৫. শেখসায়েব চলে যাওয়ার

শেখসায়েব চলে যাওয়ার ঘণ্টাদুই পরে কর্নেল আমাকে নিয়ে বেরিয়েছিলেন। তার নির্দেশমতো চৌরঙ্গী এলাকায় একটা বহুতল বাড়ির সামনে পার্কিং জোনে গাড়ি দাঁড় করালাম। তখনও জানতাম না কোথায় এসেছি। লিফটে উঠে দশতলায় নেমে দেখি, করিডরের বাঁদিকে একটা বোর্ডে লেখা আছে মহাবীর ট্রেডিং এজেন্সি লিমিটেড। অমনি বনানী সেনের কথা মনে পড়ে গেল।

কর্নেলকে অনুসরণ করে ভেতরে ঢুকলাম। মোটামুটি প্রশস্ত এবং ছিমছাম সাজানো রিসেপশন রুম। বিজ্ঞাপনের মডেল সুন্দরীদেরই একজন কাউন্টারে বসে আছে এবং টেলিফোনে কার সঙ্গে কথা বলছে। টেলিফোন রেখে সে কর্নেলের দিকে মধুর হেসে তাকা-বলুন স্যার, কী করতে পারি আপনার জন্য?

বাঁধা বুলি এবং বাজারি এটিকেটে কর্নেল বললেন–মিঃ প্রসাদের সঙ্গে দেখা করতে চাই।

নাম বলুন প্লিজ?

 কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।

 –কী কাজ বলুন প্লিজ?

কর্নেল তার নেমকার্ড দিয়ে বললেন ন্যাচারাল পার্ল সম্পর্কে আমি রিসার্চ করছি। কিছু তথ্য জানতে চাই।

রিসেপশনিস্ট যুবতী কার্ড দেখে বললেন–আপনি নেচারিস্ট?

–হ্যাঁ। নেচার আমার হবি। যা কিছু ন্যাচারাল, তা-ই আমার প্রিয়।

 যুবতী আবার মধুর হাসল।–কিন্তু দুঃখিত স্যার! মিঃ প্রসাদ এখন কনফারেন্সে ব্যস্ত। আপনাকে বরং ডেটা রিসার্চ সেকশনের ইন-চার্জ ডঃ সুন্দরমের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিচ্ছি। অবশ্য জানি না, আপনাকে কোনও তথ্য দেওয়া হবে কি না। আমাদের কম্পানি বাইরে কাকেও তথ্য দেয় না বলেই জানি। এক মিনিট।

বলে সে টেলিফোনে চাপা গলায় কার সঙ্গে কিছু বলল। তারপর কর্নেলের দিকে তাকাল।–আপনি ডঃ সুন্দরমের কাছে যেতে পারেন। বাবুলাল! ইয়ে সাবকো ডঃ সুন্দরমকা কামরা মে লে যাও। আপনি এর সঙ্গে যান।

একজন উর্দিপরা বেয়ারা আমাদের নিয়ে গেল। একটা বড় অপিস ঘর। কম লোক এবং বেশি কাজের জন্য কম্পিউটারে সাজানো। তারপর একটা সংকীর্ণ করিডর! সামনে একটা ঘর। ফলকে লেখা : ডেটা রিসার্চ সেকশন।

ছোট্ট কেবিনে বিশাল সেক্রেটারিয়েট টেবিল। তার ওধারে শ্যামবর্ণ ফো এক দক্ষিণী-ভদ্রলোক বসে খুটখাট করে বোতাম টিপছিলেন। মুখ তুলে বললেন–বসুন।

আমরা বসলাম। কর্নেল পকেট থেকে নেমকার্ড বের করছিলেন। ডঃ সুন্দরম দ্রুত বললেন–পেয়ে গেছি।

উনি কর্নেলের কার্ডের একটা জেরক্স কপি দেখিয়ে ঠোঁটের কোনায় হাসলেন। বুঝলাম এই অফিসে যন্ত্রই আসল কর্মী। রিসেপশনিস্ট যুবতী কম্পিউটারের সাহায্যে মুহূর্তেই কাজটা করে দিয়েছে।

কর্নেল অমায়িক হেসে বললেন–সময় থেকে আপনারা অনেক এগিয়ে আছেন। অভিনন্দন!

ধন্যবাদ। বলুন কী করতে পারি?

