৪. কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে

০৪.

 কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরলে ষষ্ঠীচরণ বলল, বাবামশাইকে একটা মেয়েছেলে ফোং করেছিল। আমি বললাম, উনি বেইরেছেন। তখন বলল, পরে ফোং করব।

ড্রয়িংরুমে ঢোকার মুখে টেলিফোন বাজল। কর্নেল বললেন, ওই শোন্ ফোং করছে। তুই কফি নিয়ে আয়। শিগগির!

ষষ্ঠী ফোনকে ফোং বলে। কর্নেলের মুখেও ফেং শুনলে সে বেজার হয়। তুম্বো মুখে চলে গেল। বুঝলাম কফিটা প্রচণ্ড কড়া হবে।

ফোন তুলে সাড়া দিয়ে কর্নেল বললেন, বলো অপর্ণা!…গিয়েছিলে?..। বলো।…আচ্ছা। তারপর?…কর্নেল কিছুক্ষণ হুঁ দিয়ে গেলেন। তারপর বললেন, ঠিক আছে। সময়মতো আমাকে জানাবে।

টেলিফোন রেখে ইজিচেয়ারে বসে কর্নেল বললেন, অপর্ণা আমার এখান থেকে সোজা সুদর্শনের বাড়ি গিয়েছিল। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে কারও সাড়াশব্দ পায়নি। তখন বাড়ি ফেরে। বাড়ি ফিরে দেখে, সুদর্শন ওর জন্য অপেক্ষা করছে।

বললাম, বাঃ! তারপর?

অপর্ণাকে নাকি শেষ দেখা দেখতে গেছে। শুনে অপর্ণা ওকে অনেক। বুঝিয়েছে। অপর্ণার মাও বুঝিয়েছেন। রাত্রে ওখানে থাকার জন্য পীড়াপীড়ি করেছেন। কিন্তু সুদর্শন থাকেনি।

সত্যিই ভদ্রলোক বদ্ধ পাগল।

 কর্নেল টাকে হাত বুলিয়ে বললেন, তবে আজ রাত্র সে আত্মহত্যা করবে না। বলেছে। চণ্ডীতলা আশ্রমে তার বাবার গুরুদেবের কাছে যাবে। তাকেও সব কথা জানিয়ে বিদায় নেবে। ফিরে এসে আত্মহত্যা করবে।

উত্তেজিতভাবে বললাম, কর্নেল! ব্রহ্মানন্দজি কী করবেন আমি বাজি রেখে বলতে পারি।

বলো শোনা যাক।

ওর আত্মহত্যায় সায় দেবেন। তবে তার আগে সব প্রপার্টি আশ্রমের নামে লিখিয়ে নেবেন। ওইসব সাধুর শিষ্যদের মধ্যে দুদে অ্যাডভোকেট থাকা স্বাভাবিক। ব্রহ্মানন্দজি ওকে বলবেন, তুমি যখন মরবে ঠিক করেছ, মরো। তবে তুমি মরলে তোমার প্রপার্টি ওই খারাপ মেয়েছেলেটা পাবে। সেটা কি ঠিক?

কর্নেল হাসলেন। উইলে সত্যি কী আছে, আমরা এখনও জানি না জয়ন্ত। অবনী মৈত্র মিথ্যাও বলতে পারে। শুধু এটুকু বুঝেছি, সুদর্শনের বাবার গুরুদেবের সঙ্গে তার সম্ভবত শত্রুতা আছে। এটা খুব স্বাভাবিক। অবনী একজন তান্ত্রিক। কাজেই সে নিজেও ও বাড়িতে কিংবা অন্য কোথাও আশ্রম করতে চাইবে।

এবং গোপা হবে তার সাধনসঙ্গিনী!

ষষ্ঠী কফি আনল। কফিতে চুমুক দিয়ে কর্নেল বললেন, তোমার থিওরিটা মন্দ না। তবে তার আগে জানা দরকার উইলে সত্যিই কী আছে। কলকাতার অ্যাটর্নিমহলে আমার কিছু জানাশোনা আছে। সুদর্শনের বাবা সদানন্দবাবু কার মক্কেল ছিলেন জানা দরকার।

সুদর্শনের বাবার নাম আপনি জানেন?

