৬. চণ্ডীতলা আশ্রমে

০৬.

সেদিন আমাদের চণ্ডীতলা আশ্রমে যাওয়া হলো না। গোপাকে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের একটা সান্ধ্য ফ্লাইটে দিল্লি এবং দিল্লি থেকে প্যান আমের জাম্বো জেটে করাটি ফ্রাঙ্কফুর্ট-হিথরো হয়ে শিকাগো পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে দিলেন কর্নেল। দমদম এয়ারপোর্ট থেকে কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছতে রাত আটটা বেজে গেল।

ষষ্ঠীচরণ বলল, সেই মেয়েছেলেটা দুবার ফোং করেছিল। কী যেন নামটা

কর্নেল বললেন, অপর্ণা রায়?

আজ্ঞে! তা-ই বটে। ষষ্ঠী কাচুমাচু মুখে বলল, পেটে আসছিল, মুখে আসছিল না।

কর্নেল চোখ কটমটিয়ে বললেন, কফি!

ষষ্ঠী অমনি চলে গেল। সোফায় বসে বললাম, বাপস্! দিনটা যা গেল!

এখনও যায়নি। কফি খেয়েই বেরুব। বলে কর্নেল টেলিফোন তুলে ডায়াল করতে থাকলেন।

আবার বেরুবেন? কোথায়?

কর্নেল ফোনে মন দিলেন।……অপর্ণা আছে?……আমার নাম কর্নেল নীলাদ্রী সরকার। আপনি কি অপর্ণার মা বলছেন?……….কখন বেরিয়েছে? বলে কর্নেল ঘড়ি দেখলেন।…..আচ্ছা। ফিরলে বলবেন আমার কথা।

ফোন রেখে কর্নেল তার ইজিচেয়ারে বসলেন। বললেন, গোপাকে যারা সদানন্দবাবুর ফর্মুলা হাতাতে পাঠিয়েছিল, তারা নিঃসন্দেহে নার্কোটিকসের কারবারি। ব্ল্যাক মেরি অকাল্ট আসোসিয়েশন তাদের মুখোশ। সদানন্দবাবুবর মার্কিন ড্রাগ কারবারিদের যোগাযোগের কথা পুলিশ রেকর্ডে আছে।

ষষ্ঠী কফি রেখে গেল। কফি খেতে খেতে বললাম, কিন্তু গোপার ডাকিনীবিদ্যার নমুনা দেখে তাক লেগে গেছে। হঠাৎ সুগন্ধ, গোলাপকুঁড়ি, কফির কাপে রক্ত! আপনি অলৌকিক শক্তি বলেছিলেন। কিন্তু কস্মিনকালে আপনার অলৌকিক শক্তিতে বিশ্বাসের কথা শুনিনি। ব্যাপারটা ম্যাজিক ছাড়া আর কিছুই নয়।

কর্নেল হাসলেন। কোনও বায়োকেমিস্ট যদি ডাকিনীবিদ্যার চর্চা করে, তাহলে সে অদ্ভুত অদ্ভুত কাণ্ড ঘটিয়ে মানুষকে তাক লাগিয়ে দিতে পারে। গোপা একজন বায়োকেমিস্ট।

বলে কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে উনি চুরুট ধরালেন। তারপর হাত বাড়িয়ে টেলিফোনে ডায়াল করলেন। একটু পরে বললেন, সান্যালবাড়িতে রিং হয়ে যাচ্ছে। কেউ ধরছে না। অবশ্য ভবতারণ নিচের ঘরে থাকে। টেলিফোন আছে ওপরে সুদর্শনের ঘরে….হ্যালো! হ্যালো! আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি।…..ভবতারণ পালিয়েছে? কী করে বুঝলেন? ওর ঘরে….হ্যাঁ। তালাবন্ধ থাকতেই পারে। হয়তো কোথাও গেছে।…..নাহ্! গোপার খবর জানি না। ………ঠিক, ঠিক। আপনার সঙ্গে একমত। ………সে কি মশাই! আপনি তান্ত্রিক মানুষ। আপনার ভয় কিসের? ……আচ্ছা। অপেক্ষা করুন। আমরা যাচ্ছি…….না, না। থানায় জানাবার মতো কিছু নয়। আমি যাচ্ছি।…….