–প্রাকৃতিক মুক্তো সম্পর্কে আমি গবেষণা করছি। কেরালা উপকূলে আমি কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছিলাম। ইচ্ছা ছিল, গালফ অঞ্চলে যাব। কিন্তু যুদ্ধ বেধে গেল। তো আমি শুনেছি, ওই এলাকার তথ্য আপনাদের কাছে আছে। তাই

বাধা দিয়ে ডঃ সুন্দরম বললেন কর্নেল সরকার। আপনি বললেন, সময়ের চেয়ে আমরা এগিয়ে আছি। খাঁটি কথা বলেছেন। আপনি কেন এখানে এসেছেন তা আমরা জানি। আপনার সঙ্গী ভদ্রলোক কে, তা-ও আমাদের অজানা নয়। কিন্তু দুঃখিত কর্নেল সরকার! শেখ জুবাইর আল-সাবার চুরি যাওয়া মুক্তো সম্পর্কে কোনও তথ্যই আমাদের জানা নেই।

আমি চমকে উঠেছিলাম। কর্নেল দাড়িতে হাত বুলিয়ে আস্তে বললেন–ঠিক এই তথ্যই আমি জানতে এসেছিলাম। পেয়ে গেলাম।

ডঃ সুন্দরম ভুরু কুঁচকে তাকালেন। তার মানে?

কর্নেল তাঁর কথায় কান না করে বললেন–প্রসাদজি আমার সঙ্গে দেখা করতে চান না। ওঁকে জানিয়ে দেবেন, আমার সঙ্গে দেখা করলে লাভবান হতেন।

–ধোঁয়াটে কথাবার্তা আমি পছন্দ করি না কর্নেল সরকার।

শেখ সায়েবকে প্রসাদজি যত বোকা ভেবেছিলেন, উনি তত বোকা নন।

ডঃ সুন্দরম উঠে দাঁড়ালেন। মুখের রেখায় চাপা রাগ স্পষ্ট।–আপনার হেঁয়ালি শোনার সময় আমার নেই। আপনি আসতে পারেন। আর একটা কথা আপনাকে জানিয়ে রাখা উচিত। এই কোম্পানির সঙ্গে সরকারের এক্সপোর্ট প্রমোশন কাউন্সিলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। দুবাইয়ে কাউন্সিলের ফরেন অফিসের চার্জে আছেন প্রসাদজির জামাই।

কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে একটু হেসে বললেন–প্রসাদজিকে আর একটা কথা বলে দেবেন। ইন্দ্রজিৎ রায় ওঁর ফাঁদ এড়াতে গিয়ে আরেকটা ফাঁদে পড়েছিল। প্রসাদজি যেন একই ভুল না করেন।

ডঃ সুন্দরমের সোনালি ফ্রেমের চশমা নাকের ডগায় ঝুলে ছিল। চশমার ওপর দিয়ে দুটি নিষ্পলক চোখ দেখা যাচ্ছিল। এই অবস্থায় ওঁকে রেখে আমরা বেরিয়ে এলাম।

রিসেপশন থেকে বেরিয়ে লিফটের জন্য অপেক্ষা করছি, এমন সময় করিডরের শেষ প্রান্তে বাঁকের মুখে একজন বেঁটে গাব্দাগোব্দা চেহারার টাইসুট পরা ভদ্রলোককে দেখতে পেলাম। মুখে ফ্রেঞ্চকাট কালো দাড়ি এবং মাথায় টুপি। হাতে একটা ব্রিফকেস। ভদ্রলোক আসতে আসতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে হাত তুলে ঘড়ি দেখলেন। তারপর যেদিক থেকে আসছিলেন, সেইদিকেই হন্তদন্ত ফিরে গেলেন। মুখটা কেন যেন চেনা মনে হল।

তবে সাংবাদিক জীবনে কত প্রেস কনফারেন্স কভার করেছি। কোথাও দেখে থাকব হয়তো।

নীচের পার্কিং জোনে এসে বললামবড্ড জট পাকিয়ে গেল, বস্।

কর্নেল তুম্বোমুখে বললেন–সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকার একটা বিপদ হল, মানুষ তখন একচক্ষু হরিণ হয়ে ওঠে। দৃষ্টিটা তখন সামনে। আর কত এগোনো যায়, সেই চিন্তা। আসে-পাশে বা পেছনে ঘুরে কিছু দেখে না। বুঝলে তো?

গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বললাম–শুধু বুঝলাম মহাবীর ট্রেডিং এজেন্সি এই কেসে জড়িত কি না জানতে এসেছিলেন।

–হুঁ।

 –আপনি হঠাৎ এত গম্ভীর কেন?

–গতরাতে ইস্টার্ন বাইপাসে তোমার সঙ্গে খেলাকরা লাল মারুতির শেষ দুটো সংখ্যা ৬৭ নয়, ৭৬।

একটুর জন্য একটা অ্যাম্বাসাডারের সঙ্গে ধাক্কা থেকে বেঁচে গেলাম, এমন হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। কর্নেল চোখ কটমটিয়ে তাকালেন। তারপর বললেন– তোমাকে বরাবর বলেছি জয়ন্ত, দক্ষ সাংবাদিক হওয়ার জন্য দরকার তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ। লাল মারুতিটা ওই বাড়ির পার্কিং জোনে পার্ক করা ছিল। তা ছাড়া তুমি লক্ষ্য করোনি, পার্কিং জোনের একটা করে অংশ এক একটা কোম্পানির জন্য অ্যালট করা। ফলকে কোম্পানির নাম লেখা আছে। বাইধের লোকজনের জন্য জেনারেল জোন, যেখানে তুমি গাড়ি পার্ক করেছিলে।

–সেই মারুতিটার শেষ দুটো সংখ্যা ৬৭ হতেও পারে। আপনি কী ভাবে নিশ্চিত হচ্ছেন?

–অঙ্ক ডার্লিং, অঙ্ক! মহাবীর ট্রেডিং এজেন্সি তোমার বায়োডাটা কম্পিউটারাইজড করে রেখেছে। ডঃ সুন্দরমের কাছে তার আভাস পেয়েছ।

ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বললাম রহস্য ঘনীভূত তা হলে!

কর্নেল চুরুট জ্বেলে ধোঁয়ার ভেতর বললেন। তবে এতক্ষণে খেইটা হয়তো দেখতে পাচ্ছি।

–প্লিজ, আমাকে খেইটা দেখিয়ে দিন!

বনানী সেন…বলে কর্নেল সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজলেন। ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে পৌঁছলে উনি চোখ খুলে সিধে হয়ে বসলেন। বললেন বউবাজার জয়ন্ত! একবার চন্দ্র জুয়েলার্সের কুঞ্জনাথবাবুর সঙ্গে দেখা করা দরকার। ফুয়েল। খরচ হবে তোমার গাড়ির। হোক না। আমি উসুল করে দেব। ভেবো না।

হাসতে হাসতে বললেন–দৈনিক সত্যসেবক দেবে ফুয়েল খরচ। কারণ স্টোরিটা পেলে কাগজের সার্কুলেশন এক লাখ বেড়ে যাবে। কাগজ নাকি ডাল হয়ে যাচ্ছে। কাগজের এজেন্টরা রোজ এসে সার্কুলেশন ম্যানেজারের কাছে। রিপ্রেজেন্টেশন দিচ্ছে।

চন্দ্র জুয়েলার্সের বিশাল দোকান। অফিস দোতলায়। কুঞ্জনাথ আমাদের দেখে খুশিতে প্রায় নেচে উঠলেন। বললেন–একটু আগে রিং করেছিলাম স্যার! আপনার লোক বলল, আপনি বেরিয়েছেন। মেঘ না চাইতেই জল পেয়ে গেলাম।

কর্নেল বসে বললেন–কোনও নতুন খবর আছে?

কুঞ্জনাথ উত্তেজিত ভাবে বললেন ডিটেকটিভদ্রলোক চোরডিহা থেকে কিছুক্ষণ আগে ট্রাংককল করেছিলেন। টাকা নিয়ে যেতে বললেন। কিন্তু আমাকে একা যেতে হবে। উনি নাকি ফাঁদ পেতে কিডনাপারদের ধরবেন। দাদাকেও উদ্ধার করে দেবেন। এখন কথা হল, ওঁর কথার ভরসা করে অতগুলো টাকা নিয়ে একা যাওয়া কি ঠিক হবে? তা ছাড়া ভদ্রলোকের মাথায়। ছিট আছে।

কর্নেল বললেন–হুঁ। হালদার মশাইয়ের কিছু বাতিক আছে। আমারও কম নেই। তবে মনে রাখবেন, উনি পুলিশের ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর ছিলেন। আপনি টাকা নিয়ে যেতে পারেন। তবে সঙ্গে শক্ত সমর্থ লোক নেবেন। তারা আপনার অচেনা লোক সেজে যাবে। হালদার মশাইয়ের সঙ্গে আপনার দেখা হয়ে গেলে ওরা স্টেশনে থেকে যাবে।

কুঞ্জনাথ দ্বিধার ভাব দেখিয়ে বললেন–সঙ্গে আপনার মতো মানুষ পেলে চিন্তার কিছু ছিল না।

আমি বললাম ট্রাঙ্ককলে ডিটেকটিভদ্রলোকই যে কথা বলছেন, আপনি সিওর তো কুঞ্জনাথবাবু?

