৫. ভবতারণ ঘরে এল

০৫.

 ভবতারণ আমাদের পেছন-পেছন নিচের ঘরে এল। কাতর স্বরে বলল, চলে যাচ্ছেন স্যার? এর কোনও আস্কারা হবে না? আমি যে এবার ভেসে যাব! দাদাবাবু আমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবেন।

কর্নেল তার কাঁধে হাত রেখে বললেন, তোমাকে তাড়ায় কারও সাধ্য নেই। যদি তুমি আমার কথার ঠিক-ঠিক জবাব দাও।

ভবতারণ বলল, দেব স্যার। বলুন কী জানতে চান?

 এ বাড়িতে বাইরের কোনও লোক আসত কি?

 বাইরের লোক তো অনেক আসত। মেমসাহেব আসার পর মানা করেছিলেন, কেউ যেন বাড়িতে না ঢোকে।

যারা আসত, তাদের তুমি চেনো?

কাউকে কাউকে চিনি।

 বেশি কে আসত?

 আজ্ঞে রঙের দোকানের ভকতবাবু।

কার কাছে আসতেন?

দাদাবাবু ছাড়া আর কার কাছে আসবেন? মন্দিরে বসে দুজনে কথা বলতেন। কখনও দাদাবাবুর ঘরেও বসে থাকতেন। ধম্ম নিয়ে কথাবার্তা হতো।

তোমার সাহেব-মেমসাহেব আসার পর ভকতবাবু এসেছিলেন?

 একদিন এসেছিলেন সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে। তারপর আর আসেননি।

তোমার সাহেবের মা তো বেঁচে নেই?

ভবতারণ গলার ভেতর বলল, বেঁচে আছেন। কিন্তু

বলো ভবতারণ!

ভবতারণ চোখ মুছে বলল, সে অনেক দুঃখের কথা স্যার! বড়সাহেব– আমার কর্তার চরিত্তির মোটেও ভাল ছিল না। অত বড় ওষুধের ব্যবসা মদ আর মেয়েমানুষে উড়িয়ে দিচ্ছিলেন। ছেলে পর্যন্ত আমেরিকা পালিয়ে গিয়েছিল বাবার ওপর রাগ করে।

সুদর্শন বাবার ওপর রাগ করে চলে গিয়েছিল?

আজ্ঞে। ছেলেও গেল, মা-ও চলে গেল বাড়ি ছেড়ে। এখন চণ্ডীতলা আশ্রমে আছেন। দেশে যাবার নাম করে দেখে আসি। ভালই আছেন। ইস্কুল করেছেন আশ্রমে।

সুদর্শনের মায়ের নাম কী?

করুণাময়ী। বড়সাহেব মরার আগে দেখতে চেয়েছিলেন। আমি চণ্ডীতলা গিয়েছিলাম। কিন্তু উনি আসেননি। খুব কড়া ধাতের মেয়ে স্যার! ভবতারণ শ্বাস ছেড়ে বলল, ছেলের মরার খবরটা এখন আমাকেই দিয়ে আসতে হবে। দাদাবাবু তো যাবেন না। দাদাবাবুর সঙ্গে আশ্রমের সাধুবাবার বনিবনা নেই।

আচ্ছা ভবতারণ, তোমার বড়সাহেব এই বাড়িঘর সম্পত্তির কোনও উইল করে গেছেন?

হ্যাঁ স্যার! আমি সাক্ষী। দাদাবাবু সাক্ষী। ভকতবাবুও সাক্ষী।

কোন উকিল উইল লিখেছিলেন?

পাড়াতেই থাকেন স্যার। শিবপদ ঘোষ। ট্রামরাস্তার ওধারে নতুন চারতলা বাড়ি।

উইলে সম্পত্তি কার কার নামে দেওয়া আছে?

