৭. ঘিঞ্জি ট্রামরাস্তা

০৭.

ঘিঞ্জি ট্রামরাস্তার দুধারে দোকানপাট এত রাত্রে বন্ধ। একটা পান-সিগারেটের দোকানে জিজ্ঞেস করে আডভোকেট শিবপদ ঘোষের বাড়ির খোঁজ পাওয়া গেল। হর্নের শব্দে দারোয়ান যেভাবে শশব্যস্তে গেট খুলে দিল, বুঝলাম শাঁসালো মক্কেলদের জন্য উকিলবাবুর দরজা সর্বদা অবারিত এবং অনেক রাত্রি পর্যন্ত মক্কেল আসে। কর্নেল ড্যাশবোর্ডের আলোয় একটা কাগজ পড়ছিলেন। পকেটে রেখে দিলেন। কৌতূহলটা থেকেই গেল। গাড়ি লনে পৌঁছুলে লক্ষ্য করলাম, এখনও মক্কেলের ভিড় জমে আছে। বারান্দায় একজন ধুতিপাঞ্জাবি পরা লোককে ঘিরে জনা তিন মক্কেল জটলা করছে। আমাদের দেখে সেই লোকটি তাদের তক্ষুনি বিদায় দিয়ে সম্ভাষণ করলেন, ভেতরে আসুন স্যার।

ঘরটা প্রশস্ত। আইনের বইয়ে ঠাসা অনেকগুলো আলমারি দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড় করানো। কার্পেট ঢাকা মেঝে এবং সারবন্দি অগুনতি গদি আঁটা চেয়ার। কয়েকজন অবাঙালি ভদ্রলোক বসে আছেন। নামী ডাক্তারের চেম্বারে যেন রোগীরা উদ্বিগ্ন মুখে অপেক্ষা করছেন। ও পাশে একটা ঘরে অফিস দেখা যাচ্ছিল। সে ঘরেও এতরাত্রে কর্মব্যস্ততা।

ধুতিপাঞ্জাবি পরা ভদ্রলোক সম্ভবত উকিলবাবুর ক্লার্ক, চলতি কথায় যাঁদের মুহুরিবাবু বলা হয়। অমায়িক হেসে বললেন, একটুখানি বসতে হবে স্যার।

কর্নেল তাঁর নেমকার্ড দিয়ে বললেন, কার্ডটা দিয়ে আসুন। আমরা অনেক দূর থেকে আসছি।

ভদ্রলোক অফিসঘরে ঢুকে গেলেন এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ফিরে এসে বললেন, আসুন।

অফিস ঘরের একধারে পার্টিশন করা চেম্বার। ভেতরে বেঁটেখাটো মোটাসোটা মধ্যবয়সী গুঁফো এবং রাশভারী চেহারার অ্যাডভোকেট প্রায় সিংহাসনসদৃশ একটা আসনে বসেছিলেন। সামনে বিশাল সেক্রেটারিয়েট টেবিল। উঠে দাঁড়িয়ে তিনি গম্ভীর মুখে নমস্কার করে বললেন, বসুন। আপনারা আসবেন আমি জানতাম।

কর্নেল বললেন, জানতেন?

শিববাবু বললেন, কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না কেন সুদর্শন প্রাইভেট ডিটেকটিভ লাগিয়েছিল!

সরি মিঃ ঘোষ! আম প্রাইভেট ডিটেকটিভ নই। আমার সঙ্গীর পরিচয় দিই। জয়ন্ত চৌধুরী দৈনিক….

জানি। আপনাদের দুজনেরই পরিচয় আমার অজানা নয়।

 অবনীবাবুর কাছে জেনেছেন?

শিববাবু সে-কথার জবাব না দিয়ে বললেন, সুদর্শন সুইসাইড করেনি। হি ইজ মার্ডার্ড। এই নাকি আপনার ধারণা। আপনি নিশ্চয় তেমন কোনও প্রমাণ পেয়েছেন? বেশ তো! পেয়ে থাকলে বলুন, একজন ল-ইয়ার হিসেবে আমি লিগ্যাল স্টেপ নেব।

মিঃ ঘোষ! আমি সদানন্দবাবুর উইল সম্পর্কে জানতে এসেছি। কারণ আপনিই নাকি উইলের শর্ত অনুসারে সম্পত্তির ট্রাস্টি।

হ্যাঁ। আমি ট্রাস্টি। বলুন আর কী জানতে চান?

