৭. সত্যভবনে কর্নেল

০৭.

 সত্যভবনে কর্নেল পুলিশসুপার মুকেশ সিংয়ের সঙ্গে কথা বলছিলেন। অশনি দাশগুপ্তের মার্ডার-কেসের সূত্র এখনও মেলেনি। স্থানীয় ডিটেকটিভ দফতর কলকাতার লালাবাজারের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে। লালবাজারের রিপোর্ট আজই এসে যাবে সম্ভবত। মুকেশ সিংয়ের ধারণা, অশনিবাবু খবরের কাগজের রিপোর্টার ছিলেন–যখন তখন সম্ভবত কোন র‍্যাকেট অনুসরণ করে এখানে এসেই মারা পড়েন। এমন তো অনেক ঘটেছে বা ঘটছে। এখন এই র‍্যাকেটটা কিসের, তা তার কলিগ জয়ন্তবাবু অনুমান করলেও করতে পারেন।

জয়ন্ত বলল–ও তো পলিটিক্যাল করেসপন্ডেন্ট ছিল। পুলিশকে সেটা জানিয়েছি।

মুকেশ হেসে বললেন–হ্যা!কাজেই সাবধানে এগুতে হচ্ছে। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ না বেরোয়। কর্নেল! আমি ডিটেকটিভ ইনপেক্টর ব্রজলাল শর্মাকেও এখানে আসতে বলেছি। উনি এলে ডিটেলস্ পেয়ে যাবেন।..বলে একটু চোখ নাচালেন। ..তবে মিঃ শর্মা আবার প্রাইভেটদের নাক গলানো একদম পছন্দ করেন না!

কর্নেল হাসলেন।–তাই বুঝি?

–হ্যাঁ। তবে আপনি নিশ্চয় ব্যক্রিম। শর্মা আপনার নাম না শুনেছে, এমন হতেই পারে না।

–আচ্ছা মিঃ সিং, এখানে কাবাডিয়া-লাখোটিয়ার একটা কারখানা আছে না?

–হ্যাঁ। আছে। কেন বলুন তো?

কর্নেল ব্যাপারটা উড়িয়ে দেবার ভঙ্গিতে বললেন–এমনি। কাগজে পড়েছিলুম ওরা এখানে কী সব এক্সটেনশান করছে-টরছে। অতবড় কোম্পানি এসে গেছে যখন, তখন নিশ্চয় মোহনপুরের অবস্থা আরও জমজমাট হচ্ছে।

মুকেশ হাসলেন। তার মানে আমাদেরই বারোটা বাজছে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল টাউনের সবরকম খারাপ ব্যাপার দিনে দিনে বাড়ছে।

–ওরা এখানে কী প্রডাকশান করে?

–কাবাডিয়ারা? ইলেট্রনিক গুডস। এখানকার মাল কিন্তু বিশাখাপত্তনম আর কিছুটা বোম্বাই হয়ে বিদেশে যায়। কলকাতার কারখানার মাল কলকাতা থেকেই যায়।

এই সময় একটা জিপ এসে গেটে ঢুকল। মুকেশ বললেন শর্মা এসে গেছে!

জিপটা বাংলার গাড়িবারান্দা ঘেঁষে দাঁড়াল। মোটা নাদুসনুদুস এক ভদ্রলোক নামলেন। মুকেশের উল্টো বলা যায়। মুকেশ রোগা। উনি শুধু মোটা নন-ভূঁড়ি ও প্রকাণ্ড গোঁফ আছে। তেমনি বিশাল। সাদা শার্ট আর ঘিয়ে রঙের প্যান্ট পরনে। তার সঙ্গে আরও দুজন অফিসার নামলেন। তারা পুলিশের পোশাক পরে আছেন।

কর্নেল চাপা গলায় বলে উঠলেন–সর্বনাশ করেছেন কী মিঃ সিং! আপনাকে বললুম–আমি একটু প্রাইভেটলি ব্যাপারটা…..

মুকেশ বাধা দিয়ে বললেন–তাতে কী? আসুন, আসুন, মিঃ শর্মা! আজ আপনাদের সঙ্গ এক জিনিয়াসের পরিচয় করিয়ে দিই।

শর্মা হাত বাড়িয়ে দিলেন কর্নেলের দিকে। খুব খুশি হলুম কর্নেল সরকারের সঙ্গে পরিচিত হয়ে। এতকাল শুধু শুনেছি আর কাগজে পড়েছি! এবার…

কথাটা সম্পূর্ণ করে দিলেন মুকেশ। এবার হাতেনাতে দেখা যাক। কী বলেন?