মনে পড়ছে না স্যার! ও সব ভজকট ব্যাপার বুঝি না। আপনি উকিলবাবুর কাছে জানতে পারবেন। আমি শুধু এটুকু জানি, যদ্দিন বাঁচব, মাসে পাঁচশ টাকা মাসোহারা পাব। আর দাদাবাবু পাবেন একহাজার টাকা।

কর্নেল পা বাড়িয়ে বললেন, আর একটা কথা ভবতারণ। তোমার বড়সাহেবকে একবার পুলিশ আরেস্ট করেছিল। বাড়ি সার্চ হয়েছিল। কেন তা জানো?

ভবতারণ চমকে উঠল। বলল, খামোকা হয়রানি স্যার! বড়সাহেব নাকি চোরাই ওষুধের কারবারি! স্রেফ মিথ্যা। এক ঘণ্টা আটকে রেখে দিয়েছিল পুলিশ। বাড়িতে কি পায়নি।

চলি ভবতারণ। চিন্তা কোরো না। কিছু ঘটলে আমাকে টেলিফোন করো। এই আমার কার্ড। বলে কর্নেল তার একটা নেমকার্ড দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।

গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বললাম, ধরে নিচ্ছি সুদর্শনের সুইসাইডাল নোট কেউ চুরি করে তাকে সায়নায়েড খাইয়ে মেরেছে। কিন্তু আপনি তা প্রমাণ করতে পারবেন কি?

কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট জ্বেলে বললেন, দেখা যাক।

সুদর্শন সাইকিক পেশেন্ট তা ঠিক। কিন্তু এই বোকামিটা কেন করল বোঝা যাচ্ছে না। আগে থেকে সুইসাইডাল নোট কি কেউ লেখে?

অনেকে লেখে বৈকি। এক মিনিট! তুমি দেখ, কোথাও গাড়ি পার্ক করা যায় কি না।

ঘিঞ্জি ট্রামরাস্তায় পার্কিংয়ের জায়গা পাওয়া কঠিন। বাগবাজার স্ট্রিটের মুখে পৌঁছে গাড়ি রাখলাম। কর্নেল বললেন, ভকতবাবুর সঙ্গে আলাপ করা দরকার। এস। আমরা নতুন বাড়ি করেছি। রঙ কিনতে চাই। বুঝেছ তো?

গাড়ি লক করে বললাম, অত ঝুটঝামেলায় না গিয়ে ভবতারণকে সঙ্গে আনলেই পারতেন।

নাহ্। লোকটা তাতে ঘাবড়ে যেত। এস।

দোকানের নাম লালজি পেইন্টিং কোম্পানি। সবে দোকান খুলে বেঁটে নাদুস-নুদুস চেহারার এক অবাঙালি ভদ্রলোক সিদ্ধিদাতা গণেশকে প্রণাম করছিলেন। আধুনিক কেতায় কাউন্টার আছে। শো কেশ এবং রঙবেরঙের কাটআউট। দুজন সেলসম্যান গম্ভীরমুখে বসে আছে টুলে। আমাদের দেখে একজন বলল, বলুন স্যার!

কর্নেল বললেন, আপনাদের নিজেদের কোম্পানির রঙ?

নিজেদের কোম্পানির আছে। অন্য কোম্পানিরও পাবেন। তবে আমাদের কোম্পানির কিনলে কিছু সুবিধে দিই। যেমন ধরুন, আমরা এক্সপার্ট মিস্ত্রি পাঠিয়ে সাহায্য করি। তাদের মজুরির হার কম। তা ছাড়া ছ মাসের মধ্যে গড়বড় হলে আমরা নিজেদের খরচে রি-পেইন্ট করিয়ে দিই। অবশ্যি ইনসাইড ওয়াল। আউটার ওয়াল বা দরজা-জানলার ক্ষেত্রে হাফ কস্ট আপনার। সে-ও ছমাসের মধ্যে।

বাঃ! এমন সুবিধে তো কেউ দেয় না।

এটাই আমাদের স্পেশালিটি স্যার! আমাদের ইনসাইড ডেকরেটার্স অ্যান্ড ডিজাইনার্স সেকশনও আছে। নতুন বাড়ি?