কর্নেল টেলিফোন রেখে ব্যস্তভাবে উঠে দাঁড়ালেন। জিজ্ঞেস করলাম, অবনীবাবু কী বলছে?

ওকে টেলিফোনে কেউ হুমকি দিয়েছে। বাড়ি ছেড়ে না গেলে বডি গঙ্গায় ভাসিয়ে দেবে।

আশ্চর্য তো!

ভবতারণের ঘরে তালাবন্ধ। অবনীর ধারণা, সে এই সুযোগে সুদর্শনের টাকাকড়ি হাতিয়ে কেটে পড়েছে। চলো, বেরিয়ে পড়া যাক।

পথে যেতে যেতে কর্নেল বললেন, গোপার কথা থেকে আমিও আঁচ করেছি, ভবতারণ যে কোনো কারণেই হোক, গোপাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়েছে। মুখোশপরা লোকটা ভবতারণেরই সাজানো ব্যাপার হতে পারে।

কেন ভবতারণ এ কাজ করল?

জানি না। ইচ্ছে ছিল, অ্যাডভোকেট শিবপদবাবুর বাড়ি যাব। রাত নটার পর ওঁকে ফ্রি পাব। আগে তান্ত্রিক সকাশেই যাওয়া যাক। সুদর্শনের ল্যাবটা আর একবার পরীক্ষা করে দেখতে চাই।

এলাকা জুড়ে লোডশেডিং। গেটে টর্চ আর ত্রিশূল হাতে দাঁড়িয়েছিল তান্ত্রিক। গেট খুলে দিল। আমাদের গাড়ি পোর্টিকোর তলায় গেলে ফিরে এল। চাপা স্বরে বলল, তালা এঁটে দিলাম।

সিঁড়ির ওপর বসার ঘরের দরজাতে তালা আটকানো। খুলে দিল। ভেতরে টেবলের ওপর একটা হ্যারিকেন জ্বলছিল। দরজা ভেতর থেকে এঁটে বলল, ওপরে চলুন।

কর্নেল বললেন, আগে সুদর্শনের ল্যাবে যেতে চাই।

 অবনী মৈত্র বলল, আগে আলো আসুক। ততক্ষণ আমার ঘরে

না অবনীবাবু! আমার মাথায় একটা খটকা ঢুকেছে। আমার এই স্বভাব। যতক্ষণ না সেটা ঘোচাতে পারছি, ততক্ষণ আপনার কথায় মন দিতে পারব না।

তান্ত্রিক হ্যারিকেনটা আমাকে ধরতে দিল। আমার গা ছমছম করছিল। গঙ্গার ধারে এই পুরনো বাড়ি যেন অন্ধকারে হিংস্র হয়ে উঠেছে। সুদর্শনের ঘরেও তালা আটকানো ছিল। তালা খুলে দিল তান্ত্রিক। আমরা ভেতরে ঢুকলাম। কর্নেল ঘরের ভেতরটা দেখে নিয়ে খাটের কাছে গেলেন। তারপর বেডকভার তুলে বালিশ সরালেন। কী করছেন, হ্যারিকেনের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না। তারপর উনি পকেট থেকে খুদে টর্চ বের করে সোজা পর্দা তুলে ল্যাবে ঢুকে গেলেন। অবনী হ্যারিকেনটা আমাকে টেবিলে রাখতে বলল। তারপর ভেতর থেকে দরজা এঁটে চাপা স্বরে বলল, সাবধানের মার নেই। তবে এই ত্রিশূলটা দেখছেন, এটা সাংঘাতিক পাওয়ারফুল।

ল্যাব থেকে কর্নেল বেরিয়ে এলেন। অবনী বলল, কী দেখলেন?