সবাই হো হো করে হেসে উঠল। শর্মা এবং অফিসার দুজন বসলেন।

কর্নেলের সামনে টেবিলের ওপর বাইনোকুলার ছিল। হঠাৎ তাতে চোখ রেখে কিছু দেখতে থাকলেন। সবাই তক্ষুনি কথা বলা বন্ধ করল এবং তাকিয়ে রইল।

কর্নেল বাইনোকুলার নামিয়ে বললেন–আচ্ছা মিঃ সিং! ওই বাংলোটায় কে থাকে?

মুকেশ ঘুরে দেখে বললেন–ওই হলুদ রঙেরটা তো? ওই যে জঙ্গল মতো

–হ্যাঁ, হ্যাঁ।

–ওটা তো পোড়ো বাংলো। ভূতের উপদ্রব আছে বলে লোকে। মুঙ্গেরের এক রাজা ওর মালিক ছিলেন একসময়। আজকাল আর কেউ আসে বলে শুনিনি। সরকার ওটা দখল করেছিলেন। মামলা এখনও চলছে। তা হঠাৎ বাংলোর দিকে চোখ গেল যে?

–না। এমনি।

 শর্মা হাসতে-হাসতে বললেন–ভূত দেখলেন না তো দিনদুপুরে?

আবার সবাই হেসে উঠলেন। কর্নেলও। তারপর মুকেশ বললেন–যাকগে। এবার কিছু সিরিয়াস আলোচনা হোক। মিঃ শর্মা যখন এসে গেছেন। দেখুন। মিঃ শৰ্মা, এটা কোন ফর্ম্যাল বা সরকারি নির্দেশ নয়। তবে আমরা কর্নেল সরকারের মতো অভিজ্ঞ অপরাধতাত্ত্বিকের কাছে কিছু পরামর্শ নিতে পারি। কী বলেন?

শর্মা অমনি গম্ভীর হয়ে গেলেন।–অবশ্য অবশ্য। কিন্তু স্যার, এখনও কলকাতার রিপোর্ট আমি পাইনি।

কর্নেল বললেন–কোনরকম ফনেরসিক পরীক্ষার ব্যবস্থা কি হয়েছে?

–দেখুন কর্নেল, আমাদের মফঃস্বল শহরের এই এক সমস্যা। ওসব কোন সুযোগই নেই। তাছাড়া, কেসটা আমার মতে তত কিছু জটিল নয়। এখানে কিছুটা পলিটিকাল রাইভ্যালরি আছে। আমার মনে হচ্ছে একটা গোষ্ঠী অশনিবাবুকে কোন গোপন খবর দিতে ডেকে এনেছিল–অন্য গোষ্ঠীর তাই ব্যাপারটা মনঃপুত হয়নি।

মুকেশ বললেন–তাও সম্ভব। যদিও কোনটাই প্রমাণ করা যাচ্ছে না।

এই সময় কর্নেল আবার বাইনোকুলার তুললেন। তারপর উঠে দাঁড়ালেন। বললেন–স্ট্রেঞ্জ!

সবাই চমকে উঠলেন। শর্মা ও মুকেশ হেসে বললেন–ভূত নাকি?

–না। উড্ডাক।

শর্মা বললেন–উড্ডাক? সে আবার কী?

জলে যে হাঁস বেড়ায়, তা জলহাঁস। এ পাখি হাঁসই বটে, তবে জঙ্গলে থাকে। খুব দুর্লভ প্রজাতির পাখি।..কর্নেল আবার বাইনোকুলার তুলে মুগ্ধ কণ্ঠস্বরে বললেন–আমি ভাবিইনি! মোহনপুরে জনবসতির মধ্যে কিনা উড্ডাক! জয়ন্ত, ডার্লিং। আমার ক্যামেরাটা দ্রুত নিয়ে এস। বিছানায় আছে দেখবে। মিঃ সিং! মিঃ শর্মা! প্লিজ, এই বুড়োর বাঁচালতা ক্ষমতা করবেন! এ আমার জীবনের এক মহা শুভক্ষণ! উড্ডাক! পৃথিবী জুড়ে ন্যাচারালিস্ট আর তাবৎ অরনিথোলজিস্ট এই উড্ডাকের দেখা পাবার জন্যে বনে-জঙ্গলে হন্যে হয়ে বেড়াচ্ছে! আর এখানে আমার চোখের সামনে!

