৪. লেখা চিঠি খুঁজতে

চোর কি ইন্দ্রজিৎকে লেখা চিঠি খুঁজতে এসেছিল? আমার মাথায় এই প্রশ্নটা রহস্যের জাল বুনছিল। কিন্তু পরমেশ, মিমি এবং মধুর কাছে জানা গেল, এ বাড়িতে নাকি প্রায়ই চোর ঢোকে। হানাবাড়ির মতো বাড়ি। পিছনে বস্তি এলাকা। চোরেদের উৎপাত স্বাভাবিক। তাছাড়া গা ঢাকা দেওয়ার মতো আড়ালও প্রচুর।

তবে মধু খুব কড়া নজরদার। অন্তত যতক্ষণ তার ঘুম আসে না, ততক্ষণ তো বটেই। শুধু একটাই সমস্যা। মধু ঘুমিয়ে পড়লেই একেবারে মড়া হয়ে যায়। পরমেশের মতে, সে নির্ঘাৎ গাঁজা গুলি বা আফিং ধরেছে ইদানীং। কারণ আগে মধুর ঘুম এমন গাঢ় ছিল না।

ইতিমধ্যে পাড়ার ছেলেরা এসে ডাকাডাকি করছিল মিমিদিকে। মর্গে ইন্দ্রজিতের লাশ ডেলিভারি দেবে সন্ধ্যা সাতটায়। মিমি তাদের সঙ্গে মধুকে পাঠিয়ে দিল। পরমেশ খাপ্পা হয়ে বললেন–ইন্দ্রটা মরেও আমাকে জ্বালাচ্ছে। মর্গ থেকে লাশ আনো। শ্মশানে যাও। মিমি! গেটে তালা এঁটে দিয়েছিস তো?

কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন।–চলি পরমেশবাবু!

পরমেশ বললেন–হ্যাঁ। আপনাকে আর কষ্ট দিতে চাইনে। আমার শরীরও কেমন করছে। কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকব।

মিমি গেটের তালা খুলতে নীচে নামল। বলল–জ্যাঠামশাই পাড়ার কারও সঙ্গে মেশেন না। তাই আমাকেই সবার সঙ্গে ভাব রেখে চলতে হয়। ক্লাবের ছেলেদের আমি হাতে রেখেছি। আপদে-বিপদে তারাই ছুটে আসে। তারা না। থাকলে কী হত ভাবুন। ইন্দ্রদার বডি মর্গ থেকে ডেলিভারি নেওয়া, শ্মশানে যাওয়া–জ্যাঠামশাই তো এসব কথা ভাবেন না।

আমাদের গাড়ি গেট দিয়ে বেরুনোর সময় দেখলাম, গেটের পাশে দাঁড়িয়ে এক যুবক সিগারেট টানছে। সে ডাকল–মিমি!

মিমি বলল–গৌরদা, তুমি ওদের সঙ্গে যাওনি?

সে কী বলল শোনা গেল না। বড় রাস্তায় পৌঁছে বললাম–মিমির প্রেমিক। বাজি রেখে বলতে পারি।

বৃদ্ধ রহস্যভেদী শুধু বললেন–হুঁ।

রাস্তায় যেতে যেতে সেই চিঠিটা খুঁজে দিলাম কর্নেলের হাতে। ড্যাশবোর্ডের আলোয় চিঠিটা পড়ে উনি সহাস্যে বললেনবাঃ! তুমি একজন খাঁটি গোয়েন্দার কাজ করেছ, ডার্লিং! সত্যি বলতে কি, এই ধরনের কোনও ক্লু খুঁজতেই আমি এসেছিলাম। কিন্তু আমার ধারণা ছিল, এই অর্কিডটার কাছেই তেমন কিছু পেয়ে যাব। বলে যত্নে হাতে রাখা ম্রিয়মান অর্কিডটা তুলে ধরলেন। একটু অবাক হয়ে বললাম–আপনি জানতেন এমন একটা চিঠি….

বাধা দিয়ে কর্নেল বললেন–চিঠি বলিনি। কোনও ক্লু।

–কিসের ক্লু?

–ইন্দ্রজিতের সঙ্গে কারও নৈশ অ্যাপয়েন্টমেন্টের। যাই হোক, তুমি এটা কোথায় পেলে?

–যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তার কাছেই একটা করবী ঝোপের তলায়। আসলে দলাপাকানো টাটকা কাগজ দেখেই একটু কৌতূহল হয়েছিল।

নিশ্চয় ভেবেছিলে মিমিকে লেখা কারও প্রেমপত্র?

কর্নেল হা হা করে হাসলেন।

বললাম–আমি মোটেও প্রেমপত্রের কথা ভাবিনি। কিন্তু আপনি এই অর্কিডের কাছে এমন কিছু থাকার কথা কেন ভেবেছিলেন?