ও ঘরের নিচের তলায় ঘর কি কাকেও ভাড়া দেওয়া হয়েছে?

হ্যাঁ। কমাস আগে ভকতবাবুকে ভাড়া দিয়েছি। অ্যাদ্দিন খালি পড়েছিল। ভকতবাবু ওঘরে গোডাউন করেছেন। রঙের পিপে রাখেন। পিসেমশাইয়ের আমলে নিচের ওই ঘরটাই ছিল বসার ঘর।

কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, ল্যাবের যে দরজাটা সকালে বাথরুমের দরজা মনে করেছিলাম, সেটা তালা আটকানো আছে। কেন যে তখন মাথায় এল না বাথরুম হলে তালা বন্ধ থাকবে কেন?

অবনী বলল, ওটা নিচের ঘরে নামার সিঁড়ি। ভাড়া দেওয়ার সময় আমি নিজে তালা আটকে দিয়েছিলাম। ভোলা দেখলেন নাকি?

না। আটকানোই আছে। তবু আপনি দেখে আসুন, সেই তালাটা নাকি।

তান্ত্রিক সবেগে ঢুকে গেল। আমরাও ঢুকলাম। তান্ত্রিক দরজার তালা টেনে দেখে বলল, একই অবস্থায় আছে। একই তালা।

কর্নেল বললেন, চাবি তো আপনার কাছে আছে?

 হুঁ। খুলব নাকি? তবে ভকতবাবু টের পেলে চাঁচামেচি করতে পারেন।

সাবধানে খুলুন।

অবনী তালা খুলল। তারপর দরজা ঠেলল। কিন্তু দরজা খুলল না। সে বলল, সিঁড়ির মাথা পর্যন্ত রঙের পিপে বোঝাই করা আছে। কিংবা এমনও হতে পারে, কখন উনি নিজেই আমার অজান্তে ওদিকের দুই চৌকাঠে একটা কাঠে পেরেক ঠুকে দরজা সিল করে দিয়েছেন। দিনের বেলা খোঁজ নেবখন। মহা ঘুঘু লোক মশাই! রঙের পিপে আমি কিংবা ভবা চুরি করতে পারি ভেবে এই কল্মটি করে রেখেছে।

সুদর্শনের ঘর থেকে বেরিয়ে অবনী তালা আটল। তারপর বলল, আসুন। আমার ঘরে বসবেন।

যেতে যেতে কর্নেল বললেন, মর্গ থেকে সুদর্শনের বডি কখন ফেরত পেলেন?

বিকেলে। কাছেই নিমতলা! সাড়ে সাতটার মধ্যে দাহক্রিয়া শেষ। বাড়ি ফিরে দেখি, তখনও ভবার পাত্তা নেই। তারপর উড়ো ফোনে হুমকি।

গোপা যে ঘরে থাকত, তার পাশে অবনীর ঘর। দরজা খুলতেই ধূপধুনোর কড়া গন্ধ ভেসে এল। অবনী আমার হাত থেকে হ্যারিকেন নিয়ে ঘরে ঢুকল। বলল, আসুন। এই আমার ডেরা।

বাঁদিকে একটা জলচৌকিতে সম্ভবত নকল বাঘছালের আসন পাতা। নিচে প্রকাণ্ড ধূপদানি। আসনের একপাশে মড়ার খুলি। পেছনে মা কালীর বিশাল পোর্ট্রেট। তার পেছনে বইয়ের র‍্যাক পুরনো জীর্ণ বইয়ে ঠাসা। একটা কমণ্ডলুও দেখতে পেলাম। ঘরের অন্য পাশে মেঝেয় পরিপাটি সুদৃশ্য গৈরিক বেডকভারে ঢাকা বিছানা পাতা আছে।

তান্ত্রিক পশ্চিমের দরজা খুলে দিল। বলল, গঙ্গার দিক থেকে ফুরফুরে বাতাস আসে। বুঝতে পারছি, লোডশেডিংয়ে আপনাদের গরম লাগছে। আহ্। এই দেখুন, কেমন সুন্দর বাতাস আসছে! এখানে আসুন।