কুঞ্জনাথ হকচকিয়ে গেলেন।–সেও তো ভাববার কথা। তবে ইস্টবেঙ্গলের ভাষায় কথা বললেন। কথাবার্তার ভঙ্গিতে উনি বলেই মনে হল। তবে আপনি ঠিকই ধরেছেন। যদি অন্য কেউ হয়? তাই না কর্নেলসায়েব?

কর্নেল হাসলেন।–হালদারমশাইয়ের সঙ্গে দেখা না হলে ফিরে আসবেন।

কুঞ্জনাথ করুণ মুখে বললেন–চোরডিহা নাম শুনেই কেমন ভয় করছে। তাতে বিহার মুলুকের যা কাণ্ডকারখানা কাগজে পড়ি কর্নেল তাকে থামিয়ে বললেন–ডিসিডিডি লাহিড়ি সাহেবকে বলুন, আপনার সঙ্গে সাদা পোশাকের পুলিশগার্ড যেন থাকে।

তা হলে যাব বলছেন?

–যান। কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট ধরালেন। তারপর বললেন–যেজন্য এলাম, বলি। আপনি ম্যাজিক দেখতে ভালবাসেন? কুঞ্জনাথ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন।

–বিশেষ করে বিশ্বখ্যাত জুনিয়ার পি সি সরকারের ম্যাজিক?

–কেন একথা জিজ্ঞেস করছেন স্যার?

–আগে আমার প্রশ্নের জবাব দিন কুঞ্জনাথবাবু!

 কুঞ্জনাথ নড়ে বসলেন।–মনে পড়েছে। মহাবীর ট্রেডিং এজেন্সির ম্যানেজিং ডাইরেক্টর গণেশলাল প্রসাদ দাদাকে দুটো ম্যাজিক শোয়ের টিকিট দিয়েছিলেন। দাদা আমাকে টিকিট দুটো দিয়ে বলেছিল, আমার সময় হবে না। তবে প্রসাদজি যখন দিয়েছেন, যাওয়া উচিত। বরং তুই যাস্ বউমাকে নিয়ে। তো স্যার, আমার স্ত্রী সেদিন হঠাৎ শ্বশুরমশাইয়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে চলে গেল। সেদিন প্রসাদজীর অফিস থেকে একটা ট্রেডিং ইনফরমেশন দিতে এসেছিল সেই মেয়েটা স্যার–বনানী সেন। ডেটা রিসার্চ সেকশনের অ্যাসিস্ট্যান্ট। কথায় কথায় ওকে বললাম–ম্যাজিক দেখতে চাও?

–টিকিট দুটো ওকে দিয়েছিলেন তা হলে?

 –হ্যাঁ স্যার।

 –আপনি কি দাদাকে বলেছিলেন আপনার যাওয়া হচ্ছে না?

না তো!

–আপনি নিজের ইচ্ছায় দিয়েছিলেন?

–হ্যাঁ স্যার! মেয়েটা আমাদের অনেক সিক্রেট ইনফরমেশন দেয়। ওকে আমরা খুশি রাখতে চেষ্টা করি সব সময়।

কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন–চলি কুঞ্জনাথবাবু! আপনি ডিসি ডিডির সঙ্গে এখনই যোগাযোগ করে টাকা নিয়ে চোরডিহা চলে যান। দাদাকে উদ্ধার করা আপনার কর্তব্য।

রাস্তায় নেমে বললাম–ব্যাপারটা কী?