সুদশনের অবর্তমানে সম্পত্তি কে পাবে?

 তার স্ত্রী। স্ত্রী না থাকলে চণ্ডীতলা আশ্রম।

 তাহলে এখন সম্পত্তির মালিক সুদর্শনের স্ত্রী গোপা?

গোপা সম্পত্তি দাবি করলে তাকে প্রমাণ করতে হবে সে সুদর্শনের স্ত্রী। শিববাবু ঠোঁটের কোণে তীক্ষ্ণ হাসলেন। কিন্তু সে তো হঠাৎ বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে।

তাকে ভবতারণ ভয় দেখিয়ে চলে যেতে বাধ্য করেছে।

বলেন কী? তা সুদর্শনের স্ত্রী কি এখন আপনার শেল্টারে আছে?

না! আমেরিকা ফিরে গেছে।

তাই বুঝি? আডভোকেট আরও গম্ভীর হলেন। একটু পরে বললেন, আর কিছু জানতে চান?

সুদর্শন আপনাকে বলেছিল সুইসাইড করবে। তাই না?

ও আমেরিকা যাওয়ার আগে থেকেই মেন্টাল পেশেন্ট। শিববাবু ঘড়ি দেখলেন। এনিওয়ে, আপনি যদি সত্যি প্রমাণ পেয়ে থাকেন, সুদর্শনকে কেউ বিষ খাইয়ে মেরেছে, আম আপনার পাশে আছি। কী বিষ যেন?

পটাসিয়াম সায়নায়েড, মিঃ ঘোষ!

হ্যাঁ। পোস্টমর্টেম রির্পোট আমি দেখেছি। ও বাড়িতে খুঁজলে হয়তো এখনও অনেক মারাত্মক বিষ বেরুবে। সদানন্দের ওষুধের কারখানা ছিল। তাছাড়া তার ছেলে বায়োকেমিস্ট ছিল। ছেলের বউও বায়োকেমিস্ট। হাসলেন শিববাবু। মেয়েটা নাকি ডাকিনীবিদ্যারও খেল দেখাত। ওদিকে অবুটাও তন্ত্রমন্ত্র নিয়ে থাকে। যত রাজ্যের পাগলের আখড়া! তবে আপনি বলছেন, সুদর্শনকে মারা হয়েছে। কে মারবে? কেনই বা মারবে? ওর স্ত্রীকে সন্দেহ করা যেত। কিন্তু আপনি বলছেন সে আমেরিকা ফিরে গেছে। এবার বলুন, হোয়াট ইজ দা মোটিভ অব দা মার্ডার?

জানি না। আচ্ছা মিঃ ঘোষ, এবার তা হলে প্রপার্টি আপনি আশ্রমের হাতে তুলে দেবেন?

দিতে বাধ্য। সুদর্শনের বউ যখন আমেরিকা চলে গেছে বলছেন, তখন ধরে নেওয়া যায় লিগ্যাল ম্যারেজের প্রমাণ তার হাতে নেই।

ভবতারণকে আপনি চণ্ডীতলা পাঠিয়েছেন কেন মিঃ ঘোষ?

আপনি প্রাইভেট ডিটেকটিভ। আপনার নজর রাখা স্বাভাবিক। কিন্তু ব্যাপারটা কী খুলে বলুন তো?

ভবতারণের সাহায্য নিয়ে গোপাকে ভয় দেখিয়ে তাড়ানো হয়েছে, পাছে গোপা প্রপার্টির দাবি করে।

আডভোকেট বড় বড় চোখে তাকিয়ে বললেন, আপনি কী বলছেন বুঝতে পারছি না।

হা মিঃ ঘোষ! এবং কাজটা আপনিই করেছেন।

 শিববাবু নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রুষ্টস্বরে বললেন, প্রমাণ করতে পারবেন?

কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। প্রমাণ করা কঠিন কাজ নয় মিঃ ঘোষ! আপনি চণ্ডীতলা আশ্রমের হাতে সদানন্দবাবুর প্রপার্টির তুলে দিতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। আশ্রম প্রপার্টির স্থাবর অংশ যাতে ভকতজিকে জলের দরে বিক্রি করে, তার

ব্যবস্থা আপনি করে রেখেছেন। ভকতজি ওই বাড়িতে মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং তৈরি করবেন। আপনি পাবেন প্রচুর কমিশন।

আডভোকেট বাঁকা হাসলেন। আপনি দেখছি অন্তর্যামী!

না মিঃ ঘোষ! কিছুক্ষণ আগে সুদর্শনের ঘরে ঢুকেছিলাম। স্রেফ ইনটুইশন বলতে পারেন। সকালে ওর বিছানা পরীক্ষার প্রয়োজন মনে করিনি। হঠাৎ মনে হলো, বিছানাটা দেখা উচিত। দেখতে গিয়ে বালিশের তলায় ভাজকরা একটা কাগজ পেয়েছি। গোপাকে লেখা সুদর্শনের একটা চিঠি। চিঠিটা সকালে পেলে গোপাকে আমেরিকা ফিরতে দিতাম না।

শিববাবু শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, কী চিঠি?

সুদর্শন আপনার প্ল্যানের কথা টের পেয়ে গোপাকে সতর্ক করতে চেয়েছিল। কিন্তু যে-কোনও কারণেই হোক, চিঠিটা গোপাকে দেয়নি। কিংবা পরে দেবে ভেবেছিল! কিন্তু দেবার সুযোগ আর পায়নি।

চিঠিটা দেখতে পারি?

সরি মিঃ ঘোষ! চিঠিটা আপনাকে দেখানো যাবে না।

পিছন থেকে শিববাবু বললেন, ডোন্ট ফরগেট দ্যাট আই আম এ লিগ্যাল এক্সপার্ট। ওই সব চিঠিফিটি দিয়ে কিস্যু হবে না মশাই! যা পারবেন, করুন।

কর্নেল কোনও জবাব দিলেন না। বললেন, চলো জয়ন্ত।

.

 পথে যেতে যেতে বললাম, আমার অবাক লাগছে! সুদর্শন গোপাকে ঘৃণা করত। গোপাকে সে খুন করবে বলছিল। এমনকি গোপার জন্যই সে সুইসাইড করতে চেয়েছিল। সেই গোপাকে সে অমন একটা চিঠি লিখল?

চিঠিটা পড়লে তুমি ব্যাপারটা বুঝবে। কর্নেল হাসলেন। প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে। এত রাত্রে তোমাকে সল্ট লেকে ফিরতে দিচ্ছি না। আজকাল রাতের কলকাতা বড় ভয়ঙ্কর।

কাগজের অফিস থেকে ফিরতে আমার রাত একটাও বেজে যায় কোনও কোনও দিন। কাজেই ভয় দেখাবেন না।

ডাইনের গলিতে ঢোকো জয়ন্ত! কুইক! একটা গাড়ি আমাদের ফলো করছে।

ব্যাকভিউ মিররে একটা গাড়ির আলো চোখে পড়ল। গাড়িটা জোরে আসছিল। ডাইনে ঢুকে গেলাম। নির্জন আঁকাবাঁকা গলিরাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে গ্রে স্ট্রিট। তারপর কর্নেলের কথামতো বাঁয়ে ঘুরে সোজা গিয়ে উঠলাম এ.পি.সি. সার্কুলার রোডে।

কর্নেলের বাড়িতে পৌঁছে বললাম, গাড়িটা কি সত্যিই আমাদের ফলো করেছিল?

হ্যাঁ। সুদর্শনের বাড়ি থেকে বেরিয়ে শিববাবুর বাড়ির কাছে গাড়িটা দেখেছিলাম। আমরা শিববাবুর বাড়ি থেকে চলে আমার কিছুক্ষণ পরে দেখলাম বাগবাজারে ঢুকছে। আমার ধারণা, আমরা সুদর্শনের বাড়ি ঢোকার সময় থেকেই আমাদের ওপর নজর রাখা হয়েছিল।

গাড়ির নাম্বার লক্ষ্য করেছেন?