ওদের ঘরের দেয়ালে একটা ছবিতে নাম এবং জন্মমৃত্যুর তারিখ লেখা আছে।

আমি ওসব লক্ষ্য করিনি।

কর্নেল চুপচাপ কফি খেতে থাকলেন। ওঁর মুখ দেখে টের পাচ্ছিলাম, ষষ্ঠী কফিটা প্রচণ্ড কড়া করেছে। আমারটা অবশ্য স্বাভাবিক। একটু পরে কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, ও ঘরে সুদর্শনের মায়ের ছবি দেখিনি।

সুদর্শন নিজের ঘরে রেখেছে নিশ্চয়। রিং করে জেনে নিন না!

ওকে পাচ্ছি কোথায়? অপর্ণাকে বলেছে, আজ রাত্রেই ট্রেনে কৃষ্ণনগর চলে যাবে। তারপর চণ্ডীতলা যেতে অসুবিধে নেই। সাইকেল রিকশা বা এক্কাগাড়ি পাওয়া যায় সবসময়। নদীর ধারে নাকি বেশ বড় আশ্রম।

আচ্ছা কর্নেল, আপনি গোপাকে বিপন্ন বললেন। সুদর্শন ওকে মার্ডার করবে বলে? নাকি নিছক ভয় দেখিয়ে এলেন?

কর্নেল হেলান দিয়ে চোখ বুজে বললেন, ব্যাপারটা আমার নিজের কাছেও স্পষ্ট নয়। কিন্তু আমার ইনটুইশন–এনিওয়ে, শুধু এটুকু বলতে পারি গোপাকে যেন কেউ বা কারা টোপ হিসেবে ব্যবহার করছে। সুদর্শন দৈবাৎ মারা গেলে গোপার বিপদ।

বুঝিয়ে বলুন!

এ মুহূর্তে কিছু বুঝিয়ে বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, জয়ন্ত!

বলে কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। বইয়ের র‍্যাক থেকে সেই প্রকাণ্ড বইটা নিয়ে এলেন। টেবিল-ল্যাম্প জ্বেলে বইটার পাতা খুললেন। জিজ্ঞেস করলাম, কী বই ওটা?

মার্লো পোঁতির লেখা, দা ফেনোমেলোলজি অব পার্সেপশন। মানসিক অসুখবিসুখ নিয়ে সিরিয়াস দার্শনিক আলোচনা।

আমি উঠি। বড় টায়ার্ড।

ঠিক আছে। এসো।

কর্নেল বইয়ের পাতায় মন দিলেন। আমি বেরিয়ে এলাম। ষষ্ঠী দরজা বন্ধ করতে এসে ফিক করে হেসে চাপাস্বরে বলল, বাবামশাইকে খুব জব্দ করেছি। আর্ধেক কাপও খেতে পারেননি। আপনারটা কিন্তু কড়া করিনি।

এই সময় কর্নেল হাঁকলেন, ষষ্ঠী! কফি! এবার তেতো করলে লিন্ডাদের কুকুরটা এনে ঘরে ছেড়ে দেন।

ষষ্ঠীর মুখ আবার বেজার হয়ে গেল। সে কুকুরকে বড় ভয় করে।

পরদিন সকালে চা খেতে খেতে খবরের কাগজগুলোয় চোখ বুলোচ্ছি, টেলিফোন বাজল। সাড়া দিতেই কর্নেলের কণ্ঠস্বর ভেসে এল, সুপ্রভাত ডার্লিং!

সুপ্রভাত বস্! কোনও খবর আছে?

আছে। তুমি শ্যামপুকুর থানায় চলে এস। অপেক্ষা করছি।

থানায় কেন?

সুদর্শন মারা গেছে।

সর্বনাশ! কোথায় কী ভাবে মারা গেল? তার তো রাত্রে চণ্ডীতলা আশ্রমে যাওয়ার কথা!

সুদর্শন যে কোনও কারণে হোক, চণ্ডীতলা যায়নি। নিজের ঘরে মারা গেছে। টেবিলে একটা সুইসাইডাল নোট পাওয়া গেছে। তুমি চলে এস। ফোনে সব বলা যাবে না।

ব্রেকফাস্ট না করেই বেরিয়ে পড়লাম। দশটায় ব্রেকফাস্ট করি। এখন নটা বাজে। শ্যামপুকুর থানার সামনে গিয়ে দেখি, কর্নেল অপেক্ষা করছেন। গাড়িতে উঠে বললেন, সুদর্শনের বাড়িতে চলো। বডি মর্গে চলে গেছে। পুলিশকে কিছু জানাইনি। পুলিশ সুইসাইডাল নোট পেয়েছে। দ্যাটস এনাফ ফর দেম।

সুদর্শনের হাতের লেখা?