কর্নেলের কাণ্ড দেখে এদের চোখ ছানাবড়া। জয়ন্ত ক্যামেরা এনে দিলে বাঁহাতে সেটা নিয়ে এবং চোখে দূরদর্শন যন্ত্রটা রেখে বারান্দা থেকে অদ্ভুত ভঙ্গিতে নেমে গেলেন। তারপর গেট পেরিয়ে রাস্তায় রাস্তা থেকে বাঁদিকের ঘাসের জমিতে ঘাসের জমি ছেড়ে ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে ঢুকলেন।

এবার দেখা গেল উনি হুমড়ি খেয়ে বসে অদৃশ্য হলেন। মুকেশ সিং হাসতে হাসতে বললেন–বাতিক আর কাকে বলে! সেবার প্রতাপগড়ে কী একটা পাখির। খোঁজে তিনদিন তিনরাত্রি নাকি জঙ্গলে কাটিয়েছিলেন।

অতিথিদের চায়ের ব্যবস্থা করে এল জয়ন্ত। এইসময় কর্নেলকে আবার দেখা– গেল। সেই পোড়ো বাংলোর পশ্চিমের বারান্দায় পা টিপেটিপে চলেছেন। মিঃ শর্মা বললেন–জয়ন্তবাবু একটা কথা বলব।

জয়ন্ত বলল–নিশ্চয়। বলুন!

–এই বুড়ো ভদ্রলোকের সঙ্গে আপনার কতদিনের পরিচয়?

–কেন বলুন তো?

–নিছক প্রশ্ন, জয়ন্তবাবু।

জয়ন্ত হাসল।– বছর পাঁচেক আগে কলকাতার একটা স্পাই-রিং উচ্ছেদ করা হয়েছিল। শুনে থাকবেন। সেই খবর আনতে গিয়ে ওঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। তাছাড়া, আমি সত্যসেবকের ক্রাইম-সংক্রান্ত খবরাখবরের দায়িত্বে আছি। ফলে ওঁর সঙ্গে বরাবর যোগাযোগ রাখতে হয়েছে। দারুণ সব স্টোরি পাই ওঁর সাহায্যে!

শর্মা বাঁকা হেসে বললেন–যদি চান, আমিও আপনাকে দারুণ চমকপ্রদ স্টোরি দিতে পারি। ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের সবাই পারে। কিন্তু আমি বুঝতে পারছিনে, ভদ্রলোক পাখির পেছনেই যদি ঘোরাঘুরি করেন, আর যে রকম নেশাগ্রস্ত অবস্থা দেখলুম–তাহলে তো প্রতটি কেসের অবস্থা শোচনীয় হবে। কত ক্ল নষ্ট হয়ে। যাবার চান্স থাকবে। এমন কি যদি চোখের সামনে কাকেও খুন করতে দেখেন, উনি ওই উড-ডাকের দিক থেকে চোখ ফেরাবেন না।

জয়ন্ত বলল–হ্যাঁ। ওঁর ওই অদ্ভুত স্বভাব।

শর্মা পুলিশ সুপারের দিকে কটাক্ষ করে বললেন–স্যার, আমি ততক্ষণ জয়ন্তবাবুর সঙ্গে একটু কথা বলে নিই। এসেই পড়লুম যখন।

মুকেশ বললেন–অনায়াসে! আমি কর্নেলকে ওয়াচ করি ততক্ষণ! …বলে উনি হেসে পাইপ বের করলেন। অফিসার দুজন চুপচাপ বসে রইলেন। ওঁদের চোখ পোড়ো বাংলোটার দিকে। কর্নেল বারান্দা ঘুরে উত্তরে চলে গেছেন। তাই আর ওঁকে দেখা যাচ্ছে না।

শর্মা অন্তরঙ্গভাবে জয়ন্তের হাত ধরে পশ্চিমের বারান্দায় নিয়ে গেলেন। কাঠের খুঁটিতে হেলান দিয়ে সিগারেটের প্যাকেট বের করলেন।আসুন, জয়ন্তবাবু!

জয়ন্ত সিগারেট নিল। দুজনে সিগারেট ধরাল। তারপর জয়ন্ত বলল–অশনির ব্যাপারে নতুন কোন ডেভালাপমেন্ট হল মিঃ শর্মা?

