্রশাসনের এতগুলো গাদ্দার কুচক্রী ধরা পড়ল এবং তাদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হল। উল্টো তাকে বিমর্ষ মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, যেন তার কান্না পাচ্ছে। উদগত অশ্রু ঠেকাবার চেষ্টা করছেন তিনি। মনে তার প্রচণ্ড ক্ষোভ, যার প্রকাশ তিনি করেছিলেন এভাবে

এদের কারো জানাযা পড়া হবে না। লাশগুলো তাদের আত্মীয়-স্বজনের হাতে দেয়া যাবে না। লাশগুলো রাতের আঁধারে কোন এক গভীর গর্তে নিয়ে ফেলে মাটিচাপা দিয়ে সমান করে রেখে আস। পৃথিবীতে এদের নাম-চিহ্নও যেন অবশিষ্ট না থাকে।

আমীরে মোহতারাম! কোতোয়াল এবং সাক্ষীদের জবানবন্দী ও বিচারকের রায় লিপিবদ্ধ করে সংরক্ষণ করা দরকার, যাতে ভবিষ্যতে কেউ এ অভিযোগ উত্থাপন করতে না পারে যে, এটি একক কারো রায় ছিল। স্বীকার করি, আপনার ফয়সালা যথার্থ। আপনি অতি ন্যায়সঙ্গত বিচার করেছেন। কিন্তু আইনের দাবী অন্যকিছু। বললেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর সুহৃদ ও একান্ত বিশ্বস্ত কাজী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ।

যারা কাফিরদের সাথে গাঁটছড়া বেঁধে আল্লাহর দ্বীনের মূলোৎপাটনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়, আল্লাহর বিধান তাদেরকে এই সুযোগ প্রদান করার অনুমতি দেয় কি যে, তারা আইনের সামনে দাঁড়িয়ে আল্লাহ, তাঁর রাসূল (সাঃ) ও ঈমানদারদের ইজ্জতের অতন্দ্র প্রহরীদের মিথ্যা প্রতিপন্ন করুক? আমি যদি অবিচার করে থাকি, তাহলে এতগুলো মানুষ হত্যার দায়ে আমাকে মৃত্যুদণ্ড দাও এবং আমার মৃতদেহটা জনবসতি থেকে বহুদূরে কোন এক মরু প্রান্তরে নিয়ে ফেলে আস। শৃগাল-শকুনরা আমার লাশটা খেয়ে আমাকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলুক। কিন্তু আমার বন্ধুগণ! আমাকে শাস্তি দেয়ার আগে তোমরা পবিত্র কুরআনটা আলিফ-লাম-মীম থেকে ওয়ান্নাস পর্যন্ত পড়ে নিও। আর শাস্তি যদি দিতেই হয়, তাহলে আমার গর্দান উপস্থিত। আবেগাপ্লুত অথচ অতীব গুরুগম্ভীর কণ্ঠে উপস্থিত কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বললেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী।

আপনি অবিচার করেননি মহান সেনাপতি কাজী শাদ্দাদ আসলে বলতে চেয়েছিল, পাছে আইনের অবমাননা হয়ে না যায় যেন। বলল একজন।

আমি বুঝতে পেরেছি। উদ্দেশ্য তার আয়নার মত পরিষ্কার। আমি আপনাদের শুধু এ কথাটাই বলতে চাই যে, গবর্নর যদি ব্যক্তিগতভাবে নিশ্চিত জানেন যে, অভিযুক্ত সত্যিই গাদ্দারীর অপরাধে অপরাধী, তাহলে তার কর্তব্য সাক্ষ্য-প্রমাণ ও অন্যান্য আইনী ঝামেলায় না জড়িয়ে আসামীকে উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করা। অন্যথায় বুঝতে হবে,গবর্নর নিজেও গাদ্দার। অন্তত অযোগ্য এবং বেঈমান তো অবশ্যই। আমি আশংকা করছি, যদি এদের বিচারকের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতাম, তাহলে এরা উল্টো আমাকেই অপরাধী সাব্যস্ত করে বসত। আমার বক্তব্য স্পষ্ট। তোমরা আমাকে গাদ্দারদের সারিতে দাঁড় করিয়ে দাও। দেখবে, আল্লাহর কুদরতী হাত আমাকে তাদের থেকে আলগা করে ফেলবে। তোমাদের হৃদয় যদি কাবার প্রভূর আলোতে উদ্ভাসিত হয়ে থাকে, তাহলে পাপিষ্ঠদের উপযুক্ত শাস্তি দিতে ভয় কর না। তথাপি বন্ধু বাহাউদ্দিন শাদ্দাদ যে পরামর্শ দিয়েছেন, তোমরা তা বাস্তবায়ন করে ফেল। কাগজপত্র প্রস্তুত করে মাননীয় বিচারপতির স্বাক্ষর নিয়ে রাখ। লিখবে, আমীরে মেসের- যিনি মিসর সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতিও বটে- নিজের বিশেষ ক্ষমতাবলে এই অপরাধীদের যে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেছে, এদের অপরাধ সন্দেহাতীতরূপে প্রমাণিত।

আপন ভাই তকিউদ্দীনের প্রতি দৃষ্টিপাত করেন সুলতান। দীর্ঘ সফরে তিনি ক্লান্ত পরিশ্রান্ত। সুলতান তাকে বললেন, আমি তোমার চেহারায় চিন্তা ও ক্লান্তি দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু তুমি মুহূর্তের জন্যও আরাম করতে পারবে না। তোমার সফর শেষ হয়নি। শুরু হল মাত্র। আমাকে শিগগিরই শোবক পৌঁছুতে হবে। তেমাকে জরুরী কিছু কথা বলেই রওনা হব।

যাওয়ার আগে আরো একটি সিদ্ধান্ত দিয়ে যাবেন আমীরে মোহতারাম! যাদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হল, তাদের বিধবা ও সন্তানের কি হবে? বলল নতুন নগর প্রশাসক।

এদের ব্যাপারেও সেই একই সিদ্ধান্ত, যা পূর্বেকার গাদ্দারদের পরিবার-পরিজনের ব্যাপারে দেয়া হয়েছিল। বিধবাদের ব্যাপারে তদন্ত কর, স্বামীদের ন্যায় তাদেরও কারুর দুশমনের সাথে যোগসাজস আছে কিনা দেখ। স্ত্রী-পূজাও আমাদের মধ্যে অনেক গাদ্দার জন্ম দিয়েছে। দেখনি, সুন্দরী নারী দিয়ে খৃস্টানরা কিভাবে আমাদের ভাইদের ঈমান ক্রয় করে নিয়েছে। এই বিধবাদের মধ্যে যারা সতী-সাধ্বী ও পাক্কা ঈমানদার বলে প্রমাণিত হবে, তাদেরকে তাদের মর্জি-মাফিক বিয়ে দিয়ে দাও। খবরদার! কারো উপর নিজেদের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিও না। সাবধান! কোন নারী যেন অসহায় হয়ে না পড়ে এবং সম্মানজক ডাল-রুটি থেকে বঞ্চিত না থাকে। তাদের যেন অসহায়ত্ব বোধ করতে না হয়। খেয়াল রাখবে, কোন কুচক্রী মহল যেন একথা তাদের কানে দিতে না পারে যে, তোমাদের স্বামীদের অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়েছে। বরং তাদের বুঝাবার চেষ্টা কর, তোমাদের সৌভাগ্য যে তোমরা এরূপ স্বামীদের থেকে মুক্তি পেয়েছ। বিশেষ ব্যবস্থাপনায় তাদের ছেলে-মেয়েদের শিক্ষার সুযোগ করে। দাও। যাবতীয় ব্যয় বহন করবে বাইতুলমাল থেকে। মনে রেখো, গাদ্দারের সন্তান গাদ্দারই হবে এমন কোন কথা নেই। শর্ত হল, তাদের সঠিক শিক্ষা দিয়ে ঈমানদাররূপে গড়ে তুলতে হবে। তোমরা ভুলে যেও না যে, এরা মুসলমানের সন্তান। এদের এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যেন এদের মনে কোন প্রকার অসহায়বোধ জাগতে না পারে। খবরদার! পিতার পাপের কাফফারা যেন সন্তানদের আদায় করতে না হয়। জবাব দেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী।

***

শোবক রওনা হওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী। তিনি ভাবছেন, পাছে তার অনুপস্থিতিতে খৃস্টানরা হামলা করে বসে কিনা। নূরুদ্দীন জঙ্গীর প্রেরিত বাহিনী ময়দানে পৌঁছে গেছে। কায়রোর বাহিনীও এগিয়ে যাচ্ছে সেদিকে। উভয় বাহিনীকে এলাকা ও পরিবেশ-পরিস্থিতির সাথে পরিচিত করে তুলতে হবে। নিজ দফতরে গিয়ে বসেন সুলতান। ডেকে পাঠান ভাই তকিউদ্দিন, আলী বিন সুফিয়ান, আলীর নায়েব হাসান ইবনে আবদুল্লাহ, কোতোয়াল গিয়াস বিলবিস এবং আরো কয়েকজন নায়েব-কর্মকর্তাকে। বেশিরভাগ উপদেশ প্রদান করেন ভাই তকিউদ্দীনকে। প্রথমে বৈঠকে তিনি ঘোষণা দেন, আমার অনুপস্থিতিতে আমার ভাই তকিউদ্দিন আমার স্থলাভিষিক্ত হবে এবং মিসরে প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব পালন করবে। তার ঠিক ততটুকু ক্ষমতা থাকবে, যতটুকু ছিল সালাহুদ্দীন আইউবীর।

তকিউদ্দীন! আজ থেকে মন থেকে ঝেড়ে ফেল যে, তুমি সালাহুদ্দীন আইউবীর ভাই। অযোগ্যতা, অসততা, অবহেলা, গাদ্দারী, ষড়যন্ত্র কিংবা কোন অন্যায়-অবিচারে যদি লিপ্ত হও, তাহলে তোমাকেও সেই শাস্তিই ভোগ করতে হবে, যা শরীয়ত নির্ধারণ করে দিয়েছে। তকিউদ্দীনের প্রতি দৃষ্টিপাত করে গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বললেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী।

আমি আমার কর্তব্য সম্পর্কে পরিপূর্ণ সচেতন আছি মোহতারাম আমীরে মেসের! মিসরের বিরাজমান সমস্যা সম্পর্কে আমি পূর্ণ ওয়াকিফহাল। অবনত মস্তকে বললেন তকিউদ্দীন।

শুধু মিসরই নয়, সমগ্র সালতানাতে ইসলামিয়া এই হুমকির সম্মুখীন। ইসলামের প্রসার ও ইসলামী সাম্রাজ্যের বিস্তারে এসব সমস্যা বিরাট এক প্রতিবন্ধক। তোমাকে স্মরণ রাখতে হবে, সালতানাতে ইসলামিয়ার কোন একটি ভূখণ্ড কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বিশেষের জমিদারী নয়। এর মালিক আল্লাহ। তোমরা এর পাহারাদার মাত্র। এর প্রতিটি অণু-পরমাণু তোমাদের হাতে আমানত। এর এক মুষ্ঠি মাটিও যদি তোমাদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে হয়, তাহলে আগে ভেবে দেখ, তুমি অন্যের হক নষ্ট করছ কিনা, আল্লাহর আমানতের খেয়ানত হচ্ছে কিনা। আমার কথাগুলো মনোযোগ সহকারে শোন তকিউদ্দীন! ইসলামের সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য এই যে, তার অনুসারীদের মধ্যে গাদ্দার ও কুচক্রী মানুষের সংখ্যা অনেক। মুসলমান যত গাদ্দার জন্ম দিয়েছে, এত আর কোন জাতি দেয়নি। আমাদের আল্লাহর পথে জিহাদের গৌরবময় ইতিহাস গাদ্দারীর ইতিহাসে পরিণত হতে চলেছে। স্বজাতি ও স্বধর্মের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে বেড়ানো যেন আমাদের ঐতিহ্যের রূপ ধারণ করেছে। আলী বিন সুফিয়ানকে জিজ্ঞেস কর তকি! আমাদের যেসব গুপ্তচর খৃস্টানদের এলাকায় দায়িত্ব পালন করছে, তাদের রিপোর্ট হল, খৃস্টান সম্রাটগণ, ধর্মীয় নেতৃবর্গ ও সচেতনমহল ইসলামের এই দুর্বলতা সম্পর্কে অবহিত যে, মুসলমান নারী আর ক্ষমতার লোভে নিজ ধর্ম, দেশ ও জাতির সিংহাসন উল্টিয়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না।

সভাসদ সকলের প্রতি একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন সুলতান। বললেন, আমাদের গোয়েন্দারা জানিয়েছে যে, খৃস্টানরা তাদের গুপ্তচরদের ধারণা দিয়েছে, মুসলমানদের ইতিহাস যতটা বিজয়ের, ততটা গাদ্দারীরও বটে। তারা যে পরিমাণ গাদ্দার জন্ম দিতে সক্ষম হয়েছে, সে পরিমাণ বিজয় তারা অর্জন করতে পারেনি। তাদের রাসূলের ওফাতের পরপরই খেলাফতের দখলদারিত্ব নিয়ে মুসলমানরা পরস্পর সংঘাতে লিপ্ত হয়। ক্ষমতার স্বার্থে তারা একে অপরকে হত্যা করে। কেউ খলীফা বা আমীর নিযুক্ত হলে নিজের মসনদের জন্য হুমকি হতে পারে এমন লোকদের অবলীলায় হত্যা করে। এমনকি প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য তারা শত্রুদের নিকট থেকে পর্যন্ত সহযোগিতা গ্রহণ করতে দ্বিধা করেনি। পারস্পরিক সংঘাতে তাদের জাতীয় ঐতিহ্য বিনষ্ট হয়েছে। রয়ে গেছে শুধু ব্যক্তিগত ক্ষমতার দাপট। থেমে গেছে তাদের সাম্রাজ্য বিস্তারের ধারা।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী বললেন, খৃস্টানরা আমাদের এই ঐতিহাসিক দুর্বলতা সম্পর্কে সম্যক অবগত যে, আমরা ব্যক্তি ক্ষমতার সংরক্ষণ ও নিশ্চিতকরণের স্বার্থে সালতানাতের বিশাল অংশও বিসর্জন দিতে পারি। এটাই আমাদের ইতিহাসে পরিণত হতে যাচ্ছে।

তকিউদ্দীন ও আমার বন্ধুগণ! আমি যখন অতীতের প্রতি দৃষ্টিপাত করি এবং যখন বর্তমান যুগের গাদ্দারদের বিশ্বাসঘাতকতা ও চক্রান্তের জাল দেখতে পাই, তখন আমি এই আশংকাবোধ করি যে, একটি সময় আসবে, যখন মুসলমান তাদের ইতিহাসের সাথেও গাদ্দারী করবে। জাতির চোখে ধুলো ছিটিয়ে তারা লিখবে যে, তারাই বীর এবং তারাই দুশমনের নাকে রশি বেঁধে রেখেছে। অথচ তারা হবে দুশমনের তাবেদার। দুশমন হবে তাদের অন্তরঙ্গ বন্ধু। নিজেদের ব্যর্থতা ও পরাজয়ের উপর পর্দা ঝুলিয়ে রাখবে। ইসলামী সম্রাজ্য ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকবে এবং আমাদের স্বঘোষিত খলীফা তার দায়দায়িত্ব অন্যের উপর চাপাতে চেষ্টা করবে। মুসলমানদের একটি বংশধর এমন আসবে, যারা ইসলাম জিন্দাবাদ শ্লোগান দিয়ে। ঈমানী কর্তব্য শেষ করবে। নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে কিছুই তাদের জানা থাকবে না। তাদেরকে একথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার মতও কেউ থাকবে না যে, একদল মানুষ আপন বাড়ীঘর, স্ত্রী-স্বজন ত্যাগ করে দূরে মরু-প্রান্তরে পাহাড়ে-উপত্যকায়, বিদেশ-বিভূইয়ে গিয়ে লড়াই করে ইসলামের অস্তিত্ব ও পতাকা রক্ষা করেছে। তারা বিশাল বিশাল নদী-সমুদ্রে সাঁতার কেটেছিল। আকাশের বিদ্যুৎ-বজ্র, আঁধার-ঝড় কিছুই তাদের গতিরোধ করতে পারেনি। এমন এমন দেশে গিয়ে জীবন বাজি রেখে তারা লড়াই করেছে, যেখানকার পাথর খণ্ডও ছিল তাদের দুশমন। লড়াই করেছে তারা ক্ষুৎপিপাসায় বিনা অস্ত্রে বিনা বাহনে। তারা আহত হয়েছে। কেউ তাদের জখমে পট্টি বাঁধেনি। শহীদ হয়েছে। সঙ্গীরা তাদের জন্য কবর খনন করার সুযোগ পায়নি। তারা রক্ত ঝরিয়েছে নিজেদের। রক্ত ঝরিয়েছে শত্রুদের। আর ঠিক সেই সময়ে কসরে খেলাফতে আসর বসেছিল মদের। নেচে গেয়ে উলঙ্গ সুন্দরী মেয়েরা আনন্দ দিচ্ছিল খলীফা ও তার সাঙ্গদের। ইহুদী ও খৃস্টানরা সোনা আর নারীর রূপ দিয়ে অন্ধ করে দিয়েছিল আমাদের খলীফা ও আমীরদের। খলীফারা যখন দেখলেন যে, দেশের মানুষ সেই অস্ত্রধারী মুজাহিদদের ভক্ত-অনুরক্ত হয়ে যাচ্ছে, যারা ইউরোপ ও ভারত উপমহাদেশে ইসলামের ঝান্ডা উডডীন করেছেন, তখন তারা খলীফাদের টার্গেটে পরিণত হন। ব্যভিচারের ন্যায় অপবাদ আরোপ শুরু হয় তাদের উপর। বন্ধ। করে দেয় সৈন্য ও রসদ সরবরাহ।

এই মুহূর্তে আমার কাসেমের সেই অপরিণত বয়সী ছেলেটির কথা মনে পড়ছে, যে কারো কোন সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়া হিন্দুস্তানের শক্তিধর এক শাসককে পরাজিত করেছিল এবং হিন্দুস্তানের বিশাল এক ভূখণ্ড কজা করে নিয়েছিল। ছেলেটি বিজিত এলাকায় এমন সুশাসন প্রতিষ্ঠা করেছিল যে, হিন্দুরা তার গোলামে পরিণত হয়ে যায় এবং তার স্নেহপূর্ণ সুশাসনে প্রভাবিত হয়ে মুসলমান হয়ে যায়। আমার যখন এই ছেলেটির কথা মনে পড়ে, তখন মনটা আমার ব্যথায় ঝাঁকিয়ে উঠে। কিন্তু তৎকালীন খলীফা তার সাথে কিরূপ আচরণ করলেন? তার উপর ব্যভিচারের অপবাদ আরোপ করলেন এবং অপরাধীর ন্যায় প্রত্যাহার করে নিলেন। বলতে বলতে হিচকি উঠে যায় সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর। বাম্পাচ্ছন্ন হয়ে উঠে তার দুনয়ন। থেমে যান তিনি।

বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ তার রোজনামচায় লিখেছেন

আমার বন্ধু সালাহুদ্দীন আইউবী তার ফৌজের হাজারো শহীদের লাশ দেখলেও বিচলিত হতেন না; বরং তার চোখ-মুখ উদ্দীপ্ত হয়ে উঠত। কিন্তু একজন গাদ্দারকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে যখন তার লাশে চোখ ফেলতেন, তখন তার মুখমণ্ডল বিমর্ষ হয়ে উঠত এবং দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়াতে শুরু করত। তেমনি মুহাম্মদ ইবনে কাসিমের কথা বলতে বলতেও তার হিচকি এসে যায় তিনি বারুদ্ধ হয়ে পড়েন। তখন আমি নিজ চোখে দেখেছি যে, তিনি অশ্রু রোধ করার চেষ্টা করছিলেন।

তারপর তিনি বলতে লাগলেন- দুশমন তার কোন ক্ষতি করতে পারেনি। তাকে শহীদ করল তার আপন লোকেরা। দুমশন তাকে বিজেতারূপে বরণ করে নিল আর আপনরা তাকে আখ্যা দিল ব্যভিচারী।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী যিয়াদের পুত্র তারেকের কথাও উল্লেখ করলেন। সেদিন তিনি এতই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন যে, জবান তার থামছিল না যেন। অথচ স্বভাবগতভাবেই তিনি ছিলেন স্বল্পভাষী। ছিলেন বাস্তববাদী। আমরা সকলে নীরব বসে রইলাম। অদ্ভুত এক প্রতিক্রিয়া অনুভব হচ্ছিল আমাদের। সালাহুদ্দীন আইউবী একজন মহান নেতা ছিলেন নিশ্চিত। অতীতকে তিনি কখনো ভুলতেন না। সমকালীন সমস্যা ও সময়ের দাবীর প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখতেন। দৃষ্টি তার নিবদ্ধ হয়ে থাকত অনাগত সুদূর ভবিষ্যতের প্রতি।

খৃস্টানদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আমাদের ভবিষ্যতের উপর নিবদ্ধ। খৃস্টান সম্রাট ও শাসকবর্গ বলছে যে, তারা ইসলামকে চিরতরে খতম করে দেবে। তারা আমাদের সাম্রাজ্য দখল করতে চায় না। আমাদের হৃদয়গুলো তারা চিন্তার তরবারী দিয়ে কেটে ক্ষত-বিক্ষত করতে চায়। আমার গোয়েন্দারা আমাকে বলেছে যে, খৃস্টাদের সবচেয়ে কট্টর ইসলাম-দুশমন সম্রাট ফিলিপ অগাস্টাসের বক্তব্য হল, তারা তাদের জাতিকে একটি লক্ষ্য স্থির করে দিয়েছে এবং একটি ধারার প্রবর্তন করে দিয়েছে। এখন তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পর্যায়ক্রমে সে লক্ষ্য অর্জনে কাজ করে যাবে। তারা তরবারীর জোরে লক্ষ্য হাসিল করা প্রয়োজন মনে করে না। তরবারী ছাড়া অন্য অস্ত্রও আছে তাদের কাছে …। তকিউদ্দীন! তাদের দৃষ্টি যেমন ভবিষ্যতের প্রতি, তেমনি আমাদেরও ভবিষ্যতের উপর নজর রাখা দরকার। তারা যেভাবে আমাদের মধ্যে গাদ্দার সৃষ্টি করার ধারা চালু করে দিয়েছে, তেমনি আমাদেরও এমন সব উপায় অবলম্বন করা আবশ্যক, যাতে গাদ্দারীর জীবাণু চিরতরে শেষ হয়ে যায়। গাদ্দারদের হত্যা করতে থাকা কোন প্রতিকার নয়। গাদ্দারীর প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। ক্ষমতার মোহ দূর করে আমাদের রাসূল-প্রেম সৃষ্টি করতে হবে। আর তার জন্য জাতির মনে দুমশনের অস্তিত্বের অনুভূতি থাকতে হবে। মুসলমানদের জানতে হবে যে, খৃস্টানদের সভ্যতায় এমন অশ্লীলতা বিরাজমান, যা চুম্বকের ন্যায় আকর্ষণীয়। বিভিন্ন জাতি আপন ঐতিহ্য ভুলে গিয়ে বিলীন হয়ে যাচ্ছে তাদের সভ্যতায়। তাদের ধর্মে মদপান করা বৈধ। মেয়েদের পরপুরুষের সামনে বিবস্ত্র নাচ-গান ও নির্জনে সময় কাটানো সবই সিদ্ধ। আমাদের ও তাদের মধ্যে বড় পার্থক্য এটাই যে, আমরা নারীর ইজ্জতের পাহারাদার আর তারা নারীর ইজ্জতের বেপারী। এই ব্যবধানটাই আজ আমাদের মুসলমান ভাইয়েরা মুছে ফেলতে চায়। তকিউদ্দীন! তোমার যুদ্ধক্ষেত্র দুটি। একটি মাটির উপরে, অপরটি মাটির নীচে। একটি হল দুমশনের বিরুদ্ধে আর অপরটি আপনদের বিরুদ্ধে। আমাদের নিজেদের মধ্যে যদি গাদ্দার না থাকত, তাহলে এ মুহূর্তে আমরা এখানে নয়, বৈঠক করতাম ইউরোপের হৃদপিন্ডে আর খৃস্টানরা আমাদের বিরুদ্ধে সুন্দরী মেয়ের পরিবর্তে ভালো কোন অস্ত্র ব্যবহার করত। আমাদের ঈমানের উত্তাপ যদি তীব্র হত, তাহলে এতদিনে খৃস্টানরা সে উত্তাপে জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে যেত।

আপনার সমস্যাগুলো আমি এখানে এসে বুঝতে পারলাম। মোহতারাম নূরুদ্দীন জঙ্গীও পুরোপুরি অবহিত নন যে, আপনি মিসরে একটি গাদ্দার বাহিনীর বেষ্টনীতে পড়ে গেছেন। এ ব্যাপারে তো আপনি তার সাহায্য নিতে পারতেন। বললেন তকিউদ্দীন।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী জবাব দিলেন

ভাই তকি! সাহায্য শুধু আল্লাহরই নিকট প্রার্থনা করা উচিত। সাহায্য প্রার্থনা আপনদের নিকট করা হোক বা দুশমনের নিকট, তা ঈমানকে দুর্বল করে দেয়। খৃস্টানদের বাহিনী বর্মপরিহিত। আমার সৈন্যরা আবৃত থাকে সাধারণ পোশাকে। তারপরও তারা খৃস্টানদের পরাজিত করেছে বারবার। ঈমান যদি লোহার মত শক্ত হয়, তাহলে লৌহবর্মের প্রয়োজন হয় না। বর্ম ও খন্দক নিরাপত্তার অনুভূতি সৃষ্টি করে এবং সৈন্যদের নির্ধারিত সীমানার মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলে। যুদ্ধক্ষেত্রে তুমি সব সময় পরিখার বাইরে থাকবে। ঘুরে-ফিরে লড়াই করবে। দুশমনের পিছনে যাবে না কখনো, বরং দুশমনকেই পিছনে রেখে লড়াই চালিয়ে যাবে। কেন্দ্র ঠিক রাখবে। পার্শ্ব বাহিনীকে ছড়িয়ে দেবে। দুশমনকে বেকায়দায় ফেলে হত্যা করবে। গেরিলা বাহিনী ব্যতীত কখনো যুদ্ধে যাবে না। গেরিলাদের দ্বারা দুশমনের রসদ ধ্বংস করাবে। পেছন থেকে যে রসদ আসবে, তাও ধ্বংস করবে এবং যা তাদের সাথে আছে, তাও ধ্বংস করবে। গেরিলাদেরকে দুশমনের পশুদের হত্যা কিংবা অস্থির করে তোলার কাজে ব্যবহার করবে। কখনো মুখোমুখি সংঘাতে লিপ্ত হবে না। যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করবে। দুশমনকে পেরেশান করে রাখবে। যে বাহিনীটি আমি রেখে যাচ্ছি, সেটি ময়দান থেকে এসেছে। তারা শোবক দুর্গ জয় করে এসেছে। এসেছে দুশমনের চোখে চোখ রেখে। এসেছে নিজের বহু সৈন্য শহীদ করিয়ে। জানবাজ গেরিলা বাহিনীও আছে এর মধ্যে। তাদের শুধু ইশারার প্রয়োজন। এই বাহিনীর মধ্যে আমি ঈমানের উত্তাপ সৃষ্টি করে রেখেছি। পাছে এমন যেন না হয় যে, তুমি নিজেকে সম্রাট ভেবে বস আর বাহিনীটির ঈমান ধ্বংস করে ফেল। আমাদের উপর যেসব হামলা হচ্ছে, তা আসছে আমাদের ঈমানের উপর। মনে রেখো, খৃস্ট সভ্যতা মিসরে ঢুকে পড়ছে বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মত।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী তার ভাই তকিউদ্দীনকে বিস্তারিত বুঝিয়ে দেন যে, সুদানে মিসর আক্রমণের প্রস্তুতি চলছে। সুদানীদের অধিকাংশ হল ওখানকার হাবশী উপজাতি, যারা না মুসলমান, না খৃস্টান। তাদের মধ্যে এমন কিছু মুসলমানও আছে, যারা মিসরের এই বাহিনীর পলাতক সৈনিক। বিদ্রোহের অভিযোগে তাদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী বললেন

