বোরখার আড়ালে

বোরখার আড়ালে

০১.

সরপেঁচ কালান জমাররুদ ওয়া কানবাল্ আলমাস্ বা আওয়াইজে-ই-জমাররুদ।

কর্নেল নীলাদ্রি সরকার একটা গাব্দা বইয়ের পাতা থেকে হঠাৎ মুখ তুলে এই কথাগুলি উচ্চারণ করলেন। স্বীকার করা উচিত, কথাগুলি তৎকালে আমার বোধগম্য হয়নি। পরে কৌতূহলবশে আমার রিপোর্টারস নোটবইতে টুকে নিয়েছিলাম। তো প্রথম একটু অবাক হয়ে বললাম, কী ভাষা ওটা?

আমার বৃদ্ধ বন্ধু বইটা টেবিলে রেখে বললেন, মোটমাট ৫১০ ক্যারাটের ৩০টি পান্না আর ৯০ ক্যারাটের হীরা। ৯ কোটি টাকা দাম।

অলঙ্কার?

 হু। অলঙ্কার বলতে পারো। তবে পুরুষমানুষের!

 ওঃ কর্নেল! একটু খুলে বলবেন?

কর্নেল চুরুটের একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, সেকালের নবাবদের সরচে অর্থাৎ পাগড়িতে এই অলঙ্কার শোভা পেত।

হাসতে হাসতে বললাম, পাগড়ির কাপড় অনেকটা লম্বা হয় দেখেছি। কিন্তু নামটা দেখছি শুধু লম্বা নয়, ওজনদারও বটে!

কর্নেল হাসলেন না। তাকে গম্ভীর দেখাচ্ছিল। বললেন, আরবি-ফার্সি নাম। তবে আভিজাত্যের ব্যাপারে সব ভাষাতেই এই বাগাড়ম্বর তুমি লক্ষ্য করবে জয়ন্ত!

কিন্তু আজ সক্কালবেলা হঠাৎ নবাবি অলঙ্কারের বই নিয়ে বসলেন কেন? নিশ্চয় কোনও গোলমেলে ঘটনা কোথাও বেধেছে?

 কর্নেল আমার কথার জবাব না দিয়ে কিছুক্ষণ চোখ বুজে কিছু ভেবে নিলেন। তারপর স্বগতোক্তি করলেন, ৯ কোটি টাকা দামের ঐতিহাসিক অলঙ্কার যেমন-তেমন একটা জুতোর প্যাকেটে ভরে দিল্লি থেকে প্লেনে কলকাতা! বোকামি, নাকি অতিবুদ্ধি, নাকি

তার কথার ওপর ডোরবেল বাজল এবং কর্নেল যথারীতি হাঁক দিলেন, ষষ্ঠী। তারপর কর্নেলের জাদুঘরসদৃশ ড্রয়িংরুমকে ঝলমলিয়ে দিয়ে এক বিশ্বসুন্দরীর আবির্ভাব ঘটল।

বিশ্বসুন্দরীই বলছি। কারণ, আমার সাংবাদিক পেশার কারণে সম্প্রতি এক বিশ্বসুন্দরীর সাক্ষাৎকার নিয়েছি। নিমেষে আমার মাথায় এই শব্দটাই এসে গিয়েছিল। কিন্তু এই যুবতীর চেহারায় ঈষৎ বিষাদ ছিল, যা পরক্ষণে আবিষ্কার করলাম। তার সঙ্গে ছিল যুগপৎ উত্তেজনা আর আর্তিরও আভাস। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলাম।

কর্নেল বললেন, বসুন মিসেস সিনহা! আলাপ করিয়ে দিই। আমার তরুণ বন্ধু জয়ন্ত চৌধুরি। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার রিপোর্টার। আর জয়ন্ত! ইনি মিসেস চন্দ্রপ্রভা সিনহা। বাকি পরিচয় ক্রমশ জানতে পারবে।

 বিশ্বসুন্দরী আমাকে নমস্কার করে শান্তভাবে সোফায় বসলেন। কিন্তু মিসেস শুনেই আমার কেমন যেন লাগল। এই সুন্দরী যুবতীর স্বামী থাকাটা যেন মানায় না। এতে যেন সৌন্দর্যেরই অবমাননা ঘটেছে।

চন্দ্রপ্রভা মৃদুস্বরে বললেন, খবরের কাগজকে আমি এখনও কিছু জানাইনি। পুলিশকেও না। আপনাকে টেলিফোনে বলেছি, আমি ঘটনাটা কেন গোপান রাখতে চাই।

কর্নেল একটু হেসে বললেন, জয়ন্ত খবরের কাগজে চাকরি করলেও নিজে খবরের কাগজ নয়। ওর সামনে সবকিছু আপনি খুলে বলতে পারেন। কারণ, আমার যা কিছু জানা হয়ে যায়, তা জয়ন্তেরও অজানা থাকে না। যাই হোক, বলুন!

চন্দ্রপ্রভা আমাকে একবার দেখে নিয়ে আস্তে বললেন, আমি বুঝতে পারছি না বিশ্বজিৎ এমন কেন করল? নবাবি জুয়েলস সে তো নিজেই নিলামে কিনেছে। নিজেই পার্টি ঠিক করেছে বিক্রির জন্য। অথচ হঠাৎ হোটেল থেকে উধাও হয়ে গেল! আমার ভয় হচ্ছে কর্নেল সরকার! বিশ্বজিৎ হয়তো কারও ফাঁদে পা দিয়েছে!

কর্নেল বললেন, মিঃ সিনহার চিঠিটা কি এনেছেন?

চন্দ্রপ্রভা হ্যান্ডব্যাগ খুলে একটা ভাজকরা কাগজ দিলেন। কর্নেল সেটা খুললেন। লক্ষ্য করলাম ছাপানো লেটারহেডের প্যাড থেকে ছেঁড়া একটা চিঠি। কর্নেল বিড়বিড় করে পড়ছিলেন, প্লিজ ডোন্ট বি ওয়ারিড। চেক আউট ফ্রম দি হোটেল অ্যান্ড গো টু আওয়ার হাউস। বি সিনহা। পড়ার পর জিজ্ঞেস করলেন, আপনার স্বামীর হাতের লেখা এটা?

হ্যাঁ।

 দিল্লি থেকে প্লেনে কলকাতা ফিরে কেন আপনারা বাড়ি যাননি–হোটেলে উঠেছিলেন?

বিশ্বজিৎ বলেছিল, হোটেলে ওর পার্টি আসবে। যত শীগগির হয়, জিনিসটা বেচে দিতে পারলে আর ঝুঁকি থাকবে না।

কিসের ঝুঁকি?

চন্দ্রপ্রভা চাপা শ্বাস ছেড়ে বললেন, জিনিসটার দাম নাকি কয়েক কোটি টাকা।

দিল্লির নিলামঘরে আপনি উপস্থিত ছিলেন না?

না। বিশ্বজিৎ আমাকে একটা হোটেলে রেখে গিয়েছিল।

 জুয়েলসটি আপনি দেখেছেন?

চন্দ্রপ্রভা তাকালেন। একটু পরে বললেন, না। ওসব ব্যাপার আমি বুঝি না।

ওটা সাধারণ জুতোর বাক্সে ভরার প্ল্যান–

না। আমার প্ল্যান নয়। চন্দ্রপ্রভা দ্রুত বললেন। ওটা দেখেই আমার ভয় করছিল। আমি মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মেছি। ঘটনাচক্রে বিশ্বজিতের মতো কোটিপতির সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে।

কতদিন আগে আপনাদের বিয়ে হয়েছে?

প্রায় দুমাস।

আপনি কী করতেন?

একটা ব্যালে ট্রুপে ছিলাম। ছোটবেলা থেকে ওয়েস্টার্ন ড্যান্স আমার প্রিয়।

কর্নেল হাসলেন। ব্যালেতে প্রচুর শারীরিক কসরত করতে হয়। যাই হোক, আপনি আপনাদের বাড়িতে ফিরে যাচ্ছেন না। হোটেলেই আছেন। কেন?

চন্দ্ৰপ্ৰভা শ্বাসপ্রশ্বাসের মধ্যে বললেন, আমি একা বাড়ি ফিরতে সাহস পাচ্ছি না। আমার শ্বশুরমশাই অমরজিৎ সিনহা আমাকে পছন্দ করেন না। উনি আমাকে বিপদে ফেলতে পারেন। তবে আমি টেলিফোনে ওবাড়িতে যোগাযোগ করেছি। বিশ্বজিৎ আজ সকালেও বাড়ি ফেরেনি।

আপনি নিজের পরিচয় দেননি নিশ্চয়?

না। কে ফোন ধরেছিল, জানি না। বেশি কথা বলতেও সাহস পাইনি।

 আপনার বাবার বাড়িতে–

আমার বাবার বাড়ি বোম্বে। আমি বোম্বেতে জন্মেছি। সেখানেই বড় হয়েছি।

কলকাতায় আপনার পরিচিত আর কেউ নেই?

না। বিয়ের পর ব্যবসার কাজে বিশ্বজিৎ বেশির ভাগ সময় বোম্বেতেই কাটিয়েছে।

আমার নেমকার্ড আপনি মিঃ সিনহার কাছে পেয়েছিলেন?

হ্যাঁ। সে তো আপনাকে গতরাত্রে বলেছি। বিশ্বজিৎ প্লেনে আসার সময় বলেছিল, তার কোনো বিপদ হলে আমি যেন আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করি।

কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট জ্বেলে বললেন, তাহলে দেখা যাচ্ছে সত্যি একটা বিপদ হল!

কর্নেল সরকার! আমাকে সাহায্য করুন! চন্দ্রপ্রভার চোখে জল এল। দ্রুত রুমাল বের করে চোখ মুছে ফের বললেন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস; ও কারও ফাঁদে পা দিয়েছে।

চিন্তা করবেন না। আমার যথাসাধ্য চেষ্টা আমি করব। কর্নেল তার সাদা দাড়িতে হাত বুলিয়ে ঘড়ি দেখে নিলেন। তারপর বললেন, গতকাল আপনারা দমদম এারপোর্ট থেকে ট্যাক্সি চেপে হোটেল প্যরামাউন্টে পৌঁছেছিলেন?

হ্যাঁ। বিশ্বজিৎ দালাল ধরে ট্যাক্সির ব্যবস্থা করায় অবাক হয়েছিলাম। ওখানে আমাদের গাড়ি থাকার কথা ছিল।

হোটেলে লাঞ্চের পর আপনি ঘুমিয়ে পড়েন?

হ্যাঁ। ঘুম ভেঙে দেখি রাত পৌনে নটা বাজে। আমার মাথা ঝিমঝিম করছিল। কিছুক্ষণ পরে দেখি, টেবিলে ওই কাগজটা রাখা আছে। রাত সাড়ে দশটায় আপনাকে ফোন করলাম। আপনি রিসেপশনে খোঁজ নিতে বলেছিলেন। তারা কিছু বলতে পারল না।

আপনার কি সন্দেহ যে মিঃ সিনহা আপনাকে ঘুমের বড়ি খাইয়ে দিয়েছিলেন?

চন্দ্রপ্রভা চমকে উঠলেন। কেন সে তা করবে?

কর্নেল চুপচাপ চুরুট শেষ করে অ্যাশট্রেতে নেভালেন। তারপর বললেন, এক পেয়ালা কফি খান মিসেস সিনহা। কফি নার্ভ চাঙ্গা করে।

ধন্যবাদ। আমাকে এখনই হোটেলে ফিরতে হবে। যদি বিশ্বজিৎ ফাঁদ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে ফিরে আসে?

বেশ তো! এলে নিশ্চয় আমাকে ফোন করবেন উনি। কারণ উনি আমাকে চেনেন। অবশ্য আমার মনে পড়ছে না ওঁকে আমি চিনি কি না কিংবা এঁকে আমার নেমকার্ড দিয়েছিলাম কি না! আপনি কফি খান! বলে কর্নেল হাঁকলেন, ষষ্ঠী!

কিন্তু চন্দ্রপ্রভা উঠে দাঁড়ালেন। ব্যস্তভাবে বললেন, প্লিজ কর্নেল সরকার! আমার এখন কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। আমি হোটেলে ফিরতে চাই। হোটেল প্যারামাউন্টের ঠিকানা-ফোন নাম্বার আমি দিচ্ছি।

কর্নেল হাত তুলে বললেন, আমি জানি।

চন্দ্রপ্রভা বেরিয়ে গেলেন। এতক্ষণে টের পেলাম ঘর সুগন্ধে ভরে আছে। একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখছিলাম যেন। অথচ এটা স্বপ্ন নয়। ঘর থেকে সৌন্দর্যটি চলে গেলেও সৌরভ রেখে গেছে। একটু পরে এ-ও মনে পড়ল, শুধু সৌন্দর্যদর্শন করিনি, স্মার্ট ইংরেজিতে কথোপকথনও শুনছিলাম।

জয়ন্ত! আমার প্রাজ্ঞ বন্ধু সহাস্যে বললেন, তুমি কাগজের লোক হয়েও কাগজ পড়ো না। তাই মজাটা মিস্ করলে। দিল্লির ন্যাশনাল আর্কাইভে রাখা ফতেপুরের নবাবের পাগড়ি থেকে ৯ কোটি টাকা দামের রত্ন চুরি যাওয়ার খবর বেরিয়েছে আজ। তবে–না! মাথা ঠাণ্ডা রেখে ধীরে এগোতে চাই।

আমি হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম।…

.

০২.

কর্নেলের নির্দেশে পার্ক স্ট্রিট হয়ে চৌরঙ্গির দিকে ড্রাইভ করছিলাম। কর্নেল বলছিলেন, কিছু নিলাম কোম্পানির বিদেশেও শাখা আছে। সিনহা ট্রেডার্সেরও আছে। এদের কেউ-কেউ চোরাই জিনিস কিনে বিদেশি শাখায় পাঠায়। এখন বোঝা যাচ্ছে, এই কোম্পানির বিশ্বজিৎ সিনহা নবাবি পাগড়ির রত্ন দিল্লি থেকে হাতিয়ে এনেছিল। তারপর–যাই হোক, পরের কথা পরে।

চৌরঙ্গিতে একটা বিশাল বহুতল বাড়ির পার্কিং জোনে গাড়ি রাখলাম কর্নেলের নির্দেশে। তারপর ওঁকে অনুসরণ করে লিফটে উঠলাম এবং আটতলায় নামলাম। কর্নেল বললেন, এটা সিনহা ট্রেডার্সের অফিস। নিলামঘর ক্যামাক স্ট্রিটে। দেখা যাক্, শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়ায়।

কর্মব্যস্ত অফিসঘরে ঢুকে কর্নেল এক ভদ্রলোককে মিঃ অমরজিৎ সিনহার কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি উল্টোদিকে একটা কেবিন দেখিয়ে দিলেন। বেয়ারার হাতে কর্নেলের নেমকার্ড পাঠানোর পর দুমিনিটের মধ্যে ডাক এল। প্রকাণ্ড সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওধারে সাদা ফ্রেঞ্চকাট দাড়িওয়ালা সায়েবি চেহারার এক স্মার্ট বৃদ্ধ বসেছিলেন। উঠে দাঁড়িয়ে বসতে বললেন। তারপর ইংরেজিতে বললেন, বলুন কী করতে পারি আপনাদের জন্য?

কর্নেল বললেন, আমার নেমকার্ড কি আপনার পরিচিত মনে হচ্ছে?

অমরজিৎ কার্ডটা আবার দেখে দিয়ে বললেন, নাহ্। যাই হোক, বলুন!

 আপনার ছেলে বিশ্বজিৎ

 সে বাইরে গেছে।

 আপনার বউমা চন্দ্রপ্রভা

এক মিনিট। দেখুন, আমি কারবারি মানুষ। পারিবারিক বিষয়ে এখানে কথা বলি না।

মিঃ সিনহা! সরপেঁচ কালান জমাররুদ কথাটি কি আপনার জানা?

অমরজিৎ নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকার পর আস্তে বললেন, আজকের কাগজে খবরটা পড়েছি। আপনারা কি পুলিশ কিংবা সি বি আইয়ের লোক?

কর্নেল হাসলেন। না মিঃ সিনহা! আমার কার্ডে যা লেখা আছে, আমি তাই। তবে ঘটনাচক্রে আপনার বউমা চন্দ্রপ্রভার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে।

কোথায়?

এই কলকাতায়। একটা হোটেলে চন্দ্রপ্রভা আছেন। শ্বশুরবাড়ি ফিরে যেতে সাহস পাচ্ছেন না। কারণ, আপনার ছেলে দিল্লি থেকে ফিরে ওই হোটেলে ওঠার পর নিখোঁজ হয়ে গেছেন।

অমরজিৎ নড়ে উঠলেন। অসম্ভব! অবিশ্বাস্য! কী বলতে চান আপনি?

আপনার ছেলের কাছে ওই নবাবি রত্ন ছিল। রত্নসমেত উনি নিখোঁজ।

অমরজিৎ গলার ভেতর গর্জন করলেন, ওই মেয়েটাকে গুলি করে মারব। কোন হোটেলে আছে সে?

মিঃ সিনহা! আপনার ছেলে নিখোঁজ হওয়ার আগে এই চিঠি লিখে গেছেন। দেখুন তো এই হস্তাক্ষর বিশ্বজিতের কি না!

কর্নেল পকেট থেকে ভাঁজকরা সেই কাগজটা এগিয়ে দিলেন। অমরজিৎ সেটা তুলে নিয়ে ভাঁজ খুললেন। লক্ষ্য করলাম, তাঁর হাত কাঁপছে। চিঠিটা মিনিট দু-তিন খুঁটিয়ে পড়ার পর তিনি দ্ৰ কুঁচকে বললেন, কিছু বুঝতে পারছি না। বিশ্বজিই লিখেছে। কিন্তু আপনি যে-ই হোন, বিশ্বাস করুন, বিশ্বজিৎকে আমি চোরাই রত্ন কিনতে দিল্লি পাঠাইনি। সে নিজেই গিয়েছিল। তাছাড়া এ ধরনের নোংরা কাজ আমার কোম্পানি করে না।

দেখলাম, অমরজিৎ সিনহার স্মার্টনেস ভেঙে যাচ্ছে ক্রমশ। কর্নেল বললেন, আপনার বউমাকে আপনি কেন পছন্দ করেন না মিঃ সিনহা?

অমরজিৎ গলার ভেতর বললেন, বিশ্বজিতের নির্বুদ্ধিতা! ওই সর্বনাশী মেয়েটার ফাঁদে পড়েছিল। গোড়া থেকেই ওকে সন্দেহ করেছিলাম, কেউ বা কারা ওকে আমার কারবারের খোঁজখবর যোগাড় করার জন্য বিশ্বজিতের কাঁধে চাপিয়ে দিয়েছে। এখন সন্দেহ হচ্ছে, মেয়েটা আসলে চোর। দিল্লির ন্যাশনাল আর্কাইভে রাখা নবাবি রত্ন হাতানোর জন্যই সে বিশ্বজিৎকে কাজে লাগিয়েছিল।

একটু খুলে বলুন মিঃ সিনহা! আর্কাইভে কি বিশ্বজিতের কিংবা আপনার কোম্পানির কোনও চর কর্নেল একটু হেসে বললেন, দুঃখিত। চর না বলে লোক কথাটা বরং ব্যবহার করছি।

অমরজিৎ এবার একটু চটে গেলেন। আপনার জানা উচিত, আর্কাইভে গচ্ছিত রাজা-বাদশা-নবাবদের রত্ন নিয়ে অনেক সময় তাদের উত্তরাধিকারীরা মামলা করেন। মামলায় জিতলে সেই রত্ন তারা ফেরত পান এবং নিলামে বিক্রির ব্যবস্থা করেন। তাই আমাদের এদিকে লক্ষ্য রাখতে হয়। সম্প্রতি ফতেপুরের নবাবের এক বংশধর সুপ্রিমকোর্টে মামলায় জিতেছেন। তাঁর পূর্বপুরুষের পাগড়ির রত্ন শীগগির সরকার তাঁকে ফেরত দিতেন। আজ কাগজে পড়লাম, সেই রত্ন আর্কাইভ থেকে চুরি গেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের তাই নড়ে ওঠারই কথা।

হ্যাঁ। কাগজে সেই আভাস আছে।

অমরজিৎ আবার স্মার্ট হয়ে উঠলেন। কোন হোটেলে ওই মেয়েটা আছে জানতে চাই কর্নেল সরকার!

বলছি। আপনার ছেলের চিঠিটা দয়া করে ফেরত দিন মিঃ সিনহা।

এক মিনিট। এটার জেরক্স কপি করিয়ে ফেরত দিচ্ছি। অমরজিৎ টেবিলে সুইচ টিপে একজন বেয়ারাকে ডাকলেন। তাকে চিঠিটার জেরক্স কপির হুকুম দিয়ে বললেন, এবার হোটেলের নাম-ঠিকানা দিন!

হোটেল প্যারামাউন্ট। এখান থেকে কাছেই। যতটা জানি, বড় হোটেল নয়। বিদেশি ট্যুরিস্টরাই ওঠে সেখানে।

ওই ধরনের হোটেলে বিশ্বজিৎ উঠেছিল। অবিশ্বাস্য! অসম্ভব! ওই মেয়েটাই–

কর্নেল তার কথার ওপর বললেন, মিঃ সিনহা! আপনার ছেলে নিখোঁজ হয়েছে। অথচ আমার অবাক লাগছে, আপনি ব্যাপারটা আমল দিচ্ছেন না। এর কি কোনও বিশেষ কারণ আছে?

অমরজিৎকে আবার বিব্রত দেখাল। কিন্তু তা সামলে নিয়ে বললেন, আমার ছেলের ব্যাপারে আমার নিজস্ব পথে চলবে। সে নিয়ে আপনার চিন্তার কারণ নেই।

বুঝলাম না।

সে নিখোঁজ হয়েছে এ কথা আমি বিশ্বাস করি না। ওই শয়তানি মেয়েটা আপনাকে নিশ্চয় একটা গাঁজাখুরি গল্প বলেছে। অমরজিৎ শক্ত মুখে ফের বললেন, চিঠিটা পড়ে মনে হলো বিশ্বজিৎ ওর স্বরূপ জানতে পেরে হোটেল থেকে পালিয়ে গেছে।

কিন্তু সে বাড়ি ফেরেনি।

অমরজিৎ টেলিফোন তুলে ডায়াল করলেন। তারপর চাপাস্বরে বললেন, মাধব? আমি বলছি। বিশ্বজিৎ কি ফিরেছে?…ঠিক আছে। রাখছি। ফোন রেখে অমরজিৎ কর্নেলকে বললেন, কিছুক্ষণ আগে বিশ্বজিৎ বোম্বে থেকে ফোনে জানিয়েছে, হঠাৎ একটা কাজে তাকে দিল্লি থেকে বোম্বে যেতে হয়েছে। আগামী পরশু বা তার পরের দিন ফিরবে। এবার বলুন, আপনার কী বলার আছে?

কর্নেল তুম্বোমুখে বললেন, হ্যাঁ। তাহলে কিছু বলার নেই।

এই সময় বেয়ারা সেই চিঠিটার জেরক্স কপি করে নিয়ে এল। অমরজিৎ জেরক্স কপিটা রেখে আসলটা কর্নেলকে ফেরত দিলেন। বাঁকা হেসে বললেন, চিঠিটার তলায় বা ওপরে তারিখ লেখা নেই। কাজেই বোঝা যাচ্ছে, দিল্লিতে চিঠিটা লিখে রেখে শয়তানি মেয়েটার হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে বোম্বে কেটে পড়েছে বিশ্বজিৎ। যাই হোক, আমি হোটেল প্যারামাউন্টে খোঁজ নিচ্ছি। আপনি এবার আসতে পারেন। আমি ব্যস্ত।…

নিচে নেমে পার্কিং জোনের দিকে যাবার সময় বললাম, লোকটা সত্যি বদমেজাজি আর কুচুটে। অভদ্র!

কর্নেলকে খুব গম্ভীর দেখাচ্ছিল। গাড়িতে ঢুকে বললেন, কুইক জয়ন্ত! প্যারামাউন্টে যেতে হবে। আমি শর্টকাটে যেতে চাই। বাঁদিকের ওই গলিতে ঢোকো।

বরাবর দেখে আসছি, কলকাতার নাড়িনক্ষত্র কর্নেলের একেবারে নখদর্পণে। মাঝে মাঝে মুখ তুলে পথের নির্দেশ দিচ্ছিলেন এবং সেই চিঠিটা খুলে এবার আতস কাচ দিয়ে দেখছিলেন উনি। কী অদ্ভুত! কর্নেল পকেটে আতস কাচ নিয়ে ঘোরেন জানতাম না। আবার একটা ঘোরালো গলি দিয়ে এগিয়ে সংকীর্ণ রাস্তায় পৌঁছুলাম। এতক্ষণে উনি চিঠি এবং আতস কাচ পকেটস্থ করে আপনমনে বললেন, গো টু আওয়ার হাউস! কেন? গো টু আওয়ার হোম নয় কেন?

বললাম, হাউস যা, হোমও তা-ই।

নাহ্ ডার্লিং! হোম, সুইট হোম। স্বামী তার স্ত্রীকে হোমে ফিরে যেতে বলবে, এটাই স্বাভাবিক।

চমকে উঠলাম। তার মানে, চিঠিটা বিশ্বজিৎ কি চন্দ্রপ্রভাকে লেখেননি?

সম্ভবত। তাছাড়া কোনও সম্বোধনহীন চিঠি।

 তাহলে অমরজিৎ সিনহার কথা ঠিক। সর্বনাশী মেয়ে। সাংঘাতিক

কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন, ব্যালেনর্তকীরা সাংঘাতিক নাচের কসরত দেখায়। তো–এখানেই গাড়ি রাখো। পার্কিংয়ের মতো জায়গা আর এখানে পাবে না। আমাদের ডাইনে প্যারামাউন্ট হোটেল।

সংকীর্ণ রাস্তার ধারে পাঁচতলা একটা পুরনো হোটেল। সায়েব-মেমসায়েবদের আনাগোনা দেখা যাচ্ছিল। কম খরচে অনেক বেশি ঘুরে বেড়াতে ওরা এ ধরনের আস্তানা বেছে নেয় দেখেছি। ছোট্ট রিসেপশন কাউন্টারে ঢুকে কর্নেল বললেন, ৬ নম্বর রুমে মিসেস চন্দ্রপ্রভা সিনহা কি আছেন, না বেরিয়েছেন?

রিসেপশনিস্ট অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান তরুণী বলল, ৬ নম্বর? ওঁরা তো একটু আগে চেক আউট করলেন।

ওঁরা মানে–মিঃ এবং মিসেস সিনহা দুজনেই?

 হ্যাঁ।

রুমটা কি কেউ বুক করেছেন?

তরুণী হাসল। প্যারামাউন্টে কোনও রুম খালি থাকে না।

কর্নেল একটু ইতস্তত করে বললেন, মিসেস সিনহার সঙ্গে যিনি চেক আউট করলেন, তিনিই মিঃ সিনহা কি না আপনি নিশ্চিত?

রিসেপশনিস্ট তরুণী একটু বিরক্ত হল। অত কিছু জানা আমার কর্তব্য নয়। কারও মুখ আমি মনে রাখি না।

কোনায় বসে জিনসব্যাগি শার্টপরা এক তরুণ কানে ওয়াকম্যানের নল খুঁজে মিউজিক শুনছিল এবং কর্নেলকে লক্ষ্য করছিল। কর্নেল ঘুরে পা বাড়িয়েছেন, হঠাৎ সে ওয়াকম্যান খুলে ডাকল, হাই! আপনি কি কোনও কর্নেল? ৬ নম্বরের ভদ্রমহিলা আমাকে আপনার চেহারার বর্ণনা দিয়ে গেছেন। আপনার জন্য একটা মেসেজ আছে।

কর্নেল বললেন, আমিই কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।

সে টেবিলের ড্রয়ার থেকে খামে আঁটা একটা চিঠি বের করে কর্নেলকে দিয়ে বলল, আপনি এলে এটা উনি আপনাকে দিতে বলেছেন।

কর্নেল গাড়িতে ঢুকে খামের মুখ ছিঁড়ে চিঠিটা বের করলেন। জিজ্ঞেস করলাম, কী লিখে গেছে?

বৃদ্ধ রহস্যভেদী গলার ভেতর আবৃত্তির ভঙ্গিতে বললেন, বিশ্বজিৎ কেম ব্যাক অ্যাট অ্যাবাউট ইলেভেন ওক্লক অ্যান্ড সো উই আর চেকিং আউট ফ্রম প্যারামাউন্ট। থ্যাংক্স।..

.

০৩.

কিছুক্ষণ পরে দেখি ক্যামাক স্ট্রিটে পৌঁছেছি। কিন্তু প্রচণ্ড জ্যাম। সব গাড়ি জট বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। কর্নেল গম্ভীর এবং চোখ বুজে চুরুট টানছে। পাশেই এক ট্যাকসিচালকের অতিশয় ক্ষুব্ধ বাক্যালাপ থেকে বুঝলাম, পার্ক স্ট্রিটে কোনও ভি ভি আই পি-র কনভয় পাস না করা পর্যন্ত রাস্তা খুলবে না। আমিও খাপ্পা হয়ে বলে উঠলাম, আমরাও ফেঁসে গেলাম তাহলে?

কর্নেল চোখ খুলে আমার দিকে একবার তাকালেন মাত্র। মুখে তেমনই গাম্ভীর্য জমজমাট। কতক্ষণ পরে গাড়িগুলোর চাকা আবার গড়াতে শুরু করেছিল, হিসেব করিনি। একখানে পৌঁছে কর্নেল সোজা হয়ে বসে বললেন, বাঁপাশে গাড়ি রাখো জয়ন্ত! এসে গেছি।

অনেক ঝামেলার পর ফুটপাত ঘেঁষে গাড়ি দাঁড় করিয়ে বললাম, এখানে কোথায় যাবেন?

ব্রাইট অকশন হাউস। এই দেখ, সিনহা ট্রেডার্সের নিলামঘর। বলে কর্নেল নেমে দাঁড়ালেন।

কোনও কথা না বলে ওঁকে অনুসরণ করলাম। সেকেলে বিশাল দোতলা বাড়ি। সিঁড়ির ধাপের মাথায় চওড়া দরজা। টুলে বসেছিল উর্দিপরা বন্দুকধারী একজন গার্ড। আমাদের দেখে সে বলে উঠল, আজ অকশন ডে নেহি সাব! কাল দশ বাজে আইয়ে!

কর্নেল বললেন, ম্যানেজারসাবকা সাথ অ্যাপয়েন্টমেন্ট হ্যায়।

 তো যাইয়ে।

সম্ভবত কর্নেলের সায়েবি চেহারা, তাগড়াই গড়ন, দাড়ি ও টুপি দেখে তার ভক্তি হয়েছিল। একটু পরে হলঘরের পাশের একটা কেবিনে ম্যানেজারসায়েবকে পাওয়া গেল। তিনি বাঙালি। নেমপ্লেটে লেখা ছিল পি কে দত্ত। কর্নেল সটান ঢুকতেই তিনি অবাক হয়ে তাকালেন। কর্নেল বাংলায় বললেন, মিঃ বিশ্বজিৎ সিনহার সঙ্গে এখানে আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।

ম্যানেজার বললেন, জুনিয়র মিঃ সিনহার সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট? আপনি নিশ্চয় তারিখ ভুল করেছেন স্যার!

না তো! আজ পৌনে বারোটা থেকে বারোটার মধ্যে

 কিন্তু উনি তো কাল বিকেলে দিল্লি থেকে ফিরে এখানে এসেছিলেন। তারপর নিউ আলিপুরে ওঁদের বাড়ি চলে যান। আজ সকালে ফোন করে জানলাম উনি বোম্বাই চলে গেছেন।

কর্নেল একটু ইতস্তত করে বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ! আমার একটু ভুল হয়েছে। উনি বলেছিলেন, যদি দৈবাৎ ওঁকে না পাই, ওঁর এক বন্ধুকী যেন নামটা তার এখানে থাকার কথা। তার সঙ্গে কথা বললেও চলবে বলেছিলেন।

ম্যানেজার হাসলেন। বুঝেছি। আপনি মিঃ দেববর্মনের কথা বলছেন। আমাদের কোম্পানির হংকং ব্রাঞ্চের ম্যানেজার!

কর্নেলও হাসলেন। ঠিক, ঠিক। মিঃ দেববর্মন। আসলে বয়স মানুষের স্মৃতি গোলমাল করে দেয়। তো উনি কি আছে?

মিঃ দেববর্মন আছেন। জাস্ট এ মিনিট। বলে ম্যানেজার টেলিফোন তুলে ডায়াল করলেন। একটু পরে বললেন, রিং হচ্ছে। কেউ ধরছে না। হয়তো উনি বাথরুমে আছেন।

ঠিক আছে। আমরা অপেক্ষা করছি।

ফোন রেখে ম্যানেজার বললেন, আপনারা ওপরে গিয়েও অপেক্ষা করতে পারেন। দোতলায় কোম্পানির গেস্ট হাউস। হল থেকে বেরিয়ে পাশের করিডরে ঢুকলে সিঁড়ি দেখতে পাবেন।

আর একটা কথা মিঃ দত্ত! মিসেস চন্দ্রপ্রভা সিনহা আমার পরিচিত। তারও এখানে থাকার কথা ছিল। তিনি কি মিঃ সিনহার সঙ্গে চলে গেছেন?

না মিসেস সিনহা কিছুক্ষণ আগে এসেছিলেন। মিঃ সিনহার সঙ্গে ওঁর দেখা হয়নি।

উনি কি দোতলার গেস্ট হাউসে আছেন?

না। এইমাত্র চলে গেলেন। মিনিট দশেক আগে এলে ওঁর দেখা পেতেন। ম্যানেজার অমায়িক হাসলেন। মিঃ সিনহার বড় ভুলো মন। তাছাড়া ব্যস্ত মানুষ। নিজের কিছু দামি জিনিসপত্র আমাকে রাখতে দিয়ে গেছেন। তার সঙ্গে ভুল করে স্ত্রীর জুতোর বাক্সওতো মিসেস সিনহা জুতোর বাক্স খুঁজতে এসেছিলেন। দিল্লিতে কেনা দামি বিদেশি জুতো। হাউ ফানি! মিসেস সিনহা রেগে আগুন। জুতো ফেরত পেয়ে তবে শান্ত হলেন।

কর্নেল ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। জুতোর বাক্স নিতে এসেছিলেন মিসেস সিনহা? এদিকে আমাকে ফোন করে বলেছিলেন, ব্রাইট অকশন হাউসে মিঃ সিনহার সঙ্গে থাকবেন। এস জয়ন্ত! আমরা মিঃ দেববর্মনের সঙ্গে দেখা করি।

কর্নেল হন্তদন্ত হেঁটে হলঘর থেকে বেরিয়ে পাশের করিডরে ঢুকলেন। কাঠের সিঁড়িতে বিবর্ণ কার্পেট বিছানো আছে। হতবাক হয়ে ওঁকে অনুসরণ করছিলাম। ব্রিটিশ আমলে তৈরি এসব বাড়ির ছাদ খুব উঁচু। দোতলায় চওড়া করিডরের একপাশে একটা ঘরের দরজায় পর্দা ঝুলছে। পর্দা সরিয়ে কর্নেল কপাট ঠেলতেই দরজা খুলে গেল। সুসজ্জিত ড্রয়িং রুমে ঢুকে উনি থমকে দাঁড়ালেন। আপনমনে আবৃত্তি করলেন, প্লিজ ডোন্ট বি ওয়ারিড। চেক আউট ফ্রম দি হোটেল অ্যান্ড গো টু আওয়ার হাউস। হ্যাঁ–হাউস মানে অকশন হাউস। তারপর উনি এগিয়ে গিয়ে বাঁদিকের দরজার পর্দা তুলে কপাট ঠেললেন। উঁকি মেরেই বলে উঠলেন, ও মাই গড!

চমকে উঠে বললাম, কী ব্যাপার?

কড়িকাঠ থেকে কেউ ঝুলছে!

আঁতকে উঠে উঁকি দিলাম। অনেক উঁচুতে লোহার বিম থেকে গলায় শাড়ির ফাসবাঁধা একটা দেহ ঝুলছে। দেহটা একজন পুরুষের। পরনে প্যান্ট-শার্ট। দেখামাত্র পিছিয়ে এসে বললাম, সুইসাইড!

কর্নেল তখনই দরজা আটকে দিলেন। বললেন, সুইসাইড নয় জয়ন্ত! একজন ব্যালেনর্তকী অনেক শারীরিক কসরত জানে। যাই হোক। কুইক! নিচে গিয়ে মিঃ দত্তকে পুলিশে খবর দিতে বলি। চলে এসো।…

কিন্তু আরও অদ্ভুত এবং বিস্ময়কর ঘটনা দেখতে তখনও বাকি ছিল আমার। ব্রাইট অকশন হাউসের ম্যানেজার মিঃ দত্ত কর্নেলের মুখে কথাটা শুনেই পুলিশে খবর দিয়েছিলেন। তবে কর্নেল ওঁকে হইচই বাধাতে এবং কাউকে জানাতে নিষেধ করেছিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ এসেছিল। কিন্তু দোতলার সেই ঘরে ঝুলন্ত এবং গলায় শাড়ির ফাঁস আটকানো দেববর্মনকে পাওয়া যায়নি। ম্যাজিকের মতো তার লাশ কিংবা তিনি অদৃশ্য হয়েছিলেন।

অর্থাৎ আত্মহত্যা বা ঝুলন্ত লাশ নেহাত সাজানো। দোতলার গেস্ট হাউসের সবগুলিই ফ্রেঞ্চ জানালা। গরাদহীন এবং কাচের জানালার ওপর পুরু পর্দা ঝোলানো। জানালা গলিয়ে হাত তিনেক দূরে পাইপ আঁকড়ে নিয়ে নেমে যাওয়া সহজ। নিচে একটা মোটর গ্যারাজের করোগেটেড শিটের ছাউনি ছিল। কাজেই দেববর্মনের পালিয়ে যেতে একটুও অসুবিধে হয়নি।

কিন্তু ওইভাবে সাজানো লাশের কারচুপির কারণ কী? কর্নেল বলেছিলেন, নবাবি রত্ন বাটপাড়ি করে চন্দ্রপ্রভা যাতে কলকাতা ছেড়ে নির্বিবাদে পালিয়ে যেতে পারে, তার জন্য সময়ের দরকার ছিল। ঝুলন্ত লাশ নিয়ে আমি ব্যস্ত হব এবং মাথা ঘামাব। এতে চন্দ্রপ্রভা যথেষ্ট সময় পাবে।

 তাহলে দেখা যাচ্ছে দেববর্মন চন্দ্রপ্রভার জুটি।

 তা আর বলতে? বিশ্বজিৎ নিশ্চয় চন্দ্রপ্রভাকে সন্দেহ করেছিলেন কোনও কারণে। কিন্তু তার পক্ষে দেববর্মনকে বিশ্বাস করার যুক্তি আছে। এই লোকটি তাদের কর্মচারী। তাদের হংকং ব্রাঞ্চের ম্যানেজার। যাই হোক, বিশ্বজিৎকে মুখোমুখি পেলে সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে।

কর্নেল পুলিশ এবং কাস্টমসকে এয়ারপোর্ট, রেলস্টেশন, হাইওয়ে সর্বত্র নজর রাখতে বলেছিলেন। কিন্তু সন্ধ্যা অব্দি না চন্দ্রপ্রভা, না দেববর্মন কারও পাত্তা মেলেনি। বুঝতে পারছিলাম, অন্তত চন্দ্রপ্রভা কলকাতা থেকে পালানোর। যথেষ্ট সময় পেয়েছিল।

কিংবা কলকাতার মতো বড় শহরে কোথাও হয়তো দুজনে গা-ঢাকা দিয়ে আছে। আমার মাথায় শুধু একটা প্রশ্ন শেষাবধি উত্ত্যক্ত করছিল। কেন চন্দ্রপ্রভা কর্নেলের শরণাপন্ন হয়েছিল এবং সে কর্নেলকে চিনল কী ভাবে?

কর্নেল বলেছিলেন, বিশ্বজিৎ সিনহাই এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারেন। দেখা যা।…

পরদিন সকালে আমার সল্টলেকের ফ্ল্যাটে টেলিফোনে কর্নেলের জরুরি তলব পেয়ে তাঁর ইলিয়ট রোডের তিনতলার অ্যাপার্টমেন্টে হাজির হলাম। তখন প্রায় দশটা বাজে। তার ড্রয়িং রুমে ঢুকে দেখি, অমরজিৎ সিনহা এবং আমার বয়সী এক রোগাটে চেহারার যুবক বসে আছে। তাকে ঝোড়ো কাকের মতো দেখাচ্ছিল।

অমরজিৎ আমাকে দেখেই বললেন, আপনি রিপোর্টার। কর্নেল সরকারকেও অনুরোধ করেছি। আপনাকেও করছি, প্লিজ আপনার কাগজে এমন কিছু লিখবেন না, যাতে আমার কারবারের বদনাম হয়। আমার এই নির্বোধ পুত্রের জন্যই এমন একটা কদর্য ঘটনা ঘটে গেছে। রমেশ দেববর্মন যে এমন সাংঘাতিক লোক জানতাম না। তারই পরামর্শে বিশ্বজিৎ চোরাই নবাবি রত্ন কিনতে দিল্লি গিয়েছিল। আর ওই সর্বনাশী মেয়েটা

কর্নেল তাকে থামিয়ে দিয়ে একটু হেসে বললেন, আপনি প্রবীণ, অভিজ্ঞ মানুষ। আপনার পুত্র যুবক। একজন সুন্দরী ব্যালেনর্তকীর প্রেমে পড়ে তাকে বিয়ে করে ফেলা এ বয়সে খুবই স্বাভাবিক।

বিশ্বজিৎ কুণ্ঠিতভাবে বললেন, আমি বুঝতে পারিনি দেববর্মনই আমাকে কাঁদে ফেলেছিল। চন্দ্রপ্রভাকে আমি বিয়ে করেছিলাম বটে, কিন্তু দেববর্মনই বোম্বেতে তার সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। তো চন্দ্রপ্রভাকে আমি চোরাই মালের কথা জানাইনি। জানত শুধু দেববর্মন। কারণ আমাকে সে-ই ওটা কিনিয়েছিল। প্যারামাউন্টে ওঠাও তারই পরামর্শে। ওখানে নাকি বিদেশি খদ্দের সে যোগাড় করে দেবে।

জিজ্ঞেস করলাম, চন্দ্রপ্রভাকে বিপদের কথা বলে কর্নেলের কার্ড দিয়ে আপনি

বিশ্বজিৎ দ্রুত বললেন, নাহ্ মিঃ চৌধুরি। ঘটনাটা হল, প্যারামাউন্টে ওঠার পর বাথরুমে গিয়েছিলাম। তারপর বেরিয়ে এসেই দেখি, চন্দ্রপ্রভা জুতোর বাক্স খুলেছিল। সদ্য বন্ধ করছে। ওপরে লেডিস জুতো ছিল। বলল, আমার জন্য এই জুতো কিনেছ। আমাকে দেখাওনি কেন? কিন্তু তার মুখ দেখে বুঝলাম, সে জেনে গেছে ভেতরে কী আছে। একটু পরে হঠাৎ তার চেহারা বদলে গেল। সে আমাকে ব্ল্যাকমেলের হুমকি দিতে থাকল। তাকে বুঝিয়ে শান্ত করলাম। দেববর্মন ছিল ৫ নম্বর রুমে। বেগতিক দেখে তাকে ডাকব ভাবছি, সেই সময় চন্দ্রপ্রভা বাথরুমে ঢুকল। সুযোগ পেয়ে আমার প্যাডে দেববর্মনকে একটা চিঠি লিখে ফেললাম। কিন্তু লেখার পর হঠাৎ মনে হলো, দেববর্মনও যদি রত্নের লোভে আমাকে ব্ল্যাকমেল করে? আমার মাথার ঠিক ছিল না। জুতোর বাক্স আর আমার ব্রিফকেসটা নিয়ে তখনই হোটেল থেকে কেটে পড়লাম।

কর্নেল বললেন, চন্দ্রপ্রভা আপনার চিঠিটা কাজে লাগাতে চেয়েছিল। বোঝা যাচ্ছে, দেববর্মনের সঙ্গে পরামর্শ করেছিল সে। এরপর দেববর্মন আপনাদের অকশন হাউসে চলে যায়। কাল সকালে সে প্যারামাউন্ট থেকে চন্দ্রপ্রভাকে নিয়ে আসে অকশন হাউসে। চন্দ্রপ্রভা ম্যানেজার মিঃ দত্তের কাছে জুতোর বাক্সের কথা জিজ্ঞেস করে। এটা স্বাভাবিক। অকশন হাউসেই চোরাই মাল রাখা আপনার পক্ষে নিরাপদ, তা সে জানত।

হ্যাঁ। অকশন হাউস সম্পর্কে তাকে বোকার মতো অনেক গোপন কথা কত সময় বলেছি!

অমরজিৎ ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, তুমি একটা প্রকাণ্ড মূর্খ।

কর্নেল হাসলেন। স্ত্রীর কাছে স্বামীর কোনও কথা গোপন থাকে না। বিশেষ করে স্ত্রী যদি বেশি কৌতূহলী হয়। তা চন্দ্রপ্রভার উদ্দেশ্যই ছিল চোরাই নবাবি রত্ন হাতানো। তবে মিঃ দত্তের দোষ নেই। জুতোর বাক্সতে কী আছে উনি কেমন করে জানবেন?

অমরজিৎ বললেন, যা হবার হয়ে গেছে। এখন কর্নেলসায়েবকে অনুরোধ করছি, আমার এই নির্বোধ পুত্রের জন্য আমি যাতে ফেঁসে না যাই। আপনি আমাকে বাঁচান! কারণ আমার ধারণা, পুলিশ বা অন্য কেউ ভেতরকার ঘটনাটা এখনও জানে না।

কর্নেল বললেন, চেষ্টা করব। তবে আপনি আপনার ছেলেকে সতর্ক করে দিন।

 অবশ্যই। অমরজিৎ পুত্রের উদ্দেশে কিছুক্ষণ কটুক্তি বর্ষণ করে বিদায় নিলেন।

বললাম, সবই বোঝা গেল। শুধু বোঝা গেল না চন্দ্রপ্রভা আপনার শরণাপন্ন হলো কেন? আপনার পরিচয়ই বা পেল কোথায়?

কর্নেল বললেন, সে চোরাই নবাবি রত্ন উদ্ধার করতে চেয়েছিল।

অবাক হয়ে বললাম, তার মানে?

 কারণ তার শরীরে ফতেগঞ্জের নবাবি রক্ত আছে। চন্দ্রপ্রভার আসল নাম জিনাত বেগম। চন্দ্রপ্রভা নাম সে ব্যালেনর্তকী হিসেবে নিয়েছিল। কাল রাত্রে টেলিফোনে সে আমাকে সব কথা খুলে বলেছে। দেববর্মন তার প্রেমিক। বাকিটা তুমি নিজেই বুঝতে পারবে।

কিন্তু ওই নবাবি রত্ন তো কেন্দ্রীয় সরকারের সম্পদ হয়ে গেছে!

ভুলে যাচ্ছ ফতেপুরের নবাববংশীয়রা সুপ্রিম কোর্টে মামলায় জিতেছেন। কাজেই সব নবাবি জুয়েলস সরকার এবার তাদের ফেরত দিতে বাধ্য। বলে কর্নেল ঘড়ি দেখলেন। হারি আপ জয়ন্ত! বারোটা পঁয়ত্রিশে হাওড়া স্টেশনে আমাকে উপস্থিত থাকতে হবে। এগারোটা বেজে গেছে। উঠে পড়ো!..

প্রচণ্ড জ্যাম সারা পথ। ৯ নম্বর প্ল্যাটফর্মে ঢোকার গেটে যখন দুজনে পৌঁছুলাম, তখন বারোটা বাজে। কিছুক্ষণ পরে গেটের কাছে বোরখাপরা এক মুসলিম মহিলা এসে থমকে দাঁড়ালেন। মুখের ওপর ঝোলানো সূক্ষ্ম পর্দার জাল তুলে কর্নেলকে আদাব দিতেই চমকে উঠলাম। সেই বিশ্বসুন্দরী!

তার এক হাতে ছোট্ট লাগেজ, অন্য হাতে একটা জুতোর বাক্স।

 কর্নেল মৃদুস্বরে বললেন, কাস্টমস অফিসার মিঃ দুবে সদলবলে আপনাকে অনুসরণ করছেন কিন্তু!

দিল্লিতে পৌঁছে আমি সোজা ন্যাশনাল আর্কাইভে চলে যাব। আমার পূর্বপুরুষের রত্ন ফেরত দেব।

মিঃ দেববর্মনের খবর কী?

বিশ্বসুন্দরী হাসলেন। প্লেনে কালই চলে গেছে সে। অবশ্য তাকে দাড়ি কামাতে হয়েছে।

কিন্তু আমার শেষ প্রশ্নের জবাব দিয়ে যান জিনাত!

কর্নেলসায়েব! আপনি ভুলে গেছেন আমার চাচা মির্জা আব্বাস আলি বেগ আপনার পরিচিত। ফতেগঞ্জে আমাদের বাড়িতে আপনি একবার অতিথি ছিলেন।

মাই গুডনেস! কর্নেল চঞ্চল হয়ে উঠলেন।

সেই সময় বোরখার মুখের জালি নামিয়ে নবাবনন্দিনী দ্রুত চলে গেলেন। প্ল্যাটফর্মের ভেতরে। দেখলাম, কর্নেল টুপি খুলে টাক চুলকোচ্ছেন। মুখটা বেজায় গম্ভীর। বললাম, আর কী? চলুন, ফেরা যাক।

কর্নেল মৃদুস্বরে শুধু বললেন, হ্যাঁ। চলো!..