হ্যাঁ। ওর প্যাডে ওরই রাতের লেখা। আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। ইত্যাদি। ওসি বললেন, হাতের লেখার নমুনা পেয়ে গেছেন।

আপনি কী করে খবর পেলেন?

ভবতারণ আমাকে ফোন করেছিল। সুদর্শন গত রাত্রে প্রায় একটায় বাড়ি ফরে। ভবতারণকে আমার ফোন নাম্বার দিয়ে বলেছিল, কিছু ঘটলে যেন এই নাম্বারে রিং করে জানিয়ে দেয়। ট্যাক্সি করে গিয়ে দেখি, পুলিশ এসে গেছে। আমাকে কনস্টেবলরা ঢুকতে দিল না। অগত্যা থানায় চলে গেলাম। তখন প্রায় আটটা বাজে। বাঁয়ের গলি দিয়ে শর্টকাট করো।

গলিতে সুদর্শনের বাড়ির গেট বন্ধ। সামনের দিকের রাস্তায় লোকেরা ভিড় করে আছে। হর্ন বাজানোর পর অবনী মৈত্রকে পোর্টিকোর ছাদে দেখতে পেলাম। তারপর ভবতারণ দৌড়ে এসে গেট খুলে দিল। কান্না চেপে বলল, আমি আর কারও পরোয়া করি না স্যার। আমাকে গেট খুলতে মানা করছে। ইশ! সাধু সেজে আছে। পরের ঘাড়ে বসে ফুর্তি ওড়াচ্ছে। এবার মজাটা দেখাচ্ছি।

পোর্টিকোর ছাদ থেকে ততক্ষণে অবনী মৈত্র অদৃশ্য। পোর্টিকোর তলায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে আমরা বেরোলাম। ভবতারণ বলল, ভেতরে আসুন স্যার! সাহেব আমাকে বলে গেছেন, খারাপ কিছু ঘটলে আপনাকে যেন খবর দিই। আপনি এলে যেন যত্নআত্যি করি।

অবনী মৈত্র পর্দা তুলে ঘরে ঢুকে বলল, এতে গোয়ন্দোগিরির কিছু নেই মশাই! পুলিশ যা করার করেছে। খামোকা আপারা জলঘোলা করতে এসেছেন। অ্যাই ভবা! তুই কেন এঁদের বাড়ি ঢোকালি?

ভবতারণ খুঁসে উঠল। যা তা বলবেন না দাদাবাবু! সাহেব যা বলে গেছেন, সেই মতো কাজ করছি।

তান্ত্রিক যথারীতি গঙ্গাস্নান করে এসেছে বোঝা যাচ্ছিল। পরনে সেই পোশাক। গেরুয়া লুঙ্গি এবং ফতুয়া। কপানে ত্রিপুণ্ড্রক। ভবতারণের দিকে রুষ্ট দৃষ্টে শুধু তাকিয়ে রইল।

আমরা বসলাম। কর্নেল বললেন, বসুন অবনীবাবু! কথা আছে।

 যা বলার গতকাল সন্ধ্যায় বলেছি মশাই! এখন আমি মন্দিরে যাচ্ছি।

বলে তান্ত্রিক যথারীতি খড়মের শব্দ করতে করতে বেরিয়ে গেলেন। ভবতারণ চোখ মুছে বলল, রাত্তিরে সাহেবের কথা শুনে খটকা লেগেছিল। ঘুম হয়নি। আমি নিচের ঘরে থাকি। খুটখাট শব্দ হলেই উঠে বসেছি। তারপর পোড়া চোখে কখন কালঘুম নেমে এসেছিল। হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল। তখন প্রায় সাড়ে পাঁচটা বাজে। ওপরে গিয়ে দেখলাম, সাহেবের ঘরের দরজা বন্ধ। কিন্তু তখন কি জানি দরজা ভেজানো আছে? উনি দশটার আগে ওঠেন না। ছটায় দাদাবাবু আর মেমসাহেব গঙ্গাস্নানে গেলেন। সাড়ে সাতটায় ফিরলেন।

কর্নেল বললেন, রোজই কি ওই সময় ফেরেন?