 কিন্তু তুমি ঘরে বসে দুমশনের অপেক্ষা করবে না। গোয়েন্দারা তোমাকে রিপোর্ট জানাতে থাকবে। হাসান ইবনে আবদুল্লাহ তোমার সাথে থাকবে। যখনই টের পাবে যে, দুশমনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে এবং তারা আক্রমণ করার জন্য সমবেত হচ্ছে, সময় নষ্ট না করে সাথে সাথে তুমি হামলা করে ফেলবে এবং প্রস্তুত অবস্থাতেই দুশমনদের খতম করে দেবে। পেছনের ব্যবস্থাপনা শক্ত রাখবে। দেশবাসীকে যুদ্ধের পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করতে থাকবে। আল্লাহ না করুন যদি তুমি পরাজিত হও, তাহলে নিজের ভুল স্বীকার করে নিয়ে জাতিকে পরাজয়ের প্রকৃত কারণ সম্পর্কে অবহিত করবে। যুদ্ধে লড়া হয় জনগণের রক্ত ও অর্থে। যুদ্ধে দেশবাসীর সন্তানরাই শহীদ হয়, পঙ্গু হয়। তাই জনগণের সমর্থন নিয়েই কাজ করতে হবে। যুদ্ধকে রাজা বাদশাদের খেলতামাশা মনে করবে না। এটি একটি জাতীয় বিষয়। এতে জাতিকে সাথে রাখতে হবে।

আমি যে ফাতেমী খেলাফতকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিলাম, তার সমর্থকরা এখনো আমাদের বিরুদ্ধে তৎপর। আমি জানতে পেরেছি যে, তারা নাকি একজনকে তাদের খলীফা নির্ধারণ করে রেখেছে। তাদের খলীফা আল আজেদ মৃত্যুবরণ করেছে ঠিক; কিন্তু এ আশায় তারা এই খেলাফতকে জীবিত রেখেছে যে, সুদানীরা মিসরে আক্রমণ করবে, আমাদের সৈন্যরা বিদ্রোহ করবে এবং এই সুযোগে খৃস্টানরা গোপনে ভেতরে ঢুকে ফাতেমী খেলাফত পুনর্বহাল করে দেবে। ফাতেমীরা হাসান ইবনে সাব্বাহর ঘাতক দলের সহযোগিতা পাচ্ছে। আমি আলী বিন সুফিয়ানকে সাথে করে নিয়ে যাচ্ছি। তার নায়েব হাসান ইবনে আবদুল্লাহ ও কোতোয়াল গিয়াস বিলবিসকে তোমার সাথে রেখে যাচ্ছি। এরা গুপ্ত বাহিনীর প্রতি নজর রাখবে। তুমি সেনাভর্তি বাড়িয়ে দাও এবং সামরিক মহড়া চালিয়ে যাও।

ইদানীং আমাদের নিকট সংবাদ আসছে যে, মিসরের দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকা থেকে ফৌজে লোক পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা এ সংবাদও পেয়েছি যে, সেখানকার জনগণ সেনাবাহিনীর বিপক্ষে চলে গেছে। বলল হাসান ইবনে আবদুল্লাহ।

তার কারণ জানা গেছে কি? জিজ্ঞেস করেন আলী বিন সুফিয়ান।

আমার দুজন গুপ্তচর সে এলাকায় খুন হয়েছে। সেখান থেকে সংবাদ সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তথাপি আমি নতুন লোক পাঠিয়েছি। জবাব দেন হাসান।

আমার সন্দেহ, সেখানকার মানুষ নতুন কোন প্রোপাগান্ডার শিকার হয়ে পড়েছে। এলাকাটা বড় দুর্গম। মানুষগুলো বড় পাষাণ, বিশ্বাসে নড়বড়ে এবং সন্দেহপ্রবণ। বলল গিয়াস বিলবিস।

সংশয়প্রবণতা বড় এক অভিশাপ। যা হোক, তোমরা এলাকাটার প্রতি বিশেষভাবে দৃষ্টি রাখ এবং সেখানকার মানুষগুলোকে সংশয় থেকে রক্ষা করার পদক্ষেপ নাও। বললেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী।

***

তিন-চার দিন পর।

কার্ক দুর্গে মিটিং বসেছে খৃস্টানদের। খৃস্টান সম্রাট ও সেনা অধিনায়কগণ বৈঠকে উপস্থিত। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর অগ্রযাত্রায় তারা শংকিত। তিনি শোবক নিয়ে গেছেন; যে কোন মুহূর্তে কার্কও আক্রান্ত হতে পারে বলে তারা বেজায় চিন্তিত। মুসলমানরা যদি শোবকের ন্যায় কার্কও জয় করে নিয়ে যায়, তাহলে জেরুজালেম রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে ভেবে তারা বিচলিত। তারা টের পেয়েছে যে, সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী সাবধানতার সাথে অগ্রসর হচ্ছেন। তিনি একটি এলাকা দখল করছেন আর নতুন ভর্তি দিয়ে সৈন্যের অভাব পূরণ করছেন। নতুন সৈন্যদেরকে পুরাতন সৈন্যদের সাথে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন এবং যখন নিশ্চিত হচ্ছেন যে, এবার এরা শত্রুর মুখোমুখি হওয়ার যোগ্য হয়েছে, তখন সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছেন। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর এই কর্মধারাকে সামনে রেখেই খৃস্টানরা কার্কের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে শক্ত করেছে, বাইরে এসে লড়াই করারও পরিকল্পনা প্রস্তুত। কিন্তু এ বৈঠকে তারা সেই পরিকল্পনায় পরিবর্তন সাধন করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী তার বাহিনী ও মিসরের সাম্প্রতিক বিপ্লব সংক্রান্ত গোয়েন্দা প্রধান হরমুনের রিপোর্টই তাদের নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর যে বাহিনীটি শোবক দুর্গ জয় করেছিল, তিনি তাদেরকে কায়রো নিয়ে গেছেন। কায়রোর বাহিনীকে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়ে দিয়েছেন। নূরুদ্দীন জঙ্গীর সামরিক সাহায্য ময়দানে পৌঁছে গেছে। সুলতান আইউবী কায়রো গিয়েছেন এবং কুচক্রী গাদ্দারদের শাস্তি দিয়ে আবার রণাঙ্গনের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন, অতি অল্প সময়ের মধ্যে গুপ্তচর মারফত সে সংবাদ কার্ক পৌঁছে গিয়েছিল। কায়রোর উপ-রাষ্ট্রপ্রধান মোসলহুদ্দীনের গ্রেফতারি ও মৃত্যুদণ্ডের সংবাদ ছিল খৃস্টানদের জন্য অনভিপ্রেত। মোসলেহুদ্দীন ছিল খৃস্টানদের একজন সক্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ট। বৈঠকে এসব ঘটনাপ্রবাহের বিবরণ দিচ্ছিলেন গোয়েন্দা প্রধান হরমুন।

তিনি বললেন, মোসলেহুদ্দীনের মৃত্যুতে আমাদের বিরাট ক্ষতি হয়েছে ঠিক; কিন্তু তকিউদ্দীনের নিয়োগ আমাদের জন্য আশাব্যঞ্জক। তকিউদ্দীন সালাহুদ্দীন আইউবীর ভাই বটে, তবে আমাদের গুপ্তবাহিনী তাকে বাগে আনতে সক্ষম হবে। আরো আশার কথা হল, সালাহুদ্দীন এবং আলী বিন সুফিয়ান দুজনই কায়রোতে অনুপস্থিত।

আমি বুঝতে পারছি না যে, তোমার হাশীশীরা কি করছে! অভাগারা এখনো সালাহুদ্দীন আইউবীকে হত্যা করতে পারল না! টাকা তো এ পর্যন্ত প্রচুর নষ্ট করলাম। বললেন সম্রাট রেমান্ড।

অর্থ যা ব্যয় করছি, নষ্ট হচ্ছে না। আমি আশা করছি, সালাহুদ্দীন আইউবী রণাঙ্গন পর্যন্ত পৌঁছুতে পারবেন না। তার সাথে যে চব্বিশজন দেহরক্ষী কায়রো গিয়েছিল, তাদের চারজন আমাদের হাশীশী সদস্য। মওকা তাদের হাতে এসে গেছে। সব আয়োজন আমি সম্পন্ন করে দিয়েছি। সালাহুদ্দীন আইউবীকে তারা পথেই হত্যা করে ফেলবে। সংবাদটা এই এসে পড়ল বলে। বললেন হরমুন।

আমাদের এত আত্মবিশ্বাস না থাকা উচিত। ধরে রাখ, সালাহুদ্দীন আইউবী নিহত হয়নি এবং জীবিত ও অক্ষত রণাঙ্গনে অবস্থান করছে। তার কাছে আছে এখন তাজাদম বাহিনী। নতুন ভর্তির পর এখন তার সৈন্য সংখ্যা অনেক। নূরুদ্দীন জঙ্গীর সাহায্যও পেয়ে গেছে। শোবকের ন্যায় দুর্ভেদ্য দুর্গ এখন তার দখলে। তার রসদ এখন কায়রো থেকে আসবে না। শোবকে তিনি বিপুল খাদ্য-সম্ভার জোগাড় করে রেখেছেন। এমতাবস্থায় আমাদের করণীয় কি, সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার। আমি এই সুযোগ দিতে চাই না যে, আইউবী কার্ক অবরোধ করে ফেলবেন আর আমরা তার অবরোধে লড়াই করব। বললেন ফিলিপ অগাস্টাস।

আইউবীকে আমরা দুর্গ অবরোধ করার সুযোগ দেব না। আমরা দুর্গের বাইরে গিয়ে লড়াই করব এবং এমন ধারায় লড়ব যে, ধীরে ধীরে আমরাই বরং শোবক অবরোধ করে ফেলব। বললেন অপর এক খৃস্টান সম্রাট।

সালাহুদ্দীন মরু-শিয়াল। মরু এলাকায় তাকে পরাস্ত করা সহজ নয়। আমাদেরকে তিনি শোবক অবরোধ করার সুযোগ হয়তো দেবেন, কিন্তু বিনিময়ে স্বয়ং আমাদেরকেই তিনি অবরুদ্ধ করে ফেলবেন। আমি তার চাল বুঝে ফেলেছি। তোমরা যদি মুখোমুখি এনে তাকে লড়াই করাতে বাধ্য করতে পার, তাহলে আমি তোমাদেকে বিজয়ের গ্যারান্টি দিতে পারি। তবে একথা সত্য যে, তোমরা তাকে মুখোমুখি আনতে পারবে না। বললেন ফিলিপ অগাস্টাস।

দীর্ঘ আলোচনা-পর্যালোচনার পর সিদ্ধান্ত হল, অর্ধেক সৈন্য দুর্গের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হবে। তারা সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর বাহিনীর সন্নিকটে ছাউনী ফেলে অবস্থান নেবে এবং মুসলিম বাহিনীর গতিবিধির উপর কড়া নজর রাখবে।

এ পরিকল্পনায় যারা দুর্গের বাইরে গিয়ে লড়াই করবে, তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে, সংখ্যায় তারা হবে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর বাহিনীর তিনগুণ। দ্বিগুণ তো অবশ্যই। পেছন দিক থেকে আক্রমণ করার জন্য নিযুক্ত করা হয়েছে স্বতন্ত্র বাহিনী। পরিকল্পনায় স্থির করা হয়েছে, যেহেতু মুসলিম বাহিনীর রসদ ও অন্যান্য সাহায্য আসবে শোবক থেকে, তাই শোবক আর মুসলমানদের মধ্যকার ফাঁকা স্থানকে রাখতে হবে কমান্ডো বাহিনীর দখলে। সম্মুখ থেকে এত জোরালো আক্রমণ চালাতে হবে, যাতে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী একস্থানে স্থির হয়ে মুখোমুখি লড়াই করতে বাধ্য হন।

খৃস্টানদের ভরসা মূলত বর্মাচ্ছাদিত বাহিনীর উপর। তাদের অধিকাংশ সৈন্য বর্মপরিহিত। সকলের মাথায় শিরস্ত্রাণ। উট-ঘোড়াগুলো পর্যন্ত বর্মাচ্ছাদিত। তাদের ইউরোপিয়ান ঘোড়াগুলো মরুভূমিতে অল্পসময়ে ক্লান্ত ও বেহাল হয়ে যায় বলে তারা আরব থেকে ঘোড়া ক্রয় করে এনেছে। কিন্তু সংখ্যায় তেমন বেশী নয়। তাই তারা মুসলমানদের কাফেলা থেকে ঘোড়া ছিনতাই করতে শুরু করেছিল। চুরি করেও এনেছে কিছু। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর ঘোড় উন্নতজাতের। তার আরবী জাতের ঘোড়াগুলো অসীম সহনশীল। পিপাসায় অকাতর মাইলের পর মাইল ছুটতে পারে এগুলো।

এতো হলো খৃস্টানদের সামরিক প্রস্তুতি। এর বাইরে তারা আরেকটি মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ ঘোষণা করে রেখেছিল। সে ব্যাপারে গোয়েন্দা প্রধান হরমুনের রিপোর্ট হল, সালাহুদ্দীন আইউবী মিসরের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত এলাকা থেকে নতুন ভর্তি পাবেন না। অত্র অঞ্চলের কেউ তার বাহিনীতে ভর্তি হবে না। এই সেই এলাকা, যার ব্যাপারে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর উপ-গোয়েন্দা প্রধান হাসান ইবনে আবদুল্লাহ রিপোর্ট করেছিলেন যে, অমুক এলাকার মানুষ এখন সেনাবাহিনীতে ভর্তি হচ্ছে না এবং অনেক লোক সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধাচারণ করছে।

.

এটি একটি অবাধ্য ও দাঙ্গাবাজ গোত্রের অঞ্চল। এক সময় এরা সুলতান আইউবীকে বেশ ভাল ভাল সৈন্য দিয়েছিল। কিন্তু এখন হরমুনের রিপোর্ট প্রমাণ করছে, খৃস্টানদের সন্ত্রাসী বাহিনী সে এলাকায় পৌঁছে গেছে। তাদের অপতৎপরতায় এখন সেখানকার পরিস্থিতি এত নাজুক হয়ে গেছে যে,হাসান ইবনে আব্দুল্লাহ সংবাদ নেয়ার জন্য দুজন গোয়েন্দা প্রেরণ করেছিলেন দুজনই খুন হয়েছে। তাদের লাশ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। শুধু রহস্যময় ধরনের একটি সংবাদ পাওয়া গিয়েছিল যে, তাদেরকে চিরদিনের জন্য গুম করে ফেলা হয়েছে। বিশাল-বিস্তৃত সেই লোকালয়টি এখন দুর্ভেদ দুর্গ। সেখান থেকে কোন তথ্য সংগ্রহ করে আনা এখন মুসলমানদের পক্ষে অসম্ভব। শুধু এতটুকু তথ্য জোগাড় করা সম্ভব হয়েছে যে, সেখানকার জনসাধারণ মুসলমান বটে, তবে তারা কুসংস্কারাচ্ছন্ন একটি সম্প্রদায়।

সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে হরমুন জানান যে, তার পরিকল্পনা সাফল্যের সঙ্গে এগিয়ে চলছে। এখন তিনি মিসরের সবকটি সীমান্ত এলাকায় এ পন্থা প্রয়োগ করবেন। তারপর ধীরে ধীরে এর প্রভাব মিসরের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করবেন। হরমুন আশা প্রকাশ করেন যে, গোটা মিসরকেই তিনি তার প্রভাব-বলয়ে নিয়ে আসবেন। তিনি বললেন, আমি মুসলমানদের এমন একটি দুর্বলতাকে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছি, যাকে তারা নিজেদের গুণ মনে করে। মুসলমান দরবেশ-ফকির, পীর-মুরীদ, মাওলানা মৌলভী এবং মসজিদের কোণে বসে আল্লাহ আল্লাহ জিকিরকারী সকলেই বুজুর্গ ধরনের এমন একদল লোককে নির্বিচারে ভক্তি-শ্রদ্ধা করে থাকে, যারা ইসলামী ফৌজের সেই সব সালারদের শত্রু মনে করে, যারা আমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে খ্যাতি অর্জন করেছে। এই পীর-মাশায়েখগণ তাদের আপন আপন ভক্ত-মুরিদদের বলে থাকেন যে, আল্লাহ তাদের হাতে আছেন। তারা আল্লাহর খাস বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত। তদের চিন্তা, কিভাবে তারা জনমনে সুখ্যাতি অর্জন করবেন। যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত হওয়ার হিম্মত তাদের নেই। তাই ফৌজের সালারগণ ময়দানে জীবনবাজি লড়াই করে যে খ্যাতি অর্জন করেছে, তারা ঘরে বসেই তা লাভ করতে চায়। প্রকৃত বিচারে মুসলমানদের এই সেনাপতিগণই সালাহুদ্দীন আইউবী ও নুরুদ্দীন জঙ্গী যাদের অন্যতম- খাঁটি মানুষ, আসল মুসলমান। দেশের মানুষ যদি ইবাদত-বন্দেগীতে তাদের নামও উল্লেখ করে, আমি বলব, তারা এর হকদার। কিন্তু তাদের খলীফারা ইবাদতের মধ্যে নিজেদের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করে ফেলেছেন। পাশাপাশি নামধারী আলেম ও ইমামদের একটি দলের আবির্ভাব ঘটেছে, যারা কাজ করতে ভয় পান। খলীফাদের ছত্রছায়ায় তারা জিহাদের বিকৃত ব্যাখ্যা দিচ্ছে, যাতে মানুষ জিহাদবিমুখ হয়ে তাদের নিকট গিয়ে ভীড় জমায় এবং তাদেরকে পীর বুজুর্গ,আল্লাওয়ালা জেনে শ্রদ্ধা করে। তারা এমন যাদুময় ভাষায় কথা বলে যে, সাধারণ মানুষ ভাবতে শুরু করে, তাদের হৃদয়ে এমন এমন ভেদ লুকায়িত আছে, যা আল্লাহ যাকে তাকে দান করেন না। ফলে সরল-সহজ মানুষ তাদের পাতা ফাঁদে আটকা পড়ে যাচ্ছে। আমি সেই আলেম ও দরবেশদের কাজে লাগাচ্ছি। মুসলমানদের এই দুর্বলতা আমাদের অনেক ফায়দা দিচ্ছে। আমি মুসলমানদেরকে ইসলামেরই কথা শুনিয়ে শুনিয়ে ইসলামের মৌল চেতনা থেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছি। ইতিহাস সাক্ষী আছে যে, ইহুদীরা তথ্যসন্ত্রাস দিয়েই ইসলামকে বেশ দুর্বল করে দিয়েছিল। আমি তাদেরই নীতিমালা অনুসারে কাজ করে যাচ্ছি।

এটিই সেই যুদ্ধক্ষেত্র, যার ব্যাপারে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। তার এত দুশ্চিন্তার মূল কারণ, এই যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁরই জাতির লোকেরা তাঁর বিরুদ্ধে লড়াই করছে এবং সে যুদ্ধক্ষেত্র তাঁর দৃষ্টির আড়ালে।

***

তকিউদ্দীন ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়ে সালাহুদ্দীন আইউবী রণাঙ্গনের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যান। সাথে চব্বিশজন ব্যক্তিগত দেহরক্ষীর একটি বাহিনী। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর দেহরক্ষীদের এই সংখ্যা জানা ছিল খৃস্টানদের। তারা এও জানত যে, এই বাহিনীর চারজন হাশীশী, যারা নিজেদের যোগ্যতা ও বীরত্বের প্রমাণ দিয়ে সুলতানের দেহরক্ষী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিল। কিন্তু তারা সুযোগ পাচ্ছে না। কারণ, দেহরক্ষীদের সংখ্যা সব সময় চব্বিশ অপেক্ষা বেশী থাকে এবং তাদের ডিউটি পরিবর্তন হতে থাকে। এই চারজনের ডিউটি একত্রে পড়েনি কখনো। রক্ষীবাহিনীর কমান্ডার যতটুকু সম্ভব সাবধান থাকেন সব সময়। রক্ষীদের মধ্যে ঘাতক আছে, কমান্ডার তা জানতেন না বটে, কিন্তু তিনি সর্বদা সজাগ থাকতেন, পাছে কেউ দায়িত্বে অবহেলা না করে। এই সফরে সুলতান আইউবী নিজেই বললেন, রক্ষীদের পুরো বাহিনীকে তিনি সাথে রাখবেন না। চব্বিশজনই যথেষ্ট। অথচ, পথে খৃস্টান কমান্ডোদের আক্রমণের আশংকা আছে প্রবল।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী কায়রো থেকে দ্বি-প্রহরের পর রওনা হন। রাতের অর্ধেকটা কাটে সফরে আর বাকিটা বিশ্রামে। শেষ রাতে আবার সফর শুরু করেন। সূর্য উদয় হয়। রোদের তাপ প্রখর থেকে প্রখরতর হতে থাকে। চলতে থাকে কাফেলা। দ্বি-প্রহরের প্রচন্ড সূর্যতাপ ঘোড়াগুলোকে অস্থির করে তুলতে শুরু করে। কাফেলা থেমে যায়। অবস্থান গ্রহণ করে এমন একস্থানে, যেখানে পানি আছে, গাছ আছে, আছে টিলার ছায়াও। অল্প সময়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে যায় সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর তাবু। সুলতানের চারপাই ও চাদর বিছিয়ে দেওয়া হয় তাঁবুতে।

পানাহার শেষে শুয়ে পড়েন সুলতান। তাঁবুর সামনে-পিছনে দাঁড়িয়ে যায় দুরক্ষী। নিকটেই গাছের ছায়ায় বসে পড়ে অন্যান্য রক্ষীরা। ঘোড়াগুলোকে পানি পান করানোর জন্য নিয়ে যায় কয়েকজন। আলী বিন সুফিয়ান ও অন্যান্য কর্মকর্তাগণ একটি গাছের নীচে গিয়ে শুয়ে পড়েন। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর তাবু এখান থেকে দেখা যায় না। মরুভূমির সূর্য জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছাই করে দিচ্ছে আসমান জমিন। যে যেখানে ছায়া পেল বসে-শুয়ে পড়ল সকলে।

যে দুরক্ষীর উপর সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর তাবু পাহারার দায়িত্ব চাপে, তারা দুজন হাশীশী। এমন ঘটনা এই প্রথম। দীর্ঘদিন ধরে এমনি একটি সুযোগেরই সন্ধানে ছিল তারা। মিশন বাস্তবায়নে তাদের এখনই সুবর্ণ সুযোগ। রক্ষী বাহিনীর অধিকাংশ সদস্য চলে গেছে ঘোড়াগুলোকে পানি পান করাতে। পানির কূপের অবস্থান একটি টিলার অপর প্রান্তে। কাফেলার মাল বহনকারী উটের চালকরাও উটগুলোকে পানি পান করানোর জন্য নিয়ে গেছে কূপে। তাদের মধ্যেও দুজন হাশীশী। চোখের ইশারায় ডিউটিরত হাশীশী রক্ষীদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে যায় তারা।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর তাবুর সম্মুখে দন্ডায়মান রক্ষী তাঁবুর পর্দাটা ঈষৎ ফাঁক করে ভিতরে তাকায়। ঈশারা করে বাইরের জনকে। গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী। পিঠটা তার তাঁবুর দরজার দিকে ফেরানো। পা টিপে টিপে ভিতরে ঢুকে পড়ে রক্ষী। খঞ্জর-তরবারী কিছুই বের করেনি সে। হাতের রশিটাও রেখে এসেছে তাঁবুর বাইরে। সুঠাম, সুদেহী বলবান এক যুবক। শক্তিতে সুলতান আইউবীর দিগুণ না হলেও দেড়গুণ তো অবশ্যই।

রক্ষী সতর্ক পায়ে পৌঁছে যায় সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর নিকট। বিদ্যুদ্বেগে দুহাতে ঝাঁপটে ধরে সুলতানের ঘাড়। ঘুম ভেঙ্গে যায় সুলতানের। পার্শ্ব পরিবর্তন করলেন সুলতান। কিন্তু রক্ষীর পাঞ্জা থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারলেন না তিনি। আক্রমণকারী সান্ত্রী সুলতানের পিঠে কনুইচাপা দিয়ে এক হাত সরিয়ে নেয় ঘাড় থেকে। অপর হাতে চেপে ধরে রাখে সুলতানের ধমনী। কটিবন্ধ থেকে পুরিয়ার মত কি যেন একটা বের করে সে। পুরিয়াটা এক হাতেই খুলে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর মুখে ঢুকিয়ে দিতে যায়। সুলতানকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলতে চাইছে রক্ষী।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী অসহায়। পিঠে তার শক্তিশালী একটি দানবের চাপা দেয়া কনুই। ধমনীটা চেপে ধরে আছে সে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আছে সুলতানের। মুখটা ছিল খোলা। পুরিয়া দেখে মুখটা এখন বন্ধ করে ফেলেছেন তিনি। মৃত্যু তাঁর এসে গেছে মাথার উপর। তবু বুদ্ধি হারাননি সুলতান।

তরবারী-সদৃশ একটি খঞ্জর সর্বদা সঙ্গে থাকে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর। এটি তার অলংকার। বাঁধা থাকে কোমরে। সেটি বের করে হাতে নেন তিনি। আক্রমণকারী সুলতানের মুখে বিষ দেয়ার প্রচেষ্টায় ব্যস্ত। তার পাজরে খঞ্জরটি সেঁধিয়ে দেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী। এক টানে বের করে আনেন। আঘাত হানেন পুনর্বার। পাজরে বিদ্ধ হয় আবারো। আক্রমণকারী রক্ষী গন্ডারের ন্যায় মোটা চামড়ার মানুষ। এত অল্প সময়ে সরবার নয় সে। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী একজন সৈনিক। খঞ্জরের আঘাত ও কার্যকারিতা জানা আছে তাঁর। দ্বিতীয় আক্রমণের পর রক্ষীর পাজর থেকে খঞ্জরটি বের করে নেন তিনি। কয়েকটা মোচড় দিয়ে আরো ভিতরে সেঁধিয়ে ঝটকা এক টান দেন নীচের দিকে। আক্রমণকারীর নাড়িভুড়ি ও পেটের ভেতরটা বেরিয়ে আসে বাইরে।

শিথিল হয়ে আসে আক্রমণকারীর হাত দুটো। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর ঘাড় ছুটে যায় তার হাত থেকে। অপর হাত থেকে ছুটে পড়ে যায় পুরিয়াটা। গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী। ধাক্কা দেন আক্রমণকারীকে। চারপাই থেকে নীচে গিয়ে পড়ে লোকটি। উঠে দাঁড়াবার শক্তি নেই তার।

মাত্র আধা মিনিটের মধ্যে শেষ হয়ে যায় এ যুদ্ধ। তাঁবুর বাইরে দণ্ডায়মান ছিল অপর রক্ষী। কিছু একটা পতনের শব্দ শুনতে পায় সে। পর্দা তুলে উঁকি দেয় তাঁবুর ভেতর। দৃশ্য দেখে চমকে উঠে। তরবারী উঁচু করেই ভেতরে প্রবেশ করে রক্ষী। আঘাত হানে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর উপর। ঝট করে তাঁবুর মধ্যবর্তী খুঁটির আড়ালে চলে যান তিনি। আঘাতটা পড়ে গিয়ে বাঁশের খুঁটির উপর। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী যেমন জন্মগত অসিচালক, তেমনি সুদক্ষ যোদ্ধাও। সাথে সাথে পাল্টা খঞ্জরের আঘাত হানেন আক্রমণকারীর উপর। আক্রমণকারীও সৈনিক। সুলতানের আঘাত প্রতিহত করে সে। সাথে সাথে রক্ষীবাহিনীর কমান্ডারকে আওয়াজ দেন সুলতান। পুনরায় আঘাত হানে আক্রমণকারী। সম্মুখ থেকে সরে দাঁড়ান তিনি। চলে যান আক্রমণকারীর এক পার্শ্বে। পাল্টা আঘাত করেন সুলতান। সুলতানের এই খঞ্জরাঘাত ঠেকাতে ব্যর্থ হয় রক্ষী।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর ডাকে তাঁবুতে প্রবেশ করে দুরক্ষী। কিন্তু তারাও হামলা করে সুলতানের উপর। এতক্ষণে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী আহত করে ফেলেন দ্বিতীয় রক্ষীকে। তবুও লড়ে যাচ্ছে সে। এখন সাথে এসে যোগ দেয় তার অপর দুসঙ্গী। হুঁশ-জ্ঞান-সাহস ঠিক রেখে মোকাবেলা করে যান সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী। আল্লাহর রহমত, এমনি সময়ে বাহিনীর কমান্ডার এসে প্রবেশ করেন তাঁবুর ভেতর। অন্যান্য রক্ষীদেরও ডাক দেন তিনি। সুলতান আইউবীর নির্দেশে নিজে ঝাঁপিয়ে পড়েন আক্রমণকারীদের উপর। ছুটে আসে চার-পাঁচজন রক্ষী। চেঁচামেচি শুনে দৌড়ে আসেন আলী বিন সুফিয়ান ও তাঁর সঙ্গীরা। ঘটনা দেখে থ খেয়ে যান তারা। রক্তাক্ত দেহে লুটিয়ে আছে চারজন রক্ষী। মরে গেছে দুজন। একজনের মরি মরি অবস্থা, হুঁশ নেই তার। পেটটা উপর থেকে নীচ পর্যন্ত ফাঁড়া। বুকে গভীর দুটি জখম। চতুর্থজনের পেটে একটি জখম, অপর জখমটি উরুতে। মাটিতে বসে হাতজোড় করে চীৎকার করছে সে আমাকে বাঁচতে দাও, বোনটির জন্য আমাকে বাঁচাও!

