কুয়াশার রঙ নীল

কুয়াশার রঙ নীল

সূত্রপাত

 জয়দীপ অভ্যাসমতো খুব ভোরে ময়দানে জগিং করতে এসেছিল। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি কলকাতার বুকের ভেতরটা তত কিছু ঠাণ্ডা নয়। কিন্তু ময়দানের খোলামেলায় শীতের মুখোমুখি পড়তে হয়। এ দিন কুয়াশাও ছিল ঘন।

অন্যদিন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনাসামনি কোথাও গাড়ি রেখে জয়দীপ ময়দানে যায়। আজ সে গেল রেড রোডে।

গত দুদিনই কিছু বিরক্তিকর ঘটনা ঘটেছে। এক ধরনের টিজিং বলা চলে। পরনে নীলচে রঙের হাফস্লিভ ব্যাগি সোয়েটার এবং জি, গলায় সোনালি চেন, মাথার লম্বা চুল ঘাড়ের কাছে গোছা করে বাঁধা এক যুবক জয়দীপের সঙ্গে বেয়াড়া রসিকতা করেছে। জগিংয়ের সময় কখনও সে জয়দীপের প্রায় পিঠের কাছে, কখনও তার পাশাপাশি, আবার কখনও হঠাৎ এগিয়ে গিয়ে এক চক্কর ঘুরে আবার পাশে চলে এসেছে। বিশেষ করে পাশাপাশি দৌড়নোর সময় জয়দীপের গা ঘেঁষে চলে আসা বেশি বিরক্তিকর।

জয়দীপ শান্তশিষ্ট ভদ্র প্রকৃতির বলেই কোনও প্রতিবাদ করেনি। গতকাল একবার শুধু বলেছিল, কী হচ্ছে?

লেটস্ হ্যাভ ফান, ম্যান?

তারপর আর কোনও কথা নয়। বিরক্ত জয়দীপ তার গাড়ির কাছে ফিরে গিয়েছিল। ইংরেজি উচ্চারণ শুনে এবং চেহারা দেখে জয়দীপের মনে হয়েছিল যুবকটি সম্ভবত অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। জয়দীপের চেয়ে ফর্সা চামড়া। কিন্তু একটু পোড়খাওয়া, রুক্ষ, লাবণ্যহীন। চোখের দৃষ্টিতে কৌতুকের আড়ালে কেমন যেন নিষ্ঠুরতা ওত পেতে আছে। একটু গা ছমছম করছিল জয়দীপের।

আজ রেড রোডে পৌঁছে গাড়ি ঘুরিয়ে ময়দানের দিকের ফুটপাত ঘেঁষে দাঁড় করাল জয়দীপ। তারপর চাবি এঁটে বাঁদিকে ময়দানে গেল। জগিং শুরু করল। এদিকটাতেও স্বাস্থ্যকামীদের আনাগোনা আছে। ঘন কুয়াশার ভেতর কাছে ও দূরে সঞ্চরমান কিছু ছায়ামূর্তি চোখে পড়ল তার। প্রায় মিনিট কুড়ি একটানা দৌড়নোর পর শরীরে উষ্ণতা ফিরে এল। জয়দীপ রেড রোডের দিকে সারবদ্ধ গাছের কাছাকাছি একটু থামল। তখনই তার চোখে পড়ল গাছের নিচে শুকনো নালায় একটা মোটরসাইকেল দাঁড়িয়ে আছে।

এভাবে মোটরসাইকেল রাখাটা অদ্ভুত। ফুটপাতের ধার ঘেঁষে এবং ওপরেও কিছু গাড়ি ও মোটরবাইক রাখা আছে। কিন্তু নালায় ওটা রাখার মানে কী? বেশি সতর্কতা?

তবে এ নিয়ে মাথা ঘামানোর মানে হয় না। জয়দীপ আর এক চক্কর দৌড় শুরু করল নালার সমান্তরালে। প্রায় শদুই মিটার দৌড়নোর পর হঠাৎ সে দেখল সেই বখাটে যুবকটি তার দিকেই এগিয়ে আসছে। কুয়াশার মধ্যেও চিনতে ভুল হয়নি জয়দীপের। জয়দীপ বাঁদিকে ঘুরল কিন্তু ততক্ষণে যুবকটি তার পাশে এসে গেছে।

আজ জয়দীপ বেয়াদপি বরদাস্ত করতে পারল না। সে থমকে রুখে দাঁড়াল ঘুষি মারার জন্য। অমনই তার ক্লান্ত ও স্পন্দিত হৃদপিণ্ডে একঝলক রক্ত উপচে এল যেন।

যুবকটির হাতে ছোরা।

সে ঝাঁপিয়ে পড়ার ভঙ্গিতে কাছে আসার সঙ্গে সঙ্গে জয়দীপ মাথার ঠিক রাখতে পারল না। আশেপাশে মানুষজন ছুটে যাচ্ছে। কিন্তু কুয়াশার জন্যই কেউ হয়তো সন্দেহজনক কিছু ঘটতে দেখছে না। জয়দীপ তার গাড়ি লক্ষ্য করে দৌড়তে থাকল। এ দৌড় জগিং নয় প্রাণভয়ে ছুটে পালানো।

যুবকটি তাকে অনুসরণ করেছে।

জয়দীপ এক লাফে নালা পেরিয়ে ফুটপাতে পৌঁছল। আততায়ী তখন তার পিছনে কয়েক হাত দূরে। ঘুরে দেখামাত্র দিশেহারা জয়দীপ রেড রোডে গিয়ে পড়ল।

তারপরই ঘটে গেল একটা সাংঘাতিক দুর্ঘটনা। ব্রেকের কুৎসিত ও বিপজ্জনক শব্দ স্তব্ধতা খান খান করে ফেলল।

এই রাস্তায় সব গাড়িই দ্রুত যাতায়াত করে। কুয়াশার জন্য ভোরে সব গাড়িরই হেডলাইট জ্বলে। যে গাড়িটা জয়দীপকে ধাক্কা দিল, তার কোনও আলো ছিল না এবং সেটা একটা ট্রাক। জয়দীপের শরীর ছিটকে গিয়ে পড়ল ফুটপাতের ওপর। ট্রাকটা কুয়াশার মধ্যে দ্রুত উধাও হয়ে গেল।

শব্দটা শুনেই স্বাস্থ্যকামীদের অনেকে চমকে উঠেছিল। তারা হইচই করে দৌড়ে এল। সেই যুবকটি তখন জয়দীপের থ্যাতলানো রক্তাক্ত শরীরের ওপর ঝুঁকে পড়েছে।

দেখতে দেখতে ভিড় জমে গেল। কেউ কেউ দাঁড় করানো গাড়িগুলোর কাছে ছুটে গিয়েছিল। জয়দীপকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য স্বাভাবিক মানবিক আকুতিতে। কিন্তু সব গাড়িই লক করা। একটা গাড়িতে ড্রাইভার ছিল। কিন্তু তাকে টলানো গেল না। তার মালিক ময়দান থেকে না ফেরা পর্যন্ত কিছু করার নেই। চাকরি চলে যাবে।

জয়দীপের গাড়ির পেছনে একটা গাড়ি ছিল। এই গাড়িতে ছিলেন এক প্রৌঢ় এবং একজন যুবক। যুবকটি ছিল স্টিয়ারিঙে। দুর্ঘটনার ব্যাপারটা বুঝতে তাদের একটু সময় লেগেছিল। বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গে প্রৌঢ় বলে উঠেছিলেন, কুইক! কুইক! হাঁ করে কী দেখছ?

গাড়িটা জোরে এগিয়ে জয়দীপের কাছে পৌঁছল। তারপর যুবকটি বলে উঠল, বব চলে যাচ্ছে!

ওকে ফলো করো!

বব ভিড় থেকে বেরিয়ে জগিংয়ের ভঙ্গিতে নালায় রাখা মোটসাইকেলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। সেইসময় গাড়ির হর্ন এবং বব ডাক শুনে সে এক লাফে মোটরসাইকেলে চেপে বসল। তারপর স্টার্ট দিয়ে সোজা ময়দানে উঠল। তারপরে উধাও হয়ে গেল।

প্রৌঢ় লোকটি খাপ্পা হয়ে চাপা গর্জন করলেন, নেমকহারাম! বিশ্বাসঘাতক!

তাঁর হাতে রিভলভার ছিল। যুবকটি বলল, আম্স্ লুকিয়ে ফেলুন স্যার! পেছনে পুলিশের গাড়ি এসে গেছে।

পুলিশের একটি পেট্রলভ্যান ততক্ষণে দুর্ঘটনার জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে গেছে। সার্জেন্ট ভদ্রলোক ট্রাকের নাম্বার নেওয়া হয়নি শুনে রুষ্টমুখে বললেন, আপনাদের সিভিক সেন্স নেই বলেই তো বেঁচে আছে, না মরে গেছে?

একজন অভিজাত চেহারার ভদ্রলোক ব্যস্তভাবে বলেন, এখনই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া দরকার। পি জি-তে নিয়ে যান। মনে হচ্ছে এখনও মারা যায়নি।

কনস্টেবলরা এবং ভিড়ের কিছু লোক ধরাধরি করে জয়দীপের শরীরটাকে পুলিশ ভ্যানের খোঁদলে তুলে দিল। পুলিশ ভ্যান পি জি হাসপাতালের দিকে চলে গেল। সার্জেন্ট নোটবই বের করে প্রত্যক্ষদর্শীদের স্টেটমেন্ট নিতে থাকলেন।

সেই গাড়িটি ততক্ষণে চলতে শুরু করেছে। প্রৌঢ় লোকটি সমানে ক্রুদ্ধ ও চাপা গর্জন করছেন। যুবকটি বলল, আমি ভাবতেই পারিনি বব এমন করবে। আমার এখন সন্দেহ হচ্ছে বজ্জাতটা কিছু আঁচ করেছিল।

প্রৌঢ় লোকটি শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, দ্যাটস্ অ্যাবসার্ড। তুমি যদি ওকে কিছু দৈবাৎ মুখ ফসকে বলে থাকো?

কী বলছেন স্যার? আমি শুধু ওকে—

থামো! এখন বলল, শুয়োরের বাচ্চা মোটরসাইকেল পেল কোথায়?

 সেটা জানতে দেরি হবে না স্যার। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।

 ওর ডেরা তো তুমি চেনো?

 চিনি। ওর বন্ধুদেরও চিনি।

 কাজটা তুমিই ওকে দিয়েছিল মাইন্ড দ্যাট। তোমারই সব দায়িত্ব।

নিশ্চয়। আপনি ভাববেন না।

 গাড়ি বাঁদিকে বাঁক নেওয়ার পর প্রৌঢ় বললেন, পি জি হয়ে চলো। জয়দীপ ব্যানার্জিকে একবার দেখে সিওর হতে চাই, বব সাকসেসফুল হয়েছে কি না! বুঝতে পেরেছ? আমরা জয়দীপের আত্মীয় কেমন?….

.

০১.

ম্যান ক্যান নট লিভ বাই ব্রেড অ্যালোন! আমার প্রাজ্ঞ বন্ধু তার সাদা দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন। মানুষ শুধু রুটি খেয়ে বাঁচে না। কথাটা কার বলো তো জয়ন্ত?

বললাম, হঠাৎ এ কথা কেন?

তুমি সাংবাদিক। এই ঐতিহাসিক উক্তি কার তা তোমার জানা উচিত ছিল। তা ছাড়া আজকাল যা লক্ষ্য করছ, সাংবাদিকতা যেন একেকটি আস্ত এনসাইক্লোপিডিয়া। বলে উনি কফিতে চুমুক দিলেন। মুখে সৌম্য-শান্ত ঋষিতুল্য আদল। তারপর একটু হাসলেন। কথাটা যীশু খ্রিস্টের। মানুষ শুধু রুটি খেয়ে বাঁচে না।

কর্নেল! আমি সিওর আপনি আজ সকাল-সকাল খুব তৃপ্তি সহকারে ব্রেকফাস্ট সেরে নিয়েছেন।

 ঠিক বলেছ ডার্লিং!

 আপনার আজ যে-কোন কারণে হোক, বড় বেশি খিদে পেয়েছিল।

হুউ। ঠিক বলেছ।

হাই ওল্ড ম্যান! এ বয়সে নতুন করে জগিং শুরু করেননি তো? বিশেষ করে এ বছর কলকাতায় খ্রিসমাসের সঙ্গে শীতটাও প্রচণ্ড ভাবে এসে গেছে।

কর্নেল মাথা দোলালেন। নাহ্ জয়ন্ত! গোয়েন্দাগিরিতে তুমি বরাবরই কঁচা। একটা জায়গায় গিয়ে থেমে যাও। আমাদের হালদারমশাই হলে এতক্ষণ ঠিকই ধরে ফেলতেন। বলে উনি কফি শেষ করে চুরুট ধরালেন। তোমার জানা উচিত কলকাতায় আমি কদাচ মর্নিংওয়াক করি না। ততক্ষণ আমাকে ছাদের বাগানে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়।

তা তো রোজই করেন। তাতে এমন কিছু সাংঘাতিক খিদে পায় না যে ছাদ থেকে নেমে এসেই ষষ্ঠীকে ব্রেকফাস্টের টেবিল

ওয়েট, ওয়েট! কর্নেল হাত তুলে আমাকে থামিয়ে দিলেন। তারপর চোখ বুজে চুরুটে একটা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়লেন। একটু চুপচাপ থাকার পর বললেন, ছাদের বাগানে বিচ্ছিরি রকমের জঞ্জাল জমে ছিল। আজ ষষ্ঠীকে নিয়ে সব সাফ করেছি। তো হা–তুমি ঠিকই ধরেছ। সকালের দিকে খাটা-খাটুনিতে খিদেটা বেশ বেড়ে যায়। আর্মি লাইফের কথা মনে পড়ছিল।

এবার ওঁর সামরিক জীবনের চর্বিতচর্বণ শোনার আশঙ্কায় ঝটপট বললাম, কিন্তু যীশু খ্রিস্টের কথাটা এতে আসছে কেন?

ব্রেকফাস্টের সময় কথাটা মাথায় এল। অমনই মনে হলো, যীশু খ্রিস্টের প্রখ্যাত এই উক্তির অন্য একটা দিকও আছে। মানুষ শুধু রুটি খেয়ে বাঁচে না, তা ঠিক। কিন্তু রুটি না খেলেও তো মানুষ বাঁচে না! দিস ইজ মোর ফান্ডামেন্টাল জয়ন্ত! আগে রুটি, তারপর অন্য কিছু। তাই না?

ওঁর গাম্ভীর্য দেখে হেসে ফেললাম। ও বস! আপনি এতদিনে রাজনীতিতে নাক গলাতে যাচ্ছেন না তো? আজকাল রাজনীতি ভীষণ বিপজ্জনক।

জয়ন্ত! রাজনীতি যত বিপজ্জনক হয়ে উঠুক না কেন রুটির জন্য–হ্যাঁ, আবার বলছি, বেঁচে থাকার এই ফান্ডামেন্টাল কারণের জন্য যা খুশি করা উচিত। যারা তা করে, করছে বা করতে চায়, আমি তাদের সঙ্গে আছি। হোয়াই। নট? অস্তিত্ব রক্ষার এ একটা নিজস্ব লজিক। আদিম লজিক।

এই সময় টেলিফোন বাজল। কর্নেল চোখ বুজে টাকে হাত বুলাচ্ছেন। গলার ভেতর বললেন, ফোনটা ধরো জয়ন্ত।

ফোন তুলে সাড়া দিতেই প্রাইভেট ডিটেকটিভ কৃতান্তকুমার হালদার ওরফে কে কে হালদার অর্থাৎ আমাদের প্রিয় হালদারমশাইয়ের কণ্ঠস্বর ভেসে এল। কেডা? কর্নেলসারেরে দিন।

রসিকতা করে বললাম, বলছি।

 নাহ্। রং নাম্বার। টেলিফোনেরে ভূতে ধরছে।

দ্রুত বললাম, আপনি কত নাম্বার চাইছেন?

 হালদারমশাই কর্নেলের নাম্বার আওড়ে বললেন, আপনার নাম্বার কত?

 যে নাম্বার চাইছেন।

 অ্যাঃ! কন কী? কিন্তু আপনি কর্নেল স্যার নন। ষষ্ঠীও না। কেডা?

আপনি তো বিচক্ষণ ডিটেকটিভ। বলুন!

এবার ওঁর অনবদ্য খি খি হাসি ভেসে এল। তাই কন! জয়ন্তবাবু? কী কাণ্ড! আসলে আমার মাথা বেবাক গণ্ডগোল হইয়া গেছে। মাইনষে রুটি খায়। রুটি মাইনষেরে খাইলে কী হয় বুঝুন!

অবাক হয়ে বললাম, রুটি? তার মানে, ম্যান ক্যান নট লিভ বাই ব্রেড অ্যালোন–

কী কইলেন, কী কইলেন?

 এখনই কর্নেল কথাটা নিয়ে আলোচনা করছিলেন।

 কন কী? আমার ক্লায়েন্ট তা হলে আগে ওনারে অ্যাপ্রোচ করছিল।

ব্যাপার কী হালদারমশাই? কেসটা কি রুটিঘটিত?

 জয়ন্তবাবু! প্লিজ কলেস্যারেরে দিন।

কর্নেলের দিকে ঘুরতেই উনি তুঘোমুখে বললেন, ওঁকে এখনই আমার কাছে আসতে বললো। ওঁর ক্লায়েন্টকে যেন সঙ্গে আনেন।

হালদারমশাইকে কথাটা জানিয়ে দিলাম। তিনি বললেন, আধঘণ্টার মধ্যে যাইতাছি। জয়ন্তবাবু! হেভি মিস্ট্রি। কর্নেলস্যারেরে কইবেন য্যান।

ফোন রেখে বললাম, মাই গুডনেস! আপনি তাহলে একটা রুটিসংক্রান্ত রহস্য নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন। তাই রুটি নিয়ে অতক্ষণ গুরুগম্ভীর বুকনি? ছাদের বাগানের জঞ্জাল সাফ এবং প্রচণ্ড খিদে পাওয়া–ওঃ কর্নেল! হেঁয়ালি করার এই অভ্যাসটা সত্যিই মাঝে মাঝে আমার বড্ড খারাপ লাগে।

হেঁয়ালি? কর্নেল ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকালেন। না জয়ন্ত! তোমার বোঝা উচিত, রুটি কথাটা আসলে খাদ্যের প্রতীক। প্রাণীমাত্রের বেঁচে থাকতে হলে খাদ্য চাই-ই। আজ ব্রেকফাস্টের সময় এই কঠিন সত্যটা নতুন করে আমাকে ভাবিয়েছে। যাই হোক, হালদারমশাইয়ের জন্য অপেক্ষা করা যাক।

বিরক্ত হয়ে বললাম, ব্যাপারটা কাকতালীয় বলে মেনে নিতে পারছি না কিন্তু।

আমার প্রাজ্ঞ বন্ধু একটু হেসে বললেন, না। একেবারে কাকতালীয় নয়। খাদ্য এবং খিদে সম্পর্কে আমার নতুন উপলব্ধির পেছনে আজকের কাগজের একটা খবরও দায়ী। তবে তুমি নিজে সাংবাদিক হয়ে সংবাদপত্র খুঁটিয়ে পড়ো না এটাই সমস্যা। হ্যাঁ–তোমার এ বিষয়ে বক্তব্য আমার জানা। কাজেই তা আর ব্যাখ্যা করতে বলছি না। সত্যিই তো! কাগজে কত কিছু ছাপা হয় সবই খুঁটিয়ে পড়ার মানে হয় না। কিন্তু মজাটা হলো, হেলাফেলা করে ছাপা একরত্তি। কোনও খবরের আড়ালেও অনেক গুরুতর সত্য থাকে।

খবরটা কী বলুন তো?

কর্নেল কাঁধে ঝাঁকুনি দিলেন ইউরোপীয় ভঙ্গিতে। কাটিং রাখিনি। এই তো কাগজগুলো টেবিলে পড়ে আছে।

আহা! মুখেই বলুন না!

কাল বিকেলের ঘটনা। একটা লোক দৌড়ে এসে আচমকা একটা দোকান থেকে একপাউন্ড সাইজের পাঁউরুটি তুলে নেয়। দোকানদার পয়সা চাইলে সে গ্রাহ্য করে না। বুঝতেই পারছ, এসব ক্ষেত্রে যা হয়। বচসা, হল্লা, ভিড়। তাতে ওটা বস্তি এলাকা।

এটা আবার এমন কী খবর!

 তোমাদের দৈনিক সত্যসেবকও ছেপেছে।

হাসতে হাসতে বললাম, জানেন তো? সাংবাদিক মহলে একটা জোক চালু আছে : আজ-কিছু-আছে নাকি-দাদা-খবর! তার মানে, কাগজের অফিসের টেবিলে বসে পুলিশকে ফোন করে পাওয়া খবর।

কর্নেল তেমনই গম্ভীর মুখে বললেন, হ্যাঁ, পুলিশ সোর্সেরই খবর।

 লোকটা তা হলে বেপাড়ার মস্তান।

খবরে তা বলা হয়নি। লোকটাকে মারমুখী ভিড় ঘিরে ধরতেই সে নাকি রুটিতে কামড় দেয় এবং চিৎকার করে বলে, ম্যান ক্যান নট লিভ বাই ব্রেড অ্যালোন। বাট ক্যান এনি ম্যান লিভ উইদাউট ব্রেড? সম্ভবত ইংরেজি শুনেই সব ভড়কে যায়। তবে বোঝা যায় দোকানদারটি জেদী এবং ঝানু। এটা মেনে নিলে ভবিষ্যতেও একইভাবে তার রুটি ছিনতাই হওয়ার আশঙ্কা আছে।

ঠিক ধরেছেন। তাই সে ওকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে এই তো?

কর্নেল একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, হ্যাঁ। কিন্তু কল্পনা করো জয়ন্ত তাকে যখন থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তখনও সে পাউরুটি কামড়ে খাচ্ছিল। অবশ্য পুলিশ বলেছে, রুটি ছিনতাইকারী আসলে মানসিক রোগী।

আপনি বলছিলেন এই খবরে গুরুতর সত্য আছে। সত্যটা কী?

কী আসাধারণ প্রশ্ন! ক্যান এনি ম্যান লিভ উইদাউট ব্রেড?

 ওঃ কর্নেল! ফিলোসফির ভূতটাকে কাধ থেকে নামান প্লিজ!!

ফিলোসফি নয় ডার্লিং, হার্ড ট্রুথ। বলে কর্নেল টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা নোটবই বের করলেন। তারপর পাতা উল্টে দেখে টেলিফোন টেনে নিলেন। ডায়াল করে সাড়া পাওয়ার পর বললেন, ও সি বিনয় ঘটক আছেন নাকি?…বলুন কর্নেল নীলাদ্রি সরকার কথা বলবেন।…বিনয়! কনগ্রাচুলেশন!…না, না। তুমি তো জানো….কবে জয়েন করছ?….ভালো খুব ভাল। তো শোনো। আজ কাগজে দেখলাম তোমার থানায় একজন রুটিছিনতাইকারীকে….হ্যাঁ, আমি ইন্টারেস্টেড। পরে বলবখন।…বলো কী? তারপর?….হ্যাঁ, ঠিকই করেছ। ভদ্রলোকের নাম-ঠিকানা….জাস্ট এ মিনিট! লিখে নিচ্ছি।…কার্ডে নিশ্চয় ফোন নাম্বার আছে?….হ্যাঁ বলো। কর্নেল সেই নোটবইয়ের পাতায় কোনার দিকে কার নাম-ঠিকানা টুকে নিলেন। তারপর টেলিফোন রেখে আমার দিকে ঘুরে বসলেন।

জিজ্ঞেস করলাম, কোন থানা?

 বিনয় ঘটককে তোমার চেনা উচিত। তুমি সাংবাদিক। ডক এরিয়ায় গত বছর একটা বড় স্মাগলিং র‍্যাকেট গুঁড়িয়ে দিয়ে তুলকালাম করেছিল। শেষে সেই র‍্যাকেটের রাজনৈতিক মুরুব্বিরা ওকে সেখান থেকে হটিয়ে দিয়েছে কড়েয়া থানায়। তাতেও ক্ষান্তি নেই। নখদন্তহীন স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চে প্রমোশন দিয়ে– আবার সরাচ্ছে। বললাম বটে কনগ্রাচুলেশন, কিন্তু এই পদোন্নতির মানে একজন সৎ দক্ষ অফিসারকে ঠুটো জগন্নাথ করে দেওয়া।

বুঝলাম। কিন্তু এবার দেখছি রহস্য ঘনীভূত। হালদারমশাই বলছিলেন হেভি মিস্টি 

কর্নেল ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে অভ্যাস মতো চোখ বুজে মৃদুস্বরে বললেন, পুলিশ কাগজকে সব কথা বলেনি। কোনও সময়ই বলে না। হ্যাঁ, রুটিছিনতাইকারীর আচরণ-হাবভাবে পাগলামি ছিল। সে একজন যুবক। বাংলা বলতে পারে না। ভাঙা ভাঙা হিন্দি জানে। ইংরেজি তার মাতৃভাষা। পুলিশের ধারণা, সে অ্যাংলোইন্ডিয়ান এবং কলকাতায় সদ্য এসেছে। মাথায় হিপিদের মতো চুল। তাকে সার্চ করে শতিনেক টাকা পাওয়া যায়। হাতে দামী একটা বিদেশি ঘড়িও ছিল। অতএব পাগল। দোকানদারকে তার টাকা থেকে পাঁউরুটির দাম মিটিয়ে বুঝিয়েসুঝিয়ে বিদায় দেওয়া হয়। তারপর ডিউটি অফিসার তার সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে লকআপে ঢোকান। কিছুক্ষণ পরে একজন হোমরাচোমরা গোছের বাঙালি ভদ্রলোক গিয়ে হাজির। তার সঙ্গে দুজন লোক ছিল। কার্ড দেখিয়ে বলেন তিনি সাইকিয়াট্রিক ডাক্তার। তার নার্সিংহোম থেকে একজন সাংঘাতিক রোগী পালিয়েছে। তার পেছনে গাড়ি নিয়ে ধাওয়া করেছিলেন। রোগী যে-বস্তি এলাকায় ঢুকেছিল, এইমাত্র সেখানে তিনি খবর পেয়েছেন একজন পাগলকে নাকি এই থানায় ধরে আনা হয়েছে। রোগীর চেহারার বর্ণনাও তিনি দেন। তারপর তাকে লকআপে নিয়ে যাওয়া হয় রোগীকে শনাক্ত করতে। তিনি বলেন, হ্যাঁ–এই সেই রোগী।

কর্নেল হঠাৎ চুপ করলে বললাম, ইন্টারেস্টিং। তারপর?

কর্নেল ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বললেন, তাঁকে দেখামাত্র যুবকটি ঘুরে দাঁড়িয়ে দেয়ালে মাথা ঠুকতে ঠুকতে বলে, ও গড! হি হ্যাঁজ কাম টু কিল মি। হি ইজ এ কিলার। প্লিজ সেইভ মি ফ্রম দা ন্যাস্টি ডগ। হি ইজ ফলোয়িং মি সি এ লং টাইম ইত্যাদি। ডিউটি অফিসার অগত্যা বলেন, ও সি ডিসিশন নেবেন। আপনি অপেক্ষা করুন। ভদ্রলোক রাগ করে চলে যান। হ্যাঁ যাওয়ার সময় তার নেমকার্ড ফেরত চেয়েছিলেন। বুদ্ধিমান অফিসার সেটি ফেরত দেননি। তো বিনয় থানায় ফেরে রাত দশটা নাগাদ। সব শুনে সে যুবকটিকে লকআপ থেকে এনে জেরা শুরু করে। কিন্তু যুবকটি কোনও প্রশ্নের জবাব না। দিয়ে ক্রমাগত আওড়ায়, ম্যান ক্যান নট লিভ বাই ব্রেড অ্যালোন। বাট ক্যান এনি ম্যান লিভ উইদাউট ব্রেড? বিনয়ের ধারণা হয়, যুবকটি সত্যিই মানসিক রোগী। তারপর বিনয় সেই ডাক্তারকে ফোন করতে টেলিফোন তুলেছে, আচমকা যুবকটি পালিয়ে যায়। তাকে তাড়া করে লাগাল পাওয়া যায়নি।

হেসে ফেললাম, পাগলই বটে। বিনয়বাবু ডাক্তারকে ফোন করে নিশ্চয় ব্যাপারটা জানিয়েছেন?

বিনয় পাগল নয়। থানা থেকে আসামি পালানোর মানে কী বুঝতে পারছ না? দাগী ক্রিমিন্যাল হলে কথা ছিল। গা করতেই হতো। তবে সেক্ষেত্রে সে ঘটনাটা চেপে গেছে। এদিকে আমি এ ব্যাপারে আগ্রহী। আমাকে বিনয় ভালই চেনে। কাজেই আমাকে সব খুলে বলল। নাহ–সেই ডাক্তারের সঙ্গে সে যোগাযোগ করেনি। করতেও চায় না। ডাক্তারও এখন পর্যন্ত আর থানায় যোগাযোগ করেননি। বিনয় বলল, তার একটু খটকা লেগেছে অবশ্য। আমার কথায় খটকাটা বেড়ে গেল। তবে ও এখন নিজের ব্যাপারে বেশি ব্যস্ত। প্রমোশন পেয়ে অন্য দফতরে বদলিতে বিনয় খুশি হয়নি।

এতক্ষণে ডোরবেল বাজল। কর্নেল যথারীতি হাঁক দিলেন ষষ্ঠী!

কর্নেলের এই প্রশস্ত ড্রয়িংরুমের এক কোণে বাইরের দিকে একটা ছোট্ট ওয়েটিং রুম মতো আছে। অ্যাপার্টমেন্টের বাইরের দরজা সেই ঘরটাতে। একটু পরে প্রাইভেট ডিটেকটিভ হালদারমশাইয়ের অমায়িক কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। প্লিজ কাম ইন ম্যাডাম! তারপর চাপা স্বরে–ওনারে বুড়া ভাববেন না। লুকিং বুড়া। বাট স্ট্রং অ্যান্ড হাড়ে হাড়ে বুদ্ধি। কাম ইন প্লিজ!