শর্মা একটু হাসলেন।–আপনিই সম্ভবত ওই বৃদ্ধ ভদ্রলোককে ডেকে এনেছেন। কিন্তু মাই ডিয়ার ইয়ং ফ্রেন্ড, একটা কথা বলি শুনুন। এইসব প্রাইভেটরা কেসকে আরও জটিল করে দেয়। আপনি ছেলেমানুষ–ব্যাপারটা ঠিক করেননি। আমাদের ওপর নির্ভর করতে আপনার অসুবিধেটা কী?

জয়ন্ত টের পেল, সরকারি গোয়েন্দা কর্তাটি তার ওপর মনে মনে খাপ্পা হয়ে গেছে। সে ব্যস্তভাবে বলল–না, না! অসুবিধে কিসের? আপনারা নিশ্চয় ইতিমধ্যে অনেকটা এগিয়েছেন!

শর্মা কথা কেড়ে বললেন–আলবাৎ এগিয়েছি। জাস্ট ফর ইওর কনফিডেন্স, একটা ডেভালাপমেন্ট বলছি। প্লিজ, আপনার বৃদ্ধ বন্ধুটির কানে তুলবেন না। তুললে আপনি মুশকিলে পড়বেন–মাইন্ড দ্যাট!

জয়ন্ত ভড়কে গিয়ে বললনা না। ও পাগলা বুড়োর কানে তুলবই না। আসলে কী হয়েছে জানেন, আমাদের কাগজের মালিক ওঁকে পাঠিয়েছেন! আমি কী করব বলুন?

কথাটা শর্মার মনে ধরল। বললেন। তাই বটে! নিশ্চয় মোটারকম ফি নেবেন ভদ্রলোক! কত নেন বলুন তো?

জয়ন্ত মনে মনে হেসে বলল–হাজার পাঁচেকের কম নয়।

শর্মা বাঁকা হেসে বললেন–রাশিরাশি ব্ল্যাকমানি যাদের আছে, তারাই একজন প্রাইভেটের পিছনে টাকা ওড়াবে। যাকগে, শুনুন কতটা এগিয়েছি। জাস্ট ওনলি একটা আভাস দিচ্ছি। …বলে তিনি চাপা গলায় বললেন–অশনিবাবুর পকেটে একটা ইনল্যান্ড লেটার পেয়েছিলুম। কলকাতায় পোস্ট করা এবং কলকাতায় ডেলিভারি। পোস্টিং ডেট ৩১মে–জি পি ওর ছাপ। ডেলিভারি ডেট পয়লা জুন–সময় বিকেল চারটে কুড়ি। তার মানে অশনিবাবু বিকেলের ডাকে চিঠিটা পান।

কার চিঠি!

 –সাম গার্গী রায়ের। নিশ্চয় মহিলা। কে তিনি জানেন?

 জয়ন্ত উত্তেজনা চেপে বলল–চিঠিটায় কী লেখা আছে বলুন তো?

–আগে চেনেন কি না বলুন!

–একদিন অশনি রাস্তায় আলাপ করিয়ে দিয়েছিল।

 –অশনিবাবুর ফিয়াসে। …বলে শর্মা খুকখুক করে হাসলেন।

–হ্যাঁ। সেদিন আমিও তাই ভেবেছিলুম হাব-ভাব দেখে। কিন্তু চিঠিটা…

শর্মা হাত তুলে থামিয়ে বললেন–গার্গী লিখেছে, হঠাৎ রাতারাতি মোহনপুরে যেতে হচ্ছে তাকে। যদি তেমন কিছু ঘটে অশনি যেন মোহনপুরে চলে আসে।

-বলেন কী! অশনিও হাওড়া থেকে ফোন করে আমাকে একই কথা বলেছিল–ফাস্ট জুন।

–এখন কথা হচ্ছে, তেমন কিছু ঘটে কথাটার মানে কী?

 জয়ন্ত ভাবতে ভাবতে ঘাড় নাড়ল। বলল–কিছু বুঝতে পারছিনে। অশনির কথাও বুঝতে পারিনি!

–গার্গী রায় কোথায় থাকে কলকাতায়, বলতে পারেন?

না তো। আলাপের সময় ওকথাটা ওঠেনি। তবে ও চাকরি করে, এটুকু বুঝতে পারছিলুম। বড় চাকরি নয়–ছোটখাট হবে। কারণ, ওকে সাধারণ মধ্য বা নিম্ন মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির মেয়ে বলে মনে হয়েছিল!