আজ্ঞে। আমি ওঁদের জন্য চা করছিলাম। হঠাৎ ওপরে মেমসাহেবের কান্নাকাটি শুনে চমকে উঠলাম। গিয়ে দেখি, সাহেবের ঘরের দরজা খোলা। সাহেব টেবিলে মাথা রেখে বসে আছেন। মেমসাহেব ওঁকে ওঠানোর চেষ্টা করছেন। আমি গিয়ে সাহেবকে সিধে করলাম। চোখ ঠিকরে বেরিয়ে গেছে। মুখে নাকে রক্ত গড়াচ্ছে। রক্ত আর ফেনা। মেঝেয় একটা কাপ উল্টে পড়ে আছে। দাদাবাবু ও ঘরে গিয়ে সব দেখে বললেন, সর্বনাশ! সুইসাইড করেছে। থানায় ফোন করতে হবে। উনি টেলিফোন করলেন। আমার মাথায় তখন সাহেবের কথাটা ভাসছে। সামনের সাইডে রাস্তার ধারে ভকতবাবুর রঙের দোকানে টেলিফোন আছে। আমাদেরই ভাড়াটে স্যার। ওঁকে ডাকাডাকি করে সব বললাম। ফোন করলাম আপনাকে। এই দেখুন, সাহেবের লিখে দেওয়া আপনার নম্বর।

সে পকেট থেকে একটুকরো কাগজ বের করে দিল কর্নেলকে। কর্নেল সেটা পকেটে ঢুকিয়ে বললেন, মেমসাহেব এখন কী করছেন?

নিজের ঘরে আছেন। দরজা ভেতর থেকে আটকানো। ডাকছিলাম। সাড়া পেলাম না।

তোমার সাহেবের ঘরে কি পুলিশ তালা এঁটেছে?

আজ্ঞে না তো! পুলিশ ভাঙা কাপটা আর টেবিলে রাখা একটা চিঠি নিয়ে গেছে।

কর্নেল আমার দিকে ঘুরে বললেন, পুলিশের মতে পটাসিয়াম সায়নায়েড। চা বা কফির সঙ্গে খেয়েছে। ভবতারণ, চা বা কফি তো তুমিই করো?

আজ্ঞে। তবে সাহেবের কফি সেই দশটায়।

 তা হলে তোমার সাহেবকে চা বা কফি কে দিয়েছিল?

 সেটাই তো বুঝতে পারছি না স্যার!

 চলো! ওঁর ঘরটা দেখব।

ভবতারণ আমাদের ওপরে নিয়ে গেল। একটা ঘরের দরজা খুলে বল, এই ঘরে স্যার।

ঘরের জানালাগুলো ভোলা। কিন্তু পর্দা ঝুলছে। একপাশে সেকেলে খাটে সুদৃশ্য বেডকভার চাপানো। ভবতারণ আলো জ্বেলে দিল। কর্নেল আগে বেডকভার তুললেন। বললেন, সুদর্শন বিছানায় শোয়নি।

একপাশে ডিভান। পিছনে বইয়ের র‍্যাক। অন্যপাশে লেখার টেবিল এবং গদি আঁটা চেয়ার। দেওয়ালে বিক্ষিপ্তভাবে টাঙানো কয়েকটা রঙিন ছবি। বিখ্যাত চিত্রকরদের প্রিন্ট। টেবিলের নিচে ডানদিকে ভাঙা কাপের কয়েকটা টুকরো পড়ে আছে। কর্নেল আতস কাঁচ বের করে কাপের টুকরোগুলো দেখলেন। চেয়ারটার দিকে তাকিয়ে রইলেন মিনিট দুয়েক। তারপর বললেন, ভবতারণ! কী অবস্থায় অবস্থায় তোমার সাহেবকে দেখেছিলে, তুমি বসে দেখিয়ে দাও।

ভবতারণ একটু দ্বিধার সঙ্গে চেয়ারে বসে দুটো হাত ট্রেবলের ওপর ছড়িয়ে দিল এবং মুখটা একপাশে কাত করে টেবিলে রাখল। তারপর উঠে দাঁড়াল।

কর্নেল আতস কাঁচ দিয়ে টেবিলের ওপরটা খুঁটিয়ে দেখে বললেন, তোমার সাহেবের একটা ল্যাব আছে শুনেছি। ল্যাবরেটরি মানে বোঝো?