নিজ রক্ষীদের নিরস্ত্র করেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী। অবস্থা দেখে তারা এত ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল যে, তৃতীয় লোকটিকে অচেতন অবস্থায় নিঃশ্বাস ফেলতে দেখেই ধমনী কেটে দেয় তার। চতুর্থজনকে তাদের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখেন সুলতান। এটি একদিকে যেমন তাঁর মমতার বহিঃপ্রকাশ, অপরদিকে ষড়যন্ত্রের মূল সূত্র উদঘাটনের জন্য একজনের বেঁচে থাকা আবশ্যকও বটে।

কাফেলার সাথেই ছিল সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর ডাক্তার। সুলতান যেখানে যান, এই ডাক্তার সর্বদা তাঁর সঙ্গে থাকেন। সুলতান তাকে বললেন, যে কোন মূল্যে এ লোকটিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। সুলতানের গায়ে এতটুকু আঁচড়ও লাগেনি। তিনি হাঁপাচ্ছেন। তবে মানসিক দিক থেকে তিনি সম্পূর্ণ শান্ত। আবেগ-উৎকণ্ঠা, রাগ-ক্ষোভ কিছুই নেই তার মনে। মুখে মুচকি হাসি টেনে তিনি বললেন, আমি বিস্মিত নই। এমনটি হওয়ারই কথা।

তবে আলী বিন সুফিয়ানের মনে বেশ অস্থিরতা পরিলক্ষিত হল। তাঁর দায়িত্ব ছিল, সুলতানের দেহরক্ষী হিসেবে যাকে নির্বাচন করবেন, যাচাই-বাছাই করে দেখবেন লোকটা নির্ভরযোগ্য কিনা। এখন তাকে দেখতে হবে বাহিনীর অবশিষ্ট সিপাহীদের মধ্যে এদের কোন সদস্য রয়ে গেছে কিনা।

প্রথম আক্রমণকারী রক্ষী যে পুরিয়াটা সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর মুখে দিতে চেয়েছিল, সেটা পড়ে আছে সুলতানের বিছানায়। এক প্রকার পাউডার। রং সাদা। তার খানিকটা ছিটিয়ে পড়েছে বিছানায়। ডাক্তার পাউডারগুলো পরীক্ষা করে দেখলেন। বললেন, এগুলো বিষ- এমন বিষ যে, এর তিল পরিমাণও যদি কারো কণ্ঠনালী অতিক্রম করে, তাহলে অল্প সময়ের মধ্যেই তার মৃত্যু ঘটে। এগুলো সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীকে খাওয়ানোর চেষ্টা করা হয়েছিল শুনে তিনি আঁতকে উঠেন। ডাক্তারের নির্দেশে বিছানাটি উঠিয়ে বাইরে নিয়ে পরিস্কার করে আনা হয়।

জখমীকে তুলে নিজের বিছানায় শুইয়ে দেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী। তরবারীর একটি আঘাত লেগেছে তার পেটে। অপরটি উরুতে। পেটের আঘাত আশংকাজনক নয়। তেরছা করে কাটা। উরুর জখম লম্বা ও গভীর। হাতজোড় করে সুলতানের নিকট জীবন ভিক্ষা চাইছে সে। সুলতানের বিরুদ্ধে তার ব্যক্তিগত শত্রুতা নেই। দৃষ্টিভঙ্গির কোন বিরোধও নয়। সে ভাড়াটিয়া ঘাতক। ধরা পড়ার পর এখন নিজের অবিবাহিতা বোনটির জন্যই তার যত অস্থিরতা। বারবার নিজেন নাম উচ্চারণ করে মিনতির সুরে বলছে- আমি মুসলমান। আপনি আমার অপরাধ ক্ষমা করুন মহামান্য সুলতান! আমার নিরপরাধ বোনের খাতিরে আমায় মাফ করে দিন।

মানুষের জীবন-মৃত্যু দুই-ই আল্লাহর হাতে। শান্ত সমাহিত অথচ ভাব-গম্ভীর কণ্ঠে বললেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী। সুলতান বললেন, নিজ চোখেই তো দেখলে, কে মারেন আর কে জীবিত রাখেন। তবে দোস্ত! এ মুহূর্তে তোমার জীবনটা যার হাতে, তুমি তাকে দেখতে পাচ্ছ। নিজের অপরাধের প্রতি দৃষ্টি দাও। নিজের অসহায়ত্বের কথা একটু ভাব। আমি তোমাকে তোমার সতীর্থদের মরদেহের সাথে জীবন্ত মরুভূমিতে ফেলে আসব। মরুর শিয়াল আর নেকড়েরা তোমাকে জীবন্ত ছিঁড়ে ছিঁড়ে ভক্ষণ করবে। তোমার হুশ-জ্ঞান ঠিকই থাকবে, তুমি সব টের পাবে। কিন্তু পালাতে পারবে না। তুমি ধুকে ধুকে জীবন বিসর্জন দেবে আর নিজের পাপের শাস্তি ভোগ করবে।

অকস্মাৎ শিউরে উঠে জখমী। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর দুহাত ঝাঁপটে ধরে। উপুড় হয়ে পড়ে হাউ মাউ করে কেঁদে উঠে। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কে? কোথা থেকে এসেছ? আমার সঙ্গে তোমার শত্রুতা কিসের?

আমি হাশীশীদের লোক। আমরা চারজন হাশীশী ছিলাম। কেউ দুবছর, কেউ তিন বছর আগে আপনার ফৌজে ভর্তি হয়েছি। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আমাদেরকে আপনার দেহরক্ষী ডিভিশনে ঢোকানো হয়েছে। জবাব দেয় জখমী। অকপটে সব তথ্য ফাঁস করে দিতে শুরু করে সে। বলে- আপনার রক্ষী বাহিনীতে আমরা এই চারজন ছিলাম ঘাতক। বক্তব্যের ফাঁকে সুলতান ডাক্তারকে চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। ডাক্তার তাকে ঔষধ খাইয়ে দেন। রক্তক্ষরণ বন্ধ করার চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। জখমীকে তিনি সান্ত্বনা দিয়ে বললেন- ভয় নেই, ঠিক হয়ে যাবে।

জখমী তার মনের সব গোপন কথা বলে যায় অনর্গল। ক্ষমতাচ্যুত ফাতেমী খেলাফত এবং হাশীশীদের মুখোশ উন্মোচন করে দেয় সে। ফাতেমীরা খৃস্টানদের থেকে কি কি সাহায্য গ্রহণ করেছে এবং করে যাচ্ছে, তার বিবরণ প্রদান করে।

দীর্ঘ সময় ব্যয় করে ডাক্তার তার জখমে পট্টি বাঁধার কাজ সম্পন্ন করেন। তবে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর মমতা-ই হল অসহায় জখমীর আসল চিকিৎসা।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী লাশগুলো বাইরে ফেলে দেয়ার নির্দেশ দেন। আলী বিন সুফিয়ান জখমী সম্পর্কে বলেন, একে নিয়ে তুমি কায়রো চলে যাও এবং এর স্বীকারোক্তি মোতাবেক অভিযান চালাও।

অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছিল জখমী। তন্মধ্যে কিছু ছিল এতই ভয়ংকর যে, সেগুলোর অনুসন্ধান কেবল আলী বিন সুফিয়ানের পক্ষেই সম্ভব। জখমীকে উটের পিঠে শুইয়ে নিয়ে কায়রো অভিমুখে রওনা হন আলী বিন সুফিয়ান।

.

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে আক্রমণ পরিচালিত হয়েছিল বেশ কবার। তার সব কটি ঘটনার উল্লেখ ইতিহাসে পাওয়া যায় না। মাত্র দুটি হামলার উল্লেখ পাওয়া যায়। যার একটি হল এই। অপরটির বিবরণ নিম্নরূপ

একবার এক ফেদায়ী ঘাতক সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর উপর এমনিভাবে শায়িত অবস্থায় খঞ্জর দ্বারা আক্রমণ করেছিল। খঞ্জর তাঁর শিরস্ত্রাণে আঘাত হানে এবং সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী সজাগ হয়ে যান। এই ঘাতক সুলতানের হাতেই মারা যায় এবং সুলতানের দেহরক্ষীদের মধ্যে তার বাহিনীর এমন কজন সদস্য ধরা পড়ে, যারা ছিল ফেদায়ীদের ভাড়া করা ঘাতক।

***

মিসরের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে সুদানের সীমান্তের সাথে সংযুক্ত-শত শত বছরের পুরনো কিছু প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ বিদ্যমান। তৎকালে মিসরের সীমান্ত ছিল ভিন্ন রকম। সুলতান সালাহুদ্দীন বলতেন যে, মিসরের কোন সীমান্ত নেই। সুদানীরা একটি কাল্পনিক সীমান্ত স্থির করে রেখেছিল মাত্র।

প্রাসাদগুলোর আশপাশের এলাকা অতি দুর্গম। মনে হচ্ছে ফেরাউনদের যুগে এসব এলাকা ছিল সবুজ-শ্যামল। ছিল পানির ঝরণা, ঝিল, সুগভীর দুটি নদী, বালুকারময় মরুপ্রান্তর ও বালিমাটির টিলা। কোন টিলা সুবিশাল প্রাসাদের স্তম্ভের ন্যায় চলে গেছে উপরে-অনেক দূরে। কোনটি দাঁড়িয়ে আছে দেয়ালের ন্যায়। যেখানেই সমতল ভূমি, সেখানেই বালি। লক্ষণে মনে হয়, এলাকার স্থানে স্থানে পানি ছিল। ছিল গাছপালা-তরুলতা। অধিবাসীরা চাষাবাদ করত, ফসল উৎপাদন করত। অন্তত চল্লিশ মাইল দীর্ঘ এবং দশ-বারো মাইল প্রস্থের এই অঞ্চলে এক সময় মানুষের বসবাস ছিল। অধিবাসীরা অধিকাংশই ছিল মুসলমান। তবে অদ্ভুত ধরনের বিশ্বাস লালন করত তারা।

ফেরআউনী আমলের এই প্রাসাদ-ধ্বংসাবশেষগুলোকে মানুষ প্রচণ্ড ভয় করে। আশপাশের এলাকাগুলোও এমন যে, দেখামাত্র মানুষের গা শিউরে উঠে। ভুলেও এখানে পা রাখে না কেউ। মানুষের বিশ্বাস, এ অঞ্চলে ফেরাউনদের বহগুলো বসবাস করে। দিনের বেলা এরা পশুর রূপ ধারণ করে যোরাফেরা করে। কখনো এদেরকে উটের উপর সওয়ার সিপাহীর বেশে দেখা যায়। আবার কখনো রূপসী নারীর আকৃতিতে দৃষ্টিগোচর হয়। রাতের বেলা সেখান থেকে ভয়ংকর ধরনের শব্দ শুনতে পাওয়া যায়।

.

বছর কয়েক হল, এ ধ্বংসাবশেষগুলো মানুষের কৌতূহলের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছে। তার আগে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী যখন অত্র অঞ্চলে নতুন সেনাভর্তির অভিযান শুরু করেছিলেন, তখন থেকে তাঁর সৈন্যরা এ এলাকার আশপাশ দিয়ে ঘোরাফেরা করতে শুরু করে। এলাকার অধিবাসীরা তাদের হুশিয়ার করে দিয়েছিল, যেন তারা টিলার অভ্যন্তরে প্রবেশ না করে। স্থানীয় লোকেরা তাদেরকে রহস্যময় শব্দ, ভয়ংকর বস্তু ও বদহদের নানা কাহিনী শোনায়।

এ এলাকা থেকে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী অনেক নতুন সৈন্য পেয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে তাদের চিন্তা-চেতনা পাল্টে যায়। সীমান্ত প্রহরীরা রিপোর্ট দিয়েছিল যে, তাদের টহলদার সান্ত্রীরা পর্যন্ত কখনো অত্র এলাকায় প্রবেশ করত না এবং কখনো কাউকে সেদিকে যেতে দেখেনি। কিন্তু এখন অনেকেই ভেতরে যাওয়া আসা করছে এবং যারা যাচ্ছে, ফিরে আসার পর তাদের চেহারায় কোন ভীতির ছাপ পরিলক্ষিত হয় না। এখন শোনা যাচ্ছে, প্রতি বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত ধ্বংসাবশেষের অভ্যন্তরে মেলা বসে। তারপর একটি ঘটনা এই ঘটে যে, সীমান্তরক্ষীদের চার পাঁচজন সিপাহী হঠাৎ একদিন লাপাত্তা হয়ে যায়। তাদের ব্যাপারে রিপোর্ট দেয়া হল যে, তারা পালিয়ে গেছে।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী একদিকে যেমন শত্রুর দেশে নিজের গুপ্তচর ঢুকিয়ে রেখেছিলেন, তেমনি নিজের দেশেও গুপ্তচরদের জাল বিছিয়ে রেখেছিলেন। অমুসলিম ঐতিহাসিকগণ বিশেষভাবে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর প্রশংসা করেছেন যে, তিনি গুপ্তচরবৃত্তি ও কমান্ডো স্টাইলের যুদ্ধকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রশিক্ষণের নতুন পন্থা উদ্ভাবন করেছিলেন এবং প্রমাণ করেছিলেন যে, মাত্র দশজন সৈন্য দ্বারা এক হাজার সৈন্যের কাজ করা সম্ভব। তবে এটা সত্য কথা যে, মুসলমান হওয়ার কারণে ইউরোপীয় ঐতিহাসিকগণ সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর এই বিদ্যাকে ইতিহাসের পাতায় যতটুকু স্থান দেয়া উচিত ছিল, ততটুকু দেয়নি। অবশ্য তত্ত্বালের ঐতিহাসিকগণের রচনা থেকে জানা যায় যে, ইসলামের এই মহান প্রহরী ইন্টেলিজেন্স এবং গেরিলা ও কমান্ডো অপারেশনে কী পরিমাণ অভিজ্ঞ ছিলেন। দেশের অভ্যন্তরে তার গোয়েন্দা বাহিনী পরতে পরতে দৃষ্টি রাখত এবং সেনা হেডকোয়ার্টারে রিপোর্ট সরবরাহ করত। তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ হল, মিসরের দূর-দূরান্তের এমন সব এলাকার তৎপরতার সংবাদও কেন্দ্রে পৌঁছে যেত, যেসব এলাকা সম্পর্কে বলা হতো যে, স্বয়ং খোদাও এ এলাকার কথা ভুলে গেছেন। অবশ্য সংবাদদাতারা সেসব এলাকার জনসাধারণের শুধু বাহ্যিক পরিবর্তনই প্রত্যক্ষ করতে সক্ষম হয়েছে এবং তার রিপোর্ট কেন্দ্রে পৌঁছিয়েছে। অভ্যন্তরে কী সব ঘটনা ঘটেছিল, তার সন্ধান তারা লাভ করতে সক্ষম হয়নি। এতটুকু তথ্য লাভ করার পর এক পর্যায়ে নিহত কিংবা নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল দুজন গুপ্তচর।

এবার সেখানকার জনসাধারণ শুধু টিলার ভয়ংকর এলাকার ভেতরে প্রবেশ করাই শুরু করেনি বরং ফেরাউনদের পুরোনো এমন সব প্রাসাদের অভ্যন্তরেও ঢুকতে আরম্ভ করে দিয়েছে, এক সময়ে যেখানে যাওয়ার কথা কল্পনা করলেও তাদের গা শিউরে উঠত।

সম্প্রতি এই গমনাগমনের ধারা এভাবে শুরু হয় যে, এক গ্রামে একজন উষ্ট্রারোহীর আগমন ঘটে। নবাগত সেই লোকটি মিসরীয় মুসলমান। উটটি তার উন্নত জাতের এবং সুস্থ-সবল। এলাকাবাসীদের সমবেত করে লোকটি একটি কাহিনী শোনায়

আমি একজন গরীব মানুষ। দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত হয়ে কোন উপায় না দেখে এক পর্যায়ে ডাকাতি করার উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ি। আমার কোন বাহন ছিল না। লাগাতার কয়েকদিন পায়ে হেঁটে বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে-ফিরেও ডাকাতি করার জন্য কোন শিকার পাইনি। অবশেষে ঐ পার্বত্য এলাকায় যেখানে কেউ যাওয়া-আসা করে না-প্রবেশ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। কয়েকদিন পর্যন্ত পেটে খাবার পড়েনি। আমি শক্তিহীন হয়ে পড়ি। উপায়ন্তর না দেখে আমি আকাশ পানে হাত তুলে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করি। তৎক্ষণাৎ আমি গুঞ্জনের ন্যায় একটি শব্দ শুনতে পাই। কে যেন বলছে, তোমার ভাগ্য ভালো যে তুমি এখনো পাপ করনি; পাপের সংকল্প করেছ মাত্র। তুমি যদি কাউকে লুট করে এখানে আসতে, তাহলে এতক্ষণে তোমার গায়ের গোশতগুলো খসে পড়ত এবং তোমার দেহটা কংকালে পরিণত হয়ে যেত। শয়তানের লেলিয়ে দেয়া হিংস্র প্রাণীরা তোমার খসে পড়া গোশত ভক্ষণ করত।

আওয়াজ শুনে আমি চৈতন্য হারিয়ে ফেলি। অনুভব করলাম, কে যেন আমাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। চোখ খুলে দেখলাম, আমি এক স্থানে বসে আছি। আমার সম্মুখে শুভ্র শশ্রুমন্ডিত এক বুজুর্গ। দুধের মত সাদা তার গায়ের রং। নুরানী চেহারা। আমি বুঝে ফেললাম, ঐ যে আওয়াজ শুনলাম, তা এই বুজুর্গেরই কণ্ঠস্বর। আমার বাকশক্তি হারিয়ে যায়। আমি কাঁপতে শুরু করি। বুজুর্গ লোকটি আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ভয় পেও না। ঐ যে মানুষগুলো যারা এখানে আসতে ভয় করে-ওরা কপালপোড়া। শয়তানই ওদেরকে এখানে আসতে দেয় না। তুমি যাও, ওদেরকে বল, এখন আর এখানে ফেরাউনদের প্রভূত্ব চলে না। এটি হযরত মূসা (আঃ) এর সাম্রাজ্য। শেষ জমানায় হযরত ঈসা (আঃ) আকাশ থেকে এখানে অবতরণ করবেন। তখন ইসলামের আলোতে এসব অনাবাদী এলাকা আলোকিত হবে, যে আলোতে উদ্ভাসিত হবে সমগ্র পৃথিবী। তুমি যাও, লোকদেরকে আমার পয়গাম শুনিয়ে দাও, তাদেরকে এখানে নিয়ে আস।

আগন্তুক বলল, আমি উঠে দাঁড়াতে পারছিলাম না। অনাহারে শরীর শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। বুজুর্গ বললেন, তুমি উঠে দাঁড়াও। পঞ্চাশ কদম উত্তর দিকে যাও। খবরদার পিছনে ফিরে তাকাবে না। ভয় পাবে না। মানুষের কাছে আমার পয়গাম অবশ্যই পৌঁছিয়ে দিবে। অন্যথায় তোমার বিরাট ক্ষতি হবে বলে দিচ্ছি। পঞ্চাশ কদম অতিক্রম করার পর একটি উট বসে আছে দেখবে। তার সঙ্গে খাবার আছে, পানি আছে। সঙ্গে তার যা কিছু পাবে, সবই তোমার।

আগন্তক গ্রামবাসীদের জানায়

এবার আমি উঠে দাঁড়াতে সক্ষম হই। দেহে শক্তি ফিরে আসে। আমি ভয় পাচ্ছিলাম, এটি কোন ফেরাউনের কদরূহ কিনা। আমি পেছনের দিকে তাকালাম না। ঠিক পঞ্চাশ কদম সম্মুখে আসার পর একটি উট দেখতে পেলাম। সঙ্গে তার খাদ্য পানীয় বাঁধা। আমি সেই খাবারগুলো খেলাম ও পানি পান করলাম। এবার আমার– শরীরের এত শক্তি জাগে যে, এর আগে কখনো আমি এমন শক্তি পাইনি।

আগন্তুক জনসাধারণকে একটি থলে খুলে দেখায়, যাতে কতগুলো সোনার আশরাফী। এ থলেটি উটের সঙ্গে বাঁধা ছিল। লোকটি সেই উটের পিঠে চড়ে গ্রামে এসে উপস্থিত হয়।

আগন্তুক গ্রামবাসীদের শুভ্র শশ্রুমন্ডিত বুজুর্গের পয়গাম শুনিয়ে উট হাঁকিয়ে ফিরে যায়।

আগন্তুকের কাহিনী শুনে গ্রামবাসীদের মনে ভয়ংকর সেই পার্বত্য এলাকায় প্রবেশ করার তীব্র আকাংখা জাগ্রত হয়। কিন্তু এলাকার প্রবীণ লোকেরা বলে যে, এই অপরিচিত আগন্তুক মানুষ নয় বরং এ প্রেত-পুরীরই ভয়ানক কোন বাসিন্দা।

.