লক্ষ্য করলাম, দরজার ওধারে পোর্টিকোর ছাদ। রেলিঙ আছে। সেখানে গিয়ে দুটো চেয়ার দেখলাম। বুঝলাম গোপা এবং অবনী এখানে রাত্রে বসে থাকত।

কর্নেল একটা চেয়ারে বসলেন। আমি অন্যটায় বসলাম। অবনী রেলিঙে ঝুঁকে টর্চের আলো ফেলে প্রাঙ্গণ এবং মন্দির পর্যন্ত দেখে নিল। তারপর চাপা স্বরে বলল, আপনি টেলিফোন না করলে আমি থানায় যেতাম।

বললাম, আপনার ত্রিশূল থাকতে থানায় কেন?

ত্রিশূল তো আছেই মশাই! তা হলেও আইন বলে কথা। তাই না কর্নেল সাহেব?

কর্নেল সায় দিলেন। হ্যাঁ। তাছাড়া আইনত আপনি উইলের ট্রাস্টি।

অবনীর কণ্ঠস্বর বদলে গেছে। ক্ষমা চাইছি কর্নেল সাহেব! ওই একটা মিথ্যা কথা বলেছি। বাদ বাকি সব সত্যি।

উইলের ট্রাস্টি আডভোকেট শিবপদ ঘোষ?

 জানেন আপনি?

 ভকতবাবু বলছিলেন। উনি নাকি উইলের একজন সাক্ষী।

হ্যাঁ। অবনী আবার চাপাস্বরে বলল, আমার সন্দেহ, ওই ব্যাটাছেলেই উড়ো ফোনে আমাকে হুমকি দিয়েছে। ও এই বাড়িটা ছলেবলে দখল করতে চায়।

আচ্ছা অবনীবাবু, ভাড়াটেদের কাছে মাসে মোট কত ভাড়া পান আপনি?

আমি মাত্র হাজার টাকা পাই। বাকি দু হাজার শিবু উকিল ব্যাঙ্কে নাকি জমা রাখে। খুলে বলি। ভকতবাবুর পাঁচশো, তারক মুদির দেড়শ, রামবহাল ভুজাওয়ালার পঞ্চাশ, হাবুলের স্টেশনারি স্টোর্সের দুশো আমি পাই। শিবু উকিল এই ব্যবস্থা করে দিয়েছে। বাকি ভাড়াটেরা তাকেই টাকা দেয়।

নিয়মিত আপনার শেয়ার আপনি পান?

নাহ্। ভাড়া আদায় বড় ঝামেলার কাজ। শিবু উকিলের কাছ থেকে আমার শেয়ারের ভাড়াটেদের পয়লা তারিখে রসিদ এনে রাখি। আদায় করতে রক্ত জল হয়ে যায়। এদিকে দেখুন, ভবা মাহে পাঁচশো করে শিবু উকিলের কাছ থেকে নিয়ে আসে। অবনী ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ল। নেহাত মায়ের মন্দিরের সেবার জন্য এখানে পড়ে আছি। চলে গেলে মা রুষ্ট হবেন। মন্দিরে মায়ের সামনে ধ্যানে বসলেই শুনি মা বলছেন, অবু! আমাকে ছেড়ে যেন চলে যানে। তাই আছি। বুঝলেন তো?

বুঝলাম। কিন্তু মায়ের সেবার খরচের টাকা কি শিববাবু দেন না?

 নাহ্। বলে ওই হাজার টাকা থেকেই সব হয়ে যাবে। শুধু বাৎসরিক পুজোর সময় উইলের শর্ত অনুসারে শিবু উকিল নিজে সব ব্যবস্থা করে। ধূমধাম হয়। আলোটালো মাইক কিন্তু তখন আমি কে? পাড়ার মস্তানরা এসে জোটে। তখন তারাই সব।

মূর্তি কি পাথরের?