কর্নেল হঠাৎ গুম হয়ে গেলেন। একটু পরে বললেন–জানি না। বরাবর আমার এটা হয়। কোনও রহস্যময় ঘটনার পর কোথাও অর্কিড বা ক্যাকটাস দেখতে পেলেই মনে হয়, ওরা আমাকে কোনও ক্লু দেবে। দেয়ও। আসলে। আমার প্রতিপক্ষ কিংবা কোনও গুপ্ত হিতৈষী আমার এই স্বভাবটা জানে। জানে আমি অর্কিড় বা ক্যাকটাস দেখলেই সেখানে ছুটে যাব। তবে মজাটা হল, প্রতিপক্ষ কু দেয় ভুলপথে ছোটাতে। আর গুপ্ত হিতৈষী দেয় সঠিক পথের। খোঁজ। শুধু বুঝতে পারছি না, এ ক্ষেত্রে তোমার চোখে পড়ার মতো জায়গায় ক্লু রাখল কেন?

-কী আশ্চর্য! কেউ কি জানত আমি ঠিক ওখানেই দাঁড়াব?

কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট জ্বেলে বললেন–জানত না। জেনেছিল।

–উঃ! বড্ড হেঁয়ালি করছেন বস্!

 তুমি ভুলে যাচ্ছ, ও বাড়িতে তারপরই মধু সো-কল্ড চোর দেখতে পেল।

–মাই গুডনেস! তার মানে আপনি বলতে চাইছেন আমাকে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই লোকটা আড়াল থেকে এই চিঠিটা ছুঁড়ে ফেলেছিল?

–আপাতদৃষ্টে তা-ই মনে হচ্ছে।

–কিন্তু আমি একটুও শব্দ শুনিনি। দলাপাকানো কাগজ পড়ারও একটা শব্দ হবে।

–বাতাস বইছিল। গাছপালায় শব্দ হচ্ছিল। তাই শুনতে পাওনি।

চুপ করে গেলাম। আমি কী বোকা! তখন যদি একটু নজর রাখতাম চারদিকে! কিছুক্ষণ পরে কর্নেলের বাড়ির লনে পৌঁছে বললাম–লোকটা আপনার স্বয়ং প্রতিপক্ষ না গুপ্ত হিতৈষী, কর্নেল?

কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন–এখনও জানি না।

তিনতলার অ্যাপার্টমেন্টে ডোরবেলের সুইচ টেপার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ষষ্ঠীচরণ দরজা খুলে চাপা গলায় বলল–এক ভদ্রলোক এয়েছেন। আপনি যাওয়ার পর নালবাজারের নাহিড়িসায়েব ফোং করে বললেন, এক ভদ্রলোক যাচ্ছেন। আপনি না আসা অব্দি যেন বসিয়ে রাখি।

ষষ্ঠী ডি সি ডি ডি অরিজিৎ লাহিড়িকে নালবাজারের নাহিড়িসায়েব এবং ফোনকে ফোং বলা আজও ছাড়তে পারেনি। কর্নেল চোখ কটমট করে বললেন কফি।

–দিয়েছি বাবামশাই।

আবার দে।

 ষষ্ঠী বেজার মুখে কিচেনের দিকে চলে গেল। ড্রয়িংরুমে ঢুকে দেখলাম, গোবেচারা চেহারা কিন্তু ধোপদুরস্ত পোশাকপরা মধ্যবয়সী এক ভদ্রলোক বসে আছেন। কর্নেলকে দেখে তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বিনীতভাবে নমস্কার করলেন। বললেন-ডি সি ডি ডি লাহিড়ি সায়েব আপনার কাছে আসতে বলেছেন।

কর্নেল বললেন–বসুন। আসছি।

অর্কিডটা নিয়ে উনি অদৃশ্য হলেন। বুঝলাম ছাদের বাগান শূন্যোদ্যানে ওটার পুনরুজ্জীবনের ব্যবস্থা করতে গেলেন।

ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন–আপনি কি কর্নেল সায়েবের অ্যাসিস্ট্যান্ট?

মনে মনে চটে বললামনা। আমার নাম জয়ন্ত চৌধুরি। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার সাংবাদিক।

ভদ্রলোক নমস্কার করে বললেন কী সৌভাগ্য! কী সৌভাগ্য!

অবাক হয়ে বললাম–কেন বলুন তো?

–আমি সত্যসেবক পত্রিকার ফ্যান স্যার! আপনার লেখা গালফ ওয়রের রিপোর্টওঃ! অনবদ্য!

–গালফ ওয়রের একটা রিপোর্টই আমি লিখেছিলাম। ইন্দ্রজিৎ রায়কে নিয়ে–

–সেইটের কথাই বলছি স্যার! মানে, আমাদের আবার ওই এরিয়ায় কারবার কি না। তাই কী দুর্ভাবনায় না কাটিয়েছি। তবে যাই বলুন স্যার, বুশ মুখের মতো জবাব দিয়েছেন সাদ্দামকে। নাকে ঝামা ঘষে দেওয়া ওকেই বলে।

–আপনার পরিচয় এখনও পাইনি।

সরি! মাথার ঘায়ে কুকুর পাগল অবস্থা। আমার নাম স্যার কুঞ্জনাথ চন্দ্র। জুয়েলার চন্দ্র ব্রাদার্স আছে বউবাজারে। বিজ্ঞাপনে নাম দেখে থাকবেন।

দ্রুত বললাম, বুঝেছি। আপনিই হরনাথবাবুর ভাই?