মানবস্বভাবের একটি দুর্বলতা এই যে, মানুষ গুপ্ত বিষয়কে জানার এবং গোপন রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা করে, তাতে যত নিষেধাজ্ঞাই থাকুক না কেন। যেসব দেহে যৌবনের খুন প্রবাহমান, তারা বড় বড় ঝুঁকিও বরণ করে নিতে কুণ্ঠিত হয় না। গ্রামের যুবকরা সংকল্পবদ্ধ হয় যে, তারা ওখানে যাবেই। স্বর্ণমুদ্রার আকর্ষণ বড় কঠিন, যা থেকে মানুষ নিজেকে রক্ষা করতে পারে না।

চল্লিশ মাইল দীর্ঘ দশ মাইল প্রস্থ এই ভূখন্ডে যতগুলো গ্রাম আছে, সব কটি গ্রামের অধিবাসীরা শুনতে পেয়েছে, অজ্ঞাত পরিচয় এক আগন্তুক এমন এমন কাহিনী শুনিয়ে গেছে। শুনে কেউ বিশ্বাস করল, কেউ করল না। আবার কেউ বিশ্বাস অবিশ্বাসের মাঝে দোল খেতে লাগল। কিন্তু সেদিকে যেতে ভয় পাচ্ছে সবাই। সাহস করে যারা গেল, তারাও রহস্যময় সেই পার্বত্য অঞ্চলকে দূরে থেকে দেখেই ফিরে এল। কিছুদিন পর আরো দুজন উষ্ট্রারোহী যুবক এসে সমগ্র এলাকা ঘুরে যায়। তারাও এলাকবাসীকে একই রকম কাহিনী শুনিয়ে যায়। এক বুজুর্গ ব্যক্তি তাদেরও বলে দেন যে, তোমরা পাড়ায় গিয়ে সবাইকে আমার পয়গাম পৌঁছিয়ে দাও, যেন তারা ফেরাউনী আমলের ধ্বংসাবশেষগুলোকে ভয় না করে।

তারপর এলাকাবাসীদের মধ্যে এ জাতীয় কাহিনী একের পর এক ছড়াতে থাকে। ধীরে ধীরে মানুষের মন থেকে ভীতি ও শংকা কেটে যেতে শুরু করে। এক পর্যায়ে এলাকাবাসী কৌতূহলী হয়ে উঠে এবং পর্বতসমূহের আশপাশে ঘোরাফেরা করতে আরম্ভ করে দেয়। অনেককে তারা ভেতরে যাওয়া-আসা করতে দেখতে পায়। তারা জানায় যে, ভেতরে একজন বুজুর্গ লোক আছেন, তিনি গায়েবের অবস্থা ও আকাশের খবর বলে দিতে পারেন। এমনও বলাবলি শুরু হয় যে, তিনিই ইমাম মাহদী। কেউ বলে, তিনি হযরত মূসা (আঃ)। আবার কারো মতে ঈসা (আঃ)। তবে সকলেই এ ব্যাপারে একমত যে, লোকটি আল্লাহ-প্রেরিত একজন মহামানব অবশ্যই। তিনি পাপিষ্ঠদের সাক্ষাৎ দেন না। তার নিকট যেতে হলে নিয়ত পরিচ্ছন্ন থাকতে হয়। এমনও বলা হচ্ছে যে, তিনি মৃতকে জীবিত করতে পারেন।

এসব তেলেসমাতি ও রহস্যময় কাহিনী শোনার পর এবার মানুষ ভেতরে যাওয়া আসা শুরু করে। প্রথমবারের মত তারা নিকট থেকে ফেরাউনী প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ প্রত্যক্ষ করে, যেগুলোকে এতদিন তারা ভয় করত। তারা প্রাসাদের ভেতরে প্রবেশ করে। অসংখ্য কক্ষ, আঁকাবাঁকা সরু পথ। একটি কক্ষ বিশাল-বিস্তৃত। ছাদটা অনেক উঁচু। আশপাশের পরিবেশ ভয়ানক। কিন্তু খোশবুতে মৌ মৌ করছে এলাকাটা। কক্ষের ভেতর থেকে কয়েকটি সিঁড়ি চলে গেছে নীচের দিকে।

এ প্রাসাদ সেই ফেরাউনদের, যারা নিজেদেরকে খোদা বলে দাবী করত। ঘনিষ্ঠজন ব্যতীত তাদেরকে কেউ চোখে দেখত না। তারা জনসধারণকে এই প্রাসাদে সমবেত করত এবং নিজেদের শুধু কণ্ঠস্বর শোনাত- দেখা দিত না কখনো। তাদের কণ্ঠস্বর কতগুলো সুরঙ্গ পথে ভেসে এসে এই প্রাসাদের কক্ষে কক্ষে ছড়িয়ে পড়ত। বক্তা অবস্থান করত সুরঙ্গের অপর প্রান্তে, যা সাধারণ মানুষ বুঝতে পারতো না। এই অদৃশ্য কণ্ঠস্বরকে তারা খোদার আওয়াজ মনে করত। প্রাসাদের বড় বড় কক্ষগুলোতে আলোর জন্য এমন ব্যবস্থা থাকত যে, দীপ-বাতি দেখা যেত না, কিন্তু কক্ষগুলো থাকত আলোকোজ্জ্বল। স্বচ্ছ কাঁচের মত চকমকে এক প্রকার ধাতুর তৈরী চাদর ব্যবহার করা হত। তার ভেতরে লুকায়িত থাকত ছোট ছোট বাতি। সেই বাতির আলো প্রতিবিম্বিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ত কক্ষময়; কিন্তু সাধারণ মানুষ বিষয়টি বুঝত না।

এসব তো হল শত শত বছর আগের কথা। এখন সালাহুদ্দীন আইউবীর আমলেও এই প্রাসাদে পুনরায় সেই আওয়াজ গুঞ্জরিত হতে শুরু করে, যাকে এককালে মানুষ খোদার কণ্ঠস্বর বলে বিশ্বাস করত। স্বল্প সময়ের মধ্যে মানুষের হৃদয় থেকে এই পরিত্যক্ত প্রাসাদের ভয়-ভীতি দূরীভূত হয়ে যায়। প্রশস্ত অন্ধকার সুরঙ্গ পথ অতিক্রম করে তারা প্রাসাদের বড় কক্ষে পৌঁছে যায়। আলোয় ঝলমল করছে গোটা কক্ষ। কিন্তু কোন বাতি নেই। একটি কণ্ঠস্বর ভেসে বেড়াচ্ছে কক্ষময়। কে যেন বলছে

আমি তোমাদেরকে অন্ধকার থেকে মুক্তি দিয়ে আলোর পথে এনেছি। এটি তুর পাহাড়ের আলো। এই আলোকে তোমরা হৃদয়ে স্থান করে দাও। ফেরাউনের প্রেতাত্মারা মরে গেছে। এখন এখানে বিরাজ করছে মূসার নূর। ঈসা এসে এ নূরকে আরো আলোকময় করবেন। তোমরা আল্লাহকে স্মরণ কর, কালেমা পাঠ কর।

বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়ে জনতা। বিস্ফারিত নয়নে একজন তাকায় অপরজনের দিকে। ইল্লাল্লাহর জিকিরে মুখরিত করে তোলে গোটা কক্ষ।

এই বক্তব্যে যদি নবী হযরত মূসা, হযরত ঈসা (আঃ) ও কালেমা তায়্যেবার উল্লেখ না থাকত, তাহলে সাধারণ মানুষ এতে প্রভাবিত হত না। তারা ছিল মুসলমান। ইসলামের নাম ব্যবহার করার কারণেই এই অদৃশ্য বাণী তাদের হৃদয়ে রেখাপাত করতে সক্ষম হয়েছিল। পরক্ষণে পুনরায় শব্দ ভেসে আসল আল্লাহ তার রাসূলকে রেসালাত দান করেছিলেন হেরা গুহার অন্ধকারে, তোমরা এই গুহার অন্ধকারে আল্লাহর নুর দেখতে পাবে।

জনতার মস্তক অবনমিত হয়ে আসে এবং এই বাণীও তাদের হৃদয়ে গেঁথে যায়। কিন্তু যে মহান সত্তার কণ্ঠস্বর, যিনি অসহায় পথিকদের উট-ঘোড়া, খাবার-পানি ও স্বর্ণমুদ্রা দান করেন, মৃতকে জীবন দান করেন, তাকে এক নজর দেখার জন্য মানুষ উদগ্রীব হয়ে উঠে। তাদের উৎকণ্ঠা দিন দিন বাড়তেই থাকে। যখনই তারা ঘরে ফিরত, তাদের স্ত্রীরা জানাত আজ অপরিচিত একজন লোক এসেছিল। লোকটা প্রাসাদের দরবেশের কারামত শুনিয়ে গেল এবং বলল, সে নাকি দরবেশের সাথে সাক্ষৎ করে এসেছে।

একদিন জনসাধারণ এলাকার সবচেয়ে বড় গ্রামটির মসজিদের ইমামের নিকট এসব ঘটনার তাৎপর্য জানতে চায় যে, হুজুর! বিষয়টা আসলে কী? জবাবে ইমাম বললেন, তিনি একজন মহান ব্যক্তি। নেক লোকদের ছাড়া কাউকে সাক্ষাৎ দেন না, কারো নিকট ধরা দেন না। আর নেক মানুষ তারা, যারা খুন-খারাবী করে না। আপোস ও শান্তির জীবনযাপন করে। কাউকে মারেও না, নিজেও মরতে যায় না। তোমরা যে দরবেশের কথা জানতে চাইছ, তিনি হযরত ঈসা (আঃ)-এর পয়গাম নিয়ে আবির্ভূত হয়েছেন। তার পয়গামে যুদ্ধ নেই, আছে প্রেম আর ভালোবাসা। তার আনীত পয়গামের একটি উপদেশ হল, কাউকে জখমী কর না বরং জখমীর ক্ষতস্থানে পট্টি বেঁধে দাও। তোমরা যদি তার নীতির অনুসরণ করে চল, তাহলে তিনি তোমাদের অবস্থার পরিবর্তন করে দেবেন। তোমরা সুখময় জীবন লাভ করবে।

একজন সম্মানিত ইমাম যখন দরবেশ ও তার বক্তব্য সঠিক বলে রায় দিলেন, তখন আর জনমনে সন্দেহের অবকাশ রইল না। এবার তারা ঠাটপাট প্রাসাদে যাওয়া আসা করতে শুরু করল।

কিছুদিন পর ঘোষণা হল, প্রতি বৃহস্পতিবার সারাদিন প্রাসাদের দ্বার সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে এবং সন্ধ্যায় মেলা বসবে। সেইদিন থেকে প্রাসাদের যাওয়ার জন্য বৃহস্পতিবার দিনটি নির্ধারিত হয়ে গেল এবং সেই সাথে মহিলারা যাওয়ার অনুমতি পেয়ে গেল। এখন নিজের ইচ্ছায় আর কেউ প্রাসাদে যেতে পারছে না। বৃহস্পতিবার এলেই এলাকা সরগরম হয়ে উঠে। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ উট, ঘোড়া ও খচ্চরে চড়ে এবং পায়ে হেঁটে প্রাসাদ অভিমুখে ছুটতে শুরু করে। ভেতরের স্পর্শকাতর জগতে বিপ্লব এসে যায়। তথায় মানুষের দৃষ্টিতে এখন পাপ-পুণ্য ও আলো-আঁধারের ধারণা এমনভাবে উপস্থাপিত হতে শুরু করে যে, মানুষের কাছে তাকে একটি শরীরী বস্তু হিসেবে দেখতে পাচ্ছে এবং বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়ছে। কারো মনে উল্টো-সিধে কোন প্রশ্ন নেই, নেই কোন সংশয়-সন্দেহ।

.

পশ্চিম আকাশে সূর্য অস্ত যাওয়া মাত্র সেই অন্ধকার সুরঙ্গপথের মুখ খুলে যায়। সুরঙ্গের প্রবেশ দ্বারে দাঁড়িয়ে থাকে কয়েকজন লোক। তাদের পার্শ্বে থাকে পিকৃত খেজুরছড়া। এগুলো জনসাধারণের দেয়া নজরানা। খেজুরের স্কুপের পার্শ্বেই থাকে মশকভর্তি পানি আর গ্লাস। সন্ধ্যায় যখন দর্শনার্থীরা ভেতরে প্রবেশ করার অনুমতি লাভ করে, তখন আগে তাদের প্রত্যেককে তিনটি করে খেজুর আর এক গ্লাস পানি খাইয়ে দেয়া হয়। তারপর তারা একজন একজন করে ভেতরে প্রবেশ করতে শুরু করে। আঁকাবাকা অন্ধকার সুরঙ্গপথ অতিক্রম করে আলো-ঝলমল বিশাল হলরুমে প্রবেশ করেই তারা শুনতে পায় একটি বাণী

তোমরা কালেমা তায়্যেবা পাঠ কর। আল্লাহকে স্মরণ কর। হযরত মূসা (আঃ) আগমন করেছেন। ঈসা (আঃ) এসে পড়বেন। অন্তর থেকে পাপ-প্রবণতা ও শত্রুতা ঝেড়ে ফেল। লড়াই-ঝগড়া ত্যাগ কর। আর জান্নাতের প্রলোভন দেখিয়ে যাদেরকে যুদ্ধে নামান হয়েছিল, তাদের পরিণতি দেখ।—

এ ঘোষণা শেষ হওয়া মাত্র উপস্থিত লোকদের চোখে অতি প্রখর একটি আলো এসে পতিত হয়। তাদের সকলকে একদিকে মুখ করিয়ে দাঁড় করানো হয়। ধীরে ধীরে চোখের আলো তাদের ক্ষীণ হয়ে আসে। তারপর আলো কখনো প্রখর কখনো ক্ষীণ হতে থাকে এবং লোকদের সম্মুখের দেয়ালে তারকার চমক পরিলক্ষিত হতে শুরু করে। তারকাগুলো কাঁপতে থাকে এবং অতি ভয়ংকর আকৃতির কিছু মানুষের গমনাগমন চোখে পড়তে আরম্ভ করে। আবার ভেসে আসে একটি কণ্ঠস্বর

এরা তোমাদেরই ন্যায় যুবক ও সুশ্রী ছিল। কিন্তু এরা খোদার পয়গাম মান্য করেনি। এরা কোমরে তরবারী ঝুলিয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে এদেরই ন্যায় সুদর্শন যুবকদের হত্যা করেছিল। এদের বলা হয়েছিল, তোমরা লড়াই কর। যুদ্ধ করতে করতে যদি মারা যাও, তাহলে শহীদ হবে এবং জান্নাতে চলে যাবে। এখন তোমরা এদের পরিণতি দেখ। খোদা এদের আকৃতিকে শয়তানের আকৃতিতে রূপান্তরিত করে পথে ছেড়ে দিয়েছেন।

এই কণ্ঠস্বরের সাথে শোনা যেত মেঘের গর্জন আর দেখা যেত বিজলির চমক। এমন কিছু আওয়াজও ভেসে আসত, যা হিংস্র কোন প্রাণীর শব্দ বলে মনে হতো। আলো এত প্রখর হয়ে উঠত যে, মানুষের চোখ ধাধিয়ে যেত। তারপর লম্বা লম্বা দাঁতবিশিষ্ট হিংস্র প্রাণীরা ডানে-বাঁয়ে ছুটাছুটি শুরু করে দিত। এরাও মূলত মানুষ। কিন্তু এদের আকৃতি ব্যাঘের ন্যায় ভয়ংকর। তারা বাহুর উপর দুটি করে উলঙ্গ মেয়ে তুলে রেখেছে। মেয়েগুলো অত্যন্ত সুন্দরী ও যুবতী। ছটফট করছে তারা। মেঘের গর্জন ধীরে ধীরে আরো প্রচণ্ড হয়ে উঠে। আবার ভেসে আসে কণ্ঠস্বর- নিজের রূপ লাবণ্যে এদের বড় গৌরব ছিল। কিন্তু খোদার রূপকে এরা কলংকিত করেছিল।

তারপর জনতার সম্মুখ দিয়ে অতিক্রম করে কিছু সুদর্শন পুরুষ ও নারী। হাসিমুখে উফুল্লচিত্তে তারা অতিক্রম করে। ঘোষণা হয়- এরা নেক ও পবিত্র মানুষ। এরা কখনো যুদ্ধে লিপ্ত হয়নি। যুদ্ধ-বিগ্রহকে কখনো সমর্থনও করেনি। এরা আপাদমস্তক প্রেম ও শান্তির প্রতিমূর্তি।

তারপর দর্শনার্থীদের নিয়ে যাওয়া হতো একটি পাতাল কক্ষে। সেখানে একদিকে পড়ে আছে অসংখ্য মানব কংকাল, অপরদিকে হেসে-খেলে ফুর্তি করে ছুটাছুটি করছে বেশকিছু রূপসী তরুণী। খানিক পরপর ভেসে আসছে একটি কণ্ঠস্বর- হযরত ঈসা (আঃ) এর আবির্ভাবের সময় ঘনিয়ে এসেছে। যুদ্ধ-বিগ্রহ ও খুন-খারাবী মন থেকে ঝেড়ে ফেল। অন্যথায় তোমাদের পরিণতি হবে ভয়াবহ।

পাতাল কক্ষের একটি দরজা দিয়ে লোকদের বাইরে বের করে দেয়া হয়। বের হওয়ার পর তাদের কাছে মনে হয় যেন তারা ঘুমিয়ে ছিল। ঘুমের মধ্যে অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছে। যেমন ভয়ংকর তেমন প্রীতিকর স্বপ্ন। তারা পুনরায় ভেতরে প্রবেশ করার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠে। কিন্তু আপাতত আর তাদের প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। তারা ঘরে ফিরে যেতে চায় না। প্রাসাদের আশপাশে বসে বসেই রাত কাটিয়ে দেয়। ওখানকার লোকেরা তাদের ভেতরের রহস্যের বিবরণ দেয়। একটি রহস্য হল, প্রাসাদের ভেতরে যার কণ্ঠ শোনা যায়, তিনি খোদার পক্ষ থেকে বার্তা নিয়ে এসেছেন যে, হযরত ঈসা (আঃ) পৃথিবীতে আগমন করছেন এবং খলীফা আল-আজেদও দুনিয়াতে ফিরে এসেছেন।

.

আল-আজেদ ফাতেমী খেলাফতের খলীফা ছিলেন। তার সিংহাসন ছিল মিসরে। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে মিসরকে বাগদাদের খেলাফতে আব্বাসীয়ার অধীন করে দেন। তার অল্প কদিন পরেই আল-আজেদ মৃত্যুবরণ করেন। এটি দুআড়াই বছর আগের ঘটনা। ফাতেমীরা খৃস্টান ও হাশীশীদের সাথে যোগসাজশ করে একটি ষড়যন্ত্র আঁটে। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীকে ক্ষমতাচ্যুত করা এবং মিসরে ফাতেমী খেলাফতের পুনর্বহাল ছিল সেই ষড়যন্ত্রের প্রধান উদ্দেশ্য। সেই ষড়যন্ত্রকে সফল করার লক্ষ্যে মিসর আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছিল সুদানীদের।

প্রাসাদের অদৃশ্য দরবেশের মুরীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে দিন দিন। এলাকাবাসী অদ্রুিত ভক্তে পরিণত হচ্ছে তার। দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকার মানুষদের মধ্যে এ বিশ্বাস বদ্ধমূল হতে শুরু করেছে যে, হযরত ঈসা (আঃ) খলীফা আল-আজেদকে ফেরত পাঠিয়েছেন এবং তিনি নিজেও আসছেন। তারা সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর সেনাবাহিনীতে ভর্তি হওয়ার সংকল্প থেকে তওবা করে ফেলে। এখন তাদের বিশ্বাস, যুদ্ধ-বিগ্রহ পাপের কাজ। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী একজন পাপিষ্ঠ মানুষ। নিজের রাজত্বের বিস্তৃতির জন্য তিনি ধোকা দিয়ে লোকদের ফৌজে ভর্তি করান যে, তোমরা যুদ্ধে মারা গেলে শহীদ হবে এবং সোজা জান্নাতে চলে যাবে।

প্রাসাদের ভেতরের জগত এখন মানুষের উপাসনালয়। আশপাশের পার্বত্য এলাকায় এখন তাবু ফেলে বাসবাস করছে তারা। প্রাসাদের পুণ্যাত্মা দরবেশের সাক্ষাত লাভের জন্য তারা ব্যাকুল-বেকারার। একটি নতুন ফেরকার উদ্ভব হল মিসরের এ অঞ্চলটিতে।

***

যে জখমী হাশীশী সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর উপর সংহারী হামলা করেছিল, আলী বিন সুফিয়ান তাকে কায়রো নিয়ে যান। আলাদা একটি ঘরে থাকতে দেয়া হয় তাকে। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর নির্দেশ মোতাবেক সর্বক্ষণের জন্য একজন ডাক্তার নিযুক্ত করে দেয়া হয় তার জন্য। তার ঘরের দরজায় একজন সান্ত্রী দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। কিন্তু এখনো পালাবার শক্তি ফিরে আসেনি তার।

সীমান্ত এলাকার ফেরাউনী প্রাসাদ সম্পর্কে তথ্য দিয়েছে জখমী। এখান থেকে পরিচালিত হয় খৃস্টানদের ইসলাম ও আইউবী বিরোধী ষড়যন্ত্র। জখমী সুস্থ হলে তার সহযোগিতায় গোয়েন্দা পাঠিয়ে প্রাসাদের ভেতরের খবরাখবর নেন আলী বিন সুফিয়ান। হতে পারে জখমী মিথ্যা তথ্য প্রদান করেছে। কায়রো ফিরে এসেই আলী বিন সুফিয়ান তার নায়েব হাসান ইবনে আবদুল্লাহ ও গিয়াস বিলবিসকে বলে দিয়েছিলেন যে, যে অঞ্চলের মানুষ আমাদের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে চলে গেছে বলে সংবাদ পাওয়া গেছে, সেখানে আপাতত কোন সংবাদদাতা বা গুপ্তচর যেন না পাঠায়। বড় ধরনের রহস্য উদঘাটনের আশা করছেন আলী বিন সুফিয়ান।

জখমীর মনে কেন যেন সন্দেহ জন্মে গেছে যে, সে বাঁচতে পারবে না। অনর্গল সে কাঁদছে আর নিজের গ্রামের নাম উল্লেখ করে করে বলছে, অমুক জায়গা থেকে আমার বোনটাকে এনে দিন, মৃত্যুর আগে আমি ওকে একটু দেখে যাই। বোনের প্রতি অস্বাভাবিক আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছে লোকটি। এ মুহূর্তে বোন ছাড়া আর কোন ভাবনাই নেই যেন তার হৃদয়ে। দুজন দূতকে আলী বিন সুফিয়ান জখমীর গ্রামের ঠিকানা বুঝিয়ে দিয়ে বললেন, যাও এর বোনকে সাথে করে নিয়ে আস। এলাকাটি মিসরের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। সাথে সাথে রওনা হয়ে যায় দূত।

.

শোবক পৌঁছে গেছেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী। প্রাণ-সংহারী হামলার কোন প্রতিক্রিয়া নেই তার চেহারায়। যেন পথে কিছুই ঘটেনি। তার দেহরক্ষী বাহিনী কমান্ডার ও অন্যান্য কর্মকর্তাগণ যেমন পেরেশান তেমনি লজ্জিত। তাদের আশংকা, সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী যে কোন মুহূর্তে আমাদেরকে এ ব্যাপারে জবাবদিহি করবেন। কিন্তু না, এ সম্পর্কে তার কোন কথা নেই। ইঙ্গিতে-আভাসেও কিছু বলছেন না তিনি। শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় কমান্ডের সামরিক কর্মকর্তাদের বললেন, আপনারা নিজ চোখেই তো দেখলেন যে, আমার জীবনের কোন ভরসা নেই। আপনারা আমার সমরকৌশল রপ্ত করার চেষ্টা করুন। গভীর মনোযোগ সহকারে দেখুন, আমি কিভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করছি। আমার অবর্তমানে আপনাদের সামনে অগ্রসর হতে হবে। দুশমন আমাদের বিরুদ্ধে অপর যে গোপন যুদ্ধটি চালু করে ফেলেছে, সেদিকে গভীর নজর রাখুন। নাশকতাকারীদের ধরুন আর শিরচ্ছেদ করতে থাকুন। যারা নিজ দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও দ্বীন-ধর্মের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে, তাদের প্রতি দয়া প্রদর্শনের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী নিজের দেহরক্ষী বাহিনীটির ব্যাপারে একটি শব্দও উচ্চারণ করলেন না। শোবক দুর্গে পৌঁছে প্রথম কথাটি বললেন, কোন গুপ্তচর ফিরে এসেছে কি? তাকে বলা হল, দুজন গুপ্তচর বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নিয়ে এসেছে। সুলতান আইউবী দুজনকে ডেকে পাঠান এবং খৃস্টানদের পরিকল্পনার বিস্তারিত রিপোর্ট গ্রহণ করেন। গুপ্তচরদের নিকট থেকে তিনি খৃস্টানদের পরিকল্পনা সম্পর্কে পূর্ণ অবগতি লাভ করেন। তিনি সুলতান নূরুদ্দীন জঙ্গীর প্রেরিত বাহিনীর সালার, মিসর থেকে আগত সেনা অধিনায়ক এবং দুজনের দুনায়েবকে ডেকে পাঠিয়ে গভীর ভাবনায় হারিয়ে যান।

.

চারদিন পর জখমী হাশীশীর বোন এসে পৌঁছে। সাথে তার চারজন পুরুষ। এরা জখমীর চাচাতো ভাই বলে পরিচয় দেয়া হল। মেয়েটি তরুণী, অতিশয় রূপসী। ভাইয়ের জন্য বোনও ছিল উৎকণ্ঠিত। জখমী হাশীশী তার একমাত্র ভাই। বাবা বেঁচে নেই। মা মারা গেছেন।

তারা জখমীর সাথে সাক্ষাৎ করবে। কিন্তু এর জন্য আলী বিন সুফিয়ানের অনুমতির প্রয়োজন। আলী বিন সুফিয়ান শুধু বোনকে অনুমতি দিলেন। অনুনয়-বিনয় করে পুরুষ চারজন। বলে, আমরা অনেক দূর থেকে বহু কষ্ট করে এসেছি। জখমী ভাইটিকে শুধু এক নজর দেখে যেতে দিন। তার সাথে আমরা কোন কথা বলব না।

আলী বিন সুফিয়ান এই মর্মে তাদের আবেদন মঞ্জুর করলেন যে, তিনি নিজে তাদের সাথে থাকবেন এবং জখমীকে এক নজর দেখার সুযোগ দিয়ে সাথে সাথে বের করে দেবেন।

তখনই তিনি তাদেরকে জখমীর কক্ষে নিয়ে গেলেন। ভাইকে দেখেই বোন তার গায়ের উপর লুটিয়ে পড়ে এবং হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। অন্যদের সম্পর্কে আলী বিন সুফিয়ান জখমীকে বললেন, এদের সাথে হাত মিলাও, এরা এক্ষুণি চলে যাবে। জখমী এক এক করে চারজনের সাথে হাত মিলায়। আলী বিন সুফিয়ান তাদের বের হয়ে যেতে আদেশ করলেন এবং বলে দিলেন, এরপর আর কখনো তোমরা এর সাথে দেখা করার চেষ্টা কর না।

তারা চলে যায়। বোন আলী বিন সুফিয়ানের পা জড়িয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে আবেদন জানায়, ভাইয়ের সেবার জন্য আপনি আমাকে এখানে থাকার অনুমতি দিন। আলী বিন সুফিয়ান একটি নারীর এরূপ করুণ আর্তি প্রত্যাখ্যান করতে পারলেন না। দেহ তল্লাশি নিয়ে তিনি মেয়েটিকে জখমীর নিকট থাকার অনুমতি দিয়ে বেরিয়ে যান।

কক্ষে এখন শুধু ভাই আর বোন। বোন জানতে চায়, তুমি কী করেছিলে? ভাই ঘটনার বিবরণ দেয়। বোন জিজ্ঞেস করে, তা এখন তোমার পরিণতি কী হবে? ভাই জবাব দেয়, আমি আমীরে মেসেরের উপর প্রাণ-সংহারী হামলা করেছি। এ অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। সুলতান যদি করুণা করেন, তবে বড়জোর মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই পেতে পারি। কিন্তু আজীবন তাদের বন্দীশালার অন্ধকার প্রকোষ্ঠে ধুকে ধুকে জীবন কাটাতে হবে অবশ্যই।

তার অর্থ কি এই যে, আমি জীবনে আর কখনো তোমায় দেখতে পাব না? জিজ্ঞেস করে বোন।

না শারজা! তুমি জীবনে আর কখনো আমায় দেখতে পাবে না। আর আমিও না পারব মরতে, না পারব বেঁচে থাকতে। তারা আমাকে যেখানে বন্দী করে রাখবে, তা বড়ই ভয়ংকর জায়গা। বলল জখমী।

শিশুর ন্যায় হাউমাউ করে কেঁধে উঠে বোন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে- আমি তখনও তোমায় বারণ করেছিলাম যে, ওদের চক্করে পড় না। তুমি বলেছিলে, সালাহুদ্দীন আইউবীকে হত্যা করা বৈধ। তুমি লোভে পড়ে গিয়েছিলে। আমার ভবিষ্যত কি হবে, তুমি তারও চিন্তা করলে না। তুমি না থাকলে আমার উপায় কি হত বল তো।

এলোমেলো হয়ে গেছে জখমী ভাইয়ের মস্তিষ্ক। কখনো সে অনুতপ্ত হয়ে বলছে, হায়! কেন আমি ওদের খপ্পরে পড়লাম। কখনো বলছে, সালাহুদ্দীন আইউবী মানুষ নন, আল্লাহর প্রেরিত ফেরেশতা। আমরা চারটি তাগড়া যুবক মিলেও তার দেহে খঞ্জরের একটি আচড়ও বসাতে পারলাম না। একতিল বিষ তার মুখে পুরতে পারলাম না। তিনি একা আমাদের তিনজনকে প্রাণে মেরে ফেললেন আর আমাকেও যমের মুখে তুলে দিলেন।

এই যে মানুষ বলছে, সালাহুদ্দীন আইউবীর ঈমান এত শক্ত যে, কোন পাপিষ্ঠ তাকে হত্যা করতে পারে না, তাতো মিথ্যা নয়। তোমরা চারজনই তো মুসলমান ছিলে। এতটুকু চিন্তাও তোমরা করলে না যে, তিনিও মুসলমান। বলল শারজা।

তিনি আল্লাহর খলীফার সিংহাসনের অবমাননা করেছেন। উল্টো দিকে ঘুরে যায় জখমীর মস্তিষ্ক। উত্তেজিত কণ্ঠে বলে, তুমি জান না যে, আল-আজেদ আল্লাহর প্রেরিত খলীফা ছিলেন।

হয়তো বা ছিলেন অথবা ছিলেন না। আমি শুধু এতটুকু জানি যে, তুমি আমার ভাই আর আমার থেকে তুমি আজীবনের জন্য হারিয়ে যাচ্ছ। তোমার মুক্তির কোন পথ বের করা যায় না কি? বলল শারজা।

হয়ে যাবে হয়তো। আমি এ শর্তেই তাদেরকে আমার সব তথ্য ফাঁস করে দিয়েছি যে, তারা আমাকে ক্ষমা করে দেবেন। কিন্তু আমার অপরাধ এতই মারাত্মক যে, ক্ষমা বোধ হয় পাব না। জবাব দেয় জখমী।

এ সময়ে জখমীর ঘুমিয়ে পড়ার কথা। এত কথা বলা ঠিক হচ্ছে না তার। পেটের জখম খুলে যাওয়ার আশংকা প্রবল। কিন্তু একনাগাড়ে বলেই যাচ্ছে সে। কাঁদছে তার বোন। হঠাৎ তার পেটের জখমে ব্যথা শুরু হয়ে যায়। অস্থির হয়ে উঠে সে। বোনকে বলে, শারজা! তুমি বাইরে যাও। কাউকে পেলে বল, ডাক্তার নিয়ে আসতে। আমি মরে যাচ্ছি।

এক দৌড়ে বেরিয়ে পড়ে শারজা। প্রহরী দাঁড়িয়ে আছে বাইরে। প্রহরীকে ভাইয়ের অবস্থা জানায়। প্রহরী শারজাকে ডাক্তারের ঘরটি দেখিয়ে দেয়। ডাক্তারের প্রতি নির্দেশ ছিল, দিন হোক রাত হোক জখমীকে বাঁচিয়ে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করতে হবে। শাহী ডাক্তার তিনি।

প্রহরীর দেখিয়ে দেয়া পথ ধরে ছুটে যায় শারজা। পৌঁছে যায় ডাক্তারের ঘরে। ডাক্তারকে ভাইয়ের অবস্থা জানায়। সংবাদ পাওয়া মাত্র ছুটে আসেন ডাক্তার।

রক্তে লাল হয়ে গেছে জখমীর পেটের পট্টি। ডাক্তার সাথে সাথে পট্টিটা খুলে ফেলেন। রক্ত বন্ধ করার পাউডার মেখে দীর্ঘ সময় ব্যয় করে আবার পট্টি বেঁধে দেন। রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়ে যায়। ডাক্তার জখমীকে ওষুধ খাইয়ে দেন, যার ক্রিয়ায় ঘুমিয়ে পড়ে সে।

.