কর্নেল গাড়িতে ঢুকে বললেন–রহস্যের খেইটা সত্যি পাওয়া গেল। কাজেই ঠিক পথে এগোচ্ছি।…

ফিরে আসার পথে ডঃ সুন্দরমকে বলা কর্নেলের কথাগুলো মনের পর্দায় ভেসে উঠছিল।

এক : প্রসাদজি কর্নেলের সঙ্গে দেখা করলে লাভবান হতেন।

দুই : প্রসাদজি শেখসায়েবকে যত বোকা ভেবেছিলেন, উনি তত বোকা নন।

তিন : প্রসাদজির ফাঁদ এড়াতে গিয়ে ইন্দ্রজিৎ অন্য ফাঁদে পড়েছিল। এই তিনটি কথার ওপর ভিত্তি করে নিজেই রহস্যের খেই খোঁজার চেষ্টা করছিলাম। মোটামুটিভাবে আঁচ করলাম, শেখসায়েব প্রথমে মুক্তোচুরির ব্যাপারে প্রসাদজির সঙ্গেই যোগাযোগ করেছিলেন। কিন্তু শেষাবধি তাকে যে-কোনও কারণে হোক, বিশ্বাস করতে না পেরে হরনাথের কাছে যান। হরনাথ এদেশে তার মুক্তোর বড় খদ্দের। কাজেই হরনাথকেই বেছে নেওয়া তার পক্ষে স্বাভাবিক। ওদিকে প্রসাদজি মুক্তোর লোভে ইন্দ্রজিৎকে ফাঁদে ফেলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ফাঁদটা কী?

মহাজাতি সদনে ম্যাজিক শোয়ের দুটো টিকিট?

প্রসাদজি কি ইন্দ্রজিৎকে কিডন্যাপের চক্রান্ত করেছিলেন মহাজাতি সদনের কাছে? মুক্তো আদায় করার জন্য পীড়ন করতেন। তা হলে টিকিটদুটো সরাসরি ইন্দ্রজিতের প্রেমিকা বনানীকে দিলেন না কেন? কুঞ্জনাথের কথায় জানা গেল, টিকিটদুটো তিনি বনানীকে দিয়েছিলেন।

কেন?

এর একটাই জবাব হতে পারে। মুক্তো ইন্দ্রজিতের কাছ থেকে হাতাতে প্রথমে হরনাথ এবং প্রসাদজি গোপনে একটা বোঝাপড়ায় এসেছিলেন। ইন্দ্রজিৎ ম্যাজিক শোয়ের ফাঁদ এড়াতে গিয়ে দৈবাৎ আমাকে পেয়ে গিয়েছিল। পরের ফাঁদটা হরনাথের।

সেই ফাঁদ প্রসাদজির অজ্ঞাতসারে আগেই পেতে রেখেছিলেন হরনাথ। পরমেশের বাগানে আমার কুড়িয়ে পাওয়া চিঠিটা থেকে এটা বোঝা যায়। হরনাথ প্রসাদজিকে ফাঁকি দিয়ে একা মুক্তো হাতানোর চক্রান্ত করেন। এরপর প্রসাদজি খাপ্পা হয়ে হরনাথকে কিডন্যাপ করেছেন। কিন্তু প্রসাদজি কর্নেলের সঙ্গে দেখা করলে কী লাভ হত?

–জয়ন্ত! সাবধান! অ্যাকসিডেন্ট করে ফেলবে।

একটা আবর্জনাবোঝাই বিশাল ট্রাক ওভারটেক করে বেরিয়ে গেল। স্টিয়ারিং শক্ত হাতে ধরে বললাম নাহ। আমি ব্যাকভিউ মিররে লক্ষ্য রেখেছিলাম। জানতাম ব্যাটাচ্ছেলে ওভারটেক করবে।

–কিন্তু তুমি লক্ষ্য করোনি সেই লাল মারুতি আমাদের সারাক্ষণ ফলো করছে। চমকে উঠে বললাম কি? কোথায়?

–ওয়েলিংটন স্কোয়ারের আগে গণেশ অ্যাভিনিউ দিয়ে রাইট টার্ন করে চলে গেছে।

–আপনার বলা উচিত ছিল। ওকে তাড়া করতাম। কর্নেল হাসলেন– কলকাতা শহরে কোনও গাড়িকে ফলো করা যদি বা যায়, তাড়া করে ধরা যায় না। প্রাইভেট ডিটেকটিভ হালদার মশাইয়ের মতো তা হলে রাস্তা দিয়ে দৌড়তে হয়। তবে উনি একসময় পুলিশ ছিলেন। চোরডাকাতের পিছনে দৌড়ুনো অভ্যাস আছে। তোমার নেই।

–প্রথমে কোথায় দেখেছিলেন লালটু হারামজাদাকে?