শর্মা দূরের পাহাড় দেখতে দেখতে বললেন কলকাতার লালবাজার দফতর থেকে যে কোন সময় সব খবরাখবর এসে যাবার আশা করছি। তো কথা হচ্ছে– আমি আপনাকে একটা সূত্র দিলুম। তাই না?

–দিলেন বইকি। তবে ভাববেন না, বুড়োর কানে তুলব না।

শর্মা ওর দিকে ঝুঁকে বললেন–আপনি কি তেমন কিছু জানেন–যা আমাদের বলেননি এবং আপনাদের কর্নেল ভদ্রলোককে বলেছেন?

জয়ন্ত একটু ইতস্তত করে বলল–মোটামুটি সবই তো বলেছি মিঃ শর্মা। আমি যা জানি–সবটাই বলেছি।

শর্মা চোখ নাচিয়ে ধূর্ত হেসে বললেন–সব বলেননি। যেমন গার্গী রায়ের সঙ্গে অশনির সম্পর্ক ছিল বলেননি!

জয়ন্ত অপ্রস্তুত হয়ে বলল–না। মানে, এটা দরকার হবে কি না–ধারণা ছিল না। এখন প্রশ্ন করলেন বলে বললুম।

দ্যাটস দ্য হিউম্যান নেচার। শর্মা ওর প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে বললেন। আপনার কোন দোষ নেই, জয়ন্তবাবু। আসলে কোনটা কী কাজে লাগবে আপনি তো জানেন না। আপনি এসব কেসের ব্যাপার একেবারে নোভিস! যাই হোক, এবার স্মরণ করুন তো অশনি-সংক্রান্ত আর তেমন কোন ইনফরমেশান আছে না কি! আপনার কাছে সেটা অপ্রয়োজনীয় মনে হতে পারে! ভেবে বলুন।

জয়ন্ত আবার ইতস্তত করে বলল–ওই ঘরে অশনি ছিল। আপনারা তো সব সার্চ করে দেখে গেছেন। কিন্তু ওর রিপোর্টিং স্লিপে কয়েকটি কথা টোকা ছিল। স্ট্রেঞ্জ ওয়ার্ডস।

শর্মা লাফিয়ে উঠলেন–কই? কোথায় সেই স্লিপ?

জয়ন্ত প্যান্টেব পকেট থেকে একটা ভাজকরা কাগজ বের করে দিল। শৰ্মা সেটা ছোঁ মেরে নিয়ে ফের বললেন–আপনাদের কর্নেল সায়েবকে দেখিয়েছেন নাকি?

–দেখাইনি! বলেছি। কিন্তু উনি কোন আগ্রহই দেখালেন না।

শর্মা স্লিপটা দেখতে দেখতে নিঃশব্দে হাসলেন।–ওঁর পদ্ধতি আমার জানা নেই। সবই শোনা বা কাগজে পড়া। উনি নাকি চেয়ারে বসেই সব হত্যারহস্যের সমাধান করেন! অ্যান আর্মচেয়ার ডিটেকটিভ–যেমন কি না আর্মচেয়ার সায়েন্টিস্ট!

স্লিপটা পকেটে তখনই পুরে ফেললেন শর্মা। মুখে উজ্জ্বলতা ঠিকরে পড়ছিল। জয়ন্ত বলল–কিছু বুঝলেন?

–খানিকটা।

 –কী, বলবেন?

 শর্মা ওর হাত ধরে টানলেন।-সবুর, জয়ন্তবাবু, সবুর। সব টের পাবেন। গার্গী রায়ের খবরাখবর আপনাদের লালবাজার পাঠালেই কেসের সমাধান হয়ে যাবে। বাকি কাজ পুলিসের জেনারেল ডিপার্টমেন্টের হাতে। তারা খুনীকে গ্রেফতার করবে, মামলা সাজাবে। আসুন, দেখি আপনার ন্যাচারালিস্ট বন্ধুটি ভূতের হাতে মারা পড়লেন নাকি?

ওরা দুজনে আবার দক্ষিণের বারান্দায় বাড়ির সামনের দিকে এল। মুকেশ এবং অফিসার দুজন কথা বলতে বলতে চা খাচ্ছেন। শর্মা গিয়ে বসলেন। তারপর বললেন–সাড়ে এগারোটা হয়ে গেল, স্যার। আমার তাড়া আছে। উনি তো ফিরলেন না!