শাহী ডাক্তার বয়সে তরুণ। সুদর্শন চেহারা। আকর্ষণীয় দেহ। শারজার চোখ আটকে যায় তার প্রতি। আপন ভাইয়ের প্রতি তার সহানুভূতিতেও সে অতিশয় মুগ্ধ। এত রাতে সংবাদ পাওয়া মাত্র একজন কয়েদী জখমীর চিকিৎসার জন্য কেউ ছুটে আসতে পারে, তা কল্পনাও করতে পারছে না শারজা। কিন্তু ইনি আসলেন এবং পরম গুরুত্ব সহকারে জখমীর চিকিৎসা করলেন। তাই ডাক্তারের প্রতি অভিভূত শারজা। নিদ্রায় জখমীর দুচোখের পাতা বন্ধ হয়ে এলে ডাক্তার নিজের চোখ দুটো বন্ধ করে দুহাত উর্ধে তুলে ধরে মোনাজাত করলেন- মানুষের জীবন-মৃত্যু দু-ই তোমার হাতে হে আমার আল্লাহ! এই হতভাগার প্রতি তুমি রহম কর। একে তুমি মৃত্যুর হাত থেকে– রক্ষা কর। একে সুস্থতা দান কর।

দুচোখ গড়িয়ে অশ্রু নেমে আসে শারজার। ডাক্তারের প্রতি ভক্তিতে-আবেগে আপুত হয়ে পড়ে সে। ডাক্তারের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে তার একটি হাত মুঠি করে ধরে মাথানত করে চুম খায় শারজা। শারজার পরিচয় জানতে চান ডাক্তার। শারজা বলে, আমি আপনার রোগীর বোন। বলেই সে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করে, আপনার অন্তরে কি এতই দয়া যে, আপনি আমার ভাইকে কষ্টের মধ্যে দেখতে চান না। নাকি এ উদ্দেশ্যে তাকে বাঁচিয়ে রাখতে চান যে, সে আপনাকে সব গোপন তথ্য ফাঁস করে দেবে?

এর কাছে কোন তথ্য আছে কি নেই তা নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যথা নেই। আমার কর্তব্য একে বাঁচিয়ে রাখা এবং সম্পূর্ণরূপে সুস্থ করে তোলা। আমার দৃষ্টিতে মুমিন-মুজরিমে কোন পার্থক্য নেই। বললেন ডাক্তার।

আপনি বোধ হয় জানেন না যে, এর অপরাধ কি? জানলে আপনি এর কাটা ঘায়ে পট্টি বাঁধার পরিবর্তে নুন ভরে দিতেন। বলল শারজা।

জানি। তবু আমি একে বাঁচিয়ে রাখার পূর্ণ চেষ্টা করে যাব। জবাব দেন ডাক্তার।

ডাক্তারের প্রতি প্রভাবিত হয়ে পড়ে শারজা। নিজের একান্ত ব্যক্তিগত বৃত্তান্ত শোনাতে শুরু করে সে ডাক্তারকে। শারজা জানায়, শৈশবে তার বাবা-মা দুজনই মারা যান। সে সময়ে তার এই ভাইয়ের বয়স ছিল দশ-এগার বছর। ভাই তাকে লালন-পালন করে। ভাই না থাকলে এতদিন কেউ না কেউ তাকে অপহরণ করে নিয়ে যেত। ভাই তার জীবনটাকে ওয়াকফ করে দিয়েছিল বোনের জন্য।

ডাক্তার মনোযোগ সহকারে শারজার কথা শুনতে থাকেন। এক পর্যায়ে মেয়েটিকে তিনি বাইরে আঙ্গিনায় নিয়ে যান, পাছে জখমীর ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটে। শারজার কথায় ডাক্তার এতই নিমগ্ন হয়ে পড়েন, যেন রাতটা তিনি এখানেই কাটিয়ে দেবেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পর যখন তিনি চলে যেতে উদ্যত হলেন, তখন শারজা তার হাত ধরে বলল, আপনি চলে গেলে আমি ভয় পাব। ডাক্তার বললেন, আমি না তোমায় সাথে করে নিয়ে যেতে পারি, না তোমার সাথে এখানে থাকতে পারি। তবু শারজার খাতিরে তিনি আরো কিছু সময় এখানে অতিবাহিত করে রাত দ্বি-প্রহরের পর ঘরে ফেরেন।

পরদিন ভোরবেলা। সূর্য এখনো উদয় হয়নি। ডাক্তার জখমীকে দেখার জন্য এসে পড়েন। রাতের ন্যায় যত্নের সাথে তিনি রোগীকে নিরীক্ষা করে দেখেন। জখমীকে দুধ পান করান এবং এমন খাবার খাওয়ান, যা শারজা কখনো স্বপ্নেও দেখেনি।

এ সময়ে জখমীর কক্ষে আসেন আলী বিন সুফিয়ান। জখমীকে এক নজর দেখে চলে যান তিনি। কিন্তু ডাক্তার যাননি এখনো। শারজার সাথে কথা বলতে শুরু করেন তিনি। কাটান অনেকক্ষণ।

সেদিন ডাক্তার সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনবার জখমীকে দেখতে আসেন। অথচ তার আসার কথা মাত্র একবার দুপুরে। সন্ধ্যায় যখন ডাক্তার জখমীকে দেখে ফিরে যান, তখন জখমী তার বোনকে বলে, শারজা! মনোযোগ দিয়ে তুমি আমার একটি কথা শোন। আমার জীবন এই ডাক্তারের হাতে। আমি দেখতে পাচ্ছি যে, তোমাকে দেখার পর ডাক্তার চিকিৎসা আগের চেয়ে এখন অনেক ভালো করছেন। আমি মৃত্যুকে বরণ করে নিতে পারি, কিন্তু এত বেশী মূল্য আমি তাকে দেব না, যার আশা সে পোষণ করছে। সন্দেই নয়- আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, আমাকে জীবিত রাখার বিনিময়ে লোকটি তোমার ইজ্জতের নজরানা হাতিয়ে নিতে চায়।

আমি তো তাকে ফেরেশতা মনে করি। এ যাবত এমন কোন আভাস-ইঙ্গিতও পাইনি তার কাছে। তাছাড়া আমি তো আর ছোট্ট খুকী নই যে, চাইলেই সে আমাকে পটাতে পারবে।

 রাতে ডাক্তার আসেন। ঘুমিয়ে পড়েছে জখমী। শারজা জাগ্রত। ডাক্তারের সঙ্গে বারান্দায় চলে যায় শারজা। দুজন কথা বলে দীর্ঘক্ষণ। ডাক্তার বললেন, ওষুধের ক্রিয়ায় তোমার ভাই যে ঘুম ঘুমুচ্ছে, ভোর নাগাদ তার সজাগ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এসো, আমার ঘরে চল। ডাক্তারের প্রস্তাব ফেলে দিতে পারে না শারজা। চলে যায় তার সাথে।

সুশ্রী যুবক ডাক্তার একা থাকেন ঘরে। শারজা অতিশয় বুদ্ধিমতি তরুণী। তার ধারণা, আজ রাতে লোকটা ধরা খেয়ে যাবে নিশ্চয়। কিন্তু তেমনটি হয়নি। সমব্যাথী বন্ধুর ন্যায় শারজার সাথে কথা বলে সময় কাটান ডাক্তার। তার এই স্নেহমাখা পবিত্র আচরণ মুগ্ধ করে তুলে শারজাকে। হঠাৎ শারজা জিজ্ঞেস করে বসে, আমি সুদূর এক মরু অঞ্চলের একটি গরীব মেয়ে। তদুপরি এমন এক আসামীর বোন, যে মিসরের সুলতানের ন্যায় মহান ব্যক্তিকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল। তথাপি তুমি আমার সাথে এমন সদয় আচরণ কেন করছ, যার আমি হকদার নই?

জবাবে শুধু মুচকি একটা হাসি দেন ডাক্তার। শারজা বলে, আমার তো এ ছাড়া আর কোন গুণ নেই যে, আমি একটি যুবতী মেয়ে। আর সম্ভবত কিছুটা রূপ সৌন্দৰ্য্যও আছে।

তোমার মধ্যে আরো এমন একটি গুণ আছে, যা তোমার জানা নেই। আমার একটি বোন ছিল দেখতে ঠিক তোমারই মত। তোমাদের যেমন আর কোন ভাই-বোন নেই, তেমনি আমরাও ভাই-বোন দুজনই ছিলাম। আব্বা-আম্মা মারা গেছেন। তোমার ভাইয়ের ন্যায় আমিও আমার বোনকে লালন-পালন করে বড় করেছিলাম। নিজের জীবনের সব হাসি-আনন্দ আমি তার জন্য ওয়াকফ করে দিয়েছিলাম। এক সময়ে তার অসুখ হল আর মারা গেল আমারই হাতে। রয়ে গেলাম আমি একা। তোমাকে দেখে আমার সেই বোনের কথা মনে পড়ে গেল। মনে হল, আমার বোনকে আমি ফিরে পেয়েছি। তুমি যদি নিজেকে যুবতী ও সুন্দরী মেয়ে ভেবে আমার উপর সন্দেহ করেই থাক, তাহলে ঠিক আছে, তোমার ব্যাপারে আমার আর কোন কৌতূহল রইল না। আমি তোমার ভাইকে নিয়েই ব্যস্ত থাকি। তাকে সুস্থ করে তোলা আমার কর্তব্য।

শারজা যখন ডাক্তারের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে, তখন গভীর রাত। মেয়েটির মনে এখন আর কোন সন্দেহ নেই। পরদিন ডাক্তার জখমীকে দেখতে আসেন। শারজার সাথে কোন কথা বলেন না তিনি। রোগী দেখে যখন কক্ষ থেকে বের হয়ে যেতে উদ্যত হলেন, অমনি শারজা তার সামনে এসে পথ রোধ করে দাঁড়ায়। শারজার ধারণা, ডাক্তার তার সাথে রাগ করেছেন। ডাক্তার বলেন, আমি তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট নই। শারজা খানিকক্ষণ ডাক্তারের মুখপানে ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে পথ ছেড়ে দেয়। ডাক্তার চলে যান।

রাতে জখমীকে ঘুম পাড়িয়ে শারজা আবার হাঁটা দেয় ডাক্তারের বাড়িতে। ডাক্তারের সঙ্গে কাটায় দীর্ঘ সময়। নিজের মনে কিছু জট পড়ে আছে তার। সেগুলো খুলতে চাইছে সে। শারজা ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা বলুন তো, খলীফা কি আল্লাহর প্রেরিত ব্যক্তি নন?

না, খলীফা সাধারণ মানুষ হয়ে থাকেন। আল্লাহর প্রেরিত লোক তো ছিলেন নবী রাসূলগণ। মুহাম্মদ (সাঃ) পর্যন্ত এসে সে ধারা বন্ধ হয়ে গেছে। জবাব দেন ডাক্তার।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী কি আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ? জিজ্ঞেস করে মেয়েটি।

না, তিনিও মানুষ। তবে সাধারণ মানুষ অপেক্ষা তার মর্যাদা বড়। কারণ, তিনি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের মহান পয়গামকে পৃথিবীর আনাচে-কানাচে পৌঁছিয়ে দিতে চাইছেন। ডাক্তার জবাব দেন।

শারজা এরূপ আরো অনেকগুলো প্রশ্ন করে আর ডক্তির জবাব দেন। সবশেষে শারজা বলে, আমার ভাইটি মস্তবড় পাপী। আপনি এই যে কথাগুলো আমায় বললেন, তা যদি আমার ভাইকে জানাতেন, তাহলে হয়তো ভাইটি আমার গুনাহ থেকে বেঁচে থাকতে পারত। কিন্তু তার জীবন তো আর রক্ষা পাবে না।

পাবে। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী যখন বলে দিয়েছেন যে, একে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা কর, তো এর অর্থ হল, তাকে শাস্তি দেয়া হবে না। তোমার ভাইয়ের উচিত, পাপাচার থেকে তাওবা করে নেয়া। আমার পূর্ণ বিশ্বাস যে, তোমার ভাই ক্ষমা পেয়ে যাবে। বললেন ডাক্তার।

কেঁদে ফেলে শারজা। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে, আমি সারাটা জীবন সালাহুদ্দীন আইউবীর খেদমতে কাটিয়ে দেব আর আমার ভাই আপনাদের গোলাম হয়ে থাকবে। বলতে বলতে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে শারজা। আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ডাক্তারের হাত ধরে বলে, আপনি মূল্য যা চাইবেন, আমি আদায় করব। আপনি আমায় আপনার দাসী বানিয়ে নিন, আপত্তি নেই। বিনিময়ে আমার ভাইকে সুস্থ করে তুলুন এবং তাকে শাস্তি থেকে রক্ষা করুন।

কাজের বিনিময় আমরা আল্লাহর নিকট থেকে গ্রহণ করে থাকি- শারজার মাথায় হাত রেখে ডাক্তার বললেন- তুমি নিশ্চিত থাক, ভাইয়ের অপরাধের সাজা বোনকে দেয়া হবে না এবং ভাইয়ের চিকিৎসার মূল্যও বোন থেকে আদায় করা হবে না। সকলের রক্ষণাবেক্ষণকারী আল্লাহ। তিনিই আমার উপর তোমর ইজ্জত সংরক্ষণ এবং ভাইয়ের সুস্থতার দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। দুআ কর, যেন আমি এই আমানতে খেয়ানত না করি। নারীর আহাজারি আল্লাহর আরশকে কাঁপিয়ে তুলতে পারে। তুমি দুআ কর এবং সেই আল্লাহর মহত্বের প্রতি লক্ষ্য রাখ, যার বিরুদ্ধে তোমাদেরকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে।

মেয়েটির হৃদয়জগতে জেঁকে বসেন ডাক্তার। ডাক্তারের যাদুমাখা কথা আর মায়াময় পবিত্র আচরণ চুম্বকের ন্যায় আকৃষ্ট করে তোলে মেয়েটিকে। ডাক্তারের ব্যাপারে মেয়েটির ধারণা ছিল এক রকম আর প্রমাণিত হয়েছে তার সম্পূর্ণ বিপরীত। এমন নির্জন রাতে অতিশয় রূপসী একটি যুবতী যে তার দয়ার উপর নির্ভরশীল, সে অনুভূতিই যেন তার নেই। এভাবে কেটে গেল রাতের অর্ধেকটা। ডাক্তার তাকে বললেন, ওঠ, তোমাকে ওখানে রেখে আসি, তোমার ভাইকেও এক নজর দেখে আসি।

.

ঘর থেকে বের হয় দুজন। দরজায় তালা লাগিয়ে হাঁটা দেয় তারা। অন্ধকার রাত। দুটি ঘরের মধ্যখানে একটি সরু গলিপথ অতিক্রম করতে হবে তাদের। এই গলিপথ অতিক্রম করে সামান্য একটু সামনে এগুলেই জখমী হাশীশীর থাকার ঘর। ঘরের দরজায় সান্ত্রী দণ্ডায়মান।

ডাক্তার ও শারজা গলির মধ্যে ঢুকতে যাবেন, ঠিক এমন সময়ে পেছন থেকে কারা যেন হঠাৎ ঝাঁপটে ধরে দুজনকে। মোটা কাপড় দিয়ে বেঁধে ফেলা হয় দুজনের মুখ। টু-শব্দটি পর্যন্ত করতে পারছে না তারা। ডাক্তার দৈহিক শক্তিতে দুর্বল নন। কিন্তু আগে টের পাননি বলে কোন প্রতিরোধ করতে পারলেন না তিনি। আক্রমণকারীরা পাঁচজন বলে মনে হল তাদের কাছে। ডাক্তার ও শারজাকে তুলে নিয়ে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যায় তারা।

কিছুদূরে দাঁড়িয়ে ছিল কয়েকটি ঘোড়া। ডাক্তারের হাত-পা রশি দ্বারা বেঁধে তুলে নেয়া হয় ঘোড়ার পিঠে। একজন চড়ে বসে তার ঘোড়ায়। একজনের কণ্ঠস্বর শুনতে পান ডাক্তার। লোকটি শারজাকে উদ্দেশ করে বলছে, শব্দ কর না শারজা! তোমার কাজ হয়ে গেছে। ঘোড়ার পিঠে চড়ে বস। এই নাও তোমার ঘোড়া।

শারজার মুখের কাপড় সরিয়ে নেয়া হল। ডাক্তার তার কণ্ঠস্বর শুনতে পান, ওকে ছেড়ে দাও, ওর কোন দোষ নেই। লোকটি বড় ভালো মানুষ।

আমাদের ওকে প্রয়োজন আছে। বলল একজন।

শারজা! চুপচাপ ঘোড়ার পিঠে চড়ে বস। আদেশের সুরে বলল আরেকজন।

উহ্! তুমি? শারজার কণ্ঠস্বর।

সওয়ার হয়ে যাও। সময় নষ্ট কর না। আদেশ দেয় আরেকজন।

শারজা ঘোড়ায় চড়ে বসে। ছুটে চলে কাফেলা। অল্পক্ষণের মধ্যে কায়রো থেকে বেরিয়ে যায় তারা।

***

পরদিন ভোরবেলা। পাহারাদার পরিবর্তনের সময়। নতুন প্রহরী এসে দেখে রাতের প্রহরী নেই। ঘরের ভেতরে উঁকি মেরে দেখে জখমী শুয়ে আছে কম্বল মুড়ি দিয়ে। মুখটাও তার আবৃত। প্রহরী বাইরের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। তার জানা মতে জখমীকে দেখার জন্য এক্ষুণি ডাক্তার এসে পড়বেন। আসবেন আলী বিন সুফিয়ানও। সে এও জানত যে, জখমীর বোন জখমীর সঙ্গে থাকে এবং সে ছাড়া অন্য কারো ভেতরে যাওয়ার অনুমতি নেই। কিন্তু বোনটিকেও দেখা যাচ্ছে না এদিক-ওদিক কোথাও।

সূর্য উদয় হল। আলী বিন সুফিয়ান আসলেন। ডাক্তার এসেছে কিনা জিজ্ঞেস করলেন। প্রহরী, ডাক্তার আসেননি। আমি এসে পূর্বের প্রহরীকেও পাইনি। ভেতরে জখমীর বোনও নেই। শুনে আলী বিন সুফিয়ান মনে করলেন, জখমীর ব্যাথা বোধ হয় বেড়ে গেছে,তাই তার বোন ডাক্তার ডাকতে গেছে।

এই জখমী সালতানাতে ইসলামিয়ার জন্য মিসরের সমান মূল্যবান ব্যক্তি। অপেক্ষা শুধু তার সুস্থ হওয়ার। আলী বিন সুফিয়ানের আশা, তার মাধ্যমে ভয়ংকর এক ষড়যন্ত্রের মুখোশ উন্মোচিত হবে।

দ্রুত ঘরে প্রবেশ করেন আলী বিন সুফিয়ান। জখমীর আপাদমস্তক কম্বল দিয়ে ঢাকা। তাজা রক্তের ঘ্রাণ নাকে আসে আলী বিন সুফিয়ানের। জখমীর মুখের কম্বল সরান তিনি। হঠাৎ আঁৎকে ওঠে সরে যান পেছন দিকে। যেন ওটা মানুষ নয়, অজগর। সেখানে দাঁড়িয়েই বাইরে দণ্ডায়মান প্রহরীকে ডাক দেন তিনি। ছুটে আসে প্রহরী। আলী বিন সুফিয়ান তাকে কম্বলাবৃত লোকটিকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এ লোকটি রাতের প্রহরী না তো? শায়িত লোকটির চেহারা দেখেই আতংকিত হয়ে উঠে প্রহরী। ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলে, হ্যাঁ, তা-ই তো! ইনি এই বিছানায় শুয়ে আছেন কেন হুজুর? জখমী কোথায়?

শুয়ে আছে নয়- বল মরে আছে। বললেন আলী বিন সুফিয়ান।

উপর থেকে কম্বলটা তুলে সরিয়ে ফেললেন আলী বিন সুফিয়ান। রক্তে রঞ্জিত বিছানা। জখমী হাশীশীর নয়- রাতের প্রহরীর লাশ। আলী বিন সুফিয়ান দেখলেন, লাশের হৃদপিন্ডের কাছে খঞ্জরের দুটি জখম। জখমী হাশীশী উধাও। আলী বিন সুফিয়ান কক্ষে, বারান্দায়, বাইরে নিরীক্ষা করে দেখলেন। কোথাও এক ফোঁটা রক্তও চোখে পড়ল না। এতে পরিস্কার বোঝা গেল, প্রহরীকে জীবিত তুলে এনে বিছানায় শুইয়ে রেখে খঞ্জরের আঘাতে খুন করা হয়েছে। এতটুকু ছটফটও করতে দেয়া হয়নি। অন্যথায় এদিক-ওদিক রক্ত ছড়িয়ে থাকত। প্রাণ যাওয়ার পর লাশের উপর কম্বল মুড়িয়ে রাখা হয়েছে। তারপর ঘাতকরা জখমী ও তার বোনকে তুলে নিয়ে গেছে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, জখমীর বোন তার পলায়নে সাহায্য করেছে। সম্ভবত রূপের জালে আটকিয়ে মেয়েটি প্রহরীকে ভেতরে নিয়ে এসেছিল আর ঘাতকদল তাকে হত্যা করেছে।

আলী বিন সুফিয়ান নিজের ভুলের জন্য অনুতপ্ত হলেন যে, চার সঙ্গীকে জখমীর সাথে সাক্ষাৎ করার অনুমতি দেয়া তার ঠিক হয়নি। তারা নিজেদেরকে জখমীর চাচাতো ভাই বলে পরিচয় দিয়েছিল। ভেতরে প্রবেশ করে তারা এখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করে গেছে। জখমীর বোনকেও এখানে থাকার অনুমতি না দেয়াই উচিত ছিল। তা ছাড়া মেয়েটি আসলেই জখমীর বোন কিনা, তাও তিনি যাচাই করে নিশ্চিত হননি।

আলী বিন সুফিয়ানের ন্যায় একজন অভিজ্ঞ গোয়েন্দা প্রধানকে ধোকা দেয়া সহজ ছিল না। কিন্তু এই জখমী ও তার সঙ্গীদের কাছে হেরে গেলেন তিনি। অনুতপ্ত হন নিজের ভুলের জন্য। প্রহরীকে কয়েকটি কথা জিজ্ঞেস করলে সে জানায়, এর আগের রাতে ডিউটি ছিল আমার। আমি মেয়েটিকে ডাক্তারের সঙ্গে তার ঘরে যেতে এবং গভীর রাতে ফিরে আসতে দেখেছি। এতে আলী বিন সুফিয়ানের সন্দেহ হল যে, তার মানে মেয়েটি ডাক্তারকেও রূপের জালে আটকে ফেলেছিল। আলী বিন সুফিয়ান প্রহরীকে বললেন, তুমি দৌড়ে গিয়ে ডাক্তারকে নিয়ে আস।

প্রহরী চলে যাওয়ার পর আলী বিন সুফিয়ান তথ্য অনুসন্ধানে নেমে পড়েন। বাইরে গিয়ে মাটি পরীক্ষা করেন। তিনি মানুষের পায়ের চিহ্ন দেখতে পান। কিন্তু পদচিহ্ন তাকে কোন সাহায্য করতে পারল না। জখমী শহরে পালিয়ে থাকতে পারে না। পথ আছে মাত্র একটি। তা হল, জখমীর বোনকে যে গ্রাম থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল, সেখানে গিয়ে হানা দেয়া। কিন্তু সে তো অনেক দূরের পথ।

প্রহরী ফিরে এসে জানাল, ডাক্তার ঘরে নেই। আলী বিন সুফিয়ান নিজে তার ঘরে গেলেন। চাকর বলল, ডাক্তার গভীর রাতে একটি মেয়ের সাথে ঘর থেকে বের হয়ে গিয়েছিলেন, আর ফিরেননি। মেয়েটি সম্পর্কে জানায়, এর আগেও সে ডাক্তারের সঙ্গে এ ঘরে এসেছিল এবং অনেক রাত পর্যন্ত দুজন বসে বসে কথা বলেছিল। শুনে আলী বিন সুফিয়ান নিশ্চিত হন যে, ডাক্তারও তাহলে জখমীর পলায়ন ঘটনায় জড়িত এবং এর মূলে রয়েছে মেয়েটির রূপের যাদু।

