১০. বৃদ্ধ রহস্যভেদী বন্ধু

এযাবৎ আমার এই বৃদ্ধ রহস্যভেদী বন্ধুর অদ্ভুত ক্রিয়াকলাপ দেখে আসছি। কিন্তু আজ যা করলেন, তার কোনও মাথামুণ্ডু খুঁজে পাচ্ছিলাম না। বনানীর ঘরে একটা মরুভূমির ছবি আছে, তাই বা কেমন করে জানলেন এবং সেটা হঠাৎ এভাবে কেনই বা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে চলে এলেন? তা ছাড়া কী আছে এই ছবিটাতে?

অসংখ্য প্রশ্ন আমাকে উত্ত্যক্ত করছিল। কিন্তু আমাকে সারা পথ চুপ করিয়ে রাখল কর্নেলের প্রগাঢ় স্তব্ধতা। চোখ বন্ধ করে উনি যেন ধ্যানমগ্ন। দাঁতের ফাঁকে আটকানো চুরুটটাও নিভে গেছে।

ওঁর অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে একটু ধাতস্থ হলাম। ফ্রেমে বাঁধানো ছবিটা উনি ভেতরের ঘরে রেখে এলেন। তারপর যথারীতি ষষ্ঠীচরণকে আবার কফির হুকুম দিলেন। টেলিফোনে কার সঙ্গে চাপা গলায় কিছুক্ষণ কী সব কথাবার্তা বললেন। তারপর আমার দিকে সহাস্যে তাকালেন। আর একটু দেরি করলেই সব ভেস্তে যেত। আসলে বয়স ডার্লিং, বয়স! আমার বয়স আমাকে বাহাত্তুরে দশার ফাঁদে ফেলবার তালে আছে। আমার নিজেরই অবাক লাগছে নিজের বোকামি দেখে! কেন যে এটা কাল সন্ধ্যায় আমার মাথায় আসেনি! আজও আসত না, যদি না হোটেল কন্টিনেন্টালের লনে বনানীকে দেখতে পেতাম।

আস্তে বললাম–আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না।

বনানীরও প্রথমে মাথায় ঢোকেনি, তা এখন বুঝতে পারছি। আমি ওকে। আজ সকালে বাইরে চলে যেতে বললাম। তারপর নিশ্চয় ও রহস্যটা আঁচ করেছিল। কারণ আজ অফিসে রবার্ট স্টিলারের সঙ্গে ওর দেখা হয়েছিল। স্টিলার-হা, স্টিলার ওকে বলে থাকবে মরুভূমির ছবিটার কথা। অমনি বনানী বুঝতে পারে, তার কাছে কী আছে এবং সেটার কত দাম। কিন্তু একা স্টিলারের সঙ্গে ডিলে নামতে সাহস পায়নি। একজন বিশ্বস্ত পুরুষ সঙ্গীর সাহায্য দরকার হয়েছিল। তাকেই তুমি কিছুক্ষণ আগে বনানীর সঙ্গে দেখেছ। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তুমি ছদ্মবেশী ডঃ সুন্দরমকেই দেখছ। দরাদরি শেষ করে এতক্ষণ তিনজনে যতীনবাবুর বাড়ির দিকে রওনা হয়ে গেছে সম্ভবত। আশা করছি, যতীনবাবু ফোনে জানাবেন কী হল।

ষষ্ঠী কফি দিয়ে গেল। কর্নেল চুমুক দিয়ে বসলেন ফের–ডঃ সুন্দরম যখন আজ প্রথমবার আমার কাছে এলেন, তখন বনানী তাকে অফিসে না পেয়ে তার বাড়ি গিয়ে থাকবে। বাড়িতে না পেয়ে ফের অফিসে সে ডঃ সুন্দরমের খোঁজে এসেছিল। মহাবীর ট্রেডিং এজেন্সিতে পুলিশ গোপনে নজর রেখেছে। এইমাত্র। টেলিফোনে জেনে নিলাম, বনানী আবার গিয়েছিল অফিসে। আমার পুলিশোর্স বলল, বনানী প্রথমবার অফিস থেকে বেরিয়ে যাবার সময় এক সায়েব তার সঙ্গে কথা বলেছিল। যাই হোক, দ্বিতীয়বার ডঃ সুন্দরমের খোঁজে এসে বনানী নিশ্চয় জানতে পারে প্রসাদজি তাকে ভাগিয়ে দিয়েছেন। তখন সে তার বাড়িতে যায়। ক্লিয়ার?

বললাম– হ্যাঁ। কিন্তু মরুভূমির ছবির ব্যাপারটা কী?

 কর্নেল হাসলেন। ছবিটার ভেতরে ভাঁজ করা সেই সাংঘাতিক ম্যাপ আছে।

–কিন্তু আপনি কী করে তা জানলেন?

 কর্নেল ঘড়ি দেখে নিয়ে বললেন কাল সন্ধ্যায় হাওড়া স্টেশন থেকে বনানীর অফিসে আমার যাওয়ার কারণ ছিল। আবার ওকে জেরা করে জানতে চেয়েছিলাম রবিবার রাতে ম্যাজিক শোয়ের পর ঠিক কী কী ঘটেছিল! কথায় কথায় বনানী বলল, শো ভাঙার সময় ইন্দ্রজিৎ কাগজে মোড়া একটা ছবি ওর হাতে গুঁজে দিয়ে বলে, এটা একটা মরুভূমির সুন্দর ছবি। তুমি ঘরে টাঙিয়ে রেখো। শো ভাঙার পর সে ভিড়ে নিপাত্তা হয়ে যায়। তার মানে ম্যাপটা সে নিরাপদ জায়গায় রাখার জন্য তড়িঘড়ি এই ব্যবস্থা করেছিল। কারণ সে ফাঁদটা টের পেয়েছিল। এরপর ছবিটা সম্পর্কে আমার কৌতূহল একটু বেশিমাত্রায় দেখিয়ে ভুল করেছিলাম। নাবনানী তখন কী করে জানবে ওটার মধ্যে কী আছে? আমিই বা তখন কী করে জানব ম্যাপের কথা? আমি ওকে শুধু এটুকু বলেছিলাম, ছবিটা সাবধানে রাখতে। কারণ আমার মনে হয়েছিল, তথাকথিত চোরাই মুক্তো লুকিয়ে রাখার কোনও সাংকেতিক সূত্র আছে ছবিটার মধ্যে। বুদ্ধিমতী বনানী তা বিশ্বাস করেছিল। পরে–ওর কথার ওপর বললাম পরে স্টিলার সায়েব ছবিটার কথা বলেছেন।

–হ্যাঁ। তাই মনে হচ্ছে। তবে বনানীকে স্টিলার ম্যাপের কথা না বলতেও পারেন। শুধু ছবিটা কিনতে চেয়েছিলেন সম্ভবত। কিন্তু ডঃ সুন্দরমকে আমি অদৃশ্য কালিতে লেখা ম্যাপের খবর জানিয়েছি। কাজেই এবার বনানীরও তা জানার চান্স আছে। দরাদরি জোর চলার কথা।

–কিন্তু বনানী তো ভারি অদ্ভুত মেয়ে!

–প্রেমের চেয়ে টাকাকড়ির দাম অনেক বেশি, ডার্লিং! তা ছাড়া তার প্রেমিক তো আর বেঁচে নেই।

–স্বীকার করছি। কিন্তু আপনার সঙ্গে এরকম ব্যবহার করল, এটাই খারাপ লাগছে।

কর্নেল চকিতে শেষ চুমুক দিয়ে চুরুট ধরিয়ে বললেন–ভুল করছ জয়ন্ত! বনানী আমার কাছে এসেছিল তার প্রেমিকের খুনীকে ধরিয়ে দিতে। বাকিটা তার নিজের ব্যাপার।

–খুনীদের একজন যে গৌর, তাতে আমার সন্দেহ নেই।

–হ্যাঁ। গৌর ছিল দলে। সে-রাতে মিমির ঘুম হচ্ছিল না এবং বাইরে অনেক রাত পর্যন্ত বসে ছিল। তার সোজা মানে দাঁড়াচ্ছে, গৌরকে মিমিই খিড়কির দরজা খুলে দিয়েছিল। গৌর এবং তার সঙ্গীরা বাড়ি ঢোকে। মিমি কিন্তু জানত না তারা খুন করতে এসেছে ইন্দ্রজিৎকে। চোরাই মুক্তোর লোভেই তারা অবশ্য এসেছিল। খুন করে খুঁজে না পেয়ে চলে যায়। ব্যস্ততার সময় চিঠিটার কথা ভুলে গিয়েছিল তারা।

–মিমি খুব বোকা মেয়ে!

 কর্নেল একটু হেসে বললেন–প্রেম মানুষকে নির্বোধ করে। যাই হোক, আমরা শিগগির ডিনার খেয়ে বেরুব।

–আবার কোথায় বেরুবেন?

–হাওড়া স্টেশন।

–সে কী!

রাত দশটা নাগাদ ভায়া আসানসোল গয়ার ট্রেন ছাড়ে। আমরা চোরডিহা যাব।

–সর্বনাশ!

–সর্বনাশ বৈকি! হালদারমশাই নিশ্চয় বিপদে পড়েছেন। আমার ভাবনা হচ্ছে। তা ছাড়া জঙ্গলের সেই বজরঙ্গবলীর মন্দিরে কুঞ্জনাথবাবুরা কী অবস্থায় আছেন, দেখা দরকার।

–হরনাথবাবুকে ছেড়ে দিল কি না কলকাতায় বসেই তো খবর পাবেন। আর হালদারমশাই বিচক্ষণ গোয়েন্দা। প্রাক্তন পুলিশ অফিসার বলে কথা!

কর্নেল বললেন–নাহ্। হালদার মশাইয়ের কাছে আমিই শেখসাহেব আর হরনাথবাবুকে পাঠিয়েছিলাম। কাজেই তাঁর কিছু বিপদআপদ হলে আমার তাকে বাঁচানো নৈতিক কর্তব্য।

.

উনি ষষ্ঠীকে ডেকে নটার মধ্যেই খাওয়ার টেবিল সাজাতে বললেন। আমি বললাম কিন্তু কর্নেল! বাইরে যাওয়ার জন্য আমার তো তৈরি হওয়া দরকার।

কর্নেল বললেন–হ্যাঁ। খেয়ে দেয়ে তোমার সঙ্গে তোমার সল্টলেকের ফ্ল্যাটে যাব। ওখান থেকে হাওড়া স্টেশন যাব।

–ওখান থেকে ট্যাক্সি পাওয়া যাবে না অত রাতে। আমার কোনও ড্রাইভারও নেই যে স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে আসবে।

কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন।–চিন্তার কারণ নেই। পুলিশের জিপের ব্যবস্থা করছি। বলে উনি তৈরি হওয়ার জন্য ভেতরে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে আমরা খেতে বসেছি, ডোরবেল বাজল। কর্নেল চাপা স্বরে বললেন-ষষ্ঠী! যে-ই হোক গিয়ে বলে আয়, আমি বাড়ি নেই। বাইরে গেছি। কবে ফিরব ঠিক নেই। সাবধান! ভেতরে ঢোকাবিনে।

ষষ্ঠী চলে গেল। বললাম–যদি ডি সি ডি ডি বা কোনও ভি আই পি হন?

 কর্নেল বললেন–খাওয়ার সময় কথা বলতে নেই।

একটু পরে ষষ্ঠীচরণ এসে একগাল হেসে বলল–একজন সায়েবও ছিলেন, বাবামশাই! সঙ্গে সেই দিদিমণি আর সেই ভদ্দলোক। দুপুরবেলা যিনি এয়েছিলেন।

–হুঁ। ডঃ সুন্দরম, বনানী, রবার্ট স্টিলার। কী বললেন ওঁরা?

ষষ্ঠী একটা নেমকার্ড দিয়ে বলল–ফিরে এলে আপনাকে এটা দিতে বললেন।

কার্ডটা দেখে কর্নেল রেখে দিলেন টেবিলে। দেখলাম, রবার্ট স্টিলারের কার্ড। পাশে ইংরেজিতে লেখা আছে, দয়া করে এই ফোন নম্বরে আমার সঙ্গে কথা বলবেন।

বললাম–আপনার বরাত খুলে গেছে কর্নেল! কোটিপতি হয়ে যাবেন। ডঃ সুন্দরম আর বনানীকে কিছু পার্সেন্ট কমিশন দিলেই চলবে।

কর্নেল কোনও কথা বললেন না। খাওয়া শেষ করে কর্নেল টেলিফোনে কার সঙ্গে কথা বললেন তারপর আমরা বেরুলাম। ইস্টার্ন বাইপাসে পৌঁছে বললাম– লাল মারুতিটা এবার ফলো করলে গুলি ছুঁড়ে টায়ার ফাঁসিয়ে দেব কিন্তু।

কর্নেল বললেন–তাকে পাচ্ছ কোথায়?

–কেন? গত রাতে পুলিশ তো গাড়িটা ধরতে পারেনি।

–আজ সকালে গাড়িটা মালিকের বাড়ি ফেরত এসেছে।

–সে কী? খুলে বলুন প্লিজ!

–যোগীন্দ্র শর্মা বোম্বে যায়নি। কলকাতাতেই আছে। তার প্রমাণ সে গাড়িটা চালিয়ে নিয়ে গিয়ে মালিকের বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে। মালিকের কর্মচারীর কাছে খবরটা পেয়েছি।

–কখন?

 –যতীনবাবুর বাড়ি থেকে দুপুরে ফেরার সময়।

অবাক হয়ে বললাম–তখন তো আপনার সঙ্গে আমি ছিলাম।

–ছিলে।

–কিন্তু কাল কখন আপনি লাল মারুতির কোন মালিকের কাছে গেলেন?

 –তোমার চোখের সামনে।

–আমার চোখের সামনে? যতীনবাবুর বাড়ি থেকে ফেরার সময় আপনি তো আর কোথাও যাননি।

–চন্দ্র জুয়েলার্সে ঢুকেছিলাম। তাদের কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে এলাম।

চমকে উঠে বললাম কর্নেল! আপনি কি বলতে চান লাল মারুতিটা….

আমার কথার ওপর কর্নেল বললেন–লাল মারুতিটার মালিক চন্দ্র জুয়েলার্স। শুধু নাম্বার প্লেট চেঞ্জ করা হয়েছিল।

 চন্দ্র জুয়েলার্সের গাড়ি? তা হলে আমার থিওরি ঠিক। গাড়িটা কুঞ্জনাথবাবুর। কুঞ্জনাথই ম্যাজিকশোয়ের টিকিট দিয়েছিলেন বনানীকে। বনানীর সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে ইন্দ্রজিৎকে কিডন্যাপ করতে চেয়েছিলেন। না পেরে যোগীন্দ্রের সঙ্গে চক্রান্ত করে চিঠি লিখে গৌরকে নিয়ে পরমেশবাবুর বাড়ি ঢোকেন।

কর্নেল হাসলেন। তা হলে গতরাতে কুঞ্জনাথের পুলিশের হাতে ধরা পড়ার কথা। অথচ উনি সঙ্গে টাকা আর পুলিশ নিয়ে চোরডিহা গেছেন।

কুঞ্জনাথের কোনও লোক ধরা পড়েছে কাল রাতে। সিওর।

 কর্নেল আর কোনও কথা বললেন না। সল্টলেকে আমার বাড়ির কাছে পৌঁছে দেখি পুলিশের একটা জিপ দাঁড়িয়ে আছে। কর্নেল আমাকে গাড়ি দাঁড় করাতে বললেন।–তোমার গাড়ি গ্যারেজে রেখে শিগগির তৈরি হয়ে এস। দেরি কোরো না। আমি জিপে গিয়ে বসছি।

উত্তেজনায় অস্থির হয়ে উঠেছিলাম। একটা ছোট স্যুটকেসে পোশাক এবং দরকারি কিছু জিনিস ভরে নিয়ে কয়েকমিনিটের মধ্যে বেরিয়ে এলাম।

জিপের কাছে যেতেই ডি সি ডি ডি অরিজিৎ লাহিড়ি সম্ভাষণ করলেন– হ্যাল্লো সাংবাদিকমশাই! আপনার কাগজের জন্য অসাধারণ স্টোরি হবে। তাই না?

বললাম কী ব্যাপার মিঃ লাহিড়ি? আপনিও চোরডিহা যাবেন নাকি?

নাহ্ ব্রাদার! চোরডিহা আমার এলাকা নয়। আমি শুধু কলকাতা নিয়েই আছি। কলকাতা পুলিশের লোক। আপনাদের স্টেশনে পৌঁছে দিয়েই চলে আসব।

দেখলাম লাহিড়িসায়েব নিজেই ড্রাইভ করে এসেছেন। পেছনে জনাচার পুলিশ বসে আছে। কর্নেলের পাশে ঠাসাঠাসি করে বসলাম। জিপে স্টার্ট দিয়ে লাহিড়ি সায়েব বললেন-বুঝলেন জয়ন্তবাবু? আমার ধারণা, ইন্দ্রজিৎ রায়ের মুখ্য খুনীকে হাওড়া স্টেশনেই পাওয়া যাবে। তাকে ওখানেই অ্যারেস্ট করা। যেত। কিন্তু আপনার বৃদ্ধ বন্ধুর তাতে আপত্তি। উনি বলছেন, চোরডিহার জঙ্গলে বজরঙ্গবলীর মন্দিরেই তাকে ধরা হবে। সেখানে সে নাকি চোরের ওপর বাটপাড়ি করতে যাবে।

কর্নেল বললেন–হ্যাঁ। তার বড় স্যাঙাত পুলিশ হাজতে। সে ছটফট করছে, টাকা তারই বন্ধু যোগীন্দ্র ব্যাটাচ্ছেলে এই সুযোগে হাতিয়ে নেবে। এমন তো কথা ছিল না। টাকাটা তার হাতেই ফেরত আসার কথা ছিল। নিজেকে নিজেই কিডন্যাপ করে আমাদের চোখে ধুলো দিয়ে তখাকথিত চোরাইমুক্তো হাতানোর প্ল্যান যে এভাবে ভেস্তে যাবে, সে ভাবতেও পারেনি।

হাঁ করে শুনছিলাম। বললাম–নিজেই কিডন্যাপ! এর মানে?

–কিডন্যাপড কে হয়েছেন জয়ন্ত?

 –কেন? হরনাথবাবু!

কর্নেল হাসলেন। হরনাথ নিজেকে নিজেই কিডন্যাপ করেছিলেন। অবশ্য যোগীন্দ্র এবং গৌরেরা সাহায্যে করেছিলেন। চমৎকার কৌশল বলা চলে। কিন্তু মরিয়া হয়ে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে ফেঁসে গেছেন। জয়ন্ত, গতরাতে মেট্রো সিনেমার সামনে যাকে পাকড়াও করা হয়েছে, তিনি স্বয়ং হরনাথ চন্দ্র!

হতবাক হয়ে বসে রইলাম। কী বলব মাথায় এল না।

কর্নেল বললেন মিমির ছুঁড়ে ফেলা যে চিঠিটা তুমি কুড়িয়ে পেয়েছিলে, ওটা হরনাথেরই হাতের লেখা। চন্দ্র জুয়েলার্সে গিয়ে ওঁর হাতের লেখা মিলিয়ে নিয়েছি। তবে হরনাথ দশ লক্ষ ডলার দামের জুয়েলের লোভেই এত কাণ্ড করেছেন। আসল ব্যাপারটা উনিও জানতেন না…

.

ট্রেন ছেড়েছিল তিনঘণ্টা দেরিতে। তাই তত ভিড় ছিল না এই রাতের ট্রেনে। ফার্স্টক্লাস প্রায় ফাঁকাই ছিল। বর্ধমানে পৌঁছুলে ফার্স্ট ক্লাস কোচটা একেবারে সুনসান নিরিবিলি হয়ে গেল। আমার মনে খালি যোগীন্দ্র শর্মার জন্য আতঙ্ক আর অস্বস্তি। কর্নেল কিন্তু দিব্যি নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছিলেন। একটা কুপে শুধু আমরা দুজন। দরজা ভেতর থেকে আটকে দিয়েছিলাম। প্রতিমুহূর্তে আশঙ্কা করেছিলাম, যোগীন্দ্র বা তার লোকেরা এসে বদ্ধ দরজায় শব্দ করবে। তবে অন্য কেউ হলেও দরজা খুলব না সেটা ঠিক করেই ছিলাম।

কিন্তু আসানসোল পেরিয়ে যাওয়ার পরও কেউ দরজায় নক করল না। তারপর কখন ঘুমিয়ে গেছি কে জানে। ঘুম ভাঙল কর্নেলের ডাকে। জানালার বাইরে সকালের ঝলমলে রোদ। কর্নেল বললেন–চোরডিহা এসে গেল। তুমি কী হারালে জানো না জয়ন্ত!

চমকে উঠে বললাম কী?

কর্নেল হাসলেন।–পাহাড়ি সুড়ঙ্গ। কয়েকটা পাহাড়ের সুড়ঙ্গ পেরিয়ে এলাম আমরা। তা ছাড়া দুধারে বসন্তকালের ভোরবেলার বনের অলৌকিক সৌন্দর্যও তুমি মিস করেছ।

আমার বৃদ্ধ বন্ধু একজন প্রকৃতিবিদও। বুঝতে পারলাম পাহাড় জঙ্গলের আদিম প্রাকৃতিক পরিবেশ ওঁকে মাতিয়ে তুলেছে। এবার শুধু একটাই ভয়। দুর্লভ প্রজাতির পাখি-প্রজাপতি-অর্কিডের খোঁজে আমাকে ফেলে নিপাত্তা হয়ে না যান।

ট্রেনের গতি কমে এসেছিল। কুপ থেকে বেরিয়ে দরজায় দাঁড়ালাম আমরা। বললাম–যোগীন্দ্র শর্মা সম্ভবত আপনাকে দেখতে পেয়েছিল হাওড়া স্টেশনে। : তাই এ ট্রেনে আসেনি। এলে নিশ্চয় টের পেতাম।

কর্নেল আস্তে বললেন–যোগীন্দ্র চোরডিহারই লোক।

-বলেন কী!

–তার জীবনচরিত জেনে নিয়েছি। আসলে মুক্তিপণের টাকা চোরডিহার জঙ্গলে বজরঙ্গবলীর মন্দিরে পৌঁছে দেওয়ার কথা শুনেই আমার স্বভাবত সন্দেহ হয়েছিল। এটা তার সুপরিচিত জায়গা। তার এখানে লোকজনও থাকা সম্ভব। তাই সে হরনাথের সঙ্গে চক্রান্ত করার সময় এই জায়গাটাই সাজেস্ট করেছিল। হা হরনাথ একটু বোকামি করে ফেলেছিলেন ওর কথায়। ওর ফাঁদে পড়ে গেলেন।

–কিন্তু হরনাথ ওর ফাঁদে পড়তে গেলেন কেন? নিজেকে নিজে কিডন্যাপ করার কারণ কী?

–পুলিশের জেরায় হরনাথ কবুল করেছেন, ইন্দ্রজিতের সেই চিঠিটা হাতাতে যোগীন্দ্র ওঁকে এই ফিকির বাতলেছিল। বনানী তাকে চেনে। মুখে দাড়ি এঁটে এলেও দৈবাৎ যদি চিনতে পারে, তাই কিডন্যাপড হয়ে থাকাই মোক্ষম সুবিধা। বনানীর আপাতদৃষ্টে চেনা ঠেকলেও ধারণা হবে, যে লোকটা কিডন্যাপড হয়েছে, সে কী করে তার হাত থেকে চিঠি নেবে? তার চেয়ে বড় কথা, আমাকেও ধাপ্পা দেওয়া যাবে। আমিও ধরে নেব, হরনাথ সাতেপাঁচে নেই। আফটার অল, হরনাথই তো আমার শরণাপন্ন হয়েছিলেন।

প্ল্যাটফর্মে নেমে কর্নেল এদিক-ওদিক দেখে নিলেন। ভিড় ছিল। ভিড় ঠেলে স্টেশনের বাইরে গিয়ে উনি. একটা ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করলেন। বললেন– ফরেস্ট বাংলো।

টাউনশিপের বাইরে এবড়োখেবড়ো চড়াই-উৎরাই রাস্তায় ঘোড়ার গাড়ি ছাড়া কোনও যানবাহন মিলত না। নির্জন জঙ্গলের রাস্তা। দুধারে নানা গড়নের পাথর, টিলা আর ঘন জঙ্গল। বুঝলাম কর্নেল এর আগেও এখানে এসেছেন। চোখে বাইনোকুলার রেখে এদিক-ওদিক দেখছিলেন। কিন্তু আমার মনে দুর্ভাবনা, যে-কোনও মুহূর্তে যোগীন্দ্রের পাল্লায় পড়ব। দলবল নিয়েই হয় তো ঝাঁপিয়ে পড়বে।

তেমন কিছু ঘটল না। একটা টিলার গায়ে সুন্দর বাংলো দেখা যাচ্ছিল। বাংলোর গেটে আমরা নামলাম। ভাড়া ও বখশিস নিয়ে টাঙাওয়ালা সেলাম ঠুকে চলে গেল। তারপর দেখি, উর্দিপরা চৌকিদার ছুটে এসে একেবারে মিলিটারি স্যালুট ঠুকল। তার মুখে বিস্ময় ছিল।

কর্নিলসার! আপ? আইয়ে আইয়ে!

কর্নেল বললেন–কেমন আছ বৈজু?

সে একগাল হেসে বলল–ভাল আছি কর্নিলসার। তো কুছু খবর ভেজে তো আসবেন?

–কেন? ঘর খালি নেই?

জরুর আছে। সে কর্নেলের পাশেপাশে হন্তদন্ত হাঁটতে থাকল। খালি আছে কেননা যদি পুছ করেন, অনেক বুরি রাত কর্নিলসাব। বজরঙ্গবলীজির মন্দিরে কয়রোজ বজরঙ্গবলীজি দরশন দিচ্ছেন। বাপরে বাপ! বলে সে একটা অদ্ভুত গল্প শুনিয়ে দিল।

বজরঙ্গবলীজি মানে স্বয়ং হনুমানজি। প্রভু শ্রীরামচন্দ্রের সেবক। লম্বা চওড়া সাংঘাতিক চেহারা। ওখানে তার প্রথম দরশন পায় ফরেস্টগার্ডরা। তারপর পাশের নদীতে মাছ ধরতে যাওয়া জেলেরা। একজন কন্ট্রাক্টার কাঠ আনতে ট্রাক পাঠিয়েছিলেন। তার লোকজন দরশন পেয়ে পালিয়ে আসে। শেষে ট্রাকটা নদীতে উল্টে পড়ে থাকতে দেখা যায়। এখনও সাহস করে সেটা কন্ট্রাক্টর তুলে আনতে পারেননি। এলাকার সব বস্তি জুড়ে প্রচণ্ড আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। কেউ ভুলেও ওদিকে যাচ্ছে না। কে জানে কেন, হয় তো এতবছর মন্দির সংস্কার এবং পুজোআচ্চা না হওয়ায় হনুমানজি রুষ্ট হয়ে ফিরে এসেছেন। কিন্তু পুজো দিতে যেতেও কেউ ভরসা পাচ্ছে না। কাল বিকেলে কে নাকি সাহস করে পুজো দিতে গিয়েছিল। তাকে হনুমানজি দুহাতে তুলে আছাড় মেরেছেন। সে এখন হাসপাতালে আছে। কর্নিলসাব হাসপাতালে গেলেই সব খবর পেয়ে যাবেন।

বাংলোর দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের একটা ঘরে বসে বৈজুর মুখে এই অদ্ভুত কাহিনী শুনলাম। তারপর কর্নেল তাকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া কফি, কৌটোর দুধ, চিনি এসব দিলেন। সে শিগগির কফি করে আনল। আমরা কফি খেতে খেতে আরও সাংঘাতিক কিছু ঘটনা শুনলাম। অবিশ্বাসী কারা গত রাতে মন্দিরে বজরঙ্গবলীজিকে দেখতে গিয়েছিল। বড় বড় করে ঢিল পড়তে শুরু করে। তারা পালিয়ে আসে। বাহারকা আদমি। টাউনশিপে একটা হোটেলে উঠেছে। শুধু এটুকুই জানে বৈজু। কারণ সেই হোটেলের এক বেয়ারা তার ভাগ্নে।

কর্নেল হোটেলের নামটা জেনে নিলেন। তারপর বৈজুকে দুপুরের খাওয়ার জন্য জিনিসপত্র আনতে বাজারে পাঠালেন। সাইকেলে চেপে সে চলে গেল।

বললাম–ভারি অদ্ভুত ব্যাপার তো!

কর্নেল একটু হেসে বললেন–হ্যাঁ। অদ্ভুত তো বটেই। বোঝা যাচ্ছে, এ জন্যই কুঞ্জবাবু কথামতো টাকা রাখতে গিয়ে অসুবিধেয় পড়েছেন। পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন। যাই হোক, তুমি জিরিয়ে নাও। ট্রেনে ঘুম হয়নি। আমি ততক্ষণ প্রকৃতিদর্শন করে আসি। একটা কথা, দরজা আটকে রাখো। অচেনা কাকেও দরজা খুলল না।

–সাবধান কর্নেল! হনুমানজির পাল্লায় পড়বেন।

 কর্নেল হাসতে হাসতে ক্যামেরা, বাইনোকুলার আর প্রজাপতিধরা জাল নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। ট্রেনজার্নির ধকল সামলাতে আমি শুয়ে পড়াই উচিত মনে করলাম। দরজাটা অবশ্য আটকে দিতে ভুললাম না।

বজরঙ্গবলীর আবির্ভাব নিয়ে ভাবছিলাম। বৈজু তার চেহারার যে বর্ণনা দিল, তা কি সত্যি? নাকি নিছক রটনা? যোগীন্দ্র শর্মা টাকা নিতে না আসা পর্যন্ত কি এই রটনা চলবে?

আমি ভেবেই পেলাম না যোগীন্দ্রর দলবলের হাত থেকে অনাচার সাদা পোশাকের পুলিশ এবং কর্নেল কী ভাবে আত্মরক্ষা করবেন। ওরা পাথরের বা জঙ্গলের আড়াল থেকে গুলিও ছুঁড়তে পারে। আতঙ্কে আর ঘুম এল না। এলোমেলো চিন্তা পেয়ে বসল।

এখন স্পষ্ট বুঝতে পারছি, হরনাথ চোরাই মুক্তো কর্নেলের সাহায্যে উদ্ধার করে শেখসায়েবকে নিশ্চয় খুন করতেন। যোগীন্দ্রের সঙ্গে বখরা হত। তবে কেসটার বৈচিত্র্য আছে বলতে হবে। প্রসাদজি এবং যোগীন্দ্র প্রথমে জোট বেঁধেছিলেন। শেখসায়েব টের পেয়ে যান হরনাথের কাছে। ধূর্ত যোগীন্দ্র তখন জোট বাঁধেন হরনাথের সঙ্গে। তৃতীয় জোট ডঃ সুন্দরম এবং বনানীর। বিদেশী চর রবার্ট স্টিলার তাদের জোটের মূলে।

কিন্তু মিমির আচরণ বিস্ময়কর। সে ভালই জানে তার প্রেমিকও অন্যতম হত্যাকারী। শুধু কি প্রেমের খাতিরে সে মুখ বুজে ছিল, নাকি ভয়ে?

দুটো কারণই থাকা সম্ভব। পক্ষাঘাতগ্রস্ত বৃদ্ধ জ্যাঠামশাইয়ের বিপদ হোক, এটাও সে চায়নি। ইন্দ্রজিৎ চিরবাউণ্ডুলে এবং পরমেশ তাকে পছন্দ করতেন না। কিন্তু অভিজাত রক্তের প্রেসটিজ বলে কথা! তাঁরই বাড়িতে খুনখারাপি পরমেশের আঁতে ঘা দিয়েছিল। তাই কর্নেলের শরণাপন্ন হতে। চেয়েছিলেন।

ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। দরজায় কেউ কড়া নাড়ছে। অমনি উঠে বসলাম। কিটব্যাগ থেকে রিভলবার বের করে গুলি ভরে নিলাম। তারপর সাড়া দিলাম।–কে?

হালদারমশাইয়ের সাড়া পেয়ে অবাক হয়ে গেলাম।জয়ন্তবাবু! জয়ন্তবাবু! দরজা খোলেন!

উঠে দরজা খুলে দেখলাম, মাথায় আর একহাতে ব্যান্ডেজবাঁধা প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে কে হালদার হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন। বললেন–ডিসটার্ব করলাম! ঘুমাইতেছিলেন নাকি?

আসুন! আসুন! আপনার জন্যই কর্নেল ছুটে এসেছেন কলকাতা থেকে।

–হঃ! শুনলাম। বলে প্রাইভেট ডিটেকটিভ ঘরে ঢুকলেন। কর্নেলস্যার হসপিটালে গেছিলেন। আপনি ফরেস্টবাংলোয় আছে শুনলাম।

–আপনাকে নাকি বজরঙ্গবলীজি আছাড় মেরেছেন কাল বিকেলে? হালদারমশাই হি হি করে একচোট হাসলেন। তারপর বললেন–কেডা কইল? এক হালার ব্যাটারে মন্দিরে ফলো করছিলাম। স্লিপারি জায়গা! তারে ধরছি আর ধাক্কা দিচ্ছে আর আছাড় খাইয়া পড়ছি। নিজেই হসপিট্যালে যাইয়া ভর্তি হইছিলাম। এটুখানি চোট লাগছিল।

কুঞ্জবাবুর সঙ্গে দেখা হয়েছে?

হালদারমশাই জোরে মাথা নাড়লেন।নাহ। কেমন ভদ্রলোক বুঝি না। তবে কর্নেলস্যার যহন আইয়া পড়ছেন, সেই হালারে ধইর‍্যা ফেলব।

–কে সে?

বান্দরের মতন এইটুকখানি। তবে ভেরি ক্লেভার। পুলিশলাইফে অগো দেখছি। ছিঁচকে চোর যেমন হয়।

–ওকে ফলো করেছিলেন কেন?

–মন্দিরের কাছে ঘুরতাছিল হালা। আমারে দেইখ্যাই লুকাইয়া পড়ল। যাউক গিয়া! শুনলাম শ্যাখসায়েবের জুয়েল কর্নেলস্যার উদ্ধার করছেন। হরনাথবাবুর কথা জিগাইলাম। কইলেন, পরে সব জানতে পারব।

কর্নেল কোথায় গেলেন?

–জানি না। আপনি আইছেন শুইন্যা আইয়া পড়লাম। বলে প্রাইভেট ডিটেকটিভ প্যান্টের পকেট থেকে নস্যির কৌটো বের করলেন। নাকে নস্যি গুঁজে চেয়ারে হেলান দিলেন। তারপর হাই তুলে চোখ বুজলেন। জড়ানো গলায় বললেন–হসপিট্যালে ঘুম হয় নাই।

একটু পরে ওঁর ব্যান্ডেজ বাঁধা মাথা কাত হল এবং নাক ডাকতে থাকল।

কর্নেল ফিরলেন ঘণ্টাখানেক পরে। হালদারমশাইকে দেখে একটু হাসলেন। চাপা স্বরে বললেন–তত বেশি চোট লাগেনি। ইচ্ছে করেই হাসপাতালের বেডে ছিলেন। প্ল্যান ছিল, আজ সেই লোকটাকে ধরবেন।

বললাম কুঞ্জবাবুর সঙ্গে দেখা হল?

–হ্যাঁ। ওঁদের পুলিশের জিপে আসানসোল পাঠিয়ে দিলাম। সেখান থেকে ট্রেনে কলকাতা ফিরে যাবেন।

–সে কী! যোগীন্দ্রকে তাহলে কী ভাবে ধরবেন?

–যোগীন্দ্র শর্মা বজরঙ্গবলীর থানে যাবেই। টাকার লোভ ভীষণ লোভ। তার ধারণা, দাদাঅন্তপ্রাণ কুঞ্জবাবু টাকা থানে রাখবেনই। এক মিনিট! বৈজুকে খবর দিই একজন গেস্ট আছেন।

কর্নেল বেরিয়ে গেলেন। ডাকলাম–হালদারমশাই!

প্রাইভেট ডিটেকটিভ তড়াক করে সোজা হয়ে বসে বললেন–হালার বান্দর!

–হালদারমশাই, বাথরুমে গিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলুন।

–অ্যাঁঃ? বলে হেসে উঠলেন হালদারমশাই।–কী কাণ্ড! স্বপ্ন দেখছিলাম।

–সেই লোকটার?

–হঃ!…

 দুপুরের খাওয়ার পর বারান্দায় বসে আমরা গল্প করছিলাম।

হালদারমশাইই বেশি কথা বলছিলেন। কীভাবে হরনাথবাবু কিডন্যাপড হয়েছেন, সেই ঘটনা সবিস্তারে শোনালেন। কর্নেল মাঝেমাঝে বাইনোকুলার খুলে দূরের দৃশ্য কিংবা পাখি-টাখি দেখছিলেন।

একসময় জিজ্ঞেস করলাম বজরঙ্গবলীজির মন্দির কোনদিকে? হালদারমশাই তার লম্বা তর্জনী তুলে দক্ষিণ পশ্চিম কোণে ঘন জঙ্গল দেখিয়ে দিলেন। বললেন…তা প্রায় মাইল দুইয়ের বেশি। বললাম- কর্নেল! আপনি নিশ্চয় বাইনোকুলারে দেখতে পাচ্ছেন? কর্নেল বাইনোকুলারে চোখ রেখেই হাসলেন।–পাচ্ছি। পুরনো আমলের একটা কেল্লার ধ্বংসস্তূপে জঙ্গলটা গজিয়েছে। কোনও সামন্তরাজারই কেল্লা ওটা। গত মার্চে ওখানে একটা আশ্চর্য অর্কিড দেখেছিলাম। এখনও থাকা উচিত। খুব উঁচু জায়গা বলে সংগ্রহ করতে পারিনি।

–অর্কিডটা কি বাইনোকুলারে এখন দেখতে পাচ্ছেন?

 –হুঁ। এবং যোগীন্দ্র শর্মাকেও।

 হালদারমশাই চমকে উঠলেন। কী কইলেন কর্নেল স্যার?

–যোগীন্দ্র শর্মা। না হালদারমশাই, ওর যে লোকটা আপনাকে ধাক্কা মেরেছিল, সে সঙ্গে নেই।

যোগীন্দ্র শর্মা? কেডা সে?

 –যে হরনাথবাবুকে কিডন্যাপ করেছিল।

 হালদারমশাই লাফিয়ে উঠলেন।–হালারে এখনই গিয়া ধরব।

কর্নেল বাইনোকুলার নামিয়ে বললেন–যথাসময়ে আমরা বেরুব। ব্যস্ত হবেন না। চোরডিহার পুলিশ আসুক। পুলিশই যোগীন্দ্রকে আইনত অ্যারেস্ট করতে পারে। আমরা কে!

বললাম–এখনই চলে গেছে যোগীন্দ্র?

–তাই তো দেখছি। আগে থেকে ওত পাততে গেছে। অসম্ভব ধূর্ত লোক। কাজেই পুরো কেল্লাবাড়ির জঙ্গল না ঘিরে ফেললে ওকে ধরা যাবে না।

–বোঝা যাচ্ছে, হনুমানজির আবির্ভাবের ঘটনা তার চেলাদের দিয়ে রটিয়ে রেখেছে।

–ঠিক ধরেছ।

সময় কাটছিল না। বিকেলে পুলিশের জিপ এল। একজন অফিসার এসে কর্নেলের সঙ্গে আড়ালে কী সব পরামর্শ করে চলে গেলেন। তারপর বৈজু কফি নিয়ে এসে ভয়ে ভয়ে জানতে চাইল, কোনও খতরনাক ঘটেছে কি না। কর্নেল তাকে আশ্বাস দিয়ে বললেন, নাহ। খতরনাক ঘটলেও তার চিন্তার কারণ নেই।

পাহাড়ের আড়ালে সূর্য নেমে গেলে নীচের উপত্যকায় ধূসরতা ঘন হতে থাকল। তখন কর্নেল উঠলেন।–এস জয়ন্ত! হালদারমশাই কি যেতে চান? আপনি তো এখনও সুস্থ হননি।

–কী যে কন কর্নেলস্যার! বলে প্রাইভেট ডিটেকটিভ উঠে দাঁড়ালেন। এমন ড্রামাটিক মোমেন্টে আমি প্রেজেন্ট থাকব না?

আমরা বাংলোর উল্টোদিকের গেট দিয়ে ঢাল বেয়ে নেমে গেলাম। তারপর কর্নেলকে ঝোপ-জঙ্গল পাথরের ভেতর দিয়ে অনুসরণ করলাম। কিছুক্ষণ পরে একটা ছোট্ট নদীর আঁকে গিয়ে কর্নেল বললেন–সাবধান! ঝোপের কিংবা পাথরের আড়ালে গুঁড়ি মেরে এগোতে হবে। লোকটার হাতে ফায়ার আর্মস থাকতে পারে।

নদীর ধারে কেল্লাবাড়ির ধ্বংসস্তূপ আবছা আঁধারে কালো হয়ে দেখা যাচ্ছিল। একটু পরে সামনে ফাঁকা জায়গা এবং একটা ভাঙা মন্দিরের উঁচু চত্বর অস্পষ্ট ভেসে উঠল। কর্নেল আমাদের চুপচাপ বসে থাকতে বলে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে গেলেন। তারপর আর তাকে দেখতে পেলাম না।

ক্রমশ আঁধার ঘন হচ্ছিল। এক সময় হঠাৎ টর্চের আলো জ্বলে উঠল। কেউ পায়ের কাছে আলো ফেলে চত্বরে উঠে গেল। তারপর দেখি, সে একটা ব্রিফ কেস চত্বরে রেখে নেমে এল এবং বেমক্কা হিন্দি ফিল্মের গান গাইতে গাইতে ওপাশে উধাও হয়ে গেল।

কী ব্যাপার বোঝা যাচ্ছিল না। একটু পরে চত্বরের ওপর আবার টর্চের আলো জ্বলে উঠল। কেউ এগিয়ে এসে ব্রিফকেসটার কাছে বসল। আলোটা সে জ্বেলে রেখেছে। তাই দেখতে পেলাম, সে বিফকেসটা খুলে ফেলল। খুলেই সে চাপা গর্জন করল–শালে ধোঁকেবাজ! তারপর আছাড় মেরে ফেলে দিল ব্রিফকেসটা।

এতক্ষণে কর্নেলের সাড়া পেলাম। যোগীন্দ্র শর্মা! হ্যান্ডস আপ! য়ু আর সারাউন্ডেড।

অমনি আলো নিভে গেল এবং গুলির শব্দ হল কয়েকবার। তারপর চারদিক থেকে টর্চের আলো ঝলকে ঝলকে এসে ছড়িয়ে পড়ল। যোগীন্দ্র শর্মার রিভলবারের গুলি শেষ হয়ে গেল বোঝা গেল। সে দুহাত তুলে ভাঙা গলায় আর্তনাদ করে উঠল–আই সারেন্ডার! হালদারমশাই বেরিয়ে গিয়ে চিৎকার করলেন–হেই বান্দরটা কৈ গেল? পুলিশ যোগীন্দ্র শর্মাকে ততক্ষণে ধরে ফেলেছে। কর্নেল হালদারমশাইকে বললেন–আপনাকে যে ধাক্কা দিয়েছিল, তাকে পুলিশ খুঁজে বের করবে হালদারমশাই! চলুন, বাংলোয় ফেরা যাক।…

.

উপসংহার

পরদিন বিকেল নাগাদ আমরা কলকাতায় ফিরে এলাম। হালদারমশাই তার ডেরায় চলে গেলেন। কর্নেল আমাকে বাড়ি ফিরতে বললেও সঙ্গ ছাড়তাম না। ইরাকের গোপন রাসায়নিক অস্ত্র কারখানার ম্যাপটা দেখার তীব্র ইচ্ছা ছিল।

অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছে কর্নেল তার প্রিয় পরিচারক ষষ্ঠীচরণের কাছে জানতে চাইলেন, কেউ এসেছিল বা ফোন করেছিল কি না। ষষ্ঠীচরণ বলল–কেউ আসেনি বাবামশাই। তবে একজন ফোং করেছিল বটে।

নাম বলেনি?

ষষ্ঠী তার স্বভাবমতো কান চুলকে বলল–কি বলল যেন। পেটে আসছে মুখে আসছে না।

–পুরুষ না মহিলা?

আজ্ঞে, মেয়েছেলে। আমি বললাম, বাবামশাই বেইরেছেন।

কর্নেল কপট চোখ কটমটিয়ে বললেন–কফি। শিগগির!

সে বেজার মুখে চলে গেল। বললাম-বনানী ছাড়া আর কে ফোন করবে? কর্নেল ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন–অর্থলোভ সবচেয়ে সাংঘাতিক লোভ। জানি না রবার্ট স্টিলার নামে এক বিদেশি এজেন্ট ওদের ঠিক কত টাকা দিতে চেয়েছে। তবে টাকার অঙ্কটা খুব বেশি হওয়াই উচিত।

একটু হেসে বললাম–এবার আপনার সামনে বড় সুযোগ। নাহ্ বস্! আমি কমিশন দাবি করব না। কারণ আমি চাই অমন একটা মানবতাবিরোধী ভয়ংকর অস্ত্রকারখানা, ধ্বংস হয়ে যাক।

কর্নেলও হাসলেন।–ঠিক বলেছ ডার্লিং! মানবতাবিরোধী কথাটা অসাধারণ। কাজেই ওই গুপ্তচর আমার কাছে এলে আমি ওটা তাকে বিনিপয়সায় দান করতে রাজি।

উৎসাহ দেখিয়ে বললাম–তা হোটেল কন্টিনেন্টালে ওকে ফোন করুন।

করব। কফি খেয়ে চাঙ্গা হয়ে নিই।

 ষষ্ঠী কফি আনতে দেরি করল না। কফি খাওয়ার পর কর্নেল টেলিফোন তুলে ডায়াল করলেন। একটু পরে বললেন–সুইট নাম্বার টু জিরো ফোর। রবার্ট স্টিলার।…কী? চেক আউট করেছেন? কখন?…ঠিক আছে।

ফোন নামিয়ে কর্নেল বললেন–গুপ্তচররা বেশি সময় এক জায়গায় থাকে না।

 বললাম–ইস! কী চান্সটা ও মিস করল!

–হয়তো আমাকে বিশ্বাস করতে পারেনি। ভেবেছে ওকে ধরিয়ে দেব এবং ম্যাপটা আমি ভারত সরকারের হাতে তুলে দেব। সরকার এই কার্ড পেলে বিশ্বব্যাঙ্ক আই এম এফ থেকে প্রচুর ঋণ আদায় করতে পারবেন।

এই সময় টেলিফোন বাজল। কর্নেল সাড়া দিয়ে চললেন–হ্যাঁ…কী ব্যাপার মিমি?…হ্যাঁ, বাইরে গিয়েছিলাম। এইমাত্র ফিরেছি।…হ্যাঁ, দাও জ্যাঠামশাইকে। …বলুন পরমেশবাবু।…গৌরকে অ্যারেস্ট করেছে? ভাল খবর।…বুঝেছি। আপনার। আগ্রহ স্বাভাবিক।…ঠিক ধরেছেন। জুয়েলস উদ্ধার করেছি।…দেখতে চান?…হাঃ হাঃ হাঃ। রহস্য কী ভাবে ফাস হল?…ঠিক আছে। যাচ্ছি। মুখোমুখি সব শুনবেন। ছাড়ছি।

কর্নেল টেলিফোন রেখে সহাস্যে বললেন–চলো জয়ন্ত! পরমেশ রায়চৌধুরি আমার মক্কেল। কাজেই তাকে আগাগোড়া সবটা জানানো দরকার।

বললাম–ম্যাপটা তাকে দেখাবেন নাকি?

–দেখানো উচিত। তা না হলে ভাববেন ওঁর ভাইপোর মুক্তোগুলো আমি মেরে দেবার তালে আছে। ওঁকে জানানো উচিত, ইন্দ্রজিৎ মুক্তো চুরি করে আনেনি। এনেছিল একটা ম্যাপ।

–কিন্তু কর্নেল, সঙ্গে এটা নিয়ে বেরুনো ঠিক হবে কি? ছবিটা হাতে বা কিটব্যাগে করে নিয়ে বেরুলে যদি ছিনতাই হয়ে যায়। রবার্ট স্টিলারের গুণ্ডারা ওত পেতে থাকতে পারে।

কর্নেল হাসলেন।–ম্যাপটা ভাঁজ করা আছে। পকেট থেকে কেউ ছিনতাই করতে এলে তারই বিপদ। আমাকে ধরাশায়ী করা সহজ হবে না। তাছাড়া তুমি সঙ্গে আছ। ফায়ার আর্মস রেডি থাকছে।

উনি ঢুকে গেলেন। আমি রিভলভারটা রেডি করে পকেটে রাখলাম। একটু পরে কর্নেল বেরিয়ে এসে বললেন–চলো! একটা ট্যাক্সি করে নেব।

বরাবর দেখে আসছি, কর্নেলের পাদ্রিবাবার মতো অমায়িক চেহারার জন্য হোক বা যে কারণেই হোক, ট্যাক্সিড্রাইভাররা ওঁকে না করতে পারে না। তা না হলে এই ভরসন্ধ্যার পিক আওয়ারে ট্যাক্সি পাওয়া অসম্ভব ছিল।

শর্টকাটে যেতে ট্যাক্সিড্রাইভার আপত্তি করল না। তাকে ভাড়া এবং টিপস দিয়ে খুশি করে কর্নেল গলিরাস্তায় এগিয়ে গেলেন। তাঁর দেহরক্ষীর মতো চারদিকে লক্ষ্য রেখে অনুসরণ করলাম।

মধু আমাদের অপেক্ষা করছিল। গেট খুলে একগাল হেসে বলল–গৌরকে আজ ভোরবেলা পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে স্যার! ওর সাগরেদরা ভয়ে পাড়া থেকে পালিয়েছে। পাড়ার লোকে খুব খুশি। জঙ্গুলে লনে হাঁটতে হাঁটতে সে ফের চাপা স্বরে বলল–আজও দুপুরবেলায় সেই সায়েব এসেছিলেন। কর্তামশাই কিছুতেই দেখা করবেন না। সায়েবের এক কথা, জরুরি দরকার আছে। বুঝিয়ে বলো। শেষে মিমিদিদি গিয়ে রাজি করালেন। সায়েবকে নিয়ে গেলাম।

কর্নেল বললেন–তারপর?

–খানিক পরে সায়েব বেরিয়ে গেলেন। বললাম–লোকটা ধরেই নিয়েছে এ বাড়িতেই কোথাও ইন্দ্রজিৎ জিনিসটা লুকিয়ে রেখেছে। তাই আবার লোভ দেখাতে এসেছিল। কর্নেল কোনও মন্তব্য করলেন না। মধু আমাদের ওপরে পৌঁছে দিয়ে চলে গেল। কর্নেলকে দেখে পরমেশ খুশিমুখে বললেন–আসুন! আসুন! গৌর হারামজাদাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। থানায় ফোন করে শুনলাম, ওর খুনে সাগরেদরাও ধরা পড়েছে। কিন্তু স্পষ্ট করে কিছু বলল না। বলে হাঁক দিলেন মিমি! আলো জ্বেলে দে। আর কর্নেল সায়েবের জন্য কফি নিয়ে আয়।

মিমিকে বিবর্ণ পুতুল দেখাচ্ছিল। সে চুপচাপ সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দিল। তারপর কফি করতেই যাচ্ছিল। কর্নেল বললেন–এখন নয় মিমি! একটু পরে কফি খাব। এইমাত্র খেয়ে বেরিয়েছি। তুমি বসো।

পরমেশ উজ্জ্বল মুখে বললেন–জুয়েল উদ্ধার কোথায় করলেন?

বনানীদের ঘরে।

–অ্যাঁ! ওই মেয়েটার কাছে রেখে গিয়েছিল ইন্দ্র? নির্বোধ কোথাকার। কৈ, দেখি! দেখি!

–দেখাচ্ছি। তো আজও নাকি রবার্ট স্টিলার এসেছিলেন?

 পরমেশ বিকৃত মুখে বললেন–হ্যাঁ। টাকার লোভ দেখাচ্ছিল। লোভ কি বলছি! ব্যাগভর্তি একশো টাকার নোটের বান্ডিল। শেষে বলে, ব্যাটা নিজেই বাড়ি খুঁজে দেখবে, যদি অনুমতি দিই।

মিমি কিছু বলতে ঠোঁট ফাঁক করেছিল। বলল না। কর্নেল বললেন–যাই হোক। আগাগোড়া ঘটনাটা আপনি জানতে চেয়েছেন। বলি শুনুন।

পরমেশ বললেন–বলুন! শোনা যাক।

কর্নেল ইন্দ্রজিতের পালিয়ে আসার আগে থেকে শুরু করলেন। এই কাহিনীর সবটাই আমার জানা। দীর্ঘ কাহিনীর ফাঁকে ফাঁকে পরমেশ মন্তব্য করে যাচ্ছিলেন নানারকম। হত্যাকাণ্ডের রাতে মিমির গৌরকে দরজা খুলে দেওয়া বা এই কাহিনীতে তার ভূমিকাটা সাবধানে এড়িয়ে গেলেন কর্নেল। তারপর চোরডিহাপর্ব শেষ করে বললেন–আপনি জুয়েলস দেখতে চেয়েছেন। কিন্তু পরমেশবাবু, ইন্দ্রজিৎ বাহারিন থেকে মুক্তো চুরি করে আনেনি। চোরাই মুক্তো আসলে একটা ম্যাপ!

পরমেশ চমকে উঠলেন।–ম্যাপ! কিসের ম্যাপ?

–ইরাকের গোপন রাসায়নিক অস্ত্রকারখানার।

কী সর্বনাশ! বনানীদের বাড়িতে ওটা লুকোনো ছিল?

–একটা মরুভূমির বাঁধানো ছবির পেছনে।

পরমেশ গুম হয়ে বললেন–হুঁ। এবার কফি খান। মিমি! শিগগির কফি করে আন। আমার মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। এ যে গোয়েন্দা উপন্যাসের চেয়ে রোমাঞ্চকর। কল্পনা করা যায় না। মিমি বেরিয়ে গেল কফি করতে। একটু পরে পরমেশ শ্বাস ছেড়ে বললেন–ম্যাপটা কী করবেন ভাবছেন?

কর্নেল বললেন–আমাদের গভর্নমেন্টের হাতে তুলে দেব ভাবছি। পরমেশ একটু হেসে বললেন–ঠিক বলেছেন। ওসব সাংঘাতিক ব্যাপার গভর্নমেন্টের হাতে তুলে দেওয়াই উচিত। তা ম্যাপটা কি আপনার কাছে আছে? আমার দেখতে আগ্রহ হচ্ছে।

কর্নেল ভেতর পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা বেরঙা কাগজ বের করে খুললেন। আমিও ঝুঁকে পড়লাম। সাধারণ কাগজে আঁকা কিছু রেখা আর বিন্দু। কর্নেল বললেন–আরবি লেটারে সাংকেতিক কী সব লেখা আছে।

পরমেশের একটা হাত পক্ষাঘাতগ্রস্ত। অন্য হাত বাড়িয়ে বললেন–দেখি। একসময় আমি লখনৌতে ছিলাম কিছুদিন। এক বন্ধুর কাছে উর্দু শেখার চেষ্টা করেছিলাম। উর্দু লেটার নাকি আরবি। দেখি পড়তে পারি নাকি।

কর্নেলের হাত থেকে ছোট্ট ম্যাপটা উনি নিলেন। তারপর টেবিলে চাপা রেখে টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে দিলেন। ঝুঁকে পড়লেন ম্যাপের ওপর। বিড়বিড় করে কী দুর্বোধ্য শব্দ আওড়াতে থাকলেন। শেষে বললেন–অক্ষাংশ। দ্রাঘিমাংশ মনে হচ্ছে। আমি লেটার একটু আধটু চিনলেও সংখ্যা চিনি না। এই রেখাটা সম্ভবত নদী। আর এই রেখাটা পাহাড়।

এই সময় মিমি কফির ট্রে এনে টেবিলের একপাশে রাখল। সে কর্নেল এবং আমার হাতে কফির পেয়ালা তুলে দিল। পরমেশকে সে কফির পেয়ালা দিতে যাচ্ছে, তখন পরমেশ ম্যাপের ওপর ঝুঁকে ছিলেন। মিমি বলল– জ্যাঠামশাই! কফি!

–হুঁ। দে। বলে ম্যাপে দৃষ্টি রেখে পরমেশ হাত বাড়ালেন।

এইসময় আচমকা ঘটনাটা ঘটে গেল।

মিমি কফির পেয়ালা পরমেশের হাতে দিয়েছিল ঠিকই। কিন্তু একমুহূর্তের ব্যবধান ছিল কফি দেওয়া এবং নেওয়ার মধ্যে। কফির পেয়ালাটা উল্টে পড়ে গেল ম্যাপের ওপর। পরমেশ চিৎকার করলেন–ওই যাঃ!

আমিও হাঁ হাঁ করে উঠেছিলাম। ম্যাপটা ভিজে কালি ধেবড়ে গেছে। এবং পুরোটাই নষ্ট হয়ে গেছে। ঘুরে দেখলাম কর্নেল নিস্পলক চোখে তাকিয়ে আছেন।

পরমেশ রুষ্ট মুখে বললেন–আমার এই হাতটা! হাতটা প্রায় স্লিপ করে। দুঃখিত। এই হাতটা আর কেন আছে? অন্যটার মতো এটাও শেষ হয়ে যাওয়া। উচিত। হারামজাদা শুওরের বাচ্চা হাত! একটা মাত্র হাত!

মিমি দ্রুত চলে গেল ঘর থেকে।

কর্নেল কফির পেয়ালা মেঝেয় রেখে তেমনি নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে বললেন–পরমেশবাবু! রবার্ট স্টিলার কত টাকা দিয়ে গেছে আপনাকে?

–এ কী বলছেন আপনি? পরমেশ নড়ে বসলেন।–এটা একটা অ্যাকসিডেন্ট ছাড়া কিছু নয়।

কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। আমাকে এতদিনে সত্যিই বাহাত্তুরে ধরেছে তাই এই ফঁদে পড়ে হার মানতে হল। জীবনে এই প্রথম হার। আপনার ওই একটা হাতের প্যাঁচে আমি জব্দ হয়ে গেলাম।

–আপনি কী বলছেন বুঝতে পারছি না!

–পারছেন পরমেশবাবু। রবার্ট স্টিলার আপনার ওই একটামাত্র হাতকে কাজে লাগিয়ে গেছে। আজ সে এসেছিল শুধু এই উদ্দেশ্যই। সে যা-যা বলেছিল, আপনি ঠিক তা-ই করেছেন। ডেলিবারেট প্ল্যান।

এবার পরমেশ বাঁকা হাসলেন। কিন্তু আপনি ভুলে যাচ্ছেন। ইন্দ্র আমার ভাইয়ের ছেলে। ম্যাপটা তাই আমার। ওটা নিয়ে যা খুশি করতে পারি।

কর্নেল বেরিয়ে গেলেন। ওঁকে অনুসরণ করলাম। সিঁড়িতে নামার সময় বললাম–আমি কিছু বুঝতে পারছি না কর্নেল।

কর্নেল প্রায় চাপা গর্জন করলেন।–ইউ ফুল! বুঝতে পারছ না রবার্ট স্টিলার একজন ডাবল এজেন্ট? ম্যাপটা যেভাবে হোক হাতাতে কিংবা প্রয়োজনে নষ্ট করে ফেলার জন্যই সে কলকাতায়? ড়ি দিয়েছিল। ম্যাপটা পেলে সে মার্কিন জোটকে বেচে প্রচুর টাকাকড়ি পেত। আবার নষ্ট করে দেওয়ার জন্যও সে ইরাকের কাছে প্রচুর টাকাকড়ি পাবে। ডাবল এজেন্টরা, এরকমই করে। সন্ধ্যার প্রায়ান্ধকার গলিরাস্তায় আমরা দুজনে চুপচাপ হেঁটে গেলাম। সত্যি তো! ইন্দ্রজিতের চুরি করে আনা ম্যাপটা নিয়ে তার জ্যাঠামশাই যা খুশি করতেই পারেন। আইনতই পারেন। আমরা কিছু বলার কে?…