হ্যাঁ। একেবারে নতুন।

সেলসম্যান একটা রঙিন মোটা বই বের করে দিল। এই দেখুন। কিচেন, বাথ, স্টাডি, ডাইনিং, বেডরুম–সবেরই নানারকম পেইন্টিং ডিজাইন আছে।

উনিই কি কোম্পানির মালিক? ওঁর সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।

নাদুস-নুদুস চেহারার অবাঙালি ভদ্রলোক তাকিয়েছিলেন। সহাস্যে বললেন, আসুন, আসুন। কথা বলার জন্য আমি সবসময় তৈয়ার আছি! বেটা রাজু! দো কাপ চায় বোলাও!

কোণের দিকে হাফসেক্রেটারিয়েট টেবিল। সামনে দুটো চেয়ার। আমরা বসলাম। তারপর কর্নেল বললেন, আপনিই কি ভকতবাবু! নমস্কার!

নমস্কার করে ভদ্রলোক বললেন, হ্যাঁ। আমি সে-ই আছি। ছোটা কোম্পানি। কুছু এজেন্সিভি আছে।

আপনি তো ভবতারণকে চেনেন। তার কাছেই শুনলাম আপনার রঙের কারবার আছে।

ভবতারণের কাছে শুনলেন? ভকতবাবু একটু অবাক হলেন। তাকে আপনি চেনেন?

হ্যাঁ। ওর মালিক সদানন্দবাবু ছিলেন আমার বন্ধু। হঠাৎ আজ ওঁদের বাড়িতে এসেছিলাম। আপনি নিশ্চয় শুনেছেন কী হয়েছে?

ভকতবাবুর মুখে গাম্ভীর্য ফুটে উঠল। হ্যাঁ! বহুৎ আফশোসকি বাত! সাচ কথা বলি আপনাকে আমেরিকা মুল্লুকে গিয়ে ড্রাগ পিয়ে সুদর্শনের মাথা বিগড়ে গিয়েছিল।

অবনীবাবুকে তো আপনি চেনেন?

 ভুরু কুঁচকে ভকতজী বললেন, চিনব না কেনো? আমি তাদের টেনান্ট আছি। পাঁচশ টাকা ভাড়া দিই মাসে। অবনী সাধু আছে। জপ করে। লেকিন ভাড়ার দিকে খুব নজর। মদভাঙের জন্য টাকার দরকার। পাবে কোথায়?

ভবতারণ বলছিল, উনি সম্পত্তি থেকে মাসে হাজার টাকা পান। মালিকের নাকি উইল করা আছে।

ভকতবাবু বাঁকা হাসলেন। উইল তো হইয়েছে। সেই উইল কোর্টে প্রোবেট করতে হবে, তবে তো প্রপার্টির সেটলমেন্ট হবে। তা ভকিলবাবু দয়া করে অবনীকে টাকা পাইয়ে দিচ্ছে।

অবনীবাবু নাকি উইল অনুসারে প্রপার্টির ট্রাস্টি। তা হলে কেন উকিল ওঁকে টাকা পাইয়ে দিচ্ছেন।

ট্রাস্টি আছেন শিবপদ ভকিলবাবু। উইলের উইটনেস আমিভি আছি। উইল আছে ভকিলবাবুর কাছে। ভকতবাবু উত্তেজিতভাবে বললেন, সুদর্শন ফিরল। আমি তাকে বললাম, ভকিলবাবুর কাছে যাও। কোর্টে প্রোবেট করো। তুমি প্রপার্টির মালিক আছ। সুদর্শন বলল, সে প্রপার্টি নেবে না। সুইসাইড করবে।

আপনাকে বলেছিল সুইসাইড করবে?

হ্যাঁ। ছাড়িয়ে দিন। বেটা রাজু! চায় লাও! ভকতজি ঘুরে বসলেন। রং কিনবেন তো রংয়ের কথা বলুন। কম্মল! ডিজাইনবুক এখানে দিয়ে যাও।

কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, আপনাকে ভাড়ার রসিদ দেয় তো ওরা?

 রসিদ দেয় ভকিলবাবু। আমি তার কথামতো অবনীকে পাঁচশো টাকা দিই।

আচ্ছা ভকতজি, এই যে সুদর্শন মারা গেল, এবার প্রপার্টি কে পাবে?

তার ওয়াইফ। তবে কোর্টে উইল প্রোবেট করতে হবে। খুব ঝামেলা আছে। স্যার!

সুদর্শনের মা তো বেঁচে আছে।

সে কুছু পাবে না। সদানন্দবাবু তাকে ডিভোর্স করেছিলেন। ভকতজি চশমার ওপর দিয়ে তাকালেন কর্নেলের দিকে। আপনি তো তার বন্ধু ছিলেন। আপনি সে কথা জানেন না?

ডিজাইনবুকটা ইতিমধ্যে টেবিলে এসেছিল। সেটার পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে কর্নেল বললেন, তা হলে প্রপার্টি এখন সুদর্শনের স্ত্রীর। তাই না?

হ্যাঁ। বেটা রাজু, চায় কাহা?

একজন সেলসম্যান বিরক্তমুখে কাউন্টার থেকে বেরিয়ে গেল। কর্নেল বললেন, আমি বলি ভকতজি, এই বাড়িটা আপনি কিনে নিন। সুদর্শনের বউ নাকি আমেরিকা ফিরে যাবে প্রপার্টি বেচে।

আপনাকে সে বলেছে?

হ্যাঁ। কর্নেল নির্বিকারমুখে বললেন। প্রপার্টি না বেচে সে কী করবে? সে তো এখানে থাকতে আসেনি।

ভকতজি হাসলেন। আগে পুভ করতে হবে সে সুদর্শনের ম্যারেড ওয়াইফ। আমি শুনেছি, আমেরিকায় ওদের শাদি হয়েছে। সে শাদির কাগজ ইন্ডিয়ায় চলবে না। কোর্টে অনেক ঝামেলা করতে হবে।

তাহলে প্রপার্টি কে পাবে?

একটা আশ্রম। সদানন্দবাবুর গুরুজীর আশ্রম। কিষাননগরের নজদিকে আছে।

এই সময় দু কাপ চা এল। আমরা চুপচাপ চা খেলাম। লক্ষ্য করলাম, ভকতজির চোখেমুখে এতক্ষণে সন্দেহের ছাপ ফুটে উঠেছে। একটু নার্ভাস, কেশে বললেন, বলুন, কোন্ কোন্ ডিজাইন চয়েস করলেন?

কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, কিছু ঠিক করতে পারলাম না ভকতজি! পরে আসবখন।

ভকতজি হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন। আমরা বেরিয়ে এলাম।

গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বললাম, সুদর্শনকে খুনের মোটিভ তাহলে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

কর্নেল সে কথার জবাব না দিয়ে বললেন, প্রায় এগারোটা বাজে। আডভোকেট শিবপদবাবুকে এখন বাড়িতে পাওয়া যাবে না। যাই হোক, পরে দেখা যাবে। জয়ন্ত! আজ পত্রিকা থেকে ছুটি নাও। শিগগির লাঞ্চ সেরে আমরা চন্ডীতলা আশ্রমে যাব।

কর্নেলের আপার্টমেন্টে ফিরে চমকে উঠলাম। বড় ব্রিফকেস নিয়ে বিষণ্ণ মুখে গোপা বসে আছে। বেশভূষা একেবারে অন্যরকম। পরনে সালোয়ার কামিজ। কর্নেল সহাস্যে বললেন, গুড! ভেরি গুড! য়ু আর ইনটেলিজেন্ট ডার্লিং!

গোপা শ্বাসপ্রশ্বাসের মধ্যে বলল, অল্পের জন্য বেঁচে গেছি। আপনি চলে যাওয়ার একটু পরে মন্দিরে গিয়েছিলাম অবুদার খোঁজে। হঠাৎ জবাফুলের ঝোঁপ থেকে একটা মুখোশ পরা লোক ড্যাগার হাতে বেরিয়ে এল। আমি চেঁচিয়ে ওঠার আগেই ভবতারণ ইট ছুড়ল। লোকটা পাঁচিল টপকে পালিয়ে গেল। আমার ধারণা ভবতারণ আমাকে ফলো করে এসেছিল। সে বলল, আপনি এ বাড়িতে আর থাকবেন না মেমসাহেব। একবার ভাবলাম, থানায় ফোন করি। কিন্তু করলাম না। তখনই জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে বেরোলাম। ভবতারণ ট্যাক্সি ডেকে আনল।

অবনী মৈত্রের সঙ্গে তোমার আর দেখা হয়নি?

না। এখন আমার সন্দেহ হচ্ছে, অবুদা সাংঘাতিক লোক। ওকে চিনতে ভুল হয়েছিল।

কর্নেল ইজিচেয়ারে বসলেন। ষষ্ঠী! একে কফি খাইয়েছিস?

গোপা বলল, হ্যাঁ। আপনার লোকটি খুব ওবিডিয়েন্ট।

তোমার মিশন সাকসেসফুল হয়েছে কি গোপা?

গোপা চমকে উঠল। মিশন? কিসের মিশন? ব্ল্যাক মেরি অকাল্ট আসোসিয়েশন আমাকে ইন্ডিয়ান উইচদের সম্পর্কে কিছু ইনফরমেশন আনতে পাঠিয়েছিল। আমার কাজ এখনও বাকি থেকে গেছে। দ্যাট ওয়জ মাই মিশন। এনিওয়ে, আমি ফিরে যেতে চাই। আপনি বলেছিলেন, ভি. আই. পি. কোটা থেকে আমার ফ্লাইটের ব্যবস্থা করে দেবেন। প্লিজ কর্নেল সরকার! আমার আর এদেশে এক মুহূর্ত থাকতে ইচ্ছে করছে না।

কর্নেল একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, তোমার শ্বশুর সদানন্দবাবু সম্পর্কে কিছু জানো?

গোপা তাকাল। কিন্তু কিছু বলল না।

সুদর্শন তোমাকে কিছু বলেনি?

বলেছিল, ওঁর ওষুধ তৈরির ফার্ম ছিল। স্ত্রীর সঙ্গে অশান্তির জন্য ফার্ম আর চালাননি। ধর্মকর্ম নিয়ে কাটাতেন। সুদর্শন তখন আমেরিকায়।

সুদর্শন বলেনি, মাকে তার বাবা ডিভোর্স করেছেন?

গোপা ঘড়ি দেখে ব্যস্তভাবে বলল, এ সব কথা বলে অনর্থক সময় নষ্ট হচ্ছে কর্নেল সরকার! দেখুন, আপনি বলেছিলেন, আমার ফ্লাইটের ব্যবস্থা করে দেবেন। আপনার কথামতো অমি এসেছি।

চিন্তা কোরো না। ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কিন্তু তুমি চলে যাওয়ার আগে আমার এসব কথা জানা দরকার।

গোপা আস্তে আস্তে বলল, সুদর্শনের মানসিক অসুখের মূল কারণ তার। বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ। সোমাচ আই নো। মায়ের চিঠি পাওয়ার পর ও ভীষণ। বিচলিত হয়ে উঠেছিল। মাকে নিজের কাছে রাখতে চেয়েছিল। ওর মা যাননি।

বাবার সম্পর্কে সুদর্শন সত্যিই কি তোমাকে কিছু বলেনি?

তেমন কিছু না। বাবা-মা সম্পর্কে কোনও কথা তুললে ও এড়িয়ে যেত।

কর্নেল দাড়িতে হাত বুলাতে বুলোতে বললেন, সদানন্দবাবু ডাক্তারি পড়েননি। কিন্তু ওঁর আশ্চর্য মেধা ছিল। প্রথম জীবনে একটা মেডিক্যাল কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভ ছিলেন। পরে নিজেই ওষুধ তৈরির কারখানা করেন। তারপর চিকিৎসাবিদ্যার বইপত্র ঘেঁটে নিজেও নানা অসুখবিসুখের ওষুধ তৈরির চেষ্টা করতেন। শেষে আয়ুর্বেদ আর দিশি আদিম চিকিৎসা পদ্ধতি যাকে বলে টোটকা, এসব নিয়ে চর্চা শুরু করেন। পুলিশ রেকর্ড থেকে এসব কথা জেনেছি। আদিবাসীদের টোটকা সংগ্রহে অবনী ছিল ওঁর সহকারী। অবনীর সঙ্গে বিভিন্ন অঞ্চলের আদিবাসী ওঝাদের পরিচয় এই সূত্রেই হয়েছিল।

গোপা শুনছিল। বলে উঠল, আই সি।

সদানন্দবাবু একধরনের মাদক আবিষ্কার করেছিলেন। মারাত্মক নার্কোটিকস। কিছু বিদেশী কোম্পানিতে সেই ড্রাগ বেচতেন। পুলিশ টের পেয়ে ওঁকে অ্যারেস্ট করেছিল। টাকার জোরে বেঁচে যান। যাই হোক, সদানন্দবাবুর সেই মাদক তৈরির ফরমুলা তুমি কি খুঁজে পেয়েছ?

গোপা উঠে দাঁড়াল। রুষ্টমুখে বলল, আমাকে এভাবে অপমান করার জন্য আপনি আপনার বাড়িতে আসতে বলেছিলেন, আমি চিন্তাও করিনি! আমি বরং কোনও হোটেলে চলে যাচ্ছি। ট্রাভেল এজেন্টের সাহায্যে এয়ার-টিকিট পেতে আমার অসুবিধে হবে না।

কর্নেল নির্বিকারভাবে বললেন, ফরমুলার ফাইলটা তুমি নিয়ে যেতে পারবে নাগোপা। আমি জানিয়ে দিলে গভর্নমেন্টের অ্যান্টি-ড্রাগ সেলের লোকেরা এয়ারপোর্টে সার্চ করে তোমাকে বিপদে ফেলবে। কাজেই ওটা তুমি পেয়ে থাকলে আমাকে দাও। আই আসিওর য়ু ডার্লিং, তোমার এয়ার-টিকিটের ব্যবস্থা শুধু নয়, তোমাকে নিরাপদে আমি প্লেনে তুলে দিতে রাজি।

গোপা ঠোঁট কামড়ে ধরল। একটু পরে বলল, দিস ইজ আবসার্ড!

তুমি ভুল করছ গোপা! ওটা তোমার কাছে যতক্ষণ আছে, ততক্ষণ তুমি বিপন্ন। কারণ ওই ফাইলটার কথা কলকাতাতেও সদানন্দবাবুর ঘনিষ্ঠ কোনো লোকের পক্ষে জানা সম্ভব। অবনীও জানতে পারে।

গোপা এবার শান্তভাবে বসল। তারপর মুখ নামিয়ে বলল, ফাইলটা আমাকে সুদর্শন দিয়েছিল। কিন্তু আজ মর্নিংয়ে চুরি গেছে।

কখন জানতে পারলে ওটা চুরি গেছে?

এখানে আসার সময় জিনিসপত্র গোছাচ্ছিলাম। ওটা ছিল আমার এই সুটকেসে। খুঁজে দেখলাম ফাইলটা নেই। আমি তালা দিয়ে রাখতাম। তালাটা কেউ কীভাবে খুলেছে। অবুদা এ কাজ করেনি। কারণ আমি ওকে চোখে চোখে রেখেছিলাম। ভবতারণকেও সন্দেহ করতে পারছি না। সে তত লেখাপড়া জানে না। স্যুটকেসে আরও অনেক কাগজপত্র ফাইলটাইল আছে। ওই ফাইলটার কোনও স্পেশালিটি ছিল না যে আলাদা করে চেনা যাবে।

কর্নেল গম্ভীরমুখে বললেন, তোমার এয়ার-টিকিটের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। কিন্তু এয়ারপোর্টে আন্টিড্রাগ সেলের লোকেরা তোমাকে সার্চ করবে। মাইন্ড দ্যাট!

গোপা ক্লান্তভাবে বলল, করুক। আমার এদেশে থাকতে আর এক মুহূর্ত ইচ্ছে করছে না।……..