আলী বিন সুফিয়ান তার গুপ্তচরদের ডেকে পাঠান। তারা এলে তিনি তাদের জখমীর ঘটনা অবহিত করেন। তথ্য অনুসন্ধানের জন্য তারা চারদিক ছড়িয়ে পড়ে। একস্থানে তারা অনেকগুলো ঘোড়র পায়ের চিহ্ন দেখতে পায়। স্থানীয় তিন-চার ব্যক্তি বলল, রাতে তারা অনেকগুলো ঘোড়া দৌড়ানোর শব্দ শুনতে পেয়েছিল। ঘোড়র পায়ের চিহ্ন অনুসরণ করে শহরের বাইরে চলে যায় গুপ্তচররা। কিন্তু আর অগ্রসর হওয়া নিরর্থক। রাতে পালিয়ে যাওয়া ঘোড়াগুলোর পায়ের চিহ্ন দেখে পাকড়াও করা কোনমতেই সম্ভব নয়। আসামী পালিয়ে কোন্‌দিকে গেছে, তা-ই শুধু নির্ণয় করতে সক্ষম হয়েছে তারা।

আলী বিন সুফিয়ানের আপাতত করণীয়, মিসরে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর স্থলাভিষিক্ত তকিউদ্দীনকে সংবাদ দেয়া যে, জখমী হাশীশীকে তার সতীর্থরা অপহরণ করে নিয়ে গেছে। এখন আলী বিন সুফিয়ানের ধারণা, জখমী তাকে যে তথ্য দিয়েছিল, তা সঠিক নয়। নিজের জীবন রক্ষা এবং পালাবার একটি সুযোগ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যেই সে এ কৌশল অবলম্বন করেছিল। লোকটি সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী এবং আলী বিন সুফিয়ান দুজনকেই বোকা ঠাওরিয়ে ছড়িল। আলী বিন সুফিয়ান তকিউদ্দীনকে সংবাদ জানানোর জন্য চলে গেলেন।

***

বেলা দ্বি-প্রহর। যে জখমী কয়েদীর দাঁড়াবার শক্তি পর্যন্ত ছিল না, এখন সে পৌঁছে গেছে মিসর থেকে বহু দূরে জনশূন্য বিরান এক এলাকায়। ডাক্তারও আছেন তার সঙ্গে। ডাক্তারের হাত-পা বাঁধা। নির্জীবের মত পড়ে আছেন একটি ঘোড়ার পিঠে। পা দুটি তার ঘোড়ার একদিকে, মাথা ও বাহুদ্বয় অপরদিকে। সারাটা রাত ঘোড়ার পিঠে এভাবেই কেটেছে তার। ভোরের আলো ফোঁটার আগেই ঘোড়া থেমে যায়। পট্টি বেঁধে দেয়া হয় ডাক্তারের দুচোখে। পট্টিটা কে বাঁধল দেখতে পেলেন না তিনি। চোখে পট্টি বাঁধার পর পায়ের বন্ধন খুলে দিয়ে তাকে ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে দেয়া হল। হাত দুটি এখনো বাঁধা। তার পেছনে চড়ে বসে একজন। ঘোড়া চলতে শুরু করে। ডাক্তার অনুভব করছেন যে, তার পেছনে পেছনে আরো কয়েকটি ঘোড়া চলছে এবং আরোহীরা ফিসফিস্ করে কথা বলছে।

ঘোড়া এগিয়ে চলছে আর সূর্য নীচ থেকে উপরে উঠছে। এক পর্যায়ে ডাক্তার আন্দাজ করলেন, তার ঘোড় চড়াই অতিক্রম করছে। একটু পর পর মোড় নিচ্ছে ডানে-বাঁয়ে। আবার নীচে নামছে। এতে তিনি অনুমান করলেন যে, এটি কোন পার্বত্য এলাকা।

এভাবে দীর্ঘক্ষণ পথ অতিক্রম করেন ডাক্তার। সূর্য তখন মাথার উপর উঠে এসেছে। হঠাৎ পেছন দিক থেকে উচ্চকিত এক কণ্ঠস্বর ভেসে আসে তার কানে। তাতে তিনি বুঝতে পারেন যে, কোন আরোহী ঘোড়ার পিঠ থেকে মাটিতে পড়ে গেছে। তার ঘোড়াটি থেমে গিয়ে মোড় ঘুরিয়ে দাঁড়িয়েছে পেছন দিকে। তারপর আবার কণ্ঠস্বর- তুলে নাও, ছায়ায় নিয়ে চল, লোকটা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। উহ! রক্ত ঝরছে তো! ডাক্তারের চোখ ও হাত-পায়ের বাধন খুলে দাও। তিনি রক্তক্ষরণ বন্ধ করে দেবেন। অন্যথায় ভাইটি আমার মরে যাবে।

ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যাওয়া লোকটি জখমী হাশীশী। সারাটা রাতের ঘোড়সাওয়ারীর ফলে পেটের জখম খুলে গেছে তার। উরুর ক্ষত থেকেও পুনরায় রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে। রাতভর রক্ত ঝরেছে। অবশেষে এখানে এসে এত বেশী রক্ত ঝরল যে, লোকটা চৈতন্য হারিয়ে ফেলল এবং ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গেল। তাকে তুলে একটি টিলার ছায়ায় নিয়ে যাওয়া হল, মুখে পানি দেয়া হল। কিন্তু পানি কণ্ঠনালী অতিক্রম করছে না তার। রক্তে ভিজে গেছে তার গায়ের কাপড়-চোপড়।

ঘোড়ার পিঠ থেকে নামানো হয় ডাক্তারকে। চোখ দুটি খুলে যায় তার। এদিক ওদিক না তাকিয়ে সোজা সামনের দিকে হাঁটতে নির্দেশ দেয়া হয় তাকে। পেছনে পিঠ ঘেঁষে খঞ্জর ধরে আছে কেউ, টের পান ডাক্তার। নির্দেশনা অনুযায়ী সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করেন তিনি।

একটি টিলার পাদদেশে পড়ে আছে জখমী। পাশে উপবিষ্ট শারজা। ডাক্তারকে দেখেই শারজা বলে উঠে, আল্লাহর ওয়াস্তে আপনি আমার ভাইকে রক্ষা করুন।

জখমীর শিরায় হাত রাখেন ডাক্তার। এদিক-ওদিক তাকাবার অনুমতি নেই তার। হাত রেখে বসে পড়েন তিনি। পিঠে খঞ্জরের খোঁচা অনুভব করেন। জখমীর শিরা দেখে তিনি সটান উঠে দাঁড়ান। ঘাড় ঘুরিয়ে দৃষ্টি ফেলেন পেছন দিকে। সম্মুখে কালো মুখোশপরা চারজন লোক দাঁড়িয়ে। শুধু চোখগুলো দেখা যায় তাদের। একজনের হাতে খঞ্জর। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে ডাক্তার বললেন, তোমাদের উপর আল্লাহর গজব পড়ুক। বাঁচাবার পরিবর্তে লোকটাকে তোমরা খুন করে ফেলেছ! আমরা একে চারপাই থেকে নড়তে দেয়নি। আর তোমরা কিনা একে এতদূর থেকে নিয়ে এসেছ ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে। ওর জখম খুলে গেছে এবং দেহের সব রক্ত ঝরে গেছে। লোকটা বেঁচে নেই।

ভাইয়ের লাশের উপর লুটিয়ে পড়ে শারজা। হাউমাউ করে বিলাপ জুড়ে দেয় মেয়েটি। ডাক্তারের চোখের উপর আবার পট্টি বেঁধে দেয় মুখোশধারীরা। নিয়ে যায় সেখান থেকে খানিক দূরে। ঘোড়ার পিঠে তুলে নেয়া হয় লাশটি। চলতে শুরু করে কাফেলা।

শারজার বুক-চেরা কান্নার করুণ শব্দ শুনতে পান ডাক্তার। মুহূর্তের জন্যও থামছে না মেয়েটি। ডাক্তার তার ঘোড়ার আরোহীকে বললেন, লোকটি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যেত। কিন্তু তোমরা তাকে মেরে ফেললে। তাকে কোন সাজাও ভোগ করতে হতো না।

আরোহী বলল, আমরা তাকে তার প্রাণরক্ষা করার জন্য নিয়ে আসিনি। আমরা মূলত সেইসব গোপন তথ্য অপহরণ করেছি, যা তার সঙ্গে ছিল। তার মৃত্যুতে আমাদের কোন দুঃখ নেই। তার বুকে আমাদের যেসব তথ্য লুকায়িত ছিল, তোমার সরকার যে তা বের করতে পারেনি, তা-ই আমাদের পরম পাওয়া।

তা আমাকে তোমরা কোন্ অপরাধে শাস্তি দিচ্ছ? জিজ্ঞেস করেন ডাক্তার।

আমরা তোমাকে দেবতার হালে রাখব। একটু গরম বাতাসও তোমার গায়ে লাগতে দেব না। তোমাকে আমরা নিয়ে এসেছি তিনটি কারণে। এক, পথে জখমীর কোন সমস্যা দেখা দিলে তুমি চিকিৎসা করবে। কিন্তু আমরা ভেবেই দেখেনি যে, তোমার কাছে না আছে ওষুধ, না আছে ব্যান্ডেজ করার সরঞ্জাম। দুই. শারজাকেও আমাদের আনবার প্রয়োজন ছিল। ঘটনাক্রমে তুমি ছিলে তার সাথে। এমতাবস্থায় তোমাকে ছেড়ে আসা ছিল আমাদের জন্য বিপজ্জনক। তাই তোমাকেও তুলে আনতে হল। তৃতীয় কারণ, আমাদের একজন ডাক্তারের প্রয়োজন। তোমাকে আমরা সবসময় আমাদের সাথে রাখব।

আমি এমন লোকদের চিকিৎসা করব না, যারা আমার সরকারের বিরোধী। তোমরা খৃস্টান, সুদানী ও ফাতেমীদের আপন এবং তাদেরই ইঙ্গিতে তোমরা সালতানাতে ইসলামিয়ার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছ। আমি তোমাদের কোন কাজে আসব না। ডাক্তার বললেন।

তাহলে আমরা তোমাকে হত্যা করে ফেলব। বলল আরোহী।

তা-ই বরং ভালো। জবাব দেন ডাক্তার।

তাহলে আমরা তোমার সঙ্গে এমন আচরণ করব, যা তোমার জন্য প্রীতিকর হবে না। তবে আমি আশা করছি, তোমার সাথে আমাদের খারাপ আচরণের প্রয়োজন পড়বে না। তুমি সালাহুদ্দীন আইউবীর শাসন দেখেছ। আমাদের রাজত্বও দেখবে। তখন তুমি বলবে, আমি এখানেই থাকতে চাই। এ তো জান্নাত। কিন্তু যদি তুমি আমাদের জান্নাতকে প্রত্যাখ্যান কর, তাহলে আমাদের জাহান্নাম কি জিনিস, তা তুমি দেখতে পাবে। বলল আরোহী।

চলতে থাকে ঘোড়া। ডাক্তারের চোখে পট্টি বাঁধা। পট্টির অন্ধকার ভেদ করে নিজের ভবিষ্যত দেখার চেষ্টা করছেন তিনি। মনে মনে পালাবার পন্থাও খুঁজতে থাকেন। বারবার শারজার কথা মনে পড়ে তার। কিন্তু এই ভেবে তিনি নিরাশ হয়ে পড়ছেন যে, এ মেয়েটিও এদেরই লোক। তার সহযোগিতা পাওয়ার আশা করা বৃথা।

***

সফরটা তাদের এতো দীর্ঘ ছিল না। কিন্তু সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর সীমান্ত প্রহরীদের হাতে ধরা খাওয়ার ভয়ে চুপিচুপি দূরবর্তী আঁকা-বাঁকা পথ ধরে অতিক্রম করতে হয়েছে এ সন্ত্রাসী চক্রটির। সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হওয়ার পরও পথচলা অব্যাহত থাকে কাফেলার।

মধ্যরাতের খানিক আগে কাফেলা থেমে যায়। ঘোড়া থেকে নামিয়ে হাত-পা খুলে দেয়া হয় ডাক্তারের। চোখের পট্টিও সরিয়ে ফেলা হয় তার। তবু অন্ধকারের কারণে কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না তিনি। তাকে কিছু খাবার খেতে দেয়া হয় এবং পানি পান করানো হয়।

আহার শেষে আবার তার হাত-পা বেঁধে ফেলা হয়। শুয়ে পড়তে বলা হয় তাকে। ডাক্তার শুয়ে পড়েন। মুহূর্তের মধ্যে রাজ্যের ঘুম নেমে আসে ডাক্তারের ক্লান্ত-অবসন্ন চোখে।

শুয়ে পড়ে কাফেলার অন্যান্য লোকেরাও। জিন খুলে ঘোড়াগুলো বেধে রাখে সামান্য দূরে। ডাক্তারের পালাবার কোন আশংকা নেই। হাত-পা তার শক্ত করে বাঁধা।

কিছুক্ষণ পর কারো ডাকে ডাক্তারের চোখ খুলে যায়। ভাবলেন, আবার রওনা হওয়ার জন্য ডাকা হচ্ছে। পরক্ষণে মনে হল, কেউ তার পায়ের বাঁধন খুলছে। চুপচাপ পড়ে থাকেন তিনি। মৃত্যুর জন্য তিনি পূর্ব থেকেই প্রস্তুত। তার আশংকা ছিল, খুন করে হয়ত তাকে কোথাও ফেলে দেয়া হবে। কিন্তু পায়ের বাধন খুলে যাওয়ার পর যখন হাতের বাঁধনও খুলে যেতে শুরু করল, তখন তিনি কার যেন ফিসফিস কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন। কে যেন তার কানে কানে বলছে, আমি দুটি ঘোড়ায় জিন বেঁধে রেখে এসেছি। চুপচাপ আমার পেছনে পেছনে আস। আমিও তোমার সাথে যাব। ওরা ঘুমুচ্ছে। এ কণ্ঠস্বর শারজার।

ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায় ডাক্তার। শারজার পেছনে পেছনে হাঁটতে শুরু করেন তিনি। জায়গাটা বালুকাময় হওয়ার কারণে পায়ের শব্দ হচ্ছে না। সম্মুখে দুটি ঘোড়া দণ্ডায়মান। ডাক্তারকে ইশারা দিয়ে একটিতে চড়ে বসে শারজা। অপরটিতে উঠে বসেন ডাক্তার। শারজা বলে, তুমি যদি দক্ষ ঘোড়সাওয়ার না-ও হয়ে থাক, তবু ভয় নেই, পড়বে না! ঘোড়া ছুটাও, লাগাম ঢিলে করে দাও। ঘোড়াটিকে ডানে-বাঁয়ে ঘুরাতে তো পারবে!

প্রত্যুত্তরে কিছু না বলেই ডাক্তার ঘোড়া ছুটায়। সমান তালে ছুটে চলে শারজার ঘোড়াও। ধাবমান ঘোড়ার পিঠে থেকেই শারজা বলে, তুমি আমার পেছনে পেছনে থাক। আমি পথ চিনি। অন্ধকারে আমার থেকে আলাদা হবে না কিন্তু।

দ্রুত ধাবমান ঘোড়া দুটোই সজাগ করে তোলে অপহরণকারীদের। কিন্তু ধাওয়া করা অত সহজ নয়। তাদের প্রথমে দেখতে হবে, যে ঘোড়ার ক্ষুরধ্বনি শোনা গেল, সেগুলো কার। তাদের মনে শারজার পালাবার কোন আশংকাই ছিল না। ঘোড়া ছুটিয়ে কে গেল তার সন্ধান নিতে নিতে কেটে গেল কিছুক্ষণ। জানা গেল, শারজা এবং ডাক্তার পালিয়ে গেছে। এরপর তাদের ঘোড়ায় জিন বাঁধতে হবে। এসবে যে সময় ব্যয় হল, ততক্ষণে পলায়নকারীরা অতিক্রম করে গেছে দু-আড়াই মাইল পথ।

বারবার পেছন দিকে তাকাচ্ছে ডাক্তার ও শারজা। কেউ তাদের ধাওয়া করছে কিনা, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখছে তারা। না, তারা নিশ্চিত, কেউ তাদের পিছু নেইনি। তবু ঘোড়ার গতি হ্রাস করে না তারা। ছুটে চলে তীরবেগে। এতক্ষণে তারা বহু পথ অতিক্রম করে আসে। ডাক্তার শারজাকে বলেন, আশপাশে কোথাও না কোথাও সীমান্ত চৌকি থাকার কথা। কিন্তু তা কোথায় নির্দিষ্টভাবে আমার জানা নেই। বলতে পারে না শারজাও। শারজা ডাক্তারকে নিশ্চয়তা দিয়ে বলে, আমরা সঠিক পথেই কায়রো অভিমুখে এগিয়ে চলছি। পথও আর বেশী নেই।

***

পরদিন দ্বি-প্রহর। মিসরের ভারপ্রাপ্ত গবর্নর তকিউদ্দীনের সামনে বসে আছেন আলী বিন সুফিয়ান। তকিউদ্দীন বলছিলেন, আমি এ জন্য বিস্মিত নই যে, আপনার ন্যায় একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি এই ভুল করেছেন যে, একটি সন্দেহভাজন মেয়েকে জখমী বন্দীর নিকট থাকার অনুমতি দিয়েছেন এবং চারজন সন্দেহভাজন ব্যক্তিকেও জখমীর সাথে সাক্ষাৎ করার সুযোগ প্রদান করেছেন। আমার বিস্ময় এ কারণে যে, এই চক্রটি অত্যন্ত দুঃসাহসী ও সুসংগঠিত। জখমীকে তুলে নিয়ে যাওয়া, প্রহরীকে হত্যা করে জখমীর বিছানায় ফেলে যাওয়া অতিশয় দুঃসাহসী অভিযানই বটে। সীমাহীন দুর্ধর্ষ ও সুসংগঠিত চক্র ছাড়া এমন সাহস কেউ দেখাতে পারে না।

আমার মনে হয়, ডাক্তার আর মেয়েটি এই অভিযানকে সহজ করে দিয়েছিল। এই অপরাধেও আমাদের জাতির সেই দুর্বলতা কাজ করেছে, যার জন্য সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী অস্থির, পেরেশান। যার কারণে তিনি বলে থাকেন যে, নারী আর ক্ষমতার মোহ মিল্লাতে ইসলামিয়াকে ডুবিয়ে ছাড়বে। ডাক্তারকে আমি সচ্চরিত্রবান যুবক মনে করতাম। একটি তরুণী তাকেও অন্ধ করে দিল। যা হোক, জখমী কয়েদীর গ্রামের ঠিকানা আমি পেয়ে গেছি। একটি বাহিনী রওনাও করিয়ে দিয়েছি। বললেন আলী বিন সুফিয়ান।

আর জখমী কয়েদী দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকার যে প্রাসাদটির কথা বলেছিল, তার ব্যাপারে আপনি কি সিদ্ধান্ত নিতে চান? জিজ্ঞেস করলেন তকিউদ্দীন।

আমার মনে হচ্ছে, লোকটি মিথ্যে বলেছে। নিজের জীবন রক্ষা করার জন্য একটি ভূয়া গল্প বানিয়েছিল বোধ হয়। তথাপি আমি খোঁজ-খবর নিয়ে দেখব। জবাব দেন আলী বিন সুফিয়ান।

কক্ষে বসে এ বিষয়ে কথা বলছেন দুজন। হঠাৎ দারোয়ান ভেতরে প্রবেশ করে এমন একটি সংবাদ বলে, যা তাদের হতভম্ব করে দেয়। একজনের মুখের প্রতি তাকিয়ে থাকেন অন্যজন। বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন যেন তারা। সম্বিত ফিরে পেয়ে আলী বিন সুফিয়ান উঠে দাঁড়ান এবং অন্য কেউ হবে বোধ হয় বলে বাইরে বেরিয়ে যান। তার পেছনে বেরিয়ে পড়েন তকিউদ্দীন। কিন্তু লোকটা অন্য কেউ নয় তাদেরই ডাক্তার দাঁড়িয়ে আছেন তাদের সামনে। সঙ্গে তার জখমী কয়েদীর বোন শারজা। ঘোড়াগুলো হাঁপাচ্ছে তাদের। ডাক্তার ও শারজার সমস্ত শরীর ধূলিমাখা। ওষ্ঠদ্বয় কাঠের মত শুষ্ক।

আলী বিন সুফিয়ান খানিকটা ক্ষুব্ধ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, কয়েদীকে কোথায় রেখে এসেছ? ডাক্তার হাতের ইশারায় বললেন, আমাদের একটুখানি বিশ্রাম নিতে দিন। আলী বিন সুফিয়ান দুজনকে ভেতরে নিয়ে যান। তাদের জন্য খাবার ও পানির ব্যবস্থা করার আদেশ দেন।

ডাক্তার তার ও শারজার অপহরণের কাহিনীর সবিস্তার বিবরণ দেন। এও জানান যে, জখমী কয়েদী মারা গেছে। তিনি বলেন, আমি জানতাম না যে, জখমী কয়েদীও অপহরণ হয়েছে। পরদিন যখন একটি লোক ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গিয়ে জখম খুলে গেল এবং বিপুল রক্তক্ষরণের দরুন লোকটা মারা গেল, তখনই আমি বিষয়টি জানতে পাই। তারপর ডাক্তার তার মুক্ত হয়ে ফিরে আসার কাহিনী শোনান।

কথা বলে শারজা। আলী বিন সুফিয়ান এবার বুঝতে পারেন মেয়েটি মরু অঞ্চলের মানুষ এবং অতি সাহসী ও গোঁয়ার প্রকৃতির। সে জানায়, আমি আমার ভাইয়ের আশ্রয়ে এবং তারই মুখ পানে তাকিয়ে বেঁচে ছিলাম। ভাইয়ের জন্য আমি জীবন দিতেও প্রস্তুত থাকতাম সবসময়। আপনারদের ডাক্তার যেরূপ নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে আমার ভাইয়ের চিকিৎসা করেছিলেন, তাতে আমি তার অনুরক্ত হয়ে যাই। আমার কাছে ডাক্তার ফেরেশতার মত মনে হতে লাগল।

শারজা জানায়- আমার সাথে যে চারজন লোক এসেছিল, তারা আমাদের আত্মীয় ছিল না। তারা ছিল সেই চক্রের সদস্য, যারা সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী ও তাঁর পদস্ত কর্মকর্তাদের হত্যাচেষ্টায় তৎপর। আপনার লোকেরা যখন আমাকে আনার জন্য আমাদের গ্রামে যায়, তখন তারা চারজন গ্রামে অবস্থান করছিল। তারা জানতে পেরেছিল যে, আমার ভাই জখমী অবস্থায় আপনাদের হাতে বন্দী হয়ে আছে। তাই তাকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে আমার সাথে চলে আসে। তাদের আশংকা ছিল, জখমীর কাছে যে তথ্য আছে, তা ফাঁস হয়ে যাবে। জখমী কোথায় কোন্ অভিযানে আহত হয়েছে, তা তাদের জানা ছিল।

শারজার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী তার পরিকল্পনাও এটাই ছিল যে, সে ভাইকে অপহরণ করাবে। ভাইয়ের নিকট থাকার যে আবেদন সে করেছিল, তার উদ্দেশ্য ছিল দুটি। প্রথমতঃ ভাইয়ের সেবা-শুশ্রূষা করা, দ্বিতীয়তঃ সুযোগ পেলে ভাইকে অপহরণ করান।

জখমীর সাথে সাক্ষাৎ করে তারা। কায়রোতেই অবস্থান নিয়েছিল এক জায়গায়। শারজার ইঙ্গিতের অপেক্ষায় ছিল তারা। কিন্তু ডাক্তার মেয়েটিকে এমনভাবে প্রভাবিত করে ফেলেন যে, চিন্তাই পাল্টে যায় তার। ডাক্তার শারজাকে নিশ্চয়তা প্রদান করেন যে, তার ভাইয়ের সাজা হবে না। তাছাড়া তিনি মেয়েটিকে এমন এমন কথা শোনান, যা এর আগে কখনো সে শোনেনি। তিনি মেয়েটির হৃদয়ে ইসলামের মর্যাদা জাগ্রত করে দেন এবং উন্নত চরিত্রের প্রমাণ দিয়ে তাকে ভক্ত বানিয়ে ফেলেন। মেয়েটি সারাক্ষণ ডাক্তারের কাছে বসে বসে তার মধুর-মূল্যবান কথা শুনতে ব্যাকুল হয়ে উঠে।

একদিন ডাক্তারের ঘরে যাওয়ার পথে চারজনের একজনের সাথে দেখা হয়ে যায় শারজার। লোকটি শারজাকে বলে, তোমার ভাইয়ের অপহরণে আর বিলম্ব করা ঠিক নয়। জবাবে শারজা সাফ জানিয়ে দেয়, আমি আমার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ফেলেছি। ভাই আমার এখানেই থাকবে। লোকটি বলল, তোমার ভাইয়ের যদি মতিভ্রম হয়েই থাকে, তাহলে ওকে আমরা বেঁচে থাকতে দেব না।

চার কুচক্রী জখমীকে এমন সাহসিকতার সাথে অপহরণ করে নিয়ে যাবে, তা ছিল শারজার কল্পনার অতীত। তাই সে ডাক্তারকেও অবহিত করা প্রয়োজন মনে করেনি যে, তার ভাই অপহৃত হওয়ার আশংকা আছে। সে রাতেই শারজা ও ডাক্তার পড়ে যায় চার কুচক্রীর কবলে। অপহরণ করে যখন তাদেরকে ঘোড়ার পিঠে তুলতে নিয়ে যাওয়া হল, তখন শারজা দেখতে পেয়েছিল যে, তার ভাই বসে আছে। ভাই মুক্ত হয়েছে দেখে তখন কিছুটা আনন্দিতও হয়েছিল সে। পলায়নে আগ্রহী হয়ে উঠেছিল নিজেও। কিন্তু ডাক্তারকে ওদের বন্দী হিসেবে দেখে মেনে নিতে পারেনি শারজা। তাই সে ডাক্তারকে ছেড়ে দিতে অনুরোধও করেছিল। কিন্তু সে অনুরোধ রক্ষা করেনি সন্ত্রাসীরা। হাত-পা বেঁধে ঘোড়ার পিঠে তুলে নেয় তারা ডাক্তারকে। পথে জখমীকে কিভাবে অপহরণ করল সে কাহিনী শোনায় তারা শারজাকে।

ওখানে গিয়েছিল মাত্র দুজন। পথের কথা জিজ্ঞেস করার নাম করে একজন আলাপে ভুলিয়ে দেয় প্রহরীকে। এই সুযোগে পেছন থেকে প্রহরীর ঘাড় ঝাঁপটে ধরে ফেলে অপরজন। এবার দুজনে মিলে তুলে নিয়ে যায় তাকে ভেতরে। তাদের দেখে উঠে বসে জখমী। বিছানা থেকে সরে দাঁড়ায় সে। প্রহরীকে বিছানায় শুইয়ে দেয় সন্ত্রাসীরা। খঞ্জর দ্বারা গভীর দুটি আঘাত হানে তার হৃদপিন্ডে। মারা যায় প্রহরী। মাথা থেকে পা পর্যন্ত কম্বল দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় প্রহরীর রক্তাক্ত লাশটা। জখমী কয়েদীকে নিয়ে বেরিয়ে যায় দুজন।