 কর্নেল এবার অট্টহাসি হাসলেন।–ঠিক বলেছ। লালটু হারামজাদাই বটে। চন্দ্র জুয়েলার্স থেকে বেরিয়ে অনেকটা দূরে চোখ পড়েছিল। কিন্তু অকারণ রাস্তাঘাটে সিন ক্রিয়েট করার মানে হয় না। তাড়া রিস্কও ছিল। গাড়ির জটলা থেকে গুলি ছুঁড়তে পারত। কোন গাড়ি থেকে কে গুলি ছুঁড়ল, তা বলার জন্য তুমি বা আমি বেঁচে থাকতাম না।

আঁতকে উঠলাম।–গুলি ছোঁড়ার কথা ভাবছেন কেন?

জাস্ট একটা কথার কথা।

নাহ্! আপনি সিরিয়াসলি বলছেন মনে হল।

কর্নেল আস্তে বললেন–ছেড়ে দাও!

–ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে না বস্! ডি সি ডি ডি লাহিড়িসায়েবকে গাড়িটার নাম্বার জানিয়ে দিন।

কর্নেল আবার বললেন–ছেড়ে দাও! 

–আমি কিন্তু জানিয়ে দেব।

–না ডার্লিং! তাতে কোনও লাভ হবে না। আমার ধারণা, গাড়িটার নাম্বার প্লেটে ভুয়ো নাম্বার লাগানো আছে। বেগতিক দেখলে নাম্বার প্লেট বদলে ফেলবে। এ শহরে অসংখ্য লাল মারুতি আছে।

ইলিয়ট রোডে কর্নেলের বাড়ির কাছে এসে বললাম–দুটো বাজে প্রায়। আপনাকে এখানেই নামিয়ে দিচ্ছি।

কর্নেল ষড়যন্ত্রসঙ্কুল স্বরে বললেন–তোমার লাঞ্চের নেমন্তন্ন।

কথার ভঙ্গিতে হেসে বললাম।–এবার দেখছি আমাকে পাকাপাকিভাবে আপনার অ্যাপার্টমেন্টেই ডেরা পাততে হবে। সল্ট লেকের ফ্ল্যাটে বরং ভাড়াটে বসিয়ে দেব।

–আমার আপত্তি নেই। তবে তুমিই বেশিদিন টিকতে পারবে না। পাগল হয়ে যাবে। প্রতিদিন রাজ্যের যত অদ্ভুত-অদ্ভুত লোক এসে আমাকে উত্ত্যক্ত করে। ষষ্ঠী বলে, আমার পাল্লায় পড়ে সে নাকি পাগল হয়ে যাচ্ছে। কথাটা সত্যি।

গাড়ি লনের পার্কিং জোনে রেখে কর্নেলের সঙ্গ ধরলাম। তিনতলার অ্যাপার্টমেন্টে ডোরবেলের সুইচ টেপার আগেই ষষ্ঠীচরণ দরজা খুলে দিল। নিশ্চয় জানালা দিয়ে আমাদের দেখতে পেয়েছিল।

ড্রয়িং রুমে ঢুকে কর্নেল বললেন–জয়ন্ত খাবে। শিগগির খেতে দে।

ষষ্ঠী বলল–দাদাবাবু খাবেন সে কি আমি জানি না?

কর্নেল চোখ কটমটিয়ে বললেন–তা হলে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?

–আজ্ঞে বাবামশাই, একটা ফোং এসেছিল। আমি বললাম, বাবামশাই বেইরেছেন। কখন ফিরবেন বলতে পারব না।

নাম জিজ্ঞেস করেছিলি?

–আজ্ঞে হ্যাঁ। বললে, পরে ফোং করব। কথা শুনে মনে হল বাঙালি না।

 ষষ্ঠী চলে গেলে কর্নেল বললেন–এক মিনিট ডার্লিং! পোশাক বদলানো, দরকার। তুমি বরং বাথরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে ফেলো। তোমাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে।

কিছুক্ষণ পরে ডাইনিংয়ে খাওয়ার টেবিলে বসে ডঃ সুন্দরমকে বলা কর্নেলের কথা থেকে তৈরি আমার থিওরিটা উত্থাপন করলাম। কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন–তোমাকে বরাবর বলেছি জয়ন্ত, খাওয়ার সময় কথা বলা উচিত নয়। প্রথমত, খাওয়ার স্বাদ থেকে বঞ্চিত হবে। দ্বিতীয়ত, খাবার গলায় আটকে যাওয়ার চান্স আছে। তা-ই বটে! আমার বৃদ্ধ বন্ধুর এই অভ্যাস আছে। খাওয়ার সময় উনি কথা বলা পছন্দ করেন না।

কিন্তু এই সময় ফোন বেজে উঠল। ষষ্ঠী ড্রয়িং রুমে চলে গেল ফোন ধরতে। একটু হেসে বললাম–মনে হচ্ছে, আপনার এই অভ্যাসটা সবসময় মেনে চলতে পারেন না। ধরুন, ফোনটা যদি ডি সি ডি ডি লাহিড়ি সায়েবের হয়? কিংবা হালদার মশাইয়ের ট্রাঙ্ককল?

কর্নেল হাসলেন।–ব্যতিক্রম নিয়মকেই সাব্যস্ত করে ডার্লিং! তবে ফোনটা প্রসাদজির হওয়াই সম্ভব।

ষষ্ঠী এসে বলল–সেই ভদ্রলোক বাবামশাই। বললাম, উনি এখন খাচ্ছেন। শুনে বললেন, পনের কুড়ি মিনিটের মধ্যেই যাচ্ছি। সায়েব যেন থাকেন।

কর্নেল চুপচাপ খাওয়া শেষ করলেন। আমি মনে মনে উত্তেজনা অনুভব করছিলাম। যদি সত্যি মহাবীর ট্রেডিং এজেন্সির ম্যানেজিং ডাইরেক্টর গণেশলাল প্রসাদ কর্নেলের সঙ্গে দেখা করতে আসেন, আমার থিওরি বাজিয়ে নেওয়ার চান্স ছাড়ব না।

ড্রয়িং রুমে ঢুকে ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন কর্নেল। চুরুট জ্বেলে বললেন–তোমার থিওরিটা মন্দ না। তবে একখানে একটু ফাঁক থেকে গেছে।

–কোথায় বলুন তো?

–ম্যাজিক শোয়ের টিকিট হরনাথ তাঁর ভাই কুঞ্জনাথকে দিয়েছিলেন। কুঞ্জনাথ দেন বনানীকে। নেহাত একটা আকস্মিক যোগাযোগ এসে যাচ্ছে তোমার থিওরিতে।

–ধরুন, প্রসাদজি বা হরনাথ বনানীকে টিকিট দেওয়ার পর ইন্দ্রজিৎ কিডন্যাপড হলে দুজনে জড়িয়ে পড়তেন। বনানী পুলিশকে বলত কে তাকে টিকিট দিয়েছিল।

কর্নেল একরাশ ধোঁয়ার ভেতর বললেন–একই ব্যাপার। তোমার থিওরি অনুসারে বনানী কুঞ্জনাথের নাম করত। পুলিশের জেরার চোটে কুঞ্জনাথ বলতে বাধ্য হতেন কে তাকে টিকিট দিয়েছিল।

হাল ছেড়ে দিয়ে বললাম–নাহ্। কিছু বোঝা যাচ্ছে না। এদিকে আপনি বলছেন রহস্যের খেই পেয়ে গেছেন। ঠিক পথেই এগোচ্ছেন।

–হ্যাঁ। খেই পেয়ে গেছি এবং সঠিক পথেই এগোচ্ছি।

–খেইটা কী?

–ইন্দ্রজিতের চুরি করে আনা মুক্তো কোনও পক্ষই হাতাতে পারেনি। ইন্দ্রজিৎ তা যেখানে বা যার কাছে রেখেছিল, সেখানে বা তার কাছেই আছে। তা না হলে এতসব ঘটনা ঘটত না।

একটু ভেবে নিয়ে বললাম–বনানীর কাছে নেই তো?

কর্নেল হাসলেন। তুমি ওর সঙ্গে ভাব জমিয়ে দেখতে পারো। হঠাৎ বনানীর একটা কথা মনে পড়ে গেল। বললাম কর্নেল! বনানী একটা মিথ্যা কথা বলেছে আপনাকে। ডাহা মিথ্যা।

কর্নেল ভুরু কুঁচকে তাকালেন।– মিথ্যাটা কী?

বললাম–বনানী বলছিল জুয়েলার হরনাথ চন্দ্রকে সে চেনে না। অথচ কুঞ্জনাথের কাছে জানা গেল, সে গোপনে ট্রেড সিক্রেট পাচার করতে নিয়মিত চন্দ্র জুয়েলার্সে যেত। কুঞ্জনাথ তাকে ম্যাজিক শোয়ের টিকিট দিয়েছিলেন।

কর্নেল বললেন–বনানী গোপনে ট্রেড সিক্রেট চন্দ্র জুয়েলার্সকে পাচার করত বলেই আমাকে কথাটা লুকিয়েছে। এতে অস্বাভাবিক কিছু নেই। যাই হোক–কর্নেল মিটিমিটি হাসলেন।-তুমি সাংবাদিক। বোম্বেতে ইন্দ্রজিৎকে ইন্টারভিউ করেছিলে। কাজেই তুমি সহজে ওর সঙ্গে ভাব জমাতে পারো।

হাসতে হাসতে বললাম–ওই যে শাস্ত্রবাক্য আছে, মেয়েদের মনের নাগাল দেবতারাও পান না।

এতক্ষণে প্রত্যাশিত ডোরবেল বাজল। কর্নেল হাঁকলেন-ষষ্ঠী! ষষ্ঠীর সাড়া এল কিচেনের দিক থেকে।–এঁটো হাত বাবামশাই! এঁটো হাতে দরজা না। খোলা ষষ্ঠীচরণের একটা সংস্কার। কাজেই আমিই দরজা খুলতে গেলাম। তাগড়াই চেহারার এক ফো মধ্যবয়সী ভদ্রলোক তুম্বে মুখে ইংরেজিতে বললেন-কর্নেল সরকারের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।

–আপনি কি মহাবীর ট্রেডিং এজেন্সির…

আমার কথার ওপর ভদ্রলোক বললেন–কেউ কি মহাবীর ট্রেডিং এজেন্সি থেকে কর্নেল সরকারের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছে?

একটু ভড়কে গেলাম কথার ভঙ্গিতে। বললাম না। কেউ বলেনি। অনুমান করছি আর কী!

–আপনি সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরী?

 অমনি স্মার্ট হয়ে বললাম–তা হলে আপনি মিঃ গণেশলাল প্রসাদ? ভেতর থেকে কর্নেল ডাকলেন।–ওঁকে নিয়ে এস জয়ন্ত।

ড্রয়িং রুমে ঢুকে ভদ্রলোক নমস্কার করে বসলেন। তারপর আমাকে হতাশ করে একটু হেসে বললেন–আমার নাম যোগীন্দ্র শর্মা। প্রসাদজি আমাকে পাঠিয়েছেন। আমি ওঁর প্রাইভেট সেক্রেটারি। বিকেলের ফ্লাইটে উনি জরুরি কাজে বোম্বে চলে যাচ্ছেন। তা না হলে নিজেই আসতেন।

বলুন মিঃ শর্মা, প্রসাদজির জন্য কী করতে পারি?

–প্রসাদজি দুঃখিত। ডঃ সুন্দরম আপনার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছেন।

–শুধু দুঃখপ্রকাশের জন্য প্রসাদজি নিশ্চয় আপনাকে পাঠাননি? যোগীন্দ্র শর্মা আস্তে বললেন–উনি দুঃখিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী। তবে উনি আপনার কাছে জানতে চেয়েছেন আপনি কী ব্যাপারে ওঁকে সাহায্য করতে আগ্রহী?

বুঝলাম না।

–আপনি ডঃ সুন্দরমকে বলে এসেছেন, প্রসাদজি আপনার সঙ্গে দেখা করলে লাভবান হতেন। এ কথার অর্থ উনি বুঝতে পারেননি।

কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট জ্বেলে ভীষণ গম্ভীর মুখে বললেন–দুঃখিত মিঃ শর্মা। তা জানতে হলে প্রসাদজিকে আমার মুখোমুখি হতে হবে। এ ভাবে ভায়া মিডিয়া কথা বলা আমি পছন্দ করি না। আপনি আসতে পারেন। আমি ব্যস্ত আছি।

যোগীন্দ্র শর্মা কর্নেলের দিকে ক্রুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর সটান বেরিয়ে গেলেন। আমি হতবাক হয়ে বসে রইলাম। কর্নেল চুরুট অ্যাসট্রেতে রেখে টেলিফোনের দিকে হাত বাড়ালেন….