সঙ্গে বাইনাকুলার থাকলে নাম্বার দেখতে পেতাম। তবে গাড়িটা কালো আম্বাসাডার। যাই হোক, খিদে পেয়েছে। ষষ্ঠী! আমরা খাব।

ষষ্ঠীচরণ বলল, সব রেডি বাবামশাই!

কেউ ফোং করেনি?

ষষ্ঠীচরণ তুম্বো মুখে বলল, সেই মেয়েছেলেটা সকালে আসবে বলেছে।

খাওয়ার পর ড্রয়িংরুমে বসে অভ্যাসমতো কর্নেল কফির পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বললেন, অপর্ণা কাল কলেজে যায়নি। কাল সুদর্শন তার কাছে গিয়েছিল। তারপর সে চণ্ডীতলা আশ্রমে গিয়েছিল। কৃষ্ণনগর থেকে কলকাতা আসার ট্রেন বা বাস প্রচুর। রাত একটায় বাড়ি ফিরে চিঠিটা লিখেছিল।

বললাম, চিঠিটা দিন। পড়ি।

কর্নেল পকেট থেকে ভাঁজ করা একটা কাগজ বের করে আমাকে দিলেন। খুলে দেখি, ইংরেজিতে লেখা একটা চিঠি। বাংলায় অনুবাদ করলে মোটমুটি এই দাঁড়ায়ঃ

 গোপা,
তোমাকে আমি ঘৃণা করি। ভেবেছিলাম তোমাকে আগে খুন করে তারপর আত্মহত্যা করব। কিন্তু তুমি ডাইনি। ডাইনিকে খুন করা সহজ নয়। কাজেই তোমাকে রেহাই দিলাম। তুমি বেঁচে থাকো। অবনীদার সঙ্গে তোমার অবৈধ সম্পর্ক বৈধ করে নিও। তবে অবনীদা লোকটা ভাল নয়। তোমাকে বাবার যে গোপন ফাইলটা দিয়েছিলাম, অবনীদা টের পেলে সেটা হাতাবে। কিংবা তোমাকে নিষিদ্ধ মাদক তৈরিতে প্ররোচিত করবে। তাই তোমার ভালোর জন্য ফাইলটা তোমার স্যুটকেস থেকে চুরি করেছি। আর একটা কথা। আজ চণ্ডীতলা আশ্রমে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। মা আমাকে আসতে দিচ্ছিলেন না। জোর করে চলে এলাম। মা আমাকে সাবধান করে দিয়ে বলেছেন, শিবু উকিল আর ভকতবাবু চক্রান্ত করেছে। আমি যেন তোমাকে নিয়ে শিগগির আমেরিকা ফিরে যাই। তাহলে বাড়িটা আশ্রমের দখলে আসবে না এবং ভকতজিও জলের দরে কিনতে পারবে না। স্বামী ব্রহ্মানন্দ নাকি সাদাসিধে মানুষ। ভকতজি তাঁকে ভক্তিতে নুইয়ে ফেলেছে। তাকে স্বামী ব্রহ্মানন্দ কথা দিয়েছেন, বাড়িটা যদি আশ্রমের হাতে কোনদিন আসে, তাহলে ভকতজিকেই বেচে দেবেন। ভক্তের সঙ্গে দরাদরি আবার কী? ভকতজি মাত্র পঞ্চাশ হাজার টাকা দেবে। অথচ বাড়িটার দাম খালি জমিসমেত এ বাজারে অন্তত কয়েক লক্ষ টাকা। যাই হোক, আমি আত্মহত্যা করার কথাটা মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলতে পারিনি। কিন্তু আমি আত্মহত্যা তো করবই। তারপর তুমি আমার প্রপার্টির মালিক হবে। তাই তোমাকে সাবধান করে দেওয়া আমার কর্তব্য। আর বেশি কিছু লেখার ধৈর্য নেই। তুমি ডাইনি। শিবু উকিল আর ভকতজিকে তুমি তোমার ডাইনিবিদ্যার জোরে জব্দ করতে পারবে।..

চিঠিটা তাড়াহুড়ো করে লেখা। তলায় সুদর্শন তারিখ দিয়ে সই করেছে। সময় রাত তিনটে পনের, তা-ও লিখেছে।

বললাম, বদ্ধ পাগল!