–আজ্ঞে। দাদাকে নিয়ে আজ সারাটা দিন যা গেল! কর্নেল সায়েবের কাছে শুনে থাকবেন হয়তো।

শুনেছি। হরনাথবাবুর খোঁজ পেলেন?

 কুঞ্জনাথ গম্ভীর মুখে বললেন–সব বলছি। কর্নেলসায়েব আসুন।

কর্নেলসায়েব এসে গেলেন সেই মুহূর্তে। ইজিচেয়ারে বসেই বললেন– আপনি কুঞ্জনাথবাবু?

কুঞ্জনাথ ব্যস্তভাবে পকেট থেকে একটা খাম বের করে বললেন–এটা জেরক্স কপি। আমি থানায় যাওয়ার সময় দোকানে কে দিয়ে গেছে। কী সাংঘাতিক ব্যাপার দেখুন।

কর্নেল খামটা নিয়ে খুলতে খুলতে বললেন–আসলে কপিটা থানায়?

–হ্যাঁ স্যার! থানায় দিয়েছি। তারপর আমাদের কোম্পানি অ্যাটর্নি রামজয়বাবু আমাকে ডি সি ডি ডির কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। উনি আপনার কাছে আসতে বললেন।

কর্নেল খাম থেকে একটা চিঠি বের করে পড়ছিলেন। আমাকে দিয়ে একটু হেসে বললেন–রিয়্যাল লাইফ ড্রামা, জয়ন্ত!

চিঠিতে আঁকাবাঁকা হরফে ইংরেজিতে যা লেখা আছে, বাংলায় তা এরকম :

হরনাথ চন্দ্রকে আমরা অপহরণ করেছি। মালের দাম প্রায় ২ কোটি টাকা। মাত্র ৫ শতাংশই চাই। সাতদিন সময়। আগামী রবিবার রাত ১২টা পর্যন্ত কাটায় কাটায়। নগদ টাকা প্ল্যাস্টিকের থলেয় ভরে চোরডিহার বজরঙ্গবলী থানে রেখে আসতে হবে। আসানসোল গয়া রেলপথে চোরডিহা। স্টেশন থেকে জঙ্গলের ভেতর থানের দূরত্ব এক কিমি। পুলিশ থাকলে জেনে যাব। হরনাথও বেঁচে থাকবে না।

চিঠি ফেরত দিয়ে বললাম–সর্বনাশ!

কুঞ্জনাথ প্রায় আর্তনাদ করলেন–সর্বনাশ মানে মহা সর্বনাশ! অত ক্যাশ টাকা না হয় যোগাড় করা গেল। কিন্তু অতদূর নিয়ে যাওয়া। তারপর বিশ্বাসই বা করি কী করে? তাছাড়া ২ কোটির টাকার মালই বা কী? কিছু বুঝতে পারছি না। আমার দাদা সবসময় কী সব কেলো করে বেড়ায় কে জানে? এদিকে বউদির অবস্থা শোচনীয়। নার্সিং হোমে ভর্তি করতে হয়েছে। ওঃ! দাদাকে নিয়ে আর পারা যায় না।

কর্নেল বললেন–আপনার দাদা আমার চেনা লোক। দুবছর আগে আপনাদের কোম্পানির একটা হীরের নেকলেস রং ডেলিভারি হয়েছিল। হারানো নেকলেস উদ্ধারের সূত্রে ওঁর সঙ্গে আমার আলাপ।

কুঞ্জনাথ নড়ে বসলেন। তাহলে আপনিই স্যার ওটা উদ্ধার করে দিয়েছিলেন? দাদা আমাকে আপনার কথা বলেনি। আমি ভেবেছিলাম পুলিশই উদ্ধার করেছে। আমার দাদা বড় অদ্ভুত লোক।

ষষ্ঠী কফি রেখে গেল। কুঞ্জনাথ আর কফি খেলেন না। কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন কী করবেন ঠিক করেছেন কুঞ্জবাবু? কুঞ্জনাথ করুণ মুখে বললেন–ঠাকুরের আশীর্বাদে টাকা আমাদের হাতের ময়লা। ডি সি ডি ডি সায়েব বলেছেন, আপনি যা বলবেন তাই করব।

–যদি বলি টাকা দিয়ে দাদাকে উদ্ধার করে আনুন!

 কুঞ্জনাথ চমকে উঠলেন।–ওরে বাবা! অত ক্যাশ নিয়ে আমি চোরের মুল্লুকে যাব? চোরডিহা নামেই বোঝা যাচ্ছে সাংঘাতিক জায়গা। তার ওপর জঙ্গলের ভেতর বজরঙ্গবলীর থান। ওরে বাবা!

সঙ্গে সাহসী লোক পেলে আপনি যেতে রাজি?