আজ্ঞে! ওই সে পর্দা ঝুলছে দরজায়। বলে সে পর্দা তুলল। দরজাটা ভেজানো ছিল। খুলে দিল। আমরা ল্যাবে ঢুকলাম। কর্নেল বললেন, গ্যাসের সিলিন্ডার আছে দেখছি। কেটলি এবং কাপও! সুদর্শন রাত্রে কফি খেত। গুড়ো কফির প্যাকেট আছে কয়েকটা।

বিচিত্র গড়নের জার, নল, শিশিবোতল এবং দুটো কম্পিউটার। একটা জারে কয়েকটা টিকটিকি কী আরকে ডোবানো আছে। গা ঘিনঘিন করছিল। পশ্চিমের জানালার পর্দা তুলে কাঁচের ভেতর গঙ্গা দেখতে পেলাম। জানালার নিচে একটা স্টিলের ইজিচেয়ার। সুদর্শন নিশ্চয় এখানে বসে গঙ্গদর্শন করত।

কর্নেল ল্যাবের ভেতর চক্কর দিচ্ছিলেন। হঠাৎ গ্যাসের চুল্লীর কাছে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসলেন। এ ঘরের মেঝে কিছুটা নোংরা। আতস কাঁচে পরীক্ষা করার পর কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আচ্ছা ভবতারণ, তোমার সাহেব কি তোমাকে কিছু হারিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলেন?

আজ্ঞে না তো?

ওঁকে কাল কিছু খোঁজাখুঁজি করতে দেখেছিলে?

 ভবতারণ স্মরণ করার চেষ্টা করে বলল, আজ্ঞে না। কই? তেমন কিছু

 কর্নেল সরকার!

চমকে উঠে দেখি ল্যাবের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে গোপা। পরনে গৈরিক শাড়ি ব্লাউজ। চুড়ো করে বাঁধা চুল। চোখে অস্বাভাবিক উজ্জ্বল সেই দৃষ্টি। কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, আপনার দুর্ভাগ্যের জন্য দুঃখিত মিসেস সান্যাল।

দ্যাটস মাই বিজনেস। এগেন আই ওয়ার্ন যু! ডোন্ট ইন্টারফিয়ার কর্নেল সরকার!

মিসেস সান্যাল! এবার সত্যিই আপনি বিপন্ন।

আপনি চলে যান কর্নেল সরকার।

 মিসেস সান্যাল! আপনি বিপজ্জনক ফাঁদে পা দিয়েছেন।

গোপা এতক্ষণে একটু দমে গেল। আস্তে বলল, কী বলতে চান আপনি?

আপনার স্বামীর খুনী এবার আপনাকে সরিয়ে দেবে পৃথিবী থেকে।

ননসেন্স! ও সুইসাইড করেছে। একটু অসতর্কতার জন্য

না ম্যাডাম! সুদর্শন সুইসাইড করেনি। হি ইজ ডেলিবারেটলি মার্ডার্ড।

গোপা নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইল।

হ্যাঁ। কেউ একটা কাপ এই গ্যাসের চুল্লীর কাছে রেখে দিয়েছিল যাতে সুদর্শন হাতের কাছে পায় এবং তাতে সায়নায়েড বড়ি ব্রেখেছিল। সুদর্শন লক্ষ্য করেনি। কারণ বড়িটা ছিল সাদা। চিনি ছাড়া র কফি খাওয়ার অভ্যাস আমেরিকায় কিছুকাল থাকলে রপ্ত হয়ে যায়।

গোপা শ্বাস ছেড়ে বলল, বাট হি ওয়াজ এ সাইকিক পেশ্যান্ট! সব সময় সবাইকে বলে বেড়াত সুইসাইড করবে। একটা সুইসাইডাল নোটও পাওয়া গেছে।

কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, খুনী সেই সুযোগটা নিয়েছে কাল। সকালে নিচের ঘরে কথা বলার সময় সুদর্শন হঠাৎ বলেছিল, ওই যাঃ চিঠিটা–এখন বুঝতে পারছি, ঝোঁকের বশে একটা সুইসাইডাল নোট কালই সে লিখেছিল। তারপর সেটা নিপাত্তা হয়ে যায়। আই এগ্রি গোপাদেবী, হি ওয়াজ এ সাইকিক পেশ্যান্ট। তাই ওটা সম্পর্কে হইচই বাধায়নি। হয়তো আঁচ করতেই পারেনি ওটা কেউ কাজে লাগাবে।

কিন্তু কে সে?

এখনও জানি না।

সে কি আমাদের মধ্যে কেউ?

জানি না।

 বাট হোয়াট ইজ দা মোটিভ?