কর্নেল চিঠিটা আমার কাছ থেকে নিয়ে বললেন, বদ্ধ পাগল নয়। অসুখটা সম্ভবত স্কিটজোফ্রেনিয়া। এ সব মানসিক রোগীর কাছে বাস্তব-অবাস্তবের সীমারেখা ঘুচে যায়। সে কী করছে, তা অনেক সময় টের পায় না। হ্যালুসিনেশন বা ভুল দেখা এই অসুখের একটা লক্ষণ। তাছাড়া এদের কাছে বেঁচে থাকাটা অর্থহীন হয়ে পড়ে। কাজেই সুদর্শন কোনও এক সময়ে আত্মহত্যা করতই। কিন্তু খুনীর তর সইছিল না।

বললাম, শিববাবু এবং ভকতজি ভবতারণকে দিয়ে খুন করিয়েছেন। আমি শিওর। কারণ সুদর্শনের সুইসাইডাল নোট চুরি এবং তার কফির পেয়ালা সায়নায়েড রাখা বাইরের লোকের পক্ষে সম্ভব নয়। তা ছাড়া সে মুখোশপরা একটা লোকের সাহায্যে ভয় দেখিয়ে গোপাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়েছে, এটা তো আপনারই সিদ্ধান্ত।

কর্নেল চুরুটের ধোঁয়ার মধ্যে বললেন, হ্যাঁ। ভবতারণ এটা করেছে। শিববাবু এবং ভকতজির কথাতেই করেছে। উইল অনুসারে নাকি তার পাঁচশো টাকা মাসোহারা। তার মতো মানুষ ওঁদের কথায় দায়ে পড়ে এ কাজ করতেই পারে। তা ছাড়া গোপাকে সে হয়তো পছন্দ করত না। চণ্ডীতলা আশ্রমে চিঠি নিয়ে যেতেও সে বাধ্য। কিন্তু

কিন্তুটা কিসের?

সুদর্শনের সুইসাইডাল নোট ইংরেজিতে লেখা। ভবতারণ ইংরেজি জানে না। তারচেয়ে বড় কথা, শিববাবু এবং ভকতজি সুইসাইডাল নোটের খবর পেলেন কী ভাবে? সুদর্শন সবাইকে বলে বেড়িয়েছে সুইসাইড করবে। কিন্তু অলরেডি সেই চিঠিও লিখে রেখেছে, এমন কথা কি তার পক্ষে বলা সম্ভব? কোনও আত্মহত্যাকারী কি বলে বেড়ায় আত্মহত্যার চিঠিও লিখে ফেলেছে?

সুদর্শনের মতো মানসিক রোগীর পক্ষে–

 বাধা দিয়ে কর্নেল বললেন, তাহলে তোমাকে এবং গতকাল সকালে আমাকেও বলত। মানসিক রোগী বলেই বাকি কথাটাও বলা তার পক্ষে স্বাভাবিক ছিল। স্মরণ করো জয়ন্ত, কাল সকালে সে আমাদের সঙ্গে কথা বলার সময় ওই যাঃ! চিঠিটা বলে হঠাৎ সে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। যদি চিঠিটা হারিয়ে গিয়ে থাকত, সে হইচই বাধাত। অন্তত গোপা জানতে পারত। গোপা আমাদের সে কথা বলত। এ থেকে ধরে নিচ্ছি, চিঠিটা সে লিখতে লিখতে উঠে এসেছিল। লেখার পর কোথাও লুকিয়ে রেখেছিল। সেখান থেকে কেউ চুরি করে। সুদর্শন নিশ্চয় টের পায়নি। পেলে সাবধান হয়ে যেত। এখানেই আসছে টাইমিংয়ের প্রশ্ন। সুদর্শন আত্মহত্যার নির্দিষ্ট সময় স্থির করেনি। এমনকি গতরাত্রে গোপাকে লেখা চিঠিতেও তার আভাস নেই।

গোপাকে আপনি সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দিয়েছেন দেখছি!

 দিয়েছে। কারণ তার মিশন ছিল ভিন্ন। কয়েক লক্ষ টাকার প্রপার্টির চেয়ে সদানন্দবাবুর ফর্মুলার দাম অনেক বেশি। সুদর্শন তাকে ওটা দিয়েছিল। তার মৃত্যুর পর গোপা আবিষ্কার করেছে, ওটা স্যুটকেসে নেই।

তা হলে অবনী মৈত্র—

হ্যাঁ। অবনী আমার সন্দেহের তালিকায় আছে।

তার মোটিভ?

টাকার বিনিময়ে ভকতজিকে সুইসাইডাল নোট সে বেচতেই পারে। কিন্তু তাকে কেউ টেলিফোনে নাকি ভয় দেখিয়েছে। এর কারণ কী?

কর্নেল চুরুট অ্যাশট্রেতে ঘষে নিভিয়ে বললেন, মাই গুডনেস! রাত প্রায় একটা বাজে। শুয়ে পড়া যাক…

ভোরে উঠে কর্নেল বাড়ির ছাদে তাঁর বিচিত্র শূন্যোদ্যান পরিচর্যায় যান। আটটায় নেমে আসেন। সাড়ে আটটায় ষষ্ঠীর ডাকে ঘুম ভাঙল। ষষ্ঠী মুচকি হেসে বলল, সেই মেয়েছেলেটা এয়েছে দাদাবাবু!

অপর্ণা রায়?

আজ্ঞে। আপনি বাথরুম সেরে আসুন। কফি রেডি করি গে।

কিছুক্ষণ পরে কফির পেয়ালা হাতে ড্রয়িংরুমে গেলাম। কর্নেল তার রীতি অনুসারে সম্ভাষণ করলেন, মর্নিং জয়ন্ত! আশা করি সুনিদ্রা হয়েছে।

অপর্ণার মুখে শোকদুঃখের গাঢ় ছাপ। আস্তে আস্তে বলল, আমি উঠি কর্নেল সরকার! এখান থেকে শেয়ালদা চলে যাব। আজ কলেজে না গেলেই নয়।

সে চলে যাওয়ার পর বললাম, অপর্ণা কী বলছে?

সুদর্শন তাকে একটা ফাইল রাখতে দিয়ে এসেছিল কিসের বুঝতে পারেনি অপর্ণা।

নড়ে বসলাম। সেই ড্রাগ ফর্মুলার ফাইল?

হাঁ। সুদর্শন অপর্ণাকে বলেছিল, পরে একসময় সে ওটা ফেরত নেবে। তবে তারপর আত্মহত্যা সে করবেই।

তা হলে দেখা যাচ্ছে, সে আত্মহত্যার সময় ঠিক করেনি।

ঠিক ধরেছ।

 ফাইলটা কি এখনও অপর্ণার কাছে আছে?

না। আমাকে দিয়ে গেল। বলে কর্নেল টেবেলের ড্রয়ার থেকে একটা ছোট্ট প্যাকেট বের করলেন। কাগজের মোড়ক খুলতেই একই সাইজের একটা ফাইল বেরুল। কর্নেল বললেন, দেখ। বুঝতে পারো নাকি।

ক্লিপে আঁটা এক গোছা পুরনো কাগজপত্রে ইংরেজিতে অজানা শব্দ লেখা এবং দুর্বোধ্য আঁকজোক। পাতায়-পাতায় নকশাও আছে। ফেরত দিয়ে বললাম, এক বর্ণ বুঝলাম না। তবে আপনি কোটিপতি হওয়ার এমন সুযোগ আর পাবেন না।

কর্নেল গোমড়া মুখে বললেন, ফাইলটা এখনই পুড়িয়ে ফেলব। এটা সাংঘাতিক বিষধর সাপ। চলো, ছাদে গিয়ে এটা পোড়ানো যাক।

ছাদের বাগানের এক কোণে কর্নেল ফাইলটা পুড়িয়ে ছাই করে দিলেন। তার একটু পরে ষষ্ঠীচরণ এসে বলল, এক সাধুবাবা এয়েছেন। বললেন, খুব জরুরি দরকার।

নেমে এসে দেখি, গেরুয়া পোশাকপরা অবনী তান্ত্রিক ত্রিশূল হাতে বসে আছে।…