শারজা ডাক্তারের ঘরে আছে, তাও জানা ছিল অপহরণকারীদের। তাদের আশংকা ছিল, শারজা বিষয়টা মেনে নেবে না এবং তাদের এই অপহরণ অভিযানকেও ব্যর্থ করে দেবে। অথচ তাকেও এখান থেকে সরিয়ে ফেলা একান্ত প্রয়োজন। কারণ, অনেক তথ্য তারও জানা। তাই একস্থানে ওঁৎ পেতে বসে যায় দুজন। গভীর রাতে ঘর থেকে বের হয়ে ডাক্তার ও শারজা যেই মাত্র অন্ধকার সরু গলিতে প্রবেশ করে, অম্‌নি পেছন থেকে দুব্যক্তির বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যায় তারা। সফল হয়ে যায় অপহরণ অভিযান।

***

ডাক্তার ও শারজার কথায় পুরোপুরি বিশ্বাস করলেন না আলী বিন সুফিয়ান। তিনি ভাবলেন, এটিও ষড়যন্ত্রের অংশ হতে পারে। তাই তিনি দুজনকে পৃথক করে ফেললেন। আলাদা আলাদা জিজ্ঞাসাবাদ করেন তাদের। ডাক্তার অতিশয় জ্ঞানী লোক। তিনি আলী বিন সুফিয়ানকে আশ্বস্ত করতে সক্ষম হন যে, তার বক্তব্য অক্ষরে অক্ষরে সত্য। তিনি বললেন, আকার-আকৃতিতে মেয়েটিকে আমার এক মৃত বোনের মত দেখা যায়। তাই আবেগাপ্লুত হয়ে আমি তাকে আমার ঘরে নিয়ে যাই। কয়েকবারই সে আমার ঘরে যায় এবং দীর্ঘ সময় ধরে আমি তার সাথে কথাবার্তা বলি। জখমীর ঘরেও আমি তার সাথে বসে থাকতাম। মেয়েটির প্রতি আমি কখনো কুদৃষ্টিতে তাকাইনি।

ডাক্তার জানায়, আমার এই অমলিন সদাচারে মেয়েটি এতই প্রভাবিত হয়ে পড়ে যে, ইসলাম ও মুসলমান সম্পর্কে সে তার মনের কতিপয় সন্দেহ আমার সামনে উপস্থাপন করে। আমি এক এক করে তার সব সন্দেহ দূর করার চেষ্টা করি। এতে সে আরো প্রভাবিত হয়ে যায়। আমার প্রতি তার শ্রদ্ধাবোধ বেড়ে যায়। মেয়েটি মুসলমান। কিন্তু আমি বুঝলাম, সে দারুণ বিভ্রান্ত। আমি তার সব ভ্রান্তি দূর করে দেই। চিন্তা-চেতনায় ছিল মেয়েটি পশ্চাৎপদ। কুসংস্কারাচ্ছন্ন পল্লী অঞ্চলের মানুষ। তার কথা-বার্তায় আমি বুঝতে পেরেছি যে, তার এলাকায় ইসলাম পরিপন্থী ধ্যান-ধারণা এবং সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী-বিরোধী প্রচারণা জোরে-শোরে বিস্তার লাভ করছে।

শারজার নিকট থেকে কোন জবানবন্দী নেননি আলী বিন সুফিয়ান। তিনি মেয়েটিকে প্রশ্ন করতে থাকেন আর মেয়েটি তার উত্তর প্রদান করে। তার জবাবী বক্তব্যই তার জবানবন্দীর রূপ লাভ করে। ফেরাউনী আমলের পরিত্যক্ত প্রাসাদসমূহ সম্পর্কে সেও সেই বিবরণ প্রদান করে, যা আমরা উপরে বিবৃত করে এসেছি। সেও প্রাসাদের রহস্যময় অদৃশ্য দরবেশের ভক্ত।

শারজা জানায়, তার ভাই সেনাবাহিনীতে চাকরি করত। নিজে ঘরে একা থাকত। গাঁয়ের কতিপয় লোক এই বলে তাকে প্রাসাদে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেয় যে, ওখানকার দরবেশ সুন্দরী কুমারীদের বেশ পছন্দ করেন।

আলী বিন সুফিয়ান কৌশলে তার থেকে এ তথ্যও বের করে আনেন যে, তার গ্রামের তিনটি কুমারী মেয়ে ঐ প্রাসাদে গিয়েছিল। কিন্তু পরে আর ফিরে আসেনি। একবার তার ভাই বাড়ী আসে। শারজা তার নিকট প্রাসাদে যাওয়ার অনুমতি চায়। কিন্তু ভাই তাকে বারণ করে দিয়েছিল। শারজা অবস্থাটা স্পষ্টরূপে ভাষায় ফুটিয়ে তুলতে না পারলেও আলী বিন সুফিয়ান এতটুকু বুঝে ফেললেন, মিসরের দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলে কি সব হচ্ছে।

ডাক্তার সম্পর্কে শারজা বলে, অপহরণকারীরা যদি তাকে গ্রামে নিয়েও যেত, এমনকি যদি বন্দীশালায় আবদ্ধ করে ফেলত, তবু আমি তাকে মুক্ত করেই ছাড়তাম। কিন্তু যখন আমার ভাই মরে গেল, আমি গ্রামে যাওয়ার ইচ্ছা ত্যাগ করলাম এবং সংকল্প নিলাম, যে কোন মূল্যে হোক ডাক্তারকে আমি এখান থেকেই মুক্ত করব। চার অপহরণকারীকে সে তার আপন মনে করত। কিন্তু ডাক্তার তাকে জানাল যে, এরা আল্লাহর মস্তবড় দুশমন। শারজা আরো জানতে পেরেছে যে, এরা তার ভাইয়ের সাথে ভালো আচরণ করেনি। তার কাছে যেসব তথ্য ছিল, তা যেন ফাঁস হয়ে না যায়, সে জন্যেই এদের এতো ঝুঁকিপূর্ণ অভিযান। উদ্দেশ্য সফল হওয়ার পর ইচ্ছে করেই এরা তার ভাইকে মেরে ফেলেছে।

আলী বিন সুফিয়ান শারজাকে জিজ্ঞেস করলেন, এখন তুমি কি করতে চাও? নিজের ব্যপারে তুমি কি চিন্তা করছ? শারজা জবাব দেয়, আমি আমার সারাটা জীবন ডাক্তারের চরণে কাটিয়ে দিতে চাই। তিনি যদি আমাকে আগুনে ঝাঁপ দিতে বলেন, আমি তাও করতে প্রস্তুত আছি। শারজা সম্মতি প্রকাশ করে যে, আপনি যদি ফেরাউনী প্রাসাদে অভিযান প্রেরণ করেন, তাহলে আমি তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাব এবং আমার গ্রামের যারা সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর বিপক্ষে, তাদের ধরিয়ে দেব।

আলী বিন সুফিয়ানের পরামর্শে সামরিক ও প্রশাসনিক শীর্ষ কর্মকর্তাদের জরুরী বৈঠক তলব করা হয় এবং তকিউদ্দীনকে পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করা হয়। সকলের ধারণা ছিল, তকিউদ্দীন মিসরে নতুন এসেছেন। এত বড় গুরুদায়িত্ব তার ঘাড়ে চাপে এই প্রথম। তাই তিনি আপাততঃ ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে যাবেন না।

বৈঠকে অধিকাংশ কর্মকর্তা অভিন্ন মত পোষণ করলেন যে, যেহেতু এত বিশাল একটি এলাকার এতগুলো মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে, সেহেতু আপাততঃ তাদের বিরুদ্ধে কোন সামরিক অভিযান পরিচালনা করা ঠিক হবে না। প্রাসাদের অভ্যন্তরের যে পরিস্থিতি জানা গেছে, তাতে প্রতীয়মান হয় যে, সেখান থেকে যে একটি নতুন বিশ্বাস আত্মপ্রকাশ করেছে, জনগণ তা বরণ করে নিয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষ তাদের এই উপাসনালয় ও বিশ্বাসের উপর আমাদের এই সামরিক অভিযান সহ্য করবে না। তার পরিবর্তে বরং সেখানে কিছু মুবাল্লিগ প্রেরণ করা হোক। দাওয়াত ও তাবলীগের মাধ্যমে লোকদের সঠিক পথে আনার চেষ্টা করলে ভালো ফল হবে আশা করা যায়। বৈঠকে একটি পরামর্শ এই দেয়া হয় যে, সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীকে এই পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করে তাঁর মতামত নিয়ে অভিযান পরিচালনা করা হোক।

তার মানে আপনারা মানুষকে ভয় পাচ্ছেন! আপনাদের মনে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ভয় নেই, যাদের সত্য ধর্মের অবমাননা করা হচ্ছে। আমার প্রথম কথা হচ্ছে, মিসরের বর্তমান পরিস্থিতির সংবাদ ঘুণাক্ষরে আমীরে মেসেরের কানে দেয়া যাবে না। আপনারা কি জানেন না যে, তিনি কেমন শক্তিশালী দুশমনের মোকাবেলায় মুখোমুখী দাঁড়িয়ে আছেন? আপনারা কি সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীকে একথা বুঝাতে চাচ্ছেন যে, দুচার হাজার দেশদ্রোহী পাপিষ্ঠকে আমরা ভয় পাচ্ছি আমি সরাসরি এবং কঠিন অভিযান পরিচালনা করতে চাই। জলদগম্ভীর কণ্ঠে বললেন তকিউদ্দীন।

গোস্তাখী মাফ করবেন মুহতারাম আমীর! খৃস্টানরা আমাদের বিরুদ্ধে অপবাদ আরোপ করছে যে, ইসলাম তরবারির জোরে বিস্তার লাভ করেছে। আমরা কাজে কর্মে এ অপবাদের প্রতিবাদ করতে চাই। আমরা তাদের কাছে স্নেহ-ভালোবাসার বার্তা নিয়ে যেতে চাই। বললেন এক নায়েব সালার।

তা-ই যদি হয়, তাহলে কোমরে তরবারী ঝুলিয়ে রেখেছ কেন? এতো টাকা ব্যয় করে সেনাবাহিনী পুষছই বা কেন? তার চে বরং এটা উত্তম নয় কি যে, তোমরা সেনাবাহিনী বিলুপ্ত করে দিয়ে অস্ত্রগুলো সব নীল নদে ফেলে দিয়ে দাওয়াত তাবলীগের মিশন নিয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে গাশত কর, দরবেশের ন্যায় গ্রামে-গ্রামে, পাড়ায়-পাড়ায় ঘুরে বেড়াও। তিরস্কারের সুরে বললেন তকিউদ্দীন। বলতে বলতে আবেগপ্রবণ হয়ে উঠেন তিনি। তিনি বললেন

রাসূলে খোদার পয়গামের বিরুদ্ধে যদি ক্রুশের তরবারী উত্তোলিত হয়, তাহলে ইসলামের তরবারীও কোষবদ্ধ থাকবে না। আর ইসলামের তরবারী যখন কোষমুক্ত হবে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সাঃ) দুশমনদের মস্তক দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করবে। ইসলামের সত্য-সঠিক বাণীকে যারা অস্বীকার করবে, তাদের জিহ্বা কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। খৃস্টানরা যদি এই অপবাদ আরোপ করে থাকে যে, ইসলাম তরবারীর জোরে বিস্তার লাভ করেছে, তাহলে আমি তাদের নিকট এর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে প্রস্তুত নই। আপনারা কি জানেন, সালতানাতে ইসলামিয়া কেন দিন দিন অধঃপাতে যাচ্ছে? বলতে পারেন, স্বয়ং মুসলমান কেন ইসলামের দুশমনে পরিণত হচ্ছে? তার একমাত্র কারণ, খৃস্টানরা মদ, নারী, অর্থ আর ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে ইসলামের তরবারীতে জং ধরিয়ে রেখেছে। তারা আমাদের উপর যুদ্ধপ্রিয়তা ও জুলুমের অভিযোগ আরোপ করে আমাদের সামরিক শক্তিকে নিঃশেষ করে দিতে চায়। আমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার মুরোদ তাদের নেই। তাদের স্থলবাহিনী নৌবহর সব ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের বিরুদ্ধে তারা নাশকতামূলক অভিযান পরিচালনা করছে। আল্লাহর সত্য দ্বীনে কুঠারাঘাত করছে। আর আপনারা কিনা ওদের উপর অস্ত্রধারণ করতে বারণ করছেন।

মনোযোগ দিয়ে শুনুন বন্ধুগণ! খৃস্টান ও আমাদের অন্যান্য দুশমনরা ভালোবাসার প্রলোভন দেখিয়ে আমাদের হাত থেকে তরবারী ছিনিয়ে নিতে চায়। তারা চায় আমাদের পিঠে আঘাত হানতে।কেউ তোমার এক গালে চড় মারলে অপর গালটাও এগিয়ে দাও তাদের এই নীতি প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়। কার্কের মুসলমানদের সাথে তারা কি নির্মম আচরণ করেছে, তাতে আপনাদের অজানা নয়। শোবক দুর্গ জয় করার পর আপনারা কি সেখানকার বেগার ক্যাম্পের করুণ দৃশ্য দেখেননি? সেখানকার মুসলিম নারীদের সম্ভ্রম নিয়ে তারা যে ছিনিমিনি খেলা খেলেছিল, তা কি আপনারা শুনেননি? অধিকৃত ফিলিস্তীনের মুসলমানরা চরম ভয়-উৎকণ্ঠা, অপমান ও নির্যাতনের মধ্যে জীবন-যাপন করছে। খৃস্টানরা লুণ্ঠন করছে মুসলমানদের কাফেলা, অপহরণ করে নিয়ে যাচ্ছে মুসলিম নারীদের। আর আপনারা কিনা বলছেন, ইসলামের নামে অস্ত্রধারণ করা অন্যায়। এমন পরিস্থিতিতে ইসলামের নামে অস্ত্রধারণ করা যদি অন্যায়ই হয়ে থাকে, তাহলে আমি দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করছি, এই অপরাধে আমি বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত নই। খৃস্টানদের তরবারী নিরস্ত্র মুসলমানদের উপর আঘাত হানছে। তাদের একমাত্র অপরাধ তারা মুসলমান। তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সাঃ) কথা বলে। তারা ক্রুশ ও প্রতিমার পূজারী নয়। আপনাদের তরবারী হাত থেকে খসে পড়বে তখন, যখন আপনাদের সম্মুখের লোকটি হবে নিরস্ত্র এবং তার কাছে ইসলামের পয়গাম পৌঁছেনি। এই যে কে যেন বললেন মানুষের চেতনার উপর আঘাত করা ঠিক নয়। আমি এই মতের সমর্থন করি না। আমি দেখেছি যে, আরব রাজ্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুসলিম শাসক ও অযোগ্য নেতৃবর্গ সাধারণ লোকদের সন্তুষ্ট করার জন্য তোষামোদমূলক কথা বলে থাকে। জনগণকে তাদের খেয়াল-খুশি মত চলার সুযোগ দিয়ে নিজেরা ভোগ বিলাসে ডুবে থাকে। তারা নিজেদের চারপাশে এমন কিছু চাটুকার জুড়িয়ে নিয়েছে, যারা তাদের সব কথায় জ্বী হুজুর এর নীতি পালন করে এবং প্রজাদের মধ্যে ঘুরে ফিরে প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে, আমাদের শাসকবর্গ যা কিছু বলছেন ও করছেন, সবই ঠিক। এর ফল কি হল? আল্লাহর বান্দাগণ দুশ্চরিত্র বিলাসী লোকদের গোলামে পরিণত হতে চলেছে। জাতি শাসক ও শাসিতে বিভক্ত হতে চলেছে।

আমি দেখতে পাচ্ছি যে, দুশমন আমাদের মূলোৎপাটন করছে এবং আমাদের জাতির একটি অংশকে কুফরের অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় আমরা যদি কঠিন পদক্ষেপ গ্রহণ না করি, তবে তার অর্থ হবে, আমরাও কুফরকে সমর্থন করছি। আমার ভাই সুলতান সালাহুদ্দীন বলেছিলেন, গাদ্দারী আমাদের রীতিতে পরিণত হতে চলেছে। আর আমি দেখতে পাচ্ছি যে, আমাদের মধ্যে আরও একটি রীতি এই চালু হতে যাচ্ছে যে, জাতির একটি গোষ্ঠী শাসন করবে আর অন্যরা শাসিত হবে। শাসক গোষ্ঠীটি জনগণের সম্পদকে মদের স্রোতে ভাসিয়ে দেবে আর জনগণ এক ঢোক পানিও পান করতে পারবে না। আমার ভাই ঠিকই বলেছেন যে, আমাদের জাতি ও ধর্মের ভবিষ্যতের প্রতি দৃষ্টি রাখতে হবে। আমাদের জনগণের মধ্যে আত্মমর্যাদাবোধ ও সচ্চরিত্রতা সৃষ্টি করতে হবে। এর জন্যে আমাদের কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে সামনে অগ্রসর হতে হবে। এই সঠিক পদক্ষেপ জাতির গুটিকতক মানুষের জন্য ক্ষতিকর হলেও পরোয়া করা যাবে না। জাতির গুটিকতক মানুষের জন্য আমরা গোটা জাতির মর্যাদাকে বিসর্জন দিতে পারি না। জাতির একটি অংশকে আমরা কেবল এই জন্য দুশমনের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের হাতে সোপর্দ করতে পারি না যে, সেখানকার মানুষের চেতনায় আঘাত আসবে। আপনারা দেখতে পাচ্ছেন যে, সেখানকার মানুষগুলো সরল-সহজ ও অশিক্ষিত। তাদের সমাজপতিরা দুশমনের ক্রীড়নকে পরিণত হয়ে তাদেরকে বিভ্রান্ত করছে।

সভাসদদের কারুর এই কল্পনাও ছিল না যে, তকিউদ্দীনের দৃষ্টিভঙ্গি এত কঠোর। তার সিদ্ধান্ত এত কঠিন হবে। তার উপস্থাপিত যুক্তি-প্রমাণের বিরুদ্ধে কেউ টু-শব্দটি করার সাহস পেলেন না। তিনি বললেন, মিসরে এখন যে বাহিনী আছে, তারা যুদ্ধফেরত সৈনিক। এর আগেও তারা লড়াই করেছে। এ বাহিনীর পাঁচশ অশ্বারোহী, দুইশ উষ্ট্রারোহী এবং পাঁচশ পদাতিক সৈন্য আজ সন্ধ্যায় সেই অঞ্চল অভিমুখে রওনা করিয়ে দিন। এই বাহিনী সন্দেহজনক প্রাসাদ থেকে এতটুকু ব্যবধানে অবস্থান করবে যে, প্রয়োজনে যেন সাথে সাথে তারা প্রাসাদ অবরোধ করে ফেলতে পারে। আমার সাথে দামেশক থেকে যে দুশ সাওয়ার এসেছে, তারা এলাকায় প্রবেশ করে প্রাসাদের উপর আক্রমণ চালাবে। একটি কমান্ডো দল প্রাসাদের অভ্যন্তরে ঢুকে যাবে। দুশ অশ্বারোহী প্রাসাদ অবরোধ করে রাখবে। যদি বাইরে থেকে আক্রমণ আসে কিংবা যদি সংঘাত হয়, তাহলে বাহিনীর বড় অংশটি তার মোকাবেলা করবে এবং অবরোধ সংকীর্ণ করতে থাকবে। এই অভিযানে বাহিনীকে কঠোরভাবে নির্দেশ দিয়ে রাখবে, যেন তারা কোন নিরস্ত্রের উপর আঘাত না করে।

তকিউদ্দীন এ সিদ্ধান্ত ঘোষণার পরপরই সেনাকর্মকর্তাগণ বাহিনীর রওনা হওয়া, আক্রমণ ও অবরোধ প্রভৃতির পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনার প্রস্তুতির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

***

মিসরের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে অবহিত নন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী। কার্ক ও শোবকের মধ্যবর্তী এলাকার মাইলের পর মাইল বিস্তৃত মরু অঞ্চলে খৃস্টানদের নয়া যুদ্ধ পরিকল্পনা মোতাবেক নিজের বাহিনীকে প্রস্তুত ও বিন্যস্ত করছেন তিনি। গুপ্তচররা তাকে রিপোর্ট দিয়েছিল যে, দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে খৃস্টানরা দুর্গের বাইরে এসে আক্রমণ চালাবে। তাদের এ বাহিনীর সৈন্যরা থাকবে অধিকাংশ বর্মপরিহিত। তারা সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর বাহিনীকে মুখোমুখী লড়াইয়ে বাধ্য, করার চেষ্টা করবে। একদল হামলা চালাবে পেছন দিক থেকে।

নিজের বাহিনীকে দূর-দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে দেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী। তিনি সর্বপ্রথম যে কাজটি করলেন, তাহল, যে কটি স্থানে পানি ও গাছ-গাছালি ছিল, তার সব কটি এলাকা তিনি দখলে নিয়ে নেন। জায়গাগুলোর নিয়ন্ত্রণ বহাল রাখার জন্য তিনি বড় বড় ধনুকধারী তীরন্দাজদের সেসব স্থানে পাঠিয়ে দেন। স্থাপন করলেন অগ্নিগোলা নিক্ষেপকারী মিনজানিক। এসব আয়োজনের উদ্দেশ্য, যাতে শত্রু কাছে আসতে না পারে। আশপাশের উঁচু জায়গাগুলোও দখল করে নেন তিনি। সব কটি বাহিনীকে তিনি নির্দেশ দেন, দুশমন যদি সম্মুখ দিক হতে হামলা করে, তাহলে যেন তারা আরো ছড়িয়ে পড়ে, যাতে দুশমনও বিক্ষিপ্ত হতে বাধ্য হয়। তিনি তার সৈন্যদের এমনভাবে বিন্যস্ত করলেন যে, দুশমন বুঝতেই পারেনি, মুসলিম বাহিনীর পার্শ্ব কোন দিক্ আর পেছন কোন্ দিক।  

বাহিনীর বড় একটা অংশ রিজার্ভ রেখে দেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী। একটা অংশকে তিনি এমনভাবে তৎপর রাখেন যে, প্রয়োজন হলেই যেন তারা সাহায্যের জন্য যথাস্থানে পৌঁছুতে পারে। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর সবচে গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট হল কমান্ডো বাহিনী। তদপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা বিভাগ, যারা খৃস্টানদের যে কোন তৎপরতার সংবাদ পৌঁছিয়ে দেবে সুলতানের কাছে।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী শোবক দুর্গ জয় করে নিয়েছেন আগেই। খৃস্টানদের পরিকল্পনার একটি ছিল এই যে, পরিস্থিতি অনুকুলে এসে গেলে অবরোধ করে তারা শোবক পুনর্দখল করবে। তাদের আশা ছিল, তাদের এই বিপুল সৈন্য সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর স্বল্পসংখ্যক সৈন্যকে মরুভূমির তপ্ত বালুতেই নিঃশেষ করে ফেলতে কিংবা এতটুকু দুর্বল করে দিতে সক্ষম হবে যে, তারা বাইরে থেকে শোবককে সাহায্য দিতে পারবে না।

তাদের এই পরিকল্পনার প্রেক্ষিতে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী শোবকের সেই দিকটিকে শূন্য করে ফেলেন, যেদিক থেকে খৃস্টানরা দুর্গের উপর আক্রমণ করার সম্ভাবনা আছে। পথ পরিস্কার দেখে খৃস্টানরা যাতে শোবক আক্রমণে এগিয়ে আসে, তার জন্য সুযোগ করে দেন সুলতান। সেদিক থেকে তিনি পর্যবেক্ষণ চৌকিগুলোও প্রত্যাহার করে নেন এবং দূর-দূরান্ত পর্যন্ত এলাকা খালি করে দেন।

খৃস্টান গুপ্তচররা সাথে সাথে কার্কে সংবাদ পৌঁছিয়ে দেয় যে, সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী খৃস্টানদের সাথে লড়াই করতে তার বাহিনীকে শোবক থেকে দূরে এক স্থানে সমবেত করেছে এবং শোবকের রাস্তা খালি করে দিয়েছে। এই সংবাদ পেয়ে খৃস্টানরা তাদের বাহিনীকে- যাদেরকে সুলতান আইউবীর উপর সম্মুখ থেকে আক্রমণ পরিচালনা করার জন্য রওনা করা হয়েছিল- নির্দেশ প্রদান করে, যেন তারা গতি পরিবর্তন করে শোবকের দিকে চলে যায়। নির্দেশমত বাহিনীটি শোবকের পথ ধরে অগ্রসর হতে শুরু করে। তাদের পেছনে পেছনে আসছে বিপুল রসদবাহী কাফেলা। শোবকের চার মাইল দূরে থাকতেই কাফেলা যাত্রাবিরতি দেয় এবং অস্থায়ী ছাউনী ফেলে সেখানেই অবস্থান গ্রহণ করে। রসদবাহী হাজার হাজার ঘোড়া-গাড়ী ও উট খচ্চর এখনো এসে পৌঁছায়নি। কোন শংকা নেই তাদের মনে। কারণ, দূর-দূরান্ত পর্যন্ত মুসলিম বাহিনীর নাম-চিহ্নও দেখছে না তারা।

.