কুঞ্জনাথ গোল চোখে তাকিয়ে কথাটা যেন বাজিয়ে দেখলেন।–সাহসী লোক?

–হ্যাঁ। সাহসী লোক।

–তেমন লোক পাচ্ছি কোথায়? আজকাল কাকেও বিশ্বাস করা যায় না। কর্নেল একটু হেসে আমাকে দেখিয়ে বললেন-জয়ন্ত খুব সাহসী। ওর রিভলভারও আছে।

হাত নেড়ে বললাম–অসম্ভব! আমি একা কিছুতেই যাব না। কর্নেল চোখ নাচিয়ে বললেন–আমি সঙ্গে গেলে?

–আপনি সঙ্গে থাকলে আমি নরকে ঝাঁপ দিতে রাজি।

কর্নেল তার প্রসিদ্ধ অট্টহাসি হাসলেন। কুঞ্জনাথ আরও করুণ মুখে বললেন– টাকার ব্যাপারে আমি স্যার রেডি। কিন্তু বলছিলাম কী, দাদাকে কি অন্য কোনওভাবে বদমাসদের হাত থেকে উদ্ধার করতে পারবেন না? ডি সি ডি ডি সায়েব সেইরকম আভাস দিলেন বলেই

কর্নেল তাকে থামিয়ে বললেন–আচ্ছা কুঞ্জবাবু! মহাবীর ট্রেডিং এজেন্সির সঙ্গে আপনাদের কারবার আছে?

কুঞ্জনাথ হকচকিয়ে গেলেন প্রথমে। তারপর সামলে নিয়ে আস্তে বললেন আছে। খুলেই বলি স্যার। ওরা গালফ থেকে র মেটিরিয়্যালস সাপ্লাই করে। স্মাগলিং র‍্যাকেট আছে। নানারকম জুয়েলস আমাদের হাতে এসে গয়নাগাঁটি হয়। গোল্ড বিস্কিট আর পার্লই বেশি আসে। দয়া করে এ সব কথা যেন পুলিশকে বলবেন না স্যার!

পুলিশ জানলেও মুখ বুজে থাকবে। বড় বড় পলিটিক্যাল চাই আন্ডার গ্রাউন্ডের মুরুব্বি। বোম্বের আন্ডার গ্রাউন্ডের খবর আমার চেয়ে আপনিই বেশি জানেন। পলিটিক্যাল পার্টি চাঁদা পেলেই খুশি।

কুঞ্জনাথ হাসবার চেষ্টা করে বললেন–পার্টি ফান্ডে চাঁদাটাদা দাদাই দেয়। ইলেকশনের সময় থোক টাকা দিতে হয়। বুঝতেই পারছেন কী অবস্থা। তবু পুলিশের হাঙ্গামা যে হয় না, এমন নয়।

–আপনি বনানী সেনকে চেনেন?

 কুঞ্জনাথ আবার তেমনি গোল চোখে তাকিয়ে রইলেন। তারপর ফাঁসফেঁসে গলায় বললেন–চিনি। সে দাদার নামে কিছু লাগিয়েছে নাকি স্যার?

নাহ! কর্নেল চুরুটের কেস থেকে একটা চুরুট বের করলেন। ফের বললেন–ইন্দ্রজিৎ রায় একসময় আপনাদের অ্যাকাউন্ট্যান্ট ছিল। তাই না?

কুঞ্জনাথ কর্নেলের প্রশ্নে আরও হকচকিয়ে গেলেন। ছিল। তবে সে তো কবছর আগের কথা। তাকে আমাদের বোম্বে ব্রাঞ্চে ট্রান্সফার করেছিল দাদা। সেখানে ক্যাশ তছরুপ করে গাল পালিয়ে ছিল। বোম্বে ব্রাঞ্চে আমি খুব কম গেছি। দাদাই যাতায়াত করে। ডিটেকটিভদ্রলোকের কাছে আজ সব শুনে….

কর্নেল তাকে থামিয়ে বললেন–আপনি শংকর জিরা নামে কাকেও চেনেন?

কুঞ্জনাথ বিব্রত ভাবে বললেন, কেন এসব কথা জিজ্ঞেস করছেন স্যার?

–চেনেন কি না বলুন কুঞ্জবাবু!

একটু চুপ করে থেকে ফোঁস শব্দে শ্বাস ছেড়ে কুঞ্জনাথ বললেন–বোম্বে ব্র্যাঞ্চে ছিল। আমাদের খুব বিশ্বস্ত কর্মচারী ছিল স্যার। বোম্বেতেই কবছর আগে মার্ডার হয়ে যায়। মার্ডারার ধরা পড়েনি।

–শংকরবাবু খুন হওয়ার আগে না পরে ইন্দ্রজিৎ ট্রান্সফার হয়েছিল?

–পরে। কুঞ্জনাথ কাচুমাচু মুখে বললেন–দাদাকে কিডন্যাপ করার সঙ্গে কি এসবের সম্পর্ক আছে স্যার?