এখনও আমার কাছে তা স্পষ্ট নয়। প্লিজ গোপাদেবী! আপনি এখনই আপনার জিনিসপত্র নিয়ে আপনার কোনও আত্মীয়ের বাড়িতে চলে যান। আমি আপনাকে পৌঁছে দিচ্ছি।

কলকাতায় আমার কোনও আত্মীয় নেই।

হোটেল আপনার পক্ষে নিরাপদ নয়। আপনি আমার অ্যাপার্টমেন্টে উঠতে পারেন। তারপর আমেরিকায় ফিরে যান। কোনও ফ্লাইটে ভি. আই. পি. কোটা থেকে একটা সিটের ব্যবস্থা আমি করে দেব।

সরি কর্নেল সরকার। আপনি কেন এসব কথা বলছেন আমার মাথায় আসছে না। নিজেকে বাঁচানোর শক্তি আমার আছে। গোপর মুখে হিংস্রতা ফুটে উঠল। আই হ্যাভ আকোয়ার্ড দা সুপার ন্যাচারাল পাওয়ার, য়ু নো কর্নেল সরকার! আজই আমার প্ল্যান ছিল, প্রেস কনফারেন্স ডেকে তার প্রমাণ দেব। কিন্তু মাই হাজব্যান্ড ইজ ডেড!

পর্দা সরিয়ে তান্ত্রিক ঢুকল। কী হয়েছে গোপা? গোয়েন্দামশাই কি তোমাকে জেরা করছেন?

অবুদা, হি ইজ টেলিং স্ট্রেঞ্জ থিংস!

 ওকে কী বলছেন মশাই?

 কর্নেল জবাব দিলেন না। গোপা বলল, উনি বলছেন মাই লাইফ ইজ ইন ডেঞ্জার।

আঁ? তার মানে?

আর বলছেন, সুদর্শন সুইসাইড করেনি। কেউ নাকি তাকে মার্ডার করেছে।

তান্ত্রিক হাসলেন। গোয়েন্দারা এরকম বলেই থাকে। যার যা বুলি! তুমি ভয় পেয়ো না গোপা! ও মশাই! সুদর্শন যদি খুন হয়েই থাকে খুনী কি আমি? নাকি ওই ভবা?

অবনীবাবু! কর্নেল বললেন। সুদর্শনকে সত্যিই খুন করা হয়েছে।

আমি মশাই খুনটুন করতে পারি না। ভবাটাও না আরশোলা দেখলে ব্যাটাচ্ছেলে তুলকালাম করে। হুঁ, সুদর্শন যদি সত্যিই খুন হয়ে থাকে তাহলে সেই চণ্ডীতলার ব্রহ্মানন্দ খুন করিয়েছে। দাঁড়ান! থানায় খবর দিই!

টের পেলাম, তান্ত্রিক কারণবারি পান করেছে। সে পাশের ঘরে টলতে টলতে ঢুকল। কর্নেল তাকে অনুসরণ করলেন। আমিও ওঁর সঙ্গ ধরলাম। কর্নেল টেলিফোনের কাছে গিয়ে বললেন, অবনীবাবু! এসব কথা পুলিশকে জানালে আপনিই বিপদে পড়বেন।

কেন মশাই? আমি কী করেছি?

পুলিশ প্রথমে আপনাকেই সন্দেহ করবে এবং হাতকড়া পরাবে। বেচারা ভবতারণও রেহাই পাবে না। এবং পুলিশ গোপাদেবীকেও রেয়াত করবে না।

অবনী মৈত্র মাথা দোলালেন। ঠিক। ঠিক বলেছেন মশাই! আমরা তিনজনেই ফেঁসে যাব। কাজেই চেপে যাওয়া যাক। অ্যাই ভবা! সাবধান! বলে কর্নেলের দিকে ঘুরলেন। আচ্ছা গোয়েন্দামশাই! পুলিশ যদি নিজের বুদ্ধিতে টের পায়, সুদর্শন সুইসাইড করেনি, খুন হয়েছে?

টের পাবে না। কারণ আমি যা জানি পুলিশ তা জানে না। সুইসাইডাল নোটই ওদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

ঠিক আছে। আমরা মুখ বুজে থাকব। কী বলল গোপা?

 গোপা হঠাৎ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

কর্নেল তাকে অনুসরণ করে বললেন, গোপাদেবী! আর ভুল করবেন না।

দেখলাম, গোপা নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকল এবং সশব্দে দরজা বন্ধ করল। কর্নেল আস্তে বললেন, চলো জয়ন্ত!

তান্ত্রিক ডাকছিলেন, ও মশাই! শুনুন! শুনুন! যা বাবা! হচ্ছেটা কী?…..