 আজ্ঞে! পিসেমশাইয়ের ঠাকুর্দা গঙ্গায় স্নান করতে গিয়ে মাকে পেয়েছিলেন।

এই সময় আলো জ্বলে উঠল। অবনী বলল, বসুন। দেখি গোপার ঘরে কফির প্যাকেট পাই নাকি। ও তো সব নিয়ে গেছে। কফি না পেলে চা খাওয়াব।

চলুন, গোপার ঘরটা একটু দেখি।

অবনী পাশের ঘরের দরজা খুলল। সেই ঘরে ঢুকতেই ঝাঁঝালো সুগন্ধ টের পেলাম। জানালা বন্ধ ছিল। সুইচ টিপে আলো জ্বালল অবনী। করিডরের দিকের দরজা বাইরে থেকে আটকানো দেখেছি। ঘরের ভেতর একটা খাট। খাটে শুধু ম্যাট্রেস আছে, চাদর নেই। ডেসিং টেবিল আছে। কোনও প্রসাধনী নেই। ওয়াড্রোব হাট করে খোলা। মেঝেয় একটা সুন্দর গালিচা পাতা আছে। অবনী বলল, সব নিয়ে গেছে। শুধু কার্পেটটা বাদে।

কর্নেল বললেন, কার্পেটটা গোপা এনেছিল?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

কর্নেল ঘরের ভেতরটা খুঁটিয়ে দেখার পর আস্তে বললেন, অবনীবাবু! যদি কিছু মনে না করেন, একটা কথা জিজ্ঞেস করব।

স্বচ্ছন্দে।

সুদর্শন আমাকে বলেছিল, সে গোপার সঙ্গে আপনাকে নাকি

তান্ত্রিক অদ্ভুত শব্দে হাসল। মেন্টাল পেশ্যান্ট মশাই! সবসময় প্রলাপ বকত। তবে এটা ঠিক, গোপাকে আমি সাধন সঙ্গিনী করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু মহা ধড়িবাজ মেয়ে মশাই! ছলাকলায় ওস্তাদ!

কর্নেল হাসলেন। আপনাকে পাত্তা দেয়নি!

অবনী মুহূর্তে গম্ভীর হয়ে বলল, স্বয়ং এক ডাকিনীর বাস ওর মধ্যে। তাকে বশ করতে সময় লাগত। হাত ফসকে পালিয়ে গেল। হারামজাদা লাশ একবার পেলে মায়ের সামনে বলি দেব। গোপাকে কী ভয় দেখাল ক ৷ এত বড় প্রপার্টি ফেলে পালিয়ে গেল?

ভকতবাবু বলছিলেন, গোপার বিয়ে হয়েছে আমেরিকায়। কাজেই এখানে স্বামীর প্রপার্টি পেতে আইনের ঝামেলা আছে। তার চেয়ে বড় কথা, গোপা। মার্কিন নাগরিক। হ্যাঁ, স্বামী যে দেশের নাগরিক, স্ত্রী ভিন্ন দেশের হলেও স্বামীর দেশের নাগরিকত্ব সে আপনাআপনি পাবে। কিন্তু বিয়েটা হিন্দু প্রথা বা সামাজিক আচার অনুসারে হয়েছিল কি না, তার প্রমাণ চাই।

অবনী হাঁ করে শুনছিল। বলল, এত ফ্যাকড়া?

গোপার সঙ্গে এ নিয়ে আপনার আলোচনা হয়নি?

 গোপাকে আমি বলেছিলাম উইলের কথায় কিন্তু আমার কথায় কান করেনি।

গোপা কি আপনাকে বলেছিল আমেরিকায় ফিরে যাবে?

তো। ও এদেশে থেকে ডাকিনীতন্ত্রের চর্চা করবে বলেছিল।

কর্নেল একটা দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। দরজায় পর্দা ঝুলছিল। পর্দা তুলে বললে, ঘরটা কি খালি?