মুকেশ হাসতে হাসতে বললেন–হয়তো দিনটাই কেটে যাবে উড্ডাকের পেছনে। কী বলেন জয়ন্তবাবু?

জয়ন্ত হাসল শুধু। তারপর প্লেট ঢাকা চায়ের কাপ তুলে নিল। শর্মা একটানে ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়ার চা গিলে কাপ রেখে ফের ঘড়ি দেখলেন। আমি যাই, স্যার।

 মুকেশ পোড়োবাংলোর দিকটা দেখে নিয়ে বললেন–ঠিক আছে। আসুন!

অফিসার দুজন এবং শর্মা উঠলেন। তারপর এস. পি-কে রীতিমাফিক সেলাম ঠুকে জিপে উঠলেন। জিপ রাস্তায় পড়ল।

এই রাস্তা থেকে পোড়োবাংলোর দিকে যাওয়া আরেকটা রাস্তার শুরু যেখানে, হঠাৎ শর্মা ড্রাইভারকে বললেন–এদিকে ঘোরাও। বুড়ো ভদ্রলোককে বিদায় জানিয়ে যাই। কী বলেন মিঃ আচার্য?

এস. আই. রমেশ আচার্য হেসে বললেন–হ্যাঁ। এস. পি. সায়েবের বন্ধু। সায়েব আবার কিছু ভেবে না বসেন!

-হ্যা! ফরম্যালিটি বলতে পারেন!

জিপ পোড়াবাংলোর সামনে দাঁড়াল। শর্মা নেমে বললেন–আপনারা বসুন। আমি দেখি–আছেন এখানে, নাকি হাওয়া হয়ে গেলেন।

শর্মা গিয়ে বারান্দায় শুকনোপাতার ওপর মসমস আওয়াজ তুলে কর্নেলের খোঁজে উত্তরে চলে গেলেন। গিয়ে দেখেন, ওদিকে একটা ঘরের দরজা খোলা। একটু অবাক হলেন, ঘরের মধ্যে বিছানা পাতা। কিটব্যাগ ঝুলছে দেওয়ালে হুকে। এ বাংলোয় তো কেউ বাস করার কথা নয়! মামলা চলছে। কে অনধিকার প্রবেশ করল?

ঘরে ঢুকে পড়লেন। তারপর মনে হল, ভেতরে কারা চাপা গলায় কথা বলছে। অমনি রিভলভার বের করে ডানদিকের ভোলা দরজায় গেলেন। আবার একটা ঘর। সেই ঘরের দক্ষিণের দরজা খোলা। ভেতরে আরেকটা অন্ধকার ঘর দেখা যাচ্ছে। কথাবার্তা সেখানেই হচ্ছে। পা টিপে টিপে শর্মা সেই দরজার গিয়ে যা দেখলেন, তাতে তিনি স্তম্ভিত আর হতবুদ্ধি হয়ে গেলেন। মুখে কয়েকমূহূর্ত আর কোন কথা বেরুল না। …

 কর্নেল আর একটি যুবক মুখোমুখি দাঁড়িয়ে চাপাস্বরে কী বলাবলি করছেন। আর দুজনের পায়ের কাছে ফুট তিনেক দূরে একটা উলঙ্গ লাশ-মহিলার লাশ। গলায় রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে। ঘুলঘুলি দিয়ে আসা আলোয় সব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

শর্মাকে দেখে দুজনেই ঘুরে তাকাল। তারপর কর্নেল মৃদু হেসে শুধু বললেন– আসুন মিঃ শর্মা! হেয়ার ইজ অ্যানাদার কেস ফর ইউ!

শর্মা পকেট থেকে হুইসিল বের করে উদ্ৰান্তভাবে ফুঁ দিতে থাকলেন। অফিসার দুজনের পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। শর্মা গর্জন করে রিভলভার তুললেন যুবটির দিকে। ইউ বাস্টার্ড!

কর্নেল কিছু বলার চেষ্টা করলেন, কিন্তু সুযোগই পেলেন না। শর্মার চেঁচামেচিতে অফিসার দুজন ঘরে এসে কাণ্ড দেখে থমকে দাঁড়িয়ে ছিলেন। শর্মা বললেন–অ্যারেস্ট হিম!