আনন্দে উৎফুল্ল খৃস্টান সম্রাটগণ। শোবক দুর্গকে তারা তাদের পদানত দেখছে। কিন্তু রাতে পাঁচ-ছয় মাইল দূরের আকাশটা হঠাৎ লাল হয়ে গেছে দেখতে পায় তারা। একদিক থেকে ছুটে গিয়ে আকাশ লাল করে অপর একদিকে গিয়ে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে অসংখ্য অগ্নিশিখা। কি হল দেখে আসার জন্য অশ্বারোহী ছুটায় খৃস্টানরা। তাদের রসদবাহী কাফেলা শেষ হয়ে গেছে সব। ঘটনাস্থলে পৌঁছে অশ্বারোহী দলটি দেখতে পায়, লাগামহীন ঘোড়া আর দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য উট-খচ্চরগুলো ইতস্ততঃ ছুটাছুটি করছে মরুভূমিতে।

এ ধ্বংসযজ্ঞ সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর একটি কমান্ডো বাহিনীর কৃতিত্ব। খৃষ্টানদের রসদের মধ্যে ঘোড়ার খাদ্য হিসেবে শুকনো খড় বোঝাই ছিল অসংখ্য ঘোড়াগাড়ী। রসদ-ক্যাম্পে চারদিকে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল সেগুলো। খৃস্টানদের মুখে বিজয়ের আগাম হাসি। তাদের প্রতিটি পদক্ষেপের উপর যে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর সতর্ক দৃষ্টি বিদ্যমান, সে খবর তাদের নেই। রাতে যখন রসদ ক্যাম্পের সবাই নিশ্চিন্ত ঘুমিয়ে পড়ে, তখন এই মুসলিম কমান্ডো বাহিনীটি শুকনো ঘাসের উপর আগুনের সলিতা বাঁধা তীর ছুঁড়ে। সাথে সাথে ঘাসে দাউ দাউ করে আগুন ধরে যায়। মুহর্তের মধ্যে আগুনের বেষ্টনীতে পড়ে যায় গোটা ক্যাম্প। অবরুদ্ধ মানুষগুলো প্রাণরক্ষা করার উদ্দেশ্যে এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করতে শুরু করলে তাদের উদ্দেশ্যে তীর ছুঁড়ে কমান্ডে সেনারা। যেসব পশু রশি ছিঁড়ে পালাতে সক্ষম হয়, সেগুলো প্রাণে বেঁচে যায়। আর যারা রশি ছিঁড়তে পারেনি, সেগুলো জীবন্ত পুড়ে ছাই হয়ে যায়। জাহান্নামে পরিণত হয় বিশাল ক্যাম্পটি। সম্ভব পরিমাণ উট-ঘোড়া ধরে নিয়ে পালিয়ে যায় কমান্ডোরা।

ভোরবেলা রসদ-ক্যাস্প পরিদর্শন করে খৃস্টান কমান্ডোরা। কিছুই নেই, জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে গেছে সব। ধ্বংস হয়ে গেছে তাদের এক মাসের রসদ। তারা বুঝে ফেলে, শোবকের পথ পরিস্কার থাকা ছিল সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর একটি কৌশল। কার্ক থেকে শোবক পর্যন্ত পথটা তাদের জন্য মোটেও নিরাপদ নয়, তাও বুঝে ফেলে তারা। তাই তারা শোবক অবরোধের পরিকল্পনা মুলতবী করে দেয়। রসদ ছাড়া দুর্গ অবরোধ ছিল অসম্ভব। আর যখন তারা সংবাদ পেল যে, গত রাতে তাদের সেই বাহিনীর রসদও ধ্বংস হয়ে গেছে যারা আইউবীর বাহিনীর উপর সম্মুখ থেকে আক্রমণ করতে যাচ্ছিল, তখন তারা পুরো পরিকল্পনাই পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন অনুভব করে। কোথাও সুলতান বাহিনীর কোন সৈন্য চোখে পড়ছিল না তাদের। তাদের গুপ্তচররাও জানাতে পারেনি যে, সুলতানের সৈন্য সমাবেশ কোথায়। মূলত ছিলও না কোথাও।

.

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী সংবাদ পান, উভয় যুদ্ধক্ষেত্রেই খৃস্টানরা তাদের অগ্রযাত্রা স্থগিত করে দিয়েছে। তিনি তার কমান্ডারকে ডেকে বললেন, খৃস্টানরা যুদ্ধ মুলতবী করে দিয়েছে, কিন্তু আমাদের যুদ্ধ বন্ধ হবে না। তারা যুদ্ধ মনে করে দুবাহিনীর মুখোমুখি সংঘাতকে। আর আমাদের যুদ্ধ হল কমান্ডো আর গেরিলা আক্রমণ। এখন গেরিলা বাহিনীকে তৎপর রাখ। খৃস্টানরা উভয়দিক থেকেই পেছনে সরে যাচ্ছে। তাদেরকে তোমরা শান্তিতে কেটে পড়তে দিও না। পেছন থেকে, পার্শ্ব থেকে কমান্ডো হামলা চালাও। খৃস্টানরা আমাদেরকে মুখোমুখি নিয়ে লড়াই করতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি তাদেরকে আমার পছন্দসই এমন জায়গায় মুখোমুখি নিয়ে আসব, যেখানে বালুকণাটিও আমাদের সহযোগিতা করবে। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর কোন ঠিকানা নেই। আমলা-রক্ষীবাহিনীর সাথে তিনিও যাযাবর। কোন এক স্থানে স্থির থাকছেন না বলে মনে হচ্ছে। সব জায়গায়ই আছেন তিনি।

***

মিসরে খৃস্টানদের অপর যুদ্ধক্ষেত্রের উপর আক্রমণ করতে যাচ্ছেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর ভাই তকিউদ্দীন। এটি মিসরের দক্ষিণ-পশ্চিমের পার্বত্য এলাকার ফেরাউনী আমলের সেইসব ভয়ংকর প্রাসাদ, যেখানে হযরত ঈসা (আঃ) আকাশ থেকে অবতরণ করবেন বলে মানুষের বিশ্বাস। নতুন এক বিশ্বাসের অনুসারী হয়ে গিয়েছিল যে এলাকার সব মানুষ।

এক বৃহস্পতিবারের সন্ধ্যাবেলা। শতশত দর্শনার্থী গুহাসদৃশ দরজা অতিক্রম করে প্রবেশ করছে প্রাসাদের ভিতরে। ভেতরের বৃহৎ কক্ষটিতে গুঞ্জরিত হচ্ছে রহস্যময় কণ্ঠস্বর। নেক-বদ নির্বিশেষে সব মানুষই বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের ন্যায় ঢুকে যাচ্ছে ভেতরে। হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যায় রহস্যময় সেই দরবেশের কণ্ঠস্বর, যার ব্যপারে জনশ্রুতি ছিল যে, বদকার মানুষ তার সাক্ষাৎ পায় না। তার স্থলে ভেসে এল আরেকটি কণ্ঠস্বর- লোক সকল! আজ রাতে তোমরা কেউ ঘরে যেও না। কাল সকালে তোমাদের সম্মুখে সেই রহস্য ফাঁস হয়ে যাবে, যার জন্য তোমরা উদগ্রীব হয়ে আছ। এক্ষুণি তোমরা এখান থেকে বের হয়ে যাও। হযরত ঈসা (আঃ) আগমন করছেন। এ প্রাসাদ থেকে বের হয়ে দূরে কোথাও গিয়ে তোমরা শুয়ে পড়।

ইতিপূর্বে বড় কক্ষের দেয়ালে যেসব উজ্জ্বল তারকা ভেসে উঠত, আজ তা মন্দীভূত। দৃশ্যে যেসব রূপসী তরুণী আর সুদর্শন পুরুষ হেসে-খেলে ভেসে বেড়াত, এবার দেখা গেল সিপাহীর মত একদল মানুষ তাদের ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। চিৎকারের শব্দও ভেসে আসছে মাঝে-মধ্যে। বন্ধ হয়ে গেছে মেঘের গর্জন, বিদ্যুতের চমক। এলাকাবাসীর চোখে যে স্থানটি ছিল অতিশয় পবিত্র, সেটি এখন ভয়ংকর এক স্বপ্নপুরী। ভয়ার্ত মানুষগুলো অল্পক্ষণের মধ্যে হুড়মুড় করে বেরিয়ে যায়। শূন্য হয়ে যায় প্রাসাদ।

এ বিপ্লব সাধন করেছেন তকিউদ্দীন ও আলী বিন সুফিয়ান। তকিউদ্দীনের প্রেরিত সৈন্যরা সন্ধ্যার পর গিয়েছিল পার্বত্য এলাকার সন্নিকটে। তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে আসছে শারজা। শারজা অশ্বারোহী। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সৈন্যদের পার্বত্য এলাকায় নিয়ে আসে মেয়েটি। প্রতি সপ্তাহে এইবারে এখানে মেলা বসে এবং দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন ছুটে আসে। বাহিনীর বড় অংশটিকে- যাতে আছে দুশ অশ্বারোহী, দুশ উষ্ট্রারোহী আর পাঁচশ পদাতিক দাঁড় করিয়ে রাখা হয় খানিক দূরে। সুদানের সীমান্তের উপর নজর রাখা তাদের দায়িত্ব। অসামরিক লোকদের উপর আক্রমণ করতে নিষেধ করে দেয়া হয়েছে তাদের। প্রাসাদের নাশকতামূলক তৎপরতা যেহেতু পরিচালিত হচ্ছিল খৃস্টান ও সুদানীদের পৃষ্ঠপোষকতায়, তাই সেখানে সামরিক অভিযান পরিচালিত হলে সুদানীদের পক্ষ থেকে হামলা আসার আশংকা ছিল প্রবল।

তকিউদ্দীনের সাথে দামেশক থেকে এসেছিল বাছা বাছা দুশ দুসাহসী অশ্বারোহী। ধাবমান ঘোড়ার পিঠ থেকে লক্ষ্যভেদী তীর নিক্ষেপ করা তাদের একটি বিশেষ গুণ। পদাতিক বাহিনীতে আছে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর নিজ হাতে গড়া বেশকিছু দুর্ধর্ষ কমান্ডো। তাদের এমন প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল যে, অতীব দুর্গম টিলা পর্বত ও বিশাল বিশাল গাছে অবলীলায় উঠানামা করতে পারে তারা। কয়েক গজ বিস্তৃত জ্বলন্ত আগুনের মধ্যদিয়ে আক্রমণ করা তাদের জন্য সাধারণ ব্যাপার।

দর্শনার্থীরা যখন দলে দলে প্রাসাদে প্রবেশ করছিল, ঠিক তখন প্রাসাদ অভিমুখে রওনা করা হয় এই জানবাজ কমান্ডোদের। সে পর্যন্ত নিয়ে যায় তাদের শারজা। সাথে তাদের আলী বিন সুফিয়ান। সাথে আছে তাদের দ্রুতগামী দূত, যাতে বার্তা পৌঁছাতে সময় না লাগে। প্রাসাদের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে দুজন লোক। ভেতরে গমনকারীদের তিনটি করে খেজুর আর পানি খাওয়াচ্ছে তারা। দরজা অতিক্রম করে ভেতরে প্রবেশ করলেই ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। বাইরে জ্বলছে ক্ষীণ আলোর একটি প্রদীপ।

দর্শনার্থীদের সাথে প্রাসাদের ফটকের নিকট পৌঁছে যায় ছয়জন লোক। সবার মাথা চাদর দিয়ে ঢাকা। ভেতরে গমনকারীদের খেজুর খাওয়াচ্ছে যে চারজন, ভিড় এড়িয়ে তাদের পেছনে গিয়ে দাঁড়ায় তারা। তাদেরকে সম্মুখ দিয়ে যেতে বলা হয়; কিন্তু কারো কথায় কর্ণপাত নেই তাদের। উল্টো দুজনের পিঠে খঞ্জরের আগা ঠেকিয়ে কানে কানে বলে, বাঁচতে হলে এখান থেকে সরে যাও। এ মুহূর্তে তোমরা সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর ঘেরাওয়ে রয়েছ। তারা ছয়জন কমান্ডো সদস্য।

টু-শব্দটি না করে সরে যায় তোক দুজন। উপস্থিত জনতাকে না দেখিয়ে নিজ নিজ চোগার পকেটে খঞ্জরগুলো লুকিয়ে ফেলে কমান্ডোরা। বাইরে ছদ্মবেশে দাঁড়িয়ে আছে আরো দশ-বারোজন কমান্ডো। ছয় কমান্ডোর হুমকির মুখে চার ব্যক্তি যেইমাত্র বাইরে বেরিয়ে আসে, অমনি তাদের ঘিরে ফেলে ছদ্মবেশী দশ-বারোজনের কমান্ডো দলটি। কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে তাদের টেনে-হেঁচড়ে নিয়ে যায় দূরে। সেখানে রশি দিয়ে বেঁধে ফেলা হয় তাদের। খেজুরের কূপ ও পানির মশকের নিকট দণ্ডায়মান ছয় কমান্ডো ভেতরে গমনকারী জনতাকে বলতে শুরু করে, আপনারা আজ খেজুর পানি ছাড়াই ভেতরে ঢুকে পড়ুন। ভেতর থেকে নতুন পয়গাম এসেছে। কোন উচ্চবাচ্য না করে জনতা ভেতরে প্রবেশ করতে শুরু করে।

এবার আম-জনতার সাথে কমান্ডো সদস্যও ভেতরে ঢুকতে শুরু করে। ঢুকছে বাতি-প্রদীপ। অন্তত পঞ্চাশটি বাতি ও দুশ কমান্ডো ভেতরে ঢুকে যায়। আলোকিত কক্ষে না গিয়ে তারা চলে যায় অন্ধকার সরুপথ ও ছোট কক্ষে- বাইরের মানুষ যেখানে ইতিপূর্বে যায়নি কখনো। তাদের কারো কাছে খঞ্জর, কারো নিকট তরবারী, কারো হাতে ছোট ছোট তীর-ধনুক। যে পথে জনতা বাইরে বের হত, সে পথেও ঢুকে পড়ে কমান্ডোরা। নির্দেশনা মোতাবেক আঁকাবাঁকা সরু গলিপথে ঢুকে পড়ে তারা।

সম্মুখে এগিয়ে আসে তকিউদ্দীনের দুশ অশ্বারোহী। তারা প্রাসাদ এলাকাটি ঘিরে ফেলে। পদাতিক বাহিনীও আছে তাদের সাথে। ভেতর থেকে বহির্গমনকারীদের একদিকে একত্রিত করতে শুরু করে তারা। মশালধারীদের পেছনে পেছনে ভিতরে প্রবেশ করার পর কমান্ডোদের কাছে মনে হল, যেন তারা কারো উদরে চলে এসেছে। সরুপথ অতিক্রম করে করে তারা এমন এক স্থানে গিয়ে উপনীত হয়, সেখানকার দৃশ্য দেখে কমান্ডোরা থমকে দাঁড়ায়।

.

একটি খোলামেলা কক্ষ। ছাদটি বেশ উঁচু। ভেতরে অনেক নারী আর পুরুষ। তাদের কারো কারো চেহারা বাঘের ন্যায় ভয়ংকর। অনেকের চেহারা এতই বীভৎস ও ভয়ংকর যে, দেখলে ভয়ে দেহের লোম দাঁড়িয়ে যায়। দেখতে তাদের জিন-ভূতের ন্যায় মনে হয়। তাদের মাঝে চকমকে পোশাক পরিহিত কিছু সুন্দরী যুবতী হাসছে খেলছে। একদিকে দেয়ালের সাথে কয়েকটি রূপসী মেয়ে কয়েকজন সুদর্শন পুরুষের সাথে ঠাট করে হেঁটে যাচ্ছে। অপরদিকে ছাদ থেকে মেঝে পর্যন্ত দীর্ঘ একটি পর্দা ঝুলে আছে। পর্দাটা ডানে-বাঁয়ে নড়াচড়া করছে এবং একবার খুলে যাচ্ছে আবার বন্ধ হচ্ছে। আরেক দিকে চোখ ঝলসানো আলো জ্বলছে আর নিভছে।

কমান্ডোদের যদি নিশ্চিতভাবে জানানো না হত যে, প্রাসাদে যাকেই দেখবে, যেমন আকৃতিই চোখে পড়বে, সকলেই মানুষ এবং সেখানে ভূত-প্রেত বলতে কিছু নেই; তাহলে ভয়ে তারা সেখান থেকে নির্ঘাত পালিয়ে যেত। সেখানকার সুন্দরী মেয়ে আর সুদর্শন পুরুষগুলোও ভয়ংকর বলে মনে হচ্ছিল তাদের কাছে। কমান্ডোদের দেখে অদ্ভুত এই প্রাণীগুলো ভীতি সৃষ্টির জন্য ভয়ংকর শব্দ করতে শুরু করে দিয়েছিল। বাঘের চেহারার বীভৎস লোকগুলোর শব্দ ছিল বেশী ভীতিকর। এ সময়ে সম্ভবত ভয়ে দুতিনজন লোক তাদের মুখোশ খুলে ফেলে। তাদের চেহারা ছিল বাঘের ন্যায়। ব্যাঘের মুখোশ খুলে ফেলার পর ভেতর থেকে আসল মানবাকৃতি বেরিয়ে আসে তাদের।

কমান্ডোরা ঘিরে ধরে ফেলে তাদের সকলকে। মুখোশ খুলে ফেলে সব কজনের। নিয়ে যাওয়া হল বাইরে।

অনুসন্ধান চালানো হল প্রাসাদের অন্যত্র। পাকড়াও করা হল এক ব্যক্তিকে। লোকটি একটি সরু সুড়ঙ্গের মুখে মুখ রেখে বলছে, তোমরা গুনাহ থেকে তওবা কর। হযরত ঈসা (আঃ) এসে গেছেন বলে…। এ সুড়ঙ্গ পথটি এঁকেবেঁকে চলে গেছে সেই আলোকময় কক্ষে যেখানে দর্শনার্থীদের এসব রহস্যময় ভয়ংকর ও সুদর্শন দৃশ্যাবলী প্রদর্শন করে লোকদের অভিভূত করা হয়। লোকটিকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে কমান্ডো বাহিনীর এক কমান্ডার সুড়ঙ্গে মুখ রেখে বলে, লোক সকল! আজ রাতে তোমরা ঘরে ফিরো না। কাল সকালে তোমাদের সামনে সেই রহস্য উন্মোচিত হবে, তোমরা যার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছ।

কমান্ডোদের সাথে সংঘাতে আসেনি প্রাসাদের কেউ। কমান্ডোদের খঞ্জর ও তরবারীর সামনে গ্রেফতারির জন্য নিজেদের সমর্পণ করে একে একে সকলে। গ্রেফতারকৃতদের নির্দেশনা মোতাবেক কমান্ডোরা সেসব জায়গায় পৌঁছে যায়, যেখানে বিজলীর ন্যায় উজ্জ্বল আলোর ব্যবস্থা ছিল। ছিমছাম নিরাপদ একটি স্থানে কতগুলো বাতি জ্বলছে। বাতিগুলোর পেছনে কতগুলো কাঠের তক্তা। তক্তাগুলো শীশার মত পাত করা। এই শীশার চমকই মানুষের চোখে গিয়ে পড়ত। কক্ষটিকে অন্ধকার করার জন্য বাতিগুলো নিয়ে যাওয়া হত পেছনে। একদিকে ঝুলানো অনেকগুলো পর্দা। পর্দাগুলোর স্থানে স্থানে শীশার টুকরো আটকানো। এগুলোতে আলো পড়লেই ঝলমল করে উঠতো তারকার ন্যায়। তাছাড়া পর্দাগুলোর রঙও এমন যে, কারো বলার সাধ্য ছিল না যে এগুলো কাপড়। দেখলে মনে হয় ফাটা দেয়াল। বিবেকসম্পন্ন লোকদের কাছে এসব বিস্ময়কর কিছু নয়। এসব হল আলোর জাদু, যা সম্মোহিত করে ফেলত মানুষদের। কিন্তু যে-ই ভেতরে প্রবেশ করত, তার হুশ-জ্ঞান তার নিজের আয়ত্বে থাকত না। ভেতরে প্রবেশ করার সময় লোকদের যে খেজুর পানি খাওয়ানো হত, তাতে নেশাকর মিশ্রণ থাকত। খাওয়ার পর সাথে সাথে তার ক্রিয়া শুরু হয়ে যেত। ফলে দর্শনার্থীদের মন-মস্তিষ্কে যে ধারণা এবং কানে যে শব্দই দেয়া হত, তাদের কাছে তা শতভাগ সঠিক বলে মনে হত। সে নেশার প্রতিক্রিয়ায়ই মানুষ বাইরে বের হয়ে পুনরায় প্রাসাদের ভেতরে প্রবেশ করার জন্য উদগ্রীব হয়ে যেত। তারা জানত না যে, এটি তাদের বিশ্বাসের ক্রিয়া নয়; এটি সেই নেশার ক্রিয়া, যা তাদের খেজুর ও পানির সাথে মিশিয়ে খাওয়ানো হত।

খেজুরের স্তূপ আর পানির মশকগুলোও কজা করে নেয় কমান্ডোরা। ধর-পাকড় অব্যাহত থাকে ভেতরে। বাইরে সমগ্র প্রাসাদ এলাকাটি অবরোধ করে আছে দুশ সৈন্য। সর্বত্র মশালের আলো। ফৌজের বৃহৎ অংশটি এবং দুটি সীমান্ত ইউনিট টহল দিচ্ছে সুদানের সীমান্ত এলাকায়।

.

রাত কেটে গেছে। সুদানের দিক থেকে কোন হামলা আসেনি। সংঘাত হয়নি প্রাসাদেও। সর্বত্র ভীত-সন্ত্রস্ত এলাকাবাসীর ভীড়। রাতে এদিক-ওদিক ঘুমিয়েছিল অনেকে। তাদের অবরোধ করে রেখেছে অশ্বারোহী বাহিনী।

***

কিছুক্ষণ পর একস্থানে একত্রিত করে বসিয়ে দেয়া হয় জনতাকে। সংখ্যায় তারা তিন থেকে চার হাজার। একদিক থেকে এক পাল লোককে হাঁকিয়ে নিয়ে আসে সেনারা। এরা সকলে ব্যাঘ্রের মুখোশপরা মানুষ। কুৎসিত ও ভয়ানক এদের আকৃতি। এরা সেইসব লোক, প্রাসাদের ভেতরে জনতাকে যাদের প্রদর্শন করা হত আর বলা হত এরা পাপিষ্ঠ। কৃত অপরাধের সাজা ভোগ করছে এরা। এদের অপরাধ ছিল, এরা যুদ্ধ-বিগ্রহে অভ্যস্ত ছিল। অর্থাৎ এরা মুজাহিদ।

তারপর দশ-বারটি মেয়েকেও নিয়ে আসা হয় জনতার সম্মুখে। এরা অত্যন্ত রূপসী যুবতী। এদের সাথে আছে বেশকজন সুদর্শন পুরুষ।

জনতার ভীড়ের সামনে একটি উঁচু স্থানে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয় এ দল দুটিকে। মুখোশ খুলে জনতার সামনে আসল রূপ প্রদর্শন করার নির্দেশ দেয়া হয় তাদের। সাথে সাথে বাঘের কৃত্রিম চেহারা খুলে ফেলে তারা। স্বাভাবিক মানবাকৃতির বেরিয়ে আসে তার ভেতর থেকে।

জনতাকে নির্দেশ দেয়া হয়, তোমরা কাছে এসে দেখ এদের চেন কিনা। নির্ভয়ে তাদের নিকটে যায় জনতা। চোখ বুলিয়ে দেখে সবাইকে। দেখে তারা হতভম্ব। কোথাকার এরা আকাশের প্রাণী! এরা দেখছি সকলেই আমাদের চেনা-জানা পরিচিত। সকলেই তাদের এলাকার মানুষ। এ খৃস্টান চক্রটির উদ্দেশ্য, মুসলমানদের মধ্যে এই বিশ্বাস সৃষ্টি করা যে, সেনাবাহিনীতে ভর্তি হওয়া অন্যায় কাজ। যুদ্ধ করা মস্ত বড় পাপ। এ উদ্দেশে চক্রটি সম্পূর্ণ সফল। এ এলাকার লোকদের মনে সুদানীদের প্রতি সমর্থন সৃষ্টিতেও সফল হয়েছে এ চক্রটি। ধর্ম পরিবর্তন না করেই তাদের ধর্মহীণ করে তুলেছে তারা।

জনতাকে বলা হল, এবার তোমরা প্রাসাদে ঢুকে অবলীলায় ঘুরে-ফিরে দেখ এবং খৃস্টান কুচক্রীদের ষড়যন্ত্র-প্রতারণার প্রমাণ স্বচক্ষে দেখে আস। মানুষ দলে দলে ভেতরে ঢুকে পড়ে। স্থানে স্থানে দাঁড়িয়ে আছে সেনারা। এখানে জনতাকে কিভাবে প্রতারিত করা হয়েছিল, সেনারা তার বিবরণ দেয়।

দীর্ঘ সময় পর্যবেক্ষণ করে জনতা বাইরে বেরিয়ে এলে তকিউদ্দীন তাদের উদ্দেশে ভাষণ দান করেন। ভাষণে তিনি জানান, প্রাসাদে প্রবেশ করার সময় আপনাদের যে খেজুর ও পানি দেয়া হত, তার সাথে আপনাদের নেশা মিশিয়ে খাওয়ানো হত। ভেতরে যে জান্নাত-জাহান্নাম দেখানো হত, তা নেশার ক্রিয়ায় আপনাদের দৃষ্টিগোচর হত। এই কুচক্রীদের বলুন, ভেতরে গিয়ে তোমরা দেখাও হযরত মূসা (আঃ) কোথায় এবং মৃত খলিফা আল আজেদই বা কোথায়। এসব ছিল প্রতারণা। এ সেই নেশা, যা খাইয়ে হাশীশীদের গুরু হাসান ইবনে সাব্বাহ মানুষদের জান্নাত প্রদর্শন করত। সে তো একসময়ে কয়েকজন মানুষকে নেশা খাওয়াত মাত্র। আর এখানে ইসলামের এই দুশমনরা বিশাল একটি অঞ্চলের বাসিন্দাদের মাতাল করে তুলেছে।

জনতার সামনে ঘটনার আসল চিত্র তুলে ধরে তকিউদ্দীন বললেন, প্রথমে আপনাদেরকে একজন দরবেশের কাহিনী শোনানো হয়েছিল, যে পথিকদের উষ্ট্র ও স্বর্ণমুদ্রা দান করত। তা ছিল নিছক ভিত্তিহীন গুজব। যারা আপনাদেরকে এসব কাহিনী শোনাত, তারা ছিল ইসলামের দুশমনদের দালাল, খৃস্টানদের মদদপুষ্ট।

তকিউদ্দীনের ভাষণের পর উত্তেজিত হয়ে উঠে জনতা। ক্ষিপ্ত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে কুচক্রীদের উপর। ততক্ষণে রাতের নেশা কেটে গেছে তাদের। বিক্ষুব্ধ জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে সেনারা। কিন্তু গ্রেফতারকৃত সকল কুচক্রী ও মেয়েদের প্রাণে মেরেই তবে ক্ষান্ত হয় জনতা।

এলাকায় সেনাবাহিনী ছড়িয়ে দেন তকিউদ্দীন। দুশমনের দালালদের খুঁজে খুঁজে গ্রেফতার করে তারা। কায়রোর হক্কানী আলেমদের ইমাম নিযুক্ত করা হয় মসজিদগুলোতে। ধর্মীয় ও সামরিক তালিম-তরবিয়ত শুরু করে দেয়া হয় ফেরাউনী আমলের পরিত্যক্ত প্রাসাদগুলোতে।

.

কায়রো ফিরে গিয়ে দুটি কাজ আঞ্জাম দেন তকিউদ্দীন। প্রথমত, ডাক্তার শারজাকে বিবাহবন্ধনে আবন্ধ করলেন, যা ছিল শারজার মনের ঐকান্তিক কামনা। দ্বিতীয়ত সেনাবাহিনীর কেন্দ্রীয় কমান্ডোকে সুদান আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দেন। প্রাসাদ অভিযানে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, প্রতিবেশী রাষ্ট্র সুদান মিসরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে এমনভাবে তাদের প্রভাব-বলয়ে নিয়ে নিয়েছে যে, প্রচণ্ড সামরিক অভিযান ছাড়া তা প্রতিহত করা সম্ভব নয়। তিনি আরো তথ্য পেয়েছিলেন যে, সুদানীরা খৃস্টানদের ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছে এবং তারা যথারীতি মিসর আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাই তার আগেই সুদান আক্রমণ করা অত্যাবশ্যক বলে সিদ্ধান্ত নেন তিনি। তাতে সুদানের কোন এলাকা দখলে আসুক বা না আসুক এতটুকু উপকার অবশ্যই হবে যে, দুশমনের আয়োজন লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে এবং তাদের পরিকল্পনা দীর্ঘ সময়ের জন্য পিছিয়ে যাবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *