৬. প্রকাণ্ড বইয়ের পাতা

০৬.

কর্নেল ড্রয়িংরুমে বসে একটা প্রকাণ্ড বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছিলেন। ষোল শতকের প্রখ্যাত নাবিক এবং উদ্ভিদবিজ্ঞানী রিচার্ড হ্যাঁকুইটের সমুদ্রভ্রমণের বৃত্তান্ত। সম্প্রতি বইটির পুনর্মুদ্রণ করেছেন এক মার্কিন প্রকাশক হাক্টন মিলিন কোম্পানি। হ্যাঁকুইট ছিলেন অর্কিড পাগল মানুষ। যে দ্বীপে গেছেন, প্রথমে সেখানকার গাছপালায় অর্কিড খুঁজে বেড়িয়েছেন। বর্ণনা দিয়েছেন। স্কেচ করেছেন।

ডায়মন্ডহারবারের অর্কিডটার সঙ্গে টোরা দ্বীপের অর্কিডের একটা সূক্ষ্ম অমিল চোখে পড়েছে কর্নেলের। প্রথমটার পাতার কিনারায় একটু ঢেউখেলানো ছন্দ রেখায়িত রয়েছে। তা ছাড়া পিঠের দিকটা বেশি খসখসে।

হুঁ, হ্যাক্লুইটের এ ব্যাখ্যাটা যুক্তিসম্মত। বিষুবরেখার দক্ষিণে মকরক্রান্তির আশেপাশে যে সব গাছপালা গজায়, তাদের সঙ্গে বিষুবরেখার উত্তরে কর্কটক্রান্তি অঞ্চলের গাছপালার পার্থক্য আছে। এই পার্থক্য যত উত্তরে বা দক্ষিণে যাওয়া যায়, তত বাড়ে।

ইউরেকা! কর্নেল নড়ে বসলেন। আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপের কাছে লোবো দ্বীপের যে অর্কিডের স্কেট দিয়েছেন হ্যাঁকুইট, সেটাই তো এই প্রজাতির। কর্নেল ঝুঁকে পড়লেন বইয়ের ওপর।

কখন কলিংবেল বেজেছে এবং ষষ্ঠীচরণ নালবাজারের নাহিড়ীসায়েবকে এনে এ ঘরে ঢুকিয়েছে। অরিজৎ গোয়েন্দা দপ্তরের কর্তাব্যক্তি। জুতোর শব্দ না করে পা ফেলতে জানেন। নিঃশব্দেই আসন গ্রহণ করতে পারেন। মুখ টিপে হেসে কর্নেলকে দেখছিলেন। কর্নেল তার দিকে পিঠ রেখে ঝুঁকে আছেন বইয়ের ওপর।

হঠাৎ ওইভাবে থেকেই বলে উঠলেন।–স্বপন ধরা পড়েছে বুঝি?

অরিজিৎ হো হো করে হেসে উঠলেন–আপনার দেখছি মাথার পেছনেও দুটো চোখ!

-একটা। কর্নেল ঘুরে বসলেন।–পেছনেও দুটো চোখ থাকলে কি স্বপন ধরা পড়েছে কি না জিজ্ঞেস করতুম, ডার্লিং?

অরিজিৎ একটু গম্ভীর হলেন। কাগজগুলো আমাদের ব্যর্থতাকে ভীষণ ব্যঙ্গ করে কাটুন-টার্টুন এঁকে এক কাণ্ড করেছে। কিন্তু সত্যি বলতে কি, এই কেসে হোল পুলিস ফোর্স যতখানি নিজেকে লড়িয়ে দিয়েছে, স্বাধীনতার পর এই পঁয়ত্রিশ বছরের মধ্যে আর কখনও এমন করেনি। এমন কি দেশের প্রতিটি রাজ্যের গ্রামে গঞ্জে পর্যন্ত জাল বিছানো হয়েছে। অথচ স্বপনকে পাওয়া দূরের কথা, তার নাগাল পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। তাই

–তাই? কর্নেল সপ্রশ্নে তাকালেন।

–তাই ধারণা হচ্ছে, স্বপনকে তার কোনো শত্রু খতম করে লোপাট করে ফেলেনি তো? প্রথম কথা–তার সঙ্গে কারুর কারুর ভীষণ শত্রুতার কথা আমরা তো জানিই। যেমন

–ফুটবল-কোচ অমর্ত্য রায়।

–হ্যাঁ। তারপর বড়তলা এলাকার কুখ্যাত সমাজবিরোধী কালো, যাকে সবাই বলে গলাকাটা কালো। বেনেপুকুরের জাভেদ-রেসের জকি যে। আরও আছে এমন অনেকে, যারা স্বপনের ঘোর শত্রু। কাজেই আমরা সর্বত্র বেওয়ারিশ এবং অজ্ঞাতপরিচয় ডেডবডির দিকেও নজর রেখেছি। এ পর্যন্ত এমন কোনো বডি পাওয়া যায়নি, যা স্বপনের বলে সন্দেহ হয়।

অরিজিৎ রুমাল বের করে ঘাম মুছলেন। কর্নেল বললেন–গভর্নমেন্ট তো দশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে।

–হ্যাঁ। শুধু খবরের কাগজে নয়, সব পাবলিক প্লেসে স্বপনের ছবি-সহ বিজ্ঞাপন লটকে দেওয়া হয়েছে।

–তাহলে ডার্লিং, স্বপনকে তার কোনো শত্রু খতম না করে তোমাদের হাতে তুলে দিতে চাইবে না কি? দশ হাজার টাকা পুরস্কার!

অরিজিৎ সোজা হয়ে বসলেন। কারেক্ট। এটা আমাদের আমার মাথায় আসা উচিত ছিল। সত্যি তো। দশ হাজার টাকাও পাবে এবং শত্রুও ঢিট হবে। কাজেই স্বপনকে মেরে ফেলার প্রশ্ন আসছে না। কিন্তু একটা কথা। ধরুন, অমর্ত্যবাবুর মতো লোক কি টাকার লোভ করে তাকে পুলিসের হাতে তুলে দিতে যাবেন? অমর্ত্যবাবু তো বড়লোক মানুষ।

অমর্ত্যবাবু তেমন কিছু করেছেন বলে যতক্ষণ না প্রমাণ হচ্ছে, ততক্ষণ এ কথা আসে না।

–আমরা অমর্ত্যবাবুর প্রতি নজর রেখেছি গাঙ্গুলিবাবুর, মানে মায়াপুরীর সেই টেকনিশিয়ানের কাছে খবর পেয়েই।

কর্নেল মুখ টিপে হেসে বসলেন–রেখেছ? বেশ। তাহলে গত দুদিনে অমর্ত্যবাবুর গতিবিধির খবরও জানো।

–হুউ, জানি। বলে অরিজিৎ দ্রুত অ্যাটাচি খুলে নোটবই বের করলেন শুনুন। গত পরশুর আগের রাতে ময়দানে ক্লাবের টেন্টে ছিলেন অমর্ত্যবাবু। এক মহিলা ওঁকে সঙ্গ দেন রাত বারোটা অব্দি। মহিলাটি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। রোজি স্মিথ নাম। তাকে অমর্ত্যবাবু ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে পৌঁছে দেন। বাড়ির নাম্বার ৪৭/তাই, ফ্ল্যাট নং ৯। রোজি ব্রথেল গার্ল। পরদিন সকালে সাতটা নাগাদ ওঁর কাছে যায় স্বপনের বোন রাখী। একটু ফ্লার্টিং দেখা গেছে। সাড়ে আটটায় যান এক দাড়িওলা বুড়ো ভদ্রলোক। অনেকক্ষণ কথা বলেন। রাখীকে তার লালরঙের গাড়িতে চলে যেতে দেখা যায়।

অরিজিৎ হাসলেন মুখ তুলে। কর্নেল বললেন–হু। তারপর?

–দশটায় অমর্ত্যবাবু নিউ আলিপুরে তার ফ্ল্যাটে ফেরেন। ফ্ল্যাট থেকে বেরোন বেলা, তিনটেয়। আবার ময়দানের টেন্টে। সাড়ে পাঁচটায় রাখী আসে আবার। এক ঘণ্টা পরে অমর্ত্য ওকে নিয়ে বেরোন। পার্ক স্ট্রিটের একটা বারে দুজনে ছিলেন নটা পর্যন্ত। তারপর রাখী যায় বাসে চেপে। বাসের নম্বর ৯। অমর্ত্য নিউ আলিপুরে। গতকাল সেখানে আমাদের নোক যেতে দেরি করেছিল। বেলা হলে দারোয়ানের কাছে জানতে পারে, সায়েব ময়দানে গেছেন ভোর পাঁচটায়। ময়দানে আমাদের লোক দেখে, আই বি ইন্সপেক্টার রণজিৎ বসুর সঙ্গে অমর্ত্যবাবুর কথা কাটাকাটি হচ্ছে। মিঃ বোসকে আমিই বলেছিলাম কথা বলতে। যাই হোক, উনি চলে যাওয়ার আধঘণ্টা পরে অমর্ত্যবাবু গাড়ি নিয়ে বেরোন। ধর্মতলা হয়ে মৌলালি। তারপর প্রচণ্ড জ্যামের মধ্যে ওঁর গাড়িটাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। শেয়ালদায় উড়াল পুল হয়ে সেখানকার জ্যাম এখন মৌলালিতে সরে এসেছে। আমাদের লোককে দোষ দিতে পারছি না। গাড়িটা ছিল ভাড়া করা। ড্রাইভার অত্যন্ত কুঁড়ে প্রকৃতির লোক। তাছাড়া ভেবে দেখুন কর্নেল, এ তো ইউরোপের কোনো শহর নয়। এঁদো কলকাতা। এখানে কাউকে চোখে রেখে ফলো করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার।

হুঁ, তবু যথেষ্ট করেছ তোমরা।

–তারপর বলছি! ময়দানের টেন্টে আমাদের যে লোক ছিল, সে রিপোর্ট। দিয়েছে, বিকেল চারটায় কোত্থেকে ফিরে আসেন অমর্ত্য। খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। রাতে আর বাড়ি ফেরেননি। কোনো মহিলাকেও আসতে দেখা যায়নি। তবে প্রচণ্ড মদ খাচ্ছিলেন।

–তাহলে দেখা যাচ্ছে, গতকাল সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটে পর্যন্ত অমর্ত্যবাবু কোথায় ছিলেন তোমাদের জানা নেই।

–কোনো প্রয়োজন দেখা দিলে ওঁকে আমরা জেরা করে জেনে নিতে পারব। অ্যালিবাই থাকলে প্রমাণ করতে ইনসিস্ট করব।

কর্নেল চোখ বুজে কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর উঠে গেলেন বইটা র‍্যাকে তুলে রাখতে। তরপর চুরুট ধরিয়ে বললেন-রোজি স্মিথ?

অরিজিৎ বুঝতে না পেরে বললেন হ্যাঁ। কেন?

নামটা সুন্দর।

অরিজিৎ হাসেন।–দেখতেও সুন্দর। কিন্তু যাকে বলে আস্ত ডটার অফ ডেভিল। ওর স্বামী ছিল ইলেকট্রিসিয়ান। এক সময় সিনেমা স্টুডিওতে টেকনিশিয়ানের কাজ করত। গত বছর রোজিকে ডিভোর্স করে অন্য একটা মেয়েকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়া চলে গেছে। লোকটানাম ছিল ক্যারি। স্টুডিও মহলে নাকি পপুলার ছিল।

–সিনেমা স্টুডিওতে?

–হ্যাঁ। কেন?

-এমনি। কর্নেল একটু হাসলেন। স্টুডিও শুনলেই এখন মাথার ভেতরটা কেমন করে ওঠে! বাই দা বাই, রোজির ঠিকানাটা লিখে দাও। ওর ডিভোর্সড স্বামীর নামটাও লিখে দাও।

অরিজিৎ অবাক হয়েছিলেন। কিন্তু প্রশ্ন না করে নোটবইয়ের পাতা ছিঁড়ে ঠিকানাটা লিখে দিলেন। কর্নেল সেটা ড্রয়ারে রেখে বললেন–অর্মত্যবাবুর ওপর আরও কড়া নজর রাখার ব্যবস্থা কর, অরিজিৎ।

ইলেভেন টাইগার্স টেন্টে আমাদের ইনফরমার আছে। আপনাকে জানিয়ে দিচ্ছি, কাজে লাগতে পারে। পরিমল নামে একটা লোক। বারে থাকে। ওয়েটার।

–মাথায় সন্ন্যাসীদের মতো চুল, মুখে আমার চেয়ে লম্বা দাড়ি, হাফপ্যান্ট

–মাই গুডনেস! আপনি অসাধারণ অবজার্ভার!

–পরিমল-টরিমল নয়, শক্তপোক্ত লোক চাই। যে খুব চালাকচতুর, বাঘের মতো ক্ষিপ্র! প্রয়োজনে যে কোনো পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারে।

অরিজিৎ একটু ভেবে বললেন–আমার এক বন্ধুর ভাই ক্লাবের খেলোয়াড়। প্রদীপ মৈত্র নাম। রাইট ব্যাকে খেলে! খুব খেলাপাগল ছেলে। সারাক্ষণ ময়দানেই পড়ে থাকে। কিন্তু ব্যাপারটা একটু খুলে বলুন না!

–যে সম্পর্কে আমি নিজেই অন্ধকারে আছি, তোমাকে কেমন করে খুলে বলব ডার্লিং? কর্নেল আবার চোখ বুজে দাড়ি টানতে থাকলেন।

জাস্ট অ্যান ইনটুইশান! আমার খালি মনে হচ্ছে, আবার কিছু ঘটতে চলেছে। যে কোনো মুহূর্তে ঘটে যাবে। কে জানে নিছক কল্পনা কি না! বাট আই স্মেল, অরিজিৎ, আই স্মেল সামথিং অড। বরাবর আমার এটা হয় দেখে আসছি। এইরকম অকারণ অস্বস্তি জেগে ওঠে।

অরিজিৎ তীক্ষ্ণদৃষ্টে লক্ষ্য করছিলেন কর্নেলকে। আস্তে বললেন–তাহলে কি আপনি অমর্ত্যবাবুর ওপর কোনো বিপদের আশঙ্কা করছেন?

কর্নেল জবাব দিলেন না। এতক্ষণে ষষ্ঠী এল কফি নিয়ে। কাচুমাচু করে বলল–আপনাকে ঢুকিয়ে সেই তখন বাজারে গেছলুম। বাবুমশাই আজ মাংস খাবেন বলেছিলেন। কি লম্বা লাইন সেখানে! বাবা রে বাবা, দাঁইড়ে আছি তো দাঁইড়েই আছি। লাইন আর ছোট হয় না–লম্বা তো লম্বা!

কর্নেল চোখ কটমট করে তাকাতেই সে ঝটপট কেটে পড়ল। কর্নেল বললেন-কফি খাও ডার্লিং!

কথাটা তো বললেন না!

–দি কিলার অ্যাট লুজ, অরিজিৎ! খুনী এখনও ধরা পড়েনি, ভুলে যেও না।

অরিজিৎ কফিতে চুমুক দিলেন। মুখে আবছা হয়ে উদ্বেগ ফুটে উঠল। এতক্ষণে।…

.

সীমন্ত তার মুনলাইট স্টুডিওতে কাল ডায়মন্ডহারবারে তোলা ছবিগুলো ডেভলাপ করছিল। রাখীর গলা শুনে ডার্করুম থেকে বেরিয়ে এল–হাই রাখী!

রাখী বলল–হাই!

আজ তাকে খুব স্মার্ট দেখাচ্ছিল আগের মতো। ভাবা যায় না, কাল ডায়মন্ড হারবার থেকে আসার সময় সারাপথ গাড়িতে মুখে রুমাল ঢেকে মাথা নিচু করে বসেছিল। কোনো কথা পর্যন্ত বলেনি। কর্নেল ডাকলেও সাড়া দেয়নি। ওদের বাড়ির কাছে বড় রাস্তার মোড়ে পৌঁছুলে মুখ তুলে বলেছিল–থাক, এখানেই নামব। তারপর গাড়ি থেকে বেরিয়ে আর ঘুরেও তাকায়নি। দ্রুত চলে গিয়েছিল।

সীমন্ত বলল-দাঁড়িয়ে কেন? বস!

রাখী হাসল। তুমি কি এখন ব্যস্ত সীমন্তদা?

-কেন? –তোমার সঙ্গে অনেক, অনেক কথা আছে।

 সীমন্ত হাসল। বেশ তো! এখানে বসেই বল। আমি কাজ করতে করতে শুনি।

রাখী কাউন্টারের কর্মচারীটির দিকে তাকিয়ে মাথা দোলাল। আস্তে বলল– প্রাইভেট কথা বলার জায়গা নাকি এটা?

–প্রাইভেট? ওক্কে? চল, উল্টো দিকের কাফেতে গিয়ে বসি।

 –ভ্যাট! কাফে-টাফেতে নয়।

–তাহলে পার্কে।

–তোমার গাড়িটা কী হল?

সীমন্ত চোখে ঝিলিক তুলে বলল–আবার ডায়মন্ডহারবার যেতে ইচ্ছে করছে বুঝি? আপত্তি ছিল না। কিন্তু তেলের যা দর। অতটা লাক্সারি পোষাবে না।

তুমি এমন কিপটে ছিলে না তো! বুঝেছি। আমার বেলায় যত–ঠিক আছে। চললুম।

–আরে! তুমি কি সিরিয়াসলি ডায়মন্ডহারবারে–

–তোমার মাথা! জাস্ট একটু ভিক্টোরিয়া বা গঙ্গার ধার অব্দি গেলেই যথেষ্ট। কে যেতে চেয়েছে ডায়মন্ডহারবার?

সীমন্ত একটু দোনামনা করে শেষ পর্যন্ত নিজেকে ঠেকাতে পারল না। কাল রাখীকে ওই অবস্থায় দেখে তার যত কৌতূহল হয়েছে, তত মায়াও জেগেছে মনের ভেতর। প্রখ্যাত চিত্রাভিনেতার মেয়ে। কপালদোষে এমন হয়ে গেছে। উজ্জ্বলকুমার যদি উচ্ছংখল বেহিসেবী না হতেন, অন্যান্য হিরোদের মতোই পয়সা জমিয়ে ছেলেমেয়েদের আখের গুছিয়ে যেতে পারতেন। নিজেও পথে বসেছিলেন, এদেরও পথে বসিয়ে গেছে।

তবে আজ রাখীকে তার দারুণ সুন্দর মনে হচ্ছে। কালকের কান্নাকাটির পর এই হাস্যোজ্জ্বল মুখ। বৃষ্টির পর রোদে দাঁড়িয়ে থাকা ফুলগাছের মতো। সীমন্ত ক্যামেরা নিয়েই বেরুল। গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করল।

ভিক্টোরিয়ার কাছে একটু থেমে সে বলল–প্রচণ্ড লোক। চল, গঙ্গার ধারেই যাই।

ছুটির দিন নয় বলে গঙ্গার ধারে লোক খুব কম–তা ছাড়া এখন সকাল নটা। নির্জন জায়গা দেখে দুজনে বসল। সীমন্ত সিগারেট ধরিয়ে বললবল রাখী!

রাখী একটু অভিমান দেখাল বল রাখী! তুমি দেখছি বড্ড বেশি কাজের লোক হয়ে গেছ।

সীমন্ত হাসল। না ভীষণ কৌতূহল হচ্ছে।

–জিজ্ঞেস করছ না কেন তাহলে, কাল ডায়মন্ডহারবারে কেন গিয়েছিলুম?

–ওকে। কেন গিয়েছিলে?

–একজন আমাকে পটিয়ে-পাটিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। তার মতলব টের পেয়েই

–ওয়েট, ওয়েট! তুমি পটলে কেন? তুমি তো বাচ্চা মেয়ে নও!

–আঃ! লোকটা যে আমার খুব চেনাজানা। জাস্ট প্রপোজাল দিয়েছিল এই যেমন তোমার সঙ্গে গাড়ি করে বেড়াতে এলুম, তেমনি করে যাব। এক্সকার্সান জার্নি। ওঃ! গিয়ে দেখি ট্যুরিস্ট লজ বুক করা আছে।

–অসাধারণ! তারপর?

 রাখী গম্ভীর হল আরও। না, ট্যুরিস্ট লজ বুক করাটাও কোনো ব্যাপার নয়। ও হিন্ট দিয়েছিল, রাতে না ফিরতেও পারি কলকাতা। আমি এমন বোকা যে তাতেও সায় দিয়েছিলুম। আসলে তলিয়ে কিছু ভাবিনি।

–লোকটা অসভ্যতা শুরু করেছিল তো?

–হু। কিন্তু সেজন্যও নয়। হঠাৎ দেখি কর্নেল আর তুমি আসছ। তোমাকে দেখে নয়, কর্নেলকে দেখেই আমি আরও ভয় পেয়ে গেলুম।

-সে কি! কেন?

 –উনি ডিটেকটিভ জান না?

–জানি। তাতে কী হয়েছে?

–আমি ভাবলুম, উনি আমাকে ফলো করে বেড়াচ্ছেন। বড়দার ছবি বেরিয়েছে কাগজে।

–যাঃ! সীমন্ত হাসতে লাগল। আমরা গিয়েছিলুম একটা বাগানে অর্কিডের খোঁজে।

-সত্যি বলছ? গা ছুঁয়ে বল তো!

সীমন্ত ওর হাতের ওপর হাত রেখে বলল–সত্যি বলছি। আমরা জানতুমই না তুমি ওখানে গেছ।

রাখী ঠোঁটের ঘাম রুমালে স্পঞ্জ করে বলল–একটা ভাবনা থেকে বাঁচা গেল, বাবা!

সীমন্ত বলল–তুমি যদি ভয় পেয়েই থাকো কর্নেলকে দেখে, কেন তার কাছেই দৌড়ে এলে?

রাখী হাসল। আমার তখন শাপে বর হল না? লোকটার হাত থেকে বেঁচে গেলুম। আবার কর্নেলকেও বোঝাতে চাইলুম, বড়দার ব্যাপারে আমার কোনো কানেকশান নেই।

–অর্থাৎ তুমি সারেন্ডার করলে! সীমন্ত জোরে হেসে উঠল। –এক ঢিলে দুই পাখি বধ। রাখী, তুমি ইনটেলিজেন্ট।

–কিন্তু জান? কাল রাত্তিরে আমার একটুও ঘুম হয়নি। শুধু ভেবেছি, আমার কোনো বিপদ হবে না তো? এর আগে তোমাকে লুকোব না, পুলিস আমাকে কয়েকবার থ্রেটন করেছে। একবার নিয়েও গিয়েছিল লালবাজারে। শেষে বাবা খবর পেয়ে ছাড়িয়ে আনেন।

–কেন তুমি অমন করে বেড়াও, রাখী? কেন বুঝতে পার না এ পথ সর্বনাশের পথ?

রাখী চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর মুখ নামিয়ে ধরা গলায় বলল এখন বুঝতে পেরেছি। তাই একটা চাকরির জন্য হন্যে হয়ে বেড়াচ্ছি। চাকরি করে দেবে বলেই তো ওই লোকটার সঙ্গে কাল–

–লোকটা-লোকটা না করে নাম বলছ না কেন?

নাম বললে তুমি তাকে চিনবে।

তাতে কী?

 রাখী শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল–অমর্ত্যদা। ফুটবল-কোচ।

 সীমন্ত চমকে উঠল-সে কী! সে তো তোমার বাবার বয়সী লোক।

বাবার বন্ধুও। একসঙ্গে মদ খেতে দেখেছি।

–স্কাউড্রেল! কিন্তু তুমি তাকে দাদা বলছ যে?

রাখী জবাব দিল না এ কথার। ঠোঁট কামড়ে চুপ করে থাকল। তারপর মুখ তুলে বলল–এখন বুঝতে পারি, চন্দ্রার সঙ্গে আলাপ না হলে এমন হতুম না। বলতে নেই, দ্রা ব্লাডক্যান্সার হয়ে মারা গেছে। কিন্তু চন্দ্রা শুধু আমার নয়, বড়দারও বারোটা বাজিয়ে গেছে। ওর সঙ্গে না মিশলে বড়দার সঙ্গে অমর্ত্যদার ঝগড়া হত না। বড়দা এতদিন বিখ্যাত ফুটবলার হয়ে যেত।

–কে চন্দ্রা?

–একটা মেয়ে ছিল। ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে থাকত মিসেস মিশেলের কাছে।

বাঙালি নাকি

বাঙালি। বাড়ি থেকে পালিয়ে এসে অনেক ঘাটে জল খেয়ে শেষে মিসেস মিশেলের পাল্লায় পড়েছি। আমাকে চন্দ্রা নিজের লাইফের কথা মাঝে মাঝে বলত। অসুখ হওয়ার পর যখনই ওকে দেখতে গেছি, ওই সব কথা। বলত। বারো-তেরো বছর বয়সেই চন্দ্রা নষ্ট হয়েছিল। বলত, মাও ভাল মেয়ে ছিল না। বাবা ছিল ইলেকট্রিসিয়ান। মা ডিভোর্স নিয়েছিল। সব কথা মনে নেই। আরও অনেক স্টোরি শুনেছি ওর লাইফের। তবে বড়দা পুরোটা জানে। বড়দাকে ও ভীষণ ভালবাসত। অথচ কি অদ্ভুত মেয়ে দেখ! বড়দা ওকে যেমনি অমর্ত্যদার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল, আর ব্যস! অমনি চন্দ্রা অমর্ত্যদার সঙ্গে ভিড়ে গেল। নেমকহারাম মেয়ে না?

–আসলে এ ধরনের মেয়েরা এমনি হয়ে থাকে। ভবিষ্যতে তুমিও হয়ে যেতে!

রাখী জোরে মাথা দোলাল।– নাঃ। আমি তা হতুম না। কাউকে যদি সত্যি ভালবাসতুম, কখনো তাকে ছেড়ে অন্য কারুর সঙ্গে মিশতুম না।

সীমন্ত চোখে হেসে আস্তে বলল–তুমি কাউকে নিশ্চয় সত্যি করে ভালবাস? ভ্যাট! ভালবাসা-টাসা আমার পোষায় না ও নিয়ে ভাবি না কোনোদিন।

সীমন্ত সিগারেট ধরাল। কিছুক্ষণ চুপচাপ টানার পর বলল–তোমার সত্যি একটা চাকরি দরকার।

–দিচ্ছে কে? যে দেব বলবে, সেই অমর্ত্যদা হয়ে যাবে।

সীমন্ত হাসল। –তুমি যেরকম সেজেগুজে থাক, লোভ হতেই পারে। আমারও হয়তো হচ্ছে!

রাখী মৃদু থাপ্পড় মারল ওকে। –কি সেজেগুজে থাকি! ভারি তো একটা বাজে শাড়ি!

–ইউ লুক সেক্সি, রাখী!

–মারব! পুরুষ মাত্রেই এক ধাতুতে গড়া। যাও! আর কথাই বলব না।

 রাখী ঘুরে বসল। সীমন্ত হাসতে হাসতে বললনাঃ! জোক করছি। তারপর সে একটু গম্ভীর হয়ে বলল–তোমাদের ফ্যামিলির ওপর শনির দৃষ্টি পড়েছে। তোমার বাবা–তারপর স্বপনটার এই ব্যাপার। আই ফিল ফর ইউ, রাখী। বিলিভ মি।

সে উঠল হঠাৎ– এক মিনিট। ঠিক ওই পোজে বসে থাক তো! নড় না। একটা ছবি নিই।……

.

বিকেলে কর্নেল ছাদের প্ল্যান্টওয়ার্ল্ডে ডায়মন্ডহারবার থেকে আনা অর্কিড দুটোর দিকে তাকিয়ে আছেন, এমন সময় ষষ্ঠী এসে বলল–এক মাঠাকরুণ এয়েছেন। মুখখানা চেনাচেনা ঠেকল। তাই বসিয়ে রেখে এলুম।

–তোর হাতে ওটা কী?

 ষষ্ঠী জিভ কাটল।–ও! উনি দিলেন। ভুলেই গেছি এটার কথা।

কর্নেল হাত বাড়িয়ে কার্ডটা নিলেন। অধ্যাপিকা পারমিতা সান্যাল। — এখানে ডেকে নিয়ে আয়। আর একটা মোড়া দিয়ে যা। সময়মতো কফি দিয়ে যাবি কিন্তু।

মানুষের এই এক আশ্চর্য রীতি। যে যাকে ভালবাসে, সে তার দোষগুলোকে আমল দেয় না। তাই যেন অতি ভদ্র মেয়েও দুর্দান্ত সমাজবিরোধীর প্রেমে পড়তে ছাড়ে না। হুঁ, নেই-নেই করেও যেন প্রেম নামে একটা বাস্তব ব্যাপার আছে। তা না থাকলে এসব ঘটনা ঘটত না। শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে দেবদাসের কথা দিয়ে অনেকে হাসিঠাট্টা করে। কিন্তু দেবদাস কি সত্যি অবাস্তব অসম্ভব চরিত্র? মানুষের পক্ষে সবই সম্ভব।

হয়তো প্রেম অর্থাৎ ভালবাসা মানে একটা ব্যক্তিত্বকেই ভালবাসা। ব্যক্তিত্ব জিনিসটা দেহমন মিলিয়ে একটা অস্তিত্ব। সুন্দর মানুষ জঘন্য কুৎসিতেরও প্রেমে পড়ে থাকে সে কারণে। দেহ নয়, দৈহিক ব্যক্তিত্ব হচ্ছে আকর্ষণের বস্তু। তবে সব জিনিসের মতো প্রেমেরও আসল-নকল আছে হয়তো। সাময়িক ভাললাগা বা মোহ থেকে সম্ভবত নকল প্রেম। আসল প্রেম এই সব বিরল প্রজাপতির অর্কিড আর ক্যাকটাসের মতো বিরল।

পারমিতা আর অমিয়র ব্যাপারটা এই গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। আসল প্রেম ছাড়া আর কী? অমিয় নেই, তবু পারমিতা এখনও তার কথা ভাবছেন। তাঁর হত্যাকারীর শাস্তি চাইছেন। বোঝা যায়, মনে মনে তাকেই পতিত্বে বরণ করে। বসেছিলেন।

কর্নেল পেছন ফিরে অর্কিডটা মাচায় একটা মোটা কাঠের টুকরোর সঙ্গে বেঁধে দিচ্ছিলেন। কাঠে একরকমের সলিউশান মাখানো। নিজস্ব আবিষ্কার। অর্কিড দ্রুত শেকড় দিয়ে জড়িয়ে ধরবে কাঠটাকে। প্রেমিকা যেমন করে আলিঙ্গন করে তার প্রেমিককে কামনার তীব্রতায় আচ্ছন্ন হয়ে, ব্যাকুল হয়ে।

চোখের কোনা দিয়ে পারমিতাকে দেখে দ্রুত হাসিমুখে ঘুরলেন। এই যে!

–আপনার পরিচর্যা দেখেছিলুম।

কর্নেল দেখলেন, কখন ষষ্ঠী মোড়া দিয়ে গেছে। ছাদে এলে তার এইরকম তন্ময়তা আসে। তাকে যদি কেউ খুন করতে চায়, এই ছাদে এলে সে খুব সহজে তা করতে পারে। কে জানে কেন, এখানে এই খোলা আকাশের নিচে মাটি থেকে অনেক উঁচুতে এই সব বিচিত্র উদ্ভিদের কাছে পৌঁছে তিনি যেন তাদেরই অন্তর্ভুক্ত হয়ে যান। জীবনে অসংখ্য হত্যাকারীকে তিনি ধরিয়ে দিয়েছেন। তাদের শাস্তি হয়েছে। তার কাছে বুদ্ধির চাতুর্যে পরাস্ত হয়ে আত্মসমর্পণ করেছে। তাদেরই কেউ না কেউ একদিন প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে কি আসবে না? সিঁড়িতে সেই আততায়ীর পায়ের শব্দও শুনতে পাবেন না। কারণ তখন তিনি উদ্ভিদের অন্তর্ভুক্ত–মূক, চক্ষুহীন, ভাষাহীন এক সত্তা। গভীর চেতনার মধ্যে লীন। আর সেই আততায়ী এসে নির্বিবাদে তাকে খতম করে যাবে। হতভাগ্য ষষ্ঠী এসে আবিষ্কার করবে বাবামশাইয়ের রক্তাক্ত মৃতদেহ।

শিউরে উঠে কাঁধ নাড়া দিলেন। পারমিতা বললেন কর্নেল, আপনি কি অসুস্থ?

একটু হাসলেন।–না! তুমি বসো। বসো। তোমার সঙ্গে কথা আছে। তাই ডেকেছিলুম।

পারমিতা চারপাশে চোখ বুলিয়ে বললেন–দারুণ! হর্টিকালচারে আপনার এমন নেশা আছে জানতুম না! আমারও অবশ্য একটু নেশা আছে। তবে স্রেফ ফুলের। এত স্পেসও নেই। জাস্ট ব্যালকনিতে কিছু টব।

একটু তফাতে বসে কর্নেল চুরুট ধরালেন। উজ্জ্বলবাবুর সঙ্গে তো। তোমার পরিচয় ছিল। তাই না?

খুব সামান্য। অমিয়র কাছে আসতেন, সেই সূত্রে যেটুকু আলাপ।

–ওঁর ছেলে স্বপনের সঙ্গে।

পারমিতা মাথা দুলিয়ে বললেন না। তাকে চিনি না।

–স্বপনই খুনী সাব্যস্ত হয়েছে, আশাকরি শুনেছ।

পারমিতা অবাক হলেন।– তাই নাকি? জানি না তো। আপনার কাছ থেকে যাওয়ার পর আমি কিছুদিন দার্জিলিঙে ছিলুম। গতকাল ফিরেছি। তাহলে উজ্জ্বলকুমারের ছেলেই খুন করেছে অমিয়কে? বুঝেছি। বাবার প্ররোচনায় এ কাজ করেছে সে। আপনাকে তো বলেছিলুম, উজ্জ্বলকুমারের এতে হাত আছে। আই ওয়াজ কারেক্ট!