কর্নেল চুরুটের ধোঁয়ার মধ্যে বললেন–থাকতে পারে, না-ও পারে। তবে আমার এসব কথা জানা দরকার। আপনি শুনলে অবাক হবেন, আপনার দাদা শেখ সায়েবকে নিয়ে আমার কাছে এসেছিলেন। কিন্তু ইন্দ্রজিৎ যে চন্দ্র জুয়েলার্সের কর্মচারী ছিল আমাকে বেমালুম গোপন করেছিলেন।

কুঞ্জনাথ বলে উঠলেন–দাদা স্যার বরাবর বড় পাচালো মানুষ। পেটে এক কথা, মুখে আরেক কথা। এতদিনে উচিত শিক্ষা পাচ্ছে। এদিকে আমার হয়েছে জ্বালা।

তা হলে টাকা দিতে আপনি রাজি?

বললাম তো স্যার! কুঞ্জনাথ আবার করুণ মুখ বললেন–দাদার একটা কিছু হয়ে গেলে আমি পড়ব অথৈ জলে। বিজনেসের কোথায় কী লেনদেন আছে, আমি স্পষ্ট জানি না। কে কোথায় আমাকে একা পেয়ে ফাঁসিয়ে দেবে সেই নিয়ে যত দুশ্চিন্তা আমার। তার ওপর গালফ ওয়রের ধাক্কায় বিজনেসের কোন জায়গায় ঘা লেগেছে, দাদা আমাকে কিছুই জানায়নি।

–ডিটেকটি ভদ্রলোক কী বললেন?

–মাথায় ছিট আছে স্যার! দুপুরে থানা থেকে সেই যে আসছি বলে চলে গেলেন তো গেলেন। পুলিশ অফিসাররা হাসাহাসি করছিলেন। দাদার যত অদ্ভুত কাণ্ড! এ কি প্রাইভেট ডিটেকটিভের কাজ?

কর্নেল চোখ বুজে দুলতে দুলতে বললেন ঠিক আছে। আপনি আসুন। এখনও তো হাতে সময় আছে। আমিই আপনাকে রিং করে জানাব কী করতে হবে।

কুঞ্জনাথ প্রায় পালিয়ে বাঁচার ভঙ্গিতে বেরিয়ে গেলেন। তারপর স্তব্ধতা ভেঙে টেলিফোন বাজল।

কোনও-কোনও সময় টেলিফোনের শব্দ বিরক্তিকর। কর্নেলকে ধ্যানস্থ দেখে আমিই ফোন তুলে সাড়া দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে শেখ সায়েবের গালাগালি খেলাম–কিশ! করি! কত্ব!

–শেখসায়েব নাকি? বাংলায় প্রশ্নটা করেই শুধরে নিলাম ইংরেজিতে।

 সগর্জনে শেখসায়েব বললেন–চোরদের শাস্তি হাত কেটে নেওয়া। খুনীর শাস্তি চৌরাস্তায় নিয়ে গিয়ে গর্দানে কোপ। হিন্দুস্থানে সবই উল্টো।

–কী হয়েছে শেখসায়েব?

কর্নেল সরকার! আমার সুইটে চোর ঢুকেছিল। আমাকে খুন করতে ছুরি তুলেছিল।

–এক মিনিট! কর্নেলকে দিচ্ছি।

কর্নেল ফোন নিয়ে সাড়া দিয়ে বললেন-বলুন শেখসায়েব!. জয়ন্ত চৌধুরি ফোন ধরেছিল–সাংবাদিক..! বলেন কী! তারপর…..কর্নেল একটানা হু দিতে থাকলেন। একসময় বললেন ঠিক আছে। সাবধানে থাকুন। আই হোলে দেখে তবে দরজা খুলবেন।…শুভরাত্রি! বলে ফোন রেখে দিলেন কর্নেল।

উত্তেজনায় ছটফট করছিলাম। বললাম কী হয়েছে?

কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট জ্বেলে একটু হাসলেন।–হোটেল কন্টিনেন্টালে নেহাত চোরের উৎপাত অস্বাভাবিক। প্রতি ফ্লোরের করিডরে ওয়াকিটকি হাতে সিকিউরিটি গার্ড ঘুরে বেড়ায়। অথচ শেখসায়েবের ঘরে চোর ঢুকল কী করে? শেখসায়েব বাথরুমে ছিলেন। বেরিয়েই দেখেন কে ওঁর বিছানা হাতড়াচ্ছে। ওঁকে দেখে লোকটা ছুরি বের করে। শেখ সাহেব বুদ্ধিমান। বাথরুমে ঢুকে পড়েন তক্ষুণি। বাথরুমে অ্যালার্ম সুইচ আছে। সুইচ টেপার পর হুলস্থূল শুরু হয়। তবে চোর নিপাত্তা হয়ে যায়। বিছানাপত্র ওলটপালট। কী খুঁজতে এসেছিল বলা কঠিন। পেট্রোডলার কি? মনে হয় না। কারণ শেখসায়েব ট্র্যাভেলার্স চেক নিয়ে এসেছেন। খুচরো টাকাকড়ি হারায়নি। অন্য কিছু হারিয়েছে কি না শেখসায়েব এখনও জানেন না। নীচের লাউঞ্জে এসে আমাকে সরাসরি ফোন করছিলেন।