পর্দা তুলে হালদারমশাই বললেন, মর্নিং কর্নেল স্যার! আলাপ করাইয়া দিই। মিসেস শ্রীলেখা ব্যানার্জি। আর মিসেস ব্যানার্জি, একজন জিনিয়াসের কাছে আপনারে লইয়া আইছি। আমাগো গুরুদেব কইতে পারেন। কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। অ্যান্ড–ইনি হইলেন গিয়া দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরী!

মহিলাদের বয়স অনুমান করতে গিয়ে আমি বাবর ঠকেছি। তবে এঁকে পূর্ণ যুবতী বলা চলে। উপমায় বলতে হলে বলব পূর্ণিমার চাঁদ। তার মানে কৃষ্ণপক্ষের ক্ষয় আসন্ন। তবে পূর্ণ চন্দ্রিমাটি যেন ঈষৎ মেঘে ঢাকা। তাই উজ্জ্বলতা কম। কিন্তু চোখ দুটি চশমার ভেতরও ধারালো। চেহারায় স্মার্টনেস স্পষ্ট। ছিপছিপে গড়ন পরনে নীলচে শাড়ি ব্লাউস। একটা কালো মোটাসোটা ব্যাগ কাঁধে ঝুলছিল। সেটা নামিয়ে পায়ের কাছে রাখলেন।

কর্নেল ওঁকে দেখছিলেন। বললেন, আমি সম্ভবত ভুল করছি না। কদিন আগে একটা কাগজে আপনার ইন্টারভিউ পড়েছি এবং ছবিও দেখেছি। আপনি শ্রী এন্টারপ্রাইজের প্রোপ্রাইটার। জাপান থেকে কম্পিউটার সফ্টওয়্যার আমদানি করে আপনার কোম্পানি পার্সোনাল কম্পিউটার তৈরি করে। আরব এবং পশ্চিম এশিয়ায় ইতিমধ্যে আপনার কোম্পানি বড় মার্কেট পেয়ে গেছে।

হালদারমশাই উত্তেজিত ভাবে নস্যি নিচ্ছিলেন দ্রুত, বললেন, আপনারে কইছিলাম ম্যাডাম–তাকে থামিয়ে কর্নেল বললেন, আপনার স্বামী ইন্টারভিউতে আপনিই বলেছেন, সম্প্রতি রেড রোডে পথ-দুর্ঘটনায় মারা গেছেন!

শ্রীলেখা মৃদুস্বরে বললেন, ময়দানে জগিং করতে গিয়েছিল। সেদিন ভোরে প্রচণ্ড কুয়াশা ছিল। ওর পকেটে একটা ক্লাবের মেম্বারশিপ কার্ড ছিল। তাতে ঠিকানা পেয়ে পি জি হাসপাতালের এমার্জেন্সি ওয়ার্ড থেকে আমাকে খবর দেওয়া হয়েছিল।

হ্যাঁ, এবার বলুন কী ব্যাপারে আপনি ওঁর ডিটেকটিড এজেন্সিতে গেলেন?

হালদারমশাই কিছু বলতে ঠোঁট ফাঁক করেছিলেন। বললেন না। শ্রীলেখা বললেন, পুলিশকে জানাতে সাহস পাইনি। কারণ একটু থেমে আস্তে শ্বাস ছেড়ে বললেন ফের, গোড়া থেকে বলা উচিত। আমার স্বামীর মৃত্যুর পরদিন থেকে যখন-তখন উড়ো ফোনে কেউ আমাকে একটা উদ্ভট কথা বলে টিজ করছিল। মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারছিলাম না।

কী কথা? বলেই কর্নেল হাসলেন। ম্যান ক্যান নট লিভ বাই ব্রেড অ্যালোন। বাট ক্যান এনি ম্যান লিভ উইদাউট ব্রেড?

শ্রীলেখার দৃষ্টিতে বিস্ময় ফুটে উঠল। হালদারমশাইয়ের গোঁফ উত্তেজনার সময় তিরতির করে কাপে লক্ষ্য করেছি। এতক্ষণে সেই কাপন দেখতে পেলাম। শ্রীলেখা বললেন, আপনি কী করে জানলেন?

কর্নেল সকৌতুকে হালদারমশাইকে দেখিয়ে বলেন, প্রাইভেট ডিটেকটিভ মিঃ হালদারকে আমরা হালদারমশাই বলে থাকি। উনি চৌত্রিশ বছর পুলিশে কাজ করে অবসর নেওয়ার পর ডিটেকটিভ এজেন্সি খুলেছেন। ওঁর সাহস, দক্ষতা, বুদ্ধিসুদ্ধি সত্যিই অসাধারণ। তবে উত্তেজনার ঝেকে উনি অনেকসময় কিছু কথাবার্তা বলে ফেলেন–না, না হালদারমশাই আপনার সংকোচের কারণ নেই। মিসেস ব্যানার্জিকে নিয়ে আসার সময় আপনি বলছিলেন, বুড়ার হাড়ে হাড়ে বুদ্ধি

হালদারমশাই ম্রিয়মাণ হয়ে বললেন, ভেরি সরি কর্নেল স্যার! ক্ষমা চাইছি। আমার এই এক ভেরি-ভেরি ব্যাড হ্যাবিট। আসলে মাদারটাং ছাড়তে পারিনি এখনও। তাই মুখ দিয়ে বুড়া বেরিয়ে যায়!

নাহ্! শব্দটার মানে তো একই। বুড়া বলুন, বুড়ো বলুন বৃদ্ধ বলুন। এনিওয়ে! তবে বলা হয় বটে হাড়ে-হাড়ে বুদ্ধি, আসলে বুদ্ধির ডেরা মগজের কোষে কোষে। মিসেস ব্যানার্জি, আমার এই তরুণ বন্ধু সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরী আমাকে মুখোমুখি ওল্ডম্যান বলে সম্ভাষণ করে। হা–ওল্ড ইজ গোল্ড। ষষ্ঠী! কফি নিয়ে আয়।

ষষ্ঠীচরণ বোঝে, তার বাবামশাই কাকে বা কাদের কফি দিয়ে আপ্যায়ন করবেন। সে নেপথ্যে তৈরিই ছিল যেন। তখনই ট্রেতে কফির সরঞ্জাম নিয়ে হাজির হলো।

শ্রীলেখা ঘড়ি দেখে বললেন, আমি কিন্তু চা বা কফি কিছু খাই না।

কর্নেল পেয়ালায় কফি ঢালতে ঢালতে বললেন, ডাক্তাররা যা-ই বলুন, আমি দেখেছি কফি নার্ভ চাঙ্গা করে। তবে আপনাকে ইসি করব না। জয়ন্ত! হালদারমশাই! হিজ হিজ হুজ হুজ তৈরি করে নিন।

কফিতে চুমুক দিয়ে হালদারমশাই বললেন, ম্যাডাম! আপনার কেস হিস্ট্রি শুরু করুন।

শ্রীলেখা কর্নেলের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টে তাকিয়ে বললেন, উড়ো ফোনের ঘটনাটা নিশ্চয় মিঃ হালদার আপনাকে জানিয়েছেন?

হালদারমশাই ঝটপট বললেন, না ম্যাডাম! আমি কিছু কই নাই।

কর্নেল বললেন, আন্দাজে ঢিল ছোঁড়া আমার অভ্যাস। আপনি উড়ো ফোনে অদ্ভুত কথা শুনতে পান। অদ্ভুত কথা–এটাই আমার কানে বিঁধেছে। যাই হোক। তাহলে দেখা যাচ্ছে কেউ আপনাকে ওই কথাগুলো বলে উত্ত্যক্ত করছে। এই তো? নাকি আরও কিছু ঘটেছে?

শ্রীলেখা বললেন, দুদিন আগে চৌরঙ্গিতে আমার কোম্পানির অফিস থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠতে যাচ্ছি, তখন প্রায় ছটা বাজে–হঠাৎ একটা লোক কাছ ঘেঁষে এসে বলে উঠল আপনার স্বামীর রিস্টওয়াচটা কি ফেরত পেয়েছেন? পার্কিং জোনের ওখানটাতে আলো কম ছিল। তবে বয়স্ক লোক মনে হলো। বললাম, কে আপনি? লোকটা চাপা গলায় বলল, ফেরত পেয়েছে কি না জানতে চাইছি মিসেস ব্যানার্জি! আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, আমার স্বামীর অনেকগুলো রিস্টওয়াচ আছে। কিন্তু কে আপনি? কেন এ কথা জানতে চাইছেন? তখন সে হুমকি দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, নীলডায়াল রোমার রিস্টওয়াচটা আমি জয়কে দিয়েছিলাম। ওটা ফেরত চাই। আমি চড়া গলায় বললাম, আর একটা কথা বললে গার্ডদের ডাকব। অমনই লোকটা চলে গেল। দেখলাম, ফুটপাতে গিয়ে সে একটা গাড়িতে উঠল। স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে গেল। সত্যি বলতে কী, আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম।

নীলডায়াল রোমার রিস্টওয়াচ?

 হ্যাঁ। কিন্তু জয়ের তেমন কোনও ঘড়ি আমি দেখিনি।

জগিংয়ের সময় ওঁর হাতে ঘড়ি থাকত নিশ্চয়। থাকা উচিত। তো হাসপাতাল থেকে ওঁর কোনও ঘড়ি আপনাকে দেওয়া হয়নি?

না।

হালদারমশাই বললেন, অ্যাকসিডেন্টের সময় ওনার হাতে ঘড়ি থাকলে গুঁড়া হওনের কথা। যে পুলিশ অফিসার অ্যাকসিডেন্টের তদন্ত করছিলেন, তিনি কইতে পারেন।

আমি বললাম, ঘড়ি ভেঙে গেলেও রিস্টে চেন বা ব্যান্ড আটকে থাকা উচিত। হয়তো হাসপাতাল-স্টাফ তা ফেলে দিয়েছিল?

শ্রীলেখা বললেন, আমিও তা-ই ভেবেছি কারণ তন্নতন্ন খুঁজে তেমন কোনও ঘড়ি দেখতে পাইনি। তো গতকাল দুপুরে অফিসে আবার একটা উড়ো ফোন এল। না–যে ম্যান ক্যান নট লিভ বাই ব্রেড অ্যালোন বলে সেই লোকটা নয়। অন্য লোক। দুদিন আগে সন্ধ্যায় যে আমাকে হুমকি দিচ্ছিল, সম্ভবত সেই। বলল, কেউ যদি আমাকে রোমার রিস্টওয়াচটা বেচতে যায়, আমি যেন তাকে আটকে রেখে এই নাম্বারে ফোন করি। হঠাৎ সেই সময় মনে পড়ল নিউজপেপারে হালদার প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সির বিজ্ঞাপন দেখেছি। বাড়ি ফিরে বিজ্ঞাপনটা খুঁজে বের করে মিঃ হালদারকে রিং করলাম। উনি বললেন, আপনাকে আসতে হবে না। ঠিকানা বলুন। আমি এখনই যাচ্ছি।

হালদারমশাই বললেন, হঃ। সার্কাস অ্যাভেনিউয়ে তখনই গিয়া হাজির হইলাম।

কর্নেল বললেন, সেই ফোন নাম্বারটা আমাকে দিন। আপনার নেমকার্ডও দিন। আমি আজ সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ আপনার বাড়িতে যাব। আর এই নিন আমার নেমকার্ড। নতুন কিছু ঘটলে তখনই জানাবেন।…

.

০২.

হালদারমশাই তাঁর মক্কেলকে বিদায় দিতে নিচে গেলেন। দেখলাম কর্নেল চোখ বুজে স্বগতোক্তি করছেন, নীলডায়াল রোমার রিস্টওয়াচ! রোমার! বিখ্যাত জাপানি ওয়াচ কোম্পানির তৈরি ঘড়ি। শ্ৰী এন্টারপ্রাইজের সঙ্গে জাপানের কারবারি যোগাযোগ আছে। এদিকে যে লোকটা শ্রীলেখা ব্যানার্জিকে একটা রোমার ঘড়ির জন্য হুমকি দিচ্ছে, তার বক্তব্য–ঘড়িটা নাকি সে-ই জয়দীপ ব্যানার্জিকে দিয়েছিল। এটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট।

বললাম, কর্নেল! ঘড়ি-টড়ি পরে। আগে সেই পাগলাটার কথা ভাবুন।

কর্নেল, চোখ খুলে বললেন, মিসেস ব্যানার্জিকে সে-ই টিজ করে বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু কেন করে সেটাই প্রশ্ন।

ওঁকে জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল, হিপিটাইপ চেহারার ওইরকম অ্যাংলো ইন্ডিয়ান যুবককে উনি চেনেন কি না। আপনি কড়েয়া থানার ব্যাপারটা ওঁকে বললেন না কেন?

 ধীরে জয়ন্ত, ধীরে। বলে কর্নেল ড্রয়ার থেকে নোটবই বের করে পাতা ওল্টালেন। তারপর টেলিফোন তুলে ডায়াল করলেন। একটু পরে বললেন, চেতনা নার্সিংহোম?…ডাঃ প্রতুল বাগচী আছেন?…শুনুন, আমি কড়েয়া থানা থেকে বলছি। দিস ইজ আর্জেন্ট।…নমস্কার ডাঃ বাগচী!..হ্যাঁ। আপনি সেই পালিয়ে যাওয়া পেশেন্টকে কি খুঁজে পেয়েছেন?….সে কী! আপনার কোনও পেশেন্ট….কিন্তু গতকাল আপনি থানায় এসেছিলেন। আপনার নেমকার্ড দিয়ে গেছেন।…আই সি! হ্যাঁ, দ্যাটস রাইট। নেমকার্ড আপনি কতজনকে দিতেই পারেন….না, না। আপনাকে কষ্ট করে আসতে হবে না। এ নিয়ে আপনার চিন্তার কারণ নেই। জাস্ট এ রুটিন এনকোয়ারি …হ্যাঁ। আজকাল সর্বত্র প্রতারকরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্লিজ ডোন্ট ওয়ারি। রাখছি।

কর্নেল টেলিফোন রেখে আমার দিকে তাকালেন।

বললাম, ওঁর কোনও রোগী পালায়নি?

নাহ্। কাজেই ওঁর থানায় যাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না।

 কিন্তু দেখা যাচ্ছে ডাঃ বাগচী সেজে কাল যে থানায় গিয়েছিল, যুবকটিকে তার খুবই দরকার। এদিকে যুবকটি তাকে দেখে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিল। তাই না?

কর্নেল দাড়ি নেড়ে সায় দিলেন। এই সময় হালদারমশাই ফিরে এলেন। ধপাস করে সোফায় বসে আবার একটিপ নস্যি নিয়ে বললেন, ফোনে জয়ন্তবাবু আমারে কইছিলেন ম্যান ক্যান নট লিভ

পাগল! বলে কর্নেল তাকে থামিয়ে দিলেন।

 হালদারমশাই অবাক হয়ে বললেন, কেডা পাগল? জয়ন্তবাবু পাগল হইবেন। ক্যান?

কর্নেল হাসলেন। জয়ন্ত নয়, সেই লোকটা।

 হঃ! আমি মিসেস ব্যানার্জিরে তা-ই কইয়া দিছি। পাগলের কথায় কান দেবেন না। কিন্তু তখন জয়ন্তবাবু ফোনে পাগলের কথা অবিকল রিসাইট করলেন। কর্নেলস্যার! আমার হেভি খটকা বাধছে। হালদারমশাই সন্দিগ্ধদৃষ্টে আমার দিকে তাকালেন।

বললাম, কর্নেল! ঘটনাটা হালদারমশাইকে জানানো উচিত।

কর্নেল বললেন, উচিত বৈকি! তবে উনি এখনও উত্তেজিত। একটু ধাতস্থ হতে দাও ওঁকে।

হালদারমশাই খি খি করে তার অনবদ্য হাসি হেসে বললেন, আই অ্যাম অলওয়েজ কাম অ্যান্ড কোয়াইট কর্নেলস্যার! কন, শুনি।

একটু চুপ করে থাকার পর কর্নেল আস্তে সুস্থে পাগল যুবকটির ঘটনা সবিস্তারে হালদারমশাইকে বললেন। শোনার পর হালদারমশাই আবার উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। চাপা স্বরে বললেন, অল ক্লিয়ার! মিসেস ব্যানার্জিরে ঘড়ির জন্য যে থ্রেটন করেছে, সেই রাস্কেল থানায় গেছিল।

কর্নেল বললেন, ঠিক। দুদিন আগে সে মিসেস ব্যানার্জিকে হুমকি দিতে গিয়েছিল। পরে সে জানতে পেরেছে, ঘড়িটা ওই পাগল যুবকের কাছে আছে। এখন প্রশ্ন হলো, জয়দীপ ব্যানার্জির ঘড়ি যুবকটি পেল কী ভাবে?

বললাম, ভদ্রমহিলা তো তার স্বামীর তেমন কোন ঘড়ি ছিল কি না জানেন না!

কর্নেল টাকে হাত বুলিয়ে বললেন, তার চেয়ে বড় কথা, কী আছে ঘড়িটাতে?

আচ্ছা কর্নেল! লোকটাকে তো ফাঁদে ফেলা সোজা।

কী ভাবে?

 মিসেস ব্যানার্জিকে সে ফোন নাম্বার দিয়েছে। কাজেই একটা ফাঁদ পেতে তাকে ধরা যায়।

প্রাইভেট ডিটেকটিভ হঠাৎ খি খি করে হেসে উঠলেন। বললেন, রিস্ক লইয়া গত রাত্রে দুইবার, মর্নিয়েও কয়বার রিং করছি। খালি কয়, দা নাম্বার ইউ হ্যাভ ডায়াল্ড ডাজ নট একজিস্ট! কর্নেলস্যার রিং করতে পারেন।

কর্নেল ডায়াল করার পর টেলিফোন রেখে বললেন, হ্যাঁ। ভুয়ো নাম্বার দিয়েছে। তা আপনি কি মিসেস ব্যানার্জিকে কথাটা জানিয়েছেন?

ইয়েস? শি ইজ মাই ক্লায়েন্ট। তারে না জানাইলে চলে? আপনি তো জানেন কর্নেলস্যার, আমি প্রোফেশোনাল এথিক্স মেইনটেন করি!

বললাম, উত্তেজনার ফলে নাম্বার টুকতে মিসেস ব্যানার্জির ভুল হয়নি তো?

ভেরি স্ট্রং নার্ভের মহিলা। কইলেন, ভুল হয় নাই।

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। হালদারমশাইয়ের কাছে নাম্বারটা ভুয়ো শুনেও মিসেস ব্যানার্জি যখন আমাকে ওই নাম্বারই দিয়ে গেলেন, তখন বোঝা যাচ্ছে, টুকতে উনি ভুল করেননি।

 আমার মাথায় একটা প্ল্যান আছে। এইমাত্র নিচে ক্লায়েন্টের লগে কনসাল্ট করলাম। হঠাৎ হালদারমশাই চাপা স্বরে বললেন, সব খরচ উনি দিতে রাজি। নিউজপেপারে বিজ্ঞাপন দিমু।

কী বিজ্ঞাপন?

পথে একটি রিস্টওয়াচ কুড়াইয়া পাইয়াছি। মালিক উপযুক্ত প্রমাণাদি দিয়া ফেরত লইয়া যান। প্রাইভেট গোয়েন্দা আবার একচোট হেসে বললেন, নামঠিকানা দিমু না। বক্সনাম্বারে বিজ্ঞাপন। দেখি, হালায় ফান্দে পা দেয় কি না।

ব্রিলিয়ান্ট আইডিয়া! দেরি করবেন না হালদারমশাই! জয়ন্ত কাগজের লোক। দরকার হলে ওর সাহায্য নিন, যাতে শীগগির বিজ্ঞাপনটা চোখে পড়ার মতো জায়গায় ছাপা হয়।

বললাম, আমি শুধু আমাদের কাগজের বিজ্ঞাপন বিভাগে বলে দিতে পারি। কিন্তু বক্সনাম্বারের বিজ্ঞাপনের জবাব পেতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। বরং ভুয়ো নাম দিয়ে হালদারমশাই তাঁর বাড়ির ঠিকানা দিন। কিংবা এক কাজ করতে পারেন। নামঠিকানার বদলে শুধু ফোন নাম্বার দিয়ে যোগাযোগ করতে বলুন।

হালদারমশাই কর্নেলের দিকে তাকালেন। আপনি কী কন কর্নেলস্যার?

কর্নেল বললেন, জয়ন্ত মন্দ বলেনি। তবে আপনার ডিটেকটিভ এজেন্সির নাম্বার দেবেন না। আপনি তো প্রায়ই আপনার এজেন্সির বিজ্ঞাপন দেন। বাড়ির ফোন নাম্বার দেবেন বরং। কেউ যোগাযোগ করলে আমাকে তখনই জানিয়ে দেবেন কিন্তু। আর একটা কথা হালদারমশাই! হিপিটাইপ পাগলের যে ঘটনা আপনি শুনলেন, তা যেন ঘুণাক্ষরে আপনার ক্লায়েন্টকে জানাবেন না। জানালে আমি এই কেস থেকে সরে দাঁড়াব।

পাগল? বলে হালদারমশাই উত্তেজিত ভাবে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর অভ্যাসমতো যাই গিয়া বলে সবেগে বেরিয়ে গেলেন।

কর্নেল একটু হেসে বললেন, হালদারমশাই সত্যি বিচক্ষণ মানুষ। তবে ওঁর ওই এক দোষ হঠকারিতা। আমার ধারণা, লোকটি সেয়ানা। এত সহজে ফাঁদে পা দেবে না। তবে যদি বলো, হালদারমশাইকে নিষেধ করলাম না কেন–আমি বলব, নিষেধ করলেও উনি শুনতেন না। বরাবর দেখে আসছি, ওঁর মাথায় একটা আইডিয়া এলেই তা-ই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

ঘড়ি দেখে বললাম, এগারোটা বাজে! উঠি।

 একটু বসো। আমিও উঠব। কারণ এতক্ষণ শুধু ইজিচেয়ারে বসে একটা রহস্যের জট ছাড়াতে ঘিলু জল করেছি। হা–প্রচুর তথ্য হাতে এসে গেল, তা ঠিক। কিন্তু পথে না নামলে জট ছাড়ানোর খেইটা পাওয়া যাবে না।

কর্নেল উঠে দাঁড়ালে বললাম, আমার আজ এখানে লাঞ্চের নেমন্তন্ন। তারপর অফিস।

ডার্লিং! তুমি এলেই ষষ্ঠী তোমাকে লাঞ্চ সার্ভ করতে উদ্যোগী হয়। ডেকে জিজ্ঞেস করতে পারো। বলে কর্নেল মিটিমিটি হাসলেন। সেই ভুয়ো টেলিফোনের নাম্বারের মতো তোমার ওই নেমন্তন্নও ভুয়ো নয় তো?

হাই ওল্ড ম্যান! আমাকে আজ নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাবেন বোঝা যাচ্ছে।

রহস্য জয়ন্ত, রহস্য! রহস্যে জড়িয়ে পড়ার চেয়ে আনন্দ আর কিসে? এক মিনিট। পোশাক বদলে আসি।…।

কিছুক্ষণ পরে কর্নেলের তিনতলার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে নিচে নেমে এলাম। লনের এককোণে আমার গাড়ি পার্ক করা ছিল। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বললাম, কোথায় যাবেন এখন?

কর্নেল বললেন, তুমিই বলল এখন কোথায় যাওয়া উচিত!

মিসেস ব্যানার্জির অফিসে।

কর্নেল হাসলেন। পাগল যুবকটিকে মিসেস ব্যানার্জি চেনেন কি না এই প্রশ্ন তোমাকে হন্ট করছে। তবে তোমাকে বলেছি, ধীরে। এখন আমরা যাব হেস্টিংস থানায়।

রাস্তায় পৌঁছে বললাম, হেস্টিংস থানায় কী ব্যাপার?

 গড়ের মাঠের পশ্চিমে রেড রোডের অংশটা ওই থানার আওতায় পড়ে।

 আপনি জয়দীপ ব্যানার্জির দুর্ঘটনায় মৃত্যু সম্পর্কে আগ্রহী তাহলে?

 দ্যাটস রাইট।

 কর্নেল! আপনি কি মিসেস ব্যানার্জিকে–

না, না! শি ইজ ইনোসেন্ট। মহিলা পাক্ষিকে ওঁর ইন্টারভিউ পড়ে দেখো।

কিন্তু আমার একটা খটকা লাগছে।

 বলো।

ভদ্রমহিলা স্মার্ট, শিক্ষিতা এবং মডার্ন। নিশ্চয় স্বামীর সঙ্গে নানা দেশে ঘুরেছেন।

হুউ।

এ ধরনের দম্পতিকে একসঙ্গে জগিং করতে দেখেছি। জয়দীপ একা জগিং করতে গিয়েছিলেন কেন?

তার একশো একটা কারণ থাকতেই পারে।

কিন্তু স্বামীর কোনও নীলডায়াল রোমার ঘড়ি ছিল কি না স্ত্রীর অবশ্য জানা উচিত।

হ্যাঁ। এটা একটা পয়েন্ট। তবে এ মুহূর্তে হেস্টিংস থানা ছাড়া আর কিছু ভাবছি না।

কর্নেল সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজলেন। বুঝলাম, এখন আর মুখ খুলতে রাজি নন। কিন্তু আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না, জয়দীপ ব্যানার্জির পথদুর্ঘটনায় মৃত্যু ওঁকে কোন সূত্র যোগাবে? মহিলা পাক্ষিক পত্রিকায় শ্রীলেখা তার স্বামীর মৃত্যু। সম্পর্কে কী বলেছেন আমি অবশ্য এখনও জানি না। তবে এখন মনে হচ্ছে। নিশ্চয় এমন কিছু বলে থাকবেন, যা আমার প্রাজ্ঞ বন্ধুর কাছে সম্ভবত গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে।

হেস্টিংস থানায় পৌঁছতে আধঘণ্টার বেশি সময় লাগল। সারা পথ ট্রাফিক জট। শীতের কলকাতা, পেট থেকে তার সব মানুষজন এবং যানবাহনকে যেন রাস্তাঘাটে উগরে দেয়। থানার পাশে গাড়ি দাঁড় করাতে বলে কর্নেল বেরিয়ে গেলেন। বললেন, দেরি হবে না। এখনই আসছি।

কৌতূহল চেপে বসে থাকতে হলো। কর্নেল ফিরলেন প্রায় মিনিট কুড়ি পরে। গাড়িতে ঢুকে বললেন, পথদুর্ঘটনায় মৃত ব্যক্তির কাছে পাওয়া জিনিসপত্রের একটা লিস্ট থানায় রাখার নিয়ম আছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবৃতি এবং নামঠিকানা নেওয়াও নিয়ম। কিন্তু সব নিয়মই যে মানা হয়, এমন নয়। ট্রাফিক সার্জেন্ট আব্দুল করিম দুর্ঘটনার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে অকুস্থলে গিয়ে পড়েছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা তাকে বলেছিলেন একটা ট্রাকের ধাক্কায় মৃত্যু। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যে জগিং করছে ময়দানে, সে কেন হঠাৎ রাস্তায় ট্রাকের মুখে পড়বে? এর একটা উত্তর করিমসাহেবের রিপোর্টে আছে। জয়দীপ জগিং করার পর তাঁর গাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন। ঘন কুয়াশা থাকায় দৈবাৎ রাস্তায় নেমেইনাহ জয়ন্ত! এটা যুক্তিসঙ্গত ঠেকছে না। বডি ছিটকে গিয়ে ফুটপাতে পড়েছিল তা ঠিক। কিন্তু পরে শ্রীলেখা তাঁর স্বামীর গাড়ির খোঁজ করলে সেখানে পুলিশ যায়। তখন উজ্জ্বল রোদ ফুটেছে। বেলা প্রায় দশটা। রাস্তার মাঝখানে খানিকটা রক্ত আবিষ্কার করে পুলিশ। তার মানে জয়দীপকে ট্রাকটা ধাক্কা মারে রাস্তার মাঝখানে। অথচ দেখ, জয়দীপের গাড়ি রাখা ছিল ময়দানের দিকের ফুটপাতের পাশেই।

ততক্ষণে গাড়িতে স্টার্ট দিয়েছি এবং যেদিক থেকে এসেছি, সেইদিকেই গাড়ি ঘুরিয়েছি। আমি চুপ করে আছি দেখে কনেল বললেন, জয়ন্ত আমার পয়েন্টটা যুক্তিসঙ্গত নয়?

বললাম, হ্যাঁ। একেই বলা হয়, ডালমে কুছ কালা হ্যায়।

কর্নেল হাসলেন। তোমার এই প্রবচনটি লাগসই।

জয়দীপের হাতে ঘড়ি ছিল কি না পুলিশের লিস্টে নেই?

নাহ্। ছিল না। এবং এ-ও একটা পয়েন্ট। কারণ যারা নিয়মিত জগিং করে, তারা সময় বেঁধেই করে। কাজেই জয়দীপের হাতে একটা ঘড়ি থাকা উচিত ছিল। তিনি নিয়মিত জগিং করতে আসতেন। শ্রীলেখার ইন্টারভিউয়ে কথাটা আছে।

আর কোথাও কি যেতে চান?

 কর্নেল ব্যস্তভাবে বললেন, রেসকোর্সের উল্টোদিকে মেঘালয় আবাসনে।

 সেখানে কী?

দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা সচরাচর ঝামেলা এড়ানোর জন্য ভুল নাম-ঠিকানা দেয়। কিন্তু জয়দীপের দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের মধ্যে একজন রিটায়ার্ড আই এ এস অফিসার আছেন। তিনি অবশ্য জগিং করতে যাননি। বয়স্ক মানুষ। গাড়ি করে রেড রোডে যান এবং ফুটপাতে ঘণ্টাখানেক হাঁটাচলা করে বাড়ি ফেরেন। দুর্ঘটনার সময় তিনি কাছাকাছি ছিলেন।..

মেঘালয় আবাসনের ভেতর ঢুকে পার্কিং জোনে গাড়ি দাঁড় করালাম। কর্নেল সহাস্যে বললেন, এবার তুমি আমার সঙ্গে আসতে পারো। তোমার মুখ দেখে বুঝতে পারছি তুমি এখন প্রচণ্ড কৈতূহলী হয়ে উঠেছ।

বিনা বাক্যব্যয়ে নেমে গাড়ি লক করলাম। কর্নেলের কথাটা ঠিক। প্রশ্নটা তীব্র হয়ে উঠেছে। কেন জয়দীপ মাঝরাস্তায় গিয়েছিলেন?

মেঘালয় আবাসনের বাড়িগুলো বহুতল। সিকিউরিটি অফিস আছে। ই ব্লকের ছতলায় লিফটে উঠে কর্নেল একটা অ্যাপার্টমেন্টের ডোরবেলের সুইচ টিপলেন। দেখলাম নেমপ্লেটে লেখা আছে : এ কে ঘোষ আই এ এস। ব্র্যাকেটে রিটায়ার্ড লেখা।

একটি মধ্যবয়সী লোক দরজা খুলে অবাক চোখে কর্নেলের দিকে তাকালো। গৃহভৃত্য বলে মনে হলো তাকে। কর্নেল তার হাতে নেমকার্ড দিয়ে বললেন, মিঃ ঘোষের সঙ্গে দেখা করতে চাই। তুমি কার্ডটা দেখালেই হবে।

সে একটু ইতস্তত করে বলল, আপনারা ভেতরে এসে বসুন স্যার।

বসার ঘরে রুচির ছাপ আছে। বইয়ের র‍্যাক, চিত্রকলা, টুকিটাকি ভাস্কর্য সুন্দর সাজানো। আমরা সোফায় বসার একটু পরেই পাজামা-পাঞ্জাবি পরা এক বৃদ্ধ এসে সম্ভাষণ করলেন। অমায়িক কণ্ঠস্বরে ইংরেজিতে বললেন, বলুন কী করতে পারি আপনাদের জন্য?

এটা একটা কেতা। ভদ্রলোক কর্নেলের মুখোমুখি বসে কার্ডটার দিকে তাকিয়ে ফের বললেন, কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। নেচারিস্ট। বাহ্! আমারও একসময় নেচার বাতিক ছিল। যখন নর্থবেঙ্গলে ছিলাম

কর্নেল দ্রুত বললেন, আপনাকে একটু বিরক্ত করতে এসেছি। গত ১৪ ডিসেম্বর ভোরে রেড রোডে পথদুর্ঘটনায় এক ভদ্রলোক মারা যান। ওই সময় আপনি ঘটনাস্থলে ছিলেন।

মিঃ ঘোষ ভুরু কুঁচকে তাকালেন। ছিলাম। বাট এনিথিং রং?

ইট ডিপেন্ডস্।

আপনি একজন রিটায়ার্ড আর্মি অফিসার। আই থিংক, দা ভিকটিম ওয়াজ অ্যান আর্মিম্যান?

কর্নেল হাসলেন। না, না মিঃ ঘোষ! আমি তার ফ্যামিলিফ্রেন্ড। আমি আপনার কাছে কিছু কথা জানতে এসেছি।

সতর্ক মিঃ ঘোষ বললেন, কিন্তু আপনার উদ্দেশ্য না বললে আমি মুখ খুলতে রাজি নই। কারণ পুলিশ এ পর্যন্ত আমার সঙ্গে কোনও যোগাযোগ করেনি। কিছু গণ্ডগোল থাকলে নিশ্চয় করত।

কর্নেল আস্তে বললেন, ভিকটিমের নাম জয়দীপ ব্যানার্জি। একটা ট্রেডিং কোম্পানির ওনার ছিল সে। তার স্ত্রীর নামে কোম্পানির ওনারশিপ উইল করা আছে। তাই জয়দীপের আত্মীয়েরা গণ্ডগোল বাধাতে চাইছে। তাদের বক্তব্য স্ত্রীর দুর্ব্যবহারেই জয়দীপ আসলে সুইসাইড করেছে।

হুঁ! আমারও সুইসাইড মনে হয়েছিল। কারণ সে মাঠের দিক থেকে ছুটে এসে আমার প্রায় নাকের ডগা দিয়ে রাস্তায় নেমেছিল। ঘন কুয়াশা ছিল বটে, কিন্তু আমার ইন্সটিঙ্ক বলতে পারেন-ট্রাকের সামনে পড়ামাত্র মনে হয়েছিল সুইসাইড করল নাকি লোকটা? তবে পুলিশকে আমি সেকথা বলা উচিত মনে করিনি।

একটা ডিটেলস বলুন প্লিজ!

দেখুন কর্নেল সরকার! আমি কিন্তু কোর্টে সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে রাজি নই। তবে যদি কোর্ট থেকে সমন আসে, আমি পুলিশকে যা বলেছি, তার একটা কথাও বেশি বলব না।

না, না। সমন আসবে না। যদি আসে, যা খুশি বলবেন। কিন্তু আমি প্রকৃত ঘটনা জানতে চাই।

বেশ আর কী জানতে চান বলুন।

বডি কোথায় পড়েছিল? প্লিজ ডিটেলস বলুন।

মিঃ ঘোষ নির্লিপ্ত মুখে বললেন, আমি থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম। ট্রাকটা খুব জোরে আসছিল। বডি কোথায় পড়ল, সেই মুহূর্তে লক্ষ্য করিনি। পরে দেখলাম, আমার পিছনে কয়েক হাত দূরে ফুটপাতে বডিটা পড়ে আছে। বেশ কিছু লোক ওখানে হাঁটাচলা এবং জগিং করছিল। তারা দৌড়ে এল। তারপর– মিঃ ঘোষ একটু চুপ করে থাকার পর ফের বললেন, । প্রথমে একজন লোক বডিটাকে চিৎ করে শোয়াতে চেষ্টা করছিল। তার পেছনটা চোখে পড়েছিল। লম্বা চুল–যাকে বলে হর্সটেলের মতো বাঁধা। হিপি বলেই মনে হয়েছিল। মাত্র কয়েক হাত দুরে তো! পরনে হাফস্লিভ ব্যাগি সোয়েটার। শুধু। এটুকুই মনে পড়ছে। আমি কিন্তু ভিড়ে ঢুকিনি।

কর্নেল শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, হিপি?

 হ্যাঁ। আমি প্রতিদিন মর্নিংয়ে ওদিকটায় হাঁটাচলা করি। মাঝে মাঝে হিপিদের দেখতে পাই।

সে জয়দীপের বডি চিৎ করে শোয়ানোর চেষ্টা করছিল?

করছিল। সেটা স্বাভাবিক। তারপর ভিড় জমে গেল।

থ্যাঙ্কস মিঃ ঘোষ। চলি।

কর্নেল হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন এবং ঘর থেকে বেরুলেন। আমি ওঁকে অনুসরণ করলাম। লিফটের সামনে না গিয়ে উনি সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করলেন। গতিতে দ্রুততা ছিল। উত্তেজিত মনে হচ্ছিল ওঁকে।

গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বললাম, কর্নেল! তা হলে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে এল দেখছি। একটা ভাইটাল ক্লু।

কর্নেল তুম্বো মুখে বললেন, একটা ভাইটাল যোগসূত্র বলা উচিত।

 রুটি ছিনতাইকারী পাগল সেদিন ভোরে রেড রোডে কী করছিল?

 জগিং।

হেসে ফেললাম। ভ্যাট! পাগলরা জগিং করে নাকি?

 সার্জেন্ট আব্দুল করিমকে একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেছিল, দুজনকে মাঠ। থেকে দৌড়ে আসতে দেখেছে। তার সামনে দিয়েই ওরা ছুটে যায়। ভিকটিমের পেছনের লোকটার চুল দেখে সে তাকে হিপি ভেবেছিল। পরে আর হিপিটাকে সে দেখতে পায়নি। বোঝা যাচ্ছে, হিপিটাইপ চেহারা তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।

তার নামঠিকানা নিশ্চয় নেওয়া হয়েছিল?

হ্যাঁ! বলে কর্নেল পকেট থেকে নোটবই বের করলেন। বাবুয়া। কেয়ার অব রামধন। ঠিকানা বাবুঘাট। পেশা ঠিকা শ্রমিক।

বাবুঘাটে যাবেন নাকি?

নাহ্। বাবুঘাটে কোনও এক রামধন বা বাবুয়াকে খুঁজে বের করা সহজ নয়। ওখানে বিচিত্র পেশার অসংখ্য মানুষ থাকে। থাকে বলছি বটে, কিন্তু সে-থাকাও ডেরা বেঁধে থাকা নয়। সার্জেন্ট ভদ্রলোক নেহাত রুটিন ওয়ার্ক করেছেন। পথদুর্ঘটনা তো প্রতিদিনই হচ্ছে। এ সব ক্ষেত্রে কী ভাবে দায়সারাগোছের কাজকর্ম চলে, তুমি সাংবাদিক হিসেবে ভালই জানো। তাছাড়া ভিকটিমের পক্ষ থেকে ভালভাবে তদন্তের জন্য চাপ দেওয়া হয়নি।

 কেন হয়নি, সেটা কি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন নয়?

কর্নেল হাসলেন। তোমার সন্দেহের কাঁটা শ্রীলেখা দেবীর দিকে ঘুরে আছে।

সেটা অমূলক নয়, বস!

কর্নেল আরও জোরালো হেসে বললেন, ঠিক আছে। আজ সন্ধ্যা ৭ টায় মুখোমুখি শ্রীলেখার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাবে। তুমি ঝোপ বুঝে কোপ মেরে দেখতে পারো। তুমি সাংবাদিক। কাজেই তোমার সুযোগের অভাব হবে না।….

কর্নেলের ইলিয়ট রোডের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরতে প্রায় দেড়টা বেজে গেল। যষ্ঠীচরণ দরজাগুলো দিয়ে বলল, কড়েয়া থানা থেকে বাবামশাইকে ফোং করেছিল!

তাকে কিছুতেই ফোন বলাতে পারেন না কর্নেল। কিংবা আমার সন্দেহ সে ইচ্ছে করেই ফোং বলে। কর্নেল চোখ কটমটিয়ে বললেন, খিদে পেয়েছে।

ষষ্ঠী বলল, সব রেডি। আমিও রেডি হয়ে আছি। কিন্তু থানার পুলিশ বলছিল, সাহেব এলেই যেন ফোং করেন।

কর্নেল টেলিফোন তুলে ডায়াল করলেন। তারপর বললেন, কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি।…বলো বিনয়!…তাই বুঝি? আসলে আমিই ডাঃ বাগচীকে ফোন করে জানতে চেয়েছিলাম….হ্যাঁ। ঠিক করেছ। চেপে যাও….যথাসময়ে জানতে পারবে। ছাড়ছি।

বললাম, সাইকিয়াট্রিস্ট ডাঃ বাগচী থানায় যোগাযোগ করেছিলেন নাকি?

কর্নেল হাসলেন। হ্যাঁ। সেটা স্বাভাবিক। পুলিশকে কে না ভয় পায়? যাই হোক, ভাগ্যিস বিনয় থানায় ছিল। বুদ্ধি করে ম্যানেজ করেছে। কার্ডটা ওঁকে দেখায়নি। বলেছে, স্রেফ ভুল বোঝাবুঝি।

সেই ডিউটি অফিসারকে দিয়ে ডাঃ বাগচীকে শনাক্ত করা উচিত ছিল, কাল উনিই থানায় গিয়েছিলেন কি না!

বিনয় তোমার চেয়ে বুদ্ধিমান। নাহ্, ডাঃ বাগচী সেই লোকটি নন। সে ছিল প্রৌঢ় শক্তসমর্থ গাঁট্টাগোট্টা চেহারার লোক। চিবুকে দাড়ি। এদিকে ডাঃ বাগচীর বয়স তার চেয়ে কম। রোগা গড়ন। বলে কর্নেল বাথরুমে ঢুকলেন।

তবে স্নানের জন্য নয়, সেটা জানি। কলকাতায় থাকতে গ্রীষ্মে নাকি সপ্তাহে দুদিন এবং শীতে নাকি মাসে একদিন স্নান করেন। বাইরে গেলে অন্যরকম। কর্নেলের এই স্বাস্থ্যবিধি আমার কাছে আজও রহস্যময়। এ বয়সে অত কফি এবং চুরুট টানা সত্ত্বেও সবসময় তাজা থাকেন। কখনও জ্বরজ্বালাও দেখিনি। অবশ্য একবার ঠাণ্ডা লেগে স্বরভঙ্গ হয়েছিল দেখেছি।…..

লাঞ্চের পর আমার ভাতঘুমের অভ্যাস বহুদিনের। ষষ্ঠী তা জানে বলে ড্রয়িংরুমের সোফায় একটা বালিশ এবং কম্বল রেখেছিল। কর্নেল চুরুট ধরিয়ে একটা গাদা বই খুলে ইজিচেয়ারে হেলান দিয়েছিলেন। বইটা যে প্রজাপতি পোকামাকড় সংক্রান্ত, তা ছবি দেখেই বোঝা গিয়েছিল।

ষষ্ঠীর ডাকে ঘুম ভেঙে দেখি, ঘরে আবছায়া ঘনিয়েছে। ষষ্ঠী কফির পেয়ালা রেখে বলল, বাবামশাই একটু বেরিয়েছেন। বলে গেছেন, দাদাবাবুকে যেন আটকে রাখবি। আলো জ্বালব নাকি দাদাবাবু?

নাহ। থাক।

কফিতে চুমুক দেওয়ার পর ক্রমে শরীরের ম্যাজমেজে ভাবটা কেটে গেল। সাড়ে পাঁচটা বাজে। শীতকালে এখন সন্ধ্যাবেলা। রাস্তার আলোর আভাস জানালার পর্দার ফাঁকে ফুটে উঠছে।

কফি শেষ করেছি, সেইসময় টেলিফোন বাজল। হাত বাড়িয়ে ফোন তুলে সাড়া দিলাম। হালদারমশাইয়ের কণ্ঠস্বর ভেসে এল। কেডা? কর্নেলস্যারেরে চাই।

সকালের মতো রসিকতা করে বললাম, আপনার কর্নেলস্যার একটু বেরিয়েছেন হালদারমশাই।

জয়ন্তবাবু নাকি? বিজ্ঞাপন দিয়া ফ্যালাইছি। একখান ইংরাজি, দুইখান বাংলা। কিন্তু এদিকে এক কাণ্ড বাধছে।

বলুন!

 এইমাত্র কোন হালায় আমারে থ্রেটন করছিল। কয় কী, হার্ট ফুটা করব।

বলেন কী!

হঃ। ট্যার পাইয়া গেছে। আই ডাউট জয়ন্তবাবু, মর্নিংয়ে আমাগো ফলো করছিল। আর কর্নেলস্যারের কথাও কইছিল। ওই বুড়ারও টাক ফুটা করব। কইলাম–কী কইলাম কনতো? খি খি খি–

খি খি খি–মানে শুধু হাসলেন?

 হালদারমশাইয়ের কণ্ঠস্বর গম্ভীর শোনাল। কইয়া দিলাম, পিপীলিকার পাখা ওঠে মরিবার তরে!

আজ সন্ধ্যায় আপনার ক্লায়েন্টের ওখানে যাবার কথা।

হঃ! কর্নেলস্যারেরে কইবেন, আমি ম্যাডামের বাড়িতে উপস্থিত থাকব।

 হালদারমশাই! ছদ্মবেশে বেরুবেন কিন্তু!

 জয়ন্তবাবু! আই হ্যাভ আ লাইসেন্সড় গান দ্যাট ইউ নো ভেরি ওয়েল।

আচ্ছা, রাখছি।

বুঝলাম প্রাইভেট ডিটেকটিভ ভদ্রলোক আমার ওপর চটে গেলেন। এতক্ষণে ষষ্ঠী এসে আলো জ্বেলে দিল।

কর্নেল ফিরলেন ছটা নাগাদ। ফিরেই টুপি খুলে রেখে হাঁকলেন, ষষ্ঠী! কফি। আমরা বেরুব।

উনি ইজিচেয়ারে বসে হেলান দিলেন। বললাম, গোয়েন্দাগিরিতে বেরিয়েছিলেন?

কর্নেল একটু হেসে বললেন, কতকটা। কোনও ফোন এসেছিল নাকি? হালদারমশাইয়ের কথা বললাম। কর্নেল টাকে হাত বুলোতে থাকলেন। ষষ্ঠী শীগগির কফি আনল। কফিতে চুমুক দিয়ে কর্নেল বললেন, হঠাৎ একটা আইডিয়া মাথায় এসেছিল। কড়েয়া থানায় গিয়েছিলাম সেই রুটির দোকানের খোঁজে। বিনয় ছিল না। তবে তাতে আমার অসুবিধে হয়নি। প্রথমে জেনে নিলাম সো-কল্ড পাগলের হাতে নীলডায়াল ঘড়ি ছিল কি না। ছিল দামী জাপানি ঘড়ি সিটিজেন। সাদা ডায়াল। তো থানার অফিসারদের চেয়ে কনস্টেবলদের থানা এরিয়াটা নখদর্পণে থাকে। কাজেই দোকানটা খুঁজে বের করা সম্ভব হলো। দোকানদার ফজল মিয়া সত্যিই তেজী এবং রগচটা মানুষ। বললেন, স্যার! ও পাগলটাগল নয়। স্রেফ বদমাশ। কারণ কাছেই বড়রাস্তার মোড়ে তার ভাতিজার টেলারিং শপ আছে। সেই ভাতিজা দেখেছে, বদমাশটা মোটরসাইকেলে চেপে এসে ওর দোকানের সামনে নামে। তারপর মোটরসাইকেলে চাবি দিয়ে গলিতে এগিয়ে যায়। তারপর ফজল মিয়ার ভাতিজা রাত সাড়ে দশটা নাগাদ দোকান বন্ধ করছে, তখন দেখে সেই বজ্জাতটা দৌড়ে এসে মোটরসাইকেলে চাপল। চেপে হাওয়া হয়ে গেল। ফজল মিয়ার ভাতিজা কালকের ঝামেলার কথা শুনেছিল। কিন্তু দোকান থেকে বেরোয়নি। আজ সকালে চাচাকে জিজ্ঞেস করতে এসেছিল। সে থাকে পার্ক সার্কাসের ওদিকে।

অদ্ভুত তো!

 অদ্ভুত। কিন্তু জলবৎ তরল।

বুঝলাম না।

 কাল ডাঃ বাগচী দুটো লোক নিয়ে গাড়িতে করে ওকে তাড়া করেছিলেন। মোটরসাইকেল রাস্তার মোড়ে রেখে তাই সে গলিতে ঢুকে পড়ে। ধুরন্ধর বুদ্ধি! এরপর সে আত্মরক্ষার জন্য রুটি তুলে নিয়ে লোক জড়ো করে। বস্তি এরিয়ার ব্যাপার। নিমেষে লোকারণ্য হয়ে যায়। এবার সে পাগল সাজতে বাধ্য হয়। আত্মরক্ষার কৌশল!

কিন্তু কর্নেল, একটা প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। যারা তাকে গাড়ি চেপে তাড়া করে আসছিল, তারা কী ভাবে জানল সে পাগল সাজবে, তাই আগেভাগে একজন সাইকিয়াট্রিস্ট ডাক্তারের নেমকার্ড যোগাড় করে রেখেছিল?

কর্নেল হাসলেন। বুদ্ধিমানের প্রশ্ন। আসলে এটা দুই ধুরন্ধরের প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের নমুনা।

বুঝলাম না।

ধরো, জাল পাগলের নাম এক্স এবং তার প্রতিপক্ষের নাম ওয়াই। ওয়াই যখন দেখল এক্স পাগল সেজেছে এবং রুটিওয়ালা সদলবলে তাকে থানায় নিয়ে যাচ্ছে, তখন ওয়াই বুঝল যে, থানার লকআপে এক্সকে ঢোকানো হবেই। পুলিশের রীতিনীতি ওয়াইয়ের জানা। কার না জানা? অতএব ওয়াই দ্রুত ফন্দি আঁটল। ডাঃ বাগচীর নার্সিংহোম পাম অ্যাভেনিউতে। ঘটনাস্থল থেকে গাড়ি চেপে পৌঁছতে পাঁচনিমিটও লাগে না। কাজেই ওয়াই তৎক্ষণাৎ ডাঃ বাগচীর কাছে ছুটে যায় এবং কল্পিত কোনও মানসিক রোগীকে ভর্তি করানোর কথা তোলে। ডাঃ বাগচীর একটা নেমকার্ড চেয়ে নেয়। যে-কোনও ডাক্তারই তা দিয়ে থাকেন। নেমকার্ড হাতিয়ে ওয়াই ছুটে আসে কড়েয়া থানায়। এবার বাকিটা তোমার জানা।

ওঃ! কি সেয়ানা লোক!

কর্নেল অট্টহাসি হেসে বললেন, হ্যাঁ। সেয়ানে-সেয়ানে কোলাকুলি বলে একটা কথা আছে। তবে এক্ষেত্রে সেয়ানে-সেয়ানে লড়াই। ওয়াই হেরে ভুট!…

.

০৩.

শ্রীলেখা ব্যানার্জির বাড়ি সার্কাস অ্যাভেনিউয়ে একটা সংকীর্ণ গলিরাস্তার ভেতর দিকে। সাবেক আমলের দোতলা বাড়ি। সামনের প্রাঙ্গণে উঁচু-নিচু কিছু গাছ-লতা-গুল্মের সজ্জা আছে। পোর্টিকোর মাথায় উজ্জ্বল আলো জ্বলছিল। সেই আলোয় প্রাঙ্গণে আলো-ছায়া মিলেমিশে কেমন গা-ছমছমকরা রহস্য অবশ্য এটা আমারই অনুভূতি। তাছাড়া পরিবেশ সুনসান স্তব্ধ। গলিরাস্তাটায় আলো নেই বললেই চলে। লোকজনেরও আনাগোনা কম। একটা রিকশা ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে চলে গেল।

গেটের কাছে হর্ন দিতেই একটা লোক দৌড়ে এসে গেট খুলে দিয়েছিল এবং হালদারমশাইয়ের সাড়া পেয়েছিলাম। প্লিজ কাম ইন কর্নেলস্যার! ম্যাডাম ইজ অ্যাংশাসলি ওয়েটিং ফর ইউ। সেইসময় কুকুরের গর্জন শুনলাম। হালদারমশাই পাল্টা গর্জে বললেন, বদ্রীনাথ! কুত্তা সামাল দাও। কাম নাই, খালি চেঁচায়।

নিচের তলায় বনেদি ধরনে সাজানো বসার ঘর। হালদারমশাই আমাদের দোতলায় নিয়ে গেলেন। বারান্দায় শ্রীলেখা দাঁড়িয়েছিলেন। নমস্কার করে আমাদের একটা ঘরে ঢোকালেন। এই ঘরটা আধুনিক রীতিতে সাজানো। ছোট্ট একটি টি ভি আছে কোণের দিকে। আমাদের বসতে বলে শ্রীলেখা সম্ভবত আপ্যায়নের জন্য ভেতরের ঘরে যাচ্ছিলেন। কর্নেল বললেন, মিসেস ব্যানার্জি, প্লিজ বসুন। আগে কিছু জরুরি কথাবার্তা সেরে নিই।

শ্রীলেখাকে সকালের চেয়ে নিষ্প্রভ দেখাচ্ছিল। পুতুলের মতো বসলেন। আস্তে বললেন, আমাকে আজ দুপুরে অফিসে সেই লোকটা টেলিফোনে হুমকি দিয়েছে। কেন আমি প্রাইভেট ডিটেকটিভ লাগিয়েছি বলে ধমক দিল। তারপর মিঃ হালদারের কাছে শুনলাম, ওঁকেও হুমকি দিয়েছে।

হালদারমশাই কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কর্নেল ইশারায় তাকে থামিয়ে বললেন, প্রথমে আমার কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দিন।

বলুন।

 আপনার এ বাড়িতে কে কে থাকে?

ফ্যামিলির ওল্ড সারভ্যান্ট সুরেন, দারোয়ান বদ্রীনাথ আর মালতী। মালতী রান্নাবান্না ইত্যাদি করে। এরা বাড়িতেই নিচের তলায় থাকে। আমার স্বামীর মৃত্যুর পর মালতী আমার পাশের ঘরে থাকে। তবে মর্নিংয়ে আমার পি এ সুদেষ্ণা আসে। কোম্পানির কিছু প্রাইভেট অ্যান্ড কনফিডেন্সিয়াল কাজকর্ম আছে। সব সেরে সে এখানেই খেয়ে নেয় এবং আমার সঙ্গে অফিসে যায়। বিকেল পাঁচটায় তাকে ছেড়ে দিই। অবশ্য আর্জেন্ট কিছু কাজ থাকলে তাকে আমার সঙ্গে এ বাড়িতে আসতে হয়। শি ইজ স্মার্ট, এফিসিয়্যান্ট অ্যান্ড রিলায়েবল।

সুরেন, বদ্রীনাথ, মালতী আপনার বিশ্বস্ত?

 ও! দে আর রিলায়ে। আমার শ্বশুরমশাইয়ের আমল থেকে ওরা ফ্যামিলির লোক হিসেবে গণ্য।

কর্নেল শ্রীলেখার চোখে চোখ রেখে বললেন, আপনার স্বামী কি প্রতিদিন জগিং করতে যেতেন?

হ্যাঁ। বিয়ের পর থেকেই জয়ের এ অভ্যাস দেখে আসছি।

আপনাদের বিয়ে হয়েছে কতদিন আগে?

শ্রীলেখা আস্তে শ্বাস ফেলে বললেন, প্রায় দু বছর। আমাদের দুজনের মধ্যে তার আগে থেকেই একটা এমোশনাল সম্পর্ক ছিল। দুজনে একই কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টারের স্টুডেন্ট ছিলাম। সেই সূত্রে আলাপ।

আপনার শ্বশুরমশাইয়ের নাম কী?

সুশোভন ব্যানার্জি। জয়ের মাকে অবশ্য আমি দেখিনি। জয়ের ছেলেবেলায় তিনি মারা যান।

সুশোভনবাবু সম্ভবত ব্যবসা করতেন। বলে কর্নেল একটু হাসলেন। কারণ চাকরি করে আগের দিনে এমন বাড়ি করা সম্ভব ছিল না।

হ্যাঁ। আমার শ্বশুরমশাইয়ের ঘড়ির বিজনেস ছিল।

 ঘড়ি?

সুদক্ষিণা ওয়াচ কোম্পানি। আমার বিয়ের আগেই তার কোম্পানি উঠে যায়। জয়ের কাছে শুনেছি, এবং নিজেও দেখেছি খুব রাগী মানুষ ছিলেন। ব্যবসাবুদ্ধি ততকিছু ছিল না। কর্মচারীদের বড্ড বেশি বিশ্বাস করতেন। তারা তাকে ঠকাত। আসলে তার পূর্বপুরুষ ছিলেন জমিদার। সেই আভিজাত্য বজায় রেখে চলতেন।

মিসেস ব্যানার্জি, আপনার জগিংয়ের অভ্যাস নেই?

এই অতর্কিত প্রশ্নে শ্রীলেখা হকচকিয়ে উঠবেন ভেবেছিলাম। কিন্তু তেমন কোনও প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করলাম না। শ্রীলেখা নিষ্পলক দৃষ্টিতে বললেন, খুব স্বাভাবিক প্রশ্ন, কর্নেল সরকার! না, আমি জয়ের সঙ্গে জগিং করতে যেতাম না। কারণ জগিং কেন, জোরে হাঁটাচলাও আমার পক্ষে সম্ভব নয়। বছর সাতেক। আগে কলেজ থেকে ফেরার সময় রাস্তার একটা ম্যানহোলে আমার ডান পা। ঢুকে যায়। প্রচণ্ড বৃষ্টিতে রাস্তায় জল জমেছিল। ম্যানহোলটা ছিল খোলা। শ্রীলেখা চাপা শ্বাস ফেলে বললেন, হিপজয়েন্টে ক্র্যাক হয়েছিল। প্রায় ছমাস প্লাস্টার বাঁধা অবস্থায় শয্যাশায়ী ছিলাম। দ্যাটস এ লং স্টোরি! আমার। অ্যাকাডেমিক কেরিয়ারের সেখানেই শেষ। যখন হাঁটাচলা সম্ভব হলো, তখন। বাবা আমাকে অগত্যা কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টারে ভর্তি করে দিলেন।

আপনার বাবা বেঁচে আছেন?

না। মা-ও বেঁচে নেই। আমি বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। একটা চুপ করে থাকার পর শ্রীলেখা ঠোঁটের কোণে কেমন একটু হেসে বললেন, প্রশ্নটা আপনি তুলবেন আমি জানতাম। তাই সেই পুরনো দুর্ঘটনার মেডিক্যাল রিপোর্ট খুঁজে বের করে রেখেছি। যদি দেখতে চান–

কর্নেল দ্রুত বললেন, আপনি ইনটেলিজেন্ট। তবে না–কোনও মেডিক্যাল রিপোর্ট দেখার প্রয়োজন আমার নেই। আপনাকে প্রশ্ন করতে এসেছি। শুধু উত্তর দেওয়াই যথেষ্ট। আচ্ছা মিসেস ব্যানার্জি, কোনও অ্যাংলো ইন্ডিয়ান যুবককে কি আপনি চেনেন–মাথায় লম্বা চুল এবং পেছন দিকে হর্সটেলের মতো বাঁধা?

না তো! তবে শ্রীলেখা হঠাৎ থেমে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলেন।

 বলুন!

জয় তার মৃত্যুর আগের দিন রাত্রে কথায় কথায় বলছিল, ময়দানে একজন হিপি টাইপের যুবক তাকে জগিংয়ের সময় টিজ করে। আবার টিজ করলে সে পুলিশকে জানাবে। শ্রীলেখা চশমার ভেতর থেকে তীক্ষ্ণদৃষ্টে তাকালেন কর্নেলের দিকে। ডু ইউ নো দ্যাট গাই?

নাহ। চিনি না। তবে জানতে পেরেছি, সে একজন পাগল।

 একজ্যাক্টলি! জয় বলছিল, পাগল ছাড়া ওভাবে কেউ টিজ করে না। জগিংয়ের সময় বারবার নাকি সে জয়ের পাশ ঘেঁষে আসত। কখনও পেছন থেকে জয়ের পিঠে খোঁচা মেরে দূরে সরে যেত। আপনাকে বলা উচিত, জয় নিরীহ ভীতু মানুষ ছিল।

আচ্ছা মিসেস ব্যানার্জি, জগিং করতে যাওয়ার সময় মিঃ ব্যানার্জির হাতে নিশ্চয় ঘড়ি থাকত।

লক্ষ্য করিনি। সে উঠত খুব ভোরে। তখন আমি ঘুমিয়ে থাকতাম। বেডরুমে ইয়েল লক আছে। ভেতরে থেকে খোলা যায়। বাইরে থেকে খুলতে হলে চাবি লাগে। জয় এসে আমার ঘুম ভাঙাত।

আপনার স্বামীর কতগুলো রিস্টওয়াচ ছিল?

 গুনে দেখিনি। আমার শ্বশুরমশাই ওয়াচ কোম্পানির মালিক ছিলেন। কাজেই জয়ের ঘড়ির সংখ্যা অনেক। ওই দেখুন, শো-কেসে কত রিস্টওয়াচ সাজানো। অনেকগুলোই অচল এবং পুরনো। আপনি নীলডায়াল রোমার ঘড়ির কথা বলছিলেন। তেমন কোনও ঘড়ি কখনও দেখিনি। কোথাও খুঁজে পাইনি। বিলিভ মি!

কিন্তু তার একটা নীলডায়াল রোমার রিস্টওয়াচ অবশ্যই ছিল।

 ছিল তো, গেল কোথায়?

দুর্ঘটনায় তার মৃত্যুর সময় ওটা ছিনতাই হয়ে গেছে।

শ্রীলেখা নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকার পর বললেন, আপনি কি ভাবে জানলেন?

হালদারমশাই বলে উঠলেন, কর্নেলস্যারের কিছু অজানা থাকে না। আপনারে কইছিলাম না?

কর্নেল হাসলেন। বরং খুলে বলুন হালদারমশাই, তদন্ত করেই জানতে পেরেছি।

হঃ!

শ্রীলেখা বললেন, এবার কফি বলি। আপনি কফির ভক্ত।

 কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। এবার কফি খাওয়া যাক।

শ্রীলেখা বেরিয়ে গেলেন। কর্নেল ঘরের ভেতরটা দেখতে দেখতে কোণের সেই ছোট্ট টি ভির দিকে আঙুল তুলে চাপা স্বরে বললেন, হালদারমশাই, বলুন তো ওটা কী?

হালদারমশাই বললেন, ক্যান? টিভি।

কর্নেল হাসলেন। এতক্ষণে যন্ত্রটা খুঁটিয়ে দেখলাম। বললাম, কম্পিউটার। তবে ঘরে ঢুকেই মনে হচ্ছিল টিভি।

হালদারমশাই উঠে গিয়ে কম্পিউটারটা দেখে এলেন। বললেন, ঠিক কইছেন। কিন্তু কম্পিউটার অফিসের কামে লাগে। বাড়িতে কম্পিউটার কী কামে লাগব?

কর্নেল বললেন, এটা কম্পিউটারের যুগ হালদারমশাই! অদূর ভবিষ্যতে ঘরে ঘরে এই যন্ত্র কেনা হবে। বিশেষ করে ওটা পার্সোনাল কম্পিউটার। মিসেস ব্যানার্জির কোম্পানিরই তৈরি সম্ভবত।

কর্নেল কম্পিউটার নিয়ে বকবক শুরু করলেন। একটু পরে শ্রীলেখা এবং তার পিছনে পরিচারিকা মালতী ঘরে ঢুকল। মালতীর হাতে বিশাল ট্রে। বয়সে প্রৌঢ়া এবং শক্ত-সমর্থ গড়ন। বোঝা যায়, শ্রীলেখাকে গার্ড দেওয়ার উপযুক্ত সে। ট্রে রেখে সে চলে গেল।

শ্রীলেখা কফি তৈরি করতে করতে বললেন, আপনারা কম্পিউটার নিয়ে আলোচনা করছেন কানে এল। ওটা জয়ের নিজস্ব ডিজাইনে তৈরি। পার্সোনাল কম্পিউটারই বটে। তবে একটু স্পেশালিটি আছে।

কর্নেল বললেন, জানতে আগ্রহ হচ্ছে। বলুন!

ওতে জয়ের ফ্যামিলির অনেক তথ্য কোডিফায়েড করা আছে। তার জন্য বিশেষ বিশেষ কোড আগে জেনে রাখা দরকার। না জানলে ওটা ব্যবহার করা যাবে না। অবশ্য সাধারণ কম্পিউটারের মতোও ওটা ব্যবহার করা যায়। কিন্তু সেই বিশেষ কোড জানলে তথ্যগুলো পেপারশিটে টাইল্ড হয়ে বেরিয়ে আসবে।

কর্নেল বলে উঠলেন, আপনি জানেন না?

শ্রীলেখা কর্নেলের হাতে কফির পেয়ালা দিয়ে আস্তে বললেন, না। জয় বলেছিল, পাঁচটা লেটার অব্দি ডেটা ফিড করাতে পেরেছে। ওই লেটার গুলোকে বলা চলে কি ওয়ার্ড। আরও কয়েকটা কি ওয়ার্ড দিয়ে ডেটা ফিড করাতে পারলে সংশ্লিষ্ট পুরো তথ্য কোডিফায়েড হবে। আমি ওর সমস্যা বুঝতাম। কম্পিউটার ব্রেন বলে একটা কথা শুনে থাকবেন। সেই ব্রেনের নিজস্ব নার্ভ আছেনা, নার্ভ বলছি উপযুক্ত শব্দের অভাবেবরং চ্যানেল অব এ সার্টেন সিস্টেম বললে আপনাদের বুঝতে সুবিধা হবে। কতকটা যেন নির্দিষ্ট রাগের সরগমের মতো। আপনি বাজাবেন পূরৰী। হয়তো একটা কড়ি বা কোমল স্বরের হেরফেরে সেটা হয়ে গেল পুরিয়া। শ্রীলেখা হঠাৎ একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন যেন। উপমা দিয়ে এসব বোঝানো যায় না। প্রাইমারি নলেজ ইজ নেসেসারি।

 কর্নেল বললেন, সেই পাঁচটা লেটারের কি ওয়ার্ড মিঃ ব্যানার্জি আপনাকে বলেননি?

না জয় বলেছিল সেই কী ওয়ার্ড অসম্পূর্ণ। আমি জানলেও কোনও লাভ হতো না।

কম্পিউটারটা কি ঘরে বসেই তৈরি করেছিলেন মিঃ ব্যানার্জি?

হ্যাঁ। তবে ফ্যাক্টরি থেকে মেটারিয়াল নিয়ে এসেছিল।

আপনি ওটা কি ব্যবহার করেছেন সাধারণ কাজকর্মে?

করার সাহস পাইনি। খুব সেনসিটিভ কম্পিউটার। অটোমেটিক এয়ারকুলার ফিট করা আছে। সবসময় এয়ারকুলার চালু রাখতে হয়। লোডশেডিং হলে অটোমেটিক চার্জারের সাহায্যে এয়ারকুলার চালু থাকে।

একটু চুপ করে থাকার পর কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। আপনি যে ফোন নাম্বারটা দিয়েছেন, সেটা ফস্ নাম্বার।

 কইয়া দিছি ওনারে। হালদারমশাই বলে উঠলেন। জোক করছে হা– বলে থেমে গেলেন প্রাইভেট ডিটেকটিভ। ম্যাডামের সামনে শব্দটা উচ্চারণ করতে বাধল।

আমি হেসে ফেললাম। কর্নেল বললেন, এ ঘরে টেলিফোন আছে?

 শ্রীলেখা বললেন, আছে। ওই তো।

কর্নেল চোখ বুজে কিছু ভেবে নিলেন। তারপর বললেন, মিসেস ব্যানার্জি! তবু পরীক্ষা করে দেখা যাক। নাম্বারটা আপনি ডায়াল করুন। দা নাম্বার ইউ হ্যাভ ডায়ালড ডাজ নট একজিস্ট শুনলেও ফোন ছাড়বেন না। ক্রমাগত আপনিও বলে যাবেন আমি শ্রীলেখা ব্যানার্জি বলছি। এই নিন সেই নাম্বার। আগে দেখে নিন আমি ঠিক টুকেছি কি না।

এক মিনিট বলে শ্রীলখো পাশের ঘরে গেলেন। একটা স্লিপ নিয়ে এসে মিলিয়ে দেখে বললেন, ঠিক আছে। তারপর হাত বাড়িয়ে টেলিফোন তুলে ডায়াল করলেন।

শ্রীলেখা কর্নেলের কথামতো আমি শ্রীলেখা ব্যানার্জি বলছি আওড়াতে শুরু করলেন। বার দশেক বলার পর লক্ষ্য করলাম ওঁর মুখে চমক খেলে গেল। হ্যাঁ, আমি শ্রীলেখা ব্যানার্জি বলছি। রোমার ঘড়িটা….শুনুন! হিপিটাইপ একটা লোক আজ আমার অফিসে দেখা করেছে। সে বলছিল, আমার স্বামীর অ্যাকসিডেন্টের জায়গায় সে ঘড়িটা কুড়িয়ে পেয়েছে।….পাঁচ হাজার টাকা চাইছিল। দিস ইজ অ্যাবসার্ড! আমি অত টাকা…কী আশ্চর্য! আপনি অকারণ আমাকে….ওকে! ওকে! মেনে নিচ্ছি আপনারই রিস্টওয়াচ। তো আপনি খুঁজে বের করুন।…ডিটেকটিভ? প্লিজ লি! মিঃ হালদার আমার শ্বশুরের বন্ধু। তাই ন্যাচারালি…কর্নেল নীলাদ্রি সরকার–ডু ইউ নো হিম?…খুলে বলি শুনুন! কর্নেল সায়েবের কাছে গিয়েছিলাম অন্য একটা ব্যাপারে!….না, না। আপনার ব্যাপারে মোটেই নয়।…হ্যাঁ, উনি এখন নিচের ঘরে আছেন। বাট হোয়াই আর ইউ শ্যাডোয়িং মি, ম্যান? এ সব আমার বিজনেস সংক্রান্ত ব্যাপার।…দেন ইউ গো টু হেল!

ফোন রেখে দিলেন শ্রীলখো। নাসারন্ধ্র স্ফীত। মুখে আগুন জ্বলছে। বুঝলাম, যতটা নিষ্প্রভ মনে হয়েছিল ভদ্রমহিলাকে, ততটা মোটেই নন। প্রয়োজনে রণরঙ্গিনী মূর্তি ধরতে পারেন।

কর্নেল গম্ভীর। হালদারমশাই হতবাক হয়ে নস্যি নিচ্ছিলেন। এবার বললেন, কী কাণ্ড!

কর্নেল কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে বললেন, এ ঘরে নো স্মোকিং লেখা আছে। কম্পিউটারের প্রাণরক্ষার জন্য। যাই হোক, চুরুট খাওয়ার জন্য বাইরে যাব বরং!

শ্রীলেখা বললেন, আপনি যে এ বাড়িতে এসেছেন লোকটা তা জানে। তার মানে ওর চরেরা নজর রেখেছে।

শোনামাত্র হালদারমশাই সবেগে বেরিয়ে গেলেন। ওঁকে বাধা দেওয়ার সুযোগই দিলেন না কাউকে। কর্নেল হাসলেন। আমার ধারণা ঠিকই ছিল দেখা যাচ্ছে। ধড়িবাজ লোক। কিন্তু হালদারমশাই আবার অকারণ ঝামেলা না বাধান। মিসেস ব্যানার্জি, আপনি প্লিজ আপনার দারোয়ান বা সারভ্যান্টকে হালদারমশাইয়ের খোঁজে বেরুতে বলুন! উনি সম্ভবত গলির ভেতরই কোথাও ওত পাততে গেলেন।

শ্রীলেখা বেরিয়ে গেলেন। একটু পরে মালতী এসে ট্রে গুছিয়ে নিয়ে গেল। তার মুখ কেন যেন এখন বেজায় গম্ভীর।

কর্নেল চোখ বুজে আওড়ালেন, ম্যান নট লিভ বাই ব্রেড অ্যালোন। বাট ক্যান এনি ম্যান লিভ উইদাউট ব্রেড?

বললাম, সাবধান কর্নেল! আপনি কিন্তু সত্যি পাগল হয়ে যাবেন। আজ সকাল থেকে ব্রেড আপনাকে ভূতে পাওয়ার মতো পেয়ে বসেছে।

কর্নেল চোখ খুলে সোজা হয়ে বসলেন। কী বললে? কী বললে?

 বলছি ব্রেড আপনাকে—

 ব্রেড! বি আর ই এ ডি। ফাইভ লেটারস! মাই গুডনেস! বলে কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। তারপর সোজা কম্পিউটারের দিকে এগিয়ে গেলেন।

চাপা গলায় বললাম, আপনি কম্পিউটারটার বারোটা বাজাবেন কিন্তু! আপনি কখনও কম্পিউটার ট্রেনিং নিয়েছেন বলে শুনিনি।

কর্নেল কম্পিউটারের দিকে ঝুঁকেছেন, এমন সময় শ্রীলেখা ঘরে ঢুকে বলে উঠলেন, কর্নেল সরকার! প্লিজ ডোন্ট টাচ। ভেরি সেনসিটিভ কম্পিউটার।

মিসেস ব্যানার্জি! আপনার স্বামীর ফাইভ লেটারস কি ওয়ার্ড আমি জানি। প্লিজ লেট মি সি হোয়াট দা মেশিন স্পিকস টু মি।

শ্রীলেখা আবার বললেন, প্লিজ ডোন্ট টাচ দা মেশিন কর্নেল সরকার!

কর্নেল গ্রাহ্য করলেন না। খটাখট শব্দ শুনলাম। ভিসন স্ক্রিনে নিমেষে নীল রঙ এবং সেই রঙের ওপর সারবদ্ধ কালো বর্ণমালা ফুটে উঠল। তারপর কর্নেল পাশ থেকে একটা কাগজ ছিঁড়ে দিয়ে বোতাম টিপে যন্ত্রটা বন্ধ করলেন।

শ্রীলেখা হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কর্নেল কাগজটা পড়ে নিয়ে বললেন, মিঃ ব্যানার্জির নীলডায়াল ঘড়িটা পেলে অসম্পূর্ণ তথ্য সম্পূর্ণ হবে। ঘড়িটার। ডায়ালের উল্টোদিকে কিছু সংখ্যা আছে। তবে আই অ্যাম ভেরি সরি মিসেস ব্যানার্জি–সত্যের খাতিরে বলছি, আপনার স্বামী আপনাকে ইদানীং বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। কেন পারছিলেন না, তা আপনারই জানার কথা।

শ্রীলেখা সোফায় বসে পড়লেন। ভাঙা গলায় বললেন, পেপার শিটটা দেখতে পারি?

আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দিন। কেন আপনি আপনার স্বামীর আস্থা হারিয়েছিলেন?

জয় একথা লিখেছে? কঁপা-কঁপা গলায় কথাটা বলে শ্রীলেখা ঠোঁট কামড়ে ধরলেন।

হ্যাঁ। বলে কর্নেল কাগজটা ভাঁজ করে জ্যাকেটের ভেতরপকেটে চালান করে দিলেন। তারপর এগিয়ে এসে আগের জায়গায় বসলেন। কোনও মহিলার ব্যক্তিগত গোপনীয় ব্যাপার জানার একটুও আগ্রহ আমার নেই মিসেস ব্যানার্জি! আপনি অন্তত আভাসে জানাতে পারেন। আমার জানা দরকার। কারণ আমি এই রহস্যের জট ছাড়াতে নেমেছি। আমার এই এক অভ্যাস। শেষ পর্যন্ত না পৌঁছতে পারলে নিজেকে ব্যর্থ মানুষ মনে হয়।

শ্রীলেখা ঈষৎ ঝুঁকে দু হাতে মুখ ঢাকলেন।

 মিসেস ব্যানার্জি, আমি আপনার হিতৈষী।

আত্মসম্বরণ করে চোখের জল মুছে শ্রীলেখা বললেন, জয়কে আমি খুব লিবার্যাল অ্যান্ড মর্ডান ভাবতাম। জানতাম না, হি ওয়াজ সো জেলাস অ্যান্ড সো ফুলিশ, সো মিনমাইন্ডেড পার্সন।

আমার ধারণা আপনি এমন কারও সঙ্গে মেলামেশা করতেন, মিঃ ব্যানার্জি যাকে পছন্দ করতেন না। অথবা এমনও হতে পারে, তার সন্দেহ হয়েছিল আপনি তার সঙ্গে গোপন চক্রান্তে লিপ্ত?

শ্রীলেখা তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বরে বললেন, কিসের চক্রান্ত?

কর্নেল আস্তে বললেন, ঘড়িটা পেলে তা খুঁজে বের করতে পারব। তবে মিঃ ব্যানার্জির সন্দেহ করার শক্ত কারণ থাকা সম্ভব। আপনি কি কারও সঙ্গে বেশি মেলামেশা করতেন বা এখনও করেন?

 বাট হি ওয়াজ হিজ ডিয়ারেস্ট ফ্রেন্ড! শ্রীলেখা ক্ষুব্ধভাবে বললেন। তা ছাড়া সে তো এখন আমেরিকা চলে গেছে। আর মেলামেশার কথা যদি বলেন, জয়ই তার সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। হ্যাঁ, আমার সঙ্গে তার একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তা ঠিক। কিন্তু তা বন্ধুতার সম্পর্ক মাত্র। তার এতটুকু বেশি নয়।

কে তিনি? কী করতেন?

 অনীশ রায়। একটা বিজনেস কনসালট্যান্সি ফার্ম খুলেছিল। চলেনি। বন্ধ করে দিয়ে মাসখানেক আগে বোস্টনে গিয়ে একটা কাজ জুটিয়েছে। যাওয়ার পর আমাদের দুজনকে একই সঙ্গে একটা চিঠি লিখেছিল। দ্যাটস অল।

অনীশ ছাড়া আর কোনও

শ্রীলেখা শক্তমুখে বললেন, না।

একটু ভেবে বলুন।

না। অনীশ ছাড়া আমি কারও সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে মিশিনি। এখনও মিশি না।

তাহলে মিঃ ব্যানার্জির এই গোপনীয়তার ব্যাপারটা অন্য দিক থেকে ভেবে দেখতে হবে।

বাট হোয়াট আর দোজ কি লেটারস?

আপনার নিরাপত্তার স্বার্থে এখন তা জানানো উচিত হবে না। কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন হঠাৎ। আমার চুরুটের নেশা পেয়েছে। আর হালদারমশাই কোথায় গেলেন তাও দেখা দরকার। মিসেস ব্যানার্জি, কথা দিচ্ছি–শুধু কি ওয়ার্ডস কেন, সবকিছু আপনাকে জানাব। কিন্তু আমার অনুরোধ, এখন থেকে এই ঘরটা লক করে রাখুন। কেউ যেন এ ঘরে না ঢোকে। এমন কি, আপনার পি এ সুদেষ্ণাকেও এ ঘরে ঢুকতে দেবেন না। আপনি একা ঢুকতে পারেন। কিন্তু সাবধান! আপনার কথাতেই বলছি, ডোন্ট টাচ দা মেশিন।

 শ্রীলেখা আগের মতো নিষ্প্রভ। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আপনাকে বলছি, ওই কম্পিউটার আমি ব্যবহার করার সাহস পাইনি। আমার ভয় ছিল, ভুল লেটারে আঙুল পড়লে সব কোডিফায়েড ডেটা নষ্ট হতে পারে।

একজ্যাক্টলি। যাই হোক, ওয়েট অ্যান্ড সি। চিন্তার কারণ নেই।

আমরা পোর্টিকোতে নেমে গিয়ে আবার কুকুরের গর্জন শুনলাম। শ্রীলেখা ডাকলেন, সুরেনদা!

গেটের কাছ থেকে সাড়া এল। আমি এখানে আছি দিদিভাই! বদ্রী আমাকে এখানে থাকতে বলে গেল, এদিকে মোড়ে কী গণ্ডগোল হচ্ছে শুনছি।

কর্নেল বললেন, কোনদিকের মোড়ে?

ডানদিকের মোড়ে স্যার!

কর্নেল বললেন, জয়ন্ত! গাড়ির দরজা খোলো।

আমি লক খুলে স্টিয়ারিঙের সামনে বসলাম। কর্নেল বাঁদিকে বসলেন। স্টার্ট দিয়ে বেরুনোর সময় দেখলাম, শ্রীলেখা একটা প্রকাণ্ড অ্যালসেশিয়ানের গলার চেন ধরে গেটের দিকে আসছেন। সুরেন গেট খুলে দিল। শ্রীলেখা বললেন, সুরেনদা! তুমি গিয়ে বদ্রীকে ডেকে আনো। গেট বন্ধ করে যাও।

আমরা এসেছিলাম বাঁদিক থেকে। কর্নেলের নির্দেশে ডানদিকে চললাম। সুরেন আমাদের গাড়ির পেছনে আসছিল। তাগড়াই চেহারার লোক।

বড় রাস্তার মোড়ে গিয়ে দেখলাম একটা ছোটখাটো রকমের ভিড় জমেছে। একটা মোটরসাইকেল কাত হয়ে পড়ে আছে সেখানে। হালদারমশাই হাত-মুখ। নেড়ে ভিড়কে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছেন। আমাদের দেখেই বলে উঠলেন, বান্দরটা মোটসাইকেল ফ্যালাইয়া পলাইয়া গেল। সেই হিপি, কর্নেলস্যার!

কর্নেল নেমে গিয়ে মোটরসাইকেলটা দেখে নোট বইয়ে রেজিস্ট্রেশন নাম্বার টুকে নিলেন। এই সময় একটা লোক কর্নেলকে সেলাম দিয়ে বলল, আমি বদ্রী আছে স্যার! আমি না এলে এই বাবুসায়েবের বহত মুশকিল হতো।

হালদারমশাই তেড়ে এলেন। শাট আপ! তুমি আমাকে আচমকা না ধরলে হালার ঠ্যাঙে গুলি করতাম!

কর্নেল বললেন, সেই হিপিকে দেখেই গুলি ছুঁড়তে যাচ্ছিলেন নাকি?

হালদারমশাই হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, না বান্দরটারে তো আমিই বাঁচাইয়া দিছি। এখানে মোটরসাইকেল টার্ন দিছে, আমিও আসতাছি, আচমকা একটা লোকে এই গাছের আড়াল থেকে অরে অ্যাটাক করতে ছুটল। তার হাতে ড্যাগার ছিল। আমি তখনই রিভলভার তুলছি। হঃ! একখান গুলি ছুঁড়ছি। জাস্ট টু গ্রেটন দা অ্যাসাসিন। বলে হালদারমশাই ভিড়ের দিকে তর্জনী তুললেন। দা ফুলিশ মব! আমারে গুণ্ডা ভাবছে! কয় কী, আমি মোটরসাইকেল ছিনতাই করছিলাম।

কে কোনদিকে পালাল বলুন?

 দুইজনই গলি দিয়া গেছে। আমি ফলো করব কী–এই ফুলিশ মব আমারে আটকাইল। দেন দিস ফুলিশ ম্যান আমারে জাপটাইয়া ধরল। বলে গোয়েন্দাপ্রবর বদ্রীর দিকে তর্জনী তুললেন।

বদ্রীনাথ বলল, হাঁ, হাঁ। আমি কেমন করে জানব কী ঝামেলা হচ্ছে? তো দো আদমি আমার পাশ দিয়ে আগে পিছে ভেগে গেল।

হালদারমশাই এতক্ষণে সুযোগ পেলেন এবং গলিরাস্তায় সবেগে উধাও হয়ে গেলেন। কর্নেল বললেন, বদ্রী! তুমি আমার এই কার্ড নিয়ে থানায় চলে যাও। ও সি বা ডিউটি অফিসার যাকে পাও, কার্ড দেখিয়ে শীগগির আসতে বলল। কিছু জিজ্ঞেস করলে বলবে, আমি এখানে আছি। একটা ঝামেলা হয়েছে। ব্যস! আর কিছু বলবে না।

বদ্রী চলে গেল। ততক্ষণে আরও লোক এসে জড়ো হয়েছে। নানা জল্পনা চলছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা রঙ চড়িয়ে ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছে। কর্নেল পকেট থেকে ছোট্ট টর্চ বের করে মোটরসাইকেলটা আবার খুঁটিয়ে দেখতে থাকলেন।

সুরেন বলল, স্যার! দিদিভাই ওয়েট করছেন! আমি গিয়ে খবরটা দিই।

কর্নেল চাপা গলায় বললেন, হ্যাঁ। তুমি যাও। তবে তোমার দিদিভাই যদি এখানে আসতে চান, বারণ করবে। ওঁকে বলবে, আমি বলেছি উনি যেন বাড়ি থেকে রাত্রে বের না হন।

সুরেন হন্তদন্ত চলে গেল।

কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, জয়ন্ত! গাড়িতে গিয়ে বসো।….

মিনিট দশের মধ্যেই পুলিশের জিপ এল। বুঝলাম থানা এখান থেকে দূরে নয়। জিপ থেকে একজন অফিসার নেমে সহাস্যে বললেন, আবার কী ঝামেলা বাধালেন কর্নেলসায়েব?

বিনয়! এই মোটরসাইকেলটা সিজ করে নিয়ে যাও! কালকের মধ্যে মোটরভেহিকেলস থেকে জেনে নেবে এর মালিক কে?

কিন্তু ব্যাপারটা কী?

কর্নেল হাসলেন। আমি ঘটনার পরে এসেছি। কাজেই প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে জেনে নাও। আমি চলি। থানায় ফিরে আমাকে রিং কোরো অথবা আমিও রিং করতে পারি। আচ্ছা, চলি!….

অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে কর্নেল অভ্যাসমতো কফি হাঁকলেন না। ইজিচেয়ারে বসে হেলান দিয়ে জ্বলন্ত চুরুটের একরাশ ধোঁয়া ছাড়লেন। তারপর মিটিমিটি হেসে বললেন, তুমি বলছিলে আমি কম্পিউটার ট্রেনিং নিয়েছি কি না।

বললাম, নিয়েছেন বুঝতে পেরেছি। তবে বলেননি এই যা!

কম্পিউটারের যুগ। আমি পাখি প্রজাপতি ক্যাকটাস অর্কিড ইত্যাদি বিষয়ে এ যাবৎ যে সব তথ্য সংগ্রহ করেছি, তার পরিমাণ কম নয়। কিন্তু ক্ল্যাসিকিকেশন এবং অ্যানালিসিস করে সেগুলো সাজাতে পারলে প্রকৃতি এবং জীবজগৎ সম্পর্কে নতুন কথা জানা যাবে–এটা আমার বিশ্বাস। কিন্তু সেই পেপার ওয়ার্ক করা খুব পরিশ্রমসাধ্য। একটা কম্পিউটার থাকলে কাজটা খুব সহজ হয়। কাজেই সপ্তাহে চারদিন আমি কাছেই একটা ট্রেনিং সেন্টারে যাই। প্রাইমারি কোর্স শেষ করেছি। পরের কোর্স শেষ হলে একটা কম্পিউটার কিনে ফেলব। না–শ্রীলেখা এন্টারপ্রাইজ থেকে নয়। ওঁদের পার্সোনাল কম্পিউটার আমার কাজের উপযুক্ত নয়।

ষষ্ঠীচরণ পর্দার ফাঁকে উঁকি মেরে বলল, বাবামশাই, কফি খাবেন না?

 আধঘণ্টা পরে।

ঘড়ি দেখে বললাম, প্রায় সাড়ে নটা বাজে। এত রাতে ইস্টার্ন বাইপাস হয়ে আমাকে ফিরতে হবে।

কর্নেল হাসলেন। তবু তোমার তাড়া দেখছি না। কারণ তুমি মিঃ ব্যানার্জির কম্পিউটারাইজড় স্টেটমেন্ট সম্পর্কে আগ্রহী।

ওঁর ভঙ্গি নকল করে বললাম, দ্যাটস রাইট।

কর্নেল জ্যাকেটের ভেতর পকেট থেকে কাগজটা বের করে আমাকে দিলেন। তারপর চোখ বুজে হেলান দিলেন। কাগজের ভাজ খুলে দেখি, ইংরেজিতে টাইপ করা কিছু বাক্য–যার বাংলা করলে এই দাঁড়ায় :

কোনও মানুষ জানে না পরের মুহূর্তে কী ঘটতে পারে। তাই আমি আমাদের পারিবারিক গোপন তথ্য এই কম্পিউটারে কোডিফায়েড করে রাখলাম। ৭টা সংখ্যা এর সংকেত। সংখ্যাগুলো পাছে ভুলে যাই, তাই বাবার নীলডায়াল রোমার হাতঘড়ির পেছনে খোদাই করেছি। শ্রীলেখার কাছে আমার গোপন করা উচিত হচ্ছে না। কিন্তু তার প্রতি আস্থা রাখতে পারলাম, না। ইদানীং তার আচরণ-হাবভাব দেখে মনে হয়েছে, সে আগের শ্রীলেখা নয়। আমার সন্দেহ, সে আমার আড়ালে এমন কিছু করে, যা আমার পক্ষে ক্ষতিকর। আমি জানি শ্রীলেখা অত্যন্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী মেয়ে বিপজ্জনকভাবে উচ্চাকাঙ্ক্ষী (ডেঞ্জারাসলি অ্যাম্বিসাস)। তার অসাধ্য কিছু নেই।…

কাগজটা কর্নেলকে ফিরিয়ে দিয়ে বললাম, হ্যাঁ। ভদ্রমহিলা সম্পর্কে আমারও ধারণা হয়েছে শি ইজ ডেঞ্জারাসলি অ্যাম্বিসাস।

কর্নেল বললেন, মহিলা অমন একটা কোম্পানি চালাচ্ছেন বলে? ডার্লিং! তোমার মধ্যে মেল শোভিনিজম লক্ষ্য করেছি। জগৎটা কী দ্রুত বদলাচ্ছে, তা তোমার চোখে পড়ে না।

 শ্রীলেখার অফিসে খোঁজ নিন। দেখবেন কোনও পুরুষমানুষ ওঁর গার্জেন হয়ে উঠেছেন। আমি উঠে দাঁড়ালাম! হালদারমশাই শেষ অব্দি কী করলেন, জানার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু আমি ভীষণ ক্লান্ত।

কর্নেল দরজা পর্যন্ত আমাকে এগিয়ে দিয়ে অভ্যাসমতো বললেন, গুডনাইট! হ্যাভ এ নাইস স্লিপ।..

সল্ট লেকের ফ্ল্যাটে ফিরে খাওয়া-দাওয়ার পর যখন বিছানায় শুয়েছি, তখন হঠাৎ মাথায় এল, হিপিটাইপ সেই অ্যাংলো ইন্ডিয়ান যুবক কি ফাইভ লেটারস কি ওয়ার্ডের কথা জানে? কেন সে ওই কথাগুলো আওড়ায় এবং টেলিফোনেও শ্রীলেখা ব্যানার্জিকে কথাগুলো বলে উত্ত্যক্ত করে?

এই পয়েন্টটা আগে মাথায় এলে কর্নেলকে বলতাম। হালদারমশাই বলছিলেন রুটি রহস্য। সত্যিই তা-ই। রুটি–ব্রেড শব্দটাই শেষাবধি এই রহস্যের একটা চাবিকাঠি হয়ে উঠল!…

সকালে ঘুম থেকে উঠে বাথরুমে যাচ্ছি, তখন টেলিফোন বাজল। বিরক্ত হয়ে ফোন তুলে অভ্যাসমতো বললাম রং নাম্বার!

রাইট নাম্বার, ডার্লিং!

 সরি! মর্নিং, ওল্ড বস্!

 মর্নিং জয়ন্ত! সাড়ে আটটা বাজে। এখনই চলে এস। আমার এখানে ব্রেকফাস্ট করবে।

কী ব্যাপার? হালদারমশাইয়ের–

না। গতরাতে তোমার ঘুম ভাঙাতে চাইনি। কিন্তু যে ভয় করেছিলাম, তা-ই হয়েছে। সেই অ্যাংলো ইন্ডিয়ান যুবক গত রাতে খুন হয়েছে। আততায়ী তার পিঠে ছুরি মেরেছিল। সেই অবস্থায় সে পাঁচিল ডিঙিয়ে শ্রীলেখা ব্যানার্জির বাড়িতে ঢোকে। তারপর–না, ফোনে বলে বোঝাতে ওরিব না। তুমি এখনই চলে এস।….

.

০৪.

কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্ট গিয়ে দেখি, হালদারমশাই মনমরা হয়ে বসে আছেন। কর্নেলের মুখে যে ঘটনা শুনলাম, তা যেমন অদ্ভুত, তেমনই সাংঘাতিক।

তখন রাত প্রায় এগারোটা। শ্রীলেখা ব্যানার্জির অ্যালসেশিয়ান কুকুরটা রাত্রে ছাড়া থাকে। বদ্রীনাথের ঘরে সুরেন মোটরসাইকেলের ঘটনাটা নিয়ে উত্তেজিতভাবে কথা বলছিল সেই কুকুরটা প্রচণ্ড গর্জন শুরু করে। ওরা দুজনেই বেরিয়ে দেখে কুকুরটা পাঁচিলের ওপর ওঠার চেষ্টা করছে। ওখানে ঘন। ঝোপ-ঝাড় এবং একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ আছে। আলো কম। দুজনে দুটো লাঠি আর টর্চ নিয়ে দৌড়ে যায়। সেই মুহূর্তে একটা লোক পাঁচিল থেকে হুড়মুড় করে ঝোপে পড়ে যায়। সুরেন কুকুরটাকে আটকায় এবং টর্চের আলো ফেলে চমকে ওঠে।

কিন্তু তখনও দুজনে জানত না, লোকটার পিঠে একটা ছুরি বিধে আছে। সে যন্ত্রণার্ত কণ্ঠস্বরে অতি কষ্টে বলে, মাড্যামকো বোলাও!

শ্রীলেখা তখনও শুয়ে পড়েননি। দোতলার ব্যালকনি থেকে জানতে চান কী হয়েছে। পাঁচিলের কাছে গিয়ে তিনিও চমকে ওঠেন। হিপিটাইপের এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান যুবক ঝোপের ভেতর হাঁটু দুমড়ে বসে আছে। সে জড়ানো গলায় বলে, টেক ইট! টেক ইট!

তার হাতে ছিল একটা ঘড়ি। সেই নীলডায়াল রোমার রিস্টওয়াচ।

ঘড়িটা কম্পিত হাতে শ্রীলেখা তার হাত থেকে নেন। তারপরই যুবকটি উপুড় হয়ে পড়ে যায়। তখন ওঁরা দেখতে পান তার পিঠে একটা ছুরি বিঁধে আছে।

শ্রীলেখা বুদ্ধিমতী। পুলিশকে ফোন করেছিলেন। কিন্তু ঘড়িটার কথা বলেননি। সুরেন এবং বদ্রীনাথকেও কিছু বলতে নিষেধ করেন। পুলিশ সুরেন বা বদ্রীকে জেরা করার পর আবিষ্কার করে, যুবকটিকে ছুরি মারা হয়েছে বাইরে। ওদিকটায় একটা মোটর গ্যারেজ এবং পোড়ো এক টুকরো জায়গা আছে। সেখান থেকে রক্তের ছাপ এগিয়ে এসেছে পাঁচিলের দিকে। পুলিশ বলেছে, এই সেই রুটি ছিনতাইকারী পাগল।

হালদারমশাই ওদিকটায় ঘোরাঘুরি করেছিলেন বটে, কিন্তু মোটর গ্যারেজের পাশে পোড়ো জায়গায় অন্ধকার ছিল। ওখানে কী ঘটছে গলির মোড় থেকে তা তার চোখে পড়ার কথাও নয়। তিনি প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে তার মক্কেলের বাড়ির কাছে এসে টের পান, বাড়িতে একটা কিছু ঘটেছে। পরে পুলিশ তাকে জেরা করেছে। কিন্তু বুদ্ধিমতী শ্রীলেখা তার একজন আত্মীয় বলে পরিচয় দেন।

হালদারমশাই ওখান থেকেই কর্নেলকে ফোন করেছিলেন। কর্নেল তখনই বেরিয়ে পড়েন। নোনাপুকুর ট্রামডিপোর কাছে একটা ট্যাক্সি পেয়ে যান। শ্রীলেখার বাড়িতে তখনও পুলিশ ছিল। রক্তাক্ত যুবকটিকে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল। ডাক্তার মৃত ঘোষণা করেছেন তাকে। কর্নেল শ্রীলেখাকে ডেকে নিয়ে দোতলায় যান। ঘড়িটা তার কাছে চেয়ে নিয়ে সেই ঘরে ঢুকে কম্পিউটারের সামনে বসেন। ঘড়ি পিছনে কয়েকটা সংখ্যা খোদাই করা ছিল। আতসকাঁচে সেগুলো দেখে সাবধানে সংখ্যাগুলোর বোতাম টেপেন। আগের মতো একটা টাইপকরা কাগজ বেরিয়ে আসে। কাগজটা তিনি শ্রীলেখাকে পরে দেখাবেন বলেছেন। শ্রীলেখা ওই অবস্থায় তাকে অবশ্য পীড়াপীড়ি করেননি। তবে শ্রীলেখার অগোচরে দুটে কোডিফায়েড ডেটাই কর্নেল কম্পিউটার থেকে মুছে নষ্ট করে দিয়েছেন।

কর্নেলের ড্রয়িংরুমেই ব্রেকফাস্ট খেতে খেতে ঘটনাটা শুনলাম। কালকের মতো আজও কর্নেল সকাল-সকাল ব্রেকফাস্ট সেরে নিলেন। হালদারমশাইয়ের খুব ধকল গেছে। তবু পুলিশ জীবনের ট্রেনিং এখনও কাজে লাগে। আসার পথে ব্রেকফাস্ট করেছেন। ষষ্ঠী এবার কফি আনলে বেশি দুধমেশানো ওঁর নির্দিষ্ট পেয়ালাটা তুলে নিয়ে চুমুক দিলেন। আপনমনে শুধু বললেন, ভেরি স্যাড!

বললাম, দুটো প্রশ্ন আমার মাথায় আসছে।

 কর্নেল গলার ভেতর বললেন, বলো!

 এক : যুবকটি ম্যান ক্যান নট লিভ বাই ব্রেড অ্যালেন ইত্যাদি আওড়াত। তার মানে সে ওই কম্পিউটারের ফাইভ লেটারস কি ওয়ার্ড ব্রেড কথাটা জানত। কিন্তু কেমন করে সে জানতে পেরেছিল? দুই : কড়েয়া থানায় তাকে পুলিশ সার্চ করে কোনও রোমার ঘড়ি পায়নি। ঘড়িটা তখন সে কোথায় রেখেছিল?

যে যুবক মোটরসাইকেলে চেপে ঘুরে বেড়াত, তার একটা নির্দিষ্ট ডেরা থাকতে বাধ্য। ঘড়িটা সেখানে লুকিয়ে রাখত সে। বলে কর্নেল মাথা নাড়লেন। না এখনও এর প্রমাণ পাইনি। কিন্তু তোমার প্রথম প্রশ্নের যুক্তিসঙ্গত উত্তর এ ছাড়া আর কী হতে পারে? আর ব্রেড-হ্যাঁ। এই কথাটা সে জানত। মিসেস ব্যানার্জিকে তার উড়ো ফোনের উদ্দেশ্য স্পষ্ট। তার দিক থেকে একটা আগ্রহ সে আশা করেছিল। কিন্তু আমরা জানি, উনি তার উড়ো ফোন শুনে একটুও আগ্রহ দেখাতে চাননি। তৎক্ষণাৎ ফোন নামিয়ে রাখতেন। কেন এমন করতেন, তা-ও স্পষ্ট। কেউ তাকে উত্ত্যক্ত করছে ভাবতেন। কোনও যুবতীর পক্ষে এটাই কি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া নয়? আজকাল টেলিফোনে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার খবর প্রায়ই বেরোয়।

হালদারমশাই বললেন, আমার ক্লায়েন্টেরে কেউ ঘড়ির জন্য থ্রেটন না। করলে উনি আমার লগে যোগাযোগ করতেন না। তাই না কর্নেলস্যার?

তা ঠিক। তবে ব্রেড শব্দের রহস্য যুবকটি জানত। জয়ন্ত যুক্তিযুক্ত প্রশ্ন তুলেছে। কী ভাবে জেনেছিল? কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, এ প্রশ্নের উত্তর অন্তত তার মুখ থেকে আর পাওয়া যাবে না। হি ইজ ডেড। কর্নেল একটু চুপ করে। থাকার পর ফের বললেন, মিসেস ব্যানার্জিকে সে চিঠি লিখেই বা কোনও কথা জানায়নি কেন? এ-ও আশ্চর্য?

বললাম, তার আচরণ অদ্ভুত! সরাসরি ওঁর সঙ্গে দেখা করতেও পারত।

সাহস পায়নি। শ্রীলেখার অফিস এবং বাড়িতে তার প্রতিপক্ষ সারাক্ষণ নজর রেখেছিল, এটা স্পষ্ট। গত রাতে মরিয়া হয়ে শ্রীলেখার সঙ্গে দেখা করতে যায় সে। তাই তাকে মারা পড়তে হয়েছে। কিন্তু আশ্চর্য! ঘড়িটা সে শ্রীলেখাকে শেষ পর্যন্ত ফেরত দিতে পেরেছে। তার যেন একান্ত উদ্দেশ্য ছিল দুর্ঘটনার পর জয়দীপ ব্যানার্জির হাত থেকে ছিনিয়ে নেওয়া ঘড়িটা তার স্ত্রীকে ফেরত দেওয়া। তাই না?

বুঝলাম প্রাজ্ঞ রহস্যভেদী তার থিওরি সাজিয়ে ফেলেছেন এবং তাতে কোনও দুর্বল পয়েন্ট আছে কি না বুঝতে চাইছেন। হালদারমশাই অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, হঃ! আমি বললাম, জয়দীপকে সে জগিংয়ের সময়। উত্ত্যক্ত করত–শ্রীলেখা বলেছিলেন। দুর্ঘটনার আগের মুহূর্তে তাকে জয়দীপের। পেছনে দৌড়তে দেখা গেছে–জনৈক ঠিকা শ্রমিক বাবুয়ার স্টেটমেন্ট অনুসারে হেস্টিংস থানার ট্রাফিক সার্জেন্ট আপনাকে একথা বলেছেন। কর্নেল! উত্তেজনায় আমি নেড়ে উঠলাম। সে কি জানত জয়দীপের হাতের ঘড়িটা সে ছিনিয়ে না নিলে অন্য কেউ ছিনিয়ে নেবে এবং ছিনিয়ে নেওয়ার জন্যই অন্য কেউ সেখানে উপস্থিত ছিল?

কর্নেল বললেন, তুমি বুদ্ধিমানের মতো প্রশ্ন তুলেছ। ঠিক তা-ই।

তা হলে তাকে সৎ এবং বিবেকবান বলতে হয়।

সো ইট অ্যাপিয়ারস। আপাতদৃষ্টে তার আচরণ থেকে এরকম ধারণা অবশ্য করা চলে। কিন্তু যতক্ষণ না তার পুরো পরিচয় জানা যাচ্ছে, ততক্ষণ তাকে ফুলমার্ক আমি দিতে পারছি না। আমাদের সামনে এ মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, সে জয়দীপের, কম্পিউটারে ফিড করা কোডিফায়েড ডেটা সম্পর্কে অবহিত ছিল। বাট হাউ? বলে কর্নেল হালদারমশাইয়ের দিকে তাকালেন। হালদারমশাই! পুলিশ অফিসিয়াল প্রসেসে কাজ করে। পুলিশকে থু প্রপার চ্যানেলে এগোতে হয়। এটা একটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আপনি একবার বলেছিলেন মনে পড়ছে, মোটরভেহিকেলস ডিপার্টমেন্টে আপনার জানাশোনা লোক আছে।

হালদারমশাই ঝটপট বললেন, আছে। আমার এক ভাগনা।

 আপনি মোটরসাইকেলটার মালিকের নাম-ঠিকানা যোগাড় করে দিতে পারবেন?

হালদারমশাই ঘড়ি দেখে নিয়ে যথারীতি যাই গিয়া বলে তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে গেলেন।

জিজ্ঞেস করলাম, বডি শনাক্ত হয়েছে কি না খবর নেওয়া উচিত। নিয়েছেন?

কর্নেল বললেন, এখন পর্যন্ত সে-খবর পাইনি। পুলিশের অনেক ইনফরমার থাকে। দেখা যাক।

ওর পকেটে নিশ্চয় কোনও কাগজপত্র আছে?

 কিছু পাওয়া যায়নি।

 মোটরসাইকেলের ডকুমেন্টস, ড্রাইভিং লাইসেন্স, পলিউশন সার্টিফিকেট।

নাথিং।

 অদ্ভুত তো! আচ্ছা কর্নেল, গত পরশু কড়েয়া থানায় ওকে সার্চ করেছিল পুলিশ। তখনও কি কোনও কাগজপত্র পাওয়া যায়নি?

নাহ্। শুধু হিপপকেটে নগদ শতিনেক টাকা, ডান পকেটে একটা সিগারেটের প্যাকেট আর বাঁ পকেটে একটা রুমাল। ডান পকেটে কিছু খুচরো পয়সাও ছিল। আর একটা লাইটার।

সিটিজেন রিস্টওয়াচ ছিল কিন্তু!

 হুঁ। দ্যাটস্ অল।

গত রাতের সেই রিস্টওয়াচটা ছিল না?

না।

মোটরসাইকেলটা সার্চ করা হয়েছে তো?

কর্নেল হাসলেন। পার্টস বাই পার্টস অবশ্য খোলা হয়নি।

 তার মানে কিছু পাওয়া যায়নি। অদ্ভুত! সত্যিই অদ্ভুত! কর্নেল! আপনি ওকে যতই ধুরন্ধর বা সেয়ানা বলুন, আমার এবার মনে হচ্ছে সত্যিই ওর মাথার গণ্ডগোল ছিল। ওই যে একটা কথা আছে, সেয়ানা পাগল!

কর্নেল ঘড়ি দেখলেন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চলো, বেরুনো যাক। শ্রীলেখা আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। আজ অফিস যাবেন না।

নিচে গিয়ে গাড়িতে উঠে বললাম, জয়দীপের দ্বিতীয় ডেটা সম্পর্কে জানতে আগ্রহ হচ্ছে। কথায় কথায় ওটা ভুলে গিয়েছিলাম। সঙ্গে কাগজটা থাকলে দিন। চোখ বুলিয়ে নিই।

কর্নেল চোখ কটমটিয়ে বললেন, আমার মাথাখারাপ যে সঙ্গে ওটা নিয়ে ঘুরব ভাবছ? তা ছাড়া তুমি গাড়ি ড্রাইভ করার সময় ওটা পড়বে এবং নির্ঘাত অ্যাকসিডেন্ট বাধাবে।

বলেন কী! ওতে কোনও সাংঘাতিক রোমাঞ্চকর তথ্য আছে বুঝি?

 থাক বা না থাক, ড্রাইভিংয়ের সময় অন্যমনস্কতা বিপজ্জনক।

পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে পৌঁছে কর্নেল বললেন, জে সি রোড ধরে সোজা চলো। তারপর বাঁদিকে সার্কাস অ্যাভেনিউতে ঢুকে যাবে। একটা সাদা মারুতি সম্ভবত আমাদের ফলো করছে। না না, ভয় পাওয়ার কিছু নেই।

ব্যাকভিউ মিররে পেছনে তেমন গাড়ি দেখতে পেলাম না। বললাম, গাড়িটা কোথায়?

পেছনে বাঁদিকে। একটা বড় ট্রাক ওকে এগোতে দিচ্ছে না। এক কাজ করো! থিয়েটার রোডের পরই বাঁদিকের গলিতে ঢুকে পড়ো। লুকোচুরি খেলা যাক।

ভয় যে পাইনি, তা নয়। এই ভিড়ে আমার গাড়ির টায়ারে গুলি ছুঁড়ে ফসানো সহজ। তারপর পেছনকার ট্রাক এসে আমার গাড়ির ওপর পড়লেই গেছি।

কিন্তু পেছনকার বিশাল ট্রাকের ড্রাইভার কোনও গাড়িকে পাশ কাটাতে দিচ্ছে না। দ্বিমুখী রাস্তার মাঝ বরাবর ছোট ছোট আইল্যান্ড এবং উল্টোদিক থেকে আসা গাড়ির আঁকও ঘন। থিয়েটার রোডের মোড়ে থামতে হলো। কর্নেল বাঁদিকের উইন্ডো দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখে বললেন, সাদা মারুতিটা বাঁদিকের গলিতে ঢুকে গেল। তুমি বরং সিধে চলো। কারণ যে-গলিতে ও ঢুকল, তা বেজায় পেঁচালো। আমি সিওর এই এলাকা ওর অজানা। ওই গলিটার দুধারে মোটর গ্যারাজ, পুরনো পার্টসের ঘিঞ্জি দোকান। তা ছাড়া শেষপর্যন্ত যেখানে বেরুনোর রাস্তা পাবে, সেখানেও আবার পেঁচালো গলি।

আপনার কেন মনে হচ্ছে, ওই গাড়িটা আমাদের ফলো করছিল?

 আজ সকালে জানালা থেকে লক্ষ্য করেছি গাড়িটা আমার অ্যাপার্টমেন্টের নিচে উল্টোদিকে একটা গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। বেরুনোর, সময়ও তাকে দেখলাম। তারপর সে আমাদের পিছু নিল।

নেমে গিয়ে বরং চার্জ করা উচিত ছিল। আপনার সঙ্গে তো লাইসেন্স আর্মস আছে।

কর্নেল প্রায় অট্টহাসি হাসলেন। রাস্তাঘাটে ফিল্মের নকল করতে বলছ ডার্লিং? এ বয়সে নাচন-কোঁদন ঢিসুম ঢিসুম আমার সাজে না, অবশ্য তোমার তা সাজে। একজন হিরোইনও এক্ষেত্রে আছে।

থিয়েটার রোডের মোড় পেরিয়ে গিয়ে বললাম, গাড়িটার নাম্বার নেওয়া উচিত ছিল। নিয়েছেন?

এ সব গাড়িতে ভুয়ো নাম্বারপ্লেট লাগানো থাকে।

 আমাদের ফলো করে ওর কী লাভ?

আমার টাক ফুটো করবে বলেছিল হালদারমশাইকে! তবে?

 কর্নেল! আপনি ব্যাপারটা হালকাভাবে নেবেন না।

কর্নেল এতক্ষণে গম্ভীর হলেন। বললেন, নাহ্। আর টাক ফুটো করবৈ না। কারণ তা হলে জয়দীপ ব্যানার্জির গোপন তথ্য হাতানোর আশায় ছাই পড়বে। এখন ওর কাজ আমাকে শুধু ফলো করা।

সার্কাস অ্যাভেনিউতে কিছুটা যাওয়ার পর কর্নেলের নির্দেশে ডানদিকের একটা গলিরাস্তায় ঢুকলাম। এবার চিনতে পারলাম বাড়িটা।

হর্ন শুনে বদ্রী গেট খুলে দিল। পোর্টিকোর তলায় গাড়ি রেখে দুজনে বেরোলাম। সুরেন দাঁড়িয়েছিল। সেলাম দিয়ে ওপরে নিয়ে গেল। গত সন্ধ্যায় যে ঘরে আমরা বসেছিলাম, সুরেন সেই ঘরে আমাদের ঢোকাল। একটু অবাক হয়ে বললাম, ঘরটা আপনি লক করে রাখতে বলেছিলেন!

কর্নেল চাপাস্বরে বললেন, আজ সকালে ফোন করে বলেছি, আর লক করে রাখার দরকার নেই।

কর্নেলের চোখে কৌতুক ঝিলিক দিল। দ্রুত বললাম, আপনি চাইছেন এ ঘরে চোর এসে হানা দিক। ইজ ইট এ ট্র্যাপ, বস্?

উনি ইশারায় চুপ করতে বললেন। শ্রীলেখা এলেন প্রায় পাঁচ নিমিট পরে। চেহারায় চঞ্চল বিভ্রান্ত ভাব। বললেন, আপনাদের বসিয়ে রাখার জন্য দুঃখিত। আমার পি এ সুদেষ্ণা আজ আসেনি। মর্নিংয়ে অনেক জরুরি কাজ থাকে। আশ্চর্য ব্যাপার! ফোনেও জানাতে পারত। অগত্যা আমি রিং করলাম। কেউ ফোন ধরল না। দিস ইজ সামথিং অড।

সুদেষ্ণার পুরো নাম কী?

সুদেষ্ণা দত্ত। আমার অবাক লাগছে, গত রাতে ওকে রিং করে আজ সাড়ে ছটার মধ্যে আসতে বললাম। এ-ও বললাম, একটা মিস-হ্যাপ হয়েছে। অফিস যাব না। তাই শ্রীলেখা বিরক্ত মুখে বললেন, সুদেষ্ণা এমন কখনও করে না। বর্ষার সময় প্রচণ্ড বৃষ্টি, রাস্তায় জল, রাফ ওয়েদার–তবু সে এসেছে।

আমি বললাম, রিং হচ্ছে, কেউ ফোন ধরছে না। তার মানে, সুদেষ্ণা হয়তো বেরিয়েছিল এখানে আসার জন্য। পথে তার কোনও বিপদ হয়নি তো?

শ্রীলেখা চমকে উঠেছিলেন। আস্তে বললেন, কিন্তু ওর কী বিপদ হবে? কেন হবে?

কর্নেল বললেন, সুদেষ্ণা কতদিন আপনার পি এর পোস্টে আছে?

 মাস দুয়েক। তার আগে অফিসে সে স্টেনোটাইপিস্ট ছিল। জয় আমার কাজে সাহায্যের জন্যই সুদেষ্ণাকে দিয়েছিল। শি ইজ সিনসিয়ার, অনেস্ট অ্যান্ড রিলায়েবল কর্নেল সরকার!

বিবাহিতা?

না। নামের আগে মিস লেখে। ফ্লুয়েন্টলি ইংলিশ বলে।

 সে থাকে কোথায়?

 গোবরা এরিয়ায়। ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের ওদিকে–আমি চিনি না।

 আপনি আর একবার রিং করে দেখুন।

শ্রীলেখা টেলিফোন তুলে ডায়াল করে বললেন, রিং হয়ে যাচ্ছে আগের মতো। এই দেখুন।

শ্রীলেখা কর্নেলের হাতে টেলিফোন দিলেন। কর্নেল একটু পরে ফোন রেখে বললেন, অবশ্য কলকাতার টেলিফোন হঠাৎ-হঠাৎ অচল হয়ে যায়। রিং ঠিকই হয়। কিন্তু আসলে লাইনটাই খারাপ। তো সুদেষ্ণার বয়স কত–আই মিন, আপনার চেয়ে নিশ্চয় কম?

 শি ইজ ইয়াং। অফিসিয়াল রেকর্ডে ঠিক কত বয়স লেখা আছে জানি না। জেনে বলতে পারি।

ঠিকানাটা আপনি জানেন?

না। অফিস রেকর্ড থেকে ফোন করে জেনে নিতে পারি। কিন্তু আপনি কি ভাবছেন সত্যি তার কোনও বিপদ হয়েছে?

এই সময় মালতী তেমনই গম্ভীর মুখে ট্রেতে কফির পট পেয়ালা স্ন্যাকস ইত্যাদি নিয়ে ঘরে ঢুকল। নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল। শ্রীলেখা তার কোম্পানি অফিসে টেলিফোন করছিলেন। একটু পরে বললেন, শেখর…হ্যাঁ, শোনো! সুদেষ্ণা এখনও আসেনি। ওর বাড়ির ঠিকানাটা দরকার।….তুমি নিজে দেখ। কম্পিউটারাইজড করা আছে। দিস ইজ আর্জেন্ট। আমি ধরে আছি।…

কিছুক্ষণ পরে একটা স্লিপে ঠিকানা লিখে শ্রীলেখা কর্নেলকে দিলেন। ফের বললেন, আপনি কি সত্যিই ভাবছেন সুদেষ্ণার কিচ্ছু হয়েছে?

কর্নেল মাথা নাড়লেন। নাহ্। জয়ন্তের ভাবনাচিন্তার সঙ্গে আমার ভাবনাচিন্তা খুব কদাচিৎ মেলে। বাই দা বাই, এর আগে কখনও দরকার হলে আপনি সুদেষ্ণাকে কি রিং করেছেন?

করেছি।

 প্রতিবারই সুদেষ্ণা ফোন ধরেছেনাকি কখনও অন্য কেউ ধরেছে?

 কখনও কখনও অন্য কেউ। সে সুদেষ্ণাকে ডেকে দিয়েছে।

 মেল অর ফিমেল?

মেল। সুদেষ্ণাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। বলেছিল, তার এক রিলেটিভ। শ্রীলেখা ভুরু কুঁচকে কিছু স্মরণ করার পর ফের বললেন, সুদেষ্ণা বলেছিল, সে বাই চান্স বাইরে গেলে যে টেলিফোন ধরবে, তাকে যেন মেসেজটা দিই। তা হলে সুদেষ্ণা ফেরার পর আমাকে রিংব্যাক করবে। আমার ধারণা, শি ইজ লিভিং উইদ হার বয়ফ্রেন্ড। তবে ওর ব্যক্তিগত কোনও ব্যাপারে আমি কোনও ইন্টারেস্ট দেখাইনি। জাস্ট ওর কথার সূত্রে আমার একটা প্রশ্ন মাত্র।

সুদেষ্ণা তার নাম বলেছিল?

নাম– শ্রীলেখা কর্নেলের দিকে তাকালেন। চশমার ভেতর থেকে তার দৃষ্টিটা তীক্ষ্ণ দেখাল। কর্নেল সরকার! ডু ইউ ফিল এনিথিং রং উইদ মাই পি এ?

কর্নেল কফির পেয়ালা নামিয়ে রেখে বললেন, আই অ্যাম নট সিওর মিসেস ব্যানার্জি। আমার এই বদ অভ্যাস বলতে পারেন–যা কিছু জানতে চাই, তা যথাসাধ্য পুরোটা জেনে নিতে চেষ্টা করি।

শ্রীলেখা একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, মনে পড়ছে, সুদেষ্ণা একজ্যাক্টলি যা বলেছিল–বাই চান্স আমি বাইরে গেলে ববকে রিং করে মেসেজটা দেবেন!

বব?

হ্যাঁ। সুদেষ্ণার সেই আত্মীয়ের ডাকনাম–দ্যাট ওয়াজ মাই ইমপ্রেশন্। তবে ঠিক এই নামটা শুনেও আমার মনে হয়েছিল বব ইজ হার বয়ফ্রেন্ড অ্যান্ড দে আর লিভিং টুগেদার।

 কর্নেল চুরুট বের করেই পকেটে ঢোকালেন। নো স্মোকিং লেখা আছে। একটা বোর্ডে, তা গতকাল সন্ধ্যায় দেখেছি। সেনসিটিভ পার্সোনাল কম্পিউটারের পক্ষে ধোঁয়া ক্ষতিকর। কর্নেল বললেন, বব বাংলায় না ইংরেজিতে কথা বলত?

ইংলিশ। সুদেষ্ণাও বাংলা খুব কম বলে।

ববের ইংলিশ উচ্চারণ সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?

 পারফেক্ট প্রোনানসিয়েশন। আমার সন্দেহ হয়েছিল, সে বাঙালি কি না।

আই সি। কর্নেল একটু হেসে উঠে দাঁড়ালেন। আমার চুরুটের নেশা পেয়েছে। তা ছাড়া এখন আমি সত্যিই আপনার পি এ সম্পর্কে আগ্রহী।

বাট শি ইজ রিলায়েবল অ্যান্ড সিনসিয়ার, কর্নেল সরকার! এমন কি হতে পারে না সুদেষ্ণা তার সো-কল্ড বয়ফ্রেন্ড ববের সঙ্গে কোথাও যেতে বাধ্য হয়েছে? মে বি, হি ইনসিস্টেড হার টু অ্যাকম্প্যানি হিম, কর্নেল সরকার। খ্রিসমাস ইভে এটা খুব স্বাভাবিক।

কর্নেল আস্তে বললেন, সুদেষ্ণা দত্ত খ্রিশ্চিয়ান?

 হ্যাঁ। কিন্তু তাতে কী?

কথাটা গোড়ার দিকে জানলে আমি অন্তত দুস্টেপ এগিয়ে যেতে পারতাম মিসেস ব্যানার্জি!

আপনি জিজ্ঞেস করেননি। করলে বলতাম।

 আসলে অনেক সময় আমরা জানি না যে আমরা কী জানি! বলে কর্নেল বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। ওঁকে অনুসরণ করলাম।

শ্রীলেখা আমাদের পিছনে আসছিলেন। সিঁড়িতে নামার সময় আর্তকণ্ঠস্বরে বললেন, কর্নেল সরকার! আপনি জয়ের ব্যক্তিগত কাগজপত্র খুঁজে দেখতে বলেছিলেন। আমি একটা অদ্ভুত চিঠি খুঁজে পেয়েছি। অনীশ রায়ের লেখা চিঠি। চিঠিটা দেখে যান।

কর্নেল ঘুরে দাঁড়ালেন। তারপর বললেন, এখন আমার প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান মিসেস ব্যানার্জি! আপনি অফিসে চলে যান। চিঠিটা নিয়ে যাবেন। আমি যথাসময়ে যাব। হা–আপনার অফিসে থাকা জরুরি। প্লিজ মিসেস ব্যানার্জি! শীগগির আপনি অফিসে যান। আমার অনুরোধ কারণ আমার সন্দেহ, আপনার অ্যাবসেন্সে এমন কিছু ক্ষতি হতে পারে, দ্যাট মে স্ম্যাশ ইওর কোম্পানি।

কর্নেল কথাগুলো বলেই হন্তদন্ত নেমে গেলেন। পোর্টিকোতে পৌঁছে বললেন, কুইক জয়ন্ত! আমরা এবার ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের দিকে যাব।..

বরাবর দেখে আসছি, কলকাতার নাড়ি-নক্ষত্র কর্নেলের জানা। সারাপথ ওঁকে প্রশ্নে প্রশ্নে জেরবার করছিলাম, কারণ শ্রীলেখা ব্যানার্জির পি এ সম্পর্কে ওঁর এই উত্তেজনা কেন তা বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু মাঝে মাঝে পথনির্দেশ ছাড়া আমার কোনও প্রশ্নেরই উত্তর দিচ্ছিলেন না।

রেলব্রিজের তলা দিয়ে এগিয়ে ঘিঞ্জি আঁকাবাঁকা গলিরাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে আমি তিতিরিক্ত। এদিকটায় ঠাসাঠাসি বস্তিবাড়ি, মাঝে মাঝে কলকারখানার টানা পাঁচিল, কখনও ঝকঝকে নতুন দোতলা-তিনতলা ইটের বাড়ি। জগাখিচুড়ি অবস্থা। অবশেষে কর্নেলের নির্দেশে একখানে থামতে হলো।

বাঁদিকে একটা নতুন চারতলা ফ্ল্যাটবাড়ি। নিচের তলায় সারবন্দি দোকান পাট। ডানদিকে সংকীর্ণ একটা প্যাসেজ এবং তার পাশে টানা নিচু পাঁচিল। গাড়ি লক করে রেখে কর্নেলকে অনুসরণ করলাম। সেই প্যাসেজ দিয়ে কিছুটা এগিয়ে বাঁদিকে ওপরে ওঠার সিঁড়ি চোখে পড়ল। সিঁড়িতে ওঠার সময় প্রতিটি ফ্ল্যাটের নেমপ্লেটে যে সব নাম দেখলাম, তা থেকে অনুমান করা যায় এটা একটা কসমোপোলিটান বাড়ি। হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান সব ধর্মের মানুষজন এর বাসিন্দা। তেতলায় একটা ফ্ল্যাটের দরজায় নেমপ্লেটে লেখা আছে, মিস এস দত্ত। কর্নেল বললেন, দরজায় তালা আটকানো দেখছি। মিসেস ব্যানার্জির অনুমান ঠিকই ছিল। তবু নিশ্চিত হওয়ার দরকার ছিল।

এইসময় চারতলা থেকে এক ভদ্রলোক নেমে আসছিলেন। আমাদের দেখে একটু থমকে দাঁড়ালেন। তারপর পাশ কাটিয়ে তিনি নামতে যাচ্ছেন, কর্নেল বললেন, এক্সকিউজ মি! আমরা মিস দত্তের কাছে এসেছিলাম। আপনি নিশ্চয় ওঁকে চেনেন?

ভদ্রলোক পাশের একটা ফ্ল্যাট দেখিয়ে হিন্দিতে বললেন, গোমস্ সাহেবকে জিজ্ঞাসা করুন। মিস দত্তের খবর উনিই বলতে পারবেন।

ভদ্রলোক নেমে গেলেন। কর্নেল পাশের ফ্ল্যাটের ডোরবেলের সুইচ টিপলেন। নেমপ্লেটে লেখা আছে : মিঃ পি গোমস্। প্রেসিডেন্ট। ইস্টার্ন সুবারব্যান খ্রিশ্চিয়ান কালচারাল সোসাইটি।

একটু পরে দরজা ফাঁক হলো। একটা লম্বাটে এবং জরাগ্রস্ত মুখ দেখা গেল। মাথার চুল পাকা এবং টাক আছে। দরজার ওপাশে মোটা চেন আটকানো। বললেন, ইয়েস?

মিঃ গোমস্! কর্নেল অমায়িক স্বরে বললেন। আই ওয়ান্ট টু টক অ্যাবাউট মিস দত্ত।

হু আর ইউ স্যার?

কর্নেল তার নেমকার্ড দিলেন। তারপর ইরেজিতে বললেন, ব্যাপারটা খুব জরুরি মিঃ গোমস্। আপনি স্থানীয় খ্রিশ্চিয়ান সোসাইটির প্রেসিডেন্ট। তাই আপনার সঙ্গেই কথা বলা দরকার।

আপনি রিটিয়ার্ড মিলিটারি অফিসার?

হ্যাঁ। তবে আমি সরকারি কাজে আসিনি। আপনার বেশি সময় নেব না।

একটু ইতস্তত করার পর গোমস্ দরজা খুলে আমাদের ভেতরে ঢোকালেন। দরজা আটকে দিয়ে বললেন, আপনারা বসুন। বলুন কী করতে পারি আপনাদের জন্য?

কর্নেল বললেন, মিস দত্তকে আপনি চেনেন। তার আত্মীয় ববকেও নিশ্চয় চেনেন। তো–

গোমস্ একটু চমকে উঠলেন যেন। বব? বব একটা বাজে ছেলে। আমি সুসানকে সতর্ক করে দিয়েছিলাম। কিন্তু সুসান আমার পরামর্শ নেয়নি।

সুসান কে?

 কে? আপনি যার সম্পর্কে কথা বলতে চাইলেন! সুসান ডাট্টা?

 কিন্তু আমি জানি ওর নাম সুদেষ্ণা দত্ত।

হতে পারে। সে বাঙালি মেয়ে তা জানি। তবে সে আমার কাছে সুসান বলে পরিচয় দিয়েছিল, আমাকে আংকেল বলে ডাকে। যাই হোক, নামে কিছু আসে যায় না। সুসান কোনো প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ করে। আজ ভোরে সে বেরিয়েছে। বলে গেছে, বব গত রাতে বাড়ি ফেরেনি। আমি যেন ওর ফ্ল্যাটের দিকে লক্ষ্য রাখি। ফিরলেই যেন তাকে বলি এই নাম্বারে রিং করতে। আপনি দেখতে চান কি নাম্বারটা? বলে গোমস্ টেবিলে পেপারওয়েট চাপা দেওয়া একটা কাগজ তুললেন।

কর্নেল নাম্বারটা দেখে বললেন, মিস দত্তের অফিসের ফোন নাম্বার।

তাহলে আপনি সুসানের পরিচিত।

 বব আপনার কতটা পরিচিত?

আমি ওকে পছন্দ করি না। সুসান ওকে জুটিয়েছিল। আমি জানি বব সুসানের বয়ফ্রেন্ড।

ববের চেহারা দেখে বোঝা যায় সে ইউরেশিয়ান– কর্নেল হাসলেন। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান কথাটা অনেকে পছন্দ করেন না। তবে ববকে দেখলে হিপি মনে হয়। তাই না?

ঠিক বলছেন। এবার বলুন, সুসান সম্পর্কে কী কথা বলতে এসেছেন। আমাকে?

এই বাড়িতে সুসান কবে এসেছে?

গত বছর।

বব?

 মাসতিনেক আগে।

 এই ফ্ল্যাটগুলো কি ওনারশিপ ফ্ল্যাট, নাকি রেন্টেড?

 ওনারশিপ। সুসানের ফ্ল্যাটটা আগে এক বাঙালি হিন্দু ভদ্রলোক কিনেছিলেন। তার কাছে সুসান কিনেছে। গোমস্ বিকৃত মুখে বললেন, এলাকাটা ভাল নয়। এখানে ভদ্রলোকদের বাস করা কঠিন। কিন্তু কী করব? আমি খিদিরপুর ডকে কাজ করতাম। অবসর নেওয়ার পর

কর্নেল গোমসের কথার ওপর বললেন, বুঝেছি। আচ্ছা মিঃ গোমস্! ববের কি একটা মোটরসাইকেল ছিল জানেন?

 গোমস্ হাসলেন মোটরসাইকেল? চালচুলোহীন একটা বাউণ্ডুলে! হ্যাঁ, আমি অবশ্য ইদানীং মোটরসাইকেলে তাকে চাপতে দেখেছি। সুসান তাকে কিনে দেয়নি, আমি নিশ্চিত জানি। নিচের তলায় একটা ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি আছে। আপনি তাদের কাছে খোঁজ নিতে পারেন। ববৃকে ওরা চেনে।

ধন্যবাদ। বলে কর্নেল উঠে পড়লেন। গোমস্ হতবাক হয়ে বসে রইলেন। এমন নাটকীয় প্রবেশ ও প্রস্থান বৃদ্ধ ভদ্রলোককে নিশ্চয় অবাক করেছিল।…

.

০৫.

 নিচের রাস্তায় এসে কর্নেল বললেন, তুমি গাড়িতে অপেক্ষা করো। আমি এখনই আসছি।

সেই ট্রান্সপোর্ট কোম্পানিতে যাচ্ছেন তো?

হ্যাঁ। বলে কর্নেল রাস্তার ভিড়ের মধ্যে উধাও হলেন। কোথাও হয়তো যানজট বেধেছে। তাই এখন রাস্তায় ঠেলা, রিকশা, টেম্পো, ট্রাক আর মানুষজনের অচল ঠাসাঠাসি অবস্থা। আমার গাড়িকে পেছন থেকে শাসাচ্ছে কারা। ফুটপাত নেই। অগত্যা একটা পাঁচিলের পাশে গাড়ি সরিয়ে নিয়ে গেলাম। এবার বুঝলাম কেন কর্নেল আমাকে গাড়িতে বসে থাকতে বলে গেলেন।

কর্নেল ফিরলেন মিনিট দশেক পরে। ততক্ষণে ভিড় একটু সচল হয়েছে। বললেন, আবার আমাদের মিসেস ব্যানার্জির বাড়ি যেতে হবে। জ্যামের জন্য একটু দেরি হবে। কিন্তু উপায় কী?

সাবধানে ড্রাইভ করছিলাম। সদ্য কিছুদিন আগে গাড়ির বডি পালিশ করিয়েছি। ঠেলাবোঝাই লম্বা লম্বা লোহার রড যেভাবে পাশ কাটানোর চেষ্টা করছে, একটু ছড়ে গেলেই আবার একগাদা টাকা খরচ। বিরক্ত হয়ে উঠেছিলাম। ক্রমশ। কর্নেল যেন তা টের পেয়ে বললেন, কলকাতার এই অংশটার সঙ্গে বড়বাজারের অলিগলির তুলনা করে তুমি দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকায় একটা রিপোর্টাজ লিখতে পারো। এখানে কিন্তু সত্যি আর একটা বড়বাজার গজিয়ে উঠছে। তোমার কেমন একটা অভিজ্ঞতা হলো বোঝো জয়ন্ত!

হেসে ফেললাম। সাংঘাতিক অভিজ্ঞতা!

হ্যাঁ। সাংঘাতিকই বটে। কর্নেল চুরুট ধরালেন। ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির মালিক ভদ্রলোক বলছিলেন, তিন বছর আগেও এরিয়ায় এত মানুষজন ছিল না। বস্তিও ছিল না অত। মোটামুটি ফাঁকা জায়গা ছিল। তাই এখানে ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির অফিস খুলেছিলেন। এখন অন্য কোথাও সরে যাবার চেষ্টা করছেন।

ববের মোটরসাইকেলের হদিস পেলেন কি না বলুন?

পেয়েছি। মালিকের এক ছেলের নাম সেলিম আখতার। বব তার নাকি জিগরি দোস্ত। মাঝে মাঝে সেলিম তার মোটরসাইকেল ববকে ব্যবহার করতে দেয়। গতকাল বিকেলেও দিয়েছিল। তারপর ববের পাত্তা নেই। গতরাতে ববের স্ত্রী-হ্যাঁ, সবাই জানে সুসান ডাট্টা ববের স্ত্রী–তো সেলিম খোঁজ নিতে গেলে বলেছে, কোনও কোনও রাতে বব রিপন স্ট্রিটে ওর আত্মীয়ের বাড়িতে থাকে। সকালে সেলিম গোমস্ সায়েবের কাছে গিয়ে শোনে, ববের স্ত্রী ভোরে বেরিয়েছে। এটা স্বাভাবিক। বেলা দশটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে সেলিম গেছে রিপন স্ট্রিটে। আমি তার বাবাকে আমার নেমকার্ড দিয়ে এলাম। ববের খোঁজ পেল কি না আমাকে যেন রিং করে জানায়।

আপনি কি ভদ্রলোকের কাছে ববের খোঁজ করছিলেন?

 তা আর বলতে? বললাম, বব আমার কাছে টাকা ধার করে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। সেলিমের বাবা জাভেদ সাহেব বললেন, ববকে টাকা ধার দেওয়া উচিত হয়নি। তার ধারণা, বব সাট্টা জুয়া খেলেটেলে। সেলিম ওর পাল্লায় পড়ছে। কিন্তু আজকাল ছেলেরা বাবাকে গ্রাহ্য করে না।

আপনি আসল কথাটা বললেই পারতেন।

কর্নেল আস্তে বললেন, ববের রিপন স্ট্রিটের ঠিকানাটা আমার দরকার।

মিসেস ব্যানার্জির বাড়ির গেটের কাছে হর্ন বাজালাম। বদ্রীনাথ দৌড়ে এসে সেলাম দিল। কর্নেলকে বলল, মেমসাব অফিসে আছেন স্যার! আপনি চলে গেলেন। তার একটু পরে মেমসাব চলে গেলেন।

কর্নেল বললেন, বদ্রী! তোমরা কি বাগানে বা পাঁচিলে রক্তের ছাপগুলো ধুয়ে ফেলেছ?

হ্যাঁ স্যার! মেমসাব বলেছিলেন ধুয়ে সাফ করতে। আমি আর সুরেন সব সাফ করেছি।

তোমরা ওখানে কোনও চাবি কুড়িয়ে পাওনি?

বদ্রী অবাক হয়ে বলল, না স্যার।

 একটা চাবি ওখানে কোথাও পড়ে থাকা উচিত। বলে কর্নেল গাড়ি থেকে নামলেন। জয়ন্ত! আমি এখনই আসছি।

কর্নেল বদ্রীর সঙ্গে প্রাঙ্গণের ছোট্ট বাগানে ঢুকে গেলেন। অ্যালসেশিয়ান কুকুরটার গজরানি শোনা গেল। সুরেনেরও সাড়া পেলাম। তারপর দোতলার ব্যালকনিতে মালতাঁকে দেখা গেল। সে বলল, কী হয়েছে বদ্রী?

সুরেনের গলা শোনা গেল। কর্নেলসায়েব গত রাতে এখানে চাবি ফেলে গেছেন।

মালতী অদৃশ্য হলো। আমি ভেবে পেলাম না কর্নেল ওখানে চাবি ফেলে গেছেন কী করে? ওই ধরনের ভুল তার কখনও হয় না। তা ছাড়া চাবি টাবি ওঁর পকেটে থাকার কথা। ওখানে গতরাতে চাবি বের করেছিলেন কেন? চাবিটাই বা কিসের?

প্রায় আধঘণ্টা পরে কর্নেল ফিরে এলেন। তার পেছনে সুরেন ও বদ্রী ছিল। দুজনের মুখেই স্বস্তির নিঃশব্দ হাসি। কর্নেল গাড়িতে ঢুকে বললেন, হাত থেকে ছিটকে ঘাসের ভেতরে পড়েছিল চাবিটা! চলো, বাড়ি ফেরা যাক। খিদে পেয়েছে।

গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বললাম, আপনি ওখানে কাল রাতে চাবি বের করেছিলেন কেন?

আমি না। হতভাগ্য বব।

 বব? ববের চাবি?

কর্নেল একটু পরে বললেন, গোমস্ সায়েবের কথা শুনে তোমার বোঝা উচিত ছিল, ববের কাছে সুসান ওরফে সুদেষ্ণার ফ্ল্যাটের ডুপ্লিকেট চাবি থাকত। অন্তিম মুহূর্তে বেচারা ঘড়ি এবং চাবি দুটোই মিসেস ব্যানার্জির হাতে তুলে দিতে চেয়েছিল। মিসেস ব্যানার্জি ঘড়িটা নেন। কিন্তু চাবিটা ববের হাত থেকে ছিটকে পড়েছিল।…

কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টের দরজা খুলে দিয়ে ষষ্ঠীচরণ বলল, হালদারমশাই ফোং করেছিলেন। তারপর কী যেন নাম, মেয়েছেলে বাবামশাই!

কর্নেল যথারীতি চোখ কটমটিয়ে বললেন, মিসেস ব্যানার্জি?

 আজ্ঞে। পেটে আসছিল, মুখে আসছিল না।

 তোর দাদাবাবুকে নেমন্তন্ন কর!

 ষষ্ঠী হাসল। করাই আছে। সব রেডি।

বললাম, কর্নেল! নেমন্তন্ন না হয় খাওয়া গেল। কিন্তু আজ অফিসে যেতেই হবে।

কর্নেল ষড়যন্ত্রসঙ্কুল কণ্ঠস্বরে বললেন, ফোন করে জানিয়ে দাও, একটা দুর্দান্ত স্টোরির জন্য নিজেকে লড়িয়ে দিয়েছ। আর ডার্লিং! আমরা এবার একটা প্রচণ্ড নাটকীয় অবস্থার মুখোমুখি এসে গেছি। এখন প্রতিটি মুহূর্তে চমক, শুধু চমক!

উনি টুপি খুলে রেখে টাকে হাত বুলিয়ে টেলিফোনের দিকে হাত বাড়ালেন। ডায়াল করার পর বললেন, শ্রীলেখা এন্টারপ্রাইজ? আমি মিসেস শ্রীলেখা ব্যানার্জির সঙ্গে কথা বলতে চাই।…বলুন, কর্নেল নীলাদ্রি সরকার কথা বলবেন।…মিসেস ব্যানার্জি! আপনি ফোন করেছিলেন….হ্যাঁ। আমি ঠিক এটাই আশঙ্কা করেছিলাম।…ঠিক আছে আপনি ঘড়িটা ওদের কথামতো জায়গায় ঠিক সময়ে পাঠিয়ে দিন …না। ঘড়িটা একটা প্রাণের চেয়ে মূল্যবান নয়।…আমি বলছি, আপনি আপনার পি এ-কে বাঁচান। কেন বলছি, তা যথাসময়ে জানাব।…ঠিক আছে। অনীশ রায়ের চিঠিটা আমার পরে দেখলেও চলবে।…অফিস থেকে কখন বেরুবেন?…ও কে! আমি তাহলে কালকের মতো সন্ধ্যা ৭টায় আপনার বাড়িতে যাব। উইশ ইউ গুড লাক। ছাড়ছি।

কর্নেল ফোন রেখে আমার দিকে তাকালেন। বললাম, সুদেষ্ণা কিডন্যা?

হ্যাঁ। কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন, একটু আগেই বলছিলাম এবার শুধু চমকের পর চমক।

আমি বলেছিলাম নিশ্চয় সুদেষ্ণার কোনও বিপদ হয়েছে। আপনি পাত্তা দেননি।

কর্নেল একটু হেসে বললেন, কিডন্যাপারদের এটাই চিরাচরিত পদ্ধতি। রোমার ঘড়িটা ঠিক সাড়ে পাঁচটায় আউট্রাম ঘাটের সামনে পৌঁছে দিতে হবে। সেখানে মোটরসাইকেলের পাশে কালো জ্যাকেট পরা একটা লোক দাঁড়িয়ে থাকবে। তার মাথায় মাংকি ক্যাপ। পুলিশ বা গোয়েন্দা তাকে পাকড়াও করলে মিসেস ব্যানার্জির পি-এর শ্বাসনালী কাটা যাবে।

কিন্তু ঘড়ি পেয়ে তো ওদের আর লাভ হবে না। আপনি জয়দীপের কম্পিউটারে দুটো ডেটাই মুছে নষ্ট করে দিয়েছেন!

দিয়েছি।

তা না দিলেও মিসেস ব্যানার্জির বাড়ি থেকে ওই কম্পিউটার চুরি অসম্ভব কাজ।

 ঠিক বলেছ। তবে কিডন্যাপারদের বিশ্বাস আছে, সেই অসম্ভবকে তারা সম্ভব করতে পারবে। কিন্তু মূল দুটো প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। জয়দীপের গোপন তথ্যের প্রারম্ভিক কি ওয়ার্ডস ছিল ব্রেড। বব কী করে তা টের পেয়েছিল? দ্বিতীয় মূল প্রশ্ন : বব কি করে জানল জয়দীপের হাতে বাঁধা নীল ডায়াল রোমার ঘড়িরও একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে?

একটু ভেবে বললাম, সুদেষ্ণা ববকে জানিয়ে থাকবে।

 তা হলে প্রশ্ন আসছে, মিসেস ব্যানার্জি যা জানেন না, তা সুদেষ্ণা কী করে জেনেছিল?

 ওঃ কর্নেল! হালদারমশাইয়ের মতো আমার মাথাও গণ্ডগোলে তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।

কর্নেল হাসলেন। কাল থেকে তুমি স্নান করোনি। আজ স্নান করে নাও। মাথা ঠাণ্ডা হবে।

স্নান করে শরীর ঝরঝরে হয়ে গেল এবং মাথাও এবার ঠাণ্ডা। খাওয়ার টেবিলে কর্নেল কথা বলার পক্ষপাতী নন। ওঁর মতে, খাওয়ার সময় কথা বললে খাদ্যের প্রকৃত স্বাদ পাওয়া যায় না। হজমে বিঘ্ন ঘটতে পারে এবং খাদ্য শ্বাসনালীতে আটকে যাওয়ার আশঙ্কাও নাকি আছে।

প্রথাভঙ্গ মাঝেমাঝে অবশ্য উনি নিজেই করেন। আজ করলেন। বললেন, তুমি যখন বাথরুমে ছিলে, সেই সেলিম আখতার ফোন করেছিল। জানতে চাইছিল কী ব্যাপার। তো আমি বললাম, রিপন স্ট্রিটে ববের আত্মীয়ের ঠিকানা দিলে আমি তাকে তার মোটরসাইকেলের খবর দেব। গিভ অ্যান্ড টেক। সেলিম ঠকানা দিল। আমি বললাম, তুমি কড়েয়া থানায় চলে যাও। সেখানে তোমার মোটরসাইকেল আছে।

বললাম, ববের আত্মীয়ের ঠিকানা নিয়ে কী করবেন? বব ইজ ডেড।

ববের জীবনের ব্যাকগ্রাউন্ড যদি পেয়ে যাই? ববকে আমার জানা খুবই দরকার। তাহলে তার অদ্ভুত আচরণের অর্থ বোঝা যাবে।

আর কোনও প্রশ্ন করলাম না। খাওয়ার পর ড্রয়িংরুমে গিয়ে ভাতঘুমের জন্য তৈরি হচ্ছি, কর্নেল বললেন, জয়ন্ত! আড়াইটে বাজে। আমরা বেরুব। মৃত বব আমাকে উত্ত্যক্ত করছে।

রিপন স্ট্রিটে যাবেন?

হ্যাঁ। তবে পায়ে হেঁটে যাব। রিপন স্ট্রিট এখান থেকে শর্টকাটে পাঁচমিনিটের পথ। ওঠ।

বাড়িটা রিপন স্ট্রিটের ওপর নয়। একটা সংকীর্ণ গলির মুখে দোতলা পুরনো বাড়ি। নিচের তলায় যারা থাকে, তাদের কেমন যেন সন্দেহজনক হাবভাব। তাদের চাউনি অস্বস্তিকর। গাউনপরা স্থূলাঙ্গী এক মহিলা বুকের কাছে একটা সাদা কুকুর নিয়ে অপরিসর বারান্দায় বসেছিলেন। কর্নেলকে দেখে ইংরেজিতে বলনে, আপনি কি কাউকে খুঁজছেন?

কর্নেল বললেন, বব নামে এক যুবক আমাকে এই ঠিকানা দিয়েছিল।

ভদ্রমহিলা বাঁকা হেসে বললেন, ববের খোঁজে প্রায়ই এখানে হোমরাচোমরা লোকেরা আসে। শুনলাম কাল সে একজনের মোটরসাইকেল চুরি করে পালিয়েছে। আপনার কী নিয়েছে?

টাকা।

 পুলিশের কাছে যান! ববকে এখানে খুঁজে পাবেন না।

ববের ঘরে কি তালা দেওয়া আছে।

দিশি মেমসায়েব পুরুষালি ভঙ্গিতে সশব্দে বিকট হাসলেন। ববের ঘর! চালচুলোহীন বাউণ্ডুলে!

তাহলে এখানে সে কার কাছে থাকত?

ওই সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় যান। ববের খুড়ি লিজাকে জিজ্ঞেস করুন। বব কী তা জানতে পারবেন। তবে সে আপনার সঙ্গে দেখা করবে কি না বলতে পারছি না।

দুজনে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে গেলাম। ফ্ৰকপরা এক বালিকা হাঁ করে কর্নেলকে দেখছিল। চাউনি দেখে মনে হলো, খ্রিসমাস ইভে সে স্বয়ং ফাদার খ্রিসমাসকে দেখছে যেন। কর্নেল মিষ্টি হেসে তার হাতে কয়েকটা চকোলেট গুঁজে দিলেন। আড়ষ্টভঙ্গিতে সে নিল। কর্নেল বললেন, আন্টি লিজার ঘর কোনটা?

সে আঙুল তুলে ঘরটা দেখিয়ে দিল। ঘরের রজায় পর্দা ঝুলছে। টানা বারান্দায় একদল ছেলেমেয়ে রঙিন কাগজ সুতোয় বেঁধে টাঙাতে ব্যস্ত। খ্রিসমাসের প্রস্তুতি। তারা আমাদের গ্রাহ্য করল না। কর্নেল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, আমি আন্টি লিজার সঙ্গে দেখা করতে চাই।

দরজার পর্দা সরিয়ে রোগা প্রৌঢ়া রুক্ষ চেহারার এক মেমসাহেব উঁকি দিলেন। কর্নেল এবং আমাকে দেখে নিয়ে শীতল কণ্ঠস্বরে বললেন, আপনারা যদি ববের খোঁজে এসে থাকেন, আমি দুঃখিত, সে এখানে আর থাকে না। গোবরা এলাকায় থাকে শুনেছি। তার সম্পর্কে আর কিছু জানি না।

কর্নেল আস্তে বললেন, আমিও দুঃখিত মিসেস লিজা

 আমি লিজা হেওয়ার্থ!

 মিসেস লিজা হেওয়ার্থ! ববের একটা শোচনীয় দুঃসংবাদ দিতে আমি এসেছি।

ববকে পুলিশ ধরেছে? ওটা কিছু নয়।

না। সে খুন হয়েছে।

 লিজা মুহূর্তে বদলে গেলেন। মুখের রুক্ষ শীতলতা গলে গেল। দরজার পাশে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালেন। ভাঙাগলায় বলে উঠলেন, ও জেসাস! তাহলে সত্যি ওরা ববকে মেরে ফেলল?

মিসেস হেওয়ার্থ! আপনার সঙ্গে এ বিষয়ে আমি কিছু কথা বলতে চাই।

কান্না সামলে লিজা বললেন, ভেতরে আসুন।

ঘরে আলো জ্বলছে। একপাশে খাট। অন্যপাশে জীর্ণ সোফাসেটে নতুন কভার চাপানো আছে। পাশাপাশি ছোট্ট কিচেন এবং বাথরুমের দরজা দেখতে পেলাম। কোণে একটা টুলের ওপর ক্রুশবিদ্ধ যিশুর ভাস্কর্য। দুটো পুরোনো আলমারি। খাটের পাশে কিচেনের দরজার কাছাকাছি ছোট্ট ডাইনিং টেবিল এবং একটা চেয়ার। বেশ পরিচ্ছন্ন করে সাজানো ঘর। দেয়াল জুড়ে বাঁধানো অনেকগুলো ফটো ঝুলছে। হঠাৎ চোখে পড়ল ফ্রেমে বাঁধানো এক টুকরো সাদা কাপড়ে এমব্রয়ডারি করা একটা বাক্য; ম্যান ক্যান নট লিভ বাই ব্রেড অ্যালোন। মনে পড়ল, কর্নেল বলেছেন ওটা যিশু খ্রিস্টের বিখ্যাত বাণী। কিন্তু এই বাণীর অন্য একটা পরিপ্রেক্ষিত আছে। আমি বিস্মিত দৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম।

লিজা চোখ মুছে বললেন, ববকে কোথায় ওরা খুন করেছে? গোবরায় সেই বাঙালি মেয়েটির বাড়িতে?

কর্নেল বললেন, না। গত রাতে সার্কাস অ্যাভেনিউ এলাকায় তাকে ছুরি মেরে খুন করা হয়েছে। আপনার বেশি সময় নেব না। আপনার এখানে টেলিফোন আছে?

ছিল। আমার স্বামীর মৃত্যুর পর আর রাখতে পারিনি।

আপনি যে ভাবে হোক, কড়েয়া থানার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। ববের বডি এখনও মর্গে আছে। আপনি গিয়ে শনাক্ত করার পর বডি শেষকৃত্যের জন্য চাইবেন। তো আমার কয়েকটা কথার জবাব দিন। কারা ববকে খুন করেছে বলে আপনি মনে করেন?

প্রায় এক সপ্তাহ আগে একটা লোক এসে ববকে খুঁজছিল। আমাকে হুমকি দিয়ে গেল, ববকে যেন বলি, সে তার সঙ্গে দেখা না করলে প্রাণে মারা পড়বে। লোকটা বাঙালি। ববের বয়সী। তাকে এই বাড়িতে আগেও ববের সঙ্গে কথা বলতে দেখেছি। তাকে দেখলে চিনতে পারব।

তারপর বব কি আপনার কাছে এসেছিল?

দুবার এসেছিল। আমি ওকে লোকটার কথা বলেছিলাম। বব গ্রাহ্যই করল না।

সেই লোকটা আর এসেছিল আপনার কাছে?

না। আমি তাকে আর দেখিনি।

 ববের আসল নাম কী?

বব। ওর বাবা আমার স্বামীর মাসতুতো ভাই। স্যাম হেওয়ার্থ। স্যাম রেলে চাকরি করত। ববের ছবছর বয়সে ওর মা রোজি একটা লোকের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া চলে যায়। স্যাম ববকে আমার কাছে রেখেছিল। তখন আমার স্বামী ডানলপ কোম্পানিতে চাকরি করত। ববকে আমিই মানুষ করেছি। আমাদের সন্তান ছিল না। তারপর স্যাম আত্মহত্যা করেছিল। হতভাগা বব!

লিজা আবার কেঁদে উঠলেন। কর্নেল তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, বব কি কোথাও চাকরি করত?

খেয়ালি ছন্নছাড়া স্বভাবের ছেলে। কোথাও বেশিদিন কাজ করার মেজাজ ছিল না ওর। আসলে বড্ড জেদি প্রকৃতির ছিল। মাঝে মাঝে উধাও হয়ে যেত কোথায়। তারপর হঠাৎ চলে আসত।

কর্নেল ঘড়ি দেখে উঠে দাঁড়ালেন। আপনি এখনই কড়েয়া থানায় যান। আমার এই নেমকার্ডটা থানায় দেখিয়ে বলবেন, আমিই আপনাকে পাঠিয়েছি। সম্ভব হলে সঙ্গে কাউকে নিয়ে যাবেন। আচ্ছা, চলি!…।

রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বললাম, দেয়ালে ফ্রেমে বাঁধানো কথাগুলো দেখেছেন?

কর্নেল অনমনস্কভাবে বললেন, দেখেছি। তবে ওসব নিয়ে এখন ভাবছি না। ফিরে গিয়ে সুসান ওরফে সুদেষ্ণার ফ্ল্যাটের দিকে ছুটতে হবে।

সেই দম আটকানো রাস্তায়? সর্বনাশ!

 কারও সর্বনাশ কারও পৌষমাস। পুরনো বাংলা প্রবচন। তাছাড়া এখন সত্যিই পৌষমাস চলেছে। ক্যালেন্ডার দেখতে পারো।

কর্নেলের রসিকতা কানে নিলাম না। গোবরা এলাকার সেই ফ্ল্যাটের কথা ভাবছিলাম। কর্নেল যেন বড় বেশি ঝুঁকি নিচ্ছেন।

বাড়ির গেটে পৌঁছে কর্নেল বললেন, এক পেয়ালা কফির ইচ্ছে ছিল। কিন্তু সময় কম। ওপরে উঠছি না। তুমি গাড়িটা এখানে নিয়ে এস।

হঠাৎ সেই সময় পের্টিকোর দিক থেকে হন্তদন্ত ছুটে এলেন প্রাইভেট ডিটেকটিভ হালদারমশাই। বললেন, নিচে ওয়েট করছিলাম। ষষ্ঠী কইল, বাবামশাই জয়ন্তবাবুরে লইয়া গেছেন। এদিকে আমার হাতে টাইম কম।

কর্নেল বললেন, চলুন। গাড়িতে যেতে যেতে সব শুনব। আপনি ফোন করেছিলেন। ষষ্ঠী বলেছে আমাকে।

আগে জিগাই, যাবেন কই? ম্যাডামের বাড়ি তো?

নাহ্। গোবরা এরিয়ায় যাব।

হালদারমশাই লম্বা মানুষ। যেন আরও লম্বা হয়ে গেলেন। গোঁফ কাঁপতে থাকল। বললেন, গোবরা এরিয়ায়? কী কাণ্ড। জাস্ট নাও আই অ্যাম কামিং ফ্রম দ্যাট প্লেস। মোটরভেহিকল্স্ অফিসে আমার ভাগনা আজ আসে নাই। তাই এত দেরি। নাম্বার দিয়া নাম-ঠিকানা পাইলাম তখন বেলা প্রায় বারোটা। পাবলিক বুথে গিয়া আপনারে ফোন করলাম। পাইলাম না।তখন কড়েয়া থানায় গেলাম। নিজের কার্ড দেখাইলাম। এক পুলিশ অফিসার ধমক দিয়ে কইলেন, আপনারে গত রাত্রে মিসেস ব্যানার্জির বাড়ি দেখছিলাম না?

 হালদারমশাই খি, খি করে হেসে উঠলেন। কর্নেল বললেন, তা হলে আপনি পুলিশের সঙ্গে সেলিম আখতারের কাছে গিয়েছিলেন?

আঁ? আপনি অরে চিনলেন ক্যামনে?

পুলিশ কি সেলিমকে অ্যারেস্ট করেছে?

থানায় লইয়া গেছে। তবে সেলিম ভিকটিমের বডি শনাক্ত করছে। ভিকটিমের নাম–

কর্নেল বললেন, বব। কিন্তু পুলিশ কি ববের ফ্ল্যাটে গিয়েছিল?

হালদারমশাই আরও অবাক হয়ে গেলেন। বললেন, গিছল। কিন্তু নেমেপ্লেটে লেখা ছিল

মিস এস দত্ত। পুলিশ কি তালা ভেঙে ঘরে ঢুকে সার্চ করেছে?

নাহ্ কর্নেলস্যার! পাশের ফ্ল্যাটের এক বুড়াকী য্যান তার নাম—

গোমস্।

হঃ। গোমস্ বুড়া কইল, বব মিস এস দত্তের রিলেটিভ। মাঝেমাঝে আসে বব থাকে রিপন স্ট্রিটে। বুড়া সেলিমেরে ধমক দিল, ইউ নো হিজ অ্যাড্রেস। হোয়াই ইউ আর নট গিভিং ইট টু দা পোলিস? তখন সেলিম অ্যাড্রেস দিল। পুলিশ অরে প্রথমে লইয়া গেল চিত্তরঞ্জন হাসপাতালের মর্গে। বডি শনাক্ত করল সেলিম। তারপর পুলিশ অরে থানায় লইয়া গেল। আমি আপনারে ইনফরমেশন দিতে দৌড়াইলাম।

কর্নেল ঘড়ি দেখে একটু ভেবে নিয়ে বললেন, তিনটে পনের বাজে হালদারমশাই? আপনি আপনার ক্লায়েন্টের অফিসে চলে যান। উনি অফিসে আছেন। আপনাকে ওঁর দরকার হতে পারে।

হালদারমশাই একটু ইতস্তত করে চলে গেলেন। বুঝলাম কর্নেলের সঙ্গে ওঁর আবার গোবরা এরিয়ায় যাবার ইচ্ছা ছিল।

গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বললাম, মনে হচ্ছে সেলিম আপনাকে ফোন করার পরই হালদারমশাই পুলিশ নিয়ে তার কাছে গিয়েছিলেন।

কর্নেল অন্যমনস্কভাবে বললেন, হুঁ।

 হাই ওল্ড বস্! সেই সাদা মারুতিটার কথা ভুলে গিয়েছিলাম!

গোবরা যাবার সময় গাড়িটা আমাদের ফলো করেনি। এখনও করছে না। কর্নেল একটু হেসে ফের বললেন, অবশ্য আজকাল সর্বত্র রঙবেরঙের মারুতি তুমি দেখতে পাবে। তুমি বরং একটা মারুতি কিনে ফেলো। তোমার ফিয়াট সেকেলে হয়ে গেছে। বাই দা বাই, শর্টকাট করো। সময় কম।

গলিরাস্তা ধরে এগিয়ে পাঁচ মিনিটের মধ্যে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের কাছে পৌঁছে গেলাম। তারপর রেলব্রিজ পেরিয়ে কর্নেল বলেন, এখানেই পার্ক করে রাখো। আমার জন্য অপেক্ষা করো।

আপনি একা যাবেন?

হ্যাঁ। কর্নেল নেমে গেলেন। বললেন, সামনে জ্যাম দেখতে পাচ্ছি। এখানে রাস্তার পাশে অনেকটা জায়গা। পার্কিংয়ে অসুবিধে নেই। বড় জোর আধঘণ্টা তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে।

কর্নেল বাঁকের মুখে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। সময় কাটানোর জন্য আমি বেরিয়ে কাছেই একটা চায়ের দোকানে গেলাম। রাস্তার ধারে এসব চায়ের দোকান বড় অপরিচ্ছন্ন। কিন্তু এ বেলা শীতটা বেশ পড়েছে। মাটির ভাঁড়ে ক্রমাগত গরম করে রাখা গাঢ় তরল পদার্থে চায়ের কোনও স্বাদ নেই। তবু মন্দ লাগছিল না।

কর্নেল ফিরে এলেন প্রায় পঁয়ত্রিশ মিনিট পরে। কাঁধে একটা কিটব্যাগ ছিল। বললেন, কুইক! যে পথে এসেছ, সেই পথে।

স্টার্ট দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ব্যাগটা কার?

 ববের। একপ্রস্থ পোশক ঠাসা আছে। এর কারণ সেগুলো সুসান ওরফে সুদেষ্ণার নয়। ভাগ্যিস দেয়ালের ব্র্যাকেটে ঝুলছিল। বেশি কিছু খুঁজতে হয়নি। গোমসের ঘরে জোরে টি ভির শব্দ হচ্ছিল। আজ নিশ্চয় বড় খেলা আছে। কোথাও।

নিউজিল্যান্ড ভার্সেস ইন্ডিয়া। ক্রিকেট।

হু। সব ফ্ল্যাটে তাই টি ভির দিকে সবার চোখ। এমনকি নিচের তলায় একটা দোকানের সামনে ভিড় দেখলাম।…

অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে কর্নেল ষষ্ঠীকে কফির হুকুম দিলেন। তারপর ড্রয়িংরুমে ইজিচেয়ারে বসে মাথার টুপি খুললেন। টাকে হাত বুলিয়ে কিটব্যাগের চেন খুললেন।

ঠাসাঠাসি করে ভরা একটা জিনসের প্যান্ট, দুটো শার্ট, তারপর একটা জ্যাকেট বেরুল। কর্নেল জ্যাকেটটা তুলতেই ওঁর পায়ের কাছে ঠকাস করে একটা ছুরি পড়ল। ইঞ্চি ছয়েক ফলা। কর্নেল ছুরিটা টেবিলে রেখে জ্যাকেটের বাইরের পকেটে হাত ভরলেন। কিছু বেরুল না। কিন্তু ভেতর পকেট খুঁজতেই বেরিয়ে এল একটা নেমকার্ড।

কর্নেল কার্ডটা দেখে টেবিলে রাখলেন। বললাম, দেখতে পারি?

নিশ্চয় পারো।

তুলে নিয়ে দেখি, বেশ দামী কার্ড। সি এস সিনহা। তার তলায় ঠিকানা আছে। ভবানীপুর এলাকা বলে মনে হলো। দুটো ফোন নাম্বার দেওয়া আছে। একটা বাড়ির, অন্যটা অফিসের।

কর্নেল কিটব্যাগের ছোট চেনগুলো টেনে টুকরো কাগজপত্র বের করছিলেন। বললেন, অফিসের ফোন নাম্বারটা শ্রীলেখা এন্টারপ্রাইজের। সর্ষের মধ্যে ভূত।

ষষ্ঠী কফি আনল। কফিতে চুমুক দিয়ে কর্নেল আবার আওড়ালেন, সর্ষের মধ্যে জব্বর ভূত, জয়ন্ত! এই ভূত এখনও বহাল তবিয়তে কাজ করে যাচ্ছে।….

.

০৬.

কর্নেলের কথা শুনে চমকে উঠেছিলাম। বললাম, সর্ষের মধ্যে এই ভূতের নাম সি এস সিনহা। মিসেস ব্যানার্জিকে এখনই জিজ্ঞেস করে জেনে নিন লোকটা কে?

কর্নেল ববের টুকরো কাগজগুলো দেখতে দেখতে বললেন, ধীরে জয়ন্ত, ধীরে!

ক্ষুব্ধ হয়ে বললাম, বঙ্কিমচন্দ্র কোট করছেন শুধু!

 কোট করছি না ডার্লিং। অনুকরণ করছি! বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন, ধীরে রজনী, ধীরে! তবে তোমাকে বলেছিলাম, এবার শুধু চমকের পর চমক। সি এস সিনহা সেইসব চমকের আর একটা চমকমাত্র। হু, ববের লেখা একটা অসমাপ্ত চিঠি দেখছি। কর্নেল কুঁচকে যাওয়া একটা ইনল্যান্ড লেটারের দিকে ঝুঁকে পড়লেন। তারপর বললেন, ববেরই লেখা। তাড়াহুড়ো করে কয়েক লাইন লিখেছিল। কিন্তু ম্যাডাম সম্বোধনে বোঝা যাচ্ছে সে শ্রীলেখা ব্যানার্জিকে চিঠিটা লিখতে চেয়েছিল। কিন্তু কোনও কারণে মত বদলায়। কি কেউ সেই সময় হঠাৎ এসে পড়ায় আর লেখা হয়নি, তাই যেমন-তেমন ভাবে ভাঁজ করে লুকিয়ে ফেলেছিল।

কর্নেল চিঠিটা পড়ার পর আমাকে পড়তে দিলেন। ম্যাডাম সম্বোধনের পর যা লিখেছে, তা বাংলায় এরকম দাঁড়ায় :

আপনার স্বামীর দুর্ঘটনায় মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী। আমি অনুতপ্ত। স্বীকার করছি, ওঁর হাতের ঘড়ি ছিনতাই করাই আমার উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু ভদ্রলোক অত বেশি ভয় পেয়ে বাচ্চা ছেলের মতো দৌড়বেন, চিন্তাই করিনি। আমার হাতে ছুরি ছিল। ভেবেছিলাম ছুরি দেখামাত্র থমকে দাঁড়াবেন। তখন ঘড়িটা চাইব। কিন্তু সেই সুযোগ তিনি দেননি। পরে জেনেছি, প্রাণভয়ে নয় তিনি ঘড়িটা বাঁচানোর জন্যই কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন এবং…।

 চিঠিটা কর্নেলকে ফেরত দিয়ে বললাম, আপনার মনে থাকা তো উচিত। আমি বলেছিলাম, ঘড়ি ছিনতাইকারীকে সৎ এবং বিবেকবান বলে মনে হয় যেন। আপনি বলেছিলেন, সো ইট অ্যাপিয়ারস। এবার তার পরিচয় মোটামুটি জেনে গেলেন। তা হলে দেখা যাচ্ছে, আমার ধারণা ঠিকই ছিল।

হ্যাঁ। আচমকা জয়দীপের পথদুর্ঘটনায় মৃত্যু ববকে বিচলিত করেছিল। আসলে কোনও মানুষই নির্ভেজাল মন্দ বা নির্ভেজাল ভালো নয়। ভাল-মন্দ বোধ সব মানুষের মধ্যেই আছে। বব ছিল স্পয়েলট চাইল্ড। পরিবেশ ওকে নষ্ট করেছিল। কিন্তু স্পষ্ট বুঝতে পেরেছি, সে পেশাদার খুনী তো নয়ই, পেশাদার অপরাধীও বলা যাবে না তাকে। কখনও-সখনও টাকার জন্য বেপরোয়া হয়ে সে। কিছু খারাপ কাজ করে থাকবে।

 কর্নেল। আমার মনে হচ্ছে, শ্রীলেখা ব্যানার্জির কর্মচারী সি এস সিনহাই ববকে টাকা খাইয়ে জয়দীপের ঘড়ি ছিনতাই করতে বলেছিল।

তা আর বলতে? বলে কর্নেল কফি শেষ করে কিটব্যাগটায় ববের জিনিসপত্র আগের মতো ঠেসে ভরলেন। তারপর ব্যাগটা ভেতরের ঘরে কোথাও রাখতে গেলেন। একটু পরে ফিরে এসে বললেন, মিসেস ব্যানার্জির পি এর কিডন্যাপার সময় বেঁধে দিয়েছে সাড়ে পাঁচটা। এর কারণ বোঝা যাচ্ছে শীতের সন্ধ্যা। তা ছাড়া আউট্রাম ঘাটের কোনও কোনও জায়গায় ল্যাম্পপোস্টে আলো থাকলেও গাছপালার ছায়া পড়ে দেখেছি। লোকটা ঝুঁকি নিতে চায় না। যাই হোক, অপেক্ষা করা যাক।….

সাড়ে পাঁচটার পর কর্নেল শ্রীলেখাকে টেলিফোন করলেন। ক্রমাগত হ্যাঁ, ঠিক আছে, তাই নাকি ইত্যাদি ছাড়া কিছু বুঝতে পারলাম না। একটু পরে ফোন রেখে কর্নেল হাসিমুখে আমার দিকে তাকালেন।

বললাম, কী ব্যাপার? আপনাকে খুশি-খুশি দেখাচ্ছে!

 হালদারমশাই গিয়ে ঘটনাটা শোনার পর চুপচাপ বেরিয়ে গেছেন। শ্রীলেখা ওঁকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন, যেন ওত পাততে না যান। তার পি এর কোনও ক্ষতি হলে হালদারমশাই দায়ী হবেন।

ঘড়িটা পাঠিয়ে দিয়েছেন শ্রীলেখা?

 শেখরবাবু নামে ওঁর একজন আস্থাভাজন কর্মীর হাতে দিয়ে পাঠিয়েছেন। শেখরবাবুর মোটরবাইক আছে। ফিরতে দেরি হবে না। উনি ফিরলেই শ্রীলেখা বাড়ি ফিরবেন। আমরা ওর বাড়িতে যেন সাড়ে ছটায় অবশ্য যাই। শ্রীলেখা অনীশ রায়ের লেখা একটা অদ্ভুত চিঠির কথা সকালে বলছিলেন। সেটা দেখাতে চান।

কিন্তু আপনার খুশির কারণ কি এই যে, ওরা এরপর জয়দীপের কম্পিউটার চুরি করলেও গোপনীয় ডেটা দুটো পাবে না?

ঠিক ধরেছ। তবে আমার খুশি হওয়ার আর একটা কারণ আছে। হালদারমশাইকে শ্রীলেখা নিষেধ করার পর উনি চুপচাপ বেরিয়ে গেছেন। অথচ আমার এখানে এখনও এলেন না। তার মানে কী বুঝতে পারছ?

ওত পাততে গেছেন তা হলে! উদ্বিগ্ন হয়ে বললাম, কর্নেল! হালদারমশাইকে। আমরা জানি। দেখবেন উনি নির্ঘাত একটা ঝামেলা বাধাবেন। আর মাঝখান থেকে মেয়েটার প্রাণ যাবে।

কর্নেল একটু হেসে বললেন, যাবে না। বরং হালদারমশাই আগেভাগে গিয়ে ওখানে ওত পাতবেন বলেই ওঁকে তখন ওঁর মক্কেলের অফিসে যেতে বলেছিলাম।

কিন্তু উনি ঝামেলা বাধালে নিজেই বিপদে পড়তে পারেন। আর মিসেস ব্যানার্জির পি এর প্রাণ যাবে না বলছেন কেন বুঝতে পারছি না।

কর্নেল আস্তেসুস্থে চুরুট ধরিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, সুসান ওরফে সুদেষ্ণা দত্তের প্রাণ যাবে না। কারণ সে কিডন্যাই হয়নি। তাকে কেউ আটকে রাখেনি।

অবাক হয়ে বললাম, বলেন কী! সুদেষ্ণা কিডন্যাপড হয়নি?

আমি যখন তার ফ্ল্যাট লক করে নিচে নেমেছি, তখন আমার পাশ কাটিয়ে তাকে হন্তদন্ত করে সিঁড়িতে উঠতে দেখলাম। জাস্ট আধমিনিট আমার দেরি হলে আমি ঝামেলায় পড়তাম। অবশ্য ববের ব্যাগটা যে উধাও হয়েছে, তা সে লক্ষ্য করতেও পারে। না-ও পারে। এখন আর কিছু যায় আসে না।

কর্নেল! আপনি তো ওকে দেখেননি! কী করে চিনলেন সে-ই মিস দত্ত?

 ফ্ল্যাটে ঢুকে ওর ছবি দেখেছি। দেয়ালে এবং টেবিলে। ববের সঙ্গেও একটা রঙিন ফটো বাঁধানো আছে দেখেছি।

হতবাক হয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকার পর বললাম, তা হলে সুদেষ্ণা এই চক্রান্তে জড়িত।

নিশ্চয় জড়িত। আর এ-ও বোঝা যাচ্ছে, জয়দীপের কম্পিউটারাইজড় গোপন ডেটার কথা কোনওভাবে সে জানতে পেরেছিল। ফার্স্ট কি ওয়ার্ডস ব্রেড এবং পরের কি যে কয়েকটা নাম্বার, তা-ও সে জানে। সেই নাম্বার বা ডিজিটাল কোড একটা নীলডায়াল রোমার ঘড়িতে আছে, সুসানের তা অজানা ছিল না। হ্যাঁ, বব তার এই গার্লফ্রেন্ডের কাছেই এ সব কথা জেনেছিল। কর্নেল একটু চুপ করে থাকার পর ফের বললেন, ববের কাছে সি এস সিনহার নেমকার্ড পেয়েছি। তাই আমার কাছে একটা টাইম ফ্যাক্টরের প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কি ওয়ার্ড ব্রেড এবং রোমার ঘড়িতে খোদাই করা নাম্বারের কথা বব সম্ভবত জয়দীপের মৃত্যুর পর জেনেছিল। দুর্ঘটনায় জয়দীপের মৃত্যু ববকে বিচলিত করেছিল, আমরা তার প্রমাণ পেয়েছি। বিচলিত বব তার গার্লফ্রেন্ডের কাছে ঘটনাটা বলতেই পারে। হয়তো অনুতপ্ত বব নেশার ঘোরেই বলে ফেলেছিল। তখন সুসান কে সব কথা জানাতে পারে। কিন্তু বিবেক যন্ত্রণায়। পীড়িত বব তখন সতর্ক হয়ে যায়। ঘড়িটা সুসানকে সে দেয়নি। জয়দীপের স্ত্রীকে ফেরত দিতে চেয়েছিল। শ্রীলেখা ব্যাকগ্রাউন্ড জানতেন না বলেই ভড়কে যান। যাই হোক, পুলিশ সুসানকে জেরা করলে আমার ধারণার সত্যতা যাচাই হবে।

ওকে পুলিশের হাতে এখনই ধরিয়ে দেওয়া উচিত!

কর্নেল আমার কথায় কান না দিয়ে বললেন, মিসেস লিজা হেওয়ার্থের কাছে আমরা জেনেছি, একটা লোক ববের খোঁজে গিয়ে হুমকি দিয়ে এসেছে। তাকে লিজা আগেও দেখেছেন। সম্ভবত সে সি এস সিনহা।

 তাকেই বা পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিচ্ছেন না কেন?

কর্নেল মিটিমিটি হেসে আবার বললেন, ধীরে জয়ন্ত, ধীরে! বলে ঘড়ি দেখলেন। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চলো। এবার শ্রীলখোর বাড়ি যাওয়া যাক।..

আমরা সবে নেমে নিচের লনে পৌঁছেছি, গেটের কাছে ট্যাক্সি থেকে হালদারমশাই অবতরণ করলেন এবং দ্রুত ভাড়া মিটিয়ে গেট দিয়ে সবেগে প্রবেশ করলেন। তারপর আমাদের দেখামাত্র ছুটে এলেন।

কর্নেল বললেন, চলুন হালদারমশাই! যেতে যেতে শোনা যাবে।

 আপনারা যাবেন কৈ?

 আপনার ক্লায়েন্টের বাড়িতে। আসুন, আমরা পেছনের সিটে বসি।

দুজনে গাড়িতে উঠলেন। স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে গেলাম। কর্নেলকে বলতে শুনলাম কী হলো হালদারমশাই? চুপ করে আছেন যে?

ভাবতাছি।

 কী ভাবছেন।

ব্যাকভিউ মিররে দেখলাম, প্রাইভেট ডিটেকটিভ একটিপ নস্যি নিলেন। তারপর রুমালে-নাক মুছে বললেন, হেভি মিস্ট্রি। ম্যাডামেরে জানানো উচিত। কিন্তু তার আগে আপনার লগেনসাল্ট করা দরকার। আমার মাথা বেবাক

গণ্ডগোল হইয়া গেছে।

আপনি কি আউট্রাম ঘাট থেকে আসছেন?

 নাহ! ম্যাডাম নিষেধ করছিলেন। রিস্ক লই নাই!

তাহলে এখন আসছেন কোথা থেকে?

হালদারমশাই শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, গোবরায় মিস দত্তের ফ্ল্যাটের পাশের ফ্ল্যাটে সেই বুড়া সায়েবের লগে আলাপ করতে গিছলাম।

মিঃ গোমসের সঙ্গে?

হঃ! বব সম্পর্কে যদি কিছু স্পেশাল ইনফরমেশন পাই, তার কিলারেরে শনাক্তকরণে হেল্পফুল হইলে হইতে পারে। কী কন?

ঠিক বলেছেন। তারপর কী হলো বলুন?

শীত-সন্ধ্যার রাস্তায় যানবাহনের গর্জন এবং আমার গাড়ির চাপা গর্জনও কম নয়, হালদারমশাইয়ের সব কথা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম না। তবু যতখানি শুনতে পেলাম বা বুঝতে পারলাম, তা থেকে গোয়েন্দা ভদ্রলোকের একটা বিপজ্জনক অ্যাডভেঞ্চার কাহিনী দাঁড় করানো যায়।

হালদারমশাই শ্রীলেখা এন্টারপ্রাইজ থেকে বেরিয়ে বারকয়েক যানবাহন বদল করে গোবরা এলাকার ফ্ল্যাটে যখন পৌঁছান, তখন পাঁচটা বেজে গেছে। সবখানে আলো জ্বলে উঠেছে। উনি মিস্ এস দত্তের ফ্ল্যাটের দরজায় গিয়ে অবাক হন। ফ্ল্যাটের তালা খোলা। ভেতরে আলো জ্বলছে। দরজায় কান পেতে কারা কথা বলছে শুনতে পান। সন্দেহজনক ব্যাপার। প্যান্টের পকেটে রিভলভারের বাঁট চেপে ধরে ডোরবেলের সুইচ টেপেন হালদারমশাই।

দরজায় লুকিং গ্লাস ফিট করা আছে। তাই একটু সরে দাঁড়ান। দরজা একটু ফাঁক করে পুরুষকণ্ঠে কেউ বলে, হু ইজ ইট?

হালদারমশাই বলেন, আই হ্যাভ কাম ফ্রম দা পোলিস স্টেশন। প্লিজ ওপেন দা ডোর।

দরজা আরও ফাঁক করে একজন লোক তাকে দেখে নিয়ে বাংলায় বলে, কী ব্যাপার?

হালদারমশাই ইংরিজিতে বলেন, আমি ববের ব্যাপারে কথা বলতে চাই।

লোকটার পরনে টাই-স্যুট! চি এক কাঁচাপাকা দাড়ি। বয়স আন্দাজ পঞ্চাশের ওপারে। সে একটু ইতস্তত করে দরজার ভেতরকার চেন খুলে দিয়ে বলে, ঠিক আছে। ভেতরে আসুন।

হালদার তার চাউনি দেখেই বিপদ আঁচ করেছিলেন। ঘরে ঢুকে দরজায় পিঠ রেখে তিনি দ্রুত লোকটার গলার কাছে রিভলভারের নল ঠেকান। সঙ্গে সঙ্গে ঘরের আলো নিভে যায়। তারপরই লোকটা তাকে এত জোরে ধাক্কা মারে তিনি মেঝেয় পড়ে যান। লোকটা সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে পালিয়ে যায়। অন্ধকার ঘর। হাঁটুতে চোট লেগেছিল। হালদারমশাই কোনও রকমে উঠে দাঁড়িয়েছেন, ঘরের দ্বিতীয় ব্যক্তি দরজা খুলে পালায়।

বাইরে করিডরের আলোয় তাকে কয়েক সেকেন্ডের জন্য দেখেছেন হালদারমশাই। সে মেয়ে। পরনে ফুলস্লিভ সোয়েটার এবং জিনস। কাঁধ অব্দি ছাঁটা চুল।

ঘরের আলো যে সেই মেয়েটিই নিভিয়ে দিয়েছিল, তাতে হালদারমশাইয়ের কোনও সন্দেহ নেই।

দেয়াল হাতড়ে সুইচবোর্ড খুঁজে পেয়ে আলো জ্বালেন হালদারমশাই। তারপর তার মাথায় আসে, ওরা যদি নিচে গিয়ে ফ্ল্যাটে ডাকাত ঢুকেছে বলে লোক জড়ো করে, তিনি বিপদে পড়বেন। তাই ঘর থেকে সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে আসেন।

ঘর সার্চ করার ইচ্ছা ছিল তার। তবে মেঝেয় পড়ে থাকা দলাপাকানো একটা কাগজ তিনি কুড়িয়ে এনেছেন।

কিন্তু না–ওরা লোক জড়ো করেনি। হালদারমশাই সংকীর্ণ রাস্তার ভিড়ে গা ঢাকা দিয়ে নিরাপদে রেলব্রিজের কাছে পৌঁছান এবং একটা খালি ট্যাক্সি পেয়ে যান।

লক্ষ্য করছিলাম, কর্নেল পকেট থেকে তার খুদে টর্চ বের করে কাগজটা পড়ছেন এবং হালদারমশাই নস্যি নিচ্ছেন।….

মিসেস ব্যানার্জির বাড়ির সামনে হর্ন দিতেই কুকুরের গর্জন এবং বদ্রীর সাড়া এল।

 কর্নেলকে দেখতে পাওয়ার পর সে সেলাম দিয়ে গেট খুলে দিল। গাড়ি ভেতরে ঢোকালাম। বাড়িটা আজ যেন বেশি স্তব্ধ। বদ্রীনাথকেও মনে হলো অস্বাভাবিক গম্ভীর। সুরেনও মুখ তুম্বো করে আছে। পুতুলের মতো সেলাম দিল মাত্র। তারপর সে আমাদের দোতলায় নিয়ে গেল।

শ্রীলেখা করিডরে দাঁড়িয়েছিলেন। ক্ষুব্ধভাবে বলে উঠলেন, কর্নেল সরকার! আমি প্রতারিত হয়েছি। তবে এ জন্য আপনিও দায়ী। আপনি আজ আমাকে কেন মিথ্যা ভয় দেখিয়ে অফিসে উপস্থিত থাকতে বলেছিলেন, বুঝতে পারছি। আমি আজ বাড়িতে থাকলে কখনই এ সর্বনাশ হতো না। তাছাড়া আপনি এই ঘরটা আর লক করে রাখার দরকার নেই বলেছিলেন। লক করা থাকলে এমন সর্বনাশ কিছুতেই হতো না।

কর্নেল বললেন, কী সর্বনাশ হয়েছে মিসেস ব্যানার্জি? কম্পিউটারটা চুরি গেছে তো?

শ্রীলেখা চমকে উঠে বললেন, আপনি কী করে জানলেন?

কর্নেল পর্দা সরিয়ে যে ঘরে ঢুকলেন এবং কর্নেলের পেছনে আমরাও ঢুকলাম, সেই ঘরটা আমাদের পরিচিত। শান্তভাবে উনি সোফায় বসলেন। আমরাও বসলাম। শ্রীলেখা রুষ্টমুখে বললেন, চুরি যায়নি। দিনদুপুরে বাটপাড়ি করেছে। আমাকে আপনি এমন ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন যে মালতী বা সুরেনদের সতর্ক করার কথা চিন্তা করিনি। তা ছাড়া আমি অফিসে যাওয়ার পর সাংঘাতিক উড়ো ফোন, সুদেষ্ণা কিডন্যা 

কর্নেল ওঁর কথার পর বললেন, কিন্তু আসলে সে কিডন্যাপড হয়নি। যাই হোক বুঝতে পারছি সুদেষ্ণা এসে কম্পিউটারটা আস্ত তুলে নিয়ে গেছে। সম্ভবত আমি এখানে একটা হারানো চাবি খুঁজতে আসার পর সে এসেছিল। তবে হ্যাঁ–কম্পিউটারটা চুরি যেতই। যে-কোনও দিনই যেত।

শ্রীলেখা তীক্ষ্ণদৃষ্টে কর্নেলের মুখের দিকে তাকিয়েছিলেন। জোরে শ্বাস ফেলে বললেন, দেন ইউ নো ইট!

কর্নেল হাসলেন। এ বাড়িতে সুদেষ্ণার গতিবিধি অবাধ। আপনার বিশ্বস্ত পি এ।

 আমি কল্পনাও করিনি সে এমন কিছু করবে। শ্রীলেখার কণ্ঠস্বর ভেঙে গেল উত্তেজনায়। সে এসে মালতাঁকে বলে, অফিস থেকে আসছে। জয়দীপের কম্পিউটারটা আমি নাকি তাকে নিয়ে যেতে বলেছি। ফ্যাক্টরিতে পাঠাতে হবে। কম্পিউটারটা গণ্ডগোল করছে। মালতীর অবিশ্বাসের কারণ ছিল না। বজ্জাত মেয়েটা কম্পিউটারটা খোলে। সুরেনকে ওটা গাড়িতে পৌঁছে দিতে বলে। হাল্কা মেশিন।

গাড়িটা সুরেন দেখেছে তাহলে? কী গাড়ি?

 সাদা রঙের মারুতি! আমার গাড়িটাও সাদা মারুতি।

 গাড়িতে কেউ ছিল?

 না। সুদেষ্ণা ড্রাইভিং জানে। কাজেই সুরেনের সন্দেহের কারণ ছিল না।

 আপনি কি বাড়ি ফিরে দেখলেন কম্পিউটার নেই?

হ্যাঁ। ওটা নেই দেখেই চমকে উঠেছিলাম। তারপর মালতাঁকে জিজ্ঞেস করলাম। শ্রীলেখা দুহাতে মুখ ঢেকে কান্না সম্বরণ করে বললেন, আমি এত বোকা! অনীশের চিঠিটা দেখার পর আমার সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আপনি আমাকে মিসলিড করলেন। কেন কর্নেল সরকার?

কর্নেল চুরুট বের করে বললেন, এ ঘরে এখন ধুমপান করা যায়। তারপর চুরুট ধরালেন। ধোঁয়া ছেড়ে ফের বললেন, মিসেস ব্যানার্জি! আপনার বিচলিত হবার কারণ নেই। কম্পিউটারের দুটো গোপন তথ্যই আমি আপনার অগোচরে মুছে নষ্ট করে দিয়েছিলাম। দুটো তথ্যই আমার কাছে আছে। তো আপনি ঘড়িটা যথাস্থানে পৌঁছে দিয়েছেন কি?

দিয়েছি। শেখর নামে আমার এক কর্মচারীকে আউট্রাম ঘাটে পাঠিয়েছিলাম। শেখর ফিরে এসে বলল, লালরঙের মোটরসাইকেল নিয়ে

জাস্ট এ মিনিট। বলে কর্নেল পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে শ্রীলেখাকে দিলেন। দেখুন তো মিসেস ব্যানার্জি! সি এস সিনহা নামে আপনার কোনও কর্মচারী আছেন কি না?

শ্রীলেখা চমকে উঠে বললেন, এ তো শেখরের কার্ড। তার নাম চন্দ্রশেখর সিনহা। জয় তাকে শেখর বলতো, আমিও বলি। কিন্তু আপনি ওর কার্ড কোথায় পেলেন? আমি কিছু বুঝতে পারছি না।

পারবেন। এবার আমাকে অনীশ রায়ের চিঠিটা দেখান।

শ্রীলেখা আলমারি খুলে একটা ব্রিফকেস বের করলেন। ব্রিফকেস খুলে একটা এয়ারোগ্রাম লেটার বের করে কর্নেলকে দিলেন। সেটার ওপর বিদেশি টিকিট ছাপানো। কর্নেল নিবিষ্ট মনে চিঠিটা পড়র পর বললেন, হু। আপনার স্বামী অনীশবাবুর চিঠির মর্ম বুঝতে পারেননি। তাই আপনাকে ভুল বুঝেছিলেন। মিঃ ব্যানার্জি ভেবেছিলেন আপনি ভীষণ উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়ে উঠেছেন। তা না হলে জনৈক বি আর সোমকে অত পাত্তা দেবেন কেন? কিন্তু কে এই ভদ্রলোক?

শ্রীলেখা উত্তেজিতভাবে বললেন, ফরেন ট্রেড কনসালট্যান্ট। ওঁকে অনীশের প্রতিদ্বন্দ্বী বলতে পারেন! ওঁর সম্পর্কে অনীশের রাগ থাকতেই পারে। অনীশের ফার্ম মিঃ সোমের ফার্মের সঙ্গে কমপিটিশনে টিকতে পারেনি। কিন্তু আমার আশ্চর্য লাগছে, জয় তো মিঃ সোমের পরামর্শেই চলত। কাজেই আমি ওঁকে পাত্তা দিয়েছি। অবশ্য পাত্তা বলতে কখনও-সখনও কোনও বড় হোটেলে ওঁর পার্টিতে যাওয়া। জয়ও গেছে। আবার কখনও তার কোনও জরুরি কাজ থাকলে আমাকে একা যেতে বলেছে। ইভ হি ইনসিস্টেন্ মি টু অ্যাটেন্ড।

মিঃ সোমের ফার্ম কোথায়?

যে বাড়িতে আমার কোম্পানি-অফিস, সেই বাড়িতেই। আমার অফিস সিক্সথ ফ্লোরে। মিঃ সোমের অফিস সেকেন্ড ফ্লোরে।

ওঁর সঙ্গে টেলিফোনে এখন যোগাযোগ করা যায়? আই মিন, ওঁর বাড়িতে?

মিঃ সোম এখন জাপানে। গত সপ্তাহে গেছেন। ফিরবেন জানুয়ারির মাঝামাঝি। শ্রীলেখা কর্নেলের দিকে তাকালেন। কয়েক সেকেন্ড পরে ফের বললেন, আপনি ওঁর সম্পর্কে আগ্রহী কেন কর্নেল সরকার?

কর্নেল জ্যাকেটের ভেতর পকেট থেকে দুটো কাগজ বের করে বললেন, যে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান যুবকটি খুন হয়েছে, তার নাম বব। হা–আপনার। পি. এ.র বয়ফ্রেন্ড। এটা তারই হাতের লেখা। এতে বি আর সোম এবং তার বাড়ির ঠিকানা লেখা আছে। আর এই দলপাকানো কাগজটা আপনার কর্মচারী। শেখরের চিঠি। সে সুদেষ্ণাকে লিখেছে, মিঃ সোম এই চিঠি নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে যাচ্ছেন। শেখর না যাওয়া পর্যন্ত যেন দুজনে অপেক্ষা করে। যদি ইতিমধ্যে কোনও গণ্ডগোল হয়, তা হলে মিঃ সোম সুদেষ্ণাকে নিয়ে তার বাড়িতে চলে যাবেন। জিনিসটা শেখরের কাছে আছে। কাজেই সুদেষ্ণার কোনও দ্বিধার কারণ নেই। সে যেন মিঃ সোমের সঙ্গে তার বাড়ি চলে যায়। অবস্থা বুঝে শেখর জিনিসটা নিয়ে সেখানেই যাবে এবং চূড়ান্ত মীমাংসা হবে।

শ্রীলেখার বিস্মিত দৃষ্টে তাকিয়েছিলেন। বললেন, কিছু বুঝতে পারছি না।

এই সময় মালতী কফি আর স্ন্যাক্সের ট্রে আনল। ট্রে রেখে সে চলে যাওয়ার পর কর্নেল বললেন, মিঃ সোমের মুখে দাড়ি আছে কি?

শ্রীলেখা বললেন, না তো! কেন?

 হালদারমশাই বলে উঠলেন, বুঝছি! হা– সামলে নিয়ে ফের বললেন, নকল দাড়ি জানলে আগে তার দাড়িতে টান দিতাম। ঘুঘু দেখেছে, ফান্দ দেখে নাই।

শ্রীলেখা ক্লান্তভাবে বললেন, আপনারা কফি তৈরি করে নিন প্লিজ!

একটু পরে কফির পেয়ালায় চুমুক দিয়ে কর্নেল বললেন, চিয়ার আপ মিসেস ব্যানার্জি! শেষ অব্দি আপনিই জিতে গেছেন। আপনার প্রতিপক্ষ এখন হা হুতাশ করছে। কারণ কম্পিউটারের গোপন ডেটা আমি মুছে নষ্ট করে দিয়েছি।

শ্রীলেখার মুখে বিরক্তির ছাপ ফুটে আঠল। আপনি কি সব কথা খুলে বলবেন?

বলব। আগে একটা অপ্রিয় প্রশ্নের সঠিক উত্তর চাই। তা হলে একটা পয়েন্ট পরিষ্কার হবে।

বলুন!

দুমাস ধরে সুদেষ্ণা আপনার পি এর কাজ করছে। তার আগে সে আপনারবরং বলা উচিত, আপনাদের কোম্পানি-অফিসে স্টেনো-টাইপিস্ট ছিল। আপনি আমাকে বলেছেন, মিঃ ব্যানার্জিই তাকে আপনার পি এ হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন। তাই কি? নাকি আপনিই তাকে চেয়েছিলেন?

শ্রীলেখা আস্তে বললেন, আমিই তাকে চেয়েছিলাম।

 এর বিশেষ কারণ ছিল কি?

ছিল। জয়কে মেয়েটা পেয়ে বসেছিল। ওর প্রতি জয়ের দুর্বলতা আমার চোখ এড়ায়নি। জয় ওকে কম্পিউটার ট্রেনিং দিচ্ছিল। শ্রীলেখা মুখ ঘুরিয়ে জোরে শ্বাস ফেলে বললেন থাক। ও সর কথা বলতে রুচিতে বাধে। শি ওয়াজ এ ন্যাস্টি গার্ল।

তাই আপনি সুদেষ্ণাকে চোখে-চোখে রাখতে চেয়েছিলেন?

 হ্যাঁ।

 তাহলে পয়েন্টটা পরিষ্কার হলো। সম্ভবত কোনও এমোশনাল অবস্থায় মিঃ ব্যানার্জি সুদেষ্ণাকে এমন গোপন কথা জানিয়ে ফেলেছিলেন, যা তাকে লোভী করে তুলেছিল। কিন্তু সে একা কাজে নামতে সাহস পায়নি। তা ছাড়া রোমার ঘড়িটাও দরকার ছিল। আপনি কোনও রোমার ঘড়ি আপনার স্বামীর কাছে দেখেননি। তার মানে, মিঃ ব্যানার্জি সেই ঘড়িটা সম্পর্কে সতর্ক ছিলেন।

শ্রীলেখা আবার রুষ্ট হলেন। কর্নেল সরকার! আগেও আপনাকে বলেছি, জয়ের অনেক ঘড়ি ছিল। স্বামী কখন কোন ঘড়ি হাতে পরছে, কোনও স্ত্রী তা নিয়ে মাথা ঘামায় না।

ঠিক, ঠিক। কর্নেল সায় দিলেন। তবে অনীশ রায়ের চিঠি থেকে বোঝা যাচ্ছে, মিঃ সোমের মতো ঝানু লোকের সঙ্গে আপনার মেলামেশায় আপনাকে ভুল সন্দেহ করেছিলেন মিঃ ব্যানার্জি। আপনাকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। কারণ–

কর্নেল হঠাৎ থেমে গেলে শ্রীলেখা তীব্র কণ্ঠে বললেন, কারণ? কর্নেল সরকার! উইল ইউ প্লিজ এক্সপ্লেন মি?

জুয়ে্লস্ মিসেস ব্যানার্জি! এ বাজারে যার দাম প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ টাকা।

 জুয়েলস্! শ্রীলেখা চমকে উঠলেন। কী বলছেন আপনি!

 হ্যাঁ। চোরাই হীরে। আপনার শ্বশুরমশাইয়ের ঘড়ির ব্যবসা ছিল। জাপান থেকে তিনি ঘড়ি আমদানি করতেন। একটা দেয়ালঘড়ির ভেতর একজন কুখ্যাত স্মাগলার হীরে পাচার করেছিল। ঘড়িটা যখন সুশোভনবাবুর কাছে পৌঁছেছে, তখন লোকটা অন্য একটা স্মাগলিং কেসে ধরা পড়ে যায়। পাঁচ বছর জেলে কাটিয়ে সে যখন মুক্তি পায়, তখন সুশোভনবাবুর সুদক্ষিণা ওয়াচ কোম্পানি উঠে গেছে এবং তিনিও মারা গেছেন। তার ছেলে জয়দীপ কম্পিউটার ট্রেনিং নিয়ে কম্পিউটার তৈরির কারবারে নামার প্ল্যান করছেন। তিনি এ বাড়ির একটা অচল দেয়ালঘড়ির ভেতর হীরেগুলোর সন্ধান পান। হা–তার বাবা মৃত্যুর আগে নার্সিংহোমে থাকার সময় গোপনে তাকে এ বিষয়ে আভাস দিয়েছিলেন। আর মিসেস ব্যানার্জি! সেই কুখ্যাত স্মাগলারের নাম বিমলারঞ্জন সোম অর্থাৎ বি আর সোম। জয়দীপ ব্যানার্জি তাই তাকে সমীহ করে চলতেন। এমন ভাব দেখাতেন, যেন সোমের আসল পরিচয় তার জানা নেই।…

.

০৭.

 কিছুক্ষণ স্তব্ধতা। হালদারমশাই সাবধানে নস্যি নিচ্ছিলেন। কর্নেল তার নিভে যাওয়া চুরুট যত্ন করে ধরালেন। তারপর শ্রীলেখা মৃদুস্বরে বললেন, আপনি কাল রাতে জয়ের কম্পিউটার থেকে যে ডেটা বের করে নিয়ে গেলেন, তাতেই কি এসব কথা আছে?

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। আমি তো অন্তর্যামী নই।

 এবার আমাকে দুটো ডেটাই দেখাতে আপত্তি থাকার কথা নয়।

নাহ্! কর্নেল হাসলেন। তবে প্রথমটা তেমন কিছু নয়। ওটা দেখলে অকারণ দুঃখ পাবেন। তাই দ্বিতীয়টা আপনাকে দেব। এটাতেই হীরেগুলোর সন্ধান আছে।

কোথায় আছে সেগুলো?

 এই বাড়িতে।

বাড়িতে কোথায়?

 আপনার বেডরুমে একটা জাপানি ছবি আছে তো?

শ্রীলেখা উত্তেজিতভাবে বললেন, আছে। বাঁধানো ছবি। ছবিতে একটা বড় রঙীন ফুল আঁকা আছে। তার পাপড়িতে একটা জলের ফোঁটা। ছবিটার ক্যাপশানে লেখা আছে : হিউম্যান লাইফ ইজ দা টাইনিপ্ল্যাশ অব এ রেনড্রপ।

আপনি ছবিটা নিয়ে আসুন।

 ছবিটা উঁচুতে আছে। আমি একা নামাতে পারব না।

তা হলে আমরা আপনাকে সাহায্য করতে রজি। জয়ন্ত! হালদারমশাই! চলুন।

আমরা বেডরুমে গেলাম। হালদারমশাই লম্বা মানুষ। একটা টুলে উঠে ছবিটা নামালেন। কর্নেল বললেন, এবার চলুন ও ঘরে যাওয়া যাক।

আগের ঘরে ফিরে কর্নেল বেডরুমে ঢোকার এবং করিডরে যাওয়ার দরজা দুটো ভেতর থেকে আটকে দিলেন। তারপর ছবিটা টেবিলে উল্টো করে রেখে পকেট থেকে ছোট্ট ছুরি বের করলেন। ছুরির ডগা দিয়ে ছবির পেছনের কাগজ, তারপর পিচবোর্ড কেটে সাবধানে তুলে নিলেন। একটা চৌকো ঘন নীলরঙের ভেলভেট কাপড় বিছানো আছে দেখা গেল। কাপড়টা কর্নেল একটুখানি তুলতেই নিচে আরেকটা চৌকো নীল ভেলভেট কাপড়ের ওপর ঝকমক করে উঠল ছোট ছোট হীরের টুকরো! আকাশের একঝাক নক্ষত্রের মতো। টুকরোগুলো। খোপে খোপে বসানো আছে।

হালদারমশাই বলে উঠলেন, কী কাণ্ড! তারপর সারগুলো ঝটপট গুনে বললেন, টেন ইনটু টেন। শওখান। ওয়ান হান্ড্রেড পিসেস অব ডায়ামন্ড!

কর্নেল বললেন, মিসেস ব্যানার্জি! আপাতত এগুলো এই কাপড়েই বেঁধে আলমারির লকারে রেখে দিন। বাট আই মাস্ট ওয়ার্ন ইউ–এগুলো চোরাচালানি হীরে। তা ছাড়া এগুলো ফেরত পাওয়ার জন্য বিমলারঞ্জন সোম আবার সুযোগ খুঁজবে। সে ববের খুনী, এটা প্রত্যক্ষভাবে প্রমাণ করা যাবে না। যদি তার জেল হয়, আবার সে ছাড়া পাবে। তখন আপনি আপনার স্বামীর মতোই বিপন্ন হবেন। কাজেই আজ রাতের মধ্যেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনাকে।

শ্রীলেখা ঠোঁট কামড়ে ধরে ভাবছিলেন। আস্তে বললেন, আপনি যা বলবেন, তাই করব। আমি জয়ের মতো লোভী নই। স্বার্থপর নই। আপনিই বলুন, আমার কী করা উচিত।

আগে ওগুলো আলমারির লকারে রেখে আসুন।

 শ্বশুরমশাইয়ের আমলের আয়রনচেস্ট আছে। সেখানে রাখাই নিরাপদ।

ঠিক আছে। তবে সাবধান। কেউ যেন– কর্নেল চাপা গলায় বললেন, আই মিন, মালতীও টের না পায়। জুয়েলসের লোভ মানুষের মাথা খারাপ করে দেয়।

শ্রীলেখা ভেলভেটের ভেতর হীরেগুলো গুছিয়ে পুঁটলি তৈরি করলেন। তার গায়ে জড়ানো ছিল রঙিন পশমি চাদর। সেই চাদরের ভেতর পুঁটলিটা নিয়ে গম্ভীরমুখে চলে গেলেন।

হালদারমশাই হঠাৎ খি খি করে হেসেই জিভ কেটে থেমে গেলেন। বললাম, কী হলো হালদারমশাই? হাসলেন যে?

প্রাইভেট ডিটেকটিভ ফিসফিস করে বললেন, ম্যাডাম য্যান নিজেই চুরি করছেন! কীভাবে পাও ফেইলা যাইতেছেন দেখলেন না?

কর্নেল কপট গাম্ভীর্যের সঙ্গে বললেন, হু! চোরাই মাল এরকমই। হাতে নিলে নিজেকে চোর-চোর লাগে।

বললাম, দুটো প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাচ্ছি না বস্!

 যেমন?

বি আর সোমের চেলা যখন শেখর বা সি এস সিনহা, তখন ঘড়িটা দেওয়ার জন্য আউট্রাম ঘাট বেছে নেওয়া হলো কেন? তা ছাড়া আপনি বলছিলেন, সাড়ে পাঁচটায় শীতের সন্ধ্যা–

আমাকে থামিয়ে কর্নেল বললেন, ওরা জানে শ্রীলেখা প্রাইভেট ডিটেকটিভ লাগিয়েছেন, এমনকি আমারও দ্বারস্থ হয়েছেন। তাই এই সতর্কতা। দেখবে, শেখর কাল দিব্যি ভালমানুষ সেজে অফিসে যাবে। সোমও তার অফিসে যাবে। শুধু সুসান ওরফে সুদেষ্ণাকে গা ঢাকা দিতে হবে। কারণ তার ফ্ল্যাটে পুলিশ গেছে। তার চেয়ে বড় কথা, সে দিনদুপুরে কম্পিউটার চুরি করেছে।

বললাম, দ্বিতীয় প্রশ্ন, আপনি আজ সকালে মিসেস ব্যানার্জিকে অমন ভয় দেখিয়ে তার কোম্পানি অফিসে যেতে বললেন। না গেলে নাকি সর্বনাশ হবে।  কিন্তু তেমন কোনও আভাস মিসেস ব্যানার্জির কাছে এখনও পাইনি। ব্যাপারটা কী?

কর্নেল হাসলেন। কম্পিউটার চুরির সুযোগ দিয়েছিলাম চোরকে। জাস্ট এ শর্ট অব ট্র্যাপ। তবে তখনও জানতাম না কে যন্ত্রটা চুরি করবে। শুধু বুঝতে পারছিলাম, যন্ত্রটা চুরি যাবেই এবং চুরি গেলে আমার থিওরি সঠিক প্রমাণিত হবে। আই ওয়াজ কারেক্ট।

শ্রীলেখা ফিরে এলেন। তাকে খুব আড়ষ্ট দেখাচ্ছিল। মৃদুস্বরে বললেন, আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছে কর্নেল সরকার! আপনিই বলুন, এবার কী করা উচিত।

কর্নেল চোখ বুজে একটু ভেবে নিয়ে বললেন, এক ঢিলে দুই পাখি মারা পড়বে, যদি আপনি একটু ট্যাক্টফুল হন।

বলুন কী করব?

আপনার কর্মচারী শেখর কাল যথারীতি অফিস যাবে। তার গা ঢাকা দেওয়ার কারণ নেই। আপনি কিন্তু তার সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণ করবেন। তারপর সুদেষ্ণার কম্পিউটার চুরি করার কথা তাকে বলবেন। সেইসঙ্গে এ-ও জানিয়ে দেবেন, আপনিই কম্পিউটারের ফাস্ট কি ওয়ার্ড ব্রেড এবং তা থেকে ঘড়ির পেছনে খোদাই করা নাম্বারের সাহায্যে মিঃ ব্যানার্জির দুটো গোপন ডেটা উদ্ধার করেছিলেন। আপনি ডেটা দুটো বুদ্ধি করে মুছে দিয়েছিলেন। তারপর চোরাচালানি হীরে আপনি খুঁজে পেয়েছেন।

শ্রীলেখা চমকে উঠেছিলেন! সে কী! বলে সোজা হয়ে বসলেন।

কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, হ্যাঁ। আপনি শেখরের সঙ্গে পরামর্শের ভান করবেন। আপনি বলবেন, চোরাই হীরে কী ভাবে বিক্রি করা যায় বুঝতে পারছেন না। তাই আপনার কোম্পানির ট্রেড কনসালট্যান্ট বি আর সোমের সাহায্য চান। ও কে?

শ্রীলেখা অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন। কিছু বললেন না।

 হালদারমশাই নড়ে বসলেন। কন কী?

আমিও বললাম, সোম হীরেগুলোর জন্যই এত কাণ্ড করল। আর শেষ অব্দি তাকেই হীরের কথা বলতে যাওয়ার মানে হয়?

কর্নেল আমাদের কথায় কান না দিয়ে বললেন, মিসেস ব্যানার্জি! আপনি কাল সঙ্গে হীরেগুলো নিয়ে যাবেন। শেখরের সঙ্গে পরামর্শের ভান করার পর ফোনে সোমকে জানাবেন, একটা জরুরি ব্যাপারে তাঁর কাছে যাচ্ছেন। সোম অফিসে থাকবে–সিওর। কারণ সে মণিহারা ফণী। মণির জন্য সে মরিয়া।

শ্রীলেখা একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, তারপর?

তারপর তার অফিসে হীরেগুলো ব্রিফকেসে ভরে নিয়ে যাবেন। সঙ্গে শেখরকে নেবেন। শেখরকে যা যা জানিয়েছেন, তাকেও তা-ই জানাবেন। হীরেগুলো বিক্রির ব্যবস্থা করতে বলবেন। সে সেগুলো দেখতে চাইবে। আপনি তাকে হীরেগুলো দেবেন। ও কে?

শ্রীলেখা আস্তে বললেন, আপনার প্ল্যানটা বুঝতে পারছি না।

কর্নেল হাসলেন। এক ঢিলে দুই পাখি বধ। প্লিজ ডোন্ট ওয়ারি। বলে উনি উঠে দাঁড়ালেন। তারপর উইশ ইউ গুড লাক বলে পা বাড়ালেন!

আমরা কর্নেলকে অনুসরণ করলাম। গাড়িতে উঠে হালদারমশাই উত্তেজনাবশে আবার একটিপ নস্যি নিলেন। তারপর আপনমনে বলেন, এক ঢিলে দুই পাখি বধ! কিন্তু আমার বিজ্ঞাপনের ফান্দে পা দিল না!

পরদিন সকালে সল্টলেক থেকে কর্নেলকে ফোন করলাম। ষষ্ঠী বলল, বাবামশাই বাইরে গেছেন। কখন ফিরবেন ঠিক নেই।

আবার দুপুরে ফোন করলাম। ষষ্ঠী বলল, হালদারমশাই এসেছিলেন, বাবামশায়ের জন্য বসে থেকে থেকে টায়ার হয়ে চলে গেছেন।

আমিও টায়ার হয়ে যাচ্ছি, ষষ্ঠী!

ষষ্ঠী বলল, হয়তো পাখি-টাখির খোঁজে গেছেন। বাবামশাইকে তো জানেন?

না ষষ্ঠী। উনি পাখি মারতে গেছেন। ফিরলে আমাকে ফোন করতে বলো যেন।

ষষ্ঠী হাসতে হাসতে অস্থির হচ্ছিল। ফোন রেখে দিলাম।

কর্নেলের টেলিফোন পেলাম দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার অফিসে। তখন প্রায় আড়াইটে বাজে। বললেন, ডার্লিং! এক ঢিলে দুই পাখি বধ হয়েছে। সোম আর তার চেলা শেখর ধরা পড়েছে। কাস্টমস অফিসাররা এবং ক্রাইম ব্র্যাঞ্চের পুলিশ অফিসাররা সাদা পোশাকে তৈরি ছিলেন। যাই হোক, কুখ্যাত আন্তর্জাতিক স্মাগলারকে বমাল ধরিয়ে দেওয়ার জন্য শ্রীলেখা ব্যানার্জি সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের সুনজরে পড়লেন। এতে ওঁর ব্যবসার শ্রীবৃদ্ধি হবে। আর সুসান ওরফে সুদেষ্ণা ধরা পড়েছে সোমের লেকভিউ রোডের বাড়িতে। হ্যাঁ, সেই কম্পিউটারসহ। আচ্ছা! ছাড়ি। ফুল স্টোরির জন্য চলে এস।

ফোন রেখে তখনই হন্তদন্ত লিফটের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকা আগামীকাল একটা চাঞ্চল্যকর এক্সক্লুসিভ স্টোরি ছাপতে পারবে।….