তুমি কি কাগজ রেগুলার পড়ো না?

পারমিতা ভুরু কুঁচকে বললেন–বিশেষ পড়ি না। তা ছাড়া, আমি এক সপ্তাহ এমন এমন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি, কাগজ সেখানে পৌঁছয় না। একা নয়, সঙ্গে আমার কলেজের একদল ছাত্রীও ছিল। এক্সকার্সান ট্যুর হয় প্রতি বছর গ্রীষ্মে। এবার আমি ওদের নিয়ে গিয়েছিলুম।

–তাহলে উজ্জ্বলকুমারের খুন হওয়ার কথা তুমি জান না?

পারমিতা চমকে উঠলেন। –সে কি! উজ্জ্বলকুমারও খুন হয়েছেন? কবে? কোথায়?

–অমিয়বাবু খুন হবার দুদিন পরে স্টুডিওর ভেতর পুকুরপাড়ে উজ্জ্বলবাবুর ডেডবডি পাওয়া গিয়েছিল। একই ভাবে মাথার পেছনে শক্ত ভোতা জিনিস দিয়ে আঘাত।

পারমিতার মুখে বিস্ময়মিশ্রিত আতঙ্কের ছাপ ফুটে উঠল। –তাহলে..কিন্তু আপনি তো বলছেন উজ্জ্বলকুমারের ছেলে খুনী! নিজের বাবাকে সে খুন করতে পারল?

–পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণ অনুসারে তাকেই দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে, তার মোটিভও খুব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সব কাগজে তার ছবি ছাপানো হয়েছে। ধরিয়ে দেওয়ার জন্য কিন্তু এখনও পর্যন্ত তাকে ধরতে পারেনি পুলিস।

নিজের বাবাকে সে খুন করবে? অমিয়কে করতে পারে।

–পুলিস সেটাই সাব্যস্ত করেছে।

পারমিতা তাকালেন। আপনি কি সাব্যস্ত করেছেন?

কর্নেল হাসলেন। আমি পুলিসের বক্তব্যের বিরুদ্ধে কোনো যুক্ত খুঁজে পাচ্ছি না। কোনো পাল্টা তথ্য আমার হাতে নেই। সত্যি বলতে কি, কেসটা ভীষণ জটিল। যেদিক থেকে তাকাচ্ছি, সেদিকেই একমাত্র স্বপনকে দেখতে পাচ্ছি।

পারমিতা একটু চুপ করে থেকে বললেন কিছু বিচিত্র নয়। আজকাল যা অবস্থা, ছেলে বাবাকে খুন করাটা তো সামান্য ব্যাপার। মূল্যবোধের যা অবক্ষয় ঘটেছে, তা তো দেখতেই পাচ্ছি সবখানে।

–মিতা, তুমি তো অমিয়বাবুর স্ত্রীকে চিনতে?

–হ্যাঁ, খুব ডাঁটিয়াল মহিলা ছিল। ভীষণ বদরাগী স্বভাবের। নাম ছিল মৃদুলা। কিন্তু মোটেও মৃদুলা নয়।

–দেখতে সুন্দরী ছিলেন কি?

 পারমিতা একটু হাসলেন। সুন্দরী বলে মনে হয়েছিল বলেই তো অমিয় বয়সে তার চেয়ে বড় হওয়া সত্ত্বেও ওকে বিয়ে করেছিল। তা ছাড়া মৃদুলা থিয়েটারে পার্ট-টার্ট করত। অমিয়র সিনেমা করতে যাওয়ার পেছনে মৃদুলারই হাত ছিল। নইলে ও তো সাহিত্যের অধ্যাপক। সিনেমার খেয়াল চাপার কারণ ওর বউ। সত্যি বলতে কি, আমি যতটা জানি, মৃদুলাই অমিয়কে স্টুডিওমহলে নিয়ে গিয়েছিল। পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল অনেক হোমরা-চোমরা লোকের সঙ্গে।

এক মিনিট। আসছি! বলে কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। ষষ্ঠী কফি আনছিল। তার পাশ কাটিয়ে সিঁড়িতে নামলেন।

ফিরে এলেন একটা খাম নিয়ে। খাম খুলে একটা ছবি বের করে বললেন– উজ্জ্বলবাবুর পাশের মহিলাকে চিনতে পারো নাকি দেখ তো মিতা!

আলো কমে এসেছে। পারমিতা ছবিটা দেখেই বলে উঠলেন–আরে! এই তো অমিয়র বউ মৃদুলা!

কর্নেল ছবিটা ফেরত নিয়ে বললেন–এজন্যই তোমাকে ডেকেছিলুম। নাও, কফি খাও।….