অবনী দরজার ছিটকিনি খুলে বলল, না। ওটাই তো সুদর্শনের ঘর।

বুঝলাম করিডর দিয়ে গেলে সুদর্শনের ঘরের একটা দরজা এবং এ ঘর থেকে গেলে আরেকটা দরজা তার মানে, গোপার ঘর থেকে পা বাড়ালেই সুদর্শনের ঘর।

কর্নেল বললেন, থাক। ও ঘরে আর যাব না। বলে আমার দিকে ঘুরলেন। জয়ন্ত এবার কিন্তু অলৌকিক শক্তি নয়, ম্যাজিক দেখতে পাবে।

উনি গালিচাটা সরিয়ে দিলেন। মেঝেয় গোলাকার ইঞ্চটাক একটা গর্ত দেখতে পেলাম। অবনী কাচুমাচু মুখে বলল, পুরনো বাড়ি। ছুঁচো ইঁদুরের বড্ড উপদ্রব।

কর্নেল গর্তে প্রায় নাক ঠেকিয়ে বসলেন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ফরাসি পারফিউম এই গর্ত দিয়ে পিচকিরিতে ছড়ানো সোজা। নিচের ঘরে ফ্যান ঘুরলে একটু পরে উবে যায়। গোলাপকুঁড়িও গর্ত দিয়ে গলিয়ে ফেলা যায়।

বললাম, কিন্তু কফির কাপে রক্ত?

সি ইজ আ বায়োকেমিস্ট, জয়ন্ত! মুর্গির রক্তকে রাসায়নিক সংশ্লেষণ প্রক্তিয়ায় জমিয়ে একটা কণার আকারে কাপে রেখে গরম কফি ঢাললে দু-তিন মিনিটের মধ্যে কণাটা গলে যায় এবং কফি লাল হয়ে ওঠে।

আমি বলেছিলাম ম্যাজিক! আপনি বলেছিলেন অলৌকিক শক্তি।

কর্নেল হাসলেন। কার্য কারণ তত্ত্ব অনুসারে কার্যে অলৌকিক শক্তির প্রকাশ এবং কারণটা ম্যাজিক। কাজেই আমরা দুজনেই ঠিক বলেছিলাম।

অবনী জোরে শ্বাস ছেড়ে বলল, আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না।

কর্নেল বললেন, ও কিছু না। চলুন, আপনার ঘরে যাই।

এবার তান্ত্রিক পোর্টিকোর ছাদ থেকে চেয়ার দুটো ঘরে নিয়ে এল। ফ্যান চালিয়ে দিল। আমরা চেয়ারে বসলাম। সে বলল, তাহলে দু কাপ চা করে আনি কর্নেল সাহেব?

থা। আপনাকে আর কষ্ট করতে হবে না। প্রায় সাড়ে দশটা বাজে। একটা প্রশ্ন করে আমরা উঠব।

বলুন!

সুদর্শনের মা করুণাময়ী কোথায় আছেন আপনার জানার কথা।

অবনী একটু চুপ করে থাকার পর বলল, পিসিমা চণ্ডীতলা আশ্রমে আছেন। আমার পিসেমশাই খুব বাজে লোক ছিলেন। ফ্যামিলির স্ক্যান্ডাল রটাতে নেই। তবে পিসিমাও ভুল করেছেন। ব্রহ্মানন্দ ব্যাটাছেলের পাল্লায় পড়া ওঁর উচিত হয়নি। আমাকে মাঝে মাঝে চিঠি লিখে যেতে বলেন। ওই ভণ্ড সাধুর জন্য যাই না।

ছেলের মৃত্যুর খবর ওঁকে পাঠিয়েছেন?

 শিবু উকিল পাঠিয়েছে। শ্মশানে গিয়েছিল। তখন বলল।

কর্নেল হঠাৎ ব্যস্তভাবে উঠে দাঁড়ালেন। আচ্ছা চলি অবনীবাবু। আপনার ভয়ের কারণ নেই। ফোনে কেউ শাসালে আপনিও পাল্টা শাসাবেন।