যুবকটি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল। অফিসার দুজন রিভলভার হাতে করে দুদিকে এগিয়ে দুধের জামা খামচে ধরলেন। সে কর্নেলের দিকে তাকিয়ে কী বলতে চেষ্টা করল। কিন্তু কর্নেল তখন শর্মার দিকে তাকিয়ে মৃদু-মৃদু হাসছেন।

শর্মা বললেন কর্নেল সরকার। আপনার চালাকি আমি বুঝতে পেরেই সতর্ক ছিলুম। উড-ডাকের ছলে আপনি এখানে এসেছিলেন। নিশ্চয় সন্দেহজনক কিছু লক্ষ্য করেছিলেন এখানে। কিন্তু ভাবতে অবাক লাগছে, খুনীকে হাতে-নাতে পেয়েও তার সঙ্গে বিবি রসালাপে মত্ত হয়েছিলেন। আশ্চর্য!

কর্নেল বললেন-কে খুনী?

 শর্মা বললেন–যাকে অ্যারেস্ট করা হল।

–ডেডবডিটা লক্ষ্য করুন মিঃ শর্মা। কর্নেল শান্তভাবে বললেন। অন্তত চব্বিশঘণ্টা আগে খুন হয়েছে, সে বিষয়ে কোন ভুল নেই। রক্ত এবং বডি লক্ষ্য করুন। এবং বলুন খুনীর পক্ষে তার খুনের সামনে এভাবে..

শর্মা পূর্ত এবং বাঁকা হেসে বাধা দিয়ে বললেন দ্যাটস নট দা কেস, কর্নেল সরকার। খুনী চিরাচরিত সাইকলজিকাল রি-অ্যাকশনেই আবার তার শিকারের অবস্থা দেখতে ফিরে এসেছে এবং আপনাকে দেখে একটা কৈফিয়ত দেবার চেষ্টা করছে। আপনিও তার কথায় ভুলে দিব্যি সময় কাটাচ্ছেন!

শর্মা অফিসারদের দিকে ঘুরে বললেন–এখনই ওকে সার্চ করুন। তারপর থানায় নিয়ে যান এহং এখনই থানা থেকে স্টাফ পাঠান। ও সি-কে পাবেন কাবাডিয়া লাখোটিয়ার অফিসে। আমার জন্যে অপেক্ষা করার কথা! শিগগির!…

.

কিছুক্ষণের মধ্যেই খবর পেয়ে মুকেশ এবং জয়ন্ত এসে পড়লেন। মুকেশ এসে নিজের হাতে জানালাগুলো খুলে দিলেন। এই ঘরটা বেশ বড়। সম্ভবত ড্রইংরুম হিসেবে ব্যবহার করা হত। এখন ঘরে কয়েকটা চেয়ার আর টেবিল ছাড়া কিছু নেই। লাশটার ওপর বাইরের আলো এসে পড়ল। উলঙ্গ এক যুবতীর লাশ। তাই সবাই মুখ ফিরিয়ে ছিলেন। শর্মা শিগগির পিছনের ঘরের সেই বিছানার চাদরটি এনে লাশ চাপিয়ে দিলেন। গলা পেঁচিয়ে কাটা হয়েছে। মুকেশ পরীক্ষা করে বললেন–কিন্তু আশ্চর্য তো! রক্ত কোথায়? এভাবে খুন হলে প্রচুর রক্ত থাকার কথা।

শর্মা এবার রীতিমতো পরীক্ষা শুরু করলেন। ডাক্তার ফোটোগ্রাফার এবং অন্যান্যরা আসার আগেই দ্রুত নিজের মনে একটা ধারণা গড়ে নিতে চান। ঘরের মেঝে খুঁটিয়ে দেখলেন। নানা ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে লাশটার দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। তারপর লাশের কাছে হাঁটু গেড়ে বসসেন।

কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে কাচুমাচু মুখে বললেন–ইয়ে মিঃ সিং! আমি ইতিমধ্যে উড়-ডাকটা হারিয়ে ফেলেছি। আশা করি, আমার উপস্থিতির প্রয়োজন হবে না।

মুকেশ সিং কিছু বলার আগেই শৰ্মা ধূর্ত হেসে বললেন–একটা বিবৃতি দরকার হবে, কর্নেল সরকার, এখনই। জাস্ট আধঘণ্টা আপনাকে থাকতে হবে।

কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন–অবশ্যই। তবে এতক্ষণ বন্ধ ঘরে ডেডবডির সঙ্গে থেকে…  

শর্মা বললেন–এবং খুনীর সঙ্গে থেকে…

কর্নেল হো হো করে আরও জোরে হাসলেন। –বেশ, তাই। আমার মাথা ধরেছে। বাইরে যাচ্ছি। এস জয়ন্ত।

মুকেশ ঠোঁটের কোনায় হাসলেন। আমি বরং মিঃ শর্মার সঙ্গে ডেডবডি দেখি। বলা যায় না, একে ভূতের বাংলো তার ওপর ডেডবডি। মিঃ শর্মাকে একা পেয়ে কেলেঙ্কারি না করে।

শর্মা গম্ভীর হয়ে শুধু বললেন ভূত ধরা গেছে স্যার।

বাইরের ঘরে এসে বিছানাটা দেখিয়ে কর্নেল বললেন জয়ন্ত, তোমার কি মনে হচ্ছে, এই বিছানায় কোন পুরুষ না মহিলা শুয়েছিল?

জয়ন্ত হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ঝুঁকে দেখে বলল–কীভাবে বুঝব?

–চুল দেখে। ওই দেখ লম্বা চুল। আর বালিশে দেখতে পাচ্ছ লিপস্টিকের ছাপ? অনেকক্ষণ ধরে একদফা পরীক্ষা করেছি। লিপস্টিকের ছাপটা দেখে মনে হয়েছে, কোন মহিলা প্রচণ্ড মুখ রগড়ে ছিল বালিশে। মুখ রগড়েছিল, এর কারণ একটাই। বিষাক্ত কিছু খেয়েছিল। বালিশটা ফরেনসিক পরীক্ষায় পাঠালে সব বোঝা যাবে। ..বলে কর্নেল দেওয়ালের হুকে আটকানো কিটব্যাগটা দেখালেন। …ওতে একটা রক্তমাখা শাড়ি আর একটা ছোরা আছে।

জয়ন্ত এবার বলে ফেলল–তাহলে বেচারা গার্গী খুন হয়ে গেল!

–গার্গী! কর্নেল একটু হাসলেন। তুমি গার্গীকে চেনো নাকি?

–একবার দেখেছিলুম অশনির সঙ্গে। কিন্তু লাশটা দেখে বোঝা গেল না।

কর্নেল মাথা নাড়লেন। তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো যে হতভাগিনী মেয়েটি গার্গী নয়।

–তবে কে ও?

কাবাডিয়া অ্যাণ্ড লাখোটিয়া কর্পোরেশনের মার্কেটিং সুপারভাইজার রুবি চ্যাটার্জি।

–আর যাকে অ্যারেস্ট করা হল ও কে?

—অভ্র। গার্গীদের বাড়িতে ওপরতলায় থাকে। পরে বলবখন। শুধু বুঝতে পারছিনে রুবি আমার কাছে কাল সকালে যাওয়ার পর হঠাৎ মোহনপুরে চলে। এল কেন! আর এল যদি, এই নির্জন পোড়ো বাংলোয় এসে ঢুকল কেন? … কর্নেল টাক ও দাড়ি পর্যায়ক্রমে চুলকোতে-চুলকোতে বাইরে বেরোলেন। বারান্দায় গিয়ে ফের বললেন-কাবাডিয়াদের ফরেন সেলস প্রমোশন অফিসার। সুনীথ ব্যানার্জিই বা কেন অভ্রকে এখানে ঢুকিয়ে কেটে পড়ল? অনেক প্রশ্ন জয়ন্ত, অনেক প্রশ্ন। আমার বুদ্ধিশুদ্ধি গুলিয়ে যাচ্ছে। জীবনে এমন ধাঁধার মধ্যে কখনও পড়িনি!

জয়ন্ত বলল-ধাঁধাটা আমার কাছে তো আরও জটিল। ব্যাকগ্রাউন্ড কিছু জানিনে।

–সব বলবখন। বলে কর্নেল হাত তুললেন। তারপর নিচে নেমে গিয়ে বললেন–ওই দেখ, রাস্তায় লোকেরা দাঁড়িয়ে গেছে। পোড়ো বাংলোয় ভুতের সংখ্যা বেড়ে যাবে।

জয়ন্ত দেখল পুলিশ ভ্যান, অ্যামবুলেন্স আর জিপের মিছিল আসছে। …