–চোর সুইটে ঢুকল কী করে? ইন্টারলকিং সিস্টেম থাকা উচিত দরজায়।

 –আছে। তবু চোর ঢুকেছে। মুখে মুখোশ ছিল।

তা হলে হোটেলেরই কেউ। ডুপ্লিকেট চাবি হাতিয়ে ঢুকেছিল।

–ডুপ্লিকেট চাবি থাকে ম্যানেজারের কাস্টডিতে। বেসমেন্টে গুপ্ত ঘরের ভেতর আয়রন সেফে থাকে।

–এ চোর তা হলে নেহাত চোর নয়। ম্যানেজারকে হাত করার ক্ষমতা তার আছে।

কর্নেল কোনও মন্তব্য না করে টেবিলের ড্রয়ার থেকে আতস কাচ বের করলেন। আমার পাওয়া এবং কুঞ্জনাথের দিয়ে যাওয়া জেরক্স করা চিঠি আতস। কাচের তলায় রেখে ঝুঁকে বসলেন।

টানা উত্তেজনার পর ক্লান্তি এসেছিল। হাই তুলে বললাম–আমি চলি এবার।

-উঁ?

বড্ড টায়ার্ড। বাড়ি গিয়ে শুয়ে পড়তে চাই।

–হুঁ।

 আমার রহস্যভেদী বন্ধু বিদায়সম্ভাষণ করলেন না। বুঝলাম না একটা, বাংলা এবং একটা ইংরেজি চিঠির মধ্যে কী মিল আবিষ্কার করতে চাইছেন উনি? ওঁর আচরণের মাথামুণ্ডু খুঁজে পাই না অনেক সময়। উনি নিজেই কতবার কত রহস্যের পেছনে ছোটাছুটি করে বিরক্ত হয়ে বলেছেন– ব্যাপারটা চেইজিং আফটার আ রেড হেরিং হয়ে গেল, ডার্লিং! যা নেই, তার পেছনে ছোটা। এবারও রেড হেরিং মাছের দিকে ছুটে চলেছেন না তো?

ইস্টার্ন বাইপাসে পৌঁছে ব্যাকভিউ মিররে হঠাৎ আবিষ্কার করলাম পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে যে লাল মারুতিটা আমার ফিয়াটের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল সিগন্যালের অপেক্ষায়, সেই গাড়িটাই আমার পেছনে আসছে।

নাকি অন্য কোনও গাড়ি?

ইস্টার্ন বাইপাসে এখন গাড়ি চলাচল কম। মানুষজনও নেই। লাল মারুতি আমার ফিয়াটের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু একটু পরে গতি কমিয়ে দিল এবং আমি সতর্ক না হলে আমার ফিয়াট তাকে গোত্তা দিতই।

আমি তাকে পেরিয়ে যেতেই সে আবার গতি বাড়াল। গাড়িটার আচরণ তো ভারি অদ্ভুত। খাপ্পা হয়ে তার নাগাল পাওয়ার জন্য অ্যাকসিলারেটারে পায়ের চাপ দিলাম। তারপর দেখলাম গাড়িটা গতি কমিয়েছে। পাশ কাটাতে গিয়ে দেখি গাড়িটা রাস্তার পাশ ঘেঁষে থামছে। লাল জোরালো আলো ফুঁসে উঠল। ব্রেক কষে প্রায় কুড়িবাইশ মিটার দূরে গাড়ি দাঁড় করালাম। নিরিবিলি রাস্তা। কুয়াশা নীল হয়ে আছে। গাড়ি থেকে নেমে গেলাম। প্যান্টের পকেটে রিভলভার রেডি। লাল মারুতির ভেতর কারা বসে আছে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু তারা কারা আমার জানা দরকার।

পরে মনে হয়েছিল, আমি আসলে প্রচণ্ড ভিতু বলেই বেঁকের বশে অতিরিক্ত সাহস দেখাতে যাই।

লাল মারুতির দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ মাথায় এল, ভুল করেছি। কিন্তু আর কী করা যাবে? কয়েকমিটার দূরে দাঁড়িয়ে ইংরেজিতে (ইংরেজি বাঙালি সন্তানের সাহস বাড়ায়) বললাম-কে তোমরা? কিছু বলার থাকলে বেরিয়ে এস। কিন্তু সাবধান, আমার কাছে আগ্নেয়াস্ত্র আছে।

গাড়িটার ইঞ্জিন বন্ধ করা হয়নি। হঠাৎ প্রায় ঝাঁপিয়ে আমার দিকে ছুটে এল। এক লাফে কিনারার ঘাসের ওপর গিয়ে পড়লাম। তারপর রিভলবার বের করেছি, লাল মারুতি উল্টোদিকে ঘুরে উধাও হয়ে গেল।

হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম অন্তত মিনিট দুই। তারপর দ্রুত আমার গাড়ির দিকে ছুটে গেলাম। স্টার্ট দিয়ে স্টেডিয়ামের কাছাকাছি পৌঁছে মানুষজনের দেখা পাওয়া গেল। আস্তেসুস্থে ড্রাইভ করছিলাম। তখনও হাত কাঁপছে।

একবার মনে হল আজকালকার আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া বড়লোকের ছেলেরা নানারকম মস্তানি করে বেড়ায়, এটা তাছাড়া কিছু নয়। আমাকে নিয়ে মজা করে গেল। খুব হাসির ব্যাপার তাদের কাছে।

আবার মনে হল, মুক্তো এবং ইন্দ্রজিৎ হত্যা রহস্যের সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই তো?

কিন্তু যদি সম্পর্ক থাকে, আমার পিছনে লাগতে আসবে কেন?

ফ্ল্যাটে ফিরেই কর্নেলকে রিং করলাম। কর্নেল সব শুনে প্রথমে একচোট হাসলেন। তারপর বললেন–তোমার দুটো ধারণার যে-কোনওটা সত্য, দ্যাট আই এগ্রি। তবে ইন্দ্রজিতের হত্যারহস্যের সঙ্গে এর সম্পর্ক থাকলে বলব, প্রতিপক্ষ তোমার মাধ্যমে আমাকেই শাসিয়ে গেল। তার মানে, সে বা তারা সরাসরি আমাকে ঘাঁটাতে সাহস পাচ্ছে না। কিংবা ঝুঁকি নিচ্ছে না। কেন নিচ্ছে না? এর জবাব হল, সে বা তারা সম্ভবত আমার চেনা লোক।

–সায় দিয়ে বললাম ঠিক বলেছেন বস্!

না। এখনও আমি কোনও সিদ্ধান্ত করছি না। জাস্ট অনুমান। এমনও হতে পারে তোমার প্রথম ধারণাটা সত্য। কোনও বখাটে ছোকরার কীর্তি। ইস্টার্ন বাইপাসে প্রায় এ ধরনের ঘটনা নাকি ঘটে। তাই পুলিশ পেট্রলের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

–বোগাস! একটাও পুলিশের গাড়ি দেখলাম না!

–দেখার ব্যাপারটা চান্স জয়ন্ত! হয় তো এক মিনিট আগে বা পরে পুলিশ পেট্রল পাস করেছে। যাই হোক, খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ো। বিশ্রাম দরকার। কাল থেকে তোমার ওপর দিয়ে সাইমুম বয়ে যাচ্ছে ডার্লিং! আরবের মরুঝা!

কর্নেল ফোন রেখে দিলেন। আরও কিছু বলতে চাইছিলাম। সুযোগ পেলাম না। লাল মারুতির নম্বরটা এখনও মাথার ভেতর জ্বলজ্বল করছে। ডায়রিতে লিখে রাখা দরকার।

কিন্তু লিখতে গিয়ে শেষ দুটো সংখ্যা নিয়ে গোলমালে পড়লাম। ৬৭ বা ৭৬? গোড়ার দুটো ঠিক আছে। কর্নেলের বাড়ির নম্বর। কাজেই মাথায় বিঁধে গেছে। শেষ দুটো ঝামেলা বাধাল। ঠিক আছে। ৬৭ এবং ৭৬ দুটোই লেখা থাক। আশা করি দুটোই লালরঙের গাড়ি হবে না।

ঘুম ভাঙতে দেরি হয়েছিল। বাথরুম সেরে এসে পোশাক বদলাচ্ছি, টেলিফোন বাজল। কর্নেল ভেবে সাড়া দিলাম। কিন্তু ভেসে এল দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার চিফ অব দা নিউজ ব্যুরো সত্যদার কণ্ঠস্বর।

জয়ন্ত, তুমি বেঁচে আছ তো? নাকি খাবি খাচ্ছ? আঁ? তুমি, মাইরি। নিজেও ডুববে, আমাকেও

সত্যদার ম্যানারিজম। বললাম–কেন সক্কালবেলা অলক্ষুণে কথাবার্তা সত্যদা? কী দোষ করেছি?

–আজকের কাগজ দেখেছ?

নাহ্। এখনও দেখিনি।

–সব কাগজ স্টোরিটা দিল। আমরাই মিস করলাম। চিফ এডিটর এইমাত্র আমাকে রিং করে একচোট নিলেন। নেওয়া উচিত। দোষ তো আমারই যে আমি তোমাদের–মানে তোমার ওপর কড়া হতে পারি না। আশ্চর্য জয়ন্ত! যে এক্সক্লসিভ স্টোরি আমরা একমাস আগে নিয়ে প্রেসটিজের চুড়োয় উঠলাম, মাইরি তুমি–ওঃ!

–কোন স্টোরি সত্যদা?

ন্যাকামি হচ্ছে? গালফ ওয়র! অ্যারাবিয়ান নাইটস! ডেজার্ট এক্সপিডিশন!

সত্যদার তর্জনগর্জন শোনামাত্র বললাম ইন্দ্রজিৎ রায়ের স্টোরি?

আজ্ঞে হ্যাঁ। কাল কলকাতায় সে খুন হয়েছে। কোথায় ছিলে তুমি? প্রেমিকার সঙ্গে ডুব মেরেছিলে!

–সরি সত্যদা। কাল থেকে আমি মরুঝড়ের বালির তলায় চাপা পড়েছি।

মরুঝড়ই দেখ জয়ন্ত, জোক করার মুড নেই। মাইরি!

-এগেন সরি সত্যদা! কাল রাতে আমার উচিত ছিল অন্তত ফোনে স্টোরিটা দেওয়া। কিন্তু ওই যে বললাম মরুঝড়ের কথা। তার ওপর লাল মারুতি!

–শাট আপ! কাল তুমি অফিসে আসোনি! উইদাউট এনি প্রায়র ইনফরমেশন।

ক্যাজুয়াল লিভের রুলে বলে, উইদিন টোয়েন্টি ফোর আওয়ার্স

–আমারে রুল দ্যাখাইও না! আমাদের এক্সক্লসিভ স্টোরির হিরো মার্ডার হইয়া গেল। আমরা মিস করলাম?

মরুঝড়! লাল মারুতি!

–অ্যাঁ? কও কী? হোয়াট ইজ দা মিনিং অব মরুঝড় অ্যান্ড লাল মারুতি?

 –সত্যদা! চিফ এডিটরকে বলুন সুদে আসলে পুষিয়ে দেব।

 –তোমার ইয়ারলি ইনক্রিমেন্ট স্টপ কইরা দিমু।

বেগতিক বুঝে বললাম প্লিজ সত্যদা, কর্নেলকে রিং করে ব্যাকগ্রাউন্ড জেনে নিন।

কারে?

 কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।

 কও কী? ওই বুড়ারে? আঁ?

হ্যাঁঃ।

ফোন রেখে দিলাম। বলতে পারতাম, লালবাজার থেকে ইন্দ্রজিৎ রায়ের কেস পুলিশই ব্রিফিং করেছে রিপোর্টারদের। সত্যসেবকের এই স্পেশাল রিপোর্টারকেই কি শুধু পুলিশ-স্টোরি নিতে হবে? অন্য রিপোর্টাররা কী করছিল? আমার বুঝি অসুখবিসুখ হতে পারে না?

.

সমস্যা হল সত্যদাকে কিছু বুঝিয়ে বলা কঠিন। চিফ রিপোর্টার অবনীদার কাছে কথাটা তুলতে হবে। অভিমান ঝেড়ে ফেলে ঝটপট ব্রেকফাস্ট খেলাম। তারপর কর্নেলের বাড়ি ছুটে চললাম। গিয়ে দেখি, কর্নেল টেলিফোনে কার সঙ্গে চাপা স্বরে কথা বলছেন। সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছেন বাহারিনের মুক্তোব্যবসায়ী সেখ জুবাইর আল-সাবা। একেবারে ভিজে নেতিয়ে পড়া চেহারা। চোখ দুটো রাঙা। তবে ফোঁস ফোঁস করে শ্বাসপ্রশ্বাস যথারীতি পড়ছে। আমার দিকে একবার তাকিয়ে চোখ ঘুরিয়ে নিলেন শেখসায়েব। বললাম–গুডমর্নিং। কিন্তু জুবাব দিলেন না।

ফোন রেখে কর্নেল আমার দিকে ঘুরলেন। গম্ভীর মুখে বাংলায় বললেন– গতরাতে চোর ঢুকে শেখসায়েবের পাসপোর্ট ভিসা চুরি করেছে। ওঁর হ্যান্ডব্যাগে ছিল। তাই রাতে খেয়াল করেননি। সকালে হ্যান্ডব্যাগ খুলে দেখেন পাসপোর্ট ভিসা নেই।

–তা হলে কি কেউ বা কারা…

আমার কথার ওপর কর্নেল বললেন–কেউ বা কারা চেয়েছে শেখসায়েব যেন এখনই এ দেশ থেকে চলে যান। একজন বিদেশীর পাসপোর্ট ভিসা চুরি গেলে শেষমেশ তাকে ডিপোর্ট করা হবেই। তা ছাড়া গালফ ওয়রে ভারতের ভূমিকায় ইরাক বাদে প্রায় সব আরবদেশ আপাতত অখুশি। শেখসায়েবকে পাসপোর্ট পেতে নিশ্চয় প্রচুর ঘুষ দিতে হয়েছিল। ভিসা দিতে ভারতের অবশ্য আপত্তি করার কথা নয়। কর্নেল শেখসায়েবকে একটা ভাঁজ করা কাগজ দিয়ে ইংরেজিতে বললেন–এই চিঠি নিয়ে যেভাবে তোক আজই দিল্লি চলে যান। তারপর আমাকে ট্রাঙ্ককলে জানাবেন। আশা করি অসুবিধা হবে না।

শেখ জুবাইর আল-সাবা বিড়বিড় করে মাতৃভাষায় কী বলতে বলতে বেরিয